০৬.

 জীবনে বোধহয় এই প্রথম বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল মিসেস ডেনভার। হাঁ করে চেয়ে আছে কিশোরের দিকে। রক্ত জমেছে মুখে, লাল, আরও লাল হয়ে উঠছে।

ডলে ফল হবে না, বলল কিশোর। সহজে উঠবে না ওই দাগ।

নেমে এসে ছেলেদের পাশে দাঁড়ালেন অলিভার। মিসেস ডেনভার, আপনার। সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে আমার।

অলিভারের কথায় চমকে যেন বাস্তবে ফিরে এল ম্যানেজার। নাকী গলায় চেঁচিয়ে উঠল, জানেন, এই বিচ্ছটা কি বলেছে আমাকে? চোর বলেছে!

জানি। ঠিকই বলেছে! জবাব দিলেন অলিভার। বাড়ির সবাই জানুক, এটা নিশ্চয় চান না? মিসেস ডেনভারের দরজার দিকে এগোলেন। আসুন। কথা বলব। ছায়াশ্বাপদ।

আমি…আমি ব্যস্ত, গলার স্বর খাদে নেমে গেছে ম্যানেজারের। অনেক-অনেক কাজ পড়ে আছে, জানেন আপনি।

জানি, জানি, বললেন অলিভার। আপনার তো চব্বিশ ঘন্টাই কাজ! তো, আজ আর কি কি করার ইচ্ছে? ডাস্টবিন ঘটবেন? আর কারও ঘরে ঢুকবেন?…আসুন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকতে পারব না।–নাকি, উকিলকে টেলিফোন করব?

আর কিছু বলতে হল না। প্রায় উড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল মিসেস ডেনভার।

তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে হাসলেন অলিভার। তোমাদের আসা উচিত হবে না। ওখানে বস। আমি কথা বলে আসছি।

দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে পড়লেন অলিভার। বন্ধ করে দিলেন দরজা।

চুপচাপ বসে রইল তিন গোয়েন্দা। কান খাড়া। মিসেস ডেনভারের তীক্ষ্ণ, নাকী গলা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কি বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। খানিক পর পরই থেমে। যাচ্ছে তার গলা। ছেলেরা বুঝতে পারছে, তখন নিচু গলায় কথা বলছেন অলিভার। তাঁর গলা শোনা যাচ্ছে না।

খুব ভালমানুষ, এক সময় বলল মুসা। কিন্তু, আমার মনে হয়, প্রয়োজনে সাংঘাতিক কঠোর হতে পারেন তিনি। মোলায়েম গলায় কি ধমকটাই না লাগালেন ম্যানেজারকে।

পুলের ওপাশে দরজা খোলার শব্দ হল। ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে। আসছে টমি গিলবার্ট। রোদের দিকে চেয়ে চোখ মিটমিট করছে, অন্ধকারের জীবের মত। পরনে মোটা সুতার পাজামা, দলে-মুচড়ে আছে। শার্টের কয়েকটা বোতাম। নেই। পা খালি। হাই তুলল সে।

গুড মর্নিং, বলল কিশোর।

আবার চোখ মিটমিট করল টমি। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে রগড়াল। চুল-মুখ অপরিষ্কার, ধোয়া হয়নি।

আবার হাই তুলল টমি। জিভ আর টাকরার সাহায্যে অদ্ভুত আঁ-ম আঁ-ম শব্দ করল। চোখে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। একটা চেয়ারে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নিল। মাথা ঝাড়া দিয়ে তাকাল একবার পুলের দিকে। ছেলেদের দিকে ফিরল। বসবে কি বসবে না, দ্বিধা করছে।

অবশেষে ধপ করে পাথুরে চত্বরেই বসে পড়ল। গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তুলে নিল পাজামার নিচের দিকটা। তারপর একটা বিশেষ ভঙ্গিতে বসল।

ভঙ্গিটা চেনে কিশোর। যোগ ব্যায়ামের একটা আসন, পদ্মাসন। গুড মর্নিং, আবার বলল সে।

ফ্যাকাসে মুখটা কিশোরের দিকে ফেরাল টমি। পুরো এক সেকেণ্ড স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চোখের কোন নির্দিষ্ট রঙ বোঝা যাচ্ছে না। মণির চারপাশের সাদা অংশটা টকটকে লাল, ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম ভাল হয়নি যেন!

এখনও সকালই রয়েছে? অবশেষে কথা বলল টমি।

 হাতঘড়ির দিকে তাকাল কিলোর। না, তা নেই। একটা বেজে গেছে।

আবার হাই তুলল টমি।

মিস্টার অলিভারের কাছে শুনলাম, আপনি ভারমন্টের একটা নাইটশপে কাজ করেন? বলল কিশোর।

সামান্য সতর্ক মনে হল টমিকে। মৃদু হাসল। মাঝরাত থেকে সকালতক। খুব খারাপ সময়। তবে ভাল পয়সা দেয় ওরা। ওই সময়টীর জন্য আলাদা ভাতা দেয়। কাজেই ছাড়ি না। তাছাড়া সারাদিন আর রাতের অর্ধেকটা সময়ই থাকে আমার। পড়াশোনা করতে পারি।

স্কুলে পড়েন? জানতে চাইল কিশোর।

মুখ বাঁকাল টমি, হাত নাড়ল বিশেষ ভঙ্গিতে, যেন স্কুলে যাওয়াটা বেহুদা সময় নষ্ট। বহু আগেই ওই পাট চুকিয়েছি। বাপ চেয়েছে, আমি কলেজে যাই। তারপর ডেন্টিস্ট হই। কোন মানে খুঁজে পেলাম না এর। কে যায়, সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে। লোকের মাড়ি খোঁচাখুঁচি করতে? আসলে, ও-সবই এক ধরনের মোহ, মায়া।

মোহ! বিড়বিড় করল মুসা।

হা। সবই মোহ। পুরো দুনিয়াটাই একটা মায়া। সবাই আসলে ঘুমে অচেতন আমরা, ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখছি। ব্যাপারটা বুঝে গেছি আমি। তাই জেগে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছি।

মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল রবিন আর মুসা। মনের ভাব, মাতাল নয় তো ব্যাটা?

কি নিয়ে পড়াশোনা করছেন? জিজ্ঞেস করল কিলোর।

ধ্যানতত্ত্ব, বলল টমি। পূর্ণ-সচেতনতায় পৌঁছতে হলে এর ব্যাপক চর্চা দরকার। আসনমুক্ত হয়ে দাঁড়াল সে। ছেলে তিনটেকে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকতে দেখে মজা পাচ্ছে।

টাকা জমাচ্ছি, আসরের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে, বুঝতে পারছে টমি। ভারতে যাব গুরু খুঁজতে। ধ্যানতত্ত্বের সবচেয়ে বড় শিক্ষক একমাত্র ভারতেই আছে। তাই কষ্ট হলেও রাতে কাজ করি, বেশি টাকার জন্যে। শিগগিরই বেশ কিছু টাকা জমে যাবে আমার, ভারতে গিয়ে তিন-বছর থাকার মত হয়ে যাবে। ধর্ম আমি বিশ্বাস করি না, বিজ্ঞান মানি না। কোন জিনিসে আমার লোভ নেই।

সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রবিন। তা থাকেও না—চাওয়ার যা যা আছে, সব জিনিস যদি থাকে কারও—

না, না! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল টমি। বুঝতে পারছ না—

 বোঝার দরকার আছে বলেও মনে হয় না! ফস করে বলে ফেলল মুসা।

খুব সহজ ব্যাপার, মুসার টিপ্পনীতে কান দিল না টমি। চাহিদা, লোভ থেকেই সব গোলমালের সৃষ্টি। ওই যে বুড়ো অলিভার, সারাক্ষণ খালি নিজের সংগ্রহ নিয়েই ব্যস্ত। আরও চাই, আরও চাই এই-ই করছে খালি। পরের জন্মে—আমার মনে হয়, পরের জন্মে ভাঁড়ারের ইঁদুর হয়ে জন্মাবে!

কি যা-তা বলছেন ভদ্রলোক সম্পর্কে রেগে গেল মুসা। ওঁর মত মানুষ হয় নাকি?

মুসার বোকামিতে হতাশ হল যেন খুব, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল টমি। কারও কাছ থেকে চুরি করে কিংবা ছিনিয়ে এনেছে বা আনছে, তা বলিনি। বলছি, এত আছে, আরও চাইছে কেন? কেন বুঝতে পারছে না, মরীচিৎকার পেছনেই ছুটছে শুধু? জান, ওর কাছে মহামূল্যবান একটা মান্দালা আছে, অথচ জানেই না ওটা কি করে ব্যবহার করতে হয়। দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে, যেন আরেকটা অতি সাধারণ চিত্র।

মান্দালাটা আবার কি জিনিস? ভুরু কুঁচকে গেছে মুসার।

প্রায় ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল টমি। সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এল আবার। হাতে ছোট একটা বই। ছেলেদের কাছে এসে বলল, ওরকম একটা মান্দালা আমার খুবই দরকার। এক ধরনের নকশা, মহাবিশ্বের। ওটার ওপর চোখ রেখে ধ্যান করলে মেকি দুনিয়ার সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যাবে তুমি, সৌরজগৎ কিংবা আরও বড় কোন জগতের একজন হয়ে পড়বে। বই খুলে রঙিন একটা ছোট নকশা দেখাল সে। বেশ কয়েকটা ত্রিভুজ একটার ওপর আরেকটা ফেলে তারকা তৈরি করা হয়েছে। ওটাকে ঘিরে রেখেছে ছোটবড় অনেকগুলো বৃত্ত। সবচেয়ে বড় বৃত্তটাকে ছুঁয়ে আঁকা হয়েছে একটা চতুর্ভুজ। এটা একটা মান্দালা।

কই, মিস্টার অলিভারের ঘরে তো এ ধরনের জিনিস দেখিনি! বলল মুসা।

আছে। আমারটার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। তিব্বত থেকে এসেছে। অনেক পুরানো দেবদেবীর ছবি আছে ওটাতে, বই বন্ধ করল টমি। ওরকম একটা জিনিস জোগাড় করবই আমি। কোন গুরুকে দিয়ে আঁকিয়ে নেব। এখন টেলিভিশন দিয়েই কাজ চালাই।

টেলিভিশন! রবিন অবাক।

হ্যাঁ, টেলিভিশন, আবার বলল টমি। বর্তমানের সঙ্গে বন্ধনমুক্ত হতে সাহায্য করে আমাকে। দোকানের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরি। তারপর খুলে দিই টেলিভিশন, সাউণ্ড বন্ধ করে রাখি। শুধু ছবি। প্রথমে পর্দার ঠিক মাঝখানে দৃষ্টি স্থির। করি, ধীরে ধীরে সরিয়ে নিই কোন এক কোনার দিকে। পর্দায় কি ঘটছে না ঘটছে, কিছু চোখে পড়ে না আর। রঙের প্রতিকৃতিগুলোর দিকে চেয়ে থাকি শুধু। একসময় হারিয়ে যাই অদ্ভুত এক জগতে, সেটাই আসল জগৎ।

ঘুমিয়ে পড়েন নিশ্চয়! মন্তব্য করল রবিন।

অপ্রতিভ মনে হল টমিকে। ধ্যানমগ্নতার–হ্যাঁ, ধ্যানমগ্নতার এটাই অসুবিধে! স্বীকার করল সে। মাঝে মাঝে এত বেশি শান্ত হয়ে যায় মন, ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্ন দেখি তখন.. বাধা পেয়ে থেমে গেল টমি।

দরজায় শব্দ। বেরিয়ে এসেছেন মিস্টার অলিভার। চেয়ে আছেন তিন গোয়েন্দার দিকে।

দুঃখিত, বলে উঠল কিশোর। আপনার সব কথা শোনা হল না। আমাদেরকে যেতে হচ্ছে।

না না, দুঃখিত হবার কিছু নেই, তাড়াতাড়ি বলল টমি। যখন খুশি, যে সময় খুশি, আমার ঘরে এস। যদি তখন ধ্যানে না বসি, কথা বলব। এ-সম্পর্কে, মান্দালা সম্পর্কে যা জানতে চাও, জানাব।…আর হ্যাঁ, আমার ভারতে যাবার ব্যাপারেও বলব…

ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যালকনির সিঁড়ির দিকে রওনা হল তিন গোয়েন্দা।

 ঘরে ঢুকেই বড় নিচু একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন অলিভার।

আরেকটা চাবি আছে মিসেস ডেনভারের কাছে, না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যাঁ, আছে, মাথা ঝোঁকালেন অলিভার। ঠিকই অনুমান করেছিলে তুমি, আরেকটা চাবি আছে কারও কাছে। নাকা বুড়ি! উকিলকে ডেকে ওর চাকরির চুক্তিপত্রে আরও কিছু শর্ত ঢোকাব আমি। এরপর থাকলে থাকবে, না থাকলে চলে যাবে।

চাবিটা জোগাড় করল কোথা থেকে? জানতে চাইল রবিন।

খুব সহজে। মাস দুই আগে ইউরোপে গিয়েছিলাম। পরিচিত এক চাবিঅলাকে ডেকে আনল বুড়ি। বলল, এ-ঘরের তালার চাবি হারিয়ে ফেলেছে, আরেকটা চাবি বানিয়ে নিতে হবে। ম্যানেজার বলছে, কাজেই কোনরকম সন্দেহ করল না চাবিঅলা। বানিয়ে দিল আরেকটা চাবি।  

আজব মহিলা! বিড়বিড় করল কিশোর।

আজব? মুখ বাঁকালেন অলিভার। আমার তো মনে হয় মাথায় গোলমাল আছে! যাক, রহস্যটার সমাধান হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করত কে, বোঝা গেল। আর ঢুকতে পারবে না। চাবিটা নিয়ে নিয়েছি ওর কাছ থেকে। আর একটা বানিয়ে নেবার সাহস হবে না, খুব ধমকে দিয়েছি। তোমরা আমার মস্ত উপকার করলে, হেসে যোগ করলেন, জেনে ভাল লাগছে, ভূত-ফুত কিছু না, রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষই ঘরে ঢুকত। ছায়া দেখাটা আসলে কল্পনা, এখন বুঝতে পারছি। ওই তামারা ব্রাইসের ভূতের গল্পই শেকড় গেড়েছিল মনে! আর কিছু না! কি বোকামিই করেছেন এতদিন ভেবে, আপনমনেই মাথা নাড়লেন তিনি।

অলিভারের কথা কিশোরের কানে ঢুকেছে বলে মনে হল না। আপনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে চলেছে সে। হঠাৎ যেন বাস্তবে ফিরে এল। হাসল বৃদ্ধের দিকে চেয়ে। যাক, রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। আপনার উপকার করতে পেরেছি, খুব ভাল লাগছে। উঠে দাঁড়াল। আচ্ছা, মিস্টার অলিভার, আপনার কাছে কি একটা মান্দালা আছে?

তুমি জানলে কি করে? ভুরু কুঁচকে গেছে অলিভারের। কেন, দেখতে চাও?

মাথা ঝোকাল কিশোর।

গোয়েন্দাপ্রধানকে নিয়ে এসে কাজের ঘরে ঢুকলেন অলিভার। ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা বিচিত্র নকশা ঝুলছে ডেস্কের ওপরে, দেয়ালে। উজ্জ্বল রঙে আঁকা। টমির কাছে যেটা রয়েছে, অনেকটা ওটার মতই। তবে অনেক বড়। আর, বৃত্তগুলো। ঘেঁষে খুদেখুদে অক্ষরে প্রাচীন দুর্বোধ্য কোন ভাষায় লেখা রয়েছে কি যেন। চার কোণে অনেকগুলো দেব-দেবীর ছবি।

এক তরুণ আর্টিস্টের কাছ থেকে কিনেছি, বললেন অলিভার। দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াত সে। তিব্বত থেকে এনেছে মান্দালাটা। ওর জন্যেই নাকি বানিয়ে দিয়েছিল এক গুরু। এটা অনেক দিন আগের কথা। আর্টিস্ট এখন নেই, মারা গেছে।

মিস্টার অলিভার, গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। এ ঘরে টমি গিলবার্ট ঢুকেছিল?

না-তো, ভুরু কোঁচকালেন অলিভার। ওই নাকা বুড়িটা ছাড়া এ-বাড়ির আর কেউ ঢোকেনি এ ঘরে। একা থাকতে পছন্দ করি আমি, জানই। আচ্ছা ভাল লাগে না। আর টমিটাকে ঢুকতে দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না। সারাদিনই কেমন যেন। মাতাল মাতাল একটা ভাব, অপরিষ্কার, গন্ধ বেরোয় চুল থেকে।

তা ঠিক, একমত হল কিশোর। ওই মান্দালাটা বাইরে বের করেছিলেন কখনও? ফ্রেম-ট্রেম ঠিক করার জন্যে?।

এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন অলিভার। গত দশ বছর ধরে ওখানে ওভাবেই ঝুলে আছে ওটা। বছর বছর দেয়ালে রঙ দেবার সময় শুধু নামাই, তা-ও নিজের হাতে। আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রাখি সে-সময়টা। রঙের কাজ শেষ হলে আবার ঝুলিয়ে দিই। কেন?

টমি জানল কি করে আপনার কাছে একটা মান্দালা আছে?

জানে?

জানে। এ-ও জানে, ওটা তিব্বতের জিনিস। ওর কাছে একটা মান্দালা আছে।

কাঁধ ঝাঁকালেন অলিভার। কি জানি! ওই হতচ্ছাড়া খবরের কাগজঅলাদের কাজ হবে হয়ত! আমার সংগ্রহে কি কি আছে, ছেপে বসেছিল হয়ত কখনও। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব জানে, কি আছে আমার সংগ্রহে। ওরাই হয়ত কেউ জানিয়েছিল খবরের কাগজঅলাদের।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোকাল কিশোর। দরজার দিকে এগোল।

কিশোর, হালকা গলায় বললেন অলিভার। আরেকটা রহস্য খুঁজছ? লাভ নেই। আর কোন রহস্য নেই এখানে।

হয়ত, একমত হতে পারছে না গোয়েন্দাপ্রধান। না থাকলেই ভাল। কিন্তু আবার কোন কিছু ঘটতে আরম্ভ করলেই ডেকে পাঠাবেন আমাদের, দ্বিধা করবেন না।

নিশ্চয়, নিশ্চয়।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে একে একে হাত মেলালেন অলিভার। দরজার বাইরে এগিয়ে দিয়ে এলেন ওদের।

রাস্তায় এসে নামল তিন ছেলে।

গেল শেষ হয়ে! বাস-স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল মুসা। এত সহজ কেস আর হাতে আসেনি। ছুটির বাকি দিনগুলো কি করে কাটাব?

প্রথম কাজ, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে দূরে থাকব, বলে উঠল রবিন। মেরিচাচীর আইসক্রীম কেকের লোভ এবারের মত ত্যাগ করতে হবে। আরিব্বাপরে, যা জঞ্জাল এনে জমিয়েছেন রাশেদ চাচা। সাফ করতে… ইঙ্গিতে বাকিটুকু বুঝিয়ে দিল গবেষক। কিশোর, তুমি কি বল?

আঁ-হা! জবাব দিল কিশোর। সঙ্গীদের কথায় মন নেই। গভীর চিন্তা চলেছে তার মাথায়।

সারাটা পথ চুপচাপ থাকল কিশোর। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে রইল।

রকি বীচে পৌঁছুল বাস। নামল তিন গোয়েন্দা। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে হেঁটেই চলে এল। কিশোরের কাছ থেকে বিদায় নিল অন্য দুজন।

টেলিফোনের কাছাকাছি থেক, ডেকে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। শিগগিরই আবার কাজে নামতে হবে। মিস্টার অলিভারের কাছ থেকে ডাক এল বলে।

বিস্মিত দুই সঙ্গীর দিকে চেয়ে হাসল কিশোর। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে রওনা হয়ে গেল ইয়ার্ডের দিকে।

.

০৭.

 একগাদা লোহা-লক্কড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন মেরিচাচী। কিশোরকে দেখেই মুখ তুলে তাকালেন। এসেছিস! তুই কি, বল তো কিশোর! মানুষকে ভাবনায় ফেলে। দিয়ে মজা পাস! বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে সেই সক্কাল বেলা বেরিয়ে চলে গেছিস! বালিশের ওপর একটা চিঠি ফেলে রেখে গেলেই হল? কেন, বলে যেতে কি অসুবিধে ছিল…।

ঘুমিয়েছিলে, বলল কিশোর, জাগাতে চাইনি…

 দরদ! এই সারাটাদিন দুঃশ্চিন্তায় ভোগানর চেয়ে ঘুম ভাঙানো অনেক ভাল ছিল। তোরা চাচা-ভাতিজা মিলে আমাকে জ্বালিয়ে খেলি। তুই থাকবি বাইরে বাইরে, টো টো করে ঘুরবি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবি। কার বেড়াল হারাল, কার কুকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, তাতে তোর কি?…আর তোর চাচা, রাজ্যের যত জঞ্জাল এনে ফেলবে আমার ঘাড়ে! এগুলো না হয় বিক্রি, না কিছু, খালি জায়গা আর সময় নষ্ট। টাকাও!

হাসল কিশোর, ভেব না, চাচী। সারাটা বিকেল পড়ে রয়েছে। আজই সাফ করে ফেলব সব। এখন খেতে দাও তো, খুব খিদে পেয়েছে।

ভুরু কোঁচকালেন মেরিচাচী। সে তো চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি! আয়, জলদি আয়! হাত মুখ ধুয়ে নে-গে। আমি খাবার বাড়ছি। তাড়াহুড়ো করে জঞ্জালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। বাড়ির দিকে চললেন।

জঞ্জালের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। হাসিতে ভরে গেছে মুখ। প্রচুর জিনিস বেরোবে ওগুলোর ভেতর থেকে, হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে ঢোকাতে পারবে। কাজে লাগবে তিন গোয়েন্দার।

পুরো বিকেল জঞ্জাল ঘটল কিশোর। সন্ধে ছটায় চলল ঘরে, রাতের খাবার খেতে। এর ঠিক এক ঘণ্টা পরে বাজল ফোন।

ফোন ধরলেন মেরিচাচী। কিশোরের দিকে চেয়ে বললেন, তোর ফোন।

চকচক করে উঠল কিশোরের চোখ। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রায় ছুটে এসে ধরল ফোন। কানে ঠেকাল রিসিভার। কিশোর পাশা।

 কিশোর, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ। আমি ফ্র্যাঙ্ক অলিভার। কিশোর, বললে বিশ্বাস করবে না আমার, আমার ঘরে আবার ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে

বলুন, শান্ত গোয়েন্দাপ্রধান।

মিসেস ডেনভারকে ধরার পর ভেবেছিলাম, ছায়ার ব্যাপারটা আমার কল্পনা, বললেন অলিভার। কিন্তু তা নয়! আবার দেখেছি আমি ছায়াটা! মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেল কিনা, বুঝতে পারছি না!

আপনার বাড়িতে আসতে বলছেন আমাদেরকে?

প্লীজ! যদি আজই পার, খুব ভাল হয়। রাতটা আমার এখানেই কাটাবে। একা থাকতে খুব খারাপ লাগছে। যে-কোন সময় আবার এসে পড়বে ছায়াটা…সইতে পারব না আর! নার্ভের ওপর খুব চাপ পড়ছে!

ঠিক আছে, আমরা আসছি, যত তাড়াতাড়ি পারি, রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর।

আবার ভাগার তালে আছিস? গম্ভীর হয়ে গেছেন মেরিচাচী।

সব কথা খুলে বলল কিশোর। বুঝিয়ে বলল চাচীকে।

তাই! সব শুনে বললেন চাচী। আহা, মানুষটার জন্যে খারাপই লাগছে! বিয়ে। করল না, সঙ্গীসাথী নেই, একা মানুষ, কাটায় কি করে! ঠিক আছে, যা। বাসে যাবার দরকার নেই। তোর চাচাকে বলছি, গাড়িতে করে দিয়ে আসবে।

চাচীকে জড়িয়ে ধরল কিশোর। টুক করে তার গালে চুমু খেয়ে বলল, এ জন্যেই তোমাকে এত ভালবাসি, চাচী!

মুসা আর রবিনকে টেলিফোন করল কিশোর।

কয়েক মিনিট পরেই ইয়ার্ডের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল ছোট পিক-আপ ট্রাকটা। পেছনে গাদাগাদি করে বসেছে তিন গোয়েন্দা।

কিশোর, আবার তোমার কথাই ঠিক হল, ঠেলেঠুলে দুই বন্ধুর মাঝখানে আরেকটু জায়গা করে নেবার চেষ্টা চালাল মুসা। কি করে জানলে, আবার খবর দেবেন, মিস্টার অলিভার?

কারণ, আমি শিওর, ছায়া দেখাটা ওঁর কল্পনা নয়। আমি নিজেও দেখেছি। ওটা?

তুমি দেখেছ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। কখন?

গতকাল। মিস্টার অলিভারের কাজের ঘরে। একটা বুকশেলফের পাশে। প্রথমে মনে করেছি, মুসা এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরে জানলাম, ও তখন বসার ঘরে ছিল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বলে উঠল মুসা। কিন্তু পরে যে বললে, বুকশেলফের ছায়া?

তখন তাই মনে করেছিলাম। এটাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু টমি গিলবার্টকে দেখার পর…

 চমকে উঠেছিলে! কিশোরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল রবিন। গতকাল পুলিশ আসার পর ঘর থেকে বেরিয়েছিল টমি। তাকে দেখেই কেমন চমকে উঠেছিলে তুমি।

হ্যাঁ। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, মুসার সমানই লম্বা সে? বলল কিশোর।

দাঁড়াও, দাঁড়াও! তাড়াতাড়ি বলল মুসা। ওর মত দেখতে নই আমি। ও আমার চেয়ে বড়, বিশের কম হবে না বয়েস। তাছাড়া হাড্ডিসার…

 আমি বলেছি টমি তোমার সমান লম্বা, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তোমার। কালো চুল, ওরও। ও গতরাতে কালো সোয়েটার পরেছিল, তোমার গায়ে ছিল। কালো জ্যাকেট। মিস্টার অলিভারের কাজের ঘরে তখন ম্লান আলো জ্বলছিল। ঘরের বেশির ভাগই ছিল অন্ধকার। টমিকে তুমি বলে ভুল করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

চুপ করে রইল মুসা আর রবিন। ব্যাপারটা পর্যালোচনা করে দেখছে মনে মনে।

কিন্তু ও ঢুকল কি করে? অবশেষে বলল রবিন। দরজায় তালা দেয়া ছিল।

জানি না, মাথা নাড়ল কিশোর। টমিকেই দেখেছি, সেটাও শিওর হয়ে বলতে পারছি না। তবে, কেউ একজন ঢুকেছিল। কি করে ঢুকেছিল, এটা জানতে পারলেই অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে।

ঘন্টাখানেকের ভেতরই প্যাসিও প্লেসে পৌঁছে গেল পিক-আপ। চত্বরের সামনে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন রাশেদ চাচা।

বেল টিপল কিশোর।

এসে পড়েছ! দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন মিস্টার অলিভার। গুড। সত্যি বলছি, ভয়ই পেতে শুরু করেছি আমি!

বুঝতে পারছি, মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ঘরটা ঘুরেফিরে দেখি? ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল সে।

মাথা কাত করলেন মিস্টার অলিভার।

প্রথমেই সোজাঁ কাজের ঘরের দিকে ছুটে গেল কিশোর। কোণের দিকে ডেস্কের ওপর জলছে শুধু টেবিল ল্যাম্পটা। ঘরে আলো-আঁধারির খেলা। পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে শুধু একটা বুকশেলফের একপাশের কয়েকটা বই, চীনামাটির তৈরি কয়েকটা মূর্তি, আর দেয়ালে ঝোলানো মান্দালা। ভুরু কুঁচকে নকশাটার দিকে চেয়ে রইল গোয়েন্দাপ্রধান। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেছে।

হঠাৎ, গত বিকেলের মতই উপলব্ধি করল, ঘরে একা নয় সে। আরও কেউ একজন রয়েছে। নীরবে লক্ষ্য করছে তাকে। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর।

গত দিন যেটার কাছে দেখেছিল, সেখানেই আজও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ছায়াটাকে। সে ফিরে তাকাতেই কোণের দিকে সরে যেতে লাগল দ্রুত। বাতাসে জানালার পর্দা কাঁপার মত কাঁপছে থিরথির করে।

লাফ দিয়েই ছুটল কিশোর। ঘরের কোণে এসে খামচে ধরার চেষ্টা করল। ছায়াটাকে। হাতে ঠেকল দেয়াল, শুধুই দেয়াল। ছুটে এসে সুইচ টিপে মাথার ওপরের তীব্র আলো জ্বেলে দিল। পাগলের মত তাকাল চারদিকে। নেই। কোথাও নেই ছায়াটা।

ছুটে কাজের ঘর থেকে বেরোল কিশোর। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিচে তাকাল।

উজ্জ্বল ফ্লাডলাইট জ্বলছে। নীল-সাদা আলোয় জ্বলজ্বল করছে সুইমিং পুলের সোনালি আর নীল মোজাইক করা তল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে টমি গিলবার্টের ফ্ল্যাটটা। জানালার পর্দা সরানো। রঙিন আলোর আবছা ঝিলিক চোখে পড়ছে, তার মানে টেলিভিশন খোলা। দেখা যাচ্ছে টমিকে। চুপচাপ মেঝেতে বসে আছে সে, পদ্মাসনে, বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথা।

কি হল? কানের কাছে ফিসফিস করল রবিনের কণ্ঠ।

আবার দেখেছি ওটা! বিড়বিড় করল কিশোর। কেঁপে উঠল একবার। কিছু না, ডিসেম্বরের ঠাণ্ডার জন্যেই এই কাঁপুনি নিজেকে প্রবোধ দিল সে। কাজের ঘরে—মান্দালাটার দিকে চেয়ে ছিলাম। হঠাৎ টের পেলাম, আরও কেউ রয়েছে ঘরে। ঘুরে তাকালাম। দেখলাম ছাঁয়াটাকে। এখন মনে হচ্ছে, টমি নয়। ওই যে টমি, তার ঘরে, বসে বসে ঝিমোচ্ছে। কিন্তু ঢুকল কি করে ছায়া! বেরিয়েই বা গেল কি করে! আশ্চর্য!

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল কিশোর। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন অলিভার।

ওকে তুমিও দেখছ, না? কম্পিত কণ্ঠ বৃদ্ধের। তারমানে, পাগল হয়ে যাইনি আমি!

নীরবে ঘরে ঢুকে গেল ছেলেরা। দরজা বন্ধ করে দিল।

না, মিস্টার অলিভার, বলল কিশোর, পাগল হয়ে যাননি! গতকালও দেখেছি ওটা আমি। কি মনে হয় আপনার? টমি গিলবার্টের সঙ্গে কোন মিল রয়েছে?

জানি না!—এত দ্রুত আসে-যায় ছায়াটা! খামোকা কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, তবে–তবে, টমির সঙ্গে মিল আছে!

কিন্তু তাই বা কি করে হয়? আপনমনেই বলল কিশোর। দুই দুই বার ওটা দেখেছি, দুবারই টমি ছিল তার ঘরে। একই সঙ্গে দুটো জায়গায় কি করে যাবে সে? জোরে জোরে মাথা নাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান। না, হতে পারে না!—মিস্টার অলিভার, টমি সম্পর্কে কতখানি জানেন আপনি?

খুবই সামান্য, বললেন অলিভার। মাস ছয়েক হল, আমার বাড়িতে ভাড়া এসেছে সে।

টমি আসার আগে কি ওই ছায়ার উপস্থিতি টের পেয়েছেন কখনও?

ভাবলেন অলিভার। মাথা নাড়লেন। না। ব্যাপারটা নতুন।

আপনার মান্দালার ওপর লোভ আছে ওর, বলল কিশোর। ভাল করে ভেবে দেখুন তো, ওটার কথা কখনও বলেছেন কিনা ওর কাছে?

কক্ষনও না, সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন অলিভার। ওর সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলি না আমি এড়িয়ে চলি। তবে মাঝেমধ্যে লারিসার সঙ্গে কথা বলি। মেয়েটা ভারি মিশুক। তবে সে-ও খুব একটা মিশতে চায় না টমির সঙ্গে। মোটা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আতঙ্ক রয়েছে মেয়েটার। রোজ রাতে নিয়মিত সাঁতার কাটে পুলে। অনেক সময় পুলের কাছে বসে থাকে টমি। মেয়েটা উঠে এলে তার সঙ্গে আলাপ জমানর চেষ্টা করে। কিন্তু পাত্তা দেয় না লারিসা। আমাকে বলেছে, ছেলেটাকে দেখলেই কেমন একটা অনুভূতি হয়-বিছে, মাকড়সা কিংবা কেঁচো দেখলে যেমন হয় কারও কারও!।

এ-বাড়ির কোথাও কোন গোপন পথ নেই তো? বলল রবিন। আপনার ঘরে ঢোকার?

মনে হয় না, অলিভারের হয়ে জবাব দিল কিশোর। এসব আধুনিক বাড়িতে গোপন পথ বানায় না লোকে। সেসব ছিল আগের দিনে, দুর্গ-টুর্গগুলোতে।

সন্দেহ থাকলে খুঁজে দেখতে পার, বললেন অলিভার। আমার বাবা আরেকজনের কাছ থেকে কিনেছিলেন এ-বাড়ি। পুরানো আমলের লোক ছিল আগের মালিক। বলা যায় না, যদি তেমন কোন পথ বানিয়ে রেখে গিয়ে থাকে।

তন্নতন্ন করে খুঁজল ওরা। বিশেষ করে কাজের ঘরে। কিন্তু গোপন পথ তো দূরের কথা, ইঁদুর বেরোনর মত বাড়তি একটা ফোকরও নেই দরজা-জানালা ভেন্টিলেটর আর পানি নিষ্কাশনের সরু ছিদ্র ছাড়া। দেয়াল বা মেঝের কোথাও কোন ফাঁপা জায়গা নেই। দরজা ছাড়া আর কোন পথে মানুষের ঢোকার উপায় নেই।

সত্যিই আশ্চর্য! অবশেষে বলল রবিন।

মাথা ঝোঁকালেন অলিভার। বহু বছর ধরে আছি এ-বাড়িতে। আরও কয়েকটা বাড়ি আছে আমার, কিন্তু এটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ। তাই এখান থেকে নড়ি না। তবে এবার বোধহয় তল্পি গোটাতেই হল। এই ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা এভাবে ঘটতে থাকলে পাগলই হয়ে যাব!

এরপর ঘাপটি মেরে কাজের ঘরে বসে রইল তিন গোয়েন্দা। কিন্তু আর এল ছায়াটা। রাত বাড়ছে। শেষে ওঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। শোবার ঘরে শুয়ে। শুয়ে বই পড়ছেন অলিভার। কোনরকম শব্দ হলেই চমকে উঠছেন। তাকে জানাল কিশোর, সারারাত পাহারা দেবে ওরা পালা করে। তিনি যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন।

বসার ঘরে সোফার ওপর রাত কাটাবে রবিন। মুসা থাকবে কাজের ঘরে। একটা কাউচে। কিশোর অন্য কোন একটা ঘরে শুতে পারবে।

রাতের প্রথম প্রহরে পাহারায় রইল কিশোর। সদর দরজার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইল সে। কান খাড়া রাখল।

এগারোটা বাজল। নিথর নীরব চারদিকটা। শোনার মত তেমন কিছুই নেই। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার শব্দও থেমে গেছে অনেক আগেই। এই সময় কানে এল। পানিতে ঝুপঝাঁপ শব্দ। নিশ্চয় লারিসা ল্যাটনিনা সাঁতার কাটতে নেমেছে। স্বাস্থ্যের প্রতি কি দৃষ্টি! কনকনে ঠাণ্ডায় এই মাঝরাতেও নিয়মের ব্যতিক্রম করেনি।

কিশোর? কাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে মুসা। জলদি এস! একটা জিনিস দেখবে!

উঠে পড়ল কিশোর। রবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। মুসাকে অনুসরণ করে কাজের ঘরে চলে এল সে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। গির্জার ভেতরে আলো!

বোধহয় ফাদার স্মিথ, বলল কিশোর। ঠিকঠাক আছে কিনা সব, দেখতে এসেছেন!

কিন্তু এত রাতে!

ঠিকই বলেছ, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর। সন্দেহজনকই! দাঁড়াও, দেখে আসছি।

আমি আসি তোমার সঙ্গে, বলল মুসা।

না, জোর দিয়ে বলল কিশোর। তুমি এখানেই থাক। পাহারা দাও। আমি যাব আর আসব।

বসার ঘরে চেয়ার থেকে জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে গায়ে চড়াল কিশোর। দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। চত্বরের আলো নিবে গেছে। নির্জন, শূন্য। সুইমিং পুলেও কেউ নেই। কেঁপে উঠল একবার কিশোর, বোধহয় ঠাণ্ডার জন্যেই। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে।

রাস্তায় এসে নামল কিশোর। গির্জার জানালায় আলোটা দেখা যাচ্ছে এখনও। ঘষা কাঁচের শার্সিতে ঘোলা প্রতিফলন। কাঁপছে অল্প অল্প। বৈদ্যুতিক আলো নয়!

গির্জার সদর-দরজা বন্ধ। সিঁড়ি বেয়ে পাল্লার কাছে উঠে এল কিশোর। আস্তে করে ঠেলা দিল। ভেজানই রয়েছে পাল্লা। খুলে গেল নিঃশব্দে। ভেতরে ঢুকে গেল সে।

পেছন ফিরে একটা বেদির কাছে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা। কালো আলখেল্লা। সাদা কলার। হাতে মোমবাতি।

শব্দ শুনে ঘুরল মূর্তি। স্থির হয়ে গেল কিশোর। পাদ্রীর পোশাক পরা একজন। মানুষ। বৃদ্ধ। লম্বা লম্বা চুল সব সাদা। গাল আর কপালের চামড়া কোঁচকানো।

কথা বলল না লোকটা। হাতের মোমবাতি তুলে নীরবে দেখছে কিশোরকে।

মাপ করবেন, ফাদার, কাঁপা গলায় বলল কিশোর, বাইরে থেকে আলো দেখলাম। চোরের উৎপাত রয়েছে তো। তাই দেখতে এসেছি। ( অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল লোকটা। তারপর হাত দিয়ে বাতাস করে নিবিয়ে। দিল মোম। গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করল ঘরটাকে।

ফাদার! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ঘাড়ের কাছে লোম খাড়া হয়ে গেছে তার। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত। পিছিয়ে এল এক পা। বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল।

পাশ দিয়ে দমকা হাওয়ার মত ছুটে গেল কিছু একটা। জোর ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল কিশোর। পরক্ষণেই পেছনে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল ভারি দরজা।

কালিগোলা অন্ধকার। হুড়মুড় করে আবার উঠে পড়ল কিশোর। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করল দরজার হাতল। টান দিল।

ইঞ্চিখানেক ফাঁক হল পাল্লা, তার বেশি না। কিসে যেন আটকে গেছে! জোরে ঠেলা দিয়েই আবার হ্যাঁচকা টান দিল কিশোর। আবারও সেই এক ইঞ্চি ফাঁক।

বাইরে থেকে তালা আটকে দেয়া হয়েছে দরজায়।

.

০৮.

দরজার পাশে দেয়াল হাতড়াচ্ছে কিশোর। হাতে ঠেকে গেল সুইচ বোর্ড। একটার পর একটা সুইচ টিপে গেল সে। উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল মাথার ওপর। আলোয়। ভরে গেল বিরাট ঘর।

দেয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল কিশোর। ধীরে ধীরে ডান থেকে বায়ে সরাল নজর। কেউ নেই। আস্তে করে এগোল। এসে থামল, খানিক আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল মূর্তিটা সেখানে। মেঝেতে পড়ে আছে কয়েক ফোঁটা মোম।

আবার দরজার কাছে ফিরে এল কিশোর। হাতল ধরে টান দিল। খুলল না। মনে হয়, বিড়বিড় করল সে আপনমনেই, ডাকার সময় হয়েছে! চৌকাঠ আর পাল্লার ফাঁকে মুখ রেখে চেঁচাতে শুরু করল সে, কে আছেন! আসুন! আমি আটকে

গেছি! কে আছেন—চুপ করল। কান পাতল! কোন আওয়াজ নেই। দরজার গায়ে। জোরে জোরে চাপড় দিতে লাগল। মুসা! ফাদার স্মিথ! আমি আটকে গেছি!

জবাব নেই।

 অপেক্ষা করল কিশোর, তারপর আবার চেঁচাল। আবার অপেক্ষার পালা।

ওখানে যাওয়া উচিত হবে না, ফাদার! শোনা গেল একটা মহিলাকণ্ঠ।

খামোকা ভয় পাচ্ছ, ব্রাইস, ফাদার স্মিথের গলা চিনতে পারল কিশোর। একা যাচ্ছি না আমি। পুলিশে ফোন করেছি। যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়বে-..

ফাদার স্মিথ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। আমি কিশোর পাশা! তালা দিয়ে। আটকে রেখে গেছে আমাকে!

কিশোর পাশা? বাইরে দরজার কাছেই শোনা গেল ফাদারের বিস্মিত কণ্ঠ।

উইলশায়ারের দিক থেকে সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল কিশোর। বুঝে গেছে, পুলিশ আসার আগে তালা খুলবেন না ফাদার। পুলিশের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটা তার বিশেষ সুখকর হবে না, এটাও বুঝতে পারছে। গির্জার ভেতরে চোখ বোলাতে বোলাতে কুটি করল সে।

কাছে, আরও কাছে এসে গেল সাইরেনের শব্দ। থেমে গেল হঠাৎ।

তালায় চাবি ঢোকানর শব্দ হল। খুলে গেল দরজা।

শোবার পোশাক পরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ফাদার স্মিথ। তার পাশে মিসেস ব্রাইস। ঘাড়ের ওপর নেমেছে চুল, তাড়াহুড়ো করে বেঁধেছে, দেখেই বোঝা যায়।

একটু সরুন, প্লীজ, ব্রাইসের পেছন থেকে বলল একজন পুলিশ।

বাঁ পাশে এক পা সরল ব্রাইস। তরুণ পেট্রলম্যানের চোখে চোখ পড়ল কিশোরের। আগের রাতে গির্জায় চোর খুঁজতে যারা যারা এসেছিল, এই লোকটাও তাদের একজন। পাশে আরেকজন, হাতে রিভলভার।

কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল তরুণ অফিসার।

আঙুল তুলে দেখাল কিশোর, যেখানে পাদ্রীর পোশাক পরা লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। গির্জার ভেতরে আলো জ্বলতে দেখলাম। এতরাতে কে ঢুকল, দেখতে এলাম। দেখি, ফাদারের পোশাক পরা এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে ওখানটায়, হাতে মোম। আমাকে দেখেই আলো নিবিয়ে দিল। অন্ধকারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বেরিয়ে চলে গেল। তালা আটকে দিল দরজায়।

দেখতে এসেছিলে? বলল আরেক অফিসার।

 হ্যাঁ। মিস্টার অলিভারের ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, গির্জায় আলো।

ও, হা হা, মনে পড়েছে, বলে উঠলেন ফাদার। সকালে মিস্টার অলিভারের সঙ্গে দেখেছি তোমাকে। কিন্তু এত রাতে এখানে এক পাদ্রীকে দেখেছ! সেই সন্ধ্যা ছটায় আমি নিজে তালা লাগিয়ে গেছি দরজায়। আমি ছাড়া আর কোন ফাদার নেই এখানে। নিশ্চয় ভুল করেছ।

না করেনি! চেঁচিয়ে উঠল ব্রাইস। ফাদার, আপনি জানেন ও ভুল করেনি!

আহ্, আবার শুরু করলে! বিরক্ত কণ্ঠ ফাদারের। তোমার কি ধারণা, আবার সেই বৃদ্ধ পাদ্রী!

চুপ করুন আপনারা! পেছনে শোনা গেল আরেকটা কণ্ঠ। ফ্র্যাঙ্ক অলিভার। সঙ্গে এসেছে মুসা।

ওই ছেলেটা আমার মেহমান, কিশোরকে দেখিয়ে বললেন অলিভার। আজ রাতে ও আর ওর দুই বন্ধু আমার ঘরেই থাকছে। এই যে, এ হল মুসা আমান। আমাকে বলেছে, খানিক আগে গির্জার ভেতরে আলো দেখেছিল। কিশোরকে ডেকে দেখিয়েছে আলোটা। ব্যাপার কি দেখতে এসেছে কিশোর পাশা।

বিরক্ত চোখে কিশোরের দিক থেকে চোখ ফেরাল দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার। মুসাকে দেখল, তারপর তাকাল অলিভারের দিকে। বাচ্চাদের এভাবে চোর-পুলিশ খেলা উচিত না। তাদের পক্ষে একজন বয়স্ক লোকের সাফাই গাওয়া আরও অনুচিত।

 স্থির হয়ে গেলেন অলিভার। নাক কোচকালেন।

কিন্তু গির্জার ভেতরে আলো দেখেছি আমি! জোর দিয়ে বলল মুসা।

এবং কেউ একজন ছিল, যযাগ করল কিশোর। কালো আলখেল্লা, সাদা কলার। ফাদার স্মিথ, আপনি যেমন পরেন, তেমনি। ধবধবে সাদা লম্বা লম্বা চুল। হাতে ছিল একটা মোমবাতি।

পোলাপানের গপ্পো! বিড়বিড় করল পুলিশ অফিসার। খোকা, বল না যেন, কিছু চুরি গেছে গির্জা থেকে।

গেছেই তো, বলে বসল কিশোর। গতরাতে ছিল ওটা, এখন নেই। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল ফাদারের দিকে। একটা স্ট্যাচু ছিল ওখানটায়, একটা জানালার পাশে দেয়ালের একটা জায়গা নির্দেশ করল সে। সবুজ ফতুয়া গায়ে, মাথায় চোখা লম্বা, চুড়াঅলা টুপি, হাতে লাঠি।

ফাদারকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়াল দুই পুলিশ অফিসার।

সত্যিই তো! ঠিকই বলেছে ছেলেটা, বলে উঠল তরুণ অফিসার। গতরাতে একটা মূর্তি ছিল ওখানে, সেইন্ট প্যাট্রিকের মূর্তি সম্ভবত! সব সময় যিনি সবুজ ফতুয়া পরে থাকেন, মাথায় বিশপের টুপি-কি যেন নাম টুপিটার, ফাদার?

দেয়ালের দিক থেকে চোখ ফেরালেন ফাদার। মাইটার, বিড়বিড় করে বললেন। সব সময়ই মাইটার মাথায় রাখেন সেইন্ট প্যাট্রিক, হাতে বিশপের। লাঠি।

তো কোথায় গেল মূর্তিটা? জানতে চাইল পুলিশ অফিসার।

এ গির্জায় কখনও সেইন্ট প্যাট্রিকের মূর্তি ছিল না, অস্বস্তি বোধ করছেন। ফাদার, কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে। থাকার কথাও না। এটা সেইন্ট জুডসের গির্জা। অসম্ভবকে সম্ভব করার ব্যাপারে খ্যাতি আছে তার।

হু, তরুণ অফিসারের কণ্ঠে অবিশ্বাস। আপনার হাউসকীপার প্রায়ই বৃদ্ধ ফাদারকে দেখতে পায়, যেটা অসম্ভব। এই ছেলেটা তাকে দেখেছে, এটা অসম্ভব। গতরাতে আমরা কয়েকজন দেখেছি একটা মূর্তি, যা নাকি কখনও ছিলই না এ গির্জায়, এটা আরেক অসম্ভব। এই গির্জার কোথাও এক-আধটা মাইটার আছে?

চমকে উঠলেন যেন ফাদার। গতকাল আনা হয়েছিল। একটা মাইটার আর একটা বিশপের লাঠি।

কেন?

একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল, বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন ফাদার। বড়দিন উপলক্ষে। গুরুজনদের সামনে অভিনয় করেছিল বাচ্চা-কাচ্চারা। মধ্যযুগে যেমন হত। ন্যাটিভিটি আর তিন জ্ঞানী লোকের ঘটনা অভিনীত হয়েছিল। অভিনয়ের শেষদিকে এসে ঢোকেন সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তি আর সাধুরা, তাঁদের মাঝে সেইন্ট প্যাট্রিকও থাকেন। সেইন্ট প্যাট্রিক সাজানর জন্যেই ফতুয়া, টুপি আর লাঠি ভাড়া করে আনা হয়েছে। আজ আবার ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি ওগুলো যেখান থেকে এনেছিলাম।

হ্যাঁ, হা! চেপে রাখা শ্বাসটা শব্দ করে ফেলল কিশোর। এতক্ষণে বুঝতে পারছি, কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিল চোরটা!

মানে? ভুরু কোঁচকাল তরুণ পুলিশ অফিসার।

একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, ভারিক্কি ভাবটা চেহারায় ফুটিয়ে তুলল কিশোর! গত সন্ধ্যায় এসেছিল এ-পাড়ায়। পাশের গলির এক বাড়িতে ঢুকেছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে এসে ঢুকল গির্জায়। বুঝতে পারল, এখানে ঢুকেও সহজে রেহাই পাবে না। পুলিশ আসবেই। চোখ পড়ল ফতুয়া, মাইটার আর লাঠির ওপর। উপস্থিত বুদ্ধি আছে চোরটার, কোন সন্দেহ নেই। তাড়াতাড়ি সেইন্ট প্যাট্রিক সেজে দেয়ালের গা ঘেঁষে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেল। চোখ এড়িয়ে গেল আপনাদের।

কিশোরের দিকে চেয়ে আছে দুই অফিসার। বিস্ময় ফুটেছে চোখে।

আপনারা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে চলে গেলেন, বলে গেল কিশোর। গির্জার দরজায় তালা দিতে এল দারোয়ান, পল মিন। তখনও বেরোয়নি চোর, কিন্তু বেরোতে হবে। দরজা ছাড়া আর কোন পথ নেই। সেদিক দিয়ে বেরোতে গেলেই চোখে পড়ে যাবে দারোয়ানের। অগত্যা তাকে কোন কিছু দিয়ে মেরে বেহুশ করে পালিয়ে গেল। ফাদার, পলের হুশ ফিরেছে? কথা মনে করতে পারছে সে?

মাথা নাড়লেন ফাদার। তেমন কিছুই না। ও বলেছে, পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল কেউ। তারপর আর কিছু মনে নেই। ওর সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে দেয়নি ডাক্তার। অবস্থা খারাপই!

হ্যাঁ, শানের ওপর পড়েছিল হয়ত, বলল কিশোর। জোরে বাড়ি খেয়েছে মাথায়। ভাল হয়ে উঠুক। চুরির ব্যাপারে কিছু একটা আলোকপাত করতে পারবে হয়ত—

বেচারা! বিড়বিড় করলেন ফাদার। মস্ত বোকামি করেছি কাল! ওর সঙ্গে আমারও আসা উচিত ছিল!

পুরো ব্যাপারটাই কেমন উদ্ভট! আপনমনেই বলল তরুণ অফিসার। রিপোর্ট কি লিখব! এক চোর, সেইন্টের পোশাক পরে লুকিয়ে থেকেছে! একটা বাচ্চা ছেলে বলছে, সে ভূত দেখেছে…

পাদ্রীর পোশাক পরা একজন মানুষকে দেখেছি, শুধরে দিল কিশোর। ভূত দেখেছি, একবারও বলিনি।

মানুষ কি করে ঢুকল? বলে উঠল তামারা ব্রাইস। তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। দরজায় তালা দেয়া ছিল! ফাদার স্মিথ নিজে দিয়েছেন! ভূতই দেখেছ তুমি, খোকা! বুড়ো ফাদারের ভূত। যাকে আমি দেখেছি।

 দরজা যদি বন্ধই থাকবে, এই ছেলেটা ঢুকল কি করে? প্রশ্ন রাখল দ্বিতীয়। অফিসার। আসলে যে ঢুকেছে, সে তালা খুলেই ঢুকেছে। ফাদার, তালার চাবি কার কাছে থাকে?

অবশ্যই আমার কাছে, বললেন ফাদার। মাঝেসাঝে ব্রাইসের কাছেও দিই…আর একটা, দারোয়ান পলের কাছে—ওটা সম্ভবত হাসপাতালে, পকেটের আর সব জিনিসের সঙ্গে রয়েছে। আমারটা কিংবা পলেরটা হারিয়ে যেতে পারে, তাই বাড়তি আরও একটা চাবি আছে। রেকটরির নিচতলায়, কোট রাখার হ্যাঁঙারের পাশে, ছোট একটা হুকে ঝোলানো থাকে।

এখনও কি আছে চাবিটা, ফাদার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ঝট করে কিশোরের দিকে চোখ ফেরালেন ফাদার। দেখলেন এক মুহূর্ত। তারপর ঘুরে প্রায় ছুটে চলে গেলেন। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলেন রেকটরি থেকে। মুখচোখ শুকনো। নেই!

কেউ কোন কথা বলল না।

এটা—এটা এক ধরনের বোকামি, আপনমনেই বললেন ফাদার। দুদুটো চাবি থাকতেও বাড়তি আরেকটা চাবি খোলা জায়গায় ঝুলিয়ে রাখা! তাহলে আর দরজায় তালা দেবার মানে কি হল!

সেটা আপনারা জানেন, ফস করে বলে বসল দ্বিতীয় অফিসার। ফাদার, মনে হচ্ছে, যে কেউ যে-কোন সময় ওখান থেকে চাবিটা নিতে পারে?

মাথা ঝোঁকালেন ফাদার। থমথমে চেহারা।

লেফটেন্যান্টকে ডাকা দরকার, সঙ্গীর দিকে চেয়ে বলল অফিসার। নিজের। কানেই শুনে যাক, সেইন্টের ছদ্মবেশে হাওয়া হয়ে গিয়েছে চোর। চাবি চুরি করে গির্জায় এসে ঢুকেছে পাদ্রীর প্রেতাত্মা!

নিচু গলায় বিড়বিড় করে কি পড়ছে তামারা ব্রাইস। ক্রুশ আঁকছে বুকে।

হাউসকীপারের দিকে চেয়ে বললেন ফাদার, আর কোন কাজ নেই এখানে আমাদের, ব্রাইস। চল, রেকটরিতে চল। চমৎকার এক কাপ চা খাওয়াবে আমাকে!

.

০৯.

অলিভারের ঘরে থেকে, বাকি রাতটা পাহারা দিয়েই কাটাল তিন গোয়েন্দা। চোর বা ভূত, কোনটাই আর কোন উপদ্রব করল না। খুব ভোরে উঠলেন মিস্টার অলিভার। ডিম ভাজলেন, টোস্ট তৈরি করলেন। এসে ঢুকলেন বসার ঘরে।

এই যে, ছেলেরা, বললেন অলিভার। নাশতা রেডি। খেতে এস।

নীরবে কয়েক মিনিট খাওয়া চলল।

 তারপর? জিজ্ঞেস করলেন অলিভার। কোন সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছ?

হ্যাঁ, একটা ডিমের বেশির ভাগই মুখে পুরে দিয়েছে মুসা। চিবোতে চিবোতে বলল, এ-রহস্যের সমাধান করা আমাদের কম্মো নয়!

খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে যাও তুমি, মুসা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। সবে। তো খেল রু। জমাট বাঁধতে শুরু করেছে রহস্য। প্রচুর চিন্তাভাবনা আর সময় ব্যয় করতে হবে এর পেছনে।

যেমন?

যেমন, চোর। গির্জায় কেন ঢুকেছিল, জানা দরকার। অন্তত অনুমান করতে পারা দরকার।

তাছাড়া, বললেন অলিভার, জানা দরকার, আমার ঘরে আসে যে ছায়াটা, ওটার সঙ্গে চোরের কি সম্পর্ক!

হ্যাঁ, বলল কিশোর। ঠিকই বলেছেন। ছায়া আর চোরের সঙ্গে যোগসাজশ থাকাটাও বিচিত্র নয়। আচ্ছা, মিস্টার অলিভার, ছায়াটা কি নির্দিষ্ট কোন একটা সময়েই দেখা যায়? দিনে বা রাতে? আমি দেখেছি দুবার, দুবারই সন্ধ্যাবেলা। আপনি?

ভাবলেন অলিভার। সাধারণত, শেষ বিকেলে কিংবা সন্ধ্যাবেলায়। দুএকবার দুপুরের পরেও দেখেছি।

মাঝরাতে, বা তারপর?

তখন তো ঘুমিয়েই থাকি। তবে কোন-কোনদিন আগে জেগে উঠি, এই পেচ্ছাপ-টেচ্ছাপ করার জন্যে। তবে ওসময় কখনও দেখিনি।

মাথা ঝোকাল কিশোর। তাহলে, আজ আর সারাদিন আমাদের থাকার কোন দরকার নেই। চলে যাব এখন। বিকেল নাগাদ ফিরে আসব। রকি বীচে যেতে হবে। কাজ আছে। বোঝা যাচ্ছে, ততক্ষণ আপনি নিরাপদ। আশা করছি, ছায়াটা ঢুকবে না ততক্ষণে।

নাশতা শেষ করে উঠে পড়ল ছেলেরা। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে সবে চত্বরে নেমেছে, পুলের ধারে একটা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল টমি গিলবার্ট।

এই যে ছেলেরা, ডাকল টমি। শুনলাম, গির্জায় নাকি ভূত দেখেছ গতরাতে? ওসব ব্যাপারে আমার খুব আগ্রহ। আমাকে যদি ডাকতে তখন!

ডাকব? টমির দিকে চেয়ে আছে কিশোর। কি করে? তখন তো আপনার কাজের সময়, দোকানে থাকার কথা।

গতরাতে ছুটি ছিল আমার। রোজই কাজ করে না লোকে।

ভূত দেখা গেছে, কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।

এ আর এমন কি কঠিন? যে পাড়ায় মিসেস ডেনভার আর ব্রাইস রয়েছে, সে পাড়ার লোকের খবর জানতে অসুবিধে হয় নাকি? ভোর হবার আগেই ছড়িয়ে পড়েছে খবর। বেড়ালটার কাছে শুনলাম।

বেড়াল! বিস্মিত রবিন।

ওই আর কি। বেড়াল-মানব, ব্রায়ান এনড্রু।

গেটের দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নামল। তাদের পিছু। নিল টমি।

একটু দাঁড়াও, ডাকল টমি। সত্যিই তোমরা তাকে দেখেছ?

কোন একজনকে দেখেছি, জবাব দিল কিশোর।

দাঁড়াল না তিন গোয়েন্দা। পেছনে টমিকে হাঁ করিয়ে রেখে দ্রুত হেঁটে এসে পড়ল উইলশায়ার স্ট্রীটে। বাস স্টেশনের দিকে চলল।

ওটাকে দেখলেই কেমন জানি গা ছমছম করে! বলল মুসা। ওই টমিটা! বাসে উঠে বসেছে ওরা।

কারণ সে ভূত-প্রেত সম্পর্কে আগ্রহী, বলল কিশোর। অতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপারে বিশ্বাসী। ওসব নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে, সিটের পেছনে হেলান দিল গোয়েন্দাপ্রধান। ওর কিছু কিছু বিশ্বাস একেবারে অমূলক নয়। বড় বড় সব ধর্মেই বলে, লোভ আর খুব বেশি টাকা পয়সা থাকা ক্ষতিকর।

অর্থই সকল অনর্থের মূল, বলল রবিন।

খাঁটি কথা। তবে, আসলে তুমি কি বলতে চেয়েছ, বুঝেছি, মুসা। ওই টমি গিলবার্টের মাঝে অদ্ভুত কিছু একটা রয়েছে। রহস্যজনক কিছু একটা!

ঠিক সকাল সাড়ে নটায় রকি বীচে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।

প্যাসিও প্লেসে যা যা ঘটেছে, সব আবার তলিয়ে দেখা দরকার, বলল কিশোর। চল, আগে হেডকোয়ার্টারে যাই।

দশ মিনিট পর ট্রেলারের ভেতর এসে ঢুকল ওরা। পুরানোপোড়া ডেস্কটা ঘিরে বসল।

একসঙ্গে তিনটে রহস্যের সমাধান করতে হচ্ছে এখন আমাদের, আলোচনা শুরু করল কিশোর। এক নাম্বার, ওই ছায়া। কি ওটা, কার ছায়া, কি করে ঢোকে মিস্টার অলিভারের ঘরে? দুই, চোর-কুকুরের মূর্তিটা যে চুরি করেছে। কে সে? গির্জায় কি কাজ তার? শেষ, এবং তিন নাম্বারটা হল, পাদ্রীর ভূত। আসলেই কি সে ভূত? ছায়া, আর চোরের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?

ছায়াটা কার, তা-তো জানিই আমরা, বলল মুসা। তুমি আর মিস্টার অলিভার, দুজনেই চিনতে পেরেছ। টমি গিলবার্ট।

দেখেছি সত্যি, মাথা ঝাঁকাল কিশোর, তবে চিনতে পেরেছি বলব না। পলকের জন্যে দেখেছি। তাই নিশ্চিত হতে পারছি না। তোমরা দুজনও যদি দেখতে, একমত হওয়া যেত।

ছায়াটা আর যাই হোক, বলল রবিন, মিসেস ডেনভারের নয়। সে শুধু তালা খুলে দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকত, দেয়াল গলে আসত না।

আবার মাথা ঝোঁকাল কিশোর। এবং আকারেও ছায়াটার সঙ্গে অনেক অমিল। মহিলা বেঁটে, মোটা। ছায়াটা লম্বা, হালকা-পাতলা। টমির সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু বুঝতে পারছি না, কোন পথে কি করে ঢোকে সে এত নিঃশব্দে! আর, একজন। লোক একই সময়ে দুজায়গায় থাকে কি করে? দুবার তাকে মিস্টার অলিভারের ঘরে দেখেছি, দুবারই ওই সময়ে নিজের ঘরে ছিল সে। ঘুমোচ্ছিল, এবং ঝিমোচ্ছিল।

কাঁধ ঝাঁকাল মুসা। হয়ত অন্য কারও ছায়া!

কিন্তু মান্দালাটার কথা জানে টমি, মনে করিয়ে দিল রবিন। নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে, যেন দেখেছে নিজের চোখে। মিস্টার অলিভার কখনও তাকে ঘরে ডেকে নেননি, এ-ব্যাপারেও সন্দেহ নেই।

অর্থাৎ, ছায়ার ব্যাপারে আমাদের প্রধান সন্দেহ, টমি গিলবার্ট, ব্যাপারটার ওপর আপাতত ইতি টানল কিশোর। তবে আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই, কোনরকম ব্যাখ্যাও দিতে পারছি না ছায়াটার। আচ্ছা, এবার চোরের কথায় আসা যাক। নিশ্চয় ব্যাটা মিস্টার অলিভারের ভাড়াটে, কিংবা কোন প্রতিবেশী। কারণ, তার জানা আছে, গির্জার একটা চাবি ঝোলানো থাকে কোটের হ্যাঁঙারের পাশে, রেকটরিতে। তার আরও জানা আছে, কুকুরের মূর্তি…আচ্ছা, বার বার এই মূর্তি মূর্তি বলতে ভাল্লাগছে না! একটা কিছু নাম দেয়া যাক এর। কি নাম? বন্ধুদের দিকে তাকাল সে।

ভূতুড়ে কুকুর, বলল মুসা।

নাহ, ভাল্লাগছে না, মাথা নাড়ল রবিন। কাঁপাথিয়ান হাউণ্ড?…নাহ্, এটাও পছন্দ না…তাহলে কি? কিশোর, তুমি একটা বল।

শ্বাপদ-শ্বাপদ-হলে কেমন হয়?

ছায়াশ্বাপদ! চমৎকার! মুসা, তুমি কি বল?

মাথা দুলিয়ে সায় দিল মুসা।

বেশ, আবার আগের কথার খেই ধরল কিশোর। এবং এর মূল্য কতখানি, জানা আছে চোরের। কে জানতে পারে?

ছায়াটা, অনুমান করতে চাইছে মুসা, মিস্টার অলিভারের ঘরে ঢুকে তার ডায়েরীতে হয়ত লেখা দেখেছে। কিংবা ফোনে তিনি কারও সঙ্গে আলাপ করেছিলেন, সে-সময় শুনেছে।

মিসেস ডেনভার হতে পারে? বলল রবিন। ও-তো মিস্টার অলিভারের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। দেখে ফেলাটা অসম্ভব নয়।

ও জানলে ওই পুরো এলাকা জেনে যেত ওটার কথা, প্রতিবাদ করল মুসা।

জানেনি, কি করে শিওর হচ্ছ? কিশোর, তোমার কি মনে হয়? গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকাল রবিন। চুরি করার উদ্দেশ্যেই কি জ্যাক ইলিয়টের ঘরে ঢুকেছিল চোর?

বলা শক্ত। কি করে সে জানল, তখন রয়েছে ওখানে? হয়ত মূল্যবান কিছু চুরির উদ্দেশ্যেই ঢুকেছিল, পেয়ে গেছে মূর্তিটা। ওই পাড়ার কেউ হয়ে। থাকলে, নিশ্চয় জানা ছিল, বাড়িটা খালি পড়ে আছে। ঢুকে পড়েছে। ওর কপাল খারাপ, রাস্তার মোড়েই ছিল পুলিশ। মিকোর চেঁচামেচি শুনে তাড়া করে এল তারা। ছুটে গিয়ে গির্জায় ঢুকে পড়ল চোর। সেইন্ট প্যাট্রিকের স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়ে গেল দেয়াল ঘেষে। সাহস আছে বলতে হবে!

তারপর, পুলিশ চলে গেল, কিশোরের কথার পিঠে বলল রবিন। তালা দিতে এল দারোয়ান পল। তাকে আহত করে পালাল চোর।

আমার মনে হয়, শুধু বেরিয়ে যাবার জন্যে পলকে আহত করেনি চোর, বলল কিশোর। তাহলে এত গুরুতর জখম করত না হয়ত, ওকে হাসপাতালে কিছু দিনের জন্যে সরিয়ে দিতেই কাজটা করেছে সে। গির্জায়ই কোথাও লুকিয়ে। রেখেছিল ছায়াশ্বাপদ। পরের রাতে এসে আবার নিয়ে যাবার ইচ্ছে। পল থাকলে। সেটা করতে অসুবিধে। তাই বেচারাকে প্রচণ্ড মার খেতে হল। মেরেই ফেলতে চেয়েছিল কিনা, কে জানে!

কিন্তু কেন? প্রশ্ন রাখল মুসা। যা শুনেছি, জিনিসটা খুব বেশি বড় নয়। পকেটে নিয়েই স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে যেতে পারত চোর। এত সব ঝামেলায় গেল কেন?

পারত, কিন্তু খুব বেশি ঝুঁকি হয়ে যেত, বলল কিশোর। ওর হয়ত ভয় ছিল, স্কোয়াড কারগুলো আবার ফিরে আসতে পারে, কিংবা সবগুলো তখনও যায়ইনি এলাকা ছেড়ে-আড়ালে থেকে গির্জার ওপর চোখ রেখেছে পুলিশ। কিংবা হয়ত পাড়ার সব বাড়িতে তল্লাশি চালাবে রাতের কোন এক সময়ে। তারচেয়ে গির্জায় লুকিয়ে রেখে যাওয়াটাই নিরাপদ মনে করেছিল সে।

তারপর পাদ্রীর ভূতের ছদ্মবেশে গতরাতে আবার এসে ঢুকেছে গির্জায়?

আমার তাই ধারণা। এমনিতেই এমন একটা গুজব ছড়িয়ে আছে ওই এলাকায়। বৃদ্ধ পাদ্রীর ছদ্মবেশ নিয়ে সে বুদ্ধিমানের কাজই করেছে। আমি সামনাসামনি দেখেও চিনতে পারিনি। হয়ত কেউই পারত না। বরং তাৎক্ষণিক একটা ধাঁধায় ফেলে দিত যে-কোন দর্শককে, আমাকে যেমন দিয়েছিল।

বেশ, বলল রবিন, বুঝলাম। কিন্তু এই সাধু পুরুষটি কে?

আর কে? সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দিল মুসা, টমি গিলবার্ট। ভূত-প্রেত তার বিষয়। তাছাড়া গতরাতে ডিউটি ছিল না তার। ওই অদ্ভুত ছদ্মবেশ নেবার কথা তার মাথায়ই তো আসবে!

আমি কিন্তু মানতে পারছি না, গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। টাকাপয়সার লোভ তার আছে বলে মনে হয় না। এ-ধরনের অদ্ভুত সাধনা যারা করে, তাদের। প্রথম পাঠই হল, জাগতিক লোভ আর আকর্ষণ ত্যাগ করা।

কিন্তু ওর টাকার দরকার, উত্তেজিত হয়ে পড়েছে রবিন। ভারতে যাবার জন্যে প্রচুর টাকা দরকার।

ঠিক, ঠিকই বলেছে রবিন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ভুলে যাচ্ছ কেন, পুলিশ যখন চোরটাকে তাড়া করেছিল, টমি ঘুমিয়ে ছিল। তার ঘরে, মনে করিয়ে দিল কিশোর। পুলিশ যখন গির্জার ভেতরে খোঁজাখুঁজি করছে, টমি আমাদের সঙ্গেই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। চোর তখন মূর্তি সেজে গির্জার ভেতরেই ছিল।

কিন্তু, একই সঙ্গে দুজায়গায় থাকতে পারে শুধু টমি, যুক্তি দেখাল রবিন। তার পক্ষেই গির্জার ভেতরে-বাইরে একই সময়ে থাকা সম্ভব।

জোরে জোরে মাথা নাড়ল কিশোর। অতি কল্পনা! তবে, টমি কিছু একটা ঘটাচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটার ওপর চোখ রাখা দরকার… থেমে গেল টেলিফোনের শব্দে। প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার। হ্যালো..ও, মিস্টার অলিভার?…এক সেকেণ্ড। একটা সুইচ টিপে দিল। হ্যাঁ, এবার বলুন।

টেলিফোন লাইনের সঙ্গে স্পীকারের যোগাযোগ করে নিয়েছে কিশোর। হেডকোয়ার্টারে বসা সবাই একই সঙ্গে কথা শোনার জন্যে।

এইমাত্র টেলিফোন করেছিল একটা লোক, স্পীকারে শোনা গেল অলিভারের কথা, কাঁপা কাঁপা, উত্তেজিত। কুকুরের মূর্তিটা আছে এখন ওর কাছে। তোমাদের সন্দেহ ছিল, এমন একটা জিনিস বিক্রি করতে পারবে না সে সহজে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পারছে। ভাল ক্রেতাকেই খুঁজে বের করেছে সে। আমি। দশ হাজার ডলার। দাম চেয়েছে সে আমার কাছে!,

.

১০.

বোমা ফেটেছে যেন ট্রেলারের ভেতর। স্তব্ধ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।

কিশোর? আছ তুমি ওখানে? আবার শোনা গেল অলিভারের উত্তেজিত কণ্ঠ।

 আঁ-হা! বলুন! কোনমতে বলল কিশোর।

আমি…আমি মনস্থির করতে পারছি না, বললেন অলিভার। একটা চোরের সঙ্গে হাত মেলাব? কিন্তু মূর্তিটাও যে আমার দরকার! ওটা হাতছাড়া করতে পারব না কিছুতেই। টাকাটা দিয়েই দেব কিনা ভাবছি! আমারই জিনিস ওটা। জ্যাককে টাকা মিটিয়ে দিয়েছি। কাজেই চোরের কাছ থেকে আমি আবার ওটা কিনে নিলে কারও কিছু বলার নেই। দুদিন সময় দিয়েছে সে আমাকে।

পুলিশকে জানিয়েছেন?

ইচ্ছে নেই। চোরটাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। তাহলে হয়ত চিরদিনের জন্যেই হারাব মূর্তিটা।

ভেবে দেখুন ভাল করে, বলল কিশোর। ভয়ানক এক অপরাধীর সঙ্গে হাত মেলাতে যাচ্ছেন। পলকে কি করেছে সে, জানেন।

জানি। ভয় পেয়ে গিয়েছিল চোরটা, জান বাঁচানো ফরজ ভেবেছে। পলকে বেহুশ করে পালিয়ে গেছে। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তার, তেমন কিছু করব না। তো, তোমরা কখন আসছ? একা একা ভাল লাগছে না আমার, কেমন যেন। অস্বস্তি বোধ করছি।

ছায়াটা এসেছিল আর?

না। তবে, এসে পড়তে পারে…সত্যি বড় ভয় পাচ্ছি আমি!

তিনটার বাস ধরব আমরা, দুই সঙ্গীর দিকে তাকাল কিশোর। ওদের মত জানতে চাইছে। মাথা ঝোকাল ওরা। আঁধার নামার আগেই পৌঁছে যাব।

গুড বাই জানিয়ে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। মেরেছে। এবার চোরের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে তাঁকে! বাড়তি কিছু কাপড়-চোপড় সঙ্গে নেব, ভাবছি। মিস্টার অলিভারের ওখানে দিনকয়েক থাকার দরকার হতে পারে। তিনটার আগেই বাস স্টেশনে চলে এস। ঠিক আছে?

মাথা ঝোকাল মুসা। টমির ওপর চোখ রাখবে বললে…

পরে আলোচনা করব ওসব নিয়ে। এখন কিছু জরুরি কাজ সারতে হবে।

বেরিয়ে চলে গেল রবিন আর মুসা। রবিনের কিছু কাজ আছে লাইব্রেরিতে, সেখানে যাবে। মুসা সোজা চলে গেল বাড়িতে। তার খিদে পেয়েছে।

কিশোরও বেরোল। লোহার একটা আলমারির মরচে পরিষ্কার করায় মন দিল। সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে। আসলে কোন একটা কাজে মগ্ন থেকে ভাবতে চাইছে সে ঠাণ্ডা মাথায়। দুপুরের খাবার খেতে ডাকলেন মেরিচাচী। খেয়ে এসে সোজা নিজের ওয়ার্কশপে ঢুকল কিশোর। ইলেকট্রনিক কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ শুরু করে দিল। শেষে যন্ত্রপাতিগুলো বাক্সে গুছিয়ে ভরে নিল। সময় হয়ে গেছে। বাক্সটা নিয়ে বাস স্টেশনের দিকে রওনা হল সে।

আরে! ওই বাক্সের ভেতর কি? কৌতূহল ঝরল রবিনের গলায়। নতুন কোন আবিষ্কার?

একটা ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরা আর রিসিভার, জানাল। কিশোর। একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে ব্যবহার হয়েছে।

হ্যাঁ, বলল মুসাঁ। আজকাল বেশির ভাগ বড় দোকানেই এ-জিনিস ব্যবহার হচ্ছে। চোর ধরার জন্যে।

তোমারটা কোথায় পেলে? জানতে চাইল রবিন।

স্টোরে আগুন লেগেছিল, বলল কিশোর। অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। এটাও নষ্ট হয়েছিল। অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে চাচা কিনে নিয়ে এসেছেন। খুলে দেখলাম, খুব বেশি কিছু খারাপ হয়নি। সহজেই ঠিক করে নিলাম।

এর সাহায্যেই টমির ওপর চোখ রাখব?

হ্যাঁ। চত্বরের দিকে কোন জানালা নেই মিস্টার অলিভারের ঘরে। ব্যালকনিতে বসে চোখ রাখা যাবে না। আমরা যাকে দেখব, সে-ও আমাদের দেখে ফেলবে। কাজেই, এই যন্ত্রটা ছাড়া উপায় নেই। সিঁড়ির নিচে বড় একটা ফুল গাছের ঝাড় আছে। ওটার ভেতর লুকিয়ে রাখব ক্যামেরাটা। ঘরে বসে আরামসে চোখ রাখতে পারব।

খাইছে! কিশোর, তোমার তুলনা হয় না! জোরে হাততালি দিল মুসা। ব্যক্তিগত চ্যানেলে টিভি দেখব আজ!

 এক ঘণ্টা পর। মিস্টার অলিভারের বাড়িতে এসে পৌঁছল তিন গোয়েন্দা। ঢোকার মুখেই গেটে দেখা হয়ে গেল সদা-উপস্থিত মিসেস ডেনভারের সঙ্গে।

আবার এসেছ? বাক্সটার দিকে চেয়ে আছে মহিলা। এটার ভেতর কি?

একটা টেলিভিশন সেট, সহজ গলায় বলল কিশোর। মিস্টার অলিভারের জন্যে বড়দিনের উপহার।

মহিলার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান। পুলের ধারে চেয়ারে বসে ধূমপান করছে জ্যাকবস। উপভোগ করছে পড়ন্ত বেলার রোদ। পাশে গামলার মত সেই অ্যাশট্রেটা। প্রতি দুই কি তিন সেকেণ্ড পর পরই ছাই ঝাড়ছে তাতে। কিশোর তাকাতেই হাসল। মিস্টার অলিভারের ওখানে থাকবে আজ রাতে?

ইচ্ছে আছে, জবাব দিল কিশোর।

ভাল, অ্যাশট্রেতে ঠেসে সিগারেট নেবাল জ্যাকবস। পরীক্ষা করে দেখল, সত্যিই নিবেছে কিনা আগুন। চোখ তুলল। মানুষটা বড় বেশি একা। মাঝেমধ্যে সঙ্গ পেলে ভালই লাগবে। আমি তো একা থাকতেই পারি না। আমার ভাগ্নেটা গেছে তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। দুদিনেই একা একা লাগতে শুরু করেছে আমার। উঠে দাঁড়াল সে। চলে গেল তার ফ্ল্যাটের দিকে।

দোরগোড়াতেই ছেলেদের জন্যে অপেক্ষা করছেন অলিভার। টেলিভিশন ক্যামেরাটা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি। কখন সেট করবে?

সাঁঝের দিকে, বলল কিশোর, অন্ধকার হয়ে এলে। এই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ।

হ্যাঁ, সেটাই উপযুক্ত সময়, বললেন অলিভার। তবে তাড়াতাড়ি করতে হবে। তোমাকে। অন্ধকার হয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চত্বরে আলো জ্বলে ওঠে আপনাআপনি।

৫-২০-এ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল কিশোর। আশপাশটা দেখল। পেছনে। চেয়ে নিচু গলায় বলল, বের করে নিয়ে এস। কেউ নেই।

দ্রুত সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। একটা ধাতব তেপায়ার ওপর ক্যামেরাটা বসাল কিশোর, কায়দা করে লুকিয়ে রাখল ফুলঝাড়ের ভেতর। দ্রুতহাতে লেন্স অ্যাডজাস্ট করল, প্রায় পুরো চত্বরটাই এসে গেল ক্যামেরার চোখের নাগালে।

ট্রানজিসটরাইজড করা আছে ক্যামেরাটা, আবার ঘরে ঢুকে দুই সঙ্গীকে বলল কিশোর। ব্যাটারিতে চলে। দূরত্ব খুব বেশি না, তবে আমাদের কাজের জন্যে যথেষ্ট।

সদর দরজা বন্ধ করে দিল কিশোর। একটা বুককেসের ওপর রাখল টেলিভিশনটা। বৈদ্যুতিক লাইনের সঙ্গে কানেকশন করে দিয়ে ডায়াল ঘোরাল।– সেকেণ্ডখানেক পরেই আবছা আলো দেখা গেল পর্দায়, কাঁপছে।

কই? বলে উঠল মুসা, কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না!

যাবে, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। চত্বরে আলো জ্বলে উঠলেই দেখতে পাবে। 

মিনিট কয়েক পরেই দপ করে জ্বলে উঠল আলো। উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ওরা টেলিভিশনের পর্দার দিকে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পুরো চত্বরটী। নির্জন।

প্রথমে টমি গিলবার্টকে দেখা গেল। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পাশের সরু গলি ধরে চলে গেল। ফিরে এল খানিক পরেই। হাতে একটা লন্ড্রি ব্যাগ। আবার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল সে।

তারপর দেখা গেল একটা মেয়েকে, সোনালি চুল। সামনের গেট দিয়ে চত্বরে ঢুকল।

লারিসা ল্যাটনিনা, বললেন অলিভার।

গটগট করে নিজের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল লারিসা। চাবি বের করে তালায় ঢোকাল। ঠিক এই সময় তার পেছনে এসে উদয় হল মিসেস ডেনভার। হাতে ছোট একটা প্যাকেট।

নিশ্চয় ডাকে এসেছে, কিংবা কেউ দিয়ে গেছে প্যাকেটটা, বললেন অলিভার। লারিসার জন্যে। ভাড়াটেরা যখন বাড়ি থাকে না, তাদের কোন জিনিস এলে সই করে রেখে দেয় ম্যানেজার। এটা তার দায়িত্ব।

নিশ্চয় কাজটা তার খুব পছন্দ, বলল মুসা।

ঠিক ধরেছ, বললেন অলিভার। চুরি করে খুলে দেখে নিশ্চয়। ভাড়াটেদের সম্পর্কে জ্ঞান আরও বাড়ে তার। বদস্বভাব!

প্যাকেটটা লারিসার হাতে তুলে দিয়েছে ম্যানেজার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নিশ্চয় জানতে চাইছে ভেতরে কি আছে।

হতাশ একটা ভঙ্গি ফুটল লারিসার হাবভাবে। হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে, প্যাকেটের মোড়ক খুলতে শুরু করল।

এই সময় নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল জ্যাকবস। থেমে দাঁড়াল। লারিসা আর মিসেস ডেনভার কি করছে, দেখছে।

লোকের গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই এ-বাড়িতে! বলেই ফেলল মুসা।

বিরক্তিতে মুখ বাঁকালেন অলিভার। ওই বুড়িটার কথা কেন শুনছে লারিসা! দেখাব না, বলে মানা করে দিলেই হত! খুব বেশি সরল।

মোড়ক খুলে ফেলেছে লারিসা। একটা টিনের বাক্স। ডালা খুলল। হাসি ফুটল তার মুখে। দুই আঙুলে কিছু একটা বের করে এনেই মুখে ফেলল। মিসেস ডেনভারকেও সাধল। মাথা নাড়ল ম্যানেজার।

চকলেট, বলল কিশোর।

খামোকা সাঁতার কাটে! বললেন অলিভার। অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া বাদ। দিলেই হয়ে যেত। মোটা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকত না আর।

বাক্স থেকে আরেকটা চকলেট বের করে মুখে ফেলল লারিসা। ডালা বন্ধ করল। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে গলার কাছে উঠে এল তার হাত। বাক্সটা খসে পড়ে গেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল চকলেটগুলো।

আরে…! কথা আটকে গেল মুসার।

টলে উঠল লারিসা। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল। পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। হাত-পা ছুঁড়ছে, মোচড়াচ্ছে শরীরটা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তিন কিশোর। হ্যাঁচকা টানে সদর দরজা খুলে ফেলল কিশোর, বেরিয়ে এল। এক এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি টপকে নেমে চলল নিচে।

মিস ল্যাটনিনা! কানে আসছে ম্যানেজারের শঙ্কিত কষ্ঠ। কি হয়েছে?

ব্যথা! গুঙিয়ে উঠল লারিসা। জ্বলে যাচ্ছে…ওহহ!…মাগো…

ছুটে এসে দাঁড়াল কিশোর। নিচু হয়ে একটা চকলেট তুলে নিল। পাশে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন। অলিভার এলেন। হাঁপাচ্ছেন তিনি।

তীক্ষ্ণ চোখে চকলেটটা দেখল কিশোর। নাকের কাছে তুলে এনে শুকল। ফিরে চাইল।

লারিসার ওপর ঝুঁকে বসেছে জ্যাকবস। টমি গিলবার্টও বেরিয়ে এসেছে। বেরোচ্ছে ব্রায়ান এনড্রু।

কিশোরের হাত খামচে ধরল মিসেস ডেনভার। কি…কি আছে ওটাতে?

তালুতে রেখেই চাপ দিয়ে চকলেটটা দলে-মুচড়ে ফেলল কিশোর। আবার। নিয়ে এল নাকের কাছে। শুকল। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি! জলদি অ্যামবুলেন্স ডাকুন! মনে হয় বিষ খাওয়ানো হয়েছে মিস ল্যাটনিনাকে!

Super User