আজ ভিসা হলো। সবচে’ কঠিন অংশটাই বোধহয় সবচে’ সহজে হলো। ভিসা অফিসার আমেরিকান। তাঁর চোখমুখ কঠিন। ভুরু সবসময় কুঁচকানো। কিন্তু তিনি দিলশাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চমৎকার বাংলায় বললেন, বিকাল তিনটার পর এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন।

দিলশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ভিসা কি হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ভিসা অফিসার আবারো হাসলেন। সেই হাসি দেখে দিলশাদের চোখ ভিজে ওঠার উপক্রম হলো। কিছুদিন হলো এটা হয়েছে। কেউ মমতা নিয়ে কিছু বললেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সেদিন অফিসে তার বস রহমান সাহেব তার কামরায় ডেকে পাঠালেন। দিলশাদ ভাবল কঠিন কিছু কথাবার্তা তাকে শুনতে হবে। সে দিনের পর দিন অফিস কামাই করছে। ছুটি নিচ্ছে না। ছুটি জমা করে রাখছে। কতদিন আমেরিকা থাকতে হয় কে জানে। সে রহমান সাহেবের ঘরে ঢুকল ভয়ে ভয়ে। প্রায় ফিস ফিস করে বলল, স্যার ডেকেছেন?

রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যা, বসুন। দিলশাদ ভয়ে ভয়ে বসল। রহমান সাহেব বললেন, আপনাকে কোনো কাজে ডাকি নি। আমার সাথে কফি খাওয়ার জন্য ডেকেছি। আপনি সারাক্ষণ এত টেনশনের ভেতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন দেখে মায়া লাগে। এত চিন্তিত হবেন না। যা হবার হবে। নিন, কফি খান আর শুনুন। আপনার মেয়েকে নিয়ে যদি কোথাও যাবার দরকার হয় আপনি অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি ট্রান্সপোর্ট সেকশানকে বলে দিয়েছি। অফিস টাইমের বাইরেও যদি গাড়ি লাগে, আমাকে বলবেন। আমার ড্রাইভার আছে, গাড়ি পাঠিয়ে দেব।

দিলশাদ বলল, থ্যাংক য়্যু স্যার। বলতে বলতেই সে লক্ষ করল, তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। সে নিশ্চিত, রহমান সাহেব আর একটা কোনো মমতার কথা বললে সে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলবে। ভাগ্যিস তিনি আর কোনো কথা বলেন নি। গম্ভীর মুখে কফির কাপে চুমুক দিয়েছেন। সেও কফি খেয়েছে একবারও তার দিকে না তাকিয়ে।

আজ আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে সে এসেছে অফিসের গাড়ি নিয়ে। গাড়ি ছাড়া উপায় কী? নাতাশাকে আনতে হয়েছে।

নাতাশা এখন ওয়েটিংরুমে তার বাবার কাঁধে হেলান দিয়ে বসে আছে। নাতাশাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে বরং কৌতূহলী হয়ে ভিসাপ্রার্থীদের শুকনো মুখ দেখছে। কিন্তু সাজ্জাদকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। দিলশাদ সামনে এসে দাঁড়াতেই সাজ্জাদ বলল, ভিসা হয়েছে?

দিলশাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হুঁ।

আমাকেও দিয়েছে?

হুঁ।

থ্যাংক গড।

বিকেল তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে বলল।

দিলশাদ হাত ধরে মেয়েকে তুলল।

নাতাশা বলল, তুমি শুধু আমার হাতটা ধর মা। আমি নিজে নিজে হাঁটতে পারব।

নাতাশা হাঁটতে পারছিল না। এলোমেলো পা ফেলছে। ভিসাপ্রার্থীরা সবাই এখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের চোখে করুণা। নাতাশার খুব লজ্জা লাগছে। মানুষের করুণা গ্রহণ করার মতো লজ্জা আর কিছুতেই নেই।

সাজ্জাদের ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করার কোনোরকম ইচ্ছা দিলশাদের ছিল না। দুজনের যাবার টাকাই জোগাড় হচ্ছে না, ততীয় জন কীভাবে যাবে। সাজ্জাদ করুণ গলায় বলেছে– আমি যাব না, শুধু ভিসাটা করিয়ে রাখি।

যাবে না, তাহলে ভিসা করে রাখবে কী জন্যে?

শেষ মুহূর্তে যদি কিছু টাকা যোগাড় হয়ে যায়।

কোত্থেকে জোগাড় হবে? আলাদিনের চেরাগের কোনো সন্ধান পেয়েছ?

তা না। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু করিম জার্মানিতে আছে। ওর ঠিকানা জোগাড় করার চেষ্টা করছি। ও জানতে পারলে আমাকে টিকিট পাঠিয়ে দিবে।

টিকিট পাঠানোর দরকার নেই। উনাকে টাকা পাঠাতে বলল। টাকা কিছুই জোগাড় হয় নি।

সাজ্জাদ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, নাতাশার চিকিৎসার সব খরচ দেয়ার পরেও যদি কিছু থাকে তাহলেই আমি যাব।

তোমার এত আগ্রহ কেন? ঐ দেশে মদ সস্তা, এইজন্যে?

সাজ্জাদের কিছু কঠিন কথা মুখে এসে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলেছে। কী হবে কঠিন কথা বলে? কঠিন কথা তোলা থাকুক। কোনো এক সময় বলা যাবে। সাজ্জাদ নিজের পাসপোর্ট করিয়েছে এবং দিলশাদের সঙ্গে ভিসার জন্য পাঠিয়েছে। দিলশাদ মুখ কঠিন করে রেখেছে। মেয়ের কথা ভেবেই হয়তো কিছু বলে নি।

ভিসা পেয়ে দিলশাদের ভালো লাগছে। ভিসা পাওয়া যাবে না এরকম সন্দেহ কয়েকদিন থেকেই তার হচ্ছিল। তাছাড়া যার সঙ্গে দেখা হয়েছে সে-ই বলেছে– আমেরিকান ভিসা? অসম্ভব। ওরা ভিসা দেবে না। কিছুতেই না।

দিলশাদ বলেছে, না দেয়ার কী আছে? আমরা ঐ দেশে বাস করার জন্যে যাচ্ছি না, চিকিৎসার জন্যে যাচ্ছি।

অন্যের চিকিৎসা নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই। চিকিৎসা হলেই কী আর হলেই কী?

ভিসা অফিসাররাও তো মানুষ।

আমেরিকান ভিসা অফিসার মানুষ তোমাকে কে বলল? ভিসা অফিসার হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়ার আগেই অপারেশন করে ওদের মাথায় কম্পিউটার বসিয়ে দেয়। ওরা হলো যন্ত্র। যন্ত্রের বেশি কিছু না। তোমার যাবতীয় কাগজপত্র উল্টে-পাল্টে দেখবে। তারপর শুকনো গলায় বলবে, সরি! নো।

ব্যাপার তা হয় নি। দিলশাদ যে-রকম চেয়েছে সেরকমই হয়েছে। শেষপর্যন্তও তাই হবে। সে তার মেয়েকে নিয়ে ভর্তি করাবে জন্স হপকিন্সে। পৃথিবীর সেরা সব ডাক্তার দিয়ে মেয়েকে পরীক্ষা করাবে। অপারেশন হবে এবং তার মেয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবে। মেডিকেল সায়েন্স অনেকদূর এগিয়ে গেছে। যারা এই বিজ্ঞানকে এতদূরে নিয়ে গেছেন দিলশাদ তাদের হাতেই মেয়েকে তুলে দেবে।

মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে সে কী করবে? প্রথমেই একমাসের ছুটি নেবে। এই একমাস দরজা বন্ধ করে শুধুই ঘুমুবে। এমনিতে ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুবে। তার শরীর-মন অসম্ভব ক্লান্ত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে ক্লান্তি দূর করবে।

নাতাশা গাড়িতে উঠেই বলল, মা’র অফিসের এই গাড়িটা খুব সুন্দর, তাই না বাবা?

সাজ্জাদ বলল, হ্যাঁ।

তোমার যদি কোনোদিন টাকা হয় এরকম একটা গাড়ি কিনো তো।

আচ্ছা মা কিনব। অবশ্যই কিনব।

দিলশাদ তিক্ত গলায় বলল, একটা খেলনা গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই, সে কিনবে পাজেরো। প্রমিজ করতেও লজ্জা লাগা উচিত।

নাতাশা মার দিকে তাকাল। সে মনে হয় বাবার পক্ষে কিছু বলতে যাচ্ছিল– বলল না। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

সাজ্জাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মার অফিসের এই চমৎকার গাড়িতে করে শহরে কয়েকটা চক্কর দিলে কেমন হয়?

নাতাশা বলল, ভালো হয় বাবা, খুব ভালো হয়।

দিলশাদ বলল, ভালো হলেও চক্কর দেয়া যাবে না। গাড়ি অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমার অফিসে কাজ আছে। আমি অফিসে গাড়ি নিয়ে চলে যাব।

মা, তাহলে আমরা রিকশা নিয়ে একটু ঘুরি?

না। প্রচণ্ড রোদ। মাথায় রোদ লাগবে।

.

মেয়েকে রোদে ঘুরতে না দিলেও দিলশাদ নিজে অনেকক্ষণ একা একা রিকশা নিয়ে। ঘুরল। ভিসা হাতে পেয়ে তার খুব আনন্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মেয়ের সুস্থ হয়ে ওঠার প্রথম ধাপটি শেষ হয়েছে। এই তো পাসপোর্টে ছমাসের ভিসার সিল মারা। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যা শুরু হয় তা শেষও হয়। একদিন এই প্রক্রিয়া শেষ হবে।

আনন্দিত মানুষ নিজের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে চায়। আনন্দের খবর সবাইকে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে। দিলশাদের পরিচিত জনের সংখ্যা সীমিত। সেই সীমিত সংখ্যক মানুষদের ঘরে ঘরে খবরটা পৌঁছাতে ইচ্ছা করছে। দিলশাদ প্রথম গেল কলাবাগানে তার মার কাছে।

হাদিউজ্জামান সাহেব বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তার পীর সাহেবের কাছে গিয়েছেন। মনোয়ারারও যাবার কথা ছিল। দাঁতের ব্যথার কারণে তিনি যান নি। দুদিন ধরে তিনি দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। আজ সেই ব্যথা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। গাল ফুলে একাকার।

দিলশাদ বলল, তোমার অবস্থা তো মা ভয়াবহ! তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

মনোয়ারা হাসলেন। দিলশাদ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই অবস্থায় তুমি হাসছ কী করে মা?

মনোয়ারা বললেন, অনেকদিন পর তুই হাসিমুখে ঘরে ঢুকেছিস। তোর হাসিমুখ দেখে হাসলাম রে মা। আজ তোর মনটা খুশি কেন?

আজ ভিসা হয়েছে। ভিসা নিয়ে একটা দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল– দেয় কি দেয় না। সেই দুঃশ্চিন্তা দূর হয়েছে। এখন টিকিট কাটব।

আলহামদুলিল্লাহ। আয় আমার সঙ্গে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়।

থাক মা।

থাকবে কেন, আয়।

আমি অফিসের কাপড় পরে আছি। তেমন পরিস্কার নেই।

আমি পরিষ্কার শাড়ি দিচ্ছি। আয় তো মা। এখন থেকে বুঝলি মা, প্রতি পদে পদে আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করে এগুবি দেখবি কোনো সমস্যা হবে না।

দিলশাদকে তার মা’র সঙ্গে নামাজ পড়তে হলো। অনেকদিন পর নামাজে দাঁড়িয়ে তার লজ্জা লজ্জা করছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছে এই বুঝি ভুল করবে। রুকুতে গিয়ে সিজদার দোয়া পড়ে ফেলবে।

নামাজের শেষে মনোয়ারা বললেন, মা আয়, দুজনে একসঙ্গে আল্লাহর কাছে দোয়া করি। হাত তোল। দুই মা একসঙ্গে আল্লাহর কাছে হাত তুলছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। মা’দের ব্যাপারে আল্লাহপাকের দুর্বলতা আছে।

দিলশাদ হাত তুলল। মনোয়ারা বেগম প্রার্থনা শুরু করলেন। তাঁর গলার স্বর নিচু কিন্তু প্রতিটি বাক্য স্পষ্ট।

হে পরম করুণাময়। তুমি করুণা কর। অবোধ নিষ্পাপ শিশুকে তুমি ভয়াবহ ব্যাধি দিয়েছ। কেন দিয়েছ তা তুমিই জানো। আমরা অতি ক্ষুদ্র মানুষ তোমার, কাজ বোঝার সাধ্য আমাদের নাই। বোঝার চেষ্টাও করব না। শুধু আমরা আমাদের মনের কষ্টের কথা তোমাকে জানাই। তুমি কষ্ট দূর কর আল্লাহপাক। ছোট্ট শিশুটাকে মুক্ত করে দাও।…

মনোয়ারা বেগম দোয়া করছেন। দিলশাদের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এমন ব্যাকুল হয়ে সে অনেকদিন কাঁদে নি। প্রাণভরে কাঁদার কারণেই হয়তো দিলশাদের মন খুব হালকা হয়ে গেল। নিজেকে তার এখন কিশোরী মেয়ের মতো লাগছে। বিয়ের আগে সে যেমন মাকে জড়িয়ে ধরে হৈচৈ চেঁচামেচি করত আজও সেরকম করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

দিলশাদ বলল, মা, তুমি আজ রাতে ভালো কিছু রান্না কর তো, আমি তোমার এখানে খাব।

কী খাবি বল?

তুমি যে কুচি কুচি করে ডিম দিয়ে আলু ভাজি কর ঐটা খাব।

শুধু আলু ভাজি? সঙ্গে আর কী খাবি?

তোমার দাঁতের যে অবস্থা– এই নিয়ে রাঁধবে কীভাবে? বরং আমাকে বলে দাও আমি রাধি।

দাঁতের ব্যথাটা এখন অনেক কমে গেছে। বুঝতে পারছি না কারণটা কী। তুই এরকম আরো কিছুক্ষণ হাসিমুখে থাকলে ব্যথাটা মনে হয় পুরোপুরি চলে যাবে।

মনোয়ারা হাসলেন। দিলশাদ বলল, তোমার বাগানে বসে চা খাব মা। চা বানিয়ে আন। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে, তাই না মা?

আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতেও পারে।

বৃষ্টি হলে তোমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজব। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তোমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম। মনে আছে মা?

হুঁ, মনে আছে।

যতবার বৃষ্টিতে ভিজতাম ততবারই বড় আপার ঠাণ্ডা লেগে গলা-টলা ফুলে বিশ্রী অবস্থা হতো।

মনোয়ারা হাসতে হাসতে বললেন, তোর বড় আপার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এখন বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না। বৃষ্টি হচ্ছে এই শব্দ শুনলেই তার ঠাণ্ডা লেগে গলা ফুলে যায়। ব্যাঙের ডাক শুনলেও বোধহয় তার এখন ঠাণ্ডা লেগে গলা ফোলে।

দিলশাদ খিল খিল করে হাসছে। মনোয়ারা মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি অনেকদিন পর তার অতি আদরের এই মেয়েটিকে এমন প্রাণ খুলে হাসতে দেখলেন।

মনোয়ারা তার এই বাগান নিজের হাতে করেছেন। বাগানের যে শৃঙ্খলা থাকে এখানে তা অনুপস্থিত। মনোয়ারা যেখানে যে গাছ পেয়েছেন লাগিয়েছেন। সম্প্রতি আঙুরের লতা লাগানো হয়েছে। লতা অনেকদুর উঠেছে। মাচা বেঁধে দিতে হয়েছে। একটা পানগাছ আগেই ছিল। সেই পানগাছ মানকচুর পাতার মতো বিশাল পাতা ছেড়েছে। বরই গাছ আছে, নারকেলি বরই। একবার এই বরই খেয়ে খুব ভালো লেগেছিল। কয়েকটা বিচি নিজের হাতে পুঁতে দিলেন। একটি থেকে চারা বের হয়েছে। সেই চারা লক লক করে বাড়ছে। কাজি পেয়ারার কয়েকটা গাছ আছে– এখনো ফল ধরে নি। তার খুব শখ জলপদ্ম লাগানোর। ছোট্ট বাগানে আর জায়গা নেই- তবু তিনি মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রেখেছেন। জায়গাটা খুঁড়ে জলাশয়ের মতো করে জলপদ্ম লাগাবেন। হাদিউজ্জামান সাহেবের ভয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করতে পারছেন না।

দিলশাদ পানগাছের পাশে দাঁড়িয়েছিল। খুঁটি বেয়ে এই গাছ অনেকদূর উঠে গেছে। মনোয়ারা চা হাতে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। দিলশাদ বলল, এটাই কি তোমার সেই বিখ্যাত পানগাছ?

হুঁ।

রাক্ষুসী পান বলে মনে হচ্ছে। এত বড় পাতা!

পাতাগুলি বেশি বড় হচ্ছে। এত বড় হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।

খেয়ে দেখেছ?

হুঁ। আমি তো এখন এই পানই খাই।

খেতে কেমন মা?

খেতে ভালোই, একটু কষটা কষটা।

আমাকে একটু দিও তো তোমার রাক্ষুসী পান, খেয়ে দেখব।

দিলশাদ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসল। মনোয়ারা বসলেন মেয়ের পাশে।

তোর টাকা কী পরিমাণ জোগাড় হয়েছে রে দিলু?

হয় নি।

হয় নি! তাহলে এত নিশ্চিত আছিস কীভাবে?

নিশ্চিত তোমাকে কে বলল মা?

তোকে দেখে কেমন নিশ্চিত মনে হচ্ছে।

আমার কাছে এই মুহূর্তে তিন লাখ টাকার সামান্য বেশি আছে। বড় দুলাভাই তিন দেবেন। তাঁকে খুব ধরব যেন আরো এক বেশি দেন। কত হলো? সাত? আপাতত আমি এই নিয়ে রওনা হব।

আরো তো লাগবে।

হ্যাঁ লাগবে। আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী রীতা আছে মেরিল্যান্ডে। ওকে চিঠি লিখেছি। ও আমার থাকার ব্যবস্থা করবে। ও বলেছে আমেরিকায় অনেক বাংলাদেশী আছে। তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলবে। আগেও কয়েকবার এরকম তোলা হয়েছে। বিদেশে যেসব বাঙালি থাকেন, তাদের মন যে-কোনো কারণেই হোক—উদার হয়। ফেলো ফিলিংস থাকে। সমস্যা হবে না মা।

ইনশাল্লাহ্ বল দিলু। সমস্যা হবে না এ জাতীয় কথা কখনো বলবি না। সবসময় বলবি ইনশাল্লাহ সমস্যা হবে না।

দিলশাদ বলল, ইনশাল্লাহ সমস্যা হবে না।

মনোয়ারা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে এক হাত মেয়ের কাঁধে রেখে বললেন তোর জন্যে আমি কিছু টাকা রেখেছি।

দিলশাদ চমকে উঠে বলল, তুমি?

আমি তোকে বলেছিলাম না যেভাবেই হোক তোকে এক লাখ টাকা জোগাড় করে দেব।

বাবা তো দু লাখ টাকা দিয়েছেন।

তোর বাবারটা তোর বাবার। আমারটা আমার।

তুমি পেলে কোথায় এত টাকা?

তোর বাবার সবসময় ধারণা সে আমার আগে মারা যাবে— তখন আমি টাকা পয়সার সমস্যায় পড়ে যাব। আমার যাতে সমস্যা না হয় সেজন্যে সে পোস্টাফিসে পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখেছিল। ঐটা বেড়ে বেড়ে এখন এক লাখ হয়েছে।

সেই টাকা আমাকে দিয়ে দেবে?

হ্যাঁ, শুধু তোর বাবা না জানলেই হলো।

মনোয়ারা এখনো মেয়ের পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নেন নি। এখনো হাত দিয়ে রেখেছেন।

টাকাটা কি এখন নিবি দিলু? আমি উঠিয়ে রেখেছি।

দাও, এখনি দাও।

এতগুলি টাকা তুই একা নিয়ে যাবি?

কিছু হবে না। ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব। আজকাল হাইজ্যাকাররা মেয়েদের ভ্যানেটি ব্যাগ নেয় না। তারা জানে মেয়েরা অনেক সাবধান। ভ্যানিটি ব্যাগ হাইজ্যাক করে কিছু পাওয়া যাবে না। হাইজ্যাকাররা অনেকবার ‘ঠক খেয়েছে।

পাঁচশ টাকার দুটা বান্ডিল ভ্যানিটি ব্যাগে ভরতে ভরতে দিলু বলল, মা আমি চলোম।

সে-কী! তুই না বললি ভাত খাবি।

অনেক দেরি হয়ে যাবে মা। তাছাড়া আজ আমার দিনটা খুব লাকি। ভিসা হলো, তারপর হঠাৎ করে তোমার কাছ থেকে এতগুলি টাকা পেলাম। লাকি দিনটা এখানে বসে বসে নষ্ট করব না।

কী করবি?

বড় দুলাভাইকে ধরে আজই টাকার ব্যবস্থা করব। আমার মনে হচ্ছে আজ গেলে উনার টাকাটাও পাওয়া যাবে। আবার ইনশাল্লাহ বলতে ভুলে গেছি। ইনশাল্লাহ্।

এখন তার কাছে যাবি?

হুঁ।

সে নাকি আলাদা থাকে? ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। কী সব কাণ্ডকারখানা যে হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

তোমার কোনো মেয়েরই স্বামীভাগ্য ভালো না মা।

মনোয়ারা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার মেয়েগুলিরও তো দায়িত্ব আছে। মেয়েরা তাদের দায়িত্ব দেখবে না। শুধু পরের ছেলেদের দোষ দেবে এটা ঠিক না।

তুমি এক অদ্ভুত মহিলা মা– শুধু নিজেদের দোষ দেখবে, অন্যদের দোষ দেখবে না। আগের যুগের জন্যে তুমি ঠিক আছ, এই যুগের জন্যে তুমি মা ঠিক না।

যে ঠিক সে সব যুগের জন্যেই ঠিক।

তুমি তর্ক করো না তো মা। আমার সঙ্গে তুমি তর্কে পারবে না। শুধু শুধু তর্ক করতে এসো না।

আচ্ছা যা তর্ক করব না।

আমার মেয়েকে তুমি দেখতে আস না কেন?

আছে একটা কারণ।

সেই কারণটা কী শুনি।

আমি আর তোর বাবা মিলে একটা খতম পড়ছি। খতম শেষ হলে দুজন একসঙ্গে গিয়ে তোর মেয়েকে দেখে আসব আর দোয়া করে আসব।

খতম শেষ হবে কবে?

লাগবে কয়েকদিন।

বাবার ঐ পীর যন্ত্রণা করছে, তাই না মা? তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়েও ভণ্ড পীরকে সহ্য করে যাচ্ছ। আশ্চর্য!

পীর ভণ্ড হতে পারে। কিন্তু আমরা তো পড়ছি আল্লাহপাকের কালাম। সেখানে তো মা কোনো ভণ্ডামি আমরা করছি না।

যা ইচ্ছা কর। মা আমি যাই।

আচ্ছা মা যা। টাকাটা সাবধান।

তুমি নিশ্চিত থাক তো মা। কেউ আমার এই টাকা নিতে পারবে না। টাকাগুলির মধ্যে আমার মেয়ের জীবন। কারো সাধ্য নেই কোনো মা’র কাছ থেকে মেয়ের জীবন ছিনিয়ে নেয়।

তুই কি এখন তোর বড় দুলাভাইয়ের কাছে যাচ্ছিস?

হ্যাঁ।

ওর নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানা জানিস?

হুঁ।

ওকে বলিস তো আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে।

বলব।

দু-একদিনের মধ্যেই যেন দেখা করে।

বলব। মা যাই?

আচ্ছা মা যা। খোদা হাফেজ মা।

.

ধানমণ্ডির এই ফ্ল্যাট বাড়িটি খুব আধুনিক। মাত্র চারতলা উঁচু ফ্ল্যাট। কিন্তু লিফট আছে দুটি। এন্ট্রির লবি পুরোটাই শ্বেতপাথরের। ধুলোমাখা জুতা পায়ে পাথরের লবীতে উঠতেও সংকোচ লাগে। মেয়ে রিসিপসনিস্ট কোনো ফ্ল্যাট বাড়িতে এখনো দেখা যায় না। এই বাড়িতে আছে। চশমাপরা ধারালো চেহারার মেয়ে। দিলশাদকে দেখে সে শুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, ম্যাডাম, আপনি কোথায় যাবেন?

দিলশাদ ওয়াদুদুর রহমানের নাম বলল। ফ্ল্যাট নাম্বার থ্রি-সি।

আপনার কি আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?

জি-না।

স্যার ফ্ল্যাটেই আছেন। আমি একটু কথা বলে দেখি। আপনার কী নাম বলব?

বলুন দিলশাদ।

রিসিপসনিস্ট মেয়েটি ইন্টারকমে নিচু গলায় কিছুক্ষণ কথা বলেই রিসিভার দিলশাদের দিকে এগিয়ে দিল–স্যার লাইনে আছেন। কথা বলুন।

দিলশাদ রিসিভার হাতে নিল।

হ্যালো দিলশাদ।

জি দুলাভাই।

তুমি এসেছ খুব ভালো হয়েছে। মনে মনে তোমাকে এক্সপেক্ট করছিলাম।

তাই বুঝি?

অফকোর্স তাই। চলে এসো। লিফটে করে চারতলায়। ফ্ল্যাট বাড়ি কেমন দেখছ?

ফ্ল্যাটবাড়ি দেখলাম কোথায়? শুধু তো লবি দেখছি।

লবি কেমন সেটাই বলো।

অসাধারণ! একেবারে ইন্দ্রপুরী।

দিলশাদ তার দুলাভাইয়ের তৃপ্তির হাসি শুনল। হাসিটা একটু অস্বাভাবিক শুনাল– যদিও অস্বাভাবিক শুনানোর কোনো কারণ নেই।

ওয়াদুদুর রহমানের পরনে লুঙ্গি খালি গা। দিলশাদ কলিংবেলে হাত রাখার আগেই দরজা খুলে ওয়াদুদুর রহমান বলল, সুস্বাগতম।

দিলশাদ বলল, জুতা বাইরে রেখে ঢুকব, না জুতা পায়ে ঢুকব? যে অপূর্ব ফ্ল্যাট, জুতা পায়ে ঢুকতে সাহস হচ্ছে না।

ওয়াদুদুর রহমান খুশি খুশি গলায় বলল, ঢং করবে না দিলু। এসো এসো, ঘরে পা দাও।

সে দিলুর হাত ধরে ভেতরে টেনে নিল। দিলু একটু সংকোচিত বোধ করছে। দিলু ঢুকতে যাচ্ছে, তাকে হাত ধরে টানাটানির প্রয়োজন ছিল না।

ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কেমন দেখছ?

খুব সুন্দর। শুধু এই সুন্দরের ভেতর লুঙ্গি পরা খালি গায়ে আপনাকে মানাচ্ছে না। বাংলা ছবির বিত্তবান বাবাদের মতো আপনার গায়ে থাকা উচিত ছিল রোব টোব জাতীয় কিছু। ফ্ল্যাটে আপনি একা?

অবশ্যই আমি একা একা থাকার জন্যে ফ্ল্যাট কিনেছি। পর্বত পাশে নিয়ে ঘুমানোনার জন্যে ফ্ল্যাট কিনি নি।

আপা এই ফ্ল্যাট দেখে নি?

কোত্থেকে দেখবে? ইচ্ছে করলেও তো ঢুকতে পারবে না। গেটেই আটকে দেবে। তাছাড়া তার যে সাইজ হয়েছে, লিফটের দরজা দিয়েও সে ঢুকবে না। ধাক্কাধাক্কি করে ঢোকাতে হবে। কার ঠেকা পড়েছে তাকে ধাক্কাধাক্কি করার? ফরগেট ইওর বড় আপা, তুমি আমার সঙ্গে এসো ফ্ল্যাটটা আগে ভালোমতো দেখাই–গাইডেড ট্যুর। আসলেই দর্শনীয়। প্রথম কী দেখবে? কিচেন?

যা দেখাবেন তাই দেখব।

দিলু কিচেন দেখে মুগ্ধ গলায় বলল, কিচেনেও কি এয়ারকুলার লাগিয়েছেন না কি?

ওটা এয়ারকুলার না দিলু। রান্নার ধোয়া শুষে নেবার ব্যবস্থা।

টেবিলটা কি শ্বেতপাথরের দুলাভাই?

হ্যাঁ শ্বেতপাথরের। রান্নাঘরে বসে যেন দুজন খেতে পারে সেই ব্যবস্থা। কিচেনে টেবিল থাকলে ফরম্যাল ডাইনিং রুমে যাবার দরকার হয় না।

আপাকে তো আনছেন না– দুজন পাচ্ছেন কোথায়?

এই তো তোমাকে পেলাম। আজ এই শ্বেতপাথরের টেবিল উদ্বোধন করব। দুজন এখানে ডিনার করব। কী খেতে চাও বলো– ইন্টারকমে খবর দিয়ে দেব। ওরা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসবে। এখন এসো তোমাকে মাস্টার টয়লেট দেখাব। দর্শনীয়। গোল একটা বাথটাব ফিট করা হয়েছে। বাথটাবটার ডিজাইন এমন যে দুজন গোসল করতে পারে। বিদেশীদের আইডিয়া কত সুন্দর দেখ। এরা জানে জীবনকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়। আমরা শুধু টাকা রোজগার করতেই জানি, খরচ করতে জানি না।

আপনি তো মনে হয় খরচ করতেও জানেন।

আমি এখনো জানি না। তবে আমি শিখছি। বাচব আর কতদিন, মরে গেলেই তো সব শেষ। ঠিক না? বাথরুমটা পছন্দ হয়েছে?

খুব সুন্দর।

এসো বারান্দা দেখাই। তোমার মনে হতে পারে আর্কিটেক্ট জায়গা নষ্ট করেছে- আসলে তা না। বারান্দাটাই বাড়ির বিউটি। দুজনে বসার জন্যে লো হাইট সোফা রাখা হয়েছে বারান্দায়। বারান্দায় বসে বসে চাঁদের আলো দেখবে– হাতে থাকবে মিষ্টি শেরির গ্লাস, ক্যাসেটে বাজবে সিম্ফোনি– দ্যাটস লাইফ। ঠিক না?

বুঝতে পারছি না। হয়তো ঠিক।

এসো বারান্দায় বসি, না চল শোবার ঘরে চল–এই একটি ঘরেই এসি আছে। একবার ভেবেছিলাম শোবার ঘরে ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট দেব। তারপর মনে হলো গরমের দেশে কার্পেট ভালো লাগবে না। ঝকঝকে হোয়াইট সিমেন্টই ভালো। এখন কী দেব বলো? চা, না ঠাণ্ডা কিছু?

দুলাভাই আজ সারাদিন আমি বাইরে, জরুরি কিছু কথা বলে চলে যাব।

বলো তোমার জরুরি কথা।

আজ ভিসা পেয়েছি।

একসেলেন্ট। আসল হার্ভেল হচ্ছে ভিসা।

ঠিক করেছি পরশু টিকিট কাটব।

পরশু কেন? হোয়াই নট টুমরো? আমার এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সি আছে। এরা কোনোরকম কমিশন না কেটে টিকিট দেবে। হাজার দশেক টাকা সেভ করতে পারবে।

থ্যাংক য়্যু দুলাভাই। তারচে’ আমার যেটা বেশি দরকার তা হচ্ছে…।

আমি তোমাকে যে টাকা প্রমিস করেছিলাম সেটা তো?

জি।

আজ তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কারেন্ট অ্যাকাউন্টের চেক বই এইখানেই আছে। আমি এক্ষুনি চেক লিখে দিচ্ছি। যেহেতু কারেন্ট অ্যাকাউন্টের চেক তুমি কালই ভাঙাতে পারবে।

দুলাভাই, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব- বুঝতে পারছি না।

মেয়ে সুস্থ হয়ে আসুক তারপর ধন্যবাদ দেবে। এখন বলল যা দেব বলেছিলাম তাতে হবে, না আরো কিছু লাগবে? ফিল ফ্রি।

যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয় তাহলে আরো এক বাড়িয়ে দিন।

তোমার জন্যে সবই সম্ভব। যাও এটাকে চার করে দিচ্ছি। এখন বলল রাতে চায়নিজ খাবে, না বাংলাদেশী ফুড– ডাল ভাত। গুলশানে একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে একসেলেন্ট বাংলাদেশী ফুড করে। বিদেশীরা লাইন দিয়ে খায়।

দুলাভাই, আজ আমি চলে যাব। আরেকদিন এসে আপনার সঙ্গে ডিনার করব।

পাগল হয়েছ! তোমাকে যেতে দেব না। তোমাকে দিয়ে রান্নাঘরের শ্বেতপাথরের টেবিল উদ্বোধন করা এবং গোল বাথটাব উদ্বোধন করাব। হা হা হা।

দিলশাদ অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কী বলার চেষ্টা করছে?

ওয়াদুদুর রহমান বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। ঠোঁটে সিগারেট খুঁজতে খুঁজতে বলল, দিলু, আমি হচ্ছি খুব ফ্রাস্টেটেড একজন মানুষ। পুরোপুরি হতাশাগ্রস্ত। এক অর্থে তুমিও হতাশাগ্রস্ত। দুজন হতাশাগ্রস্ত মানুষ যদি কিছু সময় আনন্দে কাটায় তাতে জগতের কোনো ক্ষতি হয়।

দুলাভাই, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি না।

বুঝতে না পারার তত কোনো কথা না দিলু। তুমি তো বোকা মেয়ে নও। তোমার জায়গায় তোমার আপা হলে ভিন্ন কথা ছিল। সে কিছুই বুঝত না। বিয়ের পর পর কী ঘটনা ঘটল শোন রাত একটার দিকে তোমার আপাকে ডেকে তুলে বললাম, তৃষ্ণা পেয়েছে। পানি খাব। সে ভাবল পানির তৃষ্ণাই বুঝি পেয়েছে। সে বিস্মিত হয়ে বলল, টেবিলেই তো পানির জগ আছে। গ্লাস আছে। খেয়ে নিলেই পারতে। আমাকে শুধু শুধু ডাকলে কেন? আমি তখন বললাম…।

দিলশাদ বলল, আমাকে এসব কেন শুনাচ্ছেন?

ওয়াদুদুর রহমান ডানহাত বাড়িয়ে দিলশাদের গালে রাখল। আদর করার ভঙ্গিতে হাত রাখা। দিলশাদ নিজের মুখ সরিয়ে নিল না, সে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। ওয়াদুদুর রহমানের ডানহাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের ধোয়ায় দিলশাদের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে।

ওয়াদুদুর রহমান অন্যহাত দিলশাদের কোলে রেখেছে। অনেকদিন আগে সিনেমাহলে এই ব্যাপার হয়েছিল।

দুলাভাই, আপনি ঠিক করে বলুন তো আপনি আমার কাছে কী চাচ্ছেন?

আমি নিজ থেকে কিছু চাইব না। তুমি যা দেবে তাই হাসিমুখে নেব। হা হা হা।

ওয়াদুদুর রহমান দিলশাদের দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলো। দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আমার গায়ের উপর উঠে পড়ার আগে একটা কথা শুনুন। প্লিজ স্টপ দেয়ার। আমার গাল থেকে আপনার হাত সরান। হ্যাঁ, এখন তাকান আমার দিকে। আমাকে বেশ কিছু টাকা আপনি দিচ্ছেন। তার পূর্বশর্ত কি এই যে, আমাকে আপনার সঙ্গে বাথটাবে বসে গোসল করতে হবে? আপনার সঙ্গে আমাকে বিছানায় যেতে হবে?

তুমি পুরো ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখছ দিলু। অন্যভাবে দেখার দরকার নেই– আমরা দুজনই র‍্যাশানাল হিউমেন বিং…।

দুলাভাই, আপনার টাকার আমার দরকার নেই।

দরকার না থাকলে খুব ভালো কথা। দরকার নেই বলেই তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে কেন?

আমি তো আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছি না। আপনি করছেন। কতটুক খারাপ ব্যবহার যে করেছেন তাও আপনি জানেন না।

দিলশাদ উঠে দাঁড়াল। ওয়াদুদুর রহমান স্বাভাবিক গলায় বলল, চলে যাচ্ছ?

দিলশাদ জবাব না দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে এলো। সে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। একহাতে রেলিং ধরে নামছে, তারপরেও মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ