মুক্ত বাতাসের খোঁজে : লস্ট মডেস্টি : সম্পাদনা – আসিফ আদনান
শার’ঈ সম্পাদনা শাইখ মুনীরুল ইসলাম ইবনু মাকির
উৎসর্গ
দুঃখিনী বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
নীল অন্ধকারে আটকা পড়াদের…
ভাইয়েরা আমার
ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেয়ো না…
সূচীপত্র
সম্পাদকের কথা
অভিমত
পোকামাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি
অনিবার্য যত ক্ষয়
- মাদকের রাজ্যে
- চোরাবালি
- হস্তমৈথুন : বিজ্ঞানের আতশ কাঁচের নিচে
- ১০৮ টি নীলপদ্ম
- মৃত্যু? দুই সেকেন্ড দূরে!
- নীল রঙের অন্ধকার
- অদ্ভুত আঁধার এক
- পর্দার ওপাশে
- অঙ্গার
- মিথ্যের শেকল যত
বৃত্তের বাইরে
- লিটমাস টেস্ট : যেভাবে বুঝবেন আপনি পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত
- বাড়িয়ে দাও তোমার হাত…
- ব্রেক দা সার্কেল
- ফাঁদ
- তবু হেমন্ত এলে অবসর পাওয়া যাবে…
- দু’আ তো করেছিলাম
- ও যখন পর্ন-আসক্ত
- আমাদের সন্তান পর্ন দেখে!
- বিষে বিষক্ষয়
- আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো
- রূপকথা নয়!
- ভাই আমার…
- মুক্ত বাতাসের খোঁজে…
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
আলহামদুলিল্লাহ। “মুক্ত বাতাসের খোঁজে”-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হচ্ছে। অল্প সময়ে বইটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বইটির প্রথম সংস্করণের ব্যাপারে পাঠকদের যে আগ্রহ ও চাহিদা দেখা গেছে, তা আমাদের ধারণাতীত ছিল। তবে এসবই শত সহস্র মাইল যাত্রার প্রথম কয়েক কদম কেবল। ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রচেষ্টী ছাড়া পর্নোগ্রাফি নামক নীরব মহামারির মোকাবেলা প্রায় অসম্ভব। তাই আমরা আশী করি “মুক্ত বাতাসের খোঁজে”-এর বার্তাটি সাধ্যমত পরিচিতদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পাঠক সাধ্যমত চেষ্টা করবেন, আর নিঃসন্দেহে সাফল্য একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই।
প্রথম সংস্করণের বেশ কিছু বানান ও মুদ্রণজনিত ভুল এ সংস্করণে সংশোধন করা হয়েছে। যোগ করা হয়েছে কিছু রেফারেন্স। এছাড়া পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের। পরামর্শ অনুযায়ী পৃষ্ঠাসজ্জা ও বিন্যাসগত কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এব্যাপারে যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন আল্লাহ তাঁদের উত্তম প্রতিদান দান করুন।
নিশ্চয় সকল প্রশংসা আল্লাহর। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী ও সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ এর ওপর, তাঁর পরিবারের ওপর, তাঁর সাহাবিগণের ওপর।
আসিফ আদনান রজব
১৪৩৯, মার্চ ২০১৮
.
সম্পাদকের কথা
“If you gaze long into an abyss, the abyss also gazes into you”
কিছু অন্ধকার আতঙ্কিত করে, কিছু অন্ধকার মানুষকে আকর্ষণ করে। আবদ্ধ করে অবোধ্য, অনতিক্রম্য লালসা আর কৌতূহলের জালে। গুটিগুটি পায়ে তন্ময়, মন্ত্রমুগ্ধ দ্রষ্টা যখন কিনারায় এসে দাঁড়ায়, অতল গহ্বর গ্রাস করে নেয়। আমাদের এ বই এমনই এক অন্ধকার নিয়ে। নীল অন্ধকার, পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফি বা ইরোটিকা নিয়ে কথা বলার সময় সাধারণত আমরা অন্ধকারের কথা চিন্তা করি না। ব্যাপারটার সাথে গোপনীয়তা, লজ্জা, নিষিদ্ধ আনন্দ কিংবা লালসার সম্পর্কটা পরিষ্কার। কিন্তু অন্ধকার? বাস্তবতা হলো পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমরা তেমন একটা চিন্তা করি না। এ নিয়ে আলোচনা সমাজে দুর্লভ। আলোচনার আদৌ দরকার আছে, দুর্লভ এমন চিন্তাও। পর্নোগ্রাফি নিয়ে অধিকাংশ কথাবার্তা তাই সীমাবদ্ধ থাকে নানা মাত্রার অশ্লীল, ইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতা আর হাসিঠাট্টায়। সমাজের বিশাল এক অংশ সম্পূর্ণভাবে বিষয়টা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। আর একটু আধটু আলোচনা যা হয়, তাতে পর্নের মাধ্যমে নারীর অবজেক্টিফিকেশীন; নিছক বস্তু হিসাবে, মাংসপিণ্ড হিসাবে নারীর উপস্থাপনার কথা উঠে আসে। কিন্তু এটি আংশিক চিত্র মাত্র। আদিম সুখের বিষাক্ত এ চিত্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাবের সত্যিকারের ব্যাপ্তির ছিটেফোঁটাও আমরা অনুধাবন করি না। সত্যি কথা হলো পর্নোগ্রাফি আসলে কতটা ক্ষতিকর আধুনিক মানুষ এখনো পুরোপুরি সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। তবে এখনো পর্যন্ত যা জানা গেছে, চমকে দেয়ার জন্য সেটাই যথেষ্ট।
পর্নোগ্রাফি কোনো “নির্দোষ আনন্দ” না। ছোটখাটো কোনো নৈতিক বিচ্যুতি না। এমন কোনো সমস্যা না, না দেখার ভান করে থাকলে যার অস্তিত্ব মিলিয়ে যাবে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য পর্নোগ্রাফি আসক্তি মারাত্মক এক হুমকি। কারণ, এর প্রভাব কেবল সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ না; বরং দীর্ঘমেয়াদে পর্নোগ্রাফি মানুষকে বদলে দেয়। পর্নোগ্রাফি আক্ষরিকভাবেই মানুষের মস্তিষ্ককে পাল্টে দেয়। বদলে দেয় মাথার ভেতরের সার্কিটগুলোর গঠন। পর্ন দেখার সময় মাথায় শুরু হয় ডোপামিন আর অক্সিটোসিনের মতো কেমিক্যালগুলোর বন্যা। এ কেমিক্যালগুলো আমাদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। প্রতিবার পর্ন দেখার সময় কেমিক্যাল বন্যা তৈরি করে সাময়িক আনন্দের অনুভূতি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো যা তাকে আনন্দ দেয়, বার বার ওই উৎসে ফিরে যাওয়া। তাই ডোপামিনের নেশীয় মানুষ আবার ফিরে যায় পর্নের কাছে। এভাবে একটা লুপ তৈরি হয়। পুনরাবৃত্তির একপর্যায়ে উচ্চমাত্রার ডোপামিনে অভ্যস্ত মস্তিষ্ক আগের মতো আর আনন্দিত হতে পারে না। প্রয়োজন হয় আরও বেশি ডোপামিনের। আরও বেশি, আরও “কড়া” পনের। তারপর আরও বেশি, তারপর আরও বেশি। একসময় প্রায় সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবে আনন্দিত হবার ক্ষমতা।
যদি ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয়, তাহলে পর্নের বদলে হেরোইন বা কোকেইন বসিয়ে ওপরের প্যারাটী আবার পড়ুন। এটা আসক্তির ক্লাসিক মডেল। প্রতিটি মাদকের নেশা এভাবেই মানুষের মধ্যে মুখাপেক্ষিত (dependence) ও আসক্তি তৈরি করে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে এ আসক্তির ফল হলো ব্যক্তির যৌন-মনস্তত্ত্ব, যৌনচাহিদা ও সক্ষমতা বদলে যাওয়া। ঠিক যেমন মাদকাসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনে আনন্দ খুঁজে পায় না, পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক যৌনতায় সন্তুষ্টি খুঁজে পায় না। পর্নোগ্রাফি তার ভেতরে তৈরি করে অবাস্তব প্রত্যাশী, অতৃপ্তি, আর অনুকরণের তৃষ্ণী। বাস্তব তার জন্য যথেষ্ট হয় না। সুখের খোঁজে অতৃপ্ত সে প্রবেশ করে নীল অন্ধকার গহ্বরের গভীর থেকে আরও গভীরে।
ব্যক্তির মাধ্যমে শুরু হলেও এর প্রভাব শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিষিয়ে তোলে পরিবার ও সম্পর্কগুলোকে। একপর্যায়ে পর্নোগ্রাফি প্রভাব ফেলতে শুরু করে সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর। ইতিমধ্যে মিডিয়াতে ব্যাপারটা ঘটছে। এক সময় পর্ন মূলধারার গল্প-সিনেমার অনুকরণ করত। কিন্তু এখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া অনুকরণ করছে পর্নোগ্রাফিকে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা লক্ষণীয়, তবে হালের ওয়েস্টার্ন পপ মিউযিক-মিউযিক ভিডিও এবং বলিউড আইটেম সংয়ের ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে দৃশ্যমান। এ ছাড়াও আছে সামগ্রিকভাবে মিডিয়া ও সমাজের অতি যৌনায়ন। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের জন্য এ ব্যাপারগুলো কতটা ভয়ঙ্কর, এর ব্যাপ্তি কতটা বিস্তৃত সেটা আসলেই প্রথমে বুঝে ওঠা কঠিন।
পর্নোগ্রাফি এমন এক ব্যাধি, যা সবার অগোচরে ছড়িয়ে পড়েছে মেট্রোপলিটান থেকে মফস্বলে। কোনো শ্রেণি, বর্ণ, ভাষা কিংবা জাতীয় পরিচয়ের সীমারেখা এ ব্যাধি মেনে চলে না। নিজ বিষাক্ত কলুষতায় সে চরম সাম্যবাদী। বেডরুম, ক্লাস কিংবা পাবলিক প্লেইসে আঙুলের ডগায় অপেক্ষমাণ অজ একান্ত পিক্সেল ফ্যান্টাসি। শিশু থেকে বৃদ্ধ, পর্ন সবার হাতের নাগালে। এ ব্যাধি বর্তমানের সবচেয়ে চরম স্বাস্থ্য ও সামাজিক ঝুঁকিগুলোর অন্যতম। অগণিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি এমন এক সমস্যা যা অসংখ্য মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির না, তার পরিবার ও সমাজেরও। যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো ঘরে পর্নের রয়েছে অবাধ অনুপ্রবেশ। অথচ অধিকাংশ মানুষ এ বিপদের তীব্রতা সম্পর্কে জানেই না। পর্নোগ্রাফি এক নীরব মহামারি।
আমাদের সমাজে অপরাধের কমতি নেই, কিন্তু আর কোনো কিছু পর্নোগ্রাফির মতো এতটা সহজলভ্য না। মাদক ব্যবহার, ধর্ষণ, খুন–বা অন্যান্য অপরাধগুলো করার জন্য আপনার ঘর থেকে বের হতে হবে। সামান্য হলেও ঝুঁকি নিতে হবে। ধরা পড়ে গেলে শাস্তি হবে। কিন্তু পর্নের ক্ষেত্রে কোনো বাধা, কোনো বয়সসীমা প্রযোজ্য না। আর কোনো কিছুর দরকার নেই, জাস্ট একটা ফোন, ব্যস। ২০১২ সালে কয়েকটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ওপর চালানো যমুনা টিভির জরিপ অনুযায়ী শতকরা ৭৬ জন শিক্ষার্থীর নিজের ফোন আছে। বাকিরা বাবা মার ফোন ব্যবহার করে। ৮২% সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ন দেখে, ক্লাসে বসে। পর্ন দেখে ৬২%। বেসরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে ফটোকপি আর মোবাইল ফোনে গান/রিংটোন “লোড” করে দেয়ার দোকানগুলো থেকে দেশে দৈনিক ২.৫ কোটি টাকার পর্ন বিক্রি হয়। এগুলো আজ থেকে প্রায় ছ-বছর আগের তথ্য, যখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন এবং মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিল না। বর্তমান অবস্থা কী হতে পারে, কল্পনা করুন।
যদিও পর্নোগ্রাফি আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে কিন্তু এখনো পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা আমাদের সমাজে ট্যাবু। পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা “অশোভন”, “অশ্লীল”। হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফি “আকাশ সভ্যতার অংশ” হলেও, পর্নোগ্রাফির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা “সভ্য আলাপচারিতার জন্য অনুপযোগী”। অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করে নেয়ার বদলে আধুনিক মানুষ আগ্রহী। সত্যকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে। অকপট স্বীকারোক্তির জায়গা দখল করে নিয়েছে বাস্তবতার এমন কোনো সংস্করণ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা, যা স্বীকার করে নিলে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে অপ্রিয়, অস্বস্তিকর, বিপজ্জনক কিংবা মৌলিক প্রশ্ন করতে হয় না। বাস্তবতার এ সংস্করণ আদৌ কতটুকু সত্য, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। চোখ বন্ধ করে হলেও স্থিতাবস্থাকে (staus quo) টিকিয়ে রাখা মুখ্য। চারপাশ ঘিরে আসা জমাটবাঁধী নীল অন্ধকার যখন আমাদের পূত-পবিত্র জীবনে উঁকি দেয়া শুরু করে, দেখেও না দেখার ভান করি। প্রশ্ন করি না, চিন্তা করি না। পরিবর্তনের অস্বাচ্ছন্দ্যকর পথে হাঁটার বদলে মনমতো ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়ে। অন্ধকারের গহ্বরে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবার নিষ্ক্রিয় অপেক্ষা আমাদের পছন্দ। আর তাই আমরা আত্মপ্রতারণী করি, নিজের সাথে মিথ্যা বলি না।
সর্তক-সংকেতগুলোকে অগ্রাহ্য করতে বাধ্য করেছে আমাদের এ ঐচ্ছিক অন্ধত্ব। আর পশ্চিমা আধুনিকতার শর্তহীন গ্রহণ। প্রগতির পাঠ ঠোঁটস্থ, মুখস্থ, অত্মস্থ করতে গিয়ে খেয়াল করা হয়নি কখন এ আঁধার ঢুকে পড়েছে আমাদের ঘরে ঘরে। পর্নোগ্রাফির বিষাক্ত ছোবল থেকে আজ আপনি, আমি, আমাদের সন্তান, আমাদের বন্ধু, কেউই নিরাপদ না। সবাই সম্ভাব্য ভিকটিম। পর্নোগ্রাফি আসক্তির ফাঁদে আটকা পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ শিশু- কিশোর। ভেঙে গেছে পারস্পরিক বিশ্বাস, অগণিত পরিবার। নষ্ট হয়েছে অনেক পবিত্র আত্মা এবং সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। অন্ধকার গহ্বরের একেবারে কিনারায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যদি এখনো। পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতার মাত্রা সম্পর্কে আমাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না আসে, তাহলে অনতিক্রম্য অন্ধকার সমাজকে গ্রাস করে নেয়া সময়ের ব্যাপার। মাত্র। তাই চুপ করে থাকার, নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। সত্য যতই অপ্রিয় কিংবা অস্বস্তিকর হোক, প্রকাশ করতেই হবে। কারণ, নীরবতার জন্য যে মূল্য দিতে হবে তা অনেক, অনেক চড়া। আর আল্লাহ সত্য প্রকাশে কখনো সঙ্কোচবোধ করেন না।
মুসলিম হিসাবে আমাদেরও করা উচিত না। নীল এ অন্ধকারের স্বরূপ তুলে ধরতে, আসক্তির জালে আটকা পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়াতে লস্ট মডেস্টি এগিয়ে এসেছে। সমস্যার ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি, তাদের লেখাগুলোতে উঠে এসেছে উত্তরণের উপায়ও। আমার জানা মতে, বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে এটাই প্রথম বই। শত শত বিলিয়ন ডলারের গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রির মোকাবেলায় একটি ব্লগ বা বই যথেষ্ট না। ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রচেষ্টা ছাড়া অবস্থার পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব। তবে পর্নোগ্রাফির মহামারিকে ঘিরে নীরবতার যে প্রাচীর ছিল, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবক তা ভাঙার সাহস দেখিয়েছে। আশা করি তাদের এ দৃষ্টান্ত অন্যান্যদের উদ্বুদ্ধ করবে সামাজিক এ ব্যাধি ও হুমকির মোকাবেলার জন্য। আল্লাহ্ তাদের প্রচেষ্টা কবুল করে নিন, উত্তম প্রতিদান দান করুন। অজনপ্রিয় এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসার জন্য ইলমহাউস পাবলিকেশানেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। নানা ব্যস্ততা সত্ত্বেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে ডা. শামসুল আরেফীন বইটি দেখে দিয়েছেন, এ আন্তরিকতা ও সাহায্যের জন্য আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আল্লাহ্ তাঁর দুর্বল বান্দাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করে নিন, এতে বারাকাহ দান করুন। যারা এ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন ও আছেন আর-রাহমানুর রাহীম এ কাজকে বিচারের দিনে তাদের আমলের পাল্লায় স্থান দিন। নিশ্চয় সাফল্য কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং সকল প্রশংসাও একমাত্র তাঁরই। সালাত ও সালাম। বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ), তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।
আসিফ আদনান
জুমাদাল আওয়াল ১৪৩৯, জানুয়ারি, ২০১৮
.
অভিমত
আলহামদুলিল্লাহ। সাল্লাল্লাহু আলান নাবিয়্যিল উম্মীয়্যি ওয়া আলা আলিহী ওয়া সাহবিহী আজমাঈন। এক জঙ্গনামা। লড়াইটা এক অক্টোপাসের সাথে। নীলরঙা অক্টোপাস। ব্যক্তিসত্তা, সমাজমানসকে প্রতিমুহূর্তে আগের চেয়ে আরও জোরে পেঁচিয়ে নিচ্ছে আট পায়ে। সমস্যা হলো অক্টোপাসটি একটি ট্যাবু (taboo)। তার নাম নেয়া যায় না, আলোচনা করা যায় না, তার ক্ষতি চিৎকার করে জানিয়ে দেওয়া যায় না সবাইকে। এই সুযোগে সে আরও পাঁচ কষে চলেছে। মড়মড় করে ভাঙছে পরিবার, ভাঙছে সমাজ, ভাঙছে আইন, মূল্যবোধ-সুকুমারবৃত্তি, ভাঙছে জীবন–এক একটা স্বপ্ন খানখান হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। যেগুলো ভাঙেনি ঝুরঝুরে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু ঝাঁপটার অপেক্ষায়।
পর্ন, পর্নোগ্রাফি, ব্লু ফিল্ম। একটা অসুখ। প্রতিটা গোঁফের রেখা গজানো কিশোর মুখের দিকে তাকান, প্রতিটী উদ্দাম কলেজপড়ুয়া স্বপ্নবাজ তরুণ, ভার্সিটির চোখ নামিয়ে চলা প্র্যাক্টিসিং ছাত্র, গালফোলা দুই বেণিওয়ালা বাচ্চা মেয়ে, জ্যামে ঝুলে থাকা প্রতিটি কর্মজীবীর ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকান। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি। এক কঠিন দুরারোগ্য অসুখে ভুগছে প্রতিটি মানবসন্তান। অথবা যেকোনো সময় মহামারির গ্রাস হবার অপেক্ষায়। আপনার কেবল দাঁড়াতে শেখা মেয়েটার দিকে একটু তাকান। সদ্যভূমিষ্ঠ ছেলেটীর দিকে তাকান। কী এক মড়কওয়ালা শ্মশীন রেখে যাচ্ছেন তার জন্য!
এখন ঠিক এই মুহূর্তটিতে আপনার জন্য সবচেয়ে জরুরি এই বইটি পড়া, অক্সিজেনের চেয়েও। বিশ্বাস করুন–হ্যাঁ, আপনার শ্বাসের চেয়েও। আপনাকে বুঝতে হবে, আপনাকে জাগতে হবে; না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। অনেক দেরি। আপনাকে স্মরণ করতে হবে, “আপনি একজন যোদ্ধা”। প্রবাহতাড়িত একটি “গড্ডল” না অপিনি। একটু মনে করার চেষ্টা করুন, আপনি যুদ্ধ করার জন্যই জন্ম নিয়েছেন। আর এ যুদ্ধে আপনি জিতবেন, আপনাকে জিততে হবে। এ জয় ছাড়া আপনার হাতে আর কোনো অপশন নেই। দমবন্ধ এই পৃথিবীতে আপনার খুঁজে নিতে হবে মুক্ত বাতাস। যেখানে চোখবুজে লম্বা শ্বাস টেনে নিলে নির্মল শীতল বাতাস পূর্ণ করবে আপনার প্রতিটি অ্যালভিওলাস। পরবর্তী প্রজন্মের অভিশাপের আর্তনাদ থেকে বাঁচতে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে তাদের অধিকার–একঝলক মুক্ত বাতাস।
বইটির লেখক, কলাকুশলীদের প্রাণভরা দু’আ। আল্লাহ তাদের এই খিদমতের বরকতে আমাদের বুঝ দান করুন। আমি চিকিৎসাবিদ্যাগত বিষয়গুলো দেখেছি আল্লাহর ইচ্ছায়, প্রয়োজনমতো পরিবর্তন-পরিমার্জনের পরামর্শ দিয়েছি। পর্নোগ্রাফির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত প্রলয়, এই ইন্ডাস্ট্রির নেপথ্যের কান্নার নৈঃশব্দ্য, মুক্ত বাতাসের যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ–এ আয়োজনে আমি অভিভূত। বইটি আমাদের সত্তার মানবীয় অংশটাকে জাগক, অনুশোচনায় “অগ্নিদগ্ধ” করুক, চোখের পানি হৃদয় পোড়াতে পোড়াতে নামুক। সে পোড়া ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জন্ম নিক এক “যোদ্ধা”, এক “আপনি”, এক “আমি”।
ডা. শামসুল আরেফীন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
.
পোকামাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি
কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছি…
এই তো কয়েকদিন আগেই হাফপ্যান্ট পড়া দশ বছরের কোঁকড়া চুলের এক বালক তার স্কুলমাঠের কড়ই গাছের নিচে বসে নদীর দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকত। পায়ের কাছে আছড়ে পড়ত দলবেঁধে অনেক দূর পাড়ি দেয়া ঢেউ। মাঝে মাঝে সে ঢেউ গোনার ব্যর্থ চেষ্টা করত। কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলত একটু পরেই। আবার উদীস হয়ে তাকাত নদীর দিকে। কখনো-বা আকাশের দিকে। দুপুরের বৃষ্টিভেজা রোদে মাঝে মাঝে একটা সোনালি ডানার চিল উড়ে বেড়াত। করুণ সুরে ডেকে উঠত হঠাৎ হঠাৎ। বালক আরও উদাস হয়ে যেত।
কখনো কখনো বালক স্কুল থেকে ঘরে ফেরার সময় অবাক হয়ে দেখত, আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসছে। বালকের ছাতা ছিল না। কাজেই সেই ঝুম বৃষ্টির কবল থেকে বইখাতা বাঁচাতে এক হাতে স্যান্ডেল আর এক হাতে বই নিয়ে ভোঁ দৌড় দিত। মাঝে মাঝে রাস্তার কাদায় পিছলে পড়ে যেত। কাদামাখা ভুত হয়ে ফিরত বাসায়। মা ব্যর্থ চেষ্টা করত আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দেয়ার। মায়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বালক দৌড়ে লাফিয়ে পড়ত পুকুরে। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা অদ্ভুত শব্দ করত। বালক অবাক হয়ে শুনত সে শব্দ। দীর্ঘ সময় পুকুরে দাপাদাপি করার পর চোখ লাল করে সে ফিরত। মা আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিত। শান্ত ছেলের মতো পুঁটি মাছের ভাজি দিয়ে গোগ্রাসে গরম ধোঁয়াওঠা ভাত গিলে, গল্পের বই নিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ত বালক।
টিনের চালে তখন একটানা বৃষ্টি পড়ত। বাইরে সজনে গাছটা উড়ে চলে যেতে চাইত হাওয়ার সাথে। কলাগাছের পাতায় চলত বাতাসের দাপাদাপি। বালক গল্পের বইয়ে ডুবে যেত৷ দুষ্ট বাবার কবল থেকে নৌকা নিয়ে পালাচ্ছে হাকলবেরি ফিন… সে কি নিরাপদে পালাতে পারবে? না ওর বাবা ওকে ধরে ফেলবে? টান টান উত্তেজনা! একসময় ঘুমিয়ে পড়ত বালক। ঘুমের ঘোরেই ভয় পেত বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে। মা মাঝেমধ্যে পাশে এসে শুয়ে থাকত। ঘুমের ঘোরে সে জড়িয়ে ধরত তার মায়ের গলা–এই পৃথিবীতে তার সবচেয়ে আপন মানুষটিকে…
এখনো সেই কড়াই গাছটার নিচে বহুপথ পাড়ি দিয়ে আসা ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে। সেই কড়াই গাছের নিচে বসে আজ কেউ কি ঢেউ গোনে? সেই নিঃসঙ্গ চিলটা আজও হয়তো কেঁদে কেঁদে বেড়ায়। এখনো আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। টিনের চালে এখনো বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টির সেই শব্দ কি কেউ কান পেতে শোনে?
আমাদের প্রজন্মটাই বোধহয় সর্বশেষ প্রজন্ম যারা আবহমান বাংলার ক্ল্যাসিকাল শৈশব, কৈশোরের স্বাদ কিছুটা হলেও পেয়েছিল। অলৌকিক,নিষ্পাপ, মানবিক। একই পাড়ার সব ছেলেমেয়ে যেন সবাই নিজেদেরই ভাই-বোন। হই-হুঁল্লোড়, পুকুরে দাপাদাপি, চৈত্রর দুপুরে পায়ে পায়ে ঘোরা, আমচুরি, আচারচুরি, আখিচুরি, গোল্লাছুট, রূপকথার আসর… এক অদ্ভুত সরলতায় জড়িয়ে ছিল আমাদের শৈশব। শৈশবকে বিদায় জানিয়ে কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে যখন পৌঁছালাম আমরা, তখন থেকেই যেন সুপারসনিক গতিতে অধঃপতনের দিকে যাত্রা শুরু হলো এই সভ্যতার। আসলে অধঃপতন শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, আমরা তখন টের পেলাম। অদ্ভুত এক আঁধারে ছেয়ে গেল এই বুড়ো পৃথিবী। ডিশ এন্টেনা আকাশ থেকে নামিয়ে আনল অভিশাপ, ড্রয়িং রুমে বাড়তে থাকল বোকা বাক্সের বোকামি। হাইস্পিড় ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, প্রযুক্তির বিষাক্ত প্রলোভনে ঠেলে দেয়া হলো আমাদের কোনো নির্দেশনা ছাড়াই। অক্টোপাসের মতো শক্তিশালী পুঁড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল এই নব্য ‘দানো’। আমরা হারাতে থাকলাম শৈশব-কৈশোরের মৌলিক উপাদান; খেলার মাঠ, পুকুর, নদী, অখণ্ড অবসর। আকাশছোঁয়া দালানগুলো অনুপ্রবেশ করল আমাদের স্বাধীনতার আকাশে। ভূমিদস্যু, কারখানা, ব্রয়লার ফার্ম, মাছচাষীরা কেড়ে নিল আমাদের জলাভূমি। শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা, অভিভাবকদের অসুস্থ মানসিকতা কেড়ে নিল আমাদের অবসর। আমরা যাব কোথায়? উঠোনকোণের জায়গাটুকুও তো নেই!
যে জীবন ছিল ঘাসফুল আর মাতৃসম রুপালি জলের ঘ্রাণ নেয়ার, ফাগুনের অনন্ত নক্ষত্রবীথির নিচে দাঁড়িয়ে তারা গোনার, ফড়িং আর প্রজাপতির পেছনে দৌড়ে বেড়ানোর, যে জীবন ছিল আলিফ লায়লা আর সিন্দাবাদের, যে জীবন ছিল ফাঁদ পেতে শালিক ধরার, পুকুরে বঁড়শি ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার, যে জীবন ছিল রূপকথার খেলাঘরে হারিয়ে যাবার, সেই জীবনে ভর করল অনেক জটিলতা, অস্থিরতা। অনাবিষ্কৃত আকাঙ্ক্ষাগুলো একে একে আবিষ্কৃত হলো, সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো বিকৃত উপায়ে পূরণ করে দিতে এগিয়ে এল প্রযুক্তি।
আমরা ভাঙতে থাকলাম। আমরা হারিয়ে গেলাম ভুল স্রোতে।
এক আকাশ শ্ৰীবণের সঙ্গে আজীবন সখ্যতা হলো আমাদের।
আমরা নষ্ট হলাম।
.
দুই.
সাঁই সাঁই করে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতো বাসটা উড়ে চলছিল কালো পিচে মোড়ানো প্রশস্ত রাজপথের বুকের ওপর দিয়ে। জানালার পাশের সিটে বসেছিলাম। বাতাসে উড়ছিল মাথার কোঁকড়া চুল। পথের পাশের বাবলীর গীছ, ভাঁটফুল, নাম না-জানা জংলি লতার নীল নীল ফুল, আর ১১ কেভি ইলেক্ট্রিক লাইনের পুল, সবকিছু নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছিল চোখের সামনে থেকে। বাসের ভেতরে নীরবতা জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। একটু আগেও বেশ হইচই হচ্ছিল। আমার আশেপাশে বসেছিল পনেরো-ষোলো বছর বয়সের বেশ কয়েকজন কিশোর। কেউ গল্প করছিল, কেউ উদাস হয়ে বাইরে চেয়ে ছিল, কেউ কেউ সিটে বা এর ওর ঘাড়ে মাথা রেখে মুখ হা করে ঘুমাচ্ছিল। শেষের ছেলেগুলো বেশ ক্লান্ত। একটু আগেও হাই ভলিউমে “বুরখী পড়া মেয়ে পাগল করেষ্টে” টাইপ গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জটলা বেঁধে কী নাচটাই না এরা নাচছিল। এ রকম নাচ দেখার সৌভাগ্য (না দুর্ভাগ্য?) আগে কখনো হয়নি। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে আফ্রিকান গহীন অরণ্যের কিছু জংলিদের নাচ দেখেছিলাম। সেই নাচের সাথে এই ছেলেগুলোর নাচের বেশ মিল আছে! যাই হোক ছেলেগুলো আমার বন্ধু, আমরা সবাই একই ক্লাসে পড়তাম। স্কুল। থেকে আমরা বনভোজনে যাচ্ছিলাম মুজিবনগর। বসন্তের এক অসহ্য সুন্দর দিন ছিল সেটি।
সামনের সিটগুলোতে স্যারেরা বসেছিলেন। তাদের ঠিক পেছনেই জটলা বেঁধে বসেছিল ছেলেদের এবং মেয়েদের কয়েকজন। বাস থেকে নামার পরে বেশ কয়েকজনের মুখে শুনলাম, এই ছেলেমেয়েগুলো বাসের মধ্যে প্রায় পুরোটা রাস্তা একসাথে মোবাইলে পর্ন দেখেছে! প্রচণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে ছিলাম সেদিন। তারপর আস্তে আস্তে এ রকম অনেক ঘটনা দেখে বিস্মিত হতে হতে আমার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল।
আমি জানলাম আমার স্কুলের সবচেয়ে সেরা বন্ধু ভয়ঙ্কর রকমের পর্ন-আসক্ত। কলেজে আমার পাশে বসা ছেলেটার হার্ডডিস্ক ভর্তি পর্ন। পেছনের বেঞ্চের ছেলেটা সারা রাত মোবাইলে পর্ন দেখে আর ক্লাসে এসে ঘুমায়। কাছের একজন বন্ধু, খুবই ভদ্র, লাজুক ছেলে, পর্ন-আসক্তির কারণে প্রচণ্ড নির্লজ্জ হয়ে উঠল। আমি দেখলাম। ক্লাস রুমের দরজা আটকে স্কুলের বন্ধুরা পর্ন দেখছে, কলেজের বন্ধুরা মোবাইলের লাউডস্পিকারে পর্ন ছেড়ে দিয়ে ম্যাডামকে বিরক্ত করছে, ম্যাডামদের নিয়ে রসালো আলাপে পার করে দিচ্ছে টিফিনের সময়টী। ফেসবুকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে ট্রল বানাচ্ছে। ভার্সিটির র্যাগিং এ নবাগত ছাত্রদের পর্নস্টারদের অনুকরণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। পাশের রুমের ভদ্র ছেলেটাও যখন কলেজের ব্যাগে চটিগল্পের বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, নামাজে যাওয়া ছেলেটাও যখন রুমমেটের সঙ্গে পর্নস্টারদের নিয়ে মজা করে, তখন আমি কি আর বিস্মিত হব?
খুব বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম ২০১১ সালের রমাদ্বানে। ২৭ শে রমাদ্বানের রাতে গ্রামের মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ পড়ার মাঝে বিরতিতে খেয়াল করলাম বারো-তেরো বছরের কিছু ছেলে মসজিদের বাইরের উঠোনের আমগাছের নিচে বসে জটলা বেঁধে মোবাইলে পর্ন দেখছে। হাতেনাতে ধরা। ইয়া আল্লাহ! রমাদ্বান মাসে! ২৭ শে রমাদ্বানের রাতে! লা হাওলা ওয়ালা কুউ’আতা ইল্লাহ বিল্লাহ!
ভার্সিটিতে আমি নিজে অনেক অনুনয় বিনয় করে কয়েকজনকে রাজি করাতে পেরেছিলাম হার্ডডিস্ক পরিষ্কার করতে। এদের কারও কারও হার্ডডিস্কে শত গিগাবাইটের ওপরে পর্ন ছিল! আমরা যখন বেড়ে উঠেছি তখনো বাংলাদেশে মোবাইল, ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না।
তখনই এ রকম ভয়ঙ্কর অবস্থা ছিল!
এখন কী অবস্থা হতে পারে চিন্তা করে দেখুন একবার!
.
তিন.
পৃথিবীর এখন গভীর, গভীরতর অসুখ। আজকের মতো অসভ্য অশ্লীল কলুষিত বাতাস হয়তো পৃথিবীর শত সহস্র বছরের ইতিহাসে আর কখনো প্রবাহিত হয়নি। পর্ন ভিডিওর কথা ছেড়েই দিলাম, টিভি বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড, ম্যাগাযিন, মুভি, মিউযিক, আইটেম সং, সাহিত্য, কবিতা সবকিছুই আজ চরম যৌনায়িত। সবখানেই কেবল নারীকে পণ্য করা, নারীর দেহকে পুঁজি করা। নারী-পুরুষের পবিত্র ভালোবাসা আজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে পশুর মতো যততত্র যার-তার সাথে দৈহিক মিলনে। পুরুষরা আজ আর নারীদের চোখের তারায় ভালোবাসা খোঁজে না, তারা ভালোবাসা হাতড়ে বেড়ায় নারীর শরীরের ভাঁজে। সমকাম আর অজাচারের (নাউযুবিল্লাহ) মতো জঘন্য বিষয়গুলোও আজ মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এ রকম এক প্রতিকূল পরিবেশে কী এক অস্থিরতার মধ্যে কিশোর, তরুণদের দিন কাটাতে হয়, সেটা আমাদের আগের প্রজন্ম কখনো ঠিকমতো বুঝতে পারবে কি না সন্দেহ!
আমাদের বাবা-মারা হয়তো কখনোই জানতে পারবেন না, তাদের আদরের, নিরীহ, ভদ্র ছেলেটার পিসির হার্ডডিস্কের শত শত গিগাবাইট পর্ন ভিডিও দিয়ে বোঝাই! বাবা-মারা কি আদৌ বিশ্বাস করতে পারবেন, আমাদের এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে দলবেঁধে পর্ন ভিডিও দেখে? বিয়ের আগেই শারীরিক অন্তরঙ্গতা এদের কাছে ডালভাত, গ্রুপ সেক্সও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার? যে ছেলেটার দুধের দাঁতও সব কয়টা পড়েনি সেও এখন ওরাল সেক্স, অ্যানাল সেক্স–এর মতো শব্দগুলোর সাথে পরিচিত?
নীল বাতাসে বিষাক্ত এ সময়ে বেড়ে উঠেছি আমি, বিষাক্ত বাতাস বার বার হানা দিয়েছে আমার জীবনে। জাহাজ মাস্তুল তছনছ করে দিয়েছে। তবু আল্লাহ্র (d) ইচ্ছায় ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নতুন করে স্বপ্ন দেখেছি, দুরবিনে চোখ রেখে খুঁজে বেড়িয়েছি বেঁচে থাকার মানে। শৈশব-কৈশোর-প্রথম তারুণ্যে দীর্ঘ দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, অজস্র বিশুদ্ধ মানবাত্মা পর্নোগ্রাফি, হস্তমৈথুন আর চটিগল্পের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই। এখনো চারপাশের কোটি কোটি বিশুদ্ধ ফিতরাত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে এ সমাজ, এ পৃথিবীটাকে ওলট-পালট করে দিতে। চলন্ত ট্রেনের জানালা, সোনালি ডানার বুড়ো চিল আর উঠোন কোণের সেই নিম গাছটাকে কতবার আমি আমার ইচ্ছের কথা বলেছি। তারা মুখ বাঁকিয়ে হেসেছে। আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে। নিষ্ফল ক্রোধে মাথার চুল ছিঁড়েছি, পুকুরধারে নির্জন দুপুরে চোখ ভিজিয়েছি বাংলা ভাষায়।
চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি! কিচ্ছু না!
আমার একটা ছোট ভাই আছে। কোঁকড়া চুলের এই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে কৈশোরের চৌকাঠে। ওর দিকে তাকালে এক নিমিষেই আমার অতীত আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, আর একরাশ ভয় এসে ঘিরে ধরে আমাকে। বেড়ে ওঠার সময় আমাকে, আমার বন্ধুদের বা আমাদের বয়সী একটা ছেলেকে যে যুদ্ধ করতে হয়েছে, ডিজিটাল এই যুগে তার চেয়েও তীব্র যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে আমার ছোট ভাইটিকে। নাম না-জানা আমার আরও কোটি কোটি ভাই অনবরত যুদ্ধ করে যাচ্ছে এই “দানোর” সঙ্গে। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে আমরা তেমন কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি, কিন্তু আমার এই ভাইগুলো যেন দিকনির্দেশনার অভাবে হারিয়ে না যায়, সে চিন্তা থেকেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। অনেক ভাইয়ের অশ্রু আর ঘাম ছড়িয়ে রয়েছে এই বইজুড়ে। আল্লাহ তাঁদের উত্তম প্রতিদান দিন, ফিরদাউসের ফুলবাগানে সবুজ পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানোর তৌফিক দিক। সায়েন্টিফিক ফ্যাক্টগুলো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন পিয়ার রিভিউ জার্নালের রেফারেন্স এনেছি। পরিসংখ্যানসহ আনুষঙ্গিক সংবাদের জন্য আমরা জানলের পাশাপাশি, সুপরিচিত বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্য নিয়েছি। রেফারেন্সের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে হওয়ার কারণে বইয়ের কাজ শেষ করতে যথেষ্ট সময় লেগেছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে নির্ভুল রাখার। তারপরেও ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আশা করি, আমাদের ভুলত্রুটিগুলো পাঠকেরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে শুধরে দেয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের লেখাগুলোর নিয়মিত আপডেট পেতে চোখ রাখতে পারেন এই ফেসবুক পেইজে এবং এই ওয়েবসাইটে।
নাটক, সিনেমা, মিডিয়া, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি মানুষের মনোজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করার খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। এই মিডিয়াই ঠিক করে দেয় আমরা কাকে নিয়ে চিন্তা করব, কীভাবে চিন্তা করব, কার দুঃখে কেঁদে বুক ভাসাব, কীর আনন্দে আনন্দিত হব, কী পোশাক পড়ব, কী খাবার খাব, সবকিছু। মানুষ হিমুর মতো পাগল সেজে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। ফুটবলারদের মতো হেয়ারকাট দেয়, রুপালি পর্দার নায়কদের মতো প্রেম করে, বিজ্ঞাপনের মডেলদের মতো পোশাক পড়ে। মিডিয়া মানুষের সামনে যেটা হাইলাইট করে দেখায় সেটা তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। একজন মানুষ যখন নিয়মিত পর্ন ভিডিও দেখতে থাকে তখন তার আচার আচরণ যে পর্দায় দেখা দৃশ্যগুলো দ্বারা প্রভাবিত হবে তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। অথচ, এই সহজ কথাটাই কেন জানি আমরা বুঝতে চাই না। অনেক সময় নিজেদের অজ্ঞতার কারণে, আবার অনেক সময় নিজেদের পর্ন দেখাকে জাস্টিফাই করার জন্য আমরা দাবি করে বসি, “পর্ন দেখা ক্ষতিকর না, আমি তো শুধুই দেখছি, কিছু করছি না”, ইত্যাদি ইত্যাদি…
পর্ন-আসক্তি কত ধ্রুপদী প্রেমিক, মৌলিক মানুষ আর স্নিগ্ধ নারীদের হৃদয় ভেঙেছে, কত মমতাময়ীদের পাখির নীড়ের মতো চোখে অশ্রুর ঝুম বৃষ্টি নামিয়েছে, কত রঙিন স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেছে এই আসক্তির কারণে, তার কোনো হিসেব কি কেউ কোনোদিন করেছে?
শিশুনির্যাতন, ধর্ষণ, অজাচার, হত্যা, মানবপাচার, মাদক, এইডস, সমকামিতা, হতাশী, আত্মহত্যা, বিবাহবিচ্ছেদ, হত্যা… এটি এমনই এক নির্দয় পৃথিবী। পাঠক আপনাকে স্বাগতম!