০৮. মিক্সড ব্লাড

ভোর ৬টা ৫৪ মিনিট।
প্যাডেরবন, জার্মানি।

তুমি এখানেই থাকছে, বলল গ্রে। চ্যালেঞ্জারের মেইন কেবিনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

কচু, ফিওনা আপত্তি তুলল। দূরে সরল ও, গ্রের কথা মানতে নারাজ। মনক জেটের খোলা দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের হাত দুটো আড়াআড়িভাবে রেখে মজা নিচ্ছে।

আমি এখনও তোমাদেরকে ঠিকানাটা বলিনি, তর্ক শুরু করল ফিওনা। এক মাস সময় লাগিয়ে পুরো শহরের এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি খুঁজে মরতে হবে তোমাদের। আর সেটা না চাইলে আমাকে সাথে নাও। এখন সিদ্ধান্ত তোমাদের, কোনটা করবে।

গ্রের মুখ গরম হয়ে উঠল। এই মেয়ে যখন দুর্বল, বিপদগ্রস্ত ছিল তখনই কেন ও ঠিকানাটা জেনে নেয়নি। তারপর মাথা নাড়ল। দুর্বল আর বিপদগ্রস্ত জিনিস দুটো ফিওনার সাথে যায় না। এই মেয়ে সেরকম মানুষই নয়।

তাহলে কী হবে এখন?

 দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক কাহিনি হবে। বলল মনক।

 গ্রে নরম হতে নারাজ। টিভোলি গার্ডেনস-এ কানের কাছ দিয়ে বেঁচে যাওয়া ঘটনা মনে করিয়ে যদিও এখন মেয়েটিকে ভয় দেখাতে পারে তাহলে? আচ্ছা, তোমার জঘমের কী খবর?

রাগে ফিওনার নাক ফুলে উঠল। কী আর করব? নতুনের মতো তাজা আছে। তরল ব্যান্ডেজ লাগানো আছে, এই তো।

ও এই ব্যান্ডেজ নিয়ে সাঁতার কাটতে পারবে, বলল মনক। এটা ওয়াটারপ্রফ!

 গ্রে বন্ধুর দিকে তাকাল। কথা সেটা না।

 তাহলে কী? ফিওনা জানতে চাইল।

ওর দিকে ফিরল গ্রে। এই মেয়ের কোনো দায়-দায়িত্ব ও আর নিতে চায় না। বাচ্চা মেয়েদের দেখাশোনা করার মতো সময় নেই ওর।

আসলে ও ভয় পাচ্ছে, তুমি যদি আবার আঘাত পাও, শ্রাগ করে মনক বলল।

শ্বাস ফেলল গ্রে। ফিওনা, ঠিকানাটা বলে ফেলল।

আগে গাড়িতে উঠব, তারপর বলব। এখানে বসে বসে ডিমে তা দিতে পারব না।

দিন নষ্ট, বলল মনক। আজকে বোধহয় আমরা ভিজেই যাব।

সকালের আকাশ বর্তমানে চকচকে নীল হলেও উত্তর দিকে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। ঝড় হতে পারে।

ঠিক আছে। বেশ। দরজা থেকে মনককে সরে যাওয়ার জন্য ইশারা করল গ্রে। ফিওনার ওপর অন্তত মনক নজর রাখতে পারবে।

 জেটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো তিন জন। কাস্টমসের ঝামেলা ইতোমধ্যে মিটিয়ে রাখা হয়েছে। ভাড়া করা বিএমডব্লিউ বাইরে অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। মনকের কাঁধে একটা ব্যাকপ্যাক, একই জিনিস গ্রের কাঁধেও আছে। গ্রে ফিওনার দিকে তাকিয়ে দেখে ফিওনার কাঁধেও একটা ব্যাকপ্যাক! আজব….

 এটা বাড়তি ছিল, ব্যাখ্যা করল মনক। চিন্তার কিছু নেই। ওরটায় অস্ত্র, বোমা কিছুই নেই। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।

গ্রে মাথা নাড়ল। টারমাক পেরিয়ে পার্কিং গ্যারেজের দিকে এগোল ওরা। ব্যাকপ্যাকের মিল ছাড়াও ওদের তিনজনের পোশাকেও মিল আছে। কালো জিন্স, স্নিকার, সোয়েটার। পর্যটক হিসেবে এই পোশাক একটু ভিন্ন রকমের হয়ে গেছে। তবে নিজের পোশাকে বোম লাগিয়ে পরিবর্তন এনেছে ফিওনা।

 গ্যারেজে পৌঁছুনোর পর গ্রে চুপিসারে নিজের অস্ত্র আরেকবার পরীক্ষা করে নিল। সোয়েটারের নিচে ৯-এমএম রেখে বাম হাতের কব্জির ওখানে কার্বোনাইজড ছোঁড়া ঢুকিয়ে রাখল। এছাড়াও ব্যাকপ্যাকে আছে : ফ্ল্যাশ গ্রেনেড, সি-৪ বিস্ফোরক, গুলির অতিরিক্ত ক্লিপস।

এবার আর কোথাও অপ্রস্তুত অবস্থায় যাচ্ছে না গ্রে।

অবশেষে গাড়ির কাছে পৌঁছুল ওরা। গাঢ় নীল রঙের বিএমডব্লিউ-৫২৫ আই। ফিওনা চালকের দরজার দিকে এগোল।

ওকে থামাল গ্রে। ফানি।

গাড়ির অপর পাশে গেল গ্রে। চিৎকার করে বলল, শটগান!

মাথানিচু করে আশেপাশে তাকাল ফিওনা।

গ্রে ওকে সোজা করে পেছনের দরজার দিকে নিয়ে গেল। মনক আসলে সামনের সিট চেয়েছে।

মনকের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটল ফিওনা। বদ।

দুঃখিত, বাবু। অত ফটফট কোরো না, বুঝেছ?

গাড়িতে উঠে বসল ওরা। ইঞ্জিন চালু করে ফিওনার দিকে ফিরল গ্রে। কোথায় যেতে হবে?

মনক ইতোমধ্যে একটা ম্যাপ বের করে ফেলেছে।

 ওর কাঁধের কাছে ঝুঁকে এলো ফিওনা। ম্যাপে একটা আঙুল রাখল।

শহরের বাইরে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২০ কিলোমিটার যেতে হবে। আমি ভ্যালির বারেন নামক গ্রাম হচ্ছে আমাদের গন্তব্য।

তারপর? ঠিকানা কী?

ফানি, একটু আগে শোনা কথার পুনরাবৃত্তি করল ফিওনা। নিজের সিটে হেলান দিল।

রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল ও। ফিওনার চেহারা ওখানে দেখা যাচ্ছে। জোরপূর্বক তথ্য আদায় করতে চাওয়া বেচারি ওর প্রতি অসন্তুষ্ট।

তবে চেষ্টাকারীকে দোষও দিতে পারছে না।

রওনা করার জন্য গ্রেকে ইশারা করল ফিওনা।

অগত্যা কোনো উপায়ন্তর না দেখে গ্রে ওর নির্দেশ মেনে নিল।

***

পার্কিং গ্যারেজের দূরবর্তী অংশে একটা সাদা মার্সেডিজ রোডস্টারে বসে আছে দুজন। বাইনোকুলার নামিয়ে লোকটি চোখে ইটালিয়ান সানগ্লাস পড়ল। পাশে বসা যমজ বোনকে উদ্দেশ্য করে মাথা নাড়ল। ডাচ ভাষায় ফিসফিস করে স্যাটেলাইট ফোনে কথা বলল বোন।

বোনের অন্য হাত ভাইয়ের হাতে। বুড়ো আঙুল দিয়ে আলগোছে ট্যাটুর ওপর দিয়ে মেসেজ করে দিচ্ছে ভাই।

বোন তার ভাইয়ের আঙুলে চাপ দিল।

ভাই নিচ দিকে তাকিয়ে দেখে বোনের এক আঙুলের নখ দাঁত দিয়ে কাটার পর একটু এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। বিশ্রী লাগছে দেখতে।

ভাইয়ের নজর বুঝতে পেরে নিজের নখ লুকোনোর চেষ্টা করল ও। বিব্রতবোধ করছে।

যদিও লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। ওর ভাই জানে, কতটা টেনশন আর প্রেশারে থাকলে এভাবে দাঁত দিয়ে নখ কাটা পড়ে। গতকাল রাতে ওরা ওদের বড় ভাই হ্যাঁনকে হারিয়েছে।

সামনের গাড়িতে থাকা চালকটি তাকে খুন করেছে।

পার্কিং গ্যারেজ থেকে বিএমডব্লিউকে বের হয়ে যেতে দেখে চোখ সরু করল ফিউরি। জিপিএস ট্রান্সপন্ডার লাগানো আছে। গাড়িটাকে ট্র্যাক করা যাবে।

 বুঝেছি, ফোনে বলল বোন। যেমনটা আশা করা হয়েছিল… বইয়ের সূত্র ধরে এগোচ্ছে ওরা। নিঃসন্দেহে ওরা এখন বারেন গ্রামের হিরজফিল্ড এস্টেট-এ যাবে। ওদের জেটটাকে নজরদারিতে রেখে আমরা রওনা দেব। সবকিছু তৈরি।

ফোনের ওপাশের কথা শুনতে শুনতে ভাইয়ের দিকে তাকাল ও।

হ্যাঁ, বলল ও, ফোন আর ভাই দুজনকে উদ্দেশ্য করে, আমরা ব্যর্থ হব না। ডারউইন বাইবেল আমাদের-ই হবে।

ভাই মাথা নেড়ে সায় দিল। বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে ইগনিশনের চাবি ঘুরাল সে।

গুড-বাই, দাদু। বোন কথা শেষ করল।

ফোন রেখে ভাইয়ের মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে ঠিক করে দিল ও।

 এবার ঠিক আছে।

একদম ঠিকঠাক।

বোনের আঙুলের ডগায় ভাই চুমো খেল।

ভালবাসা আর প্রতিজ্ঞা মিশে আছে ওতে।

প্রতিশোধ নেবে ওরা।

 শোক পরে করা যাবে।

পার্কিং গ্যারেজ থেকে বরফ সাদা মার্সেডিজ বের করে শিকারের পেছনে ছুটল ওরা।

.

সকাল ১১ টা ৩৮ মিনিট।
 হিমালয়।

সোল্ডারিং গান থেকে গাঢ় টকটকে শিখা বেরিয়ে এলো। যন্ত্রটাকে সোজা করল ক্রো। ওর হাত কাঁপছে। তবে সেটা ভয়ে নয়, চোখের পেছনে এখনও দপদপ করে ব্যথা করছে, তাই। বেশকিছু ওষুধ খেয়েছে ও। যদিও ওগুলোর কোনোটাতেই শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যাবে না। তবে অ্যানার মতে, ওষুধগুলো খাওয়ার ফলে ক্রো আরও অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা ভাল থাকতে পারবে।

কত সময় আছে ওর হাতে?

 তিন দিনেরও কম। তারচেয়েও কম সময়ে হয়তো অক্ষম হয়ে পড়বে।

এসব চিন্তা-ভাবনা মন থেকে সরানোর চেষ্টা করল ও। দুশ্চিন্তা করলে ও আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে। ওর দাদার একটা কথা মনে পড়ল… বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।

কথাটা মাথায় রেখে সোল্ডারিং করায় মন দিল ক্রো। বেরিয়ে আসা ভূগর্ভস্থ তারের সাথে একটা ক্যাবলের সংযোগ দিচ্ছে। এই ওয়্যারিং পুরো ক্যাসলে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন অ্যান্টেনার সাথে সংযুক্ত রয়েছে। শুধু তাই না, পাহাড়ের চূড়োয় কোনো এক জায়গায় লুকোনো স্যাটেলাইট আপলিংক ডিসের সাথেও সংযোগ আছে এর।

 কাজ শেষ করে পেছনে হেললো পেইন্টার। সদ্য করা সোল্ডারিং-কে ঠাণ্ডা হতে দিচ্ছে। একটা বেঞ্চের ওপর বসে আছে সে। সার্জনের মতো ওর পাশে নানান রকম যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে আছে। দুটো ল্যাপটপ খোলা অবস্থায় আছে এখানে।

ল্যাপটপ দুটো দিয়েছে গানথার। সন্ন্যাসীদেরকে খুন করেছে, আং গেলুকে খুন করেছে; এই গানথার। এই লোকের ধারে কাছে গেলেই পেইন্টারের ভেতরে ক্রোধ জেগে ওঠে।

যেমন এখনও জাগছে।

ওর কাঁধের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহি গানথার। ওর প্রত্যেকটা নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করছে। মেইনটেন্যান্স রুমে ওরা দুজন একা। পেইন্টার একবার ভাবল, এই সোল্ডারিং গানটা লোকটার চোখে ঠেসে ধরবে কিনা। কিন্তু তারপর? সভ্য জগৎ থেকে ওরা অনেক দূরে অবস্থান করছে। মৃত্যুদণ্ডের খাড়া ঝুলছে মাথার ওপর। সহযোগিতা করলেই বাঁচার আশা আছে, নইলে নেই। অন্যদিকে লিসা রয়ে গেছে অ্যানার স্টাডি রুমে। চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করেছে সে।

আর এখানে পেইন্টার আর গানথার এসেছে ভিন্ন দিকে।

 স্যাবোটেজকারীকে ধরবে ওরা।

গানধারের ভাষ্য অনুযায়ী, যে বোম বেল-কে ধ্বংস করেছে সেটা হাতে বসানো হয়েছিল। যেহেতু বিস্ফোরণের পর কেউ এই ক্যাসল থেকে চলে যায়নি সেহেতু কালপ্রিট এখনও ক্যাসলে আছে বলে ধরে নেয়া যায়।

বিষয়টা নিয়ে এগোতে পারলে হয়তো সামনে আরও অনেক কিছু জানা যাবে।

আর সেটা করার জন্য লোকমুখে কিছু কথা ছড়িয়ে টোপ ফেলা হয়েছে।

এখানকার সব কাজ করা হচ্ছে সেই টোপকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদে পরিণত করার জন্য। একটা ল্যাপটপকে ক্যাসলের কমিউনিকেশন সিস্টেমের সাথে সংযোগ করে দেয়া হয়েছে। গানথারের কাছ থেকে পাওয়া পাসওয়ার্ডগুলো ব্যবহার করে ইতোমধ্যে সিস্টেমে ঢুকে পড়ে কাজ করতে শুরু করেছে ক্রো। কমিউনিকেশন সিস্টেম থেকে যাওয়া যাবতীয় আউটগোয়িং কল তদারকি করার জন্য ক্রো বেশ কয়েকটা সিরিজ কমপ্রেসড কোড ছেড়েছে। স্যাবোটাজকারী যদি বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাহলে তার অবস্থানসহ এখানে সেটা ধরা পড়বে।

তবে পেইন্টারের ধারণা, কালপ্রিট এত বোকা নয়। সে পুরুষ হোক বা নারী গোপনে সে দীর্ঘদিন ধরে নিজের কাজ করে আসছে। সে হিসেবে বোঝা যাচ্ছে, কালপ্রিট বেশ ধুরন্ধর।

এজন্য নতুন কিছু তৈরি করল পেইন্টার।

কালপ্রিটের কাছে নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত স্যাটেলাইট ফোন আছে। নিজের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সাথে ওটা দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে। কিন্তু ওরকম ফোনকে অরবিটিং স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হলে পরিষ্কার, ঝকঝকে, বাধাহীন লাইন প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ক্যাসলে সেরকম আরামের জায়গা আনেক আছে। কোটর, জানালা, সার্ভিস হ্যাঁচ; ইত্যাদি বহু জায়গা ব্যবহার করে গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি না করে কালপ্রিট নিজের চাহিদা মেটাতে পারবে।

ভিন্ন কিছু দরকার।

ভূগর্ভস্থ তারের সাথে লাগানো সিগন্যাল অ্যামপ্লিফায়ার চেক করল ক্রো। সিগমায় থাকাবস্থায় এই ডিভাইস ও নিজে বানিয়েছিল। ডিরেক্টর হওয়ার আগে সিগমায় দক্ষ অপারেটিভ হিসেবে দায়িত্বরত ছিল ক্রো। তখন নজরদারি আর মাইক্রোইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করতো। তাই, এসব কাজ ওর কাছে ডাল-ভাত।

আরেকটা ল্যাপটপের সাথে ভূগর্ভস্থ তারের সংযোগ ঘটিয়েছে এই অ্যামপ্লিফায়ার।

তৈরি হয়ে গেছে, বলল ক্রো, ওর মাথাব্যথা এখন একটু কমেছে।

 চালু করা যাক।

ব্যাটারি অন করল পেইন্টার। সিগন্যালের বিস্তার ও পালস রেট ঠিক করে দিল। বাকি কাজ ল্যাপটপ করে নেবে। সিগন্যাল পেলেই ধরে ফেলবে এটা। তবে একেবারে নিখুঁত হবে তা কিন্তু নয়। অবৈধভাবে কোনো সিগন্যালকে দেখলেই উৎসের ৯০ ফুটের মধ্যে অবস্থান নির্ণয় করে দেখাতে পারবে। এতখানিই যথেষ্ট।

সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করে নিল ক্রো। ঠিক আছে। সব সেট করা হয়ে গেছে। এখন আমরা অপেক্ষা করব কখন হারামজাদাটা ফোন করে।

মাথা নাড়ল গানথার।

অবশ্য যদি আমাদের টোপ সে গিলে থাকে তবেই সেটা হবে, শেষ মুহূর্তে যোগ করল ক্রো।

আধঘন্টা আগের কথা।

গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে–সীসা দিয়ে বন্ধ করা গোপন ভল্টে রাখা জেরাম-৫২৫ বিস্ফোরণের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। গুজবটা পুরো ক্যাসলে আশার আলো জ্বালিয়ে দিলো। যদি স্থানান্তরযোগ্য জ্বালানি পাওয়া যায় তাহলে হয়তো নতুন করে বেল তৈরি করা সম্ভব হবে। এমনকি বিভিন্ন টুকরো অংশ জোড়া লাগিয়ে রিসার্চারদেরকে জড়ো করতে শুরু করেছেন অ্যানা। অসুখের প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব না হোক, নতুন করে বেল হলে অন্তত বাড়তি কিছু সময় হাতে পাওয়া যাবে। বাড়তি সময় পাবে সবাই।

কিন্তু আশা জাগানোর জন্য এই গুজব ছড়ানো হয়নি। কালপ্রিটের কানে কথাগুলো পৌঁছে দেয়াই হলো আসল উদ্দেশ্য। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। বেল-কে পুনরায় তৈরি করা সম্ভব। তাহলে সে তার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির কাছে পরামর্শ চাইবে।

আর চাইতে গেলেই পেইন্টারের খপ্পরে পড়বে সে।

গানখারের দিকে ফিরল ক্রো। সুপারম্যান হতে কেমন লাগে? প্রশ্ন করল ও। রাজা সূর্যের একজন বীর।

শ্রাগ করল গানথার। তার যোগাযোগ করার মাধ্যম হলো : ঘোঁতঘোত করা, দ্রুকুটি আর অল্পকিছু শব্দ।

আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার নিজেকে সেরা কিংবা বড় মনে হয় কি-না? বেশি শক্তিশালী, দ্রুতগামী, এক লাফ দিয়ে বিল্ডিং পার হওয়া… এসব?

 গানথার কিছু বলল না, স্রেফ ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

শ্বাস ফেলল পেইন্টার। নতুন প্রসঙ্গ তুলে লোকটার মুখ খোলাতে চাইল। সহানুভূতির সাথে দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে হবে। আচ্ছা, Leprakonige মানে কী? আপনি যখন না থাকেন যখন অনেককেই আমি শব্দটা বলতে শুনেছি।

 পেইন্টার শব্দটার মানে খুব ভাল করেই জানে। কিন্তু ওর গানথারের সাড়া দরকার। এবং পেয়েও গেল। অন্যদিকে মুখ ঘোরাল গানথার। তবে পেইন্টার ওর চোখে জ্বলে ওঠা আগুন ঠিকই দেখতে পেয়েছে। নীরবতা। ও বুঝতে পারছে না লোকটা এখন কী বলবে।

কুষ্ঠ রাজা, অবশেষে গর্জন করল গানথার।

এবার পেইন্টারের চুপ করে থাকার পালা। ছোট রুমটার পরিবেশ একটু ভারী হতে দিলো ও। গানথার আবার মুখ খুলল।

 নিখুঁত কাজ করতে গিয়ে কেউ ব্যর্থতা মেনে নিতে চায় না। যেহেতু আমাদেরকে তারা আশা করেনি তাই আমাদের রোগও তারা দেখতে ইচ্ছুক নয়। আমাদেরকে আড়ালে রাখতে পারলেই তারা খুশি।

নির্বাসন দেয়া। কুষ্ঠ রোগীকে যেরকম করা হয় আরকি।

 Sonnekonlge জাতের মানুষ হয়ে বড় হয়ে ওঠার কঠিন বাস্তবতা কল্পনা করার চেষ্টা করল ক্রো। ছোটবেলা থেকেই সে জানে তার কপাল পোড়া। যেখানে রাজপুত্রের মতো আদর-যত্ন পেতে পারতো সেখানে হয় অবহেলিত।

তারপরও তো আপনি এখানে আছেন, বলল পেইন্টার। সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

আমার জন্মই হয়েছে এটার জন্য। এটা আমার কর্তব্য।

পেইন্টার অবাক হলো। কর্তব্যের বিষয়টা হয়তো এদের জিনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। গানথারকে পর্যবেক্ষণ করল ক্রো। ওর মনে হলো লোকটা সম্পর্কে ও আরও বেশি কিছু জানে। কিন্তু কী জানে সেটাই জানে না।

আপনি কেন আমাদের সবাইকে সাহায্য করছেন?

আমি এখানকার কাজে বিশ্বাস করি। আমি এখন যেটায় ভুগছি, একদিন হয়তো মানুষদেরকে আর এটায় ভুগতে হবে না।

 আর এখন? এখন তো আর চিকিৎসার কোনো আশা নেই। শুধু সময়ক্ষেপণ চলছে। আপনার তো তেমন কোনো লাভ হবে না।

গানখারের চোখ জ্বলে উঠল। Ich bin nicht krank

 মানে কী? আপনি অসুস্থ নন?

Sonnekonige-রা বেল-এর অধীনে জন্ম করেছিল। জোর গলায় বলল গানপার।

প্রতিবাদের ভাষা বুঝল ক্রো। অ্যানার কথাগুলো মনে পড়ল ওর। ক্যাসল জুড়ে সুপারম্যানদের তাণ্ডব… তারা বেল-এর দ্বারা আর কোনো কিছু হতে দেবে না। হোক সেটা ভাল কিংবা মন্দ।

আপনারা তো বিরুদ্ধে ছিলেন। বলল ক্রো।

 গানথার অন্যদিকে মুখ ঘোরাল।

পেইন্টার একটু ভাবল। যদি নিজে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকাটাই মূল উদ্দেশ্য না হয় তাহলে গানথার কীসের জন্য সাহায্য করছে?

কী সেটা?

হঠাৎ করে ক্রোর মনে পড়ে গেল অ্যানা কোন দৃষ্টিতে গানথারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। স্নেহ, মায়া, মমতা ছিল সেই দৃষ্টিতে। আর গানথার তাতে সায়ও দিয়েছিল। এছাড়া অ্যানাকে বাকিরা সবাই যতটা সম্মান করে থাকে গানথার অতটা করে না। তাহলে?

আপনি অ্যানাকে ভালবাসেন, মিনমিন করে বলল পেইন্টার।

 অবশ্যই বাসি, গানথার চট করে জবাব দিল। ও আমার বোন।

.

অ্যানার স্টাডি রুমে ঝুলে থাকা লাইট বক্সটার কাছে লিসা দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত এধরনের লাইট বক্সের আলোতে রোগীদের এক্স-রে ফিল্মগুলো দেখা হয় তবে সেই আলোতে এখন অ্যাসেটেইট কাগজ দেখছে লিসা। কালো রেখা আছে কাগজগুলোতে। ওখানে বেল-এর প্রভাবের আগে ও পরে ডিএনএ-এর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বেল এর প্রভাবে ডিএনএ-এর কোথায় কোথায় পরিবর্তন ঘটেছে সেই জায়গাগুলো দাগানো আছে গোল গোল বৃত্ত দিয়ে। জার্মান ভাষায় সেগুলোর পাশে নোটও লেখা আছে।

 ওগুলো অনুবাদ করে দিয়ে আরও কিছু বই আনতে গেলেন অ্যানা।

লাইট বক্সের আলোতে লিসা পরিবর্তনগুলো দেখতে লাগল, কোনো প্যাটার্ন কিংবা ধারা পাওয়া যায় কি-না খুঁজছে। কয়েকটি কেস স্টাডি শেষ করে বুঝল বেল-এর প্রভাবে যে মিউটেশনগুলো হয়েছিল ওগুলোর কোনো নির্দিষ্ট ছন্দ বা কারণ কোনোটাই নেই। কোনো উত্তর না পেয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে ফিরল ও। টেবিলের ওপরে এখন একগাদা বই, বৈজ্ঞানিক তথ্য আর কয়েক দশক আগে মানবদেহের ওপর চালানো পরীক্ষাগুলোর নথি রাখা আছে।

লিসার পেছনে থাকা ফায়ারপ্লেসের আগুন মটমট করে উঠল। ওর একবার ইচ্ছে হলো, এইসব কাগজপত্র আগুনে ফেলে দেবে। কিন্তু নিজের ইচ্ছের মুখে লাগাম দিল ও। যদিও এখানে অ্যানা নেই, তবুও…। পাহাড়ের অত্যধিক উচ্চতায় মানুষের মধ্যে কেমন মানসিক প্রভাব পড়ে, সে-বিষয় নিয়ে নেপালে গবেষণা করতে এসেছিল লিসা। পেশায় মেডিক্যাল ডাক্তার হলেও অন্তর থেকে ও একজন গবেষক।

অ্যানার মতো।

না… ঠিক অ্যানার মতো নয়।

 টেবিলের ওপরে থাকা একটি রিসার্চ মনোগ্রাফকে আলতো করে পাশে টেনে নিল ও। নাম : Teratogenesis in the Embryonic Blastoderm, এই নথির সাথে বেল থেকে বিকরিত ক্ষতিকর রেডিয়েশনের সম্পর্ক আছে। কালো রেখা দিয়ে চিত্র উপস্থাপন করার পাশাপাশি এখানে নিরপেক্ষভাবে কিছু ভয়ঙ্কর বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন : বিভিন্ন অঙ্গবিহীন অবিকশিত শিশু, এক চোখঅলা দৈত্যাকার দ্রুণ, বড় মস্তিষ্কঅলা মৃত শিশু ইত্যাদি।

 না, ও অবশ্যই অ্যানার মতো নয়। লিসার বুকের ভেতরে আবার সেই আগের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

নিজের রিসার্চ লাইব্রেরির দোতলায় উঠে যাওয়া মই বেয়ে নিচে নামলেন অ্যানা। হাতে একগাদা বই। জার্মানরা হাল ছেড়ে দেয়নি। কেন হাল ছাড়বে। ওরা এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে কী করে এই কোয়ান্টাম অসুখের নিরাময় করা যায়। অ্যানা মনে করেন, এখন এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজের কাজ কিছুই হবে না। সম্ভবনা যা ছিল সেটা কয়েক দশক আগে চলে গিয়েছে। এখন আর সেরকম আশা নেই। তবে লিসাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য খুব একটা অনুরোধ করতে হয়নি তাকে।

লিসা খেয়াল করে দেখল অ্যানার হাত কীভাবে কাঁপছে… যদিও ভালভাবে খেয়াল না করলে সেটা চোখেই পড়বে। তিনি নিজের হাতের তালু ঘষে কাঁপন আড়াল করার চেষ্টা করছেন। এটা দেখে আবারও মনে পড়ে গেল, ক্যাসলের সবাই রোগে আক্রান্ত। পুরো সকাল জুড়ে সবাই কতটা উদ্বিগ্ন ছিল সেটা পরিষ্কার টের পাওয়া গেছে। কিছু চিৎকার চেঁচামেচি আর একটি হাতাহাতি হওয়ার ঘটনা লিসা নিজ চোখে দেখেছে। এছাড়াও গত কয়েক ঘন্টায় আত্মহত্যাও করেছে কয়েকজন। চিকিৎসা পাবার শেষ আশা ভরসা বেল ধ্বংস হবার পর থেকে এই ক্যাসলে যেন হতাশা নেমে এসেছে। পেইন্টার আর ও যদি কোনো সমাধান বের করার আগেই এখানে যদি পাগলামো শুরু হয়ে যায় তখন কী হবে?

 এই চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে রাখল লিসা। হাল ছাড়বে না ও। বর্তমানে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে সাহায্য করলেও লিসা এখান থেকে সর্বোচ্চ সুযোগটুকু নিতে চায়।

অ্যানাকে এগোতে দেখে মাথা নাড়ল লিসা। বেশ, এখান থেকে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছি। কিন্তু আপনার বলা কিছু জিনিস আমাকে এখনও ভাবাচ্ছে।

টেবিলে বইগুলো রেখে অ্যানা একটা চেয়ারে বসলেন। কী সেটা?

আপনি বলেছিলেন, বেল নাকি বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। টেবিলের ওপরে থাকা বই আর কাগজপত্রের দিকে ইশারা করে বলল, কিন্তু এখানে যা দেখলাম সেটা হলো, পরিবর্তনশীল রেডিয়েশন প্রয়োগ করে একটা সুপ্রজনন প্রোগ্রাম করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। জেনেটিক পরিবর্তন এনে উন্নত মানুষ তৈরির চেষ্টা আরকি। কিন্তু এই ব্যাপারে আপনি বিবর্তন-এর মতো ভারী শব্দকে কেন টেনে আনলেন, ঠিক বুঝলাম না।

 আপত্তিসূচক মাথা নাড়লেন অ্যানা। ড. কামিংস, বিবর্তন বলতে আপনি কী বোঝেন?

ডারউইন যেভাবে বলে গেছেন, সেটাই।

কী সেটা?

 লিসা ভ্রু কুঁচকাল। ধীরে ধীরে জৈবিক পরিবর্তন… একটা এককোষী প্রাণী বিভিন্ন রকমভাবে বিস্তার লাভ করতে করতে বর্তমান প্রাণীকূলের অবস্থায় এসেছে।

এবং এসবের ওপর ঈশ্বরের কোনো হাত নেই?

প্রশ্ন শুনে লিসা একটু পিছু হটল। সৃষ্টির ক্ষেত্রে?

শ্রাগ করলেন অ্যানা, লিসার ওপর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিংবা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনে?

 আপনি নিশ্চয়ই সিরিয়াস নন? এরপর নিশ্চয় বলবেন যে, বিবর্তনবাদ স্রেফ একটা থিওরি ছাড়া কিছুই নয়।

 বোকার মতো কথা বলবেন না। যদি আর আন্দাজ দিয়ে যারা চলে আমি তাদের মতো নই। বিজ্ঞানের কোনো কিছুই বিস্তর তথ্য ও পরীক্ষিত হাইপোথিসিস ছাড়া থিওরির পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে না।

তাহলে আপনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানেন?

অবশ্যই। কোনো সন্দেহ নেই ওতে। বিজ্ঞানের সকল নিয়ম-কানুন মেনেই ওটা তৈরি করা হয়েছে। না মানার কোনো প্রশ্নই আসে না।

তাহলে কেন ওভাবে…।

 একটাকে গ্রহণ করতে গিয়ে তো অন্যটাকে বাদ দেয়া যাবে না।

এক ভ্রু উঁচু করল লিসা। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আর বিবর্তনবাদ?

অ্যানা মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ। একটু পেছন থেকে শুরু করি… আশা করি, আমার বোঝা ভুল নয়। প্রথমেই সমতল পৃথিবীর ধারণা বাতিল করে দিচ্ছি। অনেকে ভাবে তাদের সৃষ্টিকর্তার বানানো এই পৃথিবী নাকি সমতল! পৃথিবী গোল এটা মানতে তাদের কষ্ট হয়। সেইসাথে বাইবেল শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের জ্ঞানের বহরকেও বাতিল করে দিতে হচ্ছে। কারণ তাদের ধারণা এই পৃথিবীর বয়স সর্বসাকুল্যে ১০ হাজার বছর। এবার আমাদের মূল প্রসঙ্গে আসি। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের পক্ষে যারা ওকালতি করে, তাদের ব্যাপারে কিছু বলি।

 মাথা নাড়ল লিসা। একজন সাবেক-নাৎসি এখন বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। কাহিনি কী?

খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন অ্যানা। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে যেসব তর্ক-বিতর্ক হয় সেগুলোর অধিকাংশই বিভ্রান্তমূলক। তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্রের ভুল ব্যাখ্যা, হাঁটুভাঙ্গা পরিসংখ্যান দেখানো, পাথরের রেডিওমেট্রিক দিককে ভুলভাবে উপস্থাপন করা, ইত্যাদি। বিভ্রান্তির তালিকা করতে গেলে আরও বড় হতে থাকবে। এগুলোর কোনোটাই কোনো কাজের নয়। অথচ ঠিকই একটা ধোঁয়াশার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

লিসা মাথা নাড়ল। হাই স্কুলের জীববিদ্যা ক্লাস নেয়ার মতো করে কথা বলছেন অ্যানা। গড়পড়তা পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন ডক্টরেটেড-এর পক্ষে এগুলো হজম করা একটু কষ্টসাধ্য তাই নিজেকে হাই স্কুল ছাত্রী ভেবে নেয়াই ভাল।

অ্যানার এখনও বলা শেষ হয়নি। সেগুলোর মতে, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের একটা বিষয় বিবেচনায় করতে হবে।

কী?

মিউটেশন বা রূপান্তর হওয়ার এলোমেলো ধরন। সবকিছু নিখুঁত হলে এত ভিন্ন। ভিন্ন ধরনের মিউটেশন পাওয়া সম্ভব হতো না। কটিযুক্ত জন্মগ্রহণও যে লাভজনক পরিবর্তন আনতে পারে, সে-সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? এরকম কয়টা ঘটনা জানেন আপনি?

এই তর্ক লিসা এর আগেও শুনেছে। দ্রুতগতিতে নিখুঁতভাবে জীবন বিকশিত হওয়ার বিষয়টা আসলে খুব একটা যুক্তিসঙ্গত নয়। অবশ্য ও এটা নিয়ে কোনো মাখা ঘামায় না।

বিবর্তন কোনো নিখুঁত জিনিস নয়। বলল লিসা। এটা প্রাকৃতিক বাছাই প্রক্রিয়া কিংবা আবহাওয়ার প্রভাব, যার ফলে আগাছা ধাচের ক্ষতিকর পরিবর্তনগুলোকে ছাঁটাই করে শুধু ভাল অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে জিন বহন করে।

সেরাদের জয়, তাই তো?

সেরা না হলেও অন্তত টিকে থাকবার মতো হতে হয়। একদম নিখুঁত হওয়ার জন্য পরিবর্তন সংগঠিত হয় না। সেটা থেকে সুবিধা নেয়ার জন্য পরিবর্তন আসে। আর এভাবে অল্প অল্প করে বিভিন্ন পরিবর্তন আসতে আসতে এই শত শত মিলিয়ন বছর পর এসে আমরা এরকম বৈচিত্র্যতা দেখতে পাচ্ছি।

শত শত মিলিয়ন বছর? আচ্ছা, আপনার কথা মেনে নিলাম, সময়টা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু এখনও কী বিবর্তন হওয়ার মতো সুযোগ আছে? আর বিবর্তনের সেই বিশেষ অংশ সম্পর্কে কী বলবেন, যখন অনেক কিছু বেশ দ্রুত পরিবর্তন হয়েছিল?

আমার মনে হয়, আপনি ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের কথা বলছেন? প্রশ্ন করল লিসা। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে এটা একটা বিষয়। ক্যামব্রিয়ান সময়কালটা বেশ ছোট ছিল। মাত্র ১৫ মিলিয়ন বছর। কিন্তু সেই সময়ের ভেতরে অনেক নতুন জাতের জীবনের আবির্ভাব ঘটেছিল। যেমন : পরজীবী, শামুক, জেলিফিস, ট্রাইলোবাইট ইত্যাদি। যারা বিবর্তনবাদের বিপক্ষে তাদের জন্য এই অংশটুকু খুব কাজে দেয়।

না। ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়, হঠাৎ উদয় হওয়ার বিষয়টা আসলে হঠাৎ করে উদয় হয়নি। ক্যামব্রিয়ান সময়ের আগেও অনেক পরজীবী ও মেটাজোয়ানের মতো পোকামাকড় ছিল। এমনকি সেই সময়কার বৈচিত্র্যের ব্যাপারটাকে হত্ন জিনের জেনেটিক কোড দিয়ে বিচার করা সম্ভব।

হক্স জিন?

চার কিংবা ছয় জিনের একটা সেট যেটা জেনেটিক কোডে তাদের উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতো। প্রাথমিক উন্নতিগুলোর ওপর প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের। উপরে, নিচে, ডানে, বামে, আগা, গোড়া; অর্থাৎ পুরো শরীরের অবয়ব তৈরি করার বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করতে ওরা। ফলের মাছি, ব্যাঙ, মানুষ; এদের সবারই এই হক্স জিন আছে। একটা মাছি থেকে হক্স জিন এনে ব্যাঙের ডিএনএ-তে প্রতিস্থাপিত করা হলে ব্যাঙ দিব্যি চলতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না। যেহেতু এই জিনগুলো প্রাথমিক উন্নতির একদম মূল চাবিকাঠি তাই এগুলোতে অতিক্ষুদ্র পরিবর্তন করলেই শরীরের অবয়বে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

এত তথ্য জেনে আসলে ওদের আলোচনা কোনদিকে সেটা বোঝা না গেলেও এই বিষয়ে মহিলার জ্ঞানের গভীরতা দেখে মুগ্ধ হলো লিসা। ওর নিজের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব জেগে উঠল। অ্যানা যদি ওর কোনো কনফারেন্সের সহকর্মী হতেন তাহলে ও এগুলো বেশ ভালভাবে উপভোগ করতো। এই মহিলার সাথে কথা বলার সময় এখন থেকে সমঝে কথা বলতে হবে, মনে গেঁথে নিল লিসা।

আচ্ছা তাহলে হক্স জিনের মাধ্যমে ক্যামব্রিয়ান সময়কালে প্রাণীদের উদ্ভব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা গেল। কিন্তু…

বাধা দিলেন অ্যানা। হক্স জিন কিন্তু দ্রুত বিবর্তনের অন্যান্য অংশের ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেয় না।

যেমন? আলোচনা এখন ইন্টারেস্টিং দিকে মোড় নিচ্ছে।

যেমন : গোলমরিচ পোকা। গল্পটা জানেন তো?

মাথা নাড়ল লিসা। জানে। গোলমরিচ পোকা গাছের কাঠের মধ্যে বাস করতো। গায়ের রং : বিচিত্র বর্ণে সাদা ফুটকি। বাকলের রঙের সাথে ওদের গায়ের রং মিলে যাওয়ায় পাখিরা ওদেরকে খেতে পারতো না। ম্যানচেস্টার এলাকায় কয়লা কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর গাছগুলো একদম কালো কুচকুচে হয়ে গেল। বিপদে পড়ল গোলমরিচ পোকারা। ওদের সাদা ফুটকিঅলা শরীরগুলো পাখিরা খুব সহজেই খুঁজে পেতে শুরু করল। কিন্তু পাকাগুলোর রং কালো হয়ে গেল মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যে। ঝুলযুক্ত কালো গাছের সাথে মিশে থাকার জন্য পোকাদের ছদ্মবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

 মিউটেশন যদি এলোভাবে হয়ে থাকে, ভিন্নমত পোষণ করলেন অ্যানা, তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ঠিক যখন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তখুনি মিউটেশন হয়ে যায়! কথা হলো, এটা যদি এলোমেলো প্রক্রিয়ায়ই হয়ে থাকে তাহলে লাল, সবুজ আর রক্তবর্ণের পোকাগুলো গেল কোথায়? এমনকি দুই মাথাঅলা গোলমরিচ পোকা? সেটাইবা কোথায় গায়েব হলো?

নিজের চোখ পাকানো ঠেকানো চেষ্টা করল লিসা। আমি বলব, অন্য রঙের পোকাগুলোকে পাখি খেয়ে ফেলেছিল। দুই মাথাঅলা পোকাও মারা পড়েছিল তখন। কিন্তু আপনি উদাহরণটাকে ভুল বুঝছেন। পোকালোর রঙের পরিবর্তন কোনো মিউটেশন নয়। এই পোকাদের ভেতরে আগে থেকেই কালো জিন ছিল। প্রতি প্রজন্মেই কিছু কালো পোকা জন্ম নিতো। কিন্তু অধিকাংশই খাওয়া পড়তে ওগুলোর। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে টিকে থাকতো সাদাগুলো। গাছ কালো হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে গেল। সাদা পোকা খাওয়া পড়তে শুরু করায় কালোরা টিকে গেল এবং ধীরে ধীরে সংখ্যায় বাড়তে লাগল। এই উদাহরণটাকে মিউটেশনের দিকে টেনে না গিয়ে অন্যভাবে দেখা যায়। যেমন : পরিবেশ পরিস্থিতি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর প্রভাব রাখতে সক্ষম। এখানে কোনো মিউটেশন হয়নি। কালো জিন ওদের ভেতরে আগে থেকেই ছিল।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন অ্যানা।

লিসার মনে হলো, এই মহিলা ওর জ্ঞান পরীক্ষা করছিলেন। একদম সটান হয়ে মোটামুটি রাগী অবস্থায় আছেন তিনি।

 ভেরি গুড, অ্যানা বললেন। ঠিক আছে, আমি আরেকটা ঘটনার কথা বলি। এবারের ঘটনাটা ল্যাবের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সংগঠিত হয়েছিল। একজন গবেষক একটা ই, কলি ব্যাকটেরিয়া তৈরি করলেন যেটা ল্যাকটোজ (সুগার) হজম করতে পারে না। তারপর তিনি সেই ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে এমন একটা জায়গায় রাখলেন যেখানে খাদ্যের উৎস হিসেবে শুধু ল্যাকটোজ ছিল। বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে বলুন তো… এরপর কী হবে?

শ্রাগ করল লিসা। ল্যাকটোজ হজম করতে না পেরে ব্যাকটেরিয়া অভুক্ত থাকতে থাকতে মারা যাবে।

ঠিক। ৯৮% ব্যাকটেরিয়ার তা-ই হয়েছিল। কিন্তু বাকি ২% বেশ সুন্দরভাবে টিকে রইল। ল্যাকটোজ হজম করার জন্য নিজেরাই নিজেদের জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে নিয়েছিল ওরা। তা-ও মাত্র এক প্রজন্মে। অবাক লাগছে, তাই না? এই ঘটনা এলোমেলোভাবে কোনোকিছু ঘটার সম্পূর্ণ বিপক্ষে যায়। মাত্র ২% কেন বেঁচে থাকার তাদের একটা জিন মিউটেশন ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল? না, এলোমেলোভাবে এ জিনিস হবে না।

বিষয়টি অদ্ভুত মনে হলো লিসার কাছে। হয়তো ল্যাবে কোনো সমস্যা…

এই পরীক্ষা বারবার চালিয়ে একই ফল পাওয়া গেছে।

 কিন্তু লিসা মানতে পারল না।

আমি আপনার চোখে দ্বিধা দেখতে পাচ্ছি। ঠিক আছে, এলোমেলোভাবে মিউটেশন হয় না, এই বিষয়ে আপনাকে আরেকটা উদাহরণ দিই।

বলুন?

প্রাণের একদম শুরুতে চলুন। একদম আদিকালে। যেখানে বিবর্তনের ইঞ্জিন প্রথম চালু হয়েছিল।

লিসার মনে পড়ল, অ্যানা একবার বলেছিলেন প্রাণের উৎসের সাথে বেল-এর সম্পর্ক আছে। এখন কী তিনি সেদিকেই কথা বলবেন? নিজের কানকে পুরোপুরি খাড়া করল লিসা। দেখা যাক আলোচনা ওকে কোথায় নিয়ে যায়।

পিছনে ফিরি চলুন, অ্যানা বললেন। একদম প্রথম কোষেরও আগে। ডারউইনের মতবাদ মনে রাখুন : সাধারণ থেকে জন্ম নেয়া জন্মানো সবকিছু একটু জটিল হয়ে থাকে। তাহলে এককোষীর আগে কী ছিল? প্রাণের কত অতীত পর্যন্ত যাওয়ার পরও আমরা তাকে প্রাণ বলে ডাকব? ডিএনএ কী জীবিত? জিন জীবিত? প্রোটিন আর এনজাইমের-ই বা কী অবস্থা? প্রাণ আর রসায়নের মধ্যেকার সীমারেখাটা কোথায়?

তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্নটা বেশি জটিল হয়ে গেছে, লিসা স্বীকার করল।

 তাহলে আরেকটা প্রশ্ন করছি।

এই প্রশ্নের উত্তর লিসা জানে। আদিকালে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পুরোটা হাইড্রোজেন, মিথেন আর পানিতে ভরা ছিল। এগুলোর সাথে একটু শক্তি, ধরা যাক বজ্রপাত। তো একটু শক্তি যোগ হলে এই গ্যাসগুলো সাধারণ দেহযন্ত্রে পরিণত হতে পারে। তারপর এগুলো থেকে অণুর জন্ম হয়েছিল।

আর সেটা ল্যাবে প্রমাণিতও হয়েছে, সহমত পোষণ করলেন অ্যানা। এক বোতল ভর্তি মৌল গ্যাস থেকে অর্ধ তরল মিশ্রণের অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। প্রোটিনের ব্লক তৈরি করে ওগুলো।

এবং প্রাণের শুরু হয়।

আহা, আপনার বেশ তাড়া আছে বলে মনে হচ্ছে। সবকিছু ডিঙিয়ে একদম প্রাণে লাফ দিচ্ছেন! অ্যানা খোঁচা মারলেন। মাত্র অ্যামিনো অ্যাসিড আর ব্লক তৈরি হলো। সামান্য অ্যামিনো অ্যাসিড় থেকে আমরা কীভাবে প্রোটিনে পৌঁছুব?

যথেষ্ট পরিমাণ অ্যামিনো অ্যাসিডের মিশ্রণ থেকে ধীরে ধীরে হয়ে যাবে।

এলোমেলোভাবে?

মাথা নাড়ল লিসা।

ড. কামিংস, এতক্ষণে আমরা সমস্যার গোড়ায় আসতে পেরেছি। আমি হয়তো আপনার সাথে একমত যে, নিজেই নিজের কপি তৈরি করতে সক্ষম প্রোটিন প্রথমবার তৈরি হওয়ার পর থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ যা বলেছে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কী জানেন প্রথমবার প্রোটিন তৈরি হতে কী পরিমাণ অ্যামিনো অ্যাসিড প্রয়োজন?

না।

কমপক্ষে ৩২ অ্যামিনো অ্যাসিড। তার ফলে একদম সবচেয়ে ছোট্ট প্রোটিন তৈরি হবে। আর সেই ছোট্ট প্রোটিনটা নিজেই নিজের কপি করার ক্ষমতা রাখে। এলোমেলোভাবে এই প্রোটিনের জন্ম হয়েছে–সেটার সম্ভাবনা অনেক ক্ষীণ। গাণিতিকভাবে বলতে গেলে : টেন টু দ্য পাওয়ার ফোরটি-ওয়ান।

সংখ্যার পরিমাণ শুনে শ্রাগ করল লিসা। এই মহিলার প্রতি ওর রাগ থাকলেও এখন ধীরে ধীরে শ্রদ্ধাবোধও জেগে উঠছে।

যদি পৃথিবীর সকল বৃষ্টিপ্রধান জঙ্গলকে অ্যামিনো অ্যাসিডের স্যুপে রূপান্তরিত করা হয়, তারপরও ৩২ অ্যামিনো অ্যাসিড চেইন পূরণ হতে আরও অনেক বাকি থাকবে। অনেক বলতে, ব্যাপক। জঙ্গল থেকে পাওয়া অ্যামিনো অ্যাসিডের চেয়ে আর ৫ হাজার গুণ বেশি অ্যাসিড প্রয়োজন পড়বে। তাহলে বলুন, অর্ধ মিশ্রণযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে কীভাবে প্রথমবার প্রোটিন তৈরি হয়েছিল? প্রাণের প্রথম সঞ্চার হয়েছিল কীভাবে?

লিসা মাথা নাড়ল।

লিসাকে আটকে দিতে পেরে সন্তুষ্ট হয়ে অ্যানা নিজের দুই হাত আড়াআড়ি করে রাখলেন। বিবর্তনবাদের এখানে একটা ফাঁক আছে। ডারউইন এখানে লাফ মেরেছেন।

 কিন্তু, লিসা হার মানতে নারাজ, এই ফাঁকা অংশ পূরণ করার জন্য ঈশ্বরের হাতকে টেনে এনে সেটাকে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেয়া চলবে না। সেই ফাঁকটুকু পূরণ করার জন্য আমরা এখনও যথাযথ উত্তর খুঁজে পাইনি। তারমানে এই না যে, ওখানে অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার আছে।

 আমি অলৌকিকতা নিয়ে কিছু বলছি না। আর আপনাকে কে বলল, সেই ফাঁক পূরণ করার জন্য আমার কাছে যথাযথ উত্তর নেই?

তার দিকে তাকাল লিসা। কী উত্তর?

 বেল-কে নিয়ে গবেষণা করে আমরা গত কয়েক দশক আগেই কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। সেই জিনিসটা নিয়ে আজকের গবেষকরা মাত্র একটু নাড়াচাড়া শুরু করেছে।

সেটা কী? সোজা হয়ে বসল লিসা। বেল সম্পর্কে ওর অদম্য কৌতূহল লুকোনোর আর কোনো চেষ্টা করল না।

আমরা ওটার নাম দিয়েছি : কোয়ান্টাম বিবর্তন।

লিসা ইতিহাসে পড়েছে, বেল ও নাৎসিরা মিলে অদ্ভুত জিনিসপত্র নিয়ে গবেষণা করছিল। পরমাণুর অতিক্ষুদ্র কণা ও কোয়ান্টাম ফিজিক্স ছিল তাদের গবেষণাক্ষেত্র। এদের সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক আছে?

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে সমর্থন দেয়ার জন্য এই কোয়ান্টাম বিবর্তন শুধু নতুন ক্ষেত্ৰই তৈরি করেনি, সেইসাথে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের ডিজাইনারকে সেটারও উত্তর দিয়েছে।

আপনি মজা করছেন। ডিজাইনার কে? ঈশ্বর?

নাহ। লিসার চোখের দিকে তাকালেন অ্যানা। আমরা।

অ্যানা বিস্তারিত কিছু ব্যাখ্যা করার আগেই পুরাতন রেডিও থেকে আওয়াজ ভেসে এলো। গানথার বলছে, স্যাবোটাজকারীর হদিস পেয়েছি। আমরা কাজে নামার জন্য তৈরি।

.

সকাল ৭টা ৩৭ মিনিট।
বারেন, জার্মানি।

পুরোনা ফার্ম ট্রাকের পাশ দিয়ে বিএমডব্লিউকে এগিয়ে নিল গ্রে। ট্রাকে খড় বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ৫ নম্বর গিয়ারে নামল ও, সামনে বাঁক। অবশ্য এটাই শেষ বাঁক। পাহাড়ের উপরের দিকে ওঠার পর ও এখন সামনের উপতক্যার বিস্তৃত দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে।

 আলমি ভ্যালি, বলল মনক। গ্রের পাশে বসে আছে ও। হাত দিয়ে শক্ত করে দরজার পাশে থাকা হাতল ধরে রেখেছে।

গিয়ার নামিয়ে গতি কমাল গ্রে।

মনক ওর দিকে তাকাল। র‍্যাচেল তোমাকে বেশ ভালভাবেই ইটালিয়ান স্টাইলে ড্রাইভিং শিখিয়েছে দেখছি।

রোমে যখন..

আমরা এখন রোমে নই।

তা তো ঠিক। ওরা এখন রোমে নয়। আরও খাড়াইতে ওঠার পর ওদের সামনে উপতক্যার একটি চওড়া নদী, সবুজ তৃণভূমি, জঙ্গল আর টিলার মাঠ উদয় হলো। ছবির মতো সুন্দর মফস্বল দেখা গেল উপত্যকার ওদিকে। লাল টাইলসঅলা ছাদ আর পাথুরে ঘরগুলোর পাশ দিয়ে সরু, বাঁকা রাস্তা চলে গেছে।

তবে ওদের সবার চোখ আটকে গেল দূরে অবস্থিত একটি বিশাল ক্যাসলে। জঙ্গলের ভেতরে ওটা, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু টাওয়ার, পতাকা শোভা পাচ্ছে ওখানে। রিহনি নদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য দুর্গের মতো এই ক্যাসলকেও কেমন যেন রূপকথার কোনো প্রাসাদের মতো মনে হয়। মোহিনী শক্তির রাজকুমারী আর সাদা ঘোড়ার ওপর চড়া বীর যেন আস্তানা গেড়েছে ওখানে।

যদি ড্রাকুলা সমকামী হয়ে থাকে, বলল মনক, তাহলে ওই ক্যাসল তার-ই হবে।

মনক কথাটি বলে কী বুঝাতে চেয়েছে সেটা গ্রে জানে। ওই জায়গাকে কেমন যেন অশুভ বলে মনে হচ্ছে। তবে সেটা উত্তর দিকের নিচু আকাশের জন্যও মনে হতে পারে। ঝড় আসার আগে ওরা এখন নিচের গ্রামে পৌঁছে যেতে পারলে তবেই রক্ষা।

এবার? গ্রে প্রশ্ন করল।

আওয়াজ শোনা গেল পেছনের সিট থেকে। ফিওনা ম্যাপ চেক করছে। মনকের কাছ থেকে ওটা বাজেয়াপ্ত করে নিজেই দিকনিদের্শনার দায়িত্ব পালন করছে ও। কোন জায়গায় যাওয়া হচ্ছে সে-ব্যাপারে ও এখনও আগেভাগে মুখ খুলতে নারাজ।

সামনে ঝুঁকে নদীর দিকে ইশারা করল ও। ব্রিজ পার হতে হবে।

 তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। ম্যাপ কীভাবে পড়তে হয় তা আমার জানা আছে। বাইসাইকেল আরোহীদের একটি লম্বা লাইনকে পাশ কাটিয়ে উপত্যকার নিচের দিকে রওনা হলো গ্রে। বিএমডব্লিউ নিয়ে গ্রামের প্রান্তদেশে পৌঁছে গেল।

 এ যেন আরও একশ বছর পেছনের এলাকা। সব জানালার পাশে থাকা বাক্সে টিউলিপ ফুল ফুটে আছে। চাঁদোয়ারি দেয়া আছে প্রত্যেকটি উঁচু ছাদে। মূল সড়ক থেকে পাথর বিছানো রাস্তা চলে গেছে ভেতরে। বাইরে থাকা ক্যাফে, বিয়ার বাগান আর কেন্দ্রীয় ব্যান্ডস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে চলে গেছে ওগুলো। গ্রে নিশ্চিত এই ব্যান্ডস্ট্যান্ডে প্রতিরাতে একটি পলকা ব্যান্ড বাজানো হয়।

ব্রিজ পার হওয়ার পর দেখা গেল ওরা খামার সংলগ্ন বাড়ি আর তৃণভূমির পাশে চলে এসেছে।

বাম দিকে যাও! চিৎকার করল ফিওনা।

কষে ব্রেক দিল গ্রে। বিএমডব্লিউটাকে তীক্ষ্ণভাবে ঘোরাল। এরপর থেকে একটু আগেভাগে বলবে।

রাস্তা সরু হয়ে গেছে এখানে। মসৃণ রাস্তা এখন পাপুরে রাস্তায় পরিণত হয়েছে। এগিয়ে চলল বিএমডব্লিউ। সামনে একটি লোহার গেইট উদয় হলো। খোলা রয়েছে।

গাড়ির গতি কমাল গ্রে। আমরা কোথায়?

জায়গামতো চলে এসেছি, ফিওনা জবাব দিল। দ্য হিরজফিল্ড এস্টেট। ডারউইন বাইবেল এখান থেকেই এসেছিল।

গেইট দিয়ে বিএমডব্লিউকে প্রবেশ করাল ঘে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে গুঁড়িগুড়ি দিয়ে শুরু… তারপর একদম ঝুম বৃষ্টি।

 অল্পের জন্য রক্ষা, বৃষ্টি দেখে মনক মন্তব্য করল।

গেইটের পর চওড়া খোলা জায়গা দেখা গেল। ওখানে দুটো অংশে কটেজ ভাগ করা রয়েছে। মূল ভবন একদম নাক বরাবর সামনে অবস্থিত। মাত্র দুই তলা বিশিষ্ট। তবে ছাদে থাকা স্লেট টাইলগুলো ভবনটিকে একটু রাজকীয়ভাব এনে দিয়েছে।

মাথার ওপরে বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল।

একটু আগে ওরা যে ক্যাসল দেখেছিল সেটা এস্টেটের ওপর দিয়ে পেছনে দেখা যাচ্ছে এখন। দেখে মনে হচ্ছে ওটা যেন কটেজের ওপর আবছাভাবে আবির্ভূত হয়েছে।

ওই! হাঁক ছাড়ল একজন।

গ্রে তাকাল।

বৃষ্টির ভেতরে এক সাইকেল চালক ছুটতে ছুটতে আর একটু হলেই গাড়ির নিচে এসে পড়তো। সাইকেল আরোহী বয়সে তরুণ, পরনে হলুদ জার্সি আর বাইকার শর্টস। বিএমডব্লিউ-এর হুডে চাপড় মারল সে।

বন্ধুরা যাচ্ছ কোথায়? গ্রের দিকে তাকিয়ে বলল।

ফিওনা ইতোমধ্যে পপছনে জানালা নামিয়ে ফেলেছে। বাইরে মাথা বের করে বলল, ভাগো শালা! এতটুকু প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেদিকে নজর দাও! বেহায়া কোথাকার!

মাথা নাড়ল মনক। মনে হচ্ছে, ফিওনা সামনে একটা ডেটিং পাবে।

তরুণকে এড়িয়ে মূল ভবনের কাছে গাড়ি নিয়ে এলো গ্রে। এখানে গাড়ি আছে মাত্র একটা। কিন্তু গ্রে খেয়াল করে দেখল, এখানে অনেক মাউন্টেইন আর রেসিং বাইক আছে। এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে নামিয়ে রেখেছে ব্যাকপ্যাকগুলো। ইঞ্জিন বন্ধ করার পর ওদের কথাবার্তা কানে এলো গ্রের। স্প্যানিশ। এটা তাহলে হোস্টেল। অন্তত এখন তো তা ই মনে হচ্ছে।

ঠিক জায়গায় এসেছে তো ওরা?

যদি ঠিক জায়গায় এসেও থাকে তারপরও কাজের কাজ হবে কি-না সেটা নিয়ে গ্রের সন্দেহ আছে। কিন্তু এতদূর যখন চলেই এসেছে…

থাকো এখানে, বলল ও। মনক, তুমি ফিওনার সাথে…

গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ফিওনা বের হলো।

পরের বার থেকে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল মনক, যে গাড়িতে বাচ্চাদের জন্য লক সিস্টেম থাকে সেটা নিয়ো।

আসো। ফিওনার পেছন পেছন এগোল গ্রে।

কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে মূল ভবনের সামনের দরজার দিকে বড় বড় পা ফেলে ফিওনা এগোচ্ছে।

এগিয়ে গিয়ে ওর কনুই ধরল গ্রে।

আমরা একসাথে থাকব। কোনো দৌড়াদৌড়ি চলবে না।

ফিওনা ওর দিকে ঘুরল। গ্রের মতো সে-ও রেগে আছে। একদম ঠিক! আমরা। একসাথে থাকব। কোনো দৌড়াদৌড়ি চলবে না। তার মানে আমাকে প্লেন কিংবা গাড়ির ভেতরে রেখে চলে যাওয়াও যাবে না। কনুই ছাড়িয়ে দরজা ঠেলল ও।

এক ঘণ্টা বেজে উঠে ওদের আগমনের জানান দিল।

মেহগনি কাঠের রিসিপশন ডেস্ক থেকে চোখ মেলল ক্লার্ক। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলে ঠাণ্ডা দূর করার চেষ্টা করছে। হলরুম কড়ি কাঠে সাজানো এবং স্লেট টালি দেয়া। নির্বাক ছবি ঝুলছে দেয়ালে। একশ বছরেরও পুরোনো হবে ওগুলো। জায়গা পুরোনো হলেও দেখে মনে হচ্ছে এই ভবন কখনও মেরামত করা হয়নি। প্লাস্টারের বেহাল দশা, তক্তায় ধুলো-বালি, মেঝের করুণ অবস্থা সেটাই জানান দিচ্ছে। যৌবনকাল পেরিয়ে বার্ধক্যে পৌঁছেছে ভবন।

ক্লার্ক ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। স্বাস্থ্যবান শরীরে রাগবি শার্ট আর সবুজ ঢোলা ট্রাউজার পরে আছে সে। বয়স বিশের আশেপাশে। কলেজের নতুন ছাত্রের মতো লাগছে তাকে।

Guten morgen, গ্রে কাউন্টারের দিকে এগোতেই স্বাগতম জানাল সে।

বজ্রপাতে গর্জন শুনতে শুনতে পুরো হল রুমে চোখ বুলাল মনক। আজ সকালের কোনো কিছুই ভাল নয়। ও বিড়বিড় করল।

ও, আচ্ছা। আমেরিকান, বলল ক্লার্ক। মনকের বিড়বিড়ানি শুনতে পেয়েছে।

গলা পরিষ্কার করল গ্রে। এটা কী হিরজফিল্ড এস্টেট

ক্লার্কের চোখ একটু বড় হলো। Ja, aber… আমরা এখানে বিগত ২০ বছর যাবত BurgschloB হোস্টেল চালাচ্ছি। উত্তরাধিকারসূত্রে আমার বাবা জহান হিরজফিল্ড এই জায়গা পাওয়ার পর থেকে এই হোস্টেল চলছে।

তাহলে ওরা ঠিক জায়গাতেই এসেছে। ফিওনার দিকে তাকাল গ্রে। ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে কী চাই? দৃষ্টি নিয়ে তাকাল ফিওনা। ব্যাকপ্যাকের ভেতরে কী যেন খুঁজছে। গ্রে মনে মনে প্রার্থনা করল, মনকের কথাই যেন সত্যি হয়, এই ব্যাগে যেন কোনো বোম না থাকে।

 ক্লার্কের দিকে ফিরল গ্রে। যদি আপনার বাবার সাথে কথা বলা সম্ভব হতো…

কারণ…? ক্লার্কের কণ্ঠে একটু দুশ্চিন্তার রেশ।

গ্রেকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজের জায়গা করে নিল ফিওনা। কারণ : এটা। রিসিপশন কাউন্টারের ওপর একটি পরিচিত বই রাখল ও। ডারউইন বাইবেল।

ওরে খোদা!… গ্রে বাইবেলটাকে জেট প্লেনে লুকিয়ে রেখে এসেছিল।

 লুকিয়ে রাখাটা যথাযথ হয়নি। প্রমাণিত।

ফিওনা, সতর্ককরার সুরে বলল গ্রে।

এটা আমার, চট করে জবাব দিল ও।

বইটি তুলে নিয়ে ক্লার্ক পৃষ্ঠা ওল্টাল। এই বই সে চিনতে পারেনি। বাইবেল? এই হোস্টেলে আমরা ধর্মান্তরিত করণকে অনুমিত দিই না। বই বন্ধ করে ফিওনাকে ফিরিয়ে দিল সে। তাছাড়া, আমার বাবা ইহুদি।

ভণিতা বাদ দিয়ে সরাসরি মূল প্রসঙ্গে গেল গ্রে। এটা চার্লস ডারউইনের বাইবেল। আমরা মনে করি, এটা এক সময় আপনাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে ছিল। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদি আপনার বাবার সাথে বিস্তারিত কথা বলতে পারতাম…

বাইবেলের দিকে আগের চেয়ে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাল ক্লার্ক। আমার বাবা এখানে ওঠার আগেই লাইব্রেরি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে বলল সে। আমি কখনও লাইব্রেরি দেখতে যাইনি। তবে প্রতিবেশীদের মুখ থেকে শুনেছি ১০০ বছর ধরে ওটা ছিল।

রিসিপশন ডেস্ক থেকে বেরিয়ে ফায়ারপ্লেস পার হয়ে পাশে থাকা ছোট্ট হলের দরজা খুলে সেদিকে ওদের নিয়ে চলল ক্লার্ক। হলের একপাশের দেয়ালে সারি সারি লম্বা জানালা রুমকে কেমন যেন নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। দেয়ালের অন্যপাশে আরেকটি ফায়ারপ্লেস থাকলেও ওটা এখন ঠাণ্ডা। ফায়ারপ্লেসটা বেশ বড়সড়। এই রুমে সারি সারি টেবিল, বেঞ্চ আছে। মেঝে মোছর কাজ করছে এক বয়স্কা মহিলা… সে ছাড়া এই রুমে আর কেউ নেই, খালি।

 এটা আগে আমাদের পরিবারের লাইব্রেরি ও স্টাডিরুম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে এখন হোস্টেলের ডাইনিং হল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এস্টেট বিক্রি করার প্রতি মত ছিল না বাবার, কিন্তু ওদিকে বেশ মোটা অংকের ট্যাক্স দিতে হয়। হয়তো সেজন্য ৫০ বছর আগেই লাইব্রেরি বিক্রি করা হয়েছে। অরজিন্যাল আসবাবপত্রগুলোর অধিকাংশকে বাবা নিলামে তুলেছিলেন। প্রতি প্রজন্মে ইতিহাস একটু একটু করে বিলুপ্ত হয়েছে।

লজ্জাজনক। বলল গ্রে।

মাথা নেড়ে ক্লার্ক অন্যদিকে ঘুরল। বাবাকে বলে দেখি, আপনাদের সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারি কি-না।

কিছুক্ষণ পর ওদেরকে একজোড়া চওড়া দরজা পেরিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল সে। এই দরজা দিয়ে এস্টেটের ব্যক্তিগত অংশে যাওয়া যায়।

ওদেরকে এস্টেটের পেছন দিকে নিয়ে কনজারভেটরি (গাছ রাখার জন্য কাঁচ আর ব্রোঞ্জের তৈরি উদ্যান) পেরোতে পেরোতে নিজেকে রায়ান হিরজফিল্ড বলে পরিচয় দিলো সে। বিভিন্ন রকম গাছ আছে এখানে। তবে কতগুলোকে দেখে আগাছা বলে মনে হলো। জায়গাটায় কেমন যেন পুরোনো ও অগোছালো একটা ভাব আছে।

সানরুমে সূর্যের কোনো দেখা নেই। কনজারভেটরির মাঝখানে পলকা স্বাস্থ্যের একজন ব্যক্তি হুইলচেয়ারে বসে আছেন। তার কোলের ওপরে একটি কম্বল রাখা আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়া দেখছেন।

 তার দিকে এগোল রায়ান, খুব সংকোচবোধ করছে। Vater. Hier sind die Leute mit der Bibel.

 Auf Englisch, Ryan… auf Englisch. হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে ওদের মুখোমুখি হলেন তিনি। তাঁর চামড়া কাগজের মতো পাতলা বলে মনে হলো। শনশনে কণ্ঠস্বর। ফুসফুসের রোগে ভুগছেন বোধহয়, ভাবল গ্রে।

 আমি জহান হিরজফিল, বললেন বৃদ্ধ। আপনারা তাহলে পুরোনো লাইব্রেরি নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। ইদানীং ওটা নিয়ে বেশ কৌতূহল জাগছে কেন বুঝলাম না। কয়েক দশক কোনো খবরই ছিল না, অথচ এবছরে ২ বার খোঁজ পড়ল।

 ফিওনার বলা সেই রহস্যময় ব্যক্তির কথা মনে করল গ্রে। গ্রিট্রির বুকশপে গিয়ে ফাইলপত্র চেক করেছিল সেই ব্যক্তি। বিলের কাগজ দেখে সে-ও নিশ্চয়ই এখানে হাজির হয়েছিল।

রায়ান বলল আপনাদের কাছে নাকি লাইব্রেরির একটা বই আছে।

 ডারউইন বাইবেল। বলল গ্রে।

বৃদ্ধ লোকটি সামনে হাত বাড়িয়ে দিতেই ফিওনা সামনে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে বাইবেল দিলো। ওটাকে কোলের ওপর রাখলেন তিনি। ছোটবেলার পর এটাকে আর দেখিনি। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, রায়ান, তুমি ডেস্কে গিয়ে বসো।

 মাথা নেড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েক পা পিছাল রায়ান, তারপর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

 ছেলে কনজারভেটরির দরজা বন্ধ করে দেয়ার আগপর্যন্ত জহান অপেক্ষা করলেন। তারপর বাইবেলের দিকে নজর দিলেন তিনি। বাইবেলের সামনের কভার খুলে চোখ বুলালেন ডারউইন-এর বংশতালিকায়। আমার পরিবার যেসব বইকে খুব যত্ন করে আগলে রেখেছিল তার মধ্যে এটা একটা। ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটি থেকে আমার পরদাদাকে (দাদার বাবা) ১৯০১ সালে এই বাইবেল উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। সেই যুগের স্বনামধন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন তিনি।

গ্রে বৃদ্ধের কণ্ঠে বিষাদের সুর শুনতে পেল।

বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করাটা আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ডারউইন-এর মতো বড় কিছু না করলেও আমাদেরও কিছু অর্জন আছে। তবে সেগুলো অনেক আগের কথা। এখন আমাদের পরিচয় হলো : হোস্টেল চালিয়ে চলি; এই পর্যন্তই।

 আচ্ছা, বাইবেলের ব্যাপারে আমাকে কিছু জানাতে পারেন? বলল গ্রে। লাইব্রেরি কী সবসময় এখানেই থাকতো?

 বাইরে গবেষণার জন্য পরিবার থেকে যখন কেউ যেতো তখন কেউ কেউ এখান থেকে কিছু বই সাথে করে নিয়ে গেছে। একমাত্র এই বইটাই ফিরে এসেছিল। আমার দাদা মেইল করে পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য কারণও ছিল।

কী সেটা?

আমি জানতাম আপনি হয়তো প্রশ্নটা করবেন তাই রায়ানকে বের করে দিলাম। ওর এসব না জানাই ভাল।

আচ্ছা।

আমার দাদা হিউগো, তিনি নাৎসিদের হয়ে কাজ করতেন। তার মেয়ে অর্থাৎ আমার ফুফু টোলাও করতেন। এরা দুইজন একদম মানিকজোড় ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনদের কানাঘুষা করতে শুনেছি, কোনো একটা গোপন রিসার্চ প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিল ওরা। দুজনই নামকরা জীববিজ্ঞানী ছিল।

কীরকম রিসার্চ? এবার মনক প্রশ্ন করল।

 তা কেউ জানে না। যুদ্ধের শেষের দিকে আমার দাদা আর ফুফু মারা যান। কিন্তু তার একমাস আগে আমার দাদার পাঠানো একটা বাক্স আসে এখানে। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে বইয়ের একাংশ সেটায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। হয়তো উনি বুঝেছিলেন সামনে ওনার অবস্থা ভাল নয়, তাই বইগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন বোধহয়। মোটমাট ৫টা বই। বাইবেলে টোকা দিয়ে বললেন, এটা সেই ৫ বইয়ের একটা। এই বাইবেলটাকে কী ভেবে রিসার্চ করার জন্য নিয়েছিলেন সেটা আজ পর্যন্তও কেউ আমাকে জানাতে পারল না।

হয়তো বাড়ির স্মৃতি হিসেবে নিয়েছিলেন, নরম স্বরে বলল ফিওনা।

এতক্ষণে বোধহয় ফিওনাকে দেখতে পেলেন জহান। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন তিনি। হয়তো। এমনও হতে পারে, এটা তিনি তার বাবার স্মৃতি হিসেবে রেখেছিলেন। তবে নাৎসির হয়ে কাজ করা ভয়াবহ ব্যাপার।

 রায়ানের বলা একটি কথা মনে পড়ল গ্রের। কিন্তু আপনারা তো ইহুদি, তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, আমার পরদাদী অর্থাৎ হিউগোর মা ছিলেন জার্মান। গোড়া জার্মান যাকে বলে। নাৎসিদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য সেটা একটা মাধ্যম। এমনকী হিটলার যখন লুঠপাট শুরু করেছিল আমাদেরকে ছাড় দেয়া হয়েছিল তখন। আমাদেরকে Mischlinge নামে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। মিক্সড ব্লাড়। শংকর জাত। মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বেঁচে গেলেও বিশ্বস্ততার পরীক্ষা দিয়ে তবেই দাদা ও ফুফু নাৎসিদের সাথে যোগ দিতে পেরেছিলেন। বিজ্ঞানীদের গরু খোঁজার মতো খুঁজে খুঁজে নিজেদের দলে ঢুকিয়েছিল নাৎসিরা।

তারমানে জোর করে। গ্রে বলল।

বাইরের ঝড়ের দিকে তাকালেন বৃদ্ধ। সময়টা কঠিন ছিল। আমার দাদা কিছু অদ্ভুত জিনিসে বিশ্বাস করতেন।

যেমন?

জহানকে দেখে মনে হলো তিনি প্রশ্নটা শুনতে পাননি। বাইবেল খুলে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। বাইবেলে থাকা হাতে আঁকা ছবিগুলো দেখিয়ে দিল ও।

ҮХУКУТ Күн

এগুলো আসলে কী বুঝতে পারছি না। বলল গ্রে।

ঠুলি সোসাইটির কথা জানেন? উত্তর না দিয়ে বৃদ্ধ পাল্টা প্রশ্ন করলেন।

গ্রে মাথা নাড়ল। জানে না।

তারা ছিলেন একদম গোড়া জার্মান সংঘ। আমার দাদা ২২ বছর বয়সে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। তার মা ও পরিবারের বিভিন্ন সদ্যস সংঘটির সাথে শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। Ubermenschদর্শনে বিশ্বাস করতেন তারা।

Ubermensch, সুপারম্যান।

হ্যাঁ। ঠুলি নামের এক পৌরাণিক জায়গার নামানুসারে সোসাইটির নামকরণ করা হয়েছিল। আটলান্টাস সাম্রাজ্যের কোনো এক জায়গা হবে হয়তো। সেখানে নাকি সেরা জাতের মানুষ ছিল।

নাক দিয়ে আপত্তিসূচক ঘোত শব্দ করল মনক।

আগে বলেছি, আমার দাদার কিছু অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল। তবে সেসময় শুধু তিনিই এমন ছিলেন তা নয়। তার আশেপাশের অনেকেই এরকম ছিল। প্রচলিত ছিল, রোমান আর জার্মানির মধ্যে থাকা সীমনায় নাকি জার্মানিক টিউটন গোত্রের মানুষরা জার্মানকে রক্ষা করার জন্য জঙ্গলে পাহারা দেয়। ঠুলি সোসাইটির লোকজন মনে করতেন, এই টিউটন যোদ্ধারা হলো সেই সেরা জাতের মানুষদের বংশধর।

মিথ বা পৌরাণিক গল্পের প্রভাব যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, টের পেল গ্রে। যদি জার্মানের সেই সময়কার সুপারম্যান হতে পারে তাহলে তাদের উত্তরসূরি এই সময়কার জার্মানদের জিনেও সেই সুপারম্যান আছে? আর্য জাতিদের নিয়ে দর্শনের শুরু এখানেই।

তাদের সেই বিশ্বাসের সাথে মিথ আর অতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপার মিশে গিয়েছিল। আমার অবশ্য এসব কখনও মাথায় ধরেনি। তবে আমার পরিবার সূত্রে জেনেছি, দাদা ভিন্ন রকমের মানুষ ছিলেন। সবসময় অদ্ভুত জিনিসের সন্ধানে থাকতেন, ঘাটাঘাটি করতেন ঐতিহাসিক রহস্য নিয়ে। এমনকি অবসর সময়েও নিজের মনকে বিশ্রাম দিতেন না। বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করা আর জিগস পাজল নিয়ে পড়ে থাকতেন। এভাবে এক সময় তিনি অতিপ্রাকৃত গল্পের খোঁজ পান ও পরবর্তীতে সেগুলোর পেছনে থাকা সত্যতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন ওগুলো নিয়ে।

বলতে বলতে বাইবেলের দিকে নজর দিলেন বৃদ্ধ। পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে একদম শেষে গিয়ে পেছনের কভারের ভেতরের অংশ পরীক্ষা করে দেখলেন। আশ্চর্য!

গ্রে কাছে এগিয়ে এসে বৃদ্ধের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল।

কী?

বইয়ের ভেতরের কভারে একটি হাড্ডিসার আঙুল চালালেন তিনি। একবার সামনের কভার দেখে আমার পেছনে চলে গেলেন। ডারউইন বংশতালিকা শুধু বইয়ের রুর অংশে ছিল না… বইয়ের শেষের অংশেও ছিল। আমি তখন নিতান্তই ছেলেমানুষ, তবুও এটা আমার বেশ ভালভাবে মনে আছে।

বাইবেল মেলে ধরলেন জহান। বইয়ের পেছনের অংশে থাকা বংশতালিকা নেই!

দেখি। বই হাতে নিয়ে পেছনের কভার আরও ভাল করে পরীক্ষা করল গ্রে। ফিওনা ও মনকও যোগ দিল। গ্রে বইয়ের বাইন্ডিং অংশে হাত বুলাল।

 এখানে দেখ, বলল গ্রে। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বাইবেলের পেছনে থাকা ফাঁকা পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে নিয়ে পেছনের কভারে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। ফিওনার দিকে তাকাল ও। গ্রিট্টি করেছিলেন নাকি?

অসম্ভব। তারচে বরং নানু মোনালিসা ছিঁড়ে ফেলবে!

আচ্ছা, যদি গ্রিট্টি না করে থাকেন তাহলে…

জহানের দিকে তাকাল গ্রে।

আমি নিশ্চিত, আমার পরিবারের কেউ এই কাজ করেনি। যুদ্ধের কয়েক বছর পরেই লাইব্রেরি বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। এখানে এটাকে মেইল করে ফিরিয়ে দেয়ার পর কেউ ছুঁয়ে দেখেছে কি-না সন্দেহ।

তাহলে বাকি রইল হিউগো হিরজফিল্ড।

ছুরি, বলল গ্রে।

 নিজের প্যাক থেকে সুইস আর্মি নাইফ বের করে মনক গ্রের দিকে এগিয়ে দিল। ছুরি ব্যবহার করে বাইবেলের পেছনের আঠা লাগানো পৃষ্ঠা খুলে ফেলল গ্রে। অল্প করে আঠা লাগানো থাকায় কাজটা করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।

হুইল চেয়ার ঠেলে ওদের সাথে যোগ দিলেন জহান। নিজের হাতের ওপর ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে তাকালেন তিনি। টেবিলের ওপর গ্রে কাজ করছে। গ্রে অবশ্য ওর কাজ কোনোর কোনো চেষ্টা করছে না। কারণ–কাগজ কেটে সরানোর পর যা-ই বের হোক না কেন সেটার ব্যাপারে জাহানের সাহায্য লাগতে পারে।

 কালো কাগজ সরিয়ে গ্রে কভারের মূল পেস্টবোর্ড উন্মুক্ত করল। এখানে ডারউইন বংশতালিকা পরিষ্কারভাবে লেখা ছিল। জহান ঠিকই বলেছিলেন।

ভয়াবহ, বললেন জহান। দাদা এটা করতে যাবেন কেন? বাইবেলের এই হাল করে কী লাভ? পৃষ্ঠায় থাকা বংশতালিকার ওপর কালো কালি ছড়িয়ে একটি অদ্ভুত প্রতীক আঁকা হয়েছে।

প্রতীকের নিচে সেই একই কালিতে কছু লেখাও রয়েছে জার্মান ভাষায়।

Gott, verzeihen mir. অনুবাদ করল গ্রে।

 ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা করো।

প্রতীকের দিকে নির্দেশ করে প্রশ্ন করল মনক। এটা কীসের চিহ্ন?

একটা প্রাচীন বর্ণ। হাতের ওপর চাপ কমিয়ে হুইল চেয়ারের সিটে বসলেন তিনি। আমার দাদার পাগলামো।

গ্রে তার দিকে ফিরল।

প্রাচীন বর্ণের জাদুতে বিশ্বাস করত ঠুলি সোসাইটি। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান প্রতীকগুলোর সাথে আদিম শক্তির সম্পর্ক আছে। যেহেতু নাসিরা ঠুলি সোসাইটির সুপারম্যান দর্শনকে বুকে ধারণ করেছিল, তাই এই বর্ণ সংক্রান্ত মিথেও আস্থা ছিল তাদের।

নাৎসিদের প্রতীক আর প্রাচীন বর্ণের সাথে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে গ্রের ধারণা আছে। কিন্তু সেগুলোর সাথে এখানকার কী সম্পর্ক?

এই চিহ্নের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানেন? প্রশ্ন করল গ্রে।

না। যুদ্ধের পর কোনো জার্মান ইহুদি এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। চেয়ার ঘুরিয়ে আবার ঝড় দেখায় মনোযোগ দিলেন তিনি। দূরে বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে… ধীরে ধীরে শব্দটা এগিয়ে আসছে এদিকে। তবে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে, এরকম একজনকে আমি চিনি। ওখানকার জাদুঘরের কিউরেটর।

বাইবেল বন্ধ করে জাহানের কাছে এগিয়ে গেল গ্রে। কীসের জাদুঘর?

বিদ্যুতের আলোক ঝলকানিতে কনজারভেটরি জ্বলে উঠল। ওপরের দিকে দেখালেন জহান। তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে বজ্রপাত আর বৃষ্টির ভেতর দিয়ে গ্রে দেখতে পেল সেটাকে। সেই ক্যাসল।

Historisches Museum des Hochstifts Paderborn, ক্যাসলের ভেতরে ওটা। আজকে খোলা আছে। এই চিহ্নের অর্থ সে অবশ্যই জানে।

কীভাবে?

জহান গ্রের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন ও একটা নির্বোধ। তাছাড়া আর কে জানবে? ওটা হলো উইউইলসবার্গ ক্যাসল গ্রে কিছু বলছে না দেখে আবার বলতে শুরু করলেন জহান। হিমল্যারের আস্তানা। নাৎসি এসএস-এর দুর্গ।

ড্রাকুলার দুর্গ, মনক বিড়বিড় করল।

জহান বলে যাচ্ছেন, সতেরশ শতাব্দীতে ডাইনি মারার একটা হুজুগ লেগেছিল। হাজার হাজার মহিলাকে নির্যাতন করে মারা হয়েছিল তখন। হিমল্যার স্রেফ সেটাকে আরও রক্তে রঞ্জিত করেছেন। ক্যাসল নির্মাণের জন্যে ক্যাম্প থেকে আনা ইহুদিদের মধ্যে ১২শ ইহুদি মারা গিয়েছিল তখন অভিশপ্ত জায়গা ওটা। ভেঙে ফেলা দরকার।

 কিন্তু ওখানে থাকা জাদুঘর…, বৃদ্ধের রাগ থেকে প্রসঙ্গ সরিয়ে নিল গ্রে। ওখানকার লোকজন প্রাচীন চিহ্ন সম্পর্কে জানে?

জহান মাথা নাড়লেন। হেনরিক হিমল্যার ঠুলি সোসাইটির সদস্য ছিলেন। বর্ণ বিদ্যায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। আসলে এভাবেই তার নজরে পড়েছিলেন আমার দাদা। তখন থেকে প্রাচীন বর্ণমালা নিয়ে দুজন একত্রে ঘাটাঘাটি শুরু করেছিলেন।

গ্রে খেয়াল করে দেখল সবকিছুর কেন্দ্র হয়ে উঠছে এই ঠুলি সোসাইটি। কিন্তু কেন? ওর আরও তথ্য লাগবে। জাদুঘরে এক চক্কর যেতেই হবে।

হুইল চেয়ার ঠেলে গ্রের কাছ থেকে সরে গেলেন জহান। হিমল্যার আর আমার পরিবারের সদস্যের আগ্রহের বিষয়বস্তু এক হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিবারকে শংকরজাত হিসেবে ছাড় দেয়া হয়েছিল। ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। আমাদেরকে ক্যাম্পে যেতে হয়নি।

কারণ-হিমল্যার।

এখন গ্রে এই বৃদ্ধের রাগের কারণ বুঝতে পারছে। কেন ছেলেকে রুম থেকে চলে যেতে বলেছেন সেটাও বুঝতে পারছে বেশ ভালভাবে। পরিবারের এই বোঝ অজানা থাকাই ভাল। বাইরের ঝড় দেখছেন জহান।

বাইবেল হাতে নিয়ে গ্রে সবাইকে বের হওয়ার জন্য ইশারা করল।

 আসছি। বৃদ্ধকে ডাকল ও।

 বৃদ্ধ জবাব দিলেন না। অতীত হারিয়ে গেছেন।

ওরা সবাই সামনের প্রবেশপথে চলে এসেছে। আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। সামনের খোলা অংশে কেউ নেই। আজ কোনো বাইকিং করা চলবে না।

চলো, বৃষ্টির ভেতরে দিয়ে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল গ্রে।

আজ ক্যাসলে যাচ্ছি আর আজকেই মরার ঝড় হচ্ছে। ভাল তো! মনক ব্যঙ্গ করল।

সামনের ফাঁকা অংশ দ্রুত পার হতে গিয়ে গ্রে খেয়াল করল ওদের গাড়ির পাশে একটি নতুন গাড়ি পার্ক করে রাখা আছে। খালি। তবে বৃষ্টির মধ্যে ইঞ্জিন থেকে বাষ্প বেরোচ্ছে। মাত্রই এসেছে বোধহয়।

বরফ-সাদা মার্সেডিজ।

Super User