রত্নদানো
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৮৬

০১.

রামধনু রত্নহার চুরি করা যায় কিনা, ভাবছি! আপনমনেই বলল কিশোর পাশা।

সোলডারিং আয়রনটা মুসার হাত থেকে প্রায় খসে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল। রেডিওর তারা ঝালাই বাদ দিয়ে ফিরে তাকাল সে। তিন গোয়েন্দার। কার্ড শেষ হয়ে এসেছে, আবার ছাপা দরকার, কম্পোজ করছে রবিন, তারও হাত থেমে গেল।

কী! চোখ বড় হয়ে গেছে গোয়েন্দা সহকারীর।

বলছি, রামধনু রত্নহারটা চুরি করা যায় কিনা! আবার বলল গোয়েন্দাপ্রধান। ধর যদি আমরা চোর হতাম?

যা নই সেটা নিয়ে ভাবতে যাব কেন? চুরি করা অন্যায়।

তা ঠিক! হাতের খবরের কাগজে বিশেষ ফিচারটার দিকে আবার তাকাল। কিশোর।

হাতের স্টিকটা নামিয়ে রেখে মুখ তুলল রবিন। কিশোর, রামধনু রত্নহার! কিসের বাংলা করলে?

রেইনবো জুয়েলস।

 পিটারসন মিউজিয়মের নেকলেসটা?

হ্যাঁ।

গত রাতেই নেকলেসটার কথা শুনেছে রবিন, তার বাবা বাসায় আলোচনা করছিলেন।

পিটারসন মিউজিয়ম। নেকলেস! কি বলছ তোমরা? কিছুই বুঝতে পারছে না মুসা।

কোন্ দেশে বাস কর? খোঁজখবর রাখ কিছু! বিদ্যে জাহির করার সুযোগ পেয়ে গেছে নথি। মিউজিয়মটা হলিউডে, একটা পাহাড়ের চূড়ায় পুরানো একটা বাড়ি, মালিক ছিলেন এক মস্ত ধনী লোক, হিরাম পিটারসন। মিউজিয়মের জন্যে বাড়িটা দান করে দিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে ওখানে একটা প্রদর্শনী হচ্ছে, বলল কিশোর। রত্ন প্রদর্শনী। এর ব্যবস্থা করেছে জাপানের মস্ত বড় এক জুয়েলারি কোম্পানি, সুকিমিচি জুয়েলারস। আমেরিকার সব বড় বড় শহর ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী করবে ওরা। এটা আসলে এক ধরনের বিজ্ঞাপন। এদেশে অলঙ্কারের বড় মার্কেট রয়েছে। ওই কোম্পানির বিশেষত্ব হল মুক্তোর তৈরি অলঙ্কার। অনেক পুরানো দামি জিনিসও আছে ওদের স্টকে। তারই একটা রেইনবো জুয়েলস, সোনার তৈরি সাতনরি হার, হীরা-চুনি পান্নাখচিত। নাড়া লাগলেই রামধনুর সাতরঙ যেন ছিটকে বেরোয় পাথরগুলে থেকে। দাম অনেক।

আরও একটা দামি জিনিস এনেছে ওরা, কিশোরের কথার পিঠে বলে উঠল রবিন। একটা সোনার বেল্ট। অনেকগুলো পান্না বসানো আছে ওতে। জিনিসটার ওজন পনেরো পাউণ্ড। ওটার মালিক ছিলেন নাকি জাপানের প্রাচীন এক সম্রাট।

তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, কিশোর! বিস্ময় কাটেনি এখনও মুসার। এত দামি জিনিস চুরি করার সাধ্য কারও নেই! নিশ্চয়ই কড়া পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে জিনিসগুলো, ব্যাঙ্কের ভল্টের মত…।

তার চেয়েও কড়া পাহারায় রয়েছে। জিনিসগুলো যে-ঘরে রাখা হয়েছে, ওখানে পালা করে সারাক্ষণ পাহারা দেয় পিস্তলধারী প্রহরী। মানুষের চোখকে পুরোপুরি বিশ্বাস নেই, তাই বসানো হয়েছে একটা ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরা। রাতে যদি ক্যামেরা ঠিকমত কাজ না করে? সেজন্যে অদৃশ্য আলোকরশ্মির ব্যবস্থা হয়েছে। যে-কোন একটা রশ্মি কোনভাবে বাধা পেলেই চান হয়ে যাবে অ্যালার্ম সিস্টেম। কাঁচের বাক্সে রাখা হয়েছে রেইনবো জুয়েলস আর সোনার বেল্ট। ওই বাক্সেও রয়েছে অ্যালার্ম ব্যবস্থা। বাক্সের ভেতর কেউ হাত দিলেই বেজে উঠবে বেল। কারেন্ট ফেল করলেও অসুবিধে নেই, ব্যাটারি কানেকশন রয়েছে প্রতিটি সিসটেমের সঙ্গে।

ওই তো, যা বলেছিলাম, বলল মুসা। কেউ চুরি করতে পারবেন জিনিসগুলো।

হ্যাঁ, বড় রকমের চ্যালেঞ্জ একটা, মাথা নাড়ল কিশোর।

চ্যালেঞ্জ! ভুরু কুঁচকে গেছে রবিনের। আমরা কি চুরি করতে যাচ্ছি নাকি ওগুলো!

করার মত কোন কাজ এখন আমাদের হাতে নেই, সহজ গলায় বল কিশোর। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারও অনেকদিন কোন কাজ দিতে পারছেন না। সময় তো কাটাতে হবে আমাদের। ব্রেনটা চালু রাখতে হবে। জিনিসগুলো চুরি করার একটা উপায় নিশ্চয় আছে, সেটা যদি জানতে পারি, ভবিষ্যতে অনেক কঠিন রত্ন-ডাকাতির কেস সহজেই সমাধান করতে পারব আমরা।

অযথা সময় নষ্ট! ঠোঁট ওল্টাল মুসা। চুরিচামারির কথা ভাবার চেয়ে চলা গিয়ে ডাইভিং প্র্যাকটিস করি, পুরোপুরি রপ্ত হয়নি এখনও আমাদের।

আমিও তাই বলি, মুসার পক্ষ নিল রবিন। বাবা কথা দিয়েছে, ডাইভিংটা ভালমত শিখে নিলে আমাদেরকে মেক্সিকোতে নিয়ে যাবে। উপসাগরে সাঁতার কাটতে পারব, পানির তলায় ওখানে বড় বড় জ্যান্ত চিংড়ি পাওয়া যায়। অক্টোপাসের বাচ্চা

চুপ চুপ, আর বল না, রবিন! জোরে জোরে হাত নাড়ল মুসা। এখুনি ওখানে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আমার!

খবরের কাগজে লিখেছে। দুই সহকারীর কথা যেন শুনতেই পায়নি কিশোর, আজকে মিউজিয়মে চিলড্রেনস ডে। আঠারো বছরের নিচের যে-কোন কিশোর হাফ-টিকেটে ঢুকতে পারবে আজ। ইউনিফর্ম পরে যে বয়স্কাউটরা যাবে, তাদের পয়সাই লাগবে না।

আমাদের ইউনিফর্ম নেই, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। তারমানে আমরা বাদ।

গত হপ্তায় চাচাকে সাহায্য করেছি আমরা, ইয়ার্ডের কাজ করে বেশ কিছু কামিয়েছি, মনে করিয়ে দিল কিশোর। হাফ কেন, ফুল টিকেট কিনে প্রদর্শনী দেখার ক্ষমতা এখন আমাদের আছে। ভাবছি, আজই কেন চলে যাই না? আর কিছু না হোক, রেইনবো জুয়েলস দেখার সৌভাগ্য তো হবে। আসল মুক্তো আর হীরা চুনি-পান্না দেখতে পারব। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে এই অভিজ্ঞতা।

মুসা, গোয়েন্দা সহকারীর দিকে চেয়ে বলল নথি। ওকে ভোটে হারাতে পারব আমরা, কি বল?

নিশ্চয় পারব! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পাথর দেখে কি হবে? জানিই তো ক রঙের হবে পাথরগুলো, কেমন হবে। ওগুলো দেখে কি করব?

মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে দেখলে…

…দেখলে কি হবে? কিশোরকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল রবিন। বড় দেখাবে, এই তো?

ক্রিকেট বল, নাহয় ফুটবলের মতই দেখাল, হাতের আঙুল ওপরের দিকে বাঁকা করে নাড়ল মুসা। আমাদের কি? হ্যাঁ, একটাই কাজ করা যেতে পারে ওই পাথর দিয়ে, গুলতিতে লাগিয়ে ছুঁড়ে পাখি মারা যেতে পারে।…আরে হা হা, এই তো আবিষ্কার করে ফেলেছি, কি করে চুরি করা যায়! গুলতির সাহায্যে হারটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারলেই হল! বাইরে চোরের সঙ্গী বড় ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, লুফে নেবে ঝুড়িতে! তারপর ছুটে পালাবে! বা বা, এই তো একটা উপায় বের করে ফেলেছি! পানির মত সহজ কাজ!

চমৎকার বুদ্ধি! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

কয়েক মুহূর্ত চিন্তায় মগ্ন রইল কিশোর। তারপর মাথা নাড়ল ধীরে ধীরে। মোটেই চমঙ্কার নয়। দুটো ফাঁক রয়েছে। ঝুড়িতে নিল যে, সে হয়ত পালাতে পারবে, কিন্তু যে ছুঁড়ল, সে ঘরেই থেকে যাবে তখনও, ধরা পড়বে গার্ডের হাতে। আরেকটা দুর্বলতা হল, মুসা আর রবিনের দিকে একবার করে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান। পিটারসন মিউজিয়মের যে ঘরে রাখা হয়েছে রেইনবো জুয়েলস, ওই ঘর থেকে জানালা দিয়ে ছোঁড়া যাবে না জিনিসটা। কারণ… নাটকীয়ভাবে চুপ করল সে।

কারণ? সামনে ঝুঁকল মুসা।

হ্যাঁ, কেন ছেঁড়া যাবে না? মুসার পর পরই প্রশ্ন করল রবিন।

কারণ, পিটারসন মিউজিয়মে কোন জানালাই নেই, মুচকে হাসল কিশোর। চল রওনা হয়ে যাই, দেরি না করে।

.

০২.

ঘন্টাখানেক পর ছোট পাহাড়টার গোড়ায় এসে পৌঁছল তিন গোয়েন্দা। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে পিটারসন মিউজিয়ম। গ্রিফিথ পার্ক থেকে বেরিয়ে একটা পথ চলে গেছে উপত্যকা ধরে। এখান দিয়ে প্রায়ই পার্কে পিকনিক করতে যায় লোকে, বিশেষ করে ছেলেমেয়েরাই বেশি যায়। বিরাট বাড়িটার দুদিকে দুটো শাখা যেন ঠেলে বেরিয়েছে, দুটোরই ছাতের জায়গায় রয়েছে বিশাল দুটো গম্বুজ। বাড়ির সামনে-পেছনের ঢাল সবুজ ঘাসে ছাওয়া। ঘুরে ঘুরে একটা পথ উঠে গেছে বাড়ির পেছনে, আরেকটা পথ নেমে এসেছে; একটা ওঠার, আরেকটা নামার জন্যে।

 মোটর কার আর স্টেশন ওয়াগনের সারি ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে মিউজিয়মের দিকে। পথের একপাশ ধরে উঠতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। ঠাসাঠাসি করে গাড়ি রাখা হয়েছে পার্কিং লট-এ, আরও এসে ঢুকছে। ঢোকার সময় তো ঢুকেছে, বেরোনর সময় বুঝবে ঠেলা, ভাবল কিশোর। চারদিকে ভিড়, বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলেমেয়ে। নীল ইউনিফর্ম পরা কাব স্কাউটরা বিশৃঙ্খলভাবে ছোটাছুটি করছে এদিক-ওদিক, সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাদের ডেন মাদার (পরিচালিকা)। গার্ল স্কাউটের ছোটাছুটি বিশেষ করছে না, কিন্তু তাদের কলরবে কান ঝালাপালা। কে যে কি বলছে, বোঝার উপায় নেই। বাচ্চা ব্রাউনিদের কাছাকাছিই রয়েছে কয়েকজন লম্বা বয়স্কাউট, বেল্টে গোঁজা ছোট্ট কুঠার, হাতে ক্যানভাসের ব্যাগ।

জায়গাটা ভালমত দেখে নেয়া দরকার, সহকারীদেরকে বলল কিশোর। আগে মিউজিয়মের বাইরেটা দেখব।

বাড়ির পেছনে এক চক্কর দিল তিনজনে। একসময় অনেক জানালা ছিল, কিন্তু এখন বেশির ভাগই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইট গেঁথে। নিচের তলা আর গম্বুজওয়ালা ঘরগুলোতে একটা জানালাও নেই, সব বুজিয়ে দেয়া হয়েছে। গুলতির সাহায্যে কেন অলঙ্কার চুরি করা যাবে না, বুঝতে পারছে এখন রবিন আর মুসা। জানালাই নেই, ছুঁড়বে কোন পথ দিয়ে? গম্বুজওয়ালা একটা ঘরের দিকে এতই মনোযোগ তার, ডেন মাদারের সঙ্গে কয়েকজন কাব স্কাউটকে দেখতেই পেল না, পড়ল গিয়ে একজনের গায়ে। আউউ!..ইসস, সরি!

ঘাসের ওপর চিত হয়ে পড়েছে একটা ছেলে, রবিনের ধাক্কা খেয়ে। লজ্জিত হাসি হাসল ছেলেটা, ঝিক করে উঠল একটা সোনার দাঁত। হাত ধরে টেনে তাকে। উঠতে সাহায্য করল রবিন। আরেকবার দুঃখ প্রকাশ করল। ডেন মাদারের সঙ্গে অনেকখানি এগিয়ে গেছে অন্য স্কাউটেরা, তাদেরকে ধরতে ছুটল ছেলেটা।

আরে আরে, দেখ! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিলোর।

কি! ভুরু কুঁচকাল মুসা, ঠোঁট বাঁকাল। কি দেখব! বাড়ির পেছনটা ছাড়া তো আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!

তারগুলো দেখতে পাচ্ছ না? ওই, ওই যে? পোল থেকে নেমে এসেছে, ইলেকট্রিক তার। সবগুলোকে এক করে পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে একটা গর্তের ভেতর দিয়ে! ওই তো, বাড়িটার এক কোণে! সহজেই কেটে ফেলা যায়!

তোমার যা কথা! বলল রবিন। কে কাটতে যাবে?

রত্নচোরেরা। তবে ওগুলো কাটলে বড় জোর আলো নেবাতে পারবে, অ্যালার্ম সিস্টেম অকেজো হবে না। সে যা-ই হোক, এটা একটা দুর্বলতা!

বাড়ির সামনে-পেছনে ঘোরা শেষ করল তিন গোয়েন্দা। সামনে দিয়ে ভেতরে ঢোকার গেটের দিকে এগোল। ওরা ইউনিফর্ম পরে আসেনি, কাজেই টিকেট কিনতে হল। পঁচিশ সেন্ট করে হাফ টিকেটের দাম।

গেট পেরিয়ে প্যাসেজে এসে ঢুকল তিনজনে।

তীর চিহ্ন ধরে এগিয়ে যাও, পথের নির্দেশ দিল একজন গার্ড।

ডান শাখার বিশাল এক হলঘরে এসে ঢুকল তিনজনে। গম্বুজওয়ালা এই ঘরটা প্রায় তিন-তলার সমান উঁচু। দেয়ালের মাঝামাঝি উচ্চতায় অর্ধেকটা ঘিরে রয়েছে। ব্যালকনি। বন্ধ নির্দেশিকা ঝুলছে ওখানে।

কারুকাজ করা সুদৃশ্য কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই দামি দামি ছবি ঝুলছে দেয়ালে। ওগুলো মিউজিয়মের সম্পত্তি। ছবির প্রতি তেমন আকর্ষণ দেখাল না তিন গোয়েন্দা, তারা এসেছে রত্ন আর অলঙ্কার দেখতে।

ছবিগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কিশোর। ছবিগুলো কিভাবে ঝোলানো হয়েছে, লক্ষ্য করেছ? দেয়ালের ওপরের দিকের খাজ থেকে আটকানর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে কিন্তু এভাবে ছবি ঝোলানো হত না। সিলিঙে হুক লাগিয়ে লম্বা শেকল দিয়ে ঝোলানো হত। দেখেছ, হুকগুলো এখনও আছে?

একবার ওপরে তাকিয়ে দেখল মুসা, কিন্তু গুরুত্ব দিল না। প্রায় দরজা আকারের বড় বড় জানালাগুলোর দিকে তার মন। জানালা বন্ধ করে দিল কেন ওরা?

দেয়ালে বেশি করে জায়গা করেছে, আরও বেশি ছবি ঝোলানর জন্যে, বলল। কিশোর। এটা একটা কারণ। তবে আসল কারণ বোধহয় ভাল এয়ারকণ্ডিশনিঙের জন্যে। দামি দামি ছবি, তাপমাত্রার পরিবর্তনে ক্ষতি হতে পারে, তাই সব সময় একই রকম উত্তাপ রাখার জন্যে এই ব্যবস্থা হয়েছে।

ধীরে ধীরে পুরো ঘরে চক্কর দিল ওরা, তারপর ভিড়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পেছন। দিকের আরেকটা বড় হলঘরে এসে ঢুকল। তারপর চলে এল বাঁ-শাখার গম্বুজওয়ালা ঘরটায়। এখানেই রত্ন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছে। ডান শাখার ঘরটার মত এখানেও দেয়ালের মাঝামাঝি ব্যালকনি রয়েছে। ব্যালকনিতে ওঠার সিঁড়ির। মাথা দড়ি আটকে রুদ্ধ করা হয়েছে।

ঘরের ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে রেইনবো জুয়েলস। কাঁচের বাক্সটা ঘিরে রয়েছে। খুঁটি,  ওগুলোতে বেঁধে রঙিন মখমলের দড়ির ঘের দেয়া হয়েছে। ঘেরের এপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে বাক্সটার নাগাল পাওয়া যায় না।

সুন্দর ব্যবস্থা, সারির মধ্যে থেকে চলতে চলতে বলল কিশোর। হঠাৎ গিয়ে। ঘুসি মেরে বাক্স ভেঙে হারটা তুলে নিতে পারবে না চোর।

এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছু দেখার উপায় নেই, এত ভিড়। সারি চলছে ধীরে ধীরে, তারই মাঝে থেকে চলতে চলতে যতখানি দেখে নেয়া যায়। বড় একটা হীরা-নীল আলো ছড়াচ্ছে, মস্ত জোনাকির মত জ্বলে আছে একটা পান্না, জলন্ত কয়লার মত ধক ধক করছে একটা চুনি, আর জ্বলজ্বলে সাদা বিশাল একটা মুক্তা-এই চারটে পাথরই বেশ কায়দা করে বসানো হয়েছে রত্নহারটাতে। ওগুলোকে ঘিরে ঝকমক করছে ছোটবড় আরও অসংখ্য পাথর৷ ঠিক নামই রাখা। হয়েছে, রামধনু রত্নহার, রামধনুর মতই সাতরঙ বিচ্ছুরিত হচ্ছে পাথরগুলো থেকে।

কাঁচের বাক্সের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে একজন গার্ড। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল হারটার দাম বিশ লক্ষ আমেরিকান ডলার। দাম শুনে হু-ই-ই-ই করে। উঠল এক গার্ল স্কাউট।

এক দিকের দেয়ালের কাছে চলে এল তিন গোয়েন্দা। ব্যালকনির ঠিক নিচেই আরেকটা কাঁচের বাক্সে রাখা হয়েছে ফুট তিনেক লম্বা সোনার বেল্টটা। অনেকগুলো। চারকোনা সোনার টুকরো গেঁথে তৈরি হয়েছে বেল্ট। প্রতিটি টুকরোর মাঝখানে বসানো একটা করে চৌকোনা পান্না, ধারগুলোতে বসানো হয়েছে মুক্তা। দুই মাথার বকলেসে রয়েছে হীরা এবং চুনি। বেল্টের আকার দেখেই বোঝা যায়, এটা যিনি পরতেন, বিশালদেহী মানুষ ছিলেন তিনি।

সম্রাটের সোনার বেল্ট এটার নাম, বেল্টের বাক্সের কাছে দাঁড়ানো এক গার্ড বলল। জিনিসটা প্রায় হাজার বছরের পুরানো। ওজন পনেরো পাউণ্ডের মত। খুবই দামি জিনিস, কিন্তু আসল দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এর ঐতিহাসিক মূল্য।

আরও কিছুক্ষণ বেল্টটা দেখার ইচ্ছে ছিল তিন গোয়েন্দার, কিন্তু পেছনের চাপে বাধ্য হয়ে সরে আসতে হল। অসংখ্য কাঁচের বাক্সে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আরও অনেক মূল্যবান জিনিস, তার প্রায় সবই সুকিমিচি জুয়েলারস-এর তৈরি। আঠা দিয়ে মুক্তা আর কাঁচ জুড়ে তৈরি হয়েছে হাঁস, ঘুঘুপাখি, মাছ, হরিণ আর অন্যান্য অনেক জীবজন্তুর প্রতিকৃতি। ছেলেরা চুপচাপ মুগ্ধ চোখে দেখছে, কিন্তু মেয়েরা চুপ করে থাকতে পারছে না। চারদিক থেকে কেবল তাদের হুইই-হাইই, ইস-আস্স্ শোনা যাচ্ছে।

প্রায় ভরে গেছে এখন ঘরটা। কথা বলার জন্যে খালি একটু জায়গা দেখে সরে এল তিন গোয়েন্দা।

কত গার্ড দেখেছ? বলল কিশোর। দিনের বেলা এখানে চুরি করা সম্ভব নয়। করলে রাতে করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? ঢুকবে কি করে? অ্যালার্ম ফাঁকি দিয়ে বাক্স ভাঙবে কি করে? মাথা নাড়ল সে আপনমনেই। আমার মনে হয় না চুরি করতে পারবে, যদি না—

হুপপ! কিশোরের গায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে পিছিয়ে এসেছে, আর কোনদিকেই নজর ছিল না।

আরে, মিস্টার মার্চ? বলে উঠল কিশোর।

 কে! ভুরু কুঁচকে তাকাল লোকটা।

আরে, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি কিশোর, কিশোর পাশা। টেলিভিশনে কমিকে অভিনয় করতাম, মনে নেই? আমরা বাচ্চারা যত গণ্ডগোল বাধ্যতাম, আপনি তার খেসারত দিতেন, মনে পড়ছে?

কি, কিশোর পাশা! ও ইয়ে..হা হা! চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। কিন্তু এখন তো কথা বলার সময় নেই আমার, অভিনয় করতে হবে।

অভিনয়?

দেখ, কি করি, হাসল মিস্টার মার্চ। মজা দেখ। ওই যে, একটা গার্ড। গলা। চড়িয়ে ডাকল, গার্ড! গার্ড!

ঘুরল ইউনিফর্ম পরা গার্ড। থমথমে চেহারা। কি হয়েছে? ভারি কণ্ঠ।

টলে উঠল মার্চ। আমার-আমার মাথা ঘুরছে!…পানি! পানি! পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছল সে। হাত কাঁপছে বলেই বোধহয়, রুমালের ভাঁজ থেকে খুট করে কিছু একটা মেঝেতে পড়ে গেল। লাল একটা পাথর, রুবির মত দেখতে। আহহা! চেহারায় শঙ্কা ফুটল অভিনেতার।

দুই লাফে কাছে চলে এল গার্ড। কোত্থেকে চুরি করেছ এটা! গর্জে উঠল সে। এস, এদিকে এস! মার্চের কলার চেপে ধরে টানল লোকটা।

 হ্যাঁচকা টান দিয়ে কলার ছাড়িয়ে নিল মার্চ, জোরে এক ধাক্কা মারল গার্ডের বুকে।

আর দ্বিধা করল না গার্ড। হুইসেল বাজাল। বদ্ধ ঘরের বাতাস যেন চিরে দিল বাঁশির তীক্ষ্ণ শব্দ। জমে গেল যেন ঘরের প্রতিটি লোক। সবকটা চোখ প্রায় একই সঙ্গে ঘুরে গেছে গার্ড আর মার্চের দিকে। দেখতে দেখতে ছুটে এসে মার্চকে ঘিরে। ফেলল গার্ডেরা। অপরাধী একটা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে অভিনেতা।

এই যে, মিস্টার… শুরু করল হেড গার্ড। কিন্তু তার কথা শেষ হল না, তার আগেই গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল পুরো ঘরটা।

এক সেকেণ্ড নীরবতা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল একটা উত্তেজিত কণ্ঠ, আলো! আলো জ্বেলে দাও!

হারের বাক্সটার কাছে চলে যাও দুজন! শোনা গেল হেড গার্ডের আদেশ। বিল, ডিক, তোমরা গিয়ে দরজা আটকাও। খবরদার, কেউ যেন বেরোতে না। পারে!

এরপর শুরু হল হট্টগোল। যার যেভাবে খুশি চেঁচাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনেকে ভয়ে হাউমাউ জুড়ে দিয়েছে, চেঁচিয়ে, বুঝিয়ে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে মায়েরা।

চীফ! চেঁচিয়ে উঠল এক গার্ড। ছেলেপিলেগুলোর জন্যে এগোতে পারছি না! বাক্সটার কাছে যাওয়া যাচ্ছে না!

যেভাবেই হোক, যাও! আবার বলল হেড গার্ড। ডাকাত! ডাকাত পড়েছে!

ঠিক এই সময় ঝন ঝন করে ভাঙল কাঁচ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল যেন অ্যালার্ম বেল। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে চলল দর্শকরা। অন্ধকারের মধ্যে কে কত জোরে চেঁচাতে পারে তারই প্রতিযোগিতা চলেছে যেন।

রত্নহার! কিশোরের কানের কাছে মুখ এনে বলল মুসা। হারটা চুরি করার তালে আছে কেউ!

তাই তো মনে হচ্ছে, কিশোরের কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল, ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছে সে। ভেবেচিন্তে প্ল্যান করেই এসেছে ডাকাতেরা।…চল, সামনের দরজার কাছে চলে যাই। ব্যাটারা ওদিক দিয়েই হয়ত বেরোবে। চল চল।

পেছনেও দরজা আছে, বলল রবিন।

তা আছে। কিন্তু একসঙ্গে দুদিকে দেখতে পারব না। চল, সামনের দিকেই যাই।

দুহাতে বাচ্চাদেরকে ঠেলে সরিয়ে দরজার দিকে এগোল কিশোর। তাকে সাহায্য করল মুসা। ভিড়ের মধ্যে কোনমতে পথ করে এগোল তিন গোয়েন্দা।

দরজার কাছে যেতে পারল না ওরা। গার্ডের কাউকে বেরোতে দিচ্ছে না, ফলে দরজার কাছে ঠাসাঠাসি হয়ে আছে লোকজন। এ ওকে ঠেলা মারছে, সে তাকে অঁতো দিচ্ছে। পাগল হয়ে উঠেছে যেন সবাই। বিপজ্জনক পরিস্থিতি। এখন কোনভাবে এক-আধটা বাচ্চা পড়ে গেলে জনতার পায়ের চাপেই চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।

অ্যালার্ম আর হট্টগোল ছাপিয়ে শোনা গেল একটা কণ্ঠ, কথায় জাপানী টান। থামিয়ে দেয়া হল বেল। বোধহয় ইমার্জেন্সী সুইচ অফ করে ব্যাটারি কানেকশন কেটে দেয়া হয়েছে। আবার শোনা গেল সেই কণ্ঠে আদেশ, গার্ডস! জলদি বাইরে। চলে যাও! লোককে হল থেকে বেরোতে দাও। কিন্তু সাবধান! এরিয়ার বাইরে যেন যেতে না পারে কেউ! সবাইকে সার্চ করে তবে ছাড়বে!

দরজার কাছ থেকে বোধহয় সরে দাঁড়াল গার্ডেরা। কারণ, অন্ধকারেই বুঝতে পারল কিশোর, ঢেউ খেলে গেল যেন জনতার মাঝে। নড়তে শুরু করেছে সবাই একদিকে, বেরিয়ে যাচ্ছে। মুসা আর রবিনকে নিয়ে তাদের মাঝে ঢুকে গেল সে।

 তিন গোয়েন্দাকে যেন ছিটকে বের করে নিয়ে এল জনতার স্রোত। দেয়াল ঘেরা বড় একটা লনে বেরিয়ে এসেছে ওরা। আশপাশে অসংখ্য গার্ড, দর্শকদের কাউকেই লনের বাইরে যেতে দিচ্ছে না। বাচ্চা আর মহিলাদের শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে কয়েকজন। পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। খানিক পরেই লনের গেট দিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আর হাফট্রাক। লাফ দিয়ে নেমে এল সশস্ত্র পুলিশ।

শুরু হল তল্লাশি। বয়স্কাউট আর গার্ল গাইডরা পুলিশকে সাহায্য করতে লাগল।

দ্রুত চলল তল্লাশি। সারি দিয়ে গেটের দিকে এগোচ্ছে দর্শকরা, যাদেরকে তল্লাশি করা হয়ে যাচ্ছে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই রবিন আর মুসাকে নিয়ে। পেছনে রইল কিশোর, যাতে তাদের পালা পরে আসে।

মিস্টার মার্চের পালা এল। বিধ্বস্ত চেহারা তার। একজন গার্ডকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? ডাকাতি…।

…এই যে, মিস্টার, মার্চকে দেখেই বলে উঠল হেড গার্ড। আপনাকে এখন যেতে দেয়া হবে না। হাত ধরে টেনে অভিনেতাকে পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাছে নিয়ে চলল সে।

কিছু পাওয়া যাবে না ওর কাছে, নিচু গলায় দুই সঙ্গীকে বলল কিশোর। সহজে ছাড়াও পাবে না। জেরার পর জেরা চলবে। কিন্তু ডাকাত ব্যাটারা পালাল কোন পথে?

তাই তো বুঝতে পারছি না! পুরো লনে চোখ বোলাল মুসা। পুরুষ আর তেমন কেউ নেই, খালি মহিলা, আর বাচ্চা! এদের কাউকেই তো ডাকাত মনে হচ্ছে না!

হু! বিড়বিড় করল কিশোর। ওদের কাছে কিছু পাওয়া যাবে না…

হুড়মুড় করে এই সময় মিউজিয়ম থেকে বেরিয়ে এলেন এক ছোটখাট জাপানী ভদ্রলোক, হাতে টর্চ। চেঁচিয়ে গার্ডদেরকে বললেন, লোকেরা চলে গেছে, না? হায় হায়, গেল বুঝি! রেইনবো জুয়েলস না, রেইনবো জুয়েলস না, বেল্টটা নিয়ে গেছে!

উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিশোরের চোখ। অবাক কাণ্ড তো! ব্যাটারা বেল্ট চুরি করতে গেল কেন? হারটা নেয়া অনেক সোজা ছিল! এতবড় জিনিস, লুকাল কোথায়!

ওই যে দুজন বয়স্কাউট, আঙুল তুলে দেখাল রবিন। লম্বু দুটোকে দেখছ, আমার মনে হয় ওদের কাজ। কুঠার দিয়ে বাড়ি মেরে কাঁচের বাক্স ভেঙেছে… বেল্টটা আছে ওদের কাছেই।

আমার মনে হয় না। এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান, ঠোঁট গোল। করে শিস দিল। গোল্ডেন বেল্ট ওদের কাছে পাওয়া যাবে না।

কিশোরের কথা ঠিক হল। স্কাউটদেরকেও তল্লাশি করা হল, কিন্তু পাওয়া গেল সোনার বেল্ট। তাদের ব্যাগে খাবার ছাড়া আর কিছুই নেই, মিউজিয়ম থেকে গ্রিফিথ পার্কে গিয়ে পিকনিকের ইচ্ছে, তাই সঙ্গে খাবার নিয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে খালি হয়ে এল লন। তিন গোয়েন্দাকেও তল্লাশি করা হল। এবার বেরিয়ে যেতে পারে ওরা, কিন্তু বেরোল না কিশোর। আরেকবার মিউজিয়মে ঢোকার ইচ্ছে তার।– আর কাউকে তল্লাশি করা বাকি নেই। মিউজিয়মে এখনও আলো জ্বালানর। ব্যবস্থা হয়নি। কয়েকটা টর্চ জোগাড় করে অন্ধকার মিউজিয়মে ঢুকল গিয়ে কয়েকজন গার্ড। মুসা আর রবিনকে নিয়ে কিশোরও ঢুকে পড়ল।

যে কাঁচের বাক্সে বেল্টটা রাখা হয়েছিল, ওটার ওপরের আর একপাশের কাঁচ। ভেঙে চুরমার। অন্য বাক্সগুলো ঠিকই আছে, বেল্টটা বাদে আর কিছু চুরিও হয়নি।

এই সময় পেছনে চেঁচিয়ে উঠল কেউ, আরে, এই যে, ছেলেরা, তোমরা এখানে কি করছ? এখানে কি?

সেই জাপানী ভদ্রলোক।

স্যার। পকেট থেকে কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরল কিশোর, আমরা। গোয়েন্দা। আপনাদেরকে সাহায্য করতে চাই।

টর্চের আলোয় কার্ডটা পড়লেন ভদ্রলোক। তারপর মুখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকালেন।

হেসে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। যে-কোন ধরনের রহস্য সমাধান করতে রাজি আমরা। ভৌতিক রহস্য, চুরি, ডাকাতি…

পাগল! আমেরিকান ছেলেগুলো সব বদ্ধ পাগল। যত্তোসব! কার্ডটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ভদ্রলোক। আমি টোহা মুচামারু, সুকিমিচি জুয়েলারস কোম্পানির সিকিউরিটি ইনচার্জ, আমিই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না গোল্ডেন বেল্ট কি করে চুরি হল! আর তিনটে বাচ্চা খোকা এসেছে এর সমাধান করতে! হুহ!…যাও, খোকারা, বাড়ি যাও। খামোকা গোলমাল কোরো না। বেরোও। প্রায় ধাক্কা দিয়ে তিন গোয়েন্দাকে মিউজিয়ম থেকে বের করে দিলেন মুচামারু।

.

০৩.

পরদিন খবরের কাগজে বেশ বড়সড় হেডিং দিয়ে ছাপা হল গোল্ডেন বেল্ট চুরির সংবাদ, খুঁটিয়ে পড়ল কিশোর। নতুন কিছু তথ্য জানা গেল। মেকানিক-এর পোশাক পরা একজন লোককে মিউজিয়মের সীমানার ভেতরে ঢুকতে দেখা গেছে, এর কয়েক মিনিট পরেই গাড়িতে করে দ্রুত চলে গেছে লোকটা। যারা দেখেছে, তারা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। যে-কোন বাড়িতে যে-কোন সময় বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঘটতে পারে, সারানর জন্যে মিস্ত্রি আসতে পারে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। নিখুঁত পরিকল্পনা করে চুরি করতে এসেছিল একটা দল, মাপ সময়ে যার যার কাজ করে সরে পড়েছে। কেউ বাইরে থেকে কাজ করেছে, কেউ করেছে ভেতর থেকে। কে ছিল ভেতরে?

পেছনের দরজা দিয়ে কেউ বেরোয়নি। কাগজে লিখেছে, বেরোনর উপায় ছিল না, কারণ পেছনের দরজা এমনভাবে বন্ধ করা ছিল, ওটা খুলে বেরোনো অসম্ভব। তারমানে চোরও বেরিয়েছে সামনের দরজা দিয়েই। মিউজিয়মের ভেতরে দর্শক যারা যারা ঢুকেছিল, তাদের সবাইকে লনে আটকানো হয়েছে, ভালমত তল্লাশি করা হয়েছে। তাহলে কোন্‌দিক দিয়ে গেল চোর?

কাগজে লিখেছে, মিস্টার টোড মার্চকে জেরা করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

এই মিস্টার মার্চের ব্যাপারটাই বুঝতে পারছি না! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। রুমাল থেকে ইচ্ছে করেই একটা লাল পাথর ফেলল! আসল পাথর নয়, নকল, কাঁচ-টাচের তৈরি হবে।

হেডকোয়ার্টারে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। কিশোরের কথা শেষ হয়নি, বুঝতে পেরে চুপ করে রইল মুসা আর রবিন।

ক্যারাভানের দেয়ালের দিকে চেয়ে ভ্রুকুটি করল কিশোর। কোন সন্দেহ নেই, পেশাদার দলের কাজ। প্রতিটি সেকেণ্ড পর্যন্ত মেপে নিয়েছে। নাহ, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না! কি করে সোনার বেল্টটা বের করল ওরা?

গার্ডদের কেউ হতে পারে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। নিশ্চয় চোরের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে! কোন গার্ডকে কিন্তু তল্লাশি করা হয়নি!

 প্রশংসার দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকাল মুসা। ঠিক, এটা হতে পারে!– কিন্তু…আরও একটা সম্ভাবনা আছে। হয়ত মিউজিয়মেই কোথাও লুকিয়ে ছিল চোর। সবাই চলে যাওয়ার পর কোন এক সুযোগে বেরিয়েছে।

উঁহু! মাথা নাড়ল কিশোর। কাগজে লিখেছে, দর্শকরা সব বেরিয়ে যাওয়ার পর পুরো মিউজিয়ম খুঁজে দেখা হয়েছে। কারও পক্ষে তখন লুকিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না।

 হয়ত কোন গোপন ঘর আছে, বলল রবিন। ওসব পুরানো বাড়িগুলোতে থাকে।

চুপ করে কয়েক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। তারপর মাথা নাড়ল ধীরে ধীরে, আমার মনে হয় না! তেমন ঘর থেকে থাকলে মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ জানবেই। আর গার্ডদের ব্যাপারটা…কি জানি…! একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই, এটা। বুঝলেই অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবহার না নিয়ে বেল্টটা নিল কেন ওরা? হারটার দাম বেশি, লুকানো সহজ, বেচতে পারত সহজে।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল গোয়েন্দাপ্রধান। চিমটি কেটে চলল নিচের ঠোঁটে।

দেখি, আবার প্রথম থেকে একটা একটা পয়েন্ট আলোচনা করি, বলল। কিশোর। প্রথমেই লাইট চলে যাওয়ার ব্যাপারটা। এটা সহজ কাজ, বাইরে থেকে সহজেই করা গেছে। দুই, আলো চলে যাওয়ার পর গার্ডরা অসুবিধেয় পড়েছে। কারণ, বাচ্চা আর মহিলারা নরক গুলজার শুরু করে দিয়েছিল মিউজিয়মের ভেতর। গার্ডেরা দর্শক সামলাতেই হিমশিম খেয়ে গেছে, এই সুযোগে কাজ সেরে ফেলেছে। চোর। তারমানে, ইচ্ছে করেই চিলড্রেনস ডে বেছে নিয়েছে চোরেরা। ঠিক কিনা?

ঠিক, মাথা ঝাঁকাল মুসা।

তিন, রেইনবো জুয়েলসের দিকেই লক্ষ্য বেশি ছিল গার্ডদের, ফলে বেল্টটা সহজেই হাতিয়ে নিতে পেরেছে চোর। বাক্সের চারপাশে দড়ির রিঙ, তার বাইরে থেকেই কাজটা করতে পারে একজন লম্বা মানুষ।

গার্ডদের অনেকেই খুব লম্বা, মনে করিয়ে দিল রবিন।

ঠিক, সায় দিল কিশোর। বাক্স ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজে উঠল, দরজার দিকে দৌড় দিল কিছু গার্ড। দর্শকদেরকে বেরোতে দেয়া হল লনে, তাদেরকে তল্লাশি করা হল, তারপর ছেড়ে দেয়া হল।

এগুলো কোন তথ্য নয়, বলল মুসা। এ-থেকে রহস্যের সমাধান করা যাবে না।…আচ্ছা, আমরা যেচে সাহায্য করতে চাইলাম, এমন ব্যবহার করল কেন জাপানী সিকিউরিটি অফিসার?।

ঠোঁট উল্টাল কিশোর। কি জানি! হয়ত আমাদেরকে বেশি ছেলেমানুষ মনে করেছে, তাই। ইস, মিস্টার ক্রিস্টোফার ওই মিউজিয়মের ডিরেক্টর হলে কাজটা পেয়ে যেতাম আমরা!

তিনি নন, বলল মুসা। ওকথা ভেবে আর কি লাভ?

 মিস্টার মার্চের ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক, টেবিলে আস্তে আস্তে টোকা দিল কিশোর।

মানে? প্রায় একই সঙ্গে প্রশ্ন করল রবিন আর মুসা।

মনে আছে কি কি করেছ? টেবিলে দুই কনুই রেখে সামনে ঝুঁকল কিশোর। মিস্টার মার্চ আমাকে বলেছে, এবার অভিনয় শুরু করবে সে। তারপর অভিনয় শুরু করেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মোছার ছলে ইচ্ছে করেই পাথর ফেলেছে। গার্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সন্দেহ জাগিয়েছে। তারপর কি ঘটল?

কি ঘটল? একই প্রশ্ন করল রবিন, এবং উত্তর দিল নিজেই, গার্ড চেঁচামেচি শুরু করল, অন্য গার্ডদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, দর্শকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল মিস্টার মার্চের দিকে।

ঠিক তাই। খুশি খুশি একটা ভাব ফুটেছে কিশোরের চেহারায়। দর্শক আর গার্ডদের নজর অন্যদিকে সরিয়ে দিল লোকটা। ওই সুযোগে অন্য অপরাধীরা তাদের যার যার কাজ করে গেছে নিরাপদে। এমন কিছু, যেটা আমাদের নজরে পড়েনি।

সেই এমন কিছুটা কি? প্রশ্ন করল মুসা।

সেটাই তো জানি না। তবে ওদের সময়জ্ঞানে আশ্চর্য হতেই হচ্ছে! পাথরটা মেঝেতে ফেলল মিস্টার মার্চ, এক গার্ড বাঁশি বাজাল, অন্য গার্ডরা দৌড়ে এল। তার এক কি দুই সেকেণ্ড পরেই দপ করে নিভে গেল সব বাতি। অন্ধকার হয়ে গেল। ঘর, আর সেই সুযোগে গোল্ডেন বেল্ট চুরি করে পালাল চোরেরা। প্রতিটি কাজ নিখুঁতভাবে সেরেছে।

চিন্তিত দেখাল রবিনকে। কিন্তু কারা ওরা? বেল্টটা বের করে নিয়ে গেল কিভাবে?

কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল কিশোর, ঠিক এই সময় তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন।

তৃতীয়বার রিঙ হতেই ফোনের তারের সঙ্গে যুক্ত লাউড-স্পীকারের সুইচ টিপে

অন করে দিল কিশোর। রিসিভার তুলে নিল। হ্যালো।– কিশোর পাশা? মহিলা কণ্ঠ বেজে উঠল স্পীকারে। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার চাইছেন তোমাকে।

বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে গেল যেন তিন গোয়েন্দার চোখে মুখে। দীর্ঘদিন পর আবার এসেছে ডাক! মিস্টার ক্রিস্টোফার চাইছেন, তারমানে নিশ্চয় জটিল কোন রহস্য।

কিশোর বলছি।

ধরে থাক, প্লীজ।

 দুই সেকেণ্ড খুটখাট শব্দ হল স্পীকারে। তারপরই ভেসে এল ভারি গমগমে কণ্ঠস্বর। হ্যালো, কিশোর। কেমন আছ তোমরা?

ভাল, স্যার! উত্তেজনায় কাঁপছে কিশোরের গলা।

হাতে কোন কাজ আছে এখন তোমাদের। মানে কোন কেস?

না, স্যার, কিছু নেই! বসে থেকে থেকে…

তাহলে একটা কাজ দিচ্ছি। আমার এক লেখিকা বান্ধবীকে সাহায্য করতে পারবে?

সাহায্য? কি সাহায্য!

এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। বোধহয় গুছিয়ে নিচ্ছেন। মনে মনে। কি বলল ঠিক বুঝতে পারছি না। ওর সঙ্গে দেখা হয়নি আমার, ফোনে। কথা হয়েছে। রত্নদানোরা নাকি বিরক্ত করছে ওকে।

র-ত্ন-দা-নো! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন রবিন আর মুসা।

তাই তো বলল, বললেন মিস্টার কিস্টোফার। রত্নদানো। ওই যে, খুদে পাতাল-মানব, যারা নাকি চামড়ার পোশাক পরে, পাতালে বাস করে, আর সুড়ঙ্গ কেটে কেটে খালি রত্বের সন্ধানে ফেরে।

রত্নদানো কি, জানি, স্যার। কিন্তু ওরা তো কল্পিত জীব, কেচ্ছা কাহিনীতে আছে। সত্যি সত্যি আছে বলে তো শুনিনি কখনও!

আমিও শুনিনি। কিন্তু আমার বান্ধবী বলছে, সে নিজের চোখে দেখেছে। রাতে চুরি করে তার ঘরে ঢুকে পড়ে দানোরা, সমস্ত ছবি উল্টেপাল্টে রাখে, বই ছড়িয়ে ফেলে দিয়ে যায় যেখানে সেখানে। পুলিশকে বলেছে সে, কিন্তু পুলিশ এমনভাবে তাকিয়েছে যেন মহিলার মাথা খারাপ। ভীষণ অসুবিধেয় পড়ে শেষে আমাকে জানিয়েছে সে।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।

কিশোর, ওকে সাহায্য করতে পারবে?

পারব কিনা জানি না, তবে চেষ্টা তো নিশ্চয় করব! ঠিকানাটা দেবেন?

কাগজ-কলম টেনে নিয়ে ঠিকানা লিখে নিল রবিন।

ছেলেদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন চিত্রপরিচালক।

যাক! জোরে একটা শ্বাস ফেলল কিশোর। গোল্ডেন বেল্টের কেন্স পাইনি, কিন্তু তার চেয়েও মজার একটা পেলাম! রত্নদানো! চমৎকার!

.

০৪.

মিস শ্যানেল ভারনিয়া থাকেন লস অ্যাঞ্জেলেস-এর শহরতলীতে। বাসে যেতে অসুবিধে, একটা গাড়ি হলে ভাল হয়। মেরিচাচীকে ধরল তিন গোয়েন্দা। ইয়ার্ডের ছোট ট্রাকটা দিতে রাজি হলেন চাচী। চালিয়ে নিয়ে যাবে দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন, বোরিস।

খালি মুখে বেরোতে রাজি হল না মুসা। অগত্যা কিশোর আর রবিনকেও টেবিলে বসতে হল।

খেয়ে দেয়ে মস্ত ঢেকুর তুলল মুসা। পেটে হাত বুলিয়ে বলল, হ্যাঁ, এইবার দানো শিকারে যাওয়া যায়।

আর কিছু খাবে? মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আর? টেবিলের শূন্য প্লেটগুলোর দিকে চেয়ে বলল মুসা। আর তো কিছু নেই!

মুচকি হেসে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা জগ বের করল কিশোর। নিয়ে এসে বসল আবার টেবিলে।

কমলার রস। চেঁচিয়ে উঠল মুসা। দাও দাও, জলদি দাও! ইসস, পুডিংটা খাওয়া উচিত হয়নি! তবে তেমন ভাবনা নেই। পানির ভাগ বেশি তো, পেটে বেশিক্ষণ থাকবে না।

 দুটো গেলাসে কমলালেবুর রস ঢেলে একটা রবিনকে দিল কিশোর। আরেকটা নিজে রেখে জগটা ঠেলে দিল মুসার দিকে।

প্রায় ছোঁ মেরে জগটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে খেতে শুরু করল মুসা। হঠাৎ কি মনে পড়ে যাওয়ায় মুখের সামনে থেকে জগ সরিয়ে বলল, কিশোর, গোল্ডেন বেল্ট কি করে চুরি হয়েছে, বুঝে গেছি!

 অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। কি করে?

গার্ল স্কাউটের লীডার মেয়েটাকে দেখেছিলে না? ওর মাথায় বড় বড় চুল ছিল। আমার মনে হয় পরচুলা। পরচুলার নিচে করে নিয়ে গেছে বেল্টটা!

মুসার বুদ্ধি দেখে গোঙানি বেরোল কিশোরের।

রবিন বলল, খেয়ে খেয়ে মাথায় আর কিছু নেই ওর! পরচুলার নিচে করে গোল্ডেন বেল্ট? তা-ও যদি বলত চোরা খুপরিওয়ালা কোন লাঠির কথা—কিশোর, পেয়েছি! লাঠি! হ্যাঁ, এক বুড়োকে মোটা লাঠি হাতে দেখেছি সেদিন! নিশ্চয় ওটার চোরা খুপরির ভেতরে ভরে…

তোমাদের দুজনের মাথায়ই গোবর, থামিয়ে দিয়ে বলল কিশোর। পনেরো পাউণ্ড ওজনের তিন ফুট লম্বা একটা বেল্ট! হারটা হলে পরচুলা কিংবা লাঠির ভেতরে করে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এতবড় বেল্ট…অসম্ভব! অন্য কিছু ভাব।

আর কিছু ভাবতে পারব না আমি, আবার মুখে জগ তুলল মুসা।

আমার মাথায়ও আর কিছু আসছে না! এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল রবিন। চুলোয় যাক গোল্ডেন বেল্ট! হ্যাঁ, এনসাইক্লোপীডিয়ায় দেখলাম, রত্নদানো—

..এখন না, গাড়িতে উঠে বল, চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল কিশোর। দেখি, বোরিস গাড়ি বের করল কিনা।

সামনের সিটে বোরিসের পাশে গাদাগাদি করে বসল তিন গোয়েন্দা। মিস ভারনিয়ার বাড়ির ঠিকানা দিল বোরিসকে কিশোর। ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে পথে উঠে এল হাফট্রাক, ছুটে চলল লস অ্যাঞ্জেলেস-এর শহরতলীর দিকে।

হ্যাঁ, এইবার বল, রবিন, রত্নদানোর ব্যাপারে কি কি জেনেছ? বলল কিশোর।

রত্নদানো হল, লেকচারের ভঙ্গিতে শুরু করল রবিন, এক ধরনের ছোট্ট জীব, মানুষের মতই দেখতে, কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক ছোট, বামনদের সমান কিংবা তার চেয়েও ছোট। ওরা থাকে মাটির তলায়, গুপ্তধন খুঁজে বের করাই ওদের কাজ। রত্নদানোদের সঙ্গে বাস করে কুৎসিত চেহারার আরেক জাতের জীব, গবলিন। গবলিনরা দক্ষ কামার। শাবল, কোদাল, গাঁইতি বানাতে ওদের জুড়ি নেই। স্বর্ণকার হিসেবেও ওরা ওস্তাদ। সোনা আর নানারকম মূল্যবান পাথর দিয়ে চমৎকার গহনা বানায় রত্নদানোদের রানী আর রাজকুমারীদের জন্যে।

এসব তো কিসসা! ঘঁউক করে এক ঢেকুর তুলল মুসা। আরিব্বাপরে, খাওয়াটা বেশিই হয়ে গেছে! থাকগে, রাতে দেরি করে খেলেই হবে!..হ্যাঁ, যা। বলছিলাম, রত্নদানো, গবলিন, এসব হল গিয়ে কল্পনা। মি:মিউথো…

মিথোলজি, বলে দিল কিশোর।

হ্যাঁ, মিথোলজির ব্যাপার-স্যাপার। বাস্তবে নেই। মিস ভারনিয়ার বাড়িতে আসবে কোত্থেকে? নড়েচড়ে বসল মুসা।

সেটাই তো জানতে যাচ্ছি আমরা।

কিন্তু রত্নদানো তো বাস্তবে নেই, আবার বলল মুসা।

কে বলল নেই? পথের দিকে নজর রেখে বলে উঠল বোরিস। ব্যাভারিয়ার ব্ল্যাক ফরেস্ট জায়গাটা খুব খারাপ!

দেখলে তো? হাসি চাপল কিশোর। রত্নদানো আছে, এটা বোরিস বিশ্বাস করে।

বোরিস করে, সেটা আলাদা কথা, পেটটা সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বিড়বিড় করল মুসা। বোতাম খুলে দেব নাকি প্যান্টের? যাকগে, হজম হয়ে যাবে একটু পরেই।-হ্যাঁ, এটা ব্ল্যাক ফরেস্ট নয়। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার-লস অ্যাঞ্জেলেস। এখানে রত্নদানো আসবে কোত্থেকে, কি করে?

হয়ত রত্ন খুঁজতেই এসেছে, মুসার হাঁসফাস অবস্থা দেখে হাসছে রবিন। ক্যালিফোর্নিয়ায় কি রত্ব নেই, সোনার গহনা নেই? ১৮৪৯ সালে সোনার খনিও পাওয়া গেছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। খবরটা হয়ত অনেক দেরিতে পেয়েছে ওরা, তাই এতদিন পরে এসেছে। মাটির তলায় খবর যেতে দেরি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

রত্নদানো থাকুক বা না থাকুক, হালকা কথাবার্তা থামিয়ে দিয়ে বলল কিশোর। রহস্যজনক কিছু একটা ঘটছে মিস ভারনিয়ার বাড়িতে, এটা ঠিক। ওখানে গেলেই হয়ত জানতে পারব।

শহরতলীর অতি পুরানো একটা অঞ্চলে এসে ঢুকল ওরা। গাড়ির গতি কমিয়ে রাস্তার নাম্বার খুঁজতে লাগল বোরিস। বিরাট একটা পুরানো বাড়ির কাছে এনে গাড়ি থামাল।

বাড়ি না বলে দুর্গ বলা চলে ওটাকে। অসংখ্য গম্বুজ, মিনার, স্তম্ভ রয়েছে। যেখানে সেখানে নকশা আর ফুল আঁকা হয়েছে সোনালি রঙ দিয়ে, বেশির ভাগ জায়গায়ই বিবর্ণ হয়ে গেছে কিংবা চটে গেছে রঙ। অস্পষ্ট একটা সাইনবোর্ড পড়ে। বোঝা গেল ওটা একটা থিয়েটার-বাড়ি, মূরেরা তৈরি করেছিল। পুরানো। সাইনবোর্ডটার কাছেই আরেকটা নতুন সাইনবোর্ড-বারোতলা অফিস তৈরি হচ্ছে।

খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক চেয়ে আবার গাড়ি ছাড়ল বোরিস। থিয়েটারের পর একটা উঁচু পাতাবাহারের বেড়া পেরিয়ে এল। পলকের জন্যে বেড়ার ওপাশে, অন্ধকার, সরু লম্বা একটা দালান চোখে পড়ল কিশোরের। বেড়ার পরে আরেকটা বাড়ি, একটা ব্যাংক, পুরানো ধাচের বাড়ি, পাথরে তৈরি দেয়াল।

আরেকটা ব্লকের কাছে চলে এল ট্রাক। এখানে একটা সুপারমার্কেট, দোকানগুলো পুরানো। অনেক আগে এটা বাণিজ্যিক এলাকা ছিল, বোঝাই যাচ্ছে।

বাড়িটা পেছনে ফেলে এসেছি, ব্যাংক আর সুপারমার্কেটের মাঝখানে বসানো পাথর ফলকে রাস্তার নাম্বার দেখে বলল কিশোর।

বেড়ার ওপাশের বাড়িটাই হবে, রবিন বলল। একমাত্র ওটাকেই বসতবাড়ির মত দেখতে লাগছে।

পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে কোথাও পার্ক করুন, বোরিসকে বলল কিশোর।

খানিকটা পিছিয়ে এনে পাতাবাহারের বেড়ার ধারে গাড়ি পার্ক করল বোরিস। ছয় ফুট উঁচু গাছগুলো অযত্নে বেড়ে উঠেছে, মাথা সবগুলোর সমান নয়, রাস্তার ধুলোবালিতে আসল রঙ হারিয়ে গেছে রঙিন পাতার। বেড়ার ওপাশে পুরানো। বাড়িটার দিকে আবার তাকাল কিশোর, মনে হল, বাইরের ব্যস্ত দুনিয়া থেকে অনেক দূরে সরে আছে ওটা।

বেড়ার ধার ধরে হেঁটে গেল মুসা। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সাদা রঙ করা ছোট একটা গেটের সামনে। চেঁচিয়ে উঠল, আরে, এই তো! মিস শ্যানেল। ভারনিয়া!

মুসার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর আর রবিন।

এটা একটা জায়গা হল! বলল মুসা। দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এই ভূতের গলিতে এসে বাসা বাঁধলেন কেন মহিলা!…আরিসব্বোনাশ! কাণ্ড দেখেছ! আঙুল তুলে গেটের এক জায়গায় সাঁটানো কাগজ দেখাল সে। যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্যে কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তবু রোদে হলদেটে হয়ে গেছে সাদা মোটা কাগজ। বিড়বিড় করে পড়ল মুসা, মানুষ হলে বেল বাজান, প্লীজ। রত্নদানো, বামন কিংবা খাটোভূত হলে শিস দাও। সেরেছে, কিশোর, পাগল! পাগলের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছি! চল, ভাগি!

ভুরু কুঁচকে লেখাটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। বোঝা যাচ্ছে, ওই সব কল্পিত জীবগুলোর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন মিস ভারনিয়া। মুসা, এক কাজ কর, শিস দাও…

ফিক করে হেসে ফেলল রবিন।

 কী! চেঁচিয়ে উঠল মুসা! আমি কি রত্নদানো নাকি?

রত্নদানো না হলেও পেটুকদানো, এতে কোন সন্দেহ নেই। যা বলছি, কর। শিস দাও। দেখা যাক, কি ঘটে।

কিশোর ঠাট্টা করছে না বুঝতে পেরে আর প্রতিবাদ করল না মুসা। ঠোঁট গোল করে টানা তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে উঠল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পাতাবাহারের ঝোঁপের ভেতরে কথা বলে। উঠল কেউ, কে?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল কিশোর। ঝোঁপের ভেতরে স্পীকার লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির ভেতরে বসে স্পীকারের মাধ্যমে কথা বলছে কেউ। বড় বড় এলাকা নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে যে সব বাড়ি তৈরি হচ্ছে আজকাল, অনেক বাড়িতেই এই স্পীকারের ব্যবস্থা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল ঝোঁপের ভেতরে। কিছু দেখা গেল না। দুহাতে পাতা আর ডাল সরাতেই দেখা গেল জিনিসটা। পাখি। পোষার ছোট বাক্সে বসানো হয়েছে স্পীকার, বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্যে। মাইক্রোফোন বসানো রয়েছে স্পীকারের পাশেই।

গুড আফটারনুন, মিস ভারনিয়া, মার্জিত গলায় বলল কিশোর। আমরা তিন গোয়েন্দা। মিস্টার ক্রিস্টোফার পাঠিয়েছেন। আপনার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে এসেছি আমরা।

ও, নিশ্চয় নিশ্চয়! তালা খুলে দিচ্ছি, মিষ্টি হালকা গলা।

গেটে মৃদু গুঞ্জন উঠল। বাড়ির ভেতরে বসেই নিশ্চয় সুইচ টেপা হয়েছে, মেকানিজম কাজ করতে শুরু করেছে পাল্লার, খুলে গেল ধীরে ধীরে।

আগে ভেতরে ঢুকল কিশোর। তার পেছনে মুসা আর রবিন।

পেছনে গেটটা আবার বন্ধ হয়ে যেতেই থমকে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। ওদের মনে হল, বাইরের জগৎ থেকে আলাদা হয়ে গেল যেন। মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে ছয় ফুট উঁচু বেড়া, রাস্তা দেখা যায় না। একপাশে পরিত্যক্ত থিয়েটার-বাড়ির পুরানো দেয়াল উঠে গেছে কয়েক তলা সমান উঁচুতে। আরেক পাশে ব্যাংকের গ্ল্যানেট পাথরের দেয়াল। দেয়াল বেড়া সবকিছু মিলে সরু পুরানো বাড়িটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে যেন। বাড়িটা তিনতলা, কিছু কিছু ঘরের দেয়াল রেডউড কাঠে তৈরি, কড়া রোদ বিবর্ণ করে দিয়েছে কাঠের রঙ। নিচের তলায় সামনের দিকে বারান্দা, কয়েকটা টবে লাগানো ফুল গাছে ফুল ফুটেছে, পুরো এলাকাটায়। তাজা উজ্জ্বল রঙ বলতে শুধু ওই ফুল কটাই।

 একই সময়ে প্রায় একই অনুভূতি হচ্ছে তিনজনের। বাড়িটা দেখতে দেখতে ওদের মনে হল, রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছে যেন কোন ডাইনীর বাড়ি।

কিন্তু মিস শ্যানেল ভারনিয়াকে মোটেই ডাইনীর মত লাগল না। সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন। লম্বা, পাতলা শরীর, চঞ্চল চোখ, সাদা চুল।

এস, পাখির গলার মত মোলায়েম মিষ্টি কণ্ঠস্বর মিস ভারনিয়ার। তোমরা। আসাতে খুব খুশি হয়েছি। এস, ভেতরে এস।

 লম্বা হলঘর পেরিয়ে বড়সড় লাইব্রেরিতে ছেলেদেরকে নিয়ে এলেন লেখিকা। দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় আলমারি, বুক-শেলফ, বই উপচে পড়ছে। দেয়ালের জায়গায়। জায়গায় ঝোলানো রয়েছে সুন্দর পেইন্টিং আর ফটোগ্রাফ, সবই বাচ্চা ছেলেমেয়ের।

বস, তিনটে চেয়ার দেখিয়ে বললেন লেখিকা। হ্যাঁ, যে জন্যে ডেকেছি। তোমাদেরকে, কোনরকম ভূমিকা না করে শুরু করলেন তিনি। রত্নদানোরা বড় বিরক্ত করছে আমাকে। কয়েকদিন আগে পুলিশকে জানিয়েছিলাম, আমার দিকে যে-রকম করে তাকাল, রত্নদানোর কথা বলতে আর কোনদিন যাব না ওদের কাছে…।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আর্মচেয়ারে আরাম করে বসেছিল, এখন সোজা হয়ে গেছে পিঠ, জানালার দিকে চেয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস। জানালার বাইরে একটা ছোট্ট মানুষের মত জীব! মাথায় টোপরের মত টুপি। বিচ্ছিরি দাড়িতে মাটি লেগে আছে, কাঁধে একটা ঝকঝকে গাঁইতি। মুখ ভয়ানক বিকৃত, চোখ লাল।

.

০৫.

 রত্নদানো! চেঁচিয়ে বলল রবিন। আমাদের ওপর নজর রাখছিল!

কই, কোথায়! প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল মুসা আর কিশোর।

ওই যে, ওখানে, জানালার বাইরে ছিল! আঙুল তুলে জানালাটা দেখাল। রবিন। চলে গেছে! হয়ত আঙিনায়ই আছে এখনও!

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটল রবিন ও তার পেছনে কিশোর, সবার পেছনে মুসা। দুটো আলমারির মাঝের ফাঁকে একটু অন্ধকার মত জায়গায় রয়েছে। জানালাটা। চোখ মিটিমিটি করে তাকাল রবিন, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল মসৃণ কাঁচ।

আয়না, বলল কিশোর। প্রতিবিম্ব দেখেছ, রবিন।

ফিরে তাকাল অবাক রবিন। মিস ভারনিয়াও উঠে দাঁড়িয়েছেন। আয়নার উল্টো দিকের একটা জানালা দেখালেন তিনি। আয়নার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওদিকটা অন্ধকার হয়ে থাকে, তাই আয়না বসিয়েছি। জানালার আলো প্রতিফলিত করে।

ছুটে খোলা জানালার কাছে চলে এল ছেলেরা। মাথা বাড়িয়ে বাইরে উঁকি দিল। কিশোর, আঙিনাটা দেখল। কেউ নেই!

কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে মুসাও জানালার বাইরে মাথা বের করে দিল। নাহ্, কেউ নেই আঙিনায়! রবিন, তুমি ঠিক দেখেছিলে তো?

জানালার নিচে তাকাল রবিন, শূন্য থিয়েটার-বাড়ির উঁচু দেয়াল দেখল। কোথাও কিছু নেই। দাড়িওয়ালা রত্নদানোর ছায়াও চোখে পড়ছে না।

আমি ওকে দেখেছি! দৃঢ়কণ্ঠে বলল রবিন। নিশ্চয় বাড়ির আশপাশে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। গেট বন্ধ, বাইরে যেতে পারবে না। খুঁজলে এখনও হয়ত পাওয়া যেতে পারে ওকে।

পাবে না, কারণ ওটা রত্নদানো, বলে উঠলেন মিস ভারনিয়া। জাদুবিদ্যায় ওস্তাদ ওরা।

কিন্তু তবু খুঁজে দেখতে চাই, বলল কিশোর। পেছনে কোন গেট-টেট আছে?

মাথা ঝাঁকাল লেখিকা। তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন বাড়ির পেছনের আরেকটা ছোট বারান্দায়। ওখান থেকে আঙিনায় নেমে পড়ল ছেলেরা।

মুসা, তুমি বয়ে যাও, নির্দেশ দিল কিশোর। রবিন, তুমি এস আমার সঙ্গে। ডানে যাব।

তেমন বিশেষ কোন জায়গা নেই, যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারেরত্নদানো। আঙিনায় ছোট ছোট কয়েকটা ঝোঁপ। বাড়ির পেছনে কাঠের বেড়া, বেড়ার ওপাশে সরু গলি। বেড়ায় কোন ফোকর নেই, যেখান দিয়ে গলে বেরোতে পারে রত্নদানো। পেছনে একটা গেট আছে, তালাবদ্ধ। পুরানো, মরচে ব্রা লোহার গেট, দেখেই বোঝা যায়, অনেক বছর ধরে খোলা হয়নি। ওই গেট পেরোলেই থিয়েটার-বাড়ির সীমানা।

ওদিক দিয়ে যায়নি, মাথা নাড়ল রবিন।

যত ছোটই হোক, তবু সবকটা ঝোঁপ খুঁজল রবিন আর কিশোর, নিচতলায় ভাঁড়ারের জানালাগুলো পরীক্ষা করল বাইরে থেকে। জানালার পাল্লাগুলো অসম্ভব। নোংরা, দীর্ঘদিন খোলাও হয়নি, পরিষ্কারও করা হয়নি। বাড়ির সামনের দিকে বেড়ার ধারে চলে এল দুজনে। পুরো-বেড়াটা পরীক্ষা করল, কোথাও ফোকর নেই, ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে পাতাবাহারের গাছ। বামন-আকৃতির একটা মানুষেরও আঙিনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই, একমাত্র গেট ছাড়া।

তাহলে? যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে রত্নদানো!

মুসাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে।

চল তো, কিশোর বলল। জানালার নিচে পায়ের দাগ আছে কিনা দেখি।

লাইব্রেরি ঘরের যে জানালায় রত্নদানো দেখেছে রবিন, সেটার নিচে চলে এল তিনজনে। শুকনো কঠিন মাটি, পায়ের ছাপ নেই, পড়েনি।

নেই! দেখতে দেখতে বলল কিশোর। আরেকটা রহস্য!

মানে! ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল রবিন।

উবু হয়ে মাটি থেকে কিছু তুলে নিল কিশোর। এই যে, দেখ, আলগা মাটি। জুতোর তলা থেকে খসে পড়েছে।

মিস ভারনিয়ার টবের মাটিও হতে পারে, বলল রবিন। কোনভাবে পড়েছে এখানে।

সম্ভাবনা কম, ওপর দিকে চেয়ে আছে কিশোর। জানালাটা দেখ। চৌকাঠের নিচটাও আমাদের মাথার ওপরে। রবিন, খুব ছোট একটা মানুষকে দেখেছিলে, না?

মানুষ না, রত্নদানো! জবাব দিল রবিন, ফুট তিনেক লম্বা! মাথায় টোপরের মত টুপি, নোংরা দাড়ি, কাঁধে ধরে রেখেছে গাঁইতি। ওর কোমর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। এমনভাবে চেয়ে ছিল আমার দিকে, যেন ভীষণ রেগে গেছে।

তা কি করে হয়? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। জানালার চৌকাঠ মাটি থেকে ছয় ফুট উঁচুতে। তিন ফুট লম্বা রত্নদানোর কোমর দেখা যাবে কিভাবে? ওর মাথাই তো দেখা যাওয়ার কথা না!

প্রশ্নটা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিল রবিন আর মুসাকে।

হয়ত মই, খানিকক্ষণ চুপ করে ভেবে বলল মুসা। হয়ত কেন, নিশ্চয়ই মই!

নিশ্চয়! ব্যঙ্গ প্রকাশ পেল কিশোরের গলায়। ভাঁজ করে এই এত্তোটুকুন করে সেই মই পকেটে ভরে ফেলা যায়! তোমার কি ধারণা? মই পকেটে নিয়ে ফোর্থ ডাইমেনশনের কোন গর্তে ঢুকে পড়েছে দানোটা?

কিশোরের কথার ধরনই অমনি, রাগ করল না মুসা। মাথা চুলকাতে লাগল।

ভ্রুকুটি করল রবিন। ওরা জাদু জানে। জাদুর বলে বাংলাদশে ভানুমতির খেল দেখিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে।

আমার মনে হয় আসলে কিছু দেখনি তুমি, রবিন, বলল কিশোর। হয়ত কল্পনা করেছ, মানে, কল্পনার চোখে দেখেছ।

আমি ওটা দেখেছি! জোর দিয়ে বলল রবিন। ওর চোখও দেখেছি! টকটকে লাল, জ্বলন্ত কয়লার মত জ্বলছিল!

লাল চোখওয়ালা রত্নদানো! ইয়াল্লা! গুঙিয়ে উঠল মুসা। রবিন, দোহাই তোমার, বল, ওটা তোমার কল্পনা!

বার বার ছাগলকে কুকুর বলছে ওরা!-নিজের দৃষ্টিশক্তির ওপর সন্দিহান হয়ে উঠল রবিন। তাই তো, বেশিক্ষণ তো দেখিনি ওটাকে। মাত্র এক পলক! কি জানি! গলায় আর আগের জোর নেই তার। মনে তো হল, দেখেছি! কিন্তু-কি জানি, কল্পনাও হতে পারে! তখন অবশ্য এনসাইক্লোপীডিয়ায় দেখা রত্নদানোর ছবির কথা ভাবছিলাম। নাহ্, খুব সম্ভব কল্পনাই করেছি!

কল্পিত জীবকে পাওয়া যাওয়ার কথা না, দ্বিধায় পড়ে গেছে কিশোর। কিন্তু যদি সত্যি দেখে থাক, তাহলে জাদু জানে ব্যাটা! গায়েব হওয়ার মন্ত্র!

এছাড়া বেরোবে কি করে আঙিনা থেকে? যোগ করল মুসা।

চল, ঘরে যাই, বলল কিশোর। মিস ভারনিয়ার কথা শুনিগে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই।

সামনের বারান্দা দিয়ে আবার ঘরে ঢুকল ওরা। হল পেরিয়ে লাইব্রেরিতে এল।

 ওকে পাওনি তো? জিজ্ঞেস করলেন লেখিকা।

 নাহ, মাথা নাড়ল রবিন। গায়েব!

আমি জানতাম, পাবে না, মাথা দুলিয়ে বললেন মিস ভারনিয়া। রত্নদানোরা ওরকমই, এই আছে এই নেই! তবে আমিও অবাক হয়েছি, দিনের বেলায় আসতে দেখে। দিনের আলোয় সাধারণত বেরোয় না ওরা। যাকগে, এস আগে চা খেয়ে নিই। তারপর বলল, কি কি ঘটেছে।

চীনামাটির কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন লেখিকা, আশা করি তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে। ক্রিস্টোফারের খুব ভাল ধারণা তোমাদের ওপর। কয়েকটা অদ্ভুত রহস্য নাকি ভেদ করেছ।

তা করেছি, সবার আগে কাপ টেনে নিয়ে চায়ে প্রচুর পরিমাণে দুধ আর চিনি। মেশাতে লাগল মুসা। তবে বেশির ভাগ কৃতিত্বই কিশোরের, তাই না, রবিন?

অন্তত আশি পার্সেন্ট, গম্ভীর গলায় বলল নথি। বাকি বিশ পার্সেন্ট আমাদের দুজনের। কিশোর, ঠিক না? এই, কিশোর?।

পাশের একটা কাউচে পড়ে থাকা খবরের কাগজের হেডলাইনে মনোযোগ কিশোরের। রবিনের ডাকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, মিস ভারনিয়া, রবিন। আর মুসার সাহায্য ছাড়া একটা রহস্য ভেদ করতে পারতাম না।

মিউজিয়মের খবরটা দেখছ মনে হচ্ছে? চা আর বিস্কুট বাড়িয়ে ধরে কিশোরকে বললেন মিস ভারনিয়া। কি যে হয়েছে দিনকাল! চারদিকে খালি গোলমাল আর গোলমাল! রহস্যের ছড়াছড়ি!

একটা বিস্কুট আর কাপটা নিল কিশোর। এক কামড় বিস্কুট ভেঙে চিবিয়ে চা দিয়ে গিলে নিল। গোল্ডেন বেল্টটা যখন চুরি হয়, তখন মিউজিয়মেই ছিলাম। আমরা, সে এক তাজ্জব কাণ্ড! সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাজি হলেন না সিকিউরিটি ইনচার্জ। আমরা নাকি বড় বেশি ছেলেমানুষ।

ভাগিয়ে দিলেন, সেকথা বলছ না কেন? একসঙ্গে দুটো বিস্কুট মুখে পুরেছে মুসা, কথা অস্পষ্ট।

আরে, এ কি! মুসার দিকে চেয়ে বলে উঠল কিশোর। এই না একটু আগে হাঁসফাস করছিলে বেশি খেয়ে ফেলেছিলে বলে?

ও হ্যাঁ, তাই তো! কিশোর মনে করিয়ে দেয়ায় যেন মনে পড়ল মুসার। পেটে হাত রাখল। প্লেট থেকে বড় আকারের আরও গোটা চারেক বিস্কুট একসঙ্গে তুলে নিয়ে বলল, এই কটাই, ব্যস, আর খাব না। আরে, এত উত্তেজনা, পেটের কথা মনে থাকে নাকি?

মুচকি হাসল কিশোর।

আরে থাক, থাক, বললেন মিস ভারনিয়া। ছেলেমানুষ, এই তো তোমাদের খাওয়ার বয়েস।—হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ইনচার্জ তোমাদেরকে ভাগিয়ে দিয়ে উচিত। করেনি। তবে আমার জন্যে ভালই হল। তোমরা অন্যখানে ব্যস্ত থাকলে আমার এখানে আসতে পারতে না। খাও, চা-টা আগে শেষ কর, তারপর কথা হবে।

মিস ভারনিয়ার ভরসা পেয়ে পুরো প্লেট খালি করে দিল মুসা। আরেক কাপ চা নিয়ে আবার দুধ আর চিনি মেশাতে শুরু করল।

পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! বললেন লেখিকা। আহা, কি সব দিনই না ছিল। কতদিন পর আবার ছেলেদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছি! পুরো একটা হপ্তাও পেরোত না, টি-পার্টি দিতাম, রত্নদানো, বামন আর খাটোভূতদের নিয়ে।

বিষম খেল মুসা। গলায় চা আটকে যাওয়ায় কাশতে শুরু করল। বিস্কুটে কামড় বসিয়ে মাঝপথেই থেমে গেল রবিন।

শুধু কিশোরের অবস্থা স্বাভাবিক রইল। শান্ত কণ্ঠে বলল, প্রতিবেশী বাচ্চাদের দাওয়াত করতেন, না? ওদের নামই দিয়েছেন রত্নদানো, বামন আর খাটোভূত?

নিশ্চয়। হাসি ফুটল লেখিকার মুখে। খুব চালাক ছেলে তো তুমি! কি করে। বুঝলে?

 ডিডাকশন, খালি কাপটা টিপয়ে নামিয়ে রাখল কিশোর। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো দেখিয়ে বলল, সব বাচ্চাদের ছবি। পোশাক-আশাক পুরানো ছাঁটের, এখন আর ওসব ডিজাইন কেউ পরে না। কোন কোন ছবির নিচে লেখা দেখলাম: প্রিয় মিস ভারনিয়াকে। আপনি একজন লেখিকা, কল্পিত জীব নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, সবই বাচ্চাদের জন্যে। দুটো বই পড়েছি আমি। দারুণ বই। রত্নদানো আর খাটোভূতের চরিত্রগুলো সব মানুষের বাচ্চার মত। ধরেই নিলাম, আদর করে আপনার বাচ্চা বন্ধুদেরকে ওসব নামে ডাকেন। হাঁ হয়ে গেছে রবিন আর মুসা। ওই দুটো বই ওরাও পড়েছে, দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোও দেখেছে। কিন্তু কিশোরের মত ভেবেও দেখেনি, গুরুত্বও দেয়নি।

ঠিক, ঠিক বলেছ। আনন্দে বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিয়ে উঠলেন মিস ভারনিয়া। তবে একটা ব্যাপার ভুল বলেছ। বামন কিংবা খাটোভূত কল্পিত হতে পারে, কিন্তু রত্নদানোরা নয়। ওরা বাস্তব। আমি শিওর। একটু থেমে বললেন, আমার বাবার যথেষ্ট টাকা-পয়সা ছিল। আমি যখন বাচ্চা ছিলাম, আমার জন্যে একজন গভর্নেস রেখে দিয়েছিলেন বাবা। কি সব সুন্দর সুন্দর গল্প যে জানত মহিলা! আমাকে শোনাত। ব্ল্যাক ফরেস্টে রত্নদানো আর বামনেরা বাস করে, ওই মহিলাই প্রথম বলেছে আমাকে। বড় হয়ে তার মুখে শোনা অনেক গল্প নিজের মত করে লিখেছি। একটা বই উপহার দিয়েছিল আমাকে মহিলা। বইটা জার্মান ভাষায় লেখা। হয়ত বুঝবে না তোমরা, কিন্তু ছবি বুঝতে কোন অসুবিধে নেই। নিয়ে। আসছি বইটা।

উঠে গিয়ে শেলফ থেকে চামড়ায় বাঁধাই করা মোটা, পুরানো একটা বই নিয়ে এলেন মিস ভারনিয়া। প্রায় দেড়শো বছর আগে জার্মানীতে ছাপা হয়েছিল এ-বই। ছেলেরা ঘিরে বসলে এক এক করে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন তিনি। লেখক অনেক দিন বাস করেছেন ব্ল্যাক ফরেস্টে। রত্নদানো, বামন আর খাটোভূতদের নাকি তিনি দেখেছেন। নিজের হাতে ছবি এঁকেছেন ওগুলোর। এই যে, এই ছবিটা দেখ।

পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে একটা ড্রইং। কুৎসিত চেহারার একটা মানুষ যেন। মাথায় চূড়া আর বারান্দাওয়ালা চামড়ার টুপি, হাত-পায়ে বড় বড় রোমি। কাঁধে ধরে রেখেছে একটা ছোট গাইতি। লাল চোখ, যেন জ্বলছে। রেগে আছে যেন কোন কারণে।

ঠিক একটা…মানে এই চেহারাই দেখেছি জানালায়! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

লেখক এর নাম দিয়েছেনরত্নদানোর দুষ্ট রাজা! বলে গেলেন মিস ভারনিয়া। কিছু কিছু রত্নদানো আছে, যারা খুবই খারাপ। তবে ভাল রত্নদানোও আছে। যারা খারাপ, লেখকের মতে, তাদের চোখ লাল হয়ে যায়।

খাইছে! বিড়বিড় করল মুসা।

খারাপটাকেই দেখেছি তাহলে! আপনমনেই বলল রবিন। রত্নদানো সত্যিই দেখেছে, এই বিশ্বাস আবার ফিরে আসছে তার।

পাতা উল্টে সাধারণ পোশাক পরা আরও কিছু রত্নদানোর ছবি দেখালেন মিস ভারনিয়া। ঠিক এই ধরনের পোশাক পরা রত্নদানো দেখেছি আমি কয়েকটা, আস্তে বইটা বন্ধ করে রেখে দিলেন তিনি। ছবি তো দেখাই আছে, তাই ব্যাটাদেরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনেছি। যা যা ঘটেছে, সবই বলব। তবে আগে অন্যান্য কথা কিছু বলে নিই। পুরানো দিনের কথা, যখন খোকা-খুকুদের জন্যে আমি লিখতাম। দীর্ঘশ্বাস পড়ল লেখিকার, অতীতের সোমালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই বোধহয়। অল্প বয়েস থেকেই লিখতে শুরু করি আমি। বাবা-মা মারা গেলেন, তখন নামডাক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে আমার। ভাল পয়সা আসতে শুরু করল। এসব অনেক আগের কথা, তোমাদের জন্মও হয়নি তখন। আমার বাড়ি খুঁজে বের করত বাচ্চারা, আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসত, আমার সই নিতে আসত। বাচ্চাদেরকে ভালবাসি আমি, তাই আশপাশের বাড়ির যত বাচ্চা ছিল, সবাই ছিল। আমার বন্ধু। ধীরে ধীরে সময় বদলাল, পরিবেশ বদলাল। পুরো অঞ্চলটা বদলে গেল কি করে, কি করে জানি! পুরানো বাড়িঘর সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হল, ভাল ভাল গাছপালা কেটে সাফ করে ফেলা হল, বসত বাড়ির জায়গায় দিনকে দিন। গজিয়ে উঠতে লাগল দোকানপাট। আমার বাচ্চা বন্ধুরা যেন হুড়মুড় করে বড় হয়ে। গেল, কে যে কোথায় চলে গেল তারপর, জানি না। অনেকেই আমাকে এখান থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, কিন্তু পারলাম না। কিছুতেই এই পরিচিত বাড়িটা বিক্রি করে যেতে পারলাম না। যাবও না। যতদিন বাঁচব, এখানে, এই বাড়িতেই থাকব। এখানে কেন পড়ে আছি, বোঝাতে পেরেছি তোমাদেরকে?

তিনজনেই মাথা নোয়াল একবার।

বদলেই চলেছে সবকিছু, আবার বললেন মিস ভারনিয়া। বেশ কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে থিয়েটারটা। ফলে লোক সমাগমও অনেক কমে গেছে, আগের চেয়ে, প্রায় নির্জনই বলা চলে এখন অঞ্চলটাকে। গেটে কার্ড লাগিয়ে দিয়েছি আমি। পুরানো বন্ধুদের কেউ যদি কখনও আসে, শিস দিয়ে আমাকে ডাকবে। এটাই নিয়ম ছিল, এভাবেই ডাকত আমার রত্নদানো, বামন আর খাটোভূতেরা। লেখিকার চোখের কোণ টলমল করছে। জান, এখনও কালেভদ্রে ওদের কেউ না কেউ আসে, শিস দিয়ে ডাকে আমাকে। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিই। কিন্তু আগের সেই নিষ্পাপ ফুলগুলোকে আর দেখি না! ওরা আজ অনেক বড়! চুপ করলেন মিস ভারনিয়া। চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।

যাব না যাব না, বলছি বটে, কিন্তু যাবার দিন হয়ত এসে গেছে আমার, বললেন মিস ভারনিয়া। আমাকে সরে যেতে বাধ্য করবে ওরা। ইতিমধ্যেই কয়েকবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মিস্টার রবার্ট। আমার জায়গাটা কিনে নিতে পারলে তার সুবিধে হয়। কিন্তু মুখের ওপর মানা করে দিয়েছি। ওরা বুঝতে পারে না, আমি এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, জীবনের সোনালি দিনগুলো আমার এখানেই কেটেছে, এই জায়গা ছেড়ে আমি কি করে যাই? আমার খাটোভূতদের স্মৃতি যে জড়ানো রয়েছে এর প্রতিটি ইটকাঠে!

মহিলাকে বাড়ি ছাড়া করতে খুব কষ্ট হবে মিস্টার রবার্টের, বুঝতে পারল তিন গোয়েন্দা। আদৌ পারবে কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আরেক কাপ চা ঢেলে নিলেন মিস ভারনিয়া। আমার অতীত নিয়ে বড় বেশি বকবক করে ফেলেছি, না? হয়ত তোমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু কতদিন পর মন খুলে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি! উহ, কতদিন! কাপে চুমুক দিলেন তিনি। থাক। এখন ওসব কথা। কাজের কথায় আসি। মাত্র কয়েক রাত আগে, হ্যাঁ, মাত্র কয়েক রাত। রত্নদানোদের দেখেছি আমি। না না, আমার বাচ্চা বন্ধু নয়, সত্যিকারের দানো!

খুলে বলুন, প্লীজ, অনুরোধ করল কিশোর। রবিন, নোট নাও।

পকেট থেকে নোটবই আর পেন্সিল বের করল রবিন।

বয়েস হয়েছে, বললেন মিস ভারনিয়া। কিন্তু ঘুম ভালই হয় আমার এখনও। কয়েক রাত আগে, অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। নরম মাটিতে গাঁইতি চালাচ্ছে যেন কেউ, এমনি শব্দ।

মাঝরাত? গাঁইতি? ভুরু কুঁচকে বলল কিশোর।

হ্যাঁ। প্রথমে ভেবেছি, ভুল শুনেছি। রাতদুপুরে মাটি কাটতে আসবে কে? একমাত্র…

…রত্নদানোরা ছাড়া! বাক্যটা সমাপ্ত করে দিল মুসা।

হ্যাঁ, রত্নদানো ছাড়া! মাথা ঝাঁকালেন মিস ভারনিয়া। উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম! ওমা! আঙিনায় চারটে খুদে মানুষ! একেবারে ছবিতে যে-রকম দেখেছি, তেমনি পোশাক পরা। লাফাচ্ছে ওরা, নাচানাচি করছে, খেলছে আনন্দে! ডাকলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মত গায়েব হয়ে গেল জীবগুলো! ছেলেদের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন লেখিকা, তার কথা বিশ্বাস করছে কিনা ওরা। আমি স্বপ্ন দেখিনি। পরের দিন পরিচিত এক কনস্টেবলকে রাস্তায় দেখে তাকে ডেকে বললাম সব কথা। কি একখান চাউনি যে দিল আমাকে! আহ, যদি দেখতে! ক্ষণিকের জন্যে ঝিক করে উঠল মহিলার নীল চোখের তারা। আমাকে উপদেশ দিল ব্যাটা! নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখতে বলল। শিগগিরই বাইরে কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসতে বলল। ওকেও আচ্ছামত কথা শুনিয়েছি আমি। ওর সামনেই প্রতিজ্ঞা করেছি, রত্নদানোর কথা আর কক্ষণো বলব না পুলিশকে।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে হঠাৎ হেসে উঠলেন মিস ভারনিয়া। আসলে পুলিশেরও দোষ দেয়া উচিত না। রাতদুপুরে রত্নদানো দেখেছি, একথা বললে কে বিশ্বাস করতে চাইবে? যাই হোক, সেদিন জোর করেই মনকে বোঝালাম, রত্নদানো দেখিনি। ওসব আমার কল্পনা। দ্বিতীয় রাত গেল, কিছু ঘটল না। তৃতীয় রাতে আবার দেখলাম ওদের। একই সময়ে, একই জায়গায়। তাড়াতাড়ি ফোন করে বললাম আমার এক ভাইপোকে। বব, আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বিয়ে করেনি এখনও, মাইল কয়েক দূরে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকে সে। ওকে অনুরোধ করলাম আসতে। অবাক হল, কিন্তু আসবে বলে কথা দিল। ভাঁড়ারে দানোদের হুটোপুটির আওয়াজ পেলাম। টর্চটা নিয়ে পা টিপে টিপে নিচে নামলাম, এগোলাম ভাঁড়ারের দিকে। যতই এগোলাম, শব্দ আরও স্পষ্ট হতে থাকল। ঘরে ঢুকেই টর্চের সুইচ টিপে দিলাম। কি দেখলাম জান?

মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে তিন ছেলে। একই সঙ্গে বলে উঠল, কী!

তিনজনের দিকেই একবার করে তাকালেন মিস ভারনিয়া। স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, কিছু না!

চেপে রাখা শ্বাস শব্দ করে ছাড়ল রবিন। পুরোপুরি হতাশ হয়েছে।

হ্যাঁ, প্রথমে কিছু না! আবার বললেন মিস ভারনিয়া। টর্চ নিভিয়ে দিলাম। আবার ওপরে উঠে যাওয়ার জন্যে ঘুরতেই দেখলাম ওটাকে। ছোট একটা মানুষের। মত জীব, ফুট তিনেক লম্বা। চামড়ার টুপি, চামড়ার কোট-প্যান্ট, চোখা মাথাওয়ালা জুতো। নোংরা দাড়ি, বোধহয় মাটি লেগেছিল। এক হাতে একটা গাঁইতি কাঁধে ধরে রেখেছে, আরেক হাতে মোমবাতি। মোমের আলোয় ওর চোখ দেখতে পেলাম, টকটকে লাল, যেন জ্বলছে!

ঠিক! ওই ব্যাটাকেই খানিক আগে দেখেছি আমি! আবার চেঁচিয়ে উঠল। রবিন।

রত্নদানো। কোন সন্দেহ নেই, সায় দিয়ে বললেন মিস ভারনিয়া।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। গভীর চিন্তায় মগ্ন।

 তারপর? হঠাৎ প্রশ্ন করল গোয়েন্দাপ্রধান।

কাপে চুমুক দিলেন মিস ভারনিয়া, অল্প অল্প কাঁপছে তাঁর হাত। আমার দিকে চেয়ে ফুঁসে উঠল দানোটা। গাঁইতি বাগিয়ে শাসাল। তারপর এক ফুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দড়াম করে বন্ধ হল দরজার পাল্লা। ছুটে গেলাম দরজার কাছে। বন্ধ! বাইরে থেকে আটকে দেয়া হয়েছে। ভাঁড়ারে আটকা পড়লাম আমি!

কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল মুসা, থেমে গেল। ঘরের দূর প্রান্তে ঝনঝন। শব্দ উঠল। আলোচনায় এতই মগ্ন ছিল ওরা, চমকে উঠল ভীষণভাবে।

Super User