১০.
গাড়ির দরজা খুলে মাটিতে লাফিয়ে নেমেই আবার চেঁচাল কিশোর, পালাও!
একপাশে আগুন ধরেছে গাড়ির, ভাগ্য ভাল, ওদের কিছু হয়নি। মথা নিচু করে ছুটে পালিয়ে যেতে লাগল দুজনে গাড়িটার কাছ থেকে। ছুটতে ছুটতেই একবার ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, লাল আর কমলা রঙের আগুন দাউ দাউ করে উঠছে ওপরে। কুণ্ডলী পাকিয়ে রাতের আকাশে উঠছে কাল ধোয়া। আতঙ্কিত মেহমানরা এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে।
গেছিলাম আরেকটু হলেই! গলা কাঁপছে রবিনের।
ট্যাক রুম থেকে দৌড়ে বেরোল লুক বোলান, হাতে একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার। পথ থেকে চিৎকার করে লোকজনকে সরিয়ে দিতে লাগল, সরুন, সরে যান! গাড়ির কাছে গিয়ে যন্ত্র থেকে রাসায়নিক পদার্থ ছিটাতে লাগল আগুনের ওপর। চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল কয়েকজন শ্রমিককে। জ্বলন্ত গাড়িটার কাছে এগিয়ে আসছিল ওরা।
কিশোর! রবিন! চিৎকার করতে করতে ছুটে এল মুসা। তোমরা ভাল আছ?
আছি, জবাব দিল রবিন।
কি হয়েছিল? উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল মুসা।
বলতে পারব না, বিহুলের মত মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। আরেকটা আগুন নেভানর যন্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসতে দেখল ব্রডকে। বাগানে পানি দেয়ার মোটা একটা হোসপাইপ এনে পানি ছিটাতে শুরু করল জন।..
গ্যাস পেডালে চাপ দিতেই কি যেন গড়বড় হয়ে গেল, আবার বলল কিশোর। বোমাটোমাই হবে!
তিন গোয়েন্দার দিকে দৌড়ে এল লিলি। পেছনে রয়েছেন কেরোলিন।
তোমরা…ভাল আছ? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল লিলি।
আছি, জবাব দিল কিশোর।
কপাল ভাল আরকি তোমাদের। কেন এমন হলো কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। বিকেলে যখন গাড়িটা নিয়ে দোকানে গিয়েছিল ব্রড তখনও তো ভাল ছিল।
তারপর আর কেউ চালিয়েছে?
মাথা নাড়ল লিলি। না। চাবি আমার কাছেই এনে দিয়েছিল সে।
কমে এসেছে আগুন। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। মনে হয় কেউ বোমা লাগিয়ে রেখেছিল।
সর্বনাশ! কে তোমাকে মারতে চাইল?
আমাকে নয়, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, তাকে, যে সব সময় গাড়িটা চালায়।
চালাই তো আমি, চমকে গেছে লিলি, কিন্তু…
তাহলে আপনাকেই মারতে চেয়েছে।
ও মাই গড! চোখ বন্ধ করে ফেলল লিলি।
পোড়া গাড়িটার দিকে হাত তুলে রবিন বলল, মারতে যে চেয়েছে ওটাই তার প্রমাণ।
মুসা বলল, বেপরোয়া হয়ে গেছে লোকটা।
পুলিশকে ফোন করা দরকার, কিশোর বলল।
গাড়িটাকে জ্বলতে দেখেই করে দিয়েছি আমি, কেরোলিন বললেন। দমকলকেও করেছি। এসে যাবে।
কয়েক মিনিট পর সাইরেন শোনা গেল। দমকলের একটা ট্রাক আর শেরিফের একটা গাড়ি ঢুকল চত্বরে। লাফিয়ে মাটিতে নেমে পোড়া গাড়িটার দিকে ছুটল দমকল কর্মীরা। শেরিফের গাড়ি থেকে নামল গোয়েন্দারা। যাকে সামনে পেল তাকেই প্রশ্ন করতে লাগল।
হ্যারিসন ফোর্ড নামে একজন লালমুখো ডেপুটি জিজ্ঞেস করলেন লিলিকে, গাড়িটার কাছে কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ?
না…ব্রডকে দেখে থেমে গেল লিলি।
ব্রড এসে বলল, গাড়িটা নিয়ে বিকেলে শহরে গিয়েছিলাম। আসার পর ওখানেই রেখেছিলাম।
চালানর সময় কোন গোলমাল করেনি? জিজ্ঞেস করলেন ফোর্ড। টের পাওনি?
না, একটুও না, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ব্রডের মুখ।
বাজি দিয়ে একাজ করা হয়েছে, ডেপুটির কাছে এসে দাঁড়াল একজন দমকল কর্মী। হাতে একটা কালো খোসা। গাড়ির নিচে লম্বা ফিউজ লাগিয়ে মাথায় জুড়ে দেয়া হয়েছিল বাজিটা। ইঞ্জিনের গড়িয়ে পড়া তেলে লেগে আগুনটা ধরেছে।
তার মানে অ্যাক্সিডেন্ট নয়? আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল লিলি।
মাথা নাড়ল লোকটা। না। আমার তা মনে হয় না। ওখানে এভাবে বাজি যাবে কি করতে?
কিশোরের দিকে তাকাল লিলি, কিশোর, আর দরকার নেই। তদন্ত বাদ দাও। আর কোন ঝুঁকি নিতে দেব না তোমাদের।
তদন্ত? ভুরু কোঁচকালেন ডেপুটি। কিসের তদন্ত?
হারানো ঘোড়াটার কথা বলল লিলি।
নাক দিয়ে শব্দ করলেন ফোর্ড। ওটা এমন কোন ব্যাপার নয়। মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে পালায় ঘোড়ারা।
কিশোর বলল, আমার ধারণা ওটা চুরি হয়েছে।
ভোতা গলায় ব্রড বলল, সেটা প্রমাণ করতে পারবে না।
পারব। মিলির দিকে তাকাল কিশোর। এখন থেকে খুব সাবধানে। থাকবেন। ভয়ানক শত্রু আছে এখানে আপনার। ওরা আপনাকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করবে না।
না, কি যে বলো? আমাকে কেউ মারবে না।
সব কথা লিখে নিচ্ছেন ডেপুটি। নোটবুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, একজন। মেহমানের কাছে শুনলাম, একটু আগে ব্যাংকের একজন লোক এসে হুমকি দিয়ে গেছে তোমাকে?
ফিলিপ নিরেক আর হারনি পাইকের কথা বলল লিলি। লিখে নিলেন ডেপুটি। কয়েক মিনিট পর চলে গেলেন অন্যদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আরেকজন ডেপুটি গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে আস্তাবল আর বাড়িতে।
তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে লিলি বলল, তোমাদেরকে এতে জড়িত করে ভাল করিনি আমি। তোমরা আমার মেহমান। মেহমানের মতই থাকো এখন। থেকে। ওসব তদন্ত-ফদন্ত বাদ দাও।
অসম্ভব! জোর গলায় বলল কিশোর। এত কিছুর পর আর চুপ থাকতে পারব না আমি। এর একটা সুরাহা করেই ছাড়ব। বুঝতে পারছেন না কেন মরিয়া হয়ে উঠেছে শয়তানটা? আমরা অনেক এগিয়ে গেছি, বুঝে ফেলেছে সে। তার। জারিজুরি ফাঁস হওয়ার পথে।
কিন্তু ভয়ঙ্কর লোক ও, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। আমার জন্যে তোমরা কেন মরতে যাবে? সমস্যাটা আমার, তোমাদের নয়। তোমরা ছুটি কাটাতে এসেছ, ছুটি কাটাও।
বললামই তো, এর পর আর থেমে থাকতে পারব না আমি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে ইউনিকর্নের চোর। যেভাবেই হোক ঠেকাতে চাইছে এখন, যাতে ধরা না, পড়তে হয়। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
পোড়া গাড়িটার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে একজন ডেপুটি। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিলি বলল, বেশ। বাধা দেব না। তবে খুব সাবধান। দয়া করে আর বদনাম করো না আমার!
***
পরদিন সকালে এসে ভাল করে পোড়া গাড়িটাকে দেখল কিশোর, যদি কোন সূত্রটুত্র পেয়ে যায় এই আশায়। পেল না। সেরাতে মেহমানদের ক্যাম্পিঙে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কাজেই সারাটা দিন জিনিসপত্র গোছগাছ আর পশ্চিমের পাহাড়ে ইউনিকর্নকে খুঁজে বেড়াল তিন গোয়েন্দা।
কোন চিহ্ন পেল না।
বিকেলে বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার বেরোনোর জন্যে তৈরি হলো ওরা।
দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ল মেহমানেরা। পাহাড়ের ভেতরে নদীর ধারে ছোট এক চিলতে খোলা জায়গায় ক্যাম্পিঙের ব্যবস্থা হয়েছে।
উফ, এক্কেবারে ব্যথা হয়ে গেছে শরীর, ঘোড়ার পিঠ থেকে বেডরোল নামাতে নামাতে বলল রবিন। টেনে নামাল জিনটা। সারাটা দিন ঘোড়ার পিঠে থেকে থেকে একেবারে শেষ হয়ে গেছি।
হাসল মুসা। বাড়ি গিয়ে একবারে ঘুমিও। এখানে মজার জন্যে এসেছ মজা। লোট। রাতে পাহাড়ে কাটানর মজাই আলাদা। আগুনের ধারে বসে সাওয়ারডো বিস্কুট খাওয়া, গল্প করা, তারপর কম্বলের তলায় গুটিসুটি হয়ে পড়ে থেকে নানারকম শব্দ শোনা, নিশাচর পাখি আর জন্তু জানোয়ারের ডাক, বাতাসের। ফিসফিসানি, নদীর কূলকুল….
বাপরে! একেবারে কবি হয়ে গেলে দেখি?
মালপত্রগুলো নিয়ে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা পাইন নীডলের ওপর রাখল দুজনে। কিশোরও তারটা নিয়ে গিয়ে রাখল ওদেরগুলোর পাশে। আশেপাশে জটলা করে রয়েছে পাইন গাছ।
এজটার পরিবার আর কয়েকজন মেহমানকে নিয়ে ক্যাম্প সাজায় লাগল ব্রড। কাপলিংকে নিয়ে তিন গোয়েন্দা আগুন জ্বালানোর জন্যে শুকনো কাঠ জড় করতে লাগল।
মিসেস ব্যানার সাফ মানা করে দিল, কোন কাজ করতে পারবে না। একটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে বসে বলল, আমি এখানে এসেছি আরাম করতে, কাজ করতে নয়।
এটা কাজ নয়, ঘোড়া বাধতে বাঁধতে বলল লুক, মজা।
থাকো, হাত উল্টে জবাব দিল মিসেস ব্যানার, ওরকম মজার আমার দরকার নেই।
মুচকি হাসল রবিন। নিচু গলায় বলল, স্বামী বেচারাকে নিশ্চয় জ্বালিয়ে খায় মহিলা।
মাথা থেকে চাপড় মেরে একটা মাছি তাড়াল মুসা। বলল, মহিলা ঠিকই। করছে। কে যায় অত কাজ করতে?
তাহলে গিয়ে বসে থাক মহিলার সঙ্গে..
মিসেস ব্যানার বলছে, জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটান! দূর! ভাল লাগবে বলে মনে হয় না। আছে তো যত হতচ্ছাড়া জিনিস, বোলতা, মাছি, মশা, কয়োট! ঈশ্বরই জানে, আরও কি কি আছে!
মুখ তুলে রবিন বলল, অনেক কিছু আছে। কুগার, ভালুক, নেকড়ে।
মুসা বলল, যা খুশি থাকুক। হাতি-গুণ্ডার থাকলেও আপত্তি নেই আমার, ভূত না থাকলেই হল…
বলে কি! আঁতকে উঠল মহিলা, ভূতও আছে নাকি! বাপরে! তাহলে বাপু আমি এখানে নেই! সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারব না!
হেসে আবার নিচু গলায় মুসাকে বলল রবিন, যাও, একজন দোসর পেলে।
তাড়াতাড়ি কিশোর বলল, আরে না না, ভূত বলে কিছু নেই। অহেতুক ভয় পাচ্ছেন…
তুমি কিচ্ছু জান না, রেগে গেল মহিলা। কিশোর যে ওদের মানিব্যাগ চুরি করেছে, কথাটা ভুলতে পারেনি মিসেস ব্যানার। সেই যে সেবার, গিয়েছিলাম আমাদের বাড়ির কাছের এক বনে, রাতে থাকতে। তারপর…
হয়েছে কাজ! বলল কিশোর, শুরু হল এবার ভূতের গল্প। চলো, পালাই।
সবাই মিলে কাজ করল, মিসেস ব্যানার ছাড়া। ক্যাম্প করল, আগুন জ্বালল, রান্না করল। ডিনারের পর বাসনপেয়ালা কে ধোবে এটা নিয়ে কথা উঠল। সমাধান করে দিলেন মিস্টার এজটার। টস করা হোক। টসে তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়ল ধোয়ার। কিছুই মনে করলেন না তিনি। শার্টের হাতা গুটিয়ে কাজে লেগে গেলেন। নিজের ইচ্ছেতেই স্বামীকে সাহায্য করতে গেলেন জেনি এজটার।
থালাবাসন ধুতে ভালই লাগে আমার, কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই হেসে বললেন মহিলা।
খাওয়ার পরেও কাজ আছে অনেক। সেগুলো করতে লাগল সবাই। বলা বাহুল্য এবারেও মিসেস ব্যানার কিছু করলেন না। রেগে গিয়ে মুসা বলল, বেটিকে খেতেই দেয়া উচিত হয়নি।
চুপ! শুনবে! থামিয়ে দিল ওকে রবিন।
বনের ভেতর লম্বা হতে লাগল ছায়া। গিটার বের করল ব্রড। সাঁঝের গান ধরল ঘরেফেরা পাখিরা, শান্ত একটানা সুরে কুলকুল করে চলেছে পাহাড়ী নদী। গাছের ডালে ডালে ফিসফিস করে গেল একঝলক হাওয়া। গোধূলির আকাশে প্রথম তারাটা মিটমিট করতে দেখল কিশোর।
রাত নামল। আগুনের লাল আলো বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করল। চাঁদ উঠল একটু পরেই। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার বন্যায় ভেসে গেল যেন বন, পাহাড়, নদী। মুসার মনে হতে লাগল, ডালপাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গলে পড়ছে হলুদ আলো।
আরেক কাপ করে কফি সরবরাহ করা হল, আর কেরোলিনের তৈরি চমৎকার ওটমিল কুকির একটা করে প্যাকেট।
যাই বল, রাতটা বড় সুন্দর, কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল মুসা। আসনপিড়ি হয়ে বসেছে আগুনের ধারে।
কয়েক মিনিট পরে হাতমুখ ধোয়ার জন্যে আঁকাবাকা বুনো পথ ধরে নদীতে চলল কিশোর আর মুসা। সাথে টর্চ নিয়েছে কিশোর। আগে আগে নেচে নেচে চলেছে তার টর্চের আলো।
হঠাৎ আলো নিভিয়ে দিয়ে মুসার বাহুতে হাত রাখল সে। চুপ থাকার ইঙ্গিতটা। বুঝতে পারল গোয়েন্দা সহকারী। দাঁড়িয়ে গেল দুজনেই। শব্দ করল না।
গাছের ফাঁক দিয়ে দেখল ওরা, একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে ব্রড জেসন। ডালের ফাঁক দিয়ে এসে পড়া জ্যোৎস্নায় মেয়েটার চুল রুপালি লাগছে। বেনি কুপারকে চিনতে অসুবিধে হলো না ওদের। এখানে কি করছে সে? তাকে আসতে দাওয়াত করা হয়নি।
মুসার হাতে আলতো চাপ দিয়ে পা টিপে টিপে এগোল কিশোর। পাইন। নীডল ঢেকে দিল তার জুতোর শব্দ। কান খাড়া করে আছে। কিন্তু ক্যাম্পের কথাবার্তা আর নদীর গুঞ্জনে দুজনের কথা ঠিকমত শুনতে পেল না। বেনির বলা কয়েকটা শব্দ বুঝতে পারল, হারিকেন, রোডিও।
বেশি ভাবছ, ব্রড বলল। বেনির কাঁধ চাপড়ে দিল।
দম বন্ধ করে রেখে আরও কয়েক পা এগোল কিশোর। গাছের আড়াল থেকে সামনে মাথা বের করে দিল। …আমার খারাপ লাগতে শুরু করার আগেই চলে যাও, ব্রডের কথা শোনা গেল। আর দাঁড়াল না সে। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটে চলে গেল।
বেনির পিছু নিল কিশোর। আশা করল, ইউনিকনের কাছে তাকে নিয়ে যাবে। মেয়েটা। ওটার পিঠে চড়েই এল নাকি?
নদীর সরু অংশে একটা গাছ পড়ে আছে আড়াআড়ি, সাঁকো তৈরি করে দিয়েছে। সেটা দিয়ে নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেল বেনি। ইউনিকর্ন নয়, অন্য একটা ঘোড়া নিয়ে এসেছে সে। সেটার পিঠে চেপে রওনা হয়ে গেল ওদের র্যাঞ্চটার দিকে।
আবার মুসার কাছে ফিরে এল কিশোর।
কিছু দেখলে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছে মুসা।
তেমন কিছু না। কথাও ঠিকমত শুনতে পারলাম না। তবে যা মনে হল, অনেক কথা চেপে রেখেছে ব্রড আর বেনি। রোডিও খেলা আর হারিকেনকে নিয়ে। আলোচনা করছিল ওরা।
জানতাম! যত শয়তানী ওদেরই।
প্রমাণটমাণ থাকলে এখন ধরতে পারতাম, নিজেকেই যেন বলল কিশোর।
ক্যাম্পে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল রবিনের সঙ্গে। ওদের দেরি দেখেই দেখতে আসছিল কিছু হলো কিনা। বলল, লুক আমাকে পাঠিয়েছে দেখার জন্যে।
চলতে চলতে সব কথা তাকে জানাল কিশোর।
পাইক আর নিরেকের ব্যাপারটা কি তাহলে? রবিনের প্রশ্ন। ওরাও কি ব্রড আর বেনির সঙ্গে জড়িত? নাকি ওদের সঙ্গে এরা দুজন গিয়ে হাত মিলিয়েছে?
জানি না, আসলেই কিছু বুঝতে পারছে না কিশোর। ওই ঘোড়া চুরির ব্যাপারে হয়ত কিছুই জানে না পাইকেরা। ব্রড আর বেনিই করেছে।
তবে মোটিভ দুই দলেরই আছে। হতে পারে, না জেনেই একদল আরেক। দলের সাহায্য করে চলেছে।
এর মানে, মুসা বলল, ব্রড আর বেনি দুজনেই চাইছে লিলি রোডিওতে যোগ দিতে না পারুক, যাতে বেনির জেতাটা নিশ্চিত হয়…
কিংবা নিরেক আর পাইক চাইছে, রবিন বলল, গোলমাল বাধিয়ে দিয়ে লিলিকে সরাতে, যাতে র্যাঞ্চটা ওরা দখল করতে পারে।
কিশোর কিছু বলছে না। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে।
ওদেরকে দেখে লুক বলল, অনেক দেরি করে ফেললে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল চোখে সন্দেহ নিয়ে। তারপর বলল, রাত হয়েছে। এবার শুতে যাও।
স্লীপিং ব্যাগটা যেখানে রেখেছিল সেখানে পেল না কিশোর। টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে খানিক দূরে, গাছের জটলার ভেতরে। আশ্চর্য! বিড়বিড় করল,
কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আমার স্লীপিং ব্যাগ। মালপত্র থেকে খুলে নিয়ে গিয়ে ওখানে ফেলে রেখেছে।
ভুলে নিজের মনে করে কেউ খুলেছিল হয়ত। চলো, নিয়ে আসি।
চলো।
ব্যাগ তোলার জন্যে হাত বাড়িয়েই থমকে গেল কিশোর। পরিচিত একটা শব্দ। তবে কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। ছোট ছোট নুড়ি থলেতে রেখে ঝাঁকালে যেমন শব্দ হয় অনেকটা তেমনি।
ধুকধুক করছে তার বুক। কি আছে ব্যাগের ভেতরে? খুব সাবধানে ব্যাগটা খুলে দুই কোণ ধরে উপুড় করল, ঝাঁকি দিল জোরে জোরে।
ভেতর থেকে পড়ল একটা সাপ। মাটিতে পড়েই হিসহিস করে ফণা তুলল। ছোবল মারার জন্যে। মারাত্মক বিষাক্ত র্যাটল স্নেক।
.
১১.
চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ছুটে এল ব্রড। কি হয়েছে? চেঁচাও কেন?
ব্যাগটা সাপটার ওপর ছুঁড়ে মারল কিশোর। বলল, সাপ!
কি?
সাপ ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার ব্যাগে।
ঝনঝন আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছে ব্রড। তাড়াতাড়ি একটা লাঠি কুড়িয়ে এনে ব্যাগ তুলে সাপটাকে মারতে লাগল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ঢুকল কি করে?
কি হয়েছে? এত চেঁচামেচি কিসের? ঘোড়াগুলোকে যেখানে বাঁধা হয়েছে, সেখানে শুয়েছিল লুক, পাহারা দেয়ার জন্যে। দৌড়ে এল।
কিশোরের স্লীপিং ব্যাগে সাপ।
অবাক মনে হলো লুককে। সাপ? কে ঢোকাল? এটা কি ধরনের রসিকতা?
যেন দোষটা কিশোরেরই, সে-ই ঢুকিয়েছে। কে ঢুকিয়েছে কি করে বলব? ব্যাগটা সরিয়ে নিয়েছে, তারপর সাপ ঢুকিয়ে ওখানে ফেলে রেখেছে।
অসম্ভব…
আর একটা মিনিটও আমি থাকছি না এখানে! পেছন থেকে বলে উঠল মিসেস ব্যানার। র্যাঞ্চে ফিরে যাব।
এত রাতে? লুক বলল, কে নিয়ে যাবে?
তার আমি কি জানি? আমি থাকব না। তুমি র্যাঞ্চের ফোরম্যান, মেহমানদের দেখাশোনা করা তোমার দায়িত্ব। আমি কোন কথা শুনতে চাই না, এই জঙ্গল। থেকে বেরোতে চাই।
বেশ, লুক বলল, যেতে আপত্তি নেই আমার। তবে যে ভয়ে আপনি যেতে চাইছেন, বনের ভেতর দিয়ে এখন যাওয়ার সময় এরকম ভয় অনেক পড়বে পথে। আরও বড় বড় ভয়ও আছে। পুরো দুটো ঘণ্টা লাগবে বন থেকে বেরোতেই। ভেবে দেখুন, থাকবেন, না যাবেন?
ঢোক গিলল মিসেস ব্যানার। ভয়ে ভয়ে তাকাল চারপাশের বনের দিকে। চাঁদের আলো আছে বটে, কিন্তু গাছপালার ভেতরে প্রচুর ছায়া। বোধহয় ভূতের ভয়েই গায়ে কাটা দিল তার। কাঁপা গলায় বলল, ঠিক আছে, কষ্ট আর দিলাম না তোমাকে। থেকেই যাই।
অনেকেই উঠে এসেছে। সবাইকে বলল লুক, আবার ব্যাগে ঢোকার আগে। ভাল করে দেখে নেবেন। একটা যখন ঢুকছে আরও ঢুকতে পারে।
টর্চ জ্বেলে ভাল করে যার যার ব্যাগ দেখে নিতে লাগল সবাই। কারও ব্যাগেই কিছু নেই। থাকবে কি, এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে ওরা ভেতর থেকে।
রবিন আর কিশোরের মাঝখানে শুয়ে চোখ মুদল কিশোর। ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আসতে চাইছে না ঘুম। মাথার মধ্যে ঘুরছে অসংখ্য প্রশ্ন। কে রাখল সাপটা? ব্রড? নাকি বেনি? এত লোকের চোখ এড়িয়ে কিভাবে রাখল? কখন?
.
পরদিন সকালে আর নতুন কিছু ঘটল না। নাস্তা সেরে র্যাঞ্চে ফিরে চলল দলটা।
মুসা, রবিন আর কিশোর ঘোড়া নিয়ে কাছাকাছি রইল। মুসা বলল, নদীটায় গোসল করার ইচ্ছে ছিল। চলো না, ফিরেই যাই। একাই র্যাঞ্চে ফিরতে পারব। আমরা।
কিশোর বলল, পরে। অনেক সময় পাবে গোসলের। আগে ইউনিকর্নকে খুঁজে বের করতে হবে। মনে হচ্ছে, সমস্ত চাবিকাঠি রয়েছে ব্রডের কাছে।
র্যাঞ্চে ফিরে ঘোড়া রেখে ঘরে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা, গোসল করে পরিষ্কার হওয়ার জন্যে। হারনি পাইকের ব্যাপারে খোঁজ নিতে যেতে চায় কিশোর, বলল সেকথা। রবিন বলল, তাহলে সে-ও যাবে শহরে। লাইব্রেরিটা দেখার জন্যে।
মুসাও ওদের সঙ্গে যেতে চাইল। কিন্তু কেরোলিনের অনুরোধে তাকে সাহায্য করার জন্যে থেকে যেতে হল ওকে।
লিলির পিকআপটা চেয়ে নিল কিশোর। ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠল সে আর রবিন। তবে এবার আর কোন অসুবিধে হলো না। গাড়িটাকে নষ্ট করার জন্যে কোন কৌশল করে রাখেনি কেউ।
ছোট শহরের প্রধান রাস্তাটার পাশেই পাকা বাড়িটা। সামনের পার্কিং লটে গাড়ি রাখল কিশোর।
রবিন বলল, আমি ভেবেছিলাম হারনি পাইকের ওপর থেকে সন্দেহ চলে গেছে তোমার।
শিওর হয়ে নিতে তো আপত্তি নেই, গাড়ির চাবি পকেটে রাখতে রাখতে বলল কিশোর। আমার ধারণা, ব্রড কোনভাবে জড়িত আছেই। আরও অনেকে থাকতে পারে, আর পাইকের যেহেতু মোটিভ আছে, তারও থাকার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। লুকের ভাবসাব দেখে তো তাকেও সন্দেহ হয়। তবে তার কোন মোটিভ খুঁজে পাই না।
এয়ার কণ্ডিশন করা লাইব্রেরি। পুরানো সংবাদপত্র আর মাইক্রোফিল্ম করা খবর ঘেঁটে ঘেঁটে পাইকের সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারল ওরা। বেশ কয়েকটা আর্টিকেল করা হয়েছে তাকে নিয়ে। মনটানার উন্নতি কিভাবে করতে চায় সে, সে কথা ফলাও করে লেখা হয়েছে যতভাবে সম্ভব। তবে পড়েটড়ে মনে হল লোকটা মোটামুটি পরিষ্কার। বদনাম নেই। কিছু লোকে অবশ্য পছন্দ করে না, এটা ঠিক।
আবার সেই দেয়াল, চোখের নিচে ডলতে ডলতে বলল রবিন। এগোনোর পথ বন্ধ।
মনে তো হচ্ছে, কিশোর বলল। তবে নিজে গিয়ে কিছু না করলেও টাকা খাইয়ে অন্যকে দিয়ে করাতে পারে। ইউনিকর্নকে চুরি করাতে পারে, গাড়িটা উড়িয়ে দিতে পারে, আমার ব্যাগে সাপ ঢুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে।
ব্রডকে দিয়ে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিংবা ওরকম অন্য কেউ। তবে দুজনকে একসাথে দেখিনি একবারও, সেজন্যেই ঠিক মেলাতে পারছি না। ধাতব ফাইল কেবিনেটে মাইক্রোফিলুগুলো আবার রেখে দিল সে। চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে রয়েছে মাথায়, ছাড়াতে পারছে না। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। পাইককে বাদ দিয়ে দিলে নিরেককেও দিতে হয়। তাহলে বাকি থাকে ব্রড আর বেনি।
ওরা দুজন একসাথে করছে এসব ভাবছ?
করতেই পারে। দুটো বইয়ের তাকের মাঝখান দিয়ে এগোতে এগোতে থমকে দাঁড়াল কিশোর। এক মিনিট, বলে এস লেখা একটা ভলিউম টেনে বের করল।
কি চাইছ?
কাল রাতের সাপটার কথা মনে নেই? পাতা ওল্টাতে লাগল কিশোর।
সে কি আর ভুলি নাকি?
ওটার ব্যাপারেই খচখচ করছে মনে।
রবিনও তাকাল বইটার দিকে।
র্যাটল স্নেক খুঁজে বের করল কিশোর। অনেক জাতের রয়েছে, বিড়বিড় করে পড়ল সে, ডায়মণ্ড ব্যাক, টিম্বার স্নেক, সাইডউইণ্ডার। একই প্রজাতির সাপের মধ্যেও আবার পুব অঞ্চল আর পশ্চিম অঞ্চলের সাপে তফাত রয়েছে।
যাই হোক, রবিন বলল, আমাদের ইনি এসেছিলেন একটা রাজ পরিবার থেকে।
চকচক করছে কিশোরের চোখের তারা। দুদিকে চাপ দিয়ে ঝটাৎ করে বন্ধ করল বইটা। বুঝলাম!
বলে ফেলো, শুনি?
আমাদের সাপটা এই অঞ্চলের নয়, রবিন। মনে পড়ে, কিভাবে পাশে লাফ দিয়ে দিয়ে চলছিল? ওটা মরুভূমির সাপ! রবিনের চোখে চোখে তাকাল কিশোর, মিস্টি ক্যানিয়নে মরুভূমি নেই।
ভুরু ওপরে উঠে গেল রবিনের। বেশ, ধরলাম এটা একটা সূত্র। কিন্তু তাতে কি?
এখুনি কিছু বলতে পারছি না। তবে জবাবটা বের করতে হবে। লাইব্রেরির শীতল পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতেই গায়ে ঝাঁপটা মারল যেন গরম। গাড়িতে উঠল ওরা। ঠিক মিলছে না, বুঝলে। ঘোড়ার ওপর যথেষ্ট মায়া ব্রডের। সে জেনেশুনে ইউনিকর্ন কিংবা হারিকেনের ক্ষতি করবে, এটা বিশ্বাস হয় না।
ফিরে চলল দুজনে। একটা মোড়ের কাছে এসে ডাবল সির দিকে না গিয়ে আরেক দিকে ঘুরল কিশোর।
এই, কোথায় যাচ্ছ? রবিনের প্রশ্ন।
বেনি কুপারের সঙ্গে কথা বলতে।
বলবে?
দেখাই যাক না। না গেলে জানব কি করে?
ডাবল সির সঙ্গে কুপার র্যাঞ্চের অনেক পার্থক্য। প্রথমটা রাত হলে এটা দিন, এতটাই অন্য রকম। সমস্ত বাড়ি নতুন রঙ করা। মূল বাড়িটা ধবধবে সাদা, অন্যগুলো রেডউড কাঠের রঙ। বিকেলের রোদে ঝলমল করছে। থাম আর জানালার খড়খড়ি সব সবুজ রঙের।
জায়গা বটে, মৃদু শিস দিতে লাগল রবিন।
চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক গাছ। ওগুলোর ছায়ায় কাজ করছে। শ্রমিকেরা। মেহমানরা ঘোরাফেরা করছে। বাচ্চারা খেলছে, হাসছে। মুরগীর রোস্টের গন্ধে খিদের কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের।
বাপরে বাপ! গাড়ি থেকে নামতে নামতে রবিন বলল, এরকম জায়গা ছেড়ে লিলির ফকিরা র্যাঞ্চে কেন থাকতে যাবে লোকে?
মূল বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে বেল বাজাল কিশোর। খুলে দিল রুক্ষ হচেহারার ধূসরচুল এক পঞ্চাশ বছর বয়েসী মহিলা। নিজের পরিচয় দিল এলিনা কুপার বলে, বেনির ফুফু। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কি চাই?
বেনির সঙ্গে কথা বলব, কিশোর বলল।
ওর বন্ধু, নাকি ভক্ত?
আসলে, আমরা ডাবল সির মেহমান। ইউনিকর্নকে খুঁজে বের করতে আমাদের অনুরোধ করেছে লিলি।
ঘোড়াটা পালিয়েছে শুনছি, ঠোঁট বাঁকাল মহিলা। হবেই এরকম। ওরকম একটা পাগলা ঘোড়া কি আর আটকে থাকে বেশিদিন। কিন্তু বেনিকে কেন? ও তো কিছু জানে না। ঘড়ি দেখল এলিনা। চলে আসবে।
কোথায় গেছে?
তীক্ষ দৃষ্টিতে কিশোরের মুখের দিকে তাকাল মহিলা। প্র্যাকটিস করতে। আলাদা নিরালা জায়গায় গিয়ে করে সে। র্যাঞ্চের গণ্ডগোল পছন্দ করে না। ইচ্ছে নেই তবু যেন জোর করেই বলল, চাইলে ভেতরে বসতে পারো?
বেনির আব্বার সঙ্গে কথা বলা যাবে?
ভ্রূকুটি করল এলিনা। শহরে গিয়েছিল, এল কিনা বলতে পারছি না। এক কাজ কর। অনেক হ্যাণ্ড আছে, ওদের কারও কাছে খোঁজ নাও।
থ্যাংকস, বলে কিশোর সরে আসার আগেই তার মুখের ওপর দরজাটা লাগিয়ে দিল মহিলা।
অল্প বয়েসী একটা স্ট্যাবল বয়কে ধরল দুই গোয়েন্দা। বেড়া মেরামত করছে। বেনির আব্বার কথা কিশোর জিজ্ঞেস করলে সে হাত তুলে লম্বা, নিচু চালাওয়ালা। একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, চিড়িয়াখানায় আছে।
চিড়িয়াখানা? রবিনের প্রশ্ন।
হ্যাঁ, সাপখোপ পোষে তো, ছেলেটা বলল। তোমরা শোনোনি? যেতে চাইলে যাও, তবে বাইরে থাকবে। আজ যেন কেউ না ঢোকে মানা করে দিয়েছেন। মিস্টার কুপার।
চট করে রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। আবার ছেলেটার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কেন?
হাত ওল্টাল ছেলেটা, জানি না। ফোরম্যান আমাদেরকে জানিয়ে দিল, শুনলাম, ব্যস। তোমরা ঘরে গিয়ে বস। মিস্টার কুপার বেরোলে আমি বলব।
আচ্ছা।
রবিনকে নিয়ে র্যাঞ্চ হাউসে ফিরে যাওয়ার ভান করল কিশোর। যেই ছেলেটা আরেক দিকে ফিরল অমনি লুকিয়ে পড়ল একটা বাড়ির আড়ালে। তারপর বেড়ার আড়ালে আড়ালে দুজনে এগিয়ে চলল চিড়িয়াখানার দিকে।
মরুভূমির র্যাটলম্নেক নিশ্চয় রাখে না এখানে, কি বলো? রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল বটে কিশোর, কিন্তু প্রশ্নটা করেছে নিজেকেই।
চলো, গেলেই দেখতে পাব।
আস্তে করে ঠেলা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। পেছনে রবিন। এগিয়ে চলল কাচের বাক্সগুলোর পাশ দিয়ে। বিচিত্র সব প্রাণী ওগুলোর ভেতরে। সাপ, শিংওয়ালা ব্যাঙ, গিরগিটি, কচ্ছপ আর মরুভূমির কয়েক ধরনের ইঁদুর জাতীয় জীব। পেছনে আচমকা হিসহিস শব্দ হতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। দেখল, ছোট একটা গিলা মনস্টার তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
এই, দেখে যাও, হাত তুলে ডাকল রবিন। একটা কাচের বাক্স দেখাল। খালি। ভেতরে কে বাস করত নেমপ্লেট দেখেই বোঝা যায়। মরুভূমির একটা র্যাটলম্নেক।
খুলে গেল দরজা। দড়াম করে গিয়ে বাড়ি লাগল দেয়ালে। রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন কুপার, যাও, ভাগ! লাল হয়ে গেছে মুখ। কে ঢুকতে বলেছে? একটা সাপ ছুটে গেছে, কখন কামড়ে দেয়…
আমি জানি, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। কাল রাতে আমার স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে পেয়েছি ওটাকে।
হাঁ হয়ে গেলেন কুপার। এই সময় কিশোরের নজরে পড়ল তার কোমরের বেল্টে রূপার বাকলস, হারিকেনের স্টলের বাইরে যে জিনিস দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছিল তাকে, সে রকম। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পেয়েছ?
ক্যাম্পিঙে গিয়ে কিভাবে সাপটাকে পেয়েছে কিশোর, সব খুলে বলল, কেবল বাদ রাখল ব্রডের সঙ্গে বেনির গোপন সাক্ষাৎকারের কথাটা।
চুপ করে সব শুনলেন কুপার। সন্দেহ যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই পেয়েছ? রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি।
পেয়েছি।
ঘাড় লাল হয়ে গেছে কুপারের। তোমার ব্যাগে গেল কি করে?
নিশ্চয় কেউ নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এমন কেউ, সাপ নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে যার।
দ্বিধায় পড়ে গেলেন কুপার। জবাব দিতে অস্বস্তি বোধ করছেন। তাহলে আর কে হবে? আমার র্যাঞ্চের অনেকেই সাপ নাড়াচাড়া করে। কিন্তু প্রতিটা লোককে চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারি আমি। ব্রড় যাওয়ার পর থেকে সামান্যতম গোলমালও হয়নি আর।
ব্রড জেসনের কথা বলছেন?
শক্ত হয়ে গেল কুপারের চোয়াল। ওটা একটা ক্রিমিন্যাল। চাকরি থেকে বের করে দিয়েছিলাম তো, প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজছে। আমার যাতে দোষ হয়, সেজন্যে নিয়ে গিয়ে সাপ ঢুকিয়ে দিয়েছে ডাবল সির মেহমানের ব্যাগে।
অনেকেই তাহলে সাপ নাড়াচাড়া করে এখানে? কুপারের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
করেই তো। সাপে কামড়ালে কি করতে হয় তা-ও জানে। জানতে হয়, কারণ র্যাটলের বিষ মারাত্মক।
কয়েক দিনের মধ্যে এখানে ঢুকেছিল ব্রড? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা খারাপ! কালো হয়ে গেল কুপারের মুখ। এখানে আর তাকে পা রাখতে দিই আমি। নিলে চুরি করে নিয়েছে।
শুনেছি আপনার মেয়ে বেনির সঙ্গে তার খাতির ছিল। এখনও আছে?
আরে দূর! যখনই বুঝে গেছে ব্যাটা একটা চোর, অমনি সরে এসেছে। ব্রডটা। তো ওর সঙ্গে খাতির করেছে সম্পত্তির লোভে, জানে তো, সবই একদিন বেনির হবে। লাভ হল না। ওরকম একটা চোরের জন্যে কোন দুর্বলতা থাকতে পারে না। বেনির। তাছাড়া এখন ওসব মন দেয়ানেয়ার সময়ও নেই ওর। রোডিও নিয়ে। ব্যস্ত। জিততে পারলে অনেক সুবিধে। বিজ্ঞাপন এমনকি ছবিতে অভিনয় করারও সুযোগ পাবে, একটা জাতীয় রোডিও সফরে যেতে পারবে।
তার মানে জেতাটা তার জন্যে খুব জরুরী, বিড়বিড় করল কিশোর।
খুবই। ওর জীবনই বদলে দেবে এটা, গর্বের সাথে বললেন কুপার। রবিন আর কিশোরকে নিয়ে চললেন বাইরে। পশ্চিমের পাহাড়ের ওপরে যেন ঝুলে রয়েছে সূর্যটা, তাকালেন সেদিকে। ভাবছি, এখনই যাব ডাবল সিতে। সাপের দাম চাইতে। দেখি, লুক বোলান কি বলে?
কিছু বলল না রবিন কিংবা কিশোর। সাপের দাম চাইবেন কি চাইবেন না সেটা কুপারের সমস্যা। ওরা এগোল পিকআপের দিকে।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে ব্রডই আমাদের লোক, নিচু স্বরে বলল রবিন।
হয়তো।
গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো কিশোর। খোয়া বিছানো পথ থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, এক বোতল কোক খেলে কেমন হয়?
চমৎকার।
গলা শুকিয়ে গেছে দুজনেরই। কাজেই ডেরিক লংম্যানের দোকানে এসে দুই বোতল কোক কিনল। গলা ভিজিয়ে নিয়ে ফিরে চলল ডাবল সিতে।
কিশোর বলল, ব্রড যদি সত্যিই বেনিকে চায়, তাহলে জিততে সাহায্য করবে। কেন? জিতলে তো চলে যাবে বেনি, হারাবে তাকে ব্রড।
তাতে কি? মনের মিল থাকলেই হয়। ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়বে ব্রডও, চলে যাবে বেনির সাথে। ভালই হবে। কুপারের আওতা থেকে সরে যেতে পারবে। এমনও হতে পারে, বেনি গিয়ে তার সাহায্য চেয়েছে। ব্যস, সাহায্য করছে সে। কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, হয় না এরকম?
হাসল কিশোর, হয়।
ডাবল সিতে ঢোকার মুখে কুপারের গাড়িটা বেরোতে দেখল ওরা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত নাড়লেন তিনি। তবে হাসি নেই, মুখ কাল করে রেখেছেন।
নিশ্চয় ভাল কিছু হয়নি? রবিনের প্রশ্ন।
মনে তো হচ্ছে না, সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল কিশোর। সে ও গাড়িটা পার্ক করল, ডিনারের ঘন্টাও বাজল।
উফ, খিদে যে পেয়েছে বুঝতেই পারিনি, রবিন বলল।
আমিও না। র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোল দুজনে। সিঁড়ি দিয়ে উঠছে এই সময় দরজা খুলে ছুটে বেরোল মুসা। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। চেঁচিয়ে উঠল, তোমরা এলে! ইউনিকর্ন! ইউনিকর্ন!