১১.

সন্ধ্যা আটটায় আবার হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।

কি করতে হবে বললো কিশোর। বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে যাবে। পিটার। আমি যাবো ওখানে, ওদের কথা শুনতে। মুসা, তুমি গিয়ে আড্ডার ওপর নজর রাখবে। আমাদের নতুন ওয়াকি-টকির রেঞ্জ তিন মাইল। কিন্তু ডি লা ভিনা থেকে পাইরেটস কোভ পাঁচ মাইল। কাজেই মাঝামাঝি জায়গায় একজনকে থাকতে হবে। রবিন থাকবে। মুসার মেসেজ আমাকে দেবে, আমার মেসেজ মুসাকে। ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকালে দুই সহকারী গোয়েন্দা।

বেরিয়ে এলো ওরা। সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল যার যার জায়গার দিকে।

.

পাইরেটস কোভের পথে যখন নামলো মুসা, অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। সাইকেলের আলো জ্বেলে দিলো। আড্ডার গেটের কাছে এসে থামলো। আলো নিভিয়ে অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ, চোখে অন্ধকার সইয়ে নেয়ার জন্যে।

আগের জায়গায়ই ট্রী-সার্ভিস ট্রাকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। সিগারেটের আগুন দেখেই বুঝতে পারলো, ড্রাইভিং সীটে বসে আছে কেউ। নিশ্চয়। নজর রাখছে।

ওয়াকি-টকি বের করলো মুসা। বললো, রবিন, কিশোরকে বলল, মেজরের ন্টসহকারী টনি এখনও চোখ রাখছে আড়ার ওপর।

প্রায় মাইল তিনেক দূরে, হাইওয়ের পাশে একটা ছোট টিলার ওপরে বসে আছে। রবিন। ওয়াকি-টকিটা মুখের কাছে তুলে আনলো। অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে। বললো, কিশোর, মুসা জানিয়েছে, এখনও আড়ার ওপর চোখ রাখছে টনি।

ওর কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে, দোকানের জানালার নিচে একটা ঝোঁপের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কিশোর। মেসেজের জবাব দিলো, মেজর নিরেক, রিগো, আর টাকমাথা লোকটা এখনও বসে আছে এখানে। কিছুই করছে না। মুসাকে বলো, কড়া নজর রাখতে। খুব সাবধান যেন থাকে।

হুঁশিয়ারির প্রয়োজন ছিলো না। মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে রয়েছে টনি। এই অবস্থায় সাবধান থাকতেই হবে, তা-ই রয়েছে মুসা। লুকিয়ে আছে গাছের ছায়ায়। এমন একটা জায়গায় গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে, যেখান থেকে পার্কিং লট, গেট, টাওয়ারের ওপরের দুটো তলা আরট্রী-সার্ভিসট্রাকটা দেখা যায়।

আড্ডায় ঢোকার মুখে একটা খুঁটিতে আলো জ্বলছে। এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো। গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে থামলো একটা ভ্যান। দরজা খুলে লাফিয়ে নামলো পিটার। গেটটা লাগিয়ে দিয়ে এসে আবার গাড়িতে উঠলো।

চলে গেল ভ্যানটা। আবার ট্রাকের দিকে তাকালো মুসা। নড়লো না ওটা। বেগুনী জলদস্যু তেমনি ভাবে বসে বসে সিগারেট টানছে টনি।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার মেসেজ পাঠালো মুসা, ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটার বেরিয়ে গেছে। টনি আগের মতোই বসে আছে। নজর রাখছে।

মেসেজটা কিশোরের কাছে পাচার করলো রবিন। পথের দিকে চোখ। কয়েক মিনিট পরেই দেখতে পেলো, তার সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে পিটারদের ভ্যানটা।

মেসেজ শুনলো কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে ঘরের দিকে। রবিনের কথা শেষ হতে না হতেই ঘড়ি দেখলেন মেজর। উঠে রওনা হলেন দরজার দিকে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিশালদেহী রিগো। লাফিয়ে লাফিয়ে চললো মেজরের পেছনে। একভাবে বসে রইলো টাকমাথা লোকটা।

দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে দোকানের পাশে চলে এলো কিশোর। চত্বরের দিকে তাকালো। দোকান থেকে বেরিয়ে ভ্যানে গিয়ে উঠলেন মেজর আর রিগো, যেটাতে খোঁড়ার যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে।

চলে গেল গাড়িটা।

খবরটা রবিনকে জানালো কিশোর। তারপর ফিরে এলো আবার আগের জায়গায়। টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেট ভরছে টাকমাথা লোকটা। দুটো চেয়ার সাজিয়ে রাখলো ডেস্কের সামনে। চত্বরে আরেকটা ভ্যান ঢোকার শব্দ হলো। একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ, সঙ্গে পিটার। ঢুকেই জড়োসড়ো হয়ে গেল পিটার। এমন ভঙ্গি করতে লাগলো, যেন ভীষণ শীত করছে। এয়ারকুলার বন্ধ করে দিতে বললো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে সুইচ অফ করে দিলো। লোকটা। মনে মনে হাসলো কিশোর, বুদ্ধি আছে ছেলেটার। শুধু তাই নয়, লোকটা যখন এয়ারকুলার বন্ধ করতে গেছে, সে এসে খুলে দিয়েছে জানালা। এক পলকের জন্যে কিশোরের মুখটা নজরে পড়েছে বোধহয়, কারণ হেসেছে এদিকে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে গেছে আবার, টাকমাথা কিছু সন্দেহ করার আগেই।

মিস্টার গুন, ক্যাপ্টেন বললেন, একদিন যা বলেছি, রেকর্ড তো করে। রেখেছেন। আবার শুনতে চাই। দরকার আছে।–

সরি, ক্যাপ্টেন, জবাব দিলো গুন, এখানে নেই ওগুলো। মেজর সব নিয়ে গেছেন।

কেন? জানতে চাইলো পিটার।

বোধ হয় এডিট করবেন। তারপর আরও কপি করে পাঠিয়ে দেবেন সোসাইটির ডিরেকটরদের কাছে।… আসুন, কাজ শুরু করা যাক।

রেকর্ডিঙের বোতাম টিপে যন্ত্রটা ক্যাপ্টেনের দিকে ঠেলে দিলো গুন। নিজে গিয়ে বসলো দরজার কাছে। ক্যাপ্টেন গল্প শুরু করলেন। সে চুপচাপ কমিক পড়তে লাগলো।

জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ভাবছে, মেজর আর রিগো কোথায় গেল? টনিকে বসিয়ে এসেছে আড়া পাহারা দিতে। গুনকে রেখে গেছে ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যে। পঁচিশ ডলার করে ঘন্টায়। ফিলিপের। টাকার টানাটানি চলছে। এই অবস্থায় এটা তার জন্যে লোভনীয় কাজ। আন্তরিক ভাবে গল্প বলে যাবেন, যততা গল্প তাঁর জানা আছে। কিন্তু কেন এই কাজ করাচ্ছেন। মেজর? আন্দাজ করতে পারছে গোয়েন্দাপ্রধান। আরও আন্দাজ করতে পারছে,। কোথায় গেছেন মেজর নিরেক রিগোকে নিয়ে।

.

আড্ডার বাইরে খুঁটিতে ওই একটামাত্র আলোই জ্বলছে।

 টিকেট বুদ আর তালা দেয়া গেটটা দেখা যাচ্ছে সেই আলোয়। খুব সামান্যই গিয়ে পড়েছে পার্কিং লটে, তবে ওই ম্লান আলোতেই নড়াচড়াটা চোখ এড়ালো না। মুসার। ট্রাকের ভেতরে জ্বলছে সিগারেটের আগুন, একবার উজ্জ্বল হচ্ছে, টান। দেয়ার সময়। টান ছেড়ে দিলেই আবার কমে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পেছনের পথ। দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। মুসা আসার পর এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের একটা বিমানও। উড়ে গেছে।

তারপর, রকি বীচের দিক থেকে এলো একটা ভ্যান। পাকিং লটে ঢুকলো। হেডলাইট নিভালো। গিয়ে থামলো বন্ধ গেটের সামনে। দরজা খুলে নেমে এলেন। মেজর নিরেক আর রিগো।

রবিন! নিচু গলায় মেসেজ পাঠালো মুসা, মেজর আর রিগো ব্যাটা এসে গেছে!

জানালার নিচে বসে মেসেজটা শুনলো কিশোর। উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো, এটাই আশা করেছিলাম, নথি। ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারকে সরিয়ে দেয়া। হয়েছে আড্ডা থেকে, যাতে নিরাপদে খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যেতে পারে মেজরের। চেলারা। ওরা জানে কিংবা অনুমান করেছে কিছু একটা লুকানো রয়েছে ওখানে।

ওয়াকি-টকির খুদে মাইক্রোফোনে কড়কড় করে উঠলো রবিনের কণ্ঠ, মুসা বলেছে, মেজর আর রিগো গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলো। টনি নেমে গেছে। ওদের কাছে। গেটের তালা খুলে দিয়েছে। ভ্যান নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে মেজর আর রিগো। যতোটা সম্ভব আস্তে আর নীরবে করেছে কাজটা। আলো জ্বালেনি। ওরা। ঢুকে যেতেই আবার তালা লাগিয়ে ট্রাকে ফিরে এসেছে টনি। ভ্যানটা আর দেখতে পাচ্ছে না মুসা।

নিচের ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। রবিন, মুসাকে বললো ভ্যানের পিছু নিতে। মেজর আর রিগো কি করছে জানা দরকার।

অন্ধকারে নিজে নিজেই মাথা নাড়লো মুসা। গেটের ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। এখন ট্রাকের হাইড্রলিক লিফটে চড়ে বসেছে টনি। আমি বেরোলেই আমাকে দেখে ফেলবে। বেড়ার কাছেও যেতে পারবো না, দেখে ফেলবে। আর গিয়ে লাভও নেই। এতো উঁচু বেড়া, ডিঙাতে পারবো না।

কিশোর বলেছে, যে ভাবেই হোক, ঢুকতে হবে তোমাকে। ওরা কি করছে, জানা দরকার। কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় আছে। খোঁজো। ..

আরেকবার চোখ বোলালো মুসা। বললো, কারখানার ওদিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে পারি। বেড়া ওখানেও আছে। ডিঙানোর চেষ্টা করবো। না পারলে আরও এগিয়ে চলে যাবো। পিয়ারের কাছে। পিয়ার পার হয়ে পানিতে নেমে সাঁতরে ঢুকবো আড্ডার ভেতরে। তাহলেই আর টনি দেখতে পাবে না।

রবিনের জবাবের অপেক্ষায় রইলো মুসা। কিশোরের সঙ্গে কথা বলবে রবিন, তারপর জবাব দেবে।

বেড়ার অন্যপাশে পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। কোনো শব্দ নেই ওখানে। আলো নেই।

অবশেষে জবাব দিলো রবিন, ঠিক আছে, মুসা, যাও। তবে খুব সাবধান!

.

১২.

 কয়েকশো মিটার দূরে দৈত্যাকার ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রি-সার্ভিসট্রাকটা। সিগারেটের আগুন জানিয়ে দিচ্ছে এখনও হাইড্রলিক লিফটের ওপরে রয়েছে টনি।

পথটা দেখলো মুসা। পার্কিং লটের দিকে তাকালো। নির্জন। টনির দিকে আরেক বার তাকিয়ে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়লো সে। ছায়ায় ছায়ায় দৌড়ে চলে এলো কারখানার কাছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেণ্ড। বোঝার চেষ্টা করলো, কারো চোখে পড়ে গেল কিনা। বোধহয় পড়েনি। দেয়ালের ধার ধরে ধরে চলে এলো শেষ মাথায়, যেখানে খাড়ির সঙ্গে মিশেছে ওটা। দেয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা ইট আর কড়িকাঠ ধরে ওপরে উঠে পড়লো সে, তারপর দম বন্ধ করে লাফ দিলো। কাঠের পিয়ারে নিঃশব্দে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। থ্যাপ করে একটা শব্দ হলো। অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো আরও কিছুক্ষণ। কারো সাড়া নেই দেখে হাঁটতে আরম্ভ করলো। এগোলো কিছুদূর। খানিক দূরে চকচক করছে খুঁড়ির কালো পানি। মিটার দশেক দূরে আবছাভাবে চোখে পড়ছে ঘরবাড়ি।

পানিতে না নেমে ওখানে পৌঁছানোর আর কোনো উপায় নেই। পিয়ারের ওপর হাতড়ে হাতড়ে একটা নৌকা বাঁধার দড়ি পেয়ে গেল। টেনে দেখলো, একটা মাথা এখনও পিয়ারের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। ওটা ধরে ঝুলে পড়লো সে। নেমে এলো পানির কাছে। পা দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো। কনকনে ঠাণ্ডা পানি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো সে। তারপর হাত ছেড়ে দিলো।

পানি একেবারেই কম ওখানে, মাত্র গোড়ালি ডুবলো। দ্রুত একবার তাকালো। এদিক ওদিক, কেউ দেখছে কিনা দেখলো। তারপর হেঁটে চললো পানির মধ্যে দিয়ে। সাঁতরাতে হলো না বলে খুশি।

ট্রেলারটার কাছে উঠে এলো সে। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। সব কিছু চুপচাপ।

ডকে ভাসছে জাহাজটা, মাঝে মাঝে ঘষা লাগছে জেটির সঙ্গে, কচমচ আওয়াজ করছে। প্রমিনাডের দুপাশের ঘরগুলো সব বন্ধ। কফি স্ট্যাণ্ড, মিউজিয়ম, সব। মেজরের গাড়িটা চোখে পড়লো না।

ঘুরে মিউজিয়মের পেছনে চলে এলো সে। অন্ধকার আকাশের পটভূমিকায়। অনেক উঁচু লাগছে জাহাজের গলুইটা। সেদিকে একবার তাকিয়ে ওয়াকি-টকি তুলে আনলো মুখের কাছে। রবিন, ভেতরে ঢুকেছি। ট্রেলার, বাড়ি, জাহাজ, সব জায়গায় দেখলাম। মানুষজন চোখে পড়ছে না। মেজরের ভ্যানটাও না। কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল, আল্লাহ মালুম!

কিছুক্ষণ পর রবিনের কথা শোনা গেল, কিশোর বলছে, ওরা ওখানেই। কোথাও আছে। খুঁজতে বলেছে।

 গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তবে তর্ক করলো না। ঘুরে রওনা হলো ওকের জঙ্গলের দিকে। ঘন গাছপালার মধ্যে ঢুকে দাঁড়ালো। কান পাতলো শব্দ শোনার আশায়। কিছুই কানে এলো না, শুধু তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎছল ছাড়া। আর আছে বাতাসের ফিসফাস কানাকানি। আড়র দিকে মুখ করে থাকা, টাওয়ারের একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।

নিচু গলায় ওয়াকি-টকিতে কথা বললো মুসা, ভিকটর ইভানসের টাওয়ারে আলো দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখতে যাচ্ছি আমি।

বনের ভেতর থেকে সরাসরি না বেরিয়ে বেড়ার কাছে চলে এলো মুসা। বেড়ার ধার ঘেঁষে এগোলো, যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে। টাওয়ারের কাছাকাছি এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো মাটিতে। বুকে হেঁটে এগোলো। আলো কিত জানালাটার কাছে এসে থেমে দম নিলো, তারপর আস্তে মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালো।

 ঘরের ভেতর ভিকটর একা। ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়ছে। হঠাৎ কি মনে করে মাথা উঁচু করে কান পাতলো। যেন কোনো শব্দ কানে গেছে। সতর্ক হলো মুসা। সে কোনো আওয়াজ করে ফেললো না তো?

তাড়াতাড়ি জানালার কাছ থেকে সরে আসতে গেল সে। ফেলে দেয়া একটা খাবারের খালি টিনে পা বেধে ঠনঠন করে গড়িয়ে গেল ওটা। নীরব অন্ধকারে মুসার মনে হলো টিনের শব্দ তো না, যেন বোমা ফেটেছে।

চোখের পলকে মাটিতে শুয়ে স্থির হয়ে গেল সে।  

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ঘরের দরজা। এক ফালি আলো এসে পড়লো বাইরে। আলোর দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে ভিকটর। হাতে পিস্তল।

কেঁপে উঠলো মুসা। নেমে এলেই লোকটা তাকে দেখে ফেলবে…

মিআঁউউউ!।

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ভিকটরের পায়ে গা ঘষতে আরম্ভ করলো একটা। কালো বেড়াল। হেসে পিস্তলটা নামিয়ে ফেললো সে। তুই। আমি ভেবেছিলাম না। জানি কে। আয়, ভেতরে আয়। _

বেড়ালটাকে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ভিকটর।

কপালের ঘাম মুছলো মুসা। বেড়ালটা সময়মতো না বেরোলে…আর ভাবতে পারলো না সে। বুকে হেঁটে যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এলো আবার বেড়ার কাছে। উঠে একছুটে ঢুকে পড়লো ওকের জঙ্গলে।

জোরে জোরে দম নিলো কয়েকবার। তারপর ওয়াকি-টকি বের করে বললো, রবিন, কিশোরকে বলো, ঘরে রয়েছে ভিকটর। পড়ছে। মেজর নিরেক আর রিগোর চিহ্নও দেখলাম না। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে!

.

দোকানের পেছনে ঝোঁপের মধ্যে বসে অন্ধকারেই ভুরু কোঁচকালো কিশোর। বললো, ভ্যানটা ওখানেই কোথাও আছে।

ঘড়ি দেখলো সে। এগারোটা প্রায় বাজে। রবিনের জবাব শোনা গেল, মুসা। বলছে, পুরনো আস্তাবলগুলোর সব কটার ডবল দরজা। সহজেই ভ্যান ঢোকানো যাবে। তবে ভেতরে ঢুকতে চাইছে না, মুসা, মেজরের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।

এখনও আমরা কিছু জানতে পারিনি। ওরকম ঝুঁকি না নেয়াই ভালো। জিজ্ঞেস করো, আর কি করতে পারে সে?

দোকানের ভেতরে একটা প্যাকেট খুলে কেক বের করে ক্যাপ্টেন আর পিটারকে দিলো গুন। মুসার কাছ থেকে রবিনের মুখে জবাব এলো ওয়াকি টকিতে, একটা কাজই করতে পারে বলছে। গেটের কাছে লুকিয়ে থেকে দেখতে পারে, কোত্থেকে বেরোয় ভ্যানটা। _ আপনমনেই মাথা ঝাঁকালো কিশোর। এটাই একমাত্র বুদ্ধি..এই শোনো, ধরো, দেখি। মাথা আরেকটু তুললো সে। রেকর্ডিং শেষ হয়েছে মনে হচ্ছে।…হা, উঠে দাঁড়িয়েছেন ক্যাপ্টেন আর পিটার। এগারোটা বাজে। বেরিয়ে যাবেন।

সামনের গেটের কাছে, মিউজিয়মের কোনায় মাটিতে পেট দিয়ে শুয়ে আছে মসা। তাকিয়ে রয়েছে প্রমিনাডের দিকে। ব্ল্যাক ভালচারের দানবীয় ছায়া ছায়া শরীরটা চোখে পড়ছে। কানে আসছে শুধু বাতাসের ফিসফাস, ঢেউয়ের ছলছল, আর কাঠের জেটিতে জাহাজের ধাতব শরীর ঘষা লাগার বিচিত্র ক্যাচকোচ।

একভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে গেল মুসার। দুই চিবুকের ওপর। থুতনি রেখে চোখ মিটমিট করে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো ওটা। ভ্যান! হেডলাইট নেভানো। এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনতে পায়নি সে। কোনদিক থেকে এলো, তা-ও বুঝতে পারেনি। ঘড়ি দেখলো সে। ঠিক ১১টা।

 মাটিতে শরীর চেপে ধরলো মুসা, একেবারে মিশিয়ে ফেলতে চায় যেন। প্রায় নিঃশব্দে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেল ভ্যান। গেট খোলার জন্যে নামলো রিগো। খুলে দিতে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।

খানিকটা এগিয়ে আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়ালো ভ্যান। ঝাঁকুনি লেগে হাঁ হয়ে খুলে গেল পেছনের দরজা। খুঁটির আলো গিয়ে পড়েছে ওটার গায়ে, ভেতরে কি আছে স্পষ্ট দেখতে পেলো মুসা। গাদা গাদা বস্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে, বোঝাই।

গাল দিয়ে উঠলেন ড্রাইভিং সীটে বসা মেজর, গাধা কোথাকার! তালা লাগায়নি! লাগিয়ে জলদি এসে ওঠো!

মেজরের নির্দেশ পালন করতে ছুটলো রিগো। দরজাটা লাগিয়েই থেমে গেল। ফিরে তাকালো মুসা যেখানটায় শুয়ে আছে সেদিকে। দেখে ফেললো নাকি! জমে গেল মুসা।

এই, কি হলো, বলদ! এতো দেরি কেন? ধমক দিলেন মেজর।

মাথা চুলকালো রিগো। দ্বিধা করলো একবার। তারপর গিয়ে উঠলো সামনের। সীটে। হেডলাইট জ্বালানো হলো এবার ভ্যানের। চলে গেল ওটা।

ওয়াকি-টকির ওপর কুঁকলো মুসা। রবিন, এইমাত্র বেরিয়ে গেল মেজর আর রিগো। কোথায় ছিলো ওরা, কোত্থেকে এলো, কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে ভ্যানের পেছনে কি আছে দেখেছি। অনেক বস্তা বোঝাই করা!

.

ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারকে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলো কিশোর। ট্রাক চলে যাওয়ার শব্দ শুনলো। ওরা চলে যেতেই খোলা জানালাটা চোখে পড়লো গুনের। বিড়বিড় করে কি বলে এসে বন্ধ করে দিলো। এয়ারকুলার চালু করলো। তারপর গিয়ে বসলো টেপ রেকর্ডারের সামনে। টেপ রিওয়াইন্ড করে মুছে ফেলতে শুরু করলো ক্যাপ্টেনের কথা। অযথাই বকবক করে গেছেন যেন ফিলিপ, কোনো মানেই নেই ওসবের।

এই সময় এলো রবিনের মেসেজ। ভ্যানের পেছনে বোঝাই বস্তার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বোঝাই? যা-ই আছে, ওগুলোর জন্যেই গিয়েছিলো ওখানে ওরা! জিজ্ঞেস করো তো মুসাকে, কি আছে দেখতে পারবে কিনা?

পারবে না। ভ্যানটা চলে গেছে। এখনও পাহারা দিচ্ছে টনি। যে পথে ঢুকেছিলো সেপথেই ফিরে আসছে মুসা। হেডকোয়ার্টারে দেখা করবে, পরে।

ঠিক আছে, ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। তুমি জলদি চলে এসো এখানে।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই একটা ভ্যানের শব্দ শুনলো কিশোর। চতুরে। থামলো। খানিক পরে ঘরে এসে ঢুকলেন মেজর আর রিগো। গুনের সঙ্গে কথা: বলতে লাগলেন তিনি, আর রিগো কেকের বাকিটা শেষ করায় মন দিলো। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। জানালার বাইরে। ঝোঁপের ভেতর গুটিয়ে গেল। কিশোর। কথা শেষ করে রিগোকে ইশারা করলো গুন। নেহায়েতই অনিচ্ছা নিয়ে যেন তার পিছে পিছে চললো হাতির বাচ্চা। নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় পাহারা বদল করতে যাচ্ছে, কিশোর ভাবলো।

দেয়ালের পেছনে একটা খসখস কানে এলো তার। অন্ধকারে ঘুরে তাকালো।

রবিন এসেছে।

হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। ফিসফিস করে বললো, এসেছে। ভালো হয়েছে। আমার জায়গায় গিয়ে বসো। বস্তাগুলোয় কি আছে দেখতে যাচ্ছি আমি। আমাদের যন্ত্রটাও খুলে আনবো। মেজরকে বেরোতে দেখলেই আমাকে হুঁশিয়ার করবে।

তাড়াতাড়িই ফিরে এলো কিশোর।

দেখেছো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

 দেখেছি। দশটা বস্তায়ই। যন্ত্রটাও খুলে নিয়ে এসেছি। চলো, বাড়ি যাবো।

কি আছে?

ততোক্ষণে চলতে আরম্ভ করেছে কিশোর। রবিনের কথার জবাব দিলো না। সাইকেল নিয়ে রওনা হলো দুজনে।

ওরা ইয়ার্ডে আসার কিছুক্ষণ পর এলো মুসা।

নষ্ট হয়ে যাওয়া ট্রেইলিং ডিভাইসটা টেবিলে ফেলে রেখেছে কিশোর। কিসের সঙ্গে যেন বাড়ি খেয়ে হয়েছে এই অবস্থা।

গেল! জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো রবিন। ওই জিনিস আরেকটা কেনার পয়সাও নেই এখন আমাদের।

যাক, হাত নাড়লো মুসা। পয়সা হলে কিনে নেবো আরেকটা। এই কিশোর, বস্তার ভেতর কি দেখলে?

মাটি।

মাটি! মুসা আর রবিন দুজনেই অবাক।

মাটি আর পাথর, আবার বললো কিশোর। দশ বস্তা বোঝাই খুব বাজে মাটি আর পাথর।

কিন্তু…কিছুই বুঝতে পারছি না! হাত ওল্টালো মুসা।

এটুকু বোঝা যাচ্ছে, কিশোর বললো, মাটি খুঁড়েছে জলদস্যুর আভজাতেই। কাল আবার যাবো আমরা। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে বলবো গল্প রেকর্ডিংটা স্রেফ একটা ধাপ্পাবাজি। তারপর খুঁজে বের করবো, কোন জায়গায় খুঁড়ছেন মেজর, এবং কেন।

.

১৩.

পরদিন সকালে হেডকোয়ার্টারে রবিন দেখলো, রিসিভার ক্রেডলে নামিয়ে রাখছে কিশোর। মুসা আসছে না, জানালো সে। বাড়ি থেকে কাজ চাপানো হয়েছে ওর ওপর। ওকে রেখেই যেতে হচ্ছে আমাদের। যতো তাড়াতাড়ি পারে কাজ শেষ। করে আড্ডায় আমাদের সঙ্গে দেখা করবে বলেছে।

হাসলো ররিন। মায়ের ওপর রেগে নিশ্চয় ভোম হয়ে আছে।

যা-ই হোক, অন্তত খুশি মনে হলো না। চলো। তিনটে ওয়াকি-টকিই নিয়ে। নিচ্ছি। কাজে লাগতে পারে।

যন্ত্রগুলো ব্যাগে ভরে নিলো রবিন।

সবুজ ফটক এক দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোলো ওরা। চললো জলদস্যুর আড়ার দিকে। কুয়াশা পড়েছে। হাইওয়ে দিয়ে সাবধানে সাইকেল চালালো

পৌঁছে দেখলো নির্জন পাইরেটস কোভ-এর ওপরে নীরবে যেন ঝুলে রয়েছে। ভারি কুয়াশার চাদর।

 পিটারকে ফোন করেছিলাম, কিশোর জানালো। সে বলেছে, তার আব্বাকে বলেকয়ে রাজি করিয়ে রাখবে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে।

গেটের কাছে পৌঁছে নিচু গলায় বললো রবিন, আইসক্রীমের ভ্যানটা আছে রিগো কোথায় লুকিয়েছে কে জানে। হয়তো গাছের আড়ালে।

রাস্তার দিকে তাকালো কিশোর। গাড়িটা দেখলো। গাছের জটলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। হ্যাঁ, আছে। অতোবড় হাতির মতো দেহ লুকানো কি আর সহজ?

গেটের ভেতরে ঢুকলো দুজনে। ট্রেলারের কাছে এসে বেল বাজালো।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। পিটার বললো, এসো। তোমাদের জন্যেই বসে আছি।

রান্নাঘরে টেবিলের সামনে বসে আছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। সবে নাস্তা শেষ করেছেন। ছেলেদেরকে কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্রতার সঙ্গে বললো। ওরা, খাবে না।

হাতের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন তিনি, মেজর নিরেককে বিরক্ত করতে মানা করেছিলাম তোমাদেরকে।

মনে আছে, স্বীকার করলো কিশোর। আমরা করিনি। তদন্ত যে করছি। বগুনী জলদস্যু জানেনই না মেজর।

তাহলেই ভালো। শুনলাম, রহস্যের কিনারা নাকি করে ফেলেছে। খুলে বল তো সব।

পিটার বোধহয় বাড়িয়ে বলেছে, নরম গলায় বললো কিশোর। রহস্যের সমাধান এখনও করতে পারিনি, তবে শিওর হয়ে গেছি, রহস্য একটা সত্যিই আছে। আগের দিন রাতে যা যা ঘটেছে বলতে লাগলো সে।

আরেক কাপ কফি ঢাললেন ক্যাপ্টেন। কিশোরের কথা শেষ হলে বললেন; তাহলে তোমার বিশ্বাস, পুরো ব্যাপারটাই একটা ফাঁকিবাজি। গল্প বলানোর ছুতোয় আমাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছে মেজর, যাতে নিরাপদে মাটি খুঁড়তে পারে।

হ্যাঁ, স্যার।

 কিন্তু কেন? আর এতো পাহারার ব্যবস্থাই বা কেন করেছে?

এখনও জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। বেগুনী জলদস্যুর গুপ্তধন।  আছে হয়তো এখানে, আর সেটা জানা আছে মেজর আর তার চেলাদের। ম্যাপও আছে একটা। টেবিলে ম্যাপ বিছিয়ে যে দেখেছিলেন মেজর, সেকথা জানালো কিশোর।

সন্দেহ যাচ্ছে না ক্যাপ্টেনের। পাইরেটস কোভে গুপ্তধন আছে, একথা কারো কাছে শুনিনি। কোনো গুজব নেই। তবে উইলিয়াম ইভানস ফিরে এসে মারা। যাওয়ার পর লোকে ভাবতে শুরু করেছিলো, সে গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে। খোঁজাখুঁজিও করেছে। কেউ কিছু পায়নি। তারপর আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কেউ।

গুপ্তধন না-ও হতে পারে। তবে মাটি যে খোঁড়া হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোন জায়গায় খুঁজছে, এখন গিয়ে সেটা বের করা দরকার।

পাওয়া যাবে! উত্তেজনায় চকচক করছে পিটারের চোখ। তিন দিন ধরে খুঁড়ছে, নিশ্চয় বেশ বড় গর্ত!

তাহলে পাওয়া সহজই হবে, ক্যাপ্টেন বললেন।

আমার তা মনে হয় না, সন্দেহ রয়েছে কিশোরের। মাটি খুঁড়ে বস্তায় ভরে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অতি সাবধানতা। যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে।

আলাদা আলাদা হয়ে খুঁজতে বেরোই আমরা, কি বলো? রবিন বললো। তুমি ক্যাপ্টেনকে নিয়ে যাও। আমি আর পিটার যাচ্ছি। দুদিকে যাবো। দুজনেই এলাকা চেনেন, অসুবিধে হবে না।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

ঠিক হলো দুদিক থেকে খুঁজে এসে জাহাজটার কাছে মিলিত হবে ওরা।

কফি স্ট্যাণ্ডের পেছন দিকটায় খুঁজতে চললো কিশোর আর ক্যাপ্টেন। কুয়াশা। এখনও কাটেনি। মাথার ওপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে, হালকা মেঘের মতো।

এটা আর মিউজিয়ম করা হয়েছে যে বাড়িটায়, ক্যাপ্টেন বললেন, আগে আস্তাবল ছিলো। ওদিকে ওই গাছপালাগুলো দেখছো, ওখানে আরেকটা বাড়ি ছিলো। কোভ রোড তৈরি হওয়ার আগে।

ঘরের ভেতরেও মাটি খোঁড়া হয়ে থাকতে পারে, সন্দেহ করে একটা আস্তাবলের দরজা খুললেন তিনি। কোমল পানীয় আর টিনজাত খাবারের বাক্সে। ঘরটা বোঝাই। তবে ভ্যান রাখার জায়গা রয়েছে। মাটিতে টায়ারের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না, গর্তটৰ্তও খোঁড়া হয়নি। কিছুই পাওয়া গেল না। বাইরে বেরিয়ে আশেপাশে খুঁজলো কিছুদূর। তারপর নিরাশ হয়ে এসে দাঁড়ালো ব্ল্যাক ভালচারের কাছে।

রবিন আর পিটারও ফিরে এলো।

 পাইনি, হতাশ কণ্ঠে জানালো রবিন। একটা ইঞ্চি জায়গাও বাদ দিইনি।

ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। শো-এর সময় হয়ে যাচ্ছে। নোনতা তো এখনও এলো না। আসেই কিনা কে জানে! মাঝে মাঝেই এরকম করে। একা মারিয়া। সামলাতে পারবে না। লোক যদি বেশি হয়ে যায়, তোমরা কি সাহায্য করতে পারবে?

উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কিশোরের চোখ। নিশ্চয় পারবো, স্যার। অভিনয়ও করতাম একসময়। জলদস্যুর অভিনয় ভালোই পারবো। প্রয়োজন হলেই বলবেন। আমরা আছি।

এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে, প্রস্তাবটা রবিনেরও মনে ধরেছে। কাজও করবো, ওদিকে খোঁজাও হয়ে যাবে, গর্তটা। মিউজিয়মের চাবিটা দিন।

পকেট থেকে চাবি বের করে দিলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন, শো-এর জন্যে তৈরি হতে। তালা খুলে মিউজিয়মের ভেতরে ঢুকলো কিশোর আর রবিন।

কিশোর বললো, দেখ, মাটিতে চাকার দাগ আছে কিনা?

প্রথম ঘরটায় কোনো দাগ পাওয়া গেল না। মাটি খোঁড়ার চিহ্নও নেই। পরের ঘরটায়ও দাগটাগ মিললো না। বেরোনোর জন্যে পা বাড়িয়েই থেমে গেল রবিন। হাত তুলে হুঁশিয়ার করলো কিশোরকে।

বাইরে কুয়াশার মধ্যে নড়ছে কিছু। শব্দ শুনতে পেয়েছে সে।

দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা।

.

১৪.

কুইক! ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। দরজার পেছনে!

কিন্তু লুকানোর আগেই দরজায় দেখা দিলো একটা ছায়া। কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।

অ, তুমি! আমরা তো ভেবেছিলাম কে জানি! মুসাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস। ফেললো রবিন।

কি করে বুঝলে এখানে আছি? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। পিটারকে জিজ্ঞেস করেছো নাকি?

নাহ, দেখাই হয়নি। ভেতরে শব্দ শুনলাম, দরজাও খোলা। ভাবলাম, দেখি তো কে? কোথায় খুঁড়েছে দেখেছো?

মাথা নাড়লো কিশোর। না। তবে এ-বাড়ির একটা ঘর এখনও বাকি।

শেষ ঘরটারও তালা খুলে দেখলো ওরা। কিছু পেলো না।

বাইরে হালকা হয়ে এসেছে কুয়াশা। মিউজিয়ম বিল্ডিং আর ওকের জটলার মাঝের জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। কয়েকজন দর্শককে দেখতে পেলো, ব্ল্যাক ভালচারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কফি স্ট্যাণ্ডটা খোলা হয়েছে, কাউন্টারের পেছনে বসেছেন ক্যাপ্টেন। সাগরের কিনার, বেড়া আর ওকের সারির মাঝের জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো ছেলেরা।

খোঁড়ার কোনো লক্ষণই তো দেখছি না, রবিন বললো হতাশ কণ্ঠে।

হয়তো খুঁড়েছিলো, মুসা বললো। কালরাতে এসে আবার ভরে দিয়ে

 তাহলে পরিষ্কার বোঝা যেতো, বললো কিশোর। সবখানেই, তো খুঁজলাম…

বাধা দিলো রবিন, না, সবখানে নয়! টাওয়ার আর বোটহাউসের ভেতরটা এখনও বাকি!

বাঁকাচোরা পুরনো ওকের ভেতর দিয়ে তাকালো ওরা টাওয়ারের দিকে। পানির কিনারে কাত হয়ে থাকা বোট-হাউসটা দেখলো। গাছপালার ভেতর দিয়ে ভ্যান চালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে।

কিন্তু পাথরের টাওয়ারের ভেতরে খুঁড়বে কি করে? প্রশ্ন তুললো মুসা। বোটহাউসে পারা যাবে না। একটায় পাথর, আরেকটায় পানি।

তবে বোটহাউসে ভ্যান লুকানো সম্ভব, কিশোর বললো। রবিন ঠিকই বলেছে। দেখা দরকার।

দাঁড়াও, আবার বাধা দিলো রবিন। ভিকটর লোকটার মাথায় ছিট আছে। কাল আমাকে যেরকম করে ধরেছিলো! ক্যাপ্টেনকে নিয়ে আসা উচিত আমাদের।

ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো কিশোর। তা-ও বটে।

ভিকটর এখন টাওয়ারে নেই, মুসা বললো। আমি ঢোকার সময় দেখলাম। পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

চলো তাহলে, তুড়ি বাজালো কিশোর। এটাই সুযোগ।

হালকা বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো ওরা, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। কয়েকজন দর্শকের সঙ্গে কথা বলছেন। ঘড়ি দেখলেন একবার। গেটের কাছে টিকেট বুদটা খোলা রেখেছে এখনও মারিয়া। প্রথমে বোটহাউসের দিকে এগোলো ওরা। ডাঙার দিকের দরজাটা বেশ বড়, তালা নেই। দরজার ঠিক ভেতরেই কাঠের মেঝে, ভ্যান রাখা সম্ভব ওখানে। তবে টায়ারের চিহ্ন কিংবা তেলটেল পড়ে নেই। কালো পানির ওপর যেন ঠেলে বেরিয়ে আছে ডক, নৌকা বাঁধার জায়গা রয়েছে দুপাশে। একটা নৌকাও নেই। শেষ মাথায় দরজা ছিলো একসময় নৌকা ঢোকানোর জন্যে, তবে এখন এমনভাবে বসে গেছে পানিতে, ঢোকানোর আর উপায় নেই। ডকের ওপরে ছাতের কাছে। পাল রাখার জায়গা। ওখানে এখনও বেশ কিছু পাল, মাস্তুল আর দড়ি রয়েছে। ডকের নিচে কাঠের গায়ে ঢেউ ভাঙছে। সব কিছুই খুব স্বাভাবিক, মাটি খোঁড়ার চিহ্নই নেই।

টাওয়ারে যাওয়ার পথেও কোথাও খোঁড়ার চিহ্ন দেখা গেল না।

মুসা, কিশোর বললো, বনের ভেতর গিয়ে পাহারা দাও। ওয়াকি-টকি বের করে দিলো। নাও। ভিকটরকে আসতে দেখলেই হুঁশিয়ার করবে। সারাক্ষণ অন করে রাখবো আমাদের যন্ত্র।

টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে কিশোর। একতলায় দুটো দরজা আর কয়েকটা জানালা। দোতলা-তিনতলায় একটা করে খুদে জানালা। আর চারতলার প্রায় পুরোটাই কাঁচের, লাইটহাউসের মতো। জানালার মাঝে দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে আছে ইটের ধাপ, মইয়ের মতো অনেকটা, উঠে গেছে একেবারে চ্যাপ্টা ছাত পর্যন্ত।

সামনের একটা দরজায় ঠেলা দিলো কিশোর। তালা নেই। খুলে গেল। ছোট একটা লিভিং রুম দেখা গেল, গোল, ছাতটা উঠে গেছে গম্বুজের মতো গোল হয়ে। ডানে ওই একই আকারের বেডরুম, বাঁয়ে রান্নাঘর। ওখান থেকে বেরোনোর। আরেকটা দরজা আছে, ভেতর থেকে ছিটকানি লাগানো। একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে মাটিরতলার ঘরে, এক পাশের দেয়ালে তার দরজা। আরেক পাশের দেয়ালে আরেকটা দরজা, সেখানে একটা মোটা পাইপের মতো দেখা গেল, সিমেন্টের তৈরি। ভেতর দিয়ে লোহার মই। উঠে গেছে ওটা।

আগে নিচে নামি, কিশোর বললো।

রবিন কিছু বললো না। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার সেলারে। হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ড বের করলো কিশোর।

একটা মাত্র বা ঝোলানো রয়েছে ছাতে, অল্প পাওয়ারের। আলো খুব। সামান্য। তবে তাতে দেখতে অসুবিধে হয় না। নিচু ছাতওয়ালা একটা ঘরে ঢুকেছে ওরা। পাথরের দেয়াল। মেঝেটা কাঁচা, কিন্তু সিমেন্টের মেঝের চেয়ে কম শক্ত না। মসৃণ। দেয়ালে ধুলো জমে রয়েছে কতো বছর ধরে, বলার জো নেই।

এখানেও কেউ খোড়েনি, রবিন বললো।

তাই তো মনে হচ্ছে। বার বার নিরাশ হতে ভালো লাগছে না কিশোরের।

দেয়ালের ওপাশে আরেকটা ঘর আছে। স্টোররুম। তাতে পড়ে আছে। জমকালো সব আসবাবপত্র, ধুলোয় মাখামাখি। জানে পাবে না, তবু ওগুলোর তলায় উঁকি দিয়ে দেখলো দুজনে, খোঁড়ার চিহ্ন আছে কিনা।

কেউ আসেনি এখানে, রবিন বললো।

 মাথা ঝাঁকালো কিশোর। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।

পেছনে বিকট চিৎকার শুনে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো দুজনে।

দাঁড়িয়ে রয়েছে বেগুনী জলদস্যু। হাতে ভোজালি।

মিস্টার জেসন, রবিন বললো, আমরা।

কথা বললো না বেগুনী জলদস্যু। বেগুনী মুখোশের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে জ্বলন্ত চোখে। নাকের নিচে পুরু গোঁফ।

আপনি মিস্টার জেসন না? সন্দেহ হলো কিশোরের।

জবাবে ভোজালি উঁচিয়ে ছুটে এলো লোকটা। লাফ দিয়ে পাশের একটা মস্ত আলমারির ওপর গিয়ে পড়লো রবিন। কিশোর পড়লো কয়েকটা চেয়ারের ওপর। রবিনের পায়ে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে লম্বা এক টেবিলের ওপর গিয়ে পড়লো। জলদস্যু। পিছলে চলে গেল পেছনের দেয়ালের কাছে।

একটা মুহূর্ত নষ্ট করলো না দুই গোয়েন্দা। লাফ দিয়ে উঠে দিলো দৌড়। পেছনে তাকালো না একবারও, সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে এলো ওপরে। রান্নাঘরে ঢুকতেই কানে এলো মুসার কণ্ঠ, শুনছো! ভিকটর! এই শুনছো? ভিকটর এসেছে!

চোখের পলকে গিয়ে পেছনের দরজাটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিশোর। দেখলো, ছিটকানি তো আছেই, তালাও লাগানো। নিচে সেলারে পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। নিশ্চয় সিঁড়ির দিকে আসছে লোকটা। বাইরে, সামনে দিয়ে আসছে ভিকটর ইভানস।

আটকা পড়েছে দুই গোয়েন্দা। পালানোর পথ নেই।

.

১৫.

আরও হালকা হয়ে এসেছে কুয়াশা। বনের মধ্যে বসে আছে মুসা। ওয়াকি-টকি মুখের কাছে ধরা। আবার বললো সে, হুশিয়ার! ভিকটর আসছে! বেরিয়ে এসো!

জবাব এলো না।

ভিকটরের দিকে ফিরে তাকালো সে। গেট দিয়ে ঢুকে হেঁটে আসছে বনের দিকে। এখন না বেরোলে আর ভিকটরের চোখ এড়িয়ে বেরোতে পারবে না। কিশোর আর রবিন। করছে কি ওরা?

রবিন! কিশোর! হুঁশিয়ার! আবার সতর্ক করলো মুসা। জলদি বেরিয়ে এসো!

সামনের দরজাটা খুলতে আরম্ভ করলো। কিন্তু কেউ বেরোলো না। চোখ মিটমিট করতে লাগলো মুসা। তাহলে আপনাআপনিই খুলেছে, বাতাসে? না, বাতাস নয়। দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে আসছে কালো একটা বেড়াল। বেরিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসতে লাগলো। রবিন আর কিশোর বেরোলো না।

মরিয়া হয়ে উঠলো মুসা। প্রায় চেঁচাতে শুরু করলো, রবিন! কিশোর! ভিকটর…

এই, কি করেছে ভিকটর!

মুখ ফেরাতেই একেবারে লোকটার মুখোমুখি হয়ে গেল মুসা।

আবার ঢুকেছো চুরি করে! কার সঙ্গে কথা বলছো? ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।

ঢোক গিললো মুসা। কোথায় খোঁড়া হয়েছে, বের করার চেষ্টা করছি আমরা, স্যার। আমাদের ধারণা, এখানে কোথাও গুপ্তধন লুকানো রয়েছে। রবিন আর কিশোর গেছে আপনার টাওয়ারের ভেতরে খুঁজতে। আমি…আমি…

চট করে খোলা দরজার দিকে তাকালো ভিকটর। কে খুঁড়ছে?

 ওরা!

ওরা কারা?

যারা গুপ্তধন খুঁজছে।

কারা খুঁজছে, সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি! রেগে গেল ভিকটর।

মেজর নিরেক আর তার চেলারা। টনি, রিগো, গুন–সেই টাকমাথা লোকটা।

বিস্ময় ফুটলো ভিকটরের চোখে। আবার তাকালো টাওয়ারের দরজার দিকে। কোথায় খুঁড়ছে, দেখেছো?

না। সব জায়গায় খুঁজেছি আমরা, শুধু…

হঠাৎ যেন হাঁপাতে শুরু করলো মুসার ওয়াকি-টকি। এটা এক ধরনের সংকেত, কিশোর পাঠাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো, কি, কিশোর?

নিচু গলায় জবাব এলো, টাওয়ারে একটা লোক ঢুকেছে, মুসা। আমাদের হামলা করেছে। সেলার থেকে উঠে এসেছি আমরা, কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে পারছি না। পেছনের দরজায় তালা। সামনে দিয়ে বেরোতে গেলে ভিকটর দেখে ফেলবে। একটা কাজই করার আছে আমাদের, ওপরে চলে যাওয়া… থেমে গেল হঠাৎ কিশোর। পরক্ষণেই শোনা গেল তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, আসছে লোকটা! আমরা চলে যাই…

 নীরব হয়ে গেল ওয়াকি-টকি।

.

টাওয়ারের দোতলায় উঠে গেছে কিশোর আর রবিন। রান্নাঘর থেকে মই বেয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে লোকটা।

 জলদি, কিশোর বললো।

 ছোট একটা জানালা দিয়ে ম্লান আলো আসছে। সেই আলোয় দেখে দেখে মই বেয়ে নিঃশব্দে তেতলায় উঠে এলো দুজনে। আলো এখানেও খুব কম। পুরনো কয়েকটা পিপা আর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, ধুলোয় মাখামাখি। দেখে মনে হয় বেগুনী জলদস্যু। শত বছর ধরে ওভাবেই আছে ওগুলো ওখানে। দুটো বাক্সের ওপর বসলো ওরা। নিচে, দোতলায় ভারি পায়ের শব্দ হচ্ছে, নিশ্চয় ওদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকটা।

ও কে, কিশোর? ফিসফিসিয়ে বললো রবিন। নোনতা জেসন?

নোনতা জেসন আমাদের আক্রমণ করবে কেন?

তা-ও তো কথা।

কান পেতে শুনতে শুনতে হঠাৎ কিশোর বলে উঠলো, রবিন, আমার মনে হয় আমাদেরকে খুঁজছে ও! আমাদের পিছুও নেয়নি। অন্য কিছু খুঁজছে সে।

কিন্তু সেলারে তো হামলা চালালো?

চালিয়েছে। তবে আমাদের পিছু নিয়ে যায়নি। এখনও আমাদের পেছনে লাগেনি সে। ও হয়তো ভাবছেই না আমরা আছি এখানে। ভেবেছে, বেরিয়ে চলে গেছি।

মেজর নিরেক নয় তো?

মাথা নাড়লো কিশোর। না, মেজরের শরীর আরও ছোট। আর রিগো অনেক বড়। তবে অন্য দুজনের একজন হতে পারে, টনি কিংবা গুন আর ভিকটর ইভানস যে নয়, সে তো জানিই। কারণ সে বাইরে রয়েছে।

কিশোর! ওপরে আসছে!

মই বেয়ে চারতলায় উঠতে শুরু করলো দুজনে। মইটা শেষ হয়েছে একটা ট্র্যাপডোরের কাছে। ঠেলা দিতেই ওপরে উঠে গেল ওটা। ওরা বেরিয়ে এলো উজ্জ্বল রোদে। চারতলার এই ঘরটা ছোট, চারপাশে অসংখ্য জানালা। তাড়াতাড়ি ট্র্যাপডোর বন্ধ করে দিয়ে জানালার কাছে চলে এলো ওরা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খাড়িটা। ঘাটে বাঁধা রয়েছে ব্ল্যাক ভালচার। প্রথম শো শুরু হতে বেশি দেরি নেই।

কিশোর, এখানেও যদি আসে?

জানালার অনেক নিচে মাটি। টাওয়ার থেকে নেমে যাওয়ার আর কোনো পথও নেই। ঘরটায় আসবাব নেই, লুকানোর কোনো জায়গাই নেই।

 কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। ভয় ফুটলো কিশোরের কণ্ঠে।

আসছে! ও আসছে!

.

বনের মধ্যে বসে টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা আর ভিকটর। ওয়াকি টকিতে কিশোরের মেসেজের অপেক্ষা করছে।

গিয়ে দেখা দরকার, মুসা বললো।

নাম কি তোমার? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।

 মুসা। মুসা আমান।

মুসা, আমরা জানি না টাওয়ারে কে ঢুকেছে। কজন ঢুকেছে। গিয়ে হয়তো তোমার বন্ধুদেরকে আরও বিপদে ফেলে দেবো।

আ-আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। কিন্তু…

মুসা, টাওয়ারের দিকে হাত তুললো ভিকটর, ওই দেখো!

দেখলো মুসাও। টাওয়ারের ওপরতলার জানালা দিয়ে মুখ বের করেছে। কিশোর আর রবিন। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিতে গেল সে। খপ করে হাত চেপে ধরলো ভিকটর, টেনে থামালো। থামো! বিপদে ফেলে দেবে, ওদেরকে। তোমাকে দেখলেই বেস কিছু করে বসতে পারে ওরা।

বুঝলো মুসা। মাথা ঝাঁকালো। ঢোক গিললো। জানালা থেকে সরে গেছে। কিশোর আর রবিন। আবার জানালার দিকে হাত তুলে দেখালো ভিকটর, মুসাকে ছাড়েনি। মুসা দেখলো, জানালায় দেখা যাচ্ছে এখন বেগুনী জলদস্যুর মুখ। বেগুনী মুখোশ, কালো গোঁফ, পালক লাগানো বেগুনী হ্যাট, সোনালি কাজ করা বেগুনী কোট।

কো-কোথায় লুকালো ওরা! জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে যেন মুসা।

মাথা নাড়লো ভিকটর। কোথাও না, মুসা! ওখানে আলমারি-টালমারি কিচ্ছু নেই, লুকানোর কোনো জায়গাই নেই! আটকা পড়েছে ছেলে দুটো!

Super User