উত্তরার্চিক — দ্বাদশ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্ত অনুসারে)-১।২।৭।১০।১৩।১৪ অগ্নি; ৩।৬।৮।১১।১৫।১৭।১৮ পবমান সোম; ৪।৫।৯।১২।১৬।১৯।২০ ইন্দ্র।
ছন্দ– ১।২।৭।১০।১৪ গায়ত্রী; ৩।৯।১৯ (১ ও ২ সাম), ২০ (২ সাম) অনুষ্ঠুভ; ৪।৬।১৩ কাকুভ প্রগাথ; ৫।১৯ (৩ সাম
) বৃহতী; ৮।১১।১৫।১৮ ত্রিষ্ঠুভ; ১২।১৬ প্রগাথ বার্হতঃ; ১৭ জগতী; ২০ (১ সাম) স্কন্ধগ্রীব বৃহতী।
ঋষি– প্রতিটি সূক্তের শেষে উল্লেখিত আছে।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– উপপ্রযন্তো অধ্বরং মন্ত্রং বোচেমায়ে। আরে অস্মে চ শৃতে৷ ১৷৷. যঃ মীহিতী পূর্বঃ সঞ্জগানাসু কৃষ্টি। অরক্ষদ দাশুষে গয়৷৷ ২৷৷ সনো বেদো অমাত্যমগ্নী রক্ষতু শন্তমঃ। উম্মান পাত্মহংসঃ ৷৷ ৩৷৷ উত ব্রুবন্তু জন্তব উদগ্নিবৃত্ৰহাজনি। ধনঞ্জয়ো রণেরণে৷৷ ৪৷

সূক্ত ২) অগ্নে যুঙ্ক্ষা হি যে তবাশ্বাসো দেব সাধবঃ। অরং বহত্যাশবঃ ॥১॥ অচ্ছা নো যাহা বভি প্রয়াংসি বীতয়ে। আ দেবানমপীতয়ে। ২। উদগ্নে ভারত দুমদজস্রেণ দবিদ্যুতং শোচা হি ভাহজর৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৩– প্র সুশ্বানানায়ান্ধসসা মর্তো ন বষ্ট তদচঃ। অপ শ্বানমরাধসং হতা মখং ন ভৃগবঃ৷৷ ১৷৷

আ জামিরৎকে অব্যত ভুজে ন পুত্র ওণ্যোঃ । সরঞ্জারো ন ঘোষণাং বরো ন যোসিমাসদ৷৷ ২৷৷ ১৩৮৮ স বীরো দক্ষসাধনো বি যস্তস্তম্ভ রোদসী। হরি পবিত্রে অব্যত বেধা ন যোনিমাসদ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– হিংসাপ্রত্যবায়রহিত যজ্ঞকে সমীপে প্রাপ্ত হয়ে, অর্থাৎ সৎকর্মের অনুষ্ঠান করে, জ্ঞানদেবতার নিমিত্ত মন্ত্রকে আমরা যেন উচ্চারণ করি। (ভাব এই যে, — সৎকর্মের অনুষ্ঠানের সাথে আমরা যেন জ্ঞান অর্জনে প্রবৃত্ত হই); দূরে অবস্থিত থেকেও তিনি আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করেন। (ভাব এই যে, — অজ্ঞান আমরা যদিও জ্ঞান থেকে দূরে অবস্থিত হই, কিন্তু আমাদের সৎকর্ম-সাধনের দ্বারা জ্ঞান আমাদের সমীপবর্তী হন)। [অগ্নয়েঅর্থাৎ জ্ঞানদেবতার উদ্দেশে, আমরা যে মন্ত্র উচ্চারণ করি– এই সঙ্কল্প থেকেই জ্ঞানার্জনে প্রবৃত্ত হবার ভাবই প্রকাশ পায়। দেবতার পূজায়– দেবভাব অধিগত করাই বুঝিয়ে থাকে। দেবী সরস্বতীর আরাধনায় বিদ্যার্জন অর্থই সংসূচনা করে। এই দৃষ্টিতেই বোঝা যায়, প্রার্থনাকারী এখানে জ্ঞানার্জনেই সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছেন; আবার প্রার্থনাকারী বুঝেছেন, — অজ্ঞানতা-নিবন্ধন আমরা যদি দূরে পড়ে থাকি, সৎকর্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হলে, জ্ঞান আমাদের নিকটস্থ হন। শৃগ্ধতে পদে শ্রবণ করেন অর্থ থেকেই, জ্ঞান আমাদের সান্নিধ্যে আসেন, আমরা জ্ঞানের অধিকারী হতে পারি– এই ভাবই পাওয়া যায়]।

১/২– শত্রুকর্তৃক আক্রান্ত (অথবা– সকলের প্রতি অথবা ভগবানের প্রতি প্রীতিসম্পন্ন) দেবসামীপে আগত সাধকগণের মধ্যে যে দেবতা নিত্যকাল নিজেকে রক্ষা করেন (অর্থাৎ যে দেবতার অনুকম্পায় তাঁর অনুরাগী জন রক্ষা প্রাপ্ত হয়); সেই দেবতা উপাসকের নিমিত্ত রক্ষার উপায় বিধান করে রেখেছেন। (এই মন্থটি দেবতার মাহাত্ম্য-প্রকাশক; দেব-অনুরক্ত জনগণ যদি শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হন, দেবগণই তাদের রক্ষা করেন এবং তাদের শ্রেয়ঃসাধন করে থাকেন)।

১/৩– পরমসুখদায়ক প্রসিদ্ধ সেই জ্ঞানদেব আমাদের পরাজ্ঞান (অথবা পরমধন) এবং হৃদয়ে অবস্থিত জ্যোতিঃকে বিনাশ হতে রক্ষা করুন; অপিচ, প্রার্থনাকারী আমাদের পাপকবল হতে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত জ্যোতির্ময় জ্ঞানকে এবং আমাদের রিপুকবল হতে রক্ষা করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে এই মন্ত্রার্থের বিশেষ অনৈক্য ঘটেনি; একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই অগ্নি আমাদের অমাত্য, ধন, সমস্ত বিপদ হতে রক্ষা করুন, এবং আমাদের পাপ হতে রক্ষা করুন। কেবল জ্বলন্ত অগ্নির কাছেই এমন প্রার্থনা, মনে সংশয় আনে। জ্ঞানদেব অগ্নি বা জ্ঞানাগ্নির কাছেই এমন প্রার্থনা সমীচীন ও সঙ্গত, বোঝা যায়]।

১/৪– আর, অজ্ঞানতারূপ শত্রুর নাশকারী, সকলরকম সংগ্রামে, অর্থাৎ বাহিরের ও অন্তরের এ বিপ্লবে শত্ৰুজয়কারী, জ্ঞানদেবতা আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন হোন, অথবা সৎকর্মের সাথে সকলের হৃদয়ে সঞ্জাত হোন; এবং অজ্ঞান-অন্ধকারাচ্ছন্ন মনুষ্যগণও তাঁকে স্তব করুক– তার পূজা করুক, অর্থাৎ জ্ঞানের অনুসারী হোক। (ভাব এই যে, — জ্ঞানের উৎপত্তির সাথে মানুষ জ্ঞানের অনুসারী হোক– আমরা যেন জ্ঞানের অনুসারী হই-এটাই প্রার্থনা)। [রণেরণে পদে বহিঃসংঘর্ষের এবং অন্তরস্থ বিপ্লবের বিষয় সিদ্ধান্তিত হয়। হৃদয়ের মধ্যে, রিপুবর্গের সংঘর্ষে, যে বিপদ উপস্থিত হয়, এবং বাহির থেকে বহিঃশত্রু থেকে– যে সকল বিপদ এসে আমাদের আক্রমণ করে; জ্ঞানের সাহায্যে তাদের সকলকেই আমরা দূর করতে সমর্থ হই]। [এই সূক্তের ১ম ও ২য় সামের ঋষি গোতম রাহুগণ এবং ৩য় সামের ঋষি– বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি]।

২/১– দ্যোতমান হে অগ্নিদেব! আপনার ক্ষিপ্রগামী সত্যস্বরূপ যে ব্যাপক কিরণসমূহ, আমাদের শীঘ্রই পরমার্থ প্রাপ্ত করায় (অর্থাৎ আপনার যে কিরণপ্রভাবে আমরা শীঘ্রই পরমার্থ লাভ করি); আপনার সেই কিরণসমূহ আমাদের হৃদয়দেশে প্রোদ্ভাসিত করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! আপনার কিরণস্বরূপ শুদ্ধজ্ঞানের দ্বারাই আমরা যেন পরমার্থ লাভ করতে সমর্থ হই)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-৩দ-৫সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২/২– হে জ্ঞানদেব! আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন; আমাদের পূজা-আরাধনা গ্রহণের জন্য, এবং আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভার গ্রহণের জন্য সকল দেবভাব আমাদের প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন দেবভাব লাভ করি; ভগবান আমাদের প্রাপ্ত হোন)।

২/৩– সজ্জনপালক হে জ্ঞানদেব! প্রকৃষ্টরূপে আমাদের হৃদয়কে উজ্জ্বল করুন; নিত্যতরুণ হে দেব! পরম জ্যোতির্ময় আপনি প্রভূত পরিমাণে জ্যোতিঃর সাথে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরমজ্যোতির্ময় পরাজ্ঞান প্রকৃষ্টরূপে আমাদের হৃদয়ে লাভ করি)। [ভারত শব্দ ভৃ-ধাতু-নিষ্পন্ন। ভৃ ধাতুর অর্থ ভরণ করা, পোষণ করা। যিনি পোষণ করেন, সৎ-জনদের যিনি পালক, তিনিই ভারত অগ্নি অর্থাৎ জ্ঞানদেবই সেই সৎ-জন-পোষক। জ্ঞানের বলেই মানুষ বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পায়, আত্মশক্তির অধিকারী হয়। অজর পদেও সেই নিত্যতরুণ, চিরনবীন বস্তুকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। সেই পরমবস্তু (জ্ঞান) লাভ করবার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে)। [সূক্তটির ঋষি– বীতহব্য ভরদ্বাজ বা বার্হস্পত্য]।

৩/১– সাধক যেমন বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব সম্বন্ধীয় জ্ঞান গ্রহণ করেন এবং সাধকগণ যেমন সৎকর্ম সম্পাদন করেন, তেমনই হে আমার চিত্তবৃত্তি সমূহ! তোমরা সাধনবিঘ্নকারী রিপুদের বিনাশ করো, অর্থাৎ বিনাশ করে জ্ঞানসম্পন্ন এবং সৎকর্ম-সাধনরত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মান্বিত এবং জ্ঞানসম্পন্ন হই)। (মন্ত্রটির মধ্যে দুটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমটি মৰ্ত্তঃ ন অর্থাৎ সাধকগণ যেমন জ্ঞানগ্রহণে…। সাধকেরা তাদের সাধনার বলে নিজেদের চিত্তবৃত্তিগুলিকে ভগবৎ-অভিমুখী করেন। সাধনার প্রভাবে তাদের হৃদয়ের মলিনতা দূরীভূত হয়। সেই সাধনাগ্নিপূত হৃদয়ে সত্ত্বভাব পরাজ্ঞান পূর্ণজ্যোতিতে আবির্ভূত হয়ে থাকে। মানুষের হৃদয়ই জ্ঞানের উৎপত্তিস্থল। উপযুক্ত সাধনার দ্বারা মানুষ মাত্রেই পরাজ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন। ভগবান্ কাউকেই জ্ঞানদানে বিমুখ নন। কেবলমাত্র সেই জ্ঞান ধারণ করবার উপযোগী হৃদয় প্রস্তুত ও করা চাই। যিনিই সেই উপযোগিতা লাভ করবেন, জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে তিনিই ভগবানের সেই বা পরমদান গ্রহণ করতে সমর্থ হবেন। আমরাও মানুষ, আমরাও সেই পরমধন লাভ করবার অধিকারী; কেবলমাত্র সেই জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা চাই। মৰ্ত্তঃ ন উপমায় সেই সাধন-ধারার ইঙ্গিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় উপমা ভৃগবঃ ন মখং। সাধকেরা যেমন সৎকর্ম সাধন করেন তেমনই সৎকর্ম সাধনের জন্য আত্ম-উদ্বোধনই এই উপমার লক্ষ্য। এই উপমা থেকেও প্রথমোক্ত উপমার সার্থকতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে তার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ কল্পনা করা হয়েছে। এই দ্বিতীয় উপমার ব্যাখ্যায় এক আখ্যান উল্লেখিত হয়েছে। তা এই যে, — মখ নামক সাধনকর্মরহিত– ব্যক্তিকে ভৃগুগণ নাকি নিধন করেছিলেন। এই উপাখ্যান কোথা থেকে এল, তা জানা যায়নি। ভৃগু পদে সৎকর্মসাধনশীল অর্থই সঙ্গত ও সমীচীন। মখং শব্দ নিরুক্তে যজ্ঞ, সৎকর্ম ইত্যাদি-বাচক পর্যায়ভুক্ত। তা হঠাৎ অরাধসং অর্থাৎ সাধনকর্মরহিত হলো কেমন করে তা-ও বোঝা যায় না]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৮দ-৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৩/২– পুত্র যেমন মাতাপিতার ক্রোড়ে সম্বন্ধ হয়, তেমনভাবে বন্ধুভূত শুদ্ধসত্ত্ব পবিত্রহৃদয়ে সম্যকরূপে আবির্ভূত হন; সৎকর্মসাধক যেমন দিব্যজ্যোতিঃ প্রাপ্ত হন, এবং বর যেমন কন্যাকে প্রাপ্ত হয়, তেমনভাবে সেই শুদ্ধসত্ত্ব পবিত্র হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা তাদের পবিত্র হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বকে লাভ করেন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– আমাদের আত্মীয় এই সোম পবিত্রের উপর তেমনিভাবে অঙ্গ সংস্থাপন করছেন, যেমন কোন বালক তাকে ধারণ করবার জন্য উদ্যত পিতামাতার হস্তের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেমন উপপতি প্রণয়িনীর প্রতি কিংবা বর কন্যার প্রতি যায়, তেমন ইনি (সোমরস) আপন আধারভূত কলসে যাবার জন্য অগ্রসর হচ্ছেন। পবিত্র বেদের মধ্যে এমন উপমা উপযুক্তই বটে। আবার উপমার উদ্দেশ্য সোমরস, তা প্রচলিত মত অনুসারেই মাদকদ্রব্য; সুতরাং যুগেন যোগ্যং যোজয়েৎ নীতি অনুসারেই উপমান ও উপমেয় নির্বাচিত হয়েছে। যেমন মাদকদ্রব্য, তেমনি তার উপযুক্ত উপমা-উপপতি। অথচ জারঃ শব্দের অর্থ– জারয়িতা প্রবর্ধয়িতা– যা প্রবৃদ্ধ করে। এই পদের অর্থ সম্বন্ধে আগেও আলোচনা করা হয়েছে। আর একটি পদ– ঘোষণাং। এর প্রকৃত অর্থ– জ্যোতিঃ, দীপ্তি। কিন্তু ভাষ্যকার অর্থ করেছেন– অসতী স্ত্রিয়ং। ঘোষণা শব্দে যদি স্ত্রীলোক অর্থ প্রকাশ করে তবে সেই স্ত্রীলোককে যে অসতী হতেই হবে তার কোন অর্থ আছে কি?– অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৩/৩– শক্তিদায়ক প্রভূতশক্তিসম্পন্ন যে শুদ্ধসত্ত্ব, তিনি দ্যুলোক-ভূলোককে বিশেষভাবে আপন তেজের দ্বারা ব্যাপ্ত করেন (অথবা, ধারণ করে আছেন)। সৎকর্মসাধক যেমন সৎকর্মসাধন-স্থান প্রাপ্ত হন, তেমন পাপহারক সেই শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, পরমশক্তিদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে আবির্ভূত হন)। [এই সূক্তের ঋষি– প্রজাপতি বৈশ্বামিত্র বা বাকপুত্র। এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত সতেরটি গেয়গান আছে। তাদের নাম– মহাগৌরীবিতম, গৌতমম, ওকোনিধনম, ঔদলম, সাধ্রম্, শ্যাবাশ্বম্‌, ঔদলম, আকুপারম্, দৈবোদাসোত্তরম, শুদ্ধাশুদ্ধীয়ম, বৈশ্বামিত্রম, স্বারকৌৎসম, উরুক্ষয়ম, কণ্বরথন্তরম ইত্যাদি]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৪– অভ্রাতৃব্যো অনা ত্বমনাপিরিন্দ্র জনুষা সনাদসি। যুপেদাপিত্বমিচ্ছসে৷৷ ১. ন কী রেবন্তং সখ্যায় বিন্দসে পীয়ন্তি তে সুরা। যদা কৃগোষি নদনুং সমূহস্যাদিৎ পিতেব হয়সে৷৷ ২।

সূক্ত ৫– আ ত্বা সহস্ৰমা শতং যুক্তা রথে হিরণ্যয়ে। ব্রহ্মযুজো হয় ইন্দ্র কেশিনো বহন্তু সোমপীতয়ে৷৷ ১। আ ত্বা রথে হিরণ্যয়ে হরী ময়ূরশেপ্যা। শিতিপৃষ্ঠা বহতাং মধ্বে অন্ধসো বিবক্ষণস্য পীতয়ে। ২। পিবা ত্বতস্য গির্বণঃ সুতস্য পূর্বপা ইব। পরিষ্কৃতস্য রসিন ইয়মাসূতিশ্চারুমদায় পত্যতে৷৷ ৩

সূক্ত ৬– আসোতা পরি যিষ্ণতাশ্বং ন স্তোমমথুরং রজস্তুর। বনপ্রক্ষমুদপুত৷৷৷৷ সহস্রধারং বৃষভং পয়োদুহং প্রিয়ং দেবায় জন্মনে। ঋতেন য ঋতজাতে বি বাবৃধে রাজা দেব ঋতং বৃহৎ৷৷ ২৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৪সূক্ত/১সাম– পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে দেব! আপনি অজাতশত্রু এবং স্বতন্ত্র হন; আপনি অনাদিকাল হতে স্বতন্ত্র; চিরকাল যে জন রিপুসংগ্রামে আপনাকে আহ্বান করে, তাকে আপনি বন্ধু করেন। (ভাব এই যে, — অজাতশত্রু অনাদিদেব চিরকাল রিপুসংগ্রামে সাধকের সহায় হন)।

৪/২– হে দেব! সৎকর্মরহিত বৃথাগর্বিত মূঢ় ব্যক্তিকে আপনি সখিত্ব লাভের জন্য আশ্রয় করেন (অর্থাৎ সে আপনার কৃপা লাভ করতে সমর্থ হয় না); সেই সুরাপায়ী প্রমত্ত জনগণ আপনাকে আরাধনা করে না; হে দেব! যখন আপনি কোনও স্তোতাকে আপনার আশ্রিত করেন তখন তাকে পরমধন প্রদান করেন তারপর সেই সাধকের দ্বারা আপনি পিতার ন্যায় আরাধিত হন। (মন্ত্রটি এ নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সৎকর্মরহিত লোকগণ ভগবানকে প্রাপ্ত হয় না। সাধকগণ পরমধন লাভ করেন)। [এই সূক্তের ঋষির নাম– সোভরি কাথ। এর অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত উকথামহীরবম্]।

৫/১– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণের নিমিত্ত অথবা আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করাবার জন্য, অর্থাৎ আমাদের কর্মসমূহের সাথে শুদ্ধসত্ত্বভাবের সম্মিলিনের জন্য, জ্ঞানরশ্মিযুক্ত অর্থাৎ সৎপথপ্রদর্শক, ব্রহ্মের দ্বারা যুক্ত অর্থাৎ ভগবানের সংন্যস্ত, নিখিল জ্ঞানকিরণসমূহ, হিরণ্যের ন্যায় আকাঙ্ক্ষণীয় সৎকর্মৰূপ রথে যুক্ত হয়ে, আমাদের হৃদয়ে অথবা আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মে আপনাকে প্রকৃষ্টরূপে আনয়ন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাবার্থ এই যে, আমাদের কর্ম জ্ঞানভক্তি-সহযুত ও শুদ্ধসত্ত্ব-সমন্বিত হোক; অপিচ, তেমন কর্ম আমাদের ভগবানে নিয়োজিত করুক)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-২দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৫/২– হে দেব! অমৃতময় পরম আকাক্ষণীয় শুদ্ধসত্ত্বের প্রাপ্তির জন্য বিচিত্র বিশুদ্ধ পাপনাশক ভক্তিজ্ঞান মঙ্গলদায়ক সৎকর্মসাধনের দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকেরা জ্ঞানভক্তিযুক্ত সৎকর্মের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হন)।

৫/৩– পরম আরাধনীয় হে দেব! আদিস্বরূপ আপনি আমাদের হৃদয়স্থিত নির্মল অমৃতময় প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বকে শীঘ্র গ্রহণ করুন; এই কল্যাণকর, হৃদয়ে উৎপাদিত শুদ্ধসত্ত্ব পরম আনন্দদানে সমর্থ হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব পরমানন্দ প্রদান করে; ভগবান্ কৃপা করে আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন)। [প্রার্থনা আরাধনা প্রভৃতি ভগবৎপূজার নানারকম উপকরণ আছে সকল উপকরণের শ্রেষ্ঠ উপকরণ হৃদয়ের বিশুদ্ধ ভাব– শুদ্ধসত্ত্ব। যিনি ভগবানের চরণে নিজের বিশুদ্ধ হৃদয়ভাব নিবেদন করতে পারেন, সর্বশ্রেষ্ঠ পূজোপকরণ হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব তাকে অর্পণ করতে পারেন, আর যাঁর সেই অর্ঘ্য গৃহীত হয়, তার পূজাই সার্থক। এই সার্থকপূজার অধিকার লাভের জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এই সূক্তটির ঋষি– মেধাতিথি ও মেধ্যাতিথি কাণ্ব। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– অভীবর্তম, ভরদ্বাজম ইত্যাদি]।

৬/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! ব্যাপকজ্ঞানতুল্য আশুমুক্তিদায়ক প্রার্থনীয় অমৃতপ্রাপক (অথবা ত্রাণকারক) শক্তিদায়ক জ্যোতির্ময় অমৃতময় সত্ত্বভাবকে তোমরা হৃদয়ে উৎপাদন করো এবং তাকে বিশুদ্ধ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন মোক্ষপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করতে পারি)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-১১দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৬/২– সত্যজাত (অথবা সৎকর্মের দ্বারা উৎপন্ন) সর্বলোকাধীশ সত্যস্বরূপ যে দেবভাব সত্যের দ্বারা (অথবা সৎকর্মের দ্বারা) বর্ধিত হন, বহুশক্তিযুক্ত, অভীষ্টবষক, অমৃতদায়ক, আনন্দদায়ক, সেই দেবভাবকে মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য যেন আমরা লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, মোক্ষপ্রাপক দেবভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [ঋত শব্দ সাধারণতঃ দুঅর্থে ব্যবহৃত হয়। এক অর্থ-সত্য অন্য অর্থ সৎকর্ম। বর্তমান স্থলে দুটি অর্থেই সঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। সৎকর্মের সাধনের দ্বারা মানুষ সত্যলাভ করতে সমর্থ হয়, আবার সেই সত্যই মানুষকে দেবত্বে পৌঁছিয়ে দেয়। তাই দেবভাবকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে– ঋতেন বিবাবৃধে। অর্থাৎ সত্যের দ্বারা প্রবর্ধিত হয়। সত্যের বলে মানুষ দেবত্ব লাভ করে]। [এই সূক্তের ১ম সামের ঋষি–ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ ও ২য় সামের ঋষি– ঊর্ধ্বসদ্মা আঙ্গিরস। এই সূক্তান্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। প্রথম দুটির নাম– বাচঃসাম এবং তৃতীয়টির নাম—সফম]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৭– অগ্নিবৃত্রাণি জঙঘন দ্রবিণস্যুর্বিপনয়া। সমিঃ শুক্র আহুত। ১৷৷ গর্ভে মাতুঃ পিতুষ্পিতা বিদিদ্যুতাননা অক্ষরে। সীদঘৃতস্য যোনিমা৷৷ ২৷ ব্রহ্মা প্রজাবদা ভর জাতবেদা বিচৰ্ষণে। অগ্নে যদ দীদয় দিবি৷৷ ৩৷

সূক্ত ৮– অস্য প্রেষা হেমনা পূয়মাননা দেবো দেবেভিঃ সমপৃক্ত রস। সুতঃ পবিত্রং পযেঁতি রেভনমিতেব সদ্ম পশুমন্তি হোতা। ১৷ ভদ্রা বা সমন্যাভবসানো মহান কবিনির্বচনানি শংস। আ বচ্যস্ব চম্বোঃ পূয়মানো বিচক্ষণা জাগৃবিৰ্দেববীতৌ। ২। সমু প্রিয় মৃজ্যতে সানৌ অব্যে যশস্তরে যশসাং ক্ষৈতো অস্মে। অভি স্বর ধন্বা পয়মানো য়ং পাত স্বস্তিভিঃ সদা নঃ ৷৷ ৩.

সূক্ত ৯– এতো দ্বিন্দ্ৰং স্তবাম শুদ্ধং শুদ্ধেন সাম্রা। শুদ্বৈরুক্থৈবা ধ্বংসং শুদ্ধৈরাশীর্বান্মমভু৷৷ ১৷৷ ইন্দ্র শুদ্ধো ন আ গহি শুদ্ধঃ শুদ্ধাভিরুতিভিঃ। শুদ্ধো রয়িং নি ধারয় শুদ্ধো মমদ্ধি সোম্য৷ ২৷৷ ইন্দ্ৰ শুদ্ধো হি নো রয়িং শুদ্ধো রত্নানি দাশুষে। শুদ্ধো বৃত্রাণি জিয়সে শুদ্ধো বাজং সিষাসসি৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৭সূক্ত/১সাম– অভীষ্টধনপ্রদ, সম্যক্ দীপ্যমান স্বপ্রকাশ, নির্মল শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ সর্বব্যাপী জ্ঞানদেব, আমাদের কর্তৃক সম্পূজিত ও স্তুত হয়ে অর্থাৎ আমাদের দ্বারা সর্বথা অনুসৃত হয়ে, আমাদের শত্রুগণকে অর্থাৎ অজ্ঞানতারূপ আমাদের অন্তঃশত্রু ও বহিঃশত্রু সকল শত্রুকে সংহার করুন। (এই মন্ত্রে অন্তঃশত্রু ও বহিঃশত্রু নানারকম শনাশের কামনা অর্থাৎ অজ্ঞান-অন্ধকারের নাশের কামনা প্রকাশ পেয়েছে)। [বিভিন্ন দিক থেকে এই মন্ত্রের বিভিন্ন অর্থ পরিগৃহীত এবং প্রচলিত আছে। প্রকৃতপক্ষে এ মন্ত্রে বহিঃশত্রু এ অন্তঃশত্রু– নানা শত্রু-বিনাশের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রের বৃত্ৰাণি পদে, পৌরাণিক বৃত্রাসুর নয়, সকল দিকের সকল রকম শত্রুর প্রতি লক্ষ্য আছে। এই সব শত্রুরই সৃষ্টির মূল অজ্ঞানতা। ভগবান্ জ্ঞানদানে সেই অজ্ঞানতাকে দূরীভূত করুন]।

৭/২– বিশ্বের মূলকারণস্বরূপ, জ্যোতিঃস্বরূপ, আপন-আত্মায় স্থিত অর্থাৎ কুটস্থ পরমব্রহ্ম সত্যের (অথবা সৎকর্মের) আশ্রয়স্থান আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি)। [প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রের মূল প্রার্থনা– ব্ৰহ্মপ্রাপ্তি। তিনি মাতার মাতা, তিনি পিতার পিতা। তিনি কারণের কারণ। অক্ষরে গর্ভে পদ দুটিতে কুটস্থব্রহ্মের স্বরূপ উপলক্ষিত হচ্ছে। সেই পরমব্রহ্ম যাতে আমাদের হৃদয়-সিংহাসনে এসে আবির্ভূত হন, মন্ত্রে সেই জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে]।

৭/৩– সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, জ্ঞানস্বরূপ হে পরব্রহ্ম! যে পরমধন দ্যুলোকে দীপ্তি পায় সেই শক্তি দায়ক পরমধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [এখানেও মন্ত্রের প্রার্থনা পরব্রহ্মের প্রতিই প্রযুক্ত হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি– বীতহব্য ভরদ্বাজ বা বার্হস্পত্য]।

৮/১– পরমধনদানে পবিত্রকারক ভগবান্ তাঁর অমৃতকে লোকগণের হিতের জন্য দেবভাবের সাথে সংযোজিত করেন। (ভাব এই যে, -দেবভাবের দ্বারা মানুষ অমৃত লাভ করে)। অপাপবিদ্ধ দেবতা যেমন পবিত্র হৃদয়কে প্রাপ্ত হন, তেমন প্রার্থনাপরায়ণ সৎকর্মসাধক রিপুগণকে বিনাশ করবার জন্য সৎকর্মসাধনস্থল প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, — সৎকর্মের সাধনের দ্বারা রিপুনাশ হয়)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৬দ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– কল্যাণদায়ক রিপুনাশক তেজ ধারণ করে পরাজ্ঞানদায়ক দেব আমাদের স্তোত্র গ্রহণ করুন; পবিত্ৰকারক সর্বদর্শী চৈতন্যস্বরূপ দেব আমাদের দেবত্বপ্রাপক কঠোর-সাধনে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)।

৮/৩– সুপ্রসিদ্ধ প্রীতদায়ক পৃথিবীস্থ জনগণের হৃদয়ে উৎপন্ন শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের কল্যাণের জন্য প্রকৃষ্টরূপে বিশুদ্ধ নিত্যজ্ঞান-প্রবাহে সম্মিলিত হয়। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক আপনি আমাদের দিব্যজ্ঞান প্রদান করুন এবং পরমকল্যাণসাধনের দ্বারা সর্বদা আমাদের রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — পরিত্রাণের জন্য আমরা পরাজ্ঞান লাভ করব)। [দৃশ্যমান জাগতিক বস্তুমাত্রই অনিত্যতার স্বরূপও এক নয়। যেমন, রৌদ্রময় দিনে দূর থেকে কোন বৃক্ষকে দেখলে তার যে রূপ যে বর্ণ দেখা যায়, কাছ থেকে তার অন্যরকম রূপ ও বর্ণ দেখা যায়, মেঘাচ্ছন্ন দিনে দূর বা কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও বর্ণ দেখা যায়। সুতরাং ঐ বৃক্ষ সম্পর্কিত যে জ্ঞান, তা অনিত্যজ্ঞান– পরিবর্তনশীল বোধ। সেই আদিকারণ পরমপুরুষ সম্বন্ধে যে জ্ঞান, তা-ই সত্যজ্ঞান, নিত্যজ্ঞান। পরব্রহ্ম চিরন্তন, এক রূপ। মন্ত্রে মোক্ষদায়ক এই জ্ঞানকেই লক্ষ্য করা হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি– বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি। এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম—উহুবায়িবাসিষ্ঠম]।

 ৯/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! শীঘ্র জাগরিত হও। অপাপবিদ্ধ বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে পবিত্র স্তোত্রের দ্বারা আমরা যেন.আরাধনা করি; বিশুদ্ধ স্তোত্রসমূহের দ্বারা মহান্ দেবতাকে আমরা করি; পবিত্র অপাপবিদ্ধ সে দেবতা শুদ্ধসত্ত্বভাব সমূহের দ্বারা আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করি; তিনি যেন আমাদের সকল রকমে শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করেন)। [ইং শুদ্ধং শুদ্ধেন সাম্রা– পদগুলির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকার এক আখ্যায়িকার অবতারণা করেছেন। সেই আখ্যায়িকার মর্মার্থ এই যে, বৃত্রকে হত্যা করায় ইন্দ্রের মনে হলো, তিনি ব্রহ্মহত্যা পাপে লিপ্ত হয়েছেন; তাই ঋষিদের কাছে গিয়ে বললেন আমাকে তোমরা শুদ্ধ করে দাও। ঋষিরা ইন্দ্রকে সাম-মন্ত্রের দ্বারা শুদ্ধ করে নিয়ে বিশিষ্ট স্তোত্রের দ্বারা তার স্তব করলেন। এই উপাখ্যান সম্বন্ধে কিছু বলা অনাবশ্যক। শুদ্ধং ইন্দ্রং পদ দুটির জন্য এত কথা বলা হয়েছে এবং সেইজন্য ভাষ্যকার আপ্তবাক্যের উল্লেখ করেছেন। ইন্দ্রং পদের সঙ্গে। যখন শুদ্ধং আছে, তখন মনে করতেই হবে যে, ইন্দ্র নিশ্চয়ই একবার অশুদ্ধ হয়েছিলেন। এটাই বোধ হয় ভাষ্যকারের যুক্তি। কিন্তু তিনি যে শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং। বেদের মহান্ গভীর ভাবসমূহ পরবর্তীকালে কেমন বিকৃত আকার ধারণ করেছে, লক্ষণীয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-১২দ ৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৯/২– বলাধিপতি হে দৈব! বিশুদ্ধ আপনি আমাদের প্রাপ্ত হোন; শুদ্ধ আপনি বিশুদ্ধ রক্ষাশক্তির সাথে আগমন করুন; বিশুদ্ধ আপনি আমাদের পরমধন প্রদানের জন্য আগমন করুন (পরমধন প্রদান করুন)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)।

৯/৩– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! বিশুদ্ধ আপনিই আমাদের পরমধন প্রদান করুন; শুদ্ধ আপনি আরাধনাপরায়ণ আমাদের পরমধন প্রদান করুন;অপাপবিদ্ধ আপনি জ্ঞানের অবরোধক পাপ বিনাশ করুন; হে দেব! বিশুদ্ধ আপনি আমাদের আত্মশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। (পূর্ববর্তী দুটি মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রেও সেই শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং পরমদেবতার কাছে পরমধনপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। ভগবানের পবিত্রতার বিষয় লোকসাধারণের হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণা জন্মিয়ে দেবার জন্য এই মন্ত্রেও শুদ্ধ শব্দটি চারবার ব্যবহৃত হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষিতিরশ্চী আঙ্গিরস। সূক্তান্তৰ্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত গেয়গানের নাম—শুদ্ধাশুদ্ধীয়োত্তরম]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১০– অগ্নে স্তোমং মনামহে সিমদ্য দিবিশৃশঃ। দেরস্য দ্রবিণস্যবঃ৷৷ ১৷৷ অগ্নিৰ্জুত নো গিরো হোতা যো মানুষেধা। . স যক্ষ দৈব্যং জনম্৷৷ ২. ত্বমগ্নে সপ্রথা অসি জুষ্টো হোতা বরেণ্যঃ। ত্বয়া যজ্ঞং বি তন্বতে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১১– অভি ত্রিপৃষ্ঠং বৃষণং বয়োধামঙ্গোষিণমবাবশন্ত বাণী। বনাবসানো বরুণো ন সিন্ধুর্বি রত্নধা দয়তে বার্ষাণি৷ ১। শূরগ্রামঃ সর্ববীরঃ সহাবাঞ্জেতা পবস্ব সনি ধনানি। তিস্মায়ুধঃ ক্ষিপ্রধন্বা সমৎস্বষাঢ়ঃ সাত্মান পৃতনাসু শর্জন৷ ২৷৷ উরুগতিরভয়ানি কৃম্বৎসমীচীনে আ পবস্বা পুরন্ধী। অপঃ সিষাসনুষসঃ স্বহতৰ্গাঃ সং চিক্ৰদো মহো অস্মভ্যং বাজা৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১২– মিন্দ্র যশা অস্যজীষী শবসম্পতিঃ। ত্বং বৃত্রাণি হংসপ্রতীনেক ইৎ পূর্বত্তশ্চর্ষণীধৃতিঃ ১। তমু বা নমসুর প্রচেসং রাধো ভাগমিবেমহে। মহীব কৃত্তিঃ শরণা ত ইন্দ্র প্র তে সুম্না নো অব৷৷ ২.

সূক্ত ১৩– যজিষ্ঠং ত্বা ববৃমহে দেবং দেবত্ৰা হোতারমমর্ত্যম্। অস্য যজ্ঞস্য সুক্ৰতু৷ ১। অপাং নপাতং সুভগং সুদীদিতিমগ্নি শ্রেষ্ঠশোচিষম্। স নো মিত্রস্য বরুণস্য সো অপামা সুম্নং যক্ষতে দিবি। ২

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১০সূক্ত/১সাম– নিত্যকাল পরমধনার্থী আমরা যেন স্বর্গপ্রাপক জ্ঞানদেবের সিদ্ধিদায়ক প্রার্থনা উচ্চারণ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন নিত্যকাল ভগবৎপরায়ণ হই)। [মন্ত্রে অগ্নিকে ধনদাতা বলা হয়েছে। অগ্নি (সাধারণ প্রজ্বলিত অগ্নি) ধনদাতা হবেন কেমন করে? অগ্নি তো সর্বধ্বংসকারী। কিন্তু জ্ঞানাগ্নিই মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্ব দিতে পারে। জ্ঞানের বলেই মানুষ দেবত্বলাভে সমর্থ হয়। তাই এই পরমবস্তু-জ্ঞানাগ্নির স্তুতিই মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যাতে আমরা ভগবৎশক্তি সেই পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি, তার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১০/২– দেবভাবের উৎপাদক যে জ্ঞানদেব মানুষের হৃদয়ে বর্তমান আছেন, সেই জ্ঞানদেব আমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করুন; সেই দেবতা দেবত্বপ্রার্থী আমাকে অনুগ্রহ করুন– গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি ৪ প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় পরাজ্ঞানের অধিকারী হই)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– যে অগ্নি মনুষ্যগণের মধ্যে অবস্থান করে দেবগণের আহ্বান করেন, সেই অগ্নি আমাদের স্তব সকল গ্রহণ করুন এবং যজ্ঞীয় দ্রব্যজাত দেবগণের সমক্ষে বহন করুন। এইবারে, এই ব্যাখ্যা থেকে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রচলিত ব্যাখ্যাকাররাও এখানে অগ্নি শব্দে সাধারণ অগ্নিকে লক্ষ্য করেননি। কারণ এই পরিদৃশ্যমান অগ্নি মানুষের মধ্যে অবস্থান করে না, অথবা দেবগণকেও আহ্বান করতে অসমর্থ। সুতরাং কাষ্ঠ ইত্যাদি-দাহনশীল অগ্নি ব্যতীত অন্য কোনও বিশেষ বস্তুর প্রতি লক্ষ্য আসে। ঐ বস্তুটিই– জ্ঞানাগ্নি, পরাজ্ঞান। মানুষের অন্তরস্থায়ী এই জ্ঞানই তাকে মোক্ষপথে পরিচালিত করে]।

১০/৩– হে জ্ঞানদেব! আপনি সর্বদা প্রীতচিত্ত, বিশ্বব্যাপক, দেবভাব-উৎপাদক বরণীয় হন; আপনার সাহায্যে-সৎকর্ম সম্পাদিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা জ্ঞানের দ্বারা সৎকর্ম সম্পন্ন করতে সমর্থ হন)। [এই সূক্তের ঋষি– সুতম্ভর আত্রেয়]।

১১/১– সর্বলোকপূজিত অভীষ্টবর্ষক শক্তিদাতা, স্তুতিদ্বারা আরাধিত দেবতাকে কামনাকারী আমাদের প্রার্থনা, সেই দেবের অভিমুখে গমন করুক। (ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের স্তুতিপরায়ণ হই)। কারুণ্যরূপ দেবতারতুল্য জ্যোতিঃধারণকারী, পরমধনদাতা, অভীষ্টপূরক দেবতা বরণীয় ধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৬দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১১/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! মহাপরাক্রমশীল বীরশ্রেষ্ঠ, অপরাজেয় রিপুনাশক পরমধনদাতা আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; রক্ষাস্ত্রধারী, আশুরিপুবিনাশক রিপুসংগ্রামে অপরাজেয় আপনি রিপুসংগ্রামে শত্রুদের বিনাশ করুন। মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি, এবং রিপুজয়ী হই)।

১১/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! উন্নতিবিধায়ক, মোক্ষদায়ক, পার্থিবজনকে স্বর্গপ্রদায়ক আপনি অভয় প্রদান করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; অমৃত, জ্ঞানের উন্মেষণ, মোক্ষ, জ্ঞানকিরণ এবং মহৎ পরমধন প্রদায়ক সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন মোক্ষদায়ক অমৃতপ্ৰাপক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [প্রচলিত অনুবাদে মন্ত্রটিকে সোমার্থকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। সোমনামক মাদকদ্রব্যের যাবার পথ নাকি বিশাল; তিনি নাকি অভয় দান করতে ক্ষরিত হন। তিনিই নাকি জল ও প্রভাতের কর্তা এবং তার থেকেই নাকি প্রার্থনাকারী স্বর্গ ও গাভী লাভ করেন ইত্যাদি]। [এই সূক্তটির ঋষি-নৃমেধ ও পুরুমেধ আঙ্গিরস। এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম—সম্পাবৈয়শ্বম্]।

১২/১– পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি অশেষকীর্তিসম্পন্ন, শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চারক ও সকল শক্তির আধারভূত হন। আপনি অপ্রতিগত (অবাধগতি), অন্যের অপরাজেয়, নিখিলজ্ঞানের আবরক অজ্ঞানতারূপ শত্রুগণকে সম্যক্‌-ভাবে বিনাশ করেন। আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকগণের বিশিষ্টরূপে ধারণকর্তা অর্থাৎ রক্ষক আপনি অদ্বিতীয় হন। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম্য-প্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — হে ভগবন! অদ্বিতীয় আপনি আমাদের মধ্যে শুদ্ধ সত্ত্বের সঞ্চার করুন, অসৎবৃত্তির প্রভাব নাশ করুন এবং আমাদের আত্ম-উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ধনপতি ইন্দ্র! তুমি উপার্জিত সোমবান হয়ে যশস্বী হয়েছ। তুমি একাকী অপ্রতিহত এবং পরাজয়ে অশ্য, বৃত্ত্বগণকে মনুষ্যদের রক্ষক বজ্র দ্বারা হনন করেছ। ক ভাষ্যে বজ-শব্দের প্রয়োগ নেই। মন্ত্রেও তা দেখতে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রের তিনরকম বিভাগে তিন রকম প্রার্থনার ভাব বর্তমান। প্রথম অংশে বৃমিন্দ্র থেকে শবসম্পতিঃ পর্যন্ত, ত্বং অপ্রতীনি অনুত্তঃ পুরু বৃত্ৰাণ হংসি পর্যন্ত শনাশের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। হৃদয়ের শত্ৰু কাম ক্রোধ ইত্যাদি বিদূরিত না হলে, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের উদয় হয় না; শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চারিত না হলে হৃদয়ে শক্তির (অর্থাৎ ভগবানকে হৃদয়ে বসাবার সামর্থ্যের) উপজয় হয় না। সেইজন্যই শত্রুনাশের প্রার্থনা। চর্ষণীধৃতিঃ এক ইৎ অংশে ভগবানের স্বরূপ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে– আপনি আত্ম উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধকদের উদ্ধারকর্তা। আমি যাতে আত্ম-উৎকর্ষ সম্পন্ন হতে পারি, আপনি বিধান করুন। আপনি ভিন্ন সেই অসাধ্যসাধন আর কেউ করতে পারেন না। তাই প্রার্থনা, আপনি আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করুন; আমাদের অন্তরের শত্রুসমূহ বিনাশপ্রাপ্ত হোক; এবং শেষ পর্যন্ত আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনে আমরা আপনাতে লীন হই]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-২দ ৬সা) পরিদৃষ্ট হয়। বিবরণকারের মতে এই মন্ত্রের ঋষি একমাত্র পুরুমেধ। ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের শেষ চরণে একটু পরিবর্তন দৃষ্ট হয়]।

১২/২– বলব বলাধিপতে হে দেব! পুত্র যেমন পিতা হতে ধন প্রার্থনা করে, তেমনভাবে আমরা প্রজ্ঞানস্বরূপ প্রসিদ্ধ পিতৃতুল্য আপনার নিকট হতেই নিশ্চিতরূপে পরমধন প্রার্থনা করি; হে দেব! আপনার শক্তিদায়ক মহৎ আশ্রয়স্থান বর্তমান আছে, অর্থাৎ আপনিই পরমাশ্রয়; আপনার পরমমঙ্গল আমাদের প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের পরমধন এবং পরমমঙ্গল লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রে প্রধানভাবে পরমধন ও পরমমঙ্গল লাভের জন্য প্রার্থনা করা হলেও, তার মধ্যেও, ভগবানের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষি-নৃমেধ ও পুরুমেধ আঙ্গিরস। সূক্তান্তৰ্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গানের নাম– অভীবর্তম, দ্বিহিঙ্কারস্বামদেব্যম এবং যশম্]।

১৩/১– হে দেব! আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মের সুনিষ্পদক, যাজক-শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ ভগবানের শ্রেষ্ঠপূজক, দেবগণের আহ্বানকর্তা অর্থাৎ দেবভাব-প্রদাতা দেবগণের মধ্যে অতিশয়রূপে দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত, অবিনাশী মরণরহিত) আপনাকে আমরা সম্যকরূপে ভজনা করি– অর্চনা করি অনুবরণ করি। (ভাব এই যে, — জ্ঞানদেবতাই দেবত্বপ্রদায়ক। অতএব আমরা জ্ঞানের অনুসারী হই– এই সঙ্কল্প)। [মন্ত্রে জ্ঞানদেবের স্বরূপ পরিব্যক্ত। তিনি দেবগণের আহ্বানকর্তা অর্থাৎ হৃদয়ে দেবভাবের জনয়িতা, তিনি যাজকশ্রেষ্ঠ অর্থাৎ দেবগণের সন্তোষ-বিধানে হৃদয়ে দেবভাব আনয়নে একমাত্র পারদর্শী; তিনি দেবগণের মধ্যে অতিশয় দান ইত্যাদি গুণযুক্ত অর্থাৎ তার মতো মানুষের আর কেউ নেই; তিনি আবনাশী অর্থাৎ মরণরহিত বা চিরবর্তমান। জ্ঞান যে, অনন্তরূপ ভগবানের অঙ্গীভূত, এখানে তা-ই উপলব্ধ হয়]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-১২দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৩/২– অমৃত-প্রদায়ক, পরমধনদায়ক, উত্তমদীপ্তিযুত, সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেবকেই আমরা আরাধনা করছি; সেই জ্ঞানদেব (অগ্নিং) আমাদের মিত্রদেবতার (মিত্রস্য), অভীষ্টবর্ষক দেবতার (বরুণস্য) পরমকল্যাণ প্রদান করুন এবং সেই দেবতা মোক্ষলাভের জন্য অমৃতরূপ কল্যাণ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন অমৃতপ্রদান করুন)। [সূক্তটির ঋষি–সোভরি কাণ্ব। সূক্তান্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– সাধ্যম এবং ঐধমাবাহসম]।  

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৪– যমগ্নে পৃৎসু মৰ্তমবা বাজেযু যং জুনাঃ। স যন্তা শশ্বতীরিষঃ ৷৷ ১. ন কিরস্য সহন্ত্য-পর্যেতা কয়স্য চিৎ। বাজো অস্তি শ্ৰবাষ্যঃ। ২। স বাজং বিশ্বচৰ্ষণিরর্বদ্ভিরস্তু তরুতা। বিপ্রেভিরন্তু সনি৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৫– সাকমুক্ষো মর্জয়ন্ত স্বসাররা দশ ধীরস্য ধীতয়ে ধনুত্রীঃ।  হরিঃ পর্যদ্রবঞ্জাঃ সূর্যস্য দ্রোণং ননক্ষে অতত্যা ন বাজী৷৷৷৷৷ সং মাতৃভিন শিশুর্বাবশানো বৃষা দধন্ধে পুরুবারো অদ্ভিঃ। মর্যো ন যোমভি নিষ্কৃতং যৎসং গচ্ছতে কলশ উঠিয়াভিঃ। ২৷৷ উত প্র পিপ্য উধরগ্ন্যায় ইন্দুর্ধারাভিঃ সচতে সুমেধাঃ। মূর্ধানং গাবঃ পয়সা চমূম্বভি শ্রীণন্তি বসুভির্ন নিক্তৈঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৬– পিব সূতস্য রসিনো মৎস্য ন ইন্দ্ৰ গোমতঃ। আপির্নো বোধি সধমাদ্যে বৃধেতহস্মাং অবন্তু তে ধিয়ঃ ॥১॥ .. ভূয়াম তে সূমতৌ বাজিনো বয়ং মান স্তরভিমাতয়ে। অস্মাং চিত্রাভিরবতাদভিষ্টিভিরা নঃ সুমেষু যাময়৷৷ ২.

সূক্ত ১৭– ত্রিরস্মৈ সপ্ত ধেনবো দুদুহিরে সত্যামাশিরং পরমে ব্যোমনি।

চত্বাৰ্যন্যা ভুবনানি নির্ণিজে চারূণি চক্রে যদ ঋতৈরবধত৷৷ ১৷ স ভক্ষমাণে অমৃতস্য চারুণ উভে দ্যাবা কাব্যেনা বি শশ্রথে। তেজিষ্ঠা অপো মংহনা পরি ব্যত যদী দেবস্য শ্ৰবসা সদো বিদূঃ। ২। তে অস্য সন্তু কেতবোহমৃত্যবোহদাভ্যাসসা জনুষী উভে অনু। যেমিণা চ দেব্যা চ পুনত আদি রাজানং মতনা অগণত৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৪সূক্ত/১সাম– হে জ্ঞানদেব (অগ্নিদেব)! সংসাররূপ সমরক্ষেত্রে যে পুরুষকে রক্ষা, করেন, যে পুরুষকে আপনি পাপসহ যুদ্ধে প্রবৃত্ত করান; সে পুরুষ সর্বতোভাবে নিত্যধন (মোক্ষ) প্রাপ্ত হয়ে থাকে। (ভাব এই যে, যে জন ভগবানের প্রেরণায় সংসারসমরাঙ্গনে পাপের সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, সে জন ভগবানের কৃপায় পরাগতি লাভ করে)।

১৪/২– শত্রুবিমর্দক হে দেব! আপনার ভক্ত (ভগবৎ-ভক্ত) জনের কারও কোনও শত্রু নেই। (থাকতে পারে না)। প্রকৃষ্ট পরমধন তাদেরই থাকে (তারাই মোক্ষরূপ পরমধনের অধিকারী হন)। (ভাব এই যে, ভগবৎপরায়ণ জনের কোনও শত্রু নেই। তিনি আপন ভক্তির প্রভাবে পরাগতি লাভ করেন)। [আগের মন্ত্রটিতে বলা হয়েছে, ভগবানের কৃপাতেই মানুষ আত্মরক্ষায় সমর্থ হয়, ভগবানই মানুষকে পাপ-দমনে প্রবৃত্তি দেন। এখানে, এই মন্ত্রে তারই মুখ্য লক্ষ্য প্রকাশ পাচ্ছে। ভগবান্ শত্রুকে অভিভবকারী সত্য; কিন্তু কাদের শত্রুকে তিনি অভিভব করেন? এখানে, তার ভক্তের প্রসঙ্গই অধ্যাহৃত হয়]।

১৪/৩– সকল উৎকর্ষের বিধায়ক সেই ভগবান্ জ্ঞানদেব (অগ্নিদেব), আমাদের পাপকর্মর্সঞ্জাত কর্মফলসমূহের ত্রাণকর্তা হন; জ্ঞানিগণের সাহায্যে (জ্ঞানের সাহায্যে) তিনি আমাদের পক্ষে সুফলদাতা হোন। (ভাব এই যে, — সেই ভগবান্ সকল মানুষকে পাপ হতে ত্রাণ করেন এবং জ্ঞানদানে সকলের সুফলপ্রদ হন)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত অবদ্ভিঃ এবং বাজং পদ দুটি উপলক্ষে নানা অর্থান্তর ঘটে। অর্বদ্ভিঃঅর্বণ শব্দের তৃতীয়ার বহুবচনের বৈদিক শব্দ। অর্বণ শব্দের এক অর্থ– অশ্ব। বাজং পদের এক অর্থ সংগ্রাম। সেই অনুসারে প্রচলিত ব্যাখ্যায় মন্ত্রের অর্থ করা হয়, -সংগ্রামে অশ্বের বা অশ্বসৈন্যের দ্বারা তিনি (অগ্নিদেব) পরিত্রাণ করেন। সেই মতে বিশ্বচৰ্ষণিঃ পদে বিশ্ববাসীর পূজার্হ এমন ভাব গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মন্ত্রার্থে ঐ তিনটি শব্দেরই অনুরূপ অর্থ (অবশ্য কোষগ্রন্থ ইত্যাদি সম্মত অর্থই) গৃহীত হয়েছে। এখানে বিশ্বচৰ্ষণিঃ পদের অর্থ– সর্বজনের উৎকর্ষবিধায়ক। চর্ষণ শব্দ উৎকর্ষসাধনভাবমূলক। সকলেরই যাতে উৎকর্ষ সাধিত হয়, সকলেই যাতে শ্ৰেয়েলাভ করেন, দয়াল ভগবানের এটাই অভিপ্রেত। তাই তার বিশেষণ– বিশ্বচৰ্ষণিঃ। তারপর অর্বদ্ভিঃপদে কি বোঝায়, অনুধাবনীয়। অর্বণ শব্দেরই এক অর্থনীচ, অপকৃষ্ট। এখানে সেই অর্থই বিশেষ সঙ্গত হয়। বাজং শব্দে ধনই (কর্মফলরূপ) বলা যেতে পারে। অপকর্মের দ্বারা যে কর্মফল রূপ ধন পাওয়া যায়, পরিণামে দুঃখপ্রদ যে পাপ সঞ্চয় হয়, অর্বদ্ভিঃ বাজং পদ দুটিতে তাই বুঝিয়ে থাকে। সেই যে পাপকর্ম-জনিত দুঃখরূপ ফল ভগবান্ তা গ্রহণ করেন, সে কষ্ট থেকে তিনি পরিত্রাণ করেন, — মন্ত্রের প্রথমাংশের এটাই লক্ষ্য। শেষাংশের মর্মজ্ঞানের দ্বারা শ্রেয়ঃফল লাভ করা যায়। এবং সে পক্ষেও তিনিই সহায়তা করেন]। [এই সূক্তের ঋষি– শুনঃশেপ আজিগর্তি]।

১৫/১-সৎবৃত্তির বর্ধনকারী জ্ঞানরশ্মিসমূহ সাধকের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে; প্রাজ্ঞ জনের সমস্ত সৎকর্ম মোক্ষদায়ক হয়। (ভাব এই যে, — জ্ঞানিগণ মোক্ষ লাভ করেন)। পাপহারক দেবতা জ্ঞানশক্তি আমাদের প্রদান করুন; আত্মশক্তি তুল্য ঊর্ধ্বগতি প্রাপক জ্ঞান আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব- এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [মহাপুরুষ তা জ্ঞানিগণের হৃদয়বৃত্তিই এমনভাবে বিশুদ্ধ হয় যে, তা কখনও বিপথে চালিত হয় না। তাদের বাক্য, এ চিন্তা, কর্ম সমস্তই ভগবানের আরাধনার অঙ্গীভূত হয়ে যায়। তাদের সকল কর্মই মোক্ষপথের সহায় হয়। একমাত্র বিশুদ্ধ জ্ঞানের বলেই এই অবস্থা লাভ সম্ভবপর হয়। তাই সেই পরমকল্যাণদায়ক জ্ঞানলাভের জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৭দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৫/২– মাতৃগণ কর্তৃক যেমন পুত্র পরম স্নেহের সাথে প্রতিপালিত এবং পরিবর্ধিত হয়, তেমনভাবে দেবত্বপ্রাপক অভীষ্টবর্ষক পরম আকাঙ্ক্ষণীয় শুদ্ধসত্ত্ব অমৃতের দ্বারা পরিবর্ধিত হন; পার্থিব প্রবৃত্তিপরায়ণ ব্যক্তি যেমন তরুণীর প্রতি প্রেমের সাথে আকৃষ্ট হয়, তেমনই ভারে জ্ঞানকিরণের সাথে পরমপদপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — অমৃতদায়ক শুদ্ধসত্ত্বকে আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রের মধ্যে দুটি উপমা। দুটির মধ্যেই একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দুটিতেই সাধারণ পার্থিব জনগণের জন্যই বক্তব্য নির্দিষ্ট হয়েছে। অমৃতের দ্বারা শুব্ধসত্ত্ব কিভাবে প্রবর্ধিত হয়, তা দেখাবার জন্য বলা হলো– মায়ের স্নেহযত্নেই সন্তান যেমন পরিবর্ধিত হয়। দ্বিতীয় উপমায় দেখানো হচ্ছে, প্রার্থনার ঐকান্তিকতা। সে ঐকান্তিকতা, আকর্ষণ, কেমন? যুবতীর প্রতি যুবকের আকর্ষণ, প্রেমবন্ধন]।

১৫/৩– শুদ্ধসত্ত্ব নিত্যজ্ঞানকিরণের অমৃতপ্রবাহকে পূরিত করেন, অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা জ্ঞানামৃত পরিপূর্ণতা লাভ করে; অপিচ, প্রজ্ঞাদায়ক সেই শুদ্ধসত্ত্ব প্রভূতপরিমাণে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; বিশুদ্ধ পবম ধনের দ্বারা সাধকগণ যেমন সম্যকরূপে শ্রীসমন্বিত হন, তেমনই ভাবে শ্রেষ্ঠ সত্ত্বভাবকে জ্ঞানকিরণসমূহ অমৃতের দ্বারা শ্ৰীসমন্বিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানসমন্বিত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা তোক পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়)। [এই সূক্তের ঋষি– নোধা গৌতম। সূক্তান্তগত তিনটি মন্ত্রের একত্রে গ্রথিত তিনটি গেয়গানের নাম– ইহবদ্বাশিষ্ঠম, পার্থম এবং ঔশনম]।

১৬/১– হে ইন্দ্র! ভক্তিরসযুত জ্ঞানকিরণসমন্বিত, আমাদের সৎকর্ম ইত্যাদির দ্বারা সুসংস্কৃত শুদ্ধসত্ত্বকে পান (গ্রহণ) করে আনন্দিত অর্থাৎ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন অপিচ, হে ইন্দ্র! আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মে বন্ধুরূপে সহায় হয়ে, আমাদের অভীষ্টপূরণের জন্য প্রবুদ্ধ হোন; আরও হে ইন্দ্র! আপনার সম্বন্ধীয় পরমার্থ বুদ্ধি আমাদের রক্ষা করুক অর্থাৎ পাপের প্রভাব হতে আমাদের রক্ষা করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আমাদের ভক্তিসুধা এবং শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে, আমাদের অভীষ্টফল প্রদান করুন এবং আমাদের পাপের প্রভাব হতে পরিত্রাণ করুন)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যায় ইন্দ্রদেবকে সোম পান করবার জন্য আহ্বান জানান হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রের মধ্যে সোমের কোনও উল্লেখ নেই। সুতস্য পদ থেকেই সোমের সম্বন্ধ অধ্যাহার করা হয়েছে। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-১দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৬/২– হে দেব! প্রার্থনাকারী আমরা আপনার অনুগ্রহে যেন আত্মশক্তিসম্পন্ন হই; শত্রুর জন্য আমাদের হিংসা করবেন না অর্থাৎ আমাদের রিপুগণের বশীভূত করবেন না; প্রার্থনীয় বিচিত্র রক্ষাশক্তিদ্বারা আমাদের রক্ষা করুন, অর্থাৎ আমাদের পরমসুখী করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুকবল হতে রক্ষা করুন এবং আমাদের পরমমঙ্গল প্রদান করুন)। {প্রার্থনার ভাব সম্বন্ধে প্রশ্ন হতে পারে, আত্মশক্তি অন্যে কিভাবে দিতে পারে? ভগবানের কৃপায় আমরা সমস্তই লাভ করি, সুতরাং ভগবান্ সম্বন্ধে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে না। ভগবানই মানুষের মধ্যে শক্তির বীজ প্রদান করেছেন, তাঁর কৃপাতেই মানুষ আত্মশক্তি লাভ করতে পারে, তাই তার জন্যই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষি মেধ্যাতিথি বা মেধাতিথি কাণ্ব। সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গানের নাম অভীবর্তম, উৎসেসম্, নিষেধম, পৃষ্ঠম এবং জমদগ্নেঃসাম]।

১৭/১– দ্যুলোকস্থিত সত্ত্বভাবকে পাবার জন্য অর্থাৎ তার সাথে মিলিত হবার জন্য সমস্ত জ্ঞানরশ্মি লোকবর্গের যথার্থ আশ্রয়স্বরূপ সত্যকে দোহন করে। (ভাব এই যে, — সত্ত্বভাব-প্রাপ্তির জন্য জ্ঞান সত্যাশ্রয়ী হয়। যখন সত্ত্বভাব সত্যের দ্বারা প্রবর্ধিত হন, তখন তিনি তমোগুণাত্মক অমঙ্গলকে বিনাশ করবার জন্য সকল ভুবনকে অর্থাৎ বিশ্বকে মঙ্গলপূর্ণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্যজ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব জগতের হিতসাধন করেন)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৯দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৭/২– কল্যাণদায়ক অমৃতের গ্রহণকারী সেই প্রসিদ্ধ সৎকর্ম সাধক প্রার্থনার দ্বারা, দ্যুলোক ভূলোককে পরিপূর্ণ করেন, অর্থাৎ ঐকান্তিকতার সাথে প্রার্থনা করেন; যখন সাধক আরাধনার দ্বারা দেবভাব প্রাপ্ত হন তখন মহকর্মর্সাধনের দ্বারা জ্যোতির্ময় অমৃতের প্রবাহ প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মসাধক প্রার্থনাপরায়ণ ব্যক্তি অমৃত লাভ করেন)।

১৭/৩– শুদ্ধসত্ত্ব যে জ্ঞানকিরণসমূহের দ্বারা দেবভাবদায়ক শক্তিকে পবিত্র করে, শুদ্ধসত্ত্বের সেই নিত্য, সকলের প্রার্থনীয় জ্যোতিঃ বিশ্বের সকল বস্তুকে রক্ষা করুক; অপিচ, প্রার্থনা নিত্যকাল জ্যোতির্ময় দেবতাকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান্ প্রার্থনার দ্বারা লব্ধ হন; শুদ্ধসত্ত্ব বিশ্বকে অকল্যাণ হতে রক্ষা করেন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-সোমরসের ঔজ্জ্বল্য অবিনাশী ও অক্ষয় হোক, তার দ্বারা স্থাবর জঙ্গম এই দুরকম বস্তু রক্ষা প্রাপ্ত হোক। সেই ঔজ্জ্বল্য দ্বারা তিনি আমাদের বলবান ও ধনবান্ করেন। নিপীড়নের অব্যবহিত পরেই তার উদ্দেশে স্তুতিপাঠ হতে লাগল। এই ব্যাখ্যার মধ্যে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মন্ত্রের অন্তর্গত যেভিঃ পদের ভাব এই ব্যাখ্যায় নেই। ভাষ্যেও যঃ পদের সাথে নিত্যসম্বন্ধযুত সঃ পদের কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু য শব্দের সঙ্গে তদ শব্দের সংযোগ না থাকলে অর্থ পূর্ণ হয় না বা হতে পারে না। সেইজন্য ভাষ্য ইত্যাদির ব্যাখ্যায় ব্যাকরণের দিক থেকে অপূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। [এই সূক্তের ঋষি-রেণু বৈশ্বামিত্র। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত গেয়গানের নাম-মারুতম্]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ১৮– অভি বায়ুং বীত্যর্ষা গৃণানোত হভি মিত্রাবরুণা পূয়মানঃ। অভী নরং ধীজবনং রথেষ্ঠামভীন্দ্রং বৃষণং বজ্ৰবাহু৷ ১। অভি বস্ত্রা সুবসনান্যষাভি ধেনুঃ সুদুঘা পূয়মানঃ। অভি চন্দ্রা ভর্তবে নো হিরণ্যাভশ্বান্ রথিনো দেবনোম। ২। অভী নো অর্য দিব্যা বসূন্যভি বিশ্বা পার্থিবা পূয়মানঃ। অভি যেন দ্রবিণমশ্নবামাভ্যায়েং জমদগ্নিবন্নঃ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৯– যজ্জাযথা অপূর্ব মঘবন বৃত্রহত্যায়। তৎ পৃথিবীমপ্ৰথয়স্তদস্তা উততা দিব৷৷৷৷৷ তৎ তে যজ্ঞো অজায়েত তর্ক উত হস্কৃতিঃ। তদবিশ্বমভিভূরসি যজ্জতং যচ্চ জ৷ ২৷৷ আমাসু পমৈরয় আ সূর্যং রোহয়ো দিবি। ঘর্মং ন সামন্তপতা সুবৃক্তিভিৰ্জুষ্টং গির্বণসে বৃহৎ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২০– মৎস্বপায়ি তে মহঃ পাত্রস্যেব হরিবো মৎসরো মদঃ বৃষা তে বৃষ্ণ ইন্দুর্বাজী সহস্ৰসাতমঃ। ১৷ আ নস্তে গন্তু মৎসরো বৃষা মদো বরেণ্যঃ। সহাবা ইন্দ্র সানসিঃ পৃতনাড়মঃ॥ ২॥ ত্বং হি শূরঃ সনি চোদ্দয়ো মনুষো রথ। সহাবান্ দস্যুমব্রতমোষঃ পাত্রং ন শোচিষা৷৷ ৩৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৮সূক্ত/১সাম– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আরাধনীয় আপনি আশু মুক্তিদায়ক দেবতার অভিলক্ষ্যে এবং পবিত্রকারক আপনি মিত্রস্বরূপ অভীষ্টপূরক দেবতার অভিলক্ষ্যে তাদের গ্রহণের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সৎকর্মনেতা আশুমুক্তিদায়ক, সকর্মে বর্তমান, (অথবা হৃদয়রূপ রথে বর্তমান), অভীষ্টবষক, রক্ষাস্ত্রধারী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের অভিলক্ষ্যে অর্থাৎ তাদের প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — ভগবানের আরাধনার জন্য আমরা শুদ্ধসত্ত্ব যেন লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বকে গৃণানঃ বলা হয়েছে। সত্ত্বভাব সকলের দ্বারা স্তুত হন, অর্থাৎ সকলেই পরমবস্তুর জন্য প্রার্থনা করেন। কারণ ভগবৎপ্রাপ্তির সেটাই প্রধান সোপান। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের উপজন হলে মানুষ আপনা-আপনিই পবিত্রহৃদয় হয়। তাই সত্ত্বভাবকে পূয়মানঃ বলা হয়েছে]।

১৮/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পাপনাশক পরমধন আমাদের প্রদান করুন; পবিত্রকারক আপনি  অমৃতদায়ক জ্ঞানকিরণসমূহ প্রদান করুন; হে পরমদেব! আমাদের ঊধ্বর্গতিপ্রাপ্তির জন্য আনন্দদায়ক। এ মঙ্গলপ্রদ হন এবং সৎ কর্মসমন্বিত পরাজ্ঞান প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন, মোক্ষদায়ক পরাজ্ঞানযুত পরমধন লাভ করি)। [পাপনাশক ধনের অর্থ পাপনাশক শক্তি, যার দ্বারা মানুষ পাপের বিনাশ করতে সমর্থ হয়। দ্বিতীয় অংশের মর্ম—অমৃতদায়ক পরাজ্ঞান লাভ। জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ অমৃতত্ব লাভ করতে পারে, সেই জন্যই জ্ঞান-সুদুঘাঃ। কোন কোন স্থলে জ্ঞানকেই অমৃত বলা হয়েছে, অর্থাৎ সাধ্য ও সাধনে অভেদত্ব কল্পনা করা হয়েছে। তৃতীয় অংশেও মোক্ষপ্রাপ্তির সাধনভূত পরাজ্ঞান ও সৎকর্মসাধনসামর্থ্যের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১৮/৩– হে দেব! পবিত্রকারক আপনি আমাদের মোক্ষদায়ক পরমধন প্রদান করুন, এবং জগতের সকল ধন প্রদান করুন; যে শক্তির দ্বারা আমরা পরমধন লাভ করি, সেই শক্তি আমাদের প্রদান করুন; পরমজ্ঞানসম্পন্ন সাধক যেমন সাধক-ভোগ্য পরমধন লাভ করেন, আমাদের সেই ধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা মোক্ষদায়ক পরাজ্ঞান এবং পরমধন যেন লাভ করি)। [এই সূক্তের ঋষি-কুৎস আঙ্গিরস। এই তিনটি মন্ত্রের একত্র গ্রথিত গেয়গানের নাম পার্থ]।

১৯/১– হে অনাদিদেব! হে পরমধনদাতা! আপনি যখন পাপনাশের জন্য প্রাদুর্ভূত হন অর্থাৎ প্রবৃত্ত হন তখনই বিশ্বকে পাপবিমুক্ত দৃঢ় করেন; আরও, তখন দ্যুলোককে ধারণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — ভগবানই পাপনাশক হন। তাঁর কৃপাতেই লোকসমূহ মোক্ষপ্রাপ্ত হয়)। [বৃহত্যায় অর্থে পাপনাশায় অর্থাৎ পাপনাশের জন্যহওয়াই সঙ্গত। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রেও বৃত্রাসুরের উপাখ্যান কল্পিত হয়েছে]।

১৯/২– হে ভগবন! যখন আপনি জগতে প্রাদুর্ভূত হন তখন আপনাকে পাবার জন্য সৎকর্ম উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ লোকগণ সৎকর্মপরায়ণ হন; অপিচ, তখন পরমানন্দদায়ক জ্ঞান উৎপন্ন হয় অর্থাৎ লোকসমূহ জ্ঞানপরায়ণ হন; যা উৎপন্ন এবং যা উৎপাদ্যমান তা সমস্তই আপনি অভিভূত করেন অর্থাৎ সেই সকলের অধীশ্বর হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সৎকর্ম এবং জ্ঞানের মূলকারণ। তিনিই বিশ্বাধিপতি)। [বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জগৎ যেমন প্রাণ-চঞ্চল হয়ে ওঠে, জগতে ভগবানের স্বয়ং-আবির্ভাবে অর্থাৎ তার প্রকটনে জগতের সকলরকম উন্নতির সূত্রপাত হয়। মানুষ সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করে, জ্ঞানপরায়ণ হয়। কারণ তখন দুষ্কৃতকারীর বিনাশ হয়]।

১৯/৩– হে দেব! আপনি অজ্ঞান আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন; মোক্ষলাভের জন্য পরাজ্ঞান আমাদের মধ্যে প্রদান করুন; হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! পরম আরাধনীয় দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য তোমরা মহৎ ভগবনপ্রীতিসাধক পরম জ্যোতির্ময় স্তোত্র উচ্চারণ করো এবং শোভনস্তুতির দ্বারা সেই পরম দেবতাকে আরাধনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন; আমরা যেন আরাধনাপরায়ণ হই)। [মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য পরাজ্ঞানলাভের প্রার্থনা করেই সাধকের নিবৃত্তি হচ্ছে না। তিনি জানেন যে, ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য, তাঁর কৃপালাভের জন্য উপযুক্ত সাধনার প্রয়োজন। কিন্তু সেই সাধনার জন্য সর্বশক্তি লাভের জন্য তারই শরণগ্রহণ করতে হবে। সেইজন্যই মন্ত্রে আত্ম-উদ্বোধনমূলক প্রার্থনাও করা হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষি-পুরুমেধ আঙ্গিরস]।

২০/১– পাপহারিণীশক্তিযুক্ত হে দেব! আপনার মহাতৃপ্তিদায়ক পরমানন্দপ্রদ যে শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে বর্তমান আছে সেই শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে প্রীত হোন; হে দেব! অভীষ্টদায়ক আপনার এ শক্তিদায়ক অভীষ্টবর্ষক শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের প্রতি পরমধনদায়ক হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের পরমধন প্রদান করুন)।

২০/২– বলাধিপতি হে দেব! আপনার তৃপ্তিদায়ক, অভীষ্টবর্ষক, বরণীয় মোক্ষলাভে সাহায্যদাতা, পরম আকাঙ্ক্ষণীয়, শত্রুনাশক, অমৃতদায়ক, পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে;-হে ভগবন! আপনার কৃপায় আমরা যেন অমৃতপ্রাপক পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। [শুদ্ধসত্ত্ব পৃতনাষা অর্থাৎ শত্রুনাশক। যে সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বা সঞ্চারিত হয় তিনি রিপুর কবল থেকে উদ্ধার লাভ করেন। সত্ত্বভাবের প্রাধান্যে রিপুগণ হীনশক্তি হয়ে পরাজিত হয়। রিপুর কবল থেকে মুক্তিলাভ করলে মানুষ অমৃতের অধিকারী হতে পারে। অমৃতত্বই মানুষের চরম আকাক্ষণীয় বস্তু। রজঃ-তমঃজনিত দুঃখ থেকে উদ্ধার লাভ করে সাধক। পরমানন্দ লাভ করেন। তাই সেই পরম আনন্দময় অবস্থা প্রাপ্তির জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]।

২০/৩– হে দেব! আপনিই সর্বশক্তিমান্ এবং পরমধনদাতা হন; প্রার্থনাকারী আমাকে সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন; মোক্ষলাভে সহায় হয়ে, অগ্নি যেমন আপন তেজে তার আধারভূত পাত্রকে দহন করে, তেমনভাবে আপনি আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, সুকর্মের বিরোধী রিপুশত্রুকে দহন করুন– বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুগণকে বিনাশ করুন এবং আমাদের রিপুজয়ী করুন)। [মন্ত্রের মধ্যে ভগবৎ-মহিমাকীর্তন এবং প্রার্থনা উভয়ই আছে। ভগবান্ সর্বশক্তিমান, তারই শক্তিবলে জগৎ বিধৃত আছে এবং পরিচালিত হচ্ছে। তার শক্তিই জগতের রক্ষাবিধান করছে। তিনিই মানুষকে পরমধন প্রদান করে কৃতার্থ করেন। তাই তিনি নিতা– পরমদাতা। এই পরমদাতার কাছে কি প্রার্থনা করা হয়েছে?– রথং। ভাষ্যকার এবার আর লৌহ-কাষ্ঠ ইত্যাদির দ্বারা নির্মিত যানবিশেষকে লক্ষ্য করেননি। তিনি ঐ পদের অর্থ করলেন– রথং বৃংহণং স্যন্দনং মনোরথং বা স্বর্গগমন-সাধনং যজ্ঞার্থং রথং বা। এর মধ্যে একটি অর্থ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, — যার দ্বারা স্বর্গলাভ হয়, মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে তা-ই রথ। সেটি কি? যজ্ঞার্থং রথ অর্থাৎ সৎকর্মরূপ যে রথ। রথের কার্য কি? মানুষকে তা কোথায় নিয়ে যায়? তার উত্তরে ভাষ্যকার রথের স্বরূপবর্ণনায় বললেন– স্বর্গগমনসাধনং অর্থাৎ রথ স্বর্গে যাবার উপায়স্বরূপ। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভাষ্যের মতেও রথ স্বর্গপ্রাপক। ভাষ্যকার আরও একটু অগ্রসর হয়ে বললেন-যজ্ঞার্থংরথং। যজ্ঞের অর্থাৎ সৎকর্মের সাথে রথের সম্বন্ধ সূচিত করলেন। আমাদের মন্ত্রার্থেও, পূর্বাপরের মতোই, রথ শব্দের অর্থ গৃহীত হয়েছে সৎকর্মসাধনের সামর্থ্য। রথ যেমন মানুষকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়ে দেয়, সৎকর্মও তেমনই ভগবানের পদ প্রাপ্ত করায়]। [এই সূক্তের ঋষি– আগস্ত্য মৈত্রাবরুণ। সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– কালেয়ম]।

— দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত —  

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী