০২.
বেলা প্রায় একটা। তখন আষাড়ের শেষ। সুলতান খাঁন ছাতা মাথায় দিয়ে জমির আলের উপর বসে আছেন। দশ বার জন কামলা জমিতে আমন ধানের চারা বপন করছে। হাত ঘড়ি দেখে কামলাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার কাজ রেখে দিন। একটু পরে আজান হবে। বাড়ি গিয়ে নামাজ ও খাওয়া দাওয়ার পর এসে কাজ করবেন। কথা শেষ করে তিনি বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন।
সুলতান খাঁনের যারা কাজ করে, তারা জানে তিনি সব সময় তাদের কাজের। তদারকি করলেও নামাযের সময় হলে সবাইকে নামায পড়তে বলে নিজেও পড়বেন। যদি জানতে পারেন কামলাদের মধ্যে কেউ বেনামাযী আছে, তা হলে তাকে নামায না পড়লে কি হয় এবং পড়লে কি হয় প্রথমে বোঝাবেন। তারপরও যদি সে না পড়ে তা। হলে কাজ থেকে ছাটাই করবেন। এই ভাবে তিনি অনেক অশিক্ষিত কামলাদের নামায ধরিয়েছেন।
সুলতান খাঁন বাড়িতে ঢুকে জমিরনকে দেখে বললেন, তোর চাচি কোথায় রে মা?
জমিরন এই গ্রামেরই মেয়ে। তার স্বামী জব্বার খেটে খাওয়া মানুষ ছিল। তাদের একটাই মেয়ে। পাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে জব্বার জন্ডিসে মারা গেছে। জব্বার সুলতান খাঁনের কাছে বার মাস কামলা খাটত। স্বামী মারা যাওয়ার পর জমিরন যখন সুলতান খাঁনের পা জড়িয়ে বলল, চাচা, আমার যে কেউ রইল না, আমি কেমন করে দিন গুজরান করব। তখন সুলতান খাঁন বললেন, আল্লাহ তাঁর সমস্ত জীবকে আহার দিয়ে থাকেন। এটা কোরআন পাকের কথা। আজ থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। সেই থেকে জমিরন এ বাড়িতে রয়েছে।
চাচার কথা শুনে জমিরন বলল, চাচি রান্না করছে, আমি ডেকে দিচ্ছি।
মরিয়ম খাতুন প্রাইমারী পাশ মেয়ে হলেও স্বামীর সহচার্যে অনেক শিক্ষা পেয়েছেন। স্বামীর সাহায্যে মুসলিম মনিষি ও মনিষাদের জীবনী ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়ে আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ গৃহিনী ও আদর্শ মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাই স্বামীর কখন কি প্রয়োজন সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। প্রতিদিনের মতো আজও যোহরের আযান শুনে হাত পাখা, সর্ষের তেলের বাটি, লুঙ্গি ও গামছা হাতের কাছে। রেখে রান্না করছিলেন। স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় জমিরনকে দেখে বললেন, তরকারীটা হতে একটু বাকি, নুন চেখে নামিয়ে নিস। তারপর স্বামীর কাছে এসে সালাম দিলেন।
সুলতান খাঁন ততক্ষণে বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে কোনোদিন আগে সালাম দিতে পারলাম না। আগন্তুক আগে সালাম দিবে এটাই ইসলামের নিয়ম।
মরিয়ম খাতুন মৃদু হেসে বললেন, তা আমিও জানি। আরো জানি, যে আগে সালাম দিবে, তার সওয়াব উত্তর দাতার চেয়ে নব্বইগুন বেশি। তারপর হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললেন, ঐ দিন কোরআনের তফসীর পড়ার সময় দেখলাম
আল্লাহ পাক বলিয়াছে, তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে অগ্রসর হও।
সুবহান আল্লাহ বলে সুলতান খাঁন বললেন, তুমি এত বখীল যে, প্রায়ই সে সওয়াব থেকে আমাকে বঞ্চিত কর।
মরিয়ম খাতুন বললেন, হাদিসে পড়েছি, সওয়াব হাসিলের জন্য কোনো কাজে অগ্রভূমিকা নিলে বখীলতা হয় না। এখন ওসব কথা থাক, গোসল করে আসুন। আজান হয়ে গেছে। আপনার তো আবার কিছুক্ষন সাঁতার না কাটলে গোসলই হয় না। কথা শেষ করে তেলের বাটিটা সামনে ধরলেন।
সূলতান খান ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল তেলের বাটিতে ডুবিয়ে প্রথমে নাকে, কানে ও নাভিতে দিলেন। তারপর হাতের চেটোতে তেল ঢেলে মাথার চাঁদিতে ঘষতে ঘষতে অন্য হাতে লুঙ্গি ও গামছা নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেলেন।
এই পুকুরটা খুব বড়। লম্বায় দুশ হাত, আর চওড়ায় একশো হাত। এটা সূলতান খানের দাদা বাদশা খান কাটিয়েছিলেন। আশ-পাশের পাঁচ-দশ গ্রামের মধ্যে খুব ধামিক ও দানশীল হিসাবে তার খুব সুনাম ছিল। দেখতেও খুব সুপুরুষ ছিলেন। ছয় ফুট লম্বা বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, মুখভরা চাপদাড়ি নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন দরবেশের মতো মনে হত। অবাল বৃদ্ধ বনিতা সালাম দিয়ে পথ ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তিনি সালামের উত্তর দিতে দিতে প্রত্যেকের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেন। নিঃস্ব ও গরিবদের প্রকাশ্যে ও গোপনে অকাতরে দান করতেন। কয়েকবার হজ্ব করেছেন। একশো বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করত না, এত বয়স হয়েছে। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে পর্যন্ত যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন মনে হত একজন বলিষ্ঠ যুবক যাচ্ছেন। এই বয়সেও দেড়মনি ধানের বস্তা একা মাথায় তুলে নিতে পারতেন। সামান্য কয়েক দিনের জ্বরে মারা যান। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। গ্রামের লোকজন গ্রীষ্মকালে পানির খুব কষ্ট পেত। তাই বেশ কিছু জমি বিক্রি করে এই পুকুর কাটান এবং পাড়ের চার দিকে চারটে পাকা ঘাট করেছেন। ফলে আর্থিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। তাতে তিনি কখনো দুঃখ অনুভব করেন নি। বরং যখন সমবয়সিরা বলতেন, বাদশা খান, এই পুকুর কাটাতে গিয়ে তুমি অভাব গ্রস্থ হয়ে পড়লে, কাজটা ঠিক করনি। এসব জমিদারের কাজ। তখন তিনি মৃদু হেসে বলতেন, কেন আমি একাজ করলাম তা যদি জানতে, তা। হলে এ কথা বলতে পারতে না। তোমরা তো জান না, মানুষের উপকারের জন্য কিছু করলে আল্লাহ খুশি হন। হাদিসে আছে আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে তাঁর সৃষ্ট জীবকে ভালবাসতে হবে।
পুকুরের চার দিকের পাড়ে নানারকম ফলের বাগান। বাদশা খান প্রতি বছর যখন পুকুরের মাছ ধরে বিক্রি করতেন তখন গ্রামের ধনী গরিব সকলের বাড়িতে মাছের ভেট পাঠাতেন। আর প্রতি মৌসুমে বাগানের ফল মূলও সবাইকে দিতেন। ছেলে রুস্তম খানও তাই করতেন। সুলতান খাঁনও বাপ দাদার প্রথা চালু রেখেছেন। বাদশা খানের লাঠি খেলার ভীষন সখ ছিল। প্রতি বছর বসন্তকালে বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাঠিয়ালদের দাওয়াত দিয়ে আনিয়ে লাঠি খেলা প্রতিযোগীতার আয়োজন করতেন। যিনি বিজয়ী হতেন, তাকে বেশ মোটা টাকা পুরস্কার দিতেন। তিনি নিজেও খুব ভালো লাঠিয়াল ছিলেন। তার আর একটা সখ ছিল সাঁতার কাটা। প্রতি বছর লাঠি খেলা প্রতিযোগীতার পর সাঁতারের প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নিজেও দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। ছেলে রুস্তম খানকেও লাঠিখেলা ও সাঁতারে দক্ষ করেছিলেন। রুস্তম খানের একমাত্র ছেলে সুলতান খাঁন, তিনি সুলতান খাঁনকেও লাঠিখেলা ও সাঁতারে দক্ষ করেছেন।
সুলতান খাঁন দাদা বাদশা খানের মত সুপুরুষ। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের অধীকারি, গায়ের রংও দাদার মতো। গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে দ্বিতীয় বাদশা খান বলে ডাকেন। সুলতান খাঁনের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়, নাম মাহফুজা। মাহফুজার ছয় বছরের ছোট মাহবুব। সুলতান খাঁনও ছেলে মেয়েকে লাঠিখেলা ও সাঁতার শিখিয়েছেন, মাহবুব ছোটবেলা থেকে দক্ষ সাঁতারু। একটু দুরন্ত ধরনের ছেলে। ছোট বেলা থেকেই এত বড় পুকুর একা একা সাঁতার কেটে এপার ওপার করত। সুলতান খাঁন যখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাঁতার কাটতেন তখন পাড়ার অবাল বৃদ্ধ বণিতা চার পাশে পাড় থেকে দেখত। মাহবুব ছিল পানির পোকা। ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটত। তার বয়স যখন পনের তখন থেকে সুলতান খাঁন ছেলের সঙ্গে সাঁতারে পাল্লা দিতে পারতেন না। ঢাকার ভার্সিটিতে পড়তে এসে প্রতিবছর সাঁতার প্রতিযোগীতায় ফাষ্ট হয়। সেই সাথে স্যুটিং ও কুংফুতে পারদর্শী হয়েছে। ছাত্র হিসাবেও খুব ভালো। তাই সুলতান খাঁন। তাকে উচ্চ ডিগ্রী নিতে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। মেয়ে মাহফুজা ও ভালো ছাত্রী। এস.এস. সি, পান করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ বাড়ী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। সাত আট মাইল দূরের গ্রামের একটা ভালো ছেলের সন্ধান পেয়ে সুলতান খাঁন তার বিয়ে দিয়ে দেন। তিনিও ছিলেন দাদার মতো দানি। তাই কোনো সঞ্চয় না থাকায় মেয়ের বিয়ের সময় কিছু জমি বিক্রি করেন। বংশ পরম্পরায় ফসলী জমি বারবার বিক্রি হওয়ায় সুলতান খাঁনের আগের মতো স্বচ্ছলতা নেই।
এই গ্রামের মীরেদের অবস্থা আগে খুব খারাপ ছিল। তারা এক সময় বাদশা খানের প্রজা ছিল। সেই বংশের আলাউদ্দিন মীরের অবস্থা এখন খুব ভালো। তার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা সবার ছোট। নাম তাহেরা। আলাউদ্দিন মীরের পাঁচ ছেলের তিন ছেলে বিদেশে চাকুরী করে। তিনিই এখন গ্রামের সেরা ধনী। সুলতান খাঁনের জমি তিনিই কিনেছেন। তার পুকুরটার দিকে আলাউদ্দিন মীরের অনেক দিনের লোভ। খানেদের অবস্থার অবনতি দেখে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।
একই গ্রামের ছেলে মেয়ে হিসাবে মাহবুব ও তাহেরা একে অপরকে ছোটবেলা থেকে চিনত। বড় হওয়ার পর তাহেরা মাহবুবকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সে কথা তাকে জানাতে পারেনি। মাহবুব যখন ইন্টারে তখন তাহেরা নাইনে পড়ে।
এক গ্রীষ্মের অপরাহ্নে চারিদিক রোদে খাঁ খাঁ করছে। চারিদিক নিস্তব্দ। লোক জন রাস্তা ঘাটে নেই। যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। লিচু গাছের তলায় একটা দুধেল গাই শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। তার সাত দিনের বাচ্চাটা একবার ছুটে রাস্তায় যাচ্ছে, আবার ছুটে মায়ের কাছে ফিরে আসছে। একটা ঘুঘু পাখি শিরিশ গাছের উঁচু ডালে বসে অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে। একটা কাঠ ঠোকরা বড় আম গাছের গুঁড়িতে বসে ঠোঁট দিয়ে গাছের গুঁড়িতে ঠক ঠক করে ঠোকর দিচ্ছে। তাহেরা তাদের কাঁচারী বাড়ির জানালার ধারে বসে এই সব দেখছে। আর একবার করে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। সময় পেলে প্রায় প্রতিদিনই সে এখানে বসে ভাবে, মাহবুবকে একা যেতে দেখলে ডেকে মনের কথা জানাবে। কিন্তু সব দিনই কেউ না কেউ তার সঙ্গে থাকে। মাহবুব তাদের কাঁচারী বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কলেজে যাতায়াত করে। আজ তাকে একা দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে দাঁড়াল। কাছে এলে বলল, মাহবুব ভাই তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মাহবুব বলল, কি কথা?
কাচারী বাড়িতে এসে বস, তারপর বলব।
মাহবুব সরল মনে তার সঙ্গে কাঁচারী বাড়িতে গিয়ে বসে বলল, এবার বল কি বলবে।
তাহেরা একটুখানি বস আসছি বলে ছুটে ভিতর বাড়িতে চলে গেল। পাঁচ মিনিট পরে দুতিন পদের মিষ্টি চানাচুর ও এক গ্লাস সরবত নিয়ে এসে বলল, তুমি কলেজ থেকে ফিরছ, এগুলো আগে খেয়ে নাও তারপর বলছি।
মাহবুব ভাবল, ওর কোনো ভাইয়ার হয়ত বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। মৃদু হেসে বলল, কি ব্যাপার? কোনো শুভ সংবাদ না কি?
তাহেরা সলাজ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি যা ভাবছ তা নয়; তবে বলে থেমে গেল।
কি হল থেমে গেলে কেন? তবে কি বলবে তো।
বলছি এগুলো আগে খেয়ে নাও।
মাহবুব প্রথমে সরবত খেল। তারপর দুটো মিষ্টি খেয়ে বলল, নাও এবার বল।
মাহবুব ভাই, একটা কথা তোমাকে জানাব বলে অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করছি, কিন্তু তোমাকে একাকি না পেয়ে বলতে পারিনি। অবশ্য চিঠি দিয়েও জানাতে পারতাম; কিন্তু সাহস হয়নি।
মাহবুব তাহেরার মনের কথা বুঝতে না পেরে বলল, বেশতো এখন বল।
তাহেরা লজ্জায় সরাসরি কথাটা বলতে না পেরে বলল, কি বলব, তুমি কী বুঝতে পারছ না?
মাহবুব অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বলবে, আমি কিভাবে বুঝব?
তাহেরা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে ভালবাসি। কথা শেষ করে আবার মাথা নিচু করে নিল।
তরুণ মাহবুব ভালবাসা কি জিনিস জানে না। মেয়েদের নিয়েও কখনো চিন্তা করেনি। তাহেরার কথা শুনে অবাক হল। কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তাহেরা মোটামুটি সুন্দরী। গায়ের রং শ্যামলা, স্বাস্থ্য দোহারা, লম্বায় পাঁচ ফুট, চোখ দুটো বেশ বড় বড়। নাকটা খাড়াও নয় ধ্যাবড়াও নয় মধ্যম। মাথার চুল যে খুব লম্বা, তা খোঁপা দেখেই বোঝা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর তাহেরা মাথা তুলে মাহবুবের দিকে তাকাতে গেলে চোখে চোখ পড়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কাঁপা গলায় বলল, কিছু বলছ না কেন মাহবুব ভাই?
অজান্তেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাহবুব বলল, ভালবাসা কি জিনিস আমি জানি না। তবে শুনেছি ভালবাসা মনের ব্যাপার। আমার মনে সেরকম কিছু এখনো হয়নি। তা ছাড়া মেয়েদের নিয়ে আমি কখনো চিন্তা করিনি। আরো শুনেছি ভালো লাগা থেকে ভালবাসা জন্মায়। আমাকে তোমার হয়তো ভালো লেগেছে। তাই তোমার মনে ভালবাসা জন্মেছে।
আমাকে তোমার ভালো লাগেনি?
তোমাকে আমি গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের নজরে দেখি। যখন ভালো লাগবে এবং মনে ভালোবাসা জন্মাবে তখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব। এখন চলি বলে মাহবুব চলে এসেছিল। তারপর আর কোনো দিন তাহেরার সামনে যায়নি। এমন কি তাহেরা তাদের চাকরের হাতে অনেকবার ডেকে পাঠালেও যায়নি।
মাহবুব এইচ. এস. সি.তে পাঁচটা লেটার নিয়ে পাস করার পর যখন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে চাইল তখন কোনো উপায় না পেয়ে সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা হাউলাত নিয়েছিলেন। তারপর মাসে মাসে যখন মাহবুবকে টাকা পাঠাবার দরকার হল তখনও তার কাছে আবার যান।
আলাউদ্দিন মীর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছেন ভালো কথা; কিন্তু তার পড়াশোনা শেষ করতে যেমন অনেক সময় লাগবে তেমনি অনেক টাকা পয়সাও লাগবে। এত টাকা আপনি পাবেন কোথায়? আর আমিও শুধু শুধু আপনাকে এত টাকা হাউলাত দেব কেন? তা ছাড়া টাকাটা কিভাবে ফেরৎ দেবেন তা ভেবেছেন কি?
সুলতান খাঁন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আমিও যে এ ব্যাপারে কিছু চিন্তা করিনি তা নয়। ভেবেছি, বাস্তু সংলগ্ন যে জমিটা আছে সেটা আপনার কাছে পাঁচ বছরের জন্য বন্ধক রাখব।
আলাউদ্দিন মীর বললেন, জমি রাখলে আপনাদের সংসার চলবে কি করে? তার চেয়ে এক কাজ করুন, পুকুরটা পাঁচ বছর নয় সাত বছরের জন্য সাফকবলা রাখুন। এক লাখ টাকার দলিল হবে। টাকাটা একসঙ্গে নেন আর দফায় দফায় নেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। অবশ্য পুকুরের আসল দাম দুতিন লাখ টাকা। বেশি নিলে পুকুর ফেরাবেন কি করে? তাই এক লাখের কথা বললাম। সাত বছরের মধ্যে যখনই টাকা ফেরৎ দেবেন তখনই দলিল ফেরৎ দিয়ে দেব। পুকুর আপনার দখলেই থাকবে। তবে সাত বছরের মধ্যে টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে দলিল মোতাবেক পুকুরের স্বত্ব আমার হয়ে যাবে।
সুলতান খাঁন বললেন, আজ কিছু টাকা দেন, মাহবুবকে পাঠাতে হবে। চিন্তা ভাবনা করে কয়েক দিন পরে কাগজ পত্র নিয়ে আসব।
সেদিন রাতে সুলতান খাঁন স্ত্রীকে আলাউদ্দিন মীরের কথা জানালেন।
মরিয়ম খাতুন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আল্লাহর মহিমা তিনিই জানেন। আপনার মতই আমার মত। তবে আমার মনে হয় মাহবুবের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
সে কথা আমিও ভেবেছি; কিন্তু জানালে সে যদি পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়? কিভাবে পড়াচ্ছি তাও তো জানে না। চার পাঁচ বছরের মধ্যে ওঁর পড়াশোনা শেষ হবে। তারপর চাকরী করে দুতিন বছরের মধ্যে নিশ্চয় টাকাটা ফেরৎ দিতে পারবে। তারপর বললেন, আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছেন, তা হবেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে আমরা আর কি করব?
মরিয়ম খাতুন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ আপনি যা ভালো বুঝেন করেন।
সুলতান খাঁন কয়েক দিন পরে আলাউদ্দিন মীরকে দলিল রেজিষ্ট্রি করে দিলেন।
.
চার বছর হতে চলল, আলাউদ্দিন মীরের টকায় সুলতান খাঁন ছেলেকে পড়াচ্ছেন। মাহবুব এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অবসর সময়ে সুইমিং পুলে গিয়ে সাঁতার কাটে। ভোরে উঠে একা একা কুংফু কারাত প্র্যাকটিস করে। যখন টাকার দরকার হয় আব্বাকে চিঠি লিখে। সময় মতো পেয়ে যায়। ভার্সিটি বন্ধ থাকলে বাড়ি যায়।
আজ সুলতান খাঁন মসজিদ থেকে যোহরের নামায পড়ে ফেরার পথে পিয়ন একটা চিঠি দিল। ঠিকানা দেখে বুঝতে পারলেন মাহবুবের চিঠি। বাড়িতে এসে পড়ে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, মাহবুব সামনের মাসে আসবে লিখেছে, নাও পড়।
মরিয়ম খাতুন পড়তে লাগলেন,
শ্রদ্ধেয় আব্বা ও আম্মা,
বহুৎ বহুৎ সালাম পাক কদমে পৌঁছে। আশা করি আল্লাহ পাকের অপার করুনায় আপনারা ভালো আছেন। আমিও তারই করুনায় ও আপনাদের নেক দোয়ার বরকতে ভালো আছি। বাদ আরজ এই যে, দীর্ঘ চার মাস আপনাদেরকে না দেখে মন বড় উতলা হয়ে উঠেছে। এই নাদান ছেলেকে এতদিন না দেখে আপনাদেরও যে মন উতলা হয়ে আছে তা জাণি। পড়ার চাপে বাড়ী আসতে পারিনি। আশা করি সামনের মাসের সাত আট তারিখে ইনশাআল্লাহ আসব। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে সহি সালামতে আপনাদের মোবারক কদমে সালাম করার তওফিক দেন। আপনারা শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। আমার জন্য কোন দুঃচিন্তা করবেন না। আল্লাহর রহমত এবং আপনাদের দোয়া আমার এক মাত্র কাম্য। আমি যেন আল্লাহ ও তার রসুলের (দঃ) বিধান মোতাবেক চলতে পারি সেই দোয়া করবেন। আল্লাহ পাকের দরবারে আপনাদের সহি সালামত কামনা করে এবং আপনাদের মোবারক কদমে আর একবার সালাম জানিয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি আপনাদের নালায়েক সন্তান
মাহবুব।
চিঠি পড়তে পড়তে মরিয়ম খাতুনের চোখে পানি এসে গেল। আজ চার মাস কলিজার টুকরাকে দেখেন নি। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দুহাত তুলে দোয়া করলেন, আল্লাহ গো, তুমি আমাদের লালকে সহিসালামতে রেখ। তার মনের বাসনা পূরণ করো।
সুলতান খাঁনেরও একই অবস্থা। স্ত্রী থেমে যেতে ভিজে গলায় বললেন, আমিন।
মরিয়ম খাতুন আঁচলে চোখ মুছে বললেন, চলুন খাবেন।