১০.
একটানা ছুটে চলেছে ট্রাক। এবড়ো খেবড়ো অসমতল পথে নেমে এসেছে এখন। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। কফিনের ভেতর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পড়ে আছে মুসা আর জামান, নড়তে চড়তে পারছে না খুব একটা। হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার অবস্থা।
গুমট হয়ে আসছে কফিনের ভেতরের বাতাস, বাইরে থেকে খুব একটা ঢুকতে পারছে না। বেশিক্ষণ এই অবস্থায় থাকলে অক্সিজেনের অভাবেই মরতে হবে, ভাবল মুসা।
ভয় পেতে শুরু করেছে দুজনেই, কিন্তু কেউই প্রকাশ করছে না সেটা।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? একসময় বলল জামান। ফিসফিস করছে, যদিও কোন দরকার নেই। ট্রাকের ইঞ্জিনের প্রচণ্ড আওয়াজ কানে যাবে না ওয়েব কিংবা মেথুর।
কোথায় কে জানে! বলল মুসা। কথাবার্তা শুনে যা বুঝলাম, কোন গোপন জায়গায় নিয়ে লুকিয়ে রাখবে। যে এই কাজের ভার দিয়েছে, তার কাছে ডাবল টাকা চাইবে। টাকা আদায় করার পর তবে দেবে কফিনটা। ভালই। সময় পাব আমরা। সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়ব কফিন থেকে। বলল বটে, কিন্তু সহজে বেরিয়ে পড়তে পারবে, বিশ্বাস হচ্ছে না তার নিজেরই। যদি দড়ির বাধন না খোলে চোরেরা? এখন যেভাবে আছে, তেমনিভাবে ফেলে রেখে চলে যায়?
প্রফেসরের বাড়িতে দুবার আসতে হয়েছে, বলল ওরা। ফিসফিস করেই বলল জামান। কেউ একজনকে পাগল বলল। কিছু বুঝেছ?
রা-অরকনের মমি চুরি করতে পাঠানো হয়েছে ওদের, বলল মুসা। সোজা কথা, ভাড়া করা হয়েছে। মমিটা নিয়ে গেছে ওরা। কিন্তু সেই লোক চেয়েছে কফিনসুদ্ধ। তাই আবার পাঠিয়েছে ওদেরকে। ওরা গেছে রেগে। কফিনটা নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও রাখবে। ডুবল টাকা না পেলে দেবে না ওটা।
হু, তাই হবে, একমত হল জামান। কিন্তু রা-অরকনের মমি চুরি করবে কে? কেন? ও আমার দাদা, আর কারও নয়।
এটা আরেক রহস্য, বলল মুসা। নিশ্চয় এতক্ষণে একটা নাম দিয়ে ফেলেছে রবিন, নোট লিখে ফেলছে। মমি-রহস্য নামটাই সবচেয়ে উপযুক্ত।
রবিন? রবিন কে?
তিন গোয়েন্দার একজন।
তিন গোয়েন্দা! সেটা আবার কি? জামানের কণ্ঠে বিস্ময়।
অল্প কথায় জানাল সব মুসা।
গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনল জামাল। মুসার কথা শেষ হতেই বলল, তোমরা, আমেরিকান ছেলেরা বড় আরামে আছ। আমার দেশে, লিবিয়ায় অনেক কিছুই অন্য রকম। কার্পেটের ব্যবসা আছে আমাদের। বাবা তো আছেনই, আমাকেও দেখাশোনা করতে হয়। তোমাদের মত এত স্বাধীন না, যা খুশি করতে পারি না। তোমাদের হেডকোয়ার্টার সম্পর্কে আরও বল। টেপ-রেকর্ডার, পেরিস্কোপ, আর? রেডিও, টেলিভিশন, এসব নেই?
রেডিও! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ইসস, আরও আগে মনে হয়নি কেন! বাইরের সাহায্য চাইতে পারতাম আরও আগেই!
পকেটেই আছে ছোট ওয়াকি-টকিটা। কফিনের ভেতরে জায়গা বেশি নেই। ওই স্বল্প পরিসরেই কোনমতে শরীর বাঁকিয়ে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল যন্ত্রটা। কোমর থেকে খুলে নিল অ্যান্টেনা। ডালার ফাঁকে যেখানে পেন্সিল ঢুকিয়েছে ওখান দিয়ে বের করে দিল অ্যান্টেনার এক প্রান্ত। তারপর টিপে দিল সুইচ।
হাল্লো, ফার্স্ট ইনভেস্টিগেটর! মুখের কাছে ওয়াকি-টকি নিয়ে এসেছে মুসা। সেকেণ্ড বলছি। শুনতে পাচ্ছ? জরুরি! ওভার।
জবাবের জন্যে কান পেতে রইল মুসা। এক মুহূর্ত নীরবতা। হঠাৎ ধক করে উঠল তার বুকের ভেতর। কথা শোনা গেল: হ্যালো, টম, শুনতে পাচ্ছ? অন্য কেউ ঢুকে পড়েছে আমাদের চ্যানেলে।
জবাব দিল দ্বিতীয় একটা গলা: হ্যাঁ, জ্যাক। একটা ছেলে। খোকা, যেই হও তুমি, চুপ কর। জরুরি কথা বলছি আমরা। জ্যাক, যা বলছিলাম, পথের মাঝে আটকে গেছি। ট্রাকের টায়ার পাঙ্কচার…
হেল্প! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। শুনুন, আমার নাম মুসা আমান। রকি বীচের কিশোর পাশার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছি। খুব জরুরি!
টমের গলা শোনা গেল: কার সঙ্গে যোগাযোগ? খোকা, কি বলতে চাইছ তুমি?
রকি বীচের কিশোর পাশাকে ফোন করুন, প্লীজ, অনুরোধ জানাল মুসা। ওকে বলুন মুসা সাহায্য চাইছে। অত্যন্ত জরুরি।
জ্যাক বলল: কি ধরনের জরুরি, খোকা?
একটা মমির বাক্সে আটকে গেছি, বলল মুসা। রা-অরকনের মমি। চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ট্রাকে করে। কিশোর সব বুঝতে পারবে। প্লীজ, ফোন করুন তাকে।
হেসে উঠল জ্যাক। বলল: টম, শুনলে? এই ছেলেছোকরাগুলোর কথা আর কি বলব? নেশার বড়ি খেয়ে খেয়ে সমাজটাই শেষ হতে বসেছে!
প্লীজ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।নেশা করিনি আমি! কিশোরকে ফোন করুন।
জ্যাক বলল: খোকা, যা করেছ করেছ, আর দুষ্টুমি কোরো না। সিটিজেন ব্যাণ্ডে গোলমাল পাকালে বিপদে পড়বে। পুলিশ শুনলেই কাক করে গিয়ে ধরবে।—টম, অবস্থান জানিয়েছি সাহায্য পাঠাও।
নীরব হয়ে গেল রেডিও।
হল না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল হতাশ মুসা। অন্য কিছু বলা উচিত ছিল ওদের। টাকা হারিয়ে বিপদে পড়েছি, বা এমনি কিছু। সত্য কথা বলেছি, বিশ্বাস করেনি। ওদেরকে দোষ দেয়া যায় না। মমির বাক্সে ঢুকে আছি, এটা বিশ্বাস না করারই কথা।
কি আর করবে? তোমার চেষ্টা তুমি করেছ। আর কিছু করার নেই।
হ্যাঁ। এমন অবস্থায় হাজার বছরে কেউ একবার পড়ে কিনা সন্দেহ! কাতর শোনাল মুসার গলা।
খানিকক্ষণ নীরবতা। ছুটে চলেছে ট্রাক। ভাবছে মুসা। তার অবস্থায় পড়লে কিশোর কি করত, বোঝার চেষ্টা করছে। সময়টা কাজে লাগাতে চাইত কিশোর। কিভাবে? প্রশ্ন করে। জামান যা যা জানে, জানার চেষ্টা করত।
জামান, জিজ্ঞেস করল মুসা। তুমি লিবিয়ার ছেলে। এত ভাল ইংরেজি শিখলে কি করে?
ভাল ইংরেজি বলতে পারি! বলছ? খুশি হলাম, সন্তুষ্ট শোনাল জামানের গলা। অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না মুসা, তবে খুশি যে হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমেরিকান শিক্ষকের কাছে শিখেছি। বড় হলে ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার দরকার পড়বেই। তাই আমাকে ইংরেজি শিখতে হয়েছে। শুধু ইংরেজি না, ফরাসী আর স্প্যানিশও জানি। একটু থেমে আবার বলল, লিবিয়ায় আমাদের বংশের নাম আছে। বহু পুরুষ ধরে কার্পেটের ব্যবসা করছি। আমরা।
তা-তো বুঝলাম, বলল মুসা। কিন্তু এসবের মাঝে রা-অরকন আসছে কি করে? তুমি বলছ, ও তোমাদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু প্রফেসর বেনজামিনের মত, রা অরকন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। ও কে ছিল, কি করত, কেউ কিছু জানে না।
বইয়ে লেখা নেই, তাই জানে না। তবে কিছু কিছু জ্ঞানী লোক আছেন, যাঁরা দুনিয়ার অনেক কিছু সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। বই পড়তে হয় না তাদেরকে।
যেমন?
মাস দুই আগে, বলল জামান। এক জ্যোতিষ এসেছিল আমাদের বাড়িতে। বাবাকে বলল, সে স্বপ্নে দেখেছে, কেউ তাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলছে। তাই সে এসেছে। বাবা তাকে আদর-আপ্যায়ন করে বলেন, খাওয়ালেন। তারপর ধ্যানে বসল জ্যোতিষ। বিড়বিড় করে অদ্ভুত সব কথা বলতে লাগল। একসময় তার। মুখ দিয়ে কথা বলে উঠলেন রা-অরকন। তিনি বললেন, শ্বেতাঙ্গ বর্বরদের দেশে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজের দেশে না এলে তার শান্তি নেই। জামান বংশের পূর্বপুরুষ তিনি। কাজেই তাকে ফিরিয়ে আনা জামানদেরই কর্তব্য। বর্বরদের দেশে গেলেই রা-অরকনের কথার প্রমাণ পাবেন বাবা। প্রিয় বেড়ালের রূপ ধরে দেখা দেবেন তিনি বাবাকে। কথা শেষ হতেই ধ্যান ভেঙে গেল জ্যোতিষের। আশ্চর্য! রা অরকন কি কি বলেছেন কিছুই বলতে পারল না সে। বাবা সব খুলে বলতেই গম্ভীর হয়ে গেল।
কোনরকম ফাঁকিবাজি নেই তো?
না না। লোকটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে। চুল, লম্বা লম্বা দাড়ি, সব ধবধবে সাদা। একটা চোখ অন্ধ। বয়েসের ভারে কুঁজো, লাঠিতে ভর করে হাঁটে। সঙ্গে বোঝা ছিল। ওটা থেকে স্ফটিকের একটা বল বের করে কি সব পড়ল বিড়বিড়িয়ে। এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইল বলটার দিকে। তারপর অতীত আর ভবিষ্যতের অনেক অদ্ভুত কথা বলে দিল গড়গড় করে।
খাইছে! তোমার বাবা কি করলেন তখন?
আমাদের ম্যানেজার জলিলকে কায়রো পাঠালেন। সে গিয়ে জেনে এল, সত্যিই কায়রো মিউজিয়মে রাখা ছিল রা-অরকনের মমি। তখন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে আমেরিকায়। ক্যালিফোর্নিয়ার এক প্রফেসর হার্বার্ট বেনজামিনের কাছে যাবে। জ্যোতিষ ঠিকই বলেছে। বাবা তখন অসুস্থ। তাই নিজে আসতে পারলেন না। আমাকে আর ম্যানেজারকে পাঠালেন রা-অরকনের খোঁজে। এলাম। খুঁজে খুঁজে বের করলাম প্রফেসরের বাড়ি। তাঁর কাছে গেল ম্যানেজার। মমিটা দিয়ে দিতে বলল। কিন্তু রাজি হল না বর্বর প্রফেসর। উল্টো গালমন্দ করে জলিলকে বের করে দিল বাড়ি থেকে।
শুনেছি, বলল মুসা। প্রফেসর বলেছেন।
তখন চুরি করার ফন্দি আঁটল জলিল। এক কোম্পানিকে ধরে মালীর কাজ নিল। প্রফেসরের বাগানের কাজ করতে এসে নজর রাখতে লাগল বাড়িটার ওপর। আমিও রইলাম তার সঙ্গে। চুরি করার বেশ কয়েকটা সুযোগ পেয়েছি আমরা। কিন্তু অচেনা অজানা দেশ, বিদেশ। কাউকে চিনি না। চুরি করার সাহস হল না।
কিন্তু চুরির ফন্দি করলে কেন? প্রফেসরের কাছে মমিটা কিনে নেয়ার প্রস্তাব দিতে পারতে। ভাল টাকা পেলে হয়ত বিক্রি করে দিতেন।
রা-অরকন আমার দাদা! হিমশীতল কণ্ঠ জামানের। জোর করে কেউ তাঁকে। আটকে রাখবে, আর তার কাছ থেকে কিনে নিতে হবে, কেন? বর্বরদের দেশ কি আর সাধে বলেছি? সে যাই হোক, আমরা পারলাম না শেষ অবধি। অন্য একজন চুরি করে নিল। কিন্তু কে করল কাজটা? কেন?
ভাবনা চলছে মুসার মাথায়। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, লোক দিয়ে। জলিলই চুরি করিয়েছে মমিটা? তোমাকে না জানিয়ে হয়ত করেছে একাজ।
না, তা হতে পারে না। আমাকে জানাই। আমার সঙ্গে আলোচনা না করে। এক পা বাড়ায় না সে। বাবা মারা গেলে আমিই মালিক হব, জানা আছে তার।
তাই? জামানের সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারছে না মুসা। তো, রা-অরকন যে কথা বলল, এর কি ব্যাখ্যা দেবে?
জানি না! হয়ত রা-অরকন খেপে গিয়েছেন। আমার আর জলিলের ওপরও হয়ত রাগ করেছেন তিনি। নাহ্, এটা সত্যিই এক আজব রহস্য! গাঢ় অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে জামান, কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ নীরবতা।
থেমে গেল ট্রাক। কফিনের ভেতর থেকে দুজনের কানে এল একটা শব্দ, গ্যারেজ কিংবা ওয়্যারহাউসের দরজা খোলা হচ্ছে। আবার নড়ে উঠল ট্রাক। কয়েক গজ এগিয়ে থামল। বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। দরজা নামানর শব্দ শোনা গেল।
ট্রাকের পেছনের ডালা নামানর শব্দ হল। খানিক পরেই তোলা হল। কফিনটাকে। বয়ে নিয়ে গিয়ে ধপ করে নামানো হল মেঝেতে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। ভেতরে থেকে ছেলে দুটোর মনে হল, মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে ওদের।
চল যাই, শোনা গেল মেথুর গলা। এটা থাক এখানেই।
থাক, বলল ওয়েব। সকালে ফোন করব মক্কেলকে। বলব, কত চাই আমরা। আজ রাতটা একটু ভাবনা-চিন্তা করেই কাটাক।
কিন্তু কাল সকালেও তো পারা যাবে না, বলল মেথু। লং বীচে একটা কাজ করতে হবে, ভুলে গেছ?
তাই তো। ঠিক আছে, সকালে না পারলে বিকেলে ফোন করব। নত রাতে। দিনটাও দুশ্চিন্তা করেই কাটাক।
কত চাইব, বল তো? দ্বিগুণ নাকি তিন গুণ? জিনিসটা পাওয়ার জন্যে যেরকম উদ্বিগ্ন দেখলাম ওকে, আমার মনে হয় না করতে পারবে না। শেষ অবধি রাজি হয়ে যাবেই।
সে দেখা যাবে। চল, যাই এখন।
আবার দরজা খোলার শব্দ। স্টার্ট হল ইঞ্জিন। পিছিয়ে বেরিয়ে গেল ট্রাকটা।
উত্তেজনায় দুরুদুরু করছে মুসার বুকের ভেতর। ঠেলা দিয়ে দেখল কফিনের ডালায়। নড়াতে পারল না ঢাকনা। বড় বেশি শক্ত দড়ির বাঁধন।
.
১১.
হেডকোয়ার্টার। খটাখট টাইপ করছে রবিন। নোট লিখছে।
আজব বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে তার চেয়ারে বসে আছে কিশোর। চিন্তিত। আলতো চাপড় দিচ্ছে বেড়ালের গায়ে। মৃদু ঘড়ঘড় করে আনন্দ প্রকাশ করছে। ওটা।
সেরেছে! টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলেছে রবিন। দশটা বাজতে পাঁচ! মুসার কি হল?
হয়ত কোন সূত্র পেয়ে গেছে, বলল কিশোর। তদন্তের কাজে ব্যস্ত।
কিন্তু যেখানেই যাক, দশটার মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা তার। আমারও তাই। বেশি দেরি করলে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়ে যাবে বাড়িতে।
ফোন করে বলে দাও, ফিরতে আরও খানিক দেরি হবে। ইতিমধ্যে এসে যাবে মুসা।
ফোন ধরলেন রবিনের মা। আরও আধঘণ্টা থাকার অনুমতি দিলেন ছেলেকে।
বেড়ালটাকে ডেস্কের ওপর নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল কিশোর। গিয়ে চোখ রাখল পেরিস্কোপে। ইয়ার্ডের গেটে আলো। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট থেকেও আলো এসে পড়ছে চতুরে। নীরব, নির্জন। মেরিচাচীর ঘরে আলো জ্বলল। টেলিভিশন দেখছেন চাচা-চাচী। বোরিস আর রোভারের কোয়ার্টার অন্ধকার। সিনেমা থেকে এখনও ফেরেনি ওরা।
আবার রাস্তার দিকে পেরিস্কোপ ঘোরাল কিশোর। একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে। গেটের কাছে এসে গতি কমাল। একটা নীল স্পোর্টস কার। ড্রাইভারের আসনে বসে আছে লম্বা শুকানো এক কিশোর। মুখ ফিরিয়ে ইয়ার্ডের দিকে তাকাল ছেলেটা। তারপর আবার এ লি। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
চেয়ারে ফিরে এল কিশোর। মুসার কোন চিহ্ন নেই, গম্ভীর কণ্ঠস্বর। কিন্তু শুটকো টেরি শহরে ফিরে এসেছে। জ্বালাবে।
তাই নাকি! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। তাহলে গেল আমাদের শান্তি!
গেটের কাছে থেমেছিল। জানা কথা, আমাদেরকে খুঁজছে।
বেশি বাড়াবাড়ি করলে এবার ধরে পেটাব। ব্যাটা জন্মের শয়তান! আবার টাইপে মন দিল রবিন।
সময় যাচ্ছে। মুসার জন্যে ভাবনা বাড়ছে দুজনের।
আর আধঘণ্টা অপেক্ষা করব, অবশেষে বলল কিশোর। তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
টাইপ থামিয়ে দিয়েছে রবিন। কিশোর, কোন বিপদে পড়েনি তো মুসা? একটা টেলিফোনও তো করতে পারত!…কিশোর, ওয়াকি-টকিতে যোগাযোগের চেষ্টা করছে না তো!।
তাই তো! প্রায় লাফিয়ে উঠল কিশোর। টেবিলে রাখা লাউডস্পীকারের সঙ্গে ওয়াকি-টকির যোগাযোগ করে দিয়ে সুইচ টিপল। হেডকোয়ার্টার ডাকছে। সহকারীকে! সেকেণ্ড, শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? সেকেণ্ড!
স্পীকারের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
আবার চেষ্টা করল কিশোর। বৃথা। নাহ্, মাথা নাড়ল সে। চেষ্টা করছে না মুসা। কিংবা রেঞ্জের বাইরে রয়েছে। রবিন, রাত অনেক হয়ে গেছে। তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি থাকছি এখানেই।
অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল রবিন। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে সাইকেলটা নিয়ে চলে গেল ইয়ার্ড থেকে।
বাড়িতে ঢুকল রবিন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। বাবার ডাক শুনতেই পেল না।
রবিন? আবার ডাকলেন মিস্টার মিলফোর্ড। এত কি ভাবছিস রে? স্কুল তো ছুটি। পরীক্ষা-টরীক্ষা নেই।
মুখ তুলে তাকাল রবিন। বাবার দিকে এগোল। বাবা, একটা সমস্যায় পড়েছি! একটা রহস্য।
বলবি নাকি আমাকে?
বাবা, একটা বেড়াল, দুটো চোখ দুই রঙের। একটা সোফায় বসে পড়ল রবিন। নীল আর কমলা।
হুম! আস্তে মাথা নাড়লেন মিস্টার মিলফোর্ড। পাইপে তামাক ঠেসে আগুন ধরালেন।
কিন্তু, বাবা, আসল সমস্যা বেড়ালটা নয়। একটা মমি। তিন হাজার বছরের পুরানো। ওটা কথা বলে!
তাই নাকি? পাইপে টান দিলেন মিস্টার মিলফোর্ড। হাসলেন। এটা একটা সমস্যা হল? মমিকে কথা বলানো সহজ। পুতুল নাচ দেখিসনি? পুতুলকে কি করে কথা বলায় ওরা?
চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল রবিন প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে।
বুঝলি না? আবার পাইপে টান দিলেন মিস্টার মিলফোর্ড। ভেন্ট্রিলোকুইজম। যুক্তির ভেতরে আয়। মমি হল মরা শুকনো লাশ, ওটার কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। তার মানে, মমিটার হয়ে কোন একজন মানুষ কথা বলে। সুতরাং, রহস্যের সমাধান করতে হলে আশপাশে এমন একজন প্রতিবেশীর খোঁজ কর গিয়ে, যে ভেন্ট্রিলোকুইজম জানে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল রবিন। ফোনের দিকে ছুটল। কিশোরকে জানাতে হবে। পেছনে চাইলে দেখতে পেত, হাসিতে ভরে গেছে বাবার মুখ। ছেলেবেলায়। তিনিও রবিনের মতই চল ছিলেন। ছেলের মতিগতি তাই খুব ভাল করেই বোঝেন।
দ্রুতহাতে ডায়াল করল রবিন। প্রথম রিঙের সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে রিসিভার তুলল কিশোর। রবিনের সাড়া পেয়ে হতাশ মনে হল তাকে। আমি ভেবেছিলাম, মুসা! তো, কি খবর, রবিন? মুসার খবর জানতে চাইছ তো?
বুঝতেই পারছি, ওর কোন খবর নেই, বলল রবিন। কিশোর, মমির ব্যাপারটা নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করেছি। বলল, ব্যাপারটা ভেন্ট্রিলো কুইজমের কারসাজি। প্রফেসরের কোন প্রতিবেশীর কাজ।
সেটা আগেই ভেবেছি আমি, খুব একটা উৎসাহ দেখাল না কিশোর। প্রফেসরের বাড়ির কাছাকাছি কোন প্রতিবেশী নেই।
তবু, ভেবে দেখ, ভেবেছিল সাংঘাতিক একটা তথ্য দিয়ে চমকে দেবে। কিশোরকে, হতাশই হল রবিন। হয়ত জাদুঘরের ঠিক বাইরে, কিংবা দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে লোকটা। ওখান থেকে কফিন লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেয় কথা।…যাক গে, মুসার কি অবস্থা? প্রফেসরের বাড়িতে একবার ফোন করে দেখ না। আমরা চলে আসার পর গিয়েও থাকতে পারে।
তাই করব এখন, বলল কিশোর। আর হ্যাঁ, ভেন্ট্রিলোকুইজম নিয়ে আরও ভাবব। একেবারে বাতিল করে দেয়া যায় না সম্ভাবনাটা এখনই।—গুড নাইট।
রিসিভার নামিয়ে রাখল রবিন। নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। কাপড় ছেড়ে বিছানায় গেল। কিন্তু ঘুম আসছে না। হাজারটা ভাবনা এসে ভিড় করছে মনে। সবচেয়ে বেশি ভাবছে মুসার কথা। কোন বিপদে পড়ল না তো? রা-অরকনের। অভিশাপ তারই ওপর নামল না তো প্রথম…
.
অভিশাপ নামেনি, তবে মস্ত বিপদেই আছে মুসা আর জামান। দুজনে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে ডালা খোলার! কিন্তু এতই শক্ত বাধন, একটুও ঢিল হচ্ছে না।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকটা তখনও, ইঞ্জিনের শব্দেই বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ থেমে গেল ইঞ্জিনের শব্দ। পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। নিশ্চয় আবার ফিরে আসছে দুই চোর। কেন?
ভাল কথাই মনে করেছ, মেথুর গলা। দিনের বেলা কেউ ঢুকলে এটা চোখে পড়বেই। একটা কফিন পড়ে আছে দেখলে কৌতূহলী হয়ে উঠবে। ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে রাখাই ভাল।
সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি, বলল ওয়েব। ঢাকা দেখলে কেউ ফিরেও তাকাবে না। ভাববে ট্রাকের কোন মাল।
কাম সারছে! ফিসফিস করে বলল মুসা। এতক্ষণ তো বাতাস পেয়েছি, এবার সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে! দম বন্ধ হয়েই মরব! তারচেয়ে, চেঁচিয়ে উঠি! কয়েকটা চড়থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিতেও পারে!
আমিও সে কথাই ভাবছি! বলল জামান।
চেঁচানর জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল মুসা। একটা বিশেষ কথা কানে ঢুকেছে।
.
১২.
ওয়েব, বলছে মেথু। দড়িটা খুলে নাও আগে। কাল দরকার পড়বে।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, বলল ওয়েব। খুলে নিচ্ছি।
দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করে রইল মুসা আর জামান। দড়ি খোলার শব্দ শুনল। কফিনের ওপর ক্যানভাস টেনে দেয়ার খসখস আওয়াজ আসছে।
আবার দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। খানিক পরেই শোনা গেল ইঞ্জিনের শব্দ। চলে গেল ট্রাক।
আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল মুসা। তারপর ঠেলা দিল ডালায়। তার সঙ্গে হাত লাগাল জামান।. ডালা খুলে গেল। তবু অন্ধকার। ক্যানভাসে ঢাকা রয়েছে। দাঁড়িয়ে উঠে ঠেলে ক্যানভাস সরিয়ে ফেলল মুসা, জামান বেরিয়ে গেল আগে। তারপর বেরোল সে।
অন্ধকার। মাথার ওপরে স্কাইলাইট। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলো আসছে। ঘরের জিনিসপত্র আবছা চোখে পড়ল ওদের। একটা স্টোররুম। উঁচু ছাদ, কংক্রীটের দেয়াল, কোন জানালা নেই। বড় একটা লোহার দরজা। ধাক্কা দিল। বাইরে থেকে শক্ত করে আটকানো। ঝন ঝন আওয়াজ হল শুধু। খুলল না।
ঘরে কি কি আছে জানার চেষ্টা করল মুসা আর জামান। বেরিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজছে। আধো অন্ধকার। ভালমত দেখা যাচ্ছে না। কিছু দেখে কিছু হাতের আন্দাজে খোঁজাখুঁজি চালাল ওরা। প্রথমেই চোখে পড়ল একটা পুরানো মোটরগাড়ি। বোঝা গেল, ওটা একটা প্রাচীন পিয়ার্স-অ্যারো সিডান। ঝরঝরে হয়ে গেছে।
পুরানো মোটরগাড়ি! জামানের কণ্ঠে বিস্ময়। এটা এখানে কেন?
কেউ সংগ্রহ করে রেখেছে হয়ত। উনিশশো বিশ সালের জিনিস হবে। গ্রাহকদের কাছে খুব দামি।
এরপর কিছু পুরানো আসবাবপত্র দেখল। ভারি! সূক্ষ্ম কারুকাজ-আঙুল চালিয়ে দেখে বুঝল। জিনিসগুলো রাখা আছে একটা কাঠের মঞ্চের ওপর।
শুকনো রাখার জন্যে, জামানকে বলল মুসা। জমা করে রাখা হয়েছে।—কিন্তু এগুলো কি?—গাদা করে রাখা?
ছুঁয়ে দেখল জামান। রোল পাকিয়ে জিনিসগুলো একটার ওপর আরেকটা রেখে পিরামিড বানিয়ে ফেলা হয়েছে যেন। কার্পেট! মধ্যপ্রাচ্যের জিনিস! খুবই ভাল, অনেক দামি!
কি করে বুঝলে? মুসা অবাক। ভালমত দেখাই যাচ্ছে না।
আট বছর বয়েস থেকেই কার্পেট ঘাটাঘাটি করছি। এগুলো তো আবছামত দেখা যাচ্ছে। না দেখে শুধু ছুঁয়েই বলে দিতে পারি কোনটা কেমন কার্পেট, কি ধরনের সুতো দিয়ে বানানো, বুনট কেমন। আমাদের কোম্পানির জিনিস নয় এগুলো। তবে দামি। একেকটা দুতিন হাজার ডলারের কম হবে না।
ওরেব্বাবা! নিশ্চয় চুরি করে আনা হয়েছে, বলল মুসা। বাজি ধরে বলতে পারি, এই ঘরের সব জিনিসই চোরাই মাল। ওয়েব আর মেথু, দুই ব্যাটাই পেশাদার চোর। এজন্যেই রা-অরকন আর কফিনটা চুরি করার জন্যে ওদেরকে ডাকা হয়েছে।
হ্যাঁ, তাই হবে, একমত হল জামান। কিন্তু এখন এখান থেকে বেরোই কি করে?
এই যে, আরেকটা দরজা! অন্ধকারে প্রায় ঢাকা পড়ে ছিল ছোট দরজাটা। একটা দেয়াল, বোধহয় অন্য ঘরগুলো থেকে আলাদা করে রেখেছে স্টোররুমটাকে।
হাতল ধরে টান দিল মুসা। খুলল না দরজা। আরেকটা দরজা খুঁজে পেল। ওরা। ওটা বাথরুমের।
মনে হয়, মুসা বলল। ঘরটা তৈরিই হয়েছে চোরাই মাল রাখার জন্যে। দরজাগুলোও তৈরি হয়েছে সে কথা চিন্তা করেই। মেথু আর ওয়েব জানে কি করে ঢুকতে হয়, বেরোতে হয়। কিন্তু আমরা বেরোই কি করে? ওপরের দিকে চেয়ে কি ভাবল। ওখান দিয়ে যাওয়া যাবে! বলল আপনমনেই।
যাবে, যদি উড়তে পার।
না উড়েও হয়ত পারব। এস, চেষ্টা করে দেখি। গাড়িটা—স্কাইলাইটের ঠিক নিচে রয়েছে।
ঠিক! উত্তেজিত হয়ে পড়েছে জামান। চল উঠে দেখি। নাগাল পাই কিনা!
ধীরে, বন্ধু, ধীরে, জামানের হাত চেপে ধরেছে মুসা। এত তাড়াহুড়া কোরো না। জুতোর সুখতলার ঘষায় রঙ ছাল তুলে ফেলবে। গাড়িটার অ্যানটিক মূল্যই খতম হয়ে যাবে।
জুতো খুলে নিল দুজনেই। একটার সঙ্গে আরেকটার ফিতে বেঁধে যার যার জুতো গলায় ঝুলিয়ে নিল। বেয়ে উঠে পড়ল গাড়ির ছাদে। কিন্তু দাঁড়িয়ে উঠে দুহাত টান টান করে তুলে দিয়েও নাগাল পেল না মুসা। আরও ফুটখানেক ওপরে থেকে যায় স্কাইলাইট।
লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করব, বলল মুসা। যে করে থোক বেরোতেই হবে এখান থেকে।
লাফ দিল মুসা। আঙুলে ঠেকল স্কাইলাইটের ধাতব কিনারা। আঁকড়ে ধরল। ঠেলে খুলে ফেলতে একটা মুহূর্ত ব্যয় করল। দুহাতে ভর দিয়ে টেনে তুলল। শরীরটা। বেরিয়ে এল ধুলোবালিতে ঢাকা ছাদে। বসে পড়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিল নিচে। লাফ দাও, জামান! আমার কব্জি চেপে ধর।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল জামান। নিচে কংক্রীটের মেঝের দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার মুখ তুলল। লাফ দিল হঠাৎ। তার আঙুল ছুল মুসার হাত। কিন্তু আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না, পিছলে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে জামানের কব্জি ধরে ফেলল মুসা। টেনে তুলে আনল ওপরে।
প্রচণ্ড শক্তি তোমার গায়ে, মুসা! দুঃসাহসীও বটে! গোয়েন্দা হওয়ারই উপযুক্ত তুমি।
হয়েছে হয়েছে, প্রশংসা থামাও, হাত তুলল মুসা। ফুলে ফেঁপে শেষে পেট ফেটেই মরব। গলায় ঝোলানো জুতো নামিয়ে এনে ফিতে খুলতে শুরু করল। জলদি খোল! এখানে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।
বিল্ডিঙের পেছন দিকে ছাতে ওঠার লোহার সিঁড়ি। অন্ধকার একটা সরু গলিতে নেমে এল ওরা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেও। কেউ আসছে কিনা কিংবা লক্ষ্য করছে কিনা, দেখল। কেউ নেই। নির্জন।
পকেট থেকে নীল চক বের করল মুসা। লোহার বড় দরজাটা খুঁজে বের। করল। ওটার নিচে বাঁ দিকে চক দিয়ে বড় বড় কয়েকটা প্রশ্নবোধক আঁকল। আমাদের বিশেষ চিহ্ন, সঙ্গীকে বলল সে। আগামীকাল ফিরে আসব। চিহ্ন দেখেই বুঝতে পারব, কফিনটা কোথায় রয়েছে। চল, মোড়ের ওদিকে গিয়ে এই রাস্তার নাম দেখি। আরে, কে জানি আসছে! চোর-টোর না তো!
গলি ধরে দ্রুত উল্টো দিকে রওনা হয়ে গেল ওরা। মোড় নিয়ে দুটো দোকানের মাঝের অন্ধকার গলি ধরে বেরিয়ে এল অন্য পাশে। কানা গলিই বলা চলে এটাকে। ল্যাম্পপোস্ট নেই। একটা দোকানের দরজার কপালে জ্বলছে ম্লান আলো, তাতে বিশেষ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারল মুসা, এই অঞ্চলে আগে কখনও আসেনি। একেবারেই অচেনা।
কোথায় এসেছি, যেভাবেই হোক জানা দরকার, বলল মুসা। জামানের হাত ধরে টানল, এস, ওই মোড়টায় চলে যাই। ফলকে নিশ্চয় রাস্তার নাম লেখা আছে।
ফলকটা পাওয়া গেল ঠিকই, কিন্তু নাম পড়ার উপায় নেই। অনেক দূরে ল্যাম্পপোস্ট, আলো ঠিকমত পৌঁছাচ্ছে না এখানে। তাছাড়া কলাকটার ওপৰ্ব কাদা লেপে দিয়েছে বোধহয় কোন দুষ্ট ছেলে।
বদমাশ ছেলেগুলোকে ধরে পেটানো উচিত বিড়বিড় করল মুসা আপনমনেই। আরও কিছু একটা বলতে গিয়েই থেমে গেল।
যে গলি থেকে বেরিয়েছে ওরা ওটার শেষ মাথায় কাঁচ ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ উঠল। চেঁচিয়ে উঠল কেউ। ছুটে এল দুটো লোক। ল্যাম্পপোস্টের কাছ থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়িতে গিয়ে ঢুকল। স্টার্ট দিয়ে মুসা আর জামানের পাশ দিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছনে চিৎকার অনলা ওরা। চোর! চোর! বিশালদেহী এক লোক ছুটে আসছে। ছেলেদেরকে দেখেই ঘুসি পাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, হারামজাদা, বদমাশেরা! চোর! আমার জানালা ভেঙেছিস! চুরি করেছিস। দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা!
লোকটার চেঁচামেচিতে কয়েকটা বাড়ির দরজা খুলে গেছে। বেরিয়ে এসেছে। আরও কয়েকজন লোক। সবাই ছুটে আসছে।
খপ করে জামানের হাত চেপে ধরুল মুসা। দৌড় দাও! ধরতে পারলে হাড় গুড়ো করে ফেলবে!
ছুটল ওরা। এ-গলি, ও-গলি, এ-রাস্তা, সে-ব্রাতা, এ-বাড়ির পাঁশ, ও দোকানের কোণ পেরিয়ে এসে পড়ল একটা বড় রাস্তায়। পেছনে তখনও তাড়া করে আসছে লোক। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দুটো কুকুর। হাঁপাচ্ছে মুসা আর জামান। আর বেশিক্ষণ পারবে না। বুকের ভেতর ভীষণ লাফালাফি করছে হৃৎপিণ্ড। তবু থামল না ওরা। ছুটে ঢুকে পড়ল আরেক গলিতে।
অবশেষে তাড়া করে আসা লোকদেরকে হারিয়ে দিল ওরা। ততক্ষণে দম। ফুরিয়ে গেছে একেবারে। ধূপ করে পর্থের ওপরই বসে পড়ল দুজনে। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
খামোকা—দৌড়েছি! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা। আমরা চোর নই, জানালাও ভাঙিনি ওদেরকে সে কথা বুঝিয়ে বললেই হত।
হত না, বলল জামান। চোর বলে কেউ তেড়ে এলে প্রথম কাজ ছুট লাগানো। ঠিকই করেছ। ওরা হয়ত বুঝত শেষ অবধি, কিন্তু ততক্ষণে কিল খেয়ে থেঁতলে যেত আমাদের শরীর। ঠিকই হয়েছে, ছুট লাগিয়েছি।
কিন্তু…কাজটা খারাপ হয়ে গেল, তিক্ত কষ্ঠ মুসার। কোন জায়গা থেকে ছুট লাগিয়েছি, জানি না। কোথায় কোন্দিকে ছুটেছি, তা-ও বলতে পারব না। স্টোর হাউসটা কোথায় সামান্যতম ধারণাও নেই।
আমারও না, হতাশ মনে হল জামানকে। পড়লাম আরেক সমস্যায়, তাই না?
তাই, মাথা নাড়ল মুসা। আবার কি করে খুঁজে পাঁব বাড়িটা? বাড়িই বা ফিরব কি করে? রকি বীচ থেকে কম করে হলেও পনেরো মাইল দূরে রয়েছি আমরা। হলিউড থেকে মাইল দশেক। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলী বলেই মনে হচ্ছে।
ট্যাক্সি নিতে পারি, বলল জামান।
তা পারি, বলল মুসা। কিন্তু আমার পকেটে যা আছে তাতে কুলাবে না।
আমার কাছে আছে, আশ্বাস দিল জামান। অনেক টাকা আছে। আমেরিকান ডলার। বেশ পুরু একটা নোটের তাড়া বের করে দেখাল সে।
ভাল, উঠে দাঁড়াল মুসা। আঙুল তুলে একটা দিক দেখাল। আলো। শহর নিশ্চয়। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে ওদিকে।
দ্রুত এগিয়ে চলল দুজনে। মোড়ের কাছে একটা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড। ভাড়া দিতে পারবে? ছেলেদের দেখে সন্দেহ প্রকাশ করল ড্রাইভার। জামান নোটের তাড়া দেখাতেই নেমে এসে পেছনের দরজা খুলে ধরল।
গাড়িতে চড়ার আগে আশপাশের এলাকা সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে নিল। অনুমান করল, পনেরো-বিশ ব্লক দূরে রয়েছে স্টোর-হাউসটা। ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে গেল একটা পাবলিক ফোন-বুথের দিকে।
প্রথমবারই রিঙ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে রিসিভার তুলে নিল কিশোর।
মুসা, বলল গোয়েন্দাসহকারী। ভালই আছি। বাড়ি রওনা হচ্ছি এখনই। অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। বাড়ি থেকে ফোনে জানাব।
ওয়াকি-টকি ব্যবহার কর, বলল কিশোর। আমি আমার ঘরে অপেক্ষা করব। তোমার সাড়া পেয়ে খুব খুশি লাগছে, সেকেণ্ড।
কিশোরের গলা শুনেই বুঝতে পারছে, সত্যিই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। গোয়েন্দাপ্রধান। খুশি হয়েছে এখন ঠিকই। তবে খুশি বেশিক্ষণ থাকবে না, ভাবল মুসা। কফিনটা কোথায় আছে, দেখেছে মুসা, অথচ ঠিকানা বলতে পারবে না জানতে পারলে, কিশোরের চেহারা কেমন হবে, মনের চোখে দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার।
গাড়িতে গিয়ে উঠল মুসা। জামান আগেই উঠে বসে আছে।
পথে আর কোনরকম কিছু ঘটল না। নিরাপদেই বাড়ি পৌঁছল মুসা। জামান নামল না ট্যাক্সি থেকে। সে চলে যাবে প্রফেসর বেনজামিনের বাড়ির কাছাকাছি, যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে জলিল, সেখানে। সেখানেই উঠেছে ওরা এদেশে এসে।
গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল মুসা, খপ করে তার হাত চেপে ধরল জামান। মুসা, তোমরা সাহায্য করবে আমাকে? রা-অরকন আর তাঁর কফিনটা খুঁজে বের করতেই হবে। যদি বল, তোমাদের সার্ভিস ভাড়া করতে রাজি আছি আমি।
ভুল করছ তুমি, জামান, বলল মুসা। টাকার বিনিময়ে কারও কাজ করি না আমরা। করি স্রেফ শখে। তাছাড়া কাজটা হাতে নিয়েছি আমরা আগেই, প্রফেসর বেনজামিনের অনুরোধে।
জামানের জন্যেও কাজটা কর, অনুরোধ করল জামান। রা-অরকন আর কফিনটা খুঁজে বের করে প্রফেসরকে ফিরিয়ে দাও। আবার আমি আর জলিল যাব তার কাছে। আবার চাইব তার কাছে মমিটা। অনুরোধে কাজ না হলে অন্য উপায় দেখব।
সেটা করা যেতে পারে, মাথা নাড়ল মুসা। আগামীকাল সকাল দশটায় পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে হাজির থেক। কিশোরের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
সায় জানাল জামান। হাত মেলাল দুজনে। মুসা নামতেই ছেড়ে দিল ট্যাক্সি।
বাড়িতে ঢুকল মুসা। বসার ঘরে টেলিভিশন দেখছেন বাবা-মা।
এত দেরি কেন, মুসা? ছেলেকে দেখেই বলে উঠলেন মিস্টার আমান। ভাবনায় ফেলে দিয়েছিলে। তোমার মা তো অস্থির হয়ে উঠেছে।
বাবা, কৈফিয়ত দিচ্ছে যেন মুসা, একটা কেসে কাজ করছি আমরা। হারানো একটা বেড়াল খুঁজতে গিয়েছিলাম। তারপর…
হয়েছে, আর ওসব শুনতে চাই না, কড়া গলায় বললেন মা। চেহারা আর কাপড়-চোপড়ের যা হাল করেছ! খানা-খন্দে পড়ে গিয়েছিলে নাকি? যাও, জলদি গোসল সেরে ঘুমাতে যাও।
যাচ্ছি, মা, আরও কিছু গালমন্দ শোনার আগেই ছুট লাগাল মুসা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়, নিজের ঘরে। জানালা খুলে দিয়ে চেয়ার টেনে বসল। অ্যান্টেনাটা জানালার বাইরে ঝুলিয়ে দিয়ে সুইচ টিপল ওয়াকি-টকির। সেকেণ্ড বলছি-সেকেণ্ড বলছি।…শুনতে পাচ্ছ, ফাস্ট?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল, ফার্স্ট বলছি। তুমি কেমন আছ, মুসা? কি হয়েছিল?
দ্রুত সংক্ষেপে সব জানাল মুসা। কফিনটা কোথায় আছে, ঠিকানা বলতে পারবে না, তা জানাল সব শেষে।
ওপাশে একটা মুহূর্ত নীরবতা।
খামোকা দোষ দিয়ো না নিজেকে, বলল কিশোর। তোমার আর কিছু করার। ছিল না। কফিনটা খুঁজে বের করবই আমরা। সকালে আলোচনায় বসব। আরও কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। রহস্যের সমাধান তো হয়ইনি, বরং আরও জটিল হয়েছে। তবে, জামান যে বলছে বেড়ালটা রা-অরকনের, তা ঠিক নয়। বেড়ালটা। সত্যিই মিসেস ভেরা চ্যানেলের। আর কোন কথা না বলে চ্যানেল অফ করে দিল ধীরে সুস্থে গোসল সেরে বিছানায় উঠল মুসা। নতুন আরেক সমস্যায় ফেলে দিয়েছে তাকে কিশোর। প্রচণ্ড কৌতূহল কিছুতেই চাপা দিতে পারছে না, অথচ কিছু করারও নেই। এত রাতে আর কিশোরের ওখানে যেতে পারবে না।
মিসেস চ্যানেলের বেড়ালের পা ছিল সাদা, পাওয়া গেছে যেটা, সেটার কালো। তাহলে ওটা ওই মহিলার বেড়াল হয় কি করে?
.
১৩.
হেডকোয়ার্টারে জড় হয়েছে ওরা। কৌতূহলে ফেটে পড়ার জোগাড় মুসা আর রবিনের। কিন্তু কিশোরের নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছে, এত তাড়াতাড়ি মুখ খুলবে না গোয়েন্দাপ্রধান।
আন্দাজে কিছু বলা পছন্দ নয় আমার, বলল কিশোর। কাজেই এখন কিছু বলতে চাই না। জামান আসুক, তার সঙ্গে কথা বলে নিই আগে। যে কটা ব্যাপারে শিওর হয়েছি, সবার সামনেই বলব তখন।
দশটা বাজল। উঠে গিয়ে পেরিস্কোপে চোখ রাখল মুসা। একটা ট্যাক্সি এসে ইয়ার্ডের গেটে থেমেছে। ওটা থেকে বেরিয়ে এল জামান। তাড়াহুড়ো করে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে গেল মুসা। অতিথিকে নিয়ে আবার একই পথে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে। জামান মর্কেল, তাকে গোপন জায়গায় আনা যায়, এক নাম্বার কথা। দুনাম্বার, সারাজীবন আমেরিকায় থাকছে না সে, লিবিয়ায় ফিরে যাবে শিগগিরই। কাজেই ফাস করে দেবে আস্তানার খবর, এমন ভয় নেই।
জামান, পরিচয় করিয়ে দিল মুসা, রবিন মিলফোর্ড, রেকর্ড রাখা আর গবেষণার দায়িত্বে আছে। আর এ হল গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা।
তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম, একে একে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে হাত মেলাল জামান।
এবার কাজের কথায় আসা যাক, বলল কিশোর। মুসা, গত বিকেলে হেডকোয়ার্টার থেকে বেরোনর পর যা ঘটেছে, সব খুলে বল। কিছুই বাদ দেবে না। রবিন, নোট নাও।
একে একে সব বলে গেল মুসা। শর্টহ্যাণ্ডে নোট নিল রবিন। কিশোর গতরাতেই শুনেছে সব কথা, যদিও সংক্ষেপে। কিন্তু সে এই প্রথম শুনল।
সেরেছে! মুসার কথা শেষ হতেই বলে উঠল রবিন। সত্যিই বলতে পারবে না স্টোর-হাউসটা কোথায়?
কি ছোটা ছুটেছি, বলে বোঝাতে পারব না, গতরাতের কথা মনে করে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসার। থেমে রাস্তার নাম দেখার সময় কোথায়! পালিয়েছি কোনমতে! ধরতে পারলে আর আস্ত রাখত না। তবে, ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড থেকে বিশ ব্লক দূরে হবে জায়গাটা।
বিইশ ব্লক! আঁতকে উঠল রবিন। একেক সারিতে বিশটা করে ধরলেও চারশো ব্লক খুঁজতে হবে! তারমানে চারশো গলি। আর একেক ব্লকে যতটা বাড়ি, ততগুলো উপগলি! নাহ, অসম্ভব মনে হচ্ছে…
ভুলে যাচ্ছ কেন? বাধা দিয়ে বলল মুসা, স্টোর-হাউসের দরজায় চিহ্ন একে দিয়ে এসেছি।
ঠিক, সায় দিল কিশোর। তাতে কাজ অনেক সহজ হবে।
কিন্তু হাতে আমাদের সময় নেই বেশি, প্রতিবাদ করল রবিন। বড়জোর আজ বিকেল পর্যন্ত। এর মধ্যে খুঁজে বের করতে হবে বাড়িটা। কি করে সম্ভব?
একটা প্ল্যান এসেছে আমার মাথায়, বলল কিশোর। সেই মাফিক কাজ শুরু করে দিয়েছি। তবে তাতেও মোটামুটি সময় লাগবে। তার আগে এস, আলোচনা করে দেখি কি করে মমি-রহস্যের সমাধান করা যায়।
সত্যি রা-অরকনের মমি খুঁজে বের করতে পারবে তোমরা? এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না জামান। কোন উপায় জানা আছে? ফিরে পাব আমাদের পূর্বপুরুষকে?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ফিরে তাকাল কিশোর। এখনও জানি না। তবে একটু ভুল শুধরে দেয়া দরকার, জামান। রা-অরকন তোমাদের পূর্বপুরুষ নন, অন্তত এখন আমার তাই মনে হচ্ছে।
রেগে উঠল জামান। কিন্তু জ্যোতিষ যে বলল! ও ভাওতা দেয়নি! তাছাড়া, ও নিজে কিছু বলেনি। ধ্যানে বসেছিল। ওর মুখ দিয়ে কথা বলেছেন রা-অরকন। যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী ওই জ্যোতিষ। তার প্রমাণ পেয়েছি আমরা।
একটা কথা ঠিক, বলল কিশোর। তিন হাজার বছর আগে মিশর শাসন করেছিল লিবিয়ানরা।
এবং রা-অরকন ছিলেন লিবিয়ান, রাজার ছেলে, জোরাল কণ্ঠে ঘোষণা করল জামান। জ্যোতিষ তাই বলেছে।
তা বলেছে! কিন্তু কতখানি সত্যি, কে জানে! প্রফেসর বেনজামিনের মত অভিজ্ঞ লোকও জানেন না, রা-অরকন সত্যিই কে ছিলেন? ঠিক কত বছর আগে কবর দেয়া হয়েছিল তাঁকে। হতে পারে তিনি লিবিয়ান। কিন্তু তার অর্থ এই নয় তিনি তোমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেনই।
কিন্তু জ্যোতিষ যে বলল! জেদ ধরে বসেছে যেন জামান। মস্ত বড় জ্যোতিষ ওই লোক, তার কথা মিথ্যে হতে পারে না।
কে বলল? বেড়ালটার ব্যাপারেই মিথ্যে বলেছে সে। অন্তত ঠিক কথা বলতে পারেনি।
তোমার কথা বুঝতে পারছি না! কটি করল জামান।
বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছি, বলল কিশোর। জ্যোতিষ বলেছে, রা-অরকনের আত্মা তাঁর প্রিয় বিড়ালের রূপ ধরে, দেখা দেবে তোমাদেরকে। বেড়ালটা আবিসিনিয়ান, চোখের রঙে বৈসাদৃশ্য, সামনের দুপা কালো। এই তো?
হ্যাঁ, গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলল জামান। দেখা দিয়েছে ও। গত হপ্তার এক রাতে বৃহস্যজনকভাবে আমার ঘরে এসে হাজির হল রা-অরকনের আত্মা, বেড়ালের রূপ ধরে।
তাই, না? উঠল কিশোর। একটা জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে। ছোট্ট গবেষণাগারে গিয়ে ঢুকল সে। বেরিয়ে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হাতে সেই বেড়ালটা।
রা-অকনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জামান। আমার সম্মানিত পূর্বপুরুষ, বহাল তবিয়তেই আছে।
প্রফেসর কেনজামিনের বাড়িতে, একটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়েছিল গতরাতে, বলল কিশোর। নিয়ে এসেছি আমরা। এবার দেখ। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করল সে। বেড়ালটার সামনে এক পায়ের কালো অংশে জোরে জোরে ডলতে লাগল। সাদা রুমালে কালো দাগ লেগে যাচ্ছে। কালো পা হয়ে যাচ্ছে সাদা। বেড়ালটীর পায়ের ব্লড আসলেই সাদা। এটা মিসেস ভেরা চ্যানেলের স্ফিঙ্কস। কালো রঙ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পায়ে।
এতক্ষণে বুঝল মুসা, গতরাতে কেন এত নিশ্চিত ছিল কিশোর, ওটা মিসেস চ্যানেলের বেড়াল। খাইছে! এ-তো দেখছি ছদ্মবেশ!
কাঁপা কাঁপা হাত বাড়াল জামান। বেড়ালটার একটা পা ধরে দেখল। চোখে অবিশ্বাস। ছদ্মবেশ! তাহলে রা-অরকনের আত্ম নয় ওটা! কিন্তু জ্যোতিষ যে বলল—
মিছে কথা বলেছে, আবার গিয়ে আগের জায়গায় বসল কিশোর। মিসেস চ্যানেলের বেড়াল চুরি করে তার পায়ে রঙ করে তোমার ঘরে চালান দিয়েছিল। বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল, রা-অরকনের আত্মার সাক্ষাৎ পেয়েছ।
কিন্তু কেন? চেঁচিয়ে উঠল জামান।
হ্যাঁ, কেন? প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা।
জামানের বাবা আর ম্যানেজার জলিলকে বিশ্বাস করানর জন্যে। তাহলে প্রফেসর বেনজামিনের কাছ থেকে মমিটা ফেরত নেয়ার চেষ্টা করবেন তারা, জামানের দিকে তাকাল কিশোর। আমি শিওর, রা-অরকন তোমাদের পূর্বপুরুষ। নন।
রা-অরকন আমাদের পূর্বপুরুষ! কালো চোখের তারা জ্বলে উঠল জামানের। অনেক কষ্টে কান্না ঠেকিয়ে রেখেছে।
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল কিশোর। ঠিক আছে, আগে মমিটা পেয়ে নিই। তারপর বোঝা যাবে সবই। আগে আমাদের জানা দরকার, কে চুরি করেছে রা-অরকনকে, এবং কেন? জামানের দিকে তাকাল। জামান, গতরাতে মুসাকে যা যা বলেছ, আবার বল। মানে, জ্যোতিষ তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার পর যা ঘটেছে। রবিন নোট লিখে রাখুক।
বলতে শুরু করল জামান।
সেরেছে! মালীর কথা আসতেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন। সারাক্ষণই জলিল থাকত প্রফেসরের বাড়ির আশপাশে। সেই তোমাকে ধরেছিল! তাই তো বলি, এত সহজে ছাড়া পেলে কি করে!
আমাকে তার হাত কামড়ে দিতে বলেছিল জলিল, দিয়েছি, গর্বিত কণ্ঠে বলল জামান। আমাদের ম্যানেজার খুবই চালাক লোক!
জামান, জিজ্ঞেস করল কিশোর। সমাধিকক্ষে অভিশাপ লেখা ছিল, জান তোমরা?
নিশ্চয়, জবাব দিল লিবিয়ান ছেলেটা। জ্যোতিষ সবই বলেছে। ও বলেছে, দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবে না রা-অরকনের আত্মা।
রহস্যজনক কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিল প্রফেসরের বাড়িতে, বলল কিশোর। আনুবিসের মূর্তি উপুড় হয়ে পড়েছিল। দেয়াল থেকে খসে পড়েছিল একটা মুখোেশ। জলিলের কীর্তি, তাই না?
হ্যাঁ, হাসিতে ঝকঝকে দাঁত বেরিয়ে পড়ল জামানের। জানালার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সে, হাতে একটা লম্বা শিক নিয়ে। দেয়ালে আর জানালার চৌকাঠের মাঝে আগেই একটা ছিদ্র করে রেখেছিল। সুযোগ বুঝে শিক ঢুকিয়ে ঠেলে ফেলে। দিয়েছে মূর্তিটা। শিক দিয়ে খোঁচা মেরে মুখোশও ফেলেছে। গেটের থামের খাঁজও সেই নষ্ট করেছে। এক সুযোগে জোরে বলটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই সরে গেছে চোখের আড়ালে। প্রফেসরকে আতঙ্কিত করে ফেলতে চেয়েছে সে, তাহলে মমিটা দিয়ে দেবে, এজন্যে।
যা ভেবেছি, বলল কিশোর। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন মমির অভিশাপ বাস্তবে কার্যকর করা মোটেই কঠিন কিছু না। ওভারঅল পরা মালী রোজই বাগানে কাজ করে, বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে, তাকে সন্দেহ করবে কে?
সবই বুঝলাম, বলল মুসা। কিন্তু শেষতক মমিটা চুরি করল কে? জামান কসম খাচ্ছে, ওরা চুরি করেনি। তাহলে? মিসেস চ্যানেলের বেড়ালটাই বা চুরি করল কে? কে রেখে দিয়ে এসেছিল ওটাকে জামানের ঘরে? এগুলো খুব রহস্যজনক ব্যাপার। তাই মনে হচ্ছে আমার কাছে।
হ্যাঁ, মুসার কথায় সায় দিল রবিন। আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। তাছাড়া, মমিটা কথা বলে কি করে? ও সম্পর্কে জামান কিছু জানে না। কোন ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
এবারে একটা প্রশ্ন, প্রফেসরি ভঙ্গি কিশোরের জামান, চোর দুটোকে সত্যিই দেখেছিলে? যারা রা-অরকনকে চুরি করেছে?
হ্যাঁ, মাথা নাড়ল জামান। গত সন্ধ্যায় জলিল বলল তার হাত ব্যথা করছে। আমাকে গিয়ে চোখ রাখতে বলল প্রফেসরের বাড়ির ওপর। একটা ঝোপে লুকিয়ে। বসে আছি। বেড়ালটাও সঙ্গে আছে। ইচ্ছে করেই নিয়েছিলাম, তাতে সাহস পাচ্ছিলাম। একটা ট্রাক তখন দাঁড়িয়ে আছে চত্বরে। খানিক পরেই দুটো লোককে জাদুঘর থেকে বেরোতে দেখলাম। চাদরে পেঁচানো কি একটা ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে তুলল ট্রাকে। তখন বুঝতে পারিনি, মমিটা নিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওরা চলে যাওয়ার পর জাদুঘরে ঢুকে দেখলাম, কফিনে নেই রা-অরকন।
আমরা প্রফেসর উইলসনের বাড়িতে যাওয়ার পর ঘটেছিল ব্যাপারটা, মন্তব্য করল রবিন।
অপেক্ষা করতে থাকলাম, বলে গেল জামান। ট্রাক নিয়ে চলে গেল চোর দুটো। খানিক পরেই হাজির হল মুসা। বেড়ালটা আমার পাশে নেই, খেয়াল করিনি প্রথমে। তারপর দেখলাম, ওটা মুসার হাতে তাকেও চোরদের একজন বলেই ধরে নিয়েছিলাম। রাগ দমন করতে পারিনি।—দুঃখিত, মুসা। না বুঝেই কাণ্ডটা করে ফেলেছিলাম।
তাতে বরং ভালই হয়েছে, বলল মুসা। তোমার সঙ্গে পরিচয় হল। রহস্যটা সমাধান করা অনেকখানি সহজ হবে।
হুম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। পুরো ব্যাপারটা জটিল, তবে স্পষ্ট।
জটিল তো বটেই, একেবারে অস্পষ্ট ঘোষণা করল মুসা। ওই বৃহস্য শুধু মাথা খারাপ করতে বাকি রেখেছে আমার!
বেশ কিছু তথ্য পেয়ে গেছি, বাস্তবে ফিরে এসেছে যেন কিশোর। এবার ওগুলো খাপে খাপে বসাতে পারলেই ব্যস! রহস্য আর রহস্য থাকবে না।
নোট পড়ায় মন দিল রবিন। তথ্যগুলো খাপে খাপে বসানর চেষ্টা করছে। যতই চেষ্টা করল, আরও বেশি জট পাকিয়ে গেল সবকিছু। সমাধান করতে পারল না। অসহায় ভঙ্গিতে মুখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে।
প্রথমে, বলল কিশোর। কফিনটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। রহস্য সমাধানের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাব তাহলে। স্টোর-হাউসটা খুঁজে বের করে ওটার কাছে পিঠে লুকিয়ে থাকব। সন্ধ্যার পর এক সময় আসবে ওয়েব আর মেথু। কফিনটা ডেলিভারি দিতে নিয়ে যাবে। ওদেরকে অনুসরণ করব আমরা। কার কাছে নিয়ে যায়, দেখব। আসলে অপরাধীকে ধরে ফেলা কঠিন হবে না তখন। সমর্থনের আশায় তিনজনের দিকেই একবার করে তাকাল সে। ওরা নীরব। কিশোব্রের কথা। শেষ হয়নি বুঝে অপেক্ষা করছে। আবার বলল গোয়েন্দাপ্রধান, অপরাধীকে ধরতে পারলে মমি আর কফিনটা তো পেয়ে যাবই, সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।
চমৎকার! বন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা মুসার কণ্ঠে। এত সহজ ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি।—কিন্তু স্টোর হাউসটা খুঁজে পাওয়া—মানে, খুঁজে পাব, কারণ চিহ্ন রেখে এসেছি কিন্তু তাতে তো সময় লাগবে। দিন পনেরোর আগে হবে না। অথচ হাতে সময় আছে মাত্র আট-নয় ঘণ্টা।
খুঁজতে যাচ্ছি না আমরা সেভাবে, মাথা নাড়ল কিশোর। লাভও হবে না গিয়ে খুঁজে। অন্য প্ল্যান করেছি, বলেছি না। একটা সুন্দর নাম দিয়েছি ব্যবস্থাটার ভূত থেকে ভূতে।
হাঁ হয়ে গেল অন্য তিনজন। কিছুই বুঝতে পারছে না।
খুব সহজ একটা ব্যাপার, হেসে বলল কিশোর। অথচ খুব কার্যকন্দ্র হবে। আমার বিশ্বাস। খবর জোগাড়ের জন্যে শহরের প্রায় সব কজন ছেলেমেয়েকে লাগিয়ে দেয়া যায় এতে। কারোই কোন কষ্ট হবে না, অথচ খবর ঠিকই এসে যাবে। আমাদের হাতে। ছোট একটা পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছি শুধু।
কিশোরের কথা আরও হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হল ওদের কাছে। চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে।
সকালে, বলল কিশোর। আমার পাঁচজন বন্ধুকে ফোন করেছি। বলেছি, লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলীতে একটা স্টোর-হাউসের দরজায় কিছু নীল প্রশ্নবোধক আঁকা আছে। কথাটা ওদের পাঁচজন বন্ধুকে জানাতে বলেছি। কজন হল? পঁচিশ জন। ওই পঁচিশ জন আবার তাদের পাঁচজন করে বন্ধুকে জানাবে ফোন করে। তার মানে? একশো পঁচিশ। ওই একশো পঁচিশজন আবার তাদের পাঁচজন বন্ধুকে জানাবে। এভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে খবরটা। হাজারে হাজারে। ছেলেমেয়ে একশো ডলার পুরস্কারের লোভে খুঁজতে থাকবে নীল প্রশ্নবোধক। কাজ কতখানি হালকা হয়ে গেল আমাদের সময় কতখানি বাঁচল? এখন শুধু অপেক্ষার পালা। যে-কোন মুহূর্তে এসে যাবে খুব্বর।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। ছুটে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধ জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে। কসম খোদার, কিশোর পাশা! তুমি–তুমি সত্যিই একটা জিনিয়াস!
ঠিক এই সময় বাজল টেলিফোন। আস্তে করে মুসার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রিসিভারের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। কানে ঠেকাল রিসিভার। হ্যাল্লো বলেই একটা সুইচ টিপে দিল। জ্যান্ত হয়ে উঠল স্পীকার।
কিশোরের এক বন্ধু। জানাল, ভূত থেকে ভূতে ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। তবে বিকেলের আগে খবর পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না, বলল ছেলেটা। তারপর কেটে দিল কানেকশন।
খামোকা বসে না থেকে, প্রফেসর বেনজামিনের ওখান থেকে আরেকবার ঘুরে আসা যাক, প্রস্তাব রাখল কিশোর।
কিন্তু মেরিচাচী যেতে দেবেন বলে মনে হয় না, মাথা নাড়ল মুসা। আসার সময় শুনে এলাম বোরিস আর রোভারের সঙ্গে কথা বলছেন। অনেক কাজ ইয়ার্ডে আমরা এখান থেকে বেরোলেই আটকাবেন।
ঠিকই বলেছ, সায় দিল কিশোর। তার চেয়ে বরং ফোন করি প্রফেসরকে জামান, তোমার আর খামোকা বসে থাকার দরকার নেই। রবিন, ওকে এগিয়ে দিয়ে এস, প্লীজ।
যাচ্ছি, উঠে পড়ল রবিন।
জামানও উঠল। জলিলকে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার, কিশোর পাশা। একটা ভুল ভাঙবে। তার ধারণা, আমেরিকান ছেলেরা সব পাজী। কাজকর্ম কিছু করে না। খালি অকাজের তালে থাকে, আর বাপের পয়সা ধ্বংস করে।
আমি আমেরিকান নই, বলল কিশোর পাশা। বাঙালি। তবে আমেরিকান ছেলেরা সবাই খারাপ নয়। জলিলের সত্যিই এটা ভুল ধারণা। এই যে আমাদের রবিন, ও কি খারাপ?
হ্যাঁ, এটাই বোঝানো দরকার ওকে। আচ্ছা, চলি। রবিনের পেছনে পেছনে দুই সুড়ঙ্গের দিকে এগিয়ে গেল জামান।
জামান, পেছন থেকে ডাকল কিশোর। গতরাতে যা যা ঘটেছে, সব নিশ্চয় বলনি জলিলকে?
রা-অরকনকে খুঁজতে তোমার সাহায্য চেয়েছি, এটাই শুধু বলেছি, ফিরে চেয়ে বলল জামান। বিশেষ কেয়ার করেনি। বলল, বাচ্চা-কাচ্চাদের এর মাঝে টেনে আনা বোকামি।
আর কিছু না বলে ভাল করেছ, বলল কিশোর। কিছু বলবেও না বড়দেরকে বেশি বিশ্বাস কোরো না। নিজেদেরকে সবজান্তা ভাবে, ছোটদের ব্যাপারে সব সময় বাগড়া দেয়। এবং অনেক সময়ই ঠিক কাজ করে না। তাছাড়া গোয়েন্দার কাজে গোপনীয়তা একান্ত দরকার। কাউকে কিছু বলবে না, ঠিক আছে?
মাথা কাত করল জামান। হ্যাঁ, আবার কখন দেখা হচ্ছে আমাদের?
আজ বিকেল ছটায় চলে এস, বলল কিশোর। ততক্ষণে স্টোর-হাউসের হদিস হয়ত পেয়ে যাব আমরা।
ঠিক আছে! ট্যাক্সি নিয়ে আসব। জলিল নাকি আজ খুব ব্যস্ত থাকবে কয়েকজন কার্পেট ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলবে। সে আমাকে বাধা দিতে পারবে না।
রবিনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল জামান।
খুব ভাল ছেলে, বলল মুসা। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কি বল তো, কিশোর? কি যেন ভাবিয়ে তুলেছে তোমাকে! রা-অরকনকে কে চুরি করেছে, জান নাকি?
সন্দেহ করছি একজনকে, বলল কিশোর। মিসেস চ্যানেলের বেড়ালটার খবর ছবিসহ অনেক ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, না?
হয়েছিল, বলল মুসা। কয়েকটা ছবি দেখিয়েছেনও আমাকে মিসেস চ্যানেল।
ধর, ওরকম একটা বেড়াল দরকার কারও। স্ফিঙ্কসের কথা সহজেই জানতে পারবে সে। বেড়ালটা খুব ভদ্র, ওটাকে যে কেউ ধরে নিয়ে যেতে পারে। তারপর পায়ে কালো রঙ করে নেয়াটা কিছুই না। এখন কথা হচ্ছে, রা-অরকনকে কার এত দরকার হল? জামানের ঘরে বেড়ালটাকে ঢুকিয়ে দেয়া কার পক্ষে সহজ? সমাধিকক্ষে লেখা অভিশাপের কথা কে বেশি জানে? এবং কে প্রফেসর বেনজামিনের কাছ থেকে মমিটা নিয়ে যেতে চায়?
এক মুহূর্ত ভাবল মুসা। মালী, মানে, জলিল। জামানদের ম্যানেজার।
ঠিক, কিশোর বলল। মমিটাকে রাখার জন্যে কফিনটাও তারই বেশি দরকার। তাই না?
নিশ্চয়ই। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। কিন্তু জামান কসম খেয়ে বলেছে, জলিল এ-ব্যাপারে কিছু জানে না।
জামানের তাই ধারণা। কিন্তু বড়রা সব সময় সব কথা ছোটদেরকে বলে না, এটা তো ভাল করেই জান। আরও একটা কারণ হতে পারে, গোপন কোন পরিকল্পনা থাকতে পারে জলিলের। হয়ত মমিটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে। রেখেছে। পরে জামানের বাবাকে বলবে, অনেক টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে। টাকাটা সে নিজে মেরে দেবে। মমিটা ফেরত পাওয়ার জন্যে যে-কোন মূল্য দিতে রাজি জামানের বাবা। সুযোগটা ছাড়বে কেন ম্যানেজার?
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ঠিক ধরেছ! সে তাই করবে! আরবী জানে জলিল। প্রাচীন আরবী জানাও তার পক্ষে সহজ। দরজার বাইরে লুকিয়ে থেকে ভেন্ট্রিলোকুইজম ব্যবহার করেছে, মনে হয়েছে মমিটাই কথা বলেছে!
মাথা নাড়ল কিশোর। কিন্তু, আগে প্রমাণ দরকার। তার আগে জামানকে কিছু বলা যাবে না। রেগে চার্জ করে বসতে পারে জলিলকে। হুশিয়ার হয়ে যাবে ম্যানেজার। তখন তাকে বাগে পাওয়া খুব কঠিন হবে।
ঠিক, একমত হল মুসা। কিশোর, এখন কি করব? সারাটা দিন পড়ে আছে। স্টোর-হাউসের খবর কখন আসবে কে জানে! মেরিচাচীর সামনেও পড়তে চাই না। আজ ইয়ার্ডের কাজ করতে মোটেই ভাল্লাগবে না।
এবং সেজন্যেই এখন বেরনো যাবে না এখান থেকে, টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। প্রফেসরকে পাওয়া যায় কিনা দেখি। হুপারের খোঁজ নেয়া দরকার।
পাওয়া গেল প্রফেসরকে। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে হুপার, জানালেন। তিনি। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিল বেচারা। অদ্ভুত এক দৃশ্য নাকি দেখেছে গতরাতে। ঝোঁপ থেকে নাকি বেরিয়ে এসেছিল শেয়াল-দেবতা আনুবিস। দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। আতঙ্কেই বেহুশ হয়ে গেল হুপার। তার ধারণা, তারপর রা-অরকনকে চুরি করে নিয়ে গেছে আনুবিস।
চাওয়া-চাওয়ি করল কিশোর আর মুসা।
কিন্তু আমরা জানি, ওয়েব আর মেথু চুরি করেছে মমিটা! ফিসফিস করে বলল মুসা।
প্রফেসর, ফোনে বলল কিশোর। আমার মনে হয়, রবারের মুখোশ পরে। এসেছিল কেউ। ভয় দেখিয়েছে হুপারকে। আনুবিসের মুখোশ পাওয়া যায় বাজারে। অবিকল ওরকম না হলেও শেয়ালের মুখ যে-কোন খেলনার দোকানে পাওয়া যায়।
তা ঠিক, স্পীকারে শোনা গেল প্রফেসরের কণ্ঠ। আমারও তাই ধারণা। তো, কি মনে হয়? মমিটা আবার ফিরে পাওয়া যাবে? রহস্যটা কি, কিছু বুঝতে পেরেছ? জলিল ব্যাটাকে সন্দেহ-টন্দেহ হয়?
কিছু কিছু ব্যাপার আন্দাজ করেছি, স্যার, কিন্তু কোন প্রমাণ পাইনি এখনও। আর, আজ বিকেলে কফিনটা উদ্ধার করতে যাব, আশা করছি। তেমন কিছু জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে জানাব। রাখি এখন। রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। ট্রেলারের ছাতের দিকে চেয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল।
অপেক্ষা করছে মুসা। এক সময় উসখুস করতে লাগল। শেষে আর থাকতে না। পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলল, কি ভাবছ?
ভাবছি, মুখ নামাল কিলোর। প্রফেসর বেনজামিন বলেছেন অভিনেতা ছিল হুপার। থিয়েটারে অভিনয় করেছে।
তাতে কি?
বেহুশের অভিনয় সহজেই করতে পারে একজন অভিনেতা, বলল কিশোর। রঙ্গ-নাটকে ভেন্ট্রিলোকুইস্টের কাজ করেছে কিনা, তাই বা কে জানে?
যদি করে থাকে?
অনুমান কর।
হুপারকে অপরাধী ভাবছ? ও একা? নাকি জলিলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে? নাকি অন্য কারও সঙ্গে? আসলে কি ভাবছ তুমি, কিশোর?
সময়েই সব জানা যাবে, কেমন রহস্যময় শোনাল কিশোরের কথা।
এরপর সারাটা দিনে রেগে গুম হয়ে থাকল মুসা। আর একটা কথা বলল না কিশোর। তার কোন কথার জবাবও দিল না। একমনে কি ভাবল সারাক্ষণ।