কিন্তু এইখানে আরো একটু কথা আছে। প্রথম পরিচ্ছেদেই আমরা দেখেছি যে, লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস সমাজ-ইতিহাসের যে-পর্যায়েই হোক না কেন, একেবারে আধুনিক যুগেও আমাদের দেশ থেকে তা বিলুপ্ত হয়নি। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় যে-রকম দেখাচ্ছেন, আজ সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে ওই লোকায়তিক ধ্যানধারণাই টিকে রয়েছে। যদি তাই হয়, এবং ধ্যানধারণা যদি স্বয়ম্ভু বা স্বাবলম্বী না হয়—অর্থাৎ, সামাজিক পরিস্থিতিই যদি ধ্যানধারণার অনিবার্য ভিত্তি হয়,–তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করতে হবে যে, ভারতীয় ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্যই হলো উত্তরকালের সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের দেশে প্রাচীন-সমাজের, অর্থাৎ ট্রাইব্যাল-সমাজের—অনেক চিহ্নই টিকে থেকেছে। তা না হলে, যে-সব ধ্যানধারণার প্রাচীন সমাজ-জীবন প্রতিবিম্বিত তা আজকের সমাজেও এমনভাবে টিকে থাকতে পারতো না।

সাধারণভাবে আমরা যেগুলিকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণা বলি, উদাহরণ হিসাবে সেইগুলির উল্লেখ করা যায়। আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি, এই জাতীয় ধ্যানধারণা আমাদের দেশের মানুষদের মাথায় আকস্মিকভাবে দেখা দেয়নি, এগুলিকে ব্যক্তিবিশেষের বা সম্প্রদায়-বিশেষের বিকৃত চিন্তাধারা বলেও বর্ণনা করা যায় না। সমাজবিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে অবশ্যম্ভাবীভাবেই এগুলি মানুষের মাথায় এসেছে—এবং তা শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও। কিন্তু সেই সঙ্গেই মানতে হবে, আধুনিক যুগে আমাদের দেশের মানুষ সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়েই থাকুক না কেন, ওই জাতীয় ধ্যানধারণাগুলি তাদের চেতনা থেকে মুছে যায়নি। আর, তা যদি সত্যিই মুছে গিয়ে না থাকে তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করা দরকার যে, তাদের সমাজ জীবন থেকেও প্রাচীন-সমাজের সমস্ত চিহ্ন নিশ্চয়ই বিলুপ্ত হয়নি।

এক কথায়, এইজাতীয় ধ্যানধারণার উৎস যদি ট্রাইব্যাল-সমাজের কোনো পর্যায় হয় এবং যদি দেখা যায় আধুনিক যুগেও এই জাতীয় ধ্যানধারণা মানুষের মনে বেঁচে রয়েছে তাহলে মানতেই হবে আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলগুলিতে, ট্রাইব্যাল সমাজের বিনাশ সত্যিই পরিপূর্ণ হয়নি।

লোকায়ত-ধ্যানধারণার আলোচনায়—বিশেষ করে আজকের যুগেও লোকায়ত ধ্যানধারণা কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে তার ব্যাখ্যা খোঁজবার আশায়—আমরা ঠিক এই প্রকল্প বা হাইপথেসিস্‌ থেকেই অগ্রসর হবার চেষ্টা করছি : গণসমাজের বা ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ বা incomplete detribalization সংক্রান্ত প্রকল্প।

ঠিক কোন ধরনের তথ্যের উপর নির্ভর করে আমরা এই হাইপথেসিস্‌টি প্রণয়ন করবার চেষ্টা করছি? সে-কথার পরিচয় দিতে গেলে অবশ্যই আমাদের পক্ষে মূল আলোচনা থেকে বেশ কিছুটা বিক্ষিপ্ত হতে হবে। তার দরুন পাঠকদের পক্ষে ক্লান্তিবোধ অসম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের ধারণায় উক্ত হাইপথেসিস্‌ শুধুমাত্র লোকায়তিক চেতনার উপরই আলোকপাত করে না; বস্তুত, এরই সাহায্যে ভারতীয় সংস্কৃতির নানান বৈশিষ্ট্য বোধগম্য হতে পারে। তাই, আমরা আশা করছি, আলোচনায় অনেকদূর বিক্ষিপ্ত হবার ক্লান্তি সত্ত্বেও পাঠকবর্গ আমাদের ক্ষমা করতে পারেন।

আমাদের এই বক্তব্যটি ব্যাখ্যা করবার আশায় গণপতির ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্যায় থেকেই আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয় হবে।

Super User