মা’র কিছু একটা হয়েছে। ভয়ঙ্কর কিছু। রাত আটটায় মা বাসায় ফিরলেন– আমি তাঁকে দেখেই চমকে উঠলাম। মা বললেন, তোর বাবা কোথায়? চলে গেছে? আমি বললাম, হু। মা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার খাটের পাশে বসলেন। বসেই রইলেন। যেন রক্ত-মাংসের মানুষ হঠাৎ মূর্তি হয়ে গেছে।

অন্যদিন বাসায় ফিরে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন– মাথাব্যথা হয়েছিল? তারপর কিছুক্ষণ মাথায় হাত রাখেন। মনে হয় মনে মনে কোনো দোয়া পড়েন। মা কিছুদিন হলো দোয়া পড়া শুরু করেছেন। দরূদে শেফা। অনেক রাত জেগে পড়েন, তারপর চুপিচুপি এসে কপালে ফুঁ দিয়ে যান। আমি জেগে থেকেও ঘুমিয়ে থাকার ভান করি।

মা’র মন আজ খুব ভালো থাকার কথা। আজ আমাদের ভিসা হয়েছে। কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই হয়েছে। ভিসা হবার পর মা আমাকে আর বাবাকে বাসায় নামিয়ে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় হঠাৎ কী মনে করে বাবাকে বললেন, তুমি রাতে ভাত না খেয়ে চলে যাও কেন? আজ ভাত খেয়ে যাবে।

মার কথা শুনে বাবা যেমন আশ্চর্য হলেন, আমিও হলাম। অনেকদিন পর এই প্রথম মা বোধহয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবার সঙ্গে কথা বললেন। আমার ধারণা, বাবাকে তিনি রাতে থেকে যেতে বলতেন। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলতে পারলেন না। সেই মা’র কী হলো? এমন মন খারাপ করে ফিরলেন কেন?

আমি মার দিকে তাকিয়ে কারণটা ধরতে চেষ্টা করলাম। একটা কারণ হতে পারে– মা সব ঠিকঠাক করার পর হঠাৎ ধরতে পেরেছেন– সবই অর্থহীন।

মা ডাকলেন, ফুলির মা!

ফুলির মা দরজা ধরে দাঁড়াল। তার এখন ধমক খাওয়ার কথা। দরজা ধরে দাঁড়ালেই মা ধমক দেন। কিন্তু আজ সে ধমক খেল না। মনে হচ্ছে সে যে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মা যেন এটা দেখতে পাচ্ছেন না। ফুলির মা বলল, আম্মা কী?

মা এই প্রশ্নে কেমন যেন বিব্রত হলেন। মনে হচ্ছে কেন ফুলির মাকে ডেকেছেন তা তিনি ভুলে গেছেন।

চা দিমু আম্মা?

না।

শীতল পানি দিমু?

আচ্ছা তুমি যাও।

ফুলির মা চলে গেল। একবার ভাবলাম মাকে জিজ্ঞেস করি তোমার কী হয়েছে মা? তারপর মনে হলো কেউ যখন খুব কষ্টে থাকে তখন প্রশ্ন করে কষ্টের ব্যাপারটা জানতে নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের উপর প্রলেপ পড়ে। তখন জিজ্ঞেস করা যায়। প্রলেপ বাড়ার আগেই কষ্টের ব্যাপার জানতে চাইলে কষ্টটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।

এই থিওরি আমার বাবার কাছ থেকে শোনা। বাবা থিওরি দেবার মধ্যে খুব ওস্তাদ। মার ধারণা অকর্মণ্য, অপদার্থ লোক থিওরি দেয়াতে ওস্তাদ হয়। এরা কাজ জানে না। থিওরি জানে। মা’র কথা সত্যি হলেও হতে পারে। আমি দেখেছি মার কথা সাধারণত সত্যি হয়। বাবার সাইনবোর্ড উল্টানোর গল্পটা শুনে মা বললেন– এটা মিথ্যা গল্প। বানিয়ে বানিয়ে বলছে। মার কথা শুনে আমার খুব রাগ হয়েছিল। গতকাল বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।

ঠিক করে বলো তো বাবা গল্পটা কি সত্যি? মা বলছে মিথ্যা গল্প।

এই গল্পের সত্যি-মিথ্যা তোর মা বলবে কীভাবে? সে তো সাইনবোর্ড বদলানোয় ছিল না।

তুমি তাহলে সাইনবোর্ড বদলেছ?

প্রায় আর কী!

প্রায় মানে কী?

এই জাতীয় একটা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল… হাতুড়ি, পেরেক সবই জোগাড় করা হলো…।

শেষপর্যন্ত আর বদলাও নি, তাই না?

হুঁ।

বাবার কথায় আমরা মনটা বেশ খারাপ হলো। মজার একটা ঘটনা বাবা ঘটিয়েছিলেন এটা ভেবে যে কতবার একা একা খিলখিল করে হেসেছি– আর কখনো হাসতে পারব না। মনে মনে ভাবা এককথা, আর সত্যিকার কাজটা করে ফেলা অন্যকথা। আমি তো কত কিছুই ভাবি কিন্তু কিছুই করি না। মানুষের করার ক্ষমতার চেয়ে ভাবার ক্ষমতা লক্ষগুণ বেশি।

.

মা আমার পাশে বসে আছেন। তিনি এখন নিশ্চয়ই আকাশ-পাতাল কত কী ভাবছেন। কী ভাবছেন তা জানতে ইচ্ছা করছে। মানুষ কী ভাবে তা জানার ব্যবস্থা থাকলে খুব ভালো হতো। ভাবনাটা যদি চোখের মণিতে ভেসে উঠত! সেটাও বোধহয় সম্ভব না। মানুষ একসঙ্গে দুটা-তিনটা ভাবনা ভাবতে পারে। চোখের মণিতে তো আর একসঙ্গে দুটা-তিনটা ছবি ভাসতে পারে না।

মা একটু নড়েচড়ে বসলেন, তারপর বললেন, নাতাশা, তোর বাবা এত সকাল সকাল চলে গেল কেন?

আমি জবাব দিলাম না। এই প্রশ্ন মা আমাকে করেন নি। নিজেকেই করেছেন। মানুষ নিজেকে সরাসরি প্রশ্ন করতে ভয় পায়। এইজন্যে বেশিরভাগ সময়ই নিজেকে করা প্রশ্ন অন্যকে করে। তবে অন্যের কাছে থেকে সে জবাব শুনতে চায় না। কেউ জবাব দিলে তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়।

আমার ধারণা, মা কোনো বড় সমস্যায় পড়ে গেছেন। এই সমস্যায় বাবা কোনো না কোনোভাবে জড়িত বলে বারবার তার বাবার কথা মনে পড়ছে।

মা উঠে দাঁড়ালেন এবং আজ সারাদিন আমি কেমন ছিলাম, আমার ব্যথা উঠেছিল কি-না তা না জিজ্ঞেস করেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার ঘরের দরজা বন্ধ করার ঘটনাটাও অনেকদিন পর প্রথম ঘটল। আমার অসুখের পর থেকে তিনি দরজা বন্ধ করেন না।

আজ আমার শরীর ভয়ঙ্কর রকম খারাপ করেছিল। সেই ভয়ঙ্কর যে কী রকম ভয়ঙ্কর তা আমি বাবা এবং ফুলির মা’র দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি। এরকম ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থা আমার বেশি হয় না। খুব কমই হয়। মা এটা এখনো দেখেন নি। কারণ যে ক’বার এই অবস্থা হলো– সে ক’বারই মা অফিসে। ব্যাপারটা জানল শুধু ফুলির মা। আমি তাকে বললাম, ফুলির মা, তুমি মা’কে এটা কখনো বলবে না। খবরদার। যদি তুমি মাকে বলে দাও তাহলে আমি কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব না। :

মা’কে ব্যাপারটা জানাতে চাই নি– কারণ মা’কে জানিয়ে কী হবে? শুধু শুধু তার কষ্ট লক্ষগুণ বাড়িয়ে দেয়া হবে। তিনি অফিস-টফিস সব ছেড়ে দিন-রাত আমার বিছানার পাশে বসে থাকবেন। এতে যদি আমার লাভ হতো আমি নিজেই মা’কে বলতাম। লাভ তো কিছু হতো না। বরং এই যে মা অফিসে যাচ্ছে এতেই আমার লাভ হচ্ছে। আমি আশায় আশায় সময়টা কাটাচ্ছি– মা কখন ফিরবে? ফিরলে কী কী গল্প করব?

মানুষ তার জীবনের আনন্দের গল্পগুলি অন্যকে জানাতে চায়। দুঃখ এবং কষ্টের কথা কাউকে জানাতে চায় না। আমিও আমার কষ্টের ব্যাপার কাউকে জানাতে চাই না। কাউকেই না। আমি আমার কষ্টের ব্যাপারগুলি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে চাই। মা নিজেও তো আমাকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে। যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে গেলাম তখন মা যে কী কাণ্ড করল! এক গাদা মিষ্টি কিনে নিয়ে এসে আমাকে বলল, চল রে নাতাশা, ফ্ল্যাট বাড়িগুলিতে মিষ্টি দিয়ে আসি।

কারো বাসায় যেতে আমার খুব খারাপ লাগে। তারপরেও মা’র উৎসাহ দেখে বললাম, চল যাই। মা সবকটা ফ্ল্যাটে গেলেন। কী আনন্দ নিয়েই না মেয়ের রেজাল্টের কথা বললেন! আমার রেজাল্টের কথা শুনে অন্যরা কে কী করছে তা আমি দেখলাম না আমি শুধু মুগ্ধচোখে মাকেই দেখছিলাম। মা আমাকে যখন ফোর-বি ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন তখন মজার একটা ব্যাপার হলো। ফোর-বি ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা (তার অনেক বয়স। প্রায় আমার নানিজানের কাছাকাছি) দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন– আরে নাতাশা, তুমি? আমি অবাক হলাম ভদ্রমহিলা আমার নাম জানেন দেখে। আমি তাকে কোনোদিন দেখিও নি। মা তাকে আমার রেজাল্টের কথা বললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা এমন হৈচৈ শুরু করলেন। প্রথমেই চিৎকার করে উঠলেন– ও আল্লা, ও আল্লা, এ কী কাণ্ড! এ কী কাণ্ড! তারপর ছুটে গেলেন টেলিফোন সেটের কাছে। তিনি টেলিফোনে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন। আমি আর মা শুনছি।

হ্যালো! শোন শোন, তুমি যে প্রায়ই বলতে আমাদের ফ্ল্যাট বাড়িতে একটা পাগলা মেয়ে আছে– বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা কথা বলে আর হাত নেড়ে নেড়ে বক্তৃতা দেয়– সেই মেয়ে আর তার মা এসেছে। এই তত দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। এই শোন, মেয়েটা ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছে।

আমার আনন্দের খবরটা মা ঘরে ঘরে গিয়ে দিয়ে এলেন। কিন্তু অসুখের ব্যাপারটা কাউকে বললেন না। অনেকে নিজ থেকে খবর পেয়ে দেখতে এলো, মা তাদের কাউকেই আমার কাছে আসতে দিলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কিছু মনে করবেন না, ওর কাছে যাওয়া ডাক্তারের নিষেধ আছে। কেউ ওকে দেখতে গেলে ও মনে কষ্ট পায়, সেটা ওর ক্ষতি করে। মার কঠিন নিষেধের জন্যে কেউ আর কাছে আসতে পারল না শুধু ঐ মহিলা আসতেন। মা যখন অফিসে তখন আসতেন। মা সেটা জেনে ফেলে একদিন খুব রাগারাগি করলেন। তারপরেও উনি আসতেন। আমার একটা হাত কোলে নিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যেতেন। কোনো গল্প না, কিছু না। গল্প আমি করতাম, উনি শুধু শুনতেন। উনি আমাকে খুব দামি একটা কলম আর একটা খাতা দিয়েছেন। এত সুন্দর খাতা আমি জন্মে দেখি নি। মলাটটা হালকা বেগুনি ভেলভেটের। খাতাটা হাতে নিলেই গালে ছোঁয়াতে ইচ্ছা করে। এখন পর্যন্ত ঐখাতায় আমি কিছু লিখি নি। আমি ঠিক করে রেখেছি আমেরিকা যাবার আগে সবার জন্যে ঐ খাতায় একটা করে চিঠি লিখে যাব। ফুলির মা’র জন্যেও লিখব।

আমার মৃত্যুর খবর এলে ফুলির মা কতটা কষ্ট পাবে তা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। মনে হয় খুব একটা পাবে না। বাবার এই ব্যাপারে একটা থিওরি আছে– আনন্দ পাবার ক্ষমতা যার যত বেশি, কষ্ট পাবার ক্ষমতাও তার তত বেশি।

ফুলির মা’র আনন্দ পাবার ক্ষমতা একেবারেই নেই। তাকে গত ঈদের আগের ঈদে মা খুব ভালো একটা শাড়ি কিনে দিল। অনেকদিন পর দেশে যাচ্ছে ভালো একটা শাড়ি পরে যাক। শুধু শাড়ি না শাড়ির সঙ্গে স্যান্ডেল, গায়ে দেয়ার একটা চাঁদর। তার সাতশ টাকা পাওনা হয়েছিল। মা তাকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, তোমার কাজকর্ম, চাল চলন, বিড়ি সিগারেট খাওয়া সবই অসহ্য; তারপরেও তুমি ছিলে বলে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমি চলে যাবার পর বাসাটা খালি খালি লাগবে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।

কথা বলতে গিয়ে মার গলা ধরে গেল, কিন্তু ফুলির মা নির্বিকার ভঙ্গিতে কর্কশ গলায় বলল, আমার নিজেরও ঘর-সংসার আছে। কইলেই আওন যায় না।

তাকে যে এত কিছু দেয়া হলো সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। যাবার সময় আমাকে বলে পর্যন্ত গেল না। নতুন শাড়ি, স্যান্ডেল পরে, গট গট করে রিকশায় গিয়ে উঠল। ফুলির মা চলে যাবার পর আমার তার জন্যে এত খারাপ লাগল যে আমি দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম।

এই যে ভালোবাসা আমি ফুলির মা’র প্রতি দেখালাম সে কি সেই ভালোবাসা ফেরত দেবে না? বাংলা আপার কথা অনুযায়ী দেয়া উচিত। মনে হয় সে আমার জন্যে কাঁদবে। তবে খুব অল্প সময়ের জন্যে কাঁদবে। আমার মনে আছে তার নিজের মেয়ে ফুলির মৃত্যুর খবর পেয়েও সে খুব অল্প সময়ের জন্যে কাঁদল। ‘ফুলিরে, ও ফুলি, ও ধন, ও আমার মানিকরে’ বলে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কেঁদে বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে বাথরুমে কাপড় ধুতে গেল। বাবা বললেন, ফুলির মা, থাক আজ কাপড় ধোয়ার দরকার নেই।

ফুলির মা রাগী গলায় বলল, কাম ফালাইয়া থুইয়া কোনো লাভ আছে? কাপড় ধুইব কে? আফনে ধুইবেন?

বাথরুমে কাপড় ধুতে ধুতে সে আরেকবার ‘ফুলিরে, ও ধন রে, ও আমার মানিকরে’ বলে চেঁচিয়ে উঠেই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। আর কোনোদিন তাকে ফুলির জন্যে কাঁদতে শুনি নি।

আমার জন্যেও সে হয়তো দুবার কাদবে। একবার মৃত্যুর খবর শুনে কাদবে। আরেকবার কোনো একটা কাজ করতে করতে কাদবে। তবে বেশিও কাঁদতে পারে। নিজের মেয়েকে সে তো কখনো কাছে পায় নি। আমাকে কাছে পেয়েছে। নিজের মেয়ের প্রতি তার যে ভালোবাসা ছিল তার সবটাই নিয়ে নিয়েছি আমি। আমার যখন সেই ভয়ঙ্কর মাথাব্যথাটা হয় ঘরে যখন সে আর আমি ছাড়া কেউ থাকে না তখন অসহ্য ব্যথা নিয়েও অবাক হয়ে ফুলির মা’র কাণ্ডকারখানা আমি দেখি। আমার বড় মায়া লাগে।

প্রথম কিছুক্ষণ সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চেহারা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্রুত তার ঠোঁট নড়তে থাকে। মনে হয় সে তখন কোনো দোয়া পড়তে থাকে। আমি বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকি, সে দরজা ধরে ছটফট করতে থাকে। একসময় ছুটে গিয়ে লাল কাপড়ে মোড়া কোরান শরীফ এনে আমার মাথায় চেপে ধরে, এবং কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে ও আল্লা, পাক কালামের দোহাই লাগে। ও আল্লা, পাক কালামের দোহাই লাগে।

আমার ব্যথা একসময় কমতে থাকে। ফুলির মা’র ধারণা কোরান শরীফ মাথায় চুঁইয়ে পাক কালামের দোহাই দেয়াতে ব্যথা কমেছে।

আজ পাক কালামের দোহাই-এও কাজ হয় নি। দুপুরে খাবার পর শুয়ে আছি। বাবা বললেন, টিয়া, আমাকে একটু জায়গা দে তো মা, তোর পাশে শুয়ে থাকি। আজ কেন জানি মারাত্মক ঘুম পাচ্ছে।

আমি বললাম, আমার বিছানায় কষ্ট করবে কেন। মা’র বড় বিছানায় আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাও।

বাবা বললেন, দরকার নেই। আমি ঘুমুচ্ছি, এর মধ্যে তোর মা যদি চলে আসে তাহলে ভয়ঙ্কর ব্যাপার শুরু হবে।

আমি বললাম, তোমাদের এইসব ঝামেলা কবে মিটবে বলো তো?

বাবা রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন, খুব শিগগির মিটবে। আমি এমন এক পরিকল্পনা করেছি না মিটে উপায় নেই।

পরিকল্পনাটা কী?

তোকে বলা যাবে না।

আমাকে বলল– আমি তোমাকে সাহায্য করব।

সাহায্য করবি?

হুঁ।

তোর মা’র সঙ্গে তোর যা খাতির পরে একদিন তুই তোর মা’কে ফাস করে দিবি- আমি পড়ব মহাযন্ত্রণায়।

কোনোদিন ফাঁস করব না বাবা।

তাহলে শোন…।

এই বলে যেই বাবা আমার পাশে বসলেন, ওমনি আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। তীব্র ভয়াবহ যন্ত্রণায় মাথা টুকরো টুকরো হবার জোগাড় হলো। মনে হচ্ছে সূর্যটা দুভাগ হয়ে আমার দুচোখে ঢুকে পড়েছে। আমি গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগলাম, আমার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে শুরু করল। ফুলির মা কোরান শরীফ হাতে ছুটে এসে বলতে লাগল আল্লাহ পাকের পাক কালামের দোহাই। আল্লাহ পাকের পাক কালামের দোহাই।

বাবা আমার পাশে বসেছিলেন। তিনি হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাত দিয়ে আমাকে ছুঁলেন না। তিনি থর থর করে কাঁপছেন। আমি গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললাম, বাবা তুমি চলে যাও। বাবা তুমি চলে যাও।

বাবা ছুটে দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। তারো অনেক অনেক পরে ব্যথা কমল। আমি তাকালাম ফুলির মা’র দিকে– ফুলির মা’র সারা শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছে। মনে হচ্ছে এই এক্ষুনি সে বুঝি গোসল সেরে ফিরল।

আমি হাসিমুখে বললাম, বুয়া ঠাণ্ডা পানি খাব।

ফুলির মা পানি আনতে যাচ্ছে। সে ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। আজ বেচারির উপর দিয়ে খুব বড় ঝড় গেছে।

বাবার উপর দিয়েও ঝড় গেছে। বেচারা বাবা– কী ভয়ঙ্কর কষ্টই না পেয়েছে। ভয়ঙ্কর কষ্ট না পেলে এই অবস্থায় মেয়েকে ফেলে কেউ পালিয়ে যায়?

বাবা সে-রাতে আর ফিরলেন না। পরদিন নটার দিকে এলেন। গতদিনের অসুখ নিয়ে আমি এবং বাবা দুজনেই কেউ কোনো কথা বললাম না। দুজনই এমন ভাব করলাম যেন গতদিন কী ঘটেছিল আমরা ভুলে গেছি।

বাবার পরিকল্পনা শুনলাম। খুব হাস্যকর পরিকল্পনা, তবে আমার মনে হচ্ছে কাজ করবে। পরিকল্পনা কাজ করার জন্যে ঝড়বৃষ্টি দরকার এবং ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া দরকার। ঝড় যদি নাও হয় ভালো বৃষ্টি হলেও চলবে, তবে ইলেকট্রিসিটি চলে যেতে হবে। পুরো ঢাকা শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে যাবার দরকার নেই আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ির ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেই হবে। এই সমস্যার সমাধান ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকারকে দিয়ে করানো যায়। তাকে চা-টা খাবার জন্যে কিছু টাকা দিলেই সে নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের জন্যে মেইন সুইচ অফ করে রাখবে। এখন অপেক্ষা শুধু বৃষ্টির।

বাবা বললেন, আজ আকাশের অবস্থা বেশি সুবিধার না। মনে হচ্ছে আজই বৃষ্টি হবে। একসাথে নেমে পড়া যাক কী বলিস।

আমি বললাম, হুঁ।

ফুলির মাকে দলে টানতে হবে। নয়তো সে ফাঁস করে দেবে।

ফুলির মাকে নিয়ে ভয় নেই বাবা। আমি ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠিক করে রাখব।

বাবা চলে গেলেন মোমবাতি এবং মোটা দড়ি কিনতে। এই পরিকল্পনায় খুব শক্ত এবং মোটা দশ গজের মতো দড়ি লাগে। মোমবাতি লাগে।

আমি উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছি। মাঝে মাঝেই জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি আর ভাবছি- ইস, আকাশটা যদি আরেকটু কালো হতো

বাবা দড়ি-টড়ি নিয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মা অফিস থেকে ফিরলেন। বাবাকে সবকিছু তড়িঘড়ি করে আমার খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলতে হলো।

বাবা বললেন, আজ টিকিট কাটার কথা ছিল না? কেটেছ?

মা জবাব দিলেন না। কঠিন এবং রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই ভয়ঙ্কর, কুৎসিত এবং নোংরা ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল।

আমার ব্যথার এই তীব্রতা মা আগে কখনো দেখেন নি। এই প্রথম দেখেছেন। তিনিও বাবার মতোই করলেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। আমি বললাম, মা, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থেকো না। তুমি চলে যাও। চলে যাও।

বাবা যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিলেন, মাও ঠিক সেই ভাবেই পালিয়ে গেলেন। কোরান শরীফ নিয়ে দৌড়ে এলো ফুলির মা। আর তখন ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল। শুধু যে বৃষ্টি তা না– বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ও শুরু হলো।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ