সাজ্জাদ বারান্দায় বসে আছে। বারান্দা অন্ধকার। দিলশাদ এখনো ফেরে নি। ফুলির মা চা রেখে গেছে। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। সাজ্জাদ চায়ের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করছে না। অল্প সময়ের মধ্যে সে বেশ কয়েকটা সিগারেট খেয়ে ফেলল। সিগারেটের ধোঁয়ায় এখন তার মাথা ঘুরছে। এতদিন পর এসেছে। তার উচিত মেয়ের পাশে বসে থাকা। তার সেই ইচ্ছাও করছে না। দিলশাদের সঙ্গে আগে একটা বোঝাঁপড়া হওয়া দরকার। এমন ভয়াবহ অসুস্থ একটা মেয়ে। চিকিৎসার জন্যে বাইরে চলে যাচ্ছে। আর সে খবরটাও জানবে না? এ কেমন কথা?

ফুলির মা বলল, চাচাজান, সিনান করবেন না?

সাজ্জাদ বিরক্ত গলায় বলল, না। দিলশাদ আসবে কখন?

জানি না। বলছেন ডাক্তারের ধারে যাবেন। আপনের শইল কি ভালো চাচাজান?

আমার শরীর নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

বরফ দিয়া ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দিমু? আম্মা ফিরিজ কিনছে। নয়া ফিরিজ– লাল কালার। পুরানটা বেইচ্যা দিছে।

আচ্ছা ঠিক আছে। দাও, পানি দাও।

দাম মিলে নাই। তেরশ টাকা মিলছে।

তুমি যাও। আমাকে ঠাণ্ডা পানি এনে দাও।

নয়া ফিরিজটার দাম পড়ছে চাইর হাজার সাতশ। ঠেলাওয়ালা নিছে সত্তর টেকা।

তুমি সামনে থেকে যাও তো ফুলির মা। এত বকবক করছ কেন? এমন বকবকানি স্বভাব তত তোমার আগে ছিল না।

ফুলির মা চলে গেল। তার আরো অনেক গল্প করার ইচ্ছা ছিল, সাহসে কুলাল। চাচাজানের মেজাজ ভালো নেই। ঘরের ভেতর থেকে নাতাশা ডাকল, বাবা, শুনে যাও তো।

সাজ্জাদ মেয়ের ঘরে ঢুকল। মেয়ের দিকে তাকাল না। তাকাতে ইচ্ছা করছে না। নাতাশা বলল, তুমি এত রেগে আছ কেন বাবা?

রাগি নাই।

ধমকাধমকি করছ।

আরে বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।

এতদিন পরে এসেছ, বেচারার তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে।

সাজ্জাদ তিক্ত গলায় বলল, তোর এত বড় অসুখ আমি জানলাম না কেন? আমার জানতে অসুবিধাটা কোথায় ছিল?

এই নিয়ে তুমি মার সঙ্গে ঝগড়া করবে?

ঝগড়া করব না। আমি শুধু জানতে চাইব। জানার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে।

তুমি তো দেখি আমার সঙ্গেই ঝগড়া শুরু করে দিলে। বাবা, আমার কথা শোন বাথরুমে গিয়ে ভালো করে গোসল কর। তারপর গরম এক কাপ চা খাও। এরমধ্যে মা এসে পড়বে। ঝগড়া যে এক্ষুনি করতে হবে তা তো না। কয়েকদিন পরেও করতে পারবে। মা খুব কষ্টের মধ্যে আছে বাবা। সারাদিন ছোটাছুটি করে। টাকার জোগাড় হচ্ছে না। এদিকে যাবার সব ঠিকঠাক। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে মা আসবে, আর আসামাত্র তুমি একটা ঝগড়া শুরু করবে, সেটা কি ভালো হবে?

আমার ভালো-মন্দ তোকে দেখতে হবে না।

যে কদিন আমি বেঁচে থাকব সেই কদিন আমিই দেখব। তুমি না চাইলেও দেখব। বাবা, গোসল করতে যাও। আমি বুয়াকে বলছি চা বানানোর জন্যে। তুমি বাথরুম থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চা দেবে। গোসলের পর চায়ে চুমুক দেবার পর দেখবে তোমার রাগ অনেকটা কমে গেছে।

সাজ্জাদ বাথরুমে ঢুকল। গোসল সেরে চা খেয়ে মেয়ের পাশে বসল। নাতাশা খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করে যাচ্ছে। সাজ্জাদ শুনছে। আবার ঠিক শুনছেও না। সে আছে একধরনের ঘোরের মধ্যে, যে ঘোর কখনো কাটবে না। রাত দশটার উপর বাজে। দিলশাদ এখনো ফিরছে না। সাজ্জাদ বলল, তোর মা কি রোজই এমন দেরি করে?

এখন প্রায়ই করে। তোমার খিদে লেগেছে, তুমি কি খেয়ে নেবে?

তুই কখন খাবি?

একটু পরেই খাব। বাবা, তোমার রাগটা কি কিছু কমেছে?

সামান্য কমেছে।

আরো একটু কমাও।

আচ্ছা যা, কমাব। তোর মা’র এত দেরি করে ফেরার কারণ তো বুঝতে পারছি না। ঢাকার রাস্তাঘাটও তো সুবিধার না।

তুমি চিন্তা করো না বাবা, মা এসে পড়বে। তুমি বরং ভাত খেয়ে নাও। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার খুব খিদে পেয়েছে।

রাত দশটার পর তো কোথাও কোনো ডাক্তার থাকার কথাও না।

আজ মা’র মেজোখালার বাসায় যাবার কথা। ডাক্তারের কাছ থেকে হয়তো সেখানে গেছেন। মেজোখালু সাহেবের আজ মাকে কিছু টাকা দেয়ার কথা।

নাতাশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মা টাকা চেয়ে চেয়ে ঘুরছে। কী খারাপ যে তাঁর লাগছে কে জানে!

.

দিলশাদ তার মেজোবোন দিলরুবার বাসায় রাত আটটা থেকে বসে আছে। স্বামী স্ত্রীর দুজনের কেউই ফ্ল্যাটে নেই। উত্তরায় তাদের বাড়ি হচ্ছে, সেই বাড়ি দেখতে গেছে। কাজের মেয়ে বলল, আইস্যা পড়ব। এক্ষণ আসব।

কাজের দুটি মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। দিলরুবার একটিই মেয়ে, সে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করে। ছুটি-ছাটায় আসে। এখন গরমের ছুটি চলছে সে আসে নি। শান্তিনিকেতন থেকে একটা দল যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। সে তাদের সঙ্গে যাবে।

দিলরুবাদের ফ্ল্যাট ছবির মতো সুন্দর। হালকা গোলাপির কম্বিনেশন। কার্পেট গোলাপি, সোফার কাপড় গোলাপি, জানালার পর্দাও গোলাপি। দেয়ালে কিছু পেইন্টিং আছে। মনে হয় অর্ডার দিয়ে আঁকানো, কারণ পেইন্টিং-এও গোলাপি রঙের আধিক্য। গোলাপি রঙটা দিলশাদের অপছন্দ, কিন্তু এই ঘরে রঙটা এত মানিয়েছে। সবচে সুন্দর লাগছে গাঢ় গোলাপি ভেলভেটের সোফাসেট। সমস্যা একটাই- গা এলিয়ে আরাম করে বসতে অস্বস্তি লাগে। মনে হয় ভেলভেট ব্যথা পাবে। দিলশাদ অবশ্যি গা ছেড়েই শুয়ে আছে। এত ক্লান্ত লাগছে, মনে হয় সে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়বে। কাজের মেয়েটি বলল, চা দিব আফা?

দিলশাদ বলল, চা না, যদি পার লেবুর সরবত বানিয়ে দাও। ঘরে লেবু আছে?

আছে। আফা সেন্ডেল খুইল্যা বসেন। নতুন কার্পেট কিনছে। কেউ স্যান্ডেল লইয়া উঠলে আম্মা মনে মনে বেজার হয়।

দিলশাদ স্যান্ডেল খুলতে খুলতে বলল, এত সুন্দর জিনিস নষ্ট হলে মন খারাপ তো হবেই।

একটুকরা মোড়া কাপড়। দাম হইল ত্রিশ হাজার টেকা। শুনলেই বুক কাঁপে।

তাহলে তো শুধু স্যান্ডেল খুলে সোফায় উঠলে হবে না, অজু করে উঠতে হবে।

কাজের মেয়েটা সরু চোখে দিলশাদকে দেখছে। এই মেয়েটি কি সাজ্জাদের ঘড়ি চুরির খবর দিয়েছিল? যদি সে হয় তাহলে দিলশাদের দিকেও সে লক্ষ রাখবে। চলে যাবার সময় দিলশাদ কি বলবে– বুয়া, দেখে নাও তোমাদের জিনিস সব ঠিকঠাক আছে কি-না।

.

দিলরুবা বাড়িতে ঢুকল রাত দশটায়। ছোটবোনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ওমা, তুই! কখন এসেছিস?

নটা থেকে বসে আছি। তুমি একা যে, দুলাভাই কোথায়?

আজ ছাদ ঢালাই হচ্ছে। ও থাকবে। রাত একটা-দেড়টার আগে ফিরবে না। আমাকেও থাকতে বলেছিল। ভাগ্যিস থাকি নি। থেকে গেলে তোর সঙ্গে দেখা হতো না। তুই আসবি জানলে ওকেও নিয়ে আসতাম।

আজ যে আসব সেটা তো দুলাভাইকে টেলিফোন করে বলেছিলাম।

ওর আজকাল কিছু মনে থাকে নাকি? ও যে নিজের নাম মনে রাখে সে-ই যথেষ্ট।

কেন?

বুঝলি দিলু, ব্রেইন ডিফেক্টের মতো হয়ে গেছে। ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ। বড় অ্যামাউন্টের একটা এলসি খুলেছিল। ব্যাংক থেকে কী যেন প্রবলেম করছে। আমি জানিও না, কিছু বুঝিও না। গতকাল আমাকে বলে, রুবা, আমাকে একলাখ টাকা ধার দাও না। তিনশ বস্তা সিমেন্ট কিনব। অবস্থা চিন্তা কর। আমি টাকা পাব কোথায়? শেষে বলে, তোমার গয়না বিক্রি কর। ভাবটা এরকম যেন আমার লাখ লাখ টাকার গয়না আছে। ওর বন্ধুবান্ধব এখন ওকে দেখলে পালিয়ে বেড়ায়। সবাই ভাবে, বোধহয় এক্ষুনি টাকা ধার চাইবে…।

দিলশাদ তাকিয়ে আছে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, তোমার এই অবস্থা!

হ্যাঁ রে দিলু, এই অবস্থা। বাইরে থেকে দেখে কেউ কিছু বুঝবে না। ঠাটবাট সবই আছে। তিনদিন আগে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে কার্পেট কিনলাম। এখনো টাকা দেয়া হয় নি। রোজ টেলিফোন করছে। একবার ভাবলাম বলি, আপনারা আপনাদের কার্পেট নিয়ে যান। শেষে ভাবলাম, ঠিক আছে, যাক কয়েকটা দিন। দরকার হলে গয়না বেচব। কী করা! গয়না তো আজকাল কেউ পরে না। লকারেই পড়ে থাকে। বিক্রি করলেই কী, আর না করলেই কী। তুই কি কিছু খেয়েছিস দিলু? না শুধু-মুখে বসে আছিস?

লেবুর সরবত খেয়েছি।

ভাত খাবি? ভাত খা। ওর এক বন্ধু রূপচান্দা শুঁটকি পাঠিয়েছে চিটাগাং থেকে। ঝাল ঝাল করে বেঁধেছি। খেয়ে যা।

না, কিছু খাব না। আজ উঠব।

তুই কি টাকার জন্যে এসেছিলি?

হ্যাঁ। দুলাভাই আজ আসতে বলেছিলেন।

কাল আয়। কাল এসে ওর সঙ্গে কথা বল। আমি ওকে বাসায় থাকতে বলে দেব। তাবে তোকে সত্যি কথা বলি–ওর পক্ষে সম্ভব না। ওর ভয়াবহ অবস্থা। তোর টাকা জোগাড় হয়েছে কেমন?

সামান্যই হয়েছে।

বড় দুলাভাই যে টাকাটা দেবেন বলেছেন, দিয়েছেন?

এখনো দেন নি।

টাকাটা নিয়ে নে। আপার সঙ্গে দুলাভাইয়ের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বড় . দুলাভাই আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন। এখন শুনছি বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকেন। হোটেল থেকে ভাত আনিয়ে খান। সম্পর্ক আরো খারাপ হবার আগেই টাকাটা নিয়ে নেয়া দরকার।

আপা, আমি আজ উঠি।

তুই বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস করিস নি। তুই ভেবেছিস আমি বানিয়ে বানিয়ে অভাব-টভাবের কথা বললাম।

তা ভাবব কেন!

বিশ্বাস কর, আমি এক বর্ণ মিথ্যা বলি নি। পাপিয়া একটা মিউজিক্যাল ট্যুরে মালয়েশিয়া যাবে। ওর বাবাকে লিখল পাঁচশ ডলার পাঠাতে। ঘুরবে-টুরবে, কেনাকাটা করবে। ওর বাবা বলল, মালয়েশিয়ার কোনো দরকার নেই। মেয়েকে ঢাকায় চলে আসতে বলল। ওর পড়ার খরচ দিতে পারব কিনা তার নেই ঠিক। শেষপর্যন্ত অবশ্যি টাকা পাঠিয়েছে। কী করে পাঠিয়েছে সে-ই জানে। আমি ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি নি।

আপা, আজ উঠি?

উঠবি? দাঁড়া, তোকে কয়েকটা রূপচান্দা মাছের শুঁটকি দিয়ে দি।

শুঁটকি দিতে হবে না। তুমি তোমার ড্রাইভারকে বলো আমাকে একটু নামিয়ে দিতে। এত রাতে একা যেতে ভরসা হচ্ছে না।

ভরসা হলেও তোকে আমি একা ছাড়ব নাকি? দিলু, বড় দুলাভাইয়ের ব্যাপারে যেটা বললাম মনে রাখিস। ভুজুং-ভাজুং দিয়ে টাকাটা ম্যানেজ করে নে। কালই যাবি।

দেখি।

এখানে দেখাদেখির কিছুই নেই। প্রয়োজনটা আমাদের। ও, আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। পাপিয়ার বাবার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে, টিভির কর্তা ব্যক্তি। তার সঙ্গে পাপিয়ার বাবার কথা হয়েছে। ওদের একটা ম্যাগাজিন। নাতাশাকে প্রজেক্ট করবে। নাতাশার সঙ্গে কথা-টথা বলবে। প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিল এটা বলে তার জন্যে সাহায্য চাওয়া হবে। লোকজন এমনিতে কিছু দিতে চায় না। কিন্তু টিভিতে কিছু প্রচার করলে হু হু করে টাকা আসতে থাকে। আমাদের কিছু করতে হবে না। শুধু ব্যাংকের একটা অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেয়া থাকবে। টাকা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাবে। নাতাশাকে টিভি স্টেশনে যেতেও হবে না। টিভি ক্রুরা বাসায় এসে রেকর্ড করবে।

দিলশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এসবের কোনো দরকার নেই আপা।

দরকার নেই কেন? আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না। আমাদের কার্যোদ্ধার দিয়ে হচ্ছে কথা।

নাতাশা মনে কষ্ট পাবে। এমনিতেই সে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে আছে। আমি সেই কষ্ট আর বাড়াতে চাই না।

ফট করে না বলিস না। ভেবে দেখ।

এর মধ্যে ভাবাভাবির কিছু নেই। আপা, আমি আজ যাচ্ছি।

আয়, আমিও তোর সঙ্গে যাই। তোর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসি।

তোমাকে যেতে হবে না। তুমি উত্তরা থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছ। তুমি বিশ্রাম কর।

দিলরুবা দুটা রূপচান্দার শুঁটকি পলিথিনের ব্যাগে করে নিয়ে এলো। সঙ্গে একটা গল্পের বই। শরদিন্দুর ‘ঝিন্দের বন্দি’।

নাতাশার জন্যে পাপিয়া পাঠিয়েছে। বইটা ওকে দিয়ে দিস। কাল-পরশু একবার গিয়ে ওকে দেখে আসব।

দিলশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা এসো।

তোকে একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলা হয় নি। আমাদের সামনের বাসায় যে ভাড়াটে থাকে– আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় অফিসার। সে সেদিন হঠাৎ এসে আমাকে একটা দাওয়াতের কার্ড দিয়ে গেল। ওদের কী যেন অফিসিয়েল ফাংশান, যেতেই হবে…।

আপা, তোমার এই গল্প আরেকদিন এসে শুনব। আজ যাই।

.

সাজ্জাদ মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে। গল্প করে আগের মতো আনন্দ পাচ্ছে না। নাতাশা তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘুম ঘুম চোখে।

সাজ্জাদ একবার বলল, মা, ঘুম পাচ্ছে?

নাতাশা বলল, ঘুম পাচ্ছে না তো। অসুখের জন্যে আমার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেছে। তুমি সাইনবোর্ডের গল্পটা আরেকবার বলল।

শোনা গল্প আবার শুনবি?

হুঁ।

নতুন অনেক গল্প আছে। সেগুলি শোন। জঙ্গলের গল্প।

না। তুমি গল্প বলার সময় আমার দিকে তাকিও না। আমার দিকে তাকালে তোমার মনে হবে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। তুমি আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারবে না। বাবা, শুরু কর।

সাজ্জাদ চিন্তিত গলায় বলল, তোর মা এখনো আসছে না। এগারটার উপরে বাজে।

তোমার গল্প শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মা চলে আসবে। দেরি না করে তুমি শুরু কর তো বাবা।

তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট বেরুতে দু-তিন মাস দেরি। আমাদের কিছু করার নেই। সময় আর কাটছে না। কয়েক বন্ধু মিলে প্ল্যান করলাম, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ট্যুর দেব। সাইকেল ট্যুর। আমরা ছয় বন্ধু, সাইকেল জোগাড় হলো তিনটা। ট্যুর প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেল। কী করা যায় কিছুই বুঝতে পারছি না। একেকদিন একেকজনের মাথা থেকে একেক ধরনের আইডিয়া আসে। আইডিয়া নিয়া চিন্তা-ভাবনা করতে করতে সময় কেটে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় মা। আমাদের এক বন্ধু ছিল– করিম। এফ, করিম।

বাবা, উনি এখন কোথায়?

জার্মানি চলে গিয়েছিল। সেখানেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। কেউ কোনো খবর জানে না।

তোমার সেই বন্ধুর যা বুদ্ধি, আমার ধারণা, উনি বড় কিছু করেছেন।

করতে পারে। তবে ওর বুদ্ধির সবটাই ফাজলামি ধরনের। ফাজলামি ধরনের বুদ্ধি দিয়ে খুব বেশি কিছু করা যায় না মা।

তারপর কী হলো বাবা বললো।

এক রাতে করিম বলল, চল আমরা এক কাজ করি। শহরের মানুষগুলির পিলে চমকানোর ব্যবস্থা করি। আক্কেল গুড়ুম করে দি। আমি বললাম, কীভাবে করবি? করিম বলল, এমন কিছু করব যে শহরের লোকগুলির চোখ শুধু কপালে না, মাথার তালুতে উঠে যাবে। যেমন ধর, এক দোকানের সাইনবোর্ড অন্য দোকানে লাগিয়ে দেব। এক রাতের মধ্যে সব সাইনবোর্ড বদলে দেব। মিষ্টির দোকানে ঝুলবে ফার্মেসির সাইনবোর্ড। কাঠের দোকানে ইউনানি দাওয়াখানার সাইনবোর্ড। করিমের আইডিয়া আমাদের সবার যে পছন্দ হলো তা না। কিছুই করার নেই। বলেই আমরা রাজি হলাম। মফস্বল শহরে পাহারাদার-টার এমন থাকে না। রাতটাও ছিল শীতের রাত। সবাই গভীর ঘুমে। আমরা হাতুড়ি, পেরেক আর খুন্তি নিয়ে বের হলাম। তারপর শুরু করলাম সাইনবোর্ড বদলানো। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব মজা পেয়ে গেলাম। রাত সাড়ে তিনটার মধ্যে সব সাইনবোর্ড পাল্টানো হয়ে গেল। আমরা খুশি মনে ঘুমুতে গেলাম। পরদিন সারা শহরে হৈচৈ পড়ে গেল। সবার মুখে মুখে সাইনবোর্ডের কথা। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে কত রকম গবেষণা, কত থিওরি। মফস্বল শহরে তো আর উত্তেজনার মতো কিছু ঘটে না। সামান্য কিছু ঘটলেই তা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায়। আমরা কল্পনাও করি নি আমাদের সাইনবোর্ড পাল্টানোর ব্যাপারটা এত আলোড়ন তুলবে। আমরা চিন্তা করতে লাগলাম এর পর কী করা যায়। টিয়া পাখি, ঘুমিয়ে পড়েছিস?

নাতাশা জবাব দিল না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সাজ্জাদ ভেতরের বারান্দায় চলে গেল। অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়া হয় না। গল্প বলে বলে মুখ শুকিয়ে গেছে। সাজ্জাদ বেতের চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে কলিংবেল বাজল। তার নিজেরই দরজা খুলে দিতে ইচ্ছা করছে। সেটা সম্ভব হলো না। ফুলির মা ছুটে গেল। হড়বড় করে সে চাচাজানের আসার সংবাদ দিচ্ছে। দিলশাদকে না দেখেই সাজ্জাদ বুঝতে পারছে ফুলির মা’র উৎসাহ দিলশাদের ভেতর সংক্রমিত হলো না। সে শুধু জিজ্ঞেস করল– নাতাশা খেয়েছে? সাজ্জাদের মনে হলো, মানুষকে অগ্রাহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে এই মহিলা জন্মেছে। তবু নিজের স্বামীকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। সে অবশ্যই বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করবে, কখন এসেছ? সাজ্জাদ অপেক্ষা করতে লাগল। দিলশাদ বারান্দায় এলো না। সে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তার শরীর ঘামে কুটকুট করছে। সে আজ অনেক সময় নিয়ে গোসল করবে এবং বাথরুমের নির্জনতায় কিছুক্ষণ কাঁদবে। আজ তার কেন জানি কান্না পাচ্ছে।

তাদের দেখা এবং কথা হলো খাবার টেবিলে। সাজ্জাদ লক্ষ করল দিলশাদকে খুব রোগা এবং অসুস্থ লাগছে। চোখের কোণে কালি পড়েছে। মেয়ের অসুখ নিয়ে সে অকুল সমুদ্রে পড়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। সাজ্জাদের খুব মায়া লাগল। কিছু অত্যন্ত কঠিন কথা বলবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। এখন মনে হচ্ছে কোনো কিছুই বলা ঠিক হবে না।

দিলশাদ শুকনো গলায় বলল, তুমি খেয়ে নাও। আমি এখন খাব না।

রাত তো কম হয় নি। এখন খাবে না তো কখন খাবে?

যখন খেতে ইচ্ছা করবে তখন খাব। আমার ব্যাপার নিয়ে তোমাকে অস্থির হতে হবে না।

অস্থির হচ্ছি না, শুধু জিজ্ঞেস করলাম।

জিজ্ঞেস করারও দরকার নেই। তোমাকে খেতে দেওয়া হয়েছে, তুমি খেয়ে নেবে।

সাজ্জাদ প্লেটে ভাত নিল। দিলশাদ এমন কঠিন আচরণ কেন করছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। বড় বিপর্যয়ের সময় মানুষ কাছাকাছি চলে আসে, সে দূরে চলে যাচ্ছে কেন?

ফুলির মা চিন্তিত মুখে পানির জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দিলশাদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, জগ হাতে সঙ-এর মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? এত বড় টেবিলে জগ রাখার জায়গা পাচ্ছ না? জগ নামিয়ে রেখে বসার ঘরে তোমার চাচাজানের বিছানা করে দাও। আমার খাটের নিচে তোষক আছে, মশারি আছে। যাও সামনে থেকে। হা করে দাঁড়িয়ে থাকবে না।

সাজ্জাদ ডাল নিতে নিতে বলল, পৃথক বিছানা হচ্ছে?

হ্যাঁ হচ্ছে। কোনো অসুবিধা আছে?

না। অসুবিধা নেই। টিয়া পাখি ঘুমুচ্ছে, হৈচৈ করো না।

তুমি আমার এখানে থাকলে হৈচৈ হবে। চেঁচামেচি হবে। হৈচৈ ছাড়া বাস করতে চাইলে যেখান থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও। জঙ্গলে চলে যাও।

সাজ্জাদ হতাশ গলায় বলল, তুমি অকারণে রাগ করছ, রাগ করার মতো কোনো অপরাধ আমি এখনো করি নি। বরং তুমি অপরাধ করেছ। নাতাশার অসুখের খবর আমাকে জানাও নি। আমাকে না জানানোর পেছনে তোমার লজিক কী তা আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো লজিক আছে। তুমি লজিক ছাড়া কোনো কাজ করবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে আমি সম্ভবত আমার অল্প বুদ্ধির কারণে তোমার লজিক ধরতে পারছি না। এখনি বা কেন হঠাৎ করে রেগে যাচ্ছ সেটাও বুঝতে পারছি না।

দিলশাদ প্রায় অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, নাতাশার অসুখের খবর জানলে তুমি কী করতে? তোমার কি কিছু করার ক্ষমতা আছে? মেয়ের চিকিৎসার জন্যে এগার লাখ টাকা আমার দরকার। তুমি পারবে এগার লাখ টাকা জোগাড় করতে? কী হবে তোমাকে জানিয়ে? আমাকে ধন্যবাদ দাও যে তোমাকে জানাই নি। জানাই নি বলে নিশ্চিন্ত মনে এই কমাস মদ-ফদ খেয়ে ফুর্তি করতে পেরেছ। জানালে এই ফুর্তিও করতে পারতে না।Thave spared you the pain.

সাজ্জাদ টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তুমি ইচ্ছা করলে খেতে বসতে পার।

দিলশাদ ফুলির মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, টেবিল পরিষ্কার কর, আমি খাব না।

সাজ্জাদ বলল, আমার উপর রাগ করে খাওয়া বন্ধ করার কোনো মানে হয় না। তুমি বাচ্চা মেয়ে না। তুমি ভয়াবহ টেনশানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ তা বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি বলেই রাগ করছি না।

তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো না, প্লিজ। লোমার সঙ্গে আমার কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। তুমি ছিলে না, আমি শান্তিতে ছিলাম।

এখন আমি কি খুব অশান্তি করছি?

হ্যাঁ করছ। অশান্তি যে করছ তুমি নিজেও সেটা ভালো করে জানো। আজ এই যে আমার এত সমস্যা তার মূলেও কিন্তু তুমি।

সাজ্জাদ বিস্মিত হয়ে বলল, আমি!

দিলশাদ সহজ স্বাভাবিক গলায় প্রায় কাটা কাটা ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ তুমি। দুষ্টগ্রহের কথা বইপত্রে লেখা থাকে না? তুমি আমার জীবনের দুষ্টগ্রহ।

সাজ্জাদ তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, নাতাশা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে সেটাও আমার জন্যে?

অবশ্যই তোমার জন্যে। ওর অসুখ জেনেটিক অসুখ। তোমার জিন আমার জিন মিশ খায় নি বলেই নাতাশার জিনে এই গণ্ডগোল হয়েছে। আমার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। সিগারেট ধরাবে না। খবরদার! কিছুক্ষণ আগে এসেছ, এর মধ্যেই বাসা ধোয়ায় ঢেকে ফেলেছ। নিঃশ্বাস ফেলার উপায় নেই।

সাজ্জাদ সিগারেট ধরাল না। হাতের সিগারেট প্যাকেটে রেখে দিল। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে হকচকিয়ে গিয়েছে। দিলশাদ এই পর্যায়ে যাবে সে ঠিক ভাবতে পারে নি।

ফুলির মা ঘরে নেই। তবে সে চলেও যায় নি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সাজ্জাদ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ফুলির মা, আমি এক কাপ চা খাব।

দিলশাদ সাজ্জাদকে অবাক করে দিয়ে বলল, চা আমি বানিয়ে এনে দিচ্ছি। But do me a favour, চা খেয়ে অন্যকোথাও চলে যাও।

অন্যকোথাও চলে যাব?

দিলশাদ শান্ত গলায় বলল, নিজের উপর আমার এখন আর আগের মতো কন্ট্রোল নেই। রাগ সামলাতে পারি না। তুমি বাসায় থাকলে আমার রাতে ঘুম হবে। আমি ক্রমাগত তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব। নাতাশা শুনবে। সে কিছু বলবে কিন্তু কষ্ট পাবে। সে এমনিতেই অনেক কষ্ট পাচ্ছে, আমি আমার মেয়েকে আর কষ্ট দেব না।

সাজ্জাদ অবাক হয়ে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে রইল। দিলশাদ বলল, সকালে আমি অফিসে চলে যাই। নানান কাজে সারাদিন ঘুরি। এইসময় তুমি এসে তোমার মেয়েকে সঙ্গ দিও। তোমার মেয়ের তোমাকে দরকার। আমার তোমাকে দরকার নেই।

সত্যি চলে যেতে বলছ?

হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি। তোমাকে দেখেই আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। দুপুরে আমি কিছু খাই নি। খিদেয় আমার শরীর ঝিমঝিম করছে। তুমি আশেপাশে থাকলে আমি ভাত নিয়েও বসতে পারব না।

আমি চলে গেলে ভাত খেতে পারবে?

হয়তো পারব।

আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। চা লাগবে না। তুমি খাওয়া-দাওয়া কর।

আমি নটার দিকে অফিসে চলে যাই। তুমি নটার পর চলে এসো।

আচ্ছা।

সাজ্জাদ প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে ঘর থেকে বের হলো। সে ভেবে পাচ্ছে না দুঃশ্চিন্তায় দুঃশ্চিন্তায় দিলশাদের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে কিনা। তার আচার-আচরণ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো। এই রোগ কখনো কমে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে।

রাস্তায় নেমেই সাজ্জাদ ঠোঁটে সিগারেট নিয়েছে কিন্তু ধরাবার কথা তার মনে নেই। সে হাঁটছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। কোথায় যাবে তাও ঠিক করা নেই। এত রাতে কারো বাসায় ওঠা যাবে না, উঠতে হবে হোটেলে। সস্তাদরের হোটেল কোন অঞ্চলে আছে তাও মনে পড়ছে না। টাকা-পয়সা সে সামান্যই সঙ্গে এনেছে। এই মুহূর্তে মেয়ের অসুখের চেয়েও দিলশাদের ব্যবহার তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। রেল স্টেশনের দিকে চলে গেলে কেমন হয়? প্ল্যাটফরমে হাঁটাহাঁটি করে রাত পার করে দেয়া যায়। কিংবা সারারাত রাস্তায় হাঁটাও যেতে পারে। শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। শহরটা গত বিশ বছরে কত বড় হয়েছে সেটা তাহলে আন্দাজ করা যেত। তাতে অবশ্যি খোলা ক্ষুর হাতে হাইজ্যাকারের মুখোমুখি হবার আশঙ্কা থাকে। থাকুক না, আজ রাতে কোনো কিছুই ভয়ঙ্কর বলে মনে হবে না। ভোলা ক্ষুর হাতের হাইজ্যাকারদের দেখা পাওয়াও হবে a welcome change, বরং ওদের সে বলতে পারে- বন্ধুরা, তোমাদের খুশি করার মতো অর্থ আমার কাছে নেই। যা আছে তা অতি সামান্য। সেটা তোমাদের দিয়ে দিচ্ছি। প্লাস একটা হাতঘড়ি। ঘড়িটা দামি। পুরনো হলেও দামি। বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া। তার বদলে আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে চল– টু নাইট লেট আস বি ফ্রেন্ডস। চল আজ রাতে একসঙ্গে নেশা-টেশা করি। সস্তায় নেশা করার জায়গা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা

আছে। বাংলা মদ এখন কী দরে বিক্রি হচ্ছে? হাঁড়ি কত? দামি বোতলে সুন্দর লেবেল সেঁটে এই জিনিস বিদেশে এক্সপোর্ট করলে বিদেশীরা বুঝত– আমরা কী জিনিস। বোতলের গায়ে টকটকে লাল অক্ষরে লেখা থাকবে বাংলা। ইংরেজি লেবেলেটা হবে এরকম

BANGLA
The fire from Bangladesh

তৃষ্ণায় সাজ্জাদের শরীর এখন কাঁপছে। তার কাছে মনে হচ্ছে কোনো নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে মদ্যপান করার সুযোগের বিনিময়ে সে এখন সবকিছুই দিয়ে দিতে পারে। তার আত্মাও বন্ধক রাখা যেতে পারে। আত্মা বন্ধক রাখার লোক মেসিফস্টোফিলিস কাব্যে পাওয়া যায়, বাস্তবে পাওয়া যায় না। বাস্তবের মানুষ আত্মা সম্পর্কে খুব আগ্রহী, তবে আত্মার কেনা-বেচায় আগ্রহী না। আগ্রহী কোনো মানুষকে পাওয়া গেলে সে তার আত্মা বিক্রি করে দিত। আত্মাবিহীন মানুষ হবারও নিশ্চিয়ই অনেক মজা আছে।

.

দিলশাদ নিঃশব্দে রাতের খাওয়া শেষ করল। তার যে এত খিদে পেয়েছিল সে আগে বুঝতে পারে নি। ঘন ডালটা খেতে এত ভালো হয়েছে! ডাল থাকলে আরো কিছু ভাত খাওয়া যেত।

ফুলির মা বলল, চা দিমু আম্মা?

দিলশাদ বলল, দাও! তোমার পান আছে না? সেখান থেকে আমাকে একটু পান দিও। পান খেতে ইচ্ছা করছে।

দিলশাদ বারান্দার দিকে রওনা হলো। নাতাশার ঘরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করল নাতাশা এই গরমে চাঁদর গায়ে শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ, তবে দিলশাদ পুরোপুরি নিশ্চিত নাতাশা জেগে আছে। সাজ্জাদের সঙ্গে তার কথাবার্তা কী হয়েছে সবই শুনেছে। সময় বিশেষে এই মেয়েটার ঘাপটি মেরে থাকার অভ্যাস আছে।

দিলশাদ বলল, মা, জেগে আছিস? নাতাশা জবাব দিল না। দিলশাদ বারান্দায় চলে গেল। আজ খুব গুমট। কিছুক্ষণ আগে গোসল করা হয়েছে, এর মধ্যেই গা ঘেমে যাচ্ছে। শোবার আগে আবার গোসল করতে হবে। ফুলির মা চা দিয়ে গেছে। খেতে ভালো লাগছে। দিনের শেষ চা ফুলির মা ভালো বানায়। এক কাপ শেষ করার পর আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা করে।

ফুলির মা, নাতাশা রাতে দুধ খেয়েছে?

জে খাইছে।

সবটা খেয়েছে?

তলার মধ্যে অল্প একটু ছেল। আফার বমি আসতে ছেল, তখন চাচাজান। বলছেন, থাউক শেষ করনের প্রয়োজন নাই।

তোমার চাচাজান দুনিয়ার সবকিছু বেশি বোঝেন তো তাই বলেছেন— থাক প্রয়োজন নেই। এত বড় একটা অপারেশন হবে, অপারেশন সহ্য করার শক্তি লাগবে না? দুধ-টুধ না খেলে শক্তিটা আসবে কোত্থেকে? আকাশ থেকে?

কথা তো আম্মা ঠিকই বলছেন।

কাল তোমার চাচাজান আবার আসবে। ফোপরদালালি করতে চেষ্টা করবে। তখন কঠিন গলায় বলবে– আম্মার নিষেধ আছে। মনে থাকবে?

জে, মনে থাকব।

ভেতর থেকে নাতাশা ক্ষীণ গলায় ডাকল, মা! দিলশাদ তৎক্ষণাৎ উঠে গেল।

বাথরুমে যাব মা।

দিলশাদ হাত ধরে মেয়েকে বিছানা থেকে নামাল। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেল। আবার ফিরিয়ে এনে বিছানায় বসিয়ে দিল। কোমল গলায় বলল, আজ মাথাব্যথা হয়েছিল মা?

নাতাশা হাসিমুখে হা-সূচক মাথা নাড়ল যেন মাথাব্যথা হওয়াটা মজার একটা ব্যাপার।

কবার হয়েছিল?

তিনবার।

খুব বেশি?

হুঁ।

ব্যথার সময় ওষুধ খেয়েছিলি?

হুঁ।

তাতে কি ব্যথা কমেছিল?

হুঁ।

রাতের দুধ নাকি পুরোটা খাস নি?

বমি আসছিল মা।

বমি এলেও খেতে হবে। না খেলে শরীরে শক্তি আসবে না।

তুমি পান খাচ্ছ নাকি মা?

হ্যাঁ।

চপচপ করে পান খাওয়া আমার এত ভালো লাগে। আমাকে একটু পান দাও তো, আমি খাব। তোমার চাবানো পান একটু দাও।

আমার মুখের পান খেতে হবে না। দাঁড়া তোকে সুন্দর করে পান বানিয়ে দিচ্ছি।

না, তোমার মুখ থেকে দাও। কিচ্ছু হবে না।

অন্যের মুখের পান খাবি? ঘেন্না লাগার কথা। তোর ঘেন্না লাগে না?

উঁহু।

দিলশাদ নিতান্ত অনিচ্ছায় মেয়েকে পান দিল। নাতাশা পান চিবুতে চিবুতে সুন্দর একটা অভিনয় করল, হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, বাবা কোথায় মা?

দিলশাদ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ও তার এক বন্ধুর বাড়িতে গেছে। কী নাকি দরকার। না গেলেই না। তুই কি এতক্ষণ ঘুমুচ্ছিলি?

হুঁ। বাবা আমাকে কিছু না বলে চলে গেল?

তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে তোকে জাগায় নি।

রাতে ফিরে আসবে?

রাতে আর আসবে না। কাল সকালে চলে আসবে।

নাতাশা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল হয়তো মা তার অভিনয় ধরে ফেলবে। মা’র যা বুদ্ধি! ধরে ফেলারই কথা। তবে খুব বুদ্ধিমান মানুষরাই সবচে বেশি বোকার মতো কাজ করে। নাতাশার ধারণা, বাবার সঙ্গে তার মা যে ঝগড়াটা করেছে তা নিতান্ত বোকা মেয়েরাই করবে। এবং এই যে সে মিথ্যা অভিনয় করছে শুধুমাত্র বোকা মায়েদেরই সেটা ধরতে পারার কথা না। একজন সাধারণ বুদ্ধির মা হলেও ধরে ফেলত। তার মা’র এত বুদ্ধি অথচ সামান্য ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। এটা খুবই আশ্চর্যের কথা।

অভিনয়টা করে নাতাশার ভালো লাগছে। বাবা-মা কেউ জানবে না তাদের কুৎসিত ঝগড়া সে শুনেছে। তারা স্বস্তি বোধ করবে। এটা আনন্দিত হবার মতোই ঘটনা।

তোর বাবার সঙ্গে তুই কি অনেক গল্প-টল্প করেছিস?

হুঁ।

কী নিয়ে গল্প হলো?

সাইনবোর্ডের গল্পটা আবার শুনলাম। পুরোটা শোনা হয় নি। অর্ধেকটা বাকি আছে।

সাইনবোর্ডের কোন গল্প?

ঐ যে বাবা আর তার বন্ধুরা মিলে তাদের শহরের সব সাইনবোর্ড এক রাতে পাল্টে দিল। ছেলে হয়ে জন্মানোর কত মজা, তাই না মা? তারা কত কিছু করতে পারে?

দিলশাদ ভুরু কুঁচকে বলল, তুই কি তোর বাবার ঐসব বানানো গল্প বিশ্বাস করে বসে আছিস?

বানানো গল্প?

অবশ্যই বানানো গল্প। কয়েকজন মিলে এক রাতে সব সাইনবোর্ড খুলে অন্যখানে লাগাল। সাইনবোর্ড খোলা এত সহজ?

মার কথায় নাতাশা একটু মন খারাপ করল। সে জানে তার বাবার এই গল্পগুলি সত্যি গল্প। কিছু কিছু অদ্ভুত মানুষ পৃথিবীতে থাকে। তার বাবা একজন অদ্ভুত মানুষ। অদ্ভুত কোনো কিছু যদি তার মা’র মধ্যে থাকত তাহলে তার মাও হয়তো বাবাকে পছন্দ করত। মা’র মধ্যে অদ্ভুত কিছু নেই।

দিলশাদ বলল, ঘুম পাচ্ছে নাতাশা?

নাতাশার ঘুম পাচ্ছে না, তবু সে বলল, হ্যাঁ।

যা, শুয়ে পড়।

তুমি ঘুমুবে না?

আমি আরেকবার গোসল করব। আমার খুব গরম লাগছে।

দিলশাদ আবার দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করল। তার এত ক্লান্তি লাগছিল মনে হচ্ছিল গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে সে ঘুমিয়ে পড়বে। শরীর বেশি ক্লান্ত থাকলে ঘুমের খুব অসুবিধা হয়। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম চলে যায়।

দিলশাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দুটা রিলাক্সেন খেল। তার সঙ্গে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। এই দুয়ের কম্বিনেশন ঘুমের জন্যে ভালো। রিলাক্সেন ট্যাবলেটের নিয়ম হলো খাওয়ার পর আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ঝিমুনির মতো শুরু হলে বিছানায় যেতে হয়।

দিলশাদ ভেতরের বারান্দার পাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ঝিমুনি আসার জন্যে অপেক্ষা করছে। কাল সারাদিনে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। কোনটার পর কোনটা করা হবে একটু গুছিয়ে নেয়া দরকার।

১. আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে ভিসা ফরম আনতে হবে।

২. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা চিঠি বের করতে হবে। চিঠির বিষয়বস্তু হলো- নাতাশার অপারেশন দেশে হওয়া সম্ভব না বলে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই চিঠির জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অনেক আগেই জমা দেয়া হয়েছে। এখন হঠাৎ করে তারা চাচ্ছে মেডিকেল বোর্ডের মতামত। চারজনের একটা মেডিকেল বোর্ড লাগবে। নাতাশার ডাক্তার বলেছেন মেডিকেল বোর্ডের মতামত ছাড়াই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি বের করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।

৩. ফরেন কারেন্সি নেয়ার অনুমতির জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে হবে। তাদের কী সব ফরম-টরম পূরণ করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি ছাড়া ব্যাংকে গিয়ে লাভ হবে না।

৪. বিমানের অফিসে যেতে হবে। গুরুতর অসুস্থ রোগী নিতে হলে কী সব পারমিশনের ব্যাপার আছে। এইসব ছোটখাটো সমস্যা। দিলশাদ জানে এই জাতীয় সমস্যার সমাধান হয়। ছোটাছুটি করলেই হয়। বড় সমস্যা টাকার সমস্যা। দিলশাদ টাকা এখনো জোগাড় করতে পারে নি। বড় দুলাভাই এখনো টাকা দেন নি। তাকে পাওয়াই যাচ্ছে না। অফিসে নাকি কিছুদিন হলো কম আসছেন। কাল একবার তার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে যেতে হবে। অফিস থেকে অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা নিয়ে রাত করে উপস্থিত হতে হবে।

অনেক যন্ত্রণা, অনেক ছোটাছুটি করে মাত্র তিন লাখ টাকা জোগাড় হয়েছে। সেই তিন লাখের এক লাখ চলে যাবে টিকিটে। দশ হাজার ইউএস ডলার আগেই হাসপাতালে জমা করতে হবে। নয়তো রোগী হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করাবে না। প্রায় চার লাখ টাকা। কোত্থেকে জোগাড় হবে কে জানে! পরিচিত এমন কেউ নেই যার কাছে দিলশাদ যায় নি।

শুধু পরিচিত না, ভাসাভাসাভাবে পরিচিতদের কাছেও সে গিয়েছে। যেমন আনুশকার কাছে গেল। কলেজে একসঙ্গে পড়েছে, খুব হাই টাইপের মেয়ে। নিজে গাড়ি চালিয়ে আসত। তার জন্মদিনে সে ক্লাসের সব মেয়েকে রিভারক্রজে নিয়ে গিয়েছিল। বিশাল এক জাহাজে করে ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়া, চাঁদপুর থেকে ফিরে আসা। গান-বাজনা, ম্যাজিক কত কিছুর ব্যবস্থা যে ছিল। খুঁজে খুঁজে সেই মেয়েকে সে বের করল। বারিধারায় প্রাসাদের মতো বাড়িতে থাকে। গেটে মিলিটারিদের মতো পোশাক পরা দারোয়ান। ভেতরে ঢোকাই মুশকিল। কেন আসা হয়েছে, কী দরকার, কী নাম সব কাগজে লিখে পাঠাতে হবে। মেম সাহেব যদি সেই কাগজ দেখে সেখানে নিজের নাম সই করে দেন তবেই বাইরের লোক ঢুকতে পারবে। প্রায় একঘণ্টার মতো বসে থেকে দিলশাদ যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হলো তাকে ডাকা হবে না, তখনি ডাক পড়ল। সে খুবই আশ্চর্য হলো যে, আনুশকা তাকে চিনতে পারল। আনুশকা হাসিমুখে বলল, আরে তুমি? নাম দেখে চিনতে পারি নি। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, তাই না? লং ডিসটেন্ট কল রিসিভ করছিলাম। এখন বলো তো কী ব্যাপার। সামাজিক, সাক্ষাতের জন্যে নিশ্চয়ই আস নি।

দিলশাদ অতি দ্রুত তার সমস্যার কথা বলল। তার নিজেকে ভিক্ষুকের মতো লাগছিল, তারপরেও সে কথা শেষ করল। একটা ব্যাপার তার ভালো লাগল– আনুশকা ঘটনাটা মন দিয়ে শুনল। অতি বড়লোকরা কোনো কিছুই মন দিয়ে শুনে না। তারা অল্পতেই অধৈর্য হয়ে পড়ে। এই মেয়ে অধৈর্য হচ্ছে না বা হলেও প্রকাশ করছে না। দিলশাদ অনেক কষ্টে হাসি হাসি মুখ করে বলল, এখন আমি পরিচিত অপরিচিত সবার কাছে ধার চেয়ে বেড়াচ্ছি। নিজেও লজ্জিত হচ্ছি, যার কাছে চাচ্ছি তাকেও লজ্জায় ফেলছি।

আনুশকা বলল, না, লজ্জার কী আছে! তুমি কি কিছু খাবে, চা বা কফি?

না। আমি এখন উঠব।

ভরদুপুরে শুধু-মুখে যাবে এটা কেমন কথা? সরবত করে দি?

কিছু লাগবে না।

আনুশকা হাসিমুখে বলল, তা কি হয়? বসো একটু।

দিলশাদকে সরবত এবং পেস্ট্রি খেতে হলো। আনুশকা তার হাতে মুখবন্ধ একটা খাম দিয়ে বলল, আমার পক্ষে যা সম্ভব তোমাকে দিলাম। এটা তোমাকে ফেরত দিতে হবে না।

দিলশাদ রিকশায় উঠে খামের মুখ খুলল। মাত্র একটা চকচকে পাঁচশ টাকার নোট খামের ভেতর ভরা। আনুশকা তাকে ভিক্ষা হিসেবেই পাঁচশ’ টাকা দিয়েছে।

এই লজ্জা, এই অপমান কি কোনোদিন দূর হবে? কোনোদিন কি দিলশাদ আনুশকার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে?

রিকশায় যেতে যেতে দিলশাদ ঠিক করল অপারেশনের পর নাতাশা যখন সুস্থ হয়ে যাবে তখন তাকে নিয়ে ঐ বাড়িতে আবার যাবে। সঙ্গে থাকবে ফুলের তোড়া আর দামি কিছু উপহার। দিলশাদ বলবে, আনুশকা, আমার মেয়েটা ভালো হয়ে গেছে। তোমাকে মেয়েটা দেখাতে আনলাম। ওর নাম নাতাশা। তোমার টাকাটা আমার দুঃসময়ে খুব কাজ দিয়েছে। টাকাটা ফেরত দিতে এসেছি। সঙ্গে সামান্য উপহারও এনেছি। খুব খুশি হব যদি উপহারটাও নাও।

সাজ্জাদের কাপড় ব্যবসায়ী ধনী মামার কাছেও দিলশাদ গিয়েছিল। তিনিও আনুশকার মতোই গভীর আগ্রহ নিয়ে সবকিছু শুনলেন। অনেকবার আহা আহা করলেন। কোন ডাক্তার দেখছে এসব জানলেন, তারপর বললেন– টিউমারের সবচে ভালো চিকিৎসা কী জানো মা? সবচে ভালো চিকিৎসা হলো হোমিওপ্যাথি। ঠিকমতো তিনটা ডোজ পড়লে আর দেখতে হবে না। আমার কাছে একজনের ঠিকানা আছে। লালবাগে বসে গোলাম সারোয়ার। তার কাছে যাও– আমার নাম বলল। সে দেখুক।

দিলশাদ বলল, ওকে বাইরে নিয়ে যাবার আমি সব ব্যবস্থা শেষ করেছি। আমি আপনার কাছে ধার চাইতে এসেছি। লাখখানিক টাকা আপনি আমাকে দিন।

তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি মা? এক লাখ টাকা আমি ধার দেব কীভাবে?

আপনি পারবেন। আপনাকে টাকাটা আমি ফেরত দেব। ইন্টারেস্টসহ দেব। ব্যাংক যে হারে ইন্টারেস্ট দেয় সে হারে দেব।

ভদ্রলোক চোখ-মুখ শুকনা করে বললেন, তুমি তো মা আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ। আমাকে সুদের লোভ দেখাচ্ছ। আমি কি সুদের কারবার করি? এইরকম নোংরা কথা তুমি কীভাবে বলো?

বেশ তো, আপনি সুদ নেবেন না। আসলটাই আমি আপনাকে ফেরত দেব।

আসল আমি পাব কই? এক লাখ টাকা তো খেলা কথা না। এতগুলি টাকা কোন সাহসে তুমি ধার চাও তাও তো বুঝি না।

দিলশাদ চলে এসেছে। আসার পথে রিকশায় সে কাঁদছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, সে যে কাঁদছিল তা সে নিজে বুঝতে পারে নি। রাস্তার লোকজনদের অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে নিজের গালে হাত দিয়ে দেখে গাল ভেজা।

মানুষের অনেক বড় বড় স্বপ্ন থাকে। দিলশাদের এখন কোনো বড় স্বপ্ন নেই। তার সব স্বপ্নই ছোট ছোট স্বপ্ন। একসময় সে খুব স্বপ্ন দেখত। তার বারান্দাটা সে স্বপ্ন দেখার জন্যেই সাজিয়েছিল। এই বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে নানা কিছু ভাবতে তার ভালো লাগত। বারান্দা আগের মতোই আছে। সে বদলে গেছে। এখন সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে বারান্দায় এসে বসে। অপেক্ষা করে। স্বপ্নের জন্যে অপেক্ষা করে না, ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করে।

অপেক্ষা করতে করতে দিলশাদ একসময় বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার সারা গায়ে মশা ভন ভন করতে লাগল। সে কিছুই টের পেল না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ