১১.

ডিগারের রুমমেটকে অনুসরণ করে চলছে রবিন।

পুরানো বাড়ির সিঁড়িতে লোকটা পা রাখতেই পেছনের বেড়ার ভেতর থেকে কুকুরের চিত্তার শোনা গেল। পার্কিং লটে একটা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কি ঘটে দেখতে লাগলো রবিন।

পেছনে দরজা খোলার শব্দ হলো। ফিরে তাকালো সে।

গ্যালারির পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে ব্রড ক্যাম্পার। পরনে একটা হালকা নীল রঙের স্ন্যাকস। গায়ে একই রঙের শার্ট। নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে।

লোকটার অলক্ষ্যে থেকে তার ওপর নজর রাখলো রবিন।

স্পীডওয়ে পেরিয়ে ওশন ফ্রন্টের দিকে চললো ক্যাম্পার।

ডিগারের বাড়িতে কিছু ঘটছে না। বোধহয় ঘটবেও না, ভেবে, ক্যাম্পারের পিছু নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো রবিন। লোকটা বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর আড়াল থেকে বেরোলো সে। পিছু নিলো।

বেশ কিছুটা আগে রয়েছে ক্যাম্পার। উত্তরে চলেছে দ্রুত পায়ে। মারমেড কোর্টের পরে আরও পাঁচ ব্লক এগোলো, তারপর ঢুকে পড়লো একটা গলিতে।

পিছে লেগে রইলো রবিন। গলিটার নাম ইভলিন স্ট্রীট। পথের পাশে পুরানো বাড়িঘর। কোথাও কোথাও গাড়ি আছে। পুরানো মডেলের পুরানো গাড়ি। বারান্দায় খেলছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। পথে আর বাড়িঘরের ফাঁকে যত্রতত্র। ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর।

পুরানো একটা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলো ক্যাম্পার।

রবিন ভাবছে, এখানে কেন এসেছে লোকটা? এরকম জায়গায় তার বন্ধু-বান্ধব আছে?

বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাধার ভান করলো। চোখের কোণ দিয়ে দেখছে বাড়ির ভেতরে কি আছে। খোলা দরজা দিয়ে একটা ছোট চত্বর চোখে পড়লো। কোনো মানুষ দেখা গেল না।

আবার সোজা হয়ে রাস্তা পেরিয়ে এলো রবিন। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখার। জন্যে একটা সুবিধেমতো জায়গা খুঁজছে। একটা উঁচু বারান্দায় খেলছে দুটো ছেলে। ওটার সিঁড়িতে এসে বসলো সে। যেন ওদেরই একজন।

বসে আছে তো আছেই। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে কি যে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একেবারে শূন্য, নির্জন। জানালার ভারি পর্দাগুলোর কোনোটাই সরা তো দূরের কথা, সামান্য কাঁপছেও না।

মিনিটের পর মিনিট কাটছে।

পনেরো মিনিট পর একটা গাড়ি বেরিয়ে এলো বাড়িটার পাশ থেকে। নীল বুইক। তীক্ষ্ণ হলো রবিনের দৃষ্টি। চেনা চেনা লাগছে গাড়িটা। ড্রাইভিং সীটে বসা আরোহীকেও চেনা লাগছে।

ঠিক! স্লেভ মার্কেটে দেখেছিলো আগের দিন! এই লোকটাই ডিগারের রুমমেটকে ট্রাকসহ ভাড়া করেছিলো। সেই একই টুপি মাথায়। চোখে কালো চশমা। পুরু গোফ।

রাস্তায় উঠে পুব দিকে মোড় নিলো গাড়িটা। গতি বাড়িয়ে চলে গেল।

নোটবুক বের করে নম্বর প্লেটের নম্বর আর বাড়িটার নম্বর লিখে ফেললো রবিন। নোটবুক বন্ধ করে ভাবতে লাগলো-বুইকের ওই আরোহীর সঙ্গেই দেখা করতে। এসেছে নাকি ক্যাম্পার? লোকটার সঙ্গে ডিগারের কোনো রকম যোগাযোগ আছে? নাকি যোগাযোগটা ডিগারের রুমমেটের সঙ্গে। স্লেভ মার্কেটে রুমমেটকে ভাড়া করার ব্যাপারটা কি শুধুই কাকতালীয় ঘটনা?

এভাবে এখানে বসে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ক্যাম্পার বেরিয়ে তাকে দেখলেই বুঝে যাবে, নজর রাখছে রবিন।

উঠে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার জন্যে জায়গা খুঁজলো সে। পেলো না। পায়ে। পায়ে আবার এগিয়ে গেল অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটার কাছে। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। কোনো নড়া নেই চড়া নেই শব্দ নেই। যেন ভূতের বাড়ি, মানুষ বাস করে না এখানে।

কয়েকবার দ্বিধা করে শেষে বাড়িটার আরও কাছে চলে এলো রবিন। দরজার বেল বাজালো। কেউ এলো না।

আরকটা দরজার আরেকটা বেল বাজলো। জবাব নেই। তৃতীয় আরেকটা বাজিয়েও সাড়া পাওয়া গেল না।

একটা জানালার কাছে এসে নাক চেপে ধরলো কাঁচের গায়ে। কাঠের মেঝে চোখে পড়লো। নির্জন। ধুলোয় ঢাকা। কয়েকটা খালি বাক্স পড়ে রয়েছে। বাড়িতে কেউ আছে বলে মনে হয় না। আলো জ্বলছে না। নিশ্চয় বিদ্যুৎ নেই। আর সে কারণেই হয়তো বেলের সুইচ টিপেও লাভ হয়নি, ঘণ্টা বাজেনি।

কিন্তু ক্যাম্পার গেল কোথায়?

সদর দরজা দিয়েই তো ঢুকেছিল..

হঠাৎ দম বন্ধ করে ফেললো রবিন। বুঝে ফেলেছে! সদর দরজা দিয়ে ঢুকেছে বটে, কিন্তু বাড়ির ভেতরে নেই ক্যাম্পার, বেরিয়ে গেছে পেছনের কোন দরজা দিয়ে। তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেছে। নীল বুইক! আলগা গোঁফ লাগিয়ে নিয়েছে। মাথায় নাবিকের টুপি। চোখে কালো চশমা।

পেছনে ভারি বুটের শব্দ হলো। ঝট করে ফিরে তাকালো সে। চমকে গেল।

বিশালদেহী একজন মানুষ। মাঝবয়েসী। টাকা মাথা। খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরে বললো, এই ছেলে, এখানে কি?

শুকনো গলায় জানালো রবিন, ইস্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে রিসার্চ করছি, তথ্য সংগ্রহ করছি। নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো কথাটা।

লোকটাও বিশ্বাস করলো না। ধমক দিয়ে বললো, মিছে কথা বলার আর জায়গা পাওনি! ওই সিঁড়িতে বসে বসে চোখ রাখছিলে, দেখেছি আমি। তারপর উঠে এসেছে চুপি চুপি। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছে। নিশ্চয় চুরির মতলব?

না না, আপনি ভুল করছেন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। আমি চোর নই! লোকের সঙ্গে কথা বলতেই এসেছি। বেলপুশ টিপলাম। কেউ এলো না।

হাতের চাপ সামান্য ঢিল হলো।

 এই সুযোগে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিলো রবিন।

এই থামো! থামো বলছি! চিৎকার শুরু করলো লোকটা। নইলে ভালো হবে না… 

রবিন কি আর দাঁড়ায়? ঝেড়ে দৌড়াতে লাগলো।

.

১২.

 মুসার মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে হাঙর।

হুমকির ভঙ্গিতে নামলো একবার। সঙ্গে করে ছুরি আনা উচিত ছিলো, আফসোস করলো মুসা। যখন ভাবলো, এইবার হামলা চালাবে, ঠিক তখনই হঠাৎ নাক উঁচু করে উঠে গেল ওটা। কয়েক ফুট উঠে দ্রুতগতিতে চলে গেল গভীর পানির দিকে।

যাক, বাঁচা গেল। আবার দম নিতে আরম্ভ করলো মুসা।

শক্ত কি যেন ধরে রয়েছে, মনে পড়লো এখন। পাথর নয় জিনিসটা। শক্ত, গোল, পিচ্ছিল কি যেন। ঘোলাটে পানিতেও চিনতে অসুবিধে হলো না তার। একটা জলকন্যার মাথা। চীনামাটির তৈরি। নিশ্চয় ব্রড় ক্যাম্পারের হারানো জলকন্যা! টুকরো টুকরো হয়ে সাগরের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে মূর্তিটার অন্যান্য অংশ। এখনো কোনো কোনোটাতে জড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া বাদামী কাগজ।

এই তাহলে ব্যাপার! মূর্তিটাকেই এনে পানিতে ফেলে গেছে ক্যাম্পার! কিন্তু। কেন?

কয়েকটা টুকরো তুলে নিয়ে যাবে কিনা ভাবছে সে, এই সময় চোখের কোণে আবার দেখলো নড়াচড়া। কি ওটা, ভালো করে দেখার জন্যে থামলো না। প্রয়োজনও মনে করলো না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, হাঙরটাই ফিরে এসেছে।

তীরের দিকে পাগলের মতো সাঁতরে চললো সে। অল্প পানিতে পৌঁছে উঠে দাঁড়ালো। দৌড়ানোর চেষ্টা করলো। ঝুপঝুপ, থপথপ, নানা রকম শব্দ করতে করতে কোনোমতে এসে উঠলে কিনারে। ধপ করে বসে পড়লো বালিতে। তারপর একেবারে চিৎপাত।

কি হয়েছে? কানের কাছে বেজে উঠলো হ্যাঁনসনের কণ্ঠ।

হাঙর! মাস্ক খুলে ফেলেছে মুসা, হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিলো।

শিস দিতে দিতে খোশমেজাজে এগিয়ে এলো একজন লাইফগার্ড। চিত হয়ে থাকা মুসর ওপর কিশোর আর হ্যানসনকে উপুড় হয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার?

উঠে বসলো মুসা। হাঙর!

 তাই নাকি? ঠিক আছে, রিপোর্ট করবো। খবরদার, আর নামবে না।

পাগল! আরও নামি!

মুসাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো কিশোর। এখনও জলকন্যার মাথা ধরে  রেখেছে গোয়েন্দা সহকারী। সেটা কিশোরের হাতে দিয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো পোশাক বদলানোর জন্যে। কাপড় বদলে ফিরে এসে দেখলো পিয়ারের একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে রয়েছে কিশোর। মূর্তির মাথাটা দেখছে। এটাই তাহলে পানিতে ফেলেছিলো ক্যাম্পার?

তাই তো মনে হয়, মুসা বললে। বাকি টুকরোগুলোও আছে।

কেন করলো একাজ?

আল্লাহই জানে! হাত ওল্টালো মুসা। মিছে কথা বলার ওস্তাদ লোকটা। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, ফেললোই যখন, পানিতে কেন? রাবিশ বিন কি করেছিলো?

নিশ্চয় তার ভয়, কেউ দেখে ফেলবে।

কি হতে দেখলে? কার এতো ঠেকা পড়েছে একটা ভাঙা মূর্তি নিয়ে মাথা। ঘামানোর?

পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো হ্যানসন। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললো, মিস্টার ক্যাম্পারকে কয়েকবার এখানে ওখানে নিয়ে গেছি গাড়ি চালিয়ে। হলিউডের অনেক পাটিটাটিতে যায়। অদ্ভুত আচরণ করে তখন। সিনেমার ডায়লগ নকল করে কথা বলে। বিখ্যাত অভিনেতাদের ভাবভঙ্গি নকল করে। আস্ত একটা ভীড়। পানিতে মূর্তি ছুঁড়ে ফেলাটাও তেমন একটা অভিনয়ের নকল কিনা কে জানে।

লোকটার স্বভাব-চরিত্র আসলেই যেন কেমন! মুসা বললো। কেমন মেকি মেকি!

ঠিক বলেছেন!

 কিশোর, বলতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। ওশন ফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। মুসাও তাকালো। দেখলো, ছুটে আসছে রবিন।

কাছে এসে ধপ করে কিশোরের পাশে বসে পড়লো সে। যা জেনে এসেছে, কলার জন্যে আর তর সইছে না। বললো, ডিগার, তার রুমমেট আর ক্যাম্পারের মধ্যে একটা যোগাযোগ রয়েছে।

ইভলিন স্ট্রীটে কি ঘটেছে, খুলে বললো সব রবিন। সব শেষে আবার বললো, আমি শিওর, ও ব্রড ক্যাম্পারই।

খাইছে! মুসা বললো, ছদ্মবেশ নিয়েছে ব্যাটা!

স্তব্ধ হয়ে গেছে কিশোর। আরও কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললো, তুমি বলছো নির্জন বাড়িতে ঢুকে ছদ্মবেশ নিয়ে নীল বুইক চালিয়ে চলে গেছে? গোপন কোনো উদ্দেশ্যে? কাল একই রূপ ধরে গিয়েছিলো স্লেভ মার্কেটে?

আমি শিওর।

হুম! ওই বুইকটার মালিককে বের করা দরকার।

নম্বর নিয়েছি আমি, নোটবুক বের করলো রবিন।

 সেটা নিতে নিতে কিশোর বললো, নির্জন বাড়ি, না?

হ্যাঁ

ক্যাপ্টেন ফ্লেচারকে বলতে হবে। গাড়িটা কার বের করে দেবেন।

ফোন করবে?

 না। নিজে যাবো।

লাঞ্চ সেরে কিশোর আর হ্যানসন রওনা হয়ে গেল। রবিন আবার ফিরে গেল। মারমেড কোটে। গ্যালারিতে ক্যাম্পার ফিরেছে কিনা দেখতে। মুসা গেল ডিগারের ওপর চোখ রাখতে। তার বাড়ির কাছে গিয়ে পথের পাশের একটা ঝোপে লুকিয়ে বসে রইল।

কোস্ট হাইওয়ে ধরে উত্তরে চলেছে রোলস রয়েস। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে। জরুরী কাজে ব্যস্ত ইয়ান ফ্লেচার। কিশোরকে দেখে মুখ তুললেন। আরে কিশোর? কি ব্যাপার?

একটা বুইক সেডানের মালিক কে জানতে চাই। নম্বর নিয়ে এসেছি। ভেনিস বীচের একটা গ্যারেজে রাখা হয় ওটা।

ভেনিস বীচ? চোখ সরু হয়ে এলো ফ্লেচারের। ওই বাচ্চা ছেলেটা…কি যেন নাম…হারিয়ে গেছে। তার কেসে জড়াওনি তো?

হ্যাঁ, স্যার, ওই কেসই। ছেলেটার নাম কিটু। তার মায়ের অনুরোধেই তদন্ত করছি।

কেন, লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারছে না তার মা?

না স্যরি, তা নয়। নিনা হারকার মনে করছে, আমরা অন্য ভাবে সাহায্য করতে পারবো…

বাধা দিয়ে বললেন চীফ, দেখো, কিশোর, খুব সাবধান। একটা ছেলের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, ভুল যাতে না হয়। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

জানি, স্যার। নিজে নিজে কিছুই করতে যাবো না। তেমন বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেবো, কথা দিচ্ছি।

কিশোরের কাছ থেকে গাড়ির নম্বরটা নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন চীফ। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলেন। হাতে এক টুকরো কাগজ। ব্রড ক্যাম্পার নামে এক লোকের নামে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন। ঠিকানা, ফোর এইটি এইট, ওশন ফ্রন্ট, ভেনিস।

হুমম! মাথা দোলালো কিশোর।

এরকমই কিছু আশা করেছিলে, তাই না?

আবার মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

বেশ, এবার ক্যাম্পারের সম্পর্কে সব বলো তো।

এখনও সময় হয়নি, স্যার।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন চীফ। হাসলেন। ঠিক আছে, চাপাচাপি করবো না। তবে মনে রেখো, কোনো রকম ঝুঁকি নেবে না। কিছু দেখলেই পুলিশকে খবর দেবে।

দেবো, স্যার।

আবার ভেনিসে ফিরে এলো ওরা। মারমেড কোর্টের পেছনে কিশোরকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল হ্যানসন। বলে গেল ঘণ্টাখানেক পর ফিরবে। কাফের বারান্দায় বসে থাকতে দেখা গেল রবিনকে। হাতে একটা খালি গেলাস। কোকা কোলা খেয়েছে।

আধ ঘন্টা আগে গ্যালারি খুলেছে ক্যাম্পার, জানালো সে।

ইভলিন স্ট্রীটে ওর গাড়িটাই দেখেছিলে, বললো কিশোর।

আমারও তাই মনে হয়েছিলো। নিনা হারকারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললো, একটা জাগুয়ার চালায় ক্যাম্পার। তার বাড়ির পেছনের গ্যারেজে রাখে গাড়িটা। আরেকটা গাড়ি আর ছদ্মবেশ নেয়ার তার দরকার হলো কেন?

জবাব দিতে পারলো না কিশোর। বসে পড়লো বারান্দায়।

একটু পর ফিরে এলো মুসা। বললো, ডিগারের পিছু নিয়েছিলাম। কুকুরের। রহস্য জেনেছি। মুক্তিপণ দাবি করে না সে, পুরস্কার আদায় করে। দেখলাম, একটা সান্তা মনিকার কপি কিনলো। শুধু বিজ্ঞাপনগুলো দেখে ফেলে দিলো কাগজটা। সুযোগ করে ওটাও দেখলাম। একটা বিজ্ঞাপনের ওপর পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়া। সাদা-কালো একটা স্প্যানিয়েল কুকুরের জন্যে একশো ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা। হয়েছে। কিছুদিন আগে হারিয়ে গেছে কুকুরটা। কাগজটা ফেলে দিয়ে বাড়ির পেছন। থেকে একটা সাদা-কালো স্যানিয়েল বের করে আনলো ডিগার, নিয়ে গেল ওশন পার্কের একটা বাড়িতে। বেল টিপতে দরজা খুলে দিলো এক মহিলা। তাকে দেখে। দৌড়ে গিয়ে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো কুকুরটা, চেটেচুটে অস্থির করে দিলো। ডিগারকে কিছু টাকা এনে দিলো মহিলা। প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলো ডিগার।

থেমে দম নিলো মুসা। তারপর বললো, কিন্তু এর সঙ্গে কিটুর নিখোঁজের সম্পর্ক কি বুঝতে পারছি না। ডবকে নিশ্চয় আটকাতে চায়নি ডিগার, ওই কুত্তা আটকে কোনো লাভ হতো না।

জবাব দিলো না কিশোর। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর চিন্তায়। ডুবে গেছে। হঠাৎ মুখ তুললো। হতে পারে, অন্য দিকে সরে যাচ্ছি আমরা। হয়তো কিটুর হারানোর সঙ্গে ক্যাম্পারের কোনো হাতও নেই। ডিগার হয়তো এতে জড়িত নয়। ছেলেটা ভীষণ দুষ্ট, হয়তো নিজে নিজেই গিয়ে কোথাও আটকা পড়েছে।

সরাইখানাটা দেখিয়ে বললো সে, কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে মাটির তলার ঘরে ঢুকে যেতে পারে। খোলা জানালা দিয়ে গিয়ে সেলারে ঢুকে বসে থাকতে পারে। পুলিশ অবশ্য খোঁজ করেছে, কিন্তু ওরা কি সমস্ত জায়গা তন্ন তন্ন করে। খুঁজতে পেরেছে? হোটেলটা ছাড়াও এখানে অসংখ্য জায়গা আছে, যেখানে একটা বাচ্চা ছেলে আটকা পড়তে পারে।

সোজা হয়ে বসলো রবিন। কি করতে বলো?

গ্যালারিতে রয়েছে এখন ক্যাম্পার। মারমেড ইনে খুঁজতে ঢুকবো আমরা। দেখি ক্যাম্পার কি বলে।

.

১৩.

 পুরানো সরাইখানাটা খুলতে প্রথমে রাজি হতে চাইলো না ক্যাম্পার। অনেক বছর। ধরে তালা দেয়া রয়েছে। জানালা আটকানো। ছেলেটার ঢোকার পথ নেই।

কিটুর বয়সে, একটা গল্প শোনালো মুসা, একটা নির্জন বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম আমি। জানালা দরজা বন্ধ ছিলো, কিন্তু আমার ঢোকা তো বন্ধ করতে পারেনি। চিলে কোঠার জানালাটা ছিলো খোলা। গাছ বেয়ে উঠে ওই পথে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেছি তো সহজেই, কিন্তু বেরোতে গিয়ে জান বেরিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তবে বেরিয়েছি।

মারমেড ইনের দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যাম্পার। একতলা আর দোতলার জানালা বন্ধ, কিন্তু তিনতলার কিছু কিছু ভোলা। অসম্ভব! ওপথে ঢুকতে পারবে না কিটু। ঢুকতে হলে এই গ্যালারি কিংবা মিস্টার ডেজারের ছাতের ওপর দিয়ে গিয়ে উঠতে হবে। = আমরা বলছি না যে কিটুও ওরকম করেছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। কলছি, বাচ্চারা এমন অনেক কাজ করে বসে, বয়স্করা যা কল্পনাও করতে পারে না। খুঁজলে কি কোনো অসুবিধা হবে? হয়তো আটকা পড়ে আছে কোথাও, বেরোতে পারছে না। হয়তো জখম হয়েছে, কিংবা বেহুশ হয়ে আছে।

আর কিছু বলার থাকলো না ক্যাম্পারের। একগোছা চাবি বের করে CLOSED লেখা একটা দরজার দিকে এগোলো। সরাইতে কিটু আটকা পড়লে ডব বেরোলো কিভাবে?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

দেখতে চাইছো, দেখাচ্ছি। তবে অযথা সময় নষ্ট করছে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ওরা, মারমেড ইনের মস্ত দরজার কাছে। দরজার তালা খুলে ঠেলে পাল্লা খুললো ক্যাম্পার। ছোট একটা হলওয়ে দেখা গেল, আবছা অন্ধকার আর প্রচুর ধুলো। হলওয়ে পেরিয়ে লবি, সেখানে বেশ কিছু সোফা আর চেয়ার অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। পুরু হয়ে ধুলো জমে থাকা জানালার কাঁচের। ভেতর দিয়ে আলো ঠিকমতো আসতে পারছে না। পচে টুকরো টুকরো হয়ে আছে কার্পেট। ফুলের টবে মরা গাছের শুকনো উঁটি খাড়া হয়ে রয়েছে এখনো। মেঝের ধুলোয় জুতোর ছাপ, পুলিশ এসে খোঁজাখুঁজি করে গেছে সেই চিহ্ন।

লবি বেরিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকলো ওরা। টেবিলের ওপরে স্তূপ করে রাখা। হয়েছে চেয়ার। ডাইনিং রুমের পরে অনেক গলিপথ, অফিস রান্নাঘর, স্টোররুম। সব জায়গায়ই খোঁজা হলো, কিন্তু কিটুকে পাওয়া গেল না।

রান্নাঘরে মাকড়সার রাজত্ব, জালের অভাব নেই। তাক আর আলমারি গুলোতে বাসা বেঁধেছে নেংটি ইঁদুর। এখানে সেখানে উঁকি দিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা, হঠাৎ পায়ের নিচে কোনোখান থেকে একটা অদ্ভুত গোঙানি কানে এলো।

ঝট করে সেদিকে তাকালো কিশোর ও মুসা।

 কে! কে! বলে চিৎকার করে উঠলো মুসা।

এমনকি ক্যাম্পারের মুখও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রান্নাঘরের একধারের একটা দরজা খুললো গিয়ে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিলো কিশোর। অন্ধকার একটা সিঁড়ি চোখে পড়ছে। কেমন যেন ভেজা ভেজা আর টক গন্ধ বাতাসে।

সেলার, ক্যাস্পার কললো। ওটা আগেও ব্যবহার হতো না খুব একটা। আর এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। জোয়ার বেশি হলে পানি ঢুকে যায় ওখানে।

ডাইনিংরুম থেকে গিয়ে খুঁজে পেতে মোমবাতি বের করে আনলো রবিন। আস্ত নয়, মোমের একটা গোড়া।

মোম জ্বেলে আগে আগে চললো ক্যাম্পার, পেছনে তিন গোয়েন্দা।

সিঁড়ি বেয়ে নামছে ওরা, এই সময় আবার শোনা গেল গোঙানি। এবার আরও কাছে, আরও ভয়াবহ। পাথর হয়ে গেল যেন ওরা। হাত তুলে দেখালো মুসা, সেলারের ওপর দিকে দেয়ালে একটা জানালা। ম্লান একফালি আলো এসে ঢুকছে সে পথে। যানবাহনের আওয়াজও আসছে সেদিক দিয়ে। ধাতব একটা খটাখট, ঘটাং ঘটাং, তারপর আবার সেই ভয়ানক গোঙানি।

রাস্তায় হচ্ছে শব্দটা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুসা। জানালা ঢেকে রাখা তক্তায় ঠেলা দিলো। বড় হলো ফাঁক। সেখান দিয়ে তাকাতে চোখে পড়লো সরু একটুকরো চত্বর, স্পীডওয়ের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। সরাইখানার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে একটা লরি। ময়লা ফেলার গাড়ি ওটা। বিরাট একটা ইস্পাতের দাঁড়া নেমে আসছে চাবি টিপলেই, রাবিশ বিনকে চেপে উপরে তুলে নিয়ে গিয়ে খোলা মুখটা কাত করে ধরছে, ময়লা-জজ্ঞাল সমস্ত ট্রাকের পেছনে তুলে নিয়ে আবার মাটিতে নামিয়ে রাখছে বিনটা। বিন ওপরে ভোলার সময়ই বিকট গোঙানির মতো শব্দ করছে মেশিন।

দূর! হতাশ হয়েছে কিশোর। ময়লা ফেলার গাড়ি!

মাথা ঝাঁকালো ক্যাম্পার। পুরানো আর বদ্ধ জায়গা বলেই শব্দটা বেশি। হচ্ছে।

সেলরিটা খুঁজে দেখতে বেশিক্ষণ লাগলো না। নিরাশ হয়ে আবার রান্নাঘরে ফিরে এলো তিন গোয়েন্দা।

নিচতলায় কিটু নেই। দোতলায় উঠলো ওরা। ঘরে ঘরে সেই একই রকম শূন্যতা, ধুলো মাকড়সার জাল আর ইঁদুর।

একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ক্যাম্পার। ঘরটার নাম রাজকন্যের। স্যুইট। অনেকবার ঢোকার চেষ্টা করেছি। চাবিও আছে, কিন্তু কিছুতেই তালা, খুলতে পারিনি। মরচে পড়ে বোধহয় আটকে গেছে তালাটা। দরজা না ভেঙে আর ঢোকা যাবে না। সাধারণ দরজা হলে ভেঙে ফেলতাম, কিন্তু সুন্দর পাল্লাটা ভাঙতে। মন চায় না।

সত্যিই সুন্দর। নানারকম সামুদ্রিক জীব আঁকা রয়েছে, চারপাশে জলজ আগাছা এঁকে করা হয়েছে অলঙ্করণ। ঠিক মাঝখানে আঁকা একটা জলকন্যার হাসিমুখ।

গ্যালারিতে যে মারমেডটা ছিলো, ক্যাম্পার জানালো, ওটা আগে ছিলো। নিচতলার লবিতে। ইস, এটাকেও যদি নষ্ট না করে খুলে নিয়ে যেতে পারতাম!

চেষ্টা করলে পারতেও পারেন, কিশোর বললো। সত্যিই কি এই ঘরটায় কখনও ঢোকেননি?

না। ভেনিসে এলে এটাতেই থাকতো নিরমা হল্যাণ্ড।

এখানেই ভূত দেখা যায়? মুসার প্রশ্ন।

হাসলো ক্যাম্পার। ওসব গালগল্প বিশ্বাস করো নাকি? আমি করি না। লোকে কতো কিছুই তো বানিয়ে বলে। সব ফালতু।

এরপর তিনতলায় উঠলো ওরা। জানালা দরজা বেশির ভাগই খোলা। ক্যাম্পার বললো, মাটি থেকে তিরিশ ফুট ওপরে। এখানে উঠতে পারবে না। ও। অসম্ভব।

চিলেকোঠা আছে? কিশোর জানতে চাইলো।

না।

আশা নেই তবু খুঁজলো গোয়েন্দারা। কিটুর কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না। এককোণ থেকে একটা শ্যাফট নেমে গেছে নিচের ভাড়ার ঘরে।

এটাকে বলে ডামবওয়েইটার শ্যাফট, বুঝিয়ে বললো ক্যাম্পার। রান্নাঘর থেকে এটা দিয়ে খাবার সরাসরি ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

শ্যাফটটা শূন্য। ক্যাম্পার জানালো, টর্চ দিয়ে ভালমতো এটার ভেতরে খুঁজে দেখছে পুলিশ।

নিচতলায় নেমে এলো আবার ওরা। গ্যালারিতে ঢুকলো। ক্যাম্পারকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে, রোদে। চত্বরে দেখা গেল নিনা হারকারকে। চোখ বসে গেছে, রোগা হয়ে গেছে শরীর। গোয়েন্দাদের দেখে বললো, ওখানে খুঁজতে গিয়েছিলে তো? নেই আমি জানি। এ-ও জানি, ওর কি হয়েছে। স্পীডওয়েতে চলে– গিয়েছিলো, কিংবা আরও দূরে। গাড়ি এসে চাপা দিয়ে কুকুরটাকে মেরে ফেলে। বকা শোনার ভয়ে আরও দূরে চলে গিয়েছে কিটু, তারপর আর পথ চিনে ফিরে আসতে পারেনি। এটাই হয়েছে। থামলো একটু, তারপর বললো, টেলিভিশন দেখে কিংবা বই পড়ে সে অনেক কিছু করতে চাইতো। গত হপ্তায় কি ছবি দেখেছে জানো? পুরানো একটা সিনেমা, দ্য লিটল ফিউজিটিভ।

 হু? বলে উঠলো ক্যাম্পার। ছেলেদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কানে গেছে নিনার কথা।

হ্যাঁ। একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে গল্প। ছেলেটার মনে হয়েছে, তার ভাইকে সে খুন করেছে। ফলে কনি আইল্যাণ্ডে পালিয়েছে সে। কিটুও ওরকম করেই পালিয়েছে। ভেনিস পিয়ারে খুঁজেছে পুলিশ। পায়নি। তারমানে অন্য কোথাও লুকিয়েছে।

 ঠিক বলেছো, নিনা, জোর গলায় বললো ক্যাম্পার। যাবে কোথায়? না। খেয়ে কদিন থাকবে? খিদে সহ্য করতে না পেরে সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে আসবে।

গ্যালারিতে ফিরে গেল ক্যাম্পার।

কিন্তু খিদে আর কতো সহ্য করবে? কাদো কাদো গলায় বললো নিনা, দুদিন তো হয়ে গেল। চোখের পানি মুছে ঘুরলো। পা টেনে টেনে এগোলো বুকশপের দিকে।

মারমেড় গ্যালারির দিকে ফিরলো মুসা। গ্যালারি বন্ধ করে দিয়েছে ক্যাম্পার, দরজায় ঝুলিয়ে দিয়েছে CLOSED লেখা সাইনবোর্ড।

গেছে কোথাও, মুসার দৃষ্টি অনুসরণ করে বললো কিশোর। নিনার গল্পটা নাড়া দিয়েছে তাকে। ওর মুখ দেখেছিলে, কি রকম বদলে গিয়েছিলো?

 বেশি দূর যেতে পারেনি নিশ্চয়, রবিন বললো। দৌড় দিলো ওশন ফ্রন্টের দিকে। চত্বরের উত্তর দিকটা দেখে ফিরে এলো একটু পরেই। গ্যালারির পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামছে। জলদি এসো।

ঘুরে মারমেড ইনের পেছনে চলে এলো ওরা। গ্যারেজ থেকে জাগুয়ারটা বের। করে ফেলেছে ক্যাম্পার।

খাইছে! গাড়ি! ফলো করবো কি করে? হাত নাড়লো মুসা।

এসো, পারবো, বলে অল্পীডওয়ের দিকে ছুটলো কিশোর। রোলস রয়েসটা। এসে গেছে। ওদের পাশে এসে ব্রেক কষলো হ্যানসন। বললো, যাবেন কোথাও…

তার কথা শেষ হলো না। একটানে পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কিশোর। জাগুয়ারটা দেখিয়ে বললো, ওটাকে ফলো করুন।

রবিন আর মুসাও উঠে বসেছে।

 গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে জাগুয়ারের পেছনে লাগলো হ্যানসন।

 প্রথমে পুবে গেল জাগুয়ার। ব্লকখানেক এগিয়ে উত্তরে মোড় নিয়ে চললো সান্তা মনিকার দিকে।

সান্তা মনিকায় গিয়ে সৈকতের দিকে মুখ ঘোরালো জাগুয়ার। থামলো না। থামলো সান্তা মনিকা পিয়ারের সিকি মাইল দূরে। হ্যানসন থামলো না। জাগুয়ারের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে পরের পার্কিং এরিয়ায় ঢুকলো।

গাড়ি থেকে বেরোলো না গোয়েন্দারা। এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে জাগুয়ারটা। ক্যাম্পার বেরোলো।

হেঁটে চললো পিয়ারের দিকে।

হু, আনমনে বললো কিশোর, এখানকার পিয়ারের নিচেই তাহলে লুকিয়েছে ছেলেটা। পুলিশ ভেনিস পিয়ারে খুঁজেছে, সান্তা মনিকায় আসেনি। নিনার কাছে শুনেই ক্যাম্পার অনুমান করে নিয়েছে এখানে থাকতে পারে।

ভেনিস থেকে তো বেশ দূরে জায়গাটা, ক্যাম্পারকে পিয়ারের আড়ালে হারিয়ে যেতে দেখছে রবিন। দু-মাইল তো হবেই।

কিটুর মতো একটা ছেলের জন্যে কি এটা বেশি দূর?

ক্যাম্পার যদি দেখে ফেলে? মুসার গলায় উদ্বেগ। লোকটা সুবিধের না। কি করে বসবে…

থেমে গেল সে। পিয়ারের নিচ থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে ক্যাম্পার। রোগা, লালমুখো, ছেঁড়া পোশাক পরা এক লোক তাড়া করেছে তাকে। হাতে একটা খালি মদের বোতল। বাড়ি মারার ভঙ্গিতে নাড়ছে ওটা।

অলিম্পিক জেতার বাজি রেখেছে যেন ক্যাম্পার। লোকটার আগেই চলে। এলো গাড়ির কাছে। এক ঝটকায় দরজা খুলে উঠে বসলো ড্রাইভিং সীটে। মুহূর্ত পরেই হাইওয়ের দিকে চলতে আরম্ভ করলো জাগুয়ার।

নীরবে হাসছে হ্যানসন। কিশোর তার দিকে তাকাতেই বললো, প্রায়ই কানে আসে সান্তা মনিকা পিয়ারের নিচে বিশেষ ভদ্রলোকদের আড্ডা। আজ বুঝলাম ঠিকই শুনেছি। ক্যাম্পার সাহেবের বোধহয় খবরটা জানা ছিলো না।

হ্যানসনের কথা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে মুসা। এগোলো লোকটার দিকে। মাতালের মতো দুলছে লালমুখে, নিজে নিজেই কথা বলছে।

তার কাছে গিয়ে মুসা খুব বিনয় করে বললো, শুনছেন?

জ্বলন্ত চোখে মুসার দিকে তাকালো লোকটা।

ছোট্ট একটা ছেলেকে খুঁজছি আমরা, আবার বললো মুসা। হাত দিয়ে উচ্চতা দেখিয়ে বললো, এই এত্তোটুকু হবে লম্বা। দুদিন ধরে নিখোঁজ।

না, দেখিনি। বাচ্চাদের ঢুকতে দিই না এখানে। দেখলেই ভাগিয়ে দিই।

আর কিছু বলে লাভ হবে না বুঝে ফিরে এলো মুসা। নাহ, কাজ হলো না।

একেবারেই হয়নি, তা নয়, কিশোর বললো, একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছি। ক্যাম্পারও জানে না কিটু কোথায় আছে। এবং সে-ই ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে চায় সবার আগে। অবাক লাগছে না? তার এতো মাথাব্যথা কিসের? একটু থেমে বললো, বুঝতে পারছি, কিটুকে খুঁজে বের করতে হলে আগে ব্রড ক্যাম্পার রহস্যের সমাধান করতে হবে।

.

১৪.

পরদিন সকালে আবার ভেনিসে গেল তিন গোয়েন্দা। নিনাকে পাওয়া গেল না। বুকশপের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন তার বাবা।

বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকতে বলেছি, বোরম্যান বললেন। না খেয়ে না ঘুমিয়ে একেবারে কাহিল হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তিনটে দিন হয়ে গেল, এখনও এলো না! কি যে হলো ছেলেটার!

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলো কিশোর। মিস্টার বোরম্যান, কুকুরটার পোস্ট মর্টেম করার কথা ছিলো। কিছু বোঝা গেছে?

নাহ, গাড়ি চাপা পড়েছে বলে মনে হয় না। মাথায় আর ঘাড়ে খুব সামান্য আঘাত। ডাক্তারদের ধারণা, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। বুড়ো হয়ে গিয়েছিলো, শক পেয়েছিলো হয়তো, সইতে পারেনি।

দোকানে ঢুকে গেলেন বোরম্যান। ছেলেরা চললো তাদের কাজে।

একটা পরিকল্পনা করে তৈরি হয়ে এসেছে ওরা আজ। সঙ্গে করে ওয়াকি-টকি এনেছে। রবিন আর মুসাকে একটা করে দিয়ে তৃতীয়টা নিজে রাখলো কিশোর। ডিগারের বাড়ির কাছে ঝোঁপের ভেতর গিয়ে নজর রাখার জন্যে লুকিয়ে বসলো রবিন।

 কাফের বারান্দায় একটা টেবিলের কাছে বসলো মুসা আর কিশোর। ব্রড ক্যাম্পারের বাড়ির ওপর চোখ রাখবে ওরা। একটু পরেই সরে গেল জানালার পর্দা। উঁকি দিলো ক্যাম্পার। কিশোর আর মুসার ওপর চোখ পড়তে দ্বিধা করলো একবার, তারপর হাত নাড়লো।

হাত নেড়ে জবাব দিলো দুই গোয়েন্দা।

 এখানে বসে সুবিধে করতে পারবো না, মুসা বললো। দেখে ফেলেছে।

তবু এখানেই বসতে হবে। আগেও বসেছি, কাজেই সন্দেহ করবে না।

কাফে থেকে বেরিয়ে এলো লিসটার। জিজ্ঞেস করলো, কি লাগবে?

ঠিক এই সময় ওয়াকি-টকিতে ভেসে এলো রবিনের কণ্ঠ, কিশোর, এইমাত্র বেরিয়ে গেল ডিগার। তার রুমমেট গেছে দশ মিনিট আগে। বাড়িতে কেউ নেই এখন।

শুনলো লিসটার। ভুরু কোঁচকালো। কিন্তু কিছু বললো না।

মুসাকে বললো কিশোর, তুমি এখানে থাকো। খিদে পেলে খাও। আমি আসছি। গ

লিসটার কিংবা মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চলে এলো মারমেড কোর্টের পেছনে, রবিন যেখানে বসে আছে।

হেঁটে গেছে ডিগার, রবিন জানালো। একবার ভাবলাম পিছু নিই, ভাবলাম দেখিই না, এখানেও কিছু ঘটতে পারে।

ভালো করেছে। বসে থাকো, আমি যাচ্ছি।

দরজায় তালা আটকে দিয়েছে ডিগার।

ঢোকার নিশ্চয় আরও পথ আছে।

ঠিকই আন্দাজ করেছে কিশোর। বাড়ির পুবধারে একটা জানালা খোলা পাওয়া গেল। আস্তে করে চৌকাঠে উঠে বসে ভেতরে লাফিয়ে নামলো সে।

ঘরটা বোধহয় একসময় ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার হতো। ছাত থেকে ঝুলছে অনেক পুরানো একটা ঝাড়বাতি। একধারের দেয়ালে একটা সাইডর্বোড় তৈরি করা হয়েছে, রুপালি রঙ করা। কাঠের মেঝেতে এক জায়গায় পড়ে রয়েছে। কতগুলো ছেঁড়া ম্যাগাজিন। আর কিছু নেই, একটা চেয়ারও না।

রান্নাঘরে ঢুকলো কিশোর। একটা টেবিলে পড়ে আছে এঁটো প্লেট। সিংকে। রয়েছে আরও কয়েকটা। টেবিলের এক কোণে জড়ো করে রাখা হয়েছে কুকুরের খাবার। বাজে গন্ধ বেরোচ্ছে সব কিছু থেকেই। পেছনে যাবার দরজাটা ভাঙা, বেঁকে রয়েছে।

সামনের ঘরে একটা চামড়ার সোফা, বয়েস কতো অনুমান করাই মুশকিল। কাঁচের টপওয়ালা গোল একটা টেবিল, তাতে কয়েকটা কুকুরের কলার, আর সান্তা মনিকা পত্রিকার একটা কপি পড়ে আছে। কুকুর হারানো বিজ্ঞাপনে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা। বাদামী রঙের ম্যানিলা খাম আছে কয়েকটা। সরকারী খাম। ডাকবাক্স থেকে এসব চুরি করে আনে নাকি?–ভাবলো কিশোর।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো সে। শোবার ঘর আর গোসলখানা দেখতে বেশি সময় লাগলো না। চোখে পড়ার মতো কিছু নেই, বাথরুমে কিছু অধধায়া পুরানো কাপড় ছাড়া।

তিনতলা নেই বাড়িটায়, বেসমেন্টও নেই, নেই কিটুর কোনো চিহ্ন।

হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসতে যাবে কিশোর, এই সময় ওয়াকি-টকিতে শোনা গেল রবিনের গলা। কিশোর ডিগার আসছে!

এক দৌড়ে ডাইনিং রুমে চলে এলো কিশোর। জানালা দিয়ে দেখলো, প্যাসিফিক অ্যাভেনর দিক থেকে আসছে ডিগার।

রান্নাঘরে ঢুকলো কিশোর। সামনের বারান্দায় পদশব্দ শোনা গেল। ভাঙা দরজাটা খুলে পিছনের বারান্দায় চলে এলো সে। একসঙ্গে ফেটে পড়লো যেন কুকুরগুলো। প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো।

এই, অমন করছিস কেন? সামনের বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ডিগার।

চট করে পেছনের আঙিনাটায় চোখ বুলিয়ে নিলো কিশোর। তক্তার উঁচু বেড়ায় ঘেরা জায়গাটা। ওটা ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না। একমাত্র যে গেটটা আছে, ওটা দিয়ে বেরোতে গেলে ডিগারের চোখে পড়ে যাবে।

একটা কাজই করতে পারে, এবং সেটাই করলো কিশোর। দৌড় দিলো। কুকুরের খোয়াড়ের দিকে।

এই, এই! দেখে ফেলেছে ডিগার। বাড়ির ধার ঘুরে দেখতে আসছিলো চেঁচামেচি করছে কেন কুকুরগুলো।

ফিরেও তাকালো না কিশোর। সব চেয়ে কাছে যে খোয়াড়টা পেলো, খুলে দিলো ওটার দরজার হুড়কো। খোলা পেয়ে চোখের পলকে বেরিয়ে পড়লো জার্মান শেফার্ড।

এই, এই কুত্তা, ঢোক, ভেতরে ঢোক! চেঁচিয়ে আদেশ দিলো ডিগার।

কি হলো দেখার জন্যে দাঁড়ালো না কিশোর। খুলে দিলো আরেকটা খোয়াড়ের হুড়কো। ঘাউ করে উঠে বেরিয়ে এলো আরেকটা কুকুর। শেফার্ডের ওপর চোখ পড়তেই গেল রেগে। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লো ওটার ঘাড়ে। বেধে গেল মারামারি। থামানোর জন্যে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলো ডিগার। বৃথা চেষ্টা।

আরেকটা খোয়াড়ের হুড়কো খুলে দিলো কিশোর, তারপর আরও একটা।

কুকুরগুলোকে ছাড়াতে গিয়ে ইতিমধ্যেই দু-জায়গায় কামড় খেলো ডিগার।

 বেড়ার ফাঁক দিয়ে এসব দেখলো রবিন। তাড়াতাড়ি খুলে দিলো চত্বর আর ড্রাইভওয়ের মাঝের গেট। খোলা দেখে চোখের পলকে ঝগড়া থামিয়ে দিলো কুকুরগুলো। দৌড় দিলো বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।

ডিগারের অবস্থা দেখার মতো। চেঁচাতে চেঁচাতে গলার রগ ফুলে গেছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন, দুহাত তুলে উন্মাদ নৃত্য শুরু করেছে। কে শোনে কার। কথা। প্রথমেই খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল শেফার্ডটা।

একে একে চারটে কুকুর স্পীডওয়েতে বেরিয়ে চার দিকে ছড়িয়ে পড়লো। ওদের পেছনে ছুটলো ডিগার। শিস দিয়ে এবং আরও যতো রকমে কুকুরকে ডাকা। স, ডেকে ডেকে ফেরানোর চেষ্টা করলো।

 রাস্তার মোড়ে বসে পড়েছে রবিন। বেদম হাসছে।

এই সময় স্পীডওয়ে ধরে আসতে দেখা গেল রুমমেটের ট্রাক।

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়ালো ট্রাকটা। লাফিয়ে নামলো রুমমেট। একটা কুকুরকে ধরার জন্যে ছুটলো। কয়েক পা গিয়েই থেমে গেল যেন দেয়ালে হোঁচট খেয়ে। রাস্তার মাথায় দেখা দিয়েছে দুটো পুলিশের গাড়ি।

 দেখেই আরেক দিকে দৌড় দিলো ডিগার। বেড়ার পাশের কয়েকটা ঝোঁপের দিকে। রুমমেট ছুটলো তার উল্টোদিকে।

চেঁচামেচি শুনে অন্যান্য বাড়ির কয়েকজন লোক বেরিয়ে এসেছে।

 গাড়ি থামিয়ে নামলো পুলিশ।

সবার চোখ এড়িয়ে সরে পড়লো দুই গোয়েন্দা। সন্তুষ্ট হয়েছে কিশোর। একটা কাজ অন্তত সমাধা করতে পেরেছে। বন্ধ করে দিয়েছে ডিগারের কুকুর চুরির ব্যবসা।

.

১৫.

 মারমেড কোর্টের উত্তর ধারে রবিনকে রেখে, ক্যাম্পারের গ্যালারির দিকে এগোলো কিশোর। ঘুরে এসে দেখলো, কাফের বারান্দায় বসে রয়েছে মুসা।

সুতোর দোকানের ওপরে একটা দরজা খুলে গেল। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন মিস এমিনার। ডেকে বললেন, এই, তোমাদের সঙ্গে কথা আছে।

চট করে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো মুসা আর কিশোর।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো দুজনে। দরজায় অপেক্ষা করছেন মিস এমিনার। ডেকে নিয়ে এলেন ভেতরে।

বসার ঘরে বসে আছেন মিস্টার ডেজার। ব্রড ক্যাম্পারের জানালার দিকে চোখ।  

ডিগারকে তো ফাঁসিয়ে দিয়েছো দেখলাম, মিস এমিনার বললেন হাসিমুখে। ক্যাম্পারকেই বা ছাড়বে কেন?

আবার চোখে চোখে তাকালো দুই গোয়েন্দা। ক্যাম্পারকে একেবারেই দেখতে পারেন না মহিলা।

ওকে আপনি দেখতে পারেন না, বলেই ফেললো মুসা।

 ভালো লোক হলে তো পারবো? ডেজার বললেন।

জানালার বাইরে তাকালো কিশোর। গ্যালারিতেই রয়েছে ক্যাম্পার। কফির কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়েছে রান্নাঘর থেকে।

 পুরানো সরাইখানাটার পেছনের অংশে চোখ পড়লো কিশোরের। ডেজারকে জিজ্ঞেস করলো, ওটা সম্পর্কে তার কি ধারণা।

লোকে বলে ভূত আছে বাড়িটাতে, আগেও বলেছেন, আবার বললেন ডেজার। ভূতের কাছাকাছি বাস করতে পেরে যেন খুব খুশি তিনি। ওটা নাকি নিরম হল্যাণ্ডের প্রেতাত্মা।

একেবারে কাঠির মতো শুকনো তার শরীর, যোগ করলেন এমিনার। ভূতের কাছ থেকে নিশ্চয় ভাড়া পায় না ক্যাম্পার। অথচ তার মতো একটা লোক টাকা উপার্জনের চেষ্টা করছে না হোটেলটা থেকে, এটা বিশ্বাস হয় না। না ভাঙার নিশ্চয়। কোনো কারণ আছে।

কিন্তু কারণটা কি? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো কিশোর। দামী জায়গা এখন এটা। সাগরের দিকে মুখ করা। চমৎকার হোটেল বানিয়ে প্রচুর টাকা ইনকাম করা যায়।

আসলে ক্যাম্পারটাকে বোঝাই মুশকিল, জোরে মাথা আঁকালেন মিস এমিনার। আজব লোক!

ওপর তলার জানালায় শিক নেই, কিশোর বললো। ভাবছি, ঢোকা যাবে। কিনা! এই বাড়িটার ছাতের ওপর দিয়ে যাওয়া যায়, চেষ্টা করলে।

অবাক হলো মুসা। কেন? দেখেই তো এলাম একবার।

নিরমা হল্যাণ্ডের ঘরটাতে ঢুকতে পারিনি, ভুলে গেছো?

ওটাতেই তো থাকে ভূত, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ডেজার। ওই জানালী গুলো দেখছো, উত্তর ধারে? ওটা নিরমা হল্যাণ্ডের ঘর। রাতের বেলা ওখানেই আলো দেখি মাঝে মাঝে।

ঘরের ভেতরের আলো না। যুক্তি দেখালেন মিস এমিনার, হয়তো বাইরের আলো এসে পড়ে জানালার কাঁচে, আপনার মনে হয়েছে ভেতরে জ্বলছে।

জবাব দিলেন না ডেজার, এড়িয়ে গেলেন। কিশোরকে বললেন, তোমরা যেতে চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি। ক্যাম্পারের সঙ্গে কথা বলার ছুতোয় তাকে আটকে রাখবো, এই সুযোগে তোমরা গিয়ে ঢুকে দেখে আসতে পারো।

থ্যাংক ইউ, মিস্টার ডেজার।

আমি এখান থেকে চোখ রাখছি, মিস এমিনার বললেন। যদি এক ঘণ্টার মধ্যে না ফেরো তোমরা, মিস্টার ডেজার আর মিস্টার বোরম্যানকে পাঠাবো তোমাদের খুঁজতে।

উঠে বেরিয়ে গেলেন ডেজার। গ্যালারিতে গিয়ে ঢুকলেন। কথা বলতে শুরু করলেন ক্যাম্পারের সঙ্গে। চত্বরের দিকে পেছন ফিরে আছে ক্যাম্পার।

এসো, যাই, মুসাকে বললো কিশোর।

কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। যদি…যদি সত্যিই ভূত থেকে থাকে?

থাকবে না, কারণ, ভূত বলে কিছু নেই। এসো।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলো না মুসা। তবে আর প্রতিবাদও করলো না। মিস এমিনারের ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে চলে এলো। ছাতে উঠে পেরিয়ে এলো মিস্টার ডেজারের ঘরের ছাত। সামনেই সরাইখানার দেয়াল। মাথা নিচু করে রইলো ওরা, যাতে গ্যালারি থেকে ক্যাম্পারের চোখে না পড়ে।

হাত থেকে উঁচুতে তিনতলার জানালা। তবে বেশি উঁচু নয়। উঁকি দিয়ে একবার দেখলো কিশোর, ক্যাম্পার আর ডেজার কথা বলছেন।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা জানালার পাল্লায় ঠেলা দিলো মুসা। খুলে গেল ওটা। জানালা গলে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর।

তিনতলার সমস্ত ঘরই একবার দেখে গেছে। আজ আর দেখার প্রয়োজন মনে। করলো না। সোজা এগোলো সিঁড়ির দিকে। নেমে এসে দাঁড়ালো প্রিন্সেস স্যুইটের। সামনে। নব ধরে মোচড় দিলো মুসা। ঘুরলো না। জানে লাভ হবে না, তবু কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলো পাল্লায়।

আমরা রান্নাঘরের ওপরে রয়েছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর। কিংবা ভাঁড়ারের ওপর। আর তিনতলার কোণের ঘরের নিচে রয়েছি, যেটা থেকে ডামব ওয়েইটার নেমে গেছে। হাসি ফুটলো মুখে। শ্যাফটটা নিশ্চয় প্রিন্সেস স্যুইটের ভেতর দিয়ে নেমেছে। এই দেয়ালটার ঠিক ওপাশে। ঘরে খাবার পাঠানোর জন্যে তৈরি হয়েছে ডামবওয়েইটার, নিশ্চয় বন্ধ থাকার কথা নয় সব জায়গায়। প্রতি তলাতেই ওটা থেকে বেরোনোর জায়গা আছে।

খাইছে! তাই তো!

তাড়াতাড়ি আবার তিনতলায় উঠে এলো ওরা। শ্যাফটের ছোট দরজাটা খুলে ভেতরে উঁকি দিলো কিশোর। অন্ধকার। বাড়িটা তৈরি করতে কাঠ লেগেছে, ওগুলোর মাথা অনেক জায়গায় বেরিয়ে রয়েছে শ্যাফটের ভেতর।

ধরে ধরে সহজেই নেমে যেতে পারবো, বললো মুসা। মইয়ের মতো।

নেমে যেতে আরম্ভ করলো সে।

ওপর থেকে দেখছে কিশোর।  

বেশিক্ষণ লাগলো না, দোতলায় দরজাটা পেয়ে গেল মুসা। পা দিয়ে ঠেলতেই খুলে গেল পাল্লা। শূন্য একটা ঘরে ঢুকলো মুসা। ধুলোর ছড়াছড়ি সবখানে। দরজা। দিয়ে আবার মুখ বের করে ওপরে তাকিয়ে ডাকলো সে, এসো।

কিশোরও নেমে এলো। ঢুকলো নিমা হল্যাণ্ডের ঘরে।

ছোট একটা অ্যান্টিরুমে ঢুকেছে ওরা। পুরানো ধাচের একটা সুইং ডোরের। গায়ে বসানো ছোট কাঁচের ভেতর দিয়ে আলো আসছে।

বাকি ঘরগুলো ওপাশে আছে, ফিসফিসিয়ে কথা বলছে মুসা, ভয়ে ভয়ে। তাকালো এদিক ওদিক। যেন ভয় করছে এখুনি বেরিয়ে আসবে ভূতটা।

সুইং ডোরে ঠেলা দিলে কিশোর। ওপাশে তাকিয়েই হাঁ হয়ে গেল।

ধুলোর নামগন্ধও নেই ঘরটায়। অনেকদিন বদ্ধ থাকলে যেমন ভ্যাপসা গন্ধ থাকে বাতাসে, তেমন গন্ধও নেই। লুকানো কোনো ভেন্টিলেটর দিয়ে বাতাস এসে থিরথির করে কাঁপছে জানালার পর্দা। ভারি, সুন্দর পর্দা, দামী। ঘরে আলো খুব কম তবে কি আছে না আছে দেখতে অসুবিধে হয় না। সাইডবোর্ড আছে কয়েকটা। তাতে রয়েছে রুপার মোমদানী, রুপার নানারকম পানপাত্র। দেয়ালে ঝোলানো অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ছবি।

এই যে,বললো একটা চাপা কণ্ঠ, এটা কেমন?

ভীষণ চমকে গেল মুসা। ধক করে উঠলো বুক। কিশোরের হাত আঁকড়ে প্রলো। ব্রড ক্যাম্পারের গলা।

বাহ সুন্দর তো, মিস্টার ডেজার বললেন। মডার্ন আর্ট বুঝি না আমি, তবে দেখতে ভালোই লাগছে।

শব্দ করলে শোনা যাবে, বুঝে গেছে গোয়েন্দারা, তাই শব্দ করলো না। ঘরে কি আছে দেখতে লাগলো। দামী দামী অনেক জিনিস আছে। কার্পেট, চেয়ার, বাক্স, আর আরও অনেক জিনিস।

ক্যাম্পার আর ডেজার কথা বলছেন। কিন্তু তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না।

দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে শব্দ, অনুমান করলো কিশোর। সেটার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। পুরানো একটা কাঠের বাক্স দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তার। ডালায় আর গায়ে খোদাই করা রয়েছে নানারকম পৌরাণিক দানরে ছবি। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো বাক্সটার কাছে। ডালা ধরে টান দিলো।

ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠলো মুসা। বিস্ময়ে।

বাক্সটা টাকায় বোঝাই। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশো ডলার নোটের বাণ্ডিল থরে থরে সাজানো। ব্যাংকে যেমন থাকে।

আপনার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালোই লাগলো মিস্টার ডেজার, ক্যাম্পার বলছে। তার ইচ্ছে, ডেজার এবার চলে যাক। এতো কাছাকাছি থাকি, অথচ কথা বলারই সুযোগ হয় না। এসে খুব ভালো করেছেন।

ঠেলে চেয়ার সরানোর শব্দ হলো। দেয়ালের ওপাশে পায়ের আওয়াজ এগিয়ে গেল গ্যালারির দরজা পর্যন্ত।

আস্তে ডালাটা আবার নামিয়ে দিলো কিশোর।

গ্যালারির দরজার ঘণ্টাটা বাজলো। তারমানে বেরিয়ে গেছেন ডেজার। আগের জায়গায় ফিরে এলো ক্যাম্পার। চেয়ারটা জায়গামতো নিয়ে গিয়ে রাখলো, আওয়াজ শুনেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।

দেয়ালের কাছ থেকে সরে এলো কিশোর। মুসাকে ইশারা করলো পাশের ঘরে চলে আসতে। তারপর এগোলো, যেখান দিয়ে ঢুকেছে, সেখান দিয়েই বেরিয়ে যাবে আবার।

 কতো টাকা, দেখলে! ফিসফিস করে বললো মুসা।

আনমনে মাথা দোলালো শুধু কিশোর।

কিন্তু এখনো পড়ে আছে কেন? আবার বললো মুসা। নিরমা হল্যাও তো সেই কবেই মরে গেছে।

আমার মনে হয় না টাকাটা তার। ক্যাম্পার কিছু একটা করছে। ও আমাকে বলেছিলো, সরাইটা যখন কেনে তখন একেবারে খালি ছিলো এটা… থমকে গেল। কিশোর। পাশের ঘরে হুড়কো খুলেছে বোধহয় কেউ।

আসছে! বলেই শ্যাফটের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো মুসা।

তাকে কয়েক ফুট ওঠার সময় দিলো কিশোর, তারপর নিজেও ঢুকে পড়লো। সাবধানে লাগিয়ে দিলো দরজা।

আরেকটা দরজা খোলার আওয়াজ হলো। নিশ্চয় সুইং ডোরটা-ভাবলো। কিশোর। ক্যাম্পার ঢুকেছে। ও কি বুঝতে পারবে ঘরে লোক ঢুকেছিলো? দরজা খুলে শ্যাফটে দেখতে আসবে?

কিচ করে আরেকবার শব্দ হলো। ধড়াস করে উঠলো কিশোরের বুক। তবে না, শ্যাফটের দরজা নয়, সুইং ডোরটাই বন্ধ হলো আবার।

আওয়াজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে থেমে গিয়েছিলো মুসা, কিশোরের মতোই সে-ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। উঠতে আরম্ভ করলো ওপরে।

Super User