ষষ্ঠ দৃশ্য

[রাণী একাকী হাঁটছেন। ওস্তাদের প্রবেশ]

রাণী : আপনি এসেছেন কেন? আপনাকে তো ডাকিনি! তাছাড়া আপনি এমন নিঃশব্দে কেন হাঁটেন? আমি চমকে উঠেছিলাম। এখানে আমার বুক কাঁপছে।

ওস্তাদ : মাঝে মাঝে চমকে ওঠা ভাল। এতে শরীর সুস্থ থাকে।

রাণী : আপনি কি চান আমার কাছে?

ওস্তাদ : শুনলাম কয়েক রাত ধরে আপনার ঘুম হচ্ছে না। আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন।

রাণী : কোত্থেকে শুনলেন আমার ঘুম হচ্ছে না?

ওস্তাদ : রাজপ্রাসাদের সবাই আপনার দুঃস্বপ্নের কথা বলাবলি করছিল। অনেকেই মনে করছে যেহেতু মহারাণী দুস্বপ্ন দেখছেন কাজেই তাদেরও দেখা উচিত। কাজেই তারাও দেখছে। কয়েক রাত ধরে অনেকেই ঘুমুতে পারছে না, মহারাণী।

রাণী : আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন?

ওস্তাদ : হ্যাঁ।

রাণী : কি দেখছেন?

ওস্তাদ : দেখলাম, মহানন্দে রাজ্যে বসন্ত উৎসব হচ্ছে, গান-বাজনা, আনন্দ-উল্লাস। রূপসী নর্তকীরা মহারাজাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে। প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে মহারাণী স্বয়ং প্রজাদের মধ্যে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। একটি-দুটি ফুল নয়, লক্ষ লক্ষ ফুলের অযুত নিযুত পাপড়ি। কি অপূর্ব তার সৌরভ।

রাণী : এ-তো চমৎকার একটি স্বপ্ন। একে দুঃস্বপ্ন বলছেন কেন?

 ওস্তাদ : দুঃস্বপ্ন বলছি কারণ ফুলের পাপড়ি আপনি যাদের দিচ্ছেন তারা ফুল চায় না।

রাণী : তারা কি চায়?

ওস্তাদ : ভাত চায়।

[রাণী তাকিয়ে থাকবেন। এবং দ্রুত চলে যাবেন। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকবে।] একজনের পেছনে একজন করে পিঠ-বাঁকার দল মঞ্চ অতিক্রম করবে। তারা পা ফেলছে তালে তালে।]

 মজনু : জয়! মহারাজার জয়! [চলতে চলতে বলবে।]

 বাকী সবাই : জয়! মহারাজায় জয়!

ওস্তাদ : তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

মজুন : বসন্ত উৎসবের কথা দশজনেরে বলতে যাই, জনাব। মহারাজার দয়ার কথা সবারে বলতে যাই। মহারাজা দয়ার সাগর।

সবাই : দয়ার সাগর!

মজনু : আনন্দের সমুদ্র!

সবাই : আনন্দের সমুদ্র!  

ওস্তাদ : বাঁকা হয়ে কি উৎসবের সংবাদ দিতে আছে? উৎসবের সংবাদ দিতে হয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। বুক টান করে দাঁড়ান না সবাই।

মজনু : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]

বশির : আমাদের অত সময় নাই।  [প্রস্থান।]

নেয়ামত : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]

সবাই : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]

[মঞ্চে শুধু বৃদ্ধ ও তরুণটি থাকবে। দু’জনেরই পিঠ বাঁকা।]

ওস্তাদ : বুক টান করে দাঁড়ান। মানুষের মত দাঁড়ান।

[দু’জনেই চেষ্টা করবে, পারবে না।]

 বৃদ্ধ  : এর ওজন বড় বেশি জনাব। সোজা হওন যায় না। অল্প কয়টা দিন বাঁচুম, বেঁকা হইয়া থাকলে অসুবিধা নাই। আচ্ছা ভাই, যাই। সেলাম।

[চলে যেতে ধরবে।]

[তরুণটি দাঁড়িয়ে আছে একা।] 

ওস্তাদ : অল্প ক’টা দিন বাঁচবে, এই কটা দিন না হয় সোজা হয়েই বাঁচো।

বৃদ্ধ  : লাভ তো কিছু নাই ওস্তাদজী।

 ওস্তাদ : লাভ থাকবে না কেন? এই বয়সে এতো বড় একটা বোঝা!

তোমার কোমর তো ভেঙে যাচ্ছে।

বৃদ্ধ  : কিন্তু জনাব, এই বোঝাটার একটা ইজ্জত আছে। এর কারণে পাঁচজনে আমারে সালাম দেয়। দুই-একটা জ্ঞানের কথা শুনতে চায়। রাজাসাবও আমারে পেয়ার করেন।

ওস্তাদ : তোমার লোকজন তো এক সময় তোমাকে ভালবাসতো তারা কি এখনো বাসে?

 বৃদ্ধ  : ছোড লোকের ভালবাসার কি কোন দাম আছে জনাব?

কোন দাম নেই। একটা ময়ূরপক্ষী এক হাজার কাকের সমান।

ওস্তাদ : বাহ, তুমি তো সত্যি সত্যি জ্ঞানের কথা বলতে শুরু করেছ!

বৃদ্ধ  : আরো একটা কথা আছে, জনাব।

ওস্তাদ : বল, সেই কথাটাও শুনি।

বৃদ্ধ : আমি হইলাম মরণকালের বুড়া। আমার পিঠ বেঁকা থাকলেই কি, সোজা হইলেই কি? [তরুণকে ইঙ্গিত করে।]

যারার পিঠ সোজা থাকনের কথা তারাই বেঁকা ইয়া ঘুরতাছে। আচ্ছা ওস্তাদজী, যাই। সেলাম। [বৃদ্ধ চলে যাবে।]

  ওস্তাদ : তোমার জোয়ান বয়স। তোমার বাঁকা হয়ে থাকা তো ঠিক না। নাম কি তোমার?

 তরুণ : চান মিয়া।

ওস্তাদ : বাহ্, কি চমৎকার একটা নাম! এত সুন্দর নামের একটি ছেলে সারাজীবন বাঁকা হয়ে থাকবে? দেশের বাড়িতে কে আছে তোমার?

তরুণ : আমার বউ আছে।  

ওস্তাদ : তার কি নাম?

তরুণ : ফুলি।

ওস্তাদ : বাহ্ বাহ্ বাহ্, কি সুন্দর নাম! ফুল থেকে ফুলি। শোন চান মিয়া–ফুলি না ডেকে এখন থেকে তুমি তাকে ডাকবে ফুলকুমারী।

তরুণ : জ্বি আচ্ছা।

ওস্তাদ : এখন তুমি এক কাজ কর, বস্তাটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তারপর ফিরে যাও ফুলকুমারীর কাছে। [তরুণ গলা থেকে বস্তা নামিয়ে রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে সে সোজা হয়ে দাঁড়াবে] যাও, এখন ফুলকুমারীর কাছে যাও। সে অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। অনেক দিন তো তার সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে না, ঠিক না?

তরুণ : [হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বে।]

[তরুণ সোজা হয়ে উল্টো দিকে চলে যাবে। আনন্দ ও উল্লাস-এর সংগীত বেজে উঠবে। হঠাৎ সমস্ত সংগীত থেমে যাবে। দেখা যাবে তরুণটি চোরের মত আবার ঢুকছে। স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে পিঠ বাঁকা করে সে অন্যরা যেদিকে গেছে সেদিকে রওনা হবে। একবারও তাকাবে না ওস্তাদজীর দিকে। ওস্তাদজী পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটি দেখবেন।]

[মঞ্চের অন্যপ্রান্ত থেকে ঢুকবেন রাজা। তাঁর মুখ হাসি হাসি]

 রাজা : যদি দশটি স্বর্ণমুদ্রা থাকতো তাহলে সে হয়তো তোমার কথা শুনতো। বিশটি বা ত্রিশটি থাকলেও শুনতো। কিন্তু ওখানে আছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।

 ওস্তাদ : এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা তুচ্ছ করতে পারে এমন মানুষও তো এ রাজ্যে আছে মহারাজা। আছে না?

রাজা : হয়তো আছে। কিন্তু তাদের জন্যে আছে দু’হাজার স্বর্ণমুদ্রার থলে। যারা দু’হাজারকে তুচ্ছ করবে তাদের জন্যে তিন হাজারের ব্যবস্থা আছে। [রাজা হাসতে থাকবেন।]

 রাজ্য চালনা কঠিন কাজ ওস্তাদজী।

ওস্তাদ : হ্যাঁ খুবই কঠিন।

রাজা : আমি দূর থেকে সমস্ত ব্যাপারটা খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। এত আগ্রহ নিয়ে এর আগে কোনকিছু লক্ষ্য করিনি।

ওস্তাদ : মহারাজার আগ্রহের কারণ ঘটাতে পেরেছি। তার জন্যে বড় আনন্দবোধ করছি।

 রাজা : আনন্দবোধ করাই উচিত। আমি তোমার উপর খুব খুশি হয়েছি।

ওস্তাদ : আপনার সুখের কারণ ঘটাতে পেরেছি। তাতেই আমার আনন্দ।

রাজা : ওস্তাদজী।

ওস্তাদ : বলুন জনাব।

রাজা : শুনলাম, তুমি না-কি আজকাল দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ? ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন!

 ওস্তাদ : [চুপ করে আছে।]

রাজা : এবং তুমি তোমার দুঃস্বপ্নের কথা বলে বেড়াচ্ছ সবাইকে।  

ওস্তাদ : স্বপ্ন খুব রহস্যময় বস্তু জনাব। এতে থাকে ভবিষ্যতের ইংগিত, কাজেই স্বপ্নের কথা বলতে হয়।

 রাজা : ঠিক ঠিক। খুব ঠিক। বলাই উচিত। বলে তুমি ভালই করেছ। আমি তোমার উপর খুশি। খুব খুশি। নাও, তুমি এই মালাটা নাও। এটা তোমার জন্য।

ওস্তাদ : মহারাজার মালা গলায় পরার যোগ্যতা কি আমার আছে?

রাজা : ওস্তাদজী, মহারাজার মালা অযোগ্য লোকদের গলাতেই বেশি ঝুলে।

আমি কি ঠিক বলেছি?  

ওস্তাদ : বলেছেন। ঠিক বলেছেন। আপনি মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

রাজা : [হাসি] বিভ্রান্ত হয়ে যাও। খুব ভাল বলেছ। একজন বুদ্ধিমান নৃপতির কাজই হচ্ছে আশেপাশের সবাইকে বিভ্রান্ত করে রাখা। দশটি মিথ্যা কথার সঙ্গে তিনটি সত্যি কথা মিশিয়ে দেয়া। দশটি ভুল সিদ্ধান্তের সঙ্গে দুটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া।

ওস্তাদ : আপনি বুদ্ধিমান।

রাজা : ধন্যবাদ।

ওস্তাদ : আমি কি যেতে পারি, মহারাজা?

রাজা : নিশ্চয়ই যেতে পারো। তবে শোন, একটি কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন মনে করছি তোমার গান এখন আর আমাকে তৃপ্তি দিতে পারছে না। তোমার গলা নষ্ট হয়ে গেছে। এমন একটি সুন্দর কণ্ঠ তো নষ্ট হতে দেয়া ঠিক না। কি করে তোমার গলা ঠিক করা যায় বল তো?

[রাজা হাততালি দেবেন, মন্ত্রী এসে ঢুকবেন। রাজা আবার হাততালি দেবেন, দু’জন সভাসদ এসে ঢুকবে।] এর গলা নষ্ট হয়ে গেছে। কি করে এর গলা ঠিক করা যায় বল তো? আমি তার কণ্ঠের অপূর্ব সংগীত আবার শুনতে চাই।

[ সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।] [আপন মনে]

অন্ধ গায়ক গায়িকারা খুব সুকণ্ঠ হয়। কি, হয় না?[ সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করবে।] ওকে নিয়ে যাও। নষ্ট করে দাও ওর চোখ। আমি আবার তার কণ্ঠে অপূর্ব সুরধ্বনি শুনতে চাই। আমি আবার আবেগে উদ্বেলিত হতে চাই। যাও ওকে নিয়ে যাও।

মন্ত্রী  : [অবাক] মহারাজা!

রাজা : আহা, কেন প্রশ্ন করছো? ও তো করছে না। সে তো তার কণ্ঠে যৌবন ফিরে পেতে চায়। তাই না?

ওস্তাদ : [তাকিয়ে আছেন।]

 রাজা : যাও, ওকে নিয়ে যাও।

[ওস্তাদ চলে যাবেন। তার পেছনে মন্ত্রী ও সভাসদরাও যাবে। আলো কমে আসবে। রাজা নিজ মনে পায়চারি করবেন ও হাসতে শুরু করবেন। অট্টহাসি শুনে রাণী ঢুকবেন।]

 রাণী : [আতঙ্কিত হয়ে] কি হয়েছে?

রাজা : কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে এবং দীর্ঘ দিন ধরে ঠিক থাকবে। এসো, তুমি আমার কাছে এসো!

 [রাজা ও রাণীর প্রস্থান]

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ