সপ্তম দৃশ্য

[রাজার সিংহাসন। রাজা নেই। মন্ত্রী ও সভাসদরা আছেন।]

 মন্ত্রী : মহিম গড়ের মহারাজা আজ প্রজাদের দর্শন দিতে পারছেন না। আসন্ন উৎসব নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ কাব্য রচনা করবেন বলে ঠিক করেছেন।

 নকিব : মহারাজার জয় হোক।

সবাই : মহারাজার জয় হোক।

মন্ত্রী : বসন্ত উৎসব উপলক্ষে আমাদের প্রিয় নৃপতি এই রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের জন্যে একটি বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সবাইকে সুখী দেখতে চান, আনন্দিত দেখতে চান।

মজনু : মহারাজার হয় হোক।

সবাই : মহারাজার হয় হোক।

 মন্ত্রী : মহারাজার উপহার হচ্ছে রাজ্যের সমস্ত প্রজা উবসের দশদিন রাজার পদচুম্বনের সুযোগ পাবে। ধনী-নির্ধন, আমীর-ফকির সবার জন্যেই এই উপহার। মহারাজার চোখে সবাই সমান।

সবাই : জয়, মহারাজার জয়!

[ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজবে। রাজার প্রবেশ।]

 রাজা : তুমি কি উপহারের ঘোষণাটি পড়ে ফেলেছ?

মন্ত্রী : এইমাত্র পড়লাম।

 রাজা : কিন্তু ব্যাপারটা এখন আর আমার পছন্দ হচ্ছে না। সারাক্ষণ আমার পায়ে থুথু লেগে থাকবে ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করছে। বমি-বমি ভাব হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা সবাই অল্পে তুষ্ট নয়। কেউ কেউ পা চাটতে শুরু করবে। অসহ্য, অসহ্য! ঘোষণা বাতিল করে দাও। উৎসবের দশদিন আমি ওদের দেখতে চাই না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।

মন্ত্রী : তা হয় না মহারাজ। ঘোষণা বাতিল হলে প্রজাদের আশাভঙ্গের কারণ ঘটবে। ওদের সমস্ত আনন্দই মাটি হবে। সেটা ঠিক হবে না। তবে মহারাজা, আমি দু’দিক বজায় রাখার ব্যবস্থা করেছি। প্রজারা আপনার পায়ে চুমু খাবে কিন্তু তা আপনাকে স্পর্শ করবে না।

 রাজা : বল কি!

মন্ত্রী : [হাততালি।] রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে অবিকল আপনার পায়ের মত একটি কাঠের পা তৈরি করা হয়েছে। [প্রকাণ্ড একটি ট্রেতে প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি ধবধবে একটি পা এনে মঞ্চে রাখবে।] প্রজারা চুমু খাবে এই পায়ে।

রাজা : চমৎকার!

সবাই : চমৎকার! চমৎকার!

রাজা : আমি অত্যন্ত প্রফুল্ল বোধ করছি। সমস্যার একটি সুন্দর সমাধান তুমি বের করেছ। বল, তুমি আমার কাছে কি চাও?

মন্ত্রী : আপনার অনুগ্রহ চাই। আর কিছুই চাই না।

রাজা : না না, শুধু অনুগ্রহ নয়। আমি এর বাইরেও তোমাকে কিছু দিতে চাই। কি দেয়া যায়? আমার এই রাজকীয় পা বহন করার দুর্লভ সম্মান আমি তোমাকে দিতে চাই।

মন্ত্রী : এ আমার পরম সৌভাগ্য।

[রাজার ইঙ্গিতে ঐ পা মন্ত্রীর গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। পা গলায় ঝুলানোর পর মন্ত্রী খুব ধীরে ধীরে বাঁকা হতে থাকবেন।]

রাজা : [হাসতে থাকবেন।]

সবাই : [রাজার দেখাদেখি হাসতে থাকবে।]

[টুং টুং করে ঘণ্টা বাজবে। পাঁচ পিঠ-বাঁকাকে ঢুকতে দেখা যাবে এবং মন্ত্রীর গলায় ঝুলানো পায়ে চুমু দিয়ে একে একে চলে যাবে। ওরা চলে যেতেই রাজা গম্ভীর গলায় ডাকবেন।]

রাজা : ডাক, ওদের ডাক। [ওরা এসে ঢুকবে।] তোমরা এখানে কেন? তোমাদের তো বলেছিলাম–আনন্দের বার্তা নিয়ে দূর দূরান্তে যাবে। বসন্ত উৎসবের কথা বলবে। তোমরা কি যাওনি কোথাও? বল, বল, কথা বল। চুপ করে আছ কেন?

মজনু : রোজ একবার আপনেরে না দেখলে মনটা কান্দে।

সবাই : মনটা কান্দে।

মজনু : আমরা মহারাজের আশে-পাশেই থাকতে চাই। সবাই থাকতে চাই।

মজনু : বেকুবগুলির কাছে যাইতে চাই না হুজুর।

সবাই : চাই না হুজুর।

রাজা : আমার প্রতি তোমাদের প্রতি দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। বড় ভাল লাগছে।

সবাই : আমাদেরও বড় ভাল লাগতাছে। বড় আনন্দ। [সবাই হাসবে]

রাজা : হাসছ কেন? তোমাদের তো হাসতে বলিনি। তোমাদের বলেছিলাম বসন্ত উৎসবের খবর পৌঁছাবে। তাও পৌঁছাওনি। রাজার আদেশ মাননি। রাজার আদেশ অমান্য করেছ।

মজনু : ওদের কাছে যাইতে বড় ভয় লাগে হুজুর।

রাজা : ভয়! কিসের ভয়? আমাকে ভয় লাগে, না ওদের ভয় করে।

এসব কি কথাবার্তা শুনছি? ওদের পিঠে দশ ঘা করে চাবুক বসিয়ে দিন।

[বলার সঙ্গে সঙ্গে মজনু এক হাতে কাপড় ঘুচিয়ে শাস্তি গ্রহণ করবার জন্যে এগিয়ে আসবে। অন্যরাও পিঠের কাপড় তুলবে।]

রাজা : আহ্, এরা আমার বড় অনুগত। এদের সঙ্গ বড় ভাল লাগছে। চাবুক মারা শেষ হবার পর পরই এদের একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেবেন।

 [ওরা পিঠের কাপড় আরো খোলার চেষ্টা করবে। সবার চোখে-মুখে স্বর্গীয় ভাব। চাবুক নিয়ে একজন ঢুকবে।]

না না, এখানে নয়। আমার সামনে নয়। আমি মানুষের দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারি না। ওদের এখান থেকে নিয়ে যাও। [ওরা চলে যাবে।]

 তোমরা কেন দাঁড়িয়ে আছ? যাও, তোমরাও যাও। [সবাই চলে যাবে। মঞ্চ অন্ধকার হতেই দূরাগত ধ্বনি শোনা যাবে। ভাত দেন, কাপড় দেন, অনেকটা সংগীতের মত ধ্বনি। ধীর লয়ে সমুদ্রের গর্জন। রাণী ঢুকবেন।]

রাণী : কিসের শব্দ হচ্ছে?

রাজা : বাতাসের শব্দ। বাতাসে গাছের পাতা কাঁপছে। চমৎকার ধ্বনি। তোমার ভাল লাগছে না?

রাণী : না না, ওটা বাতাসের শব্দ নয়। আমি প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ প্রাসাদের দিকেই আসছে।

রাজা : ওরা আমার ভক্ত প্রজা, ওরা আসছে উৎসব দেখতে।

রাণী : ওদের সবার হাতে মশাল।

রাজা : অন্ধকার রাত। চারদিকে ভাল দেখা যাচ্ছে না, সে জন্যেই মশাল। মশালের আলোয় ওরা উৎসব ভালমত দেখতে পাবে। রাণী। তুমি বুঝতে পারছ না। ব্যাপারটা সে রকম নয়। দূর-দূর থেকে সবাই আসছে। আমার ভাল লাগছে না। আমার একটুও ভাল লাগছে না।  

রাজা : হাসতে হাসতে বলবেন রাজপ্রাসাদের সদর দরজা বন্ধ করা আছে। ওরা কেউ এখানে আসবে না। তাছাড়া উৎসব যাতে সুশৃঙ্খলভাবে হতে পারে তার জন্যে হাজার হাজার সৈন্য আছে বাইরে। রাণী, তোমার মন বিক্ষিপ্ত। দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে এ রকম হয়েছে। রাজা-রাণীদের কখনো দুঃস্বপ্ন দেখতে নেই। ওস্তাদজীকে ডেকে এনে গান শোন, মন ভাল হবে।

[হাততালি দিতেই অন্ধ ওস্তাদ ঢুকবেন।]

 রাজা : তুমি ভাল আছ?

ওস্তাদ : ভাল আছি। বেশ ভাল।

রাজা : বাহ্ বাহ্ বাহ্। তোমার গলা চমৎকার হয়েছে। কণ্ঠ খুলেছে।

মহারাণীকে চমৎকার একটি গান শুনাও তো। ওর মন বিক্ষিপ্ত, ওর মন ভাল করে দাও। [ওস্তাদ বসবেন। গানের আয়োজন করবেন। নেপথ্য থেকে শোনা যাবে–ভাত দেন, কাপড় দেন, ভাত কাপড় দেন ইত্যাদি স্লোগান।]

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ