শ্যমাচরণকে কোথাও খুঁজে দেখতে বাকি রাখল না শিবেন। নিবুনিবু টর্চের আলোয় সাধ্যমতো আগাছা জর্জরিত রাজবাড়ির বাগানের ঝোঁপ-জঙ্গলেও খুঁজল। খুঁজতে খুঁজতে পরিশ্রমে গা গরম হয়ে ঘামতে লাগল সে। ভজহরিকে শিবেন বড়ই ভয় পায়। ভজহরির গায়ের জোর বেশি, বুদ্ধির জোর বেশি, মনের জোর বেশি। কোনওদিকেই সে ভজহরির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। শুধু লেখাপড়ায় ভজহরি তার চেয়ে একটু পিছিয়ে। আর ভজহরি সেই জন্যই শিবেনকে এত হিংসে করে। নইলে খুঁজে-খুঁজে এই অজ পাড়াগাঁয়ে শিবেনের খোঁজে এসে হাজির হত না। তবে ভজহরি যখন এসেছে, তখন শিবেনকে বিপাকে ফেলবেই। ভয়ে শিবেনের বুক ধুকপুক করছে। ভজহরির অবাধ্য হওয়ার সাধ্যই নেই তার। ভজহরির আদেশ না মানলে কোনদিক দিয়ে কোন বিপদ আসবে, তা কেউ জানে না।

পিস্তল দিয়ে কিভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হয়, তা শিবেন জানে না। শুধু জানে, মানুষ বন্দুক-পিস্তলকে ভয় পায়। আশা করা যায়, শ্যামাচরণও পাবে। যদি পায়, তা হলে শ্যামাচরণের কাছ থেকে পানিঘরের হদিশ জেনে নেওয়া তেমন কঠিন হবে না। আর পানিঘরের হদিস না দিতে পারলে ভজহরি খুব রেগে যাবে। আর ভজহরি যত রেগে যাবে, ততই বাড়বে শিবেনের বিপদ।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরির পর শিবেন ক্লান্ত হয়ে শিমুল গাছটার তলায় শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। গভীর রাতে আকাশে একটু ভুতুড়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে। তাতে বাগানে একটা ভারী আলোআঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মনটা বড় উচাটন। বাগানের সৌন্দর্য দেখার সময় নেই শিবেনের। উঠতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ বাঁ দিকের লোহার ফটকে একটা শব্দ পেয়ে শিবেন টান হল। শ্যামাদা এল নাকি?

না, শ্যামাদা নয়। ঢ্যাঙামতো একটা লোক ফটক দিয়ে ঢুকে হনহন করে বাগান পেরিয়ে রাজবাড়ির দিকে আসছে। শিবেন একটু অবাক হল। এ বাড়িতে সন্ধেবেলা একবার চোরের আগমন হয়েছে। তারপর ভজহরি হানা দিয়েছে। এখন আবার এই ঢ্যাঙা লোকটাও কি তার থিসিসের সন্ধানে এসে জুটল? শিবেনের থিসিসের খবর এমন রটে গেল কী করে, সেটাই সে ভেবে পাচ্ছে না। অবশ্য ফুল ফুটলে তার গন্ধ ছড়াবেই, তাকে তো আর আটকানো যায় না। শিবেন এও জানে যে, এই থিসিস প্রকাশিত হওয়ার পর বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত ঘুলে যাবে। আপাতত এটাকে রক্ষা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

শিবেন বাঁ-বগলে শক্ত করে থিসিসের ফাঁইলটা চেপে ধরে ডান হাতে পিস্তল বাগিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে গাছগাছালির ছায়ায় লোকটার পিছু নিল। বাড়ির পিছনের ভাঙা জানলাটার কাছে গিয়ে থামল লোকটা। তারপর কুককুক করে তিনবার একটা সাংকেতিক শিস দিল। জানলার পাল্লাটা সরিয়ে কে যেন ভিতর থেকে ঝুঁকে কি একটা বলল।

কী কথাবার্তা হয় তা জানার জন্য একটু এগিয়ে গেল শিবেন।

বাগানে ঝোঁপঝাড়ের অভাব নেই। গা-ঢাকা দেওয়ার খুব সুবিধে। তাই শিবেনের কোনও অসুবিধেই হল না। দুজনের বেশ কাছাকাছিই এগিয়ে যেতে পারল সে। তার থিসিস সম্পর্কে এরা কতটা কি জানতে পেরেছে সেটা জানা শিবেনের একান্তই দরকার।

ঢ্যাঙা লোকটা চাপা গলায় বলছিল, সন্ধান পেয়েছ?

আরে না, তবে পানিঘরেই গিয়ে ঢুকেছে মনে হয়। না হলে মজাপুকুরে ডুবে মরেছে। খুব মুশকিল হয়ে গেল। পালাল কী করে? জটাই তো পাহারায় ছিল।

তা ছিল, তার কাছে তার মেশিনগান অবধি ছিল। কিন্তু হানাদার সাঙ্ঘাতিক ধূর্ত। আচমকা ঢুকেই মেরে বসে। জটাই হাতখানা পর্যন্ত তোলার সময় পায়নি। পানিঘরের সন্ধান পেলে?

না, সারা বাড়ি ঘুরে কোথাও পথ পেলাম না। এর মধ্যে ওই হাবা গঙ্গারাম শিবেনমাস্টারটাও এসে হাজির হয়েছিল। তাপ্পি দিয়ে একটা খেলনা পিস্তল ধরিয়ে দিয়ে তাড়িয়েছি।

শিবেনমাস্টার! সে আবার এসে জুটল কেন?

কী যেন ছাইভস্ম থিসিসের কথা বলছিল। আমাকে ভজহরি বলে ধরে নিয়ে খুব তোয়াজ করছিল। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। তবে ওর কথার প্যাঁচেই ওকে ফেলেছি।

ঘুরে-ঘুরে এখন শ্যামাচরণকে খুঁজে হয়রান হচ্ছে।

শুনে শিবেনের ভারী রাগ হল। তা হলে এই পিস্তলটা আসল পিস্তল নয়! আর ওই লোকটাও নয় ভজহরি! আর তার এত কষ্টের থিসিসটা হল ছাইভস্ম! রাগ হলে শিবেনের আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। আর কাণ্ডজ্ঞান হারালে শিবেন যা তা সব কাণ্ড করে ফেলে। আজও করল। বাগানের এখানে সেখানে ফেলা ভগ্নস্তূপের ইটপাটকেল পড়ে আছে। তারই একটা কুড়িয়ে নিয়ে শিবেন ধাঁই করে জানলার লোকটাকে লক্ষ্য করে সজোরে ছুঁড়ে মারল। আঁক করে একটা আর্তনাদের শব্দ শোনা গেল। তারপর একটু তফাতে থেকেও শিবেন লোকটার পড়ে যাওয়ার শব্দ পেল।

ঢ্যাঙা লোকটা বিদ্যুতের গতিতে ফিরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চোঁ-চোঁ দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু শিবেনের রাগ হলে সে আর মানুষ থাকে না। থিসিস আর পিস্তল দুটোই ফেলে দিয়ে সে আর-একখানা আধলা কুড়িয়ে নিয়ে লোকটার পিছু ধাওয়া করল। ফটকের কাছাকাছি শিবেনের দ্বিতীয় ঢিলটা অবশ্য জায়গামতো লাগল না। তবে নোকটা পালাতে পারল না। হঠাৎ জনাদুই শক্তসমর্থ লোক কোথা থেকে এসে জাপটে ধরে পেড়ে ফেলল লোকটাকে।

.

বাইরের এসব গন্ডগোল পানিঘরে পৌঁছল না। সেখানে তখন এক আশ্চর্য শিসের শব্দে বাতাসে অপার্থিব কাপন বয়ে যাচ্ছে।

পাঁচু বিভোর হয়ে শুনছে। দু-চোখে বইছে জলের ধারা। অনেকক্ষণ শিস দেওয়ার পর হিজিবিজি থামল।

পাঁচু হাত বাড়িয়ে হিজিবিজিকে একটু ছুঁল। তারপর বলল, তুমি বড় ভালো লোক! তুমি বড় ভালো লোক!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়