পঞ্চম দৃশ্য

[রাজা বসে আছেন সিংহাসনে। মন্ত্রী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে]

রাজা  : বসন্ত উৎসবের আয়োজন কি সুসম্পন্ন?

মন্ত্রী : প্রায়!

রাজা : প্রায় কেন? মনে হচ্ছে কাজ এগুচ্ছে না?

মন্ত্রী  : যে রকম ভাবা গিয়েছিল তেমন উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে না। শীতকালটা উৎসবের জন্যে ভাল নয়।

রাজা : এই মতামত কি তোমার?

মন্ত্রী  : আমার নয় মহারাজ। মন্ত্রীর নিজস্ব কোন মতামত থাকে না। যারা উৎসবের ব্যাপারে আপত্তি করছে তাদের মতামত।

রাজা : তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয় আশা করি।

মন্ত্রী : খুব কমও নয়। আমি ওদের আপনার সামনে উপস্থিত করছি।

 রাজা  : কেন?

মন্ত্রী : ওদের কথা আপনার শোনা দরকার।

রাজা : আমাকেই যদি ওদের কথা শুনতে হয়, তাহলে আপনারা কি জন্যে আছেন?

মন্ত্রী :  বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন আর ওদের সব কথা পরিষ্কার বুঝতে পারি না।

 রাজা : কেন? ওরা কি নতুন কোন ভাষায় কথা বলছে?

মন্ত্রী : হুঁ।

রাজা  : বেশ তো, ওদের নিয়ে আসুন।

[বৃদ্ধ ওসমান ও তরুণটি প্রবেশ করবে। এদের দুজনের কোমড়ে দড়ি বাঁধা। খালি গা।]

রাজা  : তোমরা ভাল আছ? [বন্দী দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।]

ওদের বেঁধে রেখেছেন কেন? বাঁধন খুলে দিন। [বাঁধন খুলে দিতেই বৃদ্ধটি নত হয়ে কুর্নিশ করবে।]

শুনলাম তুমি চাও না বসন্ত উৎসব হোক? বৃ

দ্ধ  : [ ইতস্ততঃ করে[ বড় অভাব হুজুর! কষ্ট।

রাজা : অভাব থাকবে, কষ্ট থাকবে। আবার সুখও থাকবে। আনন্দ-উল্লাসও থাকবে। বসন্ত উৎসবও হবে।

বৃদ্ধ  : হুজুর এটা শীতকাল।

রাজা : শীত ভাবলেই শীত, বসন্ত ভাবলেই বসন্ত। তুমি যদি ভাব এটা বসন্তকাল তাহলে এটা বসন্তকাল। ঠিক না?

 বৃদ্ধ  : তা তো ঠিকই।

রাজা  : তুমি জ্ঞানীর মত কথা বলছ। তুমি বৃদ্ধ, কাজেই তুমি জ্ঞানী। বৃদ্ধরা জ্ঞানী হয়।

বৃদ্ধ  : তা তো ঠিকই।

রাজা : মন্ত্রী, আপনি একে একটি উপাধি দেবার ব্যবস্থা করুন।

 বৃদ্ধ :হুজুরের দয়া।

রাজা : তোমার উপাধি হবে জ্ঞানবৃদ্ধ।

বৃদ্ধ  : হুজুরের অসীম দয়া।

রাজা : আমার পদচুম্বনের দুর্লভ সম্মানও তুমি পাবে।

তরুণ  :  থু করে থুথু ফেলবে।]

[সবাই তাকাবে। রাজা হাসিমুখে তার পা বাড়িয়ে দেবেন। বৃদ্ধ ইতস্ততঃ করবে। তরুণটির দিকে কয়েকবার তাকাবে। তারপর এগুবে রাজার দিকে।]

 মন্ত্রী : তোমার মুখ পরিষ্কার আছে তো?

বৃদ্ধ :  [থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যাবে।]

মন্ত্রী : মুখ ধুয়ে নাও।

[একজন প্রতিহারী পানি এগিয়ে দেবে। বৃদ্ধ বার বার তাকাবে তরুণটির দিকে। তারপর মুখ ধুয়ে এগিয়ে গিয়ে পদচুম্বন করবে।]

 রাজা :  খুশি হয়েছ?

বৃদ্ধ :  জে। বড় মোলায়েম পা হুজুরের।

[মন্ত্রী হাততালি দিতেই একজন একটি প্রকাণ্ড কাঠের টুকরো এনে বৃদ্ধের গলায় ঝুলিয়ে দেবে। বৃদ্ধ বাঁকা হয়ে যাবে। তার হাতে একটি লাঠি ধরিয়ে দেয়া হবে। কাঠের টুকরোটিতে লেখা ‘জ্ঞানবৃদ্ধ’।]

 তরুণ  : [থু থু করে থুথু ফেলবে]

[ঐ তিন-বাঁকা লোক লাঠি হাতে একে একে ঢুকবে। মুখ ধুয়ে যাবে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে এনায়েত।]

রাজা :  তোমাকে জ্ঞানবৃদ্ধ উপাধি দেয়া হয়েছে, তুমি এখন একজন জ্ঞানী। কাজেই জ্ঞানীর মত কিছু কথা বল।

বৃদ্ধ :  [কাশতে থাকবে এবং এদিক-ওদিক তাকাবে।]

রাজা : তুমি জ্ঞানীর মত কথা বলতে জান না?

বৃদ্ধ :   জে না হুজুর।

রাজা : জ্ঞানের কথা হবে দুর্বোধ্য। কোন অর্থ থাকবে না। অথচ মনে হবে অর্থ আছে। এরকম কিছু তুমি কি জান না?

বৃদ্ধ :  জে না হুজুর।

রাজা :  কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে কখনো দেখনি?

বৃদ্ধ :   এই জীবনে কুল্লে একজনের দেখছি। আপনেরে দেখছি।

আর কেউরে দেখি নাই হুজুর।

রাজা :  সাধু সাধু! তুমি শুধু জ্ঞানীই নও, তুমি মহাজ্ঞানী।

[রাজার কথা শেষ হতেই একজন প্রতিহারী এসে বৃদ্ধের গলায় ‘মহাজ্ঞানী’ পদক পরিয়ে দেবে। বৃদ্ধের মাথা অনেকখানি নেমে যাবে। বৃদ্ধ হাঁপাতে থাকবে।]

বৃদ্ধ  : ওজন বড় বেশি জনাব।

রাজা  : পদকের ওজন তো বেশি হবেই। কষ্ট হচ্ছে? খুলে ফেলতে চাও?

বৃদ্ধ  : জে না। দুই-একদিন গলায় জুললে সহ্য হইব। আর ওজনও তেমন বেশি না। রাজা সাব সেলাম, মন্ত্রী সাব সেলাম। [এগিয়ে আসবে চান্দ মিয়ার দিকে।] ও চাঁদ মিঞা, আমার কথা শোন্ চুমা দে একটা রাজা সাবের পাওডাত। পাও থোয়া আছে। আমার কথা শোন।

তরুণ : আপনে আপনের কামে যান। আমার কথা চিন্তা করনের দরকার নাই।

বৃদ্ধ  : বেকুবি করিস না চান। জোয়ান বয়স হইল বেকুবির বয়স। জোয়ান বয়সে খালি বেকুবি করতে মন চায়।

রাজা : ও সত্যি সত্যি জ্ঞানীর মত কথা বলছে। ও সত্যি জ্ঞানী হয়ে গেছে। বুঝলে মন্ত্রী, জ্ঞান মানুষকে জ্ঞানী করে না।

 মন্ত্রী : পদক জ্ঞানী করে।

রাজা : শোন জ্ঞানবৃদ্ধ তুমি এখন যাও, একে একা থাকতে দাও। [বৃদ্ধ চলে যাবে। তিন-বাঁকা ঢুকবে এবং কুলি করে চলে যাবে।]

 রাজা : তুমি আমার কথা শোন। তাকাও আমার দিকে।

তরুণ  : [মাথা ঝাঁকাবে।]

রাজা : দুর্বল শরীরে এত জোরে মাথা ঝাঁকি দেয়া ঠিক না।

এতে মাথা খুলে পড়ে যেতে পারে।

মন্ত্রী : রাজার পদচুম্বন করতে কি তোমার অহংকার লাগছে?

অহংকার ভাল নয়। দুর্বলের অহংকার থাকতে নেই। [তরুণটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে পদচুম্বন করবে।]  

রাজা : তোমার শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে দেখে খুশি হচ্ছি। এসো, এসো। [তরুণটি এগিয়ে এসে গোঁ গোঁ করতে করতে রাজার পা কামড়ে ধরবে। তীব্র বাজনা বেজে উঠবে। রাজার মুখ হাসি-হাসি থাকবে।]

তোমার সাহস দেখে চমৎকৃত হয়েছি। কি নাম তোমার?

তরুণ : [তাকিয়ে থাকবে।]

রাজা : সাহসী মানুষদের আমি সব সময়ই পছন্দ করি। শুধু পছন্দ নয়, পুরস্কৃতও করি। মন্ত্রী, ওকে কি পুরস্কার দেয়া যায়?

মন্ত্রী : মহারাজ, ওকে সাহসী তরুণ উপাধি দিয়ে দিন।

তরুণ: [থু করে থুথু ফেলবে।]

রাজা : একে আমি মূল্যহীন উপাধি কি করে দেই? অন্য কিছু দিতে হবে।

মন্ত্রী : পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা দিন।

 তরুণ : [থু করে থুথু ফেলবে]

[রাজা তরুণকে লক্ষ্য করছেন।]

মন্ত্রী : পঞ্চাশটি দিন।

তরুণ : [থুথু ফেলবে।]

মন্ত্রী : পাঁচশ’ দিন।

 তরুণ : [এইবার আর থুথু ফেলবে না।]

রাজা : পাঁচশ’ নয়, এই সাহসী তরুণকে পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিন।

[সভাসদের হাততালি–একটি স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি থলে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সে অন্যদের মত বাঁকা হয়ে যাবে।]

হ্যাঁ, তুমি এখন যেতে পার।

[তরুণটি ইতস্ততঃ করে দরজা পর্যন্ত যাবে। আবার ফিরে আসবে। রাজা পা বাড়িয়ে দেবেন। তরুণটি চুম্বনের জন্য মাথা নিচু করতেই]।

মন্ত্রী : মুখ ধুয়ে নাও। ভাল করে মুখ ধুয়ে নাও।

[মুখ ধুয়ে চুম্বন করামাত্রাই অসংখ্য কাক- কা-কা করে ডাকতে থাকবে।]

রাজা : একদিনে অনেক কাজ হল মন্ত্রী। আজ তাহলে সভা ভঙ্গ হোক।

মন্ত্রী : আর অল্প কিছু সময় কি দিতে পারবেন না মহারাজা?

রাজা : নিশ্চয় পারব। একশ’বার পারব। হাজার বার পারব।

আজ আমার বড় আনন্দ মন্ত্রী। বড় আনন্দ!

 মন্ত্রী : আপনার আনন্দে আমাদেরও আনন্দ। আপনার সুখেই আমাদের সুখ।

রাজা : আহ্ এসব কথা অনেকবার শুনেছি। আর কি বলবে বল। নতুন কিছু বল।

মন্ত্রী : নগরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি আপনাকে ফুলের মালা দিতে চান।

রাজা : ফুলের মালা?

মন্ত্রী : জি, ফুলের মালা। এরা সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন।

রাজাঃ আহা, সকাল থেকে অপেক্ষা করছে! ওদের তো বড় কষ্ট হয়েছে মন্ত্রী। আমি কারো কষ্ট সহ্য করতে পারি না। যাও যাও, এক এক করে নিয়ে এসো। [ফুলের মালা হাতে একজন প্রবেশ করবে। মালা পরাবে]

ভাল আছ তুমি?

১ম লোক : ভাল আছি। খুব ভাল আছি।

রাজা : সুখে আছে?

১ম লোক : মহাসুখে আছি, মহানন্দে আছি।

 [১ম লোক চলে যাবে। ২য় লোক ঢুকবে, মালা দেবে।]

রাজা : তুমি ভাল তো?

২য় লোক : জ্বি জনাব, ভাল। আমি সুখী-মহা-সুখী।

রাজা :কেন তুমি মহাসুখী?

 ২য় লোক : আপনাকে দেখতে পেয়েছি, তাই। রাজদর্শনে পুণ্য আছে। শাস্ত্রের কথা। পুণ্যতেই সুখ-মহাসুখ। প্রস্থান।

[৩য় ব্যক্তির প্রবেশ]।

৩য় লোক : হুজুর, এই মালাটি আমার কন্যা রাত জেগে নিজ হাতে গেঁথেছে আপনার জন্যে।

 রাজা : রাত জেগে গেঁথেছে? আহা, আহা বড় কষ্ট হয়েছে তো।

৩য় লোক : আপনার জন্যে মালা গাঁথায় কোন কষ্ট নেই।

রাজা : মালা কে এত কষ্টের মালা কিন্তু কোন গন্ধ পাচ্ছি না কেন?

৩য় লোক : ফুলগুলি কাগজের, তাই গন্ধ নেই। রাজ্যে ফুলের বড় অভাব জনাব।

রাজা : হা হা। ঠিক ঠিক। আমার মনে ছিল না। গন্ধের কোন প্রয়োজন নেই। এর সৌন্দর্য তার গন্ধকে ছাপিয়ে উঠেছে। আমি তোমার কন্যার প্রতি প্রীতি হয়েছি। ওকে আমি পুরস্কৃত করতে চাই।

৩য় লোক: হুজরের অসীম দয়া। প্রজাদের প্রতি আপনার মমতার কোন সীমা নেই।

রাজা : চুপ, সব চুপ। আমি এর কন্যার জন্যে একটি কবিতা লিখে দেব। আমার ভাব এসে গেছে। কাগজ, কলম। আলো, আলো কমিয়ে দাও। গোধূলির পরিবেশ তৈরি কর। কলম, কলম।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ