রাঘবরাজার গুপ্ত আবাসের কথা তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কেউ জানে না। জানা সম্ভবও নয়।

নদীর বাঁকের মুখে যেখানে স্রোত ভয়ংকর, সেইখানে দক্ষিণ তীরে মাটির মধ্যে কিছু ইট গাঁথা আছে দেখা যায়। কোনও প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ বলে লোকে তেমন মনোযোগ দেয় না। তা ছাড়া ওই জায়গাতেই নদীর মধ্যে একটা ঘূর্ণি আছে। মানুষ, নৌকো, যা পড়বে তা-ই তলিয়ে যাবে। তাই ভয়ে কেউ ওই খাড়া পাড় আর ঘূর্ণির কাছাকাছি যায় না। তবে সাধারণ মানুষ যা পারে না, রাঘবের কাছে তা খুবই সহজ কাজ।

নিশুত রাতে রাঘব সেই খাড়া পাড়ের ধারে এসে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার দেখে নিল। তার বাঘের মতো চোখ অন্ধকারেও সবকিছু দেখতে পায়। না, কোথাও কেউ নেই। কেউ তাকে লক্ষ করছে না। রাঘব নিঃশব্দে পাড়ের ধারে ইটের খাঁজে পা রাখল। তারপর অলৌকিক দক্ষতায় ঠিক টিকটিকির মতো প্রায় পনেরো হাত খাড়াই বেয়ে খরস্রোত জলের মধ্যে ঝুপ করে নামল। সেখানে জলের স্রোত এমন প্রবল যে, হাতি অবধি ভেসে যায়। কিন্তু রাঘব ভেসে গেল না। এমনকী, খুব একটা টললও না। জলের মধ্যে টুপ করে ডুব দিল সে। ডুব দিয়ে গভীর থেকে গভীরে নেমে গেল। একদম তলায় যখন নামল, তখন তার কাছ থেকে মাত্র কয়েক হাত দুরে পাতালের এক গহিন গহ্বর। নদীর জল চোরাস্রোতে বিভীষণ বেগে সেই গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। একটু পা হড়কালেই সেই গহিন গহ্বরের উন্মত্ত জলরাশি কোথায় কোন পাতালগঙ্গায় টেনে নিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। অন্ধকারে একবার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে রাঘবরাজা গহুরটার দিকে চাইল। সামনে নদীর পাড়টা যেখানে এসে নীচে ঠেকেছে, সেখানে ইটের ফাঁকে একটা সংকীর্ণ ফাটল। রাঘব ধীর পায়ে সেই ফাটলের মধ্যে ঢুকল। তারপর কতকগুলো খাঁজ বেয়ে উঠে এল খানিকটা ওপরে।

মাটির নীচে অনেকগুলো সুড়ঙ্গের মতো পথ চলে গেছে নানা দিকে। রাঘব সামনের পথটা ধরে একটু নিচু হয়ে লম্বা পা ফেলে দ্রুত এগিয়ে চলল। ক্রমে সুড়ঙ্গটা চওড়া হতে হতে একটা মস্ত হলঘরের মতো জায়গায় এসে শেষ হল। সুড়ঙ্গটা পাথর দিয়ে বাঁধানো। দেয়ালে অনেক কুলুঙ্গি। একধারে একটা মস্ত কাঠের বাক্সের ওপর বিছানা পাতা। একটা দীপাধারে দীপ জ্বলছে। রাঘবের আস্তানা।

রাঘব ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো পোশাক পরল।

তারপর, দীপটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল কুলুঙ্গির দিকে। কুলুঙ্গিগুলো বেশ চওড়া। প্রত্যেকটাতে একটা করে বড় কাঠের বাক্স, তাতে ঢাকনা দেওয়া। অনেকটা কফিনের মতো।

রাঘব প্রথম বাক্সটা খুলল। দীপের আলোয় দেখা গেল, বাক্সের মধ্যে একটা শুকনো মমির মতো মৃতদেহ। চামড়া কুঁচকে গেছে, চোখ কোটরে ঢোকানো, হাড়গুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। রাঘব ঢাকনাটা বন্ধ করে দিল। আর-একটা খুলল। এটার মধ্যেও আর-একটা মৃতদেহ। তেমনই শুকনো, কোঁচকানো। একটার পর একটা বাক্স খুলল রাঘব। আবার বন্ধ করল। এসবই রাঘবের পূর্বপুরুষের মৃতদেহ। বহুঁকাল আগে তাদের বংশে মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রথা চালু হয়। প্রাসাদ থেকে একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গপথে মৃতদেহগুলি এই পাতালঘরে এনে রাখা হত। সেই সুড়ঙ্গ এখন বুজে গেছে। নদীর তলা দিয়ে এখানে আসার পথটি আবিষ্কার করেছে। রাঘব নিজেই।

কথা আছে, যদি রাঘবের কোনও বিপদ ঘটে তা হলে এই সব মৃতদেহ আর-একবার, শেষবারের মতো জেগে উঠবে একদিন। জেগে উঠে তাদের বংশের দুলালকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। তারপর আবার ফিরে যাবে মৃতের জগতে।

রাঘব বুঝতে পারছে, আর দেরি নেই। ভোর হতে না হতেই সে শুরু করবে তার বিজয়-অভিযান। এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। অত্যাচার শুরু করলেই ভীরু, কাপুরুষ গাঁ-গঞ্জের লোকেরা পালাবে। একমাত্র বাধা ছিল শয়তান যোগেশ্বরের কয়েকজন চ্যালা। তা সেগুলোও সব নিকেশ হয়েছে। যোগেশ্বরের প্রধান চ্যালা ফটিকের এক বংশধর গৌরকে দিয়েই কাজ হাসিল করবে রাঘব। আর সেইটেই হবে যোগেশ্বরের ওপর তার প্রতিশোধ। না, রাঘবের আর কোনও বিপদ নেই। সুতরাং এই সব মৃতদেহও আর জাগবে না। এবার কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে রাঘব মৃতদেহগুলি নদীর নীচের সেই গহ্বরে বিসর্জন দেবে।

বিছানায় জোড়াসনে বসে সে কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হল। চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ভাবী রাজ্য। এই বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতেও সে এমন এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে, যা দেখে অবাক হয়ে যাবে লোকে। সেই রাজ্যে রাজাই হবে সবচেয়ে ক্ষমতাবান। প্রজারা বাস করবে অনুগত দাসের মতো। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা থাকবে না। সামান্য বেয়াদবির শাস্তি হবে মৃত্যু।

ধ্যানস্থ অবস্থায় কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করল রাঘব। ধ্যানটা ভেঙে গেল। একটা শবাধারের ভিতরে একটু নড়াচড়ার শব্দ হল না? কান খাড়া করে শুনল রাঘব।

প্রদীপটা নিয়ে প্রথম কুলুঙ্গিটার কাছে গিয়ে ঢাকনাটা খুব ধীরে খুলল রাখব। চিত হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহ পাশ ফিরে শুয়ে আছে।

রাঘব একটু চমকে উঠল। এ কী? মৃতদেহে কেন জাগরণের লক্ষণ?

আবার ধ্যানস্থ হল রাঘব। আবার অস্বস্তি। শবাধারে শব্দ। আর-একটা মৃতদেহ পাশ ফিরল। তারপর আর-একটা। আর-একটা।

রাঘবের ঘাম হচ্ছে। তবু জোর করে ধ্যানস্থ হওয়ার চেষ্টা করল রাঘব। চোখ বুজেই শুনতে পেল, একটা শবাধারের ঢাকনা সরে যাচ্ছে।

রাঘব চোখ খুলল। শুকনো কঙ্কালসার একটি মৃতদেহ উঠে বসেছে। রাঘব ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে মৃতদেহ কুলুঙ্গি থেকে নেমে আসার চেষ্টা করছে।

বিদ্যুদগতিতে উঠে দাঁড়াল রাঘব। তারপর বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “অসম্ভব! অসম্ভব! আমার সব শত্রুর নিপাত হয়েছে।”

শবদেহ তবু নেমে আসছে কেন? রাঘব বিছানার পাশ থেকে একটা লম্বা তলোয়ার টেনে নিল হাতে। এই পাতালঘরে কোনও মানুষের পক্ষেই আসা সম্ভব নয়। ওই খাড়া পাড়, চোরাস্রোত, ঘূর্ণির ভিতর দিয়ে কে আসবে এখানে?

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়