উত্তরার্চিক — উনবিংশ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে)– ১।১০।১৩ অগ্নি; ২।১৮ পবমান সোম; ৩-৫ ইন্দ্র; ৬।৮।১১।১৪।১৬. ঊষা; ৭।৯।১২।১৫।১৭ অশ্বিদ্বয়।
ছন্দ— ১।২।৬।৭।১৮ গায়ত্রী;
৩।১৩।১৪।১৫ ত্রিষ্টুপ; ৪।৫ প্রগাথ; ৮।৯ উষ্ণিক; ১০-১২ পঙক্তি; ১৬।১৭ জগতী।
ঋষি– ১ বিরূপ আঙ্গিরস; ২।১৮ অবৎসার কাশ্যপ; ৩ বিশ্বামিত্র গাথিন্; ৪ দেবাতিথি কাণ্ব
; ৫।৮।৯।১৬ গোতম রাহুগণ; ৬ বামদেব গৌতম; ৭ প্রস্কন্দ কাণ্ব; ১০ বসুশ্রুত আত্রেয়; ১১ সত্যশ্রবা আত্রেয়; ১২ অবস্যু আত্রেয়; ১৩ বুধ ও গবিষ্ঠি আত্রেয়; ১৪ কুৎস আঙ্গিরস; ১৫ অত্রি ভৌম; ১৭ দীর্ঘতমা ঔচথ্য।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– অগ্নি প্রত্নেন জন্মনা শুম্ভানস্তঘাঁতস্বা। কবিৰ্বিপ্ৰেণ বাবৃধে৷৷ ১। ঊর্জো নপাতমাহুবেইগ্নিং পাবকশোচিষম্। অস্মিন্ যজ্ঞে স্বধরে। ২। স নো মিত্রমহস্তুমগ্নে শুক্রেণ শশাচি। দেবৈরা সৎসি বহিষি ৷৩৷৷

সূক্ত ২– উত্তে শুষ্মসো অস্তু রক্ষো ভিন্তো অদ্রিবঃ। নুদস্ব যাঃ পরিধঃ৷ ১৷৷ অয়া নিজঘিরোজসা রথসঙ্গে ধনে হিতে। স্তবা অবিভূষা হৃদা৷ ২৷৷ অস্য ব্ৰতানি নাবৃষে পবমানস্য দূঢ্যা। রুজ যা পৃতন্যতি৷৷ ৩৷৷ তং হিন্তি মদচ্যুতং হরিং নদীযু বাজিন। ইমিন্দ্রায় মৎসর৷৷ ৪৷৷

সূক্ত ৩– আ মন্দৈরিন্দ্র হরিভির্যাহি ময়ূররোমভিঃ। মা ত্বা কে চিন্নি যমুরিন্ন পাশিনোহতি ধন্বেব তা ইহি। ১৷৷ বৃত্ৰখাদো বলং রুজঃ পুরাং দর্মো অপামজঃ। স্থাতা রথস্য হর্যোরভিম্বর ইন্ট্রো দৃঢ়া চিদারুজঃ ৷৷ ২৷৷ গম্ভীরা উদধীরিব ক্রতুং পুষ্যসি গা ইব। প্র সুগোপা যুবসং ধেনবো যথা হ্রদং কুল্যা ইবাশত ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৪– যথা গৌরো অপাকৃতং তৃষ্যত্যেবেরিণম্। আপিত্বে নঃ প্রপিত্বে তৃয়মা গহি কন্বেষু সু সচা পিব৷৷৷৷৷ মন্তু ভ্রা মঘবন্নিবো রাধোদেয়ায় সুধতে।

আমুয্যা সোমমপিবশ্চমূ সুতং জ্যেষ্ঠং তদ দধিষে সহঃ ॥২॥

সূক্ত ৫– ত্বমঙ্গ প্রশংসিযো দেবঃ শবিষ্ঠ মর্তম। ন হৃদন্যো মঘবন্নস্তি মর্জিতেন্দ্র ব্রবীমি তে বচঃ ॥১॥ মা তে রাধাংসি মা ত ঊতয়ো বসোহম্মান কদাচনা দভ। বিশ্ব চ ন উপমিমীহি মানুষ বসূনি চৰ্ষণিভ্য আ॥২৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– সর্বান্তর্যামী জ্ঞানদেব পুরাতন জন্মহেতু অর্থাৎ অনাদিত্ব হেতু আপনার মাহাত্ম্য প্রকাশ করে জ্ঞানিজনের দ্বারা সম্পূজিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -অনাদি অনন্ত জ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হন)। [সাধকেরা নিজেদের মুক্তিলাভের জন্য ভগবানের আরাধনায় রত হন। জ্ঞান-স্বরূপ সেই পরমদেবতার কৃপালাভ করবার জন্য তারা ভগবানের ॥ মহিমা কীর্তন করেন। জগতে প্রকাশমান ভগবানের বিভূতি দর্শন করে মানুষ তার চরণে প্রণত হয়। প্রত্নেন জন্মনা পদ দুটিতে জ্ঞানের জ্ঞানদেবের উৎপত্তি কথিত হয়েছে। প্রত্নেনপদের ভাষ্যার্থ পুরাণেন। প্রত্ন শব্দের অর্থ চির পুরাতন। প্রত্নেন জন্মনা পদ দুটির দ্বারা অনাদিত্বকে লক্ষ্য করে। জ্ঞান অনাদি অনন্ত। তার উৎপত্তি নেই, বিলয় নেই, কারণ তা ভগবানেরই বিভূতি মাত্র। এই পরিদৃশ্যমান জগতে তার বিভূতি বিদ্যমান রয়েছে। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ, তারা তারই মহিমা বিঘঘাষিত করে। মলয় পবনে তারই সুরভিত নিশ্বাস বায়ু প্রবাহিত হয়, কোকিল-কূজনে তারই কণ্ঠধ্বনি শুনতে পাওয়া মা মিন যায়। মাতৃ-হৃদয়ে তাঁরই স্নেহ-সুষমা, বজ্রধ্বনিতে তাঁরই রুদ্রকণ্ঠের পরিচয় জ্ঞাপন করে। সাধক জ্ঞান দৃষ্টিতে, প্রেম-দৃষ্টিতে বহির্জগতের সেই বিভূতি দর্শনে অন্তর্জগতের ধ্যানে নিমগ্ন হন। তাই বলা হয়েছে- স্বাং তন্বং শুম্ভানং বিপ্ৰেণ বাবৃধে]।

১/২– শক্তির রক্ষক, পবিত্রকারক জ্যোতিঃযুত জ্ঞানদেবকে আমরা কল্যাণদায়ক আমাদের অনুষ্ঠিত সকৰ্মে আহ্বান করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সৎকর্মের সাধনে আমরা ভগবানের জ্ঞানশক্তিকে যেন লাভ করি)। [প্রচলিত ধারণা ব্যতীত নপাত শব্দের মূল অর্থ রক্ষাকারী– পতন থেকে রক্ষাকারী। আমরা সর্বত্র এই অর্থ গ্রহণ করেছি। এখানে উর্জঃ নপাতং পদ দুটি অগ্নিং পদের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। জ্ঞানই মানুষের শক্তিরক্ষক। সেই জ্ঞান পাবকশোচিষং অর্থাৎ জ্ঞানের জ্যোতিঃ পবিত্রকারক। আমরা যেন সেই পবিত্ৰজ্যোতিঃ দ্বারা সৎকর্মসাধনে পরিচালিত হতে পারি- এটাই মন্ত্রের সারাংশ। এই মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে একটি অনুবাদ– বলের পুত্র এবং পবিত্র দীপ্তিযুক্ত অগ্নিকে এই হিংসাশূন্য যজ্ঞে আহ্বান করছি। এখানে উর্জ নপাতং পদ দুটি ভাষ্যকারের অন্নস্য পুত্রং অর্থকে অনুসরণ করেছে]।

 ১/৩– পরম আরাধনীয় মিত্রস্বরূপ হে জ্ঞানদেব! প্রসিদ্ধ আপনি নির্মলজ্যোতিঃর এবং দেবতাসমূহের সাথে আমাদের হৃদয়াসনে আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে জ্ঞানস্বরূপ ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [ভগবান্ মিত্রমহঃ পরমপূজনীয় মিত্রস্বরূপ। তাঁর আগমনে মানুষের সকলরকম উচভাব বিকশিত হয়। দেবভাবের বিকাশে মানুষ ক্রমশঃ ঊর্ধ্বমার্গে আরোহণ করতে সমর্থ হন। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে মিত্রগণের পূজনীয় অগ্নি। তুমি দেবগণের সমভিব্যহারে উজ্জ্বল তেজের সঙ্গে যজ্ঞে আসীন হও। মিত্রমহঃ পদের অর্থ করা হয়েছে– মিত্রগণের পূজনীয়। কিন্তু আমাদের ধারণা যে, এখানে মিত্র ও মহ এই দুই শব্দের একত্র সংযোগ হয়েছে। তার অর্থ পরমারাধনীয় মিত্রস্বরূপ দেব]।

২/১– রিপুনাশের জন্য পাষাণকঠোর হে দেব! রাক্ষসবর্গের বিনাশকারী আপনার আশুমুক্তিদায়িকা শক্তি জাগ্রত হোক। যে শবর্গ আমাদের বাধা প্রদান করে, তাদের বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুগণকে বিনাশ করুন)। [তিনি মানুষকে নিজের কোমল স্নেহধারায় সঞ্জীবিত করে তোলেন। আবার জগতের শত্রুনাশের সময় তারই বিশালগর্জন বিশ্বকে প্রকম্পিত করে তোলে (অথবা স্নেহবা পিতাও যেমন অসৎ-পথগামী প্রিয়তম পুত্রকে শাসনকালে পাষাণের মতো কঠোর হয়ে ওঠেন)। সুতরাং পরম করুণাময় মূর্তি পরিত্যাগ করে ভগবানকে কখনও কখনও রুদ্ররূপ ধারণ করতে হয়। অদ্রিবঃপদে সেই রূপেরই পরিচয় দেওয়া হয়েছে। উদ পদের উঠুক, জাগুক অর্থ অবলম্বনে ভগবানের রিপুনাশিকা শক্তি জাগ্রত হোক– এমন ভাবই এসেছে। অথবা তারই শক্তি আমাদের রিপুনাশে উদ্বুদ্ধ করুক। সমগ্র মন্ত্রের ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় আমরা যেন রিপুজয়ী হই। — এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে প্রস্তরসমুদ্ভূত সোমরস! রাক্ষসধ্বংসকারী তোমার তেজঃ সমস্ত উদ্ৰিক্ত হয়েছে, যে সকল বিপক্ষ চতুর্দিকে আস্ফালন করছে, তাদের তাড়িয়ে দাও। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

২/২– হে দেব! আপন শক্তির দ্বারা আপনি রিপুনাশক হন; সৎকর্মজনিত পরমধন লব্ধ হলে আপনাকে প্রাপ্তির জন্য আমরা যেন নির্ভয় হৃদয়ে আরাধনা করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এ প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মসাধনের দ্বারা ভগবানকে লাভ করতে আরাধনাপরায়ণ হই)। [অয়া ওজসা পদ দুটিতে ভগবৎশক্তিকেই লক্ষ্য করেছে। ভগবান্ শক্তির আধার। তিনি নিজে অজাতশত্রু। কিন্তু তাঁর প্রিয় সন্তান মানুষকে রিপুকবল থেকে রক্ষা করবার জন্য তাকে রিপুর শত্রু হতে হয়। সৎকর্ম সাধনের দ্বারা মানুষ যখন আপন হৃদয়ের মালিন্য দূরীভূত করতে সমর্থ হয়, তখনই তার পক্ষে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ সম্ভবপর হয়; কারণ দুর্বলেরও হৃদয়ে পুণ্যের শক্তি এমনই প্রবল হয় যে, সে অভীঃ হয়ে উঠতে পারে। প্রার্থনাও সেই শক্তিলাভের জন্যই। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ — এই আমি নির্ভয় হৃদয়ে (বিপক্ষের) রথমধ্যনিহিত ধন লুণ্ঠন করবার জন্য এবং নিজ বলে বিপক্ষ সংহার করবার উদ্দেশে সোমের গুণ গান করছি। আমাদের মনে হয়, এই অনুবাদ মূলমন্ত্রের ভাব মোটেই প্রকাশ করতে পারেনি, বরং অনেকাংশে বিপরীত ভাবই প্রকাশ করেছে। বিপক্ষ শব্দ অনুবাদকার অধ্যাহ্নত করেছেন। তারপর রথমধ্যস্থিত ধনরত্ন লুণ্ঠনের কোন প্রসঙ্গ মন্ত্রে নেই। এই ব্যাখ্যা থেকে যদি এটা অনুমান করা যায় যে, সোম বা মদ্যপানে উন্মত্ত আর্যগণও একশ্রেণীর দস্যু ছিলেন, তাহলে বিশেষ অন্যায় হবে কি? তা-ই হয়েছে। এমন ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করেই পাশ্চাত্য অথবা পাশ্চাত্যু-ভাবাপন্ন পণ্ডিত এমনই সিদ্ধান্ত প্রচার করেছেন। আমরা বহুবার উল্লেখ করেছি যে, বেদে ঐসব বিষয়ের কোনও প্রসঙ্গ নেই। বেদের মূল লক্ষ্য জগতে পরাজ্ঞান বিতরণ, ভগবানের মাহাত্ম্য প্রকাশ। সুতরাং তাতে ঐসব বিষয়ের প্রসঙ্গই থাকতে পারে না, এবং নাই-ও]।

২/৩– হে দেব! আপনার কৃপায় প্রসিদ্ধ পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্বের অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বজনিত কর্মসমূহ বিঘ্নকারক রিপুগণের দ্বারা নিবারিত হয় না; আপনাকে যে জন আরাধনা করে না তাকে বিনাশ করুন। (প্রার্থনামূলক মন্ত্রটির ভাব এই যে, হে দেব! রিপুদের অপ্রতিহত হয়ে আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বজনিত সৎকর্ম সাধন করতে পারি)। [ভগবান্ নিজের রক্ষাশক্তির প্রভাবে মানুষকে সকলরকম রিপুর আক্রমণ থেকে উদ্ধার করেন। যা সাধনপথের বিঘ্ন, তা ভগবানেরই কৃপায় দূরীভূত হয়। রুজ পদের অর্থ বিনাশ করুন। কথাটি এখানে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যারা পাপী, তাদের বিনাশ করার অর্থ, তাদের মধ্যস্থিত পাপপ্রবৃত্তিকে বিনাশ করা]।

২/৪– সাধকগণ পরমানন্দদায়ক, পাপহারক, আত্মশক্তিদায়ক, পরমানন্দপ্রদ, প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বকে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য অমৃতপ্রবাহে সম্মিলিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা ভগবানকে লাভ করার জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সমুৎপাদন করেন)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই যে সোম, যিনি মদিরা ক্ষরিত করেন, যার বর্ণ দুর্বদলবৎ, যিনি বলকর, তাকে ইন্দ্রের আনন্দবিধানের জন্য ঋত্বিকগণ নদীতে ঢেলে দিচ্ছেন। ভাষ্যকার নদী শব্দে বসতীবরী জলকে লক্ষ্য করেছেন। বাংলা অনুবাদকার তার সহজ নদী অর্থই গ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু তার দ্বারা কোন সুষ্ঠুভাব প্রকাশিত হয়নি। সোমরসকে নদীতে ইন্দ্রের জন্য ঢেলে দেওয়ার অর্থ কি? (এটা যেন কোনও মদের বিজ্ঞাপন, অথবা অঢেল মদ্য-প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন)। আমরা মনে করি, নদীষু পদে অমৃতপ্রবাহকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্ব অমৃতপ্রবাহের সাথে মিলিত হয়– এটাই মন্ত্রের ভাব। আবার ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য এই উভয়ের মিলন অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাই বলা হয়েছে– ইন্দুং নদীষু হিণ্বন্তি]।

৩/১– পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সৎকর্মসাধক সদানন্দদায়ক ময়ূররোমের ন্যায় বিচিত্ৰদৰ্শন অর্থাৎ চিত্তাকর্ষক অথবা বিচিত্র সামর্থোপেত অর্থাৎ নানা রকমে অসৎবৃত্তির নাশক জ্ঞানকিরণসমূহের দ্বারা যুক্ত আপনি আমাদের কর্মে অথবা হৃদয়ে আগমন করুন। (প্রার্থনার ভাব, এই যে, – হে ভগবন! নিখিলজ্ঞানকিরণসমূহ আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করুক। আপনার কৃপায় যাতে প্রজ্ঞানসম্পন্ন হতে পারি এবং সেই প্রজ্ঞানের প্রভাবে যাতে আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তা বিহিত করুন)। হে ইন্দ্র! পাশহস্ত ব্যাধ যেমন বন্ধনসাধক পাশের দ্বারা পক্ষিগণের গমনপ্রতিবন্ধক জন্মিয়ে তাদের নিহত করে, তেমনই কোনও শত্রুই যেন আপনার গমনপ্রতিবন্ধক উৎপন্ন করে নিহত না করে। পরন্তু, মরুপ্ৰদেশ প্রাপ্ত হলে পান্থ যেমন শীঘ্র তা অতিক্রম করে আগমন করে, তেমনই আপনি গমনপ্রতিবন্ধক শত্রুগণকে অতিক্রম (অর্থাৎ পরাভূত) করে, আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মে অথবা হৃদয়ে শীঘ্র আগমন করুন। (এই মন্ত্রাংশে অন্তঃশত্রু-বহিঃশত্রু নাশের কামনা প্রকাশ পেয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের সকল শত্রুকে নাশ করে আমাদের আপনার সাথে সম্মিলিত করুন এবং আমাদের উদ্ধার করুন)। [ভাষ্যের অনুসরণে এই মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা প্রচলিত হয়েছে তা এই, হে ইন্দ্র! তুমি মাদক ও ময়ূরের লোমের ন্যায় লোমযুক্ত অশ্বের সাথে আগমন করো। ব্যাধ যেমন পক্ষীকে বাধা দেয়, তেমন তোমাকে যেন কেউ বাধা না দেয়। (পথিক) যেমন মরুদেশ (অতিক্রম করে গমন করে), তেমন তুমি ঐ সব বাধা অতিক্রম করে আগমন করো। কিন্তু আমাদের পরিগৃহীত অর্থ অন্য ভাব. দ্যোতনা করে। যেমন, আমরা মনে করি মন্দ্রৈঃ পদে সেই পরমানন্দের প্রতি লক্ষ্য আছে। সে আনন্দ তুচ্ছ মাদকদ্রব্য-পানের আনন্দ নয়। মানুষের আত্যন্তিক দুঃখনাশজনিত যে আনন্দ– জন্মগতি-রোধে যে নিত্য আনন্দ, এখানে সেই বিষয়ই প্রখ্যাত হয়েছে। হরিভিঃ পদে আমরা (ভাষ্যকারের মতো) অশ্বসমূহের সাথে অর্থ গ্রহণ করি না। আমরা এই পদে পূর্বাপর জ্ঞানকিরণসমূহ, জ্ঞানরশ্মিসমূহ অর্থ প্রতিপন্ন করেছি। ময়ূররোমভিঃ পদের ময়ূরের লোমের ন্যায় অর্থও আমরা গ্রহণ করি না। আমাদের মতে, এই পদের অর্থ– ময়ূরের রোমের মতো বিচিত্রদর্শন, চিত্তাকর্ষক তথা বিচিত্রসামর্থ্যযুত, নানারকম অসৎ-বৃত্তিনাশকারীইত্যাদি। সত্ত্বসমন্বিত হলে, বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হলেই জ্ঞান বিচিত্ৰদৰ্শন হয়। এ ভিন্ন তাকে অজ্ঞানতা ভিন্ন অন্য কিছু বলা যায় না। যখনই জ্ঞান নানা দিকে প্রধাবিত হয়, যখনই সে বিচিত্র সামর্থ্য লাভ করে, তখনই নানা রকমে অসৎ-বৃত্তিনাশে তার সামর্থ্য জন্মায়; সেই অবস্থাতেই জ্ঞান ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধ করতে সমর্থ হয়। -ইত্যাদি। মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশে অজ্ঞানতারূপ শনাশের প্রার্থনা বিদ্যমান। …..ব্যাধ যেমন পাশ বিস্তার করে পক্ষিগণের গমনের প্রতিবন্ধকতা উৎপাদন করে, আমার অন্তরের শত্রুরাও আপনাকে সেইভাবে বাধা প্রদান করবে। কিন্তু আপনি (হে ভগবন) সে ক্ষেত্রে এমন করুন, যেন তারা আপনার আগমনের অন্তরায় না হতে পারে। তারা আমার হৃদয় মরুভূমি সদৃশ করে রেখেছে। মরুপথগামী পথিকের সত্বর মরু-অতিক্রমের মতো আমার হৃদয়রূপ মরুভূমি অতিক্রম করুন এবং আমাতে প্রতিষ্ঠিত হোন। ইত্যাদি]।

৩/২–- পাপবিনাশক রিপুগণের শক্তিনাশক অমৃতদায়ক রিপুগণের আশ্রয়নাশক ভগবান্ ইন্দ্রদেব এ সৎকর্মের পাপহারিকা শক্তি আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করেন; দৃঢ়শত্রুকেও বিনাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ পাপনাশক রিপুনাশক হন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ ইন্দ্র বৃত্রের বিনাশক, তিনি মেঘ বিদীর্ণ করেন ও জল প্রেরণ করেন। তিনি শত্ৰুপুরী বিদীর্ণ করেন, তিনি অশ্বদ্বয়কে আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করবার জন্য রথে আরোহণ করেন। তিনি বলবান শত্রুদেরও ভগ্ন করেন। এখানে বৃত্ৰখাদঃপদের অর্থ করা হয়েছে, বৃত্রাসুরনাশক। আমরা বৃত্র পদে সবসময়েই জ্ঞানাবরক পাপকেই লক্ষ্য করি। বলংরুজঃ পদের ভাষ্যার্থ মেঘের বিদীর্ণকারী। এই প্রচলিত মতের পশ্চাতে যে আখ্যায়িকা আছে– ভাষ্যকার তারই দিকে লক্ষ্য রেখে এমন অর্থ করেছেন। এইরকমভাবেই তিনি অপামজঃ পদের অর্থ করেছেন জলবর্ষণকারী। কিন্তু আমরা; বলংরুজঃ অর্থে রিপুণাং শক্তিনাশকঃ, অপামজঃ অর্থে অমৃতদায়কং ইত্যাদি বুঝি]।

৩/৩–- হে দেব! জলের দ্বারা যেমন গম্ভীর সমুদ্র পূর্ণ হয়, তেমনভাবে আপনি সৎকর্মকে পোষণ করেন; সৎকর্মসাধক যেমন পরাজ্ঞান লাভ করেন, পরাজ্ঞান যেমন আশুমুক্তি প্রদান করে এবং ক্ষুদ্রজলধারা যেমন মহানদীকে প্রাপ্ত হয়, তেমনভাবে সকল জীব আপনাকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সকলজীব ভগবানে চরম-আশ্রয় প্রাপ্ত হয়)। [মন্ত্রে কয়েকটি উপমার সাহায্যে মন্ত্রের ভাব পরিস্ফুট করবার চেষ্টা করা হয়েছে। মন্ত্রের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় জীবের চরম গতি। মন্ত্রের সর্বশেষ উপমাতে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই ভাবের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! সাধু গোপালক যেমন গাভী সকলকে পরিপুষ্ট করে, তুমি যেমন সমুদ্রকে (নদীর দ্বারা পরিপুষ্ট করো), তেমন তুমি যজ্ঞকর্তাকে পুষ্ট করে থাকো। ধেনুগণ যেমন তৃণ ইত্যাদি (প্রাপ্ত হয়, তেমন তুমি সোমরস প্রাপ্ত হয়ে থাকো), সরিৎ যেমন হ্রদ প্রাপ্ত হয়, (তেমন সোমরস তোমাকে ব্যাপ্ত করে)। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম অভিনিধনঙ্কাণ্বম]।

৪/১– গৌরমৃগ পিপাসার্ত হয়ে জলপরিপূর্ণ তড়াগের প্রতি যেমনভাবে শীঘ্ৰ প্ৰধাবিত হয়; তেমনভাবে আপনার সাথে বন্ধুত্বে মিলনের জন্য অর্থাৎ আপনাতে আমাদের সন্যস্ত করবার জন্য, হে ভগবন! আপনি আমাদের নিকট শীঘ্র আগমন করুন; এবং আমাদের ন্যায় অকিঞ্চনের সাথে অভিন্নভাবে অর্থাৎ অভিন্ন হয়ে প্রকৃষ্টরূপে আমাদের হৃদয়সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভক্তিসুধা পান করুন অর্থাৎ গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; অকিঞ্চন আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব ও ভক্তিসুধা গ্রহণ করে আমাদের আপনার সাথে সম্মিলিত করে নিন)। অথবা চন্দ্র তৃষ্ণার্ত হয়ে অর্থাৎ সূর্যরশ্মির সাথে সম্মিলনে আকাঙ্ক্ষী হয়ে, যে রকমে অপগত-আবরক অর্থাৎ তেজঃসমূহের দ্বারা পরিপূর্ণ পূর্ণতেজঃসম্পন্ন সূর্যরশ্মির প্রতি গমন করে; তেমন, আপনার সুখিত্বে অর্থাৎ আপনাতে সন্যস্তচিত্ত হলে, হে ভগবন! আপনি আমাদের হৃদয়ে শীঘ্র আগমন করেন অর্থাৎ আবির্ভূত হন; এবং আমাদের ন্যায় অকিঞ্চনের মধ্যে অভিন্নভাবে প্রকৃষ্টরূপে সম্মিলিত হয়ে আমাদের হৃদয়-সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বকে গ্রহণ করেন। (প্রার্থনা-পক্ষে মন্ত্রের ভাব, -আমাদের মতো অকিঞ্চনের শুদ্ধসত্ত্বকে বা ভক্তিসুধাকে গ্রহণ করে আমাদের আপনাতে সম্মিলিত করুন, অথবা আমাদের মধ্যে অবস্থিতি করুন। চন্দ্র যেমন ৷ কখনও সূর্যরশ্মির সম্বন্ধকে পরিত্যাগ করেন না, হে ভগবন! আপনিও সেইভাবে আমাদের সাথে  চিরসম্বন্ধযুত হয়ে থাকুন)। [মন্ত্রের প্রথম চরণই জটিলতার সৃষ্টি করেছে। গৌরঃ এবং ইরিণং ও এক পদ দুটির যে ব্যাখ্যা প্রচলিত হয়েছে, তাতে যেন সে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গৌরঃ পদের অর্থে, ভাষ্যে এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে গৌরমৃগঃ প্রতিবাক্য গ্রহণ করা হয়; আর ইরিণং পদের অর্থ হয়- তৃণশূন্য তড়াগদেশ। মন্ত্রের পিব পদ দেখেই সোমের সম্বন্ধ অধ্যাহৃত হয়েছে। কথেষু পদের অর্থ করা হয়েছে– কণ্বপুত্রগণ। শেষপর্যন্ত মন্ত্রের ব্যাখ্যা দাঁড়িয়েছে-গৌরমৃগ যেমন তৃষিত হয়ে জলপূর্ণ তৃণশূন্য (স্থান) জানতে পারে; তেমন তুমি বন্ধুত্ব প্রাপ্ত হলে আমাদের অভিমুখে শীঘ্র আগমন করো, আমরা কণ্বপুত্র, আমাদের সাথে একত্র (সোমরস) পান করো। এমন ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, সোমমদ্যলোভাতুর ইন্দ্র যেন যজমানদের সাথে একসঙ্গে বসে সোম পান করেন। এ তো পরিষ্কার কদর্থ এবং কু-ব্যাখ্যা। আমাদের মন্ত্রার্থে দুটি অন্বয় অবলম্বনে দুটি অনুবাদ পরিবেশন করেছি। প্রথমটিতে ভাষ্যকে অনুসরণ করেই যে ভাব প্রদর্শন করা হয়েছে, অবশ্যই তা ভাষ্যকারের ভাবের থেকে স্বতন্ত্র এবং অধিকতর সঙ্গত। দ্বিতীয় অন্বয়ে গৌরঃ শব্দকে অভিধানিক অর্থেই চন্দ্র বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইরিণং পদের অর্থ, অভিধান-মতে– উষর ভূমি। (কেউ ইরিণংপদের সাথে ইরান-দেশের সম্বন্ধ খ্যাপন করতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি। (পণ্ডিতের ব্যাপার তো! ) যাই হোক, ঐ পদের অর্থ আমরা পূর্ণতেজষ্ক সূর্যরশ্মি ভাব গ্রহণ করি। — ইত্যাদি। এই সব বিষয় বিবেচনা করে মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশনে ব্রতী হলে, এই মন্ত্রের ভাবার্থ হয় এই যে, সুধাকর সুধার আধার হয়েও যেমন সুধাপানে সদা তৃষিত হয়ে আছেন, হে ভগবন! আপনিও তেমন, সকল জ্যোতিঃর সকল সুধার সকল সৎ-ভাবের আধারস্থানীয় হয়েও, আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর ভক্তিসুধার শুদ্ধসত্ত্বের প্রতি চিরতৃষিতনয়নে দৃষ্টিপাত করুন। ফলতঃ ভগবান্ যেন সর্বতোভাবে সর্বদা অনুগ্রহপরায়ণ থাকেন, উপমায় এই কামনাই প্রকাশ পেয়েছে]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ ২দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৪/২– পরমধনদাতা ভগবন হে ইন্দ্রদেব! আপনি সৎকর্মের সাধককে পরমধন প্রদানের জন্য আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব আপনাকে প্রীত করুক; আপনি কঠোর সাধনার দ্বারা বিশুদ্ধীকৃত শ্রেষ্ঠ শুদ্ধসত্ত্ব আরাধনাপরায়ণ আমাদের নিকট হতে আহরণ করে গ্রহণ করুন, তারপর প্রসিদ্ধ আত্মশক্তি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পূজোপচার গ্রহণ করে আমাদের পরমশক্তি প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে মঘব ইন্দ্র! সোম সকল অভিষবকারীকে ধন দানার্থে তোমাকে প্রমত্ত করুক। তুমি সোম পান করেছ। ঐ সোম অভিষবণ-ফলকের দ্বারা অভিযুত, অতএব অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য, এইজন্য তুমি মহাবল ধারণ করেছ।  — এই বঙ্গানুবাদ সম্বন্ধে অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। . [এই সূক্তের দুটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। নাম মনাদ্যম]।

৫/১– হে বলবত্তম! দ্যোতমান্ স্বপ্ৰকাশ আপনি, এই মনুষ্যকে– অর্চনাকারী আমাকে ত্বরায় আপনার উপাসনাপরায়ণত্ব-হেতু প্রশংসনীয় করুন। (প্রার্থনা এই যে, আমি যেন আপনার উপাসনাপরায়ণ হয়ে প্রশংসনীয় শ্রেষ্ঠ গতি প্রাপ্ত হই)। হে পরমধনশালিন্ ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনার অপেক্ষা অন্য কেউই সুখদাতা নেই; অতএব, আপনার উদ্দেশে স্তোত্র উচ্চারণ করছি। (ভাব এই যে, -ভগবৎপরায়ণ হয়ে আমি যেন প্রশংসনীয় হই এবং ভগবানের উপাসনার প্রভাবে যেন সুখশান্তি, লাভ করি, হে ভগবন! তা-ই বিধান করুন)। [এই মন্ত্রের প্রশংসিষো পদের অর্থ প্রশংসা করো। ৩ এ তাতে প্রথম চরণের অর্থ দাঁড়ায় হে অতিশয়তম বলবন্ ইন্দ্রদেব! আপনি মরণশীল মনুষ্যের প্রশংসা করুন। এমন বলার তাৎপর্য কি? এতে কোনও সৎ-ভাব প্রকাশ পায় না বলে ভাষ্যে এবং ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের অন্তর্গত মং পদের একটা বিশেষণ অধ্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। যে মরণশীল পুরুষ ভগবানের স্তবপরায়ণ, ভাষ্যে বলা হয়েছে, তারই প্রতি লক্ষ্য রয়েছে। আমরাও সেই ভাবেরই অনুসরণ করি। দ্বিতীয় চরণের দুটি অংশে যথাক্রমে ভগবানের মহিমা এবং আত্ম-উদ্বোধনা প্রকাশ পেয়েছে]।

৫/২– আশ্রয়দাতা হে ভগবন! আপনার অঙ্গীভূত পরমার্থরূপ ধনসমূহ ও আপনার আয়ত্তীভূত রক্ষাকর্মসকল, আমাকে (এই কর্মবিহীন দীনকে) এবং আমাদের (অর্থাৎ অপরাপর সকলকে) কখনও যেন পরিত্যাগ না করে কখনও যেন আমার প্রতি বিমুখ না হয়। আর, হে মনুষ্যত্বসম্পন্ন (অথবা, হে মনুষ্য)! মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিবর্গের নিকট হতে আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকদের নিকট হতে ধর্মার্থকামমোক্ষরূপ সকল ধন-সমূহকে তুমি সর্বতোভাবে আহরণ করে, আমাদের আমাদের ন্যায় কর্ম-পরাজুখ জনের জন্য অর্থাৎ লোকগণের হিতসাধনের নিমিত্ত, প্রদান করো। (এই মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্বোধক। ভগবানের করুণা ব্যষ্টিভাবে ও সমষ্টিভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোক; এবং আমরা সকলেই যেন সাধুবর্গের নিকট হতে পরমার্থ-তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হয়ে অপরকে তা জানাবার প্রচেষ্টা করি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যাসমূহ এবং ভাষ্য থেকে এই মন্ত্র আমাদের ব্যাখ্যায় সম্পূর্ণ নতুন ও সঙ্গত ভাব-প্রকাশক হয়েছে। একটি ভাষ্যানুসারী বঙ্গানুবাদ– হে নিবাসস্থানদাতা ইন্দ্র! তোমার ভূতগণ ও সহায়রূপ (মরুৎগণ) আমাদের যেন কখনও বিনাশ না করে। হে মনুষ্যের হিতকারী ইন্দ্র! আমরা মন্ত্র জানি, তুমি আমাদের ধন এনে দাও। — আমরা রাধাংসি পদে পূর্বাপর পরমার্থরূপ ধনকে লক্ষ্য করে আসছি, এখানেও তা করেছি। উতয়ঃ পদে আমরা ইন্দ্রের সহায়, মরুৎগণকে লক্ষ্য করিনি। আমরা ঐ পদে রক্ষাকর্মসমূহ লক্ষ্য করেছি। দভ ক্রিয়া-পদে বিমুখ হওয়ার, সুতরাং পরিত্যাগ করার ভাব পাওয়া যায়। দ্বিতীয় চরণের মানুষ পদ থেকে কিভাবে মানুষের হিতসাধক ইন্দ্র অর্থ আসে তা ভেবে পাওয়া যায় না। আমরা বলি, এখানে সম্বোধন মনুষ্যকে মনুষ্যত্বসম্পন্ন জনকে। অথবা মানুষ সম্বোধনে মানুষকে জনসাধারণকে সম্বোধন করা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। চর্ষনিভ্যঃ পদটিকে আমরা পঞ্চমীর পদ বলে সিদ্ধান্ত করি। ঐ পদের ভাব ত্রিকালজ্ঞ ঋষিগণের নিকট হতে আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকদের নিকট হতে। এখানকার চৰ্ষণিভ্যঃ পদে ভাষ্যে চৰ্ষণি শব্দের সৎ-অর্থই দৃষ্ট হয়। আমরাও পূর্বাপর এই ভাবই গ্রহণ করে আসছি। কিন্তু ভাষ্যকার, বিশেষতঃ তার অনুবর্তী ব্যাখ্যাকারগণ ঐ শব্দে পূর্বে কৃষক (চাষা) অর্থ গ্রহণ করে গেছেন। তা প্রকৃত অর্থ নয়, এখানেই তা বোধগম্য হবে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– পৌরুমীঢ়ম এবং ত্রৈককুভম্]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৬– প্রতি য্যা সূনরী জনী ব্যুচ্ছন্তী পরি স্বসু। দিবো অদর্শি দুহিতা৷১ অশ্বের চিত্রারুষী মাতা গবামৃতাবরী। সখা ভূদখিনোরুষাঃ॥ ২॥ উত সখাসনিার৩ মাতা গবামসি। উতোযো বস্ব ঈশিষে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৭– এষো ঊষা অপূর্বা ব্যুচ্ছতি প্রিয়া দিবঃ। ষে বামশিনা বৃহৎ৷১৷৷ যা দুস্রা সিন্ধুমাতরা মনোতরা রয়ীণা। ধিয়া দেব বসু বিদা৷ ২৷৷ বচ্যন্তে বাং ককুহাসো সূর্ণায়ামধি বিষ্টপি। যদ্বাং রথো বিভিষ্পতাৎ৷৷ ৩৷

সূক্ত ৮– উচ্চিত্রমাভরাস্মভ্যং বাজিনীতি। যেন তোকং চ তনয়ং চ ধামহে৷৷৷৷ উষো অদ্যেহ গোমত্যশ্বাবতি বিভাবরি। রেবদম্মে ব্যুচ্ছ সূতাবতি ॥ ২॥ যুঙ্ক্ষা হি বাজিনীবত্যখা আদ্যারুণ উষঃ। অথা নে। বিশ্বা সৌভগান্যা বহ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৯– অশ্বিনা বৰ্তিরস্মদা গোমদ দম্রা হিরণ্যবৎ। অর্বাগ্ রথং সমনসা নি যচ্ছতম্ ॥১॥ এহ দেবা ময়োভুবা দা হিরণ্যবর্তনী। উষবঁধে বহন্তু সোমপীতয়ে৷২৷৷ যাবিখা শ্লোকমা দিবো জ্যোতির্জনায় চক্ৰথুঃ। আ ন ঊর্জং বহতমশ্বিনা যুব৷৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ—  ৬সূক্ত/১সাম– প্রসিদ্ধ সেই জনগণের সৎপথ প্রদর্শনকারিণী স্বসৃভূত সর্বজনে জ্ঞানপ্রদানকারিণী দিব্যজাতা জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবী সর্বজীবের হৃদয়ে আবির্ভূতা হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন দিব্যজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই আদিত্যদুহিতা দৃষ্ট হচ্ছেন। তিনি (প্রাণিগণের) নেত্রী ও (সুফলের) উৎপাদয়িত্রী। তিনি, ভগিনী (রাত্রির) পর্যবসান-কালে অন্ধকার বিনাশ করেন। আমরা দিবঃ পদে দ্যুলোকস্য অর্থাৎ স্বর্গের অর্থই স্বাভাবিক ও সঙ্গত বলে মনে করি। তাই দিব্যদুহিতা পদ দুটির অর্থ হয়– দিব্যজাত, স্বর্গজাত, জ্ঞান স্বর্গজাত নিশ্চয়ই, কারণ জ্ঞান ভগবানেরই শক্তি। সূনরী পদের অর্থ সুষ্ঠু নেত্রী — জনগণের সৎপথপ্রদর্শনকারিণী। জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবী সম্বন্ধেই এই বিশেষণ সুষ্ঠুভাবে প্রযুক্ত হতে পারে। পরিব্যুচ্ছন্তী (দীপ্তিং কুন্তি, জ্ঞানং প্রযচ্ছন্তী) পদের অর্থও এই ভাবের সমর্থক। — মন্ত্রটির মূলভাব জগতের সূর্বলোক জ্ঞান লাভ করে ধন্য হোক, আমরা যেন সেই পরমদেবীর কৃপালাভে বঞ্চিত না হই]।

৬/২– ব্যাপক জ্ঞানের ন্যায় জ্যোতির্ময়ী হিতকারিণী (অথবা সত্যপ্ৰাপিকা) জ্ঞানকিরণের উৎপাদয়িত্রী অর্থাৎ জ্ঞানের মূলীভূত জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবী আধিব্যাধিনাশক দেবদ্বয়ের সখা হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানের প্রভাবে লোকসমূহ আধিব্যাধিমুক্ত হয়)। [এখানে জ্ঞানের মাহাত্ম্য পরিকীর্তিত হয়েছে। প্রথম অংশ- অশ্বের চিত্রাঅর্থাৎ ব্যাপক জ্ঞানের তুল্য বিচিত্র। এখানে ব্যাপক জ্ঞানের সাথে সমানত্ব সূচিত হচ্ছে। সেই জ্ঞান ঋতাবরী অর্থাৎ হিতকারিণী বা সত্যপ্রাপিকা। গবাং মাতা পদ দুটিতেও এই অর্থই সূচিত হয়। জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবীই জ্ঞানের জননী। যা থেকে জ্ঞানের উন্মেষ হয়, তাকে জ্ঞানের ভিত্তিভূমি বা উৎপত্তিভূমি বলা যায়। এই দিক থেকেও ঐ পদ দুটিতে আমরা জ্ঞানস্য মূলীভূতা অর্থ গ্রহণ করেছি। অশ্বিননাঃ সখা ভূৎ মন্ত্রাংশের মধ্যে বিশেষ ভাব নিহিত আছে। মানুষ যখন আধিব্যাধিতে পীড়িত হয়, রিপুবর্গের আক্রমণে বিব্রত হয়ে পড়ে তখন মানুষকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র জ্ঞান। জ্ঞানের প্রভাবেই মানুষ সকল রকম বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে মন্ত্রের এই ভাবই পরিব্যক্ত হয়েছে। অশ্বিনো– অশ্বিনীকুমার যুগলরূপ ভগবানের দুই বিভূতি যা মানুষের অন্তর্ব্যাধি ও বহির্ব্যাধির নিবারক। -মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– অশ্বিনীর মতো মনোহরা, দীপ্তিমতী ও রশ্মিসমূহের মাতা যজ্ঞবতী ঊষা অশ্বিদ্বয়ের বন্ধু হন। — ভাষ্যকার ঋতাবরী পদের যজ্ঞবতী অর্থ করেছেন। বিবরণকার ঐ পদের হিতকরী অর্থ করেছেন]।

৬/৩– জ্ঞানের উন্মোষিকে হে দেবি! আপনি আধিব্যাধিনাশক দেবদ্বয়েরও সখা হন; অপিচ, পরাজ্ঞানের মূলীভূতা কারণস্বরূপা হন; এবং আপনি পরমধনের ঈশ্বরী হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানই লোকবর্গের ভবদুঃখনিবারক পরমবন্ধুস্বরূপ হন)। [এই মন্ত্রের বিশেষ পদগুলি অবলম্বনে মন্ত্রের ভাব পূর্ব মন্ত্রেই ব্যাখ্যাত হয়েছে। তবে এখানে গবাং পদে ভাষ্যকার গরু অর্থ করেননি। ঐ পদে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন– রশ্মীনাং। আমরা কিন্তু গো পদে পূর্বাপরই জ্ঞানকিরণ। অর্থ করেছি। এখানে গবাং পদের অর্থ পরাজ্ঞানের এবং মাতা অর্থে উৎপাদয়িত্রী বা মূলীভূতা]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– জরাবোধীয়ম]।

৭/১– সেই (জ্ঞানিগণের দৃশ্যমানা) অভিনবত্বসম্পন্না, রমণীয়া, জ্ঞানের উন্মেষকারিণী ঊষাদেবতা, যখন দ্যুলোক হতে এসে অজ্ঞান-অন্ধকার নাশ করেন, তখন হে অন্তৰ্বাধিবহির্ব্যাধি নাশক দেবদ্বয়, আমি আপনাদের আরাধনা করি। (ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়ে জ্ঞানের উন্মেষ হলে, আমরা যেন অন্তর্ব্যাধি ও বহির্ব্যাধি বিনাশের জন্য প্রচেষ্টাপরায়ণ হই অর্থাৎ দেবভাবের অনুসারী হই)। এই মন্ত্রের প্রচলিত অর্থের আভাষ সায়ণ-ভায্যের বঙ্গানুবাদেই পাওয়া যাবে। রাত্রি-প্রভাতে ঊষা-সমাগমে অশ্বিনীকুমার-দ্বয়ের পূজা আরম্ভ হয়। সাধারণ প্রচলিত অর্থে, মন্ত্রে এই ভাব মাত্র আছে। মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ দেখলেও কি অর্থ উপলব্ধ হয়, তাতেই বোঝা যায়। অনুবাদ; যথা আমাদের দৃশ্যমান সকলের প্রীতিজনক ঊষা দেবতা মধ্যরাত্রিতে অগোচর ছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বর্গ হতে আগমন করে অন্ধকার বিনাশ করছেন। হে অশ্বিনীকুমারদ্বয়। আপনাদের বিস্তর স্তব করি। কিন্তু ঊষা দেবতা যে ভাব পাওয়া যায় এবং অশ্বিনীকুমার দেবদ্বয় যে যে ভগবৎ-বিভূতির প্রকাশক হন, তাতে মন্ত্রের অর্থ সম্পূর্ণ অন্য পথ পরিগ্রহ করে। যে দেবতার অনুকম্পায়, বা হৃদয়ে যে দেবভাবের বিকাশে জ্ঞানের উন্মেষ হয়, সেই দেবতাকে (ভগবানের বিশেষ বিভূতিকে) ঊষাদেবতা বলে মনে করি। অশ্বিদ্বয় বলতে অন্তর্ব্যাধি ও বহির্বাধিনাশক দেবদ্বয় (ভগবানের বিশেষ বিভূতিদ্বয়) বুঝিয়ে থাকে। এ বিষয়ও পূর্বে আলোচিত হয়েছে। ঐ দুই (ঊষা ও অশ্বিনীকুমার দ্বয়) দেবতার স্বরূপতত্ত্ব হৃদয়ে ধারণা হলে, তখন আর মন্ত্ৰাৰ্থ নিষ্কাশনে কোনরকম দ্বিধাভাব বা অন্তরায় আসতে পারে না। জ্ঞানের উন্মেষ হলেই, দেবতার পূজায় (দেবভাব-সঞ্চয়ে) প্রবৃত্তি আসে। বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ ব্যাধি-বিনাশই সে প্রবৃত্তির প্রথম প্রচেষ্টা। ভগবৎ-কৃপায় জ্ঞানের উন্মেষ হলে, মানুষ প্রথমে অন্তরস্থিত ও বহিঃস্থিত ব্যাধি দূর করতে পারে]।

৭/২– সৎ-বস্তু-দর্শনকারক (আধি-ব্যাধিনাশক) স্নেহক্ষরণশীল, পরমার্থধন-বিতরণে অভিলাষী, সকল সম্পপ্ৰদাতা যে প্রসিদ্ধ দেবদ্বয়, তাদের যেন হৃদয়ের সাথে (কর্মের দ্বারা) অনুসরণ করি। (সেই দেবদ্বয় সর্বদা আমাদের অনুসরণীয় হোন– এই ভাব)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত কয়েকটি পদের অর্থ উপলক্ষে মন্ত্রটি বিভিন্ন বিপরীত ভাব ব্যক্ত করছে। যেমন, দ পদ। পূর্বে সায়ণ ঐ পদে রিপুনাশক শত্রুনাশক অর্থ করেছিলেন। এখানে ঐ পদে দর্শনীয় অর্থ করছেন। তারপর সিন্ধুমাতরা। ঐ পদে, সমুদ্রের পুত্র বলে অশ্বিদ্বয়কে পরিচিত করা হয়েছে। কেউ আবার বলছেন, — সিন্ধু শব্দে অন্তরিক্ষকে বোঝায়। এবং সিন্ধুমাতরা পদে অন্তরিক্ষের পুত্র অর্থ হয়। আমরা পূর্ব পূর্ব মন্ত্রে পৃশ্নিমাতরঃ বলস্য পুত্রঃ প্রভৃতি স্থলে যে ভাব ও যে অর্থ গ্রহণ করেছি, এখানেও তা-ই সঙ্গত বলে মনে করি। সেই দেবদ্বয় সদস্নেহধারাক্ষরণশীল (সিন্ধু শব্দের মূল স্য ও এ ধাতুর অর্থ ক্ষরিত হওয়া); তারা সতত স্নেহকরুণা বিতরণের জন্য উন্মুখ আছেন– সিন্ধুমাতরা পদে সেই ভাব প্রকাশ করে। ঐ পদে আরও একটা ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। অনন্ত স্নেহকরুণার আধার ভগবানকে সিন্ধু স্বরূপ মনে করলে, তার অঙ্গীভূত দেবদ্বয়কে তাঁর পুত্র-স্থানীয় বলে মনে করতে পারা যায়। তাতে ঐ পদের অন্তর্গত মাতৃ-শব্দের এক ভাব প্রাপ্ত হই, আর পূর্বোক্ত অর্থে আর এক ভাব পেতে পারি। তবে এই দুই ভাবেই এক অভিন্ন নিগূঢ়তত্ত্ব ব্যক্ত হয়। আমরা তাই সিন্ধুমাতরা পদের প্রতিবাক্যে স্নেহধারাক্ষরণশীলৌ অথবা অনন্তস্নেহসমুদ্র-সমুদ্ভূতৌ পদ গ্রহণ করেছি। — ইত্যাদি।]।

৭/৩– হে দেবদ্বয়! যখন আপনাদের সম্বন্ধীয় আমাদের কর্মরূপ নানাশাস্ত্রে স্কৃয়মান স্বর্গলোকে পক্ষির ন্যায় শীঘ্রগতিতে গমন করে; রথ, তখন আপনাদের স্তুতিসমূহ আমাদের কর্তৃক উচ্চারিত হয়। ভাব এই যে, সৎকর্মের শুভফলজনিত আনন্দ যখন আমরা উপভোগ করতে সমর্থ হই, তখনই দেবতার আরাধনায় প্রবৃত্তি আসে। [মানুষ সহসা ভগবানের উপাসনায় প্রবৃত্ত হতে চায় না। তাদের আপনা হতে অনুষ্ঠিত সৎকর্মগুলি তাদের প্রথমে সেই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে। কর্মের অনুষ্ঠানের ফলে তারা ক্রমশঃ উচ্চগতি প্রাপ্ত হয়। তখন তারা ভগবানের মহিমা বুঝতে পারে। তখন তারা তার গুণ-অনুকীর্তনে তন্ময় হয়ে পড়ে। এটাই এ সংসারে সংসারীর রীতিপ্রকৃতি। সকল সৎকর্মের প্রারম্ভেই ঔদাসীন্য অবহেলা ও বীতরাগ আসে। কিন্তু কর্মের মধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, সে আবিল্য দূরীভূত হয়। এখানে সেই ভাবই পরিব্যক্ত। মন্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন, — সাধনপথে একটু অগ্রসর হবার চেষ্টা করো। তখন ভগবানের মহিমা আপনিই উপলব্ধ হবে। তখন দেবতার উপাসনায় আপনিই প্রবৃত্ত হবে। মন্ত্রে এই ভাব উপলব্ধি করলেও, মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ কিন্তু অন্যভাবদ্যোতক। সে অর্থে প্রকাশ– হে অশ্বিনীকুমারদ্বয়! যে সময়ে আপনাদের রথ অশেষ শাস্ত্র দ্বারা স্তুত স্বর্গলোকে অশ্ব দ্বারা বাহিত হয়ে গমন করে, সেই কালে আমরা আপনাদের স্তব করি। – সে যা-ই হোক, রথঃ পদে এখানে আমাদের কর্মরূপ যানই সঙ্গত। তার দ্বারাই দেবগণের (দেবভাবের) অধিষ্ঠান হয়। এটাই প্রকৃত তাৎপর্য]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– জরাবোধীয়ম]।

৮/১– সৎকর্মে প্রবর্তক হে জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবতা! আমাদের জন্য চায়নীয় শ্রেষ্ঠ মুক্তিপ্রদ সেই ধনকে আহরণ করুন- প্রদান করুন; এবং যে ধনের দ্বারা পুত্রপৌত্র ইত্যাদি বংশপরম্পরা সকল লোককে আমরা ধারণ করতে অর্থাৎ উদ্ধার করতে সমর্থ হই, সেই ধন আমাদের প্রদান করুন। (ভাব এই যে, যে জ্ঞানধনের দ্বারা আমরা নিজেদের এবং অপর সকলকে উদ্ধার করতে সমর্থ হই, জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবতা সেইধন আমাদের প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রের প্রার্থনার মর্ম অনুধাবন করলেই ঊষার সম্বোধনে যে ঊষাকালকে বোঝায় না, তা প্রতিপন্ন হয়। এ পক্ষে ভাষ্য ইত্যাদির ভাব অনুসরণ করেই আমরা ঐ বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। দেবতার কাছে প্রার্থনা জানান হয়েছে– ধন-প্রাপ্তির জন্য। আবার তোকং তনয়ং চ পুত্রপৌত্র ইত্যাদি যাতে সেই ধন প্রাপ্ত হয়, তারও কামনা প্রকাশ পেয়েছে। ধনের বিশেষণে আবার দেখা যায়– চিত্রংও তৎপদ দুটি রয়েছে। তাতে যে ধন বিচিত্র, যে ধন আকাঙ্ক্ষণীয়, যে ধন শ্রেষ্ঠ, ইত্যাদি ভাব আসতে পারে। সে ধন যে এ ধনই হোক, ঊষাকাল যে তা প্রদান করতে পারে, কেউই তা মনে করতে পারেন না। কিন্তু জ্ঞানের এ উন্মেষের ফলে মানুষ যে বিচিত্র পরমরমণীয় শ্রেষ্ঠ ধনকে লাভ করতে পারে, কোনও সংশয় নেই। আমরা সেই অর্থেই যৌক্তিকতা দেখি]।

৮/২– জ্ঞানপ্রভা-সমন্বিত, বিস্তারক জ্ঞানরশ্মিযুত, প্রকৃষ্ট প্রকাশসম্পন্ন, প্রিয় সত্যবাক্যবিশিষ্ট হে জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবতা! আপনি নিত্যকাল আমাদের হৃদয়ে অথবা আমাদের সম্বন্ধীয় ইহজগতে পরম ধনকে প্রতিষ্ঠা করুন। (ভাব এই যে, — জ্ঞানের উন্মোষিকাঁদেবতার কৃপায় আমাদের সকলের হৃদয়ে সৎ-জ্ঞানের সঞ্চার হোক)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত ব্যুচ্ছপদের অর্থ উপলক্ষে মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ বিপরীত পথ পরিগ্রহ করেছে, সেই উপলক্ষেই ভাষ্য ইত্যাদিতে একটা কষ্টকল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। মূলে আছে রেবৎ পদ; তার অর্থ দাঁড়িয়েছে– ধনযুক্তং কর্ম যথা ভবতি তথা। আবার মূলে আছে– ব্যুচ্ছ পদ; তার অর্থ গ্রহণ করতে হয়েছে– নৈশং তমো নিবারয়। বুঝে দেখুন, অর্থের উদ্ধার-পক্ষে কেমন পদগুলি অধ্যাহার করে আনতে হয়েছে। কিন্তু এমন কষ্ট-কল্পনার কোনই প্রয়োজন ছিল না। আমরা বলি, ব্যুচ্ছ পদের অর্থ বর্জন করুন নয়; তার অর্থ– সংরক্ষণ করুন। উচ্ছী ধাতুতে বর্জন অর্থ বোঝালেও বি-উপসর্গের যোগে তার বৈপরীত্য স্বীকার করা যায়। সেই অনুসারে ভাবার্থ দাঁড়ায় এই যে, আমাদের মধ্যে পরম ধন সংরক্ষণ করুন; অর্থাৎ আমাদের সদাকাল সেই পরমার্থ-রূপ ধন প্রদান করুন। দেবতার সম্বোধন ইত্যাদির বিষয় অনুধাবন করলেও ঐ অর্থেই সঙ্গতি দেখা যায়। ঊষাকাল-পক্ষে সুনৃতাবতি (প্রিয়সত্যবাক্যবিশিষ্টে) সম্বোধন সার্থক বলে মনে হয় কি? রূপক স্বীকার ব্যতীত এখানে কোনই ভাব পরিগ্রহ হয় না। পক্ষান্তরে জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবী বা বৃত্তি আমাদের যে প্রিয়সত্যবাক্যে উদ্বুদ্ধ করেন তা সহজেই বোধগম্য হয়। পরন্তু গোমতি ও অশ্বাবতি সম্বোধনে যে জ্ঞানরশ্মির ও তার ব্যাপকতার বিষয় কীর্তিত হয়েছে, তা-ই বোঝা যায়]।

৮/৩– সৎকর্মে প্রবর্তক হে জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবতা! নিত্যকাল নিশ্চয়রূপে অবিচ্ছেদে নবপ্রভাযুক্ত ব্যাপকজ্ঞানকিরণসমূহকে আমাদের হৃদয়ে সংযোজন করুন; তারপর আমাদের জন্য সকল সৌভাগ্যকে অর্থাৎ মঙ্গলসমূহকে আনয়ন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে দেবতা! আমাদের জ্ঞান-সমন্বিত করে আমাদের জন্য ধর্মার্থকামমোক্ষ-রূপ চতুর্বর্গের ফল প্রদান করুন। [যুঙ্ক্ষা ক্রিয়াপদের সাথে অরুণান্ অশ্বান পদ দুটির সংযোগ হওয়ায়, মন্ত্রের প্রথম চরণের অর্থ দাঁড়িয়েছে, — অরুণ-বর্ণের অর্থাৎ লাল রঙের ঘোটক সকলকে যুক্ত করো। ভাষ্যকার আবার অশ্বান্ পদে অশ্বস্থানীয় গো-বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেছেন। তার অভিপ্রায় এই যে, — লাল বর্ণের গো-বিশেষকে যুক্ত করতে বলা হয়েছে। কোথায় যুক্ত হবে সে বিষয় অবশ্য ভাষ্যে উহ্য রয়েছে। কোনও ব্যাখ্যাকার ভাবে শকটকে আকর্ষণ করে এনেছেন। তাতে অর্থ দাঁড়িয়েছে– আপন গো-যানে রক্তবর্ণ গো গণকে যুক্ত করে ঊষা সৌভাগ্য সকলকে (ধনসমূহকে) এনে দিন। যাই হোক, আমরা গাড়ীতে ঘোড়া বা গরু যুতবার ভাব গ্রহণ করি না। আমরা যথাপূর্ব জ্ঞানলাভ-পক্ষেই কামনার বিষয় স্বীকার করি। হৃদয়ে জ্ঞান-সংযোগই এখানকার প্রার্থনা]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান। আছে। তার নাম– শ্রুধ্যম]।

৯/১– অন্তর্ব্যাধি-বহির্ব্যাধি-নাশক হে অশ্বিদেবদ্বয়! আপনারা শত্রুগণের ক্ষপয়িতা অর্থাৎ বিদূরক তা হয়ে আমাদের হৃদয়কে জ্ঞানকিরণান্বিত এবং হিত-রমণীধনযুক্ত অর্থাৎ সত্ত্বসম্পন্ন করুন; এবং ও ঐকান্তিক যত্নের দ্বারা সুকর্ম রূপ যানকে অর্বাচীন অর্থাৎ আমাদের হৃদয় অভিমুখে প্রবর্তিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবদ্বয়! পারিপার্শ্বিক সকল বাধা দূর করে আমাদের সকল রকমে সৎকর্মসাধনে সামর্থ্যযুক্ত করুন)। [মন্ত্রের অন্তর্গত গোমৎও হিরণ্যবৎপদ দুটি উপলক্ষে, প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে প্রকাশ, দেবতা দুজনের কাছে গাভীযুক্ত ও হিরণ্য ইত্যাদিযুক্ত ধনের প্রার্থনা করে, তাঁদের রথকে প্রার্থনাকারীর গৃহ অভিমুখে প্রবর্তিত করবার কামনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যা প্রথমে শত্রুকে দূর করতে বলা হয়েছে, অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু যথাক্রমে কামক্রোধ ইত্যাদি ও ভৌতিক আক্রমণের প্রভাবকে প্রথমে নাশ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। তারপর হৃদয় জ্ঞানকিরণে উদ্ভাসিত হোক, হিত-রমণীয় ধন অধিগত হোক– ইত্যাদি আকাঙ্ক্ষা পরিব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এ সকলেরই মূল– সৎকর্মসাধন। উপসংহারে তাই বলা হয়েছে– সমনসা অর্বাক্ রথং নিচ্ছতং। এখানে রথং বলতে সৎকর্ম-রূপ যান অর্থেই সঙ্গতি দেখা যায়]।

৯/২– জ্ঞান উন্মেষের দ্বারা প্রবুদ্ধ আমাদের কর্মনিবহ অর্থাৎ আমাদের সৎকর্মসমূহ, শুদ্ধসত্ত্বকে পাওয়াবার জন্য অর্থাৎ সেই কর্মসমূহের সাথে সম্মিলনের জন্য, দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত, সুখপ্রদাত, শত্রুনাশক, হিরণ্যের ন্যায় আকাক্ষণীয় মার্গানুসারী অর্থাৎ সৎপথের অনুবর্তী, সেই দেবদ্বয়কে, এই সংসারে– লোকের হৃদয়-অভ্যন্তরে বহন করে আনুক। (ভাব এই যে, জ্ঞানসমন্বিত আমাদের কর্মের দ্বারা আমরা যেন লোকবর্গকে অন্তৰ্বাধিবহির্বাধিনাশক দেবতা দুজনের তত্ত্ব সর্বথা বিজ্ঞাপিত করতে সমর্থ হই)। [আমাদের ব্যাখ্যায় এই মন্ত্রের অর্থ সম্পূর্ণ নূতন ভাবের প্রকাশক হলো। ব্যাখ্যাকারদের মধ্যেও অবশ্য মতান্তর দৃষ্ট হয়। ব্যাখ্যায় সকলেই ভাষ্যের অনুসরণ করেননি। ভাষ্যের মতে উষবুধঃ পদের লক্ষ্য ঊষাকালে জাগরিত অশ্বের প্রতি। সেই অনুসারে অর্থ হয়– অশ্বিদ্বয়ের বাহন অশ্বগণ ঊষাকালে জাগরিত হয়ে তাদের (অশ্বিদ্বয়কে) যজ্ঞক্ষেত্রে বহন করে আনুক। প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– দ্যুতিমান্ আরোগ্যপ্রদ সুবর্ণরথযুক্ত এবং দস্র অশ্বিদ্বয়কে সোমপান করবার জন্য অশ্বগণ ঊষাকালে জাগরিত হয়ে এস্থলে আনয়ন করুক। — আমাদের ব্যাখ্যা আমাদের মন্ত্রার্থেই প্রকাশিত]।

৯/৩– অন্তৰ্বাধি-বহির্বাধি-নাশক হে অশ্বিদেবদ্বয়! আপনারা লোকহিতসাধনের জন্য পূর্বোক্ত প্রকারে অর্থাৎ সকলকে কর্মসামর্থ্যদানের পর, দ্যুলোক হতে– সত্ত্বনিলয় হতে– শংসনীয় তেজঃকে অর্থাৎ জ্ঞানকিরণকে ইহজগতে আনয়ন করুন; এবং এই প্রার্থনাকারী আমাদের জন্য বলপ্রাণকে অথবা সৎকর্মসাধনের শক্তিকে আনয়ন করুন- প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবতাযুগল! ইহজগতে সর্বদা জ্ঞানকিরণ বিস্তার করুন এবং আমাদের মধ্যে বল-প্রাণ সঞ্চার করুন)। [মন্ত্রের অন্তর্গত শ্লোকং ও জ্যোতিঃ পদ দুটির অর্থ উপলক্ষে ভাষ্যে ও ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সংশয় দেখা যায়। সায়ণ শ্লোকং পদের প্রতিবাক্যে শংসনীয় পদ গ্রহণ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে জ্যোতিঃপদের তেজঃ অর্থই সঙ্গত। সেই অনুসারে, অশ্বিদ্বয় সংসারে শংসনীয় তেজঃকে আনয়ন করেন– এই ভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু কোনও কোনও ব্যাখ্যাকার শ্লোকং পদে স্তোত্র অর্থের সার্থকতা দেখেছেন। তাদের দৃষ্টিতে জ্যোতিঃ পদে আলোকঅর্থ প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের ব্যাখ্যা আমাদের মন্ত্রার্থেই প্রকাশিত]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম শ্রুধ্যম্]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ১০– অগ্নিং তং মনো যো বসুরস্তং যং যন্তি ধেনবঃ। অস্তমবন্ত আশবোহস্তং নিত্যাসো বাজিন ইয়ং স্তোতৃভ্য আ ভর৷ ১৷৷ অগ্নিহিঁ বাজিনং বিশে দদাতি বিশ্বচৰ্ষণি। অগ্নী রায়ে স্বাভুবং স প্রীততা যাতি বাৰ্যমিষং স্তোতৃভ্য আ ভর৷৷ ২৷৷ সসা অগ্নিৰ্যো বসুৰ্গণে সং যমায়ন্তি ধেনবঃ। সমৰ্বন্তো রঘুবঃ সং সুজাতাসঃ সূরয় ইষং স্তোতৃভ্য আ ভর৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১১– মহে নো অদ্য বোধয়োযো রায়ে দিবিতী। যথা চিয়ো অবোধয়ঃ সত্যবসি বাষ্যে সুজাতে অশ্বসূনৃতে॥১॥ যা সুনীথে শৌচদ্রথে বৌচ্ছো দুহিতর্দিবঃ। সা ব্যুচ্ছ সহীয়সি সত্যবসি বায্যে সুজাতে অশ্বসুনৃতে৷ ২৷৷ সা নো অদ্যা ভরদ্বসুর্য্যচ্ছা দুহিতর্দিবঃ। যো ব্যৌচ্ছঃ সহীয়সি সশ্রবসি বায্যে সুজাতে অশ্বসূতে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১২– প্রতি প্রিয়তমং রথং বৃষণং বসুবাহন। স্তোতা বামশ্বিনাবৃষি স্তোমেভির্ভূষতি প্রতি। মাধ্বী মম শুতং হব৷৷ ১। অত্যাঘাতমখিনা তিরো বিশ্বা অহং সনা। দম্রা হিরণ্যবর্তনী সুষুণা সিন্ধুবাহসা। মাধ্বী মম সুতং হব৷ ২৷৷ আ নো রত্নানি বিভ্রতাবশ্বিনা গচ্ছতং যুবম্। রুদ্রা হিরণ্যবর্তনী জুষাণা বাজিনীবসু। মাধ্বী মম শুতং হব৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১০সূক্ত/১সাম– প্রজ্ঞানস্বরূপ যে ভগবান্ সকলের পরমাশ্রয়ভূত; সকলের আধারভূত প্রজ্ঞানস্বরূপ যে ভগবানকে আশ্রয় করে জ্ঞানকিরণসমূহ অবস্থিতি করে; অপিচ, সকলের আশ্রয়স্বরূপ যে ভগবানকে সদা সৎকর্মপরায়ণ আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকগণ আশ্রয় করেন এবং সদা সৎকর্মশীল আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন জ্ঞানিগণ সকলের আশ্রয়ভূত যে ভগবানকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ যাঁতে আত্মলীন করেন, জগতের আধারভূত জগকারণ প্রজ্ঞানাধার সেই ভগবানকে আমরা স্তুতি করি অর্থাৎ আশ্রয় করি। সেই হেন গুণসম্পন্ন হে ভগবন! আপনার আশ্রয়-প্রার্থনাকারী আমাদের অভীষ্টফল প্রদান করুন। (ভাব এই যে, সৎকর্মপরায়ণ সাধুবৰ্গই ইহসংসারে অবিচলিতভাবে ভগবানের আরাধনায় রত থাকেন। সেই কর্মের দ্বারাই ভঃ বানের সামীপ্য-প্রাপ্ত তারা পরমপদ লাভ করেন। অতএব সেই ভগবান্ আমাদের পরমপদ ও সিদ্ধি প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ যিনি নিবাসপ্রদ, এবং যাঁকে ধেনুগণ, শীঘ্রগামী অশ্বগণ ও নিত্য প্রবৃত্ত হব্যদাতাগণ নিজ নিজ গৃহের ন্যায় আশ্রয় করে, আমি সেই অগ্নিকে স্তুতি করি। হে অগ্নি! স্তোতাগণের জন্য অন্ন আনয়ন করো। বলা বাহুল্য, এই ব্যাখ্যার সাথে আমরা একমত নই। আমরা মনে করি, নানা ভাব-প্রকাশক এই মন্ত্রে একদিকে যেমন নিত্যসত্যপ্রকাশক আত্ম-উদ্বোধনা আছে, অন্যদিকে তেমনি উচ্চতর প্রার্থনার ভাব সূচিত হয়েছে। জগৎ-ধারক জগৎ-রক্ষক, সর্ব-স্রষ্টা ও সর্ব প্রলয়ের অধীশ্বর ভগবানের প্রতি অনুরক্ত হলে, তার পূজায় প্রাণমন উৎসর্গ করলে, তাতে সহজেই যে আত্মলীন করতে পারা যায়, ভগবান স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাদের যে উদ্ধার করেন, — মোক্ষপদ প্রদান করেন– এই সত্যই মন্ত্রের প্রথমাংশে প্রকটিত। দ্বিতীয় অংশে সূচিত প্রার্থনার ভাবে যেন প্রার্থনাকারী বলছেন– সৎকর্মে জ্ঞান-উন্মেষে যখন আপনাকে পাওয়া যায়, আত্মজ্ঞানসম্পন্ন সাধকগণ যখন তার প্রভাবেই আপনাকে পেয়ে থাকেন, তখন আমরাই বা আপনাকে পাব না কেন? আপনার কৃপাকটাক্ষপাত হলে আমরাও তো তাদের মতো গুণকর্মসমন্বিত হতে পারি। আপনি আসুন। আমাদের মধ্যে জ্ঞানের উন্মেষ করে দিন, আমাদের সৎকর্মসাধনে উদ্বুদ্ধ করুন। আপনাকে পাবার উপযোগী করে নিন। ….অর্থাৎ তার দেওয়া জ্ঞানরশ্মির সাহায্যেই সাধক তাঁর পদপ্রান্তে পৌঁছাতে এবং তার দেওয়া জ্ঞানের ফলেই তাঁর চরণে বিলীন হতে চাইছেন। এটাই সঠিক প্রার্থনা]। [এই মন্ত্রটি ছদার্চিকেও (৪অ-৮দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১০/২– বিশ্বদ্রষ্টা জ্ঞানদেবই সাধকদের শক্তিদায়ক জ্ঞান প্রদান করেন। প্রসিদ্ধ সেই জ্ঞানদেব প্রসন্ন হয়ে ধনার্থীকে কল্যাণদায়ক সকলের বরণীয় পরমধন প্রদান করেন; হে দেব! কৃপাপূর্বক প্রার্থনাকারী আমাদের পরাসিদ্ধি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই লোকবর্গকে পরাজ্ঞান প্রদান করেন; তিনি আমাদের সেই পরমধন প্রদান করুন)। [মন্ত্রে জ্ঞানের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। জ্ঞানদেব বলতে এখানে ভগবানের শক্তিবিশেষকেই (বা বিভূতিকেই) লক্ষ্য করা হয়েছে। ভগবান্ বিশ্বদ্রষ্টা, বিশ্বের যাবতীয় বিষয় তার নখদর্পণে রয়েছে। তিনি অন্তর্যামীরূপে সাধকের হৃদয়ে বর্তমান থেকে তার মনোবাসনা পূর্ণ করেন। জ্ঞানদেব, সাধকদের জ্ঞান প্রদান করেন সেই জ্ঞান লাভ করে তারা মোক্ষমার্গে অগ্রসর হতে সমর্থ হন। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সকলের দর্শক অগ্নি যজমানদের অন্নযুক্ত (পুত্র) দান করেন, অগ্নি প্রীত হয়ে সর্বত্র ব্যাপ্ত ও বরণীয় ধন (দানের জন্য) গমন করেন। (হে অগ্নি! ) স্তোতাগণের জন্য অন্ন আহরণ করো। হোমের জন্য, প্রজ্বলিত অগ্নির কাছে এমন প্রার্থনাই প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলির উপজীব্য বিষয়। এ এ অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১০/৩– পরমাশ্রয়স্বরূপ যে দেবতা সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হন, জ্ঞানকিরণসমূহ যে। দেবতাকে প্রাপ্ত হয়, আশুমুক্তিকামী সাধকগণ যে দেবতাকে প্রাপ্ত হন, দিব্যভাবান্বিত জ্ঞানিগণ যে দেবতাকে প্রাপ্ত হন, সেই প্রসিদ্ধ জ্ঞানদেব প্রার্থনাকারী আমাদের পরাসিদ্ধি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় আমরা যেন পরাসিদ্ধি লাভ করি)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– যিনি নিবাসপ্রদ বলে স্তুত হন, যাঁর নিকট ধেনুগণ সমাগত হয়, দ্রুতগামী অশ্বগণ সমাগত হয় এবং সুজাত মেধাবীগণ সমাগত হন, তিনি অগ্নি। (হে অগ্নি! ) স্তোতাগণের জন্য অন্ন আহরণ করো। পূর্বের এবং পূর্ব পূর্ব মন্ত্রের আলোচনায় আমরা অগ্নির স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের সঙ্গত ধারণা ব্যাখ্যা করেছি। বর্তমান মন্ত্রের সূত্রে পুনরায় দেখা যেতে পারে যে, ভাষ্য ইত্যাদিতে যে অগ্নির উল্লেখ করা হয়েছে, সেই অগ্নি কি? যদি কাষ্ঠ ইত্যাদি দাহনশীল পরিদৃশ্যমান অগ্নিই মন্ত্রের লক্ষ্যস্থল হয়, তবে তা নিবাসপ্রদ হবে কেমন করে? আবার, সেই অগ্নির কাছে ধেনুগণ এবং দ্রুতগামী অশ্বগণ সমাগত হয় কেমন করে এবং কেন? তাছাড়া সুজাত মেধাবীগণই বা সেই অগ্নির কাছে কি জন্য যান?– আমাদের মনে হয় মন্ত্রের পদগুলির অর্থপ্রসঙ্গেই ভ্রান্তির অবসর ঘটেছে। প্রথমে দেখতে হবে অগ্নি শব্দে কোন বস্তুকে লক্ষ্য করে। আমরা পুনঃ পুনঃ বলেছি যে, বেদের মধ্যে অনিত্য বস্তুর বা ঘটনার কোনও প্রসঙ্গ নেই। বেদে নিত্য আধ্যাত্মিক সত্যই প্ৰখ্যাপিত হয়েছে। এই মন্ত্রেরও অগ্নি শব্দের মূল অর্থ মানুষের অন্তরস্থিত জ্ঞানাগ্নি। আবার ধেনবঃ পদে গরু বাছুর প্রভৃতি কিছুই বোঝায় না। ধেনবঃ পদে জ্ঞানকিরণকে বোঝায়। তাহলে পূর্ব অর্থ অনুসারে ধেনবঃ সমায়ন্তি পদ দুটির অনুবাদ হয়– জ্ঞানকিরণসমূহ যাঁকে প্রাপ্ত হয়। যং সর্বনাম পদ অগ্নি শব্দের পরিবর্তে, ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, তার অর্থ, জ্ঞানকিরণসমূহ জ্ঞানদেবতাকে প্রাপ্ত হয়। এই অংশের তার ব্যাখ্যা অনাবশ্যক। কারণ জ্ঞানকিরণ জ্ঞানদেবেরই বিভূতি। দ্বিতীয় অংশ, — রঘুদ্রবঃ অবন্তঃ ষং সমায়ন্তি– তার বঙ্গানুবাদ, যার নিকট দ্রুতগামী অশ্বগণ সমাগত হয়। আমরা মনে করি। রঘুবঃ অবন্তঃ পদ দুটিতে আশুমুক্তিকামী সাধকগণকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। তারাই জ্ঞানদেবের নিকটে গমন করেন অর্থাৎ সাধকগণ সাধনার প্রভাবে পরাজ্ঞান প্রাপ্ত হন। এটাই মন্ত্রাংশের অর্থ। সুজাতাসঃ সূরয়ঃ সং অংশের অর্থ সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়]।

১১/১– সৎকর্মসমুদ্ভুত সৎকর্মের অধিষ্ঠাত্রি জ্ঞানোন্মোষিকে হে দেবি! দীপ্তিমতী আপনি যেভাবে আত্মশক্তিসম্পন্ন সত্যশীল ব্যক্তিতে আপনাকে নিত্যকাল প্রকাশিত করেন; তেমন পরমধনলাভের জন্য আমাদের উদ্বোধিত করুন। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন। [সৎকর্মের সাধনের দ্বারা ও অবিচলিতভাবে সত্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে জীবন পথে চলাতে মানুষের হৃদয় পবিত্র হয়, অসত্য অজ্ঞানতা দূরে পলায়ন করে। সত্যের সাধনা ব্যতীত জ্ঞানলাভ অসম্ভব। সত্যের সাধনার দ্বারা হৃদয়ের পাপ কলুষতা সবই দূরে পলায়ন করে। তখন হৃদয় পূত পবিত্র নির্মল হয়ে ওঠে। সাধক আনায়াসে জ্ঞানলাভে অধিকারী হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ ৮দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১১/২– হে দিব্যজাতে দেবি! যে আপনি শুচিসম্পন্ন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিতে জ্যোতিঃ প্রদান করেন, সেই আপনি শক্তিবান শক্তি-সমুদ্ভুত সত্যশীল সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিতে জ্যোতিঃ প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সত্যপরায়ণ সৎকর্মসাধক ব্যক্তি দিব্যজ্যোতিঃ লাভ করেন)। [দুহিতাৰ্দিবঃ পদের ভাষ্যার্থ সূর্যের কন্যা ঊষা। বিবরণকারের মতে– অহো দুহিতৃভূতা ঊষাঃ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দিবঃ পদের অর্থ সম্বন্ধে দুটি ব্যাখ্যার মধ্যেই অসামঞ্জস্য ঘটেছে। অবশ্য দিবঃ পদের সূর্য ও দিবস এই উভয় অর্থই গৃহীত হতে পারে। কিন্তু প্রচলিত মত অনুসারেই সূর্য ও ঊষার সম্বন্ধ বিষয়ে বিরোধ বর্তমান আছে। কোনওস্থলে সূর্যকে ঊষার পিতা বলা হয়েছে, আবার কোনও কোনও স্থলে সূর্য ঊষার জার (উপপতি) বর্ণিত হয়েছেন। এমন অসঙ্গত ও অসামঞ্জস্য কেবলমাত্র প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারেই সম্ভবপর। এমন ব্যাখ্যার জন্যই পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও তাদের শিষ্য প্রশিষ্যগণ, বেদ ও বৈদিক ভারত সম্বন্ধে নাসিকা কুঞ্চিত করেন। অথচ এখানে সূর্য ও ঊষা সম্বন্ধে কোনও উপাখ্যানের অবসর নেই। — প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রের মূলভাব জ্ঞানের মহিমা ও সাধকের সৌভাগ্য প্রখ্যাপন]।

১১/৩-– হে দিব্যজাতে দেবি! যে, আপনি শক্তিবান শক্তিসমুদ্ভুত সত্যশীল শোভনকর্মা সত্যজ্ঞানার্থী ব্যক্তিতে জ্যোতিঃ প্রদান করেন, পরমধনদাত্রী সেই আপনিই নিত্যকাল আমাদের অজ্ঞানতা দূর করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ তার জ্ঞানশক্তির দ্বারা আমাদের সর্বতোভাবে নিত্যকাল রক্ষা করুন)। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের মধ্যেই কয়েকটি একই পদ ব্যবহৃত হয়েছে, সুতরাং এখানে তার পুনরালোচনার প্রয়োজন নেই। তবে পূর্বৰ্মন্ত্রে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হবার পর বর্তমান মন্ত্রে আছে প্রার্থনা। সেই প্রার্থনার মর্ম এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় সর্বদা বিপদ থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারি। এই মন্ত্রের বিশেষত্ব এই যে, তমোনাশের জন্য হৃদয়স্থিত অজ্ঞানান্ধকার বিনাশের জন্যই মন্ত্রে বিশেষভাবে প্রার্থনা করা হয়েছে। বিপদ থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রার্থনার ভাব বর্তমান আছে সত্য, কিন্তু তা-ও জ্ঞানলাভ-সাপেক্ষ। তাই এই মন্ত্রে জ্ঞানেরই প্রাধান্য পরিকীর্তিত। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে স্বর্গতনয়া ধন-আহরণকারিণী ঊষা! তুমি তেমন অদ্য আমাদের অন্ধকার দূর করো। হে সুজাতা অশ্বার্থ সম্যক্ ঔতাদেবী! তুমি ব্যপুত্র বলবান সত্যবার তমোনাশ করেছিলে। বলা বাহুল্য এরকম ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব পরিবর্তিত হতে বাধ্য এবং তা-ই হয়েছে]।

১২/১– ভবব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! আত্মউৎকর্ষসম্পন্ন সাধক আপনাদের অতিপ্রিয়, অভীষ্টবর্ষণশীল পরমধনপ্রাপক সৎকর্মরূপ বাহনকে সৎ-ভাব সমন্বিত স্তোত্রের দ্বারা অলঙ্কৃত করছেন। (ভাবার্থ আত্মজ্ঞানসম্পন্ন সাধক ভগবানের মাহাত্ম্য কীর্তন করছেন এবং সৎকর্ম-সাধন সামর্থ্য লাভের জন্য ভগবানের আরাধনা করছেন)। অমৃতপ্রদানকারী হে দেবদ্বয়! আপনাদের কর্মে নিযুক্ত আমার প্রার্থনা আপনারা প্রকৃষ্টরূপে গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাকে সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করে উদ্ধার করুন)। [জ্ঞানী সাধক ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। কেন?– সৎকর্মের সাধনের জন্য, সামর্থ্য প্রাপ্তির জন্য। এখানে রথং পদে ভাষ্যকার কাষ্ঠ ইত্যাদি নিমিত্ত যানবিশেষকে লক্ষ্য করেছেন। আমরা পূর্বাপর দেবতার রথ-শব্দে সৎকর্মরূপ যান অর্থ গ্রহণ করে আসছি। যা মানুষকে ভগবানের সমীপে বহন করে নিয়ে যায়, তা-ই তো প্রকৃত রথ। সেই রথ– সৎকর্ম। বর্তমান মন্ত্রে রথং পদের বিশেষণগুলির প্রতি লক্ষ্য করলেই আমাদের রথংপদে যে ভাব উপলব্ধ হয়, তা পরিস্ফুট হবে। — রথ কেমন? প্রিয়তমং– ভগবানের অতিশয় প্রিয়। সৎস্বরূপ ভগবানের সৎসম্বন্ধ ভিন্ন প্রিয়তম কি হতে পারে? মানুষের সৎকৰ্মই তার অতিশয় প্রিয়। সেই রথ-বৃষণং- অভীষ্টবর্ষণশীল। সাধারণ রথ কিভাবে মানুষের সমস্ত অভীষ্ট পূরণ এ করবে? কিন্তু সৎকর্মসাধনের দ্বারা মানুষ তার চরম অভীষ্ট লাভ করতে পারে, জীবনের চরম লক্ষ্যে, পৌঁছাতে পারে। সে রথ আমাদের বসুবাহনং- পরমধনপ্রাপক সৎকর্মই মানুষকে তার অভীষ্ট ২ পরমধন দিতে পারে, সৎকর্মের সাহায্যেই মানুষের বাসনা কামনার নিবৃত্তি ঘটে। সে রথ যেমন মানুষকে ভগবানের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়; তেমনি সে রথ আবার, ভগবৎপ্রাপ্তির মূলীভূত পরমধন। মোক্ষ বহন করে আনে। মানুষ যে সৎপথে চলে সৎকর্মসাধনে পরমপদ প্রাপ্ত হতে পারে, বসুবাহনং পদে তা-ই সূচিত হচ্ছে। জ্ঞানী সাধক সেই সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করেন। যাতে প্রার্থনাকারী সেই সামর্থ্য লাভ করতে পারেন, তার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনাই মন্ত্রের শেষাংশে দেখতে পাওয়া যায়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৭দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১২/২– আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! আপনারা আমাকে প্রাপ্ত হোন; প্রার্থনাকারী আমি নিত্যকাল যেন সকল শত্রুকে নিবারণ করতে সমর্থ হই; রিপুনাশক, সৎকর্ম-সাধনসামৰ্থ-প্রাপক, পরমধনদাতা, অমৃতপ্রস্রবণ, অমৃতপ্রাপক দেবদ্বয় প্রার্থনাকারী আমার প্রার্থনা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করে আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [অশ্বিনা পদে আধিব্যাধিনাশক দেবতাকে বোঝায়। ভগবানের যে শক্তি মানুষকে শারীরিক আপদবিপদ এবং দৈবদুর্বিপাক থেকে রক্ষা করে, সেই শক্তিকে অশ্বিনৌ (অশ্বিদ্বয়) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ- হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা (অন্যান্য যজমানকে) অতিক্রম করে এখানে আগমন করো, কারণ তাহলে আমি সর্বদা সমস্ত (শত্রুকে) পরাভূত করতে পারব। হে শসংহারকারী সুবর্ণময় রথারূঢ় প্রশস্ত ধনসম্পন্ন ও নদী সকলের বেগপ্রবর্তনকারী এবং মধুবিদ্যাবিশারদ অশ্বিদ্বয়! তোমরা আমার আহ্বান শ্রবণ করো। বেদমন্ত্রগুলির অন্তর্গত পদসমূহের অর্থ বিশ্লেষণ করবার সময় বৈদিক যুগকে বিস্মৃত হয়ে আধুনিক শব্দার্থ আরোপ করলে এমনই হয়]।

১২/৩– হে আধিব্যাধিনাশক দেবদ্বয়! আপনারা আমাদের পরমধন প্রদান করে আমাদের প্রাপ্ত হোন। রিপুনাশে রুদ্রস্বরূপ হে দেবদ্বয়! সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য-প্রাপক, পরমশক্তিসম্পন্ন আরাধনীয় অমৃতপ্রাপক আপনারা প্রার্থনাকারী আমার প্রার্থনা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রেরও আরাধ্য দেবতা অশ্বিনাঅর্থাৎ আধিব্যাধিনাশক দেবতা। তবে এই মন্ত্রের মধ্যে রিপুনাশের পরিবর্তে পরমধনলাভের প্রার্থনা আছে। কিন্তু এখানে রুদ্রা পদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে রিপুনাশের। প্রার্থনার ভাব পাওয়া যায়। রুদ্র ধ্বংসের দেবতা। ভগবান তাঁর স্নেহলালিত মানুষের মঙ্গলের জন্য মানুষের শত্রুরূপী পাপ-তাপ ইত্যাদিকে ধ্বংস করেন, তথা তখন তিনি রিপুনাশক অবশ্যই। বাজিনীবসূ পদের অর্থ, শক্তিই যাঁর ধন অর্থাৎ পরমশক্তিসম্পন্ন। জুষাণা পদের মর্ম আরাধিত, পরমারাধনীয়। অন্যান্য পদ পূৰ্বৰ্মন্ত্রের মতো। তবে প্রচলিত অর্থের ভাব বোঝাবার জন্য একটি প্রচলিত অনুবাদ উদ্ধৃত হলোহে অশ্বিদ্বয়! তোমরা আমাদের জন্য রত্ন নিয়ে আগমন করো। হে সৌবর্ণ রথারূঢ়, অন্নরূপ ধনৈ ধনবান, যজ্ঞে অধিষ্ঠানকারী ও মধুবিদ্যাবিশারদ অশ্বিদ্বয়! তোমরা আমার আহ্বান শ্রবণ করো। সঙ্গত-অসঙ্গত পাঠকেরই বিচার্য]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১৩–। অবোধ্যগ্নিঃ সমিধা জনানাং প্রতি ধেনুমিবাযতীমুষাস। যহ্র ইব প্রবয়ামুজ্জিহানাঃ প্র ভানবঃ সম্রতে নাকমচ্ছ৷৷৷৷৷ অবোধ হোতা যজথায় দেবানূর্ধো অগ্নিঃ সুমনাঃ প্রাতরস্থা। সমিদ্ধস্য রুশদদর্শি পাজো মহান্ দেবস্তমসো নিরমমাচি৷৷ ২৷৷ যদীং গণস্যরশনামজীগঃ শুচিরঙক্তে শুচিভিগোভিরগ্নিঃ। আদ দক্ষিণা যুজ্যতে বাজয়ন্তত্তানামূৰ্ধো অধযজ জুহুভিঃ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৪– ইদং শ্রেষ্ঠং জ্যোতিষাং জ্যোতিরাগাছ চিত্রঃ প্রকেতো অজনিষ্ট বিড়া। যথা প্রসূতা সবিতুঃ সবায়ৈবা রাষসে যোনিমারৈ৷৷৷৷ রুশদ্বৎসা রুশতী শেত্যাগাদারৈগু কৃষ্ণা সদনান্যস্যাঃ। সমানবন্ধু অমৃত অনূচী দ্যাবা বর্ণং চরত আমিনানে৷৷ ২৷৷ সমাননা অধূ স্বরনন্তস্তমন্যান্যা চরতে দেবশিষ্টে। ন মেথেতে ন তস্থতুঃ সুমেকে নক্তোষাসা সমনসা বিরূপে৷৩৷৷

সূক্ত ১৫–। আভাত্যগ্নিরুষসামনীমুদবিপ্রাণাং দেবয়া বাচো অস্তু। অর্বাঞ্চা নূনং রথ্যেহ যাতং পীপিংসমশিন ধর্মমচ্ছ৷৷৷ ন সংস্কৃতং প্র মিমীতো গবিষ্ঠান্তি নূনমশ্বিনোপ স্তুতে। দিবাভিপিত্বেহবসা গমিষ্ঠা প্রত্যবর্তিং দাশুষে শম্ভবিষ্ঠা ৷৷ ২ উতা যাতং সংগবে প্রাতরহো মধ্যন্দিন উদিতা সূর্যস্য। দিবানক্তমবসা শন্তমেন নেদানীং পীতিরশ্বিনা ততান৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ—  ১৩সূক্ত/১সাম– ঊষাকালে আগমনকারী সূর্যরশ্মির ন্যায় জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব জনসমূহের (সাধকগণের) সত্ত্বভাবের সাথে প্রবুদ্ধ হন। (ভাব এই যে, -ঊষার পশ্চাতে আলোকরশ্মি যেমন ধাবমান হয়, সত্ত্বভাবের সাথে জ্ঞান তেমনই সংযুক্ত হন- হৃদয় আলোকিত করেন)। মহান্ বৃক্ষের শাখা বহির্গমনের ন্যায় (অথবা, উড্ডীয়মান পক্ষীর আপন আশ্রয়স্থান ত্যাগের মতো) ও জ্ঞানরশ্মিসমূহ অন্তরিক্ষ-অভিমুখে প্রসারিত হয় (অর্থাৎ, জ্ঞানকিরণসমূহের দ্বারা সাধকগণ পরমার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত হন)। (ভাব এই যে, – পক্ষিগণ বা বৃক্ষশাখাসকল যেমন বৃক্ষসম্বন্ধ অতিক্রম করে আকাশে আত্মসম্প্রসারণ করে, জ্ঞানসম্বন্ধপ্রাপ্ত আমরাও যেন তেমনই সংসার-সম্বন্ধ ত্যাগ করে পরমার্থের সন্নিকর্ষ বা মোক্ষ লাভ করি)। [এই মন্ত্রটি বড়ই জটিলতাপূর্ণ। সেইজন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যাকার এই মন্ত্রের বিভিন্ন অর্থ নির্দেশ করে গিয়েছেন। একটি প্রচলিত অনুবাদ– ধেনুর ন্যায় আগমনকারিণী ঊষা উপস্থিত হলে অগ্নি অধ্বর্যুগণের কাষ্ঠ দ্বারা প্রবুদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের শিখাসমূহ মহান্ এবং শাখাবিস্তারকারী (বৃক্ষের) ন্যায় অন্তরীক্ষাভিমুখে প্রস্ত হচ্ছে। আমাদের মন্ত্রার্থে আমাদের গৃহীত ভাব লক্ষণীয় এবং প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলির সাথে আমাদের পার্থক্য অনুমেয়। তথাপি নিবেদন, আমরা অন্বয়মুখে-মন্ত্রটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথম অংশে (ঊষাসং প্রতি আয়তীং ধেনুমিব অগ্নিঃ জনানাং সমিধা অবোধি অংশে) জ্বলন্ত অগ্নি-পক্ষেও অর্থ হয়; আবার জ্ঞান-পক্ষেও অর্থ আসে। লোকগণের প্রদত্ত সমিধের দ্বারা আগুন জ্বলে; আবার সত্ত্বভাবের সমাবেশেই হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত হয়। এই দুই ভাবই এখানে গ্রহণ করতে পারি। তবে পূর্ব মন্ত্রের উপসংহারবাক্যের সত্ত্বভাবের নিকট জ্ঞান-কিরণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়– এই ভাব স্মরণ হলে, জ্ঞানের ও সত্ত্বসম্বন্ধের বিষয়ই এখানে প্রখ্যাত আছে, মনে আসে। তারপর ঊষাসং প্রতি আয়তীং ধেনুমিব এই উপমাতেই ঐ ভাবই অধিকতর প্রস্ফুট হয়ে থাকে। যদি বলেন, এই বাক্যের অর্থ– গাভীর মতো আগমনকারী ঊষা। তাতে কোনই ভাব অধ্যাহৃত হয় না। পক্ষান্তরে ঊষার সঙ্গে আলোকরশ্মিই অব্যাহত গতি। সংস্কৃত ভাষায় (এমন কি, প্রায় সব ভাষাতেই) এইরকমই প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ধেনুং পদ এখানে কিরণার্থক স্বীকার করতেই হয়। নানা বিচারের দ্বারা (এমন কি ধাতু-অর্থের বিশ্লেষণেও এই অর্থ সঙ্গত বলে প্রমাণ করা যায়। মন্ত্রের শেষ অংশের (ভানবঃ যত্মা বয়াং প্রোজ্জিহানাঃ ইব অচ্ছ প্র সতে অংশের) বয়াং পদে শাখাসমূহ এবং পক্ষী সকল দুরকম অর্থ আসে। এতেও আমাদের ব্যাখ্যার লক্ষ্য অব্যাহত থাকে। বৃক্ষ থেকে যেমন শাখা নির্গত হয়, অথবা আশ্রয়স্থান বৃক্ষ ত্যাগ করে পক্ষিগণ যেমন অন্তরীক্ষে উড্ডীন হয়– এ উপমা অগ্নির শিখা পক্ষেও খাটে, জ্ঞান-জ্যোতিঃ বিষয়েও যথাপ্রযুক্ত হতে পরে। তবে তা সেই কিরণ বা জ্যোতিঃ কোথায় বিস্তৃত হয়, তা লক্ষ্য করলে, জ্ঞান-পক্ষের প্রাধান্যই পরিদৃষ্ট হয়। নাকংপদে স্বর্গ বোঝায়। ঐ পদের নিগূঢ় ভাব মোক্ষ বা ভগবৎ সান্নিধ্য। অগ্নির শিখা আকাশে বা স্বর্গে ওঠে, এই কল্পনার চেয়ে একথা চিন্তাই সঙ্গত যে, — মানুষ যখন সৎকর্মের দ্বারা সত্ত্বভাবের সাহায্যে জ্ঞানরশ্মিকে লাভ করে, তখন সেই জ্ঞানরশ্মির প্রভাবে তারা মোক্ষ পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়। শাখার উদগমের উপমার চেয়ে পক্ষীর উড্ডয়নের উপমায় একটু নিগূঢ় ভাব আসে। পক্ষীর উড্ডয়নে আশ্রয় স্থান পরিত্যাগ, পার্থিব সকল সম্বন্ধ পরিত্যাগ, জন্মজরামরণের সম্বন্ধ নাশ– এইরকম ভাব পাওয়া যায়। যিনি যে ভাবে জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন, তার পক্ষে উপমায় তেমন অর্থই গ্রহণ করা যায়। যিনি কেবল কর্মকাণ্ডে অনুরক্ত, তিনি স্বর্গ ইত্যাদি প্রাপ্তি দ্বারা (বৃক্ষের শাখা উদামের মতো) সুখভোগ করেন; আর যিনি কর্মকাণ্ডের গণ্ডী অতিক্রম করে প্রকৃষ্ট জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন, যাঁর হৃদয় জ্ঞানের কিরণে উদ্ভাসিত হয়েছে, তার কর্মসম্বন্ধ সমস্তই ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তিনি আত্যন্তিক দুঃখনাশ-রূপ পরমসুখ মোক্ষ প্রাপ্ত হয়েছেন। শব্দার্থে দুই ভাবই আসতে পারে। — প্রার্থনার পক্ষে এই মন্ত্রের অর্থ এই যে, সেই জ্ঞানদেব আমার সত্ত্বভাবের সাথে আমার মধ্যে প্রবুদ্ধ (জাগরিত) হোন; ঊষার আলোকের মতো আমার সত্ত্বভাবের সাথে প্রজ্ঞান-রশ্মি প্রকটিত হোক। পক্ষিগণ যেমন আশ্রয়স্থান ত্যাগ পূর্বক অনন্তে উড্ডীন হয়, আমার সত্ত্বভাব সহ আমায় সেই পু এ দুঃখরিরহিত মোক্ষধামে নিয়ে যাক]। [এই মন্ত্রটি ছদার্চিকেও (১অ-৮দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।  

১৩/২– সৎকর্মসাধক ব্যক্তি দেবতার আরাধনার জন্য প্রবুদ্ধ হন; জ্ঞানদেব সৎকর্মের আরম্ভে প্রসন্ন হয়ে সাধকদের ঊর্ধ্বলোকে স্থাপন করেন; প্রবুদ্ধ জ্ঞানের জ্যোতির্ময়ী দীপ্তি সাধকগণ কর্তৃক লব্ধ হয়; পরমদেব অজ্ঞানান্ধকার হতে সাধকগণকে নিমুক্ত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধক ভগবানের আরাধনাপরায়ণ হন; তিনি পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [প্রচলিত অর্থে বা ভাষ্যে হোতা পদের সাথে অগ্নিঃ পদকে অন্বিত করা হয়েছে। তাতে এই মন্ত্রে অগ্নিই হোতা এমন অর্থ করা হয়েছে; যেহেতু যজ্ঞনির্বাহে অগ্নিই প্রধান বস্তু। কিন্তু আমরা মনে করি, অগ্নি শব্দে মানুষের অন্তরস্থিত সেই পরম জ্ঞানাগ্নিকেই লক্ষ্য করা যায়। সৎকর্মসাধন করতে জ্ঞানের প্রয়োজন (যেমন অগ্নি ব্যতীত যজ্ঞ হয় না)। ভগবানের আরাধনা করবার জন্য সাধকেরা উদ্বুদ্ধ হন, তারা হৃদয়ে দেবভাব উপজনের জন্য যত্নপরায়ণ হন। — এটাই মন্ত্রের প্রথমাংশের মর্মার্থ। দ্বিতীয় অংশের প্রচলিত অর্থ অগ্নি প্রাতঃকালে প্রসন্নমনে ঊর্ধ্বে উত্থিত হন। এটা থেকে মনে হয়, মন্ত্রে যেন প্রাতঃকালীন হোমের বর্ণনা আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে জ্ঞানের মহিমাই ব্যক্ত আছে। অগ্নিদেব– জ্ঞানদেব, সৎকর্মের আরম্ভে সাধকের প্রতি প্রসন্ন হন এবং সেইজন্য সাধকের মনকে ঊর্ধ্বে সাংসারিক ভয়ভাবনা, সুখদুঃখের অতীত রাজ্যে নিয়ে যান, সাধক যেন পার্থিব মোহমায়ায় আবদ্ধ না হয়ে ঊর্ধ্বপথে বিচরণ করতে পারেন। মন্ত্রের তৃতীয় অংশের ভাব এই যে, সাধকেরা দিব্যজ্যোতিঃ লাভ করেন। চতুর্থ অংশে এই সত্যই আরও পরিস্ফুটভাবে বিবৃত হয়েছে। মহান্ দেবঃ তমসং নিরমচি– সেই পরমদেবতা সাধককে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে নিমুক্ত করেন]।

১৩/৩– যখন এই প্রসিদ্ধ জ্ঞানদেব বদ্ধজগতের ঘন অন্ধকার বিনাশ করেন, যখন পবিত্র জ্ঞানদেব পবিত্র জ্ঞানকিরণের দ্বারা বিশ্বকে প্রকাশিত করেন, তখন শক্তিদানকারিণী, কৃপাপরায়ণা, মঙ্গলসাধিকা জ্ঞানধারা সাধকদের হৃদয়ের সাথে সম্মিলিত হন এবং অধঃপতিতজনকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানশক্তির দ্বারা জগৎ প্রকাশিত হয়; সাধকেরা পরমকল্যাণসাধক পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ- যখন অগ্নি একত্রিত (জগতের) রঞ্জুরূপ অন্ধকার গ্রহণ করেন, তখন তিনি প্রদীপ্ত হয়ে দীপ্ত রশ্মির দ্বারা (জগৎকে প্রকাশিত করেন। অনন্তর তিনি প্রবৃদ্ধ অন্নাভিলাষী (ঘৃতধারার) সাথে যুক্ত হন এবং উন্নত হয়ে উপরে বিস্তৃত (সেই ধারাকে) জুহুদ্বারা পান করেন। এই অনুবাদের মধ্যে বন্ধনীস্থিত অংশগুলি অনুবাদকার অধ্যাহার করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই অনুবাদ সম্পূর্ণভাবে মূলানুগ নয়। ভাষ্যের সাথেও অনেকাংশে এর মিল নেই। যাই হোক, ভাষ্যকার বা অপরাপর ব্যাখ্যাকারেরা অগ্নি শব্দে কাষ্ঠ ইত্যাদি দহনশীল অগ্নিকেই আগাগোড়া লক্ষ্য করেছেন। আমরা অগ্নি পদে ঈশ্বরের জ্ঞানরূপ বিভূতি তথা জ্ঞানাগ্নি তথা জ্ঞানদেব বুঝি। আমাদের পূর্বাপর মন্ত্রার্থের আলোচনায় তা বিশ্লেষিতও হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম– ঔশনম]।

১৪/১– এই বক্ষ্যমাণ শ্রেষ্ঠ সকল জ্ঞানরশ্মির মূলীভূত প্রজ্ঞান, জ্ঞানহীন আমাদের সর্বতোভাবে, প্রাপ্ত হোন; রমণীয়, অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন সকলের বিজ্ঞাপক, তাঁর রশ্মিসমূহ পর্যাপ্ত হয়ে, সর্বথা আমাদের মধ্যে প্রাদুর্ভূত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, জ্ঞানহীন আমাদের মধ্যে জ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হোক)। যেহেতু, অজ্ঞানতা-রূপা রাত্রি, প্রজ্ঞান-রূপ সূর্য হতে উৎপন্ন হলে অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে অজ্ঞানজ কর্ম সম্বন্ধ-বিশিষ্ট হলে, জ্ঞান-উন্মোষিকা-বৃত্তি-রূপ ঊষাকে প্রকাশ করবার জন্য, নিমিত্তভূত কারণ হন; সেহেতু, অজ্ঞানতারূপা রাত্রিই জ্ঞান-উন্মোষিকা ঊষার উৎপত্তি-ক্ষেত্র বলে অভিহিত হন। (ভাব এই যে, — জ্ঞানের সাথে যে কর্ম সম্বন্ধযুক্ত, তা-ই সুফলপ্রদ হয়ে থাকে; অতএব আমাদের সকল কর্ম জ্ঞানসম্বন্ধযুত হোক– এটাই প্রার্থনা)। অথবা এই দৃশ্যমান, মহৎ অপেক্ষাও মহৎ, দ্যোতনশীল সূর্য ইত্যাদি গ্রহগণের স্বপ্রকাশকরূপ জগৎফ্রণাত্মক অনির্বচনীয় আলোক, যখন সর্বতোভাবে হৃদয়দহরাকাশে উপস্থিত হয়; তখন, অদ্ভুততম বৈচিত্র্যকারক জ্ঞানালোক বিস্তৃত হয়ে, অজ্ঞান-তিমিরের বিনাশক হয়ে থাকে;- যেমন সূর্য হতে উৎপন্না অন্ধকারময়ী রাত্রিই ঊষাকালের উৎপত্তির কারণ হয়। (ভাব এই যে, যেমন সূর্য থেকে সমুদ্ভূত রাত্রি, ঊষাকালের নিমিত্ত হয়ে থাকে, তেমন পরমব্রহ্মের উপর ভাসমান এই অজ্ঞান-রাত্রি জ্ঞানালোকের উৎপত্তির নিমিত্ত হয়)। [আমরা দুরকম অন্বয়ে এই মন্ত্রের দুরকম অর্থ নির্দেশ করেছি। ঐ দুই অর্থেই আমরা সঙ্গত ভাব প্রাপ্ত হই। প্রথম ব্যাখ্যায় প্রার্থনার ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা অনুসারে মন্ত্রটি নিত্যসত্যতত্ত্বজ্ঞাপক অথবা আত্ম-উদ্বোধনা-মূলক। মন্ত্রের প্রথম চরণের অগাৎ এবং দ্বিতীয় চরণের অজুনিষ্ট– এই দুটি ক্রিয়াপদের প্রতিবাক্য গ্রহণ উপলক্ষেই ভাবপার্থক্য দাঁড়িয়ে গেছে। এ মন্ত্রের ঐ দুটি পদই প্রথম আলোচ্য। প্রার্থনার পক্ষে অগাৎ পদে আসুক-আমাদের প্রাপ্ত হোক এবং অজনিষ্ট পদে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হোক– এমন অর্থ; গৃহীত হয়েছে। আবার ঐ দুটি পদে যথাক্রমে আগমন করেছেন এবং প্রাদুর্ভূত হয়েছিল অর্থগ্রহণ করেও নিত্য-সত্যতত্ত্ব জ্ঞাপক ভাব নিষ্কাশিত হতে পারে। আমরা দুই অর্থেই সঙ্গতি দেখি। মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণটি উপমামূলক। এই চরণের পদগুলির আভিধানিক অর্থ অনুসারে প্রচলিত অনুবাদের যে রূপটি পাওয়া যায়, তা থেকে কোন মর্মই উপলব্ধ হয় না]।

১৪/২– যখন দীপ্তজ্ঞানরূপবৎসবিশিষ্ট প্রদীপ্ত সুনির্মল জ্ঞানদাত্রী ঊষা, সৃম্যরূপে এসে উপস্থিত হন; তখন তমোময়ি অজ্ঞানরাত্রি, সত্ত্বময়ী জ্ঞানরূপ ঊষার কেন্দ্রীভূত স্থানস্বরূপ মহেশ্বরে বিলীন হয়ে যায়; এইজন্য তমোময়ী অজ্ঞানরাত্রি ও সত্ত্বময়ী ঊষা, পরস্পর আশ্রয়-আশ্ৰয়িতভাবে বন্ধুত্বভাবাপন্ন ও অমরণশীল এবং পরস্পর অনুগতভাবে সমগ্র প্রাণিজগতের রূপ-জ্ঞান নষ্ট করে, এই সৃষ্টিপথের মধ্যে বিচরণ করছে। (ভাব এই যে, জ্ঞানরূপ ঊষার সমাগম হলে মলিনাত্মিকা অজ্ঞানরাত্রি পরমব্রহ্ম মহেশ্বরে আত্মগোপন করে থাকে; নিখিল জগৎ নাম-রূপ পরিত্যাগ করে ব্রহ্মরূপে অবভাসমান হয়ে থাকে)। [নির্মল দীপ্ত ঊষা নিত্য জ্ঞানময়ী। সূর্য ঊষার পুত্র; যেহেতু ঊষার গর্ভে উদয় হয় এবং জগৎকে প্রভাত করে। জ্ঞানও তেমনই ঊষামাতৃকার সন্তান। এই জ্ঞানময়ী ঊষা সুপ্ত-চেতনার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন এনে দেয়। ঊষার আলোকে অন্ধকার-জগৎ আলোকিত হয়। জগৎ নবীন চেতনায় হেসে ওঠে। জীবজগৎ সমগ্র দিবস অক্লান্ত দেহে কঠোর পরিশ্রমে কর্মের সেবা করে এবং সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লান্ত শরীরে বিবশ-চিত্তে সুপ্তির আশ্রয় নেয়। এই সুপ্তির নাম নিত্য প্রলয়। সুপ্তির সময় জাগ্রৎ-জগতের কোনও জ্ঞান থাকে না। থাকে কেবল– বিরাটু চৈতন্য ও জাগ্রতের সংস্কার মাত্র। বিরাট চৈতন্যের স্পন্দনে ও সংস্কারের সাহায্যে ঊষার বিমল প্রভায় জগৎ জ্ঞানের মধ্যে এসে পুনঃ কর্মশীল হয়। সুতরাং, এই ঊষা যেমন দৈনন্দিন নৈশ-প্রলয় থেকে জগৎকে মুক্ত করে সৃষ্টির বিমল হাস্যে ভাসিয়ে তোলে, তেমনই জগৎ যখন তমোগুণে আশ্রিত মহেশ্বরের মধ্যে প্ৰলীন হয়ে অবস্থান করে, অথবা এই দৃশ্যমান প্রপঞ্চ নাম-রূপ পরিত্যাগ করে অনাম, অ এ ব্যয়, ও নিগুণ ব্রহ্মে বিলীন হয়ে থাকে, তখনই এই জ্ঞানময়ী চৈতন্যরূপা ঊষা পুনঃসৃষ্টি সম্পাদনের জন্য সেই নির্গুণ ব্রহ্মের বক্ষে ইচ্ছারূপে অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে। এরই নাম– ইচ্ছাময়ী শক্তি এরই নাম– সৃষ্টিময়ী ঊষা। এই জন্য ঊষার নাম জ্ঞান বা চৈতন্য। আমাদের ব্যাখ্যাতা জ্ঞান উন্মোষিকা দেবীতথা ঈশ্বরের অন্যতম বিভূতি-সাধারণ রাত্রি ও ঊষার বর্ণনা করতে এত বড় বেদের কোনও আবশ্যকতা ছিল না। আমরা মনে করি, মন্ত্রে যে ঊষার নির্দেশ দেখতে পাই, সে ঊষা নিত্য প্রকাশশীলা। সাধারণ ঊষা নয়। ঊষা পদ উপলক্ষে এখানে রূপকে সৃষ্টিতত্ত্বের নিগুঢ় রহস্য প্রকাশ পাচ্ছে। এ ঊষা, কল্পান্তকারী প্রলয়ের পরে সৃষ্টির পূর্বাভাস প্রদান করেন; গাঢ় তমিস্রার অন্তরালবর্তী আলোকরশ্মি বিকশিত করেন; অজ্ঞান-অন্ধকারে নিমজ্জিত সৃষ্টির চিত্তকে বিমল ভাস্বর জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে তোলেন]।  

১৪/৩– সহোদরার মতো অজ্ঞান ও জ্ঞানরূপিণী রাত্রির ও ঊষারপথ এক ও অবসান-রহিত। (রাত্রি অজ্ঞানরূপা এবং ঊষা জ্ঞানরূপিণী)। দ্যোতনশীল জ্যোতিঃস্বভাব পরমাত্মাতে অনুগত হয়ে, অজ্ঞান ও জ্ঞানরূপা রাত্রি এবং ঊষা আপেক্ষিকভাবে সেই বিশাল পথে নিত্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে; তুল্য উৎপাদনশীল ও তমঃ-প্রকাশাত্মক বিরুদ্ধ-স্বভাবসম্পন্ন, সমানমনা অজ্ঞান ও জ্ঞানরূপা রাত্রি এবং ঊষা পরস্পর কেউ কাউকে হিংসা করে না এবং চিরকালও থাকে না। (ভাব এই যে, যেমন বিরুদ্ধ স্বভাবসম্পন্ন রাত্রি এবং ঊষা এক স্থান থেকে সমুৎপন্ন হয়েও পরস্পর কেউ কাউকে হিংসা করে না এবং চিরদিনও থাকতে পারে না, অজ্ঞান ও জ্ঞানও ঠিক তেমনই)। [এক নির্গুণ নিষ্ক্রিয় পূরমব্রহ্ম বা পরাপ্রকৃতি ব্রহ্মশক্তি বা চিৎশক্তি থেকে সমুদ্ভূত হয় বলে, এই অজ্ঞানরূপিণী রাত্রি ও জ্ঞানরূপিণী ঊষা এরা পরস্পরে সহোদরা ভগ্নীর মতো। এদের উৎপত্তিস্থান এক। এক বস্তুতেই এই পরস্পর বিরুদ্ধ-ধর্মবিশিষ্ট দুই বস্তু আপনিই প্রতিভাত হয়ে রয়েছে। এই-ই হয়। অন্ধকার ও আলোক, অজ্ঞান ও জ্ঞান, পাপ ও পুণ্য প্রভৃতি নানা বিরুদ্ধ বস্তু পরিলক্ষিত হলেও এক চৈতন্যের পূর্ণ সত্তা ব্যতীত অন্য কোনও সত্তাই এখানে নেই। যেমন সুষুপ্তিতে বিশুদ্ধ চৈতন্যের উপর জাগ্রৎ জীবনের সংস্কার অন্তর্লীন থাকে এবং বিশুদ্ধ চৈতন্যের পরিস্পন্দনে ঐ সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে আবার যেমন জাগ্রঞ্জীরনের সম্পাদন করে; এখানেও ঠিক তা-ই। রাত্রি– সৃষ্টির প্রলয়কাল; ঊষা– তার প্রথম প্রভাত। এইজন্য এই রাত্রি ও ঊষার পথ এক; অর্থাৎ এক নির্গুণ নির্লিপ্ত পরমব্রহ্মের উপর ভাসমান এই সৃষ্টির ধারা একটি। যেমন মাটি, ঘট ও কুম্ভকার। মাটি থেকে ঘট হয়, কুম্ভকার তা প্রস্তুত করে। ঘট হলেই ভাঙে, আবার ভাঙলেই প্রস্তুত হয়। যেহেতু কুম্ভকার ও কুম্ভকারের মনে ঘট-প্রস্তুত প্রণালীর সংস্কার অক্ষুণ্ণ থাকে, তেমনই জগৎ নিগুণ ব্রহ্মে বিলীন হয়, আবার সংস্কার ও মায়ার বশবর্তী হয়ে নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের বক্ষে তরঙ্গমালার মতো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সমুদ্ভূত হয়ে ওঠে। সুতরাং সৃষ্টির পর প্রলয় ও প্রলয়ের পরে সৃষ্টি-রাত্রির পর ঊষা ও ঊষার পর রাত্রি। এইভাবেই অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। এইভাবে বোঝা যায়, এই জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়– এরা ঊষা ও রাত্রি। এরা একবৃত্তি এবং অসীম হলেও ব্যবহারিক। এদের স্বতন্ত্র সত্ত্বা বা শক্তি নেই। এরা অনাদিকাল-পরম্পরায় জগঞ্জপে প্রতিভাসমান থাকলেও, ব্রহ্ম-বিজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত, নামরূপে আখ্যাত থাকে। আত্মার অপরোক্ষ-অনুভূতি হলেই, এদের আর স্বতন্ত্র সত্তা থাকে না, অথবা উপলব্ধ হয় না। তখন একমাত্র ব্রহ্ম-সত্তাই বিরাজমান থাকে। সুতরাং জ্ঞানের বিকাশ না হওয়া পর্যন্তই এই অজ্ঞান। অজ্ঞান নামমাত্র। জ্ঞানই চিরন্তন। জ্ঞানই জগৎ- আকারে পরিণত। বেদ সেই সমাচার দেবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছেন]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি, এ মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে এবং সেটির নাম ঔষসম]।

১৫/১–  জ্ঞান-উন্মেষণের মূলীভূত কারণস্বরূপ জ্ঞানদেব সাধকের হৃদয়ে প্রকাশিত হন; জ্ঞানিগণের দেবকামী প্রার্থনা উদাত হয়; আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! সৎকর্মসাধনসামর্থ্যের সাথে আমাদের অভিমুখী হয়ে নিশ্চিতভাবে আমাদের সৎকর্মসাধনে জ্যোতির্ময় মোক্ষ ইত্যাদিরূপ ফল নিত্যকাল প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের মোসাধক পরমধন প্রদান করুন)। [আলোচ্য মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদঅগ্নি ঊষা সকলের প্রারম্ভকে সমুজ্জ্বল করছে। মেধাবী স্তোতৃবর্গের স্তোত্র সকল দেব উদ্দেশে উদগীত হচ্ছে। অতএব হে রথাধিপতি অশ্বিদ্বয়! তোমরা অদ্য এই স্থানে অবতীর্ণ হয়ে সোমপূর্ণ এই সমৃদ্ধ যজ্ঞে আগমন করো। কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যের অনেকাংশে অনৈক্য লক্ষিত হয়। আমাদের ব্যাখ্যার সাথে উপরোক্ত ব্যাখ্যার এবং ভাষ্যের ব্যাখ্যার পার্থক্য আছে। আমরা ঊষা পদে জ্ঞানোন্মেষিকা শক্তিকেই বুঝি, আবার অগ্নি শব্দে জ্ঞানদেবতাকে অথবা ভগবানের জ্ঞানশক্তিরূপ বিভূতিকেই বুঝি। সুতরাং জ্ঞানশক্তি অথবা অগ্নি-ই ঊষার মূলীভূত কারণ। নতুবা অগ্নি ঊষার প্রারম্ভকে সমুজ্জ্বল করবে কিভাবে? আমাদের মন্ত্রার্থেই তা প্রকাশিত]।

১৫/২– আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! আপনারা সৎকর্মসাধককে হিংসা করেন না; নিশ্চিতভাবে ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক আপনারা আমাদের সমীপে আরাধিত হোন; কর্মীবনের আরম্ভে সাধকের হৃদয়ে আগমনকারী আপনারা রক্ষার সাথে শক্তিদায়ক এবং আরাধনাপরায়ণ জনে সুখদাতা হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, – হে ভগবন! আমাদের ঊর্ধ্বগতি, এবং পরাশক্তি ও পরমসুখ প্রদান করুন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা সংস্কৃত যজ্ঞের হিংসা করো না, কিন্তু অতি শীঘ্র যজ্ঞসমীপে আগমনপূর্বক স্তুতিভাজন হও। যাতে অন্নাভাব না হয় তার জন্য দিবসের প্রারম্ভে রক্ষা সমভিব্যাহারে আগমন করো এবং হব্যদাতাকে সুখ প্রদান করতে তৎপর হও। – সংস্কৃতং পদে ভাষ্য ইত্যাদিতে সৎকর্ম অর্থ গৃহীত হয়েছে। আমাদের মতে, এখানে সৎকর্মের সাধককেই লক্ষ্য করা হয়েছে। ভগবৎশক্তি কখনও সাধকের অনিষ্ট করেন না, অধিকন্তু সাধকের পরম মঙ্গলসাধনেই নিযুক্ত থাকেন– এটাই গমিষ্ঠা পদের ভাষ্যার্থ– যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ গতি প্রাপ্ত করান বা প্রাপ্ত হন। দেববিভূতির পক্ষে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত করানই সঙ্গত অর্থ। দিবাভিপিত্বে পদের সাধারণ অর্থ– দিবসের প্রারম্ভে। দিবসের প্রথমেই মানুষ কর্মে রত হয়, তাই এই পদের অর্থ দাঁড়ায়– কর্মজীবনের আরম্ভে]।

১৫/৩– হে দেবদ্বয়! সন্ধ্যাকালে, প্রাতঃকালে, মধ্যসময়ে, সায়াহ্নে সূর্যোদয়কালে, দিবাকালে, রাত্রিতে অর্থাৎ সর্বকালে সুখদায়ক রক্ষাশক্তির সাথে আগমন করুন; অপিচ, আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! নিত্যকাল আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সর্বত্র সর্বকালে ভগবানের রক্ষাশক্তি আমাদের রক্ষা করুক)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– তোমরা রাত্রিশেষে গো-দোহন-সময়ে প্রত্যুষে অথবা সূর্য যে সময়ে অত্যন্ত প্রবৃদ্ধ হন, সেই মধ্যাহ্নবেলায় কিংবা দিবসে, বা রাত্রিকালে, যে কোনও সময়ে উপস্থিত হবে, সুখকর রক্ষা সমভিব্যাহারে আগমন করো; কারণ অশ্বিদ্বয় ব্যতিরেকে (অন্যান্য দেবগণ) সোমরস পানে প্রবৃত্ত হন না। এই অনুবাদের সঙ্গে ভাষ্যেরও অনেক অমিল রয়েছে। অবশ্য ভাষ্যকারও সোমরসপানের উল্লেখ করতে ভোলেননি। আবার, এক ব্যাখ্যাকার বলছেন– অন্য দেবতার মতো সোম পান করো; অপরটি বলছেন– অশ্বিনীকুমার না হলে অন্য দেবতা সোমপানে প্রবৃত্ত হন না। আমরা কিন্তু মন্ত্রে সোমরসের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– অশ্বিনম]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৬–, এতা উ ত্যা উষসঃ কেতুমত পূর্বে অর্ধে রজসোভানুমঞ্জতে। নিষ্কৃথানা আয়ুধানীব ধৃষ্ণবঃ প্রতি গাবোহরুষীৰ্যন্তি মাতরঃ ১। উদপ্তরুণা ভানবো বৃথা স্বাযুজো অরুষীৰ্গা অযুক্ষত। অনুযাসো বয়ুনানি পূর্বথা রুশন্তং ভানুমরুষারশিয়ুঃ৷৷ ২৷৷ অৰ্চন্তি নারীরপসোন বিষ্টিভিঃ সমানেন যোজনেনা পরাবতঃ। ইষং বহন্তীঃ সুকৃতে সুদানবে বিশ্বেদহ যজমানায় সুন্বতে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৭– অবোধ্যগির্জা উদেতি সূর্যো ব্যুষাশ্চন্দ্রা মহ্যাবো অর্চিষা। আযুক্ষাতামশ্বিনা যাবে রথং প্রাসাবীদ দেবঃ সবিতা জগৎ পৃথক্‌৷১৷৷ যদযুঞ্জাথে বৃষণমশ্বিনা রথং ঘৃতেন নো মধুনা ক্ষমুক্ষত। অস্মাকং ব্ৰহ্ম পৃতনাসু জিন্বতং বয়ং ধনা, শূরসাতা ভজেমহি৷৷ ২ অর্বাঙ ত্রিচক্রো মধুবাহনো রথো জীরাশ্বে অশ্বিনোর্যাতু সুষ্ঠুতঃ। ত্রিবন্ধুরো মঘবা বিশ্বসৌভগঃ শং ন আবক্ষ দ্বিপদে চতুষ্পদে ৷৩৷৷

সূক্ত ১৮–। প্র তে ধারা অসশ্চতত দিবো ন যন্তি বৃষ্টয়ঃ। অচ্ছা বাজং সহণি৷ ১৷৷ অভি প্রিয়াণি কাব্যা বিশ্বা চক্ষাণো অৰ্ষতি। হরিস্তুঞ্জান আয়ুধা৷ ২৷৷ স মম্‌জান আয়ুভিরিমো রাজেব সুব্রতঃ। শ্যেনো ন বংসু যীদতি৷ ৩৷৷ স নো বিশ্বা দিবো বসূততা পৃথিব্যা অধি। পুনান ইন্দবাভর৷৷ ৪৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৬সূক্ত/১সাম– সর্বত্রপ্রকাশমান সেই প্রসিদ্ধ জ্ঞানোন্মেষক দেবতাগণ, অজ্ঞানান্ধকারাবৃত সকলের জ্ঞানকে প্রকাশ করেন। (ভাব এই যে, জ্ঞানের উন্মোষিকা বৃত্তির অনুশীলনের দ্বারা অর্থাৎ সৎকর্ম-অনুষ্ঠানের দ্বারা মনুষ্য অজ্ঞান-নাশে সমর্থ ও সত্য-তত্ত্বজ্ঞ হয়); আর, সেই জ্ঞান-উন্মেষক দেবতাগণ হৃদয়রূপ এই অন্তরিক্ষ-লোকের (অথবা রজোভাবের) প্রাচীন দিক্‌-বিভাগে (অথবা অভ্যুদয়ে) জ্ঞানের প্রকাশকে পূর্ণজ্ঞানকে ব্যক্ত করেন– প্রকাশিত করেন। (ভাব এই যে, ঊষা সমাগমের সাথে যেমন পূর্ব-দিক্‌-বিভাগে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, জ্ঞান উন্মেষের সাথে তেমনই হৃদয়ে জ্ঞান-প্রভা প্রকাশিত হয়ে থাকে)। শত্রুধর্ষণশীল যোদ্ধৃগণ যেমন শনাশের জন্য অস্ত্র-সংস্কার করেন, তেমনই রিপুদমনে অজ্ঞানান্ধকার-নাশে জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণশীল আপনা-আপনি দীপ্তিসম্পন্ন মাতৃস্থানীয় জ্ঞানদ্যুতিস্কল (ঊষাদেবতাগণ) উপাসকদের অর্থাৎ অনুসারিবর্গের অভিমুখে আপনা-আপনিই গমন করেন। (ভাব এই যে, নিজের শাণিত অস্ত্রের দ্বারা রিপুদের বিমর্দন করে জ্ঞান আপনা-আপনিই নিজের অনুসারিবর্গকে প্রাপ্ত হন)। [ব্যাখ্যা উপলক্ষে আমরা মন্ত্রটিকে তিনভাগে বিভক্ত করেছি। তার প্রথম অংশের প্রথম আলোচ্য উষসঃপদ। বহুবচনান্ত ঐ পদে সকলেই ঊষা-কালকে বোঝাচ্ছে বলে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু আমরা বলি জ্ঞানোন্মেয়িকা বৃত্তিসমূহ (জ্ঞানের উন্মেষক দেবতাগণ) এখানকার লক্ষ্যস্থল। কেতুং পদে জ্ঞানকে বোঝায়। যে জ্ঞান অজ্ঞান-অন্ধকারে আবৃত থাকে। — ইত্যাদি। দ্বিতীয় অংশে উ রজসঃ পূর্বে অর্ধে ভানুং অঞ্জতে পদ কটি গৃহীত। বলা বাহুল্য, এখানেও সেই ঊষা দেবতাগণের ক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। কিরকম অবস্থায় কিভাবে কি রকম জ্ঞানকে তারা প্রকাশ করেন, এখানে সেই তত্ত্ব বিবৃত। — ইত্যাদি। তারপর মন্ত্রের তৃতীয় অংশের দ্বিতীয় চরণে ধৃষ্ণবঃ আয়ুধানীব নিষ্কৃথানা বাক্যাংশে একটি উপমার ভাব দেখা যায়। এখানকার সাধারণ অর্থ এই যে, শত্রুধর্ষণকারী যোদ্ধৃগণ যেমন শত্রুনাশের জন্য অস্ত্রশস্ত্র শাণিত করে নেন, ঊষা দেবতাগণও তেমন, রিপুশনাশে অজ্ঞানতার বিধ্বংসীকরণে, নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত করে নেন। মর্ম এই যে, জ্ঞান উন্মেষের সাথে সৎ-বৃত্তির স্ফুর্তির সঙ্গে সঙ্গে, সৎকর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা, রিপুদমনের উপযোগী আয়ুধগুলি প্রস্তুত হতে থাকে। জ্ঞান-উন্মেষই সেই আয়ুধগুলির চাকচিক্যসম্পাদনকারী হয়ে থাকে। অরুষীঃ মাতরঃ ও গাবঃ– এই তিনটি পদ উষসঃ পদেরই দ্যোতক। জ্ঞানোন্মেষিকা বৃত্তি বা সৎকর্ম যে দীপ্তিসম্পন্ন, অরুষী পদে সেই ভাব ব্যক্ত হয়েছে। সবৃত্তিগুলিকে বা সৎকর্মসমূহকে মাতরঃ অভিধায়ে অভিহিত করারও বিশেষ তাৎপর্য লক্ষণীয়। মাতৃবৎ স্নেহে লালন পালন করে, সুপথ প্রদর্শনের দ্বারা, তারাই নতুন জীবন দান করেন– চতুর্বর্গ ফলের অধিকারী করেন মোক্ষধামে পৌঁছিয়ে দেন। গাবঃ পদে জ্ঞানদ্যুতি অর্থেই এখানেও সঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। মাতৃস্থানীয় আপনা-আপনি (স্বতঃ) দীপ্তি সম্পন্ন জ্ঞানকিরণসমূহ যে সৎবৃত্তির অনুসারী হয় বা সৎকর্মের অনুগামী হয়ে মনুষ্যগণকে প্রাপ্ত হয়, তা বলাই বাহুল্য। সেই তত্ত্বই এখানে প্রখ্যাত হয়েছে। এইভাবে বুঝতে পারা যায়, এই মন্ত্রে জ্ঞানোন্মেষিকা দেবতার প্রভাব অর্থাৎ সৎবৃত্তির স্ফুরণের বা সৎকর্মের অনুষ্ঠানের শুভফল প্রকীর্তিত রয়েছে]।

১৬/২– (ঊষাদেবতাগণের প্রভাবে বা অনুকম্পায়) অজ্ঞানান্ধকারনাশক জ্ঞানরশ্মিসমূহ আপনিই ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়– অনুসারী জনকে ভগবানে নিয়ে যায়; এবং সুষ্ঠুভাবে হৃদয়ে ভগবৎ-সম্বন্ধকে সংযুক্ত করতে সমর্থ অজ্ঞানান্ধকারনাশক জ্ঞানরশ্মিসমূহ হৃদয়ে আপনা-আপনি সংযুক্ত হয়ে বিদ্যমান

থাকে। (ভাব এই যে, জ্ঞান-উন্মেষক বৃত্তির দ্বারা অথবা সৎকর্মের প্রভাবে অজ্ঞানতা দূর হয় এবং এ জ্ঞানোদয়ের সাথে মানুষ ভগবানকে প্রাপ্ত হয়)। অজ্ঞান-অন্ধকারের নাশক জ্ঞান-উন্মেষক দেবতাগণ সর্বাগ্রে সকল প্রাণিগণের জ্ঞানসমূহকে উন্মেষণ করে দেন তারপর অনাবিল জ্ঞান-সূর্যকে সেই জ্ঞানের সাথে একীভূত করেন। (ভাব এই যে, জ্ঞান-উন্মেষক দেবতাগণ অনুসারী জনগণের হৃদয়ে, জ্ঞান-উন্মেষণ করে সেই জ্ঞানকে সর্বথা ভগবৎ-সম্বন্ধযুত করেন এবং অনুসারী জনকে ভগবানে। সম্মিলন করে দেন। [এই মন্ত্র পাঠ করলে এবং এর ব্যাখ্যা ইত্যাদি দেখলে মনে হয় বটে– এখানে. ঊষাকালেরই বর্ণনা আছে। পরন্তু প্রহেলিকা প্রতি পদে। একে একে পদাবলি বিশ্লেষণ করে দেখলে, দেখা যাবে– কবিত্বের ঝঙ্কার, রূপকের বাহার, উপমার অলঙ্কার– মন্ত্রের বর্ণে বর্ণে কেমন উদ্ভাসিত রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বেশ বোধগম্য হবে যে, এ বর্ণনা কেবল ঊষার বর্ণনা নয়– ঊষা উপলক্ষে ঊষার অতীত এক অপার্থিব সামগ্রীর প্রতি এখানে কেমন লক্ষ্য আছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ অরুণ ভানুকিরণ অনায়াসে উদিত হলো, পরে রথযোজনযোগ্য শুভ্রবর্ণ গাভীসকলকে ঊষাদেবতাগণ রথে যোজিত করলেন, এবং পূর্বের ন্যায় সমস্ত প্রাণীকে জ্ঞানযুক্ত করলেন; তার পরে দীপ্তিযুক্ত ঊষাদেবতা সকল শুভ্রবর্ণ সূর্যকে আশ্রয় করলেন। — এবার আমাদের দৃষ্টিতে মন্ত্রটি যেভাবে প্রতিভাত, তার একটু পরিচয় আবশ্যক। মন্ত্রের একটি পদ– অরুণাঃ। সহসা মনে হয় বটে– ওটি ঊষারই এক অবস্থা। পক্ষান্তরে আবার দেখা যায় অজ্ঞানতার অন্ধকারে হৃদয় যখন আচ্ছন্ন ছিল, তখন সে জ্ঞানের উন্মেষ, তা ঊষারই প্রথম বিকাশের মতো অরোচমান অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকার-নাশক। অন্ধকারের ক্রোড়ে প্রথম যে আলোকের দ্যুতি, তা রক্তিমাভা প্রকাশ করে; অজ্ঞানতার মধ্যে জ্ঞানোদয়েও রক্তরাগ ফুটে ওঠে। — ইত্যাদি। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে, স্বাযুজঃ অরুষীঃ গাঃ অযুক্ষতঃ পদ চারটি পরিগৃহীত হয়। আমরা বলি, এখানেও জ্ঞান-উন্মেষক সৎ-বৃত্তির অনুশীলনের বা সৎকর্মের সাধনার ফল প্রদর্শিত হয়েছে। সেই গাঃ অর্থাৎ জ্ঞানরশ্মিসমূহ– তারা কেমন? স্বাযুজঃ ও অরুষীঃ অর্থাৎ সুষ্ঠুভাবে ভগবৎ-সম্বন্ধে সম্বন্ধযুক্ত করতে পারে এবং অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর করতে সমর্থ হয়। তেমন যে গাঃ তারা তখন হৃদয়ে সংযুক্ত হয়ে থাকে। মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণটিও দুই অংশে বিভক্ত করা গিয়েছে। জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবতার অনুকম্পায়, জ্ঞান-উন্মেষক কর্মের বা সৎবৃত্তির স্ফুরণে, মানুষদের মধ্যে যে জ্ঞানের উন্মেষ হয়, তার ফলে জ্ঞানসূর্যকে জ্ঞানময়কে মানুষ প্রাপ্ত হয়]।

১৬/৩– সেই নেত্রিগণ (সৎপথে পরিচালনকারী জ্ঞানোন্মেষক দেবতাগণ অর্থাৎ সৎ-বৃত্তিসমূহ বা সৎকর্মপরায়ণতা সকল) নিবেশক আপনাদের তেজের বা শক্তির দ্বারা, সত্ত্বভাবসকল যেমন অভীষ্টসাধক হয়, তেমনভাবে, সৎকর্মকারী সত্ত্বানুসারী শোভনদানশীল অর্থাৎ ভগবানে উৎসৃষ্ট কর্মফল উপাসকের জন্য সরকম অন্ন বা শক্তি প্রদান করে সেই একেরই সাথে সংযোগ-সাধনের দ্বারা অর্থাৎ ভগবানের সাথে সম্মিলন-সাধন করে, পতন থেকে সর্বতোভাবে সেই উপাসককে রক্ষা করেন। (ভাব এই যে, জ্ঞান-উন্মেষক কর্ম উপাসককে ভগবানে: লীন করে দেয়)। [মন্ত্রটি ঊষাদেবতাগণের মাহাত্ম্য-প্রখ্যাপক। মন্ত্রের অন্তর্গত চার রকম প্রশ্নের সমাধানেই দেরতত্ত্ব অধিগত হতে পারে। প্রথম প্রশ্ন– সেই দেবতাগণ কেমন? উত্তর– নারীঃ। ভাষ্যের অর্থ– তারা নেত্রী অর্থাৎ মানুষদের পরিচালিত করে থাকেন। আমরা তাই ঐ পদের প্রতিবাক্যে প্রথমে সৎপথি পরিচালিকা পদ গ্রহণ করেছি। কিন্তু আসলে তাদের স্বরূপ কি? মানুষদের যারা সৎপথে পরিচালিত করে, তারাই তো সবৃত্তিসমূহ, বা সৎকর্মপরায়ণতা! দ্বিতীয়তঃ সেই দেবতাগণ কি করেন? এর বিশ্বেদহ বহন্তীঃ সমানেন যোজনেন আপরাবতঃ অর্থাৎ ভগবান্ (সেই দেবতাগণ) দূরে থাকলেও সৎকর্মের দ্বারা সৎ-বৃত্তির অনুশীলনের ফলে, সৎস্বরূপ ভগবানে মিলিত হয়ে, আমরা রক্ষা প্রাপ্ত হই। — তৃতীয়তঃ, সেই যে রক্ষা, কোন্ জন তা প্রাপ্ত হন? সুকৃতে সুথতে সুদানবে। সুকর্মকারী হতে হবে, সত্ত্বানুসারী হতে হবে, শোভনদানশীল অর্থাৎ ভগবানে সকল কর্মফল সমর্পণ করতে হবে। এইরকম গুণান্বিত যিনি, তিনিই রক্ষা পান; অর্থাৎ দেবতাগণ তাকেই দূর থেকে আকর্ষণ করে এনে ভগবানে লীন করে দেন। — চতুর্থতঃ, কিভাবে সেই দেবতাগণ উপাসকের প্রতি ঐরকম অনুগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন? বলা হয়েছে বিষ্টিভিঃ। তাঁরা নিজেদের তেজের বা শক্তির দ্বারা উপাসকের অনুসরণকারীর হৃদয়ে তেজঃ বা শক্তি সঞ্চার করেন। কেমনভাবে কাদের মতো? উপমা- অপসঃন; অর্থাৎ সত্ত্বভাবগুলি যেমন আপনা-আপনিই সত্ত্বসমূহে লীন হয়;ঐ দেবতাগণ, তেমনই নিজেদের শক্তির দ্বারা তেজের প্রভাবে, অনুসারী জনকে সৎকর্মান্বিত জনকে, সত্ত্বসমুদ্ররূপ ভগবানে সম্মিলিত করে দেন। — এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ নেত্রী ঊষাদেবতাগণ (উজ্জ্বল অস্ত্রধারী যোদ্ধৃবৃন্দের মতো; এবং উদ্যোগের দ্বারাই দূরদেশ পর্যন্ত আপনাপন তেজের দ্বারা ব্যাপ্ত করেন। তারা শোভনকর্মধারী, সোমদায়ী, (দক্ষিণ) দাতা যজমানদের সকল অন্ন প্রদান করেন]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। নাম- উষঃ]।

১৭/১– জ্ঞানদেব পৃথিবীর সাধকদের হৃদয়ে উদ্বুদ্ধ হন; মহতী আনন্দদায়িনী জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবী জ্যোতিঃর দ্বারা তমো বিনাশ করেন; আধিব্যাধি নাশক হে দেবদ্বয়; আপনারা সৎকর্মসাধনের স্থান প্রাপ্তির জন্য সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন; সৎকর্মে প্রেরক দেবতা জগতের সকল লোকবর্গকে আপন আপন কর্মে নিয়োজিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা দিব্যজ্ঞান লাভ করেন; ভগবানই সাধকদের হিতের জন্য তাদের সৎকর্মে নিয়োজিত করেন]। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটিকে আংশিকভাবে নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং আংশিক ভাবে প্রার্থনামূলক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, ভূমির উপর অগ্নি জাগরিত হলেন, সূর্য উদিত হলেন। মহতী ঊষা তেজঃদ্বারা সকলকে আল্লাদিত করে (তমঃ) দূরীকৃত করছেন। হে অশ্বিদ্বয়। আগমনের জন্য তোমাদের রথ যোজিত করো, সবিতা সমস্ত জগৎকে (আপন আপন কর্ম করণে) নিয়োজিত করুন। — এই মন্ত্রের মধ্যে তিনস্থানে তিনজন বিভিন্ন দেবতার বা দেবশক্তির উল্লেখ আছে। প্রথমতঃ (আমাদের ব্যাখ্যানুসারে) দেবী ঊষা অর্থাৎ জীবের হৃদয়ে জ্ঞানের উন্মেষকারিণী দেবী বা ঈশ্বরের ঐ সম্পর্কিত বিভূতি। দ্বিতীয়তঃ অশ্বিনীবা অশ্বিনীকুমারদ্বয় অর্থাৎ আধিব্যাধিনাশক দেবতা বা ঈশ্বরের ঐ সম্পর্কিত বিভূতি। তৃতীয়তঃ জগৎপ্রসবিতৃ অথবা সবিতাদের তথা জ্ঞানং, পরাজ্ঞানং সম্পর্কিত ঈশ্বরীয় বিভূতির উল্লেখ রয়েছে। অগ্নি ও সূর্য দেবদ্বয় ভগবানের একই শক্তির প্রকাশক। এইভাবেই আমাদের মন্ত্ৰাৰ্থ গৃহীত হয়েছে]।

১৭/২– আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! যখন আপনারা অভীষ্টবর্ষক সৎকর্ম-সামর্থ্যকে জ্যোতির্ময় অমৃতের সাথে সংযোজিত করেন, তখন আমাদের শক্তি রক্ষা করুন। হে পরমব্রহ্ম! রিপুসংগ্রামে আমাদের জয়ী করুন; আমরা রিপুসংগ্রামে পরমধন প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ আমাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করুন; আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [প্রার্থনার প্রথম অংশের মর্মার্থ– সৎকর্ম সাধনের দ্বারা আমরা যেন অমৃতলাভ করতে পারি। দ্বিতীয় অংশের মর্মার্থ– আমরা চারিদিকে রিপুগণ কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে আছি; সেই ভয়ঙ্কর শত্রুগণের হাত থেকে ভগবান আমাদের রক্ষা করুন। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ- হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা যখন বৃষ্টিপ্রদ রথ যোজনা করছ, তখন মধুর জলের দ্বারা আমাদের বল বর্ধিত করো এবং আমাদের লোকবর্গকে, অন্নের দ্বারা প্রীত করো। আমরা যেন বীর যুদ্ধে ধন প্রাপ্ত হই। এটি ভাষ্যানুসারী নয়। ক্ষত্রং পদে এখানে বীর ধরা হয়েছে। ভাষ্যকার এই পদে বল এবং ক্ষত্রিয়জাতি এই দুই অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা এখানে ক্ষত্রিয়জাতি অর্থে কোনও সঙ্গতি লক্ষ্য করতে পারিনি]।

১৭/৩– আধিব্যাধিনাশক দেবদ্বয়ের সর্বত্রগমনশীল অমৃতপ্রাপক আশুমুক্তিদায়ক সৎকর্মরূপ যান সুষ্ঠুভাবে আমাদের অভিমুখে আগমন করুক অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত হোক; জ্ঞান-ভক্তি-বৈরাগ্য দায়ক সকলের পরমমঙ্গলসাধক পরমধনদাতাদের আমাদের এবং সকল জীবকে পরমমঙ্গল প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান আমাদের প্রাপ্ত হোন; সেই পরমদেবতা আমাদের পরমমঙ্গল সাধন করুন)। [রথঃ অর্থাৎ সৎকর্মরূপ যান। ত্রিবন্ধুরঃ পদে জ্ঞান ভক্তি ও বৈরাগ্য এই তিন সারথিকে লক্ষ্য করে। এই তিন সারথি সৎকর্মরূপ যানের পরিচালক হলে মানুষ অনায়াসেই সংসারের দুর্গম সাধনমার্গ অতিক্রম করে চরম গন্তব্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। সেই রথ আবার ত্রিচক্রঃ অর্থাৎ ত্রিভুবন, বিশ্ব অতিক্রম করতে সমর্থ। স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালকে তার তিনটি চক্র বা চাকা বলা যায়। এই বিশেষণের দ্বারা এটাই পরিস্ফুট হচ্ছে যে, সক্কর্মের সাধক সর্বত্রই নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন, সর্বত্রই তার অবাধগতি। — – অথচ একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ এইরকম– অশ্বিদ্বয়ের চক্ৰত্রয়বিশিষ্ট মধুপূর্ণ শীঘ্রগামী অশ্ববিশিষ্ট প্রশংসিত ত্রিবন্ধুর ধনপূর্ণ সর্বসৌভাগ্যসম্পন্ন রথ আমাদের অভিমুখে আগমন করুক এবং আমাদের দ্বিপদ (পুত্র ইত্যাদির) ও চতুষ্পদ (গরু ইত্যাদির) সুখ সম্পাদন করুন। আমরা দ্বিপদে চতুষ্পদে অর্থে সর্বজীবেনঅর্থাৎ সকল জীবকেলক্ষ্য করি]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে এবং সেটির নাম কাবম]।

১৮/১– হে পরমদেব! দ্যুলোকের অমৃতধারার মতো আপনার করুণাধারা অবাধে আমাদের অভিমুখে আগমন করুক। আপনি প্রভূতপরিমাণে আত্মশক্তি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন আত্মশক্তি প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রার্থনার মধ্যে একটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে, তার প্রধান উদ্দেশ্য স্বর্গের মন্দাকিনী ধারার সাথে ভগবানের করুণার তুলনা করা। কিন্তু একটু অনুধাবন করলেই দেখা যাবে যে, প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রে কোন উপমা নেই বা থাকতেও পারে না। কারণ স্বর্গীয় ধারা এবং ভগবানের করুণাধারা বলতে একই বস্তুকে বোঝায়। সুতরাং এক বস্তুর মধ্যেই উপমা সম্ভবপর নয়। কেবলমাত্র মন্ত্রের ভাব পরিস্ফুট করবার জন্য উপমার সাদৃশ্য আনয়ন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভগবানের করুণারই মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে]।

১৮/২– পাপহারক দেবতা ভগবৎপ্রিয় সর্বকর্ম দর্শন করে সাধকবর্গের প্রতি আগমন করেন; ॥ রক্ষাস্ত্রসমূহ রিপুনাশের জন্য প্রেরণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সৎকর্মসাধনের দ্বারা লোকসমূহ ভগবানকে প্রাপ্ত হন; ভগবান্ সাধকদের রিপুগুলি বিনাশ করেন)। [মন্ত্রটি দুই অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ পাপহারক দেবতা সর্বান্তর্যামী ও সর্বজ্ঞ। তিনি সমস্ত অবগত আছেন বলেই মানুষের সকলরকম কর্মাকর্মের পুরস্কার বা দণ্ডবিধান করতে পারেন। বিশ্বা কাব্য চক্ষাণঃ– জগতের সমস্ত কর্ম তিনি দর্শন করেন। দ্বিতীয় অংশ আয়ুধা তুঞ্জানঃ– রক্ষাস্ত্রসমূহ প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য রিপুনাশ এবং রিপুর আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা। — মন্ত্রটির একটি প্রচলিত অনুবাদ যথা, এই হরিত্বৰ্ণ সোমরস দেবতাদের প্রীতিকর, সকল কার্যের প্রতি মনোযোগী; ইনি অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করতে করতে আসছেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

 ১৮/৩– সৎকর্মসাধক, ভয়হীন, পবিত্র, সর্বাধিপতি, আশুমুক্তিদায়ক দেব, সৎকর্মসম্পন্ন সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হয়ে প্রসিদ্ধ সেই দেবতা সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা সৎকর্ম সাধনের দ্বারা ভগবানকে লাভ করতে পারেন)। [এখানে আপাতঃ প্রতীয়মান দুটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। একটি রাজেব অপরটি শ্যেনঃন। এই দুটির দ্বারা ভগবানের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। রাজেব– রাজতুল্য। সাধারণতঃ পার্থিব মানুষ ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য রাজার মধ্যেই দেখতে পায়। তাই সাধারণ মানুষকে ভগবৎ-বিভূতি বোঝাবার জন্যই রাজেব উপমামূলক পদ ব্যবহৃত হয়েছে। ভগবান মানুষের আশুমুক্তিদায়ক। কেমন আশু? শ্যেনের মতো। শীঘ্রগামী– তাই শ্যেনঃন। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যাতে মন্ত্রটি যে ভাব পরিগ্রহ করেছে, তা এই সোমরসের সকল কার্যই উত্তম। যখন যাজ্ঞিকেরা এঁকে শোধন করতে থাকেন, ইনি রাজার ন্যায় শ্যেন পক্ষীর ন্যায় নির্ভয়ে গিয়ে আপন স্থান গ্রহণ করেন। মন্তব্যের প্রয়োজন দেখা যায় না]।

১৮/৪– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ আপনি আমাদের দ্যুলোকস্থিত অপিচ, পৃথিবীতে বর্তমান সকল পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [মন্ত্রটি শুদ্ধসত্ত্বকে লক্ষ্য করে উচ্চারিত হয়েছে। পবিত্রকারক সেই পরমবস্তু আমাদের মধ্যে উদিত হলে, আমাদের সমগ্র সত্তা পবিত্র হয়, আমাদের বাক্য মন কর্ম পবিত্রতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সুতরাং মানুষ শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পরমধনলাভের (মোক্ষের) উপযোগিতা প্রাপ্ত হয়। দিবঃ অধি উত পৃথিব্যাং মন্ত্রাংশের দ্বারা বিশ্বের যাবতীয় শ্রেষ্ঠ বস্তুকে লক্ষ্য করে। কারণ তার পরেই আছে বিশ্বা বসুঅর্থাৎ সমস্ত ধন। সাধকের প্রার্থনা হীন অকিঞ্চিৎকর বস্তুর জন্য নয়। পৃথিবীতে, স্বর্গে, যেস্থানে যে পবিত্র মহান্ বস্তু আছে, সেই পরমধনের জন্যই প্রার্থনা। তাঁর চরম লক্ষ্য দিব্যবস্তু, অপার্থিব ধন। দিবঃ পদের দ্বারা সেই স্বর্গীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য আছে। অথচ সাধক পার্থিব বস্তুকে উপেক্ষা করেননি। কারণ তিনি জানেন, পার্থিব বস্তুর ভিতর দিয়েই সেই পরম বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি জানেন, যে অবস্থার মধ্যে, যে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে মানুষ অবস্থিতি করে ইচ্ছামাত্রই সে তার হাত থেকে মুক্ত হতে পারে না। পার্থিব বস্তুর ধারণার সাহায্যেই ধীরে ধীরে তাকে সেই অপার্থিব পরমার্থতার ধারণায় উঠতে হবে। তাই জ্ঞানী সাধক বলছেন, আমাকে স্বর্গীয় ধন দাও, পার্থিব ধন দাও। কারণ পার্থিব ধনের সাহায্যেই আমার মতো ক্ষুদ্ৰহৃদয় হীনপ্রজ্ঞ ব্যক্তি তোমার দিব্যধনের সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করতে পারবে। সেইজন্যই বেদের অনেকস্থলেই দেখা যায় যে, পার্থিব বস্তুর উদাহরণ দিয়ে অপার্থিব দিব্য বস্তুর বিষয় বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং তা-ই স্বাভাবিক। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তুমি ক্ষরিত হতে হতে কি পৃথিবীস্থ, কি স্বর্গলোকস্থ সমস্ত ধনসামগ্রী আমাদের বিতরণ করো। হিন্দী অনুবাদও আছে-হে সোম! পূয়মান তু দুলোকমে স্থিত আউর পৃথ্বীলোকমে স্থিত সকল ধন হমৈ দে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

ঊনবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী