একটি ক্ষুদ্র একতলা বাড়িতে আমাদের ক্লাব। চারিটি ঘর এবং দুইটি বারান্দা বেষ্টন করিয়া ছোট কম্পাউন্ড। তাহাতে ব্যাডমিন্টন খেলিবার ব্যবস্থা আছে। আমরা প্রায় আট-নয়জন বাঙ্গালী এই ক্লাবের মেম্বার। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ইহার নাম রাখিয়াছি কোটেশন ক্লাব (Quotation Club)। আমরা এখানে যথাসম্ভব কোটেশনে কথা কহিয়া থাকি, স্ব স্ব রচনা আপনাদের মধ্যে পড়িয়া শুনাই, সাময়িক সাহিত্য, দৈনিক সংবাদপত্রের সমালোচনা করি, গান গাহি এবং যথেচ্ছ গল্প করি। কিন্তু আমাদের সভার উদ্দেশ্য উল্লিখিত বিষয়গুলি অপেক্ষাও মহৎ। আমরা প্রয়োজন এবং সাধ্য হিসাবে পরোপকারও করিয়া থাকি। স্কুলের কোন ছাত্র শিক্ষকভাবে পড়িতে না পাইলে আমরা তাঁহাদের বিদ্যাদান করি এবং লোকাভাবে মড়া স্থানান্তরিত না হইলে সে ভারও নিজ স্কন্ধে বহন করি।

ক্লাব সম্প্রতি গঠিত হইয়াছে। আমরা সকল মেম্বারই উদ্যোগী। আমাদের কাহারও কাহারও নাম এখন না হোক অন্যত্র পাঠক-পাঠিকার প্রয়োজন হইতে পারে, এই জন্য উদ্ধৃত করিলাম। যথা-সন্তোষ (সভাপতি), অমূল্য (সম্পাদক), অনাদি, চুনী, প্রভাত, বরদা, হৃষী ও পৃথ্বী। ভবিষ্যতে আরও একনিষ্ঠ মেম্বারের প্রত্যাশা রাখি।

সন্ধ্যার সময় আমাদের ক্লাব বসিত। সেদিন যথাসময় উপস্থিত হইয়া দেখি বাহিরের অন্ধকারে কে একজন চেয়ার পাতিয়া বসিয়া আছে। আরও অনেকের কণ্ঠস্বর ঘরের ভিতর হইতে আসিতেছিল। বাহিরে যে বসিয়াছিল তাহার উদ্দেশ্যে বলিলাম, কে? Who’s there?

উত্তর। Nay answer me. Stand and unfold thyself.

আমি। God save the Quotation Club.

উত্তর। সন্তোষ?

আমি। He.

অমূল্য কহিল, কিহে, আজ যে গেট পার হতে না হতেই কোটেশনের ছুঁচোবাজি ছেড়ে দিলে। আমি একটা চেয়ার বাহিরে আনিয়া তাহারপাশে বসিয়া বলিলাম, কি ভাবিছ মনে মনে?

অমূল্য। ভাবছি আমি কবিতা লিখলে কেমন মানায়।

আমি। লিখেছ নাকি?

অমূল্য। এক stanza.

আমি। কি শুনি।

অমূল্য। শোন,

জনম অবধি কার তোমা’পরে অধিকার
প্রিয় বলে ডাকিবার দিয়াছেন বিধি,
জানি না গো আমি তাহা তবু ভাবি যদি আহা
পাইতাম তোমা হেন অলকার নিধি।

জিজ্ঞাসা করিলাম, কি বিষয়?

অমূল্য বলিল, সেইটে এখনো ঠিক করতে পারিনি। যাক গে, এখন তোমার সংবাদ?

আমি। মন্দ নয়। কিন্তু আমার কেদারদাদার সংবাদ বড়ই আশঙ্কাজনক। তাঁর সম্বন্ধে
I could a tale unfold
Whose lightest word would–

অমূল্য। খুলে বল, খুলে বল।

আমি। অকস্মাৎ দাদা প্রেমে পড়ে গেছে।

অমূল্য উৎসুক হইয়া বলিল, কার সঙ্গে?

আমি আদ্যোপান্ত বিস্তারিত বর্ণনা করিলাম। দিনান্তে অমূল্যর কাছে মনের সমস্ত কথা না বলিলে আমার চলিত না। তাহার সহিত আমার বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য।

সে শুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর বলিল, একটা কাজ করলে হয়।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কি কাজ?

ভাবিতে ভাবিতে অমূল্য বলিল, বলব?

আমি অধীর হইয়া বলিলাম, বল না।

অমূল্য তখন তাহার মতলব প্রকাশ করিয়া বলিল। উপসংহারে কহিল, তোমার দাদা যে রকম বেকুব, বুঝতেও পারবে না যে এর মধ্যে কোন কারচুপি আছে। তার ওপর দেখ কোটেশন ক্লাবের উদ্দেশ্য শুধু পঞ্চমুখ হয়ে কথা কওয়া নয়। আমাদের ক্লাবের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। তোমার কেদারদাদা যদি এ সময় প্রেমচাঁচায় মনোনিবেশ করে তাহলে নিশ্চয় জেনো এবার সে পরীক্ষায় কাৰ্যত স্থিতিশীলতার পরিচয় দেবে। আমাদের উচিত হচ্ছে তাকে ফিরিয়ে আনা।

আমি বলিলাম, কিন্তু ভাই, বিয়ে তো একদিন সকলকেই করতে হবে।

অমূল্য বলিল, আমি কি তাতে না বলছি। বিয়ে করে স্ত্রীর সঙ্গে অনর্গল প্রেম কর-যা লোকে আবহমান কাল করে এসেছে। কিন্তু এ কি? বিয়ের আগেই প্ৰেম! সত্যি কথা বলবি ভাই, এরকম সাহেবিয়ানা আমার সহ্য হয় না। যে লোক বিয়ে করবার আগেই কোনও মেয়েকে ভালবাসে অথবা মনে করে ভালবাসি, আমি বলি তার হৃদয় দুর্বল। নিজের মনের ওপর তার শাসন নেই। শক্তি আছে তার হৃদয়ে যে নিজের স্ত্রীকে মনের মত করে নিয়ে ভালবাসতে পারে। কিন্তু কেদারের মত লোকের পক্ষে-যে গোঁফ উঠে অব্দি প্রেমের নেশায় বিভোর হয়ে আছে-পাঠ্যাবস্থায় বিয়ে করা অত্যন্ত ক্ষতিকর।–তারপর, মনে কর, তোমরা ক্ষিতীনবাবুর কাছে প্ৰস্তাবটা উপস্থিত করলে।

তিনি যদি বলে বসেন, আমি ওই তিন-বছর-ফেল-করা ছেলেকে মেয়ে দেব না। কি দেখেই বা দেবেন। ক্ষিতীনবাবুর মত বুদ্ধিমান লোক টাকা দেখে। কখনই মেয়েকে জলে ফেলে দেবেন না। আর চেহারার কথা যদি বল, ওইটেই তোমার দাদার আছে-চেহারায় পেট ভরে না। বিংশ শতাব্দীতেও পুরুষের রূপ অর্থকরী নয়। এই যে তোমার সঙ্গে উনি এক মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন সে কেবল তোমার রূপ দেখে নয়। তোমার মত বিদ্বান, মেধাবী, সুবোধ পাত্ৰ–

আমি বাধা দিয়া বলিলাম, থাক, থাক, আর প্রশংসায় কাজ নেই। সুবোধই বটে। মারামারি গুণ্ডামি এবং ফুটবলে যে সুনাম কিনে রেখেছি!

অমূল্য উত্তেজিত হইয়া বলিল, সেই কি কম নাকি! কজন লোকের গুণ্ডামি মারামারি করবার সাহস আছে। বিশেষত বাঙ্গালীর? করুক না দেখি কেদার। কিন্তু যাক ওসব বাজে কথা। তুমি যদি উপস্থিত কেদারের প্রেমের প্রতিকার করতে রাজী না হও-আমি একাই করব।

আমি বলিলাম, না। আমি রাজী আছি। কিন্তু দেখো কথাটা জানাজানি না হয়।

 

পরদিনই আমরা দুই বন্ধুতে কাগজ কলম লইয়া নিভৃতে বসিয়া গেলাম। অনেক তর্ক অনেক কাটাকুটির বাধা ভেদ করিয়া আমাদের কবিতা প্রবাহ চলিল–

জনম অবধি কার তোমা পরে অধিকার
প্রিয় বলে ডাকিবার দিয়াছেন বিধি,
জানি না গো আমি তাহা তবু ভাবি যদি আহা
পাইতাম তোমা হেন অলকার নিধি।

তোমার বিহনে শুধু প্ৰাণ মোর করে ধুধু
যেন গো সিকতাময় নিদারুণ মরু—

আমি বলিলাম, এইবার মরুর সঙ্গে কি মেলানো যায়!

অমূল্য ভাবিতে ভাবিতে বলিল, গরু—মরু—

আমি হাসিয়া বলিলাম, থাক হয়েছে–

সুনিবিড় ছায়াদানে জুড়াও কাতর প্রাণে
তুমি এ সাহারা মাঝে সুশীতল তরু!

অমূল্য আপত্তি করিয়া বলিল, যাই বল, এর চেয়ে তুমি এ সাহারা মাঝে একমাত্র গরু ঢের ভাল শোনাত।

আমি। মানে হত কই?

অমূল্য। মানে হত না? এর মানে এই হত যে—আমার প্রাণ সাহারার মত, শুকনো, তাতে যে ক’গাছি ঘাস জন্মায় সে কেবল তোমারি জন্য, অন্য কোন গরু সে ঘাস খেতে পায় না।

এইরূপে অনতিক্ষুদ্র কবিতা শেষ হইল। তারপর একখানি এসেন্সের গন্ধে ভরপুর গোলাপী চিঠির কাগজে লাল কালি দিয়া লিখিত হইল।

লিপি লিখন শেষ হইলে আমি বলিলাম, অমূল্য, একবার ফিলিং দিয়ে পড়তে, দেখি কেমন শোনায়।

অমূল্য হরবোলা, সে ললনাকষ্ঠে চিঠি পড়িতে আরম্ভ করিল–

জনম অবধি কার তোমাপরে অধিকার
প্রিয় বলে ডাকিবার দিয়াছেন বিধি,
জানি না গো আমি তাহা তবু ভাবি যদি আহা
পাইতাম তোমা হেন অলকার নিধি।

তোমার বিহনে শুধু প্ৰাণ মোর করে ধুধু
যেন গো সিকতাময় নিদারুণ মরু,
সুনিবিড় ছায়াদানে জুড়াও কাতর প্রাণে
তুমি এ সাহারা মাঝে সুশীতল তরু।

প্রাণের গোপন কথা প্রকাশিছে ব্যাকুলতা
বাহির হইতে মায়া মোহ পরিহরি,
লেখনী সে বাধ-বাধ কথা কহে আধ-আধ
দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছে সমর প্রহরী।

ভাঙ্গি সরমের বাঁধ মনের আকুল সাধ
গিরিজা তটিনী সম ধায় তব পানে,
তুমি মম হে সাগর, তুমি মম হে নাগর
হতাশা দিও না ঢেলে প্রোষিত পরাণে।

করিবারে দাসীপনা ভেবেছিনু বাসিব না
বিপুল এ ধরা মাঝে কাহারেও ভাল,
আঁধারে একটি দীপ আকাশে চাঁদের টীপ
সম তুমি এ হৃদয় করিয়াছ আলো।

তাই আজ যেচে এসে পড়েছি চরণ দেশে
জেনো মোরে এ জগতে বড় অভাগিনী,
নয়নে কিসের জ্বালা হৃদয়ে বিষের জ্বালা
কানে বাজে সকরুণ হতাশ রাগিণী।

প্রভাত আলোক মিশে বায়ু ধায় দিশে দিশে
কত কুসুমিকা তারে দিয়ে ফেলে প্ৰাণ,
পবন তো জানে না তা ফুল বোঝে নিজ ব্যথা
জানে সেই বুকে যার বিঁধে আছে বাণ!

তাই এই বাচালতা চপল চটুল কথা
আনমনে কতশত বাতুল প্ৰলাপ,
এই বলে ক্ষমা কর একটি কঠিন শর
ত্যজিয়াছে মোরে চাহি মদনের চাপ।

–একবার আসিও। তোমাকে প্ৰাণ ভরিয়া দেখিব, মনের কথা বলিব। কাল রাত্ৰি নটার সময়; আমাদের বাড়ির পিছনে তেঁতুল গাছের নীচে।

ইতি
তোমারি আকাঙ্ক্ষিণী
যাহাকে ফেরিওয়ালার সঙ্গে দেখিয়াছিলে।

পাঠ শেষ করিয়া অমূল্য বলিল, তুমি থাকবে গাছের ওপর, আমি কিছু দূরে আড়ালে লুকিয়ে থাকব। তুমি জোরে শিস দিলেই আমি এসে রক্তাক্ত হস্তে আসামী গ্রেপ্তার করব।

তখনি দাদার নামে চিঠি পোস্ট করা হইল।

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়