১১.
অ্যামবুলেন্স ডাকার সময় নেই! চেঁচিয়ে বলল জ্যাকবস। আমার গাড়িতে করেই নিয়ে যাচ্ছি ইমার্জেন্সীতে!
আমি যাব আপনার সঙ্গে! বলে উঠল মিসেস ডেনভার।
বাক্সতে তুলে চকলেটগুলোও নিয়ে যান, বলল কিশোর। পরীক্ষা করে দেখতে পারবে।
গ্যারেজ থেকে দ্রুত গাড়ি বের করল জ্যাকবস। পাজাকোলা করে লারিসাকে তুলে নিল মুসা। গাড়িতে তুলে দিল। একটা কম্বল এনে মেয়েটার গায়ে জড়াল। মিসেস ডেনভার। চকলেটসহ বাক্সটা তার হাতে গুঁজে দিল কিশোর। ছুটে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
বিষ! এতক্ষণে কথা বললেন অলিভার। বেচারি! বিষ খাওয়াল কে?
বিষই কিনা জানি না, মিস্টার অলিভার! পুলের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। অদ্ভুত একটা গন্ধ পেলাম চকলেটটাতে!
দুই ঘণ্টা পরে ফিরে এল জ্যাকবস আর মিসেস ডেনভার। সেন্ট্রাল হসপিটালে রেখে এসেছে লারিসাকে। ক্লান্ত, বিষণ্ণ চেহারা দুজনেরই।
নিজেকে এত অপরাধী মনে হয়নি আর কখনও! বলল ম্যানেজার।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন অলিভার। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে সবে রাতের খাওয়া শেষ করেছেন, এই সময় জ্যাকবসের গাড়ির শব্দ কানে এল। চারজনেই ছুটে নেমে এসেছে চতুরে।
পুলিশ! মুখ বাঁকাল মিসেস ডেনভার। বিচ্ছিরি সব প্রশ্ন করতে শুরু করল! কতক্ষণ বাক্সটা আমার কাছে রেখেছি, কোথায় রেখেছি, কেন রেখেছি, এমনি সব প্রশ্ন। আমি কি করেছি না করেছি তাতে তোমাদের কি, বাপু!
আসলে কি ঘটেছে, বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ, জ্যাকবসের কণ্ঠে ক্লান্তি।
বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে? ওদের কি ধারণা, আমি বিষ খাইয়েছি মেয়েটাকে? ওদের জানা উচিত, জীবনে মানুষ তো দূরের কথা, কোন ইঁদুরকেও বিষ খাওয়াইনি আমি! শেষদিকে ধরে এল ম্যানেজারের গলা। গটমট করে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে ফেলল নিজের ফ্ল্যাটের। ভেতরে ঢুকে দড়াম করে বন্ধ করে দিল। আবার। তালা লাগানর শব্দ হল।
কি হয়েছিল, জ্যাকবস? বেরিয়ে এসেছে এনড্রু।
বিষাক্ত কিছু ছিল চকলেটে, জানাল জ্যাকবস, ডাক্তারদের ধারণা। হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেছে অ্যানালাইসিসের জন্যে। মিস ল্যাটনিনার স্টমাক ওয়াশ করে একটা প্রাইভেট রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সারারাত পর্যবেক্ষণে রাখবে ডাক্তারুরা। পুলিশকে খবর দেয়া হল। ওরা এসেই ঘেঁকে ধরল মিসেস ডেনভারকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে বেচারিকে। ভালই হয়েছে। শিক্ষা হবে এতে কিছুটা। আক্কেল থাকলে জীবনে আর অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবে না। ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছে, যে কারোরই প্রথম সন্দেহ পড়বে তার ওপর।
চকলেট এসেছে কিভাবে, জানেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ডাকে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।
খুলে গেল মিসেস ডেনভারের দরজা। এরই মাঝে অনেকটা সামলে নিয়েছে। বেরিয়েই পুলের দিকে তাকাল। প্রতিটি খারাপ ঘটনার একটা ভাল দিকও থাকে। যা আবহাওয়া আর ঠাণ্ডা, ইদানীং শুধু লারিসাই নামত পুলে। দিন কয়েক আর নামতে পারবে না। এই সুযোগে পানি সরিয়ে পুলটা পরিষ্কার করে ফেলতে পারব। অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি।
কি যেন বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল জ্যাকবস। কাঁধ ঝাঁকাল। সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। এনড্রুও চলে গেল।
ম্যানেজারের দিকে তাকালেন অলিভার। চোখে ঘৃণা- তিনিও এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। ব্যালকনিতে উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেদের দিকে চেয়ে বললেন, মায়ামমতা বলতে কিছু নেই বুড়িটার! ওদিকে মারা যাচ্ছে মেয়েটা! আর বুড়ি বলছে, ভালই হয়েছে! পুল পরিষ্কারের সময় পাওয়া গেল! ওটাকে এবার তাড়াব আমি!
কে বিষ খাওয়াল মেয়েটাকে? ঘরে ঢুকেই আরেকবার প্রশ্নটা করলেন অলিভার।
এমন কেউ, যে মিস ল্যাটনিনার স্বভাব-চরিত্র জানে, বলল কিশোর, যে জানে, সে কখন কি করে না করে। জানে, চকলেট তার প্রিয় জিনিস, পেলেই খাবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, কেন বিষ খাওয়ানো হল তাকে?।
কেউ কোন জবাব দিল না।
আড়াআড়ি পা মুড়ে মেঝেতেই বসে পড়ল কিশোর। টেলিভিশনের ওপর চোখ রাখতে সুবিধে।
বেশ মজার জায়গায় বাস করেন আপনি, মিস্টার অলিভার, টিভির পর্দার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। শূন্য চতুর। মাত্র তিন দিন আপনার সঙ্গে আমাদের পরিচয়। এখানে এসেছি, সে-ও তিন দিন। এরই মাঝে কয়টা ঘটনা ঘটল! দুবার অদ্ভুত এক ছায়াকে দেখলাম, চুরি করে ঘরে ঢুকে ধরা পড়ল মিসেস ডেনভার, দামি। একটা জিনিস চুরি হল, তারপর সেই জিনিসের জন্যে টাকাও দাবি করল চোর। এখন, আপনার এক ভাড়াটেকে বিছু খাওয়াল কেউ।
গির্জার দারোয়ানের কথা বাদ দিলে কেন? মনে করিয়ে দিল রবিন। তাকে মেরে বেহুশ করে ফেলে রেখে গেল। তুমি গিয়ে ভূত দেখলে গির্জায়, আটকা পড়লে।
একটা ঘটনার সঙ্গে আরেকটা ঠিক মেলে না! আপনমনেই বলল গোয়েন্দাপ্রধান। কিন্তু, আমার ধারণা, প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে কোথাও একটা যোগসূত্র রয়েছে। একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে। ঘটনার কেন্দ্রস্থল এই বাড়িটা। যা-ই ঘটছে, এর ভেতরে, কিংবা আশপাশে, কাছাকাছি।
হ্যাঁ, সায় দিল মুসা। আর ঘটছে, টমি গিলবার্ট যখন বাড়ি থাকছে তখন। ও কাজে চলে গেলে আর কিছু ঘটে না।
ঝট করে মাথা তুললেন অলিভার। দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন পুরো ঘরে। চাপা গলায় বললেন, আস্তে! কে জানে, এ মুহূর্তে হয়ত এ-ঘরেই রয়েছে সে। ছায়া হয়ে। আমাদের কথা শুনছে!
উঠে পড়ল রবিন। সব কটা আলো জ্বেলে প্রতিটি কামরা ভাল করে দেখে এল। না, কোথাও ছায়াটা চোখে পড়ল না। কিন্তু তবু নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না অলিভার। শঙ্কা গেল না চেহারা থেকে। উঠে গিয়ে এঁটো বাসন-পেয়ালা ধোয়ায় মন দিলেন। টেলিভিশনের সামনে বসে রইল তিন গোয়েন্দা।
পরের কয়েকটা ঘণ্টা কিছুই ঘটল না। চত্বরে কেউই বেরোল না, মিসেস ডেনভার ছাড়া। ময়লা ফেলার জন্য বেরিয়েছিল। ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েই আবার গিয়ে ঘরে ঢুকেছে। বিরক্ত হয়ে উঠছে ছেলেরা, চোখে ঘুম।
দেখ! হঠাৎ শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল কিশোরের।
পর্দায় দেখা গেল, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে টমি। পুলের কিনারে এসে দাঁড়াল। চেয়ে আছে পানির দিকে। ঘুম চলে গেল মুসা আর রবিনের চোখ থেকেও।
জ্যাকবসের ঘরের দরজা খুলে গেল এই সময়। বেরিয়ে এল সে। ঠোঁটে সিগারেট, হাতে অ্যাশট্রে। কাছে এসে মাথাটা সামান্য একটু নোয়াল টমির দিকে চেয়ে। একটা টেবিলে অ্যাশট্রে রেখে তাতে সিগারেট চেপে নেবাল। গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। মুসা গিয়ে দাঁড়াল একটা জানালার কাছে, রাস্তার দিকে তাকাল।
কোথাও যাচ্ছে সে, জানালার কাছ থেকেই বলল মুসা। খুব জোরে চালাচ্ছে।
হয়ত হাওয়া খেতে যাচ্ছে, বললেন অলিভার। ঘুম আসছে না হয়ত। অস্বস্তি বোধ করছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে অনেকেরই এমন হয়।
ঘরে ফিরে গেল টমি। পর্দা টেনে দিল জানালার।
খাইছে! আবার টেলিভিশনের সামনে এসে বসেছে মুসা। ব্যাটা কি করছে, দেখতে পাব না আর!
কাপড় পরছে হয়ত, বলল কিশোর। কাজে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। মাঝরাত থেকে তার ডিউটি।
ঠিক এই সময় নিবে গেল চত্বরের আলো। সেই সঙ্গে নিবে গেল টেলিভিশনের পর্দার আলো। হালকা ধূসর-নীল একটা উজ্জ্বলতা রয়েছে শুধু, টমির জানালার আলো কোনাকুনিভাবে পড়েছে ক্যামেরার চোখে।
আরও ভাল হয়েছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এবার আর কিছুই দেখতে পাব না।
অটোমেটিক টাইমার লাগানো আছে চত্বরের লাইটিং সিসটেমের সঙ্গে, বললেন অলিভার। ঠিক এগারোটায় অফ হয়ে যায় বাতি।
আমাদেরও টেলিভিশন অফ করে দিতে হচ্ছে, উঠে গিয়ে সুইচ টিপে সেটটা বন্ধ করে দিল কিশোর।
হ্যাঁ, আর দরকার কি ওটার? বলল মুসা। তবে, টমি ব্যাটা কোথায় যাচ্ছে, দেখা দরকার। তোমরা বস। আমি ব্যালকনিতে যাচ্ছি। অন্ধকারে ও আমাকে দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। তেমন বুঝলে নেমে গিয়ে ফুলঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে দেখব।
খবরদার, বেল-টেল বাজাবে না! হুশিয়ার করে দিল কিশোর। আস্তে করে টোকা দেবে দরজায়। আমরা বেরোব।
ঠিক আছে, উঠে গিয়ে স্কি-জ্যাকেটটা তুলে নিল মুসা। গায়ে চড়াল। সুইচ টিপে বসার ঘরের আলো নিবিয়ে দিল রবিন। মুহূর্তে দরজা খুলে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এল মুসা। পেছনে আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা। তবে এবার তালা লাগানো হল না ভেতর থেকে।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রইল মুসা। জানে, দরজার ওপাশে তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কিশোর আর রবিন। সে ইঙ্গিত দেয়ামাত্র ছুটে বেরোবে ওরা।
আরও খানিকক্ষণ জ্বলল টমির ঘরের আলো, তারপর নিবে গেল। অপেক্ষা করে রইল মুসা। যে-কোন মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারে টমি। সময় যাচ্ছে। কিন্তু বেরোল না সে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোর একটা রশ্মি এসে পড়েছে পুলের পানিতে, অন্ধকার গাঢ় হতে পারছে না ওই জায়গাটুকুতে। ওই আলোর জন্যেই আবছাভাবে চোখে পড়ছে টমির ঘরের বারান্দা। মুসার চোখ এড়িয়ে দরজা দিয়ে। বেরোতে পারবে না সে।
সময় যাচ্ছে। মাঝরাত পেরোল। শোনা গেল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। খানিক পরেই গেটে দেখা গেল একটা লোককে। সতর্ক হয়ে উঠল মুসা। পরক্ষণেই ঢিলা পড়ে গেল আবার সতর্কতায়। পুলের টেবিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মূর্তিটা। ফ্র্যাঙ্কলিন জ্যাকবস। অ্যাশট্রেটা তুলে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। পরক্ষণেই আলো জ্বলল তার পর্দা ঢাকা জানালায়।
চোখ মিটমিট করল মুসা। মাত্র কয়েকটা সেকেণ্ড জ্যাকবসের ওপর চোখ ছিল, দৃষ্টি সরে গিয়েছিল বারান্দার ওপর থেকে। ঠিক ওই সময়ে বেরিয়ে এসেছে টমি। জ্যাকবসের ঘরের আবছা আলো পড়ছে তার ওপর। ঘুমোনর পোশাক পরনে। পুলের ধার ধরে নিঃশব্দে এগোচ্ছে জ্যাকবসের ঘরের দিকে। হঠাৎ…
আবার চোখ মিটমিট করল মুসা। দুহাতে রগড়াল। স্বপ্ন দেখছে না তো! টমি নেই! হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে!
দ্রুত দরজায় টোকা দিল মুসা। পরক্ষণেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। দ্রুত চতুর পেরিয়ে গিয়ে টমির দরজা আগলে দাঁড়াবে। কোন্ পথে ঘরে ঢোকে টমি, দেখবে।
ছুটছে মুসা। পুলের ধারে পৌঁছতেই পায়ের তলায় পড়ল কি যেন! নরম, জ্যান্ত! তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল!
আঁতকে উঠে লাফিয়ে একপাশে সরে গেল মুসা। সে পা তুলতে না তুলতেই ওটাও লাফ দিয়েছে। পড়ল গিয়ে তার আরেক পায়ের তলায়। আরও জোরে আর্তনাদ করে উঠল। চেঁচিয়ে উঠে আবার সামনে লাফ দিল মুসা। মাটিতে পা ঠেকল না। টের পাচ্ছে, প্যান্টের ঝুল আঁকড়ে ধরে ঝুলছে কিছু একটা। আঁচড় লাগছে পায়ের চামড়ায়। ঝপাং করে পড়ল গিয়ে সে পানিতে।
ঝট করে খুলে গেল এনড্রুর ঘরের দরজা।
দপ করে আবার জ্বলে উঠল চত্বরের আলো।
পুলের ধার খামচে ধরে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে মুসা। শব্দ তুলে মুখ থেকে ফেলছে ক্লোরিন মেশানো পানি।
তার কাছাকাছিই পুলের ধার ধরে সাঁতরাচ্ছে আরেকটা জীব। নিচু হয়ে ঘাড়ের চামড়া ধরে ওটাকে তুলে নিল এনড্রু। কালো একটা বেড়াল।
তুমি…তুমি একটা অমানুষ! মুসার দিকে চেয়ে ধমকে উঠল বেড়াল-মানব।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনমতে ডাঙায় উঠে এল মুসা। ভেজা শরীরে সূঁচ ফোঁটাচ্ছে যেন কনকনে ঠাণ্ডা।
মিস্টার অলিভার! নাকা তীক্ষ্ণ গলা। চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করছে মিসেস ডেনভার। গায়ে কম্বল জড়ানো। এলোমেলো চুল। মিস্টার অলিভার, ছেলেগুলোকে আটকে তালা দিয়ে রাখলেন না কেন? লোকের ঘুম নষ্ট করছে! এমনভাবে বলল মহিলা, যেন সে-ই এই বাড়ির মালিক।
অলিভারের সাড়া নেই। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে কিশোর।
হঠাৎ আবার উদয় হয়েছে টমি তার ঘরের দরজায়।
আমার—আমার ঘুম আসছিল না, বিড়বিড় করে বলল মুসা।
জ্যাকবসের দরজাও খুলে গেছে। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে জানতে চাইল সে, আবার কি হল?
আমার বেড়ালটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ছোঁড়াটা! রাগ এখনও পড়েনি। বেড়াল-মানবের। ভেজা, চুপচুপে জানোয়ারটাকে কোলে তুলে নিয়েছে, হাত বোলাচ্ছে গায়ে। আর ভয় নেই, থোকা, মোলায়েম গলায় বলল এনড্রু। চল, গা মুছিয়ে দিচ্ছি। চুলার ধারে বসলেই গা গরম হয়ে যাবে আবার। বাজে ছেলেদের। ব্যবহারই ওরকম, মন খারাপ কোরো না।
আর যেন তোমাকে এসব করতে না দেখি! মুসাকে হুশিয়ার করল মিসেস ডেনভার।
না, ম্যাডাম, করব না, তাড়াতাড়ি বলল গোয়েন্দা সহকারী।
অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল মিসেস ডেনভার। গটমট করে হেঁটে গিয়ে ঢুকল তার ঘরে।
আজও ছুটি। টমির দিকে চেয়ে আছে কিশোর।
মাথা ঝোঁকাল টমি।
কেমন কাটছে ছুটি? ভাল?
না-হা—ঠিক তা না!—কি যেন…
কি?
না, কিছু না, চোখ রগড়াচ্ছে টমি। মনে হয় স্বপ্ন দেখছিলাম!…চলি…
দ্রুত ফিরে গিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল টমি।
অলিভারের ঘরে এসে ঢুকল মুসা, পেছনে কিশোর। বড় একটা তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছেন অলিভার। বাথরুমে গরম পানির শাওয়ার ছেড়ে দিয়েছে রবিন।
টমি কোত্থেকে উদয় হল? কিশোরের দিকে চেয়ে জ্যাকেট খুলছে মুসা। পুলের ধার ধরে জ্যাকবসের ঘরের দিকে যেতে দেখলাম। হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল সে! ওকে খুঁজতে গিয়েই এই বিপত্তি!
ওর ঘর থেকেই তো বেরোতে দেখলাম, বলল কিশোর। তুমি তখন পানিতে।
অসম্ভব! জ্যাকেটের চেনে আঙুল থেমে গেছে মুসার। আমি যখন পুলে পড়েছি, টমি তার ঘরে ছিল না। নিজের চোখে দেখেছি, জ্যাকবসের ঘরের দিকে এগোচ্ছে। খানিকটা এগিয়েই হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল সে। কোন দিকে গেল, দেখিনি। তবে নিজের ঘরে যায়নি, আমি শিওর!
.
১২.
বাকি রাতটা ব্যালকনিতে বসে পালা করে পাহারা দিয়ে কাটাল রবিন আর কিশোর। অন্ধকার চত্বর। আলো নিবিয়ে দিয়েছে আবার মিসেস ডেনভার। চত্বরের বাতির মেইন সুইচ তার ঘরে। নির্দিষ্ট সময়ে অটোমেটিক কাজ করে লাইটিং সিসটেম, তবে। দরকার পড়লে যে-কোন সময় ওই সুইচ টিপে আলো জ্বালানো-নেবানো যায়।
ভোর চারটা অবধি নির্জন, শূন্য রইল চত্বর। তারপরই বেরিয়ে এল মিসেস ডেনভার। পরনে টুইডের ভারি কোট। তাকে দেখেই ভেতরে ঢুকে গেল কিশোর।
সারাটা রাত বসার ঘরে সোফায় বসে থেকেছেন মিস্টার অলিভার। ঘুমোতে যাননি। ওখানেই বসে বসে ঢুলেছেন।
মিসেস ডেনভার বাইরে যাচ্ছে, বলল কিশোর।
এতে অবাক হবার কিছু নেই, শান্ত রয়েছেন অলিভার।
এই ভোর রাতে!
হাই তুললেন অলিভার। চব্বিশ ঘণ্টাই বাজার খোলা থাকে, জানই। হপ্তায় একবার বাজার করে ডেনভার, বিষাদ বারে। ভোর চারটের সময় বেরোয়।
অলিভারের দিকে চেয়ে আছে কিশোর।
তার বক্তব্য, এই সময় বাজারে ভিড় থাকে না, বললেন অলিভার। কেনাকাটা করতে সুবিধে। আমার ধারণা অন্য। এ-সময়ে ভাড়াটেরা সব ঘুমিয়ে থাকে। বুড়িটারও দেখার কিছু নেই। জ্যাকবস অফিসে যায় ভোর পাঁচটায়। এক ঘণ্টা সময় হাতে থাকছে ডেনভারের। বাজার সেরে ফিরে আসতে পারে সে। নিশ্চিন্তে।
কথাবার্তায় তন্দ্রা থেকে জেগে উঠেছে রবিন আর মুসা।
তার মানে, বলল মুসা, আপনি বলতে চাইছেন, লোকে কে কি করছে না করছে, দেখার জন্যে বাড়ি থেকেই বেরোয় না মিসেস ডেনভার? ভাড়াটেরা সব না, ঘুমোলে বাজারেও যায় না?
তাই, মাথা ঝোঁকালেন অলিভার। আশ্চর্য এক চরিত্র! জাল ছেড়ে যেমন মাকড়সা কোথাও যায় না, ওই বুড়িটাও তেমনি। এই বাড়ি ছেড়ে নড়তেই চায় না। খালি লোকের ওপর চোখ। যেন এসব দেখার জন্যেই বেঁচে আছে সে!
উঠে গিয়ে রাস্তার দিকের জানালার সামনে দাঁড়াল রবিন। টেনে পর্দা সরিয়ে দিল। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসছে। ধূসর সিডান গাড়িটাকে দেখতে পেল সে।
আশ্চর্য! হপ্তায় মাত্র একবার গাড়িটা চালায়! জানালার কাছ থেকেই বলল রবিন। ব্যাটারি ডাউন হয়ে যায় না?
প্রায়ই দেখি গ্যারেজে খবর দেয়, বললেন অলিভার। মেকানিকস আসে।
এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। সামনেই মোড়। ঠিক এই সময় বুমম করে শব্দ হল। শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার।
লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অলিভার।
কিশোর আগেই উঠে পড়েছে। ছুটে যাচ্ছে জানালার দিকে।
পাগলের মত ডানে-বাঁয়ে কাটছে সিডানের নাক। হুডের নিচ থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে।
আবার চেঁচিয়ে উঠল মিসেস ডেনভার। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে গাড়ি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামনের একপাশ দিয়ে গুতো মারল রাস্তার পাশের দেয়ালে। ঘষে এগোল। বাম্পারের ধাক্কা লাগাল মোটা একটা পানির পাইপে। ভোঁতা শব্দ তুলে মাটির কয়েক ইঞ্চি ওপর থেকে ছিঁড়ে গেল পাইপ। ওটার ওপরে এসে গাড়ি থামল। চারপাশ থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে বেরোচ্ছে পানি। আবার শোনা গেল মিসেস ডেনভারের চিত্তার।
দমকল ডাকতে হবে! ফোন করতে ছুটল মুসা।
দরজার দিকে ছুট লাগিয়েছে রবিন। আগে বের করে আনা দরকার মহিলাকে!
কিশোরও ছুটল রবিনের পেছনে।
হুড়মুড় করে চত্বরে নেমে এল দুজনে। বেরিয়ে এসেছে জ্যাকবস, গায়ে ঘুমানর পোশাক। টমি গিলবার্টও বেরিয়েছে। পাজামা পরনে, গায়ে তাড়াহুড়ো করে একটা কোট চাপিয়েছে। গেটের দিকে ছুটেছে।
সবার আগে ছুটছে জ্যাকবস। মিসেস ডেনভার! চেঁচিয়ে উঠল সে সিডান টাকে দেখেই।
টমির পাশ কাটিয়ে এল ছেলেরা, জ্যাকবসকে পেছনে ফেলে এল। ছুটে এসে দাঁড়াল গাড়িটার পাশে। বরফ-শীতল পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর, গ্রাহ্যই করছে না।
স্টিয়ারিঙের পেছনে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে চেঁচাচ্ছে মিসেস ডেনভার। তার এ চিৎকার যেন বন্ধ হবে না আর কোনদিন।
মিসেস ডেনভার! হাতল ধরে হ্যাঁচকা টান লাগাল কিশোর। খুলল না দরজা। বোধহয় তালা আটকানো।
কিশোরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জ্যাকবস। জানালায় থাবা দিচ্ছে জোরে জোরে।
খুব ধীরে ধীরে মুখ ফেরাল মিসেস ডেনভার। শূন্য দৃষ্টি। চেঁচানো থামেনি।
দরজা খুলুন! চেঁচিয়ে উঠল জ্যাকবস। তালা লাগিয়েছেন কেন?
হঠাৎ যেন বাস্তবে ফিরে এল মিসেস ডেনভার। থাবা মারল লক-বাটনের দিকে। এক সেকেণ্ড পরেই হাতল ধরে হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে ফেলল জ্যাকবস। টেনে-হিঁচড়ে মহিলাকে বের করে আনতে লাগল, রবিন সাহায্য করল তাকে।
সাইরেনের শব্দ কানে এল। কয়েক মুহূর্ত পরেই মোড়ের কাছে দেখা গেল ফায়ার ব্রিগেডের ইমার্জেন্সী ট্রাক। কাছে এসে টায়ারের তীব্র কর্কশ আর্তনাদ তুলে থেমে গেল গাড়ি। লাফিয়ে নেমে এল একদল কালো রেনকোট পরা লোক। এক পলক দেখেই পুরো অবস্থাটা যাচাই করে নিল তাদের অফিসার। চেঁচিয়ে আদেশ দিল।
আবার চলতে শুরু করল ট্রাক। গিয়ে থামল মোড়ের কাছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই বন্ধ হয়ে গেল পানির ফোয়ারা।
মিসেস ডেনভারকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে কিশোর, রবিন, জ্যাকবস আর টমি। স্তব্ধ হয়ে গেছে মহিলা। প্রচণ্ড শক খেয়েছে।
পানি বন্ধ করলেন কি করে? একজন ফায়ারম্যানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল। জ্যাকবস।
মোড়ের কাছে মাস্টার ভালভ আছে একটা, জানাল ফায়ারম্যান। মিসেস ডেনভারের দিকে তাকাল। কোথায় চলেছিলেন?
জবাব দিল না মিসেস ডেনভার।
ঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার, বলল জ্যাকবস। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। নিউমোনিয়া বাধিয়ে বসলেও অবাক হব না!
দুদিক থেকে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে মিসেস ডেনভারকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে এল। কিশোর আর রবিন। গাড়িতে পড়ে থাকা হ্যাঁণ্ডব্যাগ খুলে ঘরের চাবি নিয়ে এসেছে। জ্যাকবস। সঙ্গে এসেছে একজন ফায়ারম্যান। একজন পুলিশ অফিসারও এসে হাজির হয়েছে পেছন পেছন।
কি হয়েছিল? জানতে চাইল অফিসার।
বসার ঘরে দাঁড়িয়ে কাঁপছে মিসেস ডেনভার। কেউ গুলি করেছিল আমাকে। চাঁপা গলা। ঠোঁট নড়লই না যেন কথা বলার সময়।
ভেজা কাপড় খুলে ফেলুন জলদি, শান্ত কণ্ঠে বলল অফিসার। তারপর, ভাল বোধ করলে, কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন।
মাথা ঝোকাল মিসেস ডেনভার। টলমল করে হেঁটে গিয়ে ঢুকল শোবার ঘরে।
তারও দাঁতে দাতে বাড়ি লাগছে, এতক্ষণে খেয়াল করল যেন কিশোর। আমারও কাপড় বদলানো দরকার!
কিছু দেখেছিলে? জিজ্ঞেস করল পুলিশ অফিসার।
আমি দেখেছি, বলে উঠল রবিন। দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে তারও। গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা শব্দ…
যাও, রবিন আর কিশোরকে বলল অফিসার। আগে কাপড় বদলে এস। তারপর শুনব।
বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। কাঁপতে কাঁপতে এসে ঢুকল অলিভারের বসার ঘরে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন অলিভার আর মুসা। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল দুজনেই।
বুড়িটার কি অবস্থা? জানতে চাইলেন অলিভার।
ভালই, বলল কিশোর। ঠাণ্ডায় কাঁপছে, আর কিছু না।
হু, আবার রাস্তার দিকে ফিরলেন অলিভার।
তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরে নিল রবিন আর কিশোর। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আবার এসে ঢুকল মিসেস ডেনভারের ঘরে। পুলিশ অফিসার নেই, ঘটনাস্থলে চলে গেছে।
বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। দুর্ঘটনাস্থলে চলল।
ফায়ার ব্রিগেডের আরও একটি ট্রাক আর দুটো পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হয়েছে। সাদা পোশাক পরা পুলিশের গোয়েন্দাও এসেছে একজন। তার সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ অফিসার।
দুই গোয়েন্দাকে দেখেই এগিয়ে এল অফিসার।
যা যা দেখেছে, শুনেছে, পুলিশকে জানাল কিশোর আর রবিন।
কেউ মহিলাকে গুলি করে থাকলে, মিস করেছে, বলল সাদা-পোশাক পরা। গোয়েন্দা।
ঠিক গুলির শব্দ না, বলল কিশোর। বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ।
গাড়িটা পরীক্ষা করছিল দুজন পুলিশ এগিয়ে এল ওরা। গুলির ছিদ্র নেই।
পানির পাইপের ওপর থেকে গাড়ি সরানর কাজে লাগল দমকল বাহিনী। সিডানের বাম্পারে শিকল বেঁধে, শিকলের অন্য মাথা আটকাল ট্রাকের পেছনের হুকে। টান দিল। সরে এল সিডান।
অন্য ট্রাকের হেডলাইটের আলো পড়েছে সিডানটা এতক্ষণ যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে। মাটিতে পড়ে থাকা লালচেমত এক টুকরো কাগজ দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের। এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে তুলে নিল ওটা। দেখল। ধোয়ার। কালি মনে হচ্ছে!
কি? ফিরে তাকাল গোয়েন্দা।
ধোয়ার কালি, আবার বলল কিশোর। শব্দটা হবার পর গাড়ির হুডের তলা থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।
দ্রুতপায়ে সিডানের কাছে এগিয়ে গেল গোয়েন্দা বনেট তুলে ফেলল। তার। পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে টর্চের আলো ফেলল পুলিশ অফিসার। কিশোরও এসে দাঁড়াল পাশে।
ইঞ্জিন-ব্লকের ওপর পড়ে আছে কয়েক টুকরো লালচে কাগজ, আর পোড়া আধপোড়া কিছু তুলো। পুড়ে গেছে রেডিয়েটর হোস, ফ্যানের বেল্ট ছেঁড়া।
না, গুলি করেনি, মাথা নাড়াল সাদা-পোশাক পরা গোয়েন্দা। বিস্ফোরণ। বোমা ফাটানো হয়েছে।
ঘটাং করে বনেটটা আবার নামিয়ে রাখল গোয়েন্দা। নিয়ে যাও! ট্রাকের ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলল। পুলিশ গ্যারেজে নিয়ে রাখবে।
জ্যাকবস এসে হাজির হয়েছে আবার। কিশোরের প্রায় ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে আছে টমি গিলবার্ট। বেড়াল-মানব এনড্রুও এসে হাজির হয়েছে, পরনে পাজামা, গায়ে একটা কম্বল জড়ানো।
ওকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল! বলে উঠল এনড্রু।
ঘুরে চাইল গোয়েন্দা। কোন শত্রু ছিল মহিলার?
ছিল মানে? জবাবটা দিল জ্যাকবস। পুরো এক বাড়ি ভর্তি শত্রু। তবে ওদের কেউ বোমা মেরে মারতে চায় ওকে, মনে হয় না? এত শত্রুতা নেই।
আপনি? জিজ্ঞেস করল গোয়েন্দা। আমার নাম ফ্র্যাঙ্কলিন জ্যাকবস, হাই তুলল স্টকব্রোকার। মিস্টার অলিভারের বাড়িতে ভাড়া থাকি।
আপনি কিছু দেখেছেন?
না। বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বেরিয়ে এসে দেখি, গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। পাইপ ছেঁড়া, ফোয়ারার মত পানি ছিটকে বেরোচ্ছে। এই ছেলেগুলোর সাহায্যে মহিলাকে গাড়ির ভেতর থেকে টেনে বের করলাম, আবার হাই তুলল জ্যাকবস। রাতে ভাল ঘুম হয়নি।…াই, ঘুমোইগে।…যদি আপনার। কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে, দুপুরে আসবেন। তার আগে আর ঘুম থেকে উঠছি না আমি। হাই তুলতে তুলতে চলে গেল সে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে জ্যাকবসের গমন পথের দিকে তাকাল পুলিশ অফিসার। তারপর তাকাল অলিভারের বাড়িটার দিকে। বিড়বিড় করল, আশ্চর্য? গত দুদিনে। জায়গাটাতে কয়েকটা অঘটন ঘটল পর পর! মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!
পুবের আকাশে ধূসর আলো। সূর্য ওঠার দেরি নেই।
চল, আমরাও যাই, রবিনের দিকে চেয়ে বলল কিশোর। ঘুম পেয়েছে।
চল, বড় করে হাই তুলল রবিন।
.
১৩.
রাতে ঘুম হয়নি, তাছাড়া প্রচণ্ড উত্তেজনা গেছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে চাইছে অলিভারের। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। তিন গোয়েন্দাও ঘুমোতে গেল।
অনেক বেলায় উঠলেন অলিভার। নাশতা তৈরি করে ডাকলেন ছেলেদের।
নাশতা শেষ হল। বসার ঘরে চলে এল সবাই। টেলিভিশন অন করে দিল। কিশোর। খালি চত্বর। পুরো বাড়িটা নীরব।
ব্যাংকে যেতে হবে আমাকে, বললেন অলিভার। দশ হাজার ডলার তুলব। ছোট ছোট নোটে। তোমরা কেউ যাবে আমার সঙ্গে? এস না? খুশি হব।
নিশ্চয় যাব, বলল কিশোর। তবে, কি করতে যাচ্ছেন, পুলিশকে জানিয়ে রাখলে ভাল হত না?
না। ঝুঁকি কিছুতেই নেব না আমি। বিপদ দেখলে হাউণ্ডটা ধ্বংসই করে ফেলতে পারে চোর। ওর নির্দেশ মানতেই হচ্ছে আমাকে।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর, গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ট্যাক্সি। বড় একটা সুটকেস এনে গাড়িতে তুলল ড্রাইভার। পেছনেই এল মিসেস ডেনভার।
আপনার ম্যানেজার চলে যাচ্ছে, চোখ না ফিরিয়েই বলল কিশোর।
সান্তা মনিকায় বুড়িটার এক বোন থাকে, বলল অলিভার। অসুস্থ হলে, কিংবা কোনরকম বিপদে পড়লে, ওখানেই গিয়ে ওঠে।
চলতে শুরু করল ট্যাক্সি। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মোড়ের দিকে।
ভাল বিপদে পড়েছে এবার, টিপ্পনী কাটল মুসা। খালি ছোঁক ছোঁক করে লোকের পেছনে। এইবার দিয়েছে টাইট…
কাঁচ ভাঙার প্রচণ্ড শব্দে থেমে গেল মুসা।
আগুন! আগুন! চেঁচিয়ে উঠল কেউ। আগুন লেগেছে!
চোখের পলকে দরজার কাছে ছুটে গেল চারজনে। দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ব্যালকনিতে।
চতুরের একপাশে ধোঁয়া। জ্যাকবসের ঘরের জানালা দিয়ে বেরোচ্ছে। একটা লোহার চেয়ার তুলে নিয়ে দমাদম পিটিয়ে শার্সির কাঁচ ভাঙছে টমি। পরনে ঘুমানর পোশাক। খালি পা। ঘাড়ের কাছের চুল খাড়া হয়ে গেছে।
মাই গড! চেঁচিয়ে উঠলেন অলিভার। ছুটে আবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করবেন।
রবিন আর কিশোর নড়ার আগেই সিঁড়ির মাঝামাঝি নেমে গেছে মুসা। লাফিয়ে এসে নামল চত্বরে। পুলের ধার থেকে আরেকটা চেয়ার তুলে নিয়ে ছুটল।
ঝট করে, বেড়াল-মানবের ঘরের দরজা খুলে গেল। প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল। এনড্রু।
মিস্টার জ্যাকবস! ভাঙা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
জবাব নেই।
তাড়াতাড়ি চৌকাঠে পড়ে থাকা কাঠের টুকরো সরিয়ে ফেলতে লাগল মুসা। পর্দায় আগুন ধরে গেছে। অনেকখানি পুড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। থাবা দিয়ে নেবানর চেষ্টা করল পর্দার আগুন।
এই যে! চিৎকার শোনা গেল কিশোরের। পাশে কুলুঙ্গিতে হুকে ঝোলানো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রটা দেখতে পেয়েছে। ছুটে গিয়ে ওটা খুলে নিয়ে এল সে।
তীক্ষ হিসহিস শব্দ উঠল। যন্ত্রের মুখ থেকে সাদা ফেনামত জিনিস ছুটে গিয়ে পড়তে থাকল জ্বলন্ত পর্দায়। ছ্যাক করে উঠল আগুনের শিখা, নিবে গেল। চেয়ার দিয়ে বাড়ি মেরে জানালার পাল্লার ছিটকিনি ভেঙে ফেলল মুসা, ঝটকা দিয়ে দুপাশে সরে গেল পাল্লাদুটো। চৌকাঠে উঠে বসল টমি, তার পাশেই কিশোর। জানালার ঠিক নিচেই রয়েছে সোফা, জ্বলছে। পাশেই ক্রিসমাস গাছ, ওটাতেও আগুন ধরে গেছে প্রায়। নির্বাপক যন্ত্রের মুখ ঘোরাল কিশোর, একনাগাড়ে ফেনা নিক্ষেপ করে গেল আগুনের ওপর।
মুসা আর রবিনও উঠে বসেছে চৌকাঠে। ধোয়ার জন্য শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকমত, চোখ জ্বালা করছে। চেঁচিয়ে ডাকা হল জ্যাকবসের নাম ধরে, কিন্তু কোন। সাড়া এল না।
লাফিয়ে ঘরের মেঝেতে নেমে পড়ল কিশোর আর মুসা। ঝুঁকে চোখ বাঁচানর চেষ্টা করতে করতে এগোল ধোয়ার ভিতর দিয়ে।
বসার ঘর আর শোবার ঘরের দরজার মাঝামাঝি পাওয়া গেল জ্যাকসকে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
জলদি বের করে নিয়ে যেতে হবে ওকে! ধোয়া ঢুকে যাচ্ছে নাক-মুখ দিয়ে, কেশে উঠল মুসা। নিচু হয়ে বাহু ধরে টেনে চিত করল জ্যাকসকে। জোরে চড় লাগাল দুই গালে।
নড়লও না জ্যাকবস।
এখানে হবে না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। বের করে নিয়ে যেতে হবে!
দুদিক থেকে দুহাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে জ্যাকবসকে নিয়ে চলল দুজনে। ততক্ষণে নেমে পড়েছে রবিন আর টমি। একজন ছুটে গেল দরজা খুলতে, আরেকজন সাহায্য করতে এল মুসা আর কিশোরকে।
জ্যাকবসের পায়ের দিকে তুলে ধরল রবিন। তিনজনে মিলে বয়ে নিয়ে চলল দরজার দিকে।
কাশছে টমি। খুলে ফেলল দরজা।
দম বন্ধ হয়ে আসছে তিন গোয়েন্দার। ভারি দেহটাকে বয়ে নিয়ে কোনমতে এসে পৌঁছুল দরজায়। হাত লাগাল টমি। জ্যাকবসকে নিয়ে আসা হল পুলের ধারে। চিত করে শুইয়ে দেয়া হল। জ্যাকবসের মুখে এসে পড়ছে রোদ। ফেকাসে চেহারা, রক্ত নেই যেন মুখে।
ঈশ্বর! বিড়বিড় করলেন অলিভার।
স্থির দৃষ্টিতে জ্যাকবসের মুখের দিকে চেয়ে আছে এনড্রু। ও কি..ও কি…।
উবু হয়ে বসে লোকটার বুকে কান পেতেছে মুসা। সোজা হয়ে বলল, না, বেঁচেই আছে।
পৌঁছে গেল দমকল বাহিনী। অক্সিজেন আর অ্যামবুলেন্স নিয়ে এসেছে। এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে জ্যাকবসের ঘর থেকে। সেদিকে ছুটে গেল কয়েকজন ফায়ারম্যান।
ছুটে এসে চত্বরে ঢুকল দমকল বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন। সোজা ছুটে গেল জ্যাকবসের ঘরের দিকে।
অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে দুজন ফায়ারম্যান এসে বসল জ্যাকবসের দুপাশে। নাকে মুখে চেপে ধরল মাস্ক। ধীরে ধীরে চোখ মেলল স্টকব্রোকার। মিটমিট করল। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে গলার ভেতর থেকে। দুর্বল একটা হাত বাড়িয়ে ঠেলে মাস্কটা নাকের ওপর থেকে সরিয়ে দিল সে।
ভয় নেই, মিস্টার, বলল একজন ফায়ারম্যান। খানিকটা ধোয়া ঢুকে গিয়েছিল ফুসফুসে, আর কিছু না।
উঠে বসার চেষ্টা করল জ্যাকবস।
না না, উঠবেন না, বাধা দিল আরেক ফায়ারম্যান। ইমার্জেন্সীতে নিয়ে যাব আপনাকে।
প্রতিবাদ করবে মনে হল, কিন্তু শেষে কি মনে করে করল না জ্যাকবস। শুয়ে পড়ল আবার পাথরের চত্বরে।
জর্জ, স্ট্রেচারটা নিয়ে এস, সঙ্গীকে বলল এক ফায়ারম্যান।
স্ট্রেচার এল। তাতে তুলে নেয়া হল জ্যাকসকে। শান্ত রইল সে। কোনরকম বাধা দিল না। ধূসর একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হল তার দেহ। স্ট্রেচার তুলে। নিল দুজন ফায়ারম্যান।
ওর সঙ্গে কারও যাওয়া দরকার, বলল এনড্রু।
আমার ভাগ্নে, দুর্বল গলায় বলল জ্যাকবস। আমার ভাগ্নেকে একটা খবর দেবেন। ও শুনলেই চলে আসবে।
অ্যামবুলেন্সে তোলা হল জ্যাকসকে। সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল গাড়ি।
জ্যাকবসের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। সেই পুরানো কাহিনী। আধপোেড়া একটা সিগারেটের টুকরো ধরে আছে দুআঙুলে, দেখাল। সিগারেট জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোনভাবে সোফায় পড়েছে টুকরোটা, আগুন ধরে গেছে পর্দায়…
কপাল ভাল ওর, বলে উঠল টমি। এখনও খালি পায়েই রয়েছে। চেহারা ফেকাসে। সময়মত দেখতে পেয়েছিলাম…
হ্যাঁ, সত্যিই ভাল, মাথা ঝোঁকাল ক্যাপ্টেন। আরেকটু হলেই আগুন ধরে যেত ক্রিসমাস গাছটায়। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ত আগুন।
সিগারেট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন কিশোর।
অনেকেই এ-কাণ্ড করে, খোকা, বলল ক্যাপ্টেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু একটা গামলার সমান অ্যাশট্রে আছে ওর, ক্যাপ্টেনের কথা মানতে পারছে না গোয়েন্দাপ্রধান। ওতে সিগারেট কেন, জ্বলন্ত কয়লার টুকরো রেখে দিলেও ভয় নেই। সিগারেটটা অ্যাশট্রের বাইরে পড়ল কি করে?
ঘুমের ঘোরে হয়ত অ্যাশট্রের ভেতরে রাখতে চেয়েছিল। ভেতরে না রেখে, বাইরেই ফেলেছে। ব্যস, ধরে গেছে আগুন। এটা স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল রবিন। খুব নাকি ঘুম পেয়েছিল তার। সারারাত ঘুমাতে পারেননি। দুপুর পর্যন্ত টানা ঘুম দেবেন, বলেছেন সকালে। হয়ত এসে সোফাতেই শুয়ে পড়েছিলেন, সিগারেট ধরিয়েছিলেন। তারপর আর চোখ খুলে রাখতে পারেননি।
কিন্তু ওকে মাঝের দরজায় পেয়েছি, বেডরুমের দিকে মুখ। সোফায় ঘুমোলে, ঘুম থেকে উঠে বারান্দার দরজার দিকে না গিয়ে বেডরুমের দরজায় গেল কেন? বেরোনর চেষ্টা না করে ঘরের আরও ভেতরে গেল কেন? ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল। কিশোর। আপনার কি মনে হয়?
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘর ভর্তি ধোয়া, দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল বেচারা! জবাব দিল ক্যাপ্টেন। রওনা দিয়েছিল বেডরুমের দরজার দিকে। এগোতে পারেনি বেশি দূর। ধোয়া কাহিল করে ফেলেছিল।
পোড়া সোফার অবশিষ্ট বয়ে এনে ধুপ করে বাইরে ফেলল দুজন ফায়ারম্যান।
যা নোংরা হয়েছে, পরিষ্কার করতে গেলে বোঝা যাবে, বলে উঠল বেড়াল মানব।
মিসেস ডেনভার এ-অবস্থা দেখলে, তাকেও আবার হাসপাতালে পাঠানর দরকার হবে, হাসল টমি। গেল কোথায় মহিলা? এত হৈ চৈয়েও দেখা নেই!
খানিক আগে ট্যাক্সিতে করে চলে গেছে, বললেন অলিভার। যাবে আর কোথায়? বোনের ওখানে গেছে হয়ত।
ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল কিশোর। মিস্টার জ্যাকবসকে কোথায় নেবে?
সেন্ট্রাল হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা করলেই চলবে বুঝলে, তাই করে ছেড়ে দেবে ডাক্তাররা। অবস্থা খারাপ দেখলে ভর্তি করে নেবে।
সেন্ট্রাল হাসপাতাল! চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে। মিস ল্যাটনিনাকেও ওখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মিস্টার জ্যাকবস-জ্যাকবসও ওখানে…
ওখানেই তো নেবে, প্রথমে বাধা দিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। ওটা ইমার্জেন্সী হাসপাতাল, সরকারী। রোগী পয়সা খরচ করতে রাজি থাকলে দেবে কোন প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে।
আমি সে কথা বলছি না, মাথা নাড়ল কিশোর। সিগারেটের ব্যাপারে, আগুনের ব্যাপারে এত সতর্ক লোকটা! সিগারেট খাবার সময় অ্যাশট্রে সঙ্গে রাখে! অথচ অসাবধানে সে-ই আগুন ধরিয়ে দিল ঘরে! নাহ, বোঝা যাচ্ছে না!
.
১৪.
জিনের আসর হয়েছে বাড়িটাতে! দমকল বাহিনী চলে যেতেই ঘোষণা করল এনড্রু। প্রথমে লারিসা, তারপর মিসেস ডেনভার, এখন আবার জ্যাকবস!
সব কিছুর মূলে ওই চুরি, বললেন অলিভার। আড়চোখে টমির দিকে তাকালেন। লাউঞ্জে একটা চেয়ার বের করে তাতে আধশোয়া হয়ে আছে। চোখ আধবোজা, বোধহয় রোদের দিকে সরাসরি চেয়ে আছে বলেই। তিন রাত আগেও এসব কিছুই ঘটেনি। চোরটা গেল চত্বর দিয়ে, শুরু হয়ে গেল যত গণ্ডগোল।
মাখা ঝোঁকাল কিশোর। এর একটাই মানে। ছায়াশ্বাপদটা রয়েছে
ছায়া—কি বললে? ভুরু কোঁচকালেন অলিভার।
ছায়াশ্বাপদ, হাউটার নাম রেখেছি আমি। বাংলা শব্দ। ইংরেজিতে ইনভিজিবল ডগ বলতে পারেন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। এ-বাড়ির সীমানার মধ্যেই কোথাও রয়েছে ছায়াশ্বাপদ। আর চোরও নিশ্চয় এ-বাড়িরই কেউ।
কি বলছ, খোকা? চোখ কপালে উঠেছে বেড়াল-মানবের। এ-বাড়িতে কুকুর। নেই, খালি বেড়াল।
জ্যান্ত কুকুর না ওটা, বললেন অলিভার। ক্রিস্টালে তৈরি একটা মূর্তি। আটিস্ট জ্যাক ইলিয়ট বানিয়েছিল। সোমবার রাতে ওটার জন্যই এসেছিল চোর, জ্যাকের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে।
খুকখুক করে হেসে উঠল এনড্রু। তাই বলুন! মিসেস ডেনভার কবেই এসে বলেছে আমাকে, আপনি একটা কুকুর আনবেন। আমার বেড়াল যেন সাবধানে। রাখি। হাহ হাহ! এখন শুনছি একটা কাঁচের কুকুর! হাহ!
কাঁধ ঝাঁকালেন অলিভার। ওই বুড়িটার জন্যে আর গোপন রইল না কিছু! কুকুরটার কথা লিখেছি ডায়েরীতে। আমার কাগজপত্র ঘেঁটেছে। নিশ্চয় ওটা পড়েছে বুড়ি। আপনাকে যখন বলেছে, আরও অনেককেই হয়ত বলেছে। জানাজানি হয়ে গেছে। চোরের কানেও গেছে কথাটা।
হু! আমাকে সন্দেহ-টন্দেহ করছেন না তো? হাসি উধাও হয়ে গেছে বেড়াল মানবের মুখ থেকে। যা-ই হোক, আর আমি এখানে থাকছি না। যা শুরু হয়েছে, প্রাণের নিরাপত্তাই নেই। কখন দেবে বিষ খাইয়ে, কিংবা বোমা মেরে গাড়ি উড়িয়ে, কে জানে! তার চেয়ে কোন মোটেলে চলে যাব।
নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল এনড্রু। বেরিয়ে এল শিগগিরই। এক হাতে সুটকেস, আরেক হাতে পোষা কালো বেড়ালটা। বিকেল পাঁচটায় একবার আসতেই হচ্ছে। বেড়ালগুলো আসবে, আমি না থাকলে না খেয়ে ফিরে যাবে। ওদেরকে মোটেলটা চিনিয়ে দেব নিয়ে গিয়ে। যদি কোন কারণে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার পড়ে, উইলশায়ার ইন-এ খোঁজ করবেন। ফ্ল্যাটটা ছাড়ছি না। এখানকার পরিস্থিতি শান্ত হলেই ফিরে আসব আবার।
চলতে গিয়েও কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল বেড়াল-মানব। অলিভারের দিকে তাকাল। আমি নেই, চট করে আবার আমার ঘরে ঢুকে পড়বেন না। তল্লাশি চালাতে চাইলে, পুলিশ এবং সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আসবেন।
গটগট করে হেঁটে চলে গেল এনড্রু। খানিক পরেই গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হল।
চাইলে আমার ঘরে খুঁজে দেখতে পারেন, মিস্টার অলিভার, বলল টমি। গিলবার্ট। দুপুরে বাইরে যাব, কাজ আছে। তখন ঢুকতে পারেন ইচ্ছে করলে। সার্চ ওয়ারেন্ট লাগবে না।
দুপুরে? ভুরু কোঁচকাল রবিন। আপনার ডিউটি রাতে না?
আজ দিনের শিফটে কাজ করব, বলল টমি। আমার এক কলিগ অসুস্থ। তার কাজটা চালিয়ে নিতে হবে।
আমি জানি, আপনার ঘরে নেই ছায়াশ্বাপদ, শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর। এ-বাড়ির কোন ঘরেই নেই।
একটু যেন হতাশ মনে হল টমিকে। কাঁধ ঝাঁকাল। ঘুরে গিয়ে ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে।
এত নিশ্চিত হচ্ছ কি করে? জানতে চাইলেন অলিভার।
সহজ, বলল কিশোর। তাহলে মিসেস ডেনভারের শকুনি-চোখে এড়াতো না জিনিসটা। কার ঘরে কোথায় কোন সুতোটা আছে, আমার মনে হয় তা-ও তার জানা। নকল চাবি বানিয়ে মালিকের ঘরে ঢোকার যার সাহস আছে, ভাড়াটেদের ঘরে সুযোগ পেলেই ঢুকবে সে, এতে কোন সন্দেহ নেই। সবারই বাক্স-পেটরা ড্রয়ার ঘাটে সে, আমি শিওর।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
তবে, এর মানে এই নয়, কাছাকাছি নেই মূর্তিটা। নইলে, এখান থেকে লোকজন সরাতে চাইছে কেন চোর? গতকাল মিস ল্যাটনিনাকে বিষ খাওয়াল। আজ বোমা ফাটাল মিসেস ডেনভারের গাড়িতে। মিস্টার জ্যাকবসের ঘরে আগুন লাগিয়ে তাকে খেদাল। ভয়েই পালাল বেড়াল-মানব-মিস্টার অলিভার, জ্যাকবসের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি। ও হয়ত কিছু জানাতে পারবে। কি করে আগুন। লাগল, হয়ত কিছুটা আলোকপাত করতে পারবে।
ভ্রূকুটি করল রবিন। তোমার ধারণা, ওই আগুন লাগা নিছক দুর্ঘটনা নয়?
সম্ভবত।
তাহলে? কে লাগিয়েছে আগুন? টমি? সবার আগে ও-ই হাজির হয়েছে। ওকে। আসতে দেখেনি কেউ। হয়ত, দেয়াল গলে জ্যাকবসের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। আগুন। লাগিয়ে আবার দেয়াল গলেই বেরিয়ে এসেছে। তারপর যেন বাঁচাচ্ছে জ্যাকবসকে, এরকম অভিনয় করে গেছে।
দূর! প্রতিবাদ করল মুসা। অতিকল্পনা!
ব্যাপারটা প্রমাণ করে ছাড়ব আমি, দৃঢ় কণ্ঠে বলল রবিন। ডক্টর রোজারের সঙ্গে কথা বলব। ডক্টর লিসা রোজারকে চেনে কিশোর আর মুসাও। রবিনের দূর সম্পর্কের খালা। রুক্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজির প্রফেসর, হেড অভ দ্য ডিপার্টমেন্ট। প্রেততত্ত্ব আর ডাকিনী বিদ্যার ওপর প্রচুর পড়াশোনা আছে, ওসবের ওপর গবেষণা করছেন এখন। আগুন লাগাক বা না লাগাক, দেয়াল গলে যে টমিই আসে-যায়, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিভাবে কাজটা করে সে, জানতে হবে।
ওসব ভূত-প্রেতের মধ্যে আমি নেই, বলল মুসা। বাস্তব কাজ করব। টমিকে অনুসরণ করব আজ দুপুরে। কোথায় যায়, দেখব। সত্যিই বাজারে কাজে যায়। কিনা, দেখতে হবে। আর, এনড্রুর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেব। দেখে আসব, সত্যি উইলশায়ার ইন-এ গিয়েছে কিনা।
আমি যাব হাসপাতালে, ঘোষণা করল কিশোর। কয়েকটা হাসপাতাল ঘুরে আসতে হবে হয়ত কিছু তথ্য দরকার। আশা করছি, ল্যাটনিনা আর জ্যাকবসের কাছ থেকে জানা যাবে কিছু।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল যেন অলিভারের, আরে! আমার ব্যাংকে যাওয়া! তোমাদের একজন যাবে বলেছিলে। এত টাকা একা আনার সাহস আমার নেই, এখন!
যাব, তবে আগে কাজগুলো সেরে আসি, বলল কিশোর।
ততক্ষণ একা থাক! একটা লোক নেই এতবড় বাড়িটায়! আমি পারব না! আঁতকে উঠেছেন অলিভার।
আপনার কোন বন্ধু নেই?
ওই মিকো ইলিয়ট, সে-ই কাছাকাছি থাকে।
তাকেই ডাকুন। বসে বসে গল্প করুন দুজনে। আমরা বেশি দেরি করব না।
আবার বসার ঘরে ঢুকল চারজনে। ফোন করতে গেলেন অলিভার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে, কথা দিল মিকো।
দ্রুত তৈরি হয়ে নিল রবিন। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। রুক্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলল।
মিনিট বিশেক পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছুল রবিন। প্রফেসর লিসা রোজারকে তার অফিসেই পাওয়া গেল। সুন্দর চেহারা। বয়েস চল্লিশ মত হবে।
টাকমাথা, গোলগাল চেহারার এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে কথা বলছেন লিসা রোজার, রবিনের সাড়া পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন। আরে, রবিন! তুই হঠাৎ!…আয়, আয়!
ডেস্কের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল রবিন। কেমন আছ, খালা?
ভাল। তোরা সব কেমন? তোর মা কেমন আছে?
ভাল। তারপর? কি মনে করে? খালাকে দেখতে আসার সময় হল তোর?
খালা, একটা কাজ। মানে, ইয়ে… দ্বিধা করছে রবিন। টাকমাথা ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। একটা কথা…
ইনি প্রফেসর ডোনাল্ড রস, পরিচয় করিয়ে দিলেন মহিলা। অ্যাপলজির প্রফেসর। ডোনাল্ড, ও শেলি, মানে আমার বোনের ছেলে। ওর কথা বলেছি তোমাকে। গোয়েন্দাগিরির শখ।
তাই নাকি? খুব ভাল শখ, হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রফেসর রস।
প্রফেসরের সঙ্গে হাত মেলাল রবিন।
হ্যাঁ, কি বলছিলি, বল, বললেন ডক্টর রোজার।
খালা, একটা উদ্ভট ঘটনা, দ্বিধা যাচ্ছে না রবিনের। মানে ভূতুড়ে…
এত দ্বিধা করছিস কেন? ভূতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার নিয়েই আমার কারবার, জানিসই তো, ডেস্কে পেপারওয়েট চাপা দেয়া একটা চিঠি দেখালেন মহিলা। এই যে চিঠিটা, ডুবুক থেকে এক লোক পাঠিয়েছে। তার বোনের ভূত নাকি তাড়া করে। তাকে আজকাল। মজার ব্যাপার হল, তার কোন বোনই নেই, ছিলও না কখনও।
যতসব বদ্ধ পাগল নিয়ে তোমার কারবার, লিসা, চেয়ারে হেলান দিলেন রস। ইয়াংম্যান, ভূতের কথা কি যেন বলছিলে?
অলিভারের বাড়িতে ভূতুড়ে যা যা ঘটেছে, সব খুলে বলল রবিন। গির্জায় পাদ্রীর প্রেতাত্মা দেখেছে কিশোর, সে কথাও বাদ দিল না।
হুমম! গম্ভীর হয়ে মাথা ঝোঁকালেন লিসা রোজার। আমি গিয়েছিলাম ওই গির্জায়।
তুমি শুনেছ প্রেতাত্মার কথা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
শুনেছি, বললেন লিসা রোজার। যেখানেই এই ধরনের গুজব শুনি, যাই। সরেজমিনে তদন্ত করি। তোর বন্ধু কিশোর যাকে দেখেছে, তার সঙ্গে বছর তিনেক আগে মারা যাওয়া পাদ্রীর নাকি মিল আছে। লম্বা সাদা চুল, বৃদ্ধ-। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, শুধু হাউসকীপার তামারা ব্রাইসই দেখেছে ভূতটাকে। তামারার ব্যাপারে খোঁজখবর করেছি। আয়ারল্যাণ্ডের এক ছোট্ট শহর ডুঙ্গালওয়ে থেকে এসেছে সে। ওখানকার গির্জায় ভূত আছে, অনেকেই বলে। ভূতের ব্যাপারে রীতিমত বিখ্যাত জায়গাটা। বহুদিন আগে নাকি কোথায় যাবার জন্যে জাহাজে চেপেছিল এক পাদ্রী। সাগরে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যান তিনি। লোকে বলে, তারই প্রেতাত্মা এসে ঠাই নিয়েছে ডুঙ্গালওয়ে গির্জায়। গিয়েছিলাম। কয়েক রাত কাটিয়েছি ওখানে। কোন ভূত-টুত আমার নজরে পড়েনি। ওখান থেকে এসেছে তো, গির্জায় পাদ্রীর ভূত থাকবেই, বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে হয়ত তামারা ব্রাইসের। যাই হোক, অলিভারের। ঘরে ঢোকে যে ছায়াটা, ওটা পাদ্রীর প্রেতাত্মা নয়।
আমারও তাই ধারণা। ও নিশ্চয় টমি গিলবার্ট।
সামনে ঝুঁকলেন লিসা রোজার। বলছিস, দুবার ছায়াটা দেখেছে কিশোর। এবং দুবারই টমি তার ঘরে সেই সময় ঘুমিয়েছিল?
হ্যাঁ, ছিল।
মৃদু হাসলেন ডক্টর রোজার। চমৎকার! নীরবে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে ছেলেটা!
মিস্টার অলিভারের কাছে ব্যাপারটা মোটেই চমৎকার নয়, গম্ভীর হয়ে গেছে। রবিন। কিভাবে করে টমি?
উঠে গিয়ে ফাইল ক্যাবিনেট খুললেন লিসা রোজার। ফিতে বাধা কয়েকটা ফাইল বের করে এনে রাখলেন ডেস্কে। আমার মনে হয়, ঘুমের ঘোরে ছায়া শরীরে বেরিয়ে আসে সে। ঘুরে বেড়ায়।
হাঁ হয়ে গেল রবিন।
আবার চেয়ারে বসলেন প্রফেসর রোজার। একটা ফাইল খুললেন। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চালিয়েছি আমরা এ-ব্যাপারে, তবে খুব কমই সে-সুযোগ পাওয়া যায়। এসব যারা করে, লোককে জানিয়ে করে না। ল্যাবরেটরিতে আসা তো দূরের কথা। অনেক খোঁজখবর নিয়ে, এমন এক-আধজনকে বের করে, অনেক বলে কয়ে নিয়ে আসতে হয়। কারও কারও ধারণা, অন্য কাউকে জানালে তার এ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। গত বছর এসেছিল এক মহিলা, সাধারণ এক গৃহবধূ। মনট্রোজে থাকে। ওর নাম বলতে চাই না।
মাথা ঝোকাল রবিন।
মহিলার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, বললেন আবার লিসা রোজার। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে এবং সেটা সত্যি।
তারমানে, আগ্রহে সামনে ঝুঁকল প্রফেসর রস। তুমি বলতে চাইছ, মহিলা যা দেখে, সেটা পরে সত্যি হয়?
ঠিক তা নয়। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি, ফাইলের কাগজে চোখ বোলালেন লিসা রোজার। ঘুমের ঘোরেই আকনে তার মায়ের জন্মদিনের উৎসবে হাজির হয়েছিল ওই মহিলা। সে সবাইকে দেখেছিল, তাকে কেউ দেখেনি। পরিষ্কার বলেছে সে, কি কি দেখেছে। তার দুই বোন সেদিন সেই উৎসবে হাজির ছিল। মাঝারি সাইজের একটা কেক, সাদা মাখনের একটা প্রলেপ, তার ওপর লাল চিনি। দিয়ে লেখা ছিল মহিলার মায়ের নাম। কটা মোম কোন কোন রঙের ছিল, ঠিক ঠিক বলে দিয়েছে সে। রাতে স্বপ্ন দেখেছে। সকালে উঠে তার স্বামীকে বলল ব্যাপারটা। হেসে উড়িয়ে দিল স্বামী। দিন কয়েক পরেই একটা চিঠি আর কয়েকটা ছবি এল। মহিলার মায়ের কাছ থেকে। জন্মদিনের উৎসবে তোলা, রঙিন-ফটোগ্রাফ। যা যা স্বপ্নে দেখেছিল মহিলা, ঠিক মিলে গেল ছবির সঙ্গে। অস্বস্তিতে পড়ে গেল স্বামী বেচারা। এরপর আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটল ওরকম। কোথাও গিয়েছে, হয়ত স্বপ্নে দেখে মহিলা। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তার বর্ণনার সঙ্গে ঠিক মিলে যায় সব, অথচ ওই জায়গায় সশরীরে কখনও যায়নি মহিলা। রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়ল। স্বামী। খোঁজখবর নিয়ে শেষে একদিন আমার কাছে নিয়ে এল স্ত্রীকে।
ল্যাবরেটরিতে মহিলার ওপর পরীক্ষা চালিয়েছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ। কয়েকদিন ল্যাবরেটরির একটা ঘরে রেখে দিয়েছিলাম মহিলাকে। একটা মাত্র দরজা ঘরটার। রাতে বন্ধ করে দিতাম। চোখ রাখতাম বিশেষভাবে তৈরি। একটা ফোকর দিয়ে। ওখান দিয়ে পুরো ঘরটাই ভালমত দেখা যায়। প্রথম রাতে। মহিলা ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে তার ঘরে ঢুকলাম। দেয়াল-তাক আছে ওঘরে কয়েকটা। সবচেয়ে ওপরের তাকে রাখলাম মুখবন্ধ একটা খাম! ভেতরে এক টুকরো কাগজে দশ অঙ্কের একটা সংখ্যা লিখেছি। সংখ্যাটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। খামটা রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম। চোখ রাখলাম ফোকরে। যতক্ষণ ঘুমিয়েছিল মহিলা, নড়িনি ওখান থেকে। একবারও ঘুম ভাঙেনি তার। সারারাতে। সকালে উঠে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘরে কি কি আছে। প্রথমেই খামটার কথা বলল মহিলা। রঙ, আকার সব ঠিক ঠিক। তবে ভেতরে কি আছে, বলতে পারল না। পরের রাতে মহিলা ঘুমিয়ে পড়লে তার অজান্তে আবার রেখে এলাম খামটা, আরেকটা তাকে। খামের ভেতরের কাগজটা সেদিন বের করে নিয়েছি, ওটা রাখলাম খামের ওপরে, নাম্বার লেখা পিঠটা ওপরের দিকে। ভোরে উঠে জিজ্ঞেস করতেই কাগজটার কথা বলল মহিলা। ঠিক বলে দিল নাম্বারটা।
সেদিনও সারারাত চোখ রেখেছিলে ওর ওপর? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। রবিন। রাতে একবারও ঘুম ভাঙেনি মহিলার? কোন ফাঁকে উঠে দেখে নেয়নি তো নাম্বারটা?
আমি নিজে চোখ রেখেছি ফোকরে, বললেন প্রফেসর। মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাইনি। একবারও ঘুম ভাঙেনি মহিলার, বিছানা ছেড়ে ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে, নিশ্চয় তার শরীরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল ছায়া শরীর। ঘুরে বেড়িয়েছিল সারা ঘরে।
কি যেন ভাবছে রবিন। বলল, কিন্তু এতে কিছুই প্রমাণ হয় না!
নিশ্চয় প্রমাণ হয়, ছায়া শরীরে মিস্টার অলিভারের ঘরে ঢুকেছিল টমি, জবাবটা দিলেন ডক্টর রস। মান্দালার কথা জেনেছে সে ওভাবেই।
কিন্তু তার ছায়া দেখা গেছে, প্রতিবাদ করল রবিন। মহিলার দেখা যায়নি।
বেশ, বললেন লিসা রোজার। আরেকটা ঘটনার কথা বলছি। অরেঞ্জে বাস করে এক লোক, আমার এক রোগী। সারাজীবন স্বপ্নে যা যা দেখেছে, সব সত্যি ঘটেছে। মনট্রোজের ওই গৃহবধূর মত। তবে, মহিলার সঙ্গে একটা পার্থক্য আছে, তার ছায়া শরীর দেখা গেছে, আবার ফাইল দেখলেন প্রফেসর। হলিউডে লোকটার এক বন্ধু আছে। আসল নাম বলব না, ধরে নিই, তার নাম জোনস। একরাতে, জোনস তার ঘরে বসে বই পড়ছে। হঠাৎ জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তার কুকুরটা। জোনস ভাবল, নিশ্চয় আঙিনায় চোর ঢুকেছে। দেখতে চলল সে। হলঘরেই দেখা হয়ে গেল অরেঞ্জে বাস করে যে, সে বন্ধুর সঙ্গে। এতরাতে বন্ধুকে দেখে অবাক হল জোনস। কেন এসেছে, জানতে চাইল। কোন কথা বলল না বন্ধু। নিঃশব্দে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। বোকা হয়ে গেল যেন জোনস। শেষে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে সে-ও উঠে এল। কোথাও নেই তার বন্ধু। একেবারে হাওয়া। তখুনি অরেঞ্জে ফোন করল জোনস। বাড়িতেই পাওয়া গেল বন্ধুকে। কয়েকবার রিঙ হবার পর ফোন ধরেছে। ঘুমজড়িত গলা, স্পষ্ট। কেন ফোন করেছে, জানতে চাইল বন্ধু। জানাল জোনস। বন্ধু, আশ্চর্য হল। সে-ও নাকি স্বপ্ন দেখছিল জেনসকে দেখেছে, শোবার ঘরে বসে বই পড়ছে। কুকুর ডেকে উঠল। জোনস এসে ঢুকল হলঘরে। বন্ধু এত রাতে কেন এসেছে জিজ্ঞেস করল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল সে। আর কিছু মনে নেই তার। এর পর পরই টেলিফোন ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করে বলল রবিন।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকালেন লিসা রোজার। আশ্চর্যই, এবং ভয় পাওয়ার মত। স্বপ্নে যে ঘুরে বেড়ায়, ঘুম থেকে উঠে সে-ও ভয় পায়, তাকে যারা ঘুরতে দেখে, তারাও।
টমির ছায়া দেখে ভয় পান মিস্টার অলিভার, সন্দেহ নেই, বলল রবিন। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে টমি ভয় পায় বলে তো মনে হয় না!
তার কেসটা একটু আলাদা। যা শুনলাম, এই ঘুরে বেড়ানো রীতিমত চর্চাই করে সে।
তার মানে, ঘাবড়ে গেছে রবিন। তাকে ঠেকানর কোন উপায়ই নেই মিস্টার অলিভারের?
না। তবে অলিভারের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এসব ঘুরে বেড়ানো লোকেরা ক্ষতিকর নয়। ছায়া শরীর নিয়ে কারও কোন ক্ষতি করতে পারে না এরা। শুধু দেখা বা শোনার ক্ষমতা থাকে তখন।
তুমি বলছ, কোন জিনিস ছুঁতে পারে না ওরা?
হয়ত ছুতে পারে, বললেন লিসা রোজার। তবে নড়াতে পারে না। মনট্রোজের মহিলার কথাই ধরা যাক, সাধারণ একটা খাম খুলতে পারেনি সে।
সুতরাং, ছায়া শরীরে ঘুরে বেড়ানর সময় কোন কিছু ধরতে, বা চুরি করতে পারবে না টমি গিলবার্ট?–
আমার তো মনে হয়, না।
টমি গিলবার্ট ভারতে যেতে চাইছে, খবরটা জানাল রবিন। ওখানে গিয়ে ধ্যানতত্ত্ব নিয়ে প্রচুর গবেষণা আর চর্চা করার ইচ্ছে।
মাথা ঝোঁকালেন প্রফেসর। শুনেছি, ভারতীয় ঋষিরা নাকি এসব বিদ্যায় ওস্তাদ। আমাদের দেশে অবশ্য.ওসব গালগল্প বিশ্বাস করে না লোকে। তবে, পুরো ব্যাপারটা একেবারে ভিত্তিহীন হয়ত নয়। সম্মোহন কিংবা ভেন্ট্রিলোকুইজম-এ তো বিশ্বাস করে লোকে। আজকাল ছায়া শরীর নিয়েও গবেষণা হচ্ছে, বিশ্বাস করতে
আরম্ভ করেছেন কিছু কিছু বিজ্ঞানী।
বুঝলাম, তুমিও বিশ্বাস কর, বলল রবিন। কিন্তু পাদ্রীর ভূতের ব্যাপারটা কি? ওটা বিশ্বাস কর?
কাঁধ ঝাঁকালেন লিসা রোজার। বিশ্বাস করার মত কোন প্রমাণ পাইনি এখনও। যেখানেই ভূত আছে শুনেছি, ছুটে গিয়েছি। রাত কাটিয়েছি। কিন্তু আজ অবধি কোন ভূতের ছায়াও নজরে পড়েনি। এই বিশ্বাস কেন জন্মাল লোকের মনে, সেটা নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি, অনেক ভেবেছি। কোন কূল-কিনারা পাইনি। শেষে দুত্তোর বলে হাল ছেড়ে দিয়েছি। সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই সম্ভবত, ভূত বিশ্বাস করে আসছে লোকে। কেন? কে জানে!
.
১৫.
রবিন বেরিয়ে যাবার পর পরই সেন্ট্রাল হাসপাতালে ফোন করল কিশোর। জানল, জ্যাকবসকে হ্যামলিন ক্লিনিকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। দিন দুয়েক তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে চান ডাক্তাররা। লারিসা ল্যাটনিনা এখনও সেন্ট্রাল হাসপাতালে রয়েছে। প্রথমে তার সঙ্গে কথা বলা স্থির করল কিশোর। বেরিয়ে পড়ল।
সহজেই কেবিনটা খুঁজে বের করল কিশোর। খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে আছে লারিসা। বালিশে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। বিষণ্ণ।
আরে! দরজায় সাড়া পেয়েই ফিরে তাকিয়েছে লারিসা। তুমি মিস্টার অলিভারের মেহমান না?
হ্যাঁ, বলল কিশোর। কিশোর পাশা। কেমন লাগছে এখন?
ভাল না খারাপও না, মুখ বাঁকাল লারিসা। তবে বিষ খাওয়াতে চেয়েছিল আমাকে কেউ, ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। তাছাড়া খিদে। জাউ আর দুধ ছাড়া কিছু খেতে দেয় না ডাক্তাররা, বিরক্ত ভঙ্গিতে পায়ের ওপর ফেলে রাখা কম্বলটায় লাথি লাগল সে।একটা উপদেশ দিচ্ছি, কক্ষণো বিষ খেও না!
চেষ্টা করব না খেতে! হাসল কিশোর। ভাল করে তাকাল লারিসার দিকে। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে কেমন এক ধরনের ঘা, সাদা সাদা। কি বিষ ছিল, জেনেছেন?
জিজ্ঞেস করেছিলাম, লারিসার কণ্ঠে বিরক্তি। সাধারণ কি একটা কেমিক্যালের কথা বলল ওরা, নামটা মনে করতে পারছি না এখন। তবে আর্সেনিক কিংবা স্ট্রিকনিন নয়, এটা শিওর।
বেঁচে গেছেন সেজন্যেই, মাথা দোলাল কিশোর। স্ট্রিকনিন খেলে আর এখন এখানে থাকতেন না।
জানি! এরপর থেকে চকলেট খাওয়াই বাদ দেব কিনা, ভাবছি, বিষণ্ণ হাসি হাসল লারিসা।
কোথা থেকে এসেছে ওগুলো, জানতে পেরেছে পুলিশ?
না। সাধারণ কেমিক্যাল, যে-কোন কেমিস্টের দোকান থেকে কেনা যায়। আর চকলেট তো একটা বাচ্চা ছেলেও কিনতে পারে।
সারা ঘরে নজর বোলাল কিশোর। ছোট একটা আলমারির ওপর রাখা ফুলদানীতে একগোছা ফুলের ওপর এসে থামল দৃষ্টি। কারও উপহার?
মাথা ঝোকাল লারিসা। এক বান্ধবী দিয়েছে। একই জায়গায় কাজ করি আমরা। রোজই এক গোছা করে দিয়ে যায়। কথা বলে যায় খানিকক্ষণ।
লোকের সঙ্গে মেশামেশি ভালই আছে আপনার, না?
হেসে ফেলল লারিসা। পুলিশের মত জেরা শুরু করে দিয়েছ। পুরো সকালটা আজ জ্বালিয়ে খেয়েছে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেছে। জানার চেষ্টা করেছে, আমার কোন শত্রু আছে কিনা। যত্তোসব! লোকের সাথেও নেই আমি, পাঁচেও নেই, আমার শত্রু থাকতে যাবে কেন?
আমারও তাই ধারণা, মাথা ঝোকাল কিশোর। হ্যাঁ, মিস্টার অলিভার আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আবার তার বাড়িতে ফিরে গেলে তিনি খুশি হবেন।
খুব ভাল লোক, বলল লারিসা। আমি খুব পছন্দ করি। ভাল লোকের ওপরই যতরকম অত্যাচার। চোর-ছ্যাচোড়-বদমাশ—হ্যাঁ, ভাল কথা, কুকুরটা কি এসেছে তার?
স্থির হয়ে গেল হঠাৎ কিশোর। কুকুর!
হ্যাঁ। ওটা এলে চোরের উপদ্রব কমবে।
মিস্টার অলিভার বলেছেন?
না, মাথা নাড়ল লারিসা। মিসেস ডেনভার।–কবে যেন বলল, কবে যেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, গত শনিবারে। পুলে সাঁতার কাটছিলাম, কিনারে বসে ডাকপিয়নের অপেক্ষা করছিল মহিলা, আর বকর বকর করছিল। মিস্টার অলিভার কুকুর আনাচ্ছেন জেনে ম্যানেজারের খুব দুশ্চিন্তা। বলেছে আমাকে। আমি বললাম, রাজ্যের যত বেড়ালকে যখন সইতে পারছেন, একটা কুকুর সইতে পারবেন না কেন?
মাথা ঝোঁকাল কিশোর। হু!—আচ্ছা, বাসায় রয়ে গেছে, এমন কোন জিনিস দরকার আপনার? বললে দিয়ে যাব এক সময়।
না, দরকার নেই, মাথা নাড়ল লারিসা। যা যা লাগে, চাইলেই পাওয়া যায় এখানে। খালি পছন্দসই খাবার দিতে চায় না। এছাড়া সব রকমভাবে সাহায্য করে নার্সেরা। চুপ করল একটু। হয়ত, আগামীকালই ছেড়ে দেবে ওরা আমাকে। কাল নাহলে পশু তো ছাড়বেই।
লারিসাকে গুড বাই জানিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। মনে ভাবনা। যা সন্দেহ করেছিল, মিসেস ডেনভারের কল্যাণে ছায়াশ্বাপদের কথা অলিভারের বাড়ির আর কারও জানতে বাকি নেই। বাইরেরও কজন জানে, কে জানে! ডাকপিয়নসহ হয়ত পোস্ট অফিসেরও সবাই জানে। গির্জার ওরাও জানে নিশ্চয়। হয়ত পুরো পাড়াই খবরটা জেনে গেছে। তবে, লোকেরা জানে, জ্যান্ত কুকুর আনবেন অলিভার।
মূর্তিটার কথা কজন জানে? টমি গিলবার্ট? জ্যাকবস? জিজ্ঞেস করতে হবে স্টকব্রোকারকে। ওখানেই যাবে এখন কিশোর। হ্যামলিন ক্লিনিক কোথায়, চেনে না সে। ট্যাক্সি নেয়া স্থির করল।
ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে চলে এল কিশোর। সারির সবচেয়ে আগের গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, হ্যামলিন ক্লিনিক কোথায়, চেনেন?
অবশ্যই। উইলশায়ার আর ইয়েলের মাঝামাঝি
যাবেন?
এস।
অবাক হয়ে দেখল কিশোর, প্যাসিও প্লেসের দিকে ছুটেছে ট্যাক্সি। আরে! মিস্টার অলিভারের বাড়িতে চলে যাবে নাকি? দূর, কি বোকামি করেছে! অলিভারকে জিজ্ঞেস করলেই হত। তার বাড়ির মাত্র দুটো ব্লক দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি। ছোটখাট একটা আধুনিক বাড়ি। গেটের কপালে বড় করে লেখা: হ্যামলিন ক্লিনিক।
ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হাসপাতালে ঢুকে পড়ল কিশোর। রিসেপশন রুমে ঢুকেই থমকে গেল। সেন্ট্রাল হাসপাতালের তুলনায় এটা রাজবাড়ি। প্রাইভেট ক্লিনিক, যারা প্রচুর পয়সা খরচ করতে পারে, তাদের জন্যে। পুরু কার্পেটে ঢাকা মেঝে। দামি আসবাবপত্র। ঝকঝকে একটা ডেস্কের ওপাশে বসে আছে হালকা। লাল পোশাক পরা স্মার্ট রিসেপশনিস্ট। কাছে এসে জ্যাকবসের রুম নাম্বার জানতে চাইল কিশোর। মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা। একটা খাতা খুলে নাম মিলিয়ে কেবিন নাম্বার বলে দিল।
দোতলায় কোণের দিকে বেশ বড়সড় একটা ঘর। দুটো খোলা জানালা দিয়ে। রোদ ঢুকছে। বিছানায় শুয়ে আছে জ্যাকবস। লাল মুখ ফেকাসে সাদা হয়ে গেছে। বিছানার পায়ের কাছে একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে তার ভাগ্নে বব বারোজ। চোখমুখ কালো করে রেখেছে।
কিশোরকে দেখেই বলে উঠল জ্যাকবস, উপদেশ দিতে এসেছ তো? যেতে পার। অনেক হয়েছে। সারাটা দিন আমার কান ঝালাপালা করে ফেলেছে বব।
সব সময় বলেছি, আবারও বলছি, ঘোষণা করল বব। ওই সিগারেট তোমাকে খাবে! এবারে বেঁচ্ছে কোনমতে, এর পরের বার আর বাঁচবে না।
একশো বার বলছি, আমি ক্লান্ত ছিলাম, মুখ গোমড়া করে ফেলেছে। জ্যাকবস। ক্লান্ত ছিলাম, সেজন্যেই ঘটল এটা। জানিসই তো, খুব হুঁশিয়ার থাকি আমি। সিগারেট নিয়ে বেডরুমেও যাই না।
তাহলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খাওয়ার জন্যে বুঝি সোফায় শুয়েছিলে?
গুঙিয়ে উঠল জ্যাকবস। উফ, আর পারি না! বাঁচাল ভাগ্নের চেয়ে খারাপ জীব আর কিছু নেই পৃথিবীতে!
তাই ঘটেছিল, না? মাঝখান থেকে কথা বলে উঠল কিশোর। সিগারেট মুখে। নিয়ে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
তাই হয়ত হবে! স্বীকার করল জ্যাকবস। এছাড়া আর কি হতে পারে? মনে আছে, মিসেস ডেনভার অ্যাক্সিডেন্ট করার পর ঘরে ঢুকেছি…ভীষণ ঘুম পেয়েছিল—শেষ একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিলাম সোফায় বসে-তারপর আর কিছু মনে নেই। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। জেগে উঠে দেখলাম ধোয়ায় ভরে গেছে ঘর। চোখ জ্বালা করছে। ভাল দেখতে পাচ্ছি না। এর মাঝেই দরজাটা খুঁজে বের করতে গেলাম। তারপর তো বেহুশ!
ভুল দিকে দরজা খুঁজতে গিয়েছিলেন, বলল কিশোর। বেডরুমের দিকে চলে গিয়েছিলেন।
মাথা ঝোঁকাল জ্যাকবস। তুমি বের করে এনেছ আমাকে।
আমি একা নই, জানাল কিশোর। রবিন, মুসা আর টমিও সঙ্গে ছিল। টমিকেই ধন্যবাদ দেয়া উচিত আপনার। আগুন লেগেছে, সে-ই দেখেছে প্রথমে।
অদ্ভুত একটা ছেলে! বিড়বিড় করল জ্যাকবস। দেখতে পারতাম না ওকে। অথচ ও-ই আমার জান বাঁচাল।
মিস্টার জ্যাকবস, বলল কিশোর। মিস্টার অলিভার একটা কুকুর আনাচ্ছেন, শুনেছেন আপনি?
কুকুর! বালিশ থেকে মাথা তুলে ফেলল জ্যাকবস। কুকুর দিয়ে কি করবে?
জানি না। শুনলাম, কুকুর আনবে শুনে মিসেস ডেনভার খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
ওই মহিলা! ও-তো খামোকাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। কতখানি সত্যি বলেছে তাই বা কে জানে! এত বেশিকথা বলে, মিথ্যে না বললে পাবে কোথায় কথা? আবার বালিশে মাথা রাখল জ্যাকবস। টান টান করল শরীরটা। ওই বাড়িতে আর থাকছি না আমি। কিশোরের দিকে তাকাল। তোমরাও চলে যাও ওখান থেকে। বাড়িটা মোটেই নিরাপদ না।
উঠে দুপা এগিয়ে এল বব। ওসব নিয়ে ভেব না এখন। ডাক্তার বলেছে, চুপচাপ বিশ্রাম নিতে। আমি যাচ্ছি, ঘরদোর পরিষ্কার করে ফেলিগে। কিছু মেরামতের থাকলে তা-ও করে ফেলব। আগে ভাল হয়ে ওঠো, তারপর খুঁজে পেতে। ভাল আরেকটা বাড়ি দেখে উঠে যাব।
হাসল জ্যাকবস। আসলে ছেলেটা তুই খারাপ না, বব। একেক সময় ভাবি, . আমি তোর গার্জেন, না তুই আমার!
যাচ্ছি, কিশোরের দিকে ফিরল বব। তুমি?
আমিও যাব।
ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এল দুজনে।
খুব বেশি বিড়ি খায় আমার মামা, তিক্ত কণ্ঠে বলল বব। খাটেও সাংঘাতিক, দুশ্চিন্তাও বেশি। আগুন লেগেছে, একদিক থেকে ভালই হয়েছে।
ঝট করে চোখ ফেরাল কিশোর ববের দিকে।
না না, খারাপ অর্থে বলিনি, তাড়াতাড়ি বলল বব। হাসপাতালে একটু বিশ্রাম নিতে পারবে। ইদানীং খুব বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছিল, ঘুমাতই না বলতে গেলে। বড় বেশি ভাবত। অযথাই চমকে চমকে উঠত। এটা লক্ষ করছি ক্রিসমাসের পর থেকে। ব্যবসা সুবিধের যাচ্ছে না কিছুদিন ধরে। সেটাই কারণ হতে পারে। তার ওপর অতিরিক্ত সিগারেট। শরীর তো খারাপ হবেই। এবার আর না ঘুমিয়ে পারবে না। ঘুমোতে না চাইলে ঘুমের বড়ি খাওয়াবে ডাক্তাররা। সিগারেট ছুতেও দেবে না। দিন দুয়েক বিশ্রাম হবে।
এবং সেটা ভালই হবে, রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে, হাঁটতে হাঁটতে বলল কিশোর। ইদানীং ওই বাড়িটাতেও অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা ঘটছে! যে রাতে চোর এসেছিল, তুমি ও-বাড়িতে ছিলে না, না?
নাহ্…একটা মজা মিস করেছি। বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার কাছে শুনলাম, চোর এসেছিল।
মিস্টার অলিভার যে কুকুর আনাচ্ছেন, এটা শুনেছ?
না। বুড়িটাকে সহ্যই করতে পারি না আমি, কথা বলতে এলে পালাই। নইলে হয়ত শুনতে পেতাম।
অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে এসে পৌঁছুল ওরা। চত্বর পেরিয়ে জ্যাকবসের ফ্ল্যাটের কাছে এল।
ভাঙা জানালার দিকে চেয়ে শিস দিয়ে উঠল বব। শার্সিতে ভাঙা কাঁচের কয়েকটা টুকরো লেগে আছে এখনও। পর্দার জায়গায় ঝুলছে কয়েক ফালি পোড়া ন্যাকড়া।
কাঁচের মিস্ত্রিকে খন্ত্র দিতে হবে আগে, পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল বব। একটা চাবি বেছে নিয়ে তালায় ঢোকাল। বাইরের অবস্থা দেখেই ভেতরে কি হয়েছে বুঝতে পারছি। এমন হবে জানলে কে যেত মামাকে একা ফেলে! মোচড়। দিয়ে তালা খুলে ফেলল। দরজা খুলে ঢুকে গেল ভেতরে।– কিশোরও ঘুরে দাঁড়াল। ব্যালকনির সিঁড়ির দিকে এগোল। মনে ভাবনা।
লারিসা ল্যাটনিনার বিষ খাওয়াটা কি নিছকই দুর্ঘটনা? জ্যাকবস কি সত্যিই জানে না। কুকুর আনার কথা? যতখানি নিরীহ আর নিরপরাধ মনে হচ্ছে বব বারোজকে, আসলেও কি তাই? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে সন্দেহ পুরোপুরি গিয়ে পড়ে টমি গিলবার্টের ওপর। সে-ই একমাত্র লোক, যে জানতে পারে হাউণ্ডের মূর্তিটার কথা। আরও একটা যদি আছে এখানে-যদি সত্যিই মিস্টার অলিভারের ঘরের ছায়াটা সে-ই হয়। আরেকটা কথা মনে এল কিশোরের। কেউ একজন চাইছে, অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটা আর তার আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে দিতে। তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এরপর কাকে সরানর পালা? নিশ্চয় তিন গোয়েন্দা!