০৫.
এ বছর শবনম ও তার মেজ ভাই নাসির উদ্দিন এস, এস, সি পরীক্ষা দিবে। গত বছর নাসির উদ্দিন পরীক্ষা দিয়েছিল কিন্তু পাশ করতে পারেনি। তাই এ বছর আবার দিবে। এই দুবছরের মধ্যে শবনমের ও আতাহারের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতম হয়েছে। শবনম যেমন স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী হয়েছে তেমনি রূপের জৌলুসও বেড়েছে। ক্লাস টেনে উঠার পর থেকে বোরখা পরে স্কুলে যাচ্ছে।
আতাহারও স্বাস্থ্যবান যুবক হয়ে উঠেছে। ছোটবেলা থেকে তার লম্বা চওড়া স্বাস্থ্য। যৌবন প্রাপ্ত হয়ে আরো লম্বা চওড়া হয়েছে। এমনি তার গায়ের রং খুব ফর্সা এখন সেই রং আরো উজ্জ্বল হয়েছে।
আতাহার মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে যে কদিন থাকে, সেই কদিন মেয়ের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হয় দেখে যুবাইদা খানমের মনে সন্দেহ হয়েছে। আরো একটা কারণে তাঁর সন্দেহ জেগেছে, আতাহার বাড়িতে এসেই একবার হলেও তাদের ঘরে আসে। আর তখন থেকেই মেয়ের মুখে আনন্দের আভা দেখতে পান। কয়েকদিন পর সেই আনন্দের আভা থাকে না। মাঝে মাঝে তাকে মন খারাপ করে বই খুলে বসে থাকতে দেখেন। ছেলেমেয়েরা সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও মাকে পারে না। সব। মায়েরাই ছেলেমেয়েদের মনের খবর বুঝতে পারেন। যুবাইদা খানম মেয়ে সেয়ানা হওয়ার পর তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে সন্দেহ করেন; শবনম নিশ্চয় আতাহারকে ভালবাসে। তিনি ভাবেন, ছেলে হিসাবে আতাহার খুব ভালো, তাদের বংশও খুব ভালো। কিন্তু সে শবনমের অনুপযুক্ত। আতাহার ক্লাস টেনে ওঠে আর্থিক দূরবস্থার কারণে লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে। একটা বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আরেকটা বোন চার পাঁচ বছর পর উপযুক্ত হবে। সামান্য চাকরির টাকায় তাদের সংসারের অভাব মেটে না। কিভাবে বোনদের বিয়ে দেবে? এই সব চিন্তা করে ও মেয়ের হাবভাব লক্ষ্য করে তিনি শঙ্কিত হলেন। এবারে আতাহার ঢাকা থেকে এসে যখন তাদের ঘরে এল তখন মেয়ের মুখে সেই একই রকম আনন্দের আভা দেখলেন এবং তার পরের দিন স্কুল থেকেও ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে দৃঢ় বিশ্বাস হল; স্কুল ছুটির পর শবনম ফেরার পথে নিশ্চয় আতাহারের সঙ্গে কোনো জায়গায় যায়। তাই দেরি হয়। শবনমের ছোটবোন আসমা এ বছর সিক্সে পড়ছে। তাকে আজ একা স্কুল থেকে ফিরতে দেখে যুবাইদা খানম জিজ্ঞেস করলেন, তারা দুবোন তো প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাতায়াত করিস। আজ তুই একা এলি যে? তোকে না বলেছি, তোর আগে ছুটি হলেও শবনমের জন্য অপেক্ষা করবি?
আসমা বলল, আমার ছুটি হয়ে যাওয়ার পর আমি অপক্ষো করছিলাম। মেজ আপা এসে বলল, তুই বাড়ি চলে যা, আমার ফিরতে দেরি হবে। তাই চলে এলাম।
যুবাইদা খানম বললেন, কাল যদি তোকে চলে আসতে বলে, তা হলে বলবি, আম্মা থাকতে বলেছে।
পরের দিন স্কুল ছুটির পর আসমা ক্লাসে বসে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় শবনম এসে বলল, তোকে থাকতে হবে না। তুই চলে যা। আমার আজও ফিরতে দেরি হবে।
আসমা বলল, তোমাকে রেখে কাল চলে গেছি বলে আম্মা বকাবকি করে বলল, তোমার দেরি হলেও অপেক্ষা করতে।
শবনম ভাবল, আম্মা কি কিছু টের পেয়েছে? কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, আয়।
কিছু দূর আসার পর অন্য রাস্তায় যেতে দেখে আসমা বলল, এদিকে যাচ্ছ কেন? শবনম সে কথার জওয়াব না দিয়ে বলল, তুই চৌধুরীদের বাগানে কখনো গেছিস?
না। ওখানে নাকি জ্বীনেরা থাকে। আম্মা সে কথা বলে ওখানে যেতে নিষেধ করেছে।
আম্মা ঠিক কথাই বলেছে, তবে এখন আর সেখানে জ্বীনেরা থাকে না। চৌধুরী হুজুর সেখানে বাড়ি করেছেন। এখন সেখানে লোকজন বাস করে।
সত্যি বলছ মেজ আপা?
হারে সত্যি। চল আজ তোকে তাদের কাছে নিয়ে যাব। তা হলেই বুঝবি আমি সত্যি বলছি না মিথ্যে বলছি।
শবনম তাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আলমাসদের বাড়িতে এল।
আলমাস তখন বাড়ির সামনে যেখানে লালশাক চাষ করেছিল, সেখানে দাউলি দিয়ে নিড়ানী দিচ্ছিল। ওদেরকে দেখতে পেয়ে দাউলি হাতে করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি মা, আজ আতাহার বাবাজী কোথায়? তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ আবার কাকে সাথে করে এনেছ?
শবনম সালাম দিয়ে বলল, এ আমার ছোট বোন আসমা। ওতো ভয়ে আসতেই চায় না। বলে, এখানে জ্বীনেরা থাকে।
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে হেসে উঠে আসমার দিকে চেয়ে বলল, জান মা আগে হয়তো এখানে জ্বীন থাকত, এখন আর নেই।
জয়তুন এতক্ষণ ঘরের ভিতর ছিল। স্বামীর সঙ্গে কারা যেন কথা বলছে শুনে বেরিয়ে এল।
তাকে দেখে শবনম বলল, চাচি আমার বোন আসমা আপনাদেরকে দেখতে এসেছে। আপনারা এর সঙ্গে কথা বলুন, আমি একটু আসছি। তারপর ফিরে চলল।
আসমার জ্বীনের ভয় এখনও কাটেনি। ভয়ার্তকণ্ঠে বলল,এই আপা, তুমি আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছ?
শবনম এগিয়ে এসে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, কিরে ভয় পাচ্ছিস কেন? এনারা তো জ্বীন নয়, আমাদের মত মানুষ।
এমন সময় পাঁচ বছরের ও দুবছরের দুটো ছেলে-মেয়ে এসে জয়তুনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা খিদে পেয়েছে, মুড়ি খাব।
জয়তুন বলল, দাঁড়া দিচ্ছি। তারপর আসমা ও শবনমের দিকে চেয়ে বলল, এস মা, তোমাদেরকেও কিছু খেতে দেই।
শবনম বলল, আমি খাব না, আসমাকে দিন। তারপর আসমাকে বলল, তুই নাস্তা খা। বাগানের ওপাশে আমার এক বান্ধবীর বাড়ি। তার সঙ্গে দেখা করে এক্ষুণি ফিরব। তারপর সে চলে গেল।
আসমার তবুও ভয় কাটল না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
জয়তুন তাহার হাত ধরে এনে দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে বসতে দিল। তারপর মুড়ি ও নারকেলের নাড় খেতে দিয়ে বলল, খাও মা। তোমার আপা তো আতাহারের সঙ্গে প্রায়ই এখানে আসে।
আসমা বুঝতে পারল, মেজ আপার কেন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়।
আতাহার আগে থেকে বাগানের রাস্তার ধারে একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। শবনমের সঙ্গে আসমাকে আসতে দেখে আড়াল হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাদেরকে আলমাসদের ঘরের দিকে যেতে দেখে তাদের পিছু নিয়ে আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। শবনম কাছাকাছি এলে তার সামনে এসে সালাম দিয়ে বলল,কি ব্যাপার। আজ আসমাকে এনেছ কেন?
শবনম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার ফিরতে দেরি দেখে আম্মা এতদিন বকাবকি করেছে। এবার মনে হয় সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তারপর আসমাকে আনার কারণ বলে বলল, আজ দেরি করতে পারব না। কাল থেকে এখানে আসতেও বোধ হয় আর পারব না। তুমি কাল টিফিনের সময় স্কুলের বাইরে থেক, খুব জরুরী কথা আছে বলব। এখন আসমাকে নিয়ে বাড়ি যাই।
আতাহার বলল, ঠিক আছে যাও। ইনশাআল্লাহ কাল দেখা হবে। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।
শবনম আসমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
ঐদিন দেরিতে ফিরতে দেখেও যুবাইদা খানম তখন কাউকে কিছু বললেন না। এশার নামায পড়ে যুবাইদা খানম পাশের রুম থেকে আসমা বলে ডাক দিলেন।
আসমা ও শবনম তখন পড়ছিল। মায়ের ডাক শুনে জ্বি আম্মা আসছি বলে আসমা মায়ের কাছে এল।
যুবাইদা খানম তাকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আজও তোদের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হল যে?
আসমা খুব সহজ সরল মেয়ে। বলল, জান আম্মা, চৌধুরীদের বাগানে এখন আর জ্বীন থাকে না। সেখানে ঘর উঠিয়ে লোকজন বাস করছে। আপা আজ আমাকে তাদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারা নারকেলের নাড়ু ও মুড়ি খেতে দিল। তাদের মুখে শুনলাম, আতাহার ভাই ও মেজ আপা প্রায় ওখানে যায়।
যুবাইদা খানম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, চৌধুরীদের বাগানের কথা আমি জানি। আর কখনো ওখানে যাবি না। আজও আতাহার গিয়েছিল?
আমি দেখিনি। আমি যখন নাস্তা খাচ্ছিলাম তখন আপা কোথায় যেন গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে ঘরে এল। যুবাইদা খানম যা জানার জেনে গেলেন। বললেন, যা এবার পড়তে যা।
আসমাকে ডাকতে শবনম ভাবল, আম্মা নিশ্চয় ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। তাই উৎকণ্ঠিত হয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আসমা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করল, কিরে তোকে আম্মা ডাকল কেন?
আসমা বলল, আম্মা আমাদের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হল কেন জিজ্ঞেস করল।
তুই কি বললি?
বললাম,তুমি চৌধুরীদের বাগানে যারা থাকে তাদের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলে।
আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
আতাহার ভাই সেখানে ছিল কি না জিজ্ঞেস করেছিল। আমি বললাম তাকে দেখিনি।
যুবাইদা খানম মেয়েকে শাসন করার জন্য আসমার পিছনে পিছনে এসে শবনম তাকে কিছু বলছে শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আসমার কথা শেষ হতে ভিতরে এসে রাগের সঙ্গে শবনমকে বললেন, তোকে আতাহারের সঙ্গে মিশতে কতবার নিষেধ করেছি, তবুও তুই তার সঙ্গে মিশিস কেন? তোর কী বদনামের ভয় ডর নেই? তোর আব্বা বাড়ি আসুক, তারপর কি করি দেখিস। আর কোনোদিন ওর সাথে মিশবি না। যদি শুনি আবার তার সঙ্গে চেীধুরীদের বাগানে গেছিস, সেদিন তোর একদিন কি আমার একদিন। তারপর নাসির উদ্দিনের রুমে গিয়ে তাকে বললেন, আতাহারের সঙ্গে তোর তো খুব বন্ধুত্ব। সে দেশে এলে তাকে ঘরে নিয়ে আসিস। তার সঙ্গে যে তোর বোন। চৌধুরীদের বাগানে যায়, সে খবর রাখিস?
আতাহারের পরের বোন কুলসুম সেভেনে পড়ে। তাকে নাসির উদ্দিনের খুব পছন্দ। ভেবে রেখেছে, ভবিষ্যতে তাকে বিয়ে করবে। সেই জন্যে আতাহার ঢাকা থেকে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করার অসিলায় মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যায়। তার সঙ্গে স্কুলের যাতায়াতের পথে দেখা করে।
কুলসুম এখন কিশোরী হলে কি হবে, খুব চালাক চতুর মেয়ে। নাসির উদ্দিন যে ভাইয়ার বন্ধু তা জানে। ভাইয়ার সঙ্গে অনেকবার তাদের বাড়ি এসেছে। মাও যে তাকে বেশ স্নেহ করে তাও জানে। তাই তার কিশোরী মনে নাসির উদ্দিনকে ভালো লাগে। সে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেলেও খুশি হয়। কুলসুম অংকে ও ইংরেজিতে কাঁচা। তাই মাকে ও ভাইয়াকে একদিন বলেছিল, প্রাইভেট মাস্টার রাখার কথা।
আতাহার কিছু বলার আগে রফিকা বেগম বলেছিলেন, নিজে কষ্ট করে পড় মা। দেখছিস না, তোর ভাইয়া নিজে পড়াশোনা বন্ধ করে কত কষ্ট করে তোদেরকে লেখাপড়া করাচ্ছে।
আতাহার তখন কিছু না বললেও সেইদিন নাসির উদ্দিনকে সময় করে কুলসুমের অংক, ইংরেজিটা একটু বুঝিয়ে দিতে বলেছিল।
নাসির উদ্দিন সানন্দে রাজি হয়ে যায় এবং তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে কুলসুমের বাড়ি গিয়ে তাকে অংক, ইংরেজি বুঝিয়ে দেয়। তার ছোট বোন খাদিজাকেও পড়ায়।
একথা তাদের বাড়ির কেউ জানে না। এখন মায়ের কথা শুনে ভাবল তা হলে কি আতাহার ও শবনমের মধ্যে ভালবাসা হয়েছে। নিজের কথা ভেবে আতাহারের উপর রাগতে গিয়েও পারল না। কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল। যুবাইদা খানম তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরো রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গেই বললেন, কিরে কিছু বলছিস না কেন?
নাসির উদ্দিন বলল, আমাকে বকছ কেন? শবনমকে নিষেধ করে দাও। ওতো সেই ছোটবেলা থেকেই আতাহারের সঙ্গে মিশে। আগে থেকে নিষেধ করলে এরকম হত না।
নিষেধ আমি আগে থেকেই করছি। তুই আতাহারকে ঘরে নিয়ে এসে ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিস। আর কোনোদিন আনবি না। ওর সঙ্গে তুইও মেলামেশা করবি না। এবারে খালেদা এসে বলে গেল, তার বড় ননদ দেবরের জন্য শবনমকে পছন্দ করেছে। কত বড়লোক তারা। ছেলে এম, এ পাশ। ভোলাতে ব্যাংকে চাকরি করে। এসব ব্যাপার জেনে গেলে তারা কি আর সম্বন্ধ করবে?
এসব কথা আমাকে বলছ কেন? তোমার মেয়েকে বল।
মেয়েকে বললে যদি শুনতো, তা হলে আতাহারের সঙ্গে মিশত না। তোদের আব্বাকে কালকেই চিঠি দেব। যার মেয়ে সেই এসে যা করার করবে। তারপর গজর গজর করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
এবারে খালেদা এসে যখন শবনমকে তার ননদের ইচ্ছার কথা বলছিল তখন থেকে শবনম খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। গতকাল চৌধুরীদের বাগানে আতাহারকে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আতাহারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে কথা ভুলে গেছে। আজ বলবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু আসমার জন্য টেনসনে ছিল বলে বলতে পারেনি। এখন মেজভাইকে আম্মা যেসব কথা বলল, সব শুনে শবনমের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। ভেবে রাখল, কাল আতাহার ভাইকে কথাগুলো বলতেই হবে।
পরের দিন আতাহার দুপুর একটার সময় শবনমদের স্কুলের গেটের বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগল।
টিফিনের ঘন্টা পড়ার দুতিন মিনিট পর শবনম গেটের বাইরে এসে আতাহারকে দেখে সালাম দিল।
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে বলল, কি ব্যাপার, চাচি-আম্মা বকেছে নাকি? তোমার মনটা ভার ভার মনে হচ্ছে?
শবনম বলল, আম্মা তোমার আমার সম্পর্কের কথা এবং তুমি বাড়ি এলেই তোমার সঙ্গে যে চৌধুরীদের বাগানে দেখা করি, সে সব জানতে পেরেছে। গতরাতে আমাকে খুব বকাবকি করেছে। আর একটা কথা, আপার ননদ তার দেবরের জন্য আমাকে পছন্দ করেছে। আম্মা, আব্বাকে বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিয়েছে। তুমি ঢাকা চলে যাওয়ার পর যদি আব্বা বাড়ি এসে বিয়ের কথাবর্তা ঠিক করে ফেলে, তা হলে কি হবে?
আতাহার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এতে দুঃশ্চিন্তার কি আছে? আল্লাহ আমাদের জোড়া যদি তৈরি করে থাকেন, তা হলে যতই বিয়ের কথাবার্তা হোক বা অন্য কিছু হোক না কেন সব ভেস্তে যাবে। তুমি সবর করে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চাও। আমিও চাইব। তারপর তকৃদিরে যা আছে তা তো হবেই। আমি চারদিনের ছুটিতে এসেছি। কাল চলে যাব। তোমার আব্বা আসার পর কি হল না হল, চিঠি দিয়ে জানাবে। তারপর কি করব না করব আমিও তোমাকে চিঠি দিয়ে জানাব। নচেৎ এসে যা করার ভেবে চিন্তে করব। তোমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি বিয়েতে মত দিও না।
শবনম ছলছল চোখে বলল, আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। আমার চিঠি যদি তুমি সময় মত না পাও?
আতাহার বলল, এতদিন যখন সময় মত পেয়েছি, তখন ইনশাআল্লাহ এবারও পাব। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আল্লাহর উপর সব সময় ভরসা রাখবে। আর নিজের মনের। বাসনা তাকে জানাবে। টিফিন ওভারের ওয়ার্নিং ঘন্টা শুনে বলল, এখন আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে ফিরে চলল।
শবনম আতাহারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিল। ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও একইভাবে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তারপর ঘন্টা পড়ার শব্দ শুনে চোখ মুছে ক্লাসে গেল।
স্ত্রীর চিঠি পেয়েও সাখাওয়াত হোসেন অফিসের কাজের চাপে আসতে পারলেন না। চিঠির উত্তরে সে কথা জানিয়ে লিখলেন, শবনমকে এ ব্যাপারে এখন বেশি রাগারাগি করার দরকার নেই। ওর সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার পর সামসুদ্দিনের ও ওর একসঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করব। আল্লাহপাক রাজি থাকলে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আসব।
স্বামীর চিঠি পেয়ে যুবাইদা খানম খালেদাকে চিঠি দিয়ে জানালেন, তোর আব্বা সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আসবে। আমি তাকে তোদের ওখানে পাঠাব। যতটা পারিস কথা এগিয়ে রাখবি। শবনমের পরীক্ষার পরপর বিয়ের দিন করার ব্যবস্থা করবি।
.
০৬.
এতদিন রমিসা ও মুনসুর জানে না যে, শাইমা বেগম তার ভাইপোদের নামে তাদের বাস্তুটা রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন। একদিন কুলসুমের সাথে মুরগী নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে রমিসা বলল, তোদের গুষ্ঠীকে ভিটে ছাড়া না করেছি তো আমি বাপের বেটি না। আমার মায়ের জায়গায় কি করে থাকিস দেখব।
কুলসুম এখন বড় হয়েছে। জ্ঞানও বেশ হয়েছে। বলল, আমরাও দেখব কেমন করে ভিটে ছাড়া কর। ফুফু আমাদেরকে এই জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে।
রমিসা শুনে মায়ের উপর ভীষণ রেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে গিয়ে বলল, তুমি নাকি আতাহারদের বাস্তুটা তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছ?
শাইমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, যা দিয়েছি, তাতে তোর কি?
রমিসা আরো রেগে গিয়ে বলল, আপা ও ভাইয়া জানে?
শাইমা বেগম বললেন, আমার অংশ থেকে দিয়েছি, তাদেরকে জানাতে হবে কেন?
রমিসা রাগের সঙ্গেই বলল, কাজটা তুমি ঠিক করনি মা। আমি ও তোমাদের জামাই এখানে রয়েছি, আমাদেরকে অন্তত জানান উচিত ছিল। যারা আমাদেরকে একদম দেখতে পারে না, তাদেরকে দেওয়া ঠিক হয়নি।
শাইমা বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোর অংশ তোকে দিয়েছি। আর তোর বড় বোনের অংশ রেখে এতিম ভাইপোদেরকে দিয়েছি। এতে আবার উচিত অনুচিত হল কোথায়?
রমিসা বলল, তোমার জামাই বলছিল, আমাদের ঐটুকু জায়গায় গোজরান করা খুব কষ্টকর। তাই ঐ জায়গাটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার কথা তোমাকে বলব, ভেবেছিলাম।
শাইমা বেগম এবার রেগে গিয়ে বললেন, যতটুকু দিয়েছি, তাতেই কষ্ট করে। পারলে থাকবি, নচেৎ অন্য কোথাও বেশি জায়গা-জমি কিনে জামাইকে বাস্তু বানাতে বলবি।
রমিসা কেঁদে ফেলে বলল, তুমি নিজেই তো দেখে শুনে জামাই করেছ। এখন আবার এই কথা বলছ কেন? তোমার জামাইয়ের যদি সে রকম ক্ষমতা থাকত, তা হলে তোমার জায়গার আশা করতাম না। মেয়ে জামাইয়ের ভালোমন্দ দেখে না, এমন মা যে দুনিয়াতে আছে তা জানতাম না।
শাইমা বেগম বললেন, তোর কি জ্ঞানগম্য বলতে কিছুই নেই? তোকে তো তোর প্রাপ্য দিয়েছি। তবু তোর আশা মিটেনি। এতিম মামাতো ভাইবোনদের পথে বসিয়ে ঐ জমিটাও পেতে চাস। তোদের মতো অমানুষ আছে বলে আমিও জানতাম না। যা আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। তোকে পেটে ধরেছি ভাবতে নিজের কাছে ঘেন্না লাগছে।
রমিসা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মামী তোমাকে তাবিজ করেছে। তা না হলে নিজের মেয়ে জামাই নাতি নাতনিদের চেয়ে ভাবি ও ভাইপো-ভাইজীরা তোমার আপন হল।
শাইমা বেগম আরো রেগে গিয়ে বললেন, তোর মধ্যে যদি এতটুকু মনুষ্যত্ব বোধ থাকত, হা হলে এসব কথা বলতিস না। তোর আর কোন কথা শুনতে চাই না। চলে যা এখান থেকে।
রমিসা যেতে যেতে বলল, বেঁচে থাকতে আর কোনোদিন তোমার কাছে আসব না।
শাইমা বেগম বললেন, তোর মতো মেয়ের মুখ আমিও দেখতে চাই না।
সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীর চিঠির উত্তর দেওয়ার পর বড় ছেলে সামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বললেন, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি বাড়ি যাব। তুমি অনেক দিন যাওনি। আমার ইচ্ছা-আমার সঙ্গে তুমিও যাবে। সেই মতো ছুটি নিও।
সামসুদ্দিন বলল, ঠিক আছে আব্বা তাই হবে।
পরের মাসে সাখাওয়াত হোসেন ও সামসুদ্দিন বাড়িতে এল।
যুবাইদা খানম এক সময় সামসুদ্দিনের সামনে স্বামীকে শবনম ও আতাহারের সম্পর্কের কথা বলে খালেদার ননদের কথাও বললেন।
সামসুদ্দিন শুনে খুব রেগে গেলেও আব্বার আগে কিছু বলা বেয়াদবি হবে ভেবে চুপ করে রইল।
সাখাওয়াত হোসেন আতাহারকে ছোট বেলা থেকেই খুব ভালবাসতেন। শবনমের সঙ্গে যখন খেলাধুলা করতে দেখতেন, সেই সময় তাদের দুজনের মিল দেখে মনে মনে ভেবে ছিলেন, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে আতাহারের সাথে শবনমের বিয়ে দেবেন। পরে যখন আতাহারের আব্বা মারা গেলেন এবং আতাহার লেখাপড়া বন্ধ করে ঢাকায় চাকরি করছে শুনলেন তখন সেই ইচ্ছাটা বাতিল করে দেন। এখন স্ত্রীর মুখে তাদের সম্পর্কের কথা শুনে গম্ভীর মুখে বললেন, আতাহারের আব্বা খুব ভালো লোক ছিলেন। ওদের বংশটাও খুব ভালো। আতাহার খুব ভাল ছাত্র ছিল; কিন্তু তার আব্বা হঠাৎ মারা যাওয়ায় পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তিনিও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
সামসুদ্দিন আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে সংযত কণ্ঠে বলল, তাই বলে আমরা তো শবনমকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারি না। এ বছর শবনম এস.এস.সি পরীক্ষা। দেবে। আতাহার তো টেনে উঠে আর পড়েনি। তাদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। তা ছাড়া যেখানে আপার ননদ তার দেবরের জন্য শবনমকে পছন্দ করেছে, সেখানে। আতাহারের কথা চিন্তা করাই যায় না। আমি আপাদের বাড়ি গিয়েছি। তখন একবার তার ননদের স্বামী আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অবস্থা খুব ভালো। ছেলে শিক্ষিত ও চাকরি করে। এত ভালো সম্বন্ধ আমরা হাতছাড়া করতে পারি না।
সাখাওয়াত হোসেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যা তোমার কথাই ঠিক। খালেদা যখন এটা চাচ্ছে তখন আমাদের এই পাত্র হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না। তবে সবকিছুর আগে ছেলেকে ও তাদের সবকিছু দেখতে হবে। ছেলে শিক্ষিত ও চাকুরে হলেই যে ভালো হবে, তা ঠিক নয়। তার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে। ছেলে ও তাদের বাড়ির সবাই ধর্ম-কর্ম করে কিনা, ছেলের বাবা, দাদা নানা সুদ খায় কি না সবকিছু জানতে হবে। তা ছাড়া ছেলের আগে কোনো বিয়ে হয়েছে কিনা? হয়ে থাকলে সে স্ত্রীর খোঁজও নিতে হবে। আজকাল মেয়ের বাবারা এইসব না দেখে না শুনে রোজগারী ছেলে ও ভালো অবস্থা দেখে জামাই করছে। তার ফলে বিয়ের পর মেয়েকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে।
যুবাইদা খানম বললেন, খালেদার বিয়ে দেবার সময় তো তার শ্বশুরদের সবকিছু জেনেছ। এই ছেলে তো তাদেরই আত্মীয়। সে রকম কিছু হলে খালেদা রাজি হত না।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, তোমার কথা অবশ্য ঠিক। তবু আমি গিয়ে খোঁজ খবর নেব।
যুবাইদা খানম বললেন, বেশ তো, দু-একদিনের মধ্যে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে এস।
সাখাওয়াত হোসেন দুদিন পর চরখলিফায় মেয়ের বাড়ি গেলেন। খালেদার ননদের বিয়ে হয়েছে একই গ্রামে। ছুটিতে জামাই বাড়িতে ছিল। জামাই মজিদের কাছে সবকিছু শুনে একদিন তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে শুনে সাখাওয়াত হোসেনের পছন্দ হল। তিনি পাত্র পক্ষকে দাওয়াত দিয়ে বললেন, আপনারা আমাদের বাড়িতে এসে সবকিছু দেখাশোনা করুন। তারপর বিয়ের কথাবার্তা পাকা করা হবে এবং শবনমের এস.এস.সি পরীক্ষার পর দিন ঠিক করা হবে।
বাড়ি ফিরে সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীকে সব কিছু বলে বললেন, এর মধ্যে সামসুদ্দিনের জন্য মেয়ে দেখতে হবে। ঠিক করেছি, সামসুদ্দিনের ও শবনমের বিয়ে একসঙ্গে দেব।
যুবাইদা খানম বললেন, আমারও তাই ইচ্ছা।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, ফজল ঘটকের সাথে আজ বাজারে দেখা হয়েছিল। তাকে সামসুদ্দিনের জন্য একটা মেয়ে দেখতে বলতেই বলল, চৌকির ঘাটে একটা মেয়ে। আছে। মেয়েটা বি.এ. পড়ছে। নামায কালাম পড়ে। দেখতে শুনতে ভালো। বনেদী বংশের মেয়ে। তবে তার বাবার অবস্থা তেমন ভালো না। ভদ্রলোকের চেীকির ঘাটেই একটা ভাতের হোটেল আছে। হোটেলের আয়ে সংসার চলে। জমি-জায়গা নেই বললেই চলে। মেয়েটাই বড়। আরো দুতিনটে ছোট ছোট ভাইবোন আছে। মেয়েটা হস্তশিল্পের কাজ খুব ভালো জানে। সেই কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালায়।
যুবাইদা খানম বললেন, সামসুদ্দিন ঐ রকম ঘরে বিয়ে করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া তাদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা করা কি ঠিক হবে? মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে। তুমি অন্য কোথাও সম্ভ্রান্ত ঘরের কোনো মেয়ের খোঁজ করতে ফজল ঘটককে বল।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, তা না হয় বলব; কিন্তু আজকাল সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা নামায কালামের ধার ধারে না। তাদের লজ্জা শরমও কম।
যুবাইদা খানম বললেন, সবাই কি এক রকম হয়। এর মধ্যে দেখেশুনে করতে হবে। চৌকির ঘাটের যে মেয়ের কথা বলছ, তার বাবা তো মেয়ে জামাইকে কিছুই দিতে পারবে না। সামসুদ্দিনের মত শিক্ষিত ও চাকরিওয়ালা ছেলের সেই রকম উপযুক্ত ঘরে বিয়ে না হলে আত্মীয়-স্বজনরাই বা কি বলবে। না না, ঐ মেয়ে যতই ভালো হোক আমরা তাকে বৌ করে আনতে পারব না।
সাখাওয়াত হোসেন অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, তুমি যে লেনদেনের কথা বললে, তা আমি মেনে নিতে পারলাম না। ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ের বাবার কাছ থেকে দাবি করে কিছু নেওয়া শরীয়তে নিষেধ। সামসুদ্দিনকে তো আমি চিনি, শুনলে সেও রেগে যাবে। কি জান, আমাদের মতো সামর্থবানরা গরীব ঘরের মেয়েদেরকে গ্রহণ করছি না বলেই অনেক ভালো ভালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। যদিও কারো কারো হচ্ছে। সে সব মেয়েরা এমন ছেলের হাতে পড়ছে, যাকে বলে বানরের গলায় মুক্তার মালা। বানরেরা তো মুক্তার কদর বুঝে না। তারা সেটাকে সিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। আমাদের নবী করিম (দঃ) বিয়ের ব্যাপারে পুরুষদেরকে বলেছেন, ধন দৌলতের চেয়ে ধার্মিক মেয়ে বিয়ে করবে। তিনি আরো বলেছেন, ধনদৌলতের চেয়ে ধার্মিক স্ত্রী অতি উত্তম।-এসব হাদিসের কথা। আজকাল মানুষ ধনদৌলতের লোভে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) এর কথা ভুলে গেছে। তাই মুসলমানদের এত দূর্গতি। যাই হোক, তবু আমি ফজল ঘটককে বড় ঘরের ভালো মেয়ের খোঁজ নিতে বলব। তারপর তকদিরে যা আছে, তা তো হবেই।
সাখাওয়াত হোসেনের ছুটি শেষ, তিনি এক সপ্তাহ থেকে চলে গেলেন।
সামসুদ্দিন অনেক দিন পর পনের দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। সে আরো এক সপ্তাহ থাকবে। সামসুদ্দিন তার বিয়ের ব্যাপারে মা-বাবার কথোপকথন শুনেছে। সে ফজল ঘটককে চিনে। খালেদার ঘটকালি সেই করেছিল। তার বাড়ি গুপ্তগঞ্জে। সেও সামসুদ্দিনকে চিনে। একদিন সামসুদ্দিন ফজল ঘটকের সাথে দেখা করে চৌকির ঘাটের মেয়েটাকে দেখাবার ব্যবস্থা করতে বলল।
ফজল ঘটক সেই দিনই তাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটির সময় কলেজের কাছা-কাছি রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন মেয়েকে আসতে দেখে বলল, ডানদিকের মেয়েটি।
মেয়েটিকে দেখে সামসুদ্দিনের পছন্দ হল। মেয়ে দুটি তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর বলল, বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে বলবেন, আমি এই মেয়েকে বিয়ে করব।
ফজল ঘটকের বয়স পঞ্চাশের মত। বলল, বাবাজী তোমার পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না। সারা জীবন ঘটকালি করলাম, কিন্তু এরকম পয়মন্ত মেয়ে আর একটাও দেখিনি। যাদেরকে আল্লাহ দেখার মত চোখ দিয়েছে, তারাই এই মেয়েকে দেখলে পছন্দ করবে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই মেয়েকে বিয়ে করলে ইনশাআল্লাহ তুমি সুখ শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে।
সামসুদ্দিন বলল, আল্লাহপাক আমাকে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন, তাতেই মেয়েটিকে দেখে আপনার সঙ্গে আমি একমত। মেয়েটির নাম জানেন চাচা?
নিশাত তামান্না। নামও যেমন, গুণও তেমন।
নামের অর্থটা বলবেন?
আকাঙ্খিত আনন্দ। তারপর হেসে উঠে বলল প্রত্যেক মানুষই আনন্দ আকাঙ্খা করে।
সামসুদ্দিন বলল, হ্যাঁ চাচা আপনার কথাই ঠিক। এবার আসি, তারপর সালাম বিনিময় করে চলে এল।
ছুটি শেষ হওয়ার পর সামসুদ্দিন কর্মস্থলে চলে গেল।
আব্বা আপাদের বাড়িতে কেন গিয়েছিল, শবনম তা বুঝতে পারলেও কি হল, না হল, জানতে পারল না।
মাসখানেক পর খালেদা বাপের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এল। একদিন শবনমকে বলল, ভালো করে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করবি। আমার বড় ননদ বলছিল, তার দেবর বলেছে, বিয়ের পর তোকে ভোলাতে নিজের কাছে রেখে কলেজে পড়াবে।
আপার কথা শুনে শবনম বুঝতে পারল, বিয়ের কথা তা হলে ঠিক হয়ে গেছে। ভাবল, এখনই আপাকে নিজের মতামত জানান দরকার। কিন্তু কিভাবে বলবে চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে খালেদা বলল, কিরে চুপ করে কি ভাবছিস? তারপর বলল, তোর ভাগ্য খুব ভালো। ছেলেটা যেমন সৎ তেমনি আচার ব্যবহারও খুব সুন্দর।
শবনম বলল, ভাগ্যের কথা আল্লাহ জানে। আপা তোমাকে একটা কথা বলছি, আমি কিন্তু এই বিয়েতে রাজি না।
খালেদা মায়ের কাছে শবনমের ও আতাহারের সম্পর্কের কথা শুনেছে। এখন তার অমতের কথা শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমি আতাহার ভাইকে ভালবাসি।
তাতে কি হয়েছে? কারো সঙ্গে ভালবাসা হলেই যে, তার সঙ্গে বিয়ে হবে, এটা ঠিক নয়। তা ছাড়া আতাহার তোর চেয়ে কম শিক্ষিত। তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। আমার ননদের দেবরের কাছে আতাহার কিছুই না। ওসব বদখেয়াল ছেড়ে দে।
কিন্তু আপা, আমরা একে অপরকে ছোটবেলা থেকেই ভালবাসি। তাকে ছাড়া আমি যেমন বাঁচব না, তেমনি আমাকে ছাড়া সেও বাঁচবে না। সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, কেউ কাউকে ছাড়া বিয়ে করব না।
এ তুই কি বলছিস শবনম? প্রতিজ্ঞা করার আগে আমাদের ও আতাহারদের অবস্থার কথা চিন্তা করলি না। আব্ব ও সামসুদ্দিন শুনলে তোকে আস্ত রাখবে? এবার আব্বা চর খলিফায় গিয়ে আমার ননদের শ্বশুরের সঙ্গে এক রকম কথাবার্তা ঠিক করে এসেছে। তোর পরীক্ষার পর বিয়ে হবে।
শবনম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, না আপা না, এ কখনই সম্ভব নয়। তোমরা যদি জোর করে আমার বিয়ে দাও, তবে আমার লাশের বিয়ে হবে।
খালেদা খুব রেগে গিয়ে তার গালে একটা চড় মেরে বলল, তোর এতবড় সাহস। যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা। একটা গরিব এতিম ছেলের জন্য আত্মহত্যা করার ভয় দেখাচ্ছিস? তারপর মাকে ডেকে বলল, আম্মা, শবনম কি বলছে শুনবে।
শবনম ভাবতেই পারেনি আপা তাকে মারবে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, তুমি আমাকে মারলে আপা?
খালেদা রাগের সঙ্গেই বলল, আমি না হয় একটা চড় মেরেছি। আম্মা জানতে পারলে তোকে মেরে খুন না করে ফেলে।
যুবাইদা খানম রান্নাশালে আনাজ কূটছিলেন। খালেদার কথা শুনে তাদের কাছে। এসে শবনমকে কাঁদতে দেখে ঘটনাটা আঁচ করতে পেরেও বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে ওকে বকছিস কেন? আর ও কাঁদছেই বা কেন?
খালেদা বলল, ওকে আমি আমার বড় ননদের দেবরের সঙ্গে বিয়ের কথা বলতে বলে কিনা, ও আতাহারকে ভালবাসে। তাকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসবে না। তাই মেরেছি।
যুবাইদা খানম রাগ সামলাতে পারলেন না। বললেন, ঠিক করেছিস। তারপর শবনমের চুল ধরে পিঠে কয়েকটা কিল মেরে বললেন, ঐ কথা যদি আবার মুখে আনিস, তা হলে তোকে খুন করে ফেলব।
শবনম মায়ের দুপা জড়িয়ে ধরে বলল, তাই কর মা তাই কর। আমি আতাহার ভাইকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসব না।
এই কথা শুনে যুবাইদা খানম আরো মারতে লাগলেন।
খালেদা চিন্তা করল, সামনে ওর পরীক্ষা, এখন বেশি মারধর করলে ভালভাবে পড়াশোনা করতে পারবে না। তাই মাকে ধরে ফেলে বলল, এখন আর মারার দরকার নেই। ছেলেমানুষী বুদ্ধিতে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। আমি ওকে বোঝাব। তারপর। মাকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, এখন ওর উপর অত্যাচার করা ঠিক হবে না। কারণ সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার পরপর ওর বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে হবে। যে কদিন আছি ওকে আমি বোঝাব।
যুবাইদা খানমের রাগ তখন কিছুটা কমেছে। ভাবলেন, খালেদা ঠিক কথাই বলেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ তুই ওকে বুঝিয়ে বলবি, ও যেন আতাহারের কথা ভুলে যায়। তারপর রান্নাঘরে চলে গেলেন।
খালেদা শবনমের কাছে এসে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বলল, ঠিক আছে, তোকে আমরা আর কিছু বলব না। এখন ঐসব চিন্তা দূর করে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। বিয়ে শাদী তকদিরের ব্যাপার। কাকে কার সঙ্গে জোড়া করে পয়দা করেছে, সে কথা আল্লাহ জানে।
আতাহারের কথা জেনে আম্মা যে মারধর করবে, তা শবনম জানত। কিন্তু আপা তাকে মারবে, সে চিন্তাই করতে পারেনি। এখন আবার তার নরম সুর শুনে তার উপর। প্রচন্ড অভিমান হল। কোনো কথা না বলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পড়ার রুমে চলে গেল।
এরপর যে কদিন খালেদা ছিল, সেই কদিন শবনম তার সঙ্গে কথা বলেনি। তার ছেলে-মেয়েকে আদরও করেনি। কয়েকদিন পর দুলাভাই আপাকে নিয়ে যেতে এল। তারসঙ্গে কথা বললেও আগের মতো ধারে কাছে গেল না।
মজিদ একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল; কি ব্যাপার বলতো, শবনমের কি হয়েছে? সব সময় মন খারাপ করে থাকে। আমার কাছেও বড় একটা আসে না।
খালেদা মিথ্যা করে বলল, মেয়েদের অনেক রকম অসুখ হয়। সেই রকম কিছু একটা হয়েছে, তাই আর কি।
মজিদ হেসে উঠে বলল, ও তাই বল। আমি মনে করেছিলাম কি না কি হয়েছে।
যেদিন খালেদা ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে গেল, সেদিনও শবনম ভাগনা ভাগনিকে আদর করল না। আপার সঙ্গেও কথা বলল না। শুধু দুলাভাইকে আবার আসতে বলল।
কয়েকদিন পর শবনম সবকিছু জানিয়ে আতাহারকে চিঠি দিল।
আতাহার চিঠির উত্তরে সমবেদনা জানিয়ে লিখল, পরীক্ষা পর্যন্ত এসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করো না। তোমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ আমি আসব এবং যা করার করব। এর মধ্যে আসতে পারব না। তুমি আল্লার উপর ভরসা করে ধৈৰ্য্য সহকারে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দাও। তোমাকে তো বলেছি তকৃদিরে যা আছে, তা কেউই রদ করতে পারবে না। আর তোমার আমার সম্পর্কের ব্যাপার নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো উচ্চবাচ্য করো না।
শবনম চিঠি পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও সম্পুণ হতে পারল না। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল। টেস্ট পরীক্ষায় এলাও হওয়ার পর একদিন মেজভাই নাসির উদ্দিনকে বলল, তুই আমার একটা উপকার করবি?
নাসির উদ্দিন ও শবনম কোলে-পিঠে। তাই দুজনে যেমন তুই তোকারি করে, তেমনি সব সময় খিটির-মিটির লেগেই থাকে। কিন্তু উক্ত ঘটনার পর কেউ কারো সঙ্গে লাগেনি। নাসির উদ্দিনের মনে ভয় ঢুকে গেছে। সে যে আতাহারের বোন কুলসুমকে ভালবেসে ফেলেছে। সে কথা এখনো কেউ জানে না। তবে কুলসুমকে যে সে রোজ বিকেলে পড়াতে যায়, শবনম সে কথা আতাহারের কাছে শুনেছে। তাই এই ঘটনার পর যেদিন শবনম তাকে বলেছিল, তুই যে কুলসুমকে পড়াতে যাস, আম্মা শুনলে তোর সঙ্গেও খুব রাগারাগি করবে। সেদিন নাসির উদ্দিন কোনো কথা না বলে চুপ করেছিল। আতাহারের জন্য আপা ও আম্মা শবনমকে মেরেছিল জেনে তার যেমন মায়া হয়েছিল, তেমনি নিজের কথা ভেবে আরো বেশি ভয় পেয়েছিল। আজ শবনমের উপকার করে দেবার কথা শুনে বলল, বল কি করতে হবে।
আপার ননদের দেবরের ভোলার ঠিকানাটা জোগাড় করে আমাকে দিতে পারিস?
নাসির উদ্দিন শবনমের চেয়ে দুবছরের বড়। স্মরণ শক্তি কম বলে এস.এস.সি পরীক্ষায় দুবার ফেল করে এবছর শবনমের সঙ্গে আবার দিবে। যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়েছে। তার ঠিকানা কেন চাইছে বুঝতে না পেরে বলল, তার ঠিকানা নিয়ে তুই কি করবি?
কি করব এখন বলব না, পরে বলব।
নাসির উদ্দিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি তার ঠিকানা জানি।
সত্যি বলছিস?
হারে সত্যি, আপাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে একবার আমাকে ঠিকানা দিয়ে বলেছিল বেড়াতে যাওয়ার জন্য।
শবনম কাগজ কলম নিয়ে এসে বলল, তা হলে লিখে দে।
নাসির উদ্দিন ঠিকানা লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে তাকে চিঠি দিবি নাকি?
শবনম মৃদু হেসে বলল, বললাম না, এখন কিছু বলব না, পরে বলব? তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কি এখনো কুলসুমকে পড়াতে যাস?
নাসির উদ্দিন মাথা নেড়ে বলল, তুই যেন আম্মাকে বলে দিস না।
শবনমের সঙ্গে কুলসুমের স্কুলে প্রায় দেখা হয়। তার সঙ্গে কথা বলে শবনম বুঝতে পেরেছে, মেজ ভাইয়ের সঙ্গে কুলসুমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে মেজভাই এখনো তাকে পড়াতে যায়। তবু কি বলে জানার জন্য এখন জিজ্ঞেস করেছিল। মেজ ভাইয়ের কথা শুনে হেসে উঠে বলল, তোদের ব্যাপারটা জেনে গেছি। আম্মাকে অনেক আগেই জানাতে পারতাম, কিন্তু জানাইনি। তবে বিশ্বাস রাখিস, এতদিন যখন জানাইনি তখন ভবিষ্যতেও জানাব না।
ছোট বোনের কাছে ধরা পড়ে নাসির উদ্দিন লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
সেইদিন রাত বারোটা পর্যন্ত শবনম পড়াশোনা করল। তারপর বই বন্ধ করে মেজ ভাইয়ের পড়ার শব্দ না পেয়ে বুঝতে পারল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাগানের দিকে কি একটা পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল। দূরে শিয়ালের ডাক শুনতে পেয়ে পাড়ার কুকুরগুলো একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। এমন সময় কয়েকটা পেঁচা এক সঙ্গে ডেকে উঠতে শবনম ভয়ে চমকে উঠল। জানালাটা বন্ধ করে ছোট বোন আসমার দিকে চেয়ে দেখল, সে বেঘোরে গুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে মাঝখানের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, আম্মাও ঘুমাচ্ছে। ঠিকানা পাওয়ার পর ভেবে রেখেছে, সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে। মুবিনকে চিঠি লিখবে। পড়ার টেবিলের কাছে এসে চিঠি লিখতে বসল। কি বলে সম্বোধন করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে শেষে চিন্তা করল, আপার ননদের দেবর যখন, তখন তো বিয়াই বলেই সম্বোধন করা যায়।
বিয়াই,
পত্রে আমার সালাম নেবেন। আশা করি আল্লাহপাকের রহমতে ভাল আছেন। আর তাই কমনাও করি। এবার আমার পরিচয় দিয়ে আসল বক্তব্যে আসছি, আমি হলাম আপনার ভাবির ভাবির বোন। অর্থাৎ আমার বড় আপা হল, আপনার ভাবির ভাবি। আরো ভোলাসা করে বলছি। আপনার ভাবির বড় ভাই আমার আপাকে বিয়ে করেছে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আমি কে? হ্যাঁ আমার সঙ্গেই আপনার বিয়ের কথা হয়েছে। ছোটবেলায় আপনাদের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি। তখনকার কথা মনে নেই। তবে বড় বেলায় আপনার সঙ্গে মাত্র একবার অল্পক্ষণের জন্য আলাপ হয়েছিল। সেই সময়ে যতটুকু আপনাকে জেনেছি এবং আপার মুখে আপনার প্রশংসা শুনে যা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে, আপনি পাত্র হিসেবে রত্ন। আপনার যিনি স্ত্রী হবেন, তিনি যে অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ করার পেছনে আপার অবদান প্রচুর। আব্বা গিয়ে আপনাকে ও আপনাদের সবকিছু দেখেশুনে পছন্দ করে বিয়ের কথাবার্তা একরকম পাকা করে এসেছেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। কারণ আমি আপনার অনুপযুক্ত। আমার তকদিরে আপনার মতো রত্নকে আল্লাহপাক রাখেননি। তা না হলে তিনি কেন ছোটবেলা থেকে আমাদের গ্রামেরই একটা ছেলের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে দিলেন? তার ভেদ তিনিই জানেন। জ্ঞান হওয়ার পর আমরা একে অপরের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সামাজিক দৃষ্টিতে ছেলেটি আমার ও আমাদের পরিবারের অনুপযুক্ত। তাই আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে অভিভাবকেরা আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। অবশ্য আপনার মতো পাত্র পেলে যে কোনো মেয়ের অভিভাবক লুফে নেবে। আমি এই সম্বন্ধ জানতে পেরে প্রতিবাদ করি। ফলে আমার উপর নেমে আসে অভিভাবকদের অত্যাচার। পরীক্ষার জন্য এখন অত্যাচার বন্ধ আছে। মনে হয়, পরীক্ষার পর অত্যাচারের মাত্রা-সীমা ছেড়ে যাবে এবং আমার অমতে আপনার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেবে। তবে আমিও তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি, তোমরা যদি জোর জবরদস্তি কর, তা হলে আমার সঙ্গে নয়, আমার লাশের সঙ্গে বিয়ে হবে। এই পত্র পড়ে আমাকে চরিত্রহীনা মেয়ে ভাবতে পারেন, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি কি, তা আল্লাহপাক জানেন। আর একটা কথা লিখে আমার বক্তব্য শেষ করব। সবকিছু জানার পরও যদি আমাকে বিয়ে করতে চান অথবা না চান, তা হলে আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, এই চিঠির কথা সারা-জীবন গোপন রাখবেন। আশা করি আমার এই অনুরোধটুকু ইনশাআল্লাহ রাখবেন। আর আমার চিঠি পড়ে যদি আপনি মনে কষ্ট পান, তা হলে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দেবেন। আল্লাহপাকের দরবারে আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক, শান্তির হোক, এই কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি আপনার শুভাকাখিনি
শবনম।
চিঠি লেখা শেষ করে দুবার পড়ল। তারপর ভাজ করে বইয়ের মধ্যে রেখে ভাবল, কাল কোচিং করতে যাওয়ার সময় পোস্ট করবে।
.
০৭.
শবনম যাকে চিঠি দিল, তার নাম আব্দুল মুবিন। ডাক নাম মুবিন। মুবিন ঢাকা থেকে এম, এ পাশ করে ভোলায় সোনালী ব্যাংকে চাকরি করে। সেখানে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে। ধার্মীক ও সৎ ছেলে হিসাবে ছোটবেলা থেকে তার একটা সুনাম আছে। যতদিন গ্রামের বাড়িতে ছিল, ততদিন গ্রামের বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভোলাতে এক বছর মাত্র আছে। এরই মধ্যে সেখানে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ ও ধর্মীয় সংগঠনের সদস্য হয়ে কাজ করছে। তার কর্ম ও উন্নত চরিত্র দেখে সেখানকার অনেক উচ্চপদস্থ সরকারী লোকজন তাকে জামাই করতে আগ্রহী। কিন্তু মুবিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেয়, এসব ব্যাপারে আমার অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ইদানিং সমাজ কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারী ওয়াহাবের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ওয়াহাব ভোলারই ছেলে। ডাক্তারী পাশ করে ভোলা সদর হাসপাতালে ডাক্তারী করছে। এখনো বিয়ে করেনি। ধর্ম সম্বন্ধে যেমন কিছু জানত না, তেমনি ধর্মকে খুব এড়িয়ে চলত। বলত, চরিত্রবান হয়ে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করা অথবা উপকার করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আরো বলত, যারা ধর্মের কিছু আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলে, অথচ মানুষের উপকার করে না, যারা মানুষকে ঠকায়, মানুষের ক্ষতি করে, তারা আবার কিসের ধার্মীক? ঐ রকম ধার্মীক লোকদের আমি ঘৃণা করি। তাদের চেয়ে অধার্মীক লোক অনেক ভালো।
মুবিনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রথম দিকে এসব নিয়ে তার সঙ্গে ওয়াহাবের খুব তর্ক-বির্তক হত। মুবিন তার কথা স্বীকার করে নিয়ে যখন ইসলামের, কোরআনের ও হাদিসের ব্যাখ্যা তাকে বোঝাতে লাগল তখন ধীরে ধীরে তার জ্ঞানের চোখ-খুলে যায় এবং ইসলামের দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে মেনে চলতে শুরু করে। ওয়াহাব কমিউনিজমের সবকিছু ফলো করত। মুবিন তাকে বোঝালো কমিউনিজমের কাঠামো ইসলাম থেকে নেয়া এবং তারা ইসলামের দুষমন বলে ইসলামকে স্বীকার করে না। উদাহরণ স্বরূপ বলল, ধর কমিউনিজম ছোট-বড়-ধনী গরিব স্বীকার করে না। তারা বলে মানুষ সব সমান। কেউ গাছ তলায়, ফুটপাতে ও কুঁড়ে ঘরে থেকে একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাবে, আবার কেউ বড় বড় অট্টালিকায় ভোগবিলাসে জীবন যাপন করবে, তা হতে পারে না। আর ইসলাম কি বলে জানেন, পৃথিবীর মানব গোষ্ঠীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এবং সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য আল্লাহপাক ছোট বড়, ধনি-গরিব তৈরি করেছেন। সেই সঙ্গে ধনি-গরিব, ছোট-বড় সকলের জীবন ব্যবস্থার আইন কোরআন ও হাদিসে বাতলে দিয়েছেন। সেই সব আইন যদি মানবগোষ্ঠী মেনে চলত, তা হলে ছোটরা বড়দের বিরুদ্ধে এবং গরিবরা ধনীদের উপর এত অত্যাচার করত না। অথবা শোষণের স্টীম রুলার চালাত না। ক্বোরআন এবং হাদিসের ব্যাখ্যা পড়লে মুসলমানদের জন্য দুঃখে আপনার চোখ থেকে শুধু পানি নয়, রক্ত বেরিয়ে আসবে। কোরআন-হাদিসের একটা বাণী আপনাকে বলছি, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই এবং পৃথিবীর সমস্ত মুসলমান শুধু যে ভাই ভাই তা নয়, তাদের সমষ্টি মিলে একটা শরীর। শরীরের যে। কোনো অংশে ব্যথা লাগলে যেমন সমস্ত শরীরে তা অনুভুত হয়, তেমনি যে কোন মুসলমান দুঃখ কষ্টে বা বিপদে পড়লে সারা পৃথিবীর মুসলমানদের সেই দুঃখ কষ্ট বা বিপদ অনুভুত হবে এবং তার প্রতিকার করার জন্য সাহায্যার্থে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এক মুসলমানের ধন-সম্পত্তি অন্য মুসলমানদের কাছে আমানত স্বরূপ। আমানত যেমন খেয়ানত করা হারাম তেমনি এক মুসলমানের ধন-সম্পত্তি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা বা গ্রহণ করা হারাম। এমন কি কোন বিধর্মীও যদি বিপদে পড়ে, তাকে সাহায্য করা। মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব এবং তাদের ধন-সম্পত্তিও অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা হারাম। বিধর্মীরাও আল্লাহপাকের সৃষ্টি। কিন্তু মুসলমানরা কি কোরআন হাদিসের ঐসব আইন মানছে? মানছে না। তাই তো সারা দুনিয়ার মুসলমানরা আজ বিজাতীয়দের কাছে ঘৃণিত; লাঞ্ছিত ও উৎপীড়িত। এই পর্যন্ত বলে মুবিন বলল, আপনি কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ুন, আর সেই সঙ্গে নবী রসুল ও বিভিন্ন ইসলামী মণীষীদের জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন, ইসলামের কাছে পৃথিবীর কোনো ইজমই পাত্তা পাবে না।
মুবিনের সঙ্গে মেলামেশার ফলে এবং কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে ওয়াহাবের মনের কালিমা দূর হয়েছে। এখন সে ধর্মের অনেক নিয়ম মেনে চলে।
একবার ওয়াহাব অসুখে বেশ কিছুদিন বিছানায় পড়েছিল। খবর পেয়ে মুবিন কয়েকবার তাকে দেখতে গিয়েছিল। ওয়াহাবদের বাড়ির সবাই খুব মডার্ন। মেয়েরা ধর্ম কর্ম তো করেই না এমন কি পর্দা কি জিনিস তাও জানে না। মুবিন যেদিন ওয়াহাবকে প্রথম দেখতে যায় সেদিন তাদের বাড়ির মেয়েরা তাকে ওয়াহাবের বন্ধু জেনে অবাধে মেলামেশা করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন যায় তখন হঠাৎ মুবিন লক্ষ্য করল, গায়ে মাথায় চাদর জড়ান, এমন কি চোখ দুটো ছাড়া মুখও ঢাকা একটা মেয়ে অন্যান্য মেয়েদের সাথে ওয়াহাবের খাটের কাছে রয়েছে। মুবিনের মনে হল, মেয়েটা তার দিকে চেয়ে রয়েছে। মুবিন তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। সাথে সাথে মেয়েটা চোখ নামিয়ে নিল। মুবিন মাত্র কয়েক সেকেণ্ড মেয়েটার চোখে চোখ রেখেছে। তাতেই তার মনে অজানা এক অনুভূতি অনুভব হল। তারপর যে কয়দিন ওয়াহাবকে দেখতে গেছে, সেই কয়দিনই মেয়েটাকে দেখার আগ্রহ জেগেছে। কিন্তু বাড়ির এখানে ওখানে দেখলেও সে যতক্ষণ থেকেছে ততক্ষণ ওয়াহাবের কাছে আসেনি। ওয়াহাব মোটামুটি সুস্থ্য হওয়ার পর শেষ দিন যখন মুবিন তাকে দেখতে গেল তখন সেই মেয়েটি ওয়াহাবকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। সেখানে আর কেউ ছিল না। মুবিনকে দেখে একপাশে। সরে দাঁড়াল।
ওয়াহাব খাচ্ছিল, তাই সালাম না দিয়ে মুবিন জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছেন?
ওয়াহাব বলল, আল্লাহ চাহেত ভালো। আসুন বসুন। তারপর খাওয়া বন্ধ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, নাসিমা, মুবিন ভাইয়ের জন্য কিছু নিয়ে আয়।
মুবিন বলল, আপনি খান, আমি অফিস থেকে বেরিয়ে হোটেলে নাস্তা খেয়ে এসেছি। তারপর নাসিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার জন্য কিছু আনবেন না।
নাসিমা কিন্তু শুনল না। এক কাপ চা এনে মুবিনের হাতে দেওয়ার সময় বলল, হোটেলে নাস্তা খেলেও চা খাননি। তাই নাস্তা না দিয়ে শুধু চা দিলাম। আশা করি, হোটেলের চা খেতে না পারলেও এটা পারবেন।
নাসিমার কথা শুনে মুবিনের মনে হল, তার সঙ্গে যেন অনেক দিনের আলাপ পরিচয়। আরো মনে হল, মেয়েটি শিক্ষিত। বেশ অবাক হয়ে বলল, চায়ের ব্যাপারটা আপনি জানলেন কি করে?
নাসিমা কিছু বলার আগে ওয়াহাব বলল, আপনার সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচয় হল, সেদিন হোটেলে নাস্তা খাওয়ার পর চায়ের অর্ডার দিতে আপনি বলেছিলেন, হোটেলের নাস্তা খেতে পারলেও চা খেতে ভালো লাগে না বলে খান না। একদিন বাড়িতে আপনার কথা আলোচনা করার সময় কথাটা বলেছিলাম।
মুবিন আর কিছু না বলে চা খেয়ে কাপ পিরীচ টেবিলের উপর রেখে দিল।
ততক্ষণে ওয়াহাবেরও খাওয়া শেষ হয়েছে। নাসিমা ট্রেতে সব কিছু তুলে নিয়ে চলে গেল।
মুবিন ওয়াহাবকে বলল, আপনাদের বাড়ির সব মেয়েদের থেকে ওঁকে একটু অন্য রকম মনে হল।
ওয়াহাব মৃদু হেসে বলল, আমারই ভুল হয়েছে। সবার সঙ্গে পরিচয় করালেও নাসিমার সঙ্গে করান হয়নি। ও আমাদের একমাত্র বোন। বি, এ, পড়ছে। সবার ছোট। ও আমার মতো কমিউনিজমের ভক্ত ছিল। আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে আমার মনের কালিমা যেমন আল্লাহপাক দূর করে ইসলামের আলোয় আলোকিত করেছেন। তেমনি নাসিমাও আমার কাছ থেকে আপনার কথা শুনে ও ইসলামী বই পুস্তক পড়ে আমার থেকে বেশি ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছে এবং আমার থেকেও বেশি ধার্মিক হয়ে গেছে। তারপর নাসিমাকে ডাকার জন্য একটু উচ্চস্বরে বলল, নাসিমা, এখানে একবার আয়তো।
নাসিমা ট্রে রেখে ফিরে এসে ভাইয়াকে বলল, কেন ডাকলে বল,
ওয়াহাব বলল, তুই তো আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার জন্য কতবার তাকে আনতে বলেছিলি। আমার এমনই ভোলা মন, মুবিন সাহেব কতবার আমাকে দেখতে এলেন, সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম অথচ তোর সঙ্গেই পরিচয় করাইনি। অবশ্য সে সময় তুই ছিলি না। যাকগে, এখন পরিচয় করিয়ে দিই।
নাসিমা বলল, তার আর দরকার নেই। ওঁকে দেখেই আমি চিনেছি। তারপর মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, আপনার কথা ভাইয়ার মুখে অনেক শুনেছি। তাই আপনাকে দেখে চিনে ফেলেছি। আমার কথা ভাইয়ার কাছে নিশ্চয় শুনেছেন?
আগে শুনিনি, একটু আগে শুনলাম।
নাসিমা ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, আর কিছু বলবে?
কি আর বলব, যা বলতে চেয়েছিলাম, তার আর দরকার নেই।
তা হলে এবার য়ুই?
হ্যাঁ যা।
নাসিমা মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, আবার আসবেন। নাকি বন্ধু সুস্থ হয়ে গেছে। বলে আর আসবেন না?
মুবিন আজ আসার পর ওয়াহাবকে সুস্থ দেখে ভেবেছে, আর আসার দরকার নেই। তার মনের কথা নাসিমা জানতে পারল কেমন করে ভেবে খুব অবাক হল। কয়েক সেকেণ্ড তার চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আল্লাহপাকের ঈশারা থাকলে আসব।
সেদিনের পর থেকে মুবিনের ওয়াহাবদের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যায়নি। ওয়াহাব তাকে কতবার নিয়ে যেতে চেয়েছে। এমন কি নাসিমা ডেকেছে বলার পরও যায়নি। কারণ প্রথম দিন নাসিমার চোখের দিকে চেয়ে যে অনুভুতি অনুভব করেছিল, শেষ দিন তার সঙ্গে পরিচয় হবার পর সেই অনুভুতি আরো বেড়েছে। অন্য কোন ছেলে হলে হয়তো নাসিমাকে দেখার জন্য নিজের ইচ্ছায় যেত। কিন্তু মুবিন খুব সংযমী ছেলে। ইচ্ছাকে দমন করার ক্ষমতা তার প্রচুর। এর কয়েকদিন পর বাড়িতে গিয়ে যখন শুনল, ভাবির ভাইয়ের শালীর সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে তখন থেকে নাসিমার কথা মনে পড়লেও গুরুত্ব দেয়নি।
আজ মুবিন অফিসে শবনমের চিঠি পেল। অবশ্য চিঠিটা যে শবনমের তা জানতে পারল না। কারণ খামের উপর প্রেরকের ঠিকানা নেই। তাই তেমন গুরুত্ব না দিয়ে রেখে দিল।
ছুটির পর বাসায় এসে চা-নাস্তা খেয়ে চিঠিটা পড়ল। পড়ে মুবিন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার কি করা উচিত ভাবতে লাগল। শবনম ছোট বেলায় যখন তার আপার বাড়িতে এসেছে তখন অনেকবার তাকে দেখেছে। সে সময় তার সঙ্গে কথাবার্তা না বললেও গতবছর তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারপর কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে যখন শুনল, শবনমকে বড় ভাবীর ও আব্বার খুব পছন্দ এবং তাকে ছোট পুত্রবধূ করার। ব্যবস্থা করেছেন তখন মনে মনে খুশিই হয়েছিল। তাই ওয়াহাব তাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে, নাসিমার সঙ্গে দেখা হতে পারে ভেবে ছয় মাস হতে চলল, যায়নি। আজ শবনমের চিঠি পড়ে কি করবে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ নাসিমার কথা মনে পড়ল। ভাবল, তা হলে কি এর মধ্যে আল্লাহপাকের কোনো ঈশারা আছে? কথাটা ভেবে মনে কিছুটা শান্তি অনুভব করল।
মুবিনরা তিন ভাই তিন বোন। মুবিন সবার ছোট। অন্যান্য সব ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। মুবিন শবনমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিল, এই চিঠির কথা সারাজীবন গোপন রাখবে। শুধু শুধু ওদের দুজনের জীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না। বড় ভাবীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিল, কোনো বিশেষ কারণে আমি এখন বিয়ে কবর না। তুমি আব্বাকে কথাটা জানিয়ে দৌলতখানে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দাও।
মুবিনের চিঠি পেয়ে তার বড় ভাবি সুরাইয়া খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সে-ই শবনমকে পছন্দ করে স্বামী ও শ্বশুরদের বলে এতোটা এগিয়েছে। এখন শুধু বিয়ের দিন ঠিক করা বাকি। চিন্তা করল, এবার মুবিন বাড়িতে আসার পর যখন শবনমের সঙ্গে বিয়ের কথা বললাম তখন তো তাকে বেশ খুশি খুশি মনে হল। এখন আবার কি এমন হল যে, বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বলছে? তা হলে কি এর মধ্যে মুবিন ভোলাতে কোনো মেয়ে পছন্দ করেছে? কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে ঐ দিন রাতে ঘুমোবার সময় কথাটা স্বামীকে জানাল।
মুবিনের বড় ভাই লতিফ। স্ত্রীর কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
সুরাইয়া অধৈর্য গলায় বলল, কিছু বলছ না যে?
লতিফ বলল, কি আর বলব, মুবিন যদি এখন বিয়ে করতে না চায়, তা হলে আমরা তো জোর করে বিয়ে দিতে পারি না?
তা না হয় ঠিক, কিন্তু এত কিছুর পর বিয়ে ভেঙ্গে দিলে ভাবি ও তার বাবা-মা কী ভাববেন? তা ছাড়া আব্বাকে কথাটা কে জানাবে?
কেন? তুমি জানাবে। তুমি যখন সবকিছুর উদ্যোক্তা তখন তোমারই জানান উচিত।
আমি পারব না। ছি, ছি, মুবিন ভাইটা যে কী, আমি ভাবতেই পারছি না। তাই যদি মনে ছিল, কথাবার্তা হওয়ার পর-পরই জানাতে পারত।
কেন জানাল না, তা তোমার আদরের দেবর জানে। তুমিই তো তাকে সব থেকে বেশি লাই দাও। এখন তার ঠেলা তোমাকেই সামলাতে হবে।
আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু জানাতে পারব না।
একান্ত তুমি না পারলে, আমাকেই জানাতে হবে। হাজার হোক মুবিন আমাদের সবার ছোট। ছোটদের ন্যায় অন্যায় বড়দেরকে সামলাতে হয়। এখন রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়। কাল যা করার আমি করব।
পরের দিন লতিফ মুবিনের অমতের কথা মা-বাবাকে জানিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে তাদেরকেও জানিয়ে এল।
কথাটা শুনে খালেদার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। স্বামীকে বলল, মুবিনের বিয়েতে অমতের কারণ কিছু বুঝতে পারছ?
মজিদ বলল, না, তবে মনে হয় সে কোনো মেয়েকে ভালবাসে?
খালেদা বলল, তা হলে শবনমের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার পরপর অমত করল না। কেন?
মজিদ বলল, তখন হয়তো সেই মেয়ের সঙ্গে তেমন ভালবাসা জমেনি।
তোমার যেমন কথা। আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।
না হলে আমি কি আর করবো?
তুমি একবার ভোলায় গিয়ে মুবিন বিয়াইয়ের সঙ্গে দেখা কর।
তা সম্ভভ নয়। এটা কি দাওয়াত খাওয়ার ব্যাপার? রাগ করে না এলে তোষামোদ করে আনব। বিয়ে-শাদীর ব্যাপার জোর করে কিছু করা যায় না। পাত্র রাজি থাকলে তার মা-বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান যায়। কিন্তু পাত্র যেখানে নিজেই অরাজি সেখানে কিছু করতে যাওয়াটা বোকামী।
কিন্তু আম্মা-আব্বাকে খবরটা তো জানাতে হবে?
তুমিই যখন এটার সবকিছু করেছ তখন তুমিই গিয়ে জানিয়ে এস।
আমি কোন মুখ নিয়ে তাদের কাছে যাব?
যেতে না পারলে চিঠি দিয়ে জানাও।
আচ্ছা তুমি কি বলত? তোমার শালীর বিয়ে ভেঙ্গে গেল, আর তুমি কোনো গুরুত্ব। দিচ্ছ না। শালীর প্রতি তোমার কি কোনো দায়িত্ব নেই?
মজিদ হেসে উঠে বলল, পাত্র-পাত্রীর অমতে জোর করে বিয়ে দিলে বুঝি দায়িত্ব পালন করা হত। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি আমার কাছে সব কিছু গোপন। করলেও আমি জানতে পেরেছি, শবনমের অমতে তুমি তোমার মা-বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছ। এমন কি আমার কাছেও সব কিছু গোপন করেছ। তুমি শিক্ষিত ও ধার্মিক পরিবারের মেয়ে। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। স্বামীর কথা শুনে খালেদা নিজের ভুল বুঝতে পারল। আরো বুঝতে পারল যে, তার উপর স্বামী মনে মনে রাগ করেছে এবং মনেও কষ্ট পেয়েছে। তাড়াতাড়ি স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে না জানিয়ে অন্যায় করেছি। আমাকে মাফ করে দাও।
মজিদ তাকে বুকে জড়িয়ে আদর দিয়ে বলল, যে কোনো বিষয়ে স্ত্রীর উচিত, স্বামীকে জানান। যে সব স্ত্রীরা তা করে না, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক আর থাকে না, অনেক হালকা হয়ে যায়। তুমি যে নিজের অন্যায় বুঝতে পেরেছ, তাতে আমি খুশি হয়েছি।
খালেদার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, বল মাফ করে দিয়েছ?
মজিদ তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, স্কুলে দেখার পর থেকে অনেক বছর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে তোমাকে পেয়েছি। তোমার সব অন্যায় আমার কাছে। ক্ষমার যোগ্য। তা ছাড়া যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধনের চেষ্টা করে, তাকে আল্লাহ মাফ করে দেন এবং তাকে ভালবাসেন। আর তুমি তো আমার প্রাণাধিকা স্ত্রী। তোমাকে মাফ না করে কি পারি? এবার তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি শবনমের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিও না। আল্লাহপাক যার সঙ্গে যার জোড় রেখেছেন, তার সঙ্গে তার বিয়ে হবেই। ধনী ঘরের শিক্ষিত রোজগারী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলেই যে, মেয়ে সুখী হবে, এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। সমাজে কত ধনী লোক গরিব হচ্ছে। আবার কত গরিব লোক ধনী হচ্ছে; এরকম তো কতই দেখা যায়। এই তোমার আব্বার কথাই ধর না; ওঁর আব্বার আগে কত জায়গা-জমি ছিল। নদীতে সব ভেঙ্গে যাওয়ার পর একরকম নিস্ব হয়ে শ্বশুর বাড়ীতে এসে উঠেন। শ্বশুরের সম্পত্তি না পেলে ওঁর অবস্থা কি হত, চিন্তা করে দেখ। আল্লাহপাকের ঈশারায় অবস্থা আজ কত ভালো। শবনম যে ছেলেটাকে ভালবাসে তার বাপেরও ঐ একই অবস্থা। তারপর তার আব্বা মারা যাওয়ার পর তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আল্লাহপাকের ঈশারা থাকলে ভবিষ্যতে ঐ ছেলের অবস্থা ফিরে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ প্রত্যেক মা-বাবা মেয়েকে স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত ও রোজগারী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। তাই বলে সাবালিকা মেয়ের অমতে জোর করে কিছু করা উচিত নয়।
খালেদা বলল, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। শবনমের পরীক্ষার পর বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার কথা। তার আগে একদিন গিয়ে মুবিনের অমতের কথা বলে আসব।
.
০৮.
সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম যাওয়ার তিন মাস পর অসুস্থ হয়ে বাড়ি এলেন। শ্বশুরের অসুখের কথা শুনে মজিদ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এলেন। একদিন। মজিদ শ্বাশুড়ীকে মুবিনের অমতের কথা বলল।
যুবাইদা খানম আতঙ্কিত হয়ে বললেন, তা হলে এখন কি হবে বাবা? তোমার শ্বশুর শুনলে তো হার্টফেল করবে।
মজিদ বলল, ওঁকে এখন একথা জনাবেন না। আর বিয়ে শাদীর ব্যাপার আল্লাহ পাকের হাতে। তিনি শবনমের জোড়া যেখানে রেখেছেন সেখানেই হবে। ওসব নিয়ে আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আব্বা সুস্থ হয়ে উঠলে আপনি তাকে জানাবেন। উনি জ্ঞানী লোক। সামলে নেবেন।
সেখানে খালেদাও ছিল। স্বামী থেমে যেতে বলল, হ্যাঁ আম্মা, তোমার জামাই ঠিক কথা বলেছে। আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হবে। মানুষ জোর করে কিছু করতে পারে না।
যুবাইদা খানম বললেন, তোমরা শবনমের জন্য অন্য ছেলের খোঁজ কর। এদিকে সামসুদ্দিনের জন্য খালেদার আব্বা ফজল ঘটককে মেয়ে দেখতে বলেছিল। সে সময় ফজল ঘটক চৌকিরঘাটের একটা মেয়ের কথা বলেছিল। মেয়েটা নাকি দেখতে শুনতে ভালো। কলেজে পড়ে। অনেক রকম হাতের কাজও জানে। কিন্তু মেয়ের বাপের অবস্থা ভালো নয়। শুনে আমরা না করে দিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে ফজল ঘটক এসে বলল, সামসুদ্দিন নাকি তাকে বলেছে, সে ঐ মেয়েকে বিয়ে করবে।
খালেদা বলল, সামসুদ্দিন যখন জেনে শুনে গরীবের মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তখন আর অসুবিধা কিসের?
যুবাইদা খানম বললেন, আমি তোর আব্বাকে সে কথা বলেছি। শুনে সেও তাই বলল।
খালেদা বলল, চৌকিরঘাট তো কাছেই। আব্বা একটু সুস্থ হলে তোমাদের জামাইকে নিয়ে একদিন মেয়ে দেখতে যাব।
যুবাইদা খানম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবেছিলাম, শবনম ও সামসুদ্দিনের বিয়ে একসঙ্গে দেব, কিন্তু তা আর হবে কি না আল্লাহ মালুম।
মজিদ এতক্ষন চুপ করে ছিল। শাশুড়ী থেমে যেতেই বলল, সামসুদ্দিন ভাইয়ের এবার বিয়ে দেওয়া উচিত। বয়স অনেক হয়েছে। আল্লাহর যখন মর্জি হবে তখন শবনমের হবে। তা ছাড়া শবনমের বয়সই বা কত? এর মধ্যে যদি সে রকম ভালো ছেলে পাওয়া যায়, তা হলে এক সঙ্গেই হবে। নচেৎ ও পাশ করার পর কলেজে পড়ক। আমরা ছেলের সন্ধান করতে থাকি।
যুবাইদা খানম বললেন, তোমরা যা ভালো বুঝ তাই কর বাবা।
খালেদা প্রায় মাস খানেক হতে চলল বাপের বাড়িতে রয়েছে। মজিদও শ্বশুর বাড়িতে থেকে স্কুল করছে। মাঝে মাঝে অবশ্য বাড়িতে যায়।
সাখাওয়াত হোসেন সুস্থ হওয়ার পর আব্বার অনুমতি নিয়ে খালেদা স্বামী ও মাকে নিয়ে চৌকির ঘাটে মেয়ে দেখতে গেল। মেয়ে পছন্দ হলেও মেয়ের বাপের আর্থিক অবস্থা দেখে খুশি হতে পারল না। ফিরে এসে আব্বাকে সে কথা জানাল।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, আমি মেয়ের বাপের অবস্থা জানি। তোর আম্মা গরিবের মেয়েকে বৌ করতে চায় না। কিন্তু সামসুদ্দিন যখন ঐ মেয়েকে বিয়ে করবে বলেছে তখন আর আপত্তি করার কি আছে। ভাবছি এবারে দিন করে ফেলব। তিনি স্ত্রীর কাছে শবনমের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা আগে শুনেছেন। এখন ছেলের বিয়ের কথা বলার পর বললেন, শবনমের বিয়েটাও একই সঙ্গে দেব ভেবেছিলাম। তা আর হল না।
মজিদ বলল, আব্বা, আল্লাহপাকের যা মর্জি তাতে আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। শবনম এখন পড়াশোনা করতে থাকুক। আমরা ওর জন্যে পাত্রের খোঁজ করব। তেমন। ভালো ছেলে পাওয়া গেলে বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, তাই হবে বাবা, আল্লাহর মর্জি ছাড়া তো মানুষ কিছু করতে পারে না।
শবনমের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সে পড়া নিয়ে ব্যস্ত। আপার উপর অভিমান এখনো যায়নি। ভাগনা-ভাগনিদের আদর করলেও আপা বা দুলাভাইয়ের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না।
একদিন খালেদা তাকে বলল, তুই যে সেই থেকে আমার উপর রাগ করে আছিস, তা আমি জানি। আমি তোর বড় বোন। একটু শাসন করার অধিকারও কি আমার নেই? আর তোর দুলাভাই দুঃখ করছিল, তুই নাকি তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলিস না। তার উপর রাগ করে আছিন কেন? সে কি তোকে কিছু বলেছে?
শবনম কোন কথা না বলে চুপ করে রইল।
কিরে কিছু বলছিস না যে?
শবনম ভিজে গলায় বলল, তোমাদের উপর রাগ করলেই বা কি, আর না করলেই বা কি। তোমরা অভিভাক। ছোটরা অন্যায় করলে শাসন তো করবেই। তারপর কুঁপিয়ে উঠল।
খালেদা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার উপর রাগ করে থাকিস না বোন। সে দিন রাগের মাথায় যা করেছি, তা ভুলে যা। আর শোন, আমার বড় ননদের দেবরের সঙ্গে যে তোর বিয়ের কথা হয়েছিল, তা ভেঙ্গে গেছে। ছেলে এখন বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে। তোর দুলাভাই আম্মা আব্বাকে সে কথা জানিয়ে বলল, শবনম পাশ করার পর কলেজে পড়ক, পরে আমরা ভালো ছেলে দেখে ওর বিয়ে দেব।
কথাটা শুনে শবনমের মন মুবিনের উপর কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। ভাবল, ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। তারপর মনে মনে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করল।
এর কয়েক দিন পর মজিদ স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। সাখাওয়াত হোসেন মেয়ে জামাই থাকতেই চৌকিরঘাটের মেয়ের সাথে সামসুদ্দিনের বিয়ের দিন ঠিক করে চট্টগ্রামে চলে গেছে। শবনম শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে চিন্তা করল, আতাহার ভাই চিঠিতে জানিয়েছিল; পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে এসে যা করার করবে; কিন্তু এল না কেন? এলে তো নিশ্চয় দেখা করত?
আরো কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরও যখন আতাহার এল না তখন একদিন নাসির উদ্দিনকে সে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করল।
নাসির উদ্দিন বলল, আতাহার অনেক দিন থেকে কঠিন অসুখে ভুগছে। সে ঢাকায় হাসপাতালে আছে। তার মা কয়েকদিন হল তার কাছে গেছে। এখন কেমন আছে জানি না।
শুনে শবনম চমকে উঠল। তার মন কেঁদে উঠল। চোখে পানি এসে যেতে মেজ ভাই দেখলে কি মনে করবে ভেবে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করল, আল্লাহ পাক, তুমি ওকে ভালো করে দাও। আমি চার জুম্মা রোযা রাখব, একশো রাকাত নফল নামায পড়ব। তুমি রহমানুর রহিম, তোমার রহমতের কোনো শেষ নেই। ওর উপর রহমত কর। তোমার হাবীবে পাকের উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। তাঁরই অচিলায় তোমার এই নাদান বান্দীর দোয়া কবুল করো। আমিন। এরপর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর আতাহারের রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতে লাগল। আর সেই সঙ্গে মানতের রোযা ও নফল নামায আদায় করতে লাগল।
দীর্ঘ দুইমাস অসুখে ভোগার পর সুস্থ হয়ে আতাহার গ্রামের বাড়িতে এল। সে অসুখের কথা শবনমকে জানায়নি। কারণ তার অসুখের কথা শুনে যদি শবনমের পরীক্ষার ক্ষতি হয়। আর পরীক্ষার পর সে স্কুলে যাবে না। চিঠি দিলে কাজ হবে না। ভেবে সুস্থ হওয়ার পরও দেয়নি। অসুখে পড়ে হাসপাতালে দুশ্চিন্তায় দিন কাটিয়েছে। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে শবনমকে হেফাজতে রাখার দোয়া করেছে। তারপর আম্মার কাছে যখন শুনল, তার বিয়ে এখনো হয়নি তখন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। বাড়িতে এসে কুলসুমের কাছে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে চোখে পানি ধরে রাখতে পারল না। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কার কাছে শুনেছিস?
কুলসুম বলল, নাসির উদ্দিন ভাইয়ের কাছে।
আতাহার দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ে আল্লাহপাকের কাছে মনের বাসনা জানাল। তারপর শবনমের সঙ্গে কি করে দেখা করবে সেই চিন্তা করতে লাগল।
বিকেলে নাসির উদ্দিন কুলসুমকে পড়াতে এসে আতাহারকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আল্লাহপাকের কাছে শুকরিয়া জানাই, তিনি তোকে সুস্থ করে দেশে আনলেন।
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আল্লাহপাকের দয়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেলাম, নচেৎ যে অসুখ হয়েছিল কবেই মরে যেতাম। তুই ভালো আছিস? তোদের বাড়ির সবাই ভালো?
আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই ভালো আছি।
আতাহার বলল, আজ আর পড়িয়ে কাজ নেই, চল তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
নাসির উদ্দিন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোকে একটা কথা বলব, আমার উপর রাগ করবি না বল?
রাগ করব কেন? বল কি বলবি।
তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে আম্মা নিষেধ করেছে। কারণটা বলছি শোন, আমি তোর আর শবনমের ব্যাপারটা অনেক আগে থেকে জানি। এটাকে আমি খারাপ কিছু ভাবতাম না। কিন্তু তোর আব্বা মারা যাওয়ার পর তুই যখন লেখাপড়া বন্ধ করে দিলি তখন থেকে তাদের পরিণতির কথা ভেবে খারাপ লাগত। গতবারে এসে তুই চলে যাবার পর আপা তার বড় ননদের দেবরের সঙ্গে শবনমের বিয়ে দেবার কথা বলতে শবনম প্রতিবাদ করে বলেছিল, সে তোকে ভালবাসে এবং তোকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসবে না। শুনে আপা ও আম্মা শবনমকে মেরেছিল। তারপর আব্বা চরখলিফায় গিয়ে আপার ননদের দেবরের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে আসে। ঠিক হয়েছিল, শবনমের পরীক্ষার পর বিয়ে হবে। কিন্তু কেন কি জানি কিছুদিন আগে আপা আর দুলাভাই এসে জানাল, সেই ছেলে এখন বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে। সে সময় আব্বা অসুখে বাড়িতে ছিল। তাকে আপা ও দুলাভাই সেই কথা জানিয়ে বলল, শবনম পাশ করলে কলেজে পড়বে। সামসুদ্দিনের বিয়ের ব্যবস্থা করুন। এর মধ্যে তারা অন্য পাত্রের সন্ধান করবে। আব্বা শুনে বলল, আমার ইচ্ছা ছিল, শবনম আর সামসুদ্দিনের বিয়ে একসঙ্গে দেব। আল্লাহ যখন তাতে রাজি নয় তখন তোমরা যা বলছ তাই হবে। এবার তুই-ই বল, তোকে কি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে?
আতাহার বলল, না উচিত হবে না। তারপর বলল, শবনম আমাকে বিয়ের কথা চিঠিতে লিখে জানিয়েছিল, তবে মারধর করার কথা বা এত কিছু ডিটেলস্ জানায়নি। সবকিছু জানিয়ে ভালই করলি। তুই শবনমের সঙ্গে অন্ততঃ একবার দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারবি না?
নাসির উদ্দিন বলল, দেখ শবনম আমার বোন, আর তুই আমার বন্ধু। তোদের কারো মনে ব্যথা দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু আমি তোদেরকে কোনো রকম সাহায্য করতে অক্ষম। তবে আজ হয়তো দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারব। ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ জানে। বলছি শোন, বড় খালা বেশ কিছু দিন থেকে অসুখে ভুগছে। আজ সকালে শবনম তাকে দেখতে গেছে। আমিও তার সঙ্গে গিয়েছিলাম। এখন আম্মা তাকে নিয়ে আসতে বলেছে। আমি বলেছি মাগরিবের নামাযের পর আনতে যাব। মাগরিবের নামায পড়ে তুই আমার সঙ্গে গিয়ে পথে অপেক্ষা করবি। আমি শবনমকে নিয়ে ফেরার সময় তোর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিতে পারি।
আতাহার উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তাই করিস, তোকে যে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
নাসির উদ্দিনের ঐ খালার বাড়ি গুপ্তগঞ্জে। সেদিন আর পড়ান হল না। দুবন্ধুতে গল্প করে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে গুপ্তগঞ্জ বাজারের মসজিদে মাগরিবের নামায পড়ল। তারপর নাসির উদ্দিন তাকে সঙ্গে করে কিছুদূর এসে বলল, তুই এখানে অপেক্ষা কর, আমি শবনমকে নিয়ে আসি।
আতাহার বলল, ঠিক আছে যা।
প্রায় আধা ঘন্টা পর নাসির উদ্দিন শবনমকে নিয়ে আসার সময় তাকে বলল, আতাহার তোর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছে। আমি তার কাছে তোকে রেখে কাছাকাছি। থাকব।
শবনম অবিশ্বাস্য সুরে বলল, সত্যি বলছিস মেজভাই? দুষ্টুমী করছিস না তো?
হারে সত্যি। অন্য সময় তোর সঙ্গে দুষ্টুমী করলেও এখন করছি না।
গুপ্তগঞ্জে এখনও বিদ্যুৎ যায়নি। কিন্তু সেদিন ছিল চতুর্দশী। চাঁদের আলোয় চারদিক উজালা। কিছুদূর আসার পর নাসির উদ্দিন বলল, ঐ যে সামনে আতাহার দাঁড়িয়ে আছে। তুই যা আমি এখানে আছি।
শবনম একবার আতাহারের দিকে চেয়ে নিয়ে ভয়ে ভয়ে মেজভাইয়ের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
নাসির উদ্দিন বলল, কিরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা দেরি করিস না।
আতাহার তাদেরকে দেখতে পেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।
তাই দেখে নাসির উদ্দিন বলল, আতাহার এদিকে আসছে, আমি অল্প দূরে আছি বলে কিছুটা পিছিয়ে এসে রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল।
আতাহার শবনমের কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?
প্রায় আট দশ মাস পর আতাহারের ভাঙ্গা শরীর দেখে শবনম নিজেকে সামলাতে পারল না। কোনো রকমে সালামের উত্তর দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আল্লাহপাক আমার মনের আশা পূরণ করেছেন, সেজন্য তাঁর পাক দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
তার কান্না দেখে আতাহারের চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, অসুখে পড়ে কথামত আসতে না পেরে যা দুশ্চিন্তায় দিন কাটিয়েছি তা আল্লাহ মালুম। হাসপাতালে আম্মার মুখে তোমার বিয়ে হয়নি শুনে আল্লাহপাকের দরবারে লাখোকোটি শুকরিয়া জানিয়ে তোমাকে হেফাজতে রাখার জন্য ফরিয়াদ করেছি। তারপর বাড়িতে এসে কুলসুমের কাছে ও তোমার মেজ ভাইয়ের কাছে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে শোকরানার নামায পড়েছি।
শবনম সামলে নিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে যাবার নেপথ্যের কাহিনী না বলে বলল, কি করবে না করবে কিছু ভেবেছ? আবার যদি অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে?
আতাহার বলল, ভেবে কিছু করার মতো এখন আমার শারিরীক ও মানসিক অবস্থা। নেই। আর আমার আর্থিক অবস্থার কথাও তুমি জান। তকদিরের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আল্লাহপাক যখন একটা ফাড়া কাটিয়েছেন তখন পরেরগুলোও কাটাবেন। তার উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রাখা ছাড়া অন্য কোনো পথ মাথায় আসছে না।
শবনম বলল, আমি একটা কথা বলব শুনবে?
বল।
এবারে ঢাকা যাবার সময় আমাকেও নিয়ে চল। সেখানে তো তোমার মামা-খালা আছেন। তারা সবকিছু জানার পর নিশ্চয়ই আমাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন।
না শবনম তা হয় না। তুমি যা বললে তা হয়তো তারা করবেন। তবু এটা আমি পারব না। তোমাকে ভালবেসেছি বললে ভুল হবে, এক কথায় তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, কিন্তু তাই বলে তোমার আম্মা-আব্বার ও তোমাদের বংশের মুখে চুন কালি লেপন করতে পারব না। তবে একথা বিশ্বাস রেখ, অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ আমি কিছু একটা করবই।
সে বিশ্বাস আমার আছে আতাহার ভাই। তবু মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়।
ভয়ের কি আছে? প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। নাসির উদ্দিন বলছিল, রেজাল্ট বেরোবার পর তুমি কলেজে ভর্তি হবে। তখন তোমাকে কলেজের ঠিকানায় চিঠি দেব। বাড়িতে এলে যাতায়াতের পথে দেখা করব।
এমন সময় নাসির উদ্দিন তাদের কাছে এসে বলল, তোদের কথা শেষ হয়েছে? এবার চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আতাহার শবনমকে বলল, এবার যাও।
তারপর নাসির উদ্দিনকে বলল, তোর এই উপকারের কথা সারাজীবন মনে থাকবে।
নাসির উদ্দিন শবনমকে নিয়ে চলে গেল।
আতাহার কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে বাড়ির পথ ধরল।
আতাহারের ফুফাতো বোন রমিসা ও তার স্বামী মুনসুর শবনমদের সবাইকে চেনে। আতাহারের সঙ্গে শবনমের সম্পর্কের কথা মুনসুর একটু আধটু স্ত্রীর মুখে শুনেছে। কিন্তু প্রমাণ না পেয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আজ সে সন্ধ্যের পর গুপ্তগঞ্জ বাজারে কিছু সদাইপাতি করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে নাসির উদ্দিনকে রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করল, তুমি সাখাওয়াত হোসেন চাচার ছেলে নাসির উদ্দিন না? এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
নাসির উদ্দিন বলল, একটা লোকের জন্য অপেক্ষা করছি।
মুনসুর আর কিছু না বলে চলে গেল।
নাসির উদ্দিন জানে মুনসুর কি ধরনের লোক। ভাবল, যেতে যেতে ওদেরকে দেখলে আম্মাকে বলে দিতে পারে। এই কথা ভেবে বেশ আতঙ্কিত হয়ে একটু এগিয়ে এসে তার দিকে লক্ষ্য রাখল, ওদের দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে কিনা। তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল, ওদেরকে হয়তো দেখেনি। শবনমকে নিয়ে ঘরে ফেরার সময় জিজ্ঞেস করল, আতাহারের ফুফাতো দুলাভাই মুনসুর আমাকে দেখেছে। মনে হয় তোদেরকেও দেখেছে। আম্মাকে বলে একটা গোলমাল বাধাতে পারে।
শবনম বলল, লোকটা যা পাজী, বাধালেও বাধাতে পারে।
মুনসুর, আতাহার ও শবনমকে কথা বলতে দেখেছে ঠিক; কিন্তু তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস না করে চলে আসে। কারণ তখন তার মাথায় একটু কূটবুদ্ধি এসেছে। ভাবল, এতদিন ওদের ভালবাসার কথা শুনলেও প্রমাণ পাইনি। আজ যখন পেলাম তখন আতাহারকে জব্দ করে ছাড়বে।
পরের দিন এক সময় শবনমদের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে বলল, চাচি একটা কথা বলতে এলাম। গতকাল রাত আটটার সময় শবনম ও আতাহারকে গুপ্তগঞ্জ বাজারের কাছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম। শবনম সেয়ানা হয়েছে, তার কি এটা করা উচিত হয়েছে? আপনি ওর দিকে খুব লক্ষ্য রাখবেন। আপনাদের বংশের কত সুনাম। লোক জানাজানি হয়ে গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে? তা ছাড়া ওর বিয়ে দিতে পারবেন? আতাহারের বাপ মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চোরা কারবার করে। আর বলে কিনা চাকরি করে। সব মিথ্যে কথা। আমার বড় শালী ঢাকায় থাকে। কিছুদিন আগে তাদের ওখানে গিয়েছিলাম। আতাহার কি করে না করে তারা সব জানে। তাদের কাছেই আমি আতাহারের কীর্তিকলাপ শুনেছি।
যুবাইদা খানম অবাক হলেন। বললেন, আতাহার কেমন ছেলে তা আমার জানার দরকার নেই; কিন্তু শবনমের সঙ্গে তার দেখা হবে কি করে? গতকাল সকালে সে গুপ্তগঞ্জে তার খালার বাড়ি গিয়েছিল। সন্ধ্যের পর নাসির উদ্দিন তাকে নিয়ে এসেছে।
মুনসুর বলল, নাসির উদ্দিন তখন ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে আমি কথাও বলেছি, তারপর বলল, আচ্ছা চাচি নাসির উদ্দিন কি আতাহারের বোন কুলসুম ও খাদিজাকে প্রাইভেট পড়ায়?
কই না তো? সে ওদেরকে প্রাইভেট পড়াতে যাবে কেন? কে তোমাকে বলেছে?
কেউ বলেনি, পাশা-পাশি ঘর এমনিই জানা যায়। ওদেরকে পড়ায় জানতে পেরে আমি একদিন নাসির উদ্দিনকে বললাম, আমার দুটো ছেলেমেয়েকে পড়াবে? একশো টাকা বেতন দেব। নাসির উদ্দিন বলল, আমি কাউকে প্রাইভেট পড়াই না। আমি তখন ওদেরকে পড়াবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ওদেরকে তো বেতন নিয়ে পড়াইনি। বন্ধুর বোন হিসাবে পড়াগুলো একটু দেখিয়ে দিই। আপনি জানেন কিনা জানি না। আতাহারের একটা বোন বিয়ের লায়েক হয়ে উঠেছে। ওর মায়ের যা স্বভাব, আমার মনে হয়, নাসির উদ্দিনকে মেয়ে গচাবার তালে আছে।
যুবাইদা খানম বুঝতে পারলেন, নাসির উদ্দিনের সাহায্যেই গতরাতে ওদের সাক্ষাৎ হয়েছে। কথাটা বুঝতে পেরে শবনম ও নাসির উদ্দিনের উপর খুব রেগে গেলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। গম্ভীর স্বরে বললেন, কথাটা বলে তুমি ভালো করেছ। ঠিক আছে তুমি এখন যাও, যা করার আমি করব।
যুবাইদা খানম যে খুব রেগে গেছেন, তা বুঝতে পেরে মুনসুরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, যাই চাচি, আমাকে আবার বাজারে যেতে হবে। ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, এবার খেলাটা ভালভাবেই লাগবে।
মুনসুর যখন ঐসব কথা বলছিল, তখন শবনম ঘরে ছিল এবং সব কিছু শুনেছে; কিন্তু নাসির উদ্দিন ছিল না। সে আসার পর শবনম তাকে মুনসুর মাকে যা যা বলেছে। সব বলল।
নাসির উদ্দিন বলল, কালকেই তোকে বললাম না, লোকটা ভীষণ খারাপ।
শবনম বলল, আম্মা সেই থেকে খুব রেগে আছে। মনে হয় আমাদেরকে খুব বকাবকি করবে।
নাসির উদ্দিন বলল, কি আর করা যাবে। দোষ যখন করেছি তখন বকাবকি হজম করতে হবে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর শবনম ও নাসির উদ্দিনকে ডেকে বললেন, তোরা দুভাই বোন কি বংশের মুখে চুন কালি দিবি? তারপর শবনমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর লজ্জা শরম বলতে কি কিছু নেই? এখনো তুই আতাহারের সঙ্গে দেখা করিস? আজ মুনসুর এসে যে কথা বলে গেল, সে কথা পাঁচজন শুনলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? আতাহার কি তোর উপযুক্ত? জামাই বলে গেল, সে বড় ঘরের শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করছে। তাই তোকে কলেজে পড়াবার কথা বলল। আর তুই কিনা আতাহারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিস? আতাহারের বাপের কি আছে? তোকে খাওয়াবে কি? তা ছাড়া মুনসুর ঢাকায় গিয়ে শুনে এসেছে, সে চোরা কারবার করে। ছিঃ ছিঃ এমন জঘন্য ছেলের সাথে তুই সম্পর্ক রেখেছিস। তারপর নাসির উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোর কি জ্ঞান-গম্য বলতে কিছু নেই। বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দিস? তোকে তো কতবার বলেছি, আতাহারের সঙ্গে মিশবি না। তবু তার সঙ্গে মিশিস কেন? আর তুই নাকি আতাহারের দুই বোনকে রোজ পড়াতে যাস। আতাহারের এক বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। সেই জন্যে যাস বুঝি? দাঁড়া তোর আব্বা আসুক, তারপর তোদের দুজনের কি করি দেখবি।
নাসির উদ্দিন সাহস করে বলল, আম্মা মুনসুর কি জঘন্য ধরনের লোক তা জেনেও তার কথা বিশ্বাস করলে? তার কাজই হলো মানুষের দোষ খোঁজে বেড়ান। আর একটা দোষ পেলে তার সঙ্গে হাজারটা মিথ্যে মিশিয়ে প্রচার করা।
যুবাইদা খানম বললেন, তা আমি জানি। তোকে আর ফুট কাটতে হবে না। একটা দোষই বা তোরা করবি কেন? সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক পাঁচকান হলে তোদের। আব্বার মান-সম্মান বাড়বে না কমবে? আজ বাদে কাল তোদের বড় ভাইয়ের বিয়ে। এখন যদি মুনসুর তোদের নামে এসব কথা পাঁচজনের কাছে বলে বেড়ায়, তা হলে কি হবে ভেবেছিস? এবার তোরা যা আমার সামনে থেকে। তারপর ভেবে রাখলেন, কাল আতাহারের মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন।
পরের দিন যুবাইদা খানম ছোট ছেলে কলিম উদ্দিনকে সাথে নিয়ে যখন আতাহারদের ঘরে গেলেন, তখন আতাহার বাইরে ছিল।
রফিকা বেগম শবনম ও আতাহারকে নিয়ে এতকিছু ঘটনা ঘটেছে তা জানতে না। তাই যুবাইদা খানমকে দেখে খুশি হয়ে বসতে বলে বললেন, আমার কি সৌভাগ্য। আজ হঠাৎ কি মনে করে এলেন আপা?
যুবাইদা খানম রাগের সঙ্গে বললেন, আমি বসতে আসিনি, একটা কথা বলতে এলাম। শুনুন আতাহারকে সাবধান করে দেবেন, সে যেন শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে। আমার মেয়ের দুর্নাম রটলে কি হবে ভেবে দেখেছেন? আপনি জানেন কি না। জানি না, সে শবনমকে বিয়ে করতে চায়। আপনিই বলুন, এটা কি সম্ভব?
রফিকা বেগম ছোটবেলায় তাদের দুজনের মিল দেখে ভাবতেন, আল্লাহ যদি রাজি থাকে, তা হলে শবনমকে বৌ করবেন। স্বামী মারা যাবার পর সে কথা ভুলে গেছেন। তারপর আতাহার যে এখনো তার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে, তা জানতেন না। বললেন, আপা আপনি আমার উপর রাগ করবেন না। আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। ঠিক আছে আতাহারকে আমি শাসন করে শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে দেব। আপনি বসুন আপা, একটু কিছু মুখে দিয়ে যান।
যুবাইদা খানম বললেন, বসতে পারব না। হাতের কাজ ফেলে এসেছি। আর একটা কথা বলে যাই, ঘরে সেয়ানা মেয়েকে সেয়ানা ছেলের কাছে পড়াতে নেই। আশা করি আমার কথাগুলো মনে রাখবেন, নচেৎ এর পরিণাম ভালো হবে না। তারপর কলিম উদ্দিনকে নিয়ে ফিরে এলেন।
রফিকা বেগম ছেলের উপর রেগে রইলেন। একটু পরে আতাহর ঘরে এলে রাগের সঙ্গে বললেন, কিছুক্ষণ আগে শবনমের মা এসে বলে গেলেন, তুই নাকি শবনমের সঙ্গে এখনো মেলামেশা করিস? তাকে বিয়েও করতে চাস?
আতাহার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল, উনি সত্যি কথাই বলেছেন।
রফিকা বেগম রাগতে গিয়েও পারলেন না। চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বললেন, না বাবা না, এটা কখনো সম্ভব নয়। শবনমের বাবার অবস্থা ভালো। তা ছাড়া সে তোর চেয়ে বেশি শিক্ষিত। শবনম চাইলেও তার মা-বাবা কিছুতেই তোর সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। তুই গরিবের ছেলে। এই অভাবের সংসারে এসে সে খুব অশান্তি ভোগ করবে। তোর এখন বিয়ের বয়সও হয়নি। আমাকে যদি আম্মা বলে ডেকে থাকিস, তা হলে শবনমের কথা ভুলে যা। তার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করবি না। আর শবনমের ভাই নাসির উদ্দিনকে কুলসুমদের পড়াতে আসতে নিষেধ করে দিস।
আতাহার কোনোদিন মায়ের কোনো কথার প্রতিবাদ করেনি। আজও করল না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
রফিকা বেগমও জানেন, আতাহার কখনো তার কথার অবাধ্য হয়নি। তাই আর কিছু না বলে বললেন, আয় নাস্তা খাবি আয়।
পরের দিন মসজিদে মাগরিবের নামায পড়তে গিয়ে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আতাহারের দেখা হতে চিন্তা করল, ব্যাপারটা কতটা গড়িয়েছে জানা দরকার। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, আজ পড়াতে এলি না যে?
নাসির উদ্দিন বলল, আমি যে কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াতে যাই তা আম্মা জানত না। পরশুদিন রাতে তুই আর শবনম যখন গুপ্তগঞ্জ বাজারের কাছে কথা বলছিলি, তখন মুনসুর দেখেছিল। কাল আমাদের বাড়িতে এসে সে কথা ও পড়াবার কথা আম্মাকে বলে গেছে। আর তোর সম্বন্ধে অনেক বদনামও করেছে। তারপর তার আম্মার বকাবকির কথা বলে বলল, আমি আর পড়াতে যাব না। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। যত গণ্ডগোলের মূলে ঐ মুনসুর।
আতাহার বলল, খুন করতে যদি আল্লাহ নিষেধ না করতেন, তাহলে কবেই ওকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম। আত্মীয় হয়ে যে আত্মীয়ের এত বড় দুশমন হয়, তা এই নরপিশাচকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
.
আজ পনের দিন হয়ে গেল আতাহার ঢাকা থেকে এসেছে। কাল চলে যাবে। যাওয়ার আগে শবনমের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার মন খুব ছটফট করছে; কিন্তু মায়ের নিষেধের কথা মনে করে তা পারছে না। মসজিদে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু তাকেও কিছু বলতে পারছে না। আজ আসরের নামায পড়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চৌধুরীদের বাগানে গেল। আলমাসকে কাজ করতে দেখে সালাম দিয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছ? অনেক দিন আসনি কেন?
আতাহার বলল, ঢাকায় ছিলাম। সেখানে অসুখ করেছিল। কয়েকদিন হল এসেছি।
আলমাস বলল, চৌধুরী হুজুর এসেছেন, তিনি তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
আতাহার বলল, তাই নাকি? চলুন তা হলে ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
আলমাস বলল, আমি এখন কাজ করছি যেতে পারব না। তুমি যাও। আমাদের ঘরের পিছনের ঘরটায় চৌধুরী হুজুর থাকেন। উনি বারান্দায় বসে কেতাব পড়ছেন।
আতাহার সেখানে গিয়ে সালাম দিল।
চৌধুরী হুজুর কেতাব বন্ধ করে সালামের উত্তর দিয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি আতাহার না?
আতাহার বলল, জ্বি।
চৌধুরী হুজুর পাটির উপরে বসে ছিলেন। বললেন, আমার কাছে এসে বস।
আতাহার বসে বলল, কেমন আছেন হুজুর?
আল্লাহপাক ভালই রেখেছেন। তা তোমার মন খারাপ কেন? শরীরও খুব ভেঙ্গে গেছে দেখছি।
জ্বি, অনেক দিন অসুখে ভুগেছি।
অসুখ বিসুখ সবারই হয়, তাতে মন খারাপ করার কি আছে?
আতাহার চিন্তা করতে লাগল, হুজুরকে শবনমের ব্যাপারটা বলবে কিনা?
চৌধুরী হুজুর তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছ। লজ্জায় বলতে পারছ না? লজ্জার কি আছে? কোনো বিপদে পড়লে বল, ইনশাআল্লাহ। তা দূর করার চেষ্টা করব।
আতাহার ওঁর দুপা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
চৌধুরী হুজুর পা থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, আহা কি হয়েছে বলবে তো।
আতাহার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার আব্বা মারা গেছেন, আপনি জানেন?
হ্যাঁ জানি।
আব্বা মারা যাওয়ার পর আর্থিক দূরবস্থার কারণে আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চাকরি করছি।
তা তো ভালই করেছ, এখন কি বিপদ তাই বল।
আতাহার ছোটবেলা থেকে শবনমের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা এবং আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবই বলল। তারপর আবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি এর একটা সুরাহা করে দিন।
চৌধুরী হুজুর আবার পা থেকে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি সুরাহা করবার কে? তুমি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। আর আমি যা বলব, তা যদি মেনে নাও, তা হলে ইনশাআল্লাহ এটার একটা সুরাহা হতে পারে।
আতাহার বলল, আপনি যা বলবেন, ইনশাআল্লাহ আমি মেনে নেব।
তা হলে শোন, শবনম ও তুমি এখন সাবালক হয়েছ। সাবালক ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে মেলামেশা করা হারাম। তুমি আর শবনমের সঙ্গে মেলামেশা করবে না এবং গোপনে বা প্রকাশ্যে দেখাও করবে না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কত বেতন পাও।
এক হাজার।
ঠিক আছে। আমি তোমাকে প্রতিমাসে দুহাজার টাকা দেব। তুমি ঢাকায় থেকে আবার পড়াশোনা শুরু কর। ঐ টাকা থেকে প্রতিমাসে তোমার আম্মাকে এক হাজার করে পাঠাবে, বাকী টাকায় তুমি পড়াশোনা করবে। আর শবনমের ভার আমি নিলাম। যখন আল্লাহপাকের মর্জি হবে তখন আমিই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। আর একটা কথা, এই সমস্ত কথা তুমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাউকে বলবে না। এমন কি শবনমকেও চিঠিপত্র দিয়ে জানাবে না। কি করবে না করবে এখনই বলতে হবে না। দুএকদিন চিন্তা করে আমাকে জানাবে। কিন্তু খবরদার, আবার বলছি, এসব কথা কাউকে বলবে না।
এমন সময় আলমাস সেখানে এলে তাকে বললেন, আতাহারকে কিছু নাস্তা খেতে দাও। তারপর আতাহারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওর সঙ্গে যাও।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষণ ভাবছিল, সে কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? এরকম মানুষও তা হলে দুনিয়াতে আছে? ওঁর শেষ কথা শুনে ওঠে সালাম জানিয়ে আলমাসের সঙ্গে চলে এল।
আলমাস তাকে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে নাস্তা খেতে দিয়ে বলল, চৌধুরী হুজুর কি বললেন?
আতাহার বলল, সে কথা বলতে পারব না। তারপর নাস্তা খেয়ে চলে এল।
সে রাতে আতাহার ঘুমাল না। চৌধুরী হুজুরের কথা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সারারাত কোরআন তেলাওয়াত ও নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল, সে যেন চৌধুরী হুজুরের কথা পালন করতে পারে।
সারারাত জাগার ফলে আতাহার সকালে খুব ক্লান্ত বোধ করল। গোসল করে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেদিনের পর থেকে ছেলের মন খুব খারাপ দেখে রফিকা বেগমেরও মন খারাপ। তাকে আশ্বাস দেবার কোন উপায় না দেখে নিজেকে শক্ত করে রেখেছেন। কাল আতাহার ঢাকা চলে যাবে তা জানেন। তাই রাত্রে এক ঘুমের পর তাকে এবাদৎ বন্দেগী করতে দেখে বললেন, কাল তুই ঢাকা যাবি, লঞ্চে ঘুমাতে পারবি না। এবার ঘুমিয়ে পড় বাবা।
আতাহার বলল, তুমি ঘুমাও আম্মা, আজ আমার ঘুম হবে না।
রফিকা বেগম মনে করলেন, মানসিক উত্তেজনায় তার ঘুম আসছে না। তাই এবাদৎ করে সময় কাটাচ্ছে। আর কিছু না বলে ছেলের কোরআন পড়া শুনতে শুনতে এক সময় আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে তাকে নাস্তা খেয়ে ঘুমাতে যেতে দেখে বললেন, সারারাত ঘুমাসনি। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নে; আমি সময় মতো জাগাবো। খেয়ে দেয়ে তারপর রওয়ানা দিবি।
আতাহার বলল, আমাকে জাগিও না। ভাবছি দুএকদিন পর ঢাকা যাব।
রফিকা বেগম আতঙ্কিত হয়ে এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন, কেন রে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
না আম্মা, তা নয়। দুদিন পরে গেলেও কোনো অসুবিধা হবে না। তাই আজ যাব না।
রফিকা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে দুদিন পরেই যাস।
সেদিন আতাহার বাইরে কোথাও গেল না। সন্ধ্যের পর কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াতে বসল। এক সময় কুলসুমকে বলল, নাসির উদ্দিন আর তোদেরকে পড়াবে না। আমি তোদের স্কুলের একজন ম্যাডামের কাছে ছুটির পর পড়ার ব্যবস্থা করে দেব।
কুলসুমের এখন সবকিছু বোঝার বয়স হয়েছে। শবনমের সঙ্গে ভাইয়ার সম্পর্কের কথা জানত না। যেদিন যুবাইদা খানম এসে রফিকা বেগমকে ঐসব কথা বললেন, সেদিন, জেনেছে। আর সেই জন্যে নাসির উদ্দিন যে পড়াতে আসেনি, তাও বুঝেছে। এখন ভাইয়ার কথা শুনে বলল, আমাদের ইংলিশের ম্যাডাম খুব ভালো। তুমি তার কাছে পড়বার ব্যবস্থা করো।
আতাহার বলল, ঠিক আছে, তাকেই আগে বলব, রাজি না হলে অন্য ম্যাডাম ঠিক করব।
পরের দিন আতাহার বোনদের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে ইংলিশ ম্যাডামের কাছেই পড়াবার ব্যবস্থা করে এসে মাকে সে কথা জানাল।
রফিকা বেগম বললেন, তোর বেতনের টাকায় এমনিতেই কত কষ্টের সঙ্গে সংসার চালাচ্ছি। ওদের প্রাইভেট মাস্টারের বেতন দেব কি করে?
আতাহার বলল, সামনের মাস থেকে ওদের প্রাইভেট মাস্টারের টাকাও পাঠাব।
রফিকা বেগম বললেন, তা হলে ভালই করেছিস।
বিকেলে আসরের নামায পড়ে আতাহার চৌধুরী হুজুরের কাছে গেল।
চৌধুরী হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, কি সিদ্ধান্ত নিলে?
আতাহার বলল, বেয়াদবি মাফ করবেন। সে কথা বলার আগে দু একটা কথা জানতে চাই।
বেশ তো বল।
আপনি আমার জন্য এতকিছু করবেন কেন? আমি শুধু শবনমের ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছি। আমাদের অভাব অনটন থাকলেও আল্লাহ তো না খাইয়ে রাখেন না। বরং অনেকের চেয়ে আল্লাহ আমাদেরকে অনেক সুখে রেখেছেন। আপনার এই অযাচিত দান নেওয়া কি আমাদের জায়েজ হবে?
সুবহানাল্লাহে ওয়া বেহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম বলে চৌধুরী হুজুর বললেন, তুমি খুব মূল্যবান কথা জানতে চেয়েছ। বলছি শোন, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করা। কেউ যদি তা করে, তার প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) খুশী হন। আর তাঁদেরকে খুশী করাও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। শবনমকে নিয়ে তুমি যে বিপদে পড়েছ, সেই বিপদে সাহায্য করতে হলে এই পথে করতে হবে। আর অযাচিত দানের কথা যে বললে, তা তোমার জন্য জায়েজ। তবে তুমি যদি পার, তা হলে পরিশোধ করে দিও। তবে তা নগদ টাকায় নয়। আমি যা বলব তাই করতে হবে।
বলুন কি করতে হবে।
আমি কিন্তু কোনো প্রতিদান পাওয়ার আশায় তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছি না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) কে খুশী করার জন্য চাচ্ছি। তবু তুমি যখন দ্বিধা করছ তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর আমার জন্য সব সময় দোয়া করবে। আল্লাহপাক যেন আমাকে ঈমানের সঙ্গে মউত দেন, কবরের আজাব থেকে রেহাই দেন, আর হাশরের মাঠে রাসূল (দঃ) এর শাফায়াত নসীব করেন। আর কেউ যদি বিপদে পড়ে তোমার কাছে সাহায্য চায় অথবা কেউ বিপদে পড়েছে জানতে পার, তা হলে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে আতাহারের আব্বার কথা মনে পড়ল, খবরদার ওঁর সঙ্গে বেয়াদবি করবি না। উনি যা বলেন শুনবি। উনি খুব বুজুর্গ লোক। আব্বার কথাটা মনে পড়তেই ভাবল, কৈফিয়ৎ চেয়ে খুব বেয়াদবি করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি কদমবুসি করে বলল, আমি এই সব জানতে চেয়ে অন্যায় করেছি, আমাকে মাফ করে দিন। আমি আপনার কথায় রাজি।
চৌধুরী হুজুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, আমি তোমার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। আর তুমি অন্যায় কিছু করনি। বরং মনে কোনো সন্দেহ রাখা উচিত নয়। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকায় তুমি থাক কোথায়, মেসে না কোনো আত্মীয়ের বাসায়?
চৌধুরী হুজুর সুবহানাল্লাহ বলে তার হাতে তিন হাজার টাকা দিয়ে বললেন, কাল তুমি ঢাকা চলে যাও। কয়েকদিন পর এ থেকে এক হাজার টাকা তোমার আম্মাকে পাঠিয়ে দেবে। তুমি তো খুব ভালো ছাত্র ছিলে। এখন থেকে পড়াশোনা আরম্ভ কর। দরকার মনে করলে একজন মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ো। আর তোমার মামাকে বলবে, তিনি যেন সামনের বছর পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তুমি প্রতি মাসে সময় মতো দুহাজার টাকা পাবে।
আতাহার বলল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনা করার কথা জানার পর মামা জিজ্ঞেস করলে কি বলব?
চৌধুরী হুজুর একটা মুখবন্ধ খাম তার হাতে দিয়ে বললেন, ঢাকায় গিয়ে এটা তার হাতে দিও। তা হলে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আর যা-যা তোমাকে বলেছি, সে সবের বরখেলাপ কিছু করবে না। আল্লাহ তোমার সহায় হোক। এবার তুমি যাও।
আতাহার কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি রোধ করতে পারল না। আর একবার কদমবুসি করে ভিজে গলায় বলল, আপনি দোয়া করবেন হুজুর, আল্লাহ যেন আপনার কথা মেনে চলার তওফিক আমাকে দেন।
চৌধুরী হুজুর চোখ বন্ধ করে বললেন, ফি আমানিল্লাহ। আতাহার সালাম বিনিময় করে চলে এল।
ঘরে এসে মাকে বলল, আমি কাল ঢাকা যাব।