প্রেম ও স্বপ্ন – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার

০১.

মাহবুব সাঁতার প্রতিযোগীতায় তিনটে স্বর্ণপদক পেয়ে স্টেডিয়াম থেকে বেরোবার সময় গেটে প্রচণ্ড ভীড়ের সম্মুখীন হল। কয়েকশো ছেলে-মেয়ে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য তাকে ঘিরে ধরেছে। বন্ধু মাসুমের সাহায্যে অটোগ্রাফ দিতে দিতে কোনো রকমে ভীড় ঠেলে যখন রাস্তায় এসে রিকশায় উঠবে, ঠিক তখনই মাহবুবা নোটবুক খুলে এগিয়ে ধরল।

মাহবুব তার মুখের দিকে এক পলক তাকাতে গিয়ে দৃষ্টি আটকে গেল। এত সুন্দর মুখ আর কখনো দেখেনি। মাসুমের কুনুইয়ের গুঁতো খেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অটোগ্রাফ দিল।

প্লীজ, বাসার ঠিকানাটা দিন।

মাহবুব রাগতে গিয়ে পারল না। তার মনে হল কেউ যেন কানে মধু ঢেলে দিল। মুখের দিকে না তাকিয়ে পারল না। ফলে চোখে চোখ পড়ে গেল। চোখ নয় যেন প্রেমের সাগর। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আমি মেসে থাকি।

মেসের ঠিকানাই দিন।

মেয়েটার কণ্ঠস্বর বার-বার মাহবুবের কানে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই ঠিকানা লিখে দিল।

মাহবুবা নোট বুক নেওয়ার সময় ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনাদেরকে লিস্ট দিতে চাই।

মাহবুব স্মিত হাস্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, মাফ করবেন, আমি আপনার অফার গ্রহণ করতে পারছি না। তারপর রিকশায় উঠে বসল।

মাসুম আগেই উঠে বসেছিল, মাহবুব বসার পর রিকশাওয়ালাকে যেতে বলল।

রিকশা কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর মাসুম পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটা তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে কুনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে কথাটা মাহবুবকে বলে বলল, মনে হয় মাইণ্ড করেছে।

মাহবুব বলল, তা করতে পারে। তাই বলে তার কথা আমাকে শুনতে হবে না কি?

মাসুম বলল, যাই বলিস, মেয়েটা দেখতে কিন্তু দারুণ। এত সুন্দরী মেয়ে জীবনে আর কোনো দিন দেখিনি। মেয়েটার কথা শুনে ও ড্রেস দেখে মনে হচ্ছে, নিশ্চয় ধনীর দুলালী।

মাহবুব একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তাতে আমার কি? তুইও তো ধনী পুত্র। যদি মনে ধরে থাকে ফিরে গিয়ে আলাপ কর।

আমি তো আর তোর মতো সুঠাম দেহের অধীকারী সুপার স্টার নই, আর সাঁতারে তিনটে স্বর্ণপদকও পাইনি।

তুই চুপ করবি, না রিকশা থেকে নামিয়ে দেব?

ঠিক আছে, এই চুপ করলাম বলে মাসুম গম্ভীর হয়ে বসে রইল। কিন্তু বেশিক্ষন চুপ করে থাকতে পারল না। বলে উঠল, দোস্ত, সত্যি বলছি, আমার দিকে কোনো মেয়ে ঐ ভাবে তাকালে নির্ঘাৎ মোমের মতো গলে যেতাম। তোর দিলটা আল্লাহ যে কী দিয়ে। তৈরী করেছে না, তা তিনিই জানেন।

মাহবুব রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই যে ভাই থামান।

মাসুম রিকশাওয়ালাকে থামাতে নিষেধ করে মাহবুবের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, এত নির্দয় হসনি দোস্ত। কি জানিস, মেয়েটা তোর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখছে। আর তুইও তো বাপু তার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলি।

মাহবুব খুব বিরক্ত বোধ করলেও হেসে ফেলল। বলল, তুই কখনো পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করেছিস? তুই তো কেমেস্ট্রির ছাত্র, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠার ঘন্টা বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকিস, চাঁদের সৌন্দর্য দেখার সময় তোর কোথায়?

তা ঠিক, তবে পূর্ণিমার চাঁদ অনেকবার দেখেছি। সত্যি বলতে কি, মেয়েটার মুখটাও ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো।

মাহবুব আবার হেসে ফেলে বলল, কেমেস্ট্রির ফরমূলা মুখস্থ করতে করতে সত্যিই তোর ব্রেন আউট হয়ে গেছে। নচেৎ একবার আমাকে আবার একবার মেয়েটাকে পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে তুলনা করতিস না। লুকিং গ্লাসে নিজের মুখ ভালো করে দেখবি। নিজের মুখকেও তাই মনে হবে।

মাসুমের গায়ের রং শ্যামলা। তাই মুখ ভার করে বলল, আমি কালো, তাই কোনো মেয়ে আমার দিকে তাকায় না। কিন্তু তুই একথা বলতে পারলি?

মাহবুব বলল, কথা প্রসঙ্গে রসিকতা করে বললাম, তুই মাইণ্ড করবি জানলে বলতাম না। ঠিক আছে, আর কখনো এরকম রসিকতা করব না মাফ করে দে।

মাসুম ভনিতা করে কথাটা বলেছিল। মাহবুবের কথা শুনে বলল, মাফ করতে পারি, যদি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিস।

বল কি জানতে চাস।

মেয়েটা অত্যন্ত সুন্দরী এটা ঠিক কিনা তোকে বলতে হবে?

মাহবুব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ তোর কথাই ঠিক, মেয়েটার মুখ যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতো।

মাসুম তার পিঠ চাপড়ে বলল, এইতো দোস্ত, সেই ঘাটের পানি খেলি, তবে ঘোলা করে।

ততক্ষনে তারা মেসে পৌঁছে গেল।

তারা দয়াগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে স্বামী বাগে একটা মেসে থাকে। মেসটার মোট ছয়টা রুম। প্রত্যেক রুমে চারটে করে সিট। এখানে যারা থাকে তারা সবাই চাকরি করে। শুধু মাসুম ও মাহবুব ছাত্র। তারা দু বন্ধুতে মিলে একটা রুমে থাকে। মাহবুব ইংলিশে আর মাসুম কেমেস্ট্রিতে মাষ্টার্স করছে।

রুমে ঢুকে মাসুম বলল, মেয়েটা তোর ঠিকানা কেন নিল কিছু বুঝতে পারছিস?

কেন পারব না? মনে করেছিল আমি হয়তো কোনো বড় লোকের ছেলে। মেসে থাকি শুনে তো আর না করতে পারে না তাই সেটাই দিতে বলল।

আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হচ্ছে।

কি কথা শুনি।

তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।

তুই বড় ফালতু কথা বলিস।

দেখিস আমার ফালতু কথাটাই একদিন তোর কাছে দামি হয়ে দাঁড়াবে।

যখনকার কথা তখন ভাবা যাবে এবার তুই থাম, সেই কখন থেকে বক বক করছিস।

.

পরের দিন কাগজে কষ্টিউম পরা ও মেডেল গলায় মাহবুবের ফটো ছাপা হয়েছে। মাহবুবা অনেক্ষণ ফটোর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাবার রুমে গেল।

আনিস সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন। শামীমা বেগম স্বামীর গায়ে কোট পরিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়েকে দেখে বললেন, কিছু বলবি?

মাহবুবা কাগজটা খুলে তাদের সামনে ধরে বলল, যে ছেলেটার কথা তোমাদের সঙ্গে প্রায় আলাপ করি, এই সেই ছেলে। জান বাবা, সাঁতারে তিনটে স্বর্ণ পদক পেয়েছে।

আনিস সাহেব কাগজটা নিয়ে মাহবুবের ছবির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, ছেলেটাতো দেখতে দারুন। তা ওকে একদিন বাসায় নিয়ে আয় আলাপ করা যাবে।

শামীমা বেগম স্বামীর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ভালো করে দেখে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর ছেলেতো, হ্যাঁ, তাই নিয়ে আসিস।

কি যে বল না তোমরা, ওর সঙ্গে এখনো ভালভাবে পরিচয়ই হয়নি, নিয়ে আসব কি করে?

পরিচয় করিসনি কেন?

ওর পাত্তাই পাওয়া যায় না।

 তুই তো বলেছিলি ও ভার্সিটিতে পড়ে, তা হলে পাত্তা পাচ্ছিসনা কেন?

ভার্সিটিতে কত হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পড়ে তাদের মধ্যে একজনের পাত্তা পাওয়া কঠিন নই কি?

তা কঠিন, তবে চেষ্টার দ্বারা কঠিনকে সহজ করা যায়।

চেষ্টার ত্রুটি করছি না। কাল চান্সও পেয়েছিলাম; কিন্তু সফল হতে পারিনি।

কেন?

মাহবুবা কালকের ঘটনাটা বলল।

আনিস সাহেব বললেন, ছবি দেখেই মনে হচ্ছে ছেলেটার একটা ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট রয়েছে। এই ধরনের ছেলেরা খুব সেন্টিমেন্টাল হয়। এখন যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।

শামীমা বেগমও ব্রীফকেসটা হাতে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় বয়স্ক ড্রাইবার দাঁড়িয়েছিল। বেগম সাহেবের হাত থেকে ব্রীফকেসটা নিয়ে আগে আগে চলে গেল। শামীমা বেগম বললেন, ছেলেটা কিন্তু দারুন, মাহবুবার সঙ্গে যা মানাবে না?

আনিস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তোমার সঙ্গে আমিও একমত। তবে আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, অল দ্যাট গীটার ইজ নট গোল্ড।

তাতো বটেই। আমরা যাচাই করেই এগোবো। তারপর স্বামী গাড়িতে উঠে বসার পর বিদায় সম্ভাসন জানালেন। গাড়ি গেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফিরে এলেন।

মাহবুবাও তাদের পিছনে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা-বাবার দিকে তাকিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে, প্রতিদিন মা বাবাকে গাড়িতে তুলে বিদায় দেওয়ার দৃশ্য। কখনো মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া, কথা কাটা-কাটি তো দুরের কথা, মাকে অভিমান করতেও দেখেনি। তার মনে হল মা-বাবার মতো সুখী দম্পত্তি বোধ হয়। সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

শামীমা বেগম ফিরে এসে মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, কিরে কি ভাবছিস? চল ঘরে চল। তারপর যেতে যেতে বললেন, ছেলেটার খোঁজ খবর নিয়ে পরিচয় কর। তারপর একদিন নিয়ে আসবি।

চেষ্টার ত্রুটি করব না বলে মাহবুবা নিজের রুমে চলে গেল।

.

রাত্রে ঘুমোবার সময় মাহবুবের হঠাৎ রিকশায় ওঠার সময় যে মেয়েটা অটোগ্রাফ নিয়ে লিফট অফার করেছিল, তার কথা মনে পড়ল। ফেরার পথে রিকশায় মাসুমের কথা শুনে বিরক্ত ভাব দেখালেও মনে মনে খুশি হয়েছিল। এখন সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখল, সে ক্লাস শেষে বাস ধরবে বলে ফুটপাত ধরে হেঁটে নীলক্ষেতে যাচ্ছিল। এমন সময় একটা প্রাইভেট কার তার সামনে ফুটপাত ঘেঁসে দাঁড়াল। মাহবুব সে দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে লাগল। গাড়িটা ক্রস করে যাওয়ার সময় শুনতে পেল, মাহবুব সাহেব একটু দাঁড়ান।

মাহবুব অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিল বলে গলার স্বর চিনতে পারল না। চার বছর ভার্সিটিতে পড়ছে, কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় নেই। তাই আজ হঠাৎ কোনো মেয়েকে তার নাম ধরে ডাকতে শুনে অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

মাহবুবা ততক্ষনে গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবের সামনে এসে বলল, চিনতে পারছেন?

মাহবুব তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

 কোথায় যাবেন? আসুন না আপনাকে পৌঁছে দিই।

ধন্যবাদ বলে মাহবুব হাঁটতে শুরু করল।

মাহবুবা পথ আগলে বলল, আপনি আচ্ছা ছেলে তো, আমি আপনাকে লিফট দিতে চাইলাম, আর আপনি কিছু না বলে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন?

মাহবুব থমকে দাঁড়িয়ে বলল, এভাবে কতজনকে লিফট দিয়েছেন?

মাহবুবা মাহবুবের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ছল ছল চোখে বলল, বললে বিশ্বাস করবেন?

সেটা আমার ব্যাপার, বলেই দেখুন।

আপনাকেই প্রথম।

এমন সময় ফজরের আযান শুনে মাহবুবের ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নের আমেজ নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। তারপর উঠে বাথরুমের কাজ সেরে মাসুমকে জাগিয়ে নামাজের কথা বলে মসজিদে গেল।

.

বেশ কিছু দিন পরের ঘটনা মেয়েটির কথা মাহবুব এক রকম ভুলেই গিয়েছিল। আজ ভার্সিটিতে ক্লাস করে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে আসার সময় মুখোমুখি দেখা।

কয়েক সেকেণ্ড একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রথমে মাহবুবা সালাম দিয়ে। বলল, চিনতে পারছেন?

মাহবুবের তখন স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ পারছি।

আর বোধ হয় ক্লাস নেই?

 এবারে মাহবুব ঘাড় নেড়ে না সূচক সায় দিল।

আমারও নেই। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই।

ধন্যবাদ বলে মাহবুব হাঁটতে শুরু করল।

মাহবুবা পথ আগলে বলল, আপনি আচ্ছা ছেলেতো, আমি আপনাকে লিফট দিতে চাইলাম, আর আপনি কিছু না বলে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন?

মাহবুব থমকে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এর আগে কতজনকে লিফট দিয়েছেন?

মাহবুবাও তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেইভাবে আরো কয়েক সেকেন্ড থেকে ছল ছল চোখে বলল, বললে বিশ্বাস করবেন?

সেটা আমার ব্যাপার, বলেই দেখুন।

আপনাকেই প্রথম। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে জিজ্ঞেস করল বিশ্বাস হল কিনা বলবেন না?

গত রাতের স্বপ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যেতে দেখে মাহবুব আরো বেশি অবাক হল। চোখে পানি দেখে বুঝতে পারল, মেয়েটা সত্য বলেছে। বলল, হয়েছে।

তা হলে লিফটা নিশ্চয় গ্রহণ করবেন?

 মাহবুব চলতে শুরু করে বলল, কিন্তু আমি তো এখন বাসায় যাব না।

মাহবুবাও তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, যেখানে যাবেন সেখানেই লিফট দেব। আমাকে লিফট দিয়ে আপনার কি লাভ? তা ছাড়া আপনি বললেই যে আমি গ্রহন করব, তা ভাবলেন কি করে?

গ্রহন করা না করা আপনার ব্যাপার, আর লাভের কথা যে বললেন, তা জানতে হলে আপনাকে আমার প্রস্তাব গ্রহন করতে হবে।

মাহবুব ক্ষণকাল চিন্তা করে বলল, একজন অপরিচিতকে গাড়িতে তোলা কী ঠিক হবে?

সেটা আমার ব্যাপার। এভাবে কথা না বলে গাড়িতে যেতে যেতে বললে ভালো হত না? আমি তো আর সন্ত্রাসী নই যে, আপনাকে কীডন্যাপ করব।

মাহবুবার কথাবার্তায় মাহবুব অভিভূত হল। জিজ্ঞেস করল, আমার পরিচয় জানেন?

না, জানার জন্যই তো চেষ্টা করছি।

কেন জিজ্ঞেস করতে পারি?

আগে গাড়িতে উঠুন তারপর বলব।

যদি বলি না?

 মাহবুবা ম্লান মুখে বলল, তাহলে বুঝব আমার দুর্ভাগ্য।

তার ম্লান মুখ দেখে মাহবুবের দিলটা মোচড় দিয়ে উঠল। বলল, ঠিক আছে চলুন।

মালিক কন্যার সাথে একজনকে আসতে দেখে ড্রাইভার নেমে পিছনের গেট খুলে দিল। মাহবুব বসার পর বন্ধ করে অন্য পাশের গেট খুলে দিল। মাহবুবা বসে ড্রাইভারকে বলল, বাসায় চলুন।

মাহবুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, বাসায় মানে?

মাহবুবা মৃদু হেসে বলল, বাসায় মানে আমাদের বাসায়। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কীড ন্যাপ করলেও মুক্তিপণ দাবি করব না।

মাহবুব রেগে গিয়ে গম্ভীর হয়ে রইল।

মাহবুবা তা বুঝতে পেরে বলল, প্লীজ আমাকে ভুল বুঝে রাগ করবেন না।

আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন?

অনেক কিছুই করতাম, কারণ আমি মেয়ে। আর আপনি——-

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাহবুব বলল,থাক আর বলতে হবে না। তারপর বলল, এখন পর্যন্ত নামটাও বললেন না।

ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন। মাহবুবা সুলতানা। সবাই মাহবুবা বলে ডাকে।

নাম শুনে মাহবুবের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, জিজ্ঞেস করল, নামের অর্থ জানেন।

না।

এ কেমন কথা, নিজের নামের অর্থ জানেন না।

আপনার জানা থাকলে প্লীজ বলে দিন না।

 মাহবুবার অর্থ প্রেমিকা বা প্রীয়া, আর সুলতানার অর্থ সম্রাজ্ঞী।

আপনার পুরো নামটা বলুন। সেদিন অটোগ্রাফ দেখে ঠিক বুঝতে পারিনি।

মাহবুব হাসান।

কি বললেন।

মাহবুব হাসান।

সত্যি বললেন, না জোক করছেন?

আমি কখনো মিথ্যা বলি না। এমন কি মিথ্যা জোকও করি না। কারণ মিথ্যা বলা মহাপাপ। মুসলমানদের জন্য হারাম।

ঠিক আছে রাগ করবেন না। নামের অর্থ বলুন।

 মাহবুব অর্থ প্রেমাষ্পদ বা প্রেমিক, আর হাসান অর্থ সুন্দর।

মাহবুবা নামের অর্থ শুনে আনন্দিত হলেও লজ্জা পেয়ে আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।

মাহবুব সামনে একটা মসজিদ দেখতে পেয়ে হাত ঘড়িতে টাইম দেখে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ঐ মসজিদের কাছে গাড়ি থামাবেন।

ড্রাইভার থামাবার পর গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবার দিকে তাকিয়ে নামায পড়ে আসছি বলে চলে গেল।

মাহবুবা মাহবুবকে নিয়ে যখন বাসায় পৌঁছাল তখন প্রায় আড়াইটা। বাবা যে লাঞ্চ খেতে ফিরেছে তার গাড়ি দেখে বুঝতে পারল। মাহবুবকে ড্রইংরুমে বসিয়ে এক্ষুণী আসছি বলে মাহবুবা ভিতরে চলে গেল।

মাহবুব অনুমান করেছিল, মাহবুবা ধনী কন্যা। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি ও বাড়ির চার পাশের পরিবেশ ও ড্রইং রুমের আসবাব পত্র দেখে মনে হল শুধু ধনী নয়, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনীদের অন্যতম। ড্রইংরুমটা বেশ বড়। চার পাশের দেওয়ালে শ্রেষ্ঠ মনিষিদের তৈল চিত্র আর বেশ কিছু বিদেশের সিন-সিনারী।

মাহবুবা বাবার ঘরে গিয়ে দেখল, বাবা ড্রেস চেঞ্জ করছে, আর মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

শামীমা বেগম মেয়েকে দেখে বললেন, তুই ফিরেছিস, যা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আয়। বাবার সঙ্গে খেয়ে নিবি।

মাহবুবা বলল, চেঞ্জ পরে করব। আগে ড্রইংরুমে চল। তোমাদেরকে যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম, তাকে নিয়ে এসেছি।

আনিস সাহেব বললেন, তাই নাকি? তার খোঁজ পেলি কি ভাবে?

সে কথা পরে শোনো, এখন ড্রইংরুমে চলো, পরিচয় করিয়ে দিই। তারপর খাওয়া দাওয়া করা যাবে।

মিনিট পাঁচেক পরে মাহবুবা মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রইংরুমে এল।

 মাহবুব দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

আনিস সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেরাও বসলেন। তারপর মাহবুবের থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে চিন্তা করলেন, এরকম ছেলেই এ বাড়ির জামাই হওয়ার উপযুক্ত। বললেন, আমরা মাহবুবার মা-বাবা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন কি নাম আপনার?

মাহবুব হাসান।

দেশের বাড়ী?

রং পুর—-

 কে কে আছেন?

শুধু মা-বাবা। এক বোন ছিল তার বিয়ে হয়ে গেছে।

পড়াশোনা শেষ করার পর কি করবেন ভেবেছেন?

 গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র জনসাধারনের উন্নতি করাই আমার জীবনের লক্ষ্য।

নিজের উন্নতির কথা চিন্তা করেন না।

যারা দশের চিন্তা করে, আল্লাহ পাক তাদের উন্নতির পথ করে দেন।

আল্লাহ তো মানুষকে চেষ্টা করতে বলেছেন।

দেখুন উন্নতি বলতে আপনারা ব্যবসা-বানিজ্য, বাড়ি-গাড়ি ও ভোগ-বিলাস বোঝেন। আর এ জন্য দেশ ও দশের সার্থের দিকে না তাকিয়ে শুধু নিজের সার্থ সিদ্ধির জন্য যে কোনো অন্যায়ের প্রশ্রয়ও নিয়ে থাকেন। আমি কিন্তু বুঝি, মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং অশিক্ষিতদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। আর এটা করাই প্রত্যেক শিক্ষিত ও সামর্থবানদের উচিত বলে আমি মনে করি।

আনিস সাহেব অসন্তুষ্ট হলেও মুখে প্রসন্ন ভাব বজায় রেখে বললেন, আপনার কথাগুলো খুব ভালো, তবে তা শুধু বই পুস্তকের পাতাতেই মানায়। বাস্তবে এর কোনো নজীর আছে বলে মনে হয় না। এ কথাটা বোধ হয় চিন্তা করেন নি, ব্যবসায়ীরা ও মিল মালিকেরা তাদের প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে চাকরী দিয়ে তাদের জিবীকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, এটা করে তারা কি দেশের ও দশের উপকার করছেন না?

মাহবুব বলল, নিশ্চয় করছেন, তবে তা শহর ভিত্তিক ও শিক্ষিত মানুষের জন্য। শহরের চেয়ে গ্রামে অধীক মানুষ বাস করে। তারা দরিদ্র ও অশিক্ষিত। তাদের জন্যও তো কিছু করা উচিত।

তা উচিত, তবে সে জন্যে প্রচুর অর্থের দরকার। আপনার কী তা আছে?

গ্রামের সাধারন মানুষের যা থাকে আল্লাহর রহমতে আমারও তাই আছে। একটু আগে বললাম না, এ সব কাজে যারা অগ্রসর হয়, তাদেরকে আল্লাহ সব দিক থেকে সাহায্য করেন।

শুনেছি গ্রামের ভীলেজ পলিটিকস খুব প্রখর। তাদের ফাঁদে পড়ে অনেক ভালো ভালো লোক সর্বশান্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বসবাস করছে।

আপনি ঠিক কথা, বলেছেন। পলিটিকস সবখানে আছে। তবে গ্রামের সহজ সরল ও সাধারন মানুষকে কিছু সংখ্যক লোক হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। ধনীরা তাদের রক্ত চুষে নিচ্ছে। আমি তাদেরকে উদ্ধার করতে চাই।

আটষট্টি হাজার গ্রামের কয়টা মানুষকে আপনি উদ্ধার করবেন?

তা জানি না, তবে নিজের গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে জন্ম সার্থক হয়েছে মনে করব।

মাহবুবার সঙ্গে আপনার পরিচয় কত দিনের?

কত দিনের মানে? এখনো ভালোভাবে পরিচয়ই হয়নি।

একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে তাদের বাসায় এলেন কি করে?

মাহবুব সাঁতার প্রতিযোগীতার দিনের ও আজকের ঘটনার কথা বলে ঘড়ি দেখে বলল, মাফ করবেন, এবার আমাকে উঠতে হবে। এই কথা বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আনিস সাহেব ও শামীমা বেগম এক সঙ্গে বলে উঠলেন, সে কি? না খেয়ে যাবেন? না না তা হতে পারে না। আপনি এসেছেন শুনে আমরা না খেয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। আমাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন।

মাফ করবেন তা সম্ভব নয়। তার পর বলল, আপনাদের মেয়ের মাথায় একটু গোলমাল আছে। বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। কথা শেষ করে সালাম দিয়ে চলে গেল।

মাহবুবা তার পিছনে যেতে যেতে বলল, প্লীজ মাহবুব সাহেব, যাবেন না, দাঁড়ান।

আনিস সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওকে যেতে দে।

মাহবুবা মা-বাবার কথা কোনো দিন অমান্য করেনি। আজও করল না। ফিরে এসে ছল ছল চোখে ভিজে গলায় বলল, ওঁর এখনো খাওয়া হয়নি বাবা। ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে ধরে এনেছিলাম।

আনিস সাহেব মেয়েকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তাতে কি হয়েছে মা? বাসায় গিয়ে খাবেন। আমরাওতো এখনো খাইনি। ছেলেটা ঠিকই বলে গেল, তোকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াই উচিত। তারপর স্ত্রীকে বললেন, চল। খেতে দেবে।

খেতে বসে মাহবুবা যে সামান্য খেয়ে উঠে গেল, তা আনিস সাহেব দেখেও দেখলেন না। শামীমা বেগম মেয়েকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন আনিস সাহেব ইশারা করে থামিয়ে দিলেন।

মেয়ে চলে যাওয়ার পর বললেন, ছেলেটা না খেয়ে চলে গেছে তাই মাহবুবা খেতে পারল না, এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না?

তা আর পারিনি। কিন্তু তাই বলে মেয়েকে খাওয়ার কথা বলব না? তারপর সামান্য খেয়ে তিনিও উঠে পড়লেন।

আনিস সাহেব গাড়ি ও গাড়ির পার্ডসের ইম্পোর্টের ব্যবসা করেন, দেশের বিভিন্ন শহরে অফিস ও শোরুম। মতিঝিলে হেড অফিস, মাহবুবাই তার এক মাত্র সন্তান। তিনি এমন একটা ছেলের সন্ধানে আছেন, যাকে জামাই করে এই ব্যবসার দায়িত্ব দেবেন। তাই মেয়ে মাহবুবের মতো সুন্দর ছেলেকে পছন্দ করেছে জেনে প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যখন জানতে পারলেন, সে আদর্শবান ও ধামকি তখন খুব চিন্তিত হলেন। খাওয়া দাওয়ার পর অফিসে এসে চিন্তা করতে লাগলেন, মাহবুবা যাকে পছন্দ করেছে তাকে ডিনাই করা কিছুতেই চলবে না। কিন্তু ঐ ছেলে কি আমাদের কথা মতো চলবে? বিয়ে করে মাহবুবাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে। মাহবুবা কি সেখানে থাকতে পারবে? তার চেয়ে গালিবই ভালো।

গালিব ম্যানেজারের ছেলে। বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ারীং পাশ করে ফিরেছে। দেখতে খুব সুন্দর। স্বাস্থ্যও ভালো। খুব স্মার্ট ছেলে। আনিস সাহেব তাকে খুলনা অফিসের ম্যানেজার পদে নিয়োগ করেছেন। ভেবে রাখলেন, গালিবের কথা বলে মেয়ের মন তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন।

বিকেলে চায়ের টেবিলে মাহবুবা মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, মাহবুবকে দেখে তোমাদের কেমন মনে হল। তারপর বলল, জান বাবা, উনি শুধু ভালো সাঁতারু নন, একজন দক্ষ সুটার ও ফাইটারও।

শামীমা বেগমের মাহবুবকে দেখে ভীষন পছন্দ হয়েছিল? কিন্তু সে গ্রামের এক সাধারন ঘরের ছেলে জেনে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই স্বামী কি বলে শোনার জন্য অপেক্ষা করুতে লাগলেন।

 আনিস সাহেব গালিবের কথা ভাবছিলেন, কিভাবে তার কথা ওঠাবেন চিন্তা করতে লাগলেন।

মা-বাবা কিছু বলছে না দেখে মাহবুবা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, তোমরা কিছু বলছ না কেন? মেয়ের কথা শুনে আনিস সাহেব বললেন, ছেলেটার সব কিছু ভালো, তবে খুব আদর্শবান। ধার্মিক বলেও মনে হল। দেখলি না, কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেয়। এই। ধরনের ছেলেরা জীবনে উন্নতি করতে পারে না।

স্বামী থেমে যেতে শামীমা বেগম বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে এক মত। তা ছাড়া ও গ্রামের একটা সাধারন ঘরের ছেলে। আমাদের জামাই হওয়ার মোটেই উপযুক্ত নয়।

আনিস সাহেব বললেন, ওর থেকে আমাদের ম্যানেজারের ছেলে গালিব অনেক ভালো।

শামীমা বেগম বললেন, গালিবের সব কিছু ভালো হলেও তার চোখ আমার একদম পছন্দ নয়। শরীরের তুলনায় চোখ দুটো খুব ছোট। এরকম হাতি চোখা ছেলেকে আমি একদম পছন্দ করি না।

মাহবুবা বলল, আমি তোমাদের কথা অস্বীকার করছি না। তোমাদের মতের বিরুদ্ধেও কিছু করব না, তবে মাহবুবকে যদি আমাদের ফ্যামীলির উপযুক্ত করে নিতে পারি, তা হলে?

আনিস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।

মাহবুবা বলল, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। আমি মাহবুবকে তোমাদের উপযুক্ত করে নেবই। আমি যা বলি তা যে করেই থাকি, তা তো তোমরা জানই।

Super User