উত্তরাৰ্চিক — দশম অধ্যায়

এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে)– ১-৭।১১-১৩। ১৬-২০ পবমান সোম; ৮ পবমানী অধ্যেতা স্তুতি; ৯ অগ্নি; ১০।১৪।১৫।২১-২৩ ইন্দ্র।
 ছন্দ–- ১৯ ত্রিষ্ঠুভ; ২-৭।১০।১১।১৬।২০।২১ গায়ত্রী; ৮।১৮।২৩ অনুষ্ঠুভ; ১২ (১ ও ২ সাম), ১৪।১৫ প্রগাথ; ১৩ (৩ সাম), ১৯ দ্বিপদা বিরাট;
১৩ জগতী; ১৪ নিবৃদবৃহতী; ১৭।২২ উষ্ণিক্; এবং ১২।১৯ দ্বিপদা পঙক্তি।
ঋষি– প্রতি সূক্তের শেষে উল্লেখিত হয়েছে।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– অক্রাসমুদ্রঃ প্রথমে বিধর্ম: জনয়ন্ প্রজা ভুবনস্য গোপাঃ। : বৃষা পবিত্রে অধিসানো অব্যে বৃহৎ সোমো বাবৃধে স্বানো অদ্রিঃ ॥১৷৷ মৎসি বায়ুমিষ্টয়ে রাধসে নো মৎসি মিত্রাবরুণা পুয়মানঃ। মৎসি শর্ধো মারুতং মৎসি দেবান্ মৎসি দ্যাবাপৃথিবী দেব সোম৷২ মহত্তসোমো মহিষকারাপাং যগর্ভোহবৃণীত দেবা। অদধাদিন্দ্রে পবমান ওজোহজনয়ৎ সূর্যেজ্যোতিরিন্দুঃ ৷৷৩৷৷

সূক্ত ২– এষ দেবো অমর্ত্যঃ পর্ণবীরিব দীয়তে। অভি দ্রোণান্যাসদম্৷১। এষ বিরৈভিষ্ণুতোহপো দেবো বি গাহতে। দধরত্নানি দাশুষে৷৷২৷৷ এষ বিশ্বানি বার‍্যা শূরো যন্নিব সত্বভিঃ। পবমানঃ সিসতি ৷৷৩৷৷ এষ দেবো রথতি পবমাননা দিশস্যতি। আবিষ্কৃণোতি বগবনু৷৷৷৷ এষ দেবো বিপভিঃ পবমান ঋতায়ুভিঃ। হরিবাজায় মৃজ্যতে ॥৫॥ এষ দেবো বিপা কৃতোহতি হুরাংসি ধাবতি। পবমাননা অদাভ্যঃ ৷৷৬৷৷ এষ দিবং বি ধাবতি তিরো রজাংসি ধারয়া। পবমানঃ কনিক্ৰদৎ৷৷৷৷ এষ দিবং ব্যাসরৎ তিরো রজাংস্যস্তৃতঃ। পবমানঃ স্বরঃ ॥৮॥ এষ প্রত্নেন জন্মনা দেবো দেবেভ্যঃ সুতঃ। হরিঃ পবিত্রে অষতি৷৯৷৷ এষ উ স্যপুরুব্রতো জজ্ঞানো জময়য়িন্নষঃ। ধারয়া পর্বতে সুতঃ ॥১০৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– বিশ্বের ধারণকারী সকলের রক্ষক দেবতা সকলের সৃজন করেন; আদিভূত, সমুদ্রের ন্যায় অসীম তিনি সমস্তকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকলের শ্রেষ্ঠ হন; (ভার এই যে, সকলের অধিপতি ভগবান্ বিশ্ব সৃষ্টি ও রক্ষা করেন); কামনাপূরক, বিশুদ্ধ, পাপনাশে পাষাণের ন্যায় কঠোর, অভীষ্টবর্ষক, মহান্ সত্ত্বভাব.জ্ঞানযুক্ত পবিত্র হৃদয়ে বর্ধিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — পবিত্র হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব উপজিত হয়)। [সোমঃসত্ত্বভাব। মন্ত্রের প্রথমাংশে বিশ্বস্রষ্টা, বিশ্বধারক আদি ও অন্তময় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ও তুলনারহিত ভগবানের মহিমা ব্যক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়াংশে সত্ত্বভাবলাভের উপায় বিবৃত হয়েছে। সেই উপায় হৃদয়ের পবিত্রতা]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৬দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১/২– আমাদের হৃদয়স্থিত হেসত্ত্বভাব! পবিত্রকারক তুমি আমাদের অভীষ্ট-প্রাপ্তির আশুমুক্তিদায়ক দেবতাকে তৃপ্ত করো; মিত্রভূত এবং অভীষ্টবর্ষক দেবতা দুজনকে তর্পণ করো; বিবেকশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করো; এবং দেবতাসমূহকে সঞ্জীবিত করো; হে দেব! পরমধনলাভের জন্য দ্যুলোক-ভূলোকস্থিত সকলকে পরমানন্দ প্রদান করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবের দ্বারা আমরা যেন দেবত্ব লাভ করি– মোক্ষপ্রাপ্ত হই; সকলজীব পরমানন্দলাভ করুক)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! ক্ষরণকালে যজ্ঞকার্য ও অন্নের জন্য ইন্দ্রকে মত্ত করো; মিত্র ও বরুণ এবং বায়ুকে মত্ত করো। মরুঙ্গণের দলকে মত্ত করো। হে সোমদেব! সকল দেবতাকে মত্ত করো। দ্যুলোক ও ভূলোককে মত্ত করো। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরস নামক মদ্যকে দিয়ে সব দেবতা সহ স্বর্গ-মর্ত্য সকলকে মত্ত করতে আহ্বান জানান হয়েছে। সোমরসের প্রভাবে সকলে, মাতাল হয়ে থাক, সমগ্র বিশ্ব সোমরসে ডুবে থাক। প্রার্থনাটা নিতান্ত মন্দ নয়। সমস্ত লোক মাতাল হোক, — এমন প্রার্থনা খুব অধঃপতিত মাতালের মুখ দিয়েও সম্ভবত বাহির হয় না। যাই হোক, আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সোম অথবা শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবৎ-শক্তির কাছেই এই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। কিসের প্রার্থনা? সমস্ত দেবতাকে (ভগবানের বিভিন্ন বিভূতিকে) আনন্দিত তৃপ্ত করবার জন্য। এক উদ্দেশ্য কি? ইষ্টয়ে, অভীষ্টসিদ্ধির জন্য। কেমন করে সেই অভীষ্টসিদ্ধি হবে? তার উত্তর এই প্রার্থনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ভগবান এক, বহু তাঁরই অভিব্যক্তি মাত্র। সেই সমস্তেই এই মন্ত্রের মধ্যে ২ আরাধনা করা হয়েছে। আমাদের শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা যেন ভগবানের পূজা করা হয়, তিনি যেন সেই পূজোপহার কৃপাপূর্বক গ্রহণ করেন। পৃথিবীর সকল লোক পরমানন্দ লাভ করুক। মন্ত্রের মধ্যে এই প্রার্থনাই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। সোমহে সত্ত্বভাব। বায়ুংবায়ুদেব, ভগবানের আশুমুক্তিদায়ক বিভূতি। মিত্রাবরুণাভগবানের মিত্রভূত এ অভীষ্টবর্ষক দুই বিভূতি, মিত্রদেব ও বরুণদেব। মারুতং শৰ্দ্ধ-বিবেকদেবের বল, ভগবানের বিবেকশক্তিধারী বিভূতি]।

১/৩– যে মহান তেজঃসম্পন্ন সত্ত্বভাব অমৃত উৎপাদন করেন, সেই সত্ত্বভাব দেবভাবসমূহের সাথে মিলিত হন। (ভাব এই যে, — সত্ত্বভাব অমৃত এবং দেবভাবকে সাধকের হৃদয়ে উৎপাদন করেন)। পবিত্রকারক সত্ত্বভাব ভগবানে শক্তি প্রদান করেন, অর্থাৎ সত্ত্বভাবই ভগবানের প্রধান ও পরমশক্তি; সত্ত্বভাব জ্ঞানেতে তেজ উৎপাদন করেন, অর্থাৎ সত্ত্বভাব হতে জ্ঞানের শক্তি বিকশিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাবই সকল শক্তির মূল কারণ)। [এই মন্ত্রে ভগবানের পরমশক্তি সত্ত্বভাবের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের উদয় হলে মানুষ দেবভাবাপন্ন হন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৭দ-১০সা) পাওয়া যায়]। [এই সূক্তের ঋষিপরাশর শাক্ত। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম-হাউঁহুবারিবাসিষ্ঠ, মহাসামবাজ বৈশ্বজ্যোতিষোত্তর এবং বাৎস]।

২/১– নিত্য, মোক্ষদায়ক ভগবান, পক্ষী যেমন বেগে গমন করে, তেমন শীঘ্রবেগে আমাদের হৃদয়কে অভিলক্ষ্য করে (অর্থাৎ হৃদয়ে) আগমন করেন এবং শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে– মোক্ষদায়ক ভগবান্ আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন)। [অমর্ত্যঃ পদের অর্থ মরণরহিত, অর্থাৎ যাঁর ধ্বংস নেই। জগতে একমাত্র ভগবান্ ব্যতীত আর সমস্তই ধ্বংসশীল, সুতরাং অমর্ত্যঃ এষঃ দেবঃ পদ তিনটিতে কেবলমাত্র ভগবানকেই লক্ষ্য করতে পারে– সোমরস নামক মদ্য, (ভাষ্যানুসারে), কখনই মরণরহিত হতে পারে না]।

২/২– জ্ঞানিগণ কর্তৃক আরাধিত ভগবান্ সাধককে পরমধন এবং অমৃত সম্যভাবে প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহে সাধকবর্গ পরমধন. মোক্ষ এবং অমৃত প্রাপ্ত হন)। [ভগবৎ প্রাপ্তিই অমৃতত্ব]।

২/৩– পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ সর্বশক্তিমান্ দেবতা আমাদের আত্মশক্তি প্রাপ্ত করিয়ে সকলরকমের পরমধন দান করেন। (নিত্যসত্যমূলক এই মন্ত্রটির ভাব এই যে, — পরমকারুণিক ভগবান্ সর্বলোককে পরমধন দান করতে ইচ্ছা করেন)। [শুধু গ্রহণের শক্তি অর্জন করো। বিশ্বানি বার‍্যা সিষাসতি তিনি তোমাকে পরমধনের অধিকারী করবার জন্য সদা উদ্বুদ্ধ রয়েছেন]।

২/৪– পবিত্রকারক ভগবান্ আমাদের সৎকর্ম কামনা করেন; অপিচ, আমাদের পরম-অভীষ্ট প্রদান করেন এবং আমাদের হৃদয়ে পরাজ্ঞান প্রকটিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপরায়ণ হয়ে লোকবর্গকে পরম-অভীষ্ট প্রদান করেন এবং আমাদের হৃদয়ে পরাজ্ঞান প্রকটিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপরায়ণ হয়ে লোকবর্গকে পরম-অভীষ্ট পরাজ্ঞান প্রদান করেন)। [সৎকর্মের সাথে জ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক। তাই সমগ্র মন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায়– এ যিনি সৎকর্মপরায়ণ, ভগবান্ তাকে পরাজ্ঞান, (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ জ্ঞান, স্বর্গীয় জ্ঞান) প্রদান করেন; তার অর্থাৎ সাধকের পরম অভীষ্ট সিদ্ধ হয়]।

২/৫– পবিত্রকারক পাপহারক ভগবান, সৎকর্মসাধক (অথবা সত্যকাম) স্তোতাগণের দ্বারা। আত্মশক্তিলাভের জন্য আরাধিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকেরা আত্মশক্তিলাভের জন্য ভগবানের আরাধনা-পরায়ণ হন)। [এখানে সোমরসের কোনও সন্ধানই নেই, অথচ ভাষ্যকার প্রথমেই সোমরসকে মন্ত্রের কেন্দ্ররূপে কল্পনা করেছেন। ফলে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। একটি উদাহরণ-যজ্ঞাভিলাষী স্তোতাগণ ক্ষরণশীল এই সোমদেবকে অশ্বের ন্যায় সংগ্রামের জন্য অলঙ্কৃত করেন। — অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

২/৬– পবিত্রকারক অজাতশত্রু ভগবান্ স্তুতির দ্বারা আরাধিত হয়ে শত্রুদের বিনাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ প্রার্থনার দ্বারা প্রীত হয়ে লোকবর্গকে আক্রমণকারী রিপুসমূহকে বিনাশ করেন)। [এখানেও এষঃ দেবঃ পদদুটিতে সোমরস নামক মদ্যকে নয়– ভগবানকেই লক্ষ্য করে। তিনিই অহিংসিত– অজাতশত্রু]।

২/৭– পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞান প্রদান পূর্বক লোকেদের রজোভাব অপহৃত করে ধারারূপে দ্যুলোকের ন্যায় উন্নত হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে লোকগণ স্বর্গ প্রাপ্ত হয়, মোক্ষ লাভ করে)। [এই মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বের মোক্ষপ্রাপক শক্তিই বর্ণিত হয়েছে। যাঁর হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের আবির্ভাব হয়, তিনি সাংসারিক রজো-তমোজনিত উদ্বেগজড়তার হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে উচ্চতর লোকে দ্যুলোকে গমন করতে পারেন]।

২/৮– পবিত্রকারক, অজাতশত্রু, সাধকদের সৎকর্মে প্রবর্তয়িতা, প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের রজোভাব অপসৃত করে, তাদের দ্যুলোক-উন্নত হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিতসত্যমূলক। ভাব এই যে, — পবিত্রকারক অজাতশত্রু শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের মোক্ষ প্রাপ্ত করান)।

২/৯– সৃষ্টির আদিভূত প্রসিদ্ধ দ্যুতিমান্ পাপহারক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকগণ ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সত্ত্বভাব সৃষ্টির আদিভূত। দুদিক দিয়ে এই ভাবটি হৃদয়ঙ্গম হতে পারে। সত্ত্বভাব ভগবানেরই শক্তি-সত্ত্বভাবেই বিশ্বের সৃষ্টি। সুতরাং এই দিক দিয়ে সত্ত্বভাবকে সমস্ত সৃষ্টির আদিভূত বলা যায়। আবার ত্রিগুণাত্মিক প্রকৃতির মধ্যে যখন সত্ত্বভাবের প্রাধান্য ঘটে, তখনই সৃষ্টির আরম্ভ হয়। সুতরাং সমগ্র সৃষ্টির আদিভূত কারণ সত্ত্বভাব। ভগবানের শক্তি এই সত্ত্বভাব স্বভাবতঃই পাপনাশক; কারণ ভগবানের পুণ্যস্পর্শসমন্বিত শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পাপ-তাপ আপনা থেকেই দূরে পলায়ন করে]। [এই মন্ত্রটি উত্তরার্চিকেও (২অ-৫খ-১৭সূ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২/১০– বিশুদ্ধ পবিত্র, বহুকর্মা প্রসিদ্ধ সেই শুদ্ধসত্ত্ব প্রাদুর্ভূত হয়ে সিদ্ধি প্রদান পূর্বক নিশ্চিতরূপে প্রভূতপরিমাণে সাধকদের হৃদয়ে ক্ষরিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকেরা প্রভূত পরিমাণে শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [শুদ্ধসত্ত্ব– পুরুব্রতঃ অর্থাৎ বহুকর্মা। কিভাবে? শুদ্ধসত্ত্ব সাধকের হৃদয়ে বর্তমান থেকে তাকে সৎকর্মে প্রবৃত্ত করে। শুদ্ধসত্ত্বরূপী এই ভগবৎশক্তি যার হৃদয়ে উন্মোষিত হয়, তিনি আপনা-আপনিই সৎকর্মে প্রবৃত্ত হন। বহুকর্ম দ্বারা বিশেষভাবে সব রকম সাধনাঙ্গকে লক্ষ্য করে। শুদ্ধসত্ত্ব সূতঃঅর্থাৎ পবিত্র– পবিত্রতার আধার। শুদ্ধসত্ত্ব আবার মানুষকে পবিত্র করে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রের ভাববিপর্যয় ঘটানো হয়েছে। যেমন, প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ এ এই বহুকৰ্মা সোমই (সোম-মাদকদ্রব্য) জাতমাত্রে অন্ন উৎপাদন করে ও অভিযুত হয়ে ধারারূপে ক্ষরিত হন। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– শুনঃশেপ আজিগর্তি]।

.

 দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৩– এষ ধিয়া যাত্যন্ধ্যা শূরো রথেভিরাশুভিঃ। যচ্ছন্নিস্য নিষ্কৃতম্ ৷৷১। এষ পুরু ধিয়ায়তে বৃহতে দেবতাতয়ে। যত্রামৃতাস আশতে৷২৷৷ এতং মৃজন্তি মর্জ্যমুপ দ্রোণেস্বায়বঃ। প্রচক্রাণং মহীরিষঃ ॥৩৷৷ এষ হিতো বি নীয়তেন্তঃ শুন্ধ্যাবতা পথা। যদী তুজান্ত ভূৰ্ণয়ঃ ৷৪৷৷ এষ রুক্মিভিরীয়তে বাজী শুভেভিরংশুভিঃ। পতিঃ সিন্ধুনাং ভবন্5৷৷ এষ শৃঙ্গাণি দেধুবচ্ছিশীতে যুথ্যাবৃষা। নৃশ্য দধান ওসা৷৬৷ এষ বসূনি পিনঃ পরুষাঃ যষিবা অতি। অব শাদেযু গচ্ছতি৷৭৷ এতমু ত্যং দশ ক্ষিপপা হরিং হিন্তি যাবে। স্বায়ুধং মদিন্তমম্। ৮৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৩সূক্ত/১সাম– প্রভূতশক্তিসম্পন্ন প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব সূক্ষ্মবুদ্ধি অর্থাৎ অনুগ্রহবুদ্ধির দ্বারা সাধককে প্রাপ্ত হন; এবং আশুমুক্তিদায়ক সৎকর্মের দ্বারা ভগবৎসামীপ্য লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন, তার পর সেই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত হন)। [মন্ত্রের প্রথম ভাগে সাধকের সত্ত্বভাব-প্রাপ্তির বিষয় এবং দ্বিতীয় অংশে ভগবৎ-প্রাপ্তির উপায় কথিত হয়েছে। দুটি অংশেই মন্ত্রের ভাষা এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে যে, তাতে মনে হয়– সত্ত্বভাবই বুঝি সৎকর্ম-সাধন করে, অথবা ভগবানের সমীপে গমন করে। কিন্তু মন্ত্রের প্রকৃত ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত সাধক সৎকর্ম সাধনের দ্বারা ভগবানের সামীপ্য লাভ করেন। এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা– এই বিক্রান্ত সোম অঙ্গুলি দ্বারা অভিযুত হয়ে কর্মবলে শীঘ্রগামী রথের সাহায্যে ইন্দ্রের নির্মিত (স্বর্গস্থানে) গমন করছেন। ভাষ্যের অনুসরণে ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রকে হ সোমার্থক করে তোলার জন্যই সেইমতো শব্দার্থ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সোমরস যে কি কর্ম সম্পাদন করে, আর রথের দ্বারা যে কেমন করে স্বর্গে গমন করে, তা বোধগম্য হয় না]।

৩/২– যে সৎকর্মে অমৃতপ্রাপক দেবভাবসমূহ বর্তমান থাকেন, সেই মহৎ সৎকর্মসাধনের জন্য প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের প্রভূতপরিমাণ সৎ-বুদ্ধি প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা সৎ-বুদ্ধির প্রভাবে অমৃতপ্ৰাপক সৎকর্ম সাধন করেন)। মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে, সাধকেরা সৎ-বুদ্ধির দ্বারা প্রণোদিত হয়ে সৎকর্মের সাধনে প্রযত্নপর হন। সেই সৎকর্মের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, — যত্র অমৃতাসঃ আশতঅর্থাৎ যেখানে, যে সৎকর্মে দেবভাবসমূহ বর্তমান থাকে। তার মর্ম এই যে, সৎকর্ম সাধনের দ্বারা সাধকের হৃদয়ে দেবভাব উপজিত হয়। সাধক সৎকর্মে রত হলে, সেই কর্মের প্রভাবে, তার উপযোগী মনোবৃত্তিও লাভ করেন অর্থাৎ মনও পবিত্র হয়, ভগবানের অভিমুখী হয়। ভগবৎ-প্রাপ্তিই অমৃতলাভ। সুতরাং যে কর্মের দ্বারা মন ভগবৎ-অভিমুখী হয়, ভগবানের চরণে পৌঁছায়, সেই কর্মকেই অমৃতপ্রাপক বলা যেতে পারে।

৩/৩– মহতী সিদ্ধিদাতা, শোধনীয় প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাবকে সাধকগণ হৃদয়ে বিশুদ্ধ (ধারণ) করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ অভীষ্টদায়ক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব হৃদয়ে উৎপাদন করেন)। [মহীঃ ইষঃ পদদুটিতে মহৎ সিদ্ধি অর্থাৎ মোক্ষকে লক্ষ্য করছে। যে সেই পরমবস্তু দান করতে পারে, তাকেই মন্ত্রে লক্ষ্য করা হয়েছে। (ভাষ্য অনুযায়ী) সোমরস কি মানুষকে মোক্ষ প্রদান করতে পারে? দ্রোণেষু পদে সাধকের হৃদয়রূপ পাত্রকেই লক্ষ্য করছে ১সত্ত্বভাব মানুষের হৃদয়েই অবস্থিত থাকে। সাধনার দ্বারা তাকে পরিশুদ্ধ– বিশুদ্ধ করতে হয়। মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র সত্ত্বভাবই থাকে না, তার সাথে রজঃ ও তমঃ-ও মিশ্রিত থাকে। সেই রজঃ ও তমঃকে সাধনবলে নিরাকৃত করতে হয়। হৃদয়ের মলিনতা দূরীভূত করতে পারলে সাধক শুদ্ধসত্ত্বের অধিকারী হন]।  ৩/৪-যখন সাধনাপরায়ণ ব্যক্তিগণ উধ্বগমন করেন, তখন সৎ-মার্গ অনুসরণের ও সৎকর্ম সাধনের দ্বারা পরমমঙ্গল-সাধক (অথবা বিশ্বে বর্তমান) প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাব তাদের কর্তৃক অন্তরের মধ্যে হৃদয়ে উৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকবর্গ সৎকর্ম সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে তার প্রভাবে মোক্ষ প্রাপ্ত হন)]।

৩/৫– ভগবান্ অমৃত-সমুদ্রের স্বামী হন; সর্বশক্তিমান্ সেই দেবতা সাধকগণ কর্তৃক পরাজ্ঞানের দ্বারা লব্ধ হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকেরা পরাজ্ঞানের সহায়তায় অমৃতস্বরূপ ভগবানকে লাভ করেন)। এষঃ পদে ভগবানের প্রতিই লক্ষ্য করে। তিনিই সিন্ধুনাং পতিঃ– অমৃতসমুদ্রের স্বামী, অর্থাৎ ভগবান অমৃতস্বরূপ। তার সম্বন্ধেই বাজী বিশেষণ প্রযুক্ত হয়েছে। তিনি বাজী অর্থাৎ পরমশক্তিসম্পন্ন, সর্বশক্তিমান। সাধকেরা ভগবানের চরণ লাভ করেন; কিন্তু কিভাবে? তার উত্তর– শুভ্রেভিঃ অংশুভিঃনির্মলজ্যোতির সাহায্যে, পরাজ্ঞানের সহায়তায়]।

৩/৬– ভগবান্ সাধককে পরমশক্তিদায়ক ঔৎকৰ্য্য (অথবা ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক পরাজ্ঞান) প্রদান করেন। বিশ্বপতি অভীষ্টবষক সেই পরমদেবতা আত্মশক্তির সাথে সাধককে পরমধন প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকদের পরাজ্ঞান পরমধন প্রদান করেন)। [যূথ্যঃ পদের অর্থ যূথপতি। যূথ শব্দ সমূহাৰ্থক। সুতরাং যূথপতি শব্দে সকলের.. অধিপতি, বিশ্বপতিকে, বোঝায়। তিনি মানুষকে নৃশ্য অর্থাৎ পরমধন প্রদান করেন। ভগবানই কৃপাপূর্বক মানুষকে পরমধন, পরাজ্ঞান প্রদান করেন]।

৩/৭– ভগবান্ পরমধনরোধক শত্রুদের আপনশক্তিতে বিনাশ করেন, বিনাশযোগ্য রিপুদের বিনাশ করবার জন্য তাদের প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ লোকবর্গকে আক্রমণকারী শত্রুদের বিনাশ করেন)। [একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা– এই সোম আচ্ছাদক, পীড়িত ৬ রাক্ষসগণকে পর্বত দ্বারা অতিক্রম পূর্বক তাদের অবগত হচ্ছেন। এই বাক্যের দ্বারা কোন সঙ্গত অর্থই পাওয়া যেতে পারে না। প্রচলিত ভাষ্যে সোম বলতে সোমরস নামক তরল মাদকদ্রব্য বোঝায়। এই সোমরস রাক্ষসদের অতিক্রম করবে কেমন করে? আবার পর্বত দ্বারা অতিক্রম….। এখানে কোথায়ও রূপক বা উপমা কিছুই নেই]।

৩/৮– সৎকর্মসাধনশক্তি, মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য রক্ষাস্ত্রধারী পরমানন্দদায়ক প্রসিদ্ধ সেই পাপহারক, শুদ্ধসত্ত্বকে নিশ্চিতরূপে হৃদয়ে সমুৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধনের দ্বারা মোক্ষদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব লব্ধ হয়) [ভাষ্য ইত্যাদিতে দশক্ষিপঃশব্দের দশ অঙ্গুলয়ঃঅর্থাৎ হাতের দশ অঙ্গুলি অর্থ গৃহীত হয়েছে। আমরা তা অসঙ্গত মনে করি না। দশ অঙ্গুলি দ্বারা দুটি হাতকেই বোঝায়। কিন্তু হাতের সার্থকতা কি? জিহ্বা দিয়ে যেমন শব্দ-উচ্চারণ বা বস্তুর স্বাদগ্রহণ করা হয়, চক্ষু দিয়ে যেমন দর্শন করা হয়, তেমনই হাতের নির্দিষ্ট কর্তব্য– সৎকর্ম করা। সেই জন্য দুই হাতকে সৎকর্মসাধনশক্তির প্রতীক বলে গ্রহণ করা যায়। তাই দশক্ষিপঃ পদ দুটিতে সৎকর্মসাধনশক্তিঃঅর্থই সঙ্গত। এই সৎকর্মসাধনশক্তি মানুষকে সৎকর্মেব সাধনে প্রেরণা দেয়। সেই সৎকর্মের দ্বারা পরিশুদ্ধ হলে সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হয়। তাই তাকে মোক্ষমার্গে নিয়ে যায়]। [এই সূক্তের ঋষি– অসিত কাশ্যপ বা দেবল]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৪– এষ উ স্য বৃষ রথোইব্যা বারেভিরব্যত। গচ্ছন বাজং সহণিম্ ॥১॥ এতং ত্রিতস্য যোষণো হরিং হিন্বন্ত্যদ্রিভিঃ। ইন্দু মিন্দ্রায় পীতয়ে৷২৷৷ এষ স্য মানুষীষা শ্যেনো ন বিক্ষুঃ সীদতি। গচ্ছঞ্জারো ন যোষিত৷৩৷৷ এষ স্য মদ্যো রসোহব চষ্টে দিবঃ শিশু। য ইন্দুর্বারমাবিশৎ৷৷৷ এষ স্য পীতয়ে সুতো হরিরতি ধর্ণসিঃ। এ যোনিমিভ প্রিয়৷৷৷৷ এতং ত্যং হরিততা দশ মম্‌জ্যন্তে অপবঃ। যাভমদায় শুম্ভতে৷৷৬৷

মন্ত্ৰার্থ— ৪সূক্ত/১সাম– অভীষ্টবর্ষক সৎকর্মসাধক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞানের সাথে সাধককে ৫ প্রাপ্ত হন; এবং সেই শুদ্ধসত্ত্ব, প্রভূতপরিমাণ আত্মশক্তি সাধকদের প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য মূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা পরাজ্ঞানের সাথে আত্মশক্তি এবং শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [বর্তমান। মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বের মহিমা পবিকীর্তিত হয়েছে। সাধক শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পরাজ্ঞান ও আত্মশক্তি লাভ করেন, তিনি সৎকর্মসাধনে আত্মনিয়োগ করেন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রটি, অন্যান্যগুলির মতোই, সোমার্থক-রূপে গৃহীত হয়েছে। যেমন একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই সোম অভিলাষপ্রদ ও রথস্বরূপ হয়ে যজমানকে সহস্র অন্ন লাভ করবার জন্য দশাপবিত্র দ্বারা দ্রোণে গমন করছেন। এই ব্যাখ্যা থেকে এটাই অনুমান করা যায় যে, সোমরস নামক মদ্য দশাপবিত্র নামক ছাকুনির মধ্য দিয়ে দ্রোণকলসে গমন করলে যজমান বা সাধকের অন্নলাভ হয়। কিন্তু মন্ত্রে দ্রোণকলসের কোন উল্লেখ নেই। দশাপবিত্রেরও কোন সম্বন্ধ আছে বলে মনে করা যায় না]।

৪/২– ত্রিগুণসাম্যাবস্থা-প্রাপ্ত সাধকগণ কঠোর সাধনের দ্বারা প্রসিদ্ধ পাপহারক শুদ্ধসত্ত্বকে ভগবানের গ্রহণের নিমিত্ত হৃদয়ে উৎপাদিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বকে উৎপাদিত করেন)। [ত্রিত শব্দে ত্রিগুণ সাম্যাবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে। সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই ত্রিগুণ যাঁর বশীভূত, অর্থাৎ যিনি এই গুণ তিনটির মধ্যে কোনটির অধীন নন, তাকেই ত্রিত শব্দে বোঝায়। এই সাধকেরা কি করেন? তারা ইন্দ্রস্য পীতয়েঅর্থাৎ ইন্দ্রের পানের জন্য শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উৎপাদন কবেন। ইন্দ্রদেব অর্থাৎ ভগবান্ আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করেন। ভগবৎপূজার শ্রেষ্ঠ উপকরণ এই– শুদ্ধসত্ত্ব]।

৪/৩– শ্যেনপক্ষী যেমন শীঘ্রবেগে কুলায়ে আগমন করে, (অথবা ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন সাধক যেমন ভগবানকে প্রাপ্ত হন) তেমনই শীঘ্র সেই পরমদেব ভগবান্ সাধকদের মধ্যে অর্থাৎ তাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন; সৎ-ভাববধক শুদ্ধসত্ত্ব যেমন ভগবৎসেবা– ভগবৎপরায়ণতা প্রাপ্ত হয়, তেমনই সেই পরমদেব সাধকদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন)। [মন্ত্রের মধ্যে শ্যেনঃ ন ও জারঃ ন ঘোষিত– দুটি উপমার দ্বারা ভগবানের মহিমা পরিকীর্তিত হয়েছে। প্রথমটির একভাব এই যে শ্যেনপক্ষী যেমন…..। এই উপমাটির আরও একটি অর্থ হয় এবং তা-ই অধিকতর সঙ্গত। শ্যেনঃ পদে প্রকৃতপক্ষে উধ্বগতিসম্পন্ন সাধককে বুঝিয়ে থাকে। তাই মন্ত্রার্থে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন সাধক… উল্লিখিত হয়েছে। দ্বিতীয় উপমাটির (জারঃ ন ঘোষিত) ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব যেমন সৎকর্মের সাথে– ভগবৎ-আরাধনার সাথে বিশেষভাবে সম্বন্ধযুক্ত, শুদ্ধসত্ত্ব যেমন ভগবৎ-আরাধনাকে প্রাপ্ত হয়, তেমনিভাবে ভগবানও সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। জার পদের ভাব প্রবর্ধক, সৎ-ভাব বর্ধক এবং ঘোষিতং পদের ভাবার্থ সেবাং, ভগবৎসেবাং, ভগবৎ-পরায়ণতাং ইত্যাদি। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের কি ভাব গ্রহণ করা হয়েছে, তার জন্যই একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ উদ্ধৃত হলো– এই সোম মনুষ্য প্রজাগণের মধ্যে শ্যেনপক্ষীর ন্যায় উপবেশন করছেন, উপপত্নীর নিকট যেমন উপপতি গমন করে তেমন গমন করছেন। বাঃ! কি চমৎকার বেদ ব্যাখ্যা! ভাষ্যকার আবার তার এক ডিগ্রি উপরে গিয়ে লিখেছেন, যোষিতং গচ্ছন অভিগচ্ছন জারঃ নজার ইব স, যথা সঙ্কেতিতঃ তস্যা কামপূরণায় গূঢ়গতিঃ গচ্ছতি তঘদিত্যর্থঃ।  বেশ। এবার আর ভাষ্যকার কিছুই বাকী রাখেননি। ভাষ্যের আর বঙ্গানুবাদ দেওয়া গেল না। কিন্তু গূঢ়গতিঃ বিশেষণের সঙ্গে সোমরসের গতির কোন সাদৃশ্য আছে কি? আবার উপপতি উপপত্নীর প্রসঙ্গ এনে সোমরসের সম্বন্ধে ভাষ্যকার কি নতুন তথ্য প্রচার করতে চাইলেন, বোঝা গেল না। যেমন সোমরস নামক মদ্য, তেমনই কি উপপতির উপমা? এই অপূর্ব ব্যাখ্যা-দৃষ্টে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বলে থাকেন যে, প্রাচীনকালেও বর্তমানকালের মতো সবরকমের পাপ বিরাজমান্ ছিল এবং বেদের মধ্যে উপপতি সম্বন্ধীয় উপমা থাকায় সমাজের নৈতিক আদর্শেরও নাকি পরিচয় পাওয়া যায়-হায়রে বেদ-ব্যাখ্যা]।

৪/৪– যে শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞান প্রাপ্ত হন, প্রসিদ্ধ, পরমানন্দদায়ক, দ্যুলোকের শিশুস্থানীয়, রসস্বরূপ, অমৃতস্বরূপ সেই শুদ্ধসত্ত্ব, পবিত্রহৃদয় সাধককে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকগণ পরাজ্ঞানযুত শুদ্ধসত্ত্বকে লাভ করেন)। [মদ্যঃ– মদকর, পবমানন্দদায়ক]।

৪/৫– ভগবানের গ্রহণের জন্য এই প্রসিদ্ধ পাপহারক সকলের ধারক, রক্ষক, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব জ্ঞান প্রদান করে তার প্রিয়স্থান সাধক-হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা পরমমঙ্গলদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [এষঃ স্যঃ পদে ভাষ্যকার সোম অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এখানে সোমরসকে আনয়ন করার কি সার্থকতা, তা বোঝা যায় না। কারণ যে সমস্ত বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে, তার দ্বারা কোন মাদকদ্রব্যকে লক্ষ্য করতে পারে না। ধর্ণসিঃ পদের ভাষ্যার্থ ধারকঃ। অর্থাৎ যা সমস্ত বস্তুকে ধারণ করে আছে। প্রচলিত মত অনুসারেই এই বিশেষণ কিভাবে মদ্যের সম্বন্ধে প্রযুক্ত হতে পারে? মদ কি বস্তুজাতকে ধারণ করে আছে– তা কি বিশ্বের ধারক? বরং মদকে সমস্ত বস্তুর বিনাশকই বলা যায়। মদ কি পাপহারক?– সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মদ নয়, শুদ্ধসত্ত্বই হরিঃ অর্থাৎ পাপহারক, শুদ্ধসত্ত্বই ধর্ণসিঃ অর্থাৎ সকলের ধারক। শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উপজিত হলে সকল পাপ তিরোহিত হয়; ভগবৎশক্তি শুদ্ধসত্ত্বই সব ধারণ করে আছে।

৪/৬– সাধকদের, সৎকর্মসাধক পাপহারক দশেন্দ্রিয় এই প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাবকে বিশুদ্ধ করেন; পরমানন্দ-লাভের জন্য দশেন্দ্রিয় দ্বারা অর্থাৎ সৎকর্মসাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা সৎকর্ম সাধনের দ্বারা পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [ভাষ্য ইত্যাদিতে দশ পদের ব্যাখ্যায় দশ অঙ্গুলি অর্থ গৃহীত হয়েছে। মন্ত্রটিকে সোমার্থকরূপে কল্পনা করার জন্যই মন্ত্রের অন্তর্গত পদগুলিরও তেমন তেমন অর্থই করা হয়েছে। হরিতঃ পদে তিনি অন্যত্র হরিৎ-বর্ণ অর্থ গ্রহণ করলেও এখানে ঐ পদের অর্থ করেছেন– হরণস্বভাবা। কিন্তু এই অঙ্গুলিগুলি কি হরণ করে? সুতরাং অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করেই আমরা দশ শব্দে দশ-ইন্দ্রিয়কেই লক্ষ্য করেছি। ঐ দশেন্দ্রিয় যখন সৎকর্মসাধনে উন্মুখ হয়, প্রকৃতপক্ষে মোক্ষসাধক কর্মে নিযুক্ত হয়, তখন তারাই মানুষের পাপহারক হয়। বিশেষতঃ দশ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এখানে মানুষের সমস্ত সত্তাকে বোঝাচ্ছে]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– রহুগণ আঙ্গিরস]।  

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ৫– এষ বাজী হিতো নৃভির্বিশ্ববিন্মনসম্পতিঃ। অব্যং বারং বি ধাবতি ॥১॥ এ পবিত্রে অক্ষরং সোমো দেবেভ্যঃ সুতঃ, বিশ্বা ধামান্যাবিশ৷৷২৷৷ এষ দেবঃ শুভায়তেহধি যোনাবমঃ। বৃত্ৰহা দেববীতমঃ ৷৩৷৷ এষ বৃষা কনিক্ৰদদ দশভির্জামিভির্যতঃ। অভি দ্রোণানি ধাবতি৷৷৷৷ এষ সূর্যমরোচয়ৎ পবমাননা অধি দ্যবি। পবিত্রে মৎসরো মদঃ ॥৫৷৷ এষ সূর্যেণ হাসতে সংবসানো বিবস্বতা। পতিবাচো অদাভ্যঃ ॥৬৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৫সূক্ত/১সাম– শক্তিপ্রদায়ক, সৎকর্মসাধকগণ কর্তৃক স্বদয়ে উৎপাদিত, সর্বজ্ঞ, সাধকদের হৃদয়াধিপতি এই প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব নিত্যজ্ঞানপ্রবাহকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, পরাজ্ঞানযুত শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকেন)। [ভাষ্য ইত্যাদিতে এষঃ পদে সোমকে (সোম নামক মাদ্ৰকদ্রব্যকে) লক্ষ্য করা হয়েছে। বাজী পদে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে অন্নবান্শক্তিমাইত্যাদি অর্থ গৃহীত হলেও এখানে বেজনশীলঃবেগবানঅর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। হিতঃ পদের অর্থ সামপক্ষে করা হয়েছে– পাত্রে নিহিতঃ। বাজী পদে আমরা সর্বত্রই শক্তিমান অর্থ গ্রহণ করেছি; এখানে তা-ই সঙ্গত। নৃভিঃ হিতঃ পদ দুটির ভাব-সম্বন্ধে এই বলা যায় যে, সাধকেরা নিজেদের সৎকর্মসাধনের দ্বারা হৃদয়ে যে সত্ত্বভাব উৎপাদন করেন, ঐ পদ দুটিতে সেই সত্ত্বভাবকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। মন্ত্রের মধ্যে একটি পদ আছে– বিশ্ববিৎঅর্থাৎ যিনি সমস্ত বিশ্বকে। জানেন, যিনি সর্বজ্ঞ। মাদকদ্রব্য সোমরস সম্বন্ধে এই বিশেষণ প্রযোজ্য হতে পারে কি? অজ্ঞানতার আধার মাদকদ্রব্য সর্বজ্ঞ হবে কেমন করে? তাই এষঃ পদে সঙ্গতভাবেই শুদ্ধসত্ত্ব-কে লক্ষ্য করা হয়েছে। মনসঃ পতিঃ পদ দুটির অর্থ সম্বন্ধে ভাষ্যকার নানারকম গবেষণা করেছেন। কখনও বা তিনি সোমকে চন্দ্র কল্পনা করে অন্য এক অর্থ গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ঐ পদ দুটির অর্থ অন্তঃকরণের স্বামী, সাধকগণের হৃদয়ের পতিই সঙ্গত]।

৫/২– এই প্রসিদ্ধ বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব দেবভাবলাভের জন্য পবিত্র হৃদয়ে আবির্ভূত হন; সকল : সাধকের হৃদয়ে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধকেরা হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদিত করেন)।

৫/৩– রিপুনাশক অজ্ঞানতানাশক, অমৃতস্বরূপ, দেবগণেরও আকাঙ্ক্ষণীয় এই প্রসিদ্ধ পরমদেবতা অর্থাৎ ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগ! কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এই মরণরহিত, বৃত্ৰহা, দেবাভিলাষী সোম আপন স্থানে শোভা পাচ্ছেন। মন্ত্রের অন্তর্গত বৃত্ৰহা, দেবাভিলাষী সোম আপন স্থানে শোভা পাচ্ছেন। মন্ত্রের অন্তর্গত বৃত্রহা পদে ভাষ্যকার শহন্তা অর্থ গ্রহণ করেছেন। এমন কি বহুস্থানে বৃত্র নামক অসুরের গল্পও দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, এমনভাবে পৌরাণিক উপাখ্যানকে বেদ-মন্ত্রের অন্তর্গতরূপে কল্পনা বেদমন্ত্রের অর্থকে বিকৃতই করে মাত্র। প্রকৃত অর্থে বৃত্র পদে অজ্ঞানতা, জ্ঞানাবরক রিপু প্রভৃতিই লক্ষ্য করে]।

৫/৪– মিত্রভূত দশেন্দ্রিয় দ্বারা উৎপাদিত হয়ে অভীষ্টবর্ষক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞান প্রদান পূর্বক সাধকদের হৃদয়ে গমন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই য়ে, সাধকেরা সৎকর্ম-সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [জামিভিঃ পদে ভাষ্যকার অঙ্গুলিভিঃ অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু দশাভিঃ জামিভিঃ পদে দশ অঙ্গুলিকে কেন, দশ ইন্দ্রিয়কেই বা বোঝাবে না কেন? অঙ্গুলি নয়, ইন্দ্রিয়সমূহই তো সকল কম সম্পন্ন করে। তাছাড়া জামিশব্দের আরও একটা অর্থ অভিধানে পাওয়া যায়-একত্র-উৎপন্নঅর্থাৎ জীবের সাথে একত্রে জন্মে। জীব জন্মগ্রহণ করা মাত্রই দশেন্দ্রিয় লাভ করে; কর্ম প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত বস্তু। এই দিক দিয়েও জামিভিঃ পদে ইন্দ্রিয়সমূহঅর্থ গৃহীত হতে পারে]।

 ৫/৫– পরমানন্দের হেতুভূত, পরমানন্দদায়ক, দ্যুলোকাধিপতি, পবিত্রকারক, পবিত্ৰহৃদয়ে বর্তমান ভগবান্ সূর্যদেবকে (অথবা ভগবানের বিভূতিধারী জ্ঞানদেবকে) দীপ্তিসম্পন্ন করেন। (মন্ত্রটি নিতসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবৎশক্তিস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বই জগতের জ্ঞানালোকের মূল কারণ; সাধকেরা সেই পরমধনকে লাভ করেন)। [মন্ত্রের সর্বপ্রধান ভাব পরিব্যক্ত হয়েছে-সূর্যং অবোচয়েৎ পদ দুটিতে। ভগবানের জ্যোতিঃ থেকেই বিশ্বের সমস্ত বস্তু দীপ্তি লাভ করে। তিনিই সকলরকম আলোকের মূল উৎস। — একটি অতি প্রচলিত (ভাষ্যানুসারী) হিন্দী অনুবাদ– স্বয়ং দশাপবিত্ৰমে স্থিত প্রসন্নতা দেনেওয়ালা আউর প্রসন্নরূপ ইয়াহ (এই) সংস্কার কিয়া জাতা হুয়া সোম দুলোকমে স্থিত সূর্যকো দীপ্ত করতা হ্যায়। অর্থাৎ সোম দশাপবিত্রের (ছাকুনির) মধ্যেই আছে, অথচ তা সূর্যকে দীপ্তি দিচ্ছে– এটাই ব্যাখ্যার সারমর্ম। মন্ত্রে অবশ্য সোমরসের কোন উল্লেখ নেই; ভাষ্যকার তার আপন কল্পিত ব্যাখ্যার জন্য সোমরসের অধ্যাহার করেছেন। সেই জন্যই এমন অদ্ভুত অর্থ সম্ভবপর হয়েছে]।

 ৫/৬– সর্বত্র বিদ্যমান, আরাধনীয়, প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব, জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেবকর্তৃক রিপুজয়ীবর্গকে প্রদত্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, রিপুজয়ী সাধকেরা জ্ঞানসমন্বিত শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [প্রথমেই একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ লক্ষ্য করা যেতে পারে– এই শোধনকালীন সোম, সূর্য কর্তৃক পবিত্র দ্যুলোকে পরিত্যক্ত হন, সোম অত্যন্ত মদকর। এই মন্ত্রের ঠিক পূর্ববর্তী মন্ত্রের সূর্যং অবোয়ৎ পদ দুটির প্রচলিত ব্যাখ্যা এই যে, সোম সূর্যকে দীপ্তিমান করেছিল; আর এই মন্ত্রে এ বলা হচ্ছে-সূর্যকর্তৃক দ্যুলোকে পরিত্যক্ত হন। অবশ্য উপরে উদ্ধৃত ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ নয়, কারণ তাতে বিবস্বতা পদের অর্থ পরিত্যক্ত হয়েছে]। [এই সূক্তটির ঋষি– আঙ্গিরাপুত্র নৃমেধ ও প্রিয়মেধ]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ৬– এষ কবিরভিষ্টতঃ পবিত্রে অধি তোশতে। পুনানো ঘন্নপ দ্বিষঃ ॥১॥ এষ ইন্দ্রায় বয়বে স্বজিৎ পরি যিচ্যতে। পবিত্রে দক্ষসাদনঃ ॥২৷৷ এষ নৃভিৰি নীয়তে দিবো মূর্ধা বৃষা সুতঃ। সোমো বনেষু বিশ্ববিৎ৷৩৷৷ এষ গহ্বরচিক্রদৎ পবমাননা হিরণ্যয়ুঃ। ইন্দু সত্রাজিদেঃ ॥৪৷৷ এষ শুষ্যসিষ্যদদন্তরিক্ষে বৃষা হরিঃ। পুনান ইন্দুরিন্দ্রমা৷৫৷৷ এষ শুমদাভ্যঃ সোমঃ পুনাননা অৰ্ষতি। দেবীরঘশংসহা ৷৬৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৬সূক্ত/১সাম– সর্বারাধনীয় সর্বজ্ঞ শুদ্ধসত্ত্ব, সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে সম্যভাবে গমন করেন; পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব শত্রুদের বিনাশ করে থাকেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন; শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা তারা রিপুজয়ী হন। (জ্ঞানের প্রভাবে অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়, আবার অজ্ঞানতা দূর হলে রিপুর আশ্রয়ও ধ্বংস হয়। রিপুদের এই পরাজয় সম্ভব সম্পূর্ণ হয়– শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা]।

৬/২– আত্মশক্তিবিধায়ক, স্বর্গাধিপতি, প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব ইন্দ্রদেবকে প্রাপ্তির জন্য, আশুমুক্তিদায়ক দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধকেরা হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সমুৎপাদিত করেন)। [প্রকৃত শক্তি তা, যা মানুষকে অবিনশ্বরত্ব দেয়, যা আত্মাকে উন্নত করে, মানুষকে অমৃতের পথে নিয়ে যায়। যে শক্তি ক্ষয়হীন, নিত্য বর্ধমান হয়ে মানুষকে অনন্ত শক্তিশালী করে তুলবে। যে শক্তির দ্বারা মানুষ নিজের মধ্যে অনন্তত্ব উপলব্ধি করতে পারবে, সেই শক্তিই মানুষের প্রকৃত কাম্যবস্তু। শুদ্ধসত্ত্বই সেই শক্তি, যা লাভ করলে মানুষ নিজেকে অনন্ত উন্নাতর পথে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। শুদ্ধসত্ত্বই মানুষকে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করায়। তাই বলা হয়েছে-ইন্দ্রায় বায়বে পরিষিচ্যতে– ইন্দ্র ও বায়ুদেবের জন্য (ভগবানের বলৈশ্বর্যের বিভূতিধারী ও আশুমুক্তিদায়ক বিভূতিধারী দেবতাদের জন্য বা স্বয়ং ভগবানের জন্য) ক্ষরিত হন, আবির্ভূত হন। কোথায়? পবিত্রে– সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে; যাঁরা ভগবৎপরায়ণ, তারাই ( এই পরমবস্তু লাভ করে ধন্য হন। মন্ত্রে ইন্দ্রায় ও বায়বে পদে প্রকৃতপক্ষে দুজন দেবতাকে লক্ষ্য করছে না কারণ দেব বহু নয়, দেব এক। সেই একই ভগবানের বিভিন্ন রূপের উল্লেখ করা হয়েছে। এ ইন্দ্ররূপে তিনি ধন ও বলের অধিপতি, আবার বায়ুরূপে তিনি আশুমুক্তিদাতা। মুক্তি ও শক্তিলাভের জন্য সাধক ভগবানের এই দুরকম বিভূতির শরণ গ্রহণ করছেন]।

৬/৩– দ্যুলোক-প্রাপক, অভীষ্টবর্ষক, সর্বজ্ঞ, বিশুদ্ধ, প্রসিদ্ধ সত্বভাব সৎকর্মর্সাধকদের দ্বারা তাদের জ্যোর্তিময় হৃদয়ে উৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা অভীষ্টবর্ষক মোক্ষপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্বলাভ করেন)।

৬/৪– পরাজ্ঞানদায়ক পবিত্রকারক, পরমধনদাতা, সকলের জেতা, অজাতশত্রু, প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের জ্ঞান প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পরাজ্ঞান এবং পরমধন লাভ করেন)। [ভগবান্ যে শুধু আমাদের জ্ঞান প্রদান করেন, তা-ই নয়, তিনি আমাদের পরমধন প্রদান করে থাকেন। তিনি সত্রাজিৎ (সকলের জেতা, সকলকে জয়কারী) এবং অস্তৃতঃ (কারও দ্বারা হিংসিত নন, অজাতশত্রু]।

৬/৫– প্রভূতশক্তিসম্পন্ন অভীষ্টবর্ষক পাপহারক পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব দুলোকে স্থিত ভগবান্ ইন্দ্রদেবের অভিমুখে গমন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের ভগবৎপ্রাপ্ত করান)।

৬/৬– প্রভূতশক্তিসম্পন্ন পরম আকাক্ষণীয়, পবিত্রকারক, দেবভাববিবর্ধক, পাপনাশক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন পরম আকাঙ্ক্ষণীয় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। [দেবত্ব ও অসুরত্ব, পুণ্য ও পাপ একত্র থাকতে পারে না। আলো ও অন্ধকারের মতোই যথাক্রমে দেবভাব ও পাপের সম্পর্ক। তাই শুদ্ধসত্ত্ব কেবল দেবাবীঃ নয় তা অঘশংসহাঅর্থাৎ পাপপ্রবণতানাশকও বটে। দেবভাব হৃদয়ে জাগরিত হলে পাপ দূরে পলায়ন করতে বাধ্য হয়]। [এই সূক্তের ঋষি– ইধহু, মতান্তরে প্রিয়মেধ ও অঙ্গিরাপুত্র নৃমেধ]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ৭– স সুতঃ পীতয়ে বৃষা সোমঃ পবিত্রে অষতি। বিয় রক্ষাংসি দেবয়ুঃ ॥১॥ স পবিত্রে বিচক্ষণো হরিরর্ষতি ধর্ণসিঃ। অভি যোনিং কনিক্ৰদৎ৷২৷৷ স বাজী রোচনং দিবঃ পবমাননা বি ধাবতি। রক্ষোহা বারমব্যয়৷৩৷৷ স ত্রিতস্যাধি সানবি পবমাননা অরোচয়ৎ। জামিভিঃ সূর্যং সহ৷৪স বৃহা বৃষা সুতো বরিবোবিদদাভ্যঃ। সোমো বাজমিবাসরৎ॥৫৷৷ স দেবঃ কবিনেষিতোহভি দ্রোণানি ধাবতি। ইন্দুরিন্দ্রায় মংহয়৷৬৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৭সূক্ত/১সাম– অভীষ্টবর্ষক দেবত্বপ্রাপক প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাব ভগবানের গ্রহণের জন্য সাধকদের রিপুসমূহকে বিনাশপূর্বক তাদের পবিত্রহৃদয়ে গমন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা রিপুনাশক ভগবৎপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– (ইন্দ্র ইত্যাদির) পানের জন্য অভিযুত সোম অভিলাষপ্রদ, রাক্ষসনাশক এবং দেবাভিলাষী হয়ে পবিত্রে (দশাপবিত্রে বা ছাঁকুনিতে) গমন করেন। সোমরস, প্রচলিত ভাষ্য অনুসারে, ছাঁকুনিতে যেতে পারে, কারণ সোমলতা থেকে রস নিষ্কাশিত করে তা হেঁকে নেওয়াই উচিত; সোম নামক মাদক দ্রব্য দেবতারাও অভিলাষ করতে পারেন; কিন্তু তা রাক্ষসদের কিভাবে নাশ করবে, বোঝা যাচ্ছেনা। আসলে এই মন্ত্র এখানে মাতালভোগ্য কোন মাদকদ্রব্যের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি, এখানে ভগবৎশক্তি শুদ্ধসত্ত্বেরই মহিমা কীর্তিত হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্বই মানুষকে পরমশক্তি দান করে, রিপুরূপী রাক্ষসদের হাত থেকে উদ্ধার করে। পবিত্রে অর্থে দশাপবিত্রে নয়, পবিত্র হৃদয়ে বোঝাই সঙ্গত]।

৭/২– পরাজ্ঞানদায়ক পাপহারক বিশ্বধারক ভগবান্ সাধকদের পবিত্রহৃদয়ে আবির্ভূত হন; সেই। পরমদেব আমাদের হৃদয়ে পরাজ্ঞান প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপক। এটি প্রার্থনামূলকও। ভাব এই যে, -সাধকগণ ভগবানকে প্রাপ্ত হন; সেই পরমদেবতা আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [প্রচলিত ভাষ্যে বিচক্ষণঃ পদের অর্থ করা হয়েছে সর্বদর্শী। তা হয় বটে, কিন্তু সোম নামক মাদক দ্রব্য সর্বদর্শী হয় কেমন করে? এই মন্ত্রার্থে বিচক্ষণঃ পদের অর্থ প্রাজ্ঞ প্রজ্ঞাদায়ক, পরাজ্ঞানদায়ক গৃহীত হয়েছে]।

৭/৩– প্রভূতশক্তিসম্পন্ন, রিপুনাশক, পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব দ্যুলোকের দীপ্তিদায়ক নিত্যজ্ঞানের প্রবাহকে লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব দিব্যজ্ঞানের সাথে মিলিত হন)।

৭/৪– পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব ত্রিগুণসাম্য-অবস্থাপ্রাপ্ত সাধকের কর্মসাধনে বন্ধুভূত সৎ বৃত্তিনিবহের সাথে জ্ঞানকে প্রকাশিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানের জ্যোতিঃকে তীক্ষ্ণ করেন)। [উচ্চস্তরের ত্রিগুণসাম্য-অবস্থাপ্রাপ্ত সাধকের সৌভাগ্য বর্তমান মন্ত্রে বিস্তৃত হয়েছে। অথচ, প্রচলিত ভাষ্যে ও ব্যাখ্যায় মন্ত্রটিকে সোমরসার্থক-রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। এমন কি, মন্ত্রের কোথায়ও সোমরসের কোন উল্লেখ না থাকলেও, ভাব থেকেও সোমরসের কল্পনা আসতে না পারলেও প্রচলিত মতে, সোমরস সোমরসই, তা কোন দৈবশক্তিসম্পন্ন বস্তু নয়। তবে জিজ্ঞাস্য সোমরস সূর্যকে প্রকাশিত করে কেমন করে? শুধু তাই নয়, মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যাতে পুনঃ পুনঃ ত্রিত নামক জনৈক ঋষির উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রিত নামক ঐ ঋষির যজ্ঞে পবিত্র হয়ে যেন সোমের এই অপূর্ব শক্তিলাভ হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে কিন্তু ত্রিত শব্দে কোন ব্যক্তিবিশেষকে লক্ষ্য করা হয়নি। ঐ পদে ত্রিগুণসাম্য-অবস্থাপ্রাপ্ত সাধককেই বোঝায়]।

৭/৫– রিপুনাশক অভীষ্টবর্ষক, পরমধনদাতা, অজাতশত্রু, প্রসিদ্ধ, বিশুদ্ধ সত্ত্বভার আশুমুক্তিদায়ক (অথবা আত্মশক্তিদায়ক) দেবতার ন্যায় সাধককে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকগণ আশু পরমধনদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [মন্ত্রের মধ্যে একটি সোমঃ পদ আছে; সুতরাং ভাষ্যকার মন্ত্রটিকে সোমার্থকরূপে গ্রহণ করেছেন। তাই প্রচলিত মতে মন্ত্রের ব্যাখ্যা দাঁড়িয়েছে (অশ্ব যেমন) সংগ্রামে গমন করে, তেমনই বৃত্রঘাতী অভিলাষপ্রদ, অভিযুত, অহিংসনীয় সোম কলসে গমন করছেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৭/৬– জ্ঞানী সাধক কর্তৃক উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রসিদ্ধ সেই দেবতা তাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন; শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য পূজাপরায়ণ হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকেরা ভগবনপ্রাপ্তির জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সমুৎপাদিত করেন। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, একটি বঙ্গানুবাদ– সেই মহান, ক্লেদযুক্ত, কবি কর্তৃক প্রেরিত সোম (সোমরস) ইন্দ্রের জন্য দ্রোণ মধ্যে ধাবিত হচ্ছেন। এই ব্যাখ্যার মধ্যেই অসামঞ্জস্য এত স্পষ্ট, যে তা কখনও দৃষ্টি অতিক্রম করতে পারে না। সোমকে ব্যাখ্যার মধ্যে এক নিঃশ্বাসেই বলা হয়েছে মহান্ এবং ক্লেদযুক্ত। আসলে বেদে সোম বলে যে বস্তুটির উল্লেখ পাওয়া যায়, তা মদ্য নয়, এবং তার প্রস্তুত প্রণালী সম্বন্ধে যে ধারণা লাভ করি, তা-ও সত্য নয়। প্রাচীন ত্রিকালদর্শী ঋষিগণ কখনই এত অপদার্থ ছিলেন না যে, একটা অতি জঘন্য মাদকদ্রব্যে এত উচ্চাঙ্গের মহিমা আরোপ করবেন। সোম অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব মানুষের হৃদয়ের বস্তু, এটি সাধকের পবিত্র হৃদয়ে সমুৎপাদিত হয়। তাই দ্রোণশব্দে শুদ্ধসত্ত্ব ধারণের উপযোগী পাত্র সাধকহৃদয়কে লক্ষ্য করে। তাই, শুধু এখানেই নয়, সর্বত্রই দ্রোণ শব্দের অর্থ গৃহীত হয়েছে– হৃদয়রূপ পাত্রাণি, হৃদয়ানি। শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদেরই পবিত্র হৃদয়ে উপজিত হয়। বর্তমান মন্ত্রে আছে– কবিনা উষিতঃ দ্রোণানি অভিধাবতি। কবি পদে জ্ঞানী সাধককে লক্ষ্য করে। জ্ঞানী সাধকের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন। অর্থাৎ সাধনার দ্বারা সাধক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে থাকেন। এই শুদ্ধসত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা কি? ইন্দ্রায় মংহয়– ভগবানের আরাধনার জন্য। ভগবৎপরায়ণ হবার জন্যই ভগবানকে যথোপযুক্তভাবে আরাধনা করবার শক্তিলাভের জন্যই শুদ্ধসত্ত্বের প্রয়োজন। মন্ত্রাংশে এই ভাবই স্পষ্টরূপে পরিব্যক্ত হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষির নাম– রহুগণ আঙ্গিরস]।

.

সপ্তম খণ্ড

সূক্ত ৮– যঃ পাবমানীরধ্যেতৃষিভিঃ সতং রস। সবং স পূতমশ্নাতি স্বদিতং মাতরিশ্বনা৷৷৷৷ পাবমানী যো অধ্যেতষিভিঃ সভৃতংরস। তস্মৈ সরস্বতী দুহে ক্ষীরং সর্পিৰ্মধূদ৷৷ ২। পাবমানীঃ স্বস্ত্যয়নীঃ সুদুঘা হি ধৃতশ্রুতঃ। ঋষিভিঃ সস্তৃত রসসা ব্রাহ্মণেঘমৃতং হিতম৷ ৩৷৷ পাবমানীর্দধন্তু ন ইমং লোমথো অমু। কামাৎসময় নো দেবীর্দেবৈঃ সমাহৃতাঃ ॥ ৪৷৷. যেন দেবাঃ, পবিত্রেণাত্মানং পুনতে সদা। তেন সহস্রধারেণ পবমানীঃ পুনন্তু নঃ ॥ ৫৷৷ পাবমানীঃ স্বস্ত্যয়নীস্তাভির্গচ্ছতি নান্দন। পুণ্যাংশ্চ ভক্ষান্ ভক্ষয়ত্যতত্বং চ গচ্ছতি৷৷ ৬৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৮সূক্ত/১সাম– পবিত্রতাসম্পন্ন (অথবা শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত) যে সাধক জ্ঞানিগণ কর্তৃক দৃষ্ট অমৃতময় বেদমন্ত্র পাঠ করেন– উচ্চারণ করেন, সেই সাধক আদিজ্ঞানের দ্বারা বিশুদ্ধীকৃত পবিত্র সকল বস্তু লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — বেদপাঠনিরত সাধকেরা পরাজ্ঞান, লাভ করেন)। [সৎকর্মের দ্বারা, সৎ-জ্ঞানের প্রভাবে মানুষ নিত্যপবিত্র পরমবস্তুর সন্ধান পায়। আর তার সন্ধান পেয়ে মানুষ তা-ই পাবার জন্য ব্যাকুলভাবে প্রধাবিত হয়। সেই সমস্ত লাভের উদ্বোধনা এবং সৎ-জ্ঞানে তার স্বরূপ-নির্ণয়ের উপদেশ মন্ত্রের অন্তর্নিহিত ভাব। কিন্তু এমন যে উচ্চভাবমূলক মন্ত্র, ব্যাখ্যায় এবং ভাষ্যে তার কি বিকৃতিই না সাধিত হয়েছে লক্ষণীয়– যে ব্যক্তি পবমান সোমবিষয়ক এই সমস্ত শ্লোকগুলি অধ্যয়ন করে, যার রসশালিনী রচনা ঋষিগণ করে গেছেন, তিনিই বায়ুদ্বারা স্বাদুকৃত সংগৃহীত সেই সমস্ত সর্বপ্রকার পবিত্র খাদ্য আহার করেছেন। ভাবের বৈচিত্র্যটিই লক্ষ্য করবার বস্তু]।

৮/২– ভগবানের শরণাগত যে ব্যক্তি, আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধকগণ কর্তৃক সেবিত অর্থাৎ হৃদয়ে ধৃত পবিত্রতাসাধক পরিত্রাণকারক শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে সংজননের জন্য নিজেকে উদ্বোধিত করে, শরণাগত সেই ব্যক্তিকে সর্বত্র সর্পণশীল দেবতা অর্থাৎ ভগবান্ সৎকর্ম-সাধনভূত প্রকৃষ্ট জ্ঞান, কর্মসামর্থ্য এবং প্রাণ-উন্মাদক শুদ্ধসত্ত্ব বা ভক্তি প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের শরণাপন্ন ব্যক্তি জ্ঞান কর্ম ও ভক্তিলাভ করেন)। [মন্ত্রে কর্মের প্রাধান্য প্রখ্যাপিত। আত্ম উৎকর্ষ-সম্পন্ন জনের– সাধুসজ্জনের পদাঙ্কের অনুসরণে অগ্রসর হলে, আত্ম-উৎকর্ষ লাভ হয়, আর তাতেই জ্ঞান কর্ম ও ভক্তির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারা যায়]।

৮/৩– পরাশক্তিদায়িকা ভক্তিরূপিণী দেবী আমাদের সম্বন্ধে পবিত্রতাসাধিকা (আত্ম-উৎকর্ষ সম্পাদিকা), স্বতঃবর্ষী চন্দ্রসুধার ন্যায় শোভন-ফুলদায়িকা এবং সৎ-ভাব-সংজনয়িতা শুদ্ধসত্ত্বদায়িকা হোন। অপিচ, অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন সাধকগণ কর্তৃক হৃদয়ে ধৃত (উৎপাদিত) শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত ভক্তিরস, ব্রহ্মজ্ঞ আমাদের মধ্যে উপজিত হয়ে, আমাদের অমৃতপ্রাপক পরমার্থদায়ক এবং পরমকল্যাণকর হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং সঙ্কল্পজ্ঞাপক। কর্মের প্রভাবে আমরা যেন সৎ-ভাবের অধিকারী হতে পারি)।

৮/৪– দেবভাবসমূহের বা সত্ত্বভাব ইত্যাদির দ্বারা উৎপন্ন, পবিত্রতাসাধক আত্ম-উৎকর্ষদায়ক স্তোতমানা ভক্তিরূপিণী দেবীগণ আমাদের ঐহিক আমুষ্মিক অথবা ইহলোক-পরলোক সম্বন্ধি কল্যাণ প্রদান করুন এবং সর্ববিধ অভিলষিত ফলসমূহ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভক্তির প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্বের গ্রহণে ভগবান্ আমাদের অভিলষিত ফলগুলি প্রদান করুন)।

৮/৫– যে পবিত্রতাসাধক শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা সাধক নিজের আত্মাকে নিত্যকাল, পবিত্র করেন, শুদ্ধসত্ত্বদায়ক সকল দেবতা (অথবা দেবভাবসমূহ) প্রভূতপরিমাণ পবিত্রতাসাধক সেই শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমাদের পবিত্র করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আত্মাকে পবিত্র করতে পারি)।

৮/৬– শুদ্ধসত্ত্বদায়ক অবিনাশী-ফলপ্রাপক অমৃতদায়ক যে দেবতাগণ– তাদের অনুকম্পায় সাধক স্বর্গপ্রাপ্ত হন; অপিচ, পবিত্র গ্রহণীয়বস্তুসমূহ গ্রহণ করেন, এবং অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় সাধক দ্যুলোকে গমন করেন, এবং অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন)। [মন্ত্রের প্রধান ভাব এই যে, ভগবানের অনুকম্পায় সাধকেরা মোক্ষ প্রাপ্ত হন, অমৃতত্ব লাভ করেন। সেই অমৃতত্বই মানুষের জীবনের প্রধান আকাঙ্ক্ষণীয় বস্তু। যখন ভগবানের করুণাধারা মানুষের মস্তকে বর্ষিত হয়, যখন মানুষ ভগবানের কৃপাকণা লাভ করতে পারেন, তখন তার হৃদয় বিশুদ্ধ হয়, পবিত্র হয়। তখন তিনি যা করেন, যা ভাবেন– সবই পবিত্র বিশুদ্ধ হয়। তার কর্ম-মাত্রই ভগবানের উপাসনায় পরিণত হয়। তাঁর ভাব, চিন্তা, কর্ম সবই তাকে অমৃতের পথে নিয়ে যায়]। [এই সূক্তের ঋষি-পবিত্র আঙ্গিরস]।

.

অষ্টম খণ্ড

সূক্ত ৯– অগন্ম মহা নমসা যবিং যো দীদায় সমিদ্ধঃ স্বে দুরোণে। চিত্রভানুং রোদসী অন্তরুবী স্বাহুতং বিশ্বতঃ প্রত্যঞ্চ৷৷ ১৷ স ম বিশ্বা দুরিতানি সানগ্নি ঈবে দম আ জাবেদাঃ। স নো রক্ষিষদ দুরিদবদ্যাদম্মা গৃণত উত নো মঘঘানঃ৷৷ ২৷৷ ত্বং বরুণ উত মিত্রো অগ্নে ত্বাং বর্ধন্তি মতিভিৰ্বসিষ্ঠাঃ। ত্বং বসু সুষণনানি সন্তু ঘূয়ং পাত স্বস্তিভিঃ সদা নঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১০– মহা ইন্দ্র যে ওজসা পর্জনন্যা বৃষ্টিমা ইব। স্তোমৈবৎসস্য বাবৃধে৷৷ ১। কম্বা ইন্দ্ৰং যদক্রত স্তোমৈর্যজ্ঞস্য সাদন। জামি ব্রবত আয়ুধা৷৷ ২। প্রজামৃতস্য পিপ্রতঃ প্র যদ ভরন্ত বয়ঃ। বিপ্ৰা ঋতস্য বাহসা৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৯সূক্ত/১সাম– স্বর্গে দীপ্ত হয়ে যে দেবতা জ্যোতিঃ প্রদান করেন, বিস্তীর্ণ দ্যাবাপৃথিবীর মধ্যে স্থিত পরম আরাধনীয়, জ্যোতির্ময় সর্বতোভাবে সর্বত্র-গমনশীল অর্থাৎ সর্বত্র বিদ্যমান সেই নিত্যতরুণ দেবতাকে আমরা ঐকান্তিক ভক্তির দ্বারা যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম উদ্বোধক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরম জ্যোতির্ময় পরমদেবতাকে আমরা যেন ভক্তি এবং প্রার্থনার দ্বারা লাভ করতে পারি)। [অগ্নি শব্দে বেদে কোন সাধারণ অগ্নিকে বোঝায় না। অগ্নি– ভগবানের জ্ঞানরূপ বিভূতি– জ্ঞানদেবতা। এই মন্ত্রের মধ্যে সেই পরমদেবতা– পরমবস্তু জ্ঞানেরই মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। অগ্নিকে যুবতমঅথবা যবিষ্ঠবলা হয়। তার কারণ প্রদর্শন করতে গিয়ে ভাষ্যকার বলেছেন– অগ্নি প্রত্যেকবার অরণিকাষ্ঠের সঙ্র্ষণে উৎপন্ন হয় বলে অগ্নিকে যবিষ্ঠ বলা হয়। এ বিষয়ে পণ্ডিতবর্গের গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু প্রকৃত বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই জ্ঞান প্রতি মুহূর্তেই মানুষের অন্তরে বিকশিত হচ্ছেন বলেই তিনি যবিষ্ঠ। জ্ঞান চিরন্তন আদিহীন। কিন্তু যার হৃদয়ে তার প্রথম আবির্ভাব হলো, তার কাছে তো তিনি নতুন, নবীনতম]।

৯/২– প্রসিদ্ধ জ্ঞানদেব মহত্ত্বের দ্বারা আমাদের সকল পাপ দূর করুন, জ্ঞানস্বরূপ দেব সৎকর্মের সাধনে সাধকদের দ্বারা স্তুত হন; সেই দেবতা আমাদের পাপ হতে রক্ষা করুন এবং অসৎকর্ম হতে প্রার্থনাকারী আমাদের রক্ষা করুন। অপিচ, পূজাপরায়ণ আমাদের রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের সকল পাপ থেকে রক্ষা করুন)। [ভগবানের শক্তিস্বরূপ যে পরাজ্ঞান, সেই জ্ঞানাগ্নিই মানুষকে পাপ থেকে রক্ষা করতে পারে। পাপ কালিমা প্রভৃতি জ্ঞানরূপ অগ্নিতে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। তাই সেই ভগবৎশক্তির কাছেই সাধক প্রার্থনা করছেন। মন্ত্রের মধ্যে প্রখ্যাপিত নিত্যসত্যটি এই যে, জ্ঞানদেব সৎকর্মসাধকদের দ্বারা স্তু হন। মানুষের হৃদয়ে জ্ঞান উপজিত হলেই সৎকর্ম সাধনের প্রবৃত্তি জন্মে; আবার সৎকর্মের সাধনে প্রবৃত্ত হলে মানুষের হৃদয়ে জ্ঞান উপজিত হয়। অর্থাৎ সৎকর্ম ও জ্ঞানের মধ্যে জন্য-জনক সম্বন্ধ বিদ্যমান। একটির উপস্থিতিতে অন্যটি উপস্থিত হয়]।

৯/৩– হে জ্ঞানদেব! আপনি অভীষ্টবৰ্ষক এবং মিত্রস্বরূপ হন; জ্ঞানিগণ স্তুতির দ্বারা আপনাকে বর্ধিত করেন– আরাধনা করেন; আপনাতে বর্তমান পরমধনসমূহ আমাদের পরম মঙ্গলসাধক হোক; হে দেবগণ! আপনারা নিত্যকাল আমাদের পরম মঙ্গলের সাথে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রক্ষেপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানিগণ জ্ঞানের সাধনে যত্ন পরায়ণ হন; পরমমিত্র অভীষ্টবর্ষক দেবতা কৃপাপূর্বক আমাদের পরমমঙ্গল সাধন করুন)। [এই মন্ত্রে অগ্নিকে সম্বোধন করেই প্রার্থনা করা হয়েছে। মূলভাব এই যে, জ্ঞানদেব অগ্নি আমাদের মঙ্গলসাধন করুন, আমাদের বিপদ থেকে চিরকাল রক্ষা করুন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই ভাব অব্যাহত থাকলেও দুএকটি পদের প্রতিশব্দ সম্বন্ধে একটু মতভেদ ঘটেছে মাত্র। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অগ্নি! তুমি বরুণ, তুমি মিত্র, বসিষ্ঠগণ তোমাকে স্তুতিদ্বারা বর্ধিত করেন। তোমাতে বিদ্যমান ধন সুলভ হোক। তোমরা সর্বদা এ আমাদের স্বস্তি দ্বারা পালন করো। এই ব্যাখ্যা থেকে এটা পরিদৃষ্ট হবে যে অগ্নিকে এখানে মিত্র? এ ও বরুণ বলা হয়েছে। ভাষ্যকার কিন্তু অনর্থক তার প্রচলিত পন্থা পরিত্যাগ করে বরুণঃ পদে পাপানাং নিবারকঃ এবং মিত্র পদে পুণ্যপ্রাপণে সখা অর্থ গ্রহণ করেছেন। এখানে একথা ঠিক যে, ভাষ্যকারকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করে অনুবাদকার মন্ত্রের মূলভাব অনেক পরিমাণে অবিকৃত রেখেছেন। ভগবান্ এক, তার বিভিন্ন বিভূতিই বিভিন্ন নামে পরিচিত– এই সত্যই মন্ত্রে পরিস্ফুট হয়েছে। তিনিই অগ্নি, তিনিই বরুণ, তিনিই সূর্য, তিনিই অৰ্মা– সমগ্র বিশ্ব তারই বিভূতি মাত্র। বসিষ্ঠ পদে জ্ঞানিগণকে লক্ষ্য করে– পূর্বে অনেকবার তা আলোচিত হয়েছে। বসিষ্ঠগণ তোমাকে স্তুতির দ্বারা বর্ধিত করেনতার ভাব এই যে, জ্ঞানিগণ সাধনার দ্বারা তাদের হৃদয়স্থ জ্ঞানরাশিকে বর্ধিত করেন]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– বসিষ্ঠ মৈত্ৰাবরুণি]।

১০/১– অভীষ্টপূরক অমৃতদায়ক দেবতার ন্যায় শক্তিতে শ্রেষ্ঠ বলৈশ্বর্যাধিপতি যে দেবতা, তিনি তাঁর পুত্রস্থানীয় সাধকের স্তুতিদ্বারা আরাধিত (বর্ধিত) হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, অমৃতপ্রাপক ভগবান্ সাধকদের দ্বারা আরাধিত হন)। [যাঁরা জ্ঞানী, যাঁরা সাধক তারা সেই পরমপিতার আরাধনায় প্রবৃত্ত হন। বাবৃষে পদের অর্থ প্রবর্ধতে অর্থাৎ বর্ধিত হন। কেমন করে? তিনি কি অপূর্ণ, যে সাধকের স্তুতিতে পূর্ণত্ব লাভ করবেন? সাধক সাধনপথে যতই অগ্রসর হন ততই ভগবানের মাহাত্ম্য তার হৃদয়ে প্রতিভাত হয়। সুতরাং ভগবান্ স্তুতির দ্বারা সাধকের হৃদয়ে বর্ধিত হন– এ কথা বলা যেতেই পারে। সেইজন্যই বাবৃষে পদে প্রবর্ধতে আরাধিতঃ ভবতিএই অর্থ সঙ্গতভাবেই গৃহীত হয়েছে]।

১০/২– যখন ক্ষুদ্রশক্তি ব্যক্তিগণ (অথবা স্তোতাগণ) স্তুতির সাথে ভগবানকে সৎকর্মের লক্ষীভূত অর্থাৎ চরমলক্ষ্য করেন, তখন সাধকগণ রক্ষাস্ত্রকে অপ্রয়োজনীয় (অথবা বন্ধুস্বরূপ) বলে থাকেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ ভগবৎপরায়ণ সাধকদের সর্বতোভাবে রক্ষা করেন)। [সাধকের নিজের সত্তা যখন সেই পরমসত্তায় বিলীন হয়ে যায়, তখন তার প্রতি রিপুর আক্রমণ সম্ভবপর হয় না। কারণ তখন সাধকের পৃথক অস্তিত্বই থাকে না– আক্রমণ করবে কাকে? তাই বলা হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, অথবা বন্ধুরূপে পরিণত হয়। অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা শত্রুনাশ হয়, কিন্তু যাঁর শত্রু নেই, তার অস্ত্রশস্ত্রেরও প্রয়োজন নেই। অথবা যে অস্ত্রশস্ত্র প্রাণনাশক, তাই সাধকের পক্ষে বন্ধুস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়]।

১০/৩– যখন জ্ঞানকিরণসমূহ সত্যসাধককে জ্ঞানের দ্বারা পূর্ণ করে, তখন সেই জ্ঞানিগণ সত্যপ্ৰাপক স্তোত্রের দ্বারা ভগবানকে পূজা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানিগণ ভগবৎপরায়ণ হন)। [মানুষের মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে, তাকে বিকশিত করে কাজে লাগাতে পারলেই সে নিজের সকল অভীষ্টই সাধন করতে পারে। সুতরাং যখন সে অভ্রান্তভাবে নিজের গন্তব্য পথ নির্দেশ করতে সমর্থ হয় এবং যখন সে নিজের অভীষ্টের সন্ধান পায়, তখন সে সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিজের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করে। শুধু তাই নয়, এই উদ্দেশ্য সাধনের প্রকৃষ্ট উপায় যে ভগবৎপরায়ণতা তা সে জ্ঞানের সাহায্যে জানতে পারে। সুতরাং অনায়াসেই সে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে সমর্থ হয়– ভগবৎ-সাধনায় আত্মনিয়োগ করে মোক্ষমার্গে অগ্রসর হয়]। [এই সূক্তটির ঋষি বৎস কাণ্ব]।

.

নবম খণ্ড

সূক্ত ১১– পবমানস্য জিয়তো হরেশ্চন্দ্রা অসৃক্ষত। জীরা অজিরশোচিষঃ৷৷ ১। পবমাননা রথীতমঃ শুভ্রেভিঃ শুভ্রণস্তমঃ। হরিশ্চন্দ্রো মুরুগণঃ ৷৷ ২৷৷ পবমান ব্যশ্নহি রশ্মিভিবাজসাতমঃ। দধৎ স্তোত্রে সুবীর্য৷৷ ৩৷৷

 সূক্ত ১২– পরীত যিঞ্চতা সুতং সোমো য উত্তমং হবিঃ। দধা যো অপস্বা৩ইন্তরা সুষাব সোমমদ্রিভিঃ । ১ নূনং পুনোহবিভিঃ পরি সুবাদঃ সুরভিত্তরঃ! সুতে চিৎ হৃাসু মদামো অন্ধসা শ্ৰীণন্তো গোভিরুত্তমম্৷৷ ২৷৷ পরি স্বানশ্চক্ষসে দেবমাদনঃ তুরিন্দুর্বিচক্ষণঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৩– অসাবি সোমো অরুষো বৃষা হরী রাজেব দম্মো অভি গা অচিক্রদৎ। পুনাননা বারমত্যেষ্যব্যয়ং শ্যেনো ন যোনিং ঘৃতবন্তমাসদ। ১৷৷ পর্জন্যঃ পিতা মহিষস্য পৰ্ণিনো নাভা পৃথিব্যা গিরিষু ক্ষয়ং দধে। স্বসার আপো অভি গা উদাসরৎসং গ্রাবভিবসতে বীতে অধ্বরে। ২৷৷ কবিৰ্বেধস্যা পর্যেষি মাহিনমত্যো ন মৃষ্টো অভি বাজমসি। অপসেধ দুরিতা সোম নো মৃড় ঘৃতা বসানঃ পরি যাসি নির্ণিজ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১১সূক্ত/১সাম– অজ্ঞানতানাশক পাপহারক বিশ্বজ্যোতিঃ পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্বের দেবভাবপ্রাপিকা ধারা সাধকদের হৃদয়ে উৎপাদিত হয়। (মন্ত্রটি নিতসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা পাপনাশক দেবভাবপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)।

১১/২– শ্রেষ্ঠতম সৎকর্মসাধক, শ্রেষ্ঠতম বিশুদ্ধিবিধায়ক, পাপহারক, পরমানন্দদায়ক, বিবেকজ্ঞানদাতা, পবিত্রকাবক শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরমানন্দদায়ক সৎকর্মসাধক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এই যে ক্ষরণশীল সোম, এর তুল্য রথী নেই; যত শুভ্রবর্ণ বস্তু আছে, ইনিই সর্বাপেক্ষা অধিক নির্মল; এঁর ধারা হরিত্বর্ণ : দেবতারা এঁর সহায়, ইনি তাদের আহ্লাদিত করেন। একই মন্ত্রের মধ্যেই সোমকে হরিবর্ণ ও শুভ্রবর্ণ বলা হয়েছে। সোম তবে কি বহুবর্ণধারী, বহুরূপী? আসলে মন্ত্রের মধ্যে সোমরসকে অধ্যাহার করার জন্যই হরিঃ প্রভৃতি পদে বিকৃত অর্থ করা হয়েছে। তাছাড়া, সোম নামক মাদকদ্রব্য রথীতমঃ হয় কেমন করে, বুঝতে পারা যায় না। আসলে হরিঃ পদের অর্থ পাপহারক; চন্দ্রঃ পদের অর্থ আত্মদকর বা পরমানন্দদায়ক; মরুণাঃ অর্থে বিবেকরূপী দেবগণ; পবমানঃ অর্থে পবিত্রকারক, শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি– এমন বোঝাই সঙ্গত]।

১১/৩– পবিত্রকারক হে দেব! আত্মশক্তিদায়ক আপনি জ্যোতিঃ দ্বারা আমাদের এবং সমস্ত জগৎকে ব্যাপ্ত করুন; আপনি প্রার্থনাপরায়ণ জনকে আত্মশক্তি প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধকেরা আত্মশক্তি লাভ করেন; আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের পরম মঙ্গলদায়ক জ্যোতিঃ লাভ করি)। [সুবীর্যং পদের অর্থ পুত্র ধনজননয়, এর প্রকৃত অর্থ শোভনবীর্য। শোভনবীর্য কি? যা মানুষকে প্রকৃতশক্তি (পরাশক্তি দিতে পার, তা-ই সুবীর্য। মানুষের অন্তরাত্মা, যখন জাগরিত হয়, মানুষের মধ্যে যখন সত্যিকার শক্তির সাড়া জাগে, তখনই মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সমর্থ হয়। সেই শক্তিই আত্মশক্তি]। [এই সূক্তের ঋষির নাম-শত বৈখানসবৃন্দ]।

১২/১– হে আমার মন! যে সত্ত্বভাব শ্রেষ্ঠ দেবপূজোপকরণ, সেই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে হৃদয়ে উৎপাদন করো; কঠোর তপঃ সাধনের দ্বারা বিশুদ্ধ, অমৃতপ্রাপক, মানুষের হিতকারক যে সত্ত্বভাব, সেই সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হও। (প্রার্থনার ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধনের দ্বারা লোকের হিতসাধক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [উত্তমং হবিঃসত্ত্বভাবই দেবপূজার শ্রেষ্ঠ উপকরণ। দেবপূজার উদ্দেশ্য– দেবতাকে বা দেবভাবকে প্রাপ্ত হওয়া। সেই উদ্দেশ্য সাধনের উপায়– হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উপজন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৫দ-২সা) প্রাপ্তব্য]। সুগন্ধি অর্থাৎ পরমপ্রীতিদায়ক, অজাতশত্রু, পবিত্রকারক আপনি নিত্যজ্ঞানের সাথে নিশ্চিতভাবে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; বিশুদ্ধ হলে শক্তি এবং জ্ঞানকিরণের সাথে শ্রেষ্ঠ অমৃতস্থিত আপনাকে মিশ্রণকারী আমরা যেন পরমানন্দ লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব এবং পরমানন্দ লাভ করি)। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ-হে দুর্ধর্ষ সোম! তুমি চমৎকার সৌরভ ধারণপূর্বক মেষলোমদ্বারা শোধিত হতে হতে শীঘ্র ক্ষরিত হও। প্রস্তুত হবার পর তোমাকে জলের সাথে, দুগ্ধের সাথে, এবং আহার-সামগ্রীর সাথে মিশ্রিত করে আনন্দের সাথে সেবন করব। বা! প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে মন্ত্রটির ভাব চমৎকার বলতে হবে। এবার আর সোমরসকে ভগবানের কাছে। নিবেদন করবার কোন আবশ্যকতা নেই। একেবারে নিজেই পান করবার জন্য বক্তা উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন]।

১২/৩– বিশুদ্ধকারক, দেবভাব-উৎপাদক, সৎকর্ম-সাধক শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞান দানের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — দেবভাবের উৎপাদক শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞানের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [স্বানঃ– বিশুদ্ধকারক। দেবমাদনঃ-  দেবতাদের তৃপ্তিদায়ক। চক্ষসে পদের সাধারণ অর্থ দর্শনায় অর্থাৎ দেখবার জন্য। কার দর্শনের জন্য? এর একমাত্র উত্তর– সাধকের দর্শনের জন্য। সাধক সত্যমিথ্যা, পাপপুণ্য দর্শন করবেন। এক কথায়, তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবে– এই জন্যই প্রার্থনা]। [এই সূক্তের ঋষি-সপ্ত ঋষি (ভরদ্বাজ, কশ্যপ, গোতম, অত্রি, বিশ্বামিত্র জমদগ্নি ও বসিষ্ঠ)। মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত বাইশটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– পৃষ্ঠম, কৌল্মলবর্হিষম, অর্ক্কপুষ্পাদ্যম, দৈর্ঘ্যশ্রবসম্, দ্ব্যক্ষরোধেয়শ্বম, আভীশবাদ্যম, মাধুচ্ছন্দসম, ঐডমায়াস্যম পৃশ্নি ইত্যাদি]।

১৩/১– অজাতশত্রু, অভীষ্টবর্ষক, পাপহারক, পরমরমণীয়, আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ হয়ে জ্ঞানের সাথে সম্মিলিত হোন; পবিত্রকারক তিনি অমৃতপ্রবাহকে প্রাপ্ত হন; ক্ষিপ্রগতিশীল সাধক যেমন ভগবানকে প্রাপ্ত হন, তেমনভাবে সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়কে অমৃতময় করে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — জ্ঞানসমন্বিত অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাবকে আমরা যেন লাভ করি)। [জ্ঞানের সাথে সত্ত্বভাবের মিলন, সাধকের চরম ও পরম সৌভাগ্যের পরিচায়ক। তাই তারই জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

 ১৩/২– অমৃতপ্রবাহ মহান্ ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্বের উৎপাদক হয়; সেই শুদ্ধসত্ত্ব সকল লোকের কেন্দ্রশক্তিস্বরূপ কঠোরসাধনে আশ্রয় গ্রহণ করেন; পরস্পর ভগিনীস্বরূপ জ্ঞানকিরণসমূহ অমৃতে সম্মিলিত হন; শ্রেষ্ঠ সকর্মে সেই শুদ্ধসত্ত্ব পাষাণকঠোর সাধনের দ্বারা উৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সর্বলোকের পরমমঙ্গলসাধক শুদ্ধসত্ত্ব কঠোর সাধনের দ্বারা উৎপাদিত হন)।

১৩/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পরজ্ঞানদাতা আপনি সৎকর্ম-সাধনের ইচ্ছায় প্রশংসনীয় সাধকহৃদয়কে প্রাপ্ত হন; বিশুদ্ধ আপনি শীঘ্র আত্মশক্তিকে প্রাপ্ত হন; হে দেব! আপনি আমাদের শত্রুদের বিনাশ করে আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন; অমৃতযুত আপনি পবিত্রতা (অথবা ঔজ্জ্বল্য) প্রাপ্ত হন। মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের রিপু বিনাশ করে পরমানন্দ প্রদান করুক; আত্মশক্তিদায়ক রিপুনাশক শুদ্ধসত্ত্ব সাধককে প্রাপ্ত হয়)। [মন্ত্রটি চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম দ্বিতীয় ও চতুর্থ অংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে এবং তৃতীয় অংশে আছে– প্রার্থনা। সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হলে তিনি সৎকর্মের সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবসম্পন্ন লোকের মধ্যে আত্মশক্তির আবির্ভাব হয়। বিশুদ্ধতার সাথে শুদ্ধসত্ত্বের অতি নিকট সম্বন্ধ। সুতরাং যে সাধক শুদ্ধসত্ত্বের অধিকারী হন, তার হৃদয় থেকে অপবিত্রতা মলিনতা দূরীভূত হয়। অথবা এটাও বলা যায় যে, হৃদয় পবিত্র না হলে শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করা সম্ভবপর নয়। প্রার্থনার প্রধান ভাব রিপুনাশ এবং পরমানন্দলাভ। — প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে সুপণ্ডিত (সোমরস)! তুমি যজ্ঞানুষ্ঠানের ইচ্ছাতে কলসের দিকে যাচ্ছ। স্নান করালে ঘোটক যেমন যুদ্ধে যায়, তেমনই তুমি যাচ্ছ। হে সোমরস! তুমি আমাদের অশেষ অনিষ্ট নষ্ট করে আমাদের সুখী করো, তুমি ঘৃতের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে নির্মল ঔজ্জ্বল্য ধারণ করো। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই সূক্তের ঋষি-বসু ভারদ্বাজ। সূক্তান্তৰ্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গান আছে। যথা, -মহাসামরাজম, দ্বিরভ্যাসালৌশম, ঐড়মায়াস্যম, বাসিষ্ঠম এবং সীমানাং নিবেদম]।

.

দশম খণ্ড

সূক্ত ১৪– শ্রায়ন্ত ইব সূর্যং বিশ্বেদিন্দ্রস্য ভক্ষত। বসুনি জাতো জনিমানোজসা প্রতি ভাগং ন দীধিমঃ৷৷ ১৷ অলর্ষিরাতিং বসুদামুপ স্তুহি ভদ্রা ইন্দ্রস্য রাতয়ঃ। যো অস্য কামং বিধতো ন রোষতি মনো দানায় চোদ্দয়৷৷ ২

সূক্ত ১৫– যত ইন্দ্র ভয়ামহে ততো নো অভয়ং কৃধি। মঘবন্ধি তব তন্ন ঊতয়ে দ্বিমো বি মৃধো জহি৷৷১৷  ত্বং হি রাধসম্পতে রাধসো মহঃ ক্ষয়্যাসি বিধর্তা। তং ত্বা বয়ং মঘবন্নি গিবর্ণঃ সুবন্তো হবামহে৷ ২।

মন্ত্ৰার্থ— ১৪সূক্ত/১সাম– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেবতার সমগ্র বিভূতিসকলকে, জ্ঞানাধিষ্ঠাতা দেবতাতে সদাশ্রিত জ্ঞানিজনের ন্যায় অথবা সূর্যরশ্মিসকল যেমন সূর্যকে আশ্রয় করে অবস্থিতি করে তেমন, ভজনা করো– অনুসরণ করো। (ভাব এই যে, — জ্ঞানিজন। যেমন জ্ঞানের ভজনা করে, তেমনই বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেবের বিভূতিসকলকে ভজনা করো); সেই শক্তির দ্বারা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ ধনসমূহকে প্রাপ্ত হয়ে, পিতৃসম্পত্তির ন্যায় যেন অধিকারী হই। (ভাব এই যে, পিতার সম্পত্তিতে যেমন পুত্রের অব্যাহত অধিকার, ভগবানের বিভূতিসমূহে আমরা যেন তেমনই অধিকারী হই)। [নিজের চিত্তবৃত্তিগুলিকে সম্বোধন করে সাধক বলছেন– তোমরা ইন্দ্রদেবের বিভূতিগুলিকে ভজনা করো। কিভাবে ভজনা করবে? জ্ঞানী যেমন জ্ঞানকে ভজনা করে, সেইভাবে। মন্ত্রে সূর্যং পদ আছে। আভ্যন্তর-পক্ষে সূর্যদেবকে জ্ঞান বলে বর্ণনা সঙ্গত হয়েছে। বাহ্যতঃ সূর্য যেমন জাগতিক অন্ধকারসমূহ ধ্বংস করে জগৎকে আলোকিত করেন জ্ঞানের উদয়ে তেমনই জন্মজন্মান্তরসঞ্চিত তমোরাশি বিধ্বস্ত হয়ে হৃদয়প্রদেশ অপূর্ব আলোকে আলোকিত হয়ে থাকে]। [মন্ত্রটি ছন্দ, আর্চিকেও (৩অ-৪দ-৫সা) দ্রষ্টব্য]।

১৪/২– হে আমার মন! অপাপীজনের দাতা, পরমধনের দাতা দেবতাকে সম্যকরূপে আরাধনা করা; কারণ ঐশ্বর্যাধিপতি দেবতার দান কল্যাণদায়ক হয়; যে সাধক পরমধন প্রাপ্তির জন্য তার অন্তঃকরণকে ভগবানের অভিমুখে প্রেরণ করেন, ভগবান্ সেই আরাধনাপরায়ণ সাধকের প্রার্থনা পূর্ণ। করেন। (নিত্যসত্যমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক এই মন্ত্রের ভাব– আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই; ভগবান আমাদের পরমধন প্রদান করেন)। [ভগবান্ অলর্ষিরাতিং– তিনি নিষ্পাপদের পরমধন বিতরণ করে থাকেন। সুতরাং তুমি যদি নিষ্পাপ হও, তো তার শরণাগত হও। কিন্তু তাঁর শরণ নিলেই কি প্রার্থিত বস্তু পরমধন মুক্তি লাভ হবে? দুর্বল মনের এই সংশয় নিরসন করবার জন্যই বেদমন্ত্র বলছেন, বসুদাং-হা, যাকে তুমি আরাধনা করবে, তিনি পরমধনদাতা]। [এই সূক্তের ঋষির নাম- নৃমেধ। এই সূক্তান্তৰ্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– শ্রায়ন্তীয়ম এবং নিষেধম]।

১৫/১– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! যা হতে আমরা ত্রাস প্রাপ্ত হই, সেই ত্রাসের কারণ হতে আমাদের ভয়শূন্য করুন– অভয় দান করুন; হে পরমধনশালিন্! আপনি অশেষ-সামর্থ্যযুক্ত হয়ে থাকেন; অতএব, আমাদের যারা দ্বেষ করে অর্থাৎ রিপুশত্রুদের বিনাশ করুন, এবং আমাদের হিংসাকারী অপকর্মর্সকলকে নাশ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে দেব! আমাদের অভয় প্রদান করুন এবং আমাদের শত্রুগণকে নাশ করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদি দেখলে মনে হয়, এখানে যেন মানুষে মানুষে যুদ্ধ বা দেবতা ও অসুরের যুদ্ধ থেকে ভয় পেয়ে ইন্দ্রদেবের শরণাপন্ন হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে দেবাসুরের অর্থাৎ দেবভাব ও পাপভাবের যে সমর অহরহঃ চলেছে, তার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে রিপুগণকে জয় করবার শক্তি-সামর্থ্যের প্রার্থনাই এই মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে বলে সিদ্ধান্তিত হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-৫দ-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৫/২– হে ধনাধিপতি! আপনিই মহান ধনের আধারের (অথবা বিনাশের) ধারণ কর্তা, রক্ষাকর্তা হন; পরম আরাধনীয়, পরমধনদাতা, ঐশ্বর্যাধিপতি হে দেব! এবষ্কৃত প্রসিদ্ধ আপনাকে বিশুদ্ধ হৃদয় ও পূজাপরায়ণ হয়ে আমরা যেন প্রার্থনা করি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই; ভগবান্ পরমধনদাতা হন)। [ভগবানকে রাধসম্পতেঃ অর্থাৎ ধনের স্বামী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ধনের অধিপতি হওয়াতেই তার মাহাত্ম্য পর্যবসিত নয়, তিনি সেই ধনকে বিতরণও করেন। আবার তিনি যে মানুষকে কেবলমাত্র ধন বিতরণই করেন, তা-ই নয়, তিনি সেই ধনকে রক্ষাও করেন। তাই বলা হয়েছে– রাধস্য ক্ষয়স্য বিধর্তা অসি– পরম ধনের নিবাসের রক্ষা কর্তা হন। এই নিবাস অর্থে কি বোঝায়? পরমধন যাতে থাকে, যে আধারে সেই পরমধন অবস্থিত হয়, সেই আধারকে লক্ষ্য করা হয়েছে। সেই আধার সাধকের হৃদয়। ভগবান্ সে আধারকে, সাধকের হৃদয়কে, সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আবার ক্ষয়স্য বিধা পদের অন্য অর্থও কল্পিত হতে পারে। ক্ষয় অর্থে বিনাশ বোঝায়। সুতরাং রাধস্য ক্ষয়স্য বিধর্তা পদ তিনটির অর্থ হয়– ধনের বিনাশের রক্ষাকর্তা, অর্থাৎ ধননাশ থেকে যিনি রক্ষা করেন]। [এই সুক্তের ঋষির নাম– ভর্গ প্রাগাথ। এই দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গানের নাম—সমন্ত]।

.

একাদশ খণ্ড

সূক্ত ১৬– ত্বং সোমাসি ধারয়ুমন্দ্র ওজিষ্ঠো অব্বরে। পবস্ব মংহয় রয়িঃ ১। ত্বং সুতো মদিন্তমো দধন্বা মৎসরিন্তমঃ। ইন্দুঃ সত্ৰাজিদস্তুতঃ৷ ২৷৷ ত্বং সুম্বাণো আদ্রিভিরভ্যর্ষ কনিক্ৰদৎ। দুমন্তং শুমাভর৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৭– পবস্ব দেববীতয় ইন্দো ধারাভিরোজসা। আ কলশং মধুমাৎসোম নঃ সদঃ৷ ১৷৷ তব দুপসা উদগ্লুত ইন্দ্ৰং মদায় বাবৃধুঃ। ত্বং দেবাশো অমৃতায় কং পপুঃ৷ ২৷৷ আ নঃ সুতাস ইন্দবঃ পুনানা ধাবতা রয়িম্। বৃষ্টিদ্যাবো রীত্যাপঃ স্বর্বিদঃ৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৮– পরি ত্যং হর্ষতং হরিং বং পুনন্তি বারেণ। যো দেবা বিশ্ব ইৎ পরি মদেন সহ গচ্ছতি৷৷ ১। দ্বিষং পঞ্চ স্বশসং সখায়ো অদ্রি সংহত৷ প্রিয়মিন্দ্রস্য কাম্যং প্রস্নাপয়ন্ত ঊময়ঃ ৷৷ ২৷৷ ইন্দ্রায় সোম পাতবে বৃত্ৰয়ে পরি যিচ্যসে। নরে চ দক্ষিণাবতে বীরায় সদনাসদে৷৷ ৩৷

 সূক্ত ১৯– পবস্ব সোম মহে দক্ষায়াশো ন নিক্তো বাজী ধনায়৷৷ ১৷৷ প্র তে সোতারো রসং মদায় পুনন্তি সোমং মহে দ্যুম্নয়৷৷ ২. শিশুং জজ্ঞানাং হরিং মৃজন্তি পবিত্রে সোমং দেবভ্য ইন্দু৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২০– উপপাষু জাতমণ্ডুরং গোভির্ভঙ্গং পরিষ্কৃত। ইন্দুং দেবা অসিযুঃ ১৷৷ তমিদ বর্ধন্তু নো গিরো বৎসং সং শিশ্বরীরিব। য ইন্দ্রস্য হৃদং সনিঃ ॥ ২ অর্ষা নঃ সোম শং গবে ধুক্ষস্ব পিপষীমিষ। বৰ্ধা সমুদ্রমুক্থ্য ম৷ ৩৷৷

মন্ত্রাৰ্থ— ১৬সূক্ত/১সামহে শুদ্ধসত্ত্ব! পরমানন্দদায়ক শ্রেষ্ঠশক্তিদায়ক আপনি লোকবর্গের সকর্মে রক্ষক হন; আপনি কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে লোকগণ সত্যৰ্ম-সাধনে সমর্থ হন; সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরমধন প্রদান করুন)।

১৬/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব। বিশুদ্ধ আপনি পরমানন্দদায়ক সৎকর্মের ধারক হন; শুদ্ধসত্ত্ব পরমানন্দদায়ক, রিপুনাশক অথচ স্বয়ং অজাতশত্রু হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব পরমানন্দদায়ক রিপুনাশক হন)। [প্রচলিত একটি অনুবাদ– হে সোম (সোমরস)! তুমি নিষ্পীড়িত হয়ে মনুষ্যগণকে আনন্দিত ও উন্মত্ত করো; তুমি পণ্ডিত ও ধনদানকর্তা, তুমি ইন্দ্রের আহারস্বরূপ হয়ে তাকে যারপরনাই আহ্লাদিত করো। সোম অর্থে শুদ্ধসত্ত্বের পরিবর্তে মাদকদ্রব্য অধ্যাহার করাতেই প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলি এমন বিসদৃশ হয়েছে। মাদকদ্রব্যের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ঋষিরা যেন, যা মুখে আসে তেমনভাবেই, মাদকদ্রব্যের স্তুতিগান করেছেন বলে মনে হবে]।

১৬/৩– হে পরমদেব। পবিত্রতাস্বরূপ আপনি পাষাণকঠোর সাধনের দ্বারা প্রীত হয়ে জ্ঞান প্রদান পূর্বক আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন; অপিচ, আমাদের জ্যোতির্ময় রিপুনাশক শক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুজয়ী করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [পবিত্রতার আধার জ্যোতিঃস্বরূপ সেই পরমদেবতা সাধকের সৎকর্মের দ্বারা তার হৃদয়ে আগমন করেন। তিনি জ্ঞানস্বরূপ। তার আগমনে জ্ঞান আপনা-আপনিই সাধকের হৃদয়ে বিকাশ লাভ করে। তবে বিশেষভাবে জ্ঞান প্রদান করবার জন্য প্রার্থনা কেন? এই প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়ে জ্ঞান প্রদান করুন, সেই জ্ঞানবলে আমরা যেন আপনাকে জানতে পারি, আপনি যেন আপনারই দেওয়া শক্তিবলে আমাদের হৃদয়ে আহূত হন। এই জ্ঞানলাভের মধ্যে যে আরও একটি ভাব নিহিত আছে, তা সুষাণ পদে পাওয়া যায়। যাঁকে হৃদয়ে পেতে চাইছি, তিনি কে? তিনি সুষাণঃ– পবিত্রতাস্বরূপ। সুতরাং তাকে লাভ করতে হলে নিজেরও তেমন শুদ্ধ পবিত্র হওয়া দরকার। হৃদয় শুদ্ধ পবিত্র হয়, হৃদয়ে পবিত্র জ্ঞানের সঞ্চারের দ্বারা]। [এই সূক্তটির, ঋষি– ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য। তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গানের নাম; যথা, — আশ্বসূক্তম, শাস্মদম ইত্যাদি]।

১৭/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য আত্মশক্তির সাথে প্রভূত পরিমাণে আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভূত হোন; হে শুদ্ধসত্ত্ব! অমৃতময় আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে অমৃত-প্রাপক সত্ত্বভাব আবির্ভূত হোন)। [দেবতার পূজাগ্রহণই সাধকের ভগবৎপ্রাপ্তি]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-১০দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৭/২–- হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার অমৃতময় আশুমুক্তিদায়ক রস সাধকদের পরমানন্দলাভের জন্য ভগবানের মহিমা প্রখ্যাপিত করে; দেবত্ব-অভিলাষিগণ অমৃতত্বপ্রাপ্তির জন্য পরমমঙ্গলদায়ক আপনাকে গ্রহণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -দেবত্ব-অভিলাষী সাধকেরা পরমানন্দ লাভের জন্য– ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে সমুৎপাদিত করেন)।

১৭/৩– বিশুদ্ধ হে সত্ত্বভাবসমূহ! পবিত্রকারক দ্যুলোকের অমৃতস্বরূপ, সর্বলোকের অমৃতপ্রাপক, স্বর্গপ্রাপক আপনারা আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পরমধন লাভ করি)। [প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে সোমরসকে লক্ষ্য করেই এইরকম মন্ত্রগুলির অন্তর্গত পদগুলির অর্থ কল্পিত হয়েছে। যেমন, রীত্যাপঃ পদের এ ভাষ্যার্থ– দুলোকে বৃষ্টির অনুকূল করে পৃথিবীতে জল বহিয়ে যে দেয়। কিন্তু ঐ পদে শুদ্ধসত্ত্বের প্রতিই লক্ষ্য আছে, তার বিশেষণ রূপেই রীত্যাপ পদ ব্যবহৃত হয়েছে বোঝাই সঙ্গত। পৃথিবীর প্রতি অমৃতদানকারী, অর্থাৎ যা পৃথিবীবাসী সকলকে অমৃত দান করে, সেই বস্তু শুদ্ধসত্ত্ব। আর একটি পদ বৃষ্টিদ্যাবঃ। এর ভাষ্যার্থের ভাব এই যে, যার দ্বারা দ্যুলোককে বৃষ্টি প্রদানে উন্মুখ করে। এও তাই, সেই সোমরসকে লক্ষ্য করেই করা হয়েছে। মন্ত্রটিতে শুদ্ধসত্ত্বের প্রতিই লক্ষ্য আছে, এমন ভাবলে দেখা যায় বৃষ্টিদ্যাবঃ পদে অমৃত প্রবাহকেওঁ লক্ষ্য করে। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে নিষ্পীড়িত সোমরসগণ! তোমরা শোধিত হচ্ছ; আমাদের চারিপাশে এমনভাবে ধাবমান হও যে, আমরা যেন ধন লাভ করি। তোমরা দ্যুলোকের বৃষ্টির অনুকূল করে পৃথিবীতে জলে বহিয়ে দাও; এবং তাবৎ বস্তুর লাভ বিষয়ে সহায়তা করো। — অধিক মন্তব্যের প্রয়োজন নেই]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– মনু আব। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম, যথাক্রমে;-বৈশ্বমনস এবং সুজ্ঞানী]।

১৮/১– সাধককে পরমানন্দ দেবার জন্য যে সত্ত্বভাব সমস্ত দেবভাবকে নিশ্চিতভাবে প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ তাদের সাথে মিলিত হন, সেই পাপহারক, সর্বলোকের স্পৃহনীয়, সজ্জনপালক সত্ত্বভাবকে অমৃতের দ্বারা সাধকগণ সর্বতোভাবে শোধন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকগণ অমৃতদায়ক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হন)। [সতের সঙ্গেই সতের মিলন হয়, সমধর্মী সমধর্মীকেই চায়। তাই সত্ত্বভাব ও দেবভাব অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ। এই উভয়ের মিলনে, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সাথে দেবভার সম্মিলিত হলে সাধক পরমানন্দ– অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন। মন্ত্রে এই সত্যই বিধৃত হয়েছে]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৮দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৮/২– সখিভূত দশেন্দ্রিয় প্রসিদ্ধ, প্রীতিদায়ক, ভগবানের প্রিয় যে শুদ্ধসত্ত্বকে পাষাণকঠোর সাধনের দ্বারা উৎপন্ন করেন, তাকে অমৃতপ্রবাহ পরিশোধন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব অমৃতের প্রবাহের সাথে সম্মিলিত হন)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই সোম যখন প্রস্তর ফলকের উপর স্থাপিত হন তখন সেই যশস্বীকে দশ ভগিনী (অঙ্গুলী) স্নান করিয়ে দেয়। তখন তিনি তরঙ্গশালী হয়ে ইন্দ্রের প্রার্থনীয় অতি চমৎকার বস্তু হন। — দ্বিঃ পঞ্চ সখায়ঃ দশসংখ্যক সখিভূত ইন্দ্রিয় বা সখিভূত দশেন্দ্রিয়। ভাষ্যকার বললেন– দশ ভগিনী (অঙ্গুলী)]।

১৮/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! শত্রুনাশক ভগবানের গ্রহণের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; এবং দয়াকারুণ্য ইত্যাদি বিভূষিত শক্তিসম্পন্ন সৎকর্মসাধক ব্যক্তির জন্য আপনি ক্ষরিত হন; অর্থাৎ তাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শক্তিসম্পন্ন সৎকর্মসাধক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন; আমরাও যেন-ভগবানের কৃপায় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি। [বস্তুতঃ মানুষ স্বভাববশেই পাপে লিপ্ত হয় না। স্বরূপতঃ সে বিশুদ্ধ পবিত্র। সংসারের মোহ মায়াজালই তাকে বিপথে নিয়ে যায়। অল্পসময়ের মধ্যেই আপাতমধুর পাপকার্য অসীম দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং তখন অনুশোচনা ও পরিতাপ এসে তার জীবনকে বিষাক্ত করে দেয়। মানুষ যতই কঠিন-হৃদয় হোক না কেন, তার অন্তরস্থ সৎ-ভাবরাজি একেবারে বিনষ্ট হয়ে যায় না, অধঃপতনের মধ্যেও অন্তরের আলোক বিদ্যুৎশিখার মতো বিকাশ পায়। তার আলোকেই মানুষ। নিজের উদ্ধারের উপায় নির্ধারণ করতে চেষ্টা করে। তখন পতিতপাবন ভবপারের কাণ্ডারীর কথা স্মরণ হয়, তার চরণে আশ্রয়লাভের চেষ্টা করে। কারণ তিনিই যে একমাত্র শত্রুবিনাশক পরমদেবতা। সেই পরমদেবতাকে লাভ করবার জন্য, তার করুণাকণা পাবার জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উপজন করতেই হবে]। [এই সূক্তের ঋষি– অম্বরীষ বার্ষাগির ও ঋজি ভারদ্বাজ। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত আঠারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– গৌরীবিতম, নিহবম, যদ্বাহিষ্ঠীয়ম, আসিতাদ্যম, সাধ্রম, বসিষ্ঠস্য আকুপারম, শ্যাবাশ্বম, আন্ধীগবম ইত্যাদি]।

১৯/১– হে সত্ত্বভাব! ব্যাপকজ্ঞানের তুল্য বিশুদ্ধ, মোক্ষপ্রাপক তুমি মহতী আত্মশক্তি সঞ্চারের জন্য, এবং পরমধন প্রদানের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (ভাব এই যে, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ের আবির্ভূত হোক)। [মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য সেই পরম আনন্দ– আত্মানন্দ। এই আনন্দই ভগবানের চরণামৃত। এটি পেতে হলে হৃদয় পবিত্র ও নির্মল করা চাই, হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সঞ্চার করা চাই। তবেই সেই অপার্থিব ধনলাভ-স্বর্গীয় আনন্দলাভ জীবনে সম্ভব হবে। এই সত্য জেনেই মন্ত্রের প্রার্থনা– আমার হৃদয় পবিত্র হোক, আমি যেন পরমধন লাভের উপযোগিতা লাভ করি। হৃদয় বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবে পূর্ণ হোক; আমি যেন সেই সত্ত্বভাবের সাহায্যে পরমানন্দ লাভ করতে পারি]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৯দ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৯/২– প্রসিদ্ধ বিশুদ্ধহৃদয় সাধকগণ পরমানন্দ লাভের জন্য, এবং মহৎ ধনপ্রাপ্তির জন্য, হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবকে প্ৰদ্দীপিত করেন; সেই সাধকগণ অমৃত প্রকৃষ্টরূপে লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, বিশুদ্ধহৃদয় সাধকেরা অমৃত লাভ করেন)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– নিপীড়ন কর্তারা সেই রসরূপী সোমকে শোধন করছেন। তাদের উদ্দেশ্য যে, আনন্দ ও প্রচুর ধন পাবেন। অথচ মন্ত্রের ভাব– মানুষের হৃদয় থেকে যখন রজোগুণজনিত চাঞ্চল্য ও তমোগুণজনিত, জড়তা দূরীভূত হয়, অর্থাৎ হৃদয় যখন সত্ত্বগুণাশ্রিত হয়ে ওঠে, তখনই সে ভগবানের আরাধনায় মনোনিবেশ করতে পারে। তখন তার চিত্তে যে প্রসন্নতা ও প্রশান্ত ভাব জাগ্রত হয়, তা-ই তার বিমলানন্দের কারণ। এই অবস্থা লাভের জন্যই সাধকেরা কঠোর সাধনায় রত হন। সেই সাধনার ফলে সাধক অমৃতত্ব লাভ করতে পারে]।

১৯/৩– সাধকগণ উৎপাদ্যমান শিশুস্থানীয় পাপহারক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে দেবভাব লাভের জন্য তাদের পবিত্র হৃদয়ে শোধন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা পাপহারক শুদ্ধসত্ত্বকে তাদের হৃদয়ে উৎপাদিত করেন। [প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে এই মন্ত্রটিও যথারীতি সোমার্থকরূপে গৃহীত হয়েছে। সোম জলের শিশুর মতো জলের মধ্য থেকে জন্মগ্রহণ করছেন এমন সব বিবরণ সেখানে পেশ করা হয়েছে। আসলে কিন্তু মন্ত্রটি শুদ্ধসত্ত্বের মহিমা-প্রখ্যাপক। সাধকের হৃদয়ে যখন সত্ত্বভাব উৎপাদিত হয়, তখন তাকে শিশুর সাথে তুলনা করা হয়। শিশুকে যেমন প্রথমে তার জীবন রক্ষার জন্য অন্যের সাহায্য গ্রহণ করা দরকার, ঠিক তেমনই হৃদয়ে অঙ্কুরিত শুদ্ধসত্ত্বকে সৎ-ভাবরাজির পরিরক্ষণের জন্য সাধকের অক্লান্ত যত্ন ও পরিশ্রমের একান্ত প্রয়োজন। অর্থাৎ সাধকহৃদয়ে সদ্যোজাত ক্ষীণশক্তি পুণ্যজ্যোতিঃটি পাপঝাবাতের ফুৎকারে শূন্যে যাতে, বিলীন না হয়ে যেতে পারে, তার জন্যই তাকে (সেই পুণ্যালোককে) অতিশয় সাবধানে, শিশুর মতো যত্নে ও সেবায়, বর্ধিত করতে হয়। তাই সত্ত্বভাবকে জজ্ঞানং শিশুং বলা হয়েছে। আবার বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে শোধন করার অর্থও ইঙ্গিতপূর্ণ। সত্ত্বভাব স্বভাবতঃ বিশুদ্ধ বটে; কিন্তু সাংসারিক বিভিন্ন অবস্থার বিভিন্ন মূর্তি প্রতিবিম্ব তার উপর পড়ে তাকে মলিন করে তোলে। সাধনার দ্বারা যেমন এই মলিনতা দূরীভূত করতে হয়, তেমনই যাতে তার উপর মলিন ছায়াপাত না হয়, তারও উপায় বিধান করা চাই]। [এই সূক্তের ঋষি– অগ্নি ধিষ্ণা ঈশ্বর। এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত। গেয়গানের নাম—বিধর্মং]।

 ২০/১– সৎকর্মের ও সম্ভাবের দ্বারা পূর্ণবিকশিত সৎকর্মসঞ্জাত অমৃতসদৃশ রিপুনাশক বিশুদ্ধ ও জ্ঞানের দ্বারা সুসংস্কৃত সত্ত্বভাবকে দেবভাবসম্পন্ন সাধকগণ প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, — দেবভাবান্বিত ব্যক্তিগণ সৎকর্মের সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)।

২০/২– স্তনদাত্রী মাতা যেমন লালন-পালনে শিশুকে প্রবর্ধিত করেন, তেমনই যে শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের প্রীতিদায়ক, সেই শুদ্ধসত্ত্বকে আমাদের প্রার্থনা প্রবর্ধিত করুক। (প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটির ভাব– আমরা যেন আমাদের হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে প্রবর্ধিত করতে পারি)। [মায়ের মতো যত্ন ও স্নেহ করবার আর কেউই নেই। মায়ের প্রত্যেক অনুপরমাণুও যেন সন্তানের মঙ্গল কামনায় ধাবিত হয়। আমাদের সমগ্র শক্তি যেন সত্ত্বভাব লাভের ও পরিবর্ধনের জন্য ধাবিত হয়, আমাদের সমগ্র সত্তা যেন তার উপযুক্ত সাধনায় নিয়োজিত হয়– এটাই মন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য। শুদ্ধসত্ত্ব লাভের জন্য যেন আমরা কায়মনোবাক্যে আত্মনিয়োগ করতে পারি-মন্ত্রের এটাই গুঢ় তাৎপর্য। মন্ত্রের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বের বিশেষণ– ইন্দ্রস্য হৃদং সনিঃ অর্থাৎ ইন্দ্রের প্রতিদায়ক। ভগবানের প্রিয়বস্তু-শুদ্ধসত্ত্ব ভিন্ন আর কি হতে পারে? ভগবানের উপাসনার প্রধান উপকরণ-হৃদয়ের এই পবিত্র বিশুদ্ধ ভাব]।

২০/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের পরাজ্ঞানলাভের জন্য পরমমঙ্গল (অর্থাৎ সেই পরাজ্ঞানলাভের সামর্থ্য) প্রদান করো; আত্মশক্তিদায়িকা সিদ্ধি প্রদান করো; (অভীষ্ট পূরণ করো)। অপিচ, হে আরাধনীয় দেব! আমাদের জন্য অমৃতসমুদ্র প্রবর্ধিত করো; আমাদের অমৃত প্রদান করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান এবং অমৃত প্রদান করুন)। [এখানে জ্ঞান ও শুদ্ধসত্ত্বরূপ অমৃতলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ-পরমমঙ্গল প্রদান করো– জ্ঞানলাভের জন্য। এখানে পরমমঙ্গল ও পরাজ্ঞান অভিন্ন-অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পরমমঙ্গলই পরাজ্ঞানরূপে আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোক, — এটাই প্রার্থনার তাৎপর্য)। [এই সূক্তের ঋষি-অমহীয়ু আঙ্গিরস। এই তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– শ্রুধ্যম ও প্রতীচীনেড়ঙ্কাশীতম]।

.

দ্বাদশ খণ্ড

সূক্ত ২১– আ ঘা যে অগ্নিমিন্ধতে ঝুণন্তি বৰ্হিরানুক। যেষামিন্দ্রো যুবা সখা। ১৷৷ বৃহন্নিদিষ্ম এষাং ভূরিং শস্ত্রং পৃথুঃ স্বরুঃ। যেষামিন্দ্রো যুবা সখা। ২। অযুদ্ধ ইদ যুধা বৃতং শূর আজতি সত্বভিঃ। যেযামিন্দ্রো যুবা সখা৷ ৩৷৷

সূক্ত ২২– য এক ইদ বিদয়তে বসূ মর্তায় দাশুষে। ঈশানো অপ্রতিদ্ভুত ইন্দ্রো অঙ্গ৷৷ ১৷ যশ্চিদ্ধি ত্বা বহুভ্য আ সুতাবা আ বিবসতি। উগ্রং তৎ পত্যতে শব ইন্দ্রো অঙ্গ৷৷ ২৷৷ কদা মর্তমরাধসং পদা ক্ষুম্পমিব ফ্রৎ। কদা ন শুশ্রব গির ইন্দ্রো অঙ্গ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২৩– গায়ন্তি ত্বা গায়ত্রিশোহচন্ত্যকর্মর্কিণঃ। ব্ৰহ্মাণস্থা শতক্রত উদবংশমিব যেমিরে। ১। যৎ সানোঃ সাম্বারুহহা ভূর্যম্পষ্ট কম্। তদিন্দ্রো অর্থং চেততি যুথেন বৃষ্ণিরেজতি৷৷ ২৷৷ যুঙ্ক্ষা হি কেশিনা হরী বৃষণা কক্ষ্য। অথা ন ইন্দ্র সোমপা গিরামুপশ্রুতিং চর৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ২১সূক্ত/১সাম– যে জনগণ অর্থাৎ আত্মার উদ্বোধ যজ্ঞ করতে ইচ্ছুক যে জনগণ, যে সকল কার্যের আনুকূল্যে অর্থাৎ আত্মার উদ্বোধন-যজ্ঞ-কার্য-সকলের আনুকূল্যে, অজ্ঞান-অন্ধকার নাশক বলে জ্ঞানরূপ জ্যোতিঃকে প্রজ্বলিত করতে পারেন এবং কুশরূপ হৃদয়কে বিস্তৃত করতে পারেন বা করেন, তাদের সেই সকল যজ্ঞে, শ্রেষ্ঠ সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে সহায়রূপে অনুষক্ত করতে (প্রাপ্ত হতে) পারেন। (ভাব এই যে, জ্ঞান উদ্দীপিত এবং সত্ত্বভাবে হৃদয় বিস্তৃত হলে, জ্ঞানময় ভগবান্ সেখানে আবির্ভূত হন)। [এ অগ্নি-শব্দে সাধারণ অগ্নি নয় এবং বহিঃশব্দেও সাধারণ কুশ নয়। অগ্নি-জ্ঞান। বহিঃ-হৃদয়। অগ্নি যেমন অন্ধকার নাশ করে দ্রব্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত করে, তেমনই জ্ঞান অজ্ঞানান্ধকার নাশ করে স্বরূপ প্রকাশিত করে; অগ্নির সাথে জ্ঞানের এমন সাদৃশ্য থাকায়, জ্ঞানরূপ অগ্নি অর্থই এখানে বুঝতে হবে; এবং কুশ যেমন আসন হয়, হৃদয়ও তেমনই জ্ঞানের বা দেবতার আসন হয়]। [মন্ত্রটি ঋগ্বেদ ছাড়াও যজুর্বেদ সংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে দ্বাত্রিংশৎ কণ্ডিকায় এবং ছন্দ আর্চিকে (ঐন্দ্র পর্বে) ২অ-২দ-৯সামেও পাওয়া যায়]।

২১/২– যে সাধকদের সাধনা নিশ্চিতই মহতী, স্তোত্র প্রভৃতপরিমাণ এবং প্রার্থনা ঐকান্তিক হয়, নিত্যতরুণ- (চিরনবীন) ভগবান্ তাদের বন্ধু হন। (মন্ত্রটি নিত্যসূত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধনার প্রভাবে ভগবানই সাধকদের পরমবন্ধু হন)। [ভগবানই সাধকদের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তাকে এইরূপে (বন্ধুরূপে বা সখারূপে) পেতে হলে সাধনার আবশ্যক, ঐকান্তিক প্রার্থনার প্রয়োজন। অর্থাৎ কারা ভগবানকে লাভ করতে পারে, তার উত্তরস্বরূপ বলা হচ্ছে– যাঁদের সাধনা মহতী, প্রার্থনা ঐকান্তিকী– তারাই তাঁকে লাভ করতে পারেন]।

 ২১/৩– নিত্যতরুণ ভগবান্ যে সাধকগণের বন্ধু হন, তাদের মধ্যে যে কোনও ব্যক্তি অযোদ্ধা। হয়েও সৈন্যবলযুত রিপুকে শূরের ন্যায় আত্মশক্তিদ্বারা বিনাশ করতে সমর্থ হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় ক্ষুদ্রজনও মহকর্ম সাধন করতে সমর্থ হয়)। [ভগবান্ যাঁর প্রতি প্রসন্ন; যিনি ভগবানের কৃপালাভ করতে পেরেছেন, তাঁর অসাধ্য কিছুই নেই। তিনি দৈববলে বলীয়া, ঐশীশক্তিতে তার হৃদয় পূর্ণ। সুতরাং মূক হলেও তিনি বাক্যবাগীশ হয়ে যেতে পারেন, পঙ্গু হলেও তিনি অনায়াসে গিরিলঙ্ঘনে সমর্থ হতে পারেন]। [এই সূক্তের ঋষি– ত্রিশোক কাথ। সূক্তান্তগত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম-ঐমবাহাদ্যম্]।

 ২২/১– সকল জগতের পতি, না-প্রতিশব্দরহিত অভীষ্টপূরক, অদ্বিতীয় লোকহিতসাধক যে ভগবান্ ইন্দ্রদেব, তিনি এই মরণধর্মশীল উপাসককে শীঘ্রই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ রূপ ধন বিশেষরকমে প্রদান করেন। (ভাব এই যে, — সকলের অভীষ্টপূরক ভগবান উপাসককে শীঘ্রই পরিত্রাণ করে থাকেন)। [মন্ত্রটির সাদাসিদা ভাব– ভগবানের উপাসকেরা ত্বরায় তাঁর করুণা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থগুলিতে ঐ ভাব একটু পরিবর্তিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। একটি বঙ্গানুবাদে প্রকাশ– যিনি হব্যদাতা ঋত্বিককে ধন প্রদান করেন, সেই ইন্দ্র শীঘ্র সমস্ত জগতের প্রভু হন। আর এক অনুবাদে প্রকাশ– যে ইন্দ্রই কেবল হব্যদ্বারা যজমানকে ধন প্রদান করেন, তিনি সমস্ত জগতের নির্বিরোধী স্বামী। দুটি অর্থই প্রায় এক ছাঁচে ঢালা। এর তাৎপর্য কিছুই বোঝা যায় না। ঋত্বিককে কিংবা যজমানকে ধন প্রদান করলেই কি জগতের স্বামিত্ব লাভ হয়। প্রকৃতপক্ষে শব্দার্থ বিভ্রাটই এর কারণ। ঈশানঃ অপ্রতিদ্ভুতঃ পদ দুটির যুগ্ম প্রয়োগ পূর্বেও পাওয়া গেছে। তিনি যে পরমেশ্বর্যসম্পন্ন, তিনি যে না-প্রতিশব্দরহিত অর্থাৎ প্রতিকূলতাহীন বা প্রার্থনাকারীর সকল প্রার্থনা তিনি যে পূর্ণ করেন, সেখানে সেই ভাবই ব্যক্ত। একঃ ইৎ পদেই তাঁর অদ্বিতীয়ত্ব প্রতিপন্ন হয়। তিনি লোকহিতসাধক, তিনি সুপ্রসিদ্ধ, তিনি জগৎপতি, তিনি অভীষ্টপূরক, তিনি অদ্বিতীয়; বিশেষণগুলি তার সেই পরিচয়ই প্রদান করছে। যারা ভগবানের ভক্ত, যাঁরা ভগবানের উপাসক, ভগবান্ তাদের প্রতি চিরকৃপাবা আছেন, তাদের তিনি সকলরকম ধন প্রদান করে থাকেন]।

২২/২– হে ভগবান্! বহুলোকের মধ্য হতে শুদ্ধসত্ত্ব সমন্বিত সৎকর্মানুরত যে জন সর্বতোভাবে নিরন্তর আপনার পরিচরণ করেন– অর্থাৎ যে জন ভগবানের অনুসারী হন; সেই উপাসককে ভগবান ইন্দ্রদেব ত্বরায় প্রবল শক্তি প্রাপ্ত করান। (ভাব এই যে, -লোকসমূহের মধ্যে অল্প জনই শুদ্ধসত্ত্বপরায়ণ ভগবৎ-অনুসারী হন; তারাই কেবল ভগবানের কৃপা লাভ করেন– শক্তিসামর্থ্য প্রাপ্ত হন)। [মন্ত্রটির প্রচলিত অর্থ– যে জন ইন্দ্রের উদ্দেশে সোমরস প্রস্তুত করেন, ইন্দ্র তাঁকেই শীঘ্র ধনদান করে থাকেন। এ পক্ষে, সুতাবান্ পদে সোমরস-প্রস্তুতকারীর প্রসঙ্গ এসে থাকে। কিন্তু সুতাবা পদে শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত অর্থই পাওয়া যায়। সুত শব্দে যে শুদ্ধসত্ত্বকে বোঝায় তা পূর্বেই প্রতিপন্ন হয়েছে]।

২২/৩– ভগবৎ-উপাসনায় বিমুখ অপকর্মকারী মনুষ্যকে (এই আমাকে) কবে পদাঘাতের দ্বারা সর্পদংশনের ন্যায় তীব্রজ্বালা অনুভব করাবেন? (হে ভগবন! কঠোর দণ্ডবিধানের দ্বারা আমাদের সৎপথে নিয়ন্ত্রিত করুন– এই-ই প্রার্থনা); ভগবান্ ইন্দ্রদেব কতদিনে আমাদের প্রার্থনাসকল অবিলম্বে তা শ্রবণ করবেন? (হে ভগবান্‌! অসৎ পদসমূহ হতে আমাদের প্রতিনিবৃত্ত করে আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করুন– এই আকাঙ্ক্ষা)। [এই সূক্তের ঋষি– গোতম রাহুগণ। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– ত্রৈককুভম্]।

২৩/১– প্রজ্ঞান-স্বরূপ হে ভগবন! সামগায়িগণ সামগানে আপনারই মহিমা গান করেন, ঋক্‌ মন্ত্রোচ্চারণকারী হোতৃগণ ঋক্‌-মন্ত্রের উচ্চারণে আপনারই অর্চনা করেন, স্তোত্রপাঠক ঋত্বিকগণ উচ্চবংশের ন্যায় আপনাকেই উন্নত করেন অর্থাৎ উচ্চৈঃস্বরে আপনার গুণগান করেন। (ভাব এই যে, সামগানে, ঋক্‌-মন্ত্রে এবং সব রকম স্তোত্রে সেই ভগবানেরই মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়)। [যেখানে যে নামে যে ভাবে ভগবানের যে কোন বিভূতির অর্চনা করা হোক না কেন, সে সবই অর্চনা সর্বস্বরূপ সেই একেরই– একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই উদ্দেশ্যে বিহিত হয়। কিন্তু প্রচলিত একটা অনুবাদে দেখা যায়– হে শতক্রতু! গায়কেরা তোমার উদ্দেশে গান করে, অর্চকেরা অর্চনীয় ইন্দ্রকে অর্চনা করে, নর্তকেরা যেমন বংশদণ্ডকে উন্নত করে, স্তুতিকারকেরা তোমাকে তেমনই উন্নত করে। এতে– দেবতার কি মাহাত্ম্য প্রকাশ পেল, বুঝে পারা যায় না]।

২৩/২– সাধক যেমন ক্রমশঃ সাধন-মার্গে অগ্রসর হন (শনৈঃশনৈঃ নিম্নস্তর হতে উচ্চস্তরে আরোহণ করেন); তার (ইষ্টাপূর্ত) কর্মনিবহও তেমন প্রভূতভাবে আরব্ধ হয় (ভগবানকে স্পর্শ করে– প্রাপ্ত হয়)। ভগবান্ তখন, সাধকের অভিপ্রায় ভক্তের (প্রয়োজন) বুঝতে পারেন। এবং বুঝতে পেরে, সর্বাভীষ্টাসিদ্ধিপ্রদ তিনি, প্রয়োজন-অনুরূপ ঐশ্বর্য ইত্যাদি সহ সাধকের সমীপে উপস্থিত হন। (যেমন ক্রমশঃ সাধক সাধনার পথে অগ্রসর হন, সৎকর্মনিবহ তাঁর অনুগমন করেন; ভগবানও তখন তার প্রয়োজন বুঝে তার অভীষ্ট পূরণ করেন)। [সাধারণতঃ এই মন্ত্রের অর্থ করা হয়, — যে সময়ে যজমানেরা সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য প্রস্তুতের জন্য সোমলতা ও সমিধ প্রভৃতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পর্বতের শিখর হতে শিখরান্তরে আরোহণ (পরিভ্রমণ) করেন, তখন তারা যে সোমবাগ-রূপ কর্ম করবার জন্য উদযোগী হয়েছেন– তা বুঝতে পেরে, অভীষ্ট বর্ষণকারী ইন্দ্রদেব, মরুৎ-ইত্যাদি সাঙ্গোপাঙ্গ-সহ তাদের যজ্ঞস্থলে এসে উপস্থিত হন। ফলতঃ, ইন্দ্রদেব সোমরস মাদক-দ্রব্যের এতই ভক্ত যে, সোমলতা-প্রভৃতি সংগ্রহের উদ্যোগ দেখলেই যজ্ঞক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হতে প্রলুব্ধ হন। বলা বাহুল্য, মন্ত্রটির এই যে অর্থ অধুনা দাঁড়িয়েছে, তার প্রধান কারণ মন্ত্রের দুতিনটি পদের উপর ব্যাখ্যাকারিদের সংস্কার-অনুরূপ দৃষ্টির প্রভাব]।

২৩/৩– হে ভক্তাধীন ভগবন! আপনি আমাদের চতুর্বর্গফলসাধনের নিমিত্ত ঐশীশক্তিসম্পন্ন, অভীষ্টপ্রদ তুল্যতাসাধক পাপ-তমোনাশী জ্ঞানভক্তিরূপ দিব্যজ্যোতিঃ (হরিদ্বয়) আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করুন, এবং স্তুতিমন্ত্রসমূহের সমীপে (শব্দব্রহ্মরূপে) বিচরণ করুন (সর্বদা বিরাজমান থাকুন)। (এই মন্ত্রে ঊর্ধ্বগতিবিশিষ্ট সাধক জ্ঞানের ও ভক্তির প্রার্থনা করছেন; কেননা, ঐ উভয়ই অভীষ্টফল প্রদান করে)। [এই সূক্তের ঋষি– মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গানের নাম– উদ্বঁশীয়ম, দ্বিরভ্যস্তস্ত্বাষ্ট্ৰীসাম এবং গৌরীরিতম্]।

দশম অধ্যায় সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী