টোরকা গ্রহাণুটা দেখতে অত্যন্ত বীভৎস। এটি লালচে, দেখে মনে হয় বিশাল কোনো প্রাণীর চামড়া ছিলে ভেতরের মাংস ক্লেদ বের করে রাখা হয়েছে। গ্রহাণুটি দুটি ভিন্ন ভিন্ন অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে-মূল অংশ থেকে এবড়োখেবড়োভাবে বের হয়ে থাকা অংশগুলো এত বিপজ্জনকভাবে ঘুরে আসছে যে স্কাউটশিপটা সেখানে মানো খুব বিপজ্জনক হতে পারে। গ্রহাণুটাতে নামার আগে নীরা ত্রাতিনা আর রিশান টোরকাকে ঘিরে একটা স্থির কক্ষপথ তৈরি করে নিল, তারপর একটা সমতল অংশ দেখে খুব সাবধানে সেখানে নেমে আসতে থাকে।

গ্রহাণুটার কয়েকশ মিটার কাছাকাছি এসে তারা মূল ইঞ্জিন বন্ধ করে ছোট ছোট দুটো ইঞ্জিন চালু করে এবং হঠাৎ করে একটি বিপজ্জনক অবস্থার মুখোমুখি হয়ে যায়। কোনো একটা বিচিত্র কারণে গ্রহাণুটা প্রচণ্ড শক্তিতে তাদের স্কাউটশিপটাকে নিচে টেনে নামাতে থাকে। রিশান কন্ট্রোল প্যানেলে বসে চিৎকার করে বলল, মূল ইঞ্জিন বিপরীত থ্রাস্ট।

নীরা ত্রাতিনা দ্রুত আবার মূল ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করে, সেটি চালু হতে খানিকটা সময় নেয়, কিন্তু ততক্ষণে স্কাউটশিপটা প্রচণ্ড গতিতে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। গ্রহাণুটার বের হয়ে থাকা একটা অংশ স্কাউটশিপটাকে একটু হলে আঘাত করে ফেলত, শেষ মুহূর্তে রিশান এটাকে সরিয়ে নেয়। গতি কমানোর জন্য মূল ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করছে, পারছে না-যখন তারা বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে ইঞ্জিনটা চালু হয়ে যায়। তারপরেও তারা স্কাউটশিপটা পুরোপুরি বাঁচাতে পারল না। প্রচণ্ড গতিতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ করে সেটা গ্রহাণুটাতে আছড়ে পড়ে।

স্কাউটশিপটার গুরুতর ক্ষতি হয়েছে, অনেকগুলো এলার্ম একসাথে তারস্বরে বাজতে শুরু করেছে। বৈদ্যুতিক যোগাযোগে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে স্কাউটশিপের আলো নিতে গিয়েছে। পোড়া একটা ঝাঁজালো গন্ধে পুরো স্কাউটশিপটা ধীরে ধীরে ভরে যেতে শুরু করে।

যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে থাকা রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা বের হয়ে এল। একজন আরেকজনের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকে। নীরা ত্রাতিনা বলল, এটা কী হল?

রিশান মাথা নাড়ে, বুঝতে পারছি না।

মনে হচ্ছে গ্রহাণুর মাঝখানে একটা নিউট্রন স্টার হাজির হয়েছে। হঠাৎ করে স্কাউটশিপটাকে এভাবে টেনে নিল কেন?

ম্যাগনেটিক ফিল্ড। আমরা যতটুকু ভেবেছিলাম তার থেকে কয়েক শ গুণ বেশি। গ্রহাণুটা ঘুরছে সেজন্য চৌম্বক আবেশ দিয়ে আশপাশে তীব্র ফিল্ড তৈরি করেছে। আমরা বুঝতে পারি নি।

নীরা ত্রাতিনা চারদিকে তাকিয়ে বলল, স্কাউটশিপটা মনে হয় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।

রিশান মাথা নাড়ল, ফাটল দিয়ে সব বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্পেস সুট পরে নেওয়া দরকার।

একটা স্পেস সুটে বড়জোর দশ-বারো ঘণ্টার মতো অক্সিজেন থাকে। তারপর কী হবে সেটা নিয়ে দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা প্রায় নিঃশব্দে স্পেস সুট পরে নেয়। স্কাউটশিপের ক্ষতির পরিমাণটা একটু অনুমান করার চেষ্টা করল। ফাটলগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয় কাজেই সেখানে সময় নষ্ট করল না। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কমিউনিকেশান মডিউলটি কাজ করছে না। পৃথিবী বা স্পেস স্টেশনের সাথেও আর কথা বলা যাচ্ছে না।

নীরা ত্রাতিনা বলল, চল, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি তাড়াতাড়ি গ্রহাণুটার মাঝে বসিয়ে আসি।

হ্যাঁ। দেরি করে লাভ নেই। চল।

দুজন স্কাউটশিপের হ্যাঁচ খুলে সেখান থেকে বিস্ফোরকগুলো বের করে নেয়। ভরশূন্য পরিবেশ, কিন্তু গ্রহাণুটার প্রচণ্ড চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে জুতোর নিচে লাগানো লোহার পাতগুলো তাদের গ্রহাণুটাতে আটকে থাকতে সাহায্য করছিল। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি নিয়ে তারা একটা ছোট জেটপ্যাক নিয়ে রওনা দেয়। গ্রহাণুটার মোটামুটি মাঝামাঝি অংশে তারা নেমেছে, এর মূল কেন্দ্রের কাছাকাছি জায়গায় একটা গভীর গর্ত করে সেখানে বিস্ফোরকটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। গর্তটা যত গম্ভীর হবে গ্রহটাকে ধ্বংস করার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে।

রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে গর্ত করতে শুরু করে। ধারালো ড্রিল মেশিনটি আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে গর্ত করতে শুরু করে, থরথর করে কাঁপতে থাকে কুৎসিত গ্রহাণুটির লালচে পাথর।

ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই প্রায় এক কিলোমিটার গভীর একটা গর্ত তৈরি হয়ে যায়। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকের টাইমারটি সেট করে এখন সেটা নামিয়ে উপর থেকে গর্তটা বন্ধ করে দিতে হবে। নীরা ত্রাতিনা প্রশ্ন দৃষ্টিতে বিশানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা টাইমারটি কতক্ষণ পরে সেট করব?

রিশান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে এটি সেট করতে হবে যেন আমরা এর মাঝে স্কাউটশিপটা ঠিক করে দূরে সরে যেতে পারি।

নীরা ত্রাতিনা বলল, আবার খুব বেশি সময় দেওয়া যাবে না। যদি কোনো কারণে বিস্ফোরকটা কাজ না করে তা হলে যেন দ্বিতীয় একটা দল আসতে পারে তার সময় দিতে হবে।

হ্যাঁ। রিশান মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছ।

টাইমারটিকে বারো ঘণ্টার জন্য সেট করে তারা বিস্ফোরকটার ভেতরে নামিয়ে দিল। ওপর থেকে গর্তটা বুজিয়ে দিয়ে তারা স্কাউটশিপে ফিরে আসতে থাকে। তাদের হাতে এখন বারো ঘণ্টার মতো সময় তার ভেতরে স্কাউটশিপটাকে চালু করে তাদের সরে যেতে হবে। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে পুরো গ্রহাণটা যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তখন তার টুকরোগুলো চারপাশে যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করবে তার কয়েক শ কিলোমিটারের ভেতর কোনো জীবন্ত প্রাণীর বেঁচে থাকার কথা নয়।

রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা স্কাউটশিপের ভেতর ঢুকে তার ধাতব দরজা বন্ধ করে, পুরোটা এক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। রিশান চারদিকে তাকিয়ে বলল, আগামী ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতর আমাদের স্কাউটশিপটা চালু করতে হবে, তারপর ছয় থেকে আট ঘন্টায় আমাদের এই গ্রহাণু টোরকা থেকে সরে যেতে হবে। যদি না পারি আমাদের শরীরের একটা পরমাণুও কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।

নীরা ত্রাতিনা চারদিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী ধারণা? স্কাউটশিপটা যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে সেটাকে কি ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে ঠিক করা যাবে?

রিশান মাথা নাড়ল, বলল, মনে হয় না।

আমারও তাই ধারণা। তবে-

তবে কী?

যদি আমরা এটাকে ছয় থেকে আট ঘণ্টার মাঝে দাঁড়া করাতে না পারি তা হলে আর কখনোই দাঁড়া করাতে পারব না। কাজেই মন খারাপ করার কিছু নেই!

রিশান হাসার চেষ্টা করে বলল, বিষয়টা নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ নীরা! আমি মোটেও মন খারাপ করছি না।

তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক।

নীরা ত্রাতিনা বলল, আমি অক্সিজেন সাপ্লইটা দেখি। তুমি দেখ ইঞ্জিনগুলো।

রিশান মাথা নাড়ল, বলল, না, আমি অক্সিজেন সাপ্লাইটুকু দেখি তুমি ইঞ্জিনগুলো দেখ। ইঞ্জিনটা দেখার আগে বৈদ্যুতিক যোগাযোগটাও তোমাকে দেখতে হবে। আমি ইমার্জেন্সি পাওয়ার ব্যবহার করে স্কাউটশিপের কম্পিউটারটা চালু করার চেষ্টা করি।

চমৎকার।

দুই ঘণ্টার মাথায় নীরা ত্রাতিনা বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ঠিক করে ফেলল। স্কাউটশিপের ফাটলগুলো বুজিয়ে বাতাসের চাপ ঠিক করতে রিশানের লাগল চার ঘণ্টা। নীরা ত্রাতিনা মূল ইঞ্জিনটা চালু করল আরো দুই ঘণ্টায়। রিশান মূল কম্পিউটারটি চালু করতে আরো তিন ঘণ্টা সময় নিল। সবগুলো ইঞ্জিন সমন্বয় করতে এবং জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে নীরা ত্রাতিনার আরো দুই ঘণ্টা সময় লেগে গেল। তখন দুইজন মিলে ঘণ্টাখানেক যোগাযোগ মডিউলটা চালু করার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হল না। তাদের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে তাই যোগাযোগ মডিউলে পৃথিবী কিংবা মহাকাশ স্টেশনের সাথে যোগাযোগ না। করেই গ্রহাণু টোরকা থেকে তারা বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হল।

নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হবার তিন ঘণ্টা আগে স্কাউটশিপটা গর্জন করে উপরে উঠে যায়, প্রথমে সেটি গ্রহাণুটাকে প্রদক্ষিণ করে কক্ষপথটা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নেয়, তারপর স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করে পৃথিবীর দিকে ছুটিয়ে নিতে থাকে।

স্কাউটশিপের ভেতরে ককপিটে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা শান্ত হয়ে বসে থাকে, খুব ধীরে ধীরে স্কাউটশিপের গতিবেগ বাড়ছে। তারা ত্বরণটুকু অনুভব করতে ব্রু করেছে, মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি চেয়ারের সাথে তাদের চেপে ধরে রেখেছে। নীরা ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের নানা ধরনের মিটারগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তারা এই গ্রহাণুটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মতো যে গ্রহাণুটি পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে তারা সেটাকে ধ্বংস করার জন্য নিউক্লিয়ার বিস্ফোরক বসিয়ে এসেছে, আর কিছুক্ষণ তার পরেই মহাকাশে ভয়ংকর একটি বিস্ফোরণে সেটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষ কিংবা মহাকাশ স্টেশনের মহাকাশচারীদের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই, সত্যি সত্যি যখন গ্রহাণুটি ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তাদের আনন্দধ্বনিটুকু তারা শুনতে পাবে না সত্যি কিন্তু সেটা পুরোপুরি অনুভব করতে পারবে।

গ্রহাণু টোরকা যখন বিস্ফোরিত হল স্কাউটশিপের মনিটরে তারা শুধুমাত্র একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। বায়ুহীন মহাশূন্যে সেটি ছিল নিঃশব্দ। পুরো গ্রহাণুটি প্রায় ভস্মীভূত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যায়। স্কাউটশিপের রেডিয়েশন মনিটরে কয়েক মিনিট গামা-রে রেডিয়েশনের শব্দ শোনা গেল তারপর সেটি পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। নীরা ত্রাতিনা এতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিল, এবার বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা একটা। নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে সে রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা তা হলে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পেরেছি।

হ্যাঁ। রিশান মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীর আট বিলিয়ন মানুষ সেজন্য এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তোমাকে এবং আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

হতচ্ছাড়া কমিউনিকেশন মডিউলটি ঠিক থাকলে আমরা এখন তাদের কথা শুনতে পেতাম।

ঠিক বলেছ। রিশান বলল, কথা না শুনলেও কি তাদের আনন্দটুকু অনুভব করতে পারছ না?

পারছি। নীরা আতিনা বলল, সত্যি পারছি।

এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্য আমাদের বিশেষ একটা কিছু করা দরকার।

নীরা ত্রাতিনা হেসে বলল, তুমি বিশেষ কী করতে চাও?

অন্ততপক্ষে দুজনের খানিকটা উত্তেজক পানীয় খাওয়া দরকার।

এই স্কাউট স্টেশনে খাবার পানি পরিশোধন করে খেতে হয় তুমি উত্তেজক পানীয় কোথায় পাবে?

রিশান বলল, এসব ব্যাপারে আমি খুব বড় এক্সপার্ট! আমাকে দুই মিনিট সময় দাও!

ঠিক আছে। নীরা খিলখিল করে হেসে বলল, তোমাকে দুই মিনিট সময় দেওয়া গেল।

দুই মিনিট শেষ হবার আগেই রিশান কটকটে লাল রঙের দুই গ্লাস পানীয় নিয়ে আসে। দুজন গ্লাস দুটো উঁচু করে ধরে, রিশান বলল, পৃথিবীর মানুষের নবজীবনের উদ্দেশ্যে।

নীরা ত্রাতিনা প্রতিধ্বনিত করে বলল, নবজীবনের উদ্দেশ্যে।

তারপর দুজন তাদের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেয়। রিশান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলল, কেমন হয়েছে আমার এই পানীয়?

খেতে মন্দ নয়। তবে

তবে কী?

কেমন জানি ওষুধ ওষুধ গন্ধ।

রিশান হাসার চেষ্টা করে বলল, ওষুধ দিয়ে তৈরি করেছি, একটু ওষুধ ওষুধ গন্ধ তো হতেই পারে।

দুজন আবার তাদের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেয়। নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা শুধু শুধু যে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করেছি তা নয়, আমরা নিজেরাও বেঁচে গিয়েছি।

রিশান কিছুক্ষণ নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রায়।

নীরা ত্রাতিনা একটু চমকে উঠে বলল, প্ৰায়?

হ্যাঁ। নীরা, আমরা এখনো পুরোপুরি বেঁচে যাই নি। তোমাকে যে কথাটা বলা হয় নি সেটি হচ্ছে– রিশান হঠাৎ থেমে যায়।

সেটি কী?

আমাদের স্কাউটশিপে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই।

কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। সব মিলিয়ে দুজনের আরো কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন রয়েছে।

নীরা ত্রাতিনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ করে তার মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে।

রিশান বলল, কাজেই যদি আমরা বেঁচে থাকতে চাই তা হলে আমাদের কিছু অস্বাভাবিক কাজ করতে হবে।

কী অস্বাভাবিক কাজ?

আমাদের শীতল ঘরে ঘুমিয়ে যেতে হবে। শীতল ঘরে শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় থাকলে মানুষকে নিশ্বাস নিতে হয় না।

নীরা ত্রাতিনা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, কী বলছ তুমি? আমাদের স্কাউটশিপে কোনো শীতল ঘর নেই! তার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে সে যেন পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না।

রিশান বলল, আছে।

কোথায় আছে?

এই পুরো স্কাউটশিপটাই হবে শীতল ঘর।

পুরো স্কাউটশিপটা– নীরার হঠাৎ মনে হতে থাকে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে সে যেন ঠিক করে কথা বলতে পারছে না। মনে হতে থাকে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। রিশান কী বলতে চাইছে সে যেন ঠিক করে বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে রিশানকেও মনে হতে থাকে যেন অনেক দূরের কোনো মানুষ।

রিশান হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে আস্তে করে নীরার হাত ধরে বলল, নীরা! আমি তোমার পানীয়ের মাঝে খুব কড়া একটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি।

নীরা ত্রাতিনা বলতে চাইল, কেন? কিন্তু সে বলতে পারল না, টলে উঠে পড়ে যাচ্ছিল, রিশান তাকে ধরে ফেলল।

রিশান তাকে জড়িয়ে ধরে সাবধানে নিচে শুইয়ে দিয়ে বলল, নীরা, সোনামণি আমার! তোমাকে পরিষ্কার করে কখনো বলি নি, আমি যে শুধু তোমাকে খুব পছন্দ করি তা নয় আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। ভালবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে কিছু নেই, তুমি আমাকে সেটা অনুভব করতে দিয়েছ। সেজন্য তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

নীরা ত্রাতিনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার ঠোঁট দুটো শুধু একবার নড়ে উঠল।

রিশান নীরা ত্রাতিনার মাথার চুল স্পর্শ করে বলল, আমি জানি তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছ। তুমি আবছা আবছাভাবে আমার কথা শুনতে পাচ্ছ। একটু পরে আর শুনতে পাবে না। তোমাকে আমি অসম্ভব ভালবাসি নীরা, তাই তোমাকে আমি কিছুতেই মারা যেতে দেব না। মনে আছে তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি উনিশ জন সন্তানের মা হতে চাও? তুমি যদি। বেঁচে না থাক তাহলে কেমন করে উনিশ জন সন্তানের মা হবে? তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে নীরা। তোমাকে আমি বাচিয়ে রাখবই।

আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। তারপর খুব ধীরে ধীরে তোমার শরীরের তাপমাত্রা আমি কমিয়ে আনব। কেমন করে সেটা করব বুঝতে পারছ? আমাদের এই স্কাউটশিপের বাইরে হিমশীতল, তাই যখনই স্কাউটশিপের তাপ বন্ধ করে দেব এটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকবে। কিন্তু সেটা করতে হবে খুব সাবধানে। মানুষের শরীর অসম্ভব কোমল, তাকে খুব যত্ন করে শীতল করতে হয়।

তোমাকে হিমশীতল করে দেবার পর তোমার আর নিশ্বাস নিতে হবে না। স্কাউটশিপে কোনো অক্সিজেন না থাকলেও তুমি বেঁচে থাকবে। আমি নিশ্চিত মহাকাশ স্টেশনের ক্রুরা এই স্কাউটশিপটা খুঁজে বের করবে। তারপর তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে পৃথিবীতে। পৃথিবীর সেরা ডাক্তাররা তোমাকে বাঁচিয়ে তুলবে। আমি নিশ্চিত তারা তোমাকে বাচিয়ে তুলবে।

রিশান নীরার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইছ আমার কী হবে? জান নীরা, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রকে দেখতাম তখন ভাবতাম আহা, আমি যদি একটা নক্ষত্র হতে পারতাম! আজ আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হবে। তোমাকে হিমশীতল করে দেবার পর আমি স্পেস সুট পরে এই স্কাউটশিপের দরজা খুলে মহাকাশে ঝাঁপিয়ে পড়ব! নিঃসীম মহাকাশে যেখানে কেউ নেই, চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার সেখানে একা ভেসে থাকতে কী বিচিত্র একটা অনুভূতি হবে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব তোমাকে নিয়ে স্কাউটশিপটা দূরে চলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছোট একটা বিল্টুর মতো সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার স্পেস সুটের অক্সিজেন যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমি সেই আশ্চর্য একাকিত্ব উপভোগ করব। তারপর আমি আকাশের নক্ষত্র হয়ে যাব। পৃথিবীতে তুমি যখন তোমার উনিশ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আকাশের দিকে তাকাবে তখন যদি ক্ষণিকের জন্য কোনো একটা অচেনা নক্ষত্রকে দেখ বুঝবে সেটা আমি।

নীরা ত্রাতিনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। রিশান দেখল তার অসহায় কালো দুটি চোখ অশ্রুসজল হয়ে আসছে। রিশান ধীরে ধীরে তার মুখ নামিয়ে এনে নীরা ত্রাতিনার ঠোঁট স্পর্শ করল।

.

নীরা ত্রাতিনার স্কাউটশিপটা মহাকাশ স্টেশনের ক্রুরা উদ্ধার করে ভেতরে তার হিমশীতল দেহটি আবিষ্কার করে। সেটি পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং পৃথিবীর একটি সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। রিশানকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। সম্ভবত সে সত্যি সত্যি আকাশ নক্ষত্র হয়ে হারিয়ে গেছে।

তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। নীরা ত্রাতিনা টেহলিস শহরের কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। তার উনিশটি সন্তানের শখ ছিল তার সেই শখ পূরণ হয়নি। রিশানের প্রতি ভালবাসার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সে কখনো বিয়ে করে নি– তার স্বামী বা সন্তান কোনোটাই কখনো ছিল না। উনিশটি দূরে থাকুক– একটিও নয়।

তবে সে জানত না মহাকাশের স্কাউটশিপ থেকে উদ্ধার করার পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে কি না সে বিষয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা থাকার কারণে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তার খানিকটা টিস্যু সংরক্ষণ করেছিলেন– ভবিষ্যতে কখনো কোনোভাবে তাকে ক্লোন করার জন্য। নীরা ত্রাতিনা বেঁচে গিয়েছিল বলে তাকে ক্লোন করার প্রয়োজন হয় নি। তবে নীরা ত্রাতিনা কখনো জানতে পারে নি যে সবার অগোচরে টেহলিস শহর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্রে খুব গোপনে তাকে ক্লোন করা হয়েছিল। চার দেয়ালে আটকে রাখা একটা গোপন ল্যাবরেটরিতে নীরা ত্রাতিনার ক্লোনেরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে।

নীরা ত্রাতিনা জানলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যেত, তার ক্লোনের সংখ্যা কাকতালীয়ভাবে ছিল ঠিক উনিশ জন।

.

মনিটরটি স্পর্শ করতেই প্রায় নিঃশব্দে চিঠিটি স্বচ্ছ পলিমারে ছাপা হয়ে বের হয়ে এল। উপরে বিজ্ঞান কেন্দ্রের লোগো, বাম পাশে কিছু দুর্বোধ্য সংখ্যা, ডান পাশে মহাপরিচালকের নিশ্চিতকরণ হলোগ্রাম। চিঠির ভাষা ভাবলেশহীন এবং কঠোর–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পরে বছরের একটি মেয়েকে বিজ্ঞান কেন্দ্রের মূল দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে। কেন পৌঁছে দিতে হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই, কখনো থাকে না। অন্য চিঠিগুলো থেকে এটা একটু অন্যরকম। নিচে লেখা আছে মেয়েটাকে সুস্থ, সবল ও নীরোগ হতে হবে যেন টেলিস শহরের দূর্গম যাত্রাপথের ধকল সহ্য করতে পারে।

চিঠিটার দিকে তাকিয়ে তিশিনা নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে। পলিমারের একটা পৃষ্ঠায় এই নিরীহ কয়েকটা লাইন একটি মেয়ের জীবনকে কী অবলীলায় সমাপ্ত করে দেবে। চার দেয়ালের ভেতরে আটকে রাখা গোপন ল্যাবরেটরিতে বড় হওয়া এই ক্লোন মেয়েগুলো যদি আর দশটি মেয়ের মতো হত তা হলে কি এই আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় বিজ্ঞান কেন্দ্র তাদের এভাবে ব্যবহার করতে পারত? নিশ্চয়ই পারত না। আর সেটি ভেবেই তিশিনার ভেতরে ক্রোধ পাক খেয়ে উঠতে থাকে। একসময় এখানে উনিশ জন মেয়ে ছিল। একজন একজন করে বিজ্ঞান কেন্দ্র আট জন মেয়ে নিয়ে গেছে। এখন আছে মাত্র এগার জন।

তিশিনা একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, আমি এই কাজের উপযুক্ত নই। ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা ক্লোনকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয় নি, তাদের সঙ্গে নিজের একাত্মবোধ করার কথা নয়। ল্যাবরেটরির গিনিপিগ এবং এই মেয়েগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই মেয়েগুলোর ব্যাপারে তার হওয়ার কথা নির্মোহ এবং পুরোপুরি উদাসীন। কিন্তু তিশিনা খুব ভালো করেই জানে, সেটি সম্ভব নয়। যারা দূরে বসে তথ্যকেন্দ্রের সংখ্যা থেকে এদের হিসাব রাখে তারা নির্মোহ হতে পারে, উদাসীন হতে পারে। কিন্তু তার মতো একজন সুপারভাইজার–যাকে প্রায় প্রতিদিন মেয়েগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতে হয়, তারা কেমন করে নির্মোহ হবে? কেমন করে উদাসীন হবে? এরকম হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েদের। জন্য গভীর মমতা অনুভব না করাটাই তো বিচিত্র। যারা ক্লোনদের নিয়ে এই গোপন প্রোগ্রামটি শুরু করেছিল তারা কি বিষয়টি ভাবে নি?

তিশিনা চিঠিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, একটি মেয়েকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে। তার এখনই গিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। মেয়েগুলোর সঙ্গে দেখা করে একজনকে বেছে নিতে হবে। কী নিষ্ঠুর একটা কাজ, অথচ তিশিনা জানে কী সহজেই না সে এই কাজটি শেষ করবে!

ক্লোন হোস্টেলের বড় গেটটি ভোলার জন্য তিশিনাকে গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার প্রতে হল। ভেতরের দুর্ভেদ্য দরজাগুলো খোলার জন্য পাসওয়ার্ড ছাড়াও তার আইরিস স্ক্যান করিয়ে নিতে হল। লম্বা করিডরের অন্যপাশে একটা বড় হলঘর, সেখানে ক্লোন মেয়েগুলো কিছু একটা করছিল, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সবাই ছুটে এল। ফুটফুটে চেহারা, একমাথা কালো চুল, মসৃণ ত্বক, ঠোঁটগুলো যেন অভিমানে কোমল হয়ে আছে। সব মিলিয়ে এগার জন, সবাই হুবহু একই চেহারার। শত চেষ্টা করেও কখনো তাদের আলাদা করা সম্ভব নয়। তিশিনা তাই কখনো চেষ্টা করে না। মেয়েগুলো তিশিনাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরে। একজন হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করে বলল, ইস! তিশিনা আজকে তোমাকে দেখতে একেবারে স্বর্গের দেবীর মতো সুন্দর লাগছে।

তিশিনা হেসে ফেলল, যৌবনে হয়তো চেহারায় একটু মাধুর্য ছিল, কিন্তু এখন এই মধ্যবয়সে তার কিছু অবশিষ্ট নেই। তার ধূসর চুল, শুষ্ক ত্বক আর ক্লান্ত দেহে এখন আর কোনো সৌন্দর্য নেই। তিশিনা বলল, স্বর্গের দেবীরা তোমাদের কথা শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে, মেয়েরা।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলল, কেন রাগ করবে? আমরা কি মিথ্যে কথা বলছি?

পাশের মেয়েটি বলল, এতটুকু মিথ্যে বলি নি। তুমি যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আস তখন আমাদের কী আনন্দ হয় তুমি জান?

প্রথম মেয়েটি বলল, সেজন্যই তো তোমাকে আমাদের স্বর্গের দেবী বলে মনে হয়।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি মেয়ে আদুরে গলায় বলল, আজকে তোমার। আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকতে হবে।

অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ।

আমরা আজকে একসঙ্গে খাব তিশিনা। ঠিক আছে?

তিশিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি আসলে এসেছি একটা কাজে।

কাজে?

একসঙ্গে সবগুলো মেয়ের চোখেমুখে বিষাদের একটা ছায়া পড়ে। তাদের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কাজ মাত্র একটিই হতে পারে তাদের কাউকে বাইরে যেতে হবে। এই গোপন ল্যাবরেটরি থেকে যারা বাইরে যায় তারা আর কখনো ফিরে আসে না।

হ্যাঁ। তিশিনা মেয়েগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, একটা জরুরি কাজে এসেছি।

কী কাজ, তিশিনা?

বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে চিঠি এসেছে। তিশিনা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের একজনকে আমার নিয়ে যেতে হবে।

ফুটফুটে মেয়েগুলো কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। একজন খুব কষ্ট করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার কী মনে হয় জান তিশিনা?

কী মনে হয়?

মেয়েটি মুখে হাসিটি ধরে রেখে বলল, আমার মনে হয়, এটি আমাদের খুব বড় সৌভাগ্য।

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, অনেক বড় সৌভাগ্য।

একজন একজন করে আমরা সবাই বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।

বিজ্ঞান কেন্দ্রে নিশ্চয়ই খুব মজা হয়। তাই না?

হ্যাঁ। প্রথম মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই খুব মজা হয়। কত রকম মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।

বাইরের মানুষেরা খুব ভালো, তাই না তিশিনা?

তিশিনা কী বলবে বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। মেয়েটি উজ্জ্বল চোখে বলল, আমাদের এখানেও আমাদের খুব সুন্দর একটা জীবন। সবাই মিলে খুব আনন্দে থাকি। যখন আমরা বাইরে যাই, তখন আমাদের আনন্দের সঙ্গে যোগ হয় উত্তেজনা।

সবগুলো মেয়ে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। উত্তেজনা, সত্যিকারের উত্তেজনা।

তিশিনা এক ধরনের গভীর বেদনা নিয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েগুলো অসম্ভব বুদ্ধিমতী, সত্যিকার ব্যাপারটি তারা বুঝতে পারে না তা নয়, সেটা তারা প্রকাশ করে না। অনেকটা জোর করে এই নিষ্ঠুর বিষয়টির মধ্যে আনন্দ খুঁজে বের করার ভান করে। একটি মেয়ে তিশিনার হাত ধরে বলল, তিশিনা, তুমি কি জান, বিজ্ঞান কেন্দ্রে আমাদের কী করতে দেবে?

তিশিনা মাথা নাড়ল, বলল, না, জানি না। তবে

তবে কী?

চিঠিতে লেখা আছে আমি যেন সুস্থ, সবল, নীরোগ একজনকে বেছে নিই।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কেন তিশিনা?

কারণ তাকে টেহলিস শহরে যেতে হবে।

মেয়েগুলো এবারে বিস্ময়ের একটি শব্দ করল, বলল, সত্যি? সত্যি টেহলিস শহরে যেতে হবে?

হ্যাঁ। টেহলিস শহর অনেক দূরে। এখন সেখানে যাওয়া খুব কঠিন।

আমাদেরকে এরকম কঠিন একটা অভিযানে নেবে?

হ্যাঁ। তিশিনা মাথা নাড়ল, তোমাদের একজনকে সেখানে যেতে হবে।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, আমি বলেছিলাম না, পুরো বিষয়টাই উত্তেজনার। মেয়েটা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ, চিন্তা করেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে।

তিশিনা মেয়েটার হাত স্পর্শ করে বলল, বিজ্ঞান কেন্দ্র আমাকে খুব বেশি সময় দেয় নি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার একজনকে বেছে নিতে হবে।

মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা?

হ্যাঁ তিশিনা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তোমাদের মধ্যে কে যেতে চাও?

মেয়েগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। সবাই দেখতে যেমন হুবহ এক, তাদের চিন্তাভাবনাও ঠিক একই রকম। জন্মের পর থেকে তারা পাশাপাশি বড় হয়েছে, এখন তারা এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছে যে, একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলতে পারে কে কী ভাবছে। একজন নরম গলায় বলল, তিশিনা, তুমি আমাদের জন্য এরকম চমৎকার একটা সুযোগ নিয়ে এসেছ, সেজন্য তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সবাই টেহলিস শহরে যেতে চাই। কিন্তু বিজ্ঞান কেন্দ্র তো মাত্র একজনকে চেয়েছে।

তিশিনা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। একজনকে চেয়েছে।

মেয়েটি বলল, তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তা হলে আমরা কি সেটা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করতে পারি?

হ্যাঁ। পার।

তা হলে খুব ভালো হয়, তিশিনা। আগামীকাল তুমি যখন আমাদের একজনকে নিতে আসবে আমরা একজন তখন তোমার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব।

চমৎকার। তিশিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, মেয়েরা, আমি কি এখন যেতে পারি? বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার আগে আমার কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করতে হয়।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, আমরা ভেবেছিলাম তুমি আজ আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকবে তিশিনা?

নিশ্চয়ই থাকব একদিন। আজ নয়। ঠিক আছে?

মেয়েগুলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তিশিনা করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করে, মেয়েগুলো আজকে আর অন্যদিনের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল না। তিশিনাও আজ পেছন ফিরে তাকাল না। সেও জানে, আজ পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে ফুটফুটে মেয়েগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে কী গভীর বিষাদের ছায়া!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল