১১.

বাঁচাও! বাঁচাও! চেঁচাতে লাগল মুসা। দানোরা মেরে ফেলল আমাকে!

আমাকেও ধরেছে! গুঙিয়ে উঠল কিশোর। দুহাতে মেরে গায়ের ওপর থেকে সরানর চেষ্টা করল খুদে মানুষগুলোকে। আমাকে আটকে ফেলেছে!

এখনও দড়ি ধরে রেখেছে মুসা, কি ভেবে হ্যাঁচকা টান মারল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল এক দানো, দড়িটা প্রচণ্ড জোরে বাড়ি মেরেছে তার গলায়।

চমকে গেল দানোরা।

ক্ষণিকের জন্যে গায়ে চাপ কমে গেল, সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল কিশোর। ঝাড়া মেরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে চলে এল মুসার কাছাকাছি। হাতে একটা চামড়ার জ্যাকেট ঠেকতেই খামচে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল, একটানে দানোটাকে সরিয়ে আনল মুসার গায়ের ওপর থেকে, প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিল একপাশে। মেঝেতে পড়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল দানোটা।

আরেকটা দানোকে ধরে মাথার ওপরে তুলে ছুঁড়ে ফেলল মুসা।

গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা, দুজনেই মুক্ত এখন। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। কব্জি থেকে দড়ি খুলে নিয়ে গুটিয়ে আবার কোমরে ঝোলাল কিশোর।

এখন কি করা, কিশোর? হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা।

দরজা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের পেছনেই বোধহয় ওটা, এই যে এদিকে, মুসার হাত ধরে টানল কিশোর।

কয়েক পা এগোতেই দেয়াল ঠেকল হাতে। হাতড়াতে শুরু করল কিশোর। দরজার হাতলে আঙুল ঠেকতেই চেপে ধরে টান দিল। খুলল না দরজা, তালা। আটকানো।

আটকাই পড়লাম, বিষণ্ণ শোনাল কিশোরের গলা। ওভাবে এসে ঢুকে পড়াটা উচিত হয়নি, মুসা। উল্টে আমরাই ওদের ফাঁদে ধরা পড়লাম।

হ্যাঁ, কাজটা ঠিক হয়নি! তোমাকেও টেনে আনলাম এর মাঝে!

এটাই চাইছিল ওরা। যা হওয়ার হয়ে গেছে—ওই যে, শুনতে পাচ্ছ?

না শোনার কোন কারণ নেই, তীক্ষ্ণ শিস দিচ্ছে দানোরা। ডানেবায়ে দুদিকে।

আবার আক্রমণের জন্যে তৈরি হচ্ছে! চাপা গলায় বলল মুসা।

জলদি বেরোতে হবে এখান থেকে! আরও পথ থাকতে পারে।

থাকলেও অন্ধকারে খুঁজে বের করব কিভাবে?

আরে তাই তো, টর্চ! ভুলেই গিয়েছিলাম! ভয় এভাবেই আচ্ছন্ন করে মনকে…আছে, কোমরেই আছে।

মুসার টর্চও ঝোলানো আছে কোমরের বেল্টে। খুলে নিয়ে সুইচ টিপতেই অন্ধকার চিরে দিল তীব্র আলোকরশ্মি। আধ সেকেণ্ড পর কিশোরের টর্চ জ্বলে উঠল।

গায়ে আলো পড়তেই ছুটোছুটি করে লুকিয়ে পড়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল খুলে মানুষগুলো। অদ্ভুত ভাষায় চিচি করে কি সব বলছে। অনেক বেশি সতর্ক এখন রত্নদানোরা। বুঝে গেছে, সহজে ছেলেদুটোকে কাবু করা যাবে না।

থিয়েটার মঞ্চের পেছনে রয়েছে দুই গোয়েন্দা। আয়তাকার কাঠের ফ্রেমে আটকানো ক্যানভাসের বড় বড় অসংখ্য ফ্ল্যাট একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে সারি দিয়ে রাখা হয়েছে। নানারকম ছবি, সিনসিনারি আঁকা ওসব ফ্ল্যাটে। নাটক অভিনয়ের সময় দৃশ্যপট পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার হত ওগুলো। মই আর অন্যান্য কাজের জিনিস এখন পড়ে আছে অবহেলিত হয়ে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে অনেক বছর। ধরে।

বাতাসে ডানা ঝাঁপটানর শব্দ, মাথার ওপর দিয়ে শব্দ করে উড়ে গেল একটা বাদুড়।

বাদুড়! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

বাদুড়ে কামড়ায় না। চেঁচিও না অযথা। ওই যে, দেখ, দানোরা আসছে! চ্যালাকাঠকে লাঠির মত বাগিয়ে ধরে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে খুদে মানুষেরা, সেদিকে দেখাল কিশোর। এখন যাই কোথায়?

এদিকে! ছোট! বলেই দুই সারি ফ্ল্যাটের মধ্য দিয়ে ছুটল মুসা।

কিশোরও ছুটল মুসার পেছনে। হঠাৎ থেমে মইটাকে এক টান মেরে ফেলে দিয়ে আবার ছুটল। তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল এক দানো, বোধহয় গায়ের ওপর মই পড়েছে, কিংবা হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেছে ওটা। সেসব দেখার সময় নেই। এখন দুই গোয়েন্দার, ছুটছে প্রাণপণে।

 থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। সামনেও আছে দুটো! দুদিক থেকে আক্রমণের। তালে আছে!

দ্রুত এপাশ-ওপাশ দেখে নিল কিশোর। সারি দিয়ে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। আঙুল তুলে দেখাল সে, ওগুলোর ভেতর দিয়ে যাব!

জোরে লাথি মারল কিশোর। ফড়াৎ করে ছিঁড়ে গেল পুরানো ক্যানভাস। মুসাকে নিয়ে ওটার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।

একের পর এক দৃশ্যপট ছিঁড়ে আরও ভেতরে ঢুকে চলল দুই গোয়েন্দা। পেছনে দুলছে ছেঁড়া ক্যানভাস। ওপাশে রয়েছে রত্নদানোরা, ওদেরকে দেখা যাচ্ছে না এখন, তবে চেঁচামেচি কানে আসছে।

কাঠের তৈরি বিশাল মঞ্চের কাছে চলে এল দুজনে। লাফিয়ে উঠে পড়ল। তাতে। সামনে আলো ফেলল। পুরানো, ধুলোমাখা নোংরা সিটের সমুদ্র চোখে পড়ল। ওগুলোর পেছনে নিশ্চয় দরজা রয়েছে। থাকলেও খোলা না বন্ধ কে জানে!।

পেছনে হালকা পায়ের শব্দ ছুটে আসছে। ঘুরে আলো ফেলল মুসা। পৌঁছে গেছে দানোরা।

দৌড়াও! চেঁচিয়ে বলল মুসা। দুই সারির মাঝখানের পথ ধরে ঢুকে পড়ব!

মঞ্চের একপাশের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে হলের মেঝেতে নেমে পড়ল ওরা। ঠিক এই সময় জ্বলে উঠল হলের আলো, মেইন সুইচ অন করে দিয়েছে কেউ।

পেছনে তাকাল একবার কিশোর। হাতে চ্যালাকাঠ নিয়ে ছুটে আসছে দুটো খুদে মানুষ। ঝাড়বাতির রঙিন আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে দাননাদুটোকে। রত্নদানো

ছুটতে ছুটতে হাত বাড়িয়ে হঠাৎ ছাত থেকে ঝুলন্ত একটা দড়ি ধরে ফেলল এক দানো। জোরে এক দোল দিল দড়াবাজিকরের মত, চোখের পলকে উড়ে এসে পড়ল কিশোরের ঘাড়ে।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কিশোর, হাত থেকে ছুটে গেল টর্চ। খোঁজার সময় নেই, গায়ে চেপে বসেছে দানো, ওটাকে ছাড়াতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

টর্চটা একটা সিটের ওপর রেখে এগিয়ে এল মুসা। দানোর কোমড় আঁকড়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল কিশোরের ওপর থেকে, গুঁজে দিল দুটো সিটের। মাঝখানের ফাঁকে। অসহায় ভঙ্গিতে ঝুলে থেকে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল দানো, সাহায্যের জন্যে চেঁচাতে লাগল।

সঙ্গীকে সাহায্য করতে ছুটে এল দ্বিতীয় দালোটা। এই সুযোগে ছুটে গিয়ে একটা পথে ঢুকে পড়ল দুই গোয়েন্দা। ছুটল লবির দিকে।

বাইরে বেরোনর দরজার গায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজনে, ধাক্কা দিল। কিন্তু এক চুল নড়ল না বিশাল ভারি দরজা।

বাইরে থেকে তক্তা লাগিয়ে পেরেক মেরে রেখেছে! দমে গেল মুসা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। জানালা খুঁজে বের করতে হবে। কিশোর, এস।

টর্চ হাতে একপাশের করিডর ধরে ছুটল মুসা। এক সারি সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করেই পা রাখল সিঁড়িতে।

একেকবারে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকাতে লাগল দুজনে। ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পুরানো ধাচের সিঁড়ি, শেষ নেই যেন এর। কয়টা মোড় ঘুরল ওরা, বলতে। পারবে না।

সিঁড়ি শেষ হল। ব্যালকনিতে উঠে এল ওরা। জিরিয়ে নেয়ার জন্যে থামল। একধারে ঘোরানো রেলিঙ, রঙিন মখমলে ঢাকা। টর্চ নিভিয়ে সেদিকে এগোল মুসা।

রেলিঙের ওপর দিয়ে সাবধানে উঁকি দিল দুই গোয়েন্দা। অনেক নিচে হলের। মেঝেতে চারটে খুদে মূর্তি এক জায়গায় জড়ো হয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। এক সময় আরেকটা মূর্তি এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। বলিষ্ঠদেহী স্বাভাবিক একজন মানুষ।

বার্ট! আঁতকে উঠল মুসা, চাপা কষ্ঠস্বর। দানোদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বার্ট!

তাই তো দেখছি! ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। মস্ত একটা ভুল করেছি আমি, মুসা।…ওই যে, শোন।

দাঁড়িয়ে আছ কেন, চামচিকের দল! নিচে ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে বার্ট। খোঁজ, খোঁজ! বিছুদুটেন্তকধরতেই হবে! সব দরজা আটকানো, পালাতে পারবে না ওরা।

ছড়িয়ে পড়ল চারটে খুদে মানুষ।

আমরা কোথায়, বুঝতে পারছে না ব্যাটারা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের এখন। মিস ভারনিয়া জেগে উঠলেই আমাদের খোঁজ পড়বে—

ইয়াল্লা! ভুলেই গিয়েছিলাম! তাই তো, আমাদের না দেখলে পুলিশকে খবর পাঠাবেন তিনি! এ-বাড়িতে নিশ্চয় খুঁজবে পুলিশ, আশায় দুলে উঠল মুসার বুক।

ঝোঁপের ধারে আমার ক্যামেরাটা খুঁজে পাবে পুলিশ, কিশোর বলল। ফিল বের করে দেখলেই বুঝে যাবে, অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে এই এলাকায়।

 চল, কোথাও লুকিয়ে পড়ি, অধৈর্য কণ্ঠে বলল মুসা। শুনতে পাচ্ছ না, সিঁড়িতে শব্দ?

.

১২.

 পরিচিত একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল মিস ভারনিয়ার: গাঁইতি দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে কেউ! চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। হ্যাঁ, সেই শব্দ! তাঁর ঘরের ভিতের নিচে যেন মাটি কাটছে রত্নদানোরা!

ছেলেরা কি শুনতে পাচ্ছে? ওরা থাকায় ভালই হয়েছে, ভাবলেন মিস ভারনিয়া। কিন্তু কোনরকম সাড়াশব্দ নেই কেন ওদের? এখনও ঘুমিয়ে আছে।

কিশোর! মুসা! গলা চড়িয়ে ডাকলেন লেখিকা।

সাড়া এল না। উঠে গিয়ে ডেকে ওদের জাগাতে হবে, ভাবলেন মিস ভারনিয়া। বিছানা থেকে নেমে পায়ে স্লিপার গলালেন। একটা আলোয়ান গায়ে চড়িয়ে। বেরোলেন ঘর থেকে। ছেলেদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

কিশোর! মুসা! আবার ডাকলেন মিস ভারনিয়া।

কোন সাড়া নেই। অবাক কাণ্ড! দরজা খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন তিনি। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দম আটকে গেল যেন। শূন্য বিছানা!

দুরুদুরু করতে লাগল বুকের ভেতর, সারা ঘরে চোখ বোলালেন মিস ভারনিয়া। চেয়ারের হেলানে রাখা আছে মুসার পায়জামা, ভাজও খোলা হয়নি। টেবিলে পড়ে আছে ছেলেদের ব্যাগ, অথচ ওরা নেই। এর মানে? পালায়নি তো! নিশ্চয় মাটি কাটার শব্দ শুনেছে, দানোদের দেখেছে, ব্যস ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। মুসা আর কিশোর।

ঈশ্বর! আপনমনেই বিড়বিড় করলেন লেখিকা, এখন আমি কি করি!

আর থাকা যায় না এ-বাড়িতে, ভাবলেন মিস ভারনিয়া। মুসা আর কিশোরের মত ছেলেও যখন ভয় পেয়ে পালিয়েছে, তিনি আর থাকেন কোন ভরসায়? নাহ, আর থাকবেন না, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন লেখিকা।

আপাতত ববের ওখানে গিয়েই উঠবেন, ভেবে, তাকে টেলিফোন করার জন্যে নিচে নামলেন মিস ভারনিয়া। হাত কাঁপছে, ডায়াল করতে পারছেন না ঠিকমত। সঠিক নাম্বার পাওয়ার জন্যে তিনবার চেষ্টা করতে হল তাঁকে। অবশেষে রিসিভারে ভেসে এল ববের ঘুমজড়িত কণ্ঠ।

বব! ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন মিস ভারনিয়া। রত্নদানো! আবার এসেছে! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি মাটি কোপানর শব্দ! বব, আর এক মুহূর্তও এখানে না! তোমার ওখানে চলে আসছি এখুনি। কাল..হ্যাঁ,কালই বাড়ি বিক্রি করে দেব!

বাড়ি বিক্রির কথা পরে হবে, ফুফু, ঘুমের লেশমাত্র নেই আর ববের কণ্ঠে। জলদি তৈরি হয়ে নাও। আমি আসছি, এই বড় জোর দশ মিনিট।

পাঁচ মিনিটেই হয়ে যাবে আমার, রিসিভার নামিয়ে রাখলেন মিস ভারনিয়া।

ববের গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করার পর শান্ত হলেন মিস ভারনিয়া। নেতিয়ে পড়লেন গাড়ির সিটে।

.

মুসা আর কিশোরের অস্বস্তি বাড়ছে। থিয়েটারের ওপরতলায় এখন রয়েছে ওরা। লুকানর জায়গা খুঁজে পায়নি। নিতান্ত দরকার না পড়লে টর্চ জ্বালছে না। বাতাসে যেন জমাট বেঁধে আছে পুরানো ভাপসা গন্ধ। দানোরা আসছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কোনরকম সাড়াশব্দ নেই কোথাও।

সরু করিডর ধরে একটা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা, ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে ঢুকল ওরা। দরজাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে টর্চ জ্বালল মুসা।

ঘরের ঠিক মাঝখানে মস্ত বড় দুটো মেশিন বসানো রয়েছে। প্রাচীন আমলের সিনেমা-প্রোজেকটর, ধুলো-ময়লায় একাকার, মরচে পড়ে বাতিল লোহায় পরিণত হতে চলেছে।

 আরি, সিনেমাও দেখানো হত নাকি! এহ্, যা-মেশিন! মুখ বাঁকাল মুসা; মিউজিয়মে রাখার উপযুক্ত! কিশোরের দিকে ফিরল। এ-ঘরেই লুকিয়ে থাকা যাক।

বড় বেশি খোলামেলা! কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে! বিপদে পড়ব শেষে।

পড়ব মানে কি? পড়েই তো আছি। বরং বল, বিপদ আরও বাড়বে।

 চল, অন্য জায়গা খুঁজি। এখানে লুকানো যাবে না।

প্রোজেকশন রুমের পাশে একটা হলে এসে ঢুকল ওরা। ঘরের এক প্রান্ত থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ছোট একটা প্ল্যাটফরমে, ওটাতে উঠে এল দুজনে। সামনে একটা দরজার গায়ে লেখা।

মিনারেট
প্রবেশ নিষেধ।

মিনারেট! কোনরকম দানব-টানব? মুসা অবাক।

তুমি বোধহয় মাইনোটারের কথা ভাবছ? গ্রীক মিথোলজির ষড়মাথা দানব, কিশোর বলল। এটা মাইনোটার নয়, মিনারেট, টাওয়ারের ওপরের খোলা জায়গা। চল, ওখানেই উঠে পড়ি। একটা বুদ্ধি এসেছে, দরজায় ঠেলা দিল কিশোর।

লোহার পাল্লা, মরচে পড়ে শক্ত হয়ে আটকে আছে। দুজনে মিলে জোরে ধাক্কা দিতেই শব্দ করে খুলে গেল। খুব সরু একটা লোহার মই উঠে গেছে দরজার ওপাশ থেকে। মই বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা।

মিনিটখানেক পরে টাওয়ারের চারকোনা একটা খোলা জায়গায় এসে উঠল। ওরা। অনেক নিচে রাস্তা, নির্জন, শুধু পথের ধারের লাইটপোস্টগুলো প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে।

মিনারেটে তো উঠলাম, বলল মুসা, এবার? এখান থেকে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আরও ভালমত আটকা পড়লাম।

আটকা আর পড়লাম কোথায়? পথের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। নিচেই রাস্তা, ওখানে কোনমতে নেমে যেতে পারলেই হল। মাত্র পঁচাত্তর ফুট।

মাত্র পঁচাত্তর ফুট! লাফিয়ে নামব নাকি?

কেন, সঙ্গে দড়ি আছে না? দড়ির বাণ্ডিল খুলে নিল কিশোর। পাকিয়ে মোটা করে নিয়েছিলাম। পাক খুললেই অনেক লম্বা হয়ে যাবে। হলেও তোমার ডবল ওজন সইতে পারবে।

আমার? আমার কেন? তোমার নয় কেন?

কারণ, তোমার মত ভাল অ্যাথলেট নই আমি, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আমি চেষ্টা করলে বড় জোর পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙতে পারি, এর বেশি কিছু। করতে পারব না, কিন্তু তুমি নিরাপদে নেমে যেতে পারবে। ওই যে, অনেক শিক বেরিয়ে আছে। ওগুলোর কোনটায় দড়ি বেঁধে দিচ্ছি, নেমে গিয়ে পুলিশ ডেকে নিয়ে। এস। মিস ভারনিয়ার জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।

 দ্রুত দড়ির পাক খুলে ফেলল কিশোর।

টেনেটুনে দড়িটা দেখল মুসা। বেশি সরু, পিচ্ছিল। ধরে রাখাই মুশকিল। হবে। হাতে কেটে বসে যাবে।

যাবে না। দস্তানার তালুতে চামড়া রয়েছে, সহজে কাটবে না। হাতের কব্জিতে এক পাক দিয়ে ঝুলে পড়কে দড়ি ধরে, তারপর আস্তে আস্তে ছাড়লেই সরসর করে। নেমে যেতে পারবে।

হাতে দড়ি পেঁচিয়ে টেনেটুনে দেখল মুসা। মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ, পারব মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা কথার জবাব দেবে?

কি? শিকে দড়ি বাধছে কিশোর।

রত্নদানো আমরা সত্যি দেখলাম তাহলে?

খুদে মানুষ দেখলাম, মুখ তুলল কিশোর। আমি একটা আস্ত গাধা! আমার ধারণা ছিল, মিস ভারনিয়াকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানর চেষ্টা করছে ওরা, যাতে উনি বাড়ি বিক্রি করে দেন। বুঝতেই পারিনি সত্যি সত্যি গুপ্তধনের জন্যে মাটি খুঁড়ছে। ওরা।

গাধা! অযথা গালমন্দ করছ নিজেকে। তুমি কেন, কেউই বুঝতে পারত না। তখন, মিস ভারনিয়ার বাড়ির তলায় গুপ্তধন খুঁজছে দানোরা।

মিস ভারনিয়ার বাড়ির তলায় নয়, মুসা এখনও বুঝতে পারছে না দেখে বিরক্ত হল কিশোর। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের গুপ্তধন কোথায়?

হবে হয়ত, পাহাড়ের তলায় কোথাও!

তোমার মাথা! কেন, ব্যাংকটা চোখে পড়ে না?

ব্যাংক? বোকা হয়ে গেছে যেন মুসা। মানে?

হাল ছেড়ে দিল কিশোর, এত কথা বলার সময় নেই এখন। যাও, নাম। যে কোন সময় ব্যাটারা এসে পড়তে পারে। সাবধান, বেশি তাড়াহুড়ো কোরো না।

কিশোর যেভাবে বলেছে ঠিক সেভাবে নামা সম্ভব হল না, দড়ি ধরে ঝুলে বাঁকা হয়ে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে নামতে লাগল মুসা। নিচের দিকে তাকাল না একবারও।

অর্ধেকটা মত নেমেছে মুসা, এই সময় ওপরে চিৎকার শুনল। একবার গুঙিয়ে উঠল কিশোর, তারপরেই চুপ হয়ে গেল। ধড়াস করে এক লাফ মারল মুসার হৃৎপিণ্ড। কিশোরকে কি ধরে ফেলেছে:-প্রচণ্ড জোরে দড়িতে নাড়া লাগল, আরেকটু হলে হাতই ছুটে গিয়েছিল মুসার। শক্ত করে দড়ি আঁকড়ে ধরল সে।

এই যে, বিচ্ছু! শোনা গেল বার্টের কর্কশ গলা। নিচে নামছ। হ্যাঁ, তোমাকে বলছি।

ঢোক গিলল মুসা। আবার নাড়া লাগল দড়িতে। প্রাণপণে দড়ি ধরে রইল সে। ব-বল!

উঠে এস।

নিচে নামছি তো! নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনাল মুসার কথা।

হঠাৎ নেমে যাবে কিন্তু! ধমকে উঠল বার্ট। দড়ি কেটে দেব।

নিচে তাকাল মুসা। আর বড় জোর তিরিশ ফুট বাকি, ঘাস থাকলে লাফিয়ে পড়তে পারত। কিন্তু কংক্রিটে বাঁধানো কঠিন পথ, দুই পায়ের হাড় কয়েক টুকরো হয়ে যাবে এখান থেকে লাফ দিলে।

কি হল, বিচ্ছু? নড়ছ না কেন? তিন পর্যন্ত গুনব, তারপর দেব দড়ি কেটে!

দাঁড়াও দাঁড়াও, গোনার দরকার নেই! চেঁচিয়ে বলল মুসা। আমি উঠে আসছি। দড়ি পিছলে যেতে চায়, শক্ত করে ধরে নিই।

ঠিক আছে। কিন্তু কোনরকম চালাকি চাই না।

একটা বুদ্ধি এসেছে মুসার মাথায়। তেমন কিছুই নয়, তবে এতে কাজ হলেও হতে পারে। ডান হাতে দড়ি ধরে ঝুলে থেকে দাঁতে কামড়ে ডান হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। পকেট হাতড়ে নীল চক, বের করে ময়লা দেয়ালে বড়সড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকল। নিচে ফেলে দিল বাকি চকটা।

আরে অই, বিচ্ছ! অধৈর্য হয়ে পড়েছে বার্ট। উঠছ না কেন? দেব নাকি দড়ি কেটে?

এই যে আসছি, আসছি!

নামার চেয়ে ওঠা অনেক বেশি কঠিন। অনেক কষ্টে মিনারেটের কাছাকাছি উঠে এল মুসা। তাকে ধরে তুলে নিল দুটো বলিষ্ঠ হাত।

বার্ট ছাড়াও আরও দুজন রয়েছে মিনারেটে, কিশোরকে চেপে ধরে রেখেছে। দুদিক থেকে।

মুসার পিঠে কনুই দিয়ে গুতো মারল বার্ট। আগে বাড়।

অনেক সিঁড়ি, অনেক মোড়, গলিঘুজি আর করিডর পার করে নিচের তলার একটা ঘরে নিয়ে আসা হল দুই গোয়েন্দাকে। কংক্রিটের এবড়োখেবড়ো দেয়াল, একপাশে বড় বড় দুটো মরচে-পড়া বয়লার পড়ে আছে। থিয়েটারের হল রুম গরম রাখার কাজে ব্যবহৃত হত নিশ্চয় ওগুলো, ভাবল মুসা।

একপাশের দেয়ালে কয়েকটা বন্ধ দরজা। প্রথম দরজাটার গায়ে লেখা: কোল বিন নং ১, তারপরে কোল বিন নং ২, এবং কোল বিন নং ৩। রঙ চটে গেছে, কোনমতে পড়া যায় শব্দগুলো। মুসা বুঝল, ওগুলো কয়লা রাখার ঘর।

এক নাম্বার ঘরের দরজা খুলে ছেলেদেরকে ভেতরে ঠেলে দিল বার্ট।

বিস্ময়ে ঘোঁৎ করে উঠল মুসা। এক কোণে বসে তাস খেলছে সেই চার রত্নদানো। একবার চোখ তুলে চেয়েই আবার খেলায় মন দিল ওরা। অনেকগুলো কোদাল, গাঁইতি আর শাবল ফেলে রাখা হয়েছে এক ধারে মেঝেতে কয়েকটা বড় বৈদ্যুতিক লণ্ঠনও আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হল মুসা কংক্রিটের দেয়ালে। একটা কালো ফোকর দেখে। নিশ্চয় মাটির নিচে রয়েছে দেয়ালের ওই অংশ, কারণ ফোকরটার ওপাশে কালো সুড়ঙ্গমত দেখা যাচ্ছে।

দ্রুত চিন্তা চলেছে মুসার মাথায়। তার মনে হল, সুড়ঙ্গটা গেছে মিস ভারনিয়ার। বাড়ির দিকে। নাকি বাড়ির তলা দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে? চকিতে বুঝে গেল কিশোরের কথার মানে, গুপ্তধনের সন্ধানে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে—ব্যাংক–হ্যাঁ, ব্যাংকে গুপ্ত রইয়েছে এই ধন!

কয়েকজন লোক আর ওই চারটে অদ্ভুত জীব আসলে ডাকাত। ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে ওরা!

.

১৩.

কংক্রিটের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একগাদা বস্তার ওপর বসেছে মুসা আর কিশোর। দুজনেরই হাত-পা বাঁধা। মুখ খোলা, ইচ্ছে করলে কথা বলতে পারে, কিন্তু কথা বলার প্রবৃত্তি হচ্ছে না কিশোরের।

ডাকাতদের কাজকর্ম দেখছে মুসা। বার্টকেই নেতা বলে মনে হচ্ছে, অন্য দুজন, জিম আর রিক তার সহকারী। বেঁটে বলিষ্ঠদেহী লোকটার নাম জিম। রিকের ইয়া বড় গোঁফ, রোগাটে শরীর, কথা বললেই লণ্ঠনের আলোয় ঝিক করে উঠছে ওপরের পাটির একটা সোনায় বাধানো দাঁত।

কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। বার্ট ব্যাংক ডাকাত, না? মিস্টার রবার্টের নাইটগার্ডের কাজ নিয়েছে সে ইচ্ছে করেই, ডাকাতি করার জন্যে।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ, নিচু গলায় বলল কিশোর। শুরুতেই ব্যাপারটা বোঝা। উচিত ছিল আমার। দুটো গুরুত্বপূর্ণ সূত্রও ছিল। গাঁইতি দিয়ে মাটি কোপানর শব্দ আর কাছেই একটা ব্যাংক। অথচ কি করলাম? গাধার মত রত্নদানোর দিকে নজর দিয়ে বসলাম।

তোমার কি দোষ? সান্তনা দিল মুসা। স্বয়ং শার্লক হোমসও আগে থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারত না। চমৎকার বুদ্ধি করেছে ব্যাটারা! রহদানোর দিকে নজর ফিরিয়ে রেখেছে আমাদের, বুঝতেই দেয়নি আসল কথা। আচ্ছা, কিশোর, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, দানো ব্যাটারা তাস খেলছে, ওদিকে তিন ডাকাত কাজ করতে করতে ঘেমে উঠেছে।

সুড়ঙ্গ খোঁড়ার জন্যে ডাকা হয়নি ওদেরকে, ক্ষোভ প্রকাশ পেল কিশোরের কথায়। ওদেরকে ভাড়া করা হয়েছে মিস ভারনিয়াকে ভয় দেখানর জন্যে, যেন তার কথা লোকে বিশ্বাস না করে সেজন্যে।

অ-অ, বুঝেছি। কিন্তু রত্নদানোদের খোঁজ পেল কি করে বার্ট, আনল কোত্থেকে? ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে?

হায়রে কপাল! হতাশ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল কিশোর। ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে আমদানি করতে যাবে কেন? ওদেরকে আনা হয়েছে রূপকথার পাতা থেকে। আঙিনায় ব্যাটাদেরকে নাচতে দেখেই সেটা অনুমান করেছিলাম।

কিশোরের কথা আরও দুর্বোধ্য লাগল মুসার কাছে, কিন্তু বকা শোনার ভয়ে আর প্রশ্ন করল না, চুপ করে ভাবতে লাগল। মিস ভারনিয়ার লেখা বইয়ের পাতা থেকে? কি মানে এর?

ডাকাতদের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথা কাটা চলছে এখন। আলগা মাটি ঝুড়িতে করে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে সুড়ঙ্গমুখের বাইরে।

আর মাত্র ফুট দশেক, রিক, জিমকে বলতে শুনল মুসা।

ওই দশ ফুটেই তো জান বের করে ছাড়বে! বলল রিক।

মাটি ফেলতে এসেছিল, ঝুড়ি নিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেল দুজনে।

আরেকটা প্রশ্ন জাগল মুসার মনে। কিশোর-.. বলতে বলতেই থেমে গেল সে। বস্তার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে গোয়েন্দাপ্রধান। ঘুমিয়ে পড়েছে।

দেখ কাণ্ড কিশোরের!অবাক হয়ে ভাবল মুসা। কোথায় মগজ খাঁটিয়ে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করবে, তা না, ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপরই মনে হল মুসার, সামনে রাতের অনেকখানি পড়ে আছে। পালানর চেষ্টা করতে হলে শক্তি সঞ্চয় করা দরকার তাদের। যেইমাত্র সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষ হবে, ব্যাংকের ভল্ট থেকে। টাকা নিয়ে পালাবে ডাকাতেরা। ততক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারলে মন্দ কি? ঠিক কাজই। করেছে কিশোর।

মুসাও শুয়ে পড়ল। মন থেকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতেই ঘুম এসে গেল তার চোখেও।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, বলতে পারবে না মুসা, কিন্তু এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীরটা। তবে হাত-পায়ের যেখানে যেখানে দড়ি বাধা, সেখানে টনটন করছে।

কাছেই কথা বলছে কেউ। উঠে বসে ফিরে চেয়ে দেখল মুসা, কিশোরের হাতে। এক কাপ সুপ। তার পাশে একটা বাক্সের ওপর বসে আছে বার্ট। কিশোরের চেহারায় কেমন একটা খুশি খুশি ভাব।

মাটি কোপানর শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর, বোধহয় সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষ হয়ে গেছে। ঘরের কোণে বসে স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে রত্নদানোরা। রিক আর জিমকে দেখা। যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গের দিকে তাকাতেই মোটা বৈদ্যুতিক তারটা চোখে পড়ল মুসার, সাপের মত একেবেঁকে ঢুকে গেছে সুড়ঙ্গের ভেতরে। মোটরের আবছা গুঞ্জন কানে। আসছে। ও, বোঝা গেছে, মেশিন দিয়ে ভল্টের কংক্রিটের দেয়ালে ছিদ্র করছে জিম। আর রিক।

গুড মর্নিং, মুসা, হেসে বলল কিশোর। ঘুম ভাল হয়েছে তো?

হা হা, নিশ্চয়, স্বপ্নে এক রাজকুমারীকে বিয়েও করে ফেলেছি। ব্যঙ্গ ঝরল মুসার কথায়। এই বিপদের সময়ে কিশোরের হাসি আসছে কিভাবে বুঝতে পারছে না সে। কিশোরের কাপের দিকে আবার চোখ পড়তেই স্বর নরম করে ফেলল, কিশোর, আর কাপ নেই? মানে, সুপ দেয়া হবে না আমাকে?

মুসার কথার ধনে হো হো করে হেসে উঠল বার্ট। মুসাকেও এক কাপ সুপ দিল। বিচ্ছু ছেলে! তবে এখানে আর ইবলিসগিরি করতে পারবে না, ভালমত আটকেছি।

তোমরাও কম ইবলিস নাকি? যেন ঘরোয়া আলাপ-সালাপ করছে কিশোর, এমনি ভাব। প্রথমে তো পুরো বোকা বানিয়ে দিয়েছিলে আমাদেরকে। আঙিনায় তোমার পাঠানো দানাগুলোকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম, ওটা ববের কাজ। ফুফুকে ভয় পাইয়ে বাড়ি থেকে তাড়ানর জন্যে ওই ফন্দি করেছে। তারপরে, ওরা যখন থিয়েটারের ভেতরে এসে ঢুকল, তখন বুঝলাম আসল ঘটনাটা।

আরেকটু হলেই দিয়েছিলে আমাদের বারোটা বাজিয়ে, দুআঙুলে চুটকি বাজাল বার্ট। পুলিশ তো প্রায় নিয়েই এসেছিলে, মুসার দিকে ফিরে বলল, চেহারা হাবাগোবার মত করে রাখলে কি হবে, ভীষণ চালাক তোমার বন্ধু। তবে এই অভিনয়টা খুব কাজে লাগবে। লোকে সন্দেহই করতে পারবে না। ওকে আমি ভালমত ট্রেনিং দিয়ে দেব। দশ বছরেই দুনিয়ার সেরা ক্রিমিন্যাল হয়ে উঠবে ও।

ধন্যবাদ, ক্রিমিন্যাল হতে চাই না আমি, মোলায়েম গলায় বলল কিশোর। ক্রিমিন্যালদের পরিণতি খুব খারাপ হয়।

বলে কি ছেলে! আরে, খোকা, তুমি জান, কার সঙ্গে কথা বলছ? দেশের সবচেয়ে ঝানু ক্রিমিনালদের একজনের সঙ্গে। মাথায় ঘিলু থাকলে সারা জীবন। অপরাধ করে বেড়াতে হয় না। প্রচুর পরিশ্রম করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ভালমত একটা দান মেরে দিতে পারলেই বাকি জীবন বসে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে। আমার সঙ্গে থাকতে না চাইলে কি আর করব? খারাপ কাজটাই করতে হবে আমাকে।

বার্টের কথার মানে বুঝতে পারল না মুসা, কিন্তু কেন যেন শিরশির করে উঠল তার মেরুদণ্ডের ভেতরটা।

অনেক কথা জানার আছে মুসার, তাড়াতাড়ি বলে উঠল কিশোর। মিস্টার বার্ট, এই ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা কি করে করলেন, খুলেই বলুন না সব ওকে।

নিশ্চয়, নিশ্চয়, সুপের জগ তুলল বার্ট। আরেক কাপ নেবে?

আমার আর লাগবে না। মুসাকে দিন।

মুসার কাপ ভরতি করে সুপ ঢেলে দিল বার্ট। হ্যাঁ, গোড়া থেকেই বলি, জগ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল সে। এই ব্লকের পাশের ব্লকটাতেই আমার বাড়ি। বছর চল্লিশেক আগে মিস ভারনিয়ার এক রত্নদানে ছিলাম আমিও। দাঁত বের করে। হাসল বাট। আমাকে দানো কল্পনা করতে কেমন লাগছে? প্রশ্নের জবাবের। অপেক্ষা না করেই বলল, হপ্তায় একবার করে পাড়ার যত ছেলেমেয়েকে নিয়ে পার্টি দিত মিস ভারনিয়া। আইসক্রীম খাওয়াত, কেক খাওয়াত, তারপর তার বই থেকে গল্প পড়ে শোনাত।

বার্টের কাছে জানা গেল, তার বাবা ছিল রাজমিস্ত্রী, এই মূরিশ থিয়েটার আর পাশের ব্যাংকটা বানাবার সময় এখানে কাজ করেছিল। বাবার কাছেই ব্যাংকের ভল্টের কথা শুনেছে বার্ট। ওটার দরজা ইস্পাতের, কিন্তু দেয়াল তৈরি হয়েছে কংক্রিট দিয়ে। মাটির অনেক গভীরে তৈরি হয়েছে ভল্ট, তাই ইস্পাতের দেয়াল দেয়ার কথা ভাবেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এই সুযোগটাই নিয়েছে বার্ট।

ওরা ভাবেনি, কিন্তু আমি ভেবেছি, বলল বার্ট। ইচ্ছে করলেই ওই ভল্ট থেকে টাকা লুট করা যায়। মিস ভারনিয়ার ভাড়ার থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু করলে মাটির তলা দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় ভল্টের কাছে। তারপর কংক্রিটের দেয়াল ভেঙে ফেলাটা কোন কাজই না।

তখন এই এলাকায় ভাঙচুর শুরু হয়েছে। বসতবাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছে লোকে। আমি ভাবলাম, মিস ভারনিয়াও চলে যাবে, কিন্তু গেল না সে। অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে উঠলাম। এই সময়েই একদিন শুনলাম, থিয়েটার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মালিকানা হাত বদল হয়ে গেছে। নতুন আইডিয়া এল মাথায়। থিয়েটার-হাউসের নিচতলার কোন একটা ঘর থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মিস। ভারনিয়ার বাড়ির নিচ দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ব্যাংকের ভল্টে। তখুনি কাজে লেগে যেতাম, কিন্তু একটা অপরাধের জন্যে ধরা পড়লাম পুলিশের হাতে, কয়েক বছর জেল হয়ে গেল।

জেলে বসে একের পর এক প্ল্যান করেছি। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কাজে নেমে পড়লাম। খুঁজে খুঁজে লোক জোগাড় করে একটা দল গড়লাম। থিয়েটার হাউসে তখন দুজন নাইটগার্ড। রাতে বিচিত্র শব্দ করে ভয় দেখিয়ে ওদেরকে তাড়ালাম। নতুন নাইটগার্ড দরকার মিস্টার রবার্টের। তার কাছে গিয়ে চাকরি চাইতেই চাকরি হয়ে গেল।

কি করে রাতের পর রাত দুই সঙ্গীকে নিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে বার্ট, সব বলল। আলগা মাটি ঝুড়িতে করে বয়ে এনে ফেলেছে কয়লা রাখার ঘরগুলোতে। কয়লার ঘরে কয়লা কিংবা জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে, ভাবেনি মিস্টার রবার্ট, তাই ওই ঘরগুলোতে ঢোকেনি। ফলে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি তার।

অ। মিস্টার রবার্ট তাহলে নেই এসবে, বলল কিশোর। আমি ভেবেছিলাম সে-ও জড়িত।

না, সে নেই এতে। একমাত্র সমস্যা হল মিস ভারনিয়াকে নিয়ে। রাতে মাটি কোপানর শব্দ তার কানে যাবেই। পুলিশকে গিয়ে বলে দিতে পারে। তাই কয়েকটা। রত্নদানো আমদানি করতে হল। পুলিশকে বলল মিস ভারনিয়া, রাতে রানোরা মাটি কোপায়। তার কথা হেসেই উড়িয়ে দিল পুলিশ। আর বেশি চাপাচাপি করলে হয়ত মানসিক হাসপাতালেই পাঠাত, হা হা করে হাসল বার্ট। ভাবলাম, এরপর ভয়ে বাড়ি ছেড়ে দেবে মিস ভারনিয়া। ভয় পেল ঠিকই, কিন্তু বাড়ি ছাড়ল না। তোমাদের সাহায্য চেয়ে বসল। আমার সবকিছু প্রায় ভেস্তে দিয়েছিলে তোমরা, অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি।

যদি মিস ভারনিয়ার ভাইপো বব বিশ্বাস করে বসত? প্রশ্ন রাখল কিশোর। যদি সে রাতে ফুফুর বাড়িতে থাকত, মাটি কোপানর শব্দ শুনত? দুজনের কথা হেসে উড়িয়ে দিতে পারত না পুলিশ।

 মিটিমিটি শয়তানি হাসি হাসল বার্ট। এত কাঁচা কাজ কি আমি করি? ববের সঙ্গে আগেই ভাব করে নিয়েছি।

ভাব বুঝতে পারছে না মুসা।

হ্যাঁ। ওকে বলেছি, মিস্টার রবার্ট মিস ভারনিয়ার বাড়িটা কিনতে চায়, কিন্তু মহিলা বেচতে রাজি নয়। তাই ভয় দেখানর ছোট্ট একটা ব্যবস্থা করেছে মিস্টার। রবার্ট। বব যেন তার ফুফুকে সাহায্য না করে, এমন ভাব দেখায়, যেন ফুফুর মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। বুবু তো এক পায়ে খাড়া। ফুফু বাড়ি বেচলে তার লাভ। পটিয়ে মোটা টাকা নিয়ে নিতে পারবে ফুফুর মৃত্যুর আগেই। হাসল বার্ট।

ইয়াল্লা, কিশোর। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বব সত্যিই তাহলে আছে এর। মাঝে!

আগেই সন্দেহ করেছ নাকি তোমরা? ভুরু কোঁচকাল বার্ট। চালু ছেলে। আবার বলছি, আমার দুলে চলে এস। পুলিশের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিতে পারব আমরা। তাহলে।

কিন্তু… চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে। ভয় পেয়ে গেল মুসা, সুপার ক্রিমিন্যাল হওয়ার লোভ না আবার পেয়ে বসে গোয়েন্দাপ্রধানকে। তার ভয়কে সত্য প্রমাণ। করার জন্যেই যেন কিশোর বলল, ঠিক আছে, আরও ভেবে দেখতে হবে আমাকে। সামান্য সময় দরকার।

আরে নিশ্চয়, নিশ্চয় সময় দেয়া হবে, হেসে বলল বার্ট। যাই দেখি, জিম আর রিক কতদূর কি করল।

যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল বার্ট, ডেকে তাকে ফেরাল মুসা। একটা কথা। ওই রত্নদানো আমদানি করা হল কোত্থেকে? মানুষের কথা শুনতে রাজি হল কি করে। ওরা?

শব্দ করে হাসল বার্ট। সেটা ওদেরকেই জিজ্ঞেস কর। হাত তুলে ডেকে। বলল, এই, বিচ্ছুরা, এদিকে এস। তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে চায় এরা, বলে আর দাঁড়াল না।

উঠে দাঁড়াল একটা দানো। লাল জ্বলজ্বলে চোখ, ময়লা দাড়ি। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেলেদুলে হেঁটে এসে দাঁড়াল সে ছেলেদের সামনে। কি হে, ইবলিসেরা, কি বলবে? এহ, মেলা জালান জ্বালিয়েছ। হাতটা প্রায় ভেঙেই দিয়েছিলে আমার। কিন্তু মাপ করে দিয়েছি, জানি তো কপালে অনেক দুঃখ আছে তোমাদের। লম্বা। সাগরপাড়ি দিতে হবে।

ভাল ইংরেজি বলে দানোটা। স্লান আলোয় যতখানি সম্ভব ভাল করে ওটাকে দেখল মুসা। লাল চোখ, চোখা রোমশ কান, কুচকুচে কালো রোমশ বড় বড় হাত, পৃথিবীর ওপরে থাকলে এই জীব মানুষের অগোচরে থাকতে পারত না কিছুতেই। মাটির তলায় লুকিয়ে থাকে বলেই লোকের চোখে পড়ে না।

তুমি কি সত্যিই রত্নদানো? জিজ্ঞেস করল মুসা।

হাসল দানোটা। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, না? টান দিয়ে রোমশ একটা কান খুলে আনল সে। অবাক হয়ে দেখল মুসা, কানটা নকল, আসল কানের ওপর। বসানো ছিল।

 এরপর টান মেরে রোমশ বিশাল একটা হাত খুলে আনল দানো। বেরিয়ে পড়ল ছোট একটা হাত, বাচ্চাছেলের হাতের চেয়েও ছোট। আসল পাটির ওপর থেকে খুলে আনল নকল দাঁত। তারপর চোখে হাত দিল। সাবধানে এক চোখের ওপর থেকে সরাল পাতলা একটা জিনিস। হেসে বলল, দেখলে তো, খোকা, লাল। চোখও নেই, চোখা দাঁতও নেই। লোকটার একটা চোখের মণি এখন স্বাভাবিক নীল। চোখের ওপর থেকে সরানো জিনিসটা দেখিয়ে বলল, টিনটেড কনট্যাক্ট লেন্স। নাকে আঙুল ছোঁয়াল। নকল নাক। দাড়িতে হাত দিল, নকল দাড়ি। রত্নদানোর ছবি দেখে তৈরি করা হয়েছে প্রতিটা জিনিস। আসলে আমি একজন। বামন, খোকা।

অনুমান করেছি, বলল কিশোর! তবে দেরিতে।

হ্যাঁ, বড্ড দেরি করে ফেলেছ। আজ আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আগামীকাল রোববার, সোমবারের আগে কেউ কিছু জানতে পারবে না।

মিস ভারনিয়া আমাদেরকে না দেখলে পুলিশে খবর দেবেন, গলায় জোর পাচ্ছে না কিশোর।

দেবে না, মাথা নাড়ল বামন। এতক্ষণে তার ভাইপোর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। কাঁচা কাজ করি না আমরা, খোকা। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার আগে কেউ জানতেই পারবে না ব্যাংকটা লুট হয়েছে।

কপালে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে মুসার। কিছু একটা বলতে মুখ খুলল, কিন্তু বলা হল না, ঘরে এসে ঢুকল বার্ট। ভল্টে ঢোকার পথ হয়ে গেছে। বামনদের সর্দারকে বলল, তুমি এখানে থাক। অন্য তিন বামনকে দেখিয়ে বলল, ওদেরকে নিয়ে ভল্টে যাচ্ছি আমি, কাজ আছে।

আমিও সঙ্গে আসব? কিশোর জিজ্ঞেস করল। কি করে কাজ সারেন। আপনারা, দেখতে ইচ্ছে করছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এস। কাজ দেখার পর ভক্তি এসেও যেতে পারে। হয়ত তখন আমাদের দলে যোগ দিতে আর দ্বিধা থাকবে না।

কিশোরের পায়ের বাধন কেটে দেয়া হল। বার্ট আর তিন বামনের পিছু পিছু সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকল সে। মুসা বসে রইল আগের জায়গায়।

খুব বোকা বানিয়েছি তোমাদের! হাসল বামনটা। জানালায় টোকা দিলাম, যাতে আমার দিকে ফিরে চাও। জানতাম তাড়া করবে, করলেও, থিয়েটার হাউসে তোমাদেরকে নিয়ে আসতে কোন অসুবিধে হল না।

কিন্তু এখানে আনার কোন দরকার ছিল? জিজ্ঞেস করল মুসা।

ছিল। মাটি খোঁড়ার শব্দ শুনে সন্দেহ জাগতই তোমাদের, পুলিশ ডেকে নিয়ে আসতে হয়ত। অহেতুক কেন ঝুঁকি নিতে যাব? তার চেয়ে তোমাদেরকে আটকে ফেলাটাই কি ভাল হয়নি?

কিন্তু তাতেই কি ঝুঁকি চলে গেল? পুলিশ কি পরেও ধরতে পারবে না তোমাদেরকে? বামনদের সহজেই খুঁজে বের করা যাবে। পুলিশকে গিয়ে সব বলব আমরা, তারা তোমাদেরকে খুঁজে বের করবেই।

যদি গিয়ে বলতে পার তবে তো? রহস্যময় হাসি হাসল বেঁটে মানুষটা। আর পুলিশ এলেই বা কি? ওটা হলিউড, ওখানে ছবি বানানো হয়।

তাতে কি?

তাতে অনেক কিছু। সারা দুনিয়ায় যত বামন আছে, তার অর্ধেক রয়েছে ওই হলিউডে। ওখানকার অনেকেই সিনেমা কিংবা টেলিভিশনে অভিনয় করে, ডিজনিল্যাণ্ডে কাজ করে। বেকারও রয়েছে অনেক। আমিও বেকার, বামনদের একটা বোর্ডিং হাউসে থাকি। ওখানে আরও তিরিশ-বত্রিশ জন থাকে। বেকারদেরও পেট আছে, তাদেরও বাঁচতে ইচ্ছে করে, তাই সব সময়ই নানারকম কাজের ধান্ধায় থাকি আমরা। লোকের বাড়ির স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে কিংবা জানালা খুলে ঢুকে যাই ভেতরে, টুকটাক জিনিস নিয়ে কেটে পড়ি। বড় ধরনের কাজও মিলে যায়। মাঝে মাঝে, এখন যা করছি। আকার ছোট হওয়ায় আমাদের অনেক সুবিধে। এমন অনেক কাজ আমরা অনায়াসেই করতে পারি, স্বাভাবিক মানুষ যা পারে না।

স্বাভাবিক মানুষ আমাদের সম্পর্কে যা খুশি ভাবে ভাবুক, কিন্তু আমরা সুখেই। আছি। এক বোর্ডিং হাউসে অনেকে মিলে এক পরিবারের মত থাকি, কেউ কারও বিরুদ্ধে কিছু করি না। বাইরের কেউ আমাদের কারও সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে এলে আমরা কেউ কিছু জানি না, কিছু দেখিনি, শুনিনি, কিছু অনুমান করতে পারি না। নকল কানটা আবার জায়গামত বসিয়ে দিল বামনটা। কাজেই আমাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে না পুলিশ। তোমরাও আমাদের আসল চেহারা দেখনি, চিনিয়ে দিতে পারবে না। উঠে দাঁড়াল সে।যাই, দেখি, ওদিকে কদ্দূর হল। সুড়ঙ্গে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল বামনটা।

কংক্রিটের দেয়ালের বাইরে একটা গুহায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। দেয়ালে একটা ফোকর করা হয়েছে, ছোট একটা ছেলে ঢুকতে পারবে ওই পথে। দরদর করে ঘামছে শ্রান্ত জিম আর রিক। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে।

ফোকরটা আরও বড় করা যায়, বার্টের দিকে ফিরে বলল জিম। কিন্তু তাতে সময় লাগবে। তাছাড়া দরকার কি? বামনরা তো ঢুকতে পারবে এর ভেতরে।

হ্যাঁ, তা পারবে, এক বামনকে ইশারা করল বার্ট।

একের পর এক বামন ঢুকে গেল ভল্টে। ওদের টর্চের আলোয় চারকোনা একটা ঘর দেখা গেল। দেয়ালের তাকে থরে থরে সাজানো রয়েছে কাগজের নোট, গহনার বাক্স। মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে মুদ্রার বস্তা।

দশ লাখ ডলারের বেশি! নোটগুলোর দিকে চেয়ে আছে বার্ট, জ্বলছে চোখের তারা। সোমবার অ্যারোপ্লেন কোম্পানির বেতনের দিন। তাই হেড অফিস থেকে এত টাকা তুলে এনে রাখা হয়েছে। কিশোরকে জানাল সে।

গভীর আগ্রহ নিয়ে বামনদের কাজ দেখছে কিশোর। তাক থেকে নোটের তাড়া নামিয়ে ছোট ছোট বস্তায় ভরল ওরা। অলঙ্কারের বাক্সগুলো ভরল আলাদা একটা বস্তায়।

পয়সার বস্তা নিয়ো না, বামনদেরকে বলল জিম। বেশি ভারি।

 শুধু দুটো বস্তা নিয়ে এস, হাত নাড়ল বার্ট। দরকার আছে।

নোট আর গহনার বস্তা এপাশে পাচার করে দিল বামনরা। মুদ্রার ভারি বস্তা পার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল। ভল্ট থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

ঝুড়িতে বস্তাগুলো সব তুলে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল সুড়ঙ্গের বাইরে, কয়লা রাখার ঘরে। একটা বস্তা খুলে নোটের বাণ্ডিল বের করল বার্ট। বামন সর্দারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নাও, এক লাখ। চারজনে ভাগ করে নিয়ো। সাবধানে খরচ কোরো, নইলে বিপদে পড়বে। যাও এখন। তোমাদের কাজ শেষ। আমরাও এখুনি যাব।

অত তাড়াহুড়ো নেই, বলল রিক। অনেক আগেই কাজ শেষ করে ফেলেছি।

রিকের কথার কোন জবাব না দিয়ে কিশোরের দিকে ঘুরল বার্ট।খোকা, আমাদের কাজ তো দেখলে, কি ঠিক করলে? আমাদের সঙ্গে থাকবে? আমি বলি থাক, কাজ কর, প্রচুর টাকা কামাই করতে পারবে। তোমার যা ব্রেন, খুব বড় গ্যাঙ লীডার হতে পারবে একদিন।

কি জবাব দেবে কিশোর?-ভাবল মুসা। কিশোর কি রাজি হবে?

আরও ভাবতে হবে আমার, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। আসলে অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে তোমাদের, কঠিন কাজটাই বাকি রয়ে গেছে এখনও। অপরাধ করা। সহজ, কিন্তু করে পার পাওয়া খুব কঠিন। বেশির ভাগ অপরাধীই সেটা পারে না।

কিশোরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল বার্টের, হাসল। সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, বলেছি না, ছেলেটার বুদ্ধি আছে। কিশোরকে বলল, একটু কষ্ট করতে হবে তোমাদের। রিক-মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল সে।

বড় বড় দুটো চটের বস্তা নিয়ে এল রিক। কিশোর আর মুসাকে বস্তায় ভরে বস্তার মুখ বেঁধে ফেলা হল।

ট্রাকে তুলে দাও, বলল বাট।

খামোকা ঝামেলা, বলল রিক। ওরা আমাদের কথা শুনবে বলে মনে হয় না।

তাই মনে হচ্ছে, না? পয়সার বস্তা দুটো কেন নিয়েছি তেমন বুঝলে পায়ে বেঁধে পানিতে ফেলে দিলেই হবে, শব্দ করে হাসল বার্ট।

.

১৪.

রোববার সকাল।

জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরে। ঘুম ভাঙল রবিনের, কিন্তু চুপচাপ বসে রইল অলস কয়েকটা মুহূর্ত। মুসা আর কিশোরের কথা মনে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠে বসল। রাতে কতখানি কি করেছে ওরা? কিছু দেখেছে? রত্নদানো ধরতে। পেরেছে? ফোন করেছে?

তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিল রবিন। ওয়াকি-টকিটা পকেটে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামল। রান্নাঘর থেকে গরম কেরে গন্ধ আসছে। ম্যাপল গুড়ের তাজা সুগন্ধ সুড়সুড়ি দিচ্ছে যেন নাকে।

মা, কিশোর ফোন করেছে? রান্নাঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল রবিন।

না।

তারমানে, রাতে তেমন কিছু ঘটেনি, ভাবল রবিন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ধীরেসুস্থে নাস্তা সারল সে। তারপর সাইকেল বের করে নিয়ে রওনা হল স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

খোলা সদর দরজা দিয়ে ইয়ার্ডের আঙিনায় ঢুকে পড়ল রবিন।

হাফ-ট্রাকটা ধোয়া-মোছায় ব্যস্ত বোরিস। তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল রবিন, কিশোরের কোন খবর আছে?

না, মুখ না ফিরিয়েই জবাব দিল বোরিস।

ভাজ পড়ল রবিনের কপালে। ইয়ার্ডের অফিসে ঢুকল। মিস ভারনিয়ার বাড়িতে ফোন করল। রিঙ হচ্ছে, কিন্তু কেউ ধরছে না ওপাশ থেকে। কেন? আবার ডায়াল করল সে। এবারেও ধরল না কেউ। কি ব্যাপার? চিন্তিত হয়ে পড়ল সে। অফিস থেকে বেরিয়ে এল। বোরিস, কেউ রিসিভার তুলছে না! মনে হচ্ছে কেউ বাড়িতে নেই।

ফিরে তাকাল বোরিস। রত্নদানোদের শিকার হয়ে গেল না তো?

জলদি চলুন! একটা কিছু ঘটেছে!

চল!

ঠিক এই সময় বেজে উঠল টেলিফোন।

নিশ্চয় কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ছুটে এসে আবার ঢুকল অফিসে, প্রায়। ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার। হ্যাল্লো! পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড।

কিশোর-স্যান আছে? মিরোর গলা চিনতে পারল রবিন। বলল, না, বাইরে গেছে। আমি রবিন।

ও, রবিন-স্যান। কিশোরের জন্যে একটা মেসেজ আছে। আবার তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে মিউজিয়মে, ছবিগুলোর পেছনেও দেখা হয়েছে।

গোল্ডেন বেল্ট পাওয়া গেছে? রিসিভার জোরে কানে চেপে ধরল রবিন।

নাহ! বাবা খুব রেগে গেছে আমার ওপর। অযথা হয়রানি করা হয়েছে বলে। আমার কিন্তু এখনও পুরোমাত্রায় বিশ্বাস রয়েছে কিশোর-স্যানের ওপর। গোল্ডেন বেল্ট পাওয়া যায়নি, বল তাকে।

বলব, রিসিভার নামিয়ে রাখল রবিন।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে রেখেছে বোরিস, রবিন এসে তার পাশে উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

ছবির পেছনে গোল্ডেন বেল্ট পাওয়া যায়নি! কিশোরের জন্যে একটা বড় দুঃসংবাদ, ভাবল রবিন। এমন তো সাধারণত করে না কিশোর! তাহলে?

একে রোবার, তার ওপর খুব সকাল, রাস্তায় গাড়ির ভিড় কম। সাংঘাতিক স্পীড দিয়েছে বোরিস, থরথর করে কাঁপছে ট্রাক। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় মিস ভারনিয়ার গেটে এসে পৌঁছুল ওরা।

ইঞ্জিন থামার আগেই দরজা খুলে লাফিয়ে ট্রাক থেকে নেমে পড়ল রবিন। ছুটে এসে বেলের বোতাম টিপে ধরল। ধরেই রাখল, কিন্তু কোন সাড়া এল না বাড়ির ভেতর থেকে। পুরোপুরি শঙ্কিত হয়ে উঠল সে। বোরিসকে ডাকল।

ট্রাক থেকে নামছে বোরিস, এই সময় রবিন লক্ষ্য করল মিস ভারনিয়ার বাড়ির গেট পুরোপুরি বন্ধ নয়। ঠেলে পাল্লা আরও ফাঁক করে ঢুকে পড়ল আঙিনায়। তার পেছনেই ঢুকল বোরিস। বারান্দায় এসে উঠল দুজনে।

দরজার পাশে আরেকটা বেলের বোতাম, টিপে ধরল রবিন, কিন্তু এবারও সাড়া দিল না কেউ।

নিশ্চয় পাথর বানিয়ে ফেলেছে দানোরা! নিচু গলায় বলল বোরিস।

দরজায় ঠেলা দিল রবিন। হাঁ হয়ে খুলে গেল পাল্লা। বাইরে থেকে চেঁচিয়ে কিশোর আর মুসার নাম ধরে কয়েকবার ডাকল সে, জবাব এল না। ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল তার চিৎকার।

পুরো বাড়ি খুঁজে দেখল রবিন আর বোরিস, ভঁড়ারও বাদ দিল না। কিন্তু কাউকেই পাওয়া গেল না। সিঁড়ির মাথার ঘরে কিশোরের ব্যাগ, মুসার পাজামা আর হাতব্যাগ পড়ে রয়েছে।

নিশ্চয় কিছু দেখেছে মুসা আর কিশোর! দ্রুত চিন্তা চলছে রবিনের মাথায়। হয়ত আরও কাছে থেকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছে! দুজনের পিছে পিছে গিয়েছেন মিস ভারনিয়া, তিনিও ধরা পড়েছেন!

রত্নদানোরাই ধরেছে! মুখ শুকিয়ে গেছে বোরিসের।

বাইরে খুঁজে দেখি, চলুন! গলা কাঁপছে রবিনের। তিনজন জলজ্যান্ত মানুষকে দানোরা পাথর বানিয়ে ফেলেছে, এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তার ধারণা, অন্য কিছু ঘটেছে। আঙিনা থেকে শুরু করব।

 কিশোরের ক্যামেরাটা খুঁজে পেল রবিন। ঝোঁপের একটা সরু ডালে বেল্ট পেঁচিয়ে আছে। হ্যাঁচকা টান মেরে ডাল থেকে বেল্ট ছাড়িয়ে দিল সে। এখান দিয়ে গেছে কিশোর! নিশ্চয় কোন কিছুর ফটো তুলেছে!

ক্যামেরা থেকে ছবি বের করল রবিন। দেখার জন্যে ঝুঁকে এল বোরিস।

ছবি দেখে থ হয়ে গেল দুজনেই। জানালায় দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর চেহারার রত্নদানো!

কি…কি বলেছিলাম! তোতলাতে শুরু করল বোরিস। ওদেরকে ধরে নিয়ে গেছে।

পুলিশকে খবর দিতে হবে… বলতে বলতে থেমে গেল রবিন। এই ছবি পুলিশকে দেখালে তাদের কি প্রতিক্রিয়া হবে, ভেবে, দ্বিধা করল। না, আগে সে আর বোরিস খুঁজে দেখবে। না পাওয়া গেলে তখন অন্য কথা। বোরিস, এ-বাড়িতে নেই ওরা। যাওয়ার সময় কোন সূত্র রেখে গেছে হয়ত। আরও ভালমত খুঁজতে হবে। আমাদের। এখানে না পেলে পুরো ব্লকটা খুঁজে দেখব।

আরও একবার খোঁজা হল মিস ভারনিয়ার বাড়ি। কিছু পাওয়া গেল না। বেরিয়ে পড়ল ওরা ও-বাড়ি থেকে।

আগে আগে পথে এসে নামল রবিন, তার পেছনে বোরিস। কাউকে দেখা গেল রাস্তায়; একেবারে নির্জন। গলিপথ ধরে থিয়েটার-বাড়ির পেছনে চলে এল ওরা।

নীল চকটা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখল রবিন। অর্ধেক ক্ষয় হয়ে গেছে, তারমানে কিছু লিখেছে মুসা। এখানে এল কি করে এটা? মুসা ইচ্ছে করে ফেলে রেখে গেল? নাকি কোনভাবে তার পকেট থেকে পড়ে গেছে।

তীক্ষ্ণ চোখে আশপাশটা পরীক্ষা করে দেখল রবিন। আর কোনরকম চিহ্ন নেই। বাড়ির দেয়াল দেখল, ধীরে ধীরে তার নজর উঠে যাচ্ছে উপর দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল চিহ্নটা। নীল চক দিয়ে মস্ত বড় করে আঁকা হয়েছে একটা প্রশ্নবোধক। কোন সন্দেহ নেই, মুসাই এঁকেছে! কিন্তু খাড়া দেয়াল, ওখানে উঠল কি করে সে? ভেবে কোন কূলকিনারা পেল না রবিন।

বোরিস, হাত তুলে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা দেখাল রবিন। ওটা মুসা এঁকেছে! আমার মনে হয় এই বাড়ির ভেতরেই আছে ওরা!

দরজা ভাঙতে হবে! বন্ধ পাল্লার দিকে চেয়ে বলল বোরিস। পা বাড়াল। দরজার দিকে।

খপ করে বোরিসের হাত চেপে ধরল রবিন। না না, ভাঙতে গেলে শব্দ হবে। অনেক দরজা আছে, একটা না একটা খোলা পাওয়া যাবেই।

মিস ভারনিয়ার বাড়ির পেছনের গলিপথটার কাছে বোরিসকে নিয়ে এল রবিন। ফিসফিস করে বলল, সাবধানে এগোতে হবে!

পকেট থেকে ছোট গোল একটা আয়না বের করল রবিন। কিশোরের ধারণা, তিন গোয়েন্দার কাজে লাগবে এই জিনিস, তাই তিনজনেই একটা করে সঙ্গে রাখে।

উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। গলিপথটার মোড়ে। এসে থামল, পাঁচ আঙুলে আয়নাটা ধরে হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। আয়নার ভেতরে। দেখা যাচ্ছে পথটা। ইমার্জেন্সী ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা সবুজ ভ্যান। আগেরদিন ওখানে ওটা ছিল না।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল একজন মানুষ। তাকে দেখেই চমকে উঠল রবিন। বার্ট ইঅং, হাতে একটা বস্তা, ভেতরে ঠাসাঠাসি করে ভরা হয়েছে কিছু। বার বার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ইঅং, যেন ভয় করছে, কেউ তাকে দেখে ফেলবে।

রবিন, কিছু দেখেছ মনে হচ্ছে? পেছন থেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। বোরিস।

নাইটগার্ড! নিশ্চয় কিছু চুরি করছে ব্যাটা! আর কোন সন্দেহ নেই, ভেতরেই আছে মুসা আর কিশোর।

তাহলে চল ঢুকে পড়ি! গার্ড ব্যাটা কিছু বললে… শার্টের হাতা গোটাল বোরিস।

না না, এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, বাধা দিল রবিন। নিশ্চয় ভেতরে গার্ডের আরও সাঙ্গোপাঙ্গ রয়েছে।-হা হা, ওই যে আরও দুজন বেরোচ্ছে, হাতে বস্তা! বোরিস, পুলিশ ডাকতে হবে! জলদি যান! আমি আছি এখানে!

বোরিসের ধারণা, তিন চোরকে সে একাই সামলাতে পারবে। বলল, পুলিশ ডাকার কি দরকার? আমিই…

না, ঝুঁকি নেয়া উচিত না! শিগগির যান!

আর দ্বিরুক্তি না করে উঠে চলে গেল বোরিস।

হাত মাটির সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে রেখেছে রবিন, তাই তার হাত কিংবা আয়নাটা। চোখে পড়ছে না তিন চোরের। একের পর এক বস্তা এনে গাড়িতে তুলছে ওরা।

সময় যাচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠছে রবিন। এখনও আসছে না কেন বোরিস?

গাড়িতে বস্তা তোলা বোধহয় শেষ হয়েছে চোরদের। গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে কি যেন পরামর্শ করল ওরা। একসঙ্গে তিনজনেই আবার গিয়ে ঢুকল বাড়ির ভেতরে। খানিক পরে বেরিয়ে এল, দুজনের কাঁধে দুটো বড় বস্তা, ভেতরে ভারি কিছু রয়েছে।

হঠাৎ নড়ে উঠল যেন একটা বস্তার ভেতরে কিছু! চোখের ভুল? আরও ভাল করে তাকাল রবিন। না না, ঠিকই নড়ছে। বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন ভেতরের কিছুটা! ভ্যানের ভেতরে অন্যান্য বস্তার ওপর নামিয়ে রাখা হল বড় বস্তাদুটো।

বোরিসের দেরি দেখে হতাশ হয়ে পড়ছে রবিন, ঘামছে দরদর করে। বুঝতে পারছে, দুটো বস্তার ভেতরে রয়েছে কিশোর আর মুসা। বোরিস থাকলে দুজনে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত লোকগুলোর ওপর, মুক্ত করতে পারত দুই বন্ধুকে। একাই যাবে কিনা ভাবল রবিন, পরক্ষণেই নাকচ করে দিল চিন্তাটা। সে গিয়ে একা কিছুই করতে পারবে না, বরং ধরা পড়বে।

ভ্যানের পেছনের দরজা বন্ধ করে দিল এক চোর। তিনজনেই উঠে বসল। সামনের সিটে। মুহূর্ত পরেই ইঞ্জিন স্টার্ট নিল, চলতে শুরু করল গাড়ি।

রবিনের চোখের সামনে দিয়ে বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিশোর আর মুসাকে, অথচ কিছুই করতে পারছে না সে! রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখল সে।

.

১৫.

বড় বেকায়দা অবস্থায় রয়েছে মুসা আর কিশোর। হাত-পা বাঁধা, বস্তার পাটের আঁশ সুড়সুড়ি দিচ্ছে নাকে মুখে। টাকা-পয়সার উঁচু নিচু বস্তার ওপর পড়ে আছে, তার ওপর অমসৃণ পথে গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, ব্যথা হয়ে গেছে দুজনের পিঠ।

টেনে হাতের বাধন খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করল কিশোর।

সঙ্গীকে নড়তে দেখে মুসা বলল, কিশোর, আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ওরা?

বোধহয় কোন জাহাজে, ফিসফিস করে জবাব দিল কিশোর। সাগর পাড়ি দেয়ার কথা বলছিল, মনে আছে?

শেষে পানিতে ডুবেই মরণ ছিল কপালে! বিষণ্ণ শোনাল মুসার কষ্ঠ। বার্ট কি বলল শুনলে না? পয়সার বস্তা পায়ে বেঁধে ছেড়ে দেবে।

শুনেছি, বলল কিশোর। মুসা, হ্যারি হুডিনির নাম শুনেছ? ওই যে সেই বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান, হাত-পা বেঁধে ড্রামে ভরে পানিতে ফেলে দিলেও যিনি বেঁচে ফিরতেন?

তার মত জাদুকর হলে মোটেই ভাবতাম না, গোঁ গোঁ করে বলল মুসা। কিন্তু আমি হুডিনি নই, মুসা আমান। বড় জোর মিনিট খানেক কোনমতে টিকে থাকতে পারব পানির তলায়, তারপরই জারিজুরি খতম।

মুসার কথার ধরনে হেসে উঠল এক বামন। বন্দিদের সঙ্গে ওরা চারজনও চলেছে ভ্যানের পেছনে বসে।

যদি পানিতে না ফেলে? যে বামনটা হেসেছে, সে বলল। যদি কোন আরব শেখের কাছে বেচে দেয়? শুনেছি, আরবের কোন কোন আমির নাকি এখনও গোলাম কিনে রাখে।

ব্যাপারটা ভেবে দেখল মুসা। সিনেমায় দেখেছে, গোলামদের ওপর কি রকম। অকথ্য অত্যাচার করে মনিবেরা। কোটা বেছে নেবে? পানিতে ডুবে মৃত্যু? নাকি শেখের গোলাম হওয়া? দুটোর কোনটাই পছন্দ হল না তার।

ছেলেদের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে চুপ করে গেল বামনটা।

ভ্যানের গতি কমতে শুরু করল, ঝাঁকুনিও কমে এল।

বার্টের গলা শোনা গেল, বামনদেরকে বলছে, বাস ধরে চলে যাবে হলিউডে। আবার বলছি, বুঝেশুনে টাকা খরচ কর। লোকের চোখে যাতে না পড়ে।

আর বলতে হবে না, বলল বামন। টাকা এখন খরচই করব না আমরা।

আরেকটা কথা, মুখ বন্ধ রাখবে!

 রাখব।

থেমে দাঁড়াল ভ্যান। পেছনের দরজা খুলে নেমে গেল বামনরা। দড়াম করে আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা, আবার ছুটল গাড়ি। কোনরকম ঝাঁকুনি নেই আর এখন, নিশ্চয় মসৃণ হাইওয়েতে উঠে এসেছে। কয়েক মাইল দূরেই রয়েছে সাগর। সেখানে ডাকাতদের অপেক্ষায় রয়েছে কোন একটা জাহাজ, ভাবল কিশোর।

প্রায় গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিশোর, এইবার আমাদের খেল খতম! ইসস, কেন। যে এই গোয়েন্দাগিরির ব্যবসা শুরু করেছিলাম!

আমাদের মেধাকে কাজে লাগানর জন্যে, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।

মেধা জমে বরফ হয়ে গেছে আমার! ঝাঁঝাল গলায় বলল মুসা। রবিনটাও যদি সময়মত আসত! চিহ্নটা দেখত! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে, কিশোর, দোহাই তোমার, চুপ করে থেক না! কিছু অন্তত বল! বল, বাঁচার আশা আছে আমাদের!

নেই, সত্যি কথাটাই বলল কিশোর। বার্ট খুব চালাক। কোনরকম ফাঁক রাখেনি।

.

ভ্যানকে অনুসরণ করে চলেছে ট্রাক। রবিন উত্তেজিত, বোরিস গম্ভীর।

বোরিস যখন ফিরেছিল, সবুজ ভ্যানটা তখন মাত্র গলির মোড় পেরিয়ে গেছে। পুলিশ আনতে পারেনি সে, রাস্তায় পুলিশ ছিল না। রবিন একবার ভেবেছে, কোন পুলিশ স্টেশনে ফোন করবে। কিন্তু পরে ভেবেছে, আজ রোববার, দোকানপাট সব বন্ধ, টেলিফোন করবে কোথা থেকে? কাজেই তখন যা করা উচিত, ঠিক তাই করেছে, বোরিসকে নিয়ে ট্রাকে উঠে পড়েছে, পিছু নিয়েছে ভ্যানের।

রোববার সকালে গাড়ির ভিড় কম, পথ প্রায় নির্জন, গতি বাড়াতে কোন অসুবিধে নেই। তীব্র গতিতে ছুটেছে ভ্যান, ওটার সঙ্গে তাল রেখে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে ইয়ার্ডের পুরানো ট্রাকের পক্ষে। বার বার পিছিয়ে পড়ছে।

দেব নাকি বাড়ি লাগিয়ে! আপনমনেই বলল বোরিস। কোনভাবে আটকে দিতে পারলে…

না না, এতবড় ঝুঁকি নেয়া যাবে না! ভ্যান উল্টে যায় যদি? যেভাবে যাচ্ছেন, যেতে থাকুন।

চলতে চলতে এক সময় গতি কমে গেল ভ্যানের, থামল। পেছনের দরজা খুলে টপাটপ লাফিয়ে নামল চারটে ছেলে। তাড়াহুড়ো করে চলে গেল বাস স্টপের দিকে।

ধরব নাকি পিচ্চিগুলোকে! ভুরু কুঁচকে গেছে বোরিসের। গোটা কয়েক চড়থাপ্পড় দিলেই গড়গড় করে বলে দেবে সব।

কি বলবে? হাত তুলল রবিন। না, ভ্যানটা হারাব তাহলে!

পেছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আবার চলতে শুরু করল ভ্যান। মোড় নিয়ে পুরানো রাস্তা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠে গেল। এগিয়ে চলল নাক বরাবর পশ্চিমে, উপকূলের দিকে।

পেছনে ট্রাক নিয়ে আঠার মত লেগে রইল বোরিস। কিন্তু আর বেশিক্ষণ লেগে থাকা বোধহয় সম্ভব না। ভ্যানটা নতুন, ওটার সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে পুরানো ট্রাক।

নড়েচড়ে বসল রবিন। পকেটে টান পড়তেই গায়ে শক্ত চাপ অনুভব করল সে, মনে পড়ল ওয়াকি-টকিটার কথা। তাই তো? যোগাযোগ করা যায়। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ছোট্ট রেডিওটা বের করল সে। একটা বোতাম টিপে দিয়ে কানের কাছে ধরল যন্ত্রটা। এক মুহূর্ত বিচিত্র গুঞ্জন উঠল স্পীকারে, পরক্ষণেই তাকে অবাক করে দিয়ে ভেসে এল একজন মানুষের গলা। কেমন পরিচিত। জোরাল, স্পষ্ট কথা: হাল্লো, হারবার! হাল্লো, হারবার! অপারেশন থিয়েটার কলিং! শুনতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ?

টানটান হয়ে গেছে রবিনের সমস্ত স্নায়ু, উল্কর্ণ হয়ে আছে সে। জবাব এল অতি মৃদু গলায়: হালো, অপারেশন থিয়েটার। হারবার বলছি। কাজ শেষ? কোন গোলমাল?

হাল্লো, হারবার! আরে, বার্ট ইঅং-এর কষ্ঠ। শেষ। কোন গোলমাল হয়নি। তবে দুজন যাত্রী নিয়ে আসছি সঙ্গে। ডকের কাছাকাছি পৌঁছে আবার কথা বলব। ওভার অ্যান্ড আউট।

চুপ হয়ে গেল স্পীকার।

হঠাৎ বুমম করে কান ফাটানো শব্দ উঠল। নিজের অজান্তেই মাথা নিচু করে ফেলল রবিন। ভ্যান থেকে বোমা ছুঁড়ল না তো!

থরথর করে কেঁপে উঠল ট্রাক, নাক সোজা রাখতে পারছে না যেন কছুতেই। স্টিয়ারিঙে চেপে বসেছে বোরিসের আঙুল, ফুলে উঠেছে হাতের শিরা। অনেক কষ্টে ট্রাকটাকে সাইডরোডে নামিয়ে আনল সে, থামিয়ে দিল।

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে বোরিস। টায়ার ফেটে গেছে!

ঢিল হয়ে গেল রবিনের স্নায়ু। হেলান দিয়ে বসল, দুহাত ছড়িয়ে পড়ল। দুদিকে। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সবুজ ভ্যানটার দিকে, দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে ওটা।

Super User