উত্তরার্চিক — বিংশ অধ্যায় (প্রথমাংশ)

এই অধ্যায়ের দেবতা (সূক্তানুসারে)১।৭ পবমান সোম; ২।৩।৭।১০১৬। ইন্দ্র; ৪-৬, ১৮।১৯ অগ্নি, অশ্বিদ্বয় ও ঊষা; ৮ মরুৎগণ; ৯ সূর্য।
ছন্দ—১।৮।১০।১৫-১৬ গায়ত্রী; ৪ উষ্ণিক;
১১ ভুরিগনুষ্টুপ; ১৩ বিরাডনুষ্টুপ; ৫ পদপঙক্তি; ৬।৯।১২ প্রগাথ বার্হত; ৭ ত্রিষ্টুপ; ১৪ শক্করী; ৩।১৬ অনুষ্টুপ; ১৭ দ্বিপদা গায়ত্রী; ১৮ অত্যষ্টি; ২ দ্বিপদা ককুপ; ১৯(১২) বিষ্টার পঙক্তি, : ১৯ (৩-৫) সতোবৃহতী, ১৯ (৬) উপরিষ্টজ্জ্যোতি।
ঋষি– ১ নৃমেধ আঙ্গিরস; ২।৩ প্রিয়মেধ আঙ্গিরস; ৪ দীর্ঘতমা উচথ্য; ৫ বামদেব গৌতম; ৬ প্রস্কণ্ণ কাণ্ব; ৭ বৃহদুকথ বানদেব্য; ৮ বিন্দু বা পূতদক্ষ আঙ্গিরস; ৯।১৭ জমদগ্নি ভার্গব;
১০ সুকক্ষ আঙ্গিরস; ১১-১৩ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ১৪ সুদা পৈজবন; ১৫ মেধাতিথি কাণ্ব ও প্রিয়মেধ আঙ্গিরস; ১৬ নীপাতিথি কাণ্ব; ১৮ পরুচ্ছেপ দৈবোদাসি;১৯ অগ্নি পাবক।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– প্রাসা ধারা অক্ষর বৃষ্ণঃ সুতসৌজসঃ। দেবা অনু প্র ভূষত৷৷৷৷৷ সপ্তিং মৃজন্তি বেধসো গৃণন্তঃ বারবো গিরা। জ্যোতির্জজ্ঞানমুকথা৷ ২৷৷সুষহা সোম তানি তে পুনায় প্রভূবসো। বৰ্ধা সমুদ্রমুক্থ্য ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২– এষ ব্রহ্মা য ঋত্বিয় ইন্দ্রো নাম শুতে গুণে৷৷৷৷ কামিচ্ছবসম্পতে যন্তি গিরো ন সংযতঃ ৷৷ ২৷৷ বি সুতয়ো যথা পথা ইন্দ্র ত্বদ যন্তু রাতয়ঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৩– আ ত্বা রথং যথোতয়ে….১॥ তুবিশুষ্ম তুবিক্রতো শচীবো বিশ্বয়া মতে। আ পপ্রাথ মহিত্বনা। ২। যস্য তে মহিনা মহঃ পরিজমায়ন্তমীয়তুঃ। হস্তা বর্জং হিরণ্যয়ম্ ॥ ৩৷৷

সূক্ত ৪– আ যঃ পুরং নার্মিণীমদীদেদত্যঃ কবিনভন্যোতনাৰ্বা। সূরো ন রুরুাঞ্ছতাত্মা ৷৷ ১৷৷ অভি দ্বিজন্মা স্ত্রী রোচনানি বিশ্বা রজাংসি শুশুচানো অস্থা। হোতা যজিষ্ঠো অপাং সধস্থে৷৷ ২৷৷ অয়ং স হোতা যো দ্বিজন্মা বিশ্বা দুধে বার্যাণি শ্ৰবস্যা। মর্তো যো অস্মৈ সুত্নবো দদাশ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৫– অগ্নে ত্বমদ্যাশ্বং ন স্তোমৈঃ ক্রতুঃ ন ভদ্রং হূদিস্পশম্। ঋধ্যামা ত ওহৈঃ ॥১॥ অধা হ্যগ্নে ক্রতোর্ভদ্রস্য দক্ষস্য সাধোর। রথীঋতসা বৃহতো বভূথ। ২৷৷ এভির্নো অৰ্কৈৰ্ভবা নো অবাক স্বর্ণ জ্যোতিঃ। অগ্নে বিশ্বেভিঃ সুমনা অনীকৈঃ ॥ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– অভীষ্টবর্ষক পবিত্র দেবভাবপ্রদানকারী প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বের অমৃতধারা আত্মশক্তির সাথে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [ভগবান্ মানুষকে অমৃত প্রদান করেন সত্য, কিন্তু সেই মানুষের পক্ষে সেই অমৃতলাভের উপযোগিতা লাভ করা চাই। কারণ কোন বস্তু লাভ করলেই তা উপভোগ করা যায় না। সেই লভ্য বস্তু রক্ষা করার ও উপভোগ করার শক্তি সঞ্চয়ও করতে হবে। আলোচ্য মন্ত্রের ব্যাখ্যায় মন্ত্রটিকে সোমার্থক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা মন্ত্রের মধ্যে সোমরসের কোনও সংশ্রব পাইনি, অথবা মন্ত্রের প্রধান বিষয়কে সোমরস বলে গ্রহণ করলে মন্ত্রের কোনও সুষ্ঠুভাব প্রাপ্ত হওয়া যায় না। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– বর্ষণকারী এই অভিযুত সোমের ধারা দেবগণের উপর স্ব-সামর্থ্য প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে ক্ষরিত হচ্ছেন। এই অনুবাদ যে কোন সুষ্ঠুভাব প্রকাশ করতে পারে তা মনে হয় না। সোমরস কেমন বর্ষণকারী কিংবা তা দেবগণের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে ইচ্ছুক হয়ে কিভাবে ও কেন ক্ষরিত হচ্ছেন, সে-সব প্রশ্ন থেকেই যায়]।

 ১/২– জ্ঞানী ব্যক্তিগণ, স্তুতির দ্বারা আরাধনাপরায়ণ সৎকর্ম-সাধকগণ পরাজ্ঞানদায়ক পরম আরাধনীয় আশুমুক্তিদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — জ্ঞানী সাধকগণ আরাধনার দ্বারা পরাজ্ঞানদায়ক আকাঙক্ষণীয় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [মন্ত্রে যে ভাব প্রচলিত আছে, তা এই– স্তুতিকারী, বিধাতা, কর্মকর্তা (অধ্বর্যুগণ) দীপ্তিমান প্রবৃদ্ধ স্তুতিযোগ্য অশ্বসদৃশ সোমকে মার্জিত করছেন। প্রচলিত হিন্দী অনুবাদও একই রকম প্রায়]।

১/৩– আরাধনীয় পরমধনসম্পন্ন হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক আপনার প্রসিদ্ধ রক্ষাকারক শক্তি ইত্যাদি আমাদের হৃদয়স্থিত অমৃতকে প্রবর্ধিত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। মানুষের মধ্যেই অমৃতের প্রস্রবণ– অমৃতভাণ্ড লুকিয়ে আছে। মানুষ যেন কস্তুরিকা মৃগ। তার অন্তরের মধ্যেই তার প্রার্থনীয় সমস্ত বস্তু আছে, যা তাকে তার জীবনের সফলতা দান করতে পারে। কিন্তু অজ্ঞানতার বশে মানুষ নিজের মধ্যেকার সেই অমৃত উৎসের কথা জানতে পারে না। বর্তমান মন্ত্রে সেই অমৃত-উৎসের প্রতিই লক্ষ্য আছে। সেই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে, বিশুদ্ধ জ্ঞানাগ্নির প্রভাবে আমাদের অন্তরের অমৃত-প্রস্রবণ যেন পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, এটাই প্রার্থনার সারমর্ম। — কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের অন্যরকম ভাব পরিদৃষ্ট হয়। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-হে প্রভূতধনবিশিষ্ট সোম! শোধনকালে তোমার সেই তেজঃসকল অত্যন্ত অভিভবপর হয়, অতএব তুমি সমুদ্রসদৃশ স্তুতিযোগ্য দ্রোণকলসকে পূর্ণ করো। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

২/১– পরমৈশ্বর্যশালী যে ভগবান্ সত্যস্বরূপ, যিনি লোকসমূহের বিধাতা অর্থাৎ সর্বাভীষ্ট পূরয়িতা, যিনি বিশ্ববিশ্রুত, অকৃতিজনের উদ্ধারকর্তা, সেই ভগবানকে যেন আরাধনা করি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎ-অনুসারী হই)। [ভগবান্ সত্য-স্বরূপ। তিনিই একমাত্র সত্য। জগতে যা কিছু সত্য আছে, তা তারই প্রকাশ। মানুষের অন্তরে যে সত্যের বিকাশ হয়, তার দ্বারা ভগবানের সত্তারই পরিচয় পাওয়া যায়। সত্যের ভিতর দিয়েই মানুষের সাথে ভগবানের মিলন সাধিত হয়। তিনি সত্যং জ্ঞানং অনন্তং। তিনি সৎ তিনি আছেন। মানুষ নিজের সাধনার সুবিধার জন্য, সেই অচিন্তনীয়কে চিন্তা করবার জন্য, ভগবানের নামরূপের সাহায্য গ্রহণ করে। ভগবানও উপাসকদের মঙ্গলের জন্য সেই নাম ও রূপ অঙ্গীকার করেন। নচেৎ সসীম সান্ত মানুষের সাধ্যই, নেই সেই অসীম অনন্তকে ধরতে পারে। — বস্তুতঃ, হিন্দুধর্ম এই নামরূপের সাহায্যে ভগবানের আরাধনার উপায় নির্দেশ করে, আপামর সাধারণ সকলকে ঈশ্বর আরাধনার সুযোগ দিয়ে, নিজের মহত্ত্ব ও দূরদর্শিতারই পরিচয় দিচ্ছেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-১০-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২/২– সর্বশক্তিমন্ হে দেব! সুসংযতচিত্ত সাধক যেমন আপনাকে প্রাপ্ত হন, তেমন আমাদের প্রার্থনা আপনাকেই প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন প্রার্থনার দ্বারা ভগবানকে লাভ করতে সমর্থ হই)। [প্রার্থনার উদ্দেশ্য ও মূল লক্ষ্য একটি উপমার দ্বারা পরিস্ফুট হ করা হয়েছে। উপমার বিষয় সংযতচিত্ত সাধকের ভগবৎপ্রাপ্তি। যিনি আপনার চিত্তবৃত্তিসমূহকে এ সুপরিচালিত করতে পারেন, যিনি প্রকৃতপক্ষে আপন মনের প্রভু, তিনিই রিপুগণের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে মোক্ষমার্গে অগ্রসর হতে সমর্থ হন। — এই মন্ত্রের প্রার্থনার উদ্দেশ্য এই যে, সংযতচিত্ত সাধকেরা যেমনভাবে ভগবৎ-লাভ করতে সমর্থ হন, আমরাও যেন আরাধনা প্রভৃতির দ্বারা তেমনভাবে ভগবানকে লাভ করতে পারি। — মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য]।

২/৩– হে ভগবন! রাজমার্গ হতে যেমন ক্ষুদ্রমার্গ নির্গত হয়, তেমনই আপনার নিকট হতে আপনার পরমকরুণাধারা বিশেষভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৪অ-১১দ-৭সা এর একটি অংশমাত্র। সম্পূর্ণ মন্ত্রটির অর্থ সেখানেই দেওয়া আছে। মন্ত্রটির মর্মার্থ এই যে, ভগবান অনন্ত রত্নের খনি। জগতের পরম শ্রেষ্ঠ রত্ন তার ভাণ্ডারেই আছে। সেই অফুরন্ত অনন্ত ভাণ্ডার থেকেই মানুষের বাসনা-কামনারূপ ধন বিতরিত হয়। পরম ঐশ্বর্যশালী দেবতা, তার সন্তানবর্গের মঙ্গলের জন্য অবারিতভাবে নিজের পরম সম্পৎ বিতরণ করছেন। অনন্ত অক্ষয় রত্নপ্রবাহ মানুষের মস্তকে বর্ষিত হচ্ছে। যে যতটুকু পারে, যার যতটুকু শক্তি, সে ততটুকু গ্রহণ করে। সে অনন্ত ভাণ্ডারের আদি নেই অন্ত নেই, ক্ষয় নেই অপচয় নেই। তিনি যেমন অনন্ত, তার রত্নভাণ্ডারও তেমনি অনন্ত, অক্ষয়। কল্পতরুর পাদমূলে দাঁড়িয়ে ঐকান্তিকতাসহকারে প্রার্থনা করলে, কেউই বিফলমনোরথ হয় না। কিন্তু প্রার্থনার মতো প্রার্থনা করা চাই, নতুবা শুধু চাইলেই পাওয়ার অধিকারী হওয়া যায় না। — মন্ত্রের প্রার্থনার আর এক ভাব সূচিত হতে পারে। রাতয়ঃ– কেবল যে ভগবানেরই দান তা নয়। প্রার্থীর দাতাকে কোনও বিশেষ সামগ্রী দান করতে সমর্থ। ভগবানের কাছে যেমন সৎ-ভাব প্রার্থনা করা যায়, তেমন আবার তাকে সৎ-ভাব প্রদান করাও চলে। মন্ত্রের উপমায় সেই ভাবই প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষুদ্র নদী যেমন মহানদীতে মিলিত হয়, ক্ষুদ্র পথ যেমন বৃহৎ পথে মিশে যায়, তেমনি আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ের ক্ষুদ্র সৎ-ভাবটুকু বিরাট তোমাতে গিয়ে মিলিত হোক, তোমাকেই আশ্রয় করে তোমাতে আত্মলীন করুক, উপমায় সেই আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করি]। [এই সাম-মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-১১দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম কালেয়ম্]।

৩/১– হে ভগবন! বিপন্ন ব্যক্তি যেমন বিপদ হতে আশুমুক্তিলাভের জন্য সৎকর্মরূপ যান গ্রহণ করেন তেমনভাবে আমরা আপনাকে যেন সম্যকরূপে প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি)। [এই মন্ত্রটিও ছন্দার্চিকে পরিদৃষ্ট হয়। এটি সেই মন্ত্রের একটি অংশ। সম্পূর্ণ মন্ত্রটির অর্থ সেখানে পাওয়া যাবে। মন্ত্রটির প্রথম ভাগে ভগবৎ-প্রাপ্তির প্রার্থনার সঙ্গে, ভগবৎ-প্রাপ্তির উদ্দেশ্য স্বরূপ দুটি বিষয় ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রথম, পাপকবল থেকে রক্ষা; দ্বিতীয় পরমানন্দলাভ। ভগবৎ-প্রাপ্তি ঘটলে পাপের আক্রমণের ভয় থাকে না। পাপ মোহ প্রভৃতির যন্ত্রণা সাধককে সহ্য করতে হয় না। কারণ, মোক্ষযাত্রার পথেই এই সমস্ত অসুরের উপদ্রব থাকে; গন্তব্য স্থানে পৌঁছালে আর সেইসব উপদ্রব থাকে না। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য পরমানন্দ লাভ। ব্রহ্মানন্দ লাভের সঙ্গে পার্থিব কোন সুখ সম্পদের, কোন আনন্দেরই তুলনা হয় না। সেই অতুলনীয় পরমানন্দলাভ হয়, শুধু তার চরণপ্রাপ্তি ঘটলে। তিনি আনন্দস্বরূপ– আনন্দের খনি। সুতরাং তাকে এ উপভোগজনিত যে আনন্দ লাভ হয়, তা আর কোথাও পাবার উপায় নেই। সাধক সেই অমৃতেরই তার এ প্রার্থনা করছেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-১দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৩/২– প্রভূত ধনশালী প্রভূতকর্মা পূজনীয় পরম-আরাধনীয় হে দেব! আপনি বিশ্বব্যাপ্ত মহত্ত্বের ও দ্বারা সর্বজগৎকে সম্যকরূপে পূর্ণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, – ভগবান্ মহিমার দ্বারা বিশ্বকে প্রপূরিত করেন)। [প্রচলিত মতের সাথে আমাদের কোন অমিল ঘটেনি। যেমন, প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে প্রভূতবলশালী অত্যন্ত প্রাজ্ঞ, বহুকর্মা এবং পূজনীয় ইন্দ্র! তুমি বিশ্বব্যাপ্ত মহত্ত্বের দ্বারা (জগৎ) আপূরিত করছ। হিন্দী অনুবাদেও আছে মহান্ বলী আউর অনেকো বিচিত্র কর্মওয়ালে অনেকো পরাক্রমোসে যুক্ত হে পূজনীয় ইন্দ্র! বিশ্বব্যাপী মহিমাসে তুমনে বিশ্বভরকো পূর্ণ করা হ্যায়। তিনি তুবিশুষ্ম– প্রভূতশক্তির অধিকারী, সর্বশক্তির অধিকারী, তিনি সর্বশক্তিমান্। শুধু তাই নয়, তিনি তুবিক্রতো– মহান্ কর্মসাধক। তিনি শচীবঃ- বহুকর্মোপেত পূজনীয়। জগতে যা কিছু সম্পাদিত হয়, সেই সমস্ত তারই কর্ম। এই অনন্ত বিশ্ব তারই শক্তিবলে। বিধৃত আছে ও পরিচালিত হচ্ছে]।

৩/৩– হে ভগবন! মহান্ যে আপনারই হস্তদ্বয় পরমমঙ্গলসাধক রক্ষাস্ত্র পরিগ্রহণ করে, সেই আপনিই সুমহত্ত্বের দ্বারা সকল বিশ্বকে প্রকৃষ্টরূপে ধারণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান রক্ষাস্ত্রের দ্বারা বিশ্বকে রক্ষা করেন)। [ভগবান্ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপে সৃষ্টিকে যথাক্রমে সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করেন। (ধ্বংস অর্থে আপন সৃষ্টিকে আপনার মধ্যেই পুনগ্রহণ করেন)। এটাই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অর্থ। — বর্তমান মন্ত্রে ভগবানের রক্ষাশক্তির মহিমাই পরিবর্ণিত হয়েছে। তিনি জগৎকে সব রকম বিঘ্ন-বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তাঁর মঙ্গলময় রক্ষাস্ত্র বজ্র সর্বদাই জগৎকল্যাণ সাধনের জন্য বিনিযুক্ত আছে। বজ্র ভগবানের আয়ুধ। তা যেমনভাবে দুষ্টের বিনাশ সাধনের জন্য প্রযুক্ত হয়, ঠিক তেমনিভাবে শিষ্টের রক্ষার জন্যও প্রযুক্ত হয়। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– তুমি মহান। তোমার মহত্ত্ব দ্বারা পৃথিবীতে ব্যাপ্ত হিরন্ময় বজ্র হস্তদ্বয়ে গ্রহণ করো। — আমাদের মন্ত্রার্থের সঙ্গে খুব বেশী পার্থক্য নেই]।

৪/১– যে দেবতা পরমসুখদায়ক স্থানকে অর্থাৎ স্বর্গকে দীপ্ত করেন, প্রাজ্ঞ যে দেবতা আশুমুক্তিদায়ক এবং অনন্তস্বরূপ যে দেবতা জ্যোতিঃরূপে প্রকাশিত হন, সেই পরমদেবতা আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (মন্ত্রটি নিত্য-সত্যমূলক। ভাব এই যে, মুক্তিদায়ক জ্যোতিঃস্বরূপ পরমদেবতা আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [তিনি শতাত্মা, অর্থাৎ জগতের প্রত্যেক অনুপরমাণুর মধ্যে তিনি বিরাজিত আছেন। জগতে তিনি, তাতে জগৎ অবস্থিত রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে, সর্বত্রই যদি তিনি বর্তমান, তবে তাকে পাবার জন্য প্রার্থনার অর্থ কি? আছে। সূর্যালোক তো সকলেই দেখতে পায়, কিন্তু অন্ধ পায় কি? এখানেও তেমনি, ভগবান তো সর্বত্রই আছেন, কিন্তু তা উপলব্ধি করবার শক্তি কি সকলের আছে? তাঁকে হৃদয়ে লাভ করে উপভোগ করবার যে শক্তি, তা লাভ করা সাধনাসাপেক্ষ। তাই তিনি সর্বত্র বিদ্যমান থাকলেও আমরা তাকে উপলব্ধি করতে পারি না। তাঁকে লাভ করবার প্রার্থনার মূলে ঐ শক্তিলাভের প্রার্থনাই নিহিত আছে]।

৪/২– পরাজ্ঞান দীপ্ত ত্রিলোককে এবং সর্বজ্যোতিকে সম্যক্ররূপে প্রকাশ করেন; দেবভাবপ্রাপক পরমারাধনীয় দেবতা অমৃতসমুদ্রে বর্তমান থাকেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ও বিশ্বপ্রকাশক জ্ঞানদেব অমৃতপ্রাপক হন)। [ভাষ্যকার দ্বিজন্মা পদের অর্থ করেছেন, দুটি ও এ অরণিকাষ্ঠের ঘর্ষণে উৎপন্ন অগ্নি। কিন্তু এ অর্থ যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর, তা অনুভব করে ভাষ্যকার, নিজেই ব্যাখ্যা দিলেন অরণিকাষ্ঠ সঙ্র্ষণে অগ্নির যে জন্ম বলা হয়, তা তার প্রথম জন্ম। আবার আধান ইত্যাদি সংস্কারকর্মকে অগ্নির দ্বিতীয় জন্ম বলা হয়। এই সংস্কারপূত অগ্নিই, ভাষ্যমতে, দ্বিজন্মা। বিবরণকার কিন্তু ঐ পদে দ্বিজকে লক্ষ্য করেছেন, দ্বিজ মানুষ, অগ্নি নয়। ব্যাখ্যাকার আবারও বলেছেন- দ্যুলোক-ভূলোক থেকে উৎপন্ন বলে অগ্নি দ্বিজন্মা। আমরা কিন্তু এখানে ভাষ্যকারের লক্ষ্য বস্তু প্রজ্বলন্ত অগ্নি কিংবা বিবরণকারের মানব দ্বিজ দুটির.কোনটিরই প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে মনে করি না। আমরা দ্বিজন্মা বলতে যে অগ্নিকে বুঝি, তা জ্ঞানাগ্নি। তা মানুষের জন্মের সঙ্গেই জন্মে, আবার গুরুর উপদেশে, শিক্ষায় সেই সুপ্ত অগ্নি নববল ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করে, এই-ই জ্ঞানাগ্নির দ্বিতীয় জন্ম। অথবা এ-ও বলা যেতে পারে যে, ভগবানের মধ্যে যে জ্ঞান আছে, তা মানুষের অন্তরে যখন প্রোথিত হয়, তখন সেই জ্ঞানাগ্নি দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে। আমরা এই দিক দিয়েই দ্বিজন্মা বলতে জ্ঞানাগ্নিকে লক্ষ্য করেছি। এ সত্ত্বেও মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হলো–দ্বিজন্মা অগ্নি দীপ্যমান লোকত্রয়কে প্রকাশ করেন এবং সমস্ত রঞ্জনাত্মক লোকও প্রকাশ করেন। তিনি দেবতাগণের আহ্বানকর্তা এবং যেস্থলে জল সংগৃহীত হয় সেখানে বর্তমান আছেন।- পাঠকই বিচার করুন]।

৪/৩– যিনি জ্ঞানদেব প্রসিদ্ধ সেই সৎকর্মসাধক দেবতা সকল বরণীয় শক্তি ইত্যাদি সাধকদের প্রদান করেন; যে ব্যক্তি প্রসিদ্ধ এই পরমদেবতাকে পূজোপচার সমর্পণ করেন সেই ব্যক্তি শোভনশক্তি হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তি দৈবশক্তি লাভ করেন; ভগবান সাধকদের পরমমঙ্গল প্রদান করেন)। [মন্ত্রে হোতাকেই দ্বিজন্মা বলা হয়েছে। হোতা শব্দের অর্থ– হোমনিষ্পদক অথবা দেবানাং আহ্বাআ। দুটি অর্থই সঙ্গত। তাই দ্বিজন্মাঅগ্নিই দেবতাদের যজ্ঞে আহ্বান করেন, অগ্নিই দেবতাদের প্রতিনিধিরূপে হব্য গ্রহণ করেন, আবার অগ্নিই সেই হব্য দেবতাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। সুতরাং দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, যজ্ঞে অগ্নির স্থান অতিশয় উচ্চে। শুধু তাই নয়, অগ্নি যজ্ঞের প্রাণস্বরূপ। অগ্নি না হলে যজ্ঞ আরম্ভই হতে পারে না। আবার যজ্ঞের প্রধান অংশসমূহ অগ্নির সাহায্যেই নিষ্পন্ন হয়, তাই অগ্নি হোমনিস্পাদক। সুতরাং প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– যে অগ্নি দ্বিজন্মা, তিনিই হোতা, তিনি হব্যলাভের ইচ্ছায় সমস্ত বরণীয়ধন ধারণ করেন। যে মর্ত অগ্নিকে হব্যদান করে তার উত্তমপুত্র হয়। কিন্তু আমাদের মতে দ্বিজন্মা পদে জ্ঞানদেবতাকেই লক্ষ্য করে, এ কথা পূর্বেও বলা হয়েছে এবং বর্তমান মন্ত্রেও সেই অর্থেই সঙ্গতি লক্ষিত হয়। সেই জ্ঞানদেবই মানুষকে বরণীয় ধনের অধিকারী করেন, তিনিই বিশ্বা বার্যানি এবস্যা দধে, সকলরকম পরমমঙ্গলদায়ক শক্তিধারণ করেন, তা সাধককে দান করেন। যিনি ভগবানের আরাধনাপরায়ণ অর্থাৎ সাধনাপরায়ণ, তিনিই পরম ধনের অধিকারী হতে পারেন]। [এই সূক্তের একত্রগ্রথিত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম সাকমশ্বম্]।

৫/১– প্রজ্ঞানস্বরূপ হে দেব! ক্ষিপ্রগমনশীল অথবা সত্বর ভগবৎপ্রাপক জ্ঞানভক্তির ন্যায় কল্যাণদায়ক অথবা দীপ্তিমন্ত এবং সৎ-ভাবপ্রাপক সৎকর্মের মতো অতিশয় প্রিয়তম তোমাকে আমরা সদাকাল ভগবৎপ্রাপক স্তোত্রের দ্বারা যেন আরাধনা করি। (ভাব এই যে, আমরা সদাকাল সর্বতোভাবে যেন ভগবানের অনুসারী হই)। [জ্ঞান কর্ম ও ভক্তি এই তিন পন্থার অনুসরণে ভগবানের চরণে পৌঁছান যায়। জ্ঞানমার্গের অনুসরণে সাধক ভগবানের স্বরূপ অবগত হতে পারেন, অর্থাৎ মোক্ষলাভ করতে পারেন। যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্ম হয়েছেন। — কর্মের সাধনাতেও ভগবৎপ্রাপ্তি ঘটে। কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন ছিন্ন হয়। কর্মমার্গের অনুসরণে সাধকের হৃদয় থেকে পাপ মলিনতা দূর হলে ক্রমশঃ ভগবানের দিব্যজ্যোতিঃ তাঁর হৃদয়ে ফুটে ওঠে। সেই জ্যোতিঃ বলে তিনি অভীষ্টলাভে সমর্থ হন। — প্রার্থনার দ্বারা এবং ভক্তির সাহায্যেও সাধক ভগবানের চরণে পৌঁছাতে পারেন। এই তিনরকম উপায়ে মুক্তি লাভ হয়, মন্ত্র উপমার ছলে তা-ই খ্যাপন করছেন। অবশ্য জ্ঞান কর্ম ভক্তি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি অন্যটির সাথে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ। মন্ত্রে তারও ইঙ্গিত করা হয়েছে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৯দ-৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৫/২– হে জ্ঞানদেব! আপনিই নিত্যকাল কল্যাণকামী সৎকর্মসাধনসমর্থ সাধকের মহৎ সত্যপ্ৰাপক সৎকর্মসাধনের পরিচালক হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সাধকদের পরিচালক হন)। [ভগবানই সৎকর্মসাধনের পরম সাহায্যকারী। ভগবানের কৃপাতেই মানুষ সেই পরমধনের অধিকারী হতে পারে। আবার তাঁর কৃপাতেই মানুষ সৎকর্মসাধন করতে সমর্থ হয়। তিনি মানুষকে রিপুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন বলেই মানুষ সৎকর্মসাধনে আত্মনিয়োগ করতে সমর্থ হয়। আমরা হিন্দু-শাস্ত্র অন্বেষণ করলে এ-সম্বন্ধে প্রভূতপরিমাণ উদাহরণ পেতে পারি। যেমন, রাক্ষসদের উপদ্রব থেকে মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ রক্ষার জন্য শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাব ইত্যাদি। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অগ্নি! তুমি এক্ষণেই ভজনীয় প্রবৃদ্ধ (অভীষ্টফল) সাধক সত্যভূত ও মহান্। যজ্ঞের নেতা হয়েছ। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৫/৩– হে জ্ঞানদেব! আমাদের উচ্চাৰ্যমাণ এই সকল স্তোত্রের সাথে আমাদের অভিমুখী হোন। হে দেব! জ্যোতিঃস্বরূপ শোভন-মনষ্ক আপনি সকল জ্যোতিঃর সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! জ্যোতিঃ স্বরূপ আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [জ্যোতিঃর আধার ভগবানের জ্যোতিতে বিশ্ব আলোকিত। মানুষের অজ্ঞান অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়কে দিব্যজ্যোতিঃতে উদ্ভাসিত করতে একমাত্র তিনিই সমর্থ। তিনি যখন কৃপা করেন, তখন মুহূর্তের মধ্যে হাজার বৎসরের সঞ্চিত জমাটবাঁধা অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায়। নরঘাতী রত্নাকর দস্যু মুহূর্তের মধ্যে সাধুত্বে পরিবর্তিত হয়ে যায়। মন্ত্রের প্রধান ভাব এই যে, ভগবান্ যেন কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে আগমন করেন, আমাদের হৃদয়ে দিব্যজ্যোতিঃ প্রদান করেন। আমাদের প্রার্থনা আরাধনা যেন তাঁর চরণে পৌঁছায়, তিনি যেন কৃপা করে এই হীন পতিত সন্তানকে তার জ্যোতিঃ দানে কৃতার্থ করেন। — কিন্তু প্রচলিত মন্ত্র ইত্যাদির ভাব অন্যরকম। যেমন, হে অগ্নি! তুমি জ্যোতির্মান্ সূর্যের মতো সমস্ত তেজোযুক্ত এবং প্রসন্ন-অন্তঃকরণ। তুমি আমাদের এই স্তোত্রের দ্বারা নীত হয়ে আমাদের অভিমুখে আগমন করো। এইরকম ভাষ্য-অনুসারী হিন্দী অনুবাদও আছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম সাকমশ্বম্।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৬– ১৭৮০, অগ্নে বিবস্বদুষসশ্চিত্ৰং রাধো অমর্ত্য। আ দাশুষে জাতবেদো বহা মদ্যা দেবাং উষবুধঃ ॥১॥ ১৭৮১, জুষ্টো হি দূতো অসি হব্যবাহনোহগ্নে রথীধুরাণা। সজুরশ্বিভ্যামুষসা সুবীর্যমস্মে ধেহি শ্ৰবো বৃহৎ ॥ ২॥

সূক্ত ৭– ১৭৮২, বিধুং দদ্রাণং সমনে বহুনাং যুবানং সন্তং পলিতো জগার। দেবস্য পশ্য কাব্যং মহিত্বদ্যা মমার স হ্যঃ সমান৷ ১ : ১৭৮৩, শাক্সনা শাকো অরুণঃ সুপর্ণ আ যো মহঃ শূরঃ সনাদনীড়। যচ্চিকেত সত্যমিৎ তন্ন মোঘং বসু পাহমুত জেতোত দাতা৷ ২৷৷ ১৭৮৪, ঐভির্দদেবৃষ্ণয়া পৌংস্যানি যেভিরৌক্ষ বৃহত্যায় বর্জী। যে কর্মণঃ ক্রিয়মাণস্যঃ মহ্ন ঋতে কর্মমুদজায়ন্ত দেবাঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৮– ১৭৮৫, অস্তি সোমো অয়ং সুতঃ পিবন্ত্যস্য মরুতঃ। উত স্বরাজো অশ্বিনা৷১৷৷ ১৭৮৬, পিবন্তি মিত্রো অর্যমা তনা পতস্য বরুণঃ। ত্রিষধস্থসা জাবতঃ। ২৷৷ ১৭৮৭, উততা দাস্য জোষমা ইন্দ্রঃ সুতস্য গোমতঃ। প্ৰাতহোতেব মৎসতি৷৷ ৩৷

সূক্ত ৯– ১৭৮৮, বমহা অসি সূর্য বডাদিত্য মহাঁ অসি। মহস্তে সততা মহিমা পনিষ্টম মহাদেব মহা অসি৷৷৷৷৷ ১৭৮৯, বটু সুৰ্যবসা মহা অসি সত্রা দেব মহা অসি। মহা দেবানামসূর্যঃ পুরোহিতো বিভু জ্যোতিরদাভ্য৷৷ ২৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ—  ৬সূক্ত/১সাম– মরণরহিত (নিত্যস্বরূপ) জ্ঞানাধার হে অগ্নিদেব! এই উপাসককে (আমাকে) জ্ঞান-উন্মেষ-সম্বন্ধীয় অনুপম (বিচিত্র) পরমার্থ ধন প্রদান করুন; অপিচ, অদ্যই (নিত্যদিন) জ্ঞান-উন্মেষসাধক দেবগণকে (দেবভাবসমূহকে) আনয়ন করে সর্বতোভাবে আমার অধিগত করুন। (আমায় প্রাপ্ত করিয়ে দিন)। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে নিত্যসত্য জ্ঞানের আধার দেব! আমাদের হৃদয়ে জ্ঞানের উন্মেষ করুন, দেবভাবসমূহ আনয়ন করুন)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ এই যে, মন্ত্রে অগ্নিদেবতাকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে- হে অগ্নিদেব! আপনি ঊষা দেবতার নিকট হতে ধন আনয়ন করে যজমানকে প্রদান করুন; আর যজ্ঞদিবসে ঊষাকালে দেবসকলকে উদ্বুদ্ধ করে আনুন। একদিকে অগ্নিদেবের বিশেষণ আছে, তিনি অমর্ত– তিনি জাতবেদঃ। প্রচলিত অর্থ পাঠ করলে মনে হয়, ধনের অধিকারী যেন ঊষাদেবতা, অগ্নিদেব ধন বহন করে আনেন মাত্র। অগ্নিদেবকে মানুষরূপে কল্পনা করলে, এমন অর্থ অধ্যাহার করা যায় বটে; কিন্তু সে পক্ষে আবার অমর্ত প্রভৃতির বিশেষণের সার্থকতা প্রতিপন্ন হয় না। পরন্তু এ পক্ষে জ্বলন্ত অগ্নিপক্ষেও সামঞ্জস্য রাখা যায় না। আমরা তাই মনে করি, উষসঃ পদে, ঊষা দেবতার নিকট হতে– এই অর্থ অপেক্ষা জ্ঞানোন্মেষ সম্বন্ধীয় অর্থই সমীচীন হয়। রাত্রির অন্ধকার অবসিত হয় ঊষার আবির্ভাবে; অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরীভূত হয় ঊষার আলোকের মতো জ্ঞান-কিরণের সম্পাতে। এইভাবে প্রথমে যে জ্ঞানসঞ্চার হয়, উষসঃ পদ তা-ই ব্যক্ত করছে]।

৬/২– হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি নিশ্চয়ই দেবগণের বা দেবভাবসমূহের আহ্বানকারী, আপনিই নিশ্চয়ই সত্ত্বভাবসমূহের প্রদায়ক, আপনি নিশ্চয়ই যজ্ঞসমূহের (সৎকর্ম-নিবহের) আশ্রয়স্বরূপ; অন্তৰ্বাধিবহির্বাধিনাশক (অশ্বিদ্বয়ের) দেবভাবের সাথে জ্ঞানের উন্মেষকারিণী সৎ বৃত্তির (ঊষা-দেবতার) সাথে একীভূত হয়ে, সকার্য-সাধনে শক্তিদায়ক (সুবীর্য) মঙ্গলপ্রদ ধন (শ্রব) আমাদের আপনি প্রদান করুন। (ভাবার্থ;- হে দেব! আপনিই সকল দেবের অথবা সকল দেবভাবের প্রদাতা। অতএব আপনি আমাদের জ্ঞানের উন্মেষকর অন্তৰ্বাধিবহির্বাধিনাশমূল পরমধন প্রদান করুন– এটাই প্রার্থনা)। [এই মন্ত্রে অগ্নিকে দূত বলা হয়েছে; হব্যবাহক বলা হয়েছে, এবং যজ্ঞের রথী বলা হয়েছে। তা থেকে অগ্নিকে মানুষভাবে বা ঋষিভাবে মনে করা যায়। ভাব প্রকাশ পায়, — – সেই অগ্নিঋষি দূতরূপে দেবগণের কাছে যাতায়াত করেন, তাঁদের জন্য উপহার ইত্যাদি নিয়ে যান। এবং তাদের রথীর কার্য করেন। সাধারণ জ্বলন্ত অগ্নিপক্ষেও ঐ ভাব কল্পনা করে নেওয়া যায়। তবে জ্ঞানমার্গে যাঁরা একটু অগ্রসর হয়েছেন, তারা ঐ অর্থে তৃপ্ত হতে পারেন না। দূত সংবাদবাহক। এখানে এ আধ্যাত্মিক যজ্ঞে, দূত কি সংবাদ বহন করে নিয়ে কোথায় যাবেন? মনে হতে পারে, আমাদের সৎকর্মের সমাচার, ব্যষ্টিস্বরূপ তিনি, সেই সমষ্টিস্বরূপ ভগবৎসমীপে নিয়ে যাবেন। তা থেকেই মর্ম আসে এই যে, আমাতে দেবভাবের সত্ত্বভাবের সমাবেশ করে আমাকে তিনি ভগবৎ সমীপে পৌঁছিয়ে দেবেন। হব্যবাহনঃ পদেও এই ভাব আসে। আমার হবনীয় দ্রব্য- শুদ্ধসত্ত্বভাব তিনি বহন করে নেবেন, আমাতে সত্ত্বভাব প্রদান করে তাতে মিশে যাবেন। এই তাৎপর্য এখানে পাওয়া যায়। আর তিনি কেমন? না– অধুরাণাং রথীঃ। সৎকর্ম-মাত্রেই তিনি আশ্রয়দাতা ও রক্ষক– এ বাক্যে এই ভাব প্রকাশমান]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– বারবন্তীয়ম, মহরামদেব্যম এবং শ্রুধ্যম]।

৭/১– রিপুসংগ্রামে অসংখ্য শত্রুর পরাজয়কারী জগতের (অথবা সৎকর্মের) বিধাতা নিত্যপুরুষকে পাপবশতঃ জীর্ণাতমা আমি, যেন আরাধনা করতে পারি। হে মম মন! ভগবানের এ মহত্ত্বপূর্ণ সৃজন ও রক্ষাসামর্থ্য উপলব্ধি করো; যে জন এই মুহূর্তে পাপবশতঃ পতিত হয়, সে ভগবানের কৃপায়, পরমুহূর্তে পাপ হতে মুক্ত হয়ে নবজীবন লাভ করে। (ভাব এই যে, ভগবানকে যেন আমি আরাধনা করি; তার কৃপায় পাপীও পুণ্য-জীবন লাভ করে; আমিও পাপ হতে মুক্তি প্রার্থনা করছি)। অথবা সংগ্রামে অসংখ্য শত্রুর পরাজয়কারী শক্তিমান্ যৌবনসম্পন্ন পুরুষকেও বার্ধক্য গ্রাস করে। হে আমার মন! ভগবানের মহত্ত্বযুক্ত সামর্থ্য উপলব্ধি করো। সেই যুবা নিত্যকাল মরছে ও পুনঃপ্রাদুর্ভূত হচ্ছে। (ভাব এই যে, এই জীবন যৌবন চঞ্চল; কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর হন)। [ঋষিগণ সাধনা আরম্ভ করলেন। জানতে হবে মৃত্যুর পরপারে কি আছে। মানুষের ভাগ্য কোন শৃঙ্খলে বাধা, তা জানা চাই-ই চাই। জীবনের ও পরলোকের মাঝখানে যে ঘনতমসাবৃত অজ্ঞান কাল-যবনিকা রয়েছে, তা উত্তোলন করতেই হবে। অন্ধকার ভেদ করে জ্যোতিঃর সন্ধান নিতে হবে। তারা প্রার্থনা করলেন– তমসসা মা জ্যোতির্গময়। মহাপুরুষদের সেই প্রার্থনা ভগবান্ গ্রহণ করলেন। বেদ বললেন, বিধূং দদ্রাণ; সমনে বহূণাং যুবান ৩ সন্তং পলিতো জগার। দেবস্য পশ্য কাব্যং মহিত্বদ্যা মমার স হ্যঃ সমান। ভয় নেই মানব! তোমরা অনিত্য জলবুদ্বুদ নও। তোমরা নিত্য, তোমরা অমৃতের অধিকারী। এই যে মৃত্যু দেখছ, এ তো মৃত্যু নয়। এ যে নবযৌবন প্রাপ্তি মাত্র। ভয় পেও না মানব। মৃত্যুর জন্য ভয় নেই। শ্রান্ত ক্লান্ত কলেবরে তোমরা পৃথিবীর কর্মভার বহন করতে যখন অসমর্থ হও, তখন তোমাদের জন্য একটু বিশ্রামের আয়োজন মাত্র। আত্মার অবিনশ্বরতা– অধ্যাত্মবিজ্ঞানের গোড়ার কথা। আত্মা সেই নিত্য পরমপুরুষেরই প্রকাশ। সুতরাং আত্মা মরতে পারে না। — তাঁর ধ্বংস নেই। বেদের এই মহতী বাণী আমাদের সঞ্জীবিত করুক। — এই মন্ত্রে আরও একটি ব্যাখ্যা প্রদত্ত হলো। তাতে পাপীকে উদ্ধারের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। যত বড় পাপী হোক না কেন- ভগবান কৃপা করলে তোক উদ্ধার পায় চিরশান্তি লাভ করে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১০দ-৩সা) পাওয়া যায়]।

৭/২– যে দেবতা মহান শক্তিমান্ নিত্য, সর্বত্রবিদ্যমান পরমশক্তিসম্পন্ন জ্যোতির্ময় ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক, সেই দেবতা যে জ্ঞান প্রদান করেন সেই জ্ঞান সত্যই হয়, মিথ্যা হয় না। অপিচ, তিনি স্পৃহণীয় পরমধন জয় করেন এবং সেই ধন সাধকদের দান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, পরমজ্যোতির্ময় সর্বশক্তিমান ভগবান্ সাধকদের পরমধন প্রদান করেন)। [মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– দেখ, উজ্জ্বল একটি পক্ষী আসছে, তার অদ্ভুত বল, সে বৃহৎ, প্রাচীন ও.বলশালী, তার কুলায় কোথাও নেই। সে যা করতে চায়, তা সত্যই হবে, বৃথা হবে না। অতি চমৎকার সম্পত্তি সে জয় করে এবং দান করে। মন্ত্রটি যে একটি রূপক; তা প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়। রূপকের ভাষার মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি সত্যতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। — মন্ত্রের ব্যাখ্যার প্রথম অংশে সুপণঃ পদের অর্থ করা হয়েছে– পক্ষী। আমাদের ব্যাখ্যা– সুনর পক্ষযুতঃ অর্থাৎ ঊর্ধ্বগতিদায়ক। আমরা প্রচলিত অর্থ অনুসারে উদ্দিষ্ট বস্তুকে পক্ষী বলেই ধরলাম। শ্রুতির অন্যত্রও পরমাত্মাকে পক্ষীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। সেই পক্ষী অনীড়ঃ– প্রকৃতপক্ষে তার কোন বাসস্থান থাকতে পারে না। তিনি সর্বত্র বিদ্যমান, তিনি সর্বদেশে সর্বকালে বর্তমান আছেন। তিনি অরুণঃঅর্থাৎ তিনি জ্যোতির্ময় জ্যোতিঃর আধার। তিনি মানুষকে যে জ্ঞানজ্যোতিঃ প্রদান করেন, তা তাকে তার চরম গন্তব্যস্থানে নিয়ে যায়। মন্ত্রে বলা হয়েছে– যৎ চিকেত তৎ সত্যং ইৎ– তিনি যা প্রকাশিত এ করেন, তা সত্যই হয়, কখনও মিথ্যা হয় না। অর্থাৎ তিনি সত্যস্বরূপ। এই মন্ত্রাংশের দ্বারা ভগবানের সত্যস্বরূপের বিষয় প্রখ্যাত হয়েছে। মোঘং ন (মিথ্যা হয় না) পদ দুটির দ্বারা এই ভাবই আরও পরিস্ফুট হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি স্পাহং জেতা অর্থাৎ স্পৃহণীয় বরণীয় ধনের জেতা (জয়কারী)। তিনিই পরমধনের অধিপতি অর্থাৎ মানুষ তারই কৃপায় পরমধন লাভ করতে সমর্থ হয়। তাই তার পরের অংশ উত দাতা অর্থাৎ তিনি কেবলমাত্র পরমধনের অধিপতি নন, তা তিনি মানুষকে দানও করেন। এই দান করাতেই তার মাহাত্ম্য এবং ধনের সার্থকতা। ভগবানই মানুষকে পরমধনের অধিকারী করেন। মন্ত্রে এই সমস্ত সত্যই পরিবর্ণিত হয়েছে]।

৭/৩– যে শক্তির সাথে রক্ষাস্ত্রধারী দেব অজ্ঞানতানাশের জন্য সাধকদের অভীষ্ট প্রদান করেন, সেই শক্তির সাথে অভীষ্টদায়ক শক্তি ইত্যাদি সাধককে প্রদান করেন; যে মহান্ দেবতাগণ সম্পদ্যমান সৎকর্মের সত্যসাধন সম্পাদন করেন, সেই দেবগণ আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, – অভীষ্টদায়ক সত্যপ্ৰাপক দেবভাবসমূহ আমাদের প্রাপ্ত হোক)। [মন্ত্রটির একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– বজ্রধারী ইন্দ্র এইসকল মরুৎ দেবতাদের এইরকম বল প্রাপ্ত হলেন, যাতে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন এবং বৃত্রকে বধ করে পৃথিবীকে অভিষিক্ত করলেন। মহীয়ান ইন্দ্র যখন সেই কার্য করেন, তখন মরুঙ্গণ আপনা হতেই বৃষ্টি উৎপাদন কর্মে প্রবৃত্ত হন। এইরকমএকটি হিন্দী অনুবাদও আছে। এই দুই ব্যাখ্যাতেই যেভিঃ এবং এভিঃ পদ দুটিতে মরুৎদেবগণকে লক্ষ্য করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত মত অনুসারে মরুৎদেবগণ ইন্দ্রদেবের নিত্যসহচর। ইন্দ্রদেবের সাথে প্রত্যেক কার্যেই মরুৎগণ সহায়করূপে উপস্থিত থাকেন। এখানেও এই চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু মূল মন্ত্রে মরুৎগণ বা ইন্দ্রের কোনও প্রসঙ্গ নেই। যেভিঃ অর্থাৎ যাভিঃ শক্তিভিঃ সহ, এভিঃ অর্থাৎ তাভিঃ শক্তিভিঃ সহ, বৃহত্যায় অর্থাৎ জ্ঞানাবরকশত্রুনাশায় অজ্ঞানতানাশায় ইত্যাদিরূপেই আমরা পদগুলির ব্যাখ্যা করেছি এবং তা থেকেই এই মন্ত্রে একটি প্রার্থনার সঙ্গত ভাব নিহিত দেখা যায়, তা এই যে, ভগবান্ যেন সকলরকম অভীষ্টপ্রাপক শক্তি আমাদের প্রদান করেন। তিনি যেন কৃপাপূর্বক আমাদের হীন হৃদয়ে আবির্ভূত হন]।

৮/১– আমাদের কর্মের দ্বারা সঞ্জাত যে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব থাকে, সেই শুদ্ধসত্ত্বের অংশকে স্বয়ং দীপ্যমান (সর্বত্র-প্রকাশশীল) মরুৎগণ (বিবেকরূপী দেবতারা) আপনা-আপনিই গ্রহণ করেন, এবং অশ্বিদ্বয়ও (অন্তৰ্বাধি-বহির্ব্যাধি-বিনাশক দেবদ্বয়ও) তা গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, — সৎকর্মের দ্বারা হৃদয়ে একটু শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার হলেই বিবেকের অনুকম্পা প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং আন্তর বাহ্য সকল ব্যাধিই নাশপ্রাপ্ত হয়)। [যেখানে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার হয়, যেখানে আপন কর্মের দ্বারা মানুষ শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয়ে সমর্থ হয়; সেখানেই মানুষের হৃদয়ে বিবেকের ক্রিয়া প্রত্যক্ষীভূত হতে থাকে, সেখানেই অন্তর্ব্যাধি ও বহির্ব্যাধি সকলরকম ব্যাধির শান্তি আনয়ন করে। এই নিত্যসত্য তত্ত্বই এই মন্ত্রে প্রখ্যাত আছে বোঝা যায়। যদি আমরা বুঝতে পারি– অস্তি সোমো অয় সুতঃ অর্থাৎ এই শুদ্ধসত্ত্বভাব আমাদের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে; তখনই বোঝা যায়– পিবন্ত্যস্য মরুতঃ উত স্বরাজ্যে অশ্বিনা, অর্থাৎ মরুৎদেবগণ তা পান করছেন, আর অশ্বিদ্বয় তা গ্রহণ করছেন। ভাব এই যে, সেই অবস্থাতেই আমাদের মধ্যে বিবেকরূপী দেবগণের ক্রিয়া উপস্থিত হয়, সেই অবস্থাতেই অন্তরের ও বাহিরের সকল ক্লেদকালিমা দূরে যায়। মরুৎদেবগণকে এবং অশ্বিদ্বয়কে আমরা যথাক্রমে বিবেকরূপী দেবগণ ও অন্তৰ্বাধি-বহির্ব্যাধি নাশক, দেবদ্বয় বলে নির্দেশ করে এসেছি। বিবেক আপনা-আপনিই প্রকাশসম্পন্ন, বিবেকরূপী দেবগণকে (মরুৎগণকে) তাই স্বরাজঃঅভিধায়ে অভিহিত করা হয়েছে। তারা সোমপান করেন, বলতে, হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাবের সাথে তাদের সম্মিলন হয়– এটাই ভাবার্থ। হৃদয় নির্মল হলে, হৃদয়ে বিবেকের প্রতিষ্ঠা ঘটলে, ব্যাধি-বিপত্তির বিভীষিকা আপনিই বিদূরিত হয়। উত অশ্বিনা– এই ভাবই দ্যোতনা করছে। — মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যভাবাপন্ন। সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য অভিষব ক্রিয়া দ্বারা সংশোধিত অর্থাৎ পরিশ্রুত হলে মরুন্নামক দেবগণ এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয় তা পান করেন;– এমন অর্থই এখন গৃহীত হয়ে আসছে। বলা বাহুল্য, আমরা সে অর্থ অনুমোদন করি না]। [এই মন্ত্রটি ছদার্চিকেও (২অ-৬দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– মিত্রভূতদেব, পরমগতিদায়ক দেব এবং অভীষ্টবর্ষক দেব ত্রিলোকস্থিত পবিত্র জনের। অর্থাৎ সকল লোকের সাধনার দ্বারা উৎপন্ন শুদ্ধসত্ত্বকে স্বয়ংই গ্রহণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপচার গ্রহণ করেন)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– মিত্র, অর্যমা ও বরুণ দশাপবিত্ৰদ্বারা শোধিত স্থানত্ৰয়ে অবস্থাপিত ঔত্যজনবিশিষ্ট সোমপান করছেন। মন্ত্রের মধ্যে সোম্রস বা সোমপানের কোনও প্রসঙ্গ নেই। ভাষ্যকার কিংবা বিবরণকার অনেক রকমভাবে ব্যাখ্যা করলেও আমরা মনে করি, ত্রিষধস্থস্য বলতে ত্রিলোকস্থিত অর্থই প্রকাশ পায়। কারণ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই ত্রিভুবনস্থিত সর্বলোকের পূজোপচারই ভগবান্ গ্রহণ করেন। — সাধকগণ সাধনার দ্বারা যে শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উৎপন্ন করেন, তা-ই ভগবৎ-আরাধনার প্রকত উপকরণ। ভগবান্ স্বয়ংই সেই উপকরণ কৃপাপূর্বক সাধকদের নিকট হতে গ্রহণ করেন– এটাই মন্ত্রের মর্মার্থ]।

৮/৩– সাধনার আরম্ভে সৎকর্মসাধক যেমন ভগবানকে পেতে ইচ্ছা করেন, সেইরকমভাবে বলাধিপতি দেব অর্থাৎ ভগবানও সাধকদের নিকট হতে প্রসিদ্ধ জ্ঞানযুত বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের গ্রহণ সম্যকরূপে ইচ্ছা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকগণ যেমন ভগবৎলাভ কামনা করেন ভগবানও তেমনই ভাবে সাধকদের পূজা-আরাধনা ইচ্ছা করেন)। [মন্ত্রের মধ্যে যে ভাবটি বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, তার অর্থ এই যে, মানুষই যে কেবলমাত্র ভগবানকে লাভ করবার জন্য চেষ্টিত থাকে তা নয়, ভগবানও মানুষকে নিজের কোলে টেনে নেবার জন্য ব্যস্ত থাকেন। তা না হলে মানুষের কি সাধ্য যে, সেই অনন্ত অসীমের সন্ধান পায়? তিনি কৃপা করে মানুষের কাছে নিজেকে ধরা দেন বলেই মানুষ তাকে ধরতে পারে। শাস্ত্রগ্রন্থ ইত্যাদিতে এই সত্য বহু উদাহরণের (ধ্রুব ইত্যাদি উপাখ্যানের দ্বারা পরিস্ফুট করা হয়েছে। আমরা অন্য এক দিক দিয়ে বিষয়টির আলোচনা করতে পারি। ভগবানও মানুষের দিকে অগ্রসর হবেন– তার অর্থ কি? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য ভগবানের সাথে মানুষের সম্বন্ধের একটু বিচার করতে হবে। বিশ্ব, ভগবানেরই বিকাশ মাত্র। সুতরাং ভগবান্ যখন মানুষের দিকে অগ্রসর হবেন, তখন তিনি নিজেকেই উপভোগের জন্য প্রস্তুত হন। সসীম মানুষ, সসীম বিশ্ব, সেই অসীমেরই একরকম বিকাশমাত্র প্রমাণিত হয়। ভগবান্ নিজেকে উপভোগ করতে পারেন এই বিশ্বের ভিতর দিয়ে; অর্থাৎ প্রেম আস্বাদন করবার জন্য দুই পক্ষ চাই। একপক্ষ ভগবান্ নিজে, অপরপক্ষ মানুষ। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা করা হয় তা এই বঙ্গানুবাদটি থেকেই উপলব্ধ হবে– ইন্দ্র প্রাতঃকালে হোর। ন্যায় অভিযুত এবং গব্যযুক্ত সোম সেবার প্রশংসা করছেন। আমরা কিন্তু এই মন্ত্রে সোমরসের কোনও এ প্রসঙ্গ পাইনি]। ক. ৯/১- হে জ্ঞানাধার! আপনি মহত্ত্বসম্পন্ন অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপ শ্রেষ্ঠ-ঐশ্বর্যের অধিকারী হন– এটা সত্য। অনন্তের অঙ্গীভূত হে দেব! আপনি মহত্ত্বসম্পন্ন অর্থাৎ অনন্ত-সৎকর্ম-রূপ শ্রেষ্ঠ বলের অধিকারী হন– এটা সত্য। মহৎ সৎস্বরূপ আপনার বলৈশ্বর্যপ্রদ মহত্ত্ব সাধকগণ কর্তৃক পরিদৃষ্ট হয়। হে দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণান্বিত আপনি মহত্ত্বের দ্বারা– জীবের হিতসাধনের দ্বারা মহান্ প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠ হয়ে আছেন। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম্য-খ্যাপক। অন্তর্নিহিত প্রার্থনা– হে ভগবন! আমাদের প্রতি আপনার সকল মহিমা প্রকট হোক)। [এই সাম-মন্ত্রে যে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করবার আছে, তার মধ্যে সূর্য ও আদিত্য পদ প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঐন্দ্রসূক্তের মধ্যে এই মন্ত্রের সন্নিবেশ হওয়ায় এখানে ইন্দ্রই সূর্য সম্বোধনে আহত হয়েছেন প্রতিপন্ন হয়। এখানে দেবতত্ত্বের বিষয় প্রণিধান করার আবশ্যক হয়। দেবতাই বা কে, আর ভগবানই বা কে? ইন্দ্রই বা কে, আর সূর্য বরুণ মিত্র বায়ু অগ্নি প্রভৃতিই বা কে? নাম রূপ বিভিন্ন হলেও বস্তুগত যে কোনও পার্থক্য নেই, সেটাই আপনা-আপনি প্রতিপন্ন হয়। সাগরের জলও জল, নদীর জলও জল, হ্রদ-তড়াগ-পুষ্করিণীর জলও জল। নাম-রূপের পার্থক্য হলেও, জল যে বস্তু, তাতে কোনও পার্থক্য নেই। স্রষ্টার সাথে সৃষ্ট বস্তুর উপমা-বিন্যাস করছি;- সে কেবল আমাদের মতো অজ্ঞেরই বোধ-উন্মেষের জন্য। দেবতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম হলেই ইন্দ্রও যে সূর্য-সম্বোধনে সম্বোধিত হতে পারেন, তা আপনিই হৃদয়-দর্পণে প্রতিভাত হয়। ভগবৎ-বিভূতি সত্ত্বভাব যতই বিচ্ছিন্ন অবস্থিত হোক না কেন, মূলতঃ সকলই অভিন্ন। এই আলোচনায় তা-ই উপলব্ধি হয়। যেমন সূর্য ও আদিত্য পদ অন্তদৃষ্টি প্রসারিত করছে, তেমনি মন্ত্রের অন্তর্গত কয়েকটি মহান্ পদ বহিদৃষ্টি উন্মুক্ত করছে। মন্ত্রে প্রথমে বলা হয়েছে, — হে সূর্যদেব! তুমি মহা– এটা সত্য। তার পর, আবার বলা হয়েছে — হে আদিত্য! তুমি মহান — এটা সত্য। একই মহান শব্দ দুবার প্রয়োগে কি সার্থকতা আছে– এখানে সেটিই বিবেচনার বিষয়। সংসারী মানুষ চায়– ঐশ্বর্য এবং শক্তিসামর্থ্য। এখানে সূর্য সম্বোধনে দেবতাকে যে মহান বলা হয়েছে, তার মর্ম তিনি শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যের অধিকারী একটু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সে ঐশ্বর্য– জ্ঞান। তাই তার সম্বোধন- হে সূর্য (হে জ্ঞানাধার)। দ্বিতীয়তঃ আদিত্য সম্বোধনে তাকে যে মহান্ বলে অভিহিত করা হয়েছে, তার ভাব তিনি শ্রেষ্ঠ বলের অধিকারী। বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, শ্রেষ্ঠ কর্মই শ্রেষ্ঠ বলের উৎপাদক, অশেষ শ্রেষ্ঠ কর্ম মানুষকে অশেষ বলে বলী করে। তাই দেবতার সম্বোধন আদিত্য অনন্তের অঙ্গীভূত অশেষ কর্মের প্রাপক। মন্ত্রের উপসংহারে আছে মহা মহান। এখানে সম্বোধন পদ দেব। দেবতার মহান্ মহত্ত্ব দীপ্তিদানাদি। দেব সম্বোধনে এখানে তার দাতৃত্বের মহিমাই ব্যক্ত করছে। যিনি জ্ঞানের আধার, জ্ঞানের বিতরণেই তার মহত্ত্ব প্রকটিত। যিনি বলৈশ্বর্যের অধিপতি, বল ও ঐশ্বর্য প্রদানে তার মহত্ত্ব প্রকাশ পায়। যিনি দেব, দীপ্তিদান ইত্যাদিই তার মহত্ত্বের বিঘোষক। এইভাবে বিভিন্ন মহাপদে দেবতার অশেষ জ্ঞানের ও বলৈশ্বর্যের এবং জীবহিতসাধনে তা বিনিয়োগের ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। মন্ত্রটি দেবভাবের মাহাত্ম্যপ্রকাশক হলেও, একটি প্রার্থনার ভাব তার অন্তর্নিহিত আছে। সে প্রার্থনা– আমাদের প্রতি ভগবানের সকল মাহাত্ম্য প্রকট হোক]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৩অ-৫দ-৪সা রূপেও পাওয়া যায়]।

৯/২– হে জ্ঞানদেব! আপনি সত্যই শক্তির দ্বারা মহান্ হন; সত্যই হে দেব! আপনি মহান হন, অজ্ঞানতানাশক হন; মহত্ত্বের দ্বারা দেবভাবসমূহের শ্রেষ্ঠতম হন; অপিচ, আপনার জ্যোতিঃ সর্বত্রব্যাপ্ত এবং সকলের আকাঙক্ষণীয় হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানই পরমবল, জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই নেই)। [মন্ত্রটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা– হে সূর্য! তুমি শ্রবণে মহান, একথা সত্য। তুমি দেবগণের মধ্যে মহান, একথা সত্য। তুমি শত্রুবিনাশী, তুমি দেবগণের ৫ হিতোপদেষ্টা, তোমার তেজ মহৎ এবং অহিংসনীয়। এইরকমই হিন্দী অনুবাদও আছে। উভয় ব্যাখ্যাতেই সূর্যের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। এই সূর্য কে? যাঁর কৃপায় জগৎ প্রকাশিত হয়, যাঁর কৃপায় বিশ্ব আলোক লাভ করে, সেই সূর্যদেবই এই মন্ত্রের উদ্দিষ্ট দেবতা। সেই মহান্ দেবতার মহিমা মন্ত্রে পরিকীর্তিত হয়েছে। বঙ্গানুবাদে বস পদের অর্থ করা হয়েছে– শ্রবণে। কিন্তু শ্রবণে মহান এই অংশের দ্বারা কোনও সুষ্ঠুভাবই পরিস্ফুট হয় না। ভাষ্যকারও এই অর্থ দিয়েছেন বটে, কিন্তু এই সঙ্গে আর একটি অর্থও দিয়েছেন– অন্নেন। অন্ন শব্দ শক্তি-অর্থক। আমরা এই অর্থই (বলেন, শক্ত্যা) গ্রহণ করেছি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– গৌরীবিতম]।

.

তৃতীয় খণ্ড

 সূক্ত ১০– উপ নো হরিভিঃ সুতং যাহি মদানাং পতে। উপ নো হরিভিঃ সুত৷৷৷৷৷ দ্বিতা যো বৃহন্তমো বিদ ইন্দ্রঃ শতকতুঃ। উপ নো হরিভিঃ সুতম্ ৷৷ ২৷৷ ত্বং হি বৃত্ৰহমোষাং পাতা সোমানাসি৷ উপ নো হরিভিঃ সুত৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১১– প্র বো মহে মহে বৃধে ভরধৃং প্রচেতসে প্র সুমতিং কৃণুধ। বিশঃ পূর্বীঃ প্রচর চর্ষণিপ্রাঃ ॥১॥ উরূব্যচসে মহিনে সুবৃক্তিমিন্দ্রায় ব্রহ্মা জনয়ন্ত বিপ্রাঃ। তস্য ব্ৰতানি ন মিনন্তি ধীরা৷৷ ২৷৷ ইন্দ্রং বাণীরনুত্তমন্যুমেব সত্ৰা রাজানাং দধিরে সহধ্যৈ। হশ্বায় বহয়া সমাপী ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১২– যদি যাবতস্তুমেতাবদহমীশীয়। স্তোতারমিদ দধিযে রদাবসো ন পাপায় রংসিষ৷৷৷৷.. শিক্ষেয়মি মহয়তে দিবেদিবে রায় আ কুহচিদ বিদে। ন হি ত্বদন্য মঘবন্ ন আপ্যং বস্যো অস্তি পিতা চ ন ৷৷ ২৷৷

সূক্ত ১৩– সুধী হবং বিপিপানস্যাদ্রেবোধা বিপ্রস্যাৰ্চত মনীষা। কৃষা দুবাংস্যন্তমা সচেমা। ১৷৷ নতে গিরো অপি মৃষ্যে তুরস্য ন সূস্তুতিমসূর্যস্য বিদ্বান্। সদা তে নাম স্বযশো বিবক্সি৷৷ ২৷৷ ভূরি হি তে সবনা মানুষেষু ভূরি মনীষী হবতে জ্বামিৎ। মারে অস্মন্ মঘবং জ্যোক কঃ ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ—  ১০সূক্ত/১সাম– হে আনন্দের অধিস্বামি (পরমানন্দনিলয়)! আপনি জ্ঞানকিরণ বিস্তারের সাথে আমাদের শুদ্ধসত্ত্বের বা সৎকর্মের প্রতি আগমন করুন; এবং আগমন করে, জ্ঞানকিরণ বিস্তারের দ্বারা আমাদের শুদ্ধসত্ত্বকে বা সুকর্মকে পরিপোষণ করুন। (ভাব এই যে, আমাদের কর্ম জ্ঞানের সাথে মিলিত হোক; তার দ্বারাই আমরা যেন পরমানন্দ প্রাপ্ত হই)। [ভাষ্যে এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রে যে অর্থ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে দেবতার প্রতি অভক্তি আসে এবং দেবপূজকদের প্রতি অশ্রদ্ধার সঞ্চার হয়। মূলে মদানাং পতে পদ আছে। তা থেকে মাদ্যন্ত্যনেনেতি মদঃ সোমঃ এমন ব্যাখ্যা-মূলে সোমরস রূপ মাদকদ্রব্যের অধিস্বামী বলে দেবতাকে নির্দেশ করা হয়। সোমরস মাদকদ্রব্য পেলেই যেন সে দেবতার তৃপ্তি হয়। তাতেই যেন তিনি বিভোর হয়ে আছেন। এমন ভাব পরিগ্রহণের পর সেই দেবতাকে যেন বলা হয়েছে, আমরা সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য প্রস্তুত করে রেখেছি; আপনি আপনার ঘোটকসমূহে আরোহণ করে শীঘ্র এসে তা পান করুন। মূলে দুবার উপনঃ সুতং বাক্যাংশ আছে। তাতে যেন সেই মদ্যপায়ী বা মদ্যের অধিকারী দেবতাকে আসবার জন্য আদর করে পুনঃ পুনঃ আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিগৃহীত অর্থ সম্পূর্ণ অন্য ভাব দ্যোতনা করে। যেমন, মদানাং পতে পদ দুটিতে সেই পরমানন্দের অধিপতি আনন্দের নিলয়-স্বরূপ ভগবানকে আহ্বান করা হয়েছে বলে মনে করি। সে আনন্দ– তুচ্ছ মাদকদ্রব্য পানের আনন্দ নয়। মানুষের দুঃখনাশজনিত যে আনন্দ– সেই আনন্দের বিষয়ই এখানে প্রখ্যাত দেখা যায়। হরিভিঃপদে ঘোটকসমূহের দ্বারাঅর্থ আমরা গ্রহণ করি না। দেবতাকে মনুষ্য-প্রকৃতিসম্পন্ন বলে মনে করলেও এককালে একাধিক ঘোটকে কেমন করে তিনি আরোহণ করবেন, তা-ও কল্পনাতীত। ঐ হরিভিঃ পদে আমরা সর্বত্রই জ্ঞানকিরণসমূহের দ্বারা অর্থই প্রতিপন্ন করে আসছি। এখানেও সেই অর্থেরই সঙ্গতি রয়েছে। ভাব এই যে, আমাদের কর্ম জ্ঞানসমন্বিত হোক; অর্থাৎ জ্ঞানের জ্যোতিঃ বিভিন্ন দিক দিয়ে বিভিন্ন রকমে বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের কর্মকে বিশুদ্ধ ভাব প্রদান করুক। আমরা যেখানেই সুতঃ পদ দেখেছি, তার সর্বত্রই শুদ্ধসত্ত্ব, ভক্তি বা সৎকর্ম অর্থ প্রাপ্ত হয়েছি। এখানেও সেই অর্থেরই সঙ্গতি রয়েছে। উপ নঃ হরিভিঃ সুতঃ বাক্যাংশের দুবার প্রয়োগে দুরকম। ভাব ব্যক্ত হয়েছে বলে আমরা মনে করি। প্রথম, এস হে ভগবান, আমার কর্মের মধ্যে জ্ঞানসমন্বিত হয়ে এস। দ্বিতীয়ে, আমার কর্মকে জ্ঞানের দ্বারা পরিপোষণ করো। আমি যেন অজ্ঞানের মতো কর্ম কখনও না করি]। [ছন্দার্চিক (২অ-৪দ-৬সা) দ্রষ্টব্য]।

১০/২– প্রভূতশক্তিসম্পন্ন, নিঃশেষে পাপনাশক যে ভগবান্ ইন্দ্রদেব উগ্র এবং শান্ত এই দুই রকমে সকলের দ্বারা জ্ঞাত হন, সেই দেবতা পাপহারক জ্ঞানকিরণের সাথে আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণের জন্য আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ বজাদপি কঠোর এবং কুসুমের অপেক্ষাও কোমল হন; তিনি কৃপাপূর্বক আমাদের পূজোপচার গ্রহণ করুন)। [বৃহন্তমঃ পদে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন– অতিশয়েন বৃত্রস্য হন্তা অর্থাৎ যিনি বিশেষভাবে বৃত্রকে বিনাশ করেন। বৃত্র যদি প্রচলিত মত অনুযায়ী অসুরবিশেষ হয়, তাহলে অতিশয়েন পদের কি সার্থকতা থাকতে পারে? অসুর যদি মরেই গেল, তবে তাকে আবার বিশেষভাবে নিধন করার দ্বারা কি ভাব বোঝাতে পারে? বৃত্র বলতে যদি বহু অসুর বোঝায় অথবা বৃত্রবংশীয় অসুরসমূহকে লক্ষ্য করত, তাহলে না হয় বোঝা যেত যে, ইন্দ্রদেব সমস্ত অসুর অথবা সেই অসুর বংশকে নির্মূল (বিশেষভাবে) করেছিলেন। কিন্তু বৃত্রবংশ বা বৃত্রদলসম্বন্ধে কোন ইঙ্গিত কোথায়ও পাওয়া যায়নি। সুতরাং ব্যাখ্যা যদি গ্রহণ করতে হয়, তবে এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, বৃত্র বলতে প্রচলিত অর্থে গৃহীত বৃত্রাসুর ব্যতীত অন্য কোনও বস্তু বোঝায়, যার আংশিক ধ্বংস এবং সম্পূর্ণ ধ্বংস এই উভয়ই সম্ভবপর। …আমরা পূর্বাপরই বৃত্র পদে পাপ অজ্ঞানতা প্রভৃতি অর্থ গ্রহণ করে আসছি; বর্তমান ক্ষেত্রেও তার অন্যথার কোন কারণ দেখা যায় না। মন্ত্রের প্রার্থনার মর্ম এই যে, সেই পরম দয়াল প্রভু কৃপা করে দীন অকিঞ্চন আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপচার যেন গ্রহণ করেন। আমাদের নিজস্ব বলতে কিছুই নেই। তাঁর চরণে নিবেদন করবার মতো কোন বস্তু নেই। হৃদয়ের ভাবকুসুমাঞ্জলি এটাও তারই দান। তারই দেওয়া উপচার দিয়ে তাঁরই পূজা করবার চেষ্টা করছি; তিনি দয়া করে আমাদের এই অর্ঘ্য গ্রহণ করুন। — এই মন্ত্রের যে সব ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটি বঙ্গানুবাদ– শ্রেষ্ঠ বৃত্ৰহা শতক্রতু ইন্দ্র দুই রকমে জ্ঞাত হন। সেই তুমি হরিগণের সাহায্যে আমাদের অভিযুত সোমের কাছে আগমন করো। হিন্দী অনুবাদে অবশ্য বৃহন্তমঃ পদে বৃত্রাসুর বা পাপকা অত্যন্তনাশক বলা হয়েছে]।

১০/৩– পাপনাশক হে দেব! আপনিই আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের রক্ষক (অথবা গ্রহীতা) হন; হে দেব! পাপহারক জ্ঞানকিরণের সাথে আমাদের বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব গ্রহণ করবার জন্য আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপচার গ্রহণ করুন)। [ভগবানকে লাভ করবার উপায় যেমন শুদ্ধসত্ত্ব, তেমনি আমাদের হৃদয়নিহতি সেই পরমবস্তুটি ভগবানের কৃপাতেই রক্ষিত হয়। আবার তাঁর পূজার জন্যই এর সত্যিকার প্রয়োজন। মন্ত্রে স্পষ্টই বলা হয়েছে– ত্বং হি সোমানাং পাতা আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের একমাত্র রক্ষক ও গ্রহীতা। ভগবান আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বকে রিপুর পাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন, সেইজন্য তিনি শুদ্ধসত্ত্বের রক্ষক। আবার মানুষের মনে সৎ-প্রবৃত্তিবিকাশের সাহায্য করে তা পালনও করেন। এই দিক দিয়ে পা ধাতুর (পাতা) পালনার্থক এবং রক্ষার্থক অর্থ সঙ্গত বলে মনে হয়। অপরপক্ষে ভগবানের জন্য, হৃদয়ে তার স্পর্শলাভ করবার জন্যই মানুষের শুদ্ধসত্ত্বের সার্থকতা। ভগবৎপূজার শ্রেষ্ঠতম উপকরণ– শুদ্ধসত্ত্ব। ভগবানের গ্রহণের জন্যই হৃদয়ের পবিত্র ভাবকুসুমাঞ্জলি রক্ষিত হয়, এবং তার গ্রহণেই এর সার্থকতা। তাই এখানে পাতা শব্দের গ্রহীতা এ অর্থও সঙ্গত হয়। প্রচলিত ব্যাখ্যা- হে বৃত্ৰহা, যেহেতু তুমি এই সোম-সমূহের পানকর্তা, অতএব এ এ হরিগণের সাথে অভিযুত সোমের নিকট গমন করো। – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১১/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা পরমধনদাতা মহত্ত্বসম্পন্ন দেবতার জন্য অর্থাৎ তাকে পাবার জন্য, আরাধনা প্রকৃষ্টরূপে সম্পাদন করো; পরাজ্ঞান লাভের জন্য সৎকর্মাত্মিকা প্রার্থনা বিশেষরূপে সম্পন্ন করো। হে দেব! সাধকবর্গের আত্ম-উন্নয়নকারী আপনি, প্রার্থনাকারী আমাদের প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে দেব! আপনাকে পাবার জন্য আমরা যেন সৎকর্মের সাধনে। সমর্থ হই; আপনি কৃপা করে আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [সৎসঙ্কল্প, সাধু উদ্দেশ্য ও হৃদয়ের পবিত্রতা। তবেই সৎকর্ম ও প্রার্থনা অভীষ্ট ফল প্রদান করতে পারে। মানুষের উন্নতির প্রকৃত কারণ– ভগবান নিজে। তাই তাকে চৰ্ষণপ্রাঃ (সাধকদের আত্ম-উন্নয়নকারী বা অভীষ্টপূরক) বলা হয়েছে]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১০দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১১/২– জ্ঞানিগণ যে মহান্ সর্বব্যাপী বলাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য মঙ্গলদায়ক স্তুতি উচ্চারণ করেন, সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেবের আরাধনা সাধকগণ সম্পাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানী সাধকগণ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আরাধনাপরায়ণ হন)। [জ্ঞানিগণ নিজেদের অন্তর্নিহিত জ্ঞানের প্রভাবে চরম মঙ্গলের উপায় স্থির করতে পারেন। সেই উপায়– ভগবানের আরাধনা। দেখতে হবে, এই ভগবানের আরাধনা বলতে কি বোঝায়?– মানুষও ভগবানের অংশ, মানুষ তারই বিভূতির একরকম বিকাশমাত্র। উভয়ের মধ্যেই এটাই মিলনসূত্র, মিলনের সাধারণ ভিত্তিভূমি। কিন্তু এই উভয়ের মধ্যে পার্থক্যও বিস্তর। আরাধনার দ্বারা সেই পার্থক্যকে দূরীভূত করবার চেষ্টা করা হয়, এবং আরাধনা সফল হলে সেই পার্থক্য দূরীভূত হয়ে সাধক ভগবানের সাথে একাত্মতা লাভ করেন। আরাধনার এটাই উদ্দেশ্য। কিন্তু পার্থক্য কি এবং কিভাবে সেই পার্থক্য দূরীভূত হয়, তা দেখা যাক। প্রথমতঃ মানুষ সসীম, সান্ত; ভগবান্ অসীম, অনন্ত। তবুও মানুষের মধ্যে অসীমত্বের অনন্তত্বের বীজ রয়েছে, এবং সেই জন্যই সে অসীমকে অনন্তকে হৃদয়ে ধারণা করতে পারে। মানুষের মধ্যে যে শক্তিবীজ আছে, আরাধনার দ্বারা তাকে বিকশিত করতে পারলেই মানুষ নিজেকে অনন্তের মধ্যে সমাহিত করতে পারে এবং এটাই সাধনার চরম লক্ষ্য। দ্বিতীয় পার্থক্য– মানুষ মোহাচ্ছন্ন, অজ্ঞান; ভগবান্ মুক্ত জ্ঞানস্বরূপ। মানুষ স্বরূপতঃ ব্রহ্ম হলেও অবিদ্যার দ্বারা মায়ার দ্বারা মোহগ্রস্ত হয়ে আছে বলে সে নিজেকে জানতে পারে না এবং সেই জন্যই যত অশান্তি ও পাপের সৃষ্টি হয়। আরাধনার দ্বারা মানুষের এই অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়। আরাধনার অর্থ আরাধ্যের অনুসরণ। সেই জ্ঞানস্বরূপ ভগবানের ধ্যানে, চিন্তায়, তার মাহাত্ম্য কীর্তনে মানুষও তার সঙ্কীর্ণতাহীনতার হাত থেকে মুক্তিলাভ করতে সমর্থ হয়। এটাই আরাধনার প্রধান উদ্দেশ্য। — প্রচলিত বঙ্গানুবাদ- যে ইন্দ্র প্রভূত ব্যাপ্তিবিশিষ্ট ও মহান, তার উদ্দেশে মেধাবীগণ স্তুতি ও হব্য উৎপাদন করছেন। প্রাজ্ঞলোকে তার ব্রত হিংসা করতে পারে না। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১১/৩– সাধকদের রিপুনাশের জন্য, তাঁদের প্রার্থনা বিশ্বপতি অপ্রতিহতশক্তি বলাধিপতি দেবকে অনুসরণ করে। হে আমার মন! পাপহারক জ্ঞান-ভক্তি-দাতা দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য বন্ধুভূত সৎ-বৃত্তিসমূহকে প্রকৃষ্টরূপে উদ্বোধিত করো। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই ॥ যে, সাধকেরা বিশ্বের অধিপতি ভগবানকে আরাধনা করেন; আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই)। [অনুত্তমং পদের অর্থ– অপ্রতিহতক্রোধং অর্থাৎ যাঁর ক্রোধ বা শক্তি কেউই প্রতিরোধ করতে না এ পারে না। যিনি অপ্রতিহতশক্তি, অথবা সর্বশক্তিমান্, তার প্রতিই এই বিশেষণ প্রযুক্ত হয়। যিনি রিপুনাশক, তিনিই অপ্রতিহতক্রোধ। অর্থাৎ তার ক্রোধ রিপুর বিনাশেই প্রযুক্ত হয়। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে সেই পরমদেবতার আরাধনা করবার জন্য আত্ম-উদ্বোধন আছে]।

১২/১– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনি যে পরমধনের অধিকারী, প্রার্থনাকারী আমিও সেই ধনের অধিকারী, যেন হই। পরমধনদাতা হে দেব! প্রার্থনাকারী আমাকে আপনি যে জ্ঞান প্রদান করেন, তা যেন আমি পাপকার্যে কিছুই ক্ষয় না করি, অর্থাৎ পাপীর সাথে যেন আমার কোনও সম্বন্ধ না হয়। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপা করে আমাকে পরমধনের পূর্ণ অধিকারী করুন; আমি যেন পাপসম্বন্ধশূন্য হই)। [মানুষ পরব্রহ্মেরই অংশীভূত; কিন্তু অজ্ঞানতার দ্বারা আচ্ছন্নবুদ্ধি থাকায় তা সে বিস্মৃত হয়ে থাকে। নিজে অমৃতের সন্তান হয়েও মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে থাকে। কিন্তু যদি আপন স্বরূপ জানতে পারে, তাহলে নিজের অধিকার পূর্ণভাবে লাভ করবার জন্য নিজের গৌরবময় অবস্থায় উন্নীত হবার জন্য আত্মনিয়োগ করে। — এইভাবে, মানুষ যখন সত্য সত্য জাগে, তখন তার কাছে পাপ আসতে পারে না, এবং পাপের ছায়া দেখলেও সাধক ভয় পান। তাই প্রার্থনা করছেন– পাপত্বায় ন রংসিং  — আমি যেন পাপের সংশ্রবেও না যাই]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৮দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১২/২– পরমধনদাতা হে দেব! আপনিই সকল সাধককে নিত্যকাল পরমধন সম্যকরূপে প্রদান করেন। হে দেব! আপনি ব্যতীত অন্য কেউই আমাদের বন্ধু নন; অপিচ, পরম আরাধনীয় নন; পালক কেউই বিদ্যমান নেই। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই আমাদের পালক ও রক্ষক হন। তিনিই সাধকদের পরমধন প্রদান করেন)। [দিবেদিবে পদের দ্বারা কালকে লক্ষ্য, করছে। এই পদ ইঙ্গিত করছে যে, সাধক সকল সময়েই ভগবানের কৃপাভাজন হন। কৃতচিদ্বিদে পদে আমরা বুঝি যে, সাধক যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তিনি ভগবানের কৃপা লাভ করেন। তাই মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, – সাধক সর্বত্র সর্বকালে সর্ব-অবস্থায় ভগবানের কৃপাবলে রক্ষিত হন। — মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে আত্মনিবেদন আছে। ভগবান ব্যতীত মানুষের অন্য কোন বন্ধু নেই, রক্ষক নেই। তিনিই একমাত্র পালক ও রক্ষক। তাই মন্ত্র বলছেন, ন পিতা ন আপ্যং ত্বদন্যৎ– আপনি ব্যতীত আমাদের কোনও বন্ধু নেই– আত্মীয় নেই, পালক নেই। আপনিই আমাদের একমাত্র বন্ধু; তাই আপনার চরণে শরণ গ্রহণ করছি। — প্রচলিত ব্যাখ্যায় কিভাবে মন্ত্রটি ভিন্নার্থক হয়ে উঠেছে, লক্ষণীয় যে কোন স্থানে বিদ্যমান পূজাকারী লোকের উদ্দেশে ধনদান করব। হে ইন্দ্র! তুমি ভিন্ন আমাদের বন্ধু প্রশস্য পিতা নেই। বলা বাহুল্য, এই অনুবাদটি ভাষ্যকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেই রচিত]।

১৩/১– হে দেব! শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণকারী কঠোরসাধনাপরায়ণ জ্ঞানের পূজা (অথবা আহ্বান) আপনি গ্রহণ করেন; জ্ঞানার্থী পূজাপরায়ণ আমার স্তুতি গ্রহণ করুন; বন্ধুভূত হয়ে হে দেব! আমার এই আরাধনা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের প্রার্থনা ও পূজোপকরণ গ্রহণ করুন)। [আরাধনা প্রার্থনা যখন ভগবানের চরণতলে পৌঁছায়, তখনই সেই প্রার্থনা পূজা সার্থক হয়। ভগবানের নিকট পৌঁছাবার জন্যই সাধক নিজের প্রার্থনা উচ্চারণ করেন। ভগবান্ যখন সেই পূজোপকরণ গ্রহণ করেন, যখন সাধক নিজের সমস্ত ভগবানের চরণে এ এ নিবেদন করেন, আর তা গৃহীত হয়, তখনই সেই পূজা সার্থক হয়। অর্থাৎ শুধু পূজা করলেই হয় না, প্রার্থনা করলেই ফললাভ হয় না, পূজার মতো পূজা, প্রার্থনার মতো প্রার্থনা করা চাই। মন্ত্রের প্রার্থনার এটাই মর্মার্থ। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! আমি সোমপান করেছি, তুমি আমার প্রস্তরের আহ্বান শ্রবণ করো, স্তুতিকারী বিপ্রের স্তুতি অবগত হও। এই যে পরিচর‍্যা করছি, সহায়ভূত হয়ে এটি সমস্ত বুদ্ধিস্থ করো। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১৩/২– হে দেব! আশুমুক্তিদায়ক আপনার শক্তি জেনে আমি প্রার্থনা পরিত্যাগ করব না; এবং মঙ্গলদায়ক প্রার্থনা পরিত্যাগ করব না; অর্থাৎ আমি যেন সকল অবস্থাতে সর্বত্র প্রার্থনাপরায়ণ হই; সর্বলোকবিদিত হে দেব! নিত্যকাল আপনার মাহাত্ম্য উচ্চারণ করব। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎপরায়ণ হতে সমর্থ হই)। [তুরস্য পদের অর্থ ত্বরমাণস্যঅর্থাৎ যিনি আশুমুক্তিদান করেন। তাঁর শরণাগত হলে, কায়মনোবাক্যে নিজেকে তাঁর চরণে সমর্পণ করতে। পারলে আর ভবব্যাধির ভয় থাকে না। তিনি অসীম শক্তিসম্পন্ন এবং মানুষের সকলরকম বিপদনাশক, রিপুনাশক ও মুক্তিদাতা। সেইজন্যই বলা হয়েছে- গিরঃ ন মৃষ্যে– প্রার্থনা পরিত্যাগ করব না, অর্থাৎ সর্বদা প্রার্থনানিরত থাকব। এটাই মন্ত্রের প্রথম অংশের ভাব। এই ভাব সুষ্ঠুতিং এবং গিরঃ এই পদ দুটির দ্বারা পরিস্ফুট করা হয়েছে। এই উভয় পদের সাথে ন মৃষ্যে (ন পরিত্যজানি) মন্ত্রাংশ অন্বিত হয়েছে। আপাতঃদৃষ্টিতে এটি দ্বিরুক্তি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা দ্বিরুক্তি নয়। প্রার্থনার আবেগ, ভাবের ঐকান্তিকতা বোঝাবার জন্য প্রার্থনামূলক পদ দুবার ব্যবহৃত হয়েছে। — মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! তুমি (শত্রু) হিংসক, আমি সর্বদা তোমার অসাধারণ যশোবিশিষ্ট নাম উচ্চারণ করব। এটি ভাষ্যানুসারী]।

১৩/৩– হে পরমধনদাতা দেব! আপনারই শুদ্ধসত্ত্ব প্রভূতপরিমাণে আমাদের মধ্যে উৎপন্ন হোক। জ্ঞানী সাধক আপনাকেই আরাধনা করেন; হে দেব! আমাদের নিকট হতে চিরকাল আপনাকে দূরে রাখবেন না, অর্থাৎ আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি; ভগবান আমাদের প্রাপ্ত হোন। [প্রার্থনার মূলভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় শুদ্ধসত্ত্বলাভ করতে পারি। মন্ত্রের যে সমস্ত প্রচলিত ব্যাখ্যা আছে, তার মধ্যে একটি– হে ইন্দ্র! মনুষ্যের মধ্যে তোমার অভিষব অনেক। মনীষী তোমাকেই অত্যন্ত আহ্বান করছে। অতএব আপনাকে আমাদের থেকে দূরে (স্থাপন করো না)। — মন্ত্রের প্রথম অংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকা, বর্তন্তে এই ক্রিয়াপদ অধ্যাহার করেছেন। তাতে প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে। প্রচুর পরিমাণে সোমাভিষব হয়। কিন্তু এই অংশের দ্বারা কোন সুষ্ঠু ভাবই প্রাপ্ত হওয়া যায় না। আমরা মনে করি উৎপন্নাঃ ভবন্তু পদ দুটি অধ্যাহার করলেই সঙ্গত অর্থ হয়। মন্ত্রের শেষাংশে যে প্রার্থনা আছে, তার ভাব এই যে, আমরা যেন কখনও ভগবানের নিকট হতে দূরে না থাকি, ভগবান যেন আমাদের তার মঙ্গলময় ক্রোড়ে তুলে নেন]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম– মহাদৈর্ঘতমসম্ এবং মরায়ম]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১৪– পোষস্মৈ পুরোরথমিন্দ্রায় শূষমত। অভীকে চিদু লোককৃৎ সঙ্গে সমৎসু বৃত্ৰহা। অস্মাকং বোধি চোদিতা নভন্তামন্যকেষাং জ্যাকা-অধি ধন্বসু৷৷ ১৷ ত্বং সিন্ধুরবাসৃজোহধরাচো অহন্নহি। অশরিন্দ্র জজ্ঞিষে বিশ্বং পুষ্যসি বার্য। ত্বং ত্ব পরিষ্যজামহে নভন্তা মন্যকেষাং জ্যাকা অধি ধন্বসু৷ ২৷৷ বি যু বিশ্ব অরাতয়োহৰ্যো নশন্ত নো ধিয়ঃ। অস্তাসি শবে বধং যো ন ইন্দ্র জিঘাংসতি। _ যা তে রাতিদিবসু নভন্তামন্যকেষাং জ্যাকা অধি ধম্বসু৷৷৩৷৷

সূক্ত ১৫– রেবাঁ ইদ রেবতস্তোতা স্যাৎ ত্বাবতো মঘোনঃ। প্ৰেদু হরিবঃ সুতস্য। ২. উথং চ ন শস্যমানং নাগো রয়িরা চিকেত। ন গায়ত্রং গীয়মান৷৷ ২৷ মা ন ইন্দ্র পীযত্নবে মা শর্ধতে পরা দাঃ। শিক্ষা শচীবঃ শচীভিঃ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৬– এন্দ্র যাহি-হরিভিরুপ কস্যসুতিম্। দিবো অনুষ্য শাসততা দিবং যয দিবাবসো৷৷৷৷৷ অত্রা বি নেভিরেষামুরাং ন ধূনুতে বৃকঃ। দিবো অনুষ্য শাসততা দিবং যয দিবাবসো৷৷ ২৷৷ আ ত্বা গ্রাবা বদহি সোমো ঘোষেণ বতু। , দিবো অনুষ্য শাসততা দিবং যয দিবাবসো৷৩৷

সূক্ত ১৭– পবস্ব সোম মন্দয়নিদ্রায় মধুমত্তমঃ ৷৷৷৷ তে সুতাসসা বিপশ্চিতঃ শুক্ৰা বায়ুমসৃক্ষত৷৷ ২৷৷ অগ্রং দেববীতয়ে বাজয়ন্তো রথা ইব৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ–  ১৪সূক্ত/১সাম– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা প্রসিদ্ধ ভগবান ইন্দ্রদেবকে প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠতম সৎকর্ম এবং আত্মশক্তিকে প্রকৃষ্টরূপে ভজনা করো আত্মশক্তিদায়ক সৎকর্ম সম্পাদন করো; লোকপালক পাপনাশক দেব রিপুসংগ্রামে আমাদের সহায়ভূত হোন। হে দেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করুন; শত্রুদের ধনুতে অধিরোপিত জ্যা নাশপ্রাপ্ত হোক অর্থাৎ শত্রুবল বিনষ্ট হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মপরায়ণ হই, ভগবান আমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করুন)। [মন্ত্রের প্রথম অংশে অস্মৈ ইন্দ্রায় পদ দুটি চতুর্থান্ত; কিন্তু ভাষ্যকার বিভক্তিব্যত্যয় স্বীকার করে ঐ পদ দুটিকে ষষ্ঠ্যন্ত বলে গ্রহণ করেছেন। তাতে অস্মৈ ইন্দ্রায় পুরোরথংমন্ত্রাংশের অর্থ দাঁড়িয়েছে– এই ইন্দ্রের পুরোভাগস্থিত রথের অগ্রে বর্তমান। এই অংশকে বিশেষণরূপে গ্রহণ করে শূষংপদকে বিশেষরূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাতে অর্থ দাঁড়ায়– ইন্দ্রদেবের অগ্রভাগস্থিত বলকে পূজা করো। একখানি বাংলা অনুবাদ-গ্রন্থে আছে ইন্দ্রের যে সৈন্য তার রথের সম্মুখভাগে আছে, উত্তমরূপে তার পূজা করো। দেখা যাচ্ছে দুটি ব্যাখ্যার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান আছে। অবশ্য বাংলা অনুবাদকার শৃষং পদের সৈন্য অর্থ একদিক দিয়ে সঙ্গতই করেছেন। কারণ বল অথবা শক্তি বলতে যা বোঝায়, সৈন্য শব্দ তারই প্রতিরূপ। কিন্তু এই সৈন্যের দ্বারা কাকে বোঝায়, অথবা কোন বস্তুকে নির্দেশ করে? আমরা এই অংশের অর্থ করেছি– প্রসিদ্ধ ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠতম সৎকর্মকে এবং আত্মশক্তিকে প্রকৃষ্টরূপে ভজনা করো অর্থাৎ আত্মশক্তিদায়ক সৎকর্ম সম্পাদন করো। আমরা মনে করি, অস্মৈ ইন্দ্রায় পদ দুটির বিভক্তি ব্যত্যয় স্বীকার করবার কোন প্রয়োজন নেই। — মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের (লোককৃৎ বৃত্ৰহা সমসু অভীকে সঙ্গে চিৎ উর) প্রচলিত অর্থের ভাব-ইন্দ্রদেব যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যসমূহের নিকটবর্তী থাকেন, তিনি বৃত্রকে বধ করেন– ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অংশের ভাব– ভগবান্ আমাদের রিপুসংগ্রামে সহায় হয়ে আমাদের সকল রকম বিপদ থেকে রক্ষা করুন। — তৃতীয় অংশের ভাব অনেকটা দ্বিতীয় অংশের অনুরূপ। শত্রুর অধিরোপিত জ্যা যেন নষ্ট না হয় অর্থাৎ শত্রুর অনিষ্টকারিণী শক্তি যেন বিনষ্ট হয়, রিপুগণ যেন আমাদের কোনও অনিষ্ট করতে না পারে– এটাই মন্ত্রাংশের ভাব]।

১৪/২– বলাধিপতি হে দেব! আপনি দীনতাসম্পন্ন আমাদের অমৃতপ্রবাহ প্রদান করুন; আমাদের রিপুবর্গকে বিনাশ করুন; আপনি অজাতশত্রুরূপে বিদ্যমান আছেন; সকল বরণীয় বস্তুজাত পালন করেন, প্রসিদ্ধ আপনাকে প্রার্থনার দ্বারা প্রাপ্ত হব; শত্রুদের ধনুতে অধিরোপিত জ্যা নাশপ্রাপ্ত হোক, অর্থাৎ শত্রুবল বিনষ্ট হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক এ আমাদের অমৃত প্রদান করুন; আমরা যেন রিপুজয়ী হই)। [এই মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব– আমরা দীনহীন তা জানি, আমরা অজ্ঞান হীনমতি তা জানি, কিন্তু এ-ও জানি প্রভু, তুমি দীনদয়াল, তুমি পতিতপাবন, তাই তো তোমার দুয়ারে জীবনের যত দুর্বিসহ বোঝা নামাতে আসি। আমরা জানি, আমরা যতই পাপী হই না কেন, যতই পতিত অপরাধী হই না কেন, হতাশহৃদয়ে তোমার নিকট হতে প্রত্যাখ্যাত হবো না। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার দ্বারা বুঝেছি, প্রভু, জগতে একমাত্র একটি শান্তিপ্রদ স্থান আছে, তা তোমার চরণাশ্রয়। আমাদের বিমুখ করো না প্রভো, তোমার স্নেহশীতল ক্রোড়ে আমাদের তুলে নাও। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে আমরা এই মন্ত্রের যে-সব ব্যাখ্যা দেখুতে পাই, তার ভাব সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন, যে সব জলরাশি নীচে আসে, তা তুমিই মোচন করে দাও এবং বৃত্রকে বধ করো। হে ইন্দ্র! তুমি অজেয় ও শত্রুর অবধ্য হয়ে জন্মেছ, বিশ্বকে পালন করে থাকো। তোমাকেই সকলের শ্রেষ্ঠ জেনে আমরা কাছে এসেছি। বিপক্ষদের ধনুগুণ ছিন্ন হয়ে যাক। — সিন্ধু শব্দে প্রচলিত মতে নদীপ্রবাহকে লক্ষ্য করে, আমরা বলি অমৃতপ্রবাহ; অধরাচঃ পদের অর্থ– অধোমুখে গমনকারী। প্রচলিত মতে, এটা নদীপ্রবাহের গতি বা নিম্নগতি; আমরা বলি, দীনতাসম্পন্ন তথা নৃতমস্তকে ঈশ্বরের শরণার্থী সাধকগণ]।

১৪/৩– হে ভগবন! আমাদের সকল শভূত মানুষ সম্যক্‌রূপে বিনাশ প্রাপ্ত হোক; হে দেব! আমাদের প্রার্থনা আপনার জন্যই উদ্গত হোক। বলাধিপতি হে দেব! যে শত্রু আমাদের হিংসা করে সেই শত্রুর জন্য বিনাশ প্রেরণ করেন, অর্থাৎ তাকে বিনাশ করেন। আপনার যে দান, সেই দান আমাদের পরমধন প্রদান করুক; শত্রুদের ধনুতে অধিরোপিত জ্যা বিনাশপ্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন রিপুজয়ী হই; ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুক)। [মন্ত্রের প্রথম অংশ ও শেষ অংশের ভাব এক; উভয় এই রিপুনাশের, রিপুর শক্তিনাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। বিশেষতঃ মন্ত্রের শেষাংশের প্রার্থনা প্রণিধানযোগ্য। এই সূক্তের প্রতি মন্ত্রেই আছে– শত্রুদের ধনুতে আরোপিত যে জ্যা তা বিনষ্ট হোক– এটাই প্রার্থনা। এখানে শত্রুদের ধনুর্বাণধারী রিপু বলে কল্পনা করা হয়েছে। তার তীক্ষ্ণ শরের দ্বারা আমাদের হৃদয় বিদ্ধ করে, আমাদের হৃদয়স্থ সৎ-বৃত্তিরাজিকে ধ্বংস করে। তাদের সেই অধিরোপিত জ্যা যদি বিনষ্ট হয়ে যায়, অর্থাৎ যদি তাদের অনিষ্টকারিণী শক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে মানুষ তাদের কবল থেকে রক্ষা পেতে পারে। শত্রু ধনুতে বাণযোজনা করে আমাদের আক্রমণ করে, শুরই তার প্রধান অস্ত্র, সেই শর যদি জ্যাচ্যুত হয়, অথবা জ্যা যদি বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে মানুষ বহুপরিমাণে রিপুর আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু কি উপায়ে (অন্তঃশত্র) রিপুবর্গকে হীনবল করা যায়? সাধনার দ্বারা রিপুনাশের শক্তি যেমন বর্ধিত হয়, ঠিক সেইভাবে শত্রুদের শক্তিও বিনষ্ট হয়। মন্ত্রের মধ্যে। এই সত্যটিই প্ৰখ্যাপিত হয়েছে। মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটি যারা দান করে না, এমন সব শত্রু দৃষ্টিপথ থেকে দূর হোক। আমাদের স্তবগুলি চলতে থাকুক। হে ইন্দ্র! যে শত্রু আমাদের বধ করতে ইচ্ছা করে, তুমি তার প্রতি মৃত্যু প্রেরণ করো। তোমার যে দানশীলতা, তা আমাদের ধন দান করুক। বিপক্ষদের ধনুগুণ ছিন্ন হয়ে যাক। — আমাদের মন্ত্রার্থের সাথে এই অনুবাদ মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, মন্ত্রের ভাবের দিক দিয়ে খুব বেশী পার্থক্য নেই]।

১৫/১– পাপহারক হে দেব! পরমধনসম্পন্ন আপনার উপাসক পরমধনসম্পন্নই হন; আপনার র ন্যায় পরম ধনবান্ পবিত্রকারক দেবতার স্তোতা ধনসম্পন্ন হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই। o যে, ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ পরমধন লাভ করেন)। [যিনি যে ভাবের অনুসরণ করেন তিনি সেইভাব প্রাপ্ত হন। যে সাধক যে দেবতার উপাসনা করেন, তিনি সেই দেবতার সাযুজ্য এবং সারূপ্য লাভ করেন। এই মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, পরমধনসম্পন্ন দেবতার উপাসক ধনলাভ করেন। এখানে। প্রশ্ন হতে পারে, দেবতা কি? আরাধনার অর্থ কি? প্রকৃতপক্ষে মানুষই দেবতা, কেবলমাত্র অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন থাকার জন্যই মানুষ আপন দেবত্বকে বিস্মৃত হয়ে থাকে। ঈশ্বরের কৃপায় যখন সে সাধনার দ্বারা দিব্যজ্ঞান লাভ করে, তখনই সে দেবতা হয়। দেবত্বলাভের জন্য, নিজের অন্তর্নিহিত সুপ্ত মহাশক্তিকে জাগরিত করবার জন্যই সাধনার প্রয়োজন। সাধনার অর্থ মানুষের অন্তর্নিহিত ভগবৎ-দত্ত মহাশক্তির উদ্বোধন ও তার সৎ-ব্যবহার। কোন উচ্চ মহান আদর্শের অনুসরণে তা সম্ভবপর হয়। সেই উচ্চ আদর্শ-দেবতা। দেবতার আরাধনার অর্থ– দেবভাবের অনুসরণ; দেবপূজার অর্থ নিজের মধ্যে দেবত্বের উদ্বোধন। সুতরাং যে দেবতা যে গুণ বা ভাবসম্পন্ন, তাঁর সাধকও সেই গুণ বা ভাব প্রাপ্ত হন। যিনি ধনের আকাঙ্ক্ষী তিনি ধন পাবেন। যিনি জ্ঞানের প্রার্থী, তিনি জ্ঞানলাভ করবেন। — যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিঃ ভবতি তাদৃশী। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হতে পারে– দেবতা কি বহু? দেবতা অর্থাৎ ভগবান্ বহু নন, তিনি এক অব্যয়। তার বিভূতি বহু। সাধক নিজের শক্তি ও প্রবৃত্তি অনুযায়ী সেই পূর্ণস্বরূপের কোন বিশেষ বিভূতির আরাধনা করেন। ভগবানের পূর্ণস্বরূপ উপলব্ধি করবার শক্তি সকলের নেই। সুতরাং সকল শ্রেণীর সাধক পূর্ণব্রহ্মের আরাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন না। তাই বিভিন্ন শ্রেণীর সাধকের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর আদর্শ। শাস্ত্রে আছে– সাধকের হিতের জন্য ব্রহ্মের রূপকল্পনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম অরূপ — অনাম। তিনি একমেবাদ্বিতীয় এক এবং দ্বিতীয়রহিত। তবে আমরা বহুর পরিচয় পাই কিভাবে? সে একেরই বিকাশ বহু। সেই অদ্বিতীয় পরব্রহ্মের বিভূতি বিভিন্ন সাধক কর্তৃক বিভিন্ন নামে পূজিত হয়। কিন্তু এই আংশিক ব্রহ্মানুভূতি অথবা ব্ৰহ্ম-উপাসনা মানুষকে পূর্ণমুক্তি দিতে পারে না। তাই বলা হয়– দেবতার উপাসনায় সেই দেবতাকেই বা দেবভাবকেই পাওয়া যায়, মুক্তি পাওয়া যায় না। কিন্তু তবুও এই দেব-উপাসনা মানুষকে ভগবৎ-অভিমুখে নিয়ে যায়, অবস্তু থেকে সৎ-বস্তুর দিকে তাকে প্রেরণা দেয়। এই দিক দিয়ে দেব-উপাসনার মূল্য অসীম, কারণ তা-ই সাধককে পরিণামে ব্রহ্ম-উপাসনায় পৌঁছিয়ে দেয়। মন্ত্রে এই দেব-উপাসনারই মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে হর্যশ্ব (হরি নামক অশ্ববাহিত রথারোহী ইন্দ্র)! তুমি ধনবান, তোমার স্তোতা ধনবান্ হয়। তোমার মতো ধনবান্ প্রসিদ্ধ লোকের স্তোতা প্রভু হয়। আমরা হরিবঃ পদে পাপহারক। হে দেব অর্থই পূর্বাপর সঙ্গত মনে করে আসছি]।

১৫/২– অভক্তের (অস্তোতার) শত্রু সেই ভগবান, অভক্তের পঠমান্ বা উচ্চারিত বেদমন্ত্রও গ্রহণ করেন না এবং গীয়মান্ সামমন্ত্রও শ্রবণ করেন না। (ভাব এই যে, হৃদয়ে যদি ভক্তি সঞ্জাত হয়, তাহলে মন্ত্রের উচ্চারণে কোনই ফল নেই)! [এই মন্ত্রটির একটি অভিনব পদ—নাগোঃ ঋগ্বেদে এটি আগোঃ রূপে পঠিত হয়। সায়ণের ভাষ্যে অগো পাঠ-গ্রহণ করা হয়েছে। সেই অনুসারে ঐ পদের অর্থ দাঁড়িয়েছে– অস্তোতুঃ (অস্তোতার)। এই রকমভাবে আরও কয়েকটি পদের অন্তর্ভুক্ত বর্ণের ঋগ্বেদ-সামবেদ বা ভাষ্যের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। ফলে ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের অর্থ ll এ দাঁড়িয়েছে– অস্তোতার শত্রু ইন্দ্র হোতার পঠ্যমান শস্ত্রকেও (মন্ত্রকেও) জানতে থাকেন; সম্প্রতি  প্রস্তোতাদের দ্বারা গীয়মান গাতব্য সাম অথবা গায়ত্ৰাখ্য সাম জানছেন। এই কারণে আমরাও সেই ইন্দ্রকে স্তব করি। এই ভাষ্যার্থেরই অনুসরণে মন্ত্রের যে বঙ্গানুবাদ প্রচারিত আছে। তা এই– ইন্দ্র স্তুতিশূন্য লোকের শত্রু, তিনি উচ্চাৰ্যমাণ উথ জানতে পারেন, সম্প্রতি গায়ত্রও গান করা হয়েছে। এরকম হিন্দী অনুবাদও প্রচারিত আছে। — কিন্তু আমাদের মন্ত্রার্থে সম্পূর্ণ অন্য ভাব পরিব্যক্ত হয়েছে। আমাদের ব্যাখ্যানুসারে মন্ত্রের উপদেশ এই যে, — অন্তরে অনুধ্যান করো, মুখে মন্ত্র উচ্চারিত বা নীত হোক, তাহলেই ভগবান্ তা গ্রহণ করবেন। — এটাই সঙ্গত]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-১২-দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৫/৩– বলাধিপতি হে দেব! রিপুর জন্য আমাদের পরিত্যাগ করবেন না, অর্থাৎ রিপুকবল হতে আমাদের উদ্ধার করুন, এবং ভীষণকবলে পরিত্যাগ করবেন না। হে শক্তিমান্ দেব! আপনি সৎকর্মের দ্বারা আমাদের উপদেশ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, – হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুর কবল থেকে উদ্ধার করুন আমাদের পরাশক্তি প্রদান করুন)। [রিপুর জন্য পরিত্যাগ করার অর্থ কি? রিপুদের কবলে পরলে তারা মানুষকে তাদের ক্রীড়নকরূপে ব্যবহার করে। রিপুদের দাসরূপে মানুষের জীবনের সকল সৌন্দর্য মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। তাই প্রার্থনায় বলা হয়েছে, রিপুদের কবলে আমাদের সমর্পণ করবেন না। আমরা তো রিপুদের দ্বারা বেষ্টিত হয়েই আছি, তবে রিপুকবলে আবার পরিত্যাগ করার অর্থ কি? রিপুকবলে আমরা আছি সত্য, কিন্তু ভগবান্ কৃপা করলে রিপুদের আক্রমণ থেকে, তাদের প্রভাব থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারেন। এই প্রার্থনার মর্ম এই যে, ভগবান্ যেন দয়া করে আমাদের রিপুদের কবল থেকে উদ্ধার করেন। মা শর্ধতে মন্ত্রাংশের একই মর্ম। ভীষণ রিপুগণের কবলে আমরা যেন পতিত না হই। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! তুমি বধকারী শত্রুর হস্তে পরিত্যাগ করো না, অভিভবকারীর হস্তে পরিত্যাগ করো না, হে শক্তিমান্ ইন্দ্র! তুমি আপন কর্মবলে আমাদের ধনদান করো। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১৬/১–- বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! জ্ঞানভক্তি ইত্যাদির সাথে অজ্ঞানন্ধ আমার প্রার্থনার প্রতি আগমন করুন, অর্থাৎ প্রার্থনাকারী আমাকে প্রাপ্ত হোন। দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন হে দেব! স্বর্গলোকের রক্ষক আপনার দেব-ভাব আমাকে প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! অজ্ঞান আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন, আমাকে সকল রকমে সত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [মানুষ যখন নিজের দুর্বলতা হীনতা বুঝতে পেরে সেই হীনতা-দুর্বলতা পরিহারের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। আর সেই প্রার্থনা যদি হৃদয়ের প্রার্থনা হয়, ঐকান্তিক প্রার্থনা হয়, তাহলে প্রার্থনাকারী যতই ক্ষুদ্র ও পতিত হোক কেন, সে উদ্ধার পায়। বিশেষভাবে মানুষ নিজের অসম্পূর্ণ নিজের অভাব অনুভব করতে পেরে, তা দূর করবার জন্য প্রার্থনা করলে ভগবান্ তার প্রতি কৃপা প্রদর্শন করেন। নিজের এই দৈন্যের জ্ঞান সহজে জন্মায় না। মানুষ নিজেকে বড় বলে– জ্ঞানীগুণী বলে ভাবতেই অভ্যস্ত। অন্যের কাছে দূরে থাকুক, নিজের কাছেও মানুষ নিজের দৈন্য স্বীকার করতে চায় না। সে নিজেকে বড় ভেবে আত্ম-প্রবঞ্চনার দ্বারা নিজেকে অধঃপাতের দিকে প্রেরণ করে। সুতরাং যিনি নিজের দৈন্য বুঝতে পারেন, তিনি অন্তরের সাথেই ভগবানের কৃপালাভের জন্য প্রার্থনা করেন। নিজের অজ্ঞানতা অসম্পূর্ণতা দূর করবার জন্য তিনি ভগবানের চরণে প্রার্থনা করেন। — এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাকালে ভাষ্যের সাথে আমাদের যথেষ্ট অনৈক্য ঘটেছে। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! তুমি অশ্বগণের l কার সাথে কথের সুন্দর স্তুতির অভিমুখে আগমন করো। ঐ ইন্দ্র দ্যুলোক শাসন করেন; হে দীপ্তহব্যবিশিষ্ট! তুমি দ্যুলোকে যাও। এখানে দীপ্তহব্যবিশিষ্ট পদ ইন্দ্রকে লক্ষ্য করছে। নতুবা, হঠাৎ একজন তৃতীয় উত্তরার্চিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করে কিছু বলার অর্থ থাকে না। কিন্তু ইন্দ্রকে আহ্বান করে, একটু তরল ভাষায় বলতে গেলে-ধূলোপায়েই বিদায় দেবার অর্থ কি? আবার সেই অর্থ কি? আবার সেই অর্থ করা হয়েছে বহু কষ্ট কল্পনার সাহায্য নিয়ে। আমরা এত কষ্ট কল্পনার প্রয়োজন মনে করি না । [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১২দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৬/২– বৃক যেমন মেষীকে কম্পিত করে। দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন হে দেব! স্বর্গলোককে শাসনকারী আপন দেবভাব আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, মানবগণ রিপুপরিবেষ্টিত আছে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের দেবভাব প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথম অংশের নিত্যসত্যপ্রখ্যাপনে– ব্যাঘ্র যেমনভাবে দুর্বল মেষীর হৃদয়কে কম্পিত করে, যেমনভাবে মরণভয়ে ভীত করে, ভীষণ রিপুগণ তেমনভাবে মানুষকে, মানুষের হৃদয়কে কম্পিত করে। এই উপমার সার্থকতা সহজেই প্রতিপন্ন হয়। বৃক অর্থ নেকড়ে বাঘের কোন প্রয়োজন থাকলেও কেবলমাত্র স্বাভাবিক হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্যই পশুবধ করে। বৃকের যা ক্রীড়া, মেষ ইত্যাদির পক্ষে তা-ই মৃত্যু। রিপুর কবলে পড়লে, ঐরকমভাবেই মানুষের মৃত্যু– আধ্যাত্মিক মৃত্যু ঘটে। মানুষের অন্তরাত্মা রিপুদের আক্রমণের ভীষণতা অনুভব করে কম্পিত হন। এই ভীষণ রিপুগণের কবল থেকে মুক্তিলাভ করতে না পারলে, তার অনিবার্যফল মৃত্যু। রিপুদের তাতেই আনন্দ ও তৃপ্তি। — দ্বিতীয় অংশের প্রার্থনার মূল ভাব এই, — দিবং য– দেবভাব আমাদের প্রদান করো। কে প্রদান করবে? — দিবাবসো– দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন দেবতা। আরও বলা হয়েছে– তিনি দিবঃ অমুষ্য শাসতঃ- স্বর্গলোকের শাসনকারী। সুতরাং তিনিই আমাদের দেবভাব প্রদান করতে পারেন। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে– মন্ত্রের প্রথম অংশের সাথে দ্বিতীয় অংশের কি সম্পর্ক আছে?– রিপুর আক্রমণ প্রতিরোধ করবার জন্য দেবভাবের প্রয়োজন। তাই প্রথম অংশে রিপুর ভীষণতা বর্ণনা করে তার কবল থেকে উদ্ধারলাভ করার উপায়ভূত দেবভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। সুতরাং এই উভয় অংশের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। — মন্ত্রটির প্রচলিত বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে– বৃক যেমন মেষীকে কম্পিত করে তেমনি এই যজ্ঞে অভিষব প্রস্তর সোমলতাকে কম্পিত করছে। ঐ ইন্দ্র দ্যুলোক শাসন করেন, হে দীপ্তহব্যবিশিষ্ট! তুমি দ্যুলোকে যাও। — ভাষ্যকার বলেছেন– নেমিঃ সোমলতাং। আমরা নেমিঃ পদে হৃৎ-চক্র বা হৃদয় লক্ষ্য করি]।

১৬/৩– হে দেব! শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন প্রার্থনাপরায়ণ সাধক পাষাণকঠোর সাধনের দ্বারা এবং প্রার্থনার দ্বারা ইহজগতে আপনাকে প্রাপ্ত হন। দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন হে দেব! স্বর্গলোকের রক্ষক আপনার দেবভাব আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সাধকবর্গ কঠোর সাধনার দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হন। হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের দেবভাব প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথম অংশ, সোমী গ্রাবা ইহ ঘোষেণ আবক্ষতু– শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন কঠোরসাধনাপরায়ণ ব্যক্তি আপনাকে লাভ করেন। কিভাবে লাভ করেন? উত্তর– গ্রাবাকঠোর সাধনার দ্বারা। শুধু তাই নয়, ঘোষেণঅর্থাৎ প্রার্থনার দ্বারাও ভগবৎপ্রাপ্তি ঘটে। — মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশে প্রার্থনা আছে। এই প্রার্থনা পূর্ববর্তী দুটি মন্ত্রেই আছে। দিবাবসো পদের দ্বারা ভগবানের মাহাত্ম্য এ পরিকীর্তিত হয়েছে। তিনিই দিব্যজ্যোতিঃর আধার, সেইজন্যই তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রার্থনার বিষয় দেবভাব। তিনি দেবভাবের– মহত্ত্বের আধার। তাই তাঁর চরণে– এই প্রার্থনা। — কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা, ইত্যাদির ভাব ভিন্নতর রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এই যজ্ঞে সোমবান অভিষব-প্রস্তর শব্দ করে ধ্বনির সাথে তোমাকে দান করুন। ঐ ইন্দ্র দ্যুলোক শাসন করেন, দীপ্তহব্যবিশিষ্ট! তুমি দ্যুলোকে যাও। — এটাতে কি সুষ্ঠুভাব পাওয়া যায়? তোমাকে দান করুন-এর তোমাকে কে? সোমলতা? আবার শব্দ করে ধ্বনির সাথে অংশেই বা কি ভাব প্রকাশ করে? এই ব্যাখ্যার প্রথম অংশ আমাদের কাছে অর্থহীন বলেই মনে হয়। এই মন্ত্রের হিন্দী অনুবাদ– হে ইন্দ্র! ইস যজ্ঞমে সোমওয়ালা শব্দ করতা হুআ অভিষব কা পাষাণ ধ্বনিকে সাথ তুঝে সোম পচাওয়ে। ইস ইন্দ্রকে দ্যুলোককা শাসন করতে সময় হম বড়ে সুখমে রহতে হ্যায়। হে দীপ্তধনওয়ালে ইন্দ্র! তুম স্বর্গলোককো পধারো। — এ যেন মূল মন্ত্রটি না পড়েই, শুধু ভাষ্যার্থ দেখেই অনুবাদ]।

১৭/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! অমৃতোপম আপনি পরমানন্দ প্রদান করে ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [এই প্রার্থনার দ্বারা এটাই স্পষ্টীকৃত হয়েছে যে, শুদ্ধসত্ত্বই বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়মাত্র, অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করাটাই জীবনের চরম সার্থকতা নয়, তার দ্বারা অন্য উচ্চতর মহত্তর বস্তু লাভ করাই চরম উদ্দেশ্য। অবশ্য শুদ্ধসত্ত্ব সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির পরম সহায়। তাই প্রথমে শুদ্ধসত্ত্বলাভের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। — সোমের বিশেষণগুলি দেখলেই সোম যে কি পদার্থ, তা উপলব্ধ হবে। সোম মধুমত্তমঃ অর্থাৎ যার থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই। শুদ্ধসত্ত্বই মানুষের পক্ষে অমৃততুল্য। কারণ শুদ্ধসত্ত্বই মানুষকে পরমবস্তু দিতে পারে। ভগবানের কৃপায় সাধনশক্তি লাভ করে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশ ঘটালে মানুষ আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক আধিদৈবিক দুঃখের হাত থেকে উদ্ধার লাভ করে নিরবচ্ছিন্ন বিমল সুখ উপভোগ করতে সমর্থ হয়; অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই মানুষ সেই পরমানন্দের অধিকারী হয়। তাই মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্ব সম্বন্ধে মন্দয়ন পদ প্রযুক্ত হয়েছে। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তোমার তুল্য মধুর বস্তু আর কিছুই নেই; তুমি ইন্দ্রের আনন্দবিধানের জন্য রক্ষিত হও। ইন্দ্রায় পদের অর্থ করা হয়েছে ইন্দ্রের আনন্দবিধানের জন্য। কিন্তু ইন্দ্রায় মন্দয়ন পদ সোম পদের সাথে সংসৃষ্ট। ইন্দ্রায় পদের অর্থ ইন্দ্রকে লাভ করবার জন্য। কিন্তু ভাষ্যকার প্রভৃতির লক্ষ্য মাদকদ্রব্য সোমরস, এবং তা ইন্দ্রের আনন্দের জন্য কল্পিত হয়েছে বলে তাদের ধারণা। এরকম হিন্দী অনুবাদও আছে]।

১৭/২– পবিত্রকারক, পরাজ্ঞানদায়ক, নির্মল শুদ্ধসত্ত্ব আশুমুক্তি প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব আশুমুক্তি প্রদান করেন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই সমস্ত নিষ্পীড়িত সোমরস, যাদের তুল্য আনন্দকর পদার্থ আর কিছুই নেই, তারা প্রস্তুত হবার সময় শব্দ করতে লাগল। কিন্তু মন্ত্রের অন্তর্গত পদগুলির দ্বারা এই অর্থ কিছুতেই সমর্থিত হতে পারে না। যাদের তুল্য…কিছুই নেই– এই অর্থ-জ্ঞাপক কোনও পদ মন্ত্রে পরিদৃষ্ট হয় না। সুতরাং এই অংশ ব্যাখ্যাকার কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন? ভাষ্যেও এর অর্থবোধক কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আবার প্রচলিত মত অনুসারেও যদি এই মন্ত্রের সমার্থক ব্যাখ্যাই গৃহীত হয়, তথাপি বিপশ্চিতঃ পদের মেধাবিনঃ অর্থ করলে মদ্যপের প্রলাপ বলেই মনে হবে। সোমরস মেধাবী এ হয় কিভাবে? আবার শুদ্ধসত্ত্ব সম্বন্ধেও এই অর্থ প্রযুক্ত হতে পারে না। বিপশ্চিতঃ পদের স্বাভাবিক অর্থ মেধাবিনঃ জ্ঞানিনঃ হয় সত্য, কিন্তু বর্তমানস্থলে জ্ঞানদায়ককেই লক্ষ্য করছে। তাই আমরা ঐ পদে পরাজ্ঞানদায়ক অর্থ গ্রহণ করেছি। বলা বাহুল্য এটি সোমরস নামক মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে এ প্রযোজ্য হতে পারে না, পারে শুদ্ধসত্ত্বের প্রসঙ্গেই। তাই আমরা সোমঅর্থে শুদ্ধসত্ত্বই পূর্বাপর গ্রহণ করে আসছি। সুতাসঃ পদের পবিত্রকারক অর্থেই সঙ্গতি লক্ষিত হয়। শুক্রাঃ পদের স্বাভাবিক অর্থ– শুভ্রবর্ণ; কিন্তু শুভ্রতা পবিত্রতা ও নির্মলতার চরম আদর্শ বলে শুক্রাঃ পদে নির্মলা অর্থ গৃহীত হয়েছে]।

১৭/৩– সৎকর্মসাধন যেমন আত্মশক্তি উৎপাদন করে, তেমনভাবে আত্মশক্তিসম্পন্ন সাধকগণ ভগবানের গ্রহণের জন্য শুদ্ধসত্ত্ব তাদের হৃদয়ে সমুৎপাদিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা ভগবানকে পাওয়ার জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বকে সমুৎপাদিত করেন)। [এই মন্ত্রে সাধনপদ্ধতির একটি ক্রম পরিবর্ণিত হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে– রথা ইবঅর্থাৎ সৎকর্ম সাধনের দ্বারা যেমন আত্মশক্তি উৎপন্ন হয়। এর পরের অংশে সেই আত্মশক্তি থেকে সমুৎপন্ন শুদ্ধসত্ত্বের মহিমা পরিকীর্তিত হয়েছে। যারা আত্মশক্তিসম্পন্ন তারা অনায়াসেই ভগবানের উপাসনায় অথবা ভগবৎ আরাধনার শ্রেষ্ঠতম উপকরণ শুদ্ধসত্ত্ব সমুৎপাদিত করতে সমর্থ হন। আমাদের সাথে ভাষ্য ইত্যাদির যথেষ্ট পার্থক্য আছে। মন্ত্রটির একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এইসকল সোমরস দেবতাদের উদ্দেশে প্রস্তুত হয়েছে। এরা রথের ন্যায় বিপক্ষদের নিকট হতে সম্পত্তি হরণ করে এনে দেয়। ভাষ্যকার আবার বাজয়ন্ত পদের অর্থ করেছেন যজমান বা ভক্তকে শক্তিদান করতে ইচ্ছাকারী। এই ইচ্ছাকারী কে? ভাষ্যকার বলছেন-সোমাঃঅর্থাৎ সোমরস। সোমরস কিভাবে শক্তিদান করতে পারে, আমরা বুঝতে পারি না। আমরা মনে করি বাজয়ন্তঃ পদে আত্মশক্তিসম্পন্ন সাধককেই লক্ষ্য করে]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৮– অগ্নিং হোতারং মন্যে দাস্বন্তং বসোঃ সূনুং সহসো জাতবেদসং বিপ্রং ন জাতবেদসম্। য উধূয়া স্বধরো দেবো দেবাচ্যা কৃপা। ঘৃতস্য বিভ্রাষ্টিমনুশুকুশোচি আজুহ্বানস্য সর্পিষঃ ॥ ১৷৷ যজিষ্ঠং ত্বা যজমানা হুবেম জ্যেষ্ঠমঙ্গিরসাং বিপ্র মন্মভিৰ্বিপ্রেভিঃ শুক্র মন্মভিঃ। পরিজমানমিব দ্যাং হোতারং চর্ষণীনা। শোচিষ্কেশং বৃষণং যমিমা বিশঃ প্রাবন্তু জুতয়ে বিশঃ ২ স হি পুরু চিদোজসা বিরুক্সতা দীদ্যানো ভবতি দ্রহন্তরঃ পরশুর্ন দুহন্তরঃ। বীড় চি যস্য সমৃতৌ শুব বনেব যৎ স্থির। নিহমাণে যমতে নাতে ধন্বাসহা নাযতে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৯– অগ্নে তব শ্রবো বয়ো মহি ভ্রজন্তে অৰ্চয়ো বিভাবসসা। বৃহভানো শবসা বাজমুথ্যাংশুদধাসি দাশুষে কবে৷৷৷৷ পাবকবৰ্চাঃ শুক্ৰবৰ্চা অনবৰ্চা উদিয়র্ষি ভানুনা। পুত্রো মাতরা বিচরনুপাবসি পৃণক্ষি রোদসী উভে৷৷ ২৷ ঊর্জো নপাজ্জাবেদঃ সুশস্তিভিৰ্মন্দস্ব ধীতিভিহিতঃ। ত্বে ইষঃ সন্দধুর্ভূরিবর্পসঃ চিত্রোতয়ো বামজাতাঃ ॥ ৩৷৷ ইরজ্যন্নগ্নে প্রথমস্য জন্তুভিরস্মে রায়ো অমর্ত্য। স দর্শস্য বপুষো বি রাজসি পৃণক্ষি দর্শতং কতুম্৷ ৪৷৷ ইষ্কর্তারমধূরস্য প্রচেতসং ক্ষয়ন্তং রাধসো মহঃ। রাতিং বামস্য সুভগাং মহীমিষং দধাসি সানসিং রয়িম্৷৷ ৫৷৷ ঋতাবানং মহিষং বিশ্বদর্শতমগ্নিং সুম্বায় দধিরে পুরো জনাঃ। শুকর্ণং সপ্রথস্তমং ত্বা গিরা দৈব্যা মানুষ যুগা৷৬৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৮সূক্ত/১সাম– দেবগণের আহ্বানকারী অর্থাৎ দেবভাবসমূহের জনক, অতিশয়িত রূপে দাতা অর্থাৎ পরমধনদাতা, সকলের নিবাসহেতুভূত, সকল শক্তির আধার অর্থাৎ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রজননকারী, তত্ত্বদর্শী আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকের ন্যায় সর্বতত্ত্বজ্ঞ, জ্ঞানস্বরূপ ভগবানকে স্তুতি করি। পূর্বোক্ত প্রভাবসম্পন্ন সেই ভগবান্ সৎকর্মসমূহে বিশেষভাবে উদ্বোধিত করবার জন্য, সাধকের হৃদয়ে দেবভাবের উৎপাদক সামর্থ্য উৎপাদন করেন; এবং সেই ভগবান প্রদীপ্ততেজষ্ক জ্ঞানভক্তিসহযোগে দীয়মান ভগবৎসম্বন্ধযুত শুদ্ধসত্ত্বের অনুক্রমে গৃহীত হন অর্থাৎ গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, ভগবানের অনুসরণ জ্ঞানপ্রাপ্তিমূলক। এই জন্যই সাধুগণ সৎ-জ্ঞান লাভের জন্য ভগবানকে আরাধনা করেন। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে আমরা যেন জ্ঞানার্থী হই। হে ভগবন! আমাদের জ্ঞানসম্পন্ন করুন; তাতে আমাদের মধ্যে পরমার্থের সমাবেশ হোক)। [আমরা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মন্ত্রটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথম ভাগে প্রার্থনা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে নিত্যসত্য ও আত্ম-উদ্বোধনা প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম অংশে ভগবানে পূজার.সঙ্কল্প আছে। সেখানে যদিও নিগুণে গুণের সমাবেশ করা হয়েছে, তথাপি সেই সগুণত্বের মধ্যে সেই সেই গুণে গুণান্বিত হবার উদ্বোধনাই দেখতে পাই। পুনঃ পুনঃ গুণকীর্তন করতে করতে, গুণময় গুণাতীতের গুণবিশেষণের আলোচনায় রত হতে হতে যদি সে গুণের আভাষমাত্রও পেতে পারি, এই উদ্দেশ্যেই ভগবানের গুণ-অনুকীর্তনে, নিগুণ গুণাতীতকে সগুণ গুণময় ভাবে পরিদর্শন সেই গুণময়ের স্তুতি করি, প্রার্থনার বা সঙ্কল্পের তাৎপর্য, আপনাকে সেই গুণের অংশভাগী করবার উদ্বোধন। যদি সে গুণের কণামাত্র আমাতে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলেই আমার জীবন সার্থক হতে পারে। মন্ত্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশে এক নেওয়া-দেওয়ার অভিনয় দেখা যায়। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে এ ভগবান্ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য উৎপন্ন করেন, সাধকের হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার করে দেন। তৃতীয় এ অংশে বলা হয়েছে, সাধক জ্ঞানভক্তি-সহযোগে ভগবৎ-সম্বন্ধযুত যে সত্ত্বভাব প্রদান করেন, ভগবান্ তা গ্রহণ করবার জন্য ব্যর্থ হন। তারই দেওয়া সামগ্রী তিনিই আবার গ্রহণ করেন। বাস্তবে অনেক সময় দেখা যায়, আমরা যত-কিছু সামগ্রীই তাকে অর্পণ করি না কেন, সবই তো পড়ে থাকে, তিনি নেন কই? তবে কি বধির, জড়পিণ্ড? তা নয়। ডাকার মতো ডাকতে পারলে, ভগবান্ তা শুনতে পান; দেবার মত দিতে পারলে, ভগবান্ তা গ্রহণ করেন। (ধ্রুব, প্রহ্লাদ, বিদুর, বিল্বমঙ্গলের কাহিনী তার প্রমাণ)। আসলে সকল কামনা রহিত হয়ে, তাকে পাবার জন্য আকুলতম আহ্বান তিনি শুনতে পার্ন। আমার আমিত্বহীন সামগ্রী কোন ফলোভের আশা না রেখে তাকে সমর্পণ করতে পারলে তিনি তা গ্রহণ করবেনই। ফলতঃ নিঃস্বার্থ দান, নিষ্কাম প্রার্থনাই. ভগবানের গ্রহণযোগ্য। এছাড়া কোনও আহ্বান তিনি শোনেন না, কোনও দানই তিনি গ্রহণ করেন না। চাই– আত্মদান, চাই– সর্বস্ব সমর্পণ, চাই, — আমিত্ব ঘুচিয়ে তন্ময়তা। আমিই তো তিনি, সুতরাং তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তো তাকেই তাঁর পাওয়ার অভিলাষ। যা কিছু সামগ্রী, সবই তো তারই দেওয়া, সুতরাং যা কিছু সমর্পণ সে তো তারই সামগ্রী তাঁকে দান। মনে এই ভাবের উদয় হলেই, এই পরমজ্ঞান লাভ হলেই, পরমার্থ সমাবেশে ভগবান্ এসে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হবেন। মন্ত্রের মধ্যে এই নিগূঢ় তত্ত্বের বিকাশ হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। — মন্ত্রের অন্তর্গত সহসঃ সূনুঃ পুদের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাকারগণ সকলেই অগ্নিকে বলের পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে অগ্নির বিবিধ পর্যায়, নির্দিষ্ট হয়। তার মধ্যে মন্থনাগ্নিকে তারা সহসঃ সূনুঃবলে অভিহিত করেন। কাষ্ঠ মন্থন দ্বারা অগ্নি উৎপাদনকালে বলের আবশ্যক হয়। তা থেকে অগ্নির ঐরকম ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়ে থাকে। আমাদের মতে, এ অগ্নি সাধারণ অগ্নি নয়। আমরা এ অগ্নিকে জ্ঞানাগ্নি বলে অভিহিত করি। অগ্নি তথা জ্ঞানাগ্নি যে সকল শক্তির আধার, তা অবশ্যই স্বীকার্য। একটি প্রচলিত অনুবাদ– কৃতবিদ্য বিপ্রের ন্যায় প্রজাবিশিষ্ট, বলের পুত্রস্বরূপ, সকলের নিবাসভূমিস্বরূপ, এবং অত্যন্ত দানশীল অগ্নিকে আমি হোতা বলে সম্মান করি। যজ্ঞনির্বাহকারী অগ্নি উৎকৃষ্ট দেবপূজা সমর্থ হয়ে, চতুর্দিক প্রসৃত ঘৃতের দীপ্তি অনুসরণ করে নিজ শিখার দ্বারা তা প্রার্থনা করছেন। ব্যাখ্যার ভাব ব্যাখ্যায়ই পরিব্যক্ত। সেই সম্বন্ধে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-১২দ-৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৮/২– জ্যোতির্ময় পরাজ্ঞানদায়ক হে দেব! জানিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপ পরম-আরাধনায় আপনাকে মন্ত্রের দ্বারা প্রার্থনাকারী আমরা যেন আরাধনা করি; জ্ঞানযুক্ত মন্ত্রের দ্বারা যেন আরাধনা করি; দেবভাবতুল্য উন্নতিবিধায়ক আত্ম-উৎকর্ষ সাধকদের দেবভাবপ্রদায়ক অভীষ্টবর্ষক পরমজ্যোতির্ময় যে দেবতাকে সকল তোক প্রকৃষ্টরূপে পূজা করেন, প্রার্থনাপরায়ণ আমরা সেই দেবতাকে মোক্ষলাভের জন্য যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম- উদ্বোধক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করতে সমর্থ হই)। [মন্ত্রটির একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে মেধাবী শুভ্রদীপ্তি অগ্নি! আমরা যজমান, আমরা মনুষ্যবর্গের উপকারের জন্য মননসাধন অত্যন্ত প্রীতিপ্রদ মন্ত্রের দ্বারা অঙ্গিরাগণের জ্যেষ্ঠস্বরূপ তোমাকে আহ্বান করি। সর্বতেগামী সূর্যের ন্যায় তুমি যজমানদের জন্য দেবতাদের আহ্বান করে থাকো। তুমি কেশের ন্যায় জ্বালাবিশিষ্ট ও অভীষ্টবর্ষী। যজমানগণ অভিমত ফলপ্রাপ্তির জন্য তোমাকে প্রীত করুক। অন্য একটি হিন্দী অনুবাদও হে মেধাবী আউর প্রজ্বলিত জ্বালাওয়ালে অগ্নিদেব! বলে সম্বোধন করে প্রায় একইরকমভাবে মন্ত্রটিকে উপস্থাপিত করেছে। এই অনুবাদগুলি, বলাই বাহুল্য, ভাষ্যকে অনুসরণ করেই বিরচিত। অঙ্গিরসাং পদে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন, – অঙ্গিরা অঙ্গারতঃ, যে অঙ্গিরা আসংস্তেহঙ্গিরসঃ ভবন; কিন্তু অঙ্গিরা শব্দে যে জ্ঞানীকে বোঝায় তা বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। অঙ্গিরসং জ্যেষ্ঠং পদ দুটিতে শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানীকে বোঝায়। শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী অর্থাৎ জ্ঞানের চরম উৎকর্ষস্থান ভগবান্। সুতরাং মন্ত্রের লক্ষ্য ভগবান্। অন্যপদ যজিং  অর্থাৎ যিনি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম আরাধনায়, যার অপেক্ষা পূজ্য আর কেউ নেই অথবা থাকতে পারে না। সে তো ভগবানই। দুটি সম্বোধন পদ– বি ও শুক্রঃ। — বি অর্থাৎ জ্ঞানী। এই বিশেষণই অঙ্গিরসাং জ্যেষ্ঠং পদ দুটিতে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। শুক্রঃ অর্থাৎ জ্যোতির্ময়। তিনিই সর্বজ্যোতিঃর আধার ভগবান্। মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশের ব্যপদেশে ভগবানের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। চর্ষণীনাং হোতারংপদ দুটির ভাব এই যে, যাঁরা আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনশীল, তাদের যিনি দেবভাব ইত্যাদি প্রদান করেন, সেই দেবতাকে যেন আমরা পূজা করি। কি উদ্দেশ্য?– তার উত্তর– জুতয়ে– মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য। ভগবানের আরাধনার দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়। শোচিকেশং পদের ভাষ্যার্থ– কেশের ন্যায় অত্যন্ত জ্বালাবিশিষ্ট। কিন্তু তার দ্বারা কোন ভাব অধিগত হয় না। শোচি শব্দের অর্থ জ্যোতিঃ। যাঁর শিরোদেশে জ্যোতিঃ আছে; অর্থাৎ জ্যোতিঃই যাঁর শ্রেষ্ঠ বস্তু অথবা জ্যোতিঃই যাঁর শোভা, সেই জ্যোতিঃস্বরূপ পরমদেবতাকে শোচিকেশং পদে বোঝাচ্ছে)।

১৮/৩– ভগবানই জ্যোতির্ময় শক্তির দ্বারা, কুঠার যেমন বৃক্ষের ছেদক হয়, তেমনভাবে শ্রেষ্ঠতম শত্রুনাশক হন। যে দেবতার কৃপালাভে পাষাণহৃদয় পাপীও সুশীল হয়, এবং পাষাণ ইত্যাদিও জলের ন্যায় বিগলিত হয়, সেই জ্ঞানদেব সমূলে রিপুগণকে বিনাশ করেন, পলায়ন করেন না, অর্থাৎ শত্রুগণকে বিনাশই করেন, কিন্তু পলায়ন করেন না। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -ভগবানের কৃপালাভে পাপীও সাধু হয়ে যায়; ভগবানই সাধকদের রিপুগণকে বিনাশ করেন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– অগ্নিবিশেষ দীপ্তিবিশিষ্ট জ্বালার দ্বারা বিশেষরূপে দীপ্যমান; তিনি বিদ্রোহীদের ছেদনার্থে পরশুর মতো বিনাশে অমোঘ; তাঁর সাথে মিলিত হলে দৃঢ় ও স্থির বস্তুও জলের মতো শীর্ণ হয়। শত্ৰুপরাভবকারী ধনুর্ধর যেমন পলায়ন করে না, অগ্নিও তেমন (শত্রুদের) অভিভবকার্য থেকে বিরত হন না। এইরকম ভাষ্যানুসারী হিন্দী অনুবাদও আছে। — ভাষ্যের সাথে আমাদের ব্যাখ্যা তুলনীয়। মন্ত্রের প্রথম অংশ– স হি বিরুক্মতা ওজসা হন্তরঃ ভবতি– তাঁর দীপ্ত তেজের দ্বারা তিনি শত্রুনাশক হন; অর্থাৎ তার পুণ্যজ্যোতিঃ বলে পাপ দূরীভূত করেন। তাঁর দীপ্ত পুণ্যজ্যোতিঃর কাছে পাপ পরাভূত হয়। কিভাবে পাপ অথবা রিপুবিনাশ করেন, তা একটি উপমার দ্বারা বোঝান হয়েছে। সেই উপমাটি — পরশুঃ ন। পরশু অর্থাৎ কুঠার যেমনভাবে বৃক্ষ ইত্যাদি ছেদন করে, তেমনভাবে ভগবান্ সমূলে পাপ ধ্বংস করেন। — মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ– যস্য সমৃতৌ বীডুচিৎ বৎ– যাঁর সংস্পর্শে পাষাণকঠোর হৃদয়ও বিগলিত হয়, অথবা যাঁর করুণাকণা লাভ করে ভীষণ পাপীও পুণ্যাত্মা হয়ে যায়। জগতের ইতিহাসেই তার অসংখ্য প্রমাণ মেলে। এর দ্বারা মন্ত্রের হন্তরঃ ভবতি অংশেরও অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়। ভগবান্ পাপ বিনাশ করেন, এবং পাপের বিনাশের সঙ্গে পাপীরও বিনাশ ঘটে, কারণ যে পাপী ছিল, তার মধ্য থেকে পাপের তিরোভাব ঘটায়, সে তো আর পাপী নয়, তখন সেই পাপী পুণ্যাত্মা হয়ে যায়। তাই ভগবান্ সম্বন্ধে হন্তরঃ পদের প্রয়োগ করা যায়। যিনি সৌভাগ্যবশে ভগবানের কৃপালাভ করতে পারেন, যিনি তার করুণার আস্বাদ লাভ করতে পারেন, তার জীবনই ধন্য হয়, সার্থক হয়। তার জীবন পাষাণের মতো, কঠিন হলেও তা গলে যায়, ভগবানের অর্ঘ্যরূপে সেই জীবন উৎসর্গীকৃত হয়। কেমনভাবে বিগলিত হয়, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে– বনেব অর্থাৎ জলের মতো। পাষাণ তার পরশে জল হয়ে যায়। এখানে পাষাণ বলতে পাষাণকঠোর মানবহৃদয়কেই লক্ষ্য করা হয়েছে। ভগবান্ সেই শত্রুগণ অথবা পাপীদের বিনাশ করেন। এই বিনাশের অর্থ কি তা ইতিপূর্বেই বিবৃত করেছি। আবার, তিনি অপরাজিত চিরজয়শীল। সর্বত্রই তাঁর জয়লাভ হয়। অর্থাৎ যখন পাপের, অধর্মের সাথে পুণ্যের সঙ্ঘর্ষ উপস্থিত হয়, তখন সেই পুণ্যশক্তিই জয়যুক্ত হয়, পাপ পরাজিত হয়। নচেৎ পাপের দ্বারা বিশ্ব ধ্বংসমুখে। পতিত হতো। বিশ্বমঙ্গলনীতির বশে পুণ্যের জয় হয়ে থাকে। আজ হোক, কাল হোক, পাপের বিনাশ। অনিবার্য– এটাই ভগবানের মঙ্গলনীতি। মন্ত্রে সেই মঙ্গলময় নীতির মাহাত্ম্যই কীর্তিত হয়েছে]।

১৯/১– হে জ্ঞানদেব! আপনার শক্তি আকাঙক্ষণীয় হয়; পরমজ্যোতির্ময় হে দেব! আপনি স্বশক্তির দ্বারা প্রশংসনীয় শক্তি আরাধনাপরায়ণ সাধককে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ বিশ্বে আলোক বিতরণ করেন, তাঁর কৃপায় সাধকগণ আত্মশক্তি লাভ করেন)। [মন্ত্রে ভগবানের জ্ঞানস্বরূপের মাহাত্ম্য পরিকীর্তিত হয়েছে। সেই জ্ঞানস্বরূপকেই সম্বোধন করে মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটিকে অগ্নির গুণবর্ণনাসূচক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অগ্নি! তোমার প্রশস্ত অন্ন আছে। তোমার শিখাগুলি বিলক্ষণ দীপ্তি পাচ্ছে। ঔজ্জ্বল্যই তোমার সম্পত্তি। তোমার দীপ্তি প্রকাণ্ড; তুমি ক্রিয়াকুশল; তুমি দাতা ব্যক্তিকে উৎকৃষ্ট অন্ন ও বল দাও। — অগ্নি বলতে কোন বস্তুকে লক্ষ্য করে, তা আমরা বহুবার বলেছি। মানুষের অন্তরে থেকে যে অগ্নি তার হৃদয়ের অন্ধকার দূর করছে, যে অগ্নির তেজোপ্রভায় মানুষ মোহকুহেলিকার মায়াজাল ছিন্ন করতে সমর্থ হয়, যে অগ্নিতে মানুষের সকল রকম পাপ ভস্মীভূত হয়ে যায়, বেদে অগ্নি বলতে সেই অগ্নিকেই বোঝাচ্ছে। মন্ত্রের অন্তর্গত প্রত্যেক পদে এই ভাবই প্রকাশ করছে]।

১৯/২– হে দেব! পবিত্ৰজ্যোতিষ্ক নির্মলদীপ্ত পূর্ণতেজষ্ক আপনি দিব্যজ্যোতিঃর সাথে সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। পুত্র যেমন তার মাতাপিতাকে সর্বপ্রযত্নে রক্ষা করে, তেমনভাবে আপনি সমস্ত লোককে রক্ষা করেন; আপনি বিশ্বকে রক্ষা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন, তিনি বিশ্বকে রক্ষা করেন)। [একটি বঙ্গানুবাদ হে অগ্নি! যখন। তুমি দীপ্তির সাথে উদয় হও, তখন তোমার তেজঃ সকলকে পরিশুদ্ধ করতে থাকে। এটি শুক্লবর্ণ ধারণপূর্বক বৃহৎ হয়ে ওঠে। তুমি দ্যুলোক ও ভূলোক স্পর্শ করতে থাকো; তুমি যেন পুত্র, তাঁরা। যেন মাতা, সেই জন্য যেন তুমি ক্ৰীড়াপূর্বক তাদের আলিঙ্গন করো। বলা বাহুল্য, এই ব্যাখ্যাকার মন্ত্রটিকে অগ্নির প্রতি প্রযুক্ত বলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু একটু আলোচনা করলেই বোঝা যায় যে, অনেকাংশে মন্ত্রটি অগ্নির প্রতি প্রযুক্ত হতে পারে না। যে অগ্নি সমস্ত ভস্মীভূত করে, সেই অগ্নি পবিত্র হবে কিভাবে? বস্তুর অস্তিত্ব যে নষ্ট করে দেয়, সে কি পবিত্র করবে? অগ্নি শব্দের প্রকৃত অর্থ মানুষের অন্তর্নিহিত জ্ঞানাগ্নি। সেই জ্ঞানাগ্নি অন্তরের সামগ্রী। যাঁর হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে। অর্থাৎ জ্ঞানের আবির্ভাব হয়েছে, তার সকরকম হীনতা মলিনতা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে ভগবানের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। এই অগ্নি সেই জ্ঞানাগ্নি– কাষ্ঠ ইত্যাদি দাহনশীল পরিদৃশ্যমান অগ্নি নয়। — – পুত্রঃ মাতরাঃ বিচরণ উপাবসি অংশের প্রচলিত ভাব এই যে, অগ্নি পুত্র এবং যে অরণিকাষ্ঠ থেকে অগ্নির উৎপত্তি তা অগ্নির মাতৃস্বরূপা। সু৩১ শগি পর, এ যেন ক্রীড়াচ্ছলে তাদের প্রাপ্ত হন। কিন্তু এমন অর্থ যে অত্যন্ত কষ্টকল্পনাপ্রসূত তা বলাই বাহুল্য। কারণ এই চারটি পদের মধ্যে অগ্নি এবং অরণিকাষ্ঠের সম্বন্ধ কিভাবে এল বোঝা যায় না। আমাদের ধারণা উপাবসি এবং পৃক্ষি পদ দুটির দ্বারা এক ভাবই প্রকাশ করছে, সেই ভাব– রক্ষা করা। পুত্র যেমন একান্তভাবে নিজের হৃদয়ের আদেশে তার মাতাপিতার সেবা করে, অথবা মাতাপিতাকে রক্ষা করে ভগবানও ঠিক তেমনিভাবে স্নেহের সাথে তার সন্তানসদৃশ জনগণকে রক্ষা করেন। এখানে প্রশ্ন হতে পারে- উপমাতে পিতা ও পুত্রের স্নেহকে এক করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে, ভগবান্ মানুষের পিতামাতা ভ্রাতা সমস্তই। সুতরাং তার সম্বন্ধে সকল সম্বন্ধই প্রযুক্ত হতে পারে। এই রক্ষার ভাব মন্ত্রের শেষাংশে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে]।

১৯/৩– শক্তিস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ হে দেব! আমাদের প্রার্থনার দ্বারা (অথবা প্রজ্ঞার দ্বারা) আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সরকম বিচিত্র রক্ষাশক্তিসমন্বিত সুজাত সিদ্ধি আপনাতে বর্তমান আছে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ প্রার্থনার দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন, তিনিই সকলের রক্ষক হন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে তেজের পুত্র জাবেদা। উৎকৃষ্ট স্তব পাঠ সহকারে তোমাকে সংস্থাপন করা হয়েছে; তুমি আনন্দ করো। তোমার উপরেই নানাবিধ ও নানাপ্রকার সংগৃহীত উত্তম সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। এইরকম, ভাষ্যানুসারী, হিন্দী অনুবাদও আছে]।

১৯/৪– অমৃতস্বরূপ হে জ্ঞানদেব! শত্রুগণকে বিনাশকারী আপনি আমাদের পরমধন প্রদান করুন; প্রসিদ্ধ আপনি পরমরমণীয় শরীরের সাথে অর্থাৎ জ্যোতির্ময় প্রকাশের সাথে বর্তমান আছেন; আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মকে সুফলের সাথে সংযোজিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন এবং সৎকর্মজনিত সুফল প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথম অংশের মধ্যে দুটি ভাব নিহিত আছে। প্রথম ভাব শত্রুনাশ। ভগবান রিপুনাশক। তাঁর অপার করুণাবশেই মানুষ রিপুনাশ করতে সমর্থ হয়। তাই বলা হয়েছে– জন্তুভিঃ ইরজ্যন– শত্রুদের বিনাশ করতঃ, অথবা শত্রুগণের বিনাশকারী। দ্বিতীয় ভাব– পরমধন-লাভের প্রার্থনা অস্মে রায়ঃ প্ৰথয়স্বঃ- আমাদের পরমধন প্রদান করুন। ভাষ্যকার অস্মে পদে ষষ্ঠ্যন্ত অস্মাকং অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু প্ৰথয়স্য ক্রিয়াপদের সাথে ষষ্ঠ্যন্ত অস্মাকং পদের সুসঙ্গতি হয় না। ষষ্ঠ্যন্ত প্রতিশব্দ গ্রহণ করে যদি ঐ অংশের অর্থ করা হয়, তা হলেও মূলতঃ আমাদের পরিগৃহীত অর্থেই উপনীত হওয়া যায়। মন্ত্রের মধ্যে অন্য যে একটি প্রার্থনা আছে, তার অর্থ এই যে, আমাদের কর্ম ইত্যাদি যেন সুফলপ্রদ হয়। মানুষ কর্ম করবার অধিকারী, ফলদাতা ভগবান্। আমরা যাতে আমাদের কর্মের সুফল লাভ করতে পারি, মন্ত্রে তারই প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে আমর অগ্নি! নবজাত কিরণমণ্ডলে বিভূষিত হয়ে আমাদের নিকট ধন বিস্তার করো, তুমি সুদৃশ্য মূর্তিতে সুশোভিত হয়েছ, সর্বফলদাতা যজ্ঞকে সংস্পর্শ করছ। – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১৯/৫– হে ভগবন! সৎকর্মে প্রবর্তক প্রজ্ঞানস্বরূপ মহান্ ধনের স্বামী পরমধনদাতা আপনাকে আমরা যেন আরাধনা করি। আপনি সৌভাগ্যদায়িকা মহতী সিদ্ধি এবং উপভোগ্য পরমধন সাধকদের প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন আরাধনাপরায়ণ হই; ভগবানই পরম ধনদাতা)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-হে অগ্নি! তুমি যজ্ঞের ও শোভাসম্পাদক, জ্ঞানী, প্রচুর অন্নদান করে থাক, উত্তম বস্তুও দান কর। এমন যে তুমি, সেই তোমাকে এ স্তব করি। অতি সুন্দর প্রচুর অন্ন দাও এবং সর্বফল-উৎপাদক ধন দান করো। অন্য একটি ভাষ্যানুগত হিন্দী অনুবাদ– যজ্ঞকা সংস্কার করনেওয়ালে, শ্রেষ্ঠজ্ঞানওয়ালে আউর বহুতলে ধনকে ঈশ্বর আউর ৬ ধনদেনেওয়ালে তুহ্মারি হম স্তুতি করতে হ্যায়, য্যায়সে তুম সৌভাগযুক্ত, বহুতসা ধন আউর ভোগনেযোগ্য ধন স্তুতি করনেওয়ালোকো দেতে হো৷– এই দুটি ব্যাখ্যার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, lll তা সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দী ব্যাখ্যাটি ভাষ্যেরই অনুসরণ করেছে। আমাদের মতে ভাষ্যার্থই এই উভয় ব্যাখ্যার মধ্যে অধিকতর সঙ্গত। আমাদের ব্যাখ্যা অনেক অংশে ভাষ্যানুসারী। মন্ত্রের মধ্যে দুটি ভাব আছে। প্রথম অংশ আত্ম-উদ্বোধক। আমরা যেন পরমমঙ্গলময় জগৎপিতার আরাধনায় আত্মনিয়োগ করি– এটাই প্রথম অংশের মর্ম। দ্বিতীয় অংশের ভাব এই যে, ভগবান সাধকদের পরমধন প্রদান করেন। মন্ত্রেই এই অংশে ভগবানের এই মাহাত্ম্যই পরিকীর্তিত হয়েছে]।

১৯/৬– সাধকগণ সৎকর্মসাধক (অথবা সত্যস্বরূপ মহান) সর্বদ্রষ্টা জ্ঞানদেবকে পরমসুখলাভের জন্য অগ্রে স্থাপন করেন। হে দেব! সাধকদের প্রার্থনা শ্রবণকারী সর্ববিদিত দিব্যভাবযুত আপনাকে ভগবৎপ্রাপিকা প্রার্থনার দ্বারা সাধকগণ আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি নিতসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকবর্গ পরমসুখলাভের জন্য সত্যস্বরূপ জ্ঞানদেবকে প্রার্থনার দ্বারা আরাধনা করেন)। [মন্ত্রের দুটি বিভাগ। প্রথম অংশে আছে– মানবগণ সত্যস্বরূপ মহান সর্বদর্শক জ্ঞানদেবতাকে অগ্রে স্থাপন করে। কেন? সুন্নায় অর্থাৎ পরম সুখলাভের জন্য। এই অংশের প্রথম ভাব ভগবানের মাহাত্ম্যকীর্তন, এবং দ্বিতীয় ভাব সাধকদের আরাধনা। সাধকেরা পরম সুখলাভের জন্য কাকে আরাধনা করেন? উত্তর– ঋতাবানং- সত্যস্বরূপং। মন্ত্রের অন্তর্গত অন্য একটি পদ মহিষং এর ভাষ্যার্থ মহান্তং পূজ্যং। আমরাও এই অর্থ গ্রহণ করেছি। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। যাঁরা মন্ত্রের অন্তর্গত পদসমূহের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বর্তমান সময়ের আভিধানিক অর্থের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেন, তাঁরা এস্থলে মহিষ শব্দের কি অর্থ করবেন? প্রচলিত মতানুসারে মন্ত্রটিকে না হয় অগ্নি-অৰ্থক বলে গ্রহণ করা গেল। কিন্তু তা হলেও অগ্নিকে মহিষ বলার কোনও সার্থকতা আছে কি? কিন্তু যাঁরা প্রচলিত মতের অনুসারী তাদের এই অর্থই গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু ভাষ্যকারও বর্তমান স্থলে মহিষ শব্দের প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করেননি। মন্ত্রাংশের তৃতীয় পদ– বিশ্বদৰ্শতং। এই পদও ভগবানের মাহাত্ম্যসূচক। তিনি বিশ্বকে বিশ্বের যাবতীয় বস্তুকে দর্শন করেন, অর্থাৎ সমগ্রজগই তার জ্ঞানের মধ্যে অবস্থিত। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে আমরা আরাধয়ন্তি পদ অধ্যাহার করেছি এবং প্রত্যেক ব্যাখ্যাকারই কোনও কোনও পদ অধ্যাহার করেছেন। মন্ত্রের এই অংশের ভাব এই যে, মানবগণ সাধকগণ সেই পরম দেবতার আরাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। কেমন আরাধনা? যুগাগিরা অর্থাৎ ভগবানের সাথে সংযোজনসাধক প্রার্থনার দ্বারা। যে প্রার্থনা ঐকান্তিকতার সাথে উচ্চারিত হয়, যে প্রার্থনার উদ্দেশ্য থাকে ভগবৎপ্রাপ্তি, সেই প্রার্থনাই সাধককে ভগবানের চরণতলে নিয়ে যেতে পারে, সেই প্রার্থনাই মানুষ ও ভগবানের মিলন সাধন করতে সমর্থ হয়। — প্রচলিত এক বঙ্গানুবাদ– যজ্ঞোপযোগী সর্বদ্রষ্টা (প্রজ্বলিত) প্রকাণ্ড অগ্নিকে মনুষ্যগণ সুখের জন্য আধান করেছি। তোমার কর্ণ সবই শোনে, — তোমার মতো বিস্তারশালী কিছু নেই, তুমি দেবলোকবাসী, এমন যে তুমি, সেই তোমাকে মনুষ্যেরা স্ত্রী পুরুষে স্তব করে। — অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

 — বিংশ অধ্যায় (প্রথমাংশ) সমাপ্ত —

.

উত্তরার্চিক — বিংশ অধ্যায় (দ্বিতীয়াংশ)

এই অধ্যায়ের দেবতা (সূক্তানুসারে)– ১-৩।৬।৭।১১ অগ্নি; ৪।৫ বিশ্বদেবগণ; ৮ ইন্দ্র; ৯ আপ; ১০ বায়ু; ১২ বেন।
ছন্দ– ১ কাকুভ প্রগাথ; ২ জগতী; ৪।৫।১১।১২ ত্রিষ্টুভ; ৩।৬-১০ গায়ত্রী।
ঋষি– ১ সৌভরি কাণ্ব; ৩ অরুণ বৈহতব্য; ৪৷৫ অবৎসার কাশ্যপ; ৭ বৎসশ্রী ভালন্দন; ৮ গোষুক্তি ও অশ্বসূক্তি কাণ্বায়ন; ৯ ত্রিশিরা ত্বাষ্ট্র বা সিন্ধুদ্বীপ আম্বরীষ; ১০ উল বাতায়ন; ১২ বেন ভার্গব, ৫।৬।১ স্যম।

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ১– প্র সো অগ্নে তবোতিভঃ সুবীরাভিস্তরতি বাজকর্মভিঃ। .. যস্য ত্বং সখ্যমাবিথ৷১৷৷ তব দ্রন্সে নীলবান বাশ ঋত্বিয় ইন্ধান সিষ্ণবা দদে। ত্বং মহীনামুষসামসি প্রিয়ঃ ক্ষপো বস্তুষু রাজসি৷৷ ২

 সূক্ত ২– তমোষধীর্দধিরে গর্ভমুত্বিয়ং তমাপো অগ্নিং জনয়ন্ত মাতরঃ। তমিৎ সমানং বনিনশ্চ বীরুঘোহন্তবতীশ্চ সুবতে চ বিশ্বহা। ১৷৷

সূক্ত ৩– অগ্নিরিন্দ্রায় পবতে দিবি শুক্রো বি রাজতি। মহিষীব বি জায়তে৷ ১৷৷

সূক্ত ৪– যো জাগার মৃচঃ কাময়ন্ত যো জাগার তমু সামানি যন্তি। যো জাগার তময়ং নোম আহ তবাহমশ্মি সখ্যে নোকাঃ। ১৷৷

সূক্ত ৫– অগ্নির্জাগার মৃঃ কাময়ন্তেহগির্জাগার তমু সামানি যান্তি। অগির্জাগার তময়ং সোম আহ তবাহমস্মি সখ্যে ন্যোকাঃ৷৷৷৷৷

সূক্ত ৬– নমঃ সখিভ্যঃ পূর্বসত্তো নমঃ সাকংনিষেভ্যঃ। যুঞ্জে বাচং শতপদী…॥১॥ যুঞ্জে বাচং শতপদীং গায়ে সহস্রবর্তনি। গায়ত্ৰং ত্ৰৈষ্ঠুভং জগৎ৷৷ ২৷, গায়ত্রং ত্ৰৈষ্ঠুভং জগদ বিশ্বা রূপাণি সম্ভ।দেবা ওকাংসি চক্রিরে৷৩৷৷

সূক্ত ৭– অগ্নিৰ্জোতির্জ্যোতিরগিরিন্দ্রো জ্যোতির্জোতিরিন্দ্রঃ। সূর্যো জ্যোতিৰ্জোতিঃ সূর্যঃ ১। পুনরূৰ্জা নিবর্ত পুনরগ্ন ইয়ুষা। পুনর্নঃ পাহ্যংহসঃ ৷৷ ২৷৷ সহ র‍্যা নি বর্তস্বাগ্নে পিন্থস্ব ধারয়া। বিশ্বপস্ন্যা বিশ্বম্পরি৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– হে জ্ঞানদেব! আপনি যে জনের মিত্রত্ব প্রাপ্ত হন (অর্থাৎ যে জন আপনার অনুগ্রহলাভ করে), সেই জনই আপন শোভনবীর্যোপেত সম্ভাবজননসমর্থ রক্ষার দ্বারা প্রবর্ধিত হয়। (ভাব এই যে, জ্ঞানদেব সর্বরক্ষণক্ষম; অতএব, আমরা তাঁর অনুগ্রহের দ্বারা সংসার সমুদ্রের পার কামনা করছি)। [ভাষ্যের মতে এই মন্ত্রে যে ভাব পরিব্যক্ত, তা এই, – হে অগ্নি! তুমি যার সখিত্ব প্রাপ্ত হও, সে তোমার অন্ন বা বলের রক্ষাকারী পুত্র ইত্যাদি-রূপ রক্ষার দ্বারা সম্বর্ধিত হয়। অর্থাৎ-তোমার মিত্রভূত ব্যক্তি এইরকম রক্ষার দ্বারা রক্ষিত হয় যে, তাতে তার বল সঞ্চিত হয়ে যায়। ভাষ্যের অনুসরণে একজন ব্যাখ্যাকার মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা আমনন করেছেন, তা এই হে এ অগ্নি! তুমি যার সখ্য গ্রহণ করো, তোমার বীরযুক্ত এবং অন্নপূর্ণ রক্ষা দ্বারা প্রবর্ধিত হয়। কিন্তু

প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রে বলা হচ্ছে- যে ব্যক্তির সখ্যতা ভগবান্ প্রাপ্ত হন, অথবা যিনি ভগবানের সখ্যতা লাভ করেন, তিনি শোভনবীর্যোপেত রক্ষার দ্বারা প্রবর্ধিত হন। এতে কি ভাব প্রকাশ পায়? তার প্রভাবে হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্জাত হয়। সত্ত্বের অধিকারী হলেই সৎস্বরূপকে লাভের সামর্থ্য আসে। ভগবান্ সস্বরূপ। তার সকল কর্ম-সৎ। তাঁর সকল কর্ম শোভন-কর্ম। তাঁর বীর্য শোভনবীর্য। তিনি যেভাবে যাঁকে রক্ষা করেন, তা সুশোভন আদর্শের মধ্যেই পরিগণিত। এতে বিশেষণ-বিরহিতের বিশেষণসমূহে, সেই সেই বিশেষণে বিশেষিত হবার উপদেশ আছে বোঝা যায়। এতে আর এক উদার। ভাবও পরিব্যক্ত দেখি। তাতে বোঝা যায়, ভগবানের করুণা যেমন সর্বত্র সমভাবে বর্ষিত হয়, তিনি যেমন সকলকে সমভাবে রক্ষা করেন, তুমিও তেমনি সর্বজীবে সমদর্শী হও; পরের উপকারে, আর্তের দুঃখ-বিমোচনে, অভাবগ্রস্তের অভাব-দূরীকরণে জীবন-মন উৎসর্গ করো। ভগবানের সখিত্ব লাভ করবার এটাই একমাত্র উপায়। এই বোধ কিন্তু সহজে সকলের মধ্যে আসে না। অজ্ঞতাই তার প্রতিবন্ধক। সত্যজ্ঞানের অভাবই অজ্ঞতা। অজ্ঞতাই সকল দুঃখের আকর। অজ্ঞতা দূর করতে না পারলে, সত্যের নির্মল জ্যোতিঃ হৃদয়ে অনুপ্রবিষ্ট না হলে, শ্ৰেয়োলাভের সম্ভাবনা নাই। অজ্ঞানতার বিনাশসাধন না হলে সত্যের সন্ধান মেলে না। জীবনসংগ্রামে জয়লাভ করতে হলে রিপুদস্যুর ধ্বংস-সাধনে সমুৎসুক থাকলে, সত্যের সন্ধান প্রথম প্রয়োজন। সত্যের অনুসন্ধান– সতের অনুসন্ধান ধর্মের অনুসন্ধান সৎস্বরূপের অনুস্মরণ]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-১২দ-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১/২– অভীষ্টবর্ষণশীল হে দেব! সর্বদর্শক পরমধনসম্পন্ন যে দেবতা, সেই আপনার রমণীয় সত্যভূত জ্যোতিঃ সাধকদের প্রদত্ত হয়। হে দেব! আপনি মহতী জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবীগণের উদ্বুদ্ধা হন এব্ং অজ্ঞানান্ধকারে বস্তুসমূহকে প্রকাশিত করেন অর্থাৎ অজ্ঞানতা বিনাশ করে সকল বস্তুজাতকে জ্ঞানের আলোকে প্রকাশিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা ভগবানের দিব্যজ্যোতিঃ প্রাপ্ত হন; ভগবান্ জনগণের অজ্ঞানতা বিনাশ করেন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোমসিক্ত! দ্রবণবান নীতবান কমণীয়, ঋতুজাত, দীপ্ত অগ্নি, তোমার জন্য সোম গৃহীত হচ্ছে; তুমি মহতী ঊষাসমূহের প্রিয়, রাত্রিকালের বস্তুতে প্রকাশিত হও। কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যের অমিল পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, ভাষ্যানুবাদের চেয়ে ঐ বাংলা অনুবাদটিই অধিকতর সঙ্গত। কারণ, ভাষ্যকার মন্ত্রের দেবতাকে অগ্নি বলেই সাব্যস্ত করেছেন; কিন্তু মন্ত্রে তার কোন প্রসঙ্গ নেই]।

২/১– মোক্ষপ্রাপক ভক্তি ইত্যাদি, সত্যজাত বীজরূপ প্রসিদ্ধ সেই জ্ঞানকে ধারণ করেন। প্রসিদ্ধ সেই পরাজ্ঞানধারক সাধকগণ অমৃত হৃদয়ে উৎপাদন করেন; এবং জ্যোতির্ময় সাধকগণও এইরকম উপায়ে সেই অমৃত লাভ করেন; অপিচ, অন্তৰ্শক্তিযুত সাধকপ্রবর সর্বপাপবিনাশক জ্ঞান উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানী সাধকগণ অমৃত লাভ করেন)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– ওষধিগণ সেই অগ্নিকে যথাকালে গর্ভস্বরূপ ধারণ করে, জলগণ জননীর ন্যায় তাকে জন্মদান করে। বনস্থিত লতাগণ গর্ভবতী হয়ে দিন দিন একভাবে তাকে প্রসব করে। স্পষ্টতঃ এখানে অগ্নির জন্মবিবরণ দেওয়া হয়েছে। প্রচলিত মতানুসারে মন্ত্রে কাষ্ঠ ইত্যাদি দাহনশীল এ অগ্নিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। ভাষ্যেও এই ভাবই অনেকাংশে গৃহীত হয়েছে। কাষ্ঠের মধ্যে অগ্নি ও এর বর্তমান থাকে বলে কাষ্ঠকে অগ্নির গর্ভস্বরূপ বলা হতে পারে। কিন্তু অনুবাদকার যথাকালে পদটি কোথা থেকে পেলেন, বোঝা যায় না। এর দ্বিতীয় অংশের কোন যৌক্তিকতা কেউই প্রদান করেননি। এবং প্রচলিত মত অনুসারেও দুর্বোধ্য। জল কিভাবে অগ্নির জন্মদান করবে? বরং অনেক স্থলে অগ্নিকে জলের পৌত্র অথবা প্রপৌত্র বলা হয়েছে; যেমন জল থেকে বৃক্ষ ইত্যাদির উৎপত্তি এবং বৃক্ষ থেকে অগ্নির উৎপত্তি। — ইত্যাদি। কিন্তু অগ্নিকে জলের পুত্র বলা যায় কোন যুক্তিতে? মন্ত্রের তৃতীয় অংশে লতাগণকে বৃক্ষ ইত্যাদির সমপর্যায়ের মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। ভাষ্যকারও যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতেও সংশয় কাটে না। আমরা মনে করি, মন্ত্রের মধ্যে অগ্নির জন্মবিবরণ দেওয়া হয়েছে সত্য, কিন্তু সে কোন্ অগ্নির বিবরণ? আমরা পূর্বাপর দেখিয়েছি, বেদে অগ্নি বলতে মানুষের অন্তর্নিহিত অথবা বিশ্বস্থিত জ্ঞানাগ্নিকেই লক্ষ্য করে। ওষধীঃ পদে মোক্ষপ্রাপক ভক্তি প্রভৃতিকে বোঝায়। ওষধী শব্দের সাধারণ অর্থ– ফল পাকলে যে সব বৃক্ষ মরে যায়। ভক্তি প্রভৃতির চরম অবস্থায়, পূর্ণবিকশিত অবস্থায় সাধকের পার্থিব অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়, তিনি দিব্যজীবন লাভ করেন। তাই ভক্তি প্রভৃতি সৎ-ভাবগুলিকে ওষধীঃ বলা অসঙ্গত নয়। ঋত্বিয়ং পদের অর্থ– ঋতজাতং। ঋতঅর্থ সত্য। পরাজ্ঞান সম্বন্ধেই এই বিশেষণটি প্রযুক্ত হতে পারে। নতুবা প্রজ্বলিত অগ্নিকে সত্যোৎপন্ন অথবা প্রচলিত মতানুসারে ঋতু থেকে উৎপন্নবলার কোনও সার্থকতা থাকে না। গর্ভঃপদের দ্বারা জ্ঞানের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। জ্ঞানই বিশ্বের বীজস্বরূপ। সাধকেরা সেই পরমবস্তু লাভ করে। জ্ঞানের সাহায্যে। মাতরঃ পদে সাধকদের লক্ষ্য করা হয়েছে। এই পদের ভাষ্যার্থ মাতৃস্থানীয়া– অর্থাৎ ধারণকারী। এই অর্থ আমরাও গ্রহণ করেছি। তাই এই অংশের ভাব হয়- সাধকেরা ভক্তি প্রভৃতি সৎ-ভাবসমূহের দ্বারা জ্ঞানলাভ করে থাকেন। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের ভাব– সাধকগণও এক উপায়ের দ্বারা অমৃতলাভ করেন। অমৃতপ্রাপ্তির দুটি উপায়। প্রথম উপায় জ্ঞানলাভ, দ্বিতীয় উপায় সাধনা। জ্ঞান স্বভাবতঃই অমৃতের পথে মানুষকে পরিচালিত করে। সাধনার ফলও তা-ই। -মন্ত্রের শেষাংশে বিশ্বহা পদের প্রচলিত অর্থ বিশ্বনাশক। কিন্তু ভগবানের কোন শক্তিই বিশ্বকে বিনাশ করে না; অধিকন্তু ভগবৎশক্তি বিশ্বকে রক্ষাই করে। বিশ্বহা পদের প্রকৃত অর্থ বিশ্বের পাপনাশক। বিশ্বের পাপ নাশ করেই ভগবান্ বিশ্বকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেন। বিশেষতঃ মন্ত্রটি পরাজ্ঞান সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, সুতরাং বিশ্বধ্বংসমূলক শব্দ একেবারেই অব্যবহার্য। মন্ত্রের কয়েকটি অংশের মূলভাব একই। সেই ভাব জ্ঞান-উৎপাদন। কারা জ্ঞানলাভের অধিকারী, কি উপায়ে জ্ঞানলাভ হয়, ইত্যাদি বিষয়ই মন্ত্রে প্রখ্যাপিত হয়েছে]।

৩/১– পরাজ্ঞান ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়, এবং জ্যোতির্ময় জ্ঞান দ্যুলোকে বিশেষভাবে বর্তমান আছে, অপিচ, মহান হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানের প্রভাবে সাধকেরা পরাজ্ঞান লাভ করেন, পরাজ্ঞানের দ্বারা ভগবৎপ্রাপ্তি হয়)। [মন্ত্রটির মূলভাব জ্ঞানের মাহাত্ম্য প্রচার করা। সাধকবর্গ জ্ঞানলাভ করে ধন্য হন। সেই জ্ঞানের বলে তারা ভগবানের চরণে পৌঁছাতে সমর্থ হন। কিন্তু প্রচলিত মত ভিন্ন। ভাষ্যানুগত একটি প্রচলিত হিন্দী অনুবাদ যজ্ঞসে অগ্রণী অগ্নি ইন্দ্রকে লিয়ে হমারে দিয়ে হুএ পুরোশমে অধিক দিপতা হ্যায়, দাপ্ত হো কর অন্তরীক্ষমে বিশেষ প্রকাশিত হোতা হ্যায়। জেসে মহিষী তৃণাদিসে দুধ ঘী আদি উৎপন্ন করতী হ্যায় ॥ এ জ্যায়সে হী দেবতাওকে অর্থ অনেকো অন্ন উৎপন্ন করতা হ্যায়। — অগ্নিঃ ইন্দ্রায় পবতে-মন্ত্রের এ প্রথমাংশ। ভাষ্যকার অর্থ করেছেন, যজ্ঞেযু প্রথমং প্রণেতা অগ্নিঃ ইন্দ্রায় ইন্দ্রার্থং গবতে অস্মাভিদত্তেন চর্বন্নেন পুরোশেন দেবানামধিকঃ ক্ষরতি। এখানে পবতে অথবা ক্ষরতি পদের দ্বারা কি অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে, তা বোঝা যায় না। কারণ প্রচলিত মতানুসারে পবতে পদের অর্থ করা হয়-ক্ষরিত হওয়া। কিন্তু আগুন (অগ্নি) তো তরল পদার্থ নয় যে ক্ষরিত হবে। সুতরাং এখানে প্রচলিত অর্থ কিভাবে প্রযুক্ত হতে পারে? আমরা মনে করি, ঐ মন্ত্রাংশে জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা বিবৃত হয়েছে। জ্ঞান কিসের জন্য? তার উত্তর– ইন্দ্রায়– ইন্দ্রার্থং, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য]।

৪/১– যে দেবতা চৈতন্যস্বরূপ, প্রার্থনা সেই দেবতাকে পেতে ইচ্ছা করে; যে দেবতা প্রজ্ঞানস্বরূপ, প্রার্থনা সেই দেবতাকেই প্রাপ্ত হয়; যে দেবতা চিরজাগরূক, সেই দেবতাকে সাধকহৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব বলে আমি আপনার সখিত্বে নিত্যকাল থাকব। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত সাধকগণ চৈতন্যস্বরূপ ভগবানকে আরাধনা করেন)। [মন্ত্রে ভগবানের মাহাত্মের একটি দিকই বিশেষভাবে পরিস্ফুট করবার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই দিক ভগবানের নিত্যচৈতন্য অথবা প্রজ্ঞানস্বরূপত্ব। মন্ত্রে যঃ জাগারঃ এই অংশ তিনবার উল্লিখিত হয়েছে। জাগার পদের ভাষ্যার্থ সর্বদা বিনিদ্রঃ অর্থাৎ যার কখনও নিদ্রা হয় না। অথবা জ্ঞানলোপ হয় না। সাধারণ মানুষ অজ্ঞানতা ও মোহের প্রভাবাধীন। কিন্তু ভগবান্ সেই অজ্ঞানতা ও মোহের প্রভাব থেকে চিরমুক্ত। অথবা তিনি জ্ঞানস্বরূপ, চৈতন্যস্বরূপ। সুতরাং জ্ঞান ও চৈতন্য যে স্থানে বর্তমান আছে সেখানে অজ্ঞানতা অথবা মোহ আসতে পারে না। আলোর মধ্যে যেমন অন্ধকার থাকতে পারে, তেমন ভগবানে অজ্ঞানতা থাকে না বা থাকতে পারে না। যঃ জাগার পদ দুটিতে ভগবানের সেই পরমশক্তিকেই বিশেষভাবে লক্ষ্য করা হয়েছে। — মন্ত্রের প্রথম দুই অংশে বলা হয়েছে সেই পরমদেবতার চরণেই মানুষের চরম প্রার্থনা– আকুল আকাঙ্ক্ষা নিবেদিত হয়। পরের অংশের ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত সাধকেরা সর্বদা নিত্যকাল ভগবানের সখ্যলাভের জন্য চেষ্টান্বিত থাকেন। কিন্তু এই মন্ত্রের যে প্রচলিত ভাব আছে, তাতে কাষ্ঠ ইত্যাদি দাহনশীল প্রজ্বলিত অগ্নিরই মাহাত্ম্য লক্ষ্য হয়। ভাষ্যকার যথারীতি সোম শব্দে সোমরসের সন্ধান দিয়েছেন]।

৫/১– জ্ঞানদেব চৈতন্যস্বরূপ হন; আমাদের প্রার্থনা সেই জ্ঞানদেবকে পেতে ইচ্ছা করে; জ্ঞানদেব প্রজ্ঞানস্বরূপ হন; প্রার্থনা সেই দেবকেই প্রাপ্ত হয়; জ্ঞানদেব চিরজাগরূক হন; প্রসিদ্ধ সাধকহৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব– আমি আপনার সখিত্বে যেন নিত্যকাল থাকি, এমন সেই জ্ঞানদেবকে বলে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সকল লোকে পরাজ্ঞান প্রার্থনা করে, শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞানের সাথে মিলিত হয়)। [বর্তমান মন্ত্রটি পূর্ববর্তী মন্ত্রেরই অনুরূপ। শুধু অনুরূপ নয়, এই মন্ত্র পূর্ব মন্ত্রের অর্থকে পরিস্ফুট করেছে। আমার দেখতে পাচ্ছি যে, পূর্বৰ্মন্ত্রের ব্যাখ্যা পরিস্ফুট করার জন্য বর্তমান মন্ত্রে যঃ পদের স্থলে অগ্নি পদ প্রদত্ত হয়েছে। পূর্বৰ্মন্ত্রে যঃ পদের দ্বারা ভগবানের জ্ঞানশক্তিকে পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করা হয়েছিল, কিন্তু এখানে প্রত্যক্ষভাবে অগ্নিঃ পদই ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই উভয় মন্ত্রের ভাব এক এবং একটি অপরটির অর্থ বিশদ করছে। — আলোচ্য মন্ত্রে একটি ভাব বিশেষভাবে পরিস্ফুট হচ্ছে, তা এই যে, জ্ঞান ও সত্ত্বভাব পরস্পর পরস্পরের অনুগামী। যেখানে জ্ঞান আছে, সেখানে শুদ্ধসত্ত্ব থাকবে; অথবা যেখানে শুদ্ধসত্ত্ব থাকবে, সেখানে জ্ঞানও থাকবে। একটির দ্বারা অপরটি লাভ করা যায়। জ্ঞান ও শুদ্ধসত্ত্ব এই উভয়ের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বর্তমান আছে, তা-ই মন্ত্রের শেষাংশে বিবৃত হয়েছে]।

৬/১– নিত্যকালবর্তমান বন্ধুস্বরূপ দেবতাগণকে আমরা নমস্কার করছি। নিত্যসহচররূপ দেবতাগণকে আমরা নমস্কার করছি; আমরা যেন প্রভূতপরিমাণ প্রার্থনা উচ্চারণ করতে পারি। (মন্ত্রটি আত্মনিবেদনমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানে ভক্তিপরায়ণ এবং প্রার্থনাপরায়ণ হই)। [নমঃ সখিভ্যঃ- সখিস্থানীয়, বন্ধুস্বরূপ দেবগণকে প্রণিপাত করছি। দেবতা অথবা দেবভাব প্রকৃতপক্ষেই মানুষের বন্ধু, কারণ এই দেবভাবের সাহায্যেই মানুষ নিজের জীবনের চরম সার্থকতা লাভ করতে পারে। তাই বলা হয়েছে- নিত্যকাল বর্তমান দেবতাগণকে নমস্কার করি, তারাই আমার প্রকৃত বন্ধু। দ্বিতীয় অংশ– যাঁরা আমাদের নিকটে বর্তমান আছেন, তাঁদের প্রণাম করছি। কারা আমাদের নিকটে আছেন? দেবভাব, দেবত্ব অথবা দেবগণ। দেবগণ শুধু যে চিরবর্তন, তা নয়, তাঁরা সর্বত্র বিদ্যমান, চিরকাল তারা আমাদের ঘিরে আছেন, আমরা ইচ্ছা করলে সাধনার দ্বারা তাদের কৃপা লাভ করতে পারি]।

৬/২– আমি যেন সর্বতোমুখী, প্রার্থনা উচ্চারণ করি; গায়ত্রী ইত্যাদি ছন্দে গ্রথিত মন্ত্রসমূহ যেন আমি সর্বতোভাবে উচ্চারণ করি; (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন আরাধনাপরায়ণ হই)। [মন্ত্রের মধ্যে প্রার্থনাকারীর ব্যাকুলতার ভাব পূর্ণ প্রকটিত। মন্ত্রে দুটি অংশ আছে। উভয় অংশেই প্রার্থনার ভাব পরিস্ফুট। প্রথম অংশ– আমরা যেন শতমুখে প্রার্থনা করতে পারি, আমাদের প্রার্থনা যেন শতধারায় প্রবাহিত হয়ে ভগবানের চরণতলে পৌঁছায়। দ্বিতীয় অংশ সহস্ৰমুখে, সহস্রভাবে আমরা যেন গায়ত্রী প্রভৃতি বৈদিক ছন্দে গ্রথিত পবিত্র বেদমন্ত্রে উচ্চারণ করতে পারি। এখানে প্রার্থনার পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র নিত্য সনাতন বেদমন্ত্রের সাহায্যে আমরা যেন আমাদের প্রার্থনা নিবেদন করি]।

৬/৩– গায়ত্রী ইত্যাদি ছন্দে গ্রথিত সকলরকম মন্ত্রের দ্বারা উদ্বুদ্ধা দেবভাবসমূহ পরমাশ্রয় সাধকবর্গকে প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, প্রার্থনা এবং দেবভাবের দ্বারা পরমাশ্রয় লাভ হয়)। [আলোচ্য মন্ত্রের সাথে পূর্ববর্তী দুটি মন্ত্রের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বর্তমান। মন্ত্রের গঠনের দিক দিয়েও এই কথা প্রযোজ্য। কারণ বর্তমান মন্ত্রের শেষ পদ দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রথম-পদ রূপে গৃহীত হয়েছে। আবার দ্বিতীয় মন্ত্রের শেষ পদ, বর্তমান মন্ত্রের প্রথম পদরূপে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু শুধু পদগুলিতে এই সমভাব পর্যবসিত হয়নি। ভাবের দিক দিয়েও মিলন পরিলক্ষিত হয়। প্রথম মন্ত্রে দেবতাগণকে অথবা দেবভাবকে নমস্কার করা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে সেই নমস্কার অথবা প্রার্থনার পদ্ধতি নিরূপিত হয়েছে। আবার তৃতীয় মন্ত্রে সেই প্রার্থনার ফল পরিবর্ণিত দেখতে পাই। তৃতীয় মন্ত্রে বর্ণিত সেই প্রার্থনার ফল কি? প্রার্থনার, সাধনার ফল পরমাশ্রয়, পরমপদলাভ। প্রার্থনার দ্বারা হৃদয়ে দেবতাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে, তার দ্বারা জীবনের চরমাশ্রয় লাভ ঘটে, এটাই মন্ত্রের বিশেষভাব]।

৭/১- যিনি জ্ঞানদেব, তিনিই দৃশ্যমান জ্যোতিঃস্বরূপ; এবং যিনি দৃশ্যমান্ জ্যোতিঃস্বরূপ, তিনিই জ্ঞানদেব হন। যিনি ভগবান্ ইন্দ্রদেব তিনিই জ্যোতিঃস্বরূপ, এবং যিনি জ্যোতিঃস্বরূপ, তিনিই ভগবান ইন্দ্রদেব হন। যিনি সূর্যদেব তিনিই জ্যোতিঃস্বরূপ; এবং যিনি জ্যোতিস্বরূপ তিনিই সূর্যদেব হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, এক পরমদেবকেই বহুরূপে প্রকাশিত দেখি)। [এই মন্ত্রের এই চারটি অংশ অগ্নিহোত হোমের মন্ত্র। এর প্রথম অংশটি সায়ংকালীন হোমে এবং দ্বিতীয় অংশটি প্রাতঃকালীন হোমে প্রযুক্ত হয়। তৃতীয় অংশে ব্রহ্মবর্ভূসকামী অর্চনাকারী সায়ংকালীন হোম এবং প্রাতঃকালীন হোম সম্পন্ন করবেন। চতুর্থ অংশ দ্বিতীয় মন্ত্রের বিকল্পে ব্যবহৃত হয়। এই চারটি অংশেরই মর্মার্থ অভিন্ন। যাকে আমরা সূর্যদেব বলে উপাসনা করি, যাকে আমরা অগ্নিদেব বলে পূজা করি, যাকে আমরা জ্যোতিঃ বলে অথবা তেজঃ বলে ধারণা করি, তারা ভিন্ন নন– অভিন্ন ও এক। এই মন্ত্রের অংশ কয়েকটি সেই শিক্ষা প্রদান করছে। ভাষ্য অনুসারে এই মন্ত্রটি অগ্নিদেবের ও সূর্যদেবের সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে, প্রতিপন্ন হয়। সেই অনুসারে অর্থ হয়ে থাকে, অগ্নিই জ্যোতিঃস্বরূপ, জ্যোতিঃই অগ্নি। অগ্নিদেবতার উদ্দেশে প্রদত্ত আহুতি সুহুত হোক। এইরকম, সূর্যই জ্যোতিঃ। জ্যোতিঃই সূর্য। সূর্যদেবের উদ্দেশে প্রদত্ত আহুতি সুহুত হোক।  ইত্যাদি। যাই হোক, মূল লক্ষ্য উভয়ত্রই যে অভিন্ন, তা বলাই বাহুল্য]। [এই সাম-মন্ত্রটি শুক্লযজুর্বেদ সংহিতায় (৩অ ৯দ-১০৫ম) পরিদৃষ্ট হয়]।

৭/২– হে জ্ঞানদেব! শক্তির সাথে আমাদের পুনঃ প্রাপ্ত হোন। সৎকর্মসাধনসামর্থ্যের সাথে আমাদের পুনঃ প্রাপ্ত হোন। আমাদের পাপ থেকে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ পতিত আমাদের আত্মশক্তি ও পরাসিদ্ধি প্রদান করুন এবং আমাদের পাপের কবল থেকে রক্ষা করুন)। [এই প্রার্থনায় পুনঃ শব্দ তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মানুষ পতিত অবস্থায় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে- হে ভগবন! আপনার কৃপায় আমরা যেন, পুনরায় আমাদের আয়ুঃশক্তি প্রভৃতি ফিরে পাই। এই পুনঃবলার তাৎপর্য কি? এর দ্বারা এটাই স্পষ্ট বোঝাচ্ছে যে, মানুষ এক সময়ে মহান্ পবিত্র ছিল, এখন সে হীন পতিত হয়েছে। -একটু অনুসন্ধান করলেই আমরা এই শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারব। মানুষ স্বরূপতঃ ভগবানের অংশ, দেবতা। সুতরাং সে তো ভগবৎ-শক্তি ও পবিত্রতার অধিকারী। একদিন সে তা ছিলও। পাপের মোহের আক্রমণে ভুলে সে সেই শক্তি ও পবিত্রতা নষ্ট করেছে। তাই পুনঃ সে বিনষ্ট ধন লাভ করবার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা ধ্বনিত করা হয়েছে। আত্মবিস্মৃত মানুষের মধ্যে, ঈশ্বরের কৃপায়, যখন ক্ষীণালোকের মতো বিবেকের স্মৃতি জাগে; যখন প্রশ্ন জাগে-কে আমি, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব– তখনই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় সাধনার আকুলতা। এই সাধনা, এই আকুলতার উদ্দেশ্য স্বরূপত্বলাভ। যা ছিলাম (ছিলাম অমৃতের সন্তান) তা-ই আবার হতে চাই; যা হারিয়েছি (অমৃতত্ব) তা-ই আবার লাভ করতে চাই। পাপের হাতে আত্মসমর্পণ করেছি, সেই পাপকে দূরীভূত পরাভূত করতে চাই। আবার (পুনঃ পুনরায়) পুণ্যজীবন লাভ করব– এটাই প্রার্থনার পুনঃ নিবৰ্তম্ব, ন পাহি অংহসঃ এর সারমর্ম] [এই সামমন্ত্রটি শুক্লযজুর্বেদ সংহিতার দ্বাদশ অধ্যায়ের নবম কণ্ডিকা থেকে সঙ্কলিত। — এই মন্ত্রটির মনুসংহিতাবিহিত একটি প্রয়োগ আছে। তা এই, ব্রহ্মচারীদের স্বপ্নে রেতঃক্ষরণে এই মন্ত্র জপ করতে হয়। সেখানে তার বিধান আছে]।

৭/৩– হে জ্ঞানদেব! পরমরমণীয় ধনের সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন; সমস্ত লোককে বিশ্বপোষক অমৃতপ্রবাহের দ্বারা অভিসিঞ্চিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন। আমাদের বিশ্বস্থিত সকল লোককে অমৃত প্রদান করুন)। [মন্ত্রের মধ্যে একটি বিশ্বজনীন ভাব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রের প্রথম অংশ, পরমধনের সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন, অর্থাৎ এ আমাদের পরমধন প্রদান করুন। কি প্রদান করতে হবে, এবং কাকে প্রদান করতে হবে তা পরবর্তী অংশে প্রদত্ত হয়েছে। বিশ্বতঃ পরি পদ দুটিতে বিশ্বের সকল লোককে বোঝাচ্ছে; অর্থাৎ বিশ্বের সকল লোককে অমৃতসিঞ্চনে অভিষিক্ত করো। সেই অমৃতধারা কেমন? বিশ্বপস্ন্যা অর্থাৎ যা বিশ্বকে পোষণ করতে পারে। বিশ্বতঃ পদটির দ্বারা বোঝাচ্ছে যে, জগতের পাপীতাপী ধনী দরিদ্র, সকলেই যেন ভগবানের করুণলাভ করে ধন্য হয়। কি উপায়ে? — বিশ্বস্ন্যা অর্থাৎ যা বিশ্বকে পোষণ করতে পারে। যে অমৃতধারায় বিশ্ব প্লাবিত হবে, তা বিশ্বপোষক, অর্থাৎ বিশ্বের সকল লোককে প্রতিপালন করতে, সঞ্জীবিত করতে সমর্থ। এই সার্বজনীনতাই হিন্দুত্বের আদর্শ ও বিশেষত্ব। হিন্দু জানেন, তিনি বিশ্বে একা নন, বিশ্বের প্রতি অনুপরমাণুর সাথে তার সম্বন্ধ বিদ্যমান। কাউকেও ফেলে, অন্যের অগ্রসর হবার উপায় নেই। যদি অগ্রসর হতে হয়, তাহলে বিশ্বের সাথে অগ্রসর হতে হবে। যে পতিত থাকবে, সে অগ্রবর্তীকে পশ্চাতে টানবে। সুতরাং কোন ব্যক্তিবিশেষের পূর্ণমুক্তিলাভের জন্য বিশ্বের মুক্তির প্রয়োজন। তাই এই সার্বজনীন প্রার্থনা। — এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত হিন্দী। অনুবাদ- হে অগ্নিদেব! রমণীয় ধনসহিত হমৈ প্রাপ্ত হোও, সবকে উপর বিশ্বভরকা উপভোগ করনেওয়ালী ধারাসে হর্মৈ, সীচো। এটি ভাষ্যেরই অনুসারী]।

.

সপ্তম খণ্ড

সূক্ত ৮– যদিন্দ্রাহং যথা ত্বমীশীয় বস্ব এক ইৎ। স্তোতা মেগোসখা স্যাৎ৷১৷৷ শিক্ষেয়মস্মৈ দিৎসেয়ং শচীপতে মনীষিণে। যদহং গোপতি স্যাম্৷ ২৷৷ ধেনুষ্ট ইন্দ্র সূতা যজমানায় সুম্বতে। গামশ্বৎ পিষী দুহে৷৩৷৷

সূক্ত ৯– আপো হি ষ্ঠা ময়োভুবস্তা ন উর্জে দধাতন। মহে রণায় চক্ষসে৷১। যোবঃ শিবতমো রসস্তস্য ভাজয়তেহ নঃ। উতশীরির মাতরঃ৷৷২৷৷ তম্মা অরং গমাম বো যস্য ক্ষয়ায় জিম্বথ। আপো জনয়থা চ নঃ ॥.৩৷৷

সূক্ত ১০– র বাত আ বাতু ভেষজং শম্ভু ময়োভু নো হ্রদে। প্র ন আয়ুংষি তারিষৎ৷৷ ১। উত বাত পিতাসি ন উত ভ্রাতোত নঃ সখা। স নো জীবাতবে কৃধি॥ ২॥ যদদো বাত তে গৃহেইমৃতং নিহিতং গুহা। তস্য নো ধেহি জীবসে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১১– অভি বাজী বিশ্বরূপো জনিং হিরণ্যয়ং বিভ্রদকং সুপর্ণঃ। সূর্যস্য ভানুমৃতুথা বসানঃ পরি স্বয়ং মেঘমৃর্জো জজান। ১। অপসুরেতঃ শিশিয়ে বিশ্বরূপং তেজঃ পৃথিব্যামধি যৎসং বভূব। অন্তরিক্ষে স্বং মহিমানং মিমানঃ কক্রিস্তি বৃষ্ণো অশ্বস্য রেতঃ ৷৷ ২৷৷ অয়ং সহস্র পরি যুক্তা বসানঃ সূর্যস্য ভানুং যজ্ঞো দাধার। সহস্রদাঃ শতদা ভূরিদাবা ধর্তা দিবো ভুরনস্য বিপতিঃ ॥৩৷৷ 

সূক্ত ১২–। নাকে সুপর্ণমুপ যৎ পতন্তং হুদা বেনন্তো অভ্যচক্ষত ত্বা। হিরণ্যপক্ষং বরুণস্য দূতং যমস্য যোনৌ শকুনং ভুরণুম। ১ উর্ধো গন্ধর্বো অধি নাকে অস্থাৎ প্রত্যঙচিত্রা বিভ্ৰদস্যায়ুধানি। বসানো অকং সুরভিং দৃশে কং স্বার্ণ নাম জনত প্রিয়াণি৷৷ ২৷৷ দ্রপসঃ সমুদ্রমভি যজ্জিগাতি পশ্য গৃস্য চক্ষসা বিধর্ম। ভানুঃ শুক্রেন শোচিষা চকানস্তৃতীয়ে চক্রেরজসি প্রিয়াণি৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৮সূক্ত/১সাম– হে পরমৈশ্বর্যশালিন দেব! যদি আপনার স্তবকারী ভক্ত বা সাধক আমার জ্ঞান-উন্মেষণের সহায় (সখীভূত) হতেন; তাহলে, হে দেব! আপনি যেমন অদ্বিতীয় সর্বজ্ঞ ও ধনবান্ অর্থাৎ পরমৈশ্বর্যশালী রূপ ধনবান, আমিও তেমন (আপনার ঐশ্বর্যে) ঐশ্বর্যযুক্ত হতে পারতাম অর্থাৎ তন্ময় হতাম। (ভাবার্থ হে ইন্দ্রদেব! আপনাকে স্তব করতে জানি না, অর্থাৎ আমি অজ্ঞান;যদি কেউ আপনার স্তবকার্যে– আমার জ্ঞান-উন্মেষণের কার্যে আমার শিক্ষক হতেন, তাহলে আমিও আপনার ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যযুক্ত অর্থাৎ আপনাতে তন্ময় হতে পারতাম। — এই মন্ত্রটি পিতার কাছে পুত্রের আবদারের মতো, ভগবানের কাছে ভক্ত-সাধকের আত্মশ্লাঘাসূচক আত্মনিবেদনরূপ আবদার সূচনা করছে)। [ভাষ্যের ব্যাখ্যা অনুসরণে এ মন্ত্রটির যে অর্থ নিষ্পন্ন হয়, তা এই, — হে ইন্দ্র! যেমন তুমি একমাত্র ধনের ঈশ্বর, তেমন আমিও যদি ঐশ্বর্যযুক্ত হই; তখন আমার স্তবকারীও, গোসখা হন অর্থাৎ বহু গরুযুক্ত হন। ঈশ্বর তুমি! তোমার স্তোতা কি জন্য গরুযুক্ত না হবেন? অবশ্যই হবেন। মন্ত্রের অন্যান্য অংশের ভাষ্যকার-কৃত ব্যাখ্যার সাথে আমাদের মতানৈক্য তো আছেই। এখানে বিশেষ করে মন্ত্রের শেষ অংশ– স্তোতা মে গোসখা স্যাৎসম্বন্ধে স্বল্প আলোচনা করা যেতে পারে। ভাষ্যকার এই অংশের ব্যাখ্যা করেছেন- আমার স্তবকারী বহু গরুযুক্ত হন। তারপর লিখেছেন ঈশ্বর তুমি…..অবশ্যই হবেন (এমন অভিপ্রায়)। এতে কি উচ্চভাব পরিব্যক্ত হচ্ছে, তা আমরা বুঝতে পারলাম না। তবে মনে হয় আমার স্তোতা গরুযুক্ত হয় লিখে, যখন ঈশ্বর তুমি, তোমার স্তবকারী: কেন গোযুক্ত হবে না? হবেই– এমন লিখেছেন; তখন, আমিও ঐশ্বর্যলাভ করলে ঈশ্বরই (তুমিই)। হব, সুতরাং আমার স্তবকারী তোমারই স্তবকারী হবেন। এমন তাঁর (ভাষ্যকারের) অভিপ্রায় মনে হয়। জীবের স্বরূপতত্ত্ব উপলব্ধ হলে, ভেদজ্ঞান তিরোহিত হয় সত্য, কিন্তু তাঁর (জীবব্রহ্মের) স্তবকারী বহু গরুযুক্ত হন, এর তাৎপর্য কি? ঈশ্বরকে স্তব করে কেবল গোটাকতক গরু পেলেই কি পাওয়া হলো? তার অভীষ্ট যত কিছু, এমন কি পরমৈশ্বর্য পর্যন্তও তত লাভ করতে পারেন। সেই জন্য আমরা স্তোতা মে গোসখা স্যাৎ এই মন্ত্রাংশের পূর্বে একটি তব পদ অধ্যাহার করে তোমার স্তোতা আমার (মে) গোসখা (গো-স্তববাক্য, জ্ঞান-উন্মেষণ, তার সখা বা সহায়ক অর্থাৎ স্তবের বা জ্ঞান-উন্মেষণের সহায়ক হতো)– এই অর্থ গ্রহণ করেছি। তাৎপর্য এই যে, আমি অজ্ঞ অধম। দেব! তোমার স্তবের বিষয় (আরাধনা) আমি কিছু জানি না। তুমি তো নানারূপে– কখনও গুরু বা শিক্ষকরূপে, কখনও শিষ্য বা উপদেশ্যরূপে বিরাজ করে। তাই বলি, উপদেশক বা সত্যপথ-প্রদর্শক মনীষিরূপে, আমার কাছে এস, পথ দেখাও। অজ্ঞানতা দূর হয়ে জ্ঞানের উন্মেষ হোক, ভেদবুদ্ধি তিরোহিত হোক। ফলে, তোমাতে ও আমাতে এক হয়ে যাই। মন্ত্রে এই প্রার্থনাই প্রকটিত বলে মনে করি। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-১দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– যজ্ঞাধিপতি হে দেব! পরমধনদাতা আপনি, যে রকমে আমি পরাজ্ঞানসম্পন্ন হতে পারি, তেমনভাবে প্রার্থনাকারী আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [ভগবানকে শচীপতে বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ভাষ্যকার তার অর্থ করেছেন– শক্তিমন্। আমরাও তা স্বীকার করি। পুরাণ ইত্যাদির সর্বজ্ঞেশ্বরঃ হরিঃ বাক্য আপামর সাধারণ সকলেই জানেন। সৎকর্মের অধিপতি ভগবান। অর্থাৎ সৎকর্ম সম্পাদন করতে হলে, ভগবানের কৃপাতেই সম্ভবপর হয়; নচেৎ শয়তান বা পাপের কবলে পতিত হয়ে সবই পণ্ড হয়ে যায়। — মন্ত্রের অন্তর্গত দিসেয়ং পদটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পদের দ্বারা মন্ত্র ভগবানের করুণার পরিচয় দিচ্ছেন। ভগবান্ দিসেয়ং পরমধনসহ সর্বস্ব তার সন্তানদের বিলিয়ে দিতেই তিনি প্রস্তুত আছেন। মন্ত্রের মধ্যে পরমদাতা ভগবানের সেই পরমধন লাভ করবার জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। হে ভগবন! যাতে আমি পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি, আপনি তার উপায় বিধান করুন। আমাকে এমন সাধনশক্তি প্রদান করুন, আমাকে এমনভাবে পরিচালিত করুন যে, আমি যেন আপনার চরণপ্রান্তে পৌঁছাবার উপযোগী জ্ঞানলাভ করতে পারি। আপনার করুণা ব্যতীত আমার কি শক্তি আছে যে, নির্বিঘ্নে আপনার আরাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারি। চারদিকে রিপুবর্গের আক্রমণ, মোহের প্রলোভন বর্তমান আছে। তাদের ভীষণ আক্রমণ প্রতিহত করতে পারি, এ আমার এমন শক্তি নেই। হে প্রভো, হে দয়াময়! আমাকে আপনার শক্তি দান করে, আপনার মহাজ্ঞান দান করে আমাকে পরিত্রাণ করুন। যাতে আপনি আমাকে আপনার সেবকের যোগ্য করে তুলতে পারেন, তার বিধান করুন। — মন্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে এই প্রার্থনাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। অথচ একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ লক্ষণীয়– হে শক্তিমান্! যদি আমি গোপতি হই, তবে এই স্তোত্রকে দান করতে ইচ্ছা করব এবং (প্রার্থিত ধন) দান করব। দেবতাকে সম্বোধন করে এই কথা বলার তাৎপর্য কি? প্রচলিত মতানুসারে মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক নয়; অধিকন্তু এটাই মনে হয় যে, মন্ত্র উচ্চারণকারী যেন দেবতাকে নীতিশিক্ষা দিচ্ছেন]।

৮/৩– বলাধিপতি হে দেব! আত্মপোষণসমর্থ সত্যস্বরূপ আপনার সম্বন্ধীয় জ্ঞান, শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন সাধককে পরাজ্ঞান এবং ব্যাপকজ্ঞান অর্থাৎ সকলরকম জ্ঞান প্রদান করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন সাধকেরা পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [ভগবৎ-জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। সেই জ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষ লাভ হয়। মন্ত্রে সেই জ্ঞানের স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে– সেই জ্ঞান সুনৃতা অর্থাৎ সত্যস্বরূপ। এটাই ভগবৎ-সম্বন্ধীয় জ্ঞানের উপযুক্ত বিশেষণ। তার পরেই বলা হয়েছে– পিপুষি। এর ভাষ্যার্থ যা যজমান অথবা সাধককে প্রবর্ধিত করে, উন্নত করে। ভগবৎ-জ্ঞানের মতো উন্নতিসাধক আর কি থাকতে পারে? যাঁর হৃদয়ে সেই জ্ঞানের আলোক, বিকাশলাভ করেছে, যিনি সেই পরমজ্যোতিঃ লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি ক্রমশঃই উন্নত থেকে উন্নততর লোকে আরোহণ করতে সমর্থ হন। পিপুষি পদের অর্থ– পোষণকারী। যে বস্তু সাধকের আত্মাকে পরিপোষণ করে, সেই বস্তুকে পিপুষি বলা যায়। জ্ঞানই মানবাত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ পোষণকারী, কারণ এই জ্ঞানের বলেই মানুষ তার স্বরূপ অবস্থা লাভ করতে সমর্থ হয়। জ্ঞানের বলেই মানুষ জানতে পারে যে, সে জন্মজরামরণকবলিত দুর্বল জীব নয়, সে অজর অমর শাশ্বত নিত্যজীব। — প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! তোমার সত্যপ্রিয় এবং প্রবর্ধক (স্তুতিরূপ) ধেনু সোমাভিষবকারীকে গাভী ও অশ্ব দান করে। পূর্বের মন্ত্রে ভাষ্যকার গোপতিঃ বলতে গবামধিপতিঃ লক্ষ্য করেছিলেন; আমরা ঐ পদে জ্ঞানাধিপতিঃ অর্থাৎ পরাজ্ঞানসম্পন্ন অর্থ করেছিলাম। এই মন্ত্রের ধেনুঃশব্দের অর্থ সম্বন্ধে ভাষ্যকারের উক্তি দোঞ্জী গৌভূত্ব; আমরা অর্থ করেছি জ্ঞানং। সুন্বতে পদে, ভাষ্যকার বলছেন– সোমাভিষব: কুৰ্বতে। আমরা বলি– শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্নায়। দুটিই সম্মত অর্থ, কিন্তু সঙ্গত কোনটি তা পাঠকেরই বিচার্য]।

৯/১– আপনারা যে অমৃতপ্রবাহ পরমসুখদায়ক হন, সেই আপনারাই আত্মশক্তিলাভের জন্য আমাদের যোগ্য করুন;মহান্ রমণীয় জ্ঞান লাভের জন্য আমাদের যোগ্য করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমরা অমৃতের সাথে পরাজ্ঞান যেন লাভ করি)। [মন্ত্রে অমৃতস্বরূপ ভগবানের নিকট শক্তিলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। অমৃতকে ময়োভুবঃ অথবা সুখের হেতুভূত বলা হয়েছে। দেখা যাক, সুখ কি বস্তু এবং অমৃতত্বই বা কি; এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধই বা কি। — অমৃত, যা পান করলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে, মৃত্যুর অধীন হয় না। এই অমৃতের স্বরূপ জানতে হলে মৃত্যুর স্বরূপ জানা প্রয়োজন। সকল মানুষই অথবা সৃষ্ট বস্তু মাত্রেই কায়িক মৃত্যুর অধীন। কিন্তু স্বরূপতঃ কোন বস্তুরই ধ্বংস নেই, ধ্বংস থাকতে পারে না। যা আছে তার আধ্যাত্মিক বিনাশ সম্ভবপর নয়। এ সুতরাং একদিক দিয়ে দেখতে গেলে বলা যায়, বস্তুমাত্রেই অমর, ধ্বংসহীন। তাই যদি হয়, তবে এ অমরত্বের জন্য এত আকুলতা কেন? আসলে, বস্তু আত্যন্তিক ধ্বংসহীন সত্য, কিন্তু পরিবর্তনের অধীন। এই পরিবর্তনই মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, অথবা এই পরিবর্তনকেই মানুষ মৃত্যু নামে অভিহিত করে। এই পরিবর্তিত অবস্থা অবধারিত এবং অজ্ঞাত। তাই মানুষ মৃত্যু নামে অভিহিত পরিবর্তনকে ভয় করে। বাস্তবিকপক্ষে মৃত্যু দুঃখজনক না হলেও ব্যবহারিক হিসেবে, সংসারের অথবা সাধনার দিক দিয়ে এই পরিবর্তন জীবের পক্ষে অশান্তিজনক বটে। সেইজন্যই। উচ্চশ্রেণীর সাধকেরা ইহজগতে দীর্ঘজীবনের কামনা করেন, এমন কি অমরত্বও প্রার্থনা করেন। অবশ্য সাধকদের অমরত্ব তাদের জীবন্মুক্ত অবস্থায় পৌঁছিয়ে দেয়। কিন্তু অমরত্ব প্রাপ্তির জন্য যে প্রার্থনা তার একটা বিশেষ অর্থ আছে। এই জন্মজরামরণরূপ পরিবর্তনের হাত থেকে চিরতরে উদ্ধারলাভ করাই অমরত্বপ্রাপ্তির উদ্দেশ্য। মানুষ যদি এই সব পরিবর্তনকে পরিত্যাগ করতে পারে, অথবা এই সব পরিবর্তন যদি মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে তাহলে মানুষ এই সব দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এই দিক দিয়েও অমরত্বলাভ বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অমরত্ব লাভের এর চেয়েও গভীরতর ও মহত্তর উদ্দেশ্য বর্তমান আছে। প্রকৃত অমর কে? যাঁর ধ্বংস নেই, পরিবর্তন নেই, অক্ষয় অব্যয়, তিনিই অমর। সামান্য মানব কিভাবে সেই অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা করতে পারে? হ্যাঁ, পারে। মানুষ সামান্য জীব নয়। মানুষ অমৃতের পুত্র; অমৃতস্বরূপ ভগবান্ থেকেই সে এসেছে। মোহমায়া অজ্ঞানতার আবরণ ছিন্ন করে যখন সে সেই স্বরূপত্বে অমৃতত্ত্বে ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আকুল প্রার্থনা করে, তখনই ভগবানের কৃপায় সে তথাকথিত ধ্বংস অথবা পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা পায়। কারণ তখন সে রিপু প্রভৃতির আক্রমণের বহির্ভূত হয়ে ঈশ্বরে সম্পূর্ণ সমর্পিত হতে পারে। তখন অবশ্যই তার আত্যন্তিক দুঃখের নিবৃত্তি হয়। দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই সুখ। এই সুখেরই অপর নাম মোক্ষ। তাই, অমৃতের সাথে সুখের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বর্তমান আছে। — দেখা যাচ্ছে, এই মন্ত্রে দুটি বিষয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ অমৃতত্বপ্রাপ্তি, দ্বিতীয়তঃ পরাজ্ঞান লাভ। উভয়েরই উদ্দেশ্য এক। অথচ এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ লক্ষণীয় হে জল! তুমি সুখের আধারস্বরূপ। তুমি অনুসঞ্চয় করে দাও। তুমি অতি চমৎকার বৃষ্টিদান করো। – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই মন্ত্রটি শুক্লযজুর্বেদের ১১শ অধ্যায়ের ৩০শ কণ্ডিকায় পরিদৃষ্ট হয়]।

৯/২– হে দেবগণ! আপনাদের যে অমৃত পরম মঙ্গলদায়ক, পুত্ৰমঙ্গলকামী মাতা যেমন পুত্ৰবৰ্গকে স্তন্যসুধা প্রদান করেন তেমনভাবে আপনারা আমাদের প্রসিদ্ধ সেই অমৃত প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন। কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে জলগণ! তোমরা স্নেহময়ী জননীর মতো, তোমাদের যে রস অতি সুখকর আমাদের তার ভাগী করো। মন্ত্রের মধ্যে জলবাচক কোন শব্দ নেই। সুতরাং অনুবাদকার এবং ভাষ্যকারও জল শব্দ অধ্যাহার করেছেন। আমরা মনে করি, দেবগণকেই সম্বোধন করে বলা হয়েছে। তাঁদের অমৃত বলতে অমৃতপ্রবাহকেই লক্ষ্য করে, এবং দেবগণই মানুষকে অমৃত দিতে সমর্থ। কিন্তু ভাষ্যকার যে অর্থ গ্রহণ করেছেন, তার দ্বারা কোন সুষ্ঠু ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায় না। যেমন, জল তরলপদার্থ, তা নিজেই রস, তবে তার আবার রস থাকবে কিভারে? সুতরাং আমরা দেখছি জল শব্দকে সাধারণ অর্থে গ্রহণ করলে কোন অর্থই পাওয়া যায় না। তবে এ কি জল (পদার্থ)? অন্যত্র দেখা যায়– আপঃ নারায়ণঃ স্বয়ংঅর্থাৎ জলই নারায়ণ। আবার শ্রুতি বলছেন– রসঃ বৈ সঃ এ তিনি রসস্বরূপ। সুতরাং বোঝা যায়, রস সেই পরমপুরুষের শক্তিকেই বোঝায়, তার শক্তিই যেন তার থেকে একটু পৃথক হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে শক্তি ও শক্তিমান্ অভিন্ন। অর্থাৎ রস

শব্দে ভগবানের শক্তিকেই লক্ষ্য করে এবং মন্ত্রটি (জলের নয়) ভগবানের উদ্দেশেই উচ্চারিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত প্রার্থনার ভাব দাঁড়িয়েছে এই যে, ভগবান্ যেন কৃপা পূর্বক আমাদের অমৃত প্রদান করেন, মাতা যেমন সস্নেহে তার সন্তানের মঙ্গলকামনায় তাঁর আয়ত্তাধীন সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু দান করেন, সেইরকম তিনি আমাদের তার করুণার ধারায় অভিষিক্ত করে কৃতার্থ করুন]।

৯/৩– অমৃতস্বরূপ হে দেবগণ! আপনারা যে পাপের বিনাশে প্রীত হন, সেই পাপক্ষয়ের জন্য ক্ষিপ্র আপনাদের যেন প্রাপ্ত হই; এবং হে দেবগণ! আমাদের পাপনাশিকা শক্তি উৎপাদন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের পাপনাশিকা শক্তি প্রদান করুন)। [ভগবানের কৃপায় আমরা যেন আমাদের মধ্যে পাপনাশিকা শক্তি সমুৎপাদিত করতে পারি। অমৃতস্বরূপ দেবতাকে সম্বোধন করে মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে। ভগবানের একটি বিশেষ ভাব মন্ত্রের প্রথমাংশে প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রের সেই অংশটি এই, যস্য ক্ষয়ায় জিন্নথ– যার বিনাশে আপনি প্রীতিলাভ করেন। এখানে যস্য পদে ভাষ্যকার যস্য পাপস্য অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমাদের মতেও। এই অর্থই সঙ্গত। কোন্ সূত্র অবলম্বন করে মন্ত্রের অকথিত পদ অধ্যাহার করা যেতে পারে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই মন্ত্রে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যাকরণের সাধারণ নিয়মই এই যে, কোন একটি পদ বা পদাংশ অধ্যাহার করলে যদি বাক্য পূর্ণতা লাভ করে, তবে সেই অধ্যাহার অবিধিজ নয়। আবার অর্থ ও ভাবের দিক দিয়েও পদ অধ্যাহার করা যায়। তারও উদাহরণ বর্তমান মন্ত্রে পাওয়া যায়। জগতের মধ্য দিয়ে, মানুষের মধ্য দিয়েই ভগবৎশক্তির বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। মানুষের মধ্যে যে শক্তির বিকাশ পরিলক্ষিত হয়, তা ভগবানেরই শক্তি। তাই ভগবানেই শক্তিলাভের কামনাই মন্ত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে জলগণ! যে পাপের ক্ষয়ের নিমিত্ত তোমরা প্রস্তুত আছ, সেই পাপক্ষয় কামনায় আমরা তোমাদের মস্তকে নিক্ষেপ করি। তোমরা আমাদের বংশবৃদ্ধি করো। এখানে ব্যাখ্যাকার জলকে সম্বোধন করে ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন। কিন্তু জল শব্দে যদি সাধারণ পানীয় বস্তু জল বোঝায়, তাহলে সেটি বহুবচনে ব্যবহৃত হবে কেন, বোঝা যায় না। বিশেষতঃ এই ব্যাখ্যাটি পড়লে মনে হয়, এটি যেন একটা স্নানের মন্ত্র, শরীরে জল দেওয়ার পূর্বে মন্ত্রটি উচ্চারণ করা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ জলের পাপনাশিকা কি শক্তি থাকতে পারে, তা-ও বোঝা দুঃসাধ্য। আবার এই ব্যাখ্যার শেষ অংশ আরও অদ্ভুত। বলা হয়েছে সেই জল যেন, আমাদের বংশ বৃদ্ধি করে। এই কথার কি অর্থ বা কি সার্থকতা থাকতে পারে, তা-ও বোঝা দুষ্কর]। [এই মন্ত্রটি শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার একাদশ অধ্যায়ের দ্বিপঞ্চাশী (৫২তম) কণ্ডিকায়ও পরিদৃষ্ট হয়]।

১০/১– হে ভগবন! আপনার কৃপায় বায়ু আমাদের হৃদয়ে ব্যাধিবিনাশক শান্তিপ্রদ ঔষধ আনয়ন। করুন; এবং আমাদের জীবনকালকে প্রবর্ধিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — বায়ু আমাদের প্রাণশক্তি দান করুন)। [বায়ু সর্বব্যাপী। বায়ু প্রাণরূপে অবস্থিত। সুতরাং বায়ু যদি মানুষের ব্যাধিনাশক ও সুখসাধক হয়, তাহলে উদ্বেগের কারণ আর বিশেষ কিছু থাকে না। তাই প্রার্থনা জানান হচ্ছে, বায়ু আমাদের ঔষধস্বরূপ তোক। বায়ু আমাদের ব্যাধিনাশক ও সুখসাধক হোক। এখানে লক্ষ্য ও করা যায়, ঋগ্বেদ-সংহিতার ভাষ্য ইত্যাদিতে এই মন্ত্রের দেবতা বায়ু বলে অভিহিত হয়েছে। কিন্তু এখানে ইন্দ্রই দেবতা বলে প্রতিপন্ন হয়। যদিও ভাষ্য ইত্যাদিতে সে ভাব প্রকাশ, নেই। কিন্তু তাৎপর্যার্থে তা-ই সিদ্ধান্তিত হয়ে থাকে। অথচ, বায়ুও একজন দেবতা। তাহলে তার শান্তিপ্রদ মূর্তি দেখবার জন্য, অন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয় কেন? এই সমস্যার সমাধানে দুরকম ভাব মনে আসতে পারে। প্রথমতঃ, সর্বদেবময় ব্রহ্ম বলে যাঁর ধারণা জন্মেছে, তার কাছে বায়ু অগ্নি ইন্দ্র সকলেই অভিন্ন। তিনি যে কোন এক দেবতাকে অবলম্বন করে মূলতঃ সেই একমেবাদ্বিতীয়। ভগবানকে সম্বোধন করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেন। আমরা সেই দৃষ্টিতেই অর্থ গ্রহণ করেছি। হে ভগবন সম্বোধন– সেই দৃষ্টিতেই সূচিত হয়েছে। — দ্বিতীয়তঃ, যাঁরা দেবতায় ভেদভাব পরিকল্পনা করেন, ইন্দ্রদেবের উপাসক হলে তারা ইন্দ্রদেবকে সম্বোধন করেই মন্ত্রটি উচ্চারণ করেছেন বলে মনে করা যেতে পারে। অথবা, বায়ুদেবতার উপাসক হলে, তাকে সম্বোধন করছেন বলে মনে করতে পারি। ফলতঃ, বিভিন্ন স্তরের ও ভাবের উপাসকের পক্ষে মন্ত্রের সম্বোধন বিভিন্ন রকমে পরিকল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু সে সব সংশয় দূর হয়– যদি সাধারণতঃ ভগবৎসম্বোধনে মন্ত্রের প্রযুক্তি স্বীকার করা যায়। প্রার্থনা– ভেষজের। কিন্তু সে ভেষজ (ঔষধ) কেমন হওয়ার প্রয়োজন? তারই সম্বন্ধে শম্ভুও ময়োভুপদ দেখতে পাই। অর্থাৎ, সেই ঔষধ শান্তিপ্রদ ও সুখদায়ক হোক। এই পক্ষে একটি পদ বিশেষ লক্ষ্য করবার আছে। সেটি হৃদে পদ। যে ঔষধ প্রার্থনা করা হচ্ছে, তা যেন হৃদয়ে আসে– এটাই, এখানকার আকাঙ্ক্ষা। সুতরাং এখানে প্রার্থী কি সামগ্রী চাইছেন, সহজেই বুঝতে পারা যায়। হৃদয় নির্মল হোক, হৃদয়ের কলুষকালিমা দূরে যাক, হৃদয়ে চিরশান্তি বিরাজ করুক, এই প্রার্থনাই এখানে প্রকাশমান। — কিন্তু ভাষ্যের অর্থের অনুসারী হতে হলে পক্ষান্তরে এখানে জলের (বৃষ্টির) কামনা প্রকাশ পেয়েছে প্রতিপন্ন হয়। কেননা, ভাষ্যে ভেষজঃ পদের প্রতিবাক্যে ঔষধং উদফং বা পদ-সমষ্টি দৃষ্ট হয়। একটি হিন্দী অনুবাদে এই অনুসরণই দেখতে পাই। কিন্তু প্রচলিত বাংলা বা ইংরেজী অনুবাদে সেই ভাব প্রকাশমান নয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৭দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়। ঋগ্বেদে সামান্য পাঠান্তর আছে]।

১০/২– হে আশুমুক্তিদায়ক দেব! আপনি আমাদের পালক এবং জনয়িতা হন; অপিচ, আমাদের ভ্রাতৃস্বরূপ স্নেহপরায়ণ হন; এবং আমাদের বন্ধুস্বরূপ হন; অপিচ, প্রসিদ্ধ সেই আপনি আমাদের সৎকর্মসাধনসামর্থ্য সম্পাদন করুন। (এই মন্ত্র নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই লোকবর্গের পিতাভ্রাতাবন্ধুস্বরূপ হন; তিনি আমাদের সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন)। [মন্ত্রের সম্বোধ্য পদ বাতঅর্থাৎ বায়ু। ভগবানের বিভিন্ন বিকাশের উপাসনা বেদের নানাস্থলে পরিদৃষ্ট হয়। বায়ু-ও ভগবানের অন্যতম বিভূতি। এইভাবে ভগবান সাধকের অভীষ্ট শীঘ্র সম্পাদন করেন, অথবা বায়ুর তীব্রগতির দ্বারা ভগবানের আশুমুক্তির স্বরূপ বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে বলে বায়ু-কে আশুমুক্তিদায়ক বলা হয়। অগ্নিরূপে আমরা ভগবানের জ্ঞানের– জ্যোতিঃর সন্ধান পাই, ইন্দ্ররূপেতার ঐশ্বর্যের, বীর্যের পরিচয় পাই। সেইরকমই আমরা বায়ুরূপে তাঁর যে বিভূতির পরিচয় পাই, তার নাম আশুমুক্তিদায়ক শক্তি। বায়ুরূপে সেই ভগবানেরই প্রকাশ। মন্ত্রে এই ভগবৎ-বিভূতির আরাধনাই পরিদৃষ্ট হয়। তিনি মানুষের পিতা, মাতা, ভ্রাতা, বন্ধু, সবই। পিতারূপে তিনি জগৎ সৃষ্টি করছেন, মাতারূপে তিনি পালন করছেন। পিতার শাসন ও মাতার স্নেহই জগৎকে ধারণ করে।  আছে। আবার তিনিই মানুষকে বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করে তাকে সৎ-মার্গে মোক্ষমার্গে প্রেরণ করেন– সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বন্ধুর কাজ করেন। সুখে দুঃখে তিনিই ভ্রাতার মতো মানুষের সঙ্গী সুখদুঃখের ভাগী। সেই বিশ্ববন্ধুর কাছে আরও একটি প্রার্থনা করা হয়েছে তিনি যেন কৃপা করে আমাদের দীর্ঘজীবন প্রদান করেন। সৎকর্মের দ্বারাই মানুষের আয়ুঃ নিরূপিত হয়। যে হাজার বৎসর পৃথিবীতে থেকেও কোন সকার্য করতে পারল না, তাকে জীবন-মৃত বলা যেতে পারে। অপরপক্ষে অল্পসময় জীবনধারণ করে যিনি সৎকর্ম সম্পাদন করতে পারলেন, তার জীবনধারণই সার্থক। আমরা, এইদিক দিয়েই জীবাতবে পদের অর্থ গ্রহণ করেছি]।

১০/৩– আশুমুক্তিদায়ক হে দেব! আপনার স্থানে নিগূঢ় যে অমৃত আছে সৎকর্মসাধনের জন্য আমাদের সেই অমৃত প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [বর্তমান মন্ত্রে দেখতে পাই– যদদঃ অমৃতং গুহা নিহিতংঅর্থাৎ সেই অমৃত গুহানিহিত অর্থাৎ লুক্কায়িত, যা লাভ করা কঠোর সাধনাসাপেক্ষ। এ থেকেই মহাভারতে বকরূপী ধর্মের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন– ধর্মস্য তত্ত্বঃ নিহিতঃ গুহায়াঃ– ধর্মের তত্ত্ব গুহানিহিত। বাস্তুবিক, ধর্ম এবং অমৃত কেবলমাত্র কঠোর সাধনার দ্বারাই লাভ করা যায়। যিনি সেই তত্ত্ব অবগত আছেন, তিনিই অমৃতলাভে সমর্থ হন। সেই ধর্মতত্ত্ব অধিগত হয় কঠোরসাধনা এবং সৎসঙ্গের দ্বারা। সাধুগণ ধর্মের তত্ত্ব সম্যকরূপে অবগত আছেন, সুতরাং সাধুসঙ্গের দ্বারা সেই পরমতত্ত্ব অবগত হতে পারেন। তাই সাধুসঙ্গের এত মহিমা পরিকীর্তিত হয়। — মন্ত্রের সোধ্যদেবতা বায়ু সম্পর্কে পূর্ব মন্ত্রেই আলোচনা করা হয়েছে। এখানেও ভগবানের সেই এক বিভূতিকেই লক্ষ্য করে প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে। সেই প্রার্থনা– তস্য নঃ ধেহি জীবসে– দীর্ঘায়ুঃ লাভের জন্য আমাদের সেই পরম অমৃত প্রদান করুন। অমৃতপ্রাপ্তি শুধু দীর্ঘায়ুঃ লাভের কারণ নয়, অমরত্ব লাভের হেতুও বটে। অর্থাৎ অমৃতের দ্বারা অমরত্বের প্রাপ্তি ঘটে। এটাও পূর্বৰ্মন্ত্রে বিবৃত হয়েছে। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ- হে বায়ু! তোমার গৃহমধ্যে ঐ যে অমৃতের নিধি সংস্থাপিত আছে, তা থেকে অমৃত নিয়ে দাও, আমাদের জীবন দান করো। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, পূর্বৰ্মন্ত্রের প্রচলিত বঙ্গানুবাদে বায়ুর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, বায়ু যেন প্রার্থনাকারীকে জীবনের ঔষধ করে দেন]।

১১/১– ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক সর্বপ্রকাশশীল পরমশক্তিসম্পন্ন ভগবান্ সকলের মূলীভূত পরম কল্যাণদায়ক জ্যোতির্ময় পরাজ্ঞান আমাদের প্রদান করুন। সর্বকালে প্রকাশমান্ উজ্জ্বল অজ্ঞানতানাশক পরাজ্ঞান পূর্ণতেজের সাথে আমাদের অভিমুখে আগমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরম কল্যাণদায়ক পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রটি দুটি অংশে বিভক্ত। উভয় অংশেই জ্ঞানলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথম অংশের প্রার্থনা সাক্ষাৎভাবে ভগবানের চরণে নিবেদিত হয়েছে, আর দ্বিতীয় অংশে সেই এক প্রার্থনাই একটু ভিন্নভাবে পরিব্যক্ত হয়েছে। প্রথম বাজী বিশ্বরূপঃ সুপর্ণঃ পদ তিনটি ভগবানের মহিমাদ্যোতক। বাজী শব্দের অর্থ বলবান। চরম-উৎকর্ষের প্রতীক, যাঁতে শক্তি পূর্ণতা লাভ করেছে, অথবা যিনি শক্তির উৎস, তাকেই এই বাজী শব্দে বোঝাচ্ছে। ভগবানই শক্তির আধার, তার থেকেই সমগ্র বিশ্ব শক্তিলাভ করে। তাই তিনি বাজী। আবার তিনি বিশ্বরূপঃ অর্থাৎ সর্ব-বিশ্বরূপ-ধারণক্ষম। বিশ্বের সমস্তই তার প্রতীকমাত্র। আবার সুপর্ণঃ পদের দ্বারা আমরা ভগবানের যে ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক রূপের ভাব গ্রহণ করি, মন্ত্রে তারই ভাব পরিস্ফুটিত। পূর্বে বহুত্র এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। — এই মন্ত্রের প্রথম অংশের দ্বিতীয় ভাগে আছে — আমাদের সেই পরমরমণীয় পরাজ্ঞান প্রদান করুন। হিরন্ময়ং পদে ভাষ্যকার হিরন্ময়মিব স্থিতং অর্থ করেছেন; কিন্তু হিরণ্যয় শব্দে হিতকারক এবং রমণীয় বস্তুকেই বোঝায়। সেই পরমবস্তু– জ্ঞান। বিভ্রং অকং পদ দুটিতে সেই বস্তুকেই লক্ষ্য করছে। এই জ্ঞানের আরও একটি বিশেষণ দেওয়া হয়েছে- জনিং , অর্থাৎ জগতের কারণভূত। জ্ঞান থেকে জগতের উৎপত্তি। জ্ঞানের দ্বারাই বিশ্ব বিধৃত। জ্ঞানের অভাবই জগতের ধ্বংস। জ্ঞানের আলোকই সকল জীবন; জ্ঞানের অভাবই অজ্ঞানতা, অজ্ঞানতাই মৃত্যু। তাই জ্ঞান—জনিং মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের ভাব– পরাজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক। এটা ভগবানের কাছে পরোক্ষভাবে জ্ঞানলাভের জন্য প্রার্থনা]।

১১/২– সর্বরূপধারণসমর্থ শক্তিরূপ যে জ্যোতিঃ অমৃতে মিশ্রিত হয়ে ভূলোকের সকল মানুষে বর্তমান থাকে, সেই তেজঃই আপন মহিমায় দ্যুলোকে ব্যাপ্ত হয়; অর্থাৎ পরাজ্ঞানের দ্বারা লোকসমূহ মোপ্রাপ্ত হয়। অভীষ্টবর্ষক জ্ঞানদায়ক দেবতার সারভূত শক্তি জ্ঞান প্রদান করে, অর্থাৎ জ্ঞানদায়িকা হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের দিব্যশক্তি দ্যুলোক-ভূলোকে বর্তমান থাকে; তার দ্বারা লোকেরা মোক্ষ লাভ করে)। [ভগবানের শক্তি সর্বত্র বর্তমান আছে, সেই শক্তিকে বিশ্বরূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বরূপ এই জন্য যে, সেটি সকলরকম রূপের মধ্যে বর্তমান থাকে। মানুষ, পশুপাখী থেকে আরম্ভ করে তৃণগুল্ম প্রস্তর পর্যন্ত, যা কিছু দৃশ্য বা অদৃশ্য আছে, তা সমস্তই সেই এক অদ্বিতীয়ের বিকাশ। সুতরাং সেই পরমপুরুষের শক্তি এই সমস্ত বস্তুতেও বর্তমান থাকে। অথবা সেই একই শক্তি লীলায় বহুরূপ ধারণ করে। সেইজন্যই শক্তিকে বিশ্বরূপ বলা হয়েছে। কিন্তু এই শক্তি কিভাবে জগতে প্রকাশিত হয়? — জ্যোতিঃরূপে, জ্ঞানরূপে, চৈতন্যরূপে এই শক্তি বিশ্বে প্রকাশিত হয়। বিশ্ব একচৈতন্য-স্বরূপের বিকাশমাত্র। জগতের সমস্ত বস্তুতে সেই চৈতন্য প্রকাশিত আছেন। তাই মন্ত্রে বলা হয়েছে বিশ্বরূপং তেজঃ। সেই চৈতন্যশক্তি যখন অমৃতপ্রবাহের সাথে মিলিত হয়, তখন মানুষ ঊর্ধ্বলোকে গমন করতে সমর্থ হয়, মোক্ষলাভ করে। মন্ত্রে তা-ই পরিব্যক্ত হয়েছে। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে– ভগবানের জ্ঞানশক্তিই মানুষকে জ্ঞানসম্পন্ন করে, অর্থাৎ ভগবানের শক্তিই মানুষের মধ্যে বিসর্পিত হয়। অথবা মানুষ ভগবানের কাছ থেকেই পরাজ্ঞান লাভ করে]।

১১/৩– দ্যুলোক-ভূলোকের ধারণকর্তা, লোকসমূহের অধিপতি, কল্পতরুর ন্যায়, বহুরকম শক্তিযুক্ত সৎকর্মসাধক (অথবা সৎকর্মাধিপতি) জ্ঞানাধিপতি প্রসিদ্ধ মহান্ দেবতা সাধকবর্গকে জ্ঞান প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় সাধকেরা পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [দিবঃ ভুবনস্য ধর্তা- দ্যুলোক-ভূলোকের ধারণকর্তা। শুধু দ্যুলোক-ভূলোক নয়, সপ্তলোক, সপ্তস্বর্গ, সপ্তপাতাল- এককথায় বলতে গেলে সমগ্র নিখিল ব্রহ্মাণ্ড তাঁর মধ্যে অবস্থিত আছে, তিনি তা ধারণ করে আছেন। কিন্তু ধারণ করাই যথেষ্ট নয়, তিনি রক্ষণ ও পালনও করেন। তিনি বিশ্বপতি– বিপতি। পতি শব্দের অর্থ কেবলমাত্র প্রভূত্বসূচক নয়। পালনার্থক পাধাতু থেকে পতি শব্দ নিষ্পন্ন। সুতরাং  বিপতি পদের মধ্যে পালন অর্থই সমধিকভাবে প্রকাশিত। সেই পালনকার্য কিভাবে সম্পন্ন হয়, তা শতদা সহস্রদাঃ ভূরিদাবা পদগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। সাধক যেন ভগবানের মহান্ দানের পরিমাণ করতে গিয়ে নিজের বর্ণনাশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। প্রথমে বললেন, ভগবান্ যে ধন দান করেন, তা শত (শতদা) সংখ্যক। কিন্তু এতেও তৃপ্ত না হয়ে বললেন  এ সহস্রদা অর্থাৎ শতদা পদে যা বোঝায়, তার চেয়েও বেশী। কিন্তু এই পদ ব্যবহার করেও সাধক যা সন্তুষ্ট নন, কারণ ভগবানের অসীমশক্তি, অসীম করুণা, তার দানও অসীম। সীমাসূচক কোন সংখ্যা বা পরিমাণ দিয়ে ভগবানের করুণা বর্ণিত হতে পারে না। সুতরাং সাধক বলছেন, ভূরিদা অর্থাৎ তিনি খুব দান করেন, প্রভূতপরিমাণে দান করেন, এত বেশী পরিমাণে দান করেন যে, তা আমরা প্রকাশ করতে পারি না। ছোট ছেলে কোন বস্তুর পরিমাণ নির্দেশ করতে না পেরে তার ক্ষুদ্র হাত দুটি বিস্তার করে যেমন বলে– এত বড়! — এই ভুরিদা পদও ঠিক যেন সেই ভাবই প্রকাশ করছে। সেই জ্ঞানস্বরূপ পরমদেবতা মানুষকে পরাজ্ঞান প্রদান করেন, অর্থাৎ সেই পরমপুরুষ থেকেই জ্ঞান মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। মন্ত্রের শেষাংশে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে। — ভাষ্যানুসারী একটি প্রচলিত হিন্দী অনুবাদ– স্বর্ণকা আউর সকল ভুবনোকা ধারণ করনেওয়ালা প্রজাওকা পালনকরনেওয়ালা যাচকোকো উনকী ইচ্ছানুসার সহস্র সৌ বা অসংখ্য ধন দেনেওয়ালা যজন করনেওয়ালা যহ অগ্নি অপনেসে মিলাহুই সহস্রে কিরণোকো চারো ওর ফৈলাতা হুআ রাত্রিমে সূর্যকে, ভী প্রকাশ কো স্বয়ং হী ধারণ করতা হ্যায়। একটি আধুনিক বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে যে, সূর্যের যজ্ঞকর্ম সকলদিকে জলের বসন পরিধান করে এই সূর্য কিরণকে ধারণ করল। সূর্যদেব সহস্ৰদাতা, শতদাতা, ভুরিদাতা, দ্যুলোকের ধাতা, ভুবনের জনগণপালক]।

১২/১– হে দেব! সর্বান্তঃকরণে আপনাকে কাময়মান সাধকবর্গ যখন মুক্তিদাতা, শুদ্ধসত্ত্বনিলয়ে নিবাসকারী, সর্বশক্তিমান্, দেবভাবপ্রদায়ক, সাধকদের আত্ম-উন্নয়নকারী, জগৎপালক, সর্বনিয়ন্তা আপনাকে আরাধনা করেন, তখন আপনি সেই সাধকবর্গকে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, ভগবৎ পরায়ণ সাধকেরা মোক্ষ লাভ করেন)। [এই মন্ত্রে আমরা ভগবানের কয়েকটি বিশেষণ দেখতে পাই। তিনি সুপর্ণ– – ঊর্ধ্বগমনই যাঁর প্রকৃতি, যিনি সাধকদের ঊর্ধ্বে নিয়ে যান। এ ঊর্ধ্ব ব্যবহারিক ঊর্ধ্ব নয়– এ আত্মার ঊর্ধ্বগমন। পতিত পাপগ্রস্ত অথবা সাধারণ প্রার্থনাকারীকে তিনি অসার মায়ানমাহের আবাস থেকে ঊর্ধ্বে সত্ত্বলোকে নিয়ে যান তাঁর চরণে আশ্রয় প্রদান করেন অর্থাৎ মুক্তি দান করেন। মানুষের পক্ষে এর অপেক্ষা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর কিছুই হতে পারে না। তিনি স্বর্গে বা শুদ্ধসত্ত্বনিলয়ে নিয়ে যান কেন? যেহেতু তিনি শুদ্ধসত্ত্বনিলয়ে নিবাস করেন, অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বভাবই তার আশ্রয়। তাই। সাধককেও সেই শুদ্ধসত্ত্বভাবের আশ্রয়ে নিয়ে যান, আর সেটাই প্রকৃত পক্ষে আত্মার ঊর্ধ্বগমন। — তিনি হিরণ্যপক্ষ– হিতকারক ও রমণীয় শক্তির অধিকারী। জগতের মঙ্গলের মূল রয়েছে তার এই শক্তিতে। হিরণ্যপক্ষ তিনি তার প্রভাবে জগতের অমঙ্গল দূর হচ্ছে বিশ্ব এক চরমমঙ্গলের দিকে চলছে। তার উপাসনায় চরমমঙ্গলই লাভ হয়। তিনি বরুণের দূত– দেবতাদের মিলন-সাধক। কার সাথে দেবভাবের সাধন হবে? সাধকের সাথে। অর্থাৎ, তিনি সাধকদের হৃদয়ে দেবভাব প্রদান করেন। যিনি নিজে সত্ত্বভাবের– দেবভাবের উৎস; যিনি সেই দেবভাব প্রদান করেন। যিনি সেই দেবভাব প্রদানের শক্তি ধারণ করেন, তিনি বরুণের দূত- ভগবান্ স্বয়ং। মুক্তিলাভের প্রধান উপায়-হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উপজন। ভগবান্ মানুষের হৃদয়ে এই দেবভাব সঞ্চার করতে পারেন আর সাধকের মঙ্গলের জন্য তা করেনও; সেই জন্য তাঁকে দেবভাব-প্রদাতা বলা হয়েছে। তিনি শকুন– সাধকদের আত্ম-উন্নয়ন-বিধায়ক। প্রচলিত ভাষ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে– শকুনং পক্ষিরূপেণ বর্তমানং। কিন্তু নিরুক্তে আছে শকোত্যুন্নেতুমাত্মানং। তাই আমরা শকুনং পদে সাধকানাং আত্মোন্নয়নকারিণংঅর্থ গ্রহণ করেছি। তিনি ভুর– জগৎপালক। তার শক্তিতে, তাঁর কৃপায় জগৎ পরিপালিত হচ্ছে — জগৎ পরিচালিত হচ্ছে। তার শক্তি না হলে জগৎ নির্জীব, অচল। তিনি জগৎ ধারণ করে আছেন, জগৎপোষণ করছেন। তিনি জগতের পিতা; জগতের মঙ্গলের জন্য, জগতের রক্ষার জন্য একমাত্র তার শক্তিই ক্রিয়াশীল। তাই তিনি ভুরণ্য। তিনি যমস্য যোনৌ– সর্বনিয়ন্তা, বিশ্বের নিয়ামক। তিনি ভিন্ন অন্য শক্তি জগতে নেই। — সেই পরমদেবতাকে কামনাকারী সাধকেরা, তাঁকেই প্রাপ্ত হয়। সেই সাধক কেমন? তারা হৃদা বেনন্তঃ — তাঁরা সর্বান্তঃকরণে ভগবানকে কামনা করেন। শুধু ডাকলেই হয় না। তনুমন প্রাণ সব সমর্পণ করে তাঁকে ডাকা চাই– তবেই তার শ্রীচরণাশ্ৰয়লাভ ঘটে থাকে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৯দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১২/২– তার বিচিত্র রক্ষাস্ত্রসমূহ ধারণ করে জ্ঞানদায়ক দেবতা ঊর্ধ্বলোকে অর্থাৎ দ্যুলোকে আমাদের অভিমুখ হয়ে বর্তমান আছে; পরাজ্ঞান-প্রদানের জন্য পরমসুখদায়ক দেব দিব্য প্রিয়বস্তুসমূহ সাধকদের প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকদের পরমধন প্রদান করেন)। [জ্ঞান দ্যুলোকের অধিবাসী, মর্ত-মানবের জন্য তিনি পৃথিবীতে নেমে আসেন। তাঁর কৃপায় মানুষ জ্যোতিঃর সন্ধান পায়, অথবা জ্ঞানই দিব্যজ্যোতিঃ। মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, সেই পরমজ্ঞান তার রক্ষাস্ত্রের সাথে আমাদের অভিমুখী হয়ে আছেন অর্থাৎ আমাদের রক্ষার জন্য ভগবানের জ্ঞানশক্তি সর্বদাই প্রস্তুত আছে। ভগবান্ সর্বদাই আমাদের তাঁর দিব্যজ্যোতিঃর দ্বারা পরিচালিত করতে উৎসুক এবং যাঁরা তাঁর সেই পরিচালনাধীনে থাকেন, তাদের ভগবান সততই সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করেন। কারণ জ্ঞানের শক্তি বিপদ নাশ করে। মানুষ অজ্ঞানতার প্ররোচনায় পাপ পথে পদার্পণ করে, নিয়গামী হয়, আবার যখন সে ভগবানের কৃপায় সৎপথের সংবাদ জানতে পারে, তখন সেই পথেই চলতে চায়। কারণ মানুষ বাস্তবপক্ষে পাপী নয়, অথবা অসৎপথে চলাই তার প্রকৃতি নয়। কিন্তু যখন রিপুগণ কর্তৃক আক্রান্ত হয় যখন মায়ার জালে আবদ্ধ হয়, তখন সে নিরয়গামী হয়। কিন্তু জ্ঞানের মহিমাবলে মানুষ সেই বিপদ থেকে উদ্ধার লাভ করতে পারে, তাই জ্ঞানকে রক্ষাস্ত্রধারী বলা হয়েছে। আবার সেই পরমদেবতা, মানুষকে কেবলমাত্র জ্ঞানের অধিকারী করেন না, মানুষকে তার অভীষ্ট বস্তুও প্রদান করেন। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ লক্ষণীয়– সেই গন্ধর্বরূপী যেন স্বর্গের উন্নত প্রদেশে উন্নতভাবে দণ্ডায়মান হলেন। তিনি চতুর্দিকে বিচিত্র অস্ত্রশস্ত্র ধারণ করে আছেন; তিনি নিজের অতি সুন্দর মূর্তি আচ্ছাদন করেছেন। এইভাবে অন্তর্হিত হয়ে তিনি অভিলষিত বৃষ্টিবারি উৎপাদন করছেন। — কিন্তু এই ব্যাখ্যাটি ঠিক মূলানুগত তো বলাই যায় না, অধিকন্তু ভাষ্যের সাথেও এই বঙ্গানুবাদের যথেষ্ট অনৈক্য রয়েছে। এবার ভাষ্যানুসারী একটি হিন্দী অনুবাদও লক্ষ্য করা যেতে পারে- উপর বর্তমান জলোকা ধারণ করনেওয়ালা যেন হমারে অভিমুখ হোতা হুআ অন্তরিক্ষ মে স্থিত হোতা হ্যায়। ক্যা করতা হুআ অপনে আশ্চর্যভূত আয়ুর্ধেকো ধারণ করতা হুআ দর্শনকে লিয়ে সুন্দর আর কৈলানেওয়ালে আপনে রূপকো সর্বত্র আচ্ছাদন করতা হুআ জ্যায়সে সূর্য অপনে রূপকো দিখানে কে লিয়ে সর্বত্র ব্যাপজাতা হ্যায় ত্যায়সে। তদনন্তর জলোকো সবকে অনুকূল করতা হ্যায় অর্থাৎ বরষা করতা হ্যায়। ভাষ্যের সাথে প্রচলিত বঙ্গানুবাদের, প্রচলিত হিন্দী অনুবাদের সাথে বঙ্গানুবাদের এবং তিনটির সাথেই আমাদের মন্ত্রার্থের পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। কোনটি সঙ্গত তা পাঠকেরই বিবেচ্য]।

১২/৩– দ্যুলোকস্থ অমৃতদায়ক জ্ঞানদায়ক দেবতার জ্যোতির সাথে বিশ্বপ্রকাশক মহান্ দেবতা, যখন সাধকদের অমৃত-সমুদ্র প্রাপ্ত করান, তখন দীপ্যমানন্ জ্ঞানদেব উজ্জ্বল তেজের সাথে স্বলোকে সাধকের অভীষ্ট সম্পাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকদের দিব্যজ্ঞান এবং পরম অভীষ্ট প্রদান করে তাদের প্রার্থনা পূর্ণ করেন)। [ভগবান্ সকলকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করে, অভীষ্ট বস্তু প্রদান করে, তাদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন। এটাই মন্ত্রের প্রধান মর্ম। অথচ একটি প্রচলিত বাংলা অনুবাদ লক্ষণীয়– বেনদেব জলরূপী, তিনি নিজকর্ম সাধনকালে গৃধ্রের তুল্য দূরবিস্তারি চক্ষুর দ্বারা দৃষ্টি করতে করতে আকাশস্বরূপ সমুদ্রের দিকে গমন করেন। তিনি শুভ্রবর্ণ আলোকের দ্বারা দীপ্যমান হন। দীপ্যমান হয়ে তিনি তৃতীয় লোকে অর্থাৎ আকাশের উপরিভাগ থেকে সর্বলোকবাঞ্ছিত বলের সৃষ্টি করেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যের পার্থক্য আছে। যেমন, ভাষ্যানুসারী একটি হিন্দী অনুবাদ– অন্তরিক্ষমে স্থিত আউর জলকী বিন্দুওয়ালা, রসকো চাহেনেওয়ালে সূর্যকে তেজসে প্রকাশিত হুআ বেন জব মেঘকী ওরকো জাতা হ্যায়, তব সূর্য স্বচ্ছ তেজসে তীসরে লোকমে দীপ্ত হোতা হুআ সবকে প্যারে জলকো বর্ষা করতা হ্যায়। প্রচলিত ব্যাখ্যাতে গৃস্য পদে গৃ নামে পরিচিত পক্ষীবিশেষকে লক্ষ্য করা হয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকার এর অর্থ করেছেন, রসানভিকাঙক্ষতঃ সূর্যস্য; আমাদের মনে হয় এই অর্থই সঙ্গত। আমরা এই ভাবেই অর্থ গ্রহণ করেছি। সাধক যখন ভগবানের কৃপার উপযুক্ত শক্তি লাভ করে জ্ঞানলাভ করে উধ্বলোকে গমন করতে সমর্থ হন। ভগবানের এই করুণার বিষয়ই মন্ত্রে প্রখ্যাপিত হয়েছে।

বিংশ অধ্যায় (দ্বিতীয়াংশ) সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী