উত্তরার্চিক — সপ্তদশ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে) — ১।৩।।১২ অগ্নি; ২।৮১১।১৩১৪ ইন্দ্র; ৪ বিষ্ণু; ৫ ইন্দ্ৰ-বায়ু; ৬ পবমান সোম।
ছন্দ– ১।২।৭।৯।১০।১২।১৩ গায়ত্রী; ৩।৮ বার্হত প্রগাথ; ৪ ত্রিষ্টুপ; ৫৬ অনুষ্টুপ;
১১ উষ্ণিক; ১৪ এ তৎসাম।
ঋষি-১।৭
শুনঃশেপ আজীগর্তি; ২ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র; ৩ শংসু বাৰ্হস্পত্য; ৪ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ৫ বামদেব গৌতম; ৬ রেভসূনু কাশ্যপদ্বয়; ৮ নৃমেধ আঙ্গিরস; ৯।১১ গোষুক্তি ও অশ্বসূক্তি কাণ্বায়ন; ১০ শ্রুতকক্ষ বা সুকক্ষ আঙ্গিরস; ১২ বিরূপ আঙ্গিরস; ১৩ বৎস কাণ্ব; ১৪ অজ্ঞাত উদগাতা।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– বিশ্বেভিরূগ্নে অগ্নিভিরিমং যজ্ঞমিদৎ বচঃ। চনো ঘাঃ সহসো যহো৷৷৷৷৷ যচ্চিদ্ধি শশ্বতা তনা দেবংদেবং যজামহে। ত্ত্বে ইদ্রুয়তে হবিঃ ॥ ২॥ প্রিয়ো নো অস্তু বিপতিহেঁতা মন্দ্রোবরেণ্যঃ। প্রিয়াঃ স্বগ্নয়ো বয়ম্ ৷৩৷৷

সূক্ত ২– ইন্দ্রং বো বিশ্বতস্পরি হবামহে জনেভ্যঃ। অস্মাকমস্তু কেবলঃ ১। স নো বৃষন্নমুং চরুং সত্ৰাদাবন্নপা বৃধি। অস্মভ্যমপ্রতিদ্ভুতঃ। ২। বৃষা যুথেব বংসগঃ কৃষ্টরিয়র্তোজসা। ইশানো অপ্রতিদ্ভুতঃ৷৷৩৷৷

সূক্ত ৩– ত্বং নশ্চিত্র উত্যা বসো রাধাংসি চোদ্দয়। অস্য রায়স্তমগ্নে রথীরসি বিদা গাধং তুচে তু নঃ ॥১৷৷ পর্ষি তোকং তনয়ং পর্তৃভিস্টমদব্ধৈরপ্ৰযুত্বভিঃ। অগ্নে হেডাংসি দৈব্যা মুযযাধি নোহদেবানি হ্রাংসি চ ৷৷ ২৷৷

সূক্ত ৪– কিমিত্তে বিষ্ণো পরিক্ষি নাম প্র যদ ববক্ষে শিপিবিষ্টো অস্মি। মা বর্পো অম্মদপ গুহ এতদ যদন্যরূপঃ সমিখে বভূথ ৷৷৷৷ প্র তত্তে অদ্য শিপিবিষ্ট হব্যমর্যঃ শংসামি বয়ুনানি বিদ্বান্। তং ত্বা গৃণামি তবসমতব্যান্ ক্ষয়মস্য রজসঃ পরাকে। ২৷৷ বষতে বিষ্ণবাস আ কৃণোমি তন্মে জুষস্ব শিপিবিষ্ট হব্য। বর্ধন্তু ত্বা সুষ্ঠুতয়ো গিরো মে ঘূয়ং পাত স্বস্তিভিঃ সদা নঃ ॥ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– সকল শক্তির আশ্রয়স্থান হে জ্ঞানদেব! সর্ব রকমের প্রকাশরূপের দ্বারা (জ্যোতিঃরূপে, জ্ঞানরূপে) আপনি আমাদের অনুষ্ঠিত যাগ ইত্যাদি কর্ম ও স্তোত্র গ্রহণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, সকল শক্তির আশ্রয়ভূত হে জ্ঞানদেব! আমাদের কর্ম এবং বাক্য যেন আপনার সাথে সম্বন্ধযুত হয়, তা করে দিন)। [মন্ত্রটি সম্বন্ধে ভাষ্যকারদের মধ্যে যে গবেষণা চলেছে, তার আভাষ দেওয়া যেতে পারে। তারা বলেন– সহসঃ যহো পদ দুটির অর্থ বিলের পুত্র। সেই অনুসারে অধ্যাহার করা হয়– বলের (শক্তির) দ্বারা ঘর্ষণে যে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে থাকে, এখানে সেই অগ্নিকে সম্বোধন করা হয়েছে। বলা হয়েছে- হে বলের পুত্র অগ্নি! আপনি অন্যান্য অগ্নিসকলের (বাৰ্হস্পত্য, আহবনীয় প্রভৃতি) সাথে আমাদের এই যজ্ঞ ও স্তোত্র ধারণ করুন। এইরকম অগ্নি, অন্যান্য অগ্নির সাথে আসবেন– এটাই যদি অর্থ হয়, তবে তার তাৎপর্য বোঝা যায় কি? সুতরাং এখানে ঐ পরিদৃশ্যমান অগ্নির বিষয় যে বলা হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। বিশ্বেভিঃ অগ্নিভিঃ পদ দুটিতে বিশ্বের প্রাণস্বরূপ অগ্নি– জ্ঞানস্বরূপ অগ্নি– এই ভাবই প্রকাশ পায়]।

১/২– হে জ্ঞানদেব! যদিও আমরা সদাকাল অশেষ পূজোপকরণের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন দেবতার পূজা করে আসছি; তথাপি, সেই সকল পূজা আপনাতেই বর্তাচ্ছে। (ভাব এই যে, জ্ঞানই সর্বদেবময়; সকল দেবতার পূজার সঙ্গেই জ্ঞান সম্বন্ধযুক্ত)। [এখানে সাধকের ভেদ-ভাব বিদূরিত হয়েছে। এখানে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, সকল দেবতাই এক। অদ্বিতীয় সনাতন ব্রহ্মই যে নানা দেবরূপে আপন বিভূতি বিস্তার করে আছেন, এখানে সাধকের তা বোধগম্য হয়েছে। আলোকস্তম্ভ যেমন কেন্দ্রস্থান থেকে চারিদিকে রশ্মিরূপে বিস্তৃত হয়, এবং সেই অনন্ত রশ্মিমালার অনুসরণে অগ্রসর ই হতে হতে পরিশেষে যেমন কেন্দ্রস্থানে উপনীত হওয়া যায়; এখানেও সেই ভাব দ্যোতনা করছে। এই যে দেবতার বা যে বিভূতির মধ্য দিয়েই পূজা উপচার প্রেরিত হোক না কেন, সকলই সেই অভিন্ন একে গিয়ে মিলিত হবে, সেই কথাই এখানে ব্যক্ত আছে। — একেশ্বরবাদিগণ যে বহুদেব-উপাসকদের এ প্রতি বিদ্রুপের দৃষ্টি সঞ্চালন করেন, এই মন্ত্রের মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করলে তাদের সে দৃষ্টি নিশ্চয়ই সঙ্কুচিত হতে পারবে]।

১/৩– হে দেব! আপনি জগৎপালক, যজ্ঞসম্পাদক (সৎকর্মকারক), আপনি আমাদের বরণীয় প্রিয় এবং আনন্দবর্ধক হোন; প্রার্থনাকারী আমরা যেন সু-অগ্নি-সহযুত (সৎ-গুণান্বিত) হয়ে আপনার প্রিয় (অনুগৃহীত) হতে পারি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, যেন আমরা আমাদের কর্মের দ্বারা আপনার প্রেমের অধিকারী হই; হে দেব! সেই অনুগ্রহ করুন)। [আমার হৃদয়ের প্রেমভক্তির দ্বারা ভগবানের প্রীতি-সম্পাদনে আমি যেন সমর্থ হই, তিনি যেন আমার বরণীয় ও প্রিয় হন। তাহলে, তার সাথে সম্বন্ধযুত হয়ে সৎ-জ্ঞান লাভ করে, আমিও তার প্রিয় হতে পারব। হে ভগবন! তুমি আমাদের প্রিয় হও, আমরা তোমার প্রিয় হই, আমাদের ও তোমার মধ্যে যেন অভিন্ন সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। সাদাসিধা এ মন্ত্রের এটাই মর্মার্থ]।

২/১– বিশ্বের সকলের উপরে প্রতিষ্ঠিত (অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ) যে ইন্দ্রদেবকে আমরা আহ্বান (স্তব) করছি; তিনি আমাদের ও তোমাদের সকলেরই কৈবল্যমোক্ষ-প্রদানকর্তা। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কেবল আমাদের বলে নয়; তিনি সকলেরই কল্যাণ সাধন করুন)। [সাধারণতঃ এ মন্ত্রের অর্থ নিষ্পন্ন করা হয়, — হে যজমানগণ! তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমরা সকল লোকের উপরিস্থিত ইন্দ্রদেবকে আহ্বান করছি। তিনি কেবল আমাদেরই (অর্থাৎ আমাদেরই প্রতি অনুগ্রহশীল) হন। এ হিসাবে স্বার্থপরতা ও আত্মম্ভরিতা এই মন্ত্রে যেন জাজ্বল্যমানভাবে প্রকাশমান রয়েছে। এমন হলে তত বেদ-মন্ত্র বেদ-মন্ত্রই নয়। — অস্মাকমস্তু কেবলঃ; এ বাক্যের অর্থ কেউ কেউ আবার তিনি (ঈশ্বর) কেবল ভারতবাসীরই হন– এমন ব্যাখ্যাও করে গেছেন। এ-ও অবশ্যই বৈশম্যমূলক এবং অগ্রহণীয়। কেবল আমাদের– এই একটা স্বার্থপূর্ণ ভাব ব্যক্ত করতে, সূক্তের শেষে-মন্ত্রের শেষে উপসংহারে একটা বাজে শব্দ কখনও ব্যবহৃত হতে পারে না, উপসংহারে সারবাক্যে পরিণতি মূলক ভাবই ব্যক্ত হওয়া সঙ্গত। অতএব, এখানে মন্ত্রের সঙ্গত অর্থ হলো– সেই পরাৎপর পরমেশ্বর আমাদের এবং তোমাদের সকলেরই মুক্তিদাতা। তিনি ভিন্ন আর দ্বিতীয় মুক্তিদাতা কেউই নেই। তার শরণ নাও, তিনি মুক্তিদান করবেন। অর্থাৎ কেবলঃ শব্দের অর্থ কৈবল্যপ্রদঃ, মোক্ষদঃ; অস্তু- ভবতু]।

২/২– অভীষ্টফলপ্রদ, প্রার্থনাপরিপূরক (অথবা বৃষ্টিপ্রদ) হে দেব! আপনি আমাদের কোনও প্রার্থনাই অপূর্ণ রাখেন না; সর্বাভীষ্টসাধক সেই দেবতা আপনি, আমাদের পরিদৃশ্যমান ঐ শসহচরকে দূর করুন (অর্থান্তরে- ঐ মেঘকে বিদীর্ণ করে জলদান করুন)। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -সৎকর্মের ফলদাতা, অভীষ্টবর্ষণকারী, সকল প্রার্থনার পরিপূরক হে দেব! আমাদের অজ্ঞানতা সহচর শত্রুকে বিনাশ করুন)। [এই মন্ত্রে, মেঘ-পক্ষে অসুর-পক্ষে এবং আমাদের অজ্ঞানতাপ্রসূত অসৎবৃত্তিগুলি সম্বন্ধে নানারকম ভাব ব্যক্ত আছে বলে মনে করা যেতে পারে। বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যাখ্যাকারগণ বিভিন্নভাবে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করে থাকেন। মরুক্ষেত্রের অধিবাসী যাঁরা, তাদের পক্ষে এই মন্ত্রের অর্থ– হে যজ্ঞফলদাতা বৃষ্টির কর্তা ইন্দ্রদেব! আপনি…দৃশ্যমান ঐ মেঘকে বিদীর্ণ এ করুন। ….অসুরভীত যজ্ঞকর্তারা বলবেন– হে দেব! ….আপনি অসুরদের ও তাদের সহচরদের সত্বর দূরীভূত করুন। — অন্য অর্থ আধ্যাত্মিক ভাবমূলক। কিবা মেঘ বিদারণ, কিবা গুপ্তচর-বিতাড়ন, সেখানে দুটি অর্থেরই সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়। সেই অর্থই কিন্তু সমীচীন। হৃদয়ের মধ্যে অহরহঃ দেবাসুরের সংগ্রাম চলছে। সৎ-বৃত্তির সাথে অসৎ-বৃত্তির সংগ্রামই– সেখানে দেবাসুরের সংগ্রাম বলে বুঝতে হবে। সে সংগ্রামে অসুরপক্ষের গুপ্তচর– কামনা (প্রলোভন)। কামনাই পাপবৃত্তিগুলিকে উত্তেজিত করে। মন্ত্রের তাই প্রার্থনা- আমার শত্রুর গুপ্তচর-রূপ কামনাকে তুমি ধ্বংস করো….। অন্য অর্থ- অজ্ঞানতার সহচর রিপুগণ আমার হৃদয় অধিকার করে আছে। আপনি তাদের সংহার করুন। আবার, কুকর্মের খরতাপে, পাপের অনলবর্ষী শিখায় অহরহঃ জ্বলে পুড়ে জর্জরিত আমার এই মরুক্ষেত্রের মতো উষর অনুর্বর হৃদয়ে তোমার করুণাবারি সিঞ্চন করো]।

২/৩– দুঃখ নিশ্চয়ই বিষয়সংসর্গজ– সহজাত; অভীষ্টফলপ্রদ পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন ভগবান্ সাধন পরায়ণ মনুষ্যগণকে সেই দুঃখ হতে সত্বর পরিত্রাণ করুন। (মন্ত্রের ভাব, জন্মমাত্র দুঃখ-হেতুভূত; ভগবানের অনুকম্পায় সেই দুঃখ দূর হয়; আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন জন ত্বরায় পরিত্রাণ লাভ করেন)। অথবা- অভীষ্টবর্ষণশীল, প্রত্যাখ্যানসূচক না-প্রতিশব্দ রহিত, পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন সেই ভগবান, বননীয় গতিতে অর্থাৎ বিচিত্র গতিবিশিষ্ট হয়ে মনুষ্যগণকে ষড়ৈশ্বর্য ইত্যাদি দান করেন; কিন্তু আত্ম উল্কর্য-সাধন-সম্পন্ন জন, আত্ম-উৎকর্ষের প্রভাবে পরিত্রাণ লাভ করেন। (এ পক্ষে ভাব এই যে, বিচিত্ৰগতি-ক্রমে ভগবান্ মনুষ্যগণের দুঃখ নাশ করেন; কিন্তু সাধুগণ আত্মশক্তির দ্বারাই দুঃখ থেকে বিমুক্ত হন)। [এই অমূল্য মন্ত্রটির প্রচলিত কুব্যাখ্যাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিস্ময়ান্বিত হতে হয়। একে বৃষা, তায় যুথা, উপরন্তু বংসগঃ সুতরাং ষাঁড়ের গাভীর ও কৃষকের সাথে সম্বন্ধযুক্ত অর্থ করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটু অভিনিবেশ সহকারে দেখলে নিশ্চয়ই বোধগম্য হবে যে, এই মন্ত্রের বৃয়া পদের অর্থ ষাঁড় নয়। এর অর্থ– অভীষ্টবর্ষণশীল। বংসগঃ (বংশগঃ) পদের অর্থও বংশবৃদ্ধির জন্য নয়, তার অর্থ– সহজাত, জন্মগত। ভাবান্তরে বননীয় গতিবিশিষ্ট অর্থ ঐ পদে গ্রহণ করা যায়। যুথশব্দের অর্থ বিষয়-সংসর্গ থেকে উৎপন্ন। অথবা, তার অর্থ– ষড়ৈশ্বর্য ইত্যাদি (ভগবানের যা স্বরূপ), ইব অব্যয় শব্দ– নিশ্চয়ার্থক। ফলে, বৃষা যুথেব বংসগঃ বাক্যের অর্থ– গোবংশ বৃদ্ধির জন্য গাভীর নিকট ষাঁড়ের গমন নয়। তার প্রকৃত অর্থ বিষয়সংসর্গজাত কর্মানুসৃত জন্মগত দুঃখপ্রবাহ। অন্য অর্থে– অভীষ্টবর্ষণশীল ভগবানের বিচিত্র গতিতে ষড়ৈশ্বর্য ইত্যাদি দানের ভাব আসে। মনে রাখতে হবে প্রথম অন্বয়ে বৃষ শব্দের প্রথমার একবচনে বৃষা পদ নিষ্পন্ন করে তার অর্থ করা হয়েছে- দুঃখ। দুটি অন্বয়েই একই ভাব রূপান্তরে পরিব্যক্ত]।

৩/১– আশ্রয়স্থানস্বরূপ হে দেব! বিচিত্ৰদৰ্শন আপনি আমাদের রক্ষণের দ্বারা চতুর্বর্গধন প্রদান করুন। হে জ্ঞানস্বরূপ দেব! আপনি চতুর্বর্গরূপ ধনের নেতা (প্রভু) হন। আমাদের এবং আমাদের। অপত্যগণকে (বংশপরম্পরাকে) শীঘ্রই সৎকর্মসম্পাদনে প্রতিষ্ঠা প্রদান করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! আপনি চতুর্বর্গপ্রদানকারী। আমাদের চতুর্বর্গ প্রদান করুন; আমাদের অপত্যগণকে সৎকর্মপরায়ণ করুন)। [সাধক জ্ঞানস্বরূপ দেবতার নিকট আপন অভীষ্টধর্ম, অর্থ; কাম ও মোক্ষরূপ চতুর্বর্গধন প্রার্থনা করছেন, সর্বতোভাবে নিজের রক্ষা কামনা করছেন; এবং নিজের বংশপরম্পরায়ও মঙ্গল প্রার্থনা জানাচ্ছেন। — ভাষ্যকারের ভাষ্যের প্রতি দৃষ্টি করলে এইরকম অর্থ অবভাসিত হয়– হে বাসক অগ্নিদেব! বিচিত্ৰদৰ্শন আপনি, রক্ষার সাথে ধনসমূহকে আমাদের প্রতি প্রেরণ করুন। আপনি এই লোকে পরিদৃশ্যমান ধনের নেতা হন, (এই কারণবশতঃ আমাদের প্রতি, ধনসমূহকে প্রেরণ করুন)। পরন্তু আমাদের অপতনহেতুভূত পুত্রকে শীঘ্রই প্রতিষ্ঠা প্রদান করুন। আমাদের মন্ত্রার্থে ভাষ্য-অনুমোদিত অর্থই গৃহীত হয়েছে। মাত্র ভাবার্থ-নিষ্কাশনে ভাষ্য থেকে আমাদের অর্থ কিছুটা ভিন্ন আকার ধারণ করেদ্বে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-৪দ-৭সা) পরিদৃষ্ট, হয়]।

৩/২– হে জ্ঞানদেব! আপনি সর্বলোকপ্রার্থনীয় আপনার বিভূতিস্বরূপ রক্ষাশক্তির দ্বারা আমাদের পুত্রপৌত্র ইত্যাদিকে পালন করুন আপনার প্রতি ভক্তিসম্পন্ন করুন; হে দেব! দেবত্ববিরোধী ভাব এবং রিপুগণের আক্রমণ দূর করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামক। ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পুত্র পৌত্র ইত্যাদি সকলকে তাতে ভক্তিপরায়ণ করুন; এবং আমাদের সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করুন)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-হে অগ্নি! তুমি সমবেত ও হিংসারহিত রক্ষার দ্বারা আমাদের পুত্র ও পৌত্রকে রক্ষা করো। তুমি আমাদের নিকট হতে দেবগণের কোপ ও মানবগণের বিদ্বেষ দূর করো। — এখানে দৈব্যা হেড়াংসি পদ দুটির অর্থ করা হয়েছে দেবগণের কোপ; কিন্তু আমরা অর্থ করেছি– দেবত্ব বিরোধিনঃ ভাবান– যে সকল ভাবের প্রাধান্য ঘটলে দেবত্বলাভে বিঘ্ন ঘটে অর্থাৎ অসৎ-বৃত্তিসমূহ। আবার অদেবানি হুরাংসি পদ দুটিতে রিপুর আক্রমণকে বোঝায়। তোকং তনয়ং পদ দুটিতে পুত্র-পৌত্র ইত্যাদির জন্য যে প্রার্থনা করা হয়েছে সন্তান ভগবৎপরায়ণ হোক বংশানুক্রমে আমাদের মধ্যে ভগবৎ-ভক্তির প্রবাহ প্রবাহিত হোক– তার চেয়ে উৎকৃষ্টতর প্রার্থনা আর কিছুই হতে পারে না]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম বারবন্তীয়ম]।

৪/১– হে সর্বব্যাপক দেব! আমি জ্যোতির্ময় ইত্যাদি আপনার যে নাম আপনি পরিবর্ণনা করেন, সেই নামের মাহাত্ম্য অকিঞ্চন আমি কিভাবে পরিকীর্তন করব? অর্থাৎ আপনার মাহাত্ম্যবর্ণন আমাদের সাধ্যের অতীত; আপনার যে এমনতর রূপ, আমাদের নিকট হতে প্রসিদ্ধ সেই জ্যোতির্ময় রূপ সংবৃত করবেন না; রিপুসংগ্রামে আপনি রিপুনাশক করালরূপ হন। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম্যখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান্ অবামনসোগোচরং হন; জ্যোতির্ময় পরমকল্যাণরূপ সেই দেবতা রিপুনাশকালে করালরূপ ধারণ করেন)। [মানুষের বাক্যমনের অতীত ভগবান্। মানুষের সাধ্যই নেই যে, তার অসীম মহিমা কীর্তন করতে পারে। মন্ত্রে ভগবানের সেই বর্ণনাতীত মহিমাই এবং তার সাথে মানুষের শক্তির সীমা প্রকাশিত হয়েছে]।

৪/২– হে জ্যোতির্ময় দেব! নিত্যকাল প্রার্থনাপরায়ণ আমি আপনার সম্বন্ধীয় প্রসিদ্ধ জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহ জেনে আপনাকে যেন প্রার্থনা করি। প্রসিদ্ধ পরমশক্তিসম্পন্ন আপনাকে আরাধনা করছি। এই লোকের দূরদেশে, অর্থাৎ ভগবানের নিকট হতে দূরে, অবস্থিত হীনশক্তি আমাকে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! হীনশক্তি আমাকে সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করুন, এবং পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [যে অসীম অনন্তের মধ্যে সমগ্র জগৎ বিধৃত আছে, মানুষ তাঁর থেকে দূরে যাবে কি করে? তাহলে, পরাকে ক্ষয়ন্তং– আপনার নিকট হতে দূরে অবস্থিত কথাটির তাৎপর্য কি? প্রকৃতপক্ষে এখানে কোন সম্বন্ধ নেই। ভগবানের বিশ্বমঙ্গলনীতির নিয়ম অনুসারে যে নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারে না, সে-ই ভগবানের নিকট হতে দূরে চলে যায়, সত্যমঙ্গলময় পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিরয়ের পথে অগ্রসর হয়। এই সত্যবিচ্যুতি, অজ্ঞানতা ও দুর্বলতাই দ্বারাই সম্ভবপর হয়। তাই সাধক ভগবানের চরণে নিজের এই দুর্বলতা, দৈন্য নিবেদন করছেন]।

৪/৩– হে সর্বব্যাপী দেব! আপনাকে প্রাপ্তির জন্য মুখের দ্বারা স্তুতি উচ্চারণ করি; হে। জ্যোতির্ময় দেব! আমার প্রার্থনারূপ সেই পূজোপচার গ্রহণ করুন, আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা আপনাকে প্রবর্ধিত করুক, অর্থাৎ আপনার মাহাত্ম্য পরিকীর্তিত করুক। হে দেবগণ! আপনারা সকলে নিত্যকাল আমাদের রক্ষাশক্তির দ্বারা রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই; ভগবান কৃপাপূর্বক অকিঞ্চন আমাদের পূজা গ্রহণ করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে বিষ্ণু! তোমার উদ্দেশে দূর হতে বষট্‌কার করেছি, অতএব হে শিপিবিষ্ট! আমার সেই হব্য সেবা করো, আমাদের সুস্তুতি ও বাক্য তোমায় বর্ধিত করুক, তোমরা সর্বদা আমাদের স্বস্তিদ্বারা পালন করো। — এ থেকে মন্ত্রের প্রচলিত ভাব উপলব্ধ হবে। আমরা বিষ্ণো অর্থে হে সর্বব্যাপিন্ দেব! গ্রহণ করেছি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম গৌরীবিতম]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৫– বায়ো শুক্রো অযামি তে মধ্যে অগ্রং দিবিষ্টিযু। আ যাহি সোমপীতয়ে স্পার্তো দেব নিযুত্বতা। ১৷৷ ইন্দ্র বায়বেষাং সোমানাং পীতিমঃ। যুবাং হি যন্তীন্দবো নিম্নমাপো ন সক্৷৷ ২৷৷ বায়বিশ্চ শুষ্মিণা সরথং শবসম্পতী। নিযুত্বা ন উতয় আ যাতং সোমপীতয়ে ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৬– অধ ক্ষপা পরিষ্কৃত বাজা অভি প্রগাহসে। যদী বিবস্বততা ধিয়ো হরিং হিন্তি যাবে৷ ১৷ তমস্য মর্জয়ামসি মদো য ইন্দ্ৰপাতমঃ। যং গাব আসভিদধুঃ পুরা নূনং চ সূরয়ঃ৷৷ ২৷ তং গাথয়া পুরাণ্যা পুনানমভ্যন্ত। উতত কৃপন্ত ধীতয়ো দেবানাং নাম বিভ্রতীঃ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৭– অশ্বং ন ত্বা বারবন্তং বন্দধ্যা অগ্নিং নমোভিঃ। সম্রাজ্যুমধূরাণা৷৷ ১৷ স ঘা নঃ সূনুঃ শবসা পৃথুপ্রগামা সুশেবঃ। মীঢ়বাং অস্মাকং বভূয়াৎ৷৷ ২৷৷ স নো দূরাচ্চাসাচ্চ নি মর্ত্যাদধায়োঃ। পাহি সদমি বিশ্বা৷ ৩৷৷

সূক্ত ৮– বৃমিন্দ্র প্রভৃর্তিভি বিশ্বা অসি স্মৃধঃ। অশস্তিহাজনিতা বৃত্ৰতুরসি ত্বং তূর্য তরুষ্যতঃ ॥১৷৷ অনু তে শুষ্মং তুরয়ন্তমীতুঃ ক্ষোণী শিশুং ন মাতরা। বিশ্বাস্তে স্মৃধঃ শ্লথয়ন্ত মন্যবে বৃত্ৰং যদি তূর্বসি৷৷ ২৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৫সূক্ত/১সাম– বায়ুর ন্যায় গতিশীল সর্বভূতাশিত আশুমুক্তিদায়ক হে দেব! মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য জ্ঞানসমন্বিত হয়ে যেন আমি আপনার অমৃত বিশিষ্টরূপে প্রাপ্ত হই। হে দেব! সকলের আকাক্ষণীয় আপনি ভগবৎপ্রাপক দেবভাবের সাথে আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণের জন্য আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনার কৃপায় যেন অমৃত লাভ করতে পারি; আপনি আমাদের দেবভাব প্রাপ্ত করান)। [ভগবান্ অনন্ত, তার রূপ অনন্ত বিভূতিও অনন্ত। তাকে যে নামেই ডাকা যায়, তিনি সেই নামেই সাড়া দেন। বক্ষ্যমাণ মন্ত্রে তাকে বায়ুরূপে আহ্বান করা হয়েছে। এটি তার অনন্ত বিভূতির এক আংশিক বিকাশ মাত্র। বায়ু যেমন সর্বত্রগতিশীল, তীব্রবেগসম্পন্ন– ভগবানও তেমনি সর্বভূতে নিত্য বিরাজিত এবং বায়ুর ন্যায় গতিবিশিষ্ট হয়ে ত্বরায় সাধকের প্রতি আশুমুক্তিদায়ক হন। এটাই বায়ুবিশেষণের তাৎপর্য। আলোচ্য মন্ত্রে মোক্ষপ্রাপ্তির উপায়ভূত অমৃত-লাভের জন্য প্রথম প্রার্থনা। এখানে মোক্ষপ্রাপ্তির প্রার্থনা দৃঢ়তর করবার জন্যই মধ্বঃ অযামি পদ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। মন্ত্রের শেষভাগে হৃদয়ে ভগবানের আবির্ভাব লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ- হে বায়ু! আমি পবিত্র হয়ে স্বর্গাভিলাষে তোমার নিকট প্রথমে সোমরস আনয়ন করছি। হে দেব! তুমি স্পৃহণীয়, তুমি সোম পানের জন্য নিযুৎ (অশ্বে) আগমন করো। ভাষ্যকার মধ্বঃ দেখলেই সোমকে লক্ষ্য করেন। আমরা ঐ শব্দে অমৃত লক্ষ্য করি]।

৫/২– আশুমুক্তিদায়ক হে দেব! আপনি এবং বলাধিপতি দেবতা আপনারা আমাদের হৃদয়ে নিহিত সত্ত্বভাব পান করবার যোগ্য হন অর্থাৎ আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। অমৃত যেমন দীনভাবাপন্ন জনের প্রতি সম্যকরূপে গমন করে, তেমনই আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব আপনাদের প্রতি গমন করুক, আপনাদের প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই না যে, হে ভগবন! দীনজন আমরা, আমাদের পূজোপচার গ্রহণ করুন)। [মন্ত্রের শেষাংশের নিম্নং আপঃ ন স উপমায় সাধকের হৃদয়ে দৈন্যনিবেদন পরিস্ফুট হয়েছে। ভাষ্যকার কিংবা ব্যাখ্যাকার কিন্তু মন্ত্রের ভিন্নার্থ কল্পনা করেছেন। তারা ইন্দ্র ও বায়ুদেবতাকে সোম পান করবার যোগ্য বলে বর্ণনা করেন; কারণ জল যেমন নিম্নদিকে গমন করে, তেমনই সোমরস নাকি তাদের অভিমুখে গমন করুক– এমনই প্রার্থনা]।

৫/৩– আশুমুক্তিদায়ক হে দেব! আপনি এবং বলাধিপতি দেব শক্তির মূলীভূত, প্রভূত শক্তিসম্পন্ন হন; আপনারা কৃপাপূর্বক আমাদের রক্ষার জন্য এবং আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণের জন্য সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য ও ভগবৎ-প্রাপক দেবভাবের সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরমশক্তিসম্পন্ন ভগবান্ সৎকর্মসাধনের শক্তি এবং দেবভাব প্রদানের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [একমেবাদ্বিতীয় ভগবানের বায়ুও ইন্দ্র নামধেয় দুটি বিভূতির একসঙ্গেই উল্লেখ করার মধ্যেই তিনি যে একতম, তা বোঝান হয়েছে। প্রকৃতার্থে এই মন্ত্রেও ভগবানের মুক্তি ও শক্তি এই দুই বিভূতিকেই আহ্বান করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব পরিবর্তিত হয়েছে]।

৬/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! অজ্ঞানান্ধকার অপগত হলে, পবিত্রকারক আপনি আত্মশক্তিকে লক্ষ্য করে গমন করেন অর্থাৎ আত্মশক্তিকে প্রাপ্ত হন; যখন স্তোতৃগণের সৎবুদ্ধি (অথবা সৎকর্ম) ঊধ্বর্গমনের জন্য পাপহার আপনাকে হৃদয়ে সমুৎপাদন করে, তখন সেই সাধকগণ মোক্ষ লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানসম্পন্ন সাধকবর্গ সৎকর্মসাধনের দ্বারা মোক্ষ লাভ করেন)। [হৃদয়ের অজ্ঞানান্ধকার দূরীভূত হয়ে যখন জ্ঞানজ্যোতিঃ প্রকাশিত হয়, তখনই মানুষের অন্তরের সকরকম মলিনতা দূরীভূত হতে থাকে। মন্ত্রের সম্বোধ্য– শুদ্ধসত্ত্ব। হৃদয় থেকে অজ্ঞানতা দূরীভূত হলে হৃদয়ের সকলরকম সৎবৃত্তি সৎ-ভাব বিশুদ্ধ হয়, স্ফুর্তি লাভ করে। শুদ্ধসত্ত্বের সাথে আত্মশক্তির সম্মিলন হয়, সত্ত্বভাবাপন্ন সাধক পরমশক্তির অধিকারী হন। — এটাই মন্ত্রের প্রথমাংশের তাৎপর্য। যখন সাধকগণ সৎ-বুদ্ধির দ্বারা প্রণোদিত হয়ে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করেন, তখন তারা ক্রমশঃ মোক্ষমার্গে অগ্রসর হতে থাকেন– এটাই শেষাংশের অর্থ]।

৬/২– যে শুদ্ধসত্ত্ব পরমানন্দদায়ক এবং ভগবান্ ইন্দ্রদেবের গ্রহণযোগ্য, এই শুদ্ধসত্ত্বের প্রসিদ্ধ অমৃত আমরা যেন প্রাপ্ত হই। নিত্যকাল জ্ঞানকিরণসমূহ যে অমৃত মুখ্যভাবে ধারণ করে, যে অমৃত জ্ঞানিগণ ধারণ করেন, সেই অমৃত আমরা যেন লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব এবং জ্ঞানজনিত অমৃত লাভ করি)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– এর (সোমের) যে অতি চমৎকার রস, যা ইন্দ্রের সর্ব শ্রেষ্ঠ পানীয় বস্তু, যা গাভিগণ এবং প্রাচীন পণ্ডিতগণ মুখে ধারণপূর্বক আস্বাদন করছেন, এস সেই রস আমরা শোধন করি। গাভিগণ তৃণ ভক্ষণ করে, সেই তৃণের মধ্যে সোমরস বর্তমান আছে, সুতরাং গাভিগণ সোম ভক্ষণ করে– এটাই ভাষ্যকারের অভিপ্রায়। সোমরস সাধারণতঃ সোম নামক এক রকম লতা থেকে উৎপন্ন হতো- এটা প্রচলিত মত। এখানে ভাষ্যকার বলছেন- তৃণের মধ্যেও সোম বর্তমান আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তৃণ থেকে সোমরসের উৎপত্তির প্রসঙ্গ কোথায়ও পরিদৃষ্ট হয় না। যাই হোক, ভাষ্যকারের এই ব্যাখ্যা ব্যতীত সে আরও একটি ভাব গৃহীত হতে পারে; তা এই যে, সোম তৃণে পর্যন্ত বর্তমান আছে– অর্থাৎ জগতের সকল বস্তুতে সোমরস বর্তমান আছে। এই ভাব থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সোম সাধারণ মাদকদ্রব্য হতে পারে না। কারণ সাধারণ মাদকদ্রব্য কখনই বিশ্বের সকল বস্তুতে বর্তমান থাকতে পারে না। সুতরাং সোম বলতে প্রকৃতপক্ষে স্বর্গীয় পরমার্থপ্রদ, যা আমাদের মোক্ষের পথে নিয়ে যায়, তেমন কোনও বস্তুকে অবশ্যই লক্ষ্য করে]।

৬/৩– সাধকগণ নিত্যপ্রার্থনার দ্বারা পবিত্রকারক ভগবানকে আরাধনা করেন; অপিচ, দেবমাহাত্ম্যপ্রখ্যাপক সৎ-বৃত্তিসম্পন্ন সাধকগণ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সমর্থ হন। (মন্ত্রটি নিতসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, – আরাধনাপরায়ণ সাধকেরা ভগবানকে প্রাপ্ত হন)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদে, ভাষ্য অনুসারে, সোমরসকে শোধনকালে নানারকমে স্তব করার প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। অথচ সমগ্র মন্ত্রের মধ্যে কোথায়ও সোমরসের উল্লেখ নেই]।

৭/১– হে দেব! রশ্মির ন্যায় স্বপ্রকাশ (জ্ঞানস্বরূপ) সর্বজ্ঞের (সকল সৎকর্মের) সম্পাদক (প্রভু) জ্ঞানস্বরূপ আপনাকে আমরা যেন (অভীষ্টসিদ্ধির জন্য) বন্দনা করতে প্রবৃত্ত হই। (ভাবার্থ, রশ্মির ন্যায় স্বপ্রকাশক সর্ব সৎকর্মসম্পাদক জ্ঞানস্বরূপ আপনাকে অভীষ্টসিদ্ধির জন্য যেন ভজনা করি)। অথবা- যজ্ঞসমূহের সম্রাটস্বরূপ, (প্রভু) অমৃতবিশিষ্ট, সর্বব্যাপক, প্রখ্যাত (সেই) জ্ঞানস্বরূপ দেবকে নমঃ-শব্দ উচ্চারণপূর্বক আমরা যেন বন্দনা করতে (সর্বদাই) প্রবৃত্ত হই। [অশ্বং ন ত্বা বারবন্তং শব্দ কটি সমস্যামূলক। ব্যাখ্যাকারগণ, ভাষ্যকারের অনুসরণে ঐ শব্দ কটির অর্থ। করেছেন– পুচ্ছ ও কেশরবিশিষ্ট অশ্বের ন্যায়। তা থেকে টেনে বুনে দৃষ্টান্তক্ষেত্রে ভাব আনা হয়েছে- অশ্ব যেমন পুচ্ছাদি সঞ্চালনে ব্যথাদায়ক দংশন মশক ইত্যাদিকে দূরীভূত করে, অগ্নিদেবও তেমনই আপন জ্বালা (শিখা) দ্বারা আমাদের পীড়াদায়ক শত্রুগণকে দূর করেন। আমরা বলি, মন্ত্রে অনিত্য ঘোটকদের সম্বন্ধ নেই। উপমপক্ষে এখানে জ্ঞানের বিষয় এবং জ্ঞানরূপ জ্যোতিঃর উপমাই বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের প্রথম অন্বয়ে অশ্বং অর্থে ব্যাপকং, রশ্মিং, অগ্নি অর্থে জ্ঞানস্বরূপং দেবংইত্যাদি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় অন্বয়েও প্রায় একইরকম অর্থ সূচিত হয়েছে; যেমন, অশ্বং– ব্যাপ্তিশীলং ইত্যাদি বলা বাহুল্য আমরা শব্দগুলির ব্যাখ্যাকালে বৈদিক-প্রয়োগ উপেক্ষা করতে পারিনি]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-২দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৭/২– সকল শক্তির আশ্রয়, সর্বত্রবিদ্যমান সেই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব আমাদের পরম সুখদায়ক হোন, প্রার্থনাকারী আমাদের অভীষ্ট প্রদানকারী হোন। সর্বশক্তির আশ্রয়ভূত জ্ঞানস্বরূপ সেই অগ্নিদেব আমাদের সুখবর্ধন এবং অভীষ্টপূরণ করুন– এটাই প্রার্থনা। [এখানে সাধারণ দৃষ্টিতে শবসা সূনুঃ পদ দুটিতে বলের পুত্র অর্থাৎ বল-উৎপন্ন (ঘর্ষণোৎপন্ন) অগ্নিকে লক্ষ্য করা হয়েছে বোঝা যায়। প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলিতে সেই অর্থই প্রকট হয়েছে। আমরা কিন্তু ঐ দুটি পদে শক্তির আশ্রয়স্থানঅর্থই গ্রহণ করি। শক্তি থেকে অগ্নি, কি অগ্নি থেকে শক্তি তা-ও নির্ধারণ করা অসম্ভব। এতে পরস্পর পরস্পরের আশ্রয়, আধার আধেয় ভাবে পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট এই তত্ত্বই, তত্ত্বপক্ষে অভিন্নত্ব ভাবই, উপলব্ধ হয়। এখানে শবসা সূনঃ এবং পৃথুপ্রগামা সেই অগ্নিকেই বোঝাচ্ছে, যিনি শক্তি থেকে উৎপন্ন অথচ শক্তিরই হেতুভূত এবং বিশ্বব্যাপক। ফলতঃ যিনি স্রষ্টা এ অথচ সৃষ্টি, ব্যক্ত অথচ অব্যক্ত; এখানে বিশেষণে তাকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। তিনি যে সাকার ও এ নিরাকার শবসা সূনুঃ পদ দুটিতে তা-ও ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং অগ্নিরূপী এ তিনি কে? ঐ প্রজ্বলন্ত অগ্নি নিশ্চয়ই নয়। অবশ্য ঐ অগ্নিকে উপলক্ষ করে সেই সকল উৎপত্তির মূলরূপে অদৃষ্ট, উৎপন্নরূপে পরিদৃশ্যমান, ঈশ্বরকেও লক্ষ্য করে]।

৭/৩– সর্বপ্রাণস্বরূপ (বিশ্বায়ু) সেই ভগবান্ অগ্নিদেব আমাদের দূরেও আছেন, এবং নিকটেও আছেন (কর্ম অনুসারে আমরা তাকে নিকটেও দেখতে পাই, আবার দূরেও দেখতে পাই); হে দেব! মানব-জন্ম-সহজাত পাপ হতে আমাদের পরিত্রাণ করুন। হে ভগবন! পাপ হতে পরিত্রাণ করুন, হৃদয়ে আগমন করুন– এটাই প্রার্থনা। [তিনি বিশ্বায়ু বিশ্বপ্রাণরূপে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হলেও মানুষ আপন কর্মানুসারে কখনও তাকে অন্তরে অধিষ্ঠিত দেখতে পায়, কখনও পায় না। এই মন্ত্রে মানুষের সেই বিভ্রমের বিষয় বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে– মানুষ, যদি তুমি তাকে সর্বদা নিকটে দেখতে চাও, তাহলে তাঁর শরণাপন্ন হও; তার নিকট প্রার্থনা জানাও, তিনি যেন এই মানব-জন্মের সাথে নিত্য-সম্বন্ধযুত পাপসমূহকে বিদূরিত করেন। পাপ বিদূরিত হলেই অজ্ঞান অন্ধকার অপসারিত হলেই, পুণ্যস্বরূপ তাঁর– জ্যোতিঃস্বরূপ তার অধিষ্ঠান হবে। তাই প্রার্থনা, হে দেব! পাপ থেকে আমাদের পরিত্রাণ করুন]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম বারবন্তীয়োত্তরং এবং বারবন্তীয়াদ্যম]।

৮/১– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! পূজ্য আপনি রিপুসংগ্রামে আমাদের সকল রিপুগণকে বিনাশ করুন। পাপহারক হে দেব! শ্রেষ্ঠ আপনি অমঙ্গলনাশক, মঙ্গলময় এবং শত্রুগণের নাশক হোন। (ভাব এই যে, মঙ্গলময় ভগবান্ আমাদের রিপুগণকে নাশ করুন; এবং মোক্ষবিঘ্নসমূহ নিবারণ করুন)। [প্রকৃতির ক্রিয়ায়, মায়ার প্রভাবে, অমঙ্গলের– পাপের উৎপত্তি হয়। কর্মবশে মানুষ পাপের অসুরের অধীনতা স্বীকার করে। মুহূর্তের জন্য, পাপ অমঙ্গল জগতে আধিপত্য বিস্তার করে বটে। কিন্তু মঙ্গলময় পরমশিব ভগবানের রাজত্বে শয়তানের আধিপত্য টিকতে পারে না। ভগবান্ রুদ্ররূপে তা ধ্বংস করেন। কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে, ভগবান্ যদি মঙ্গলময়ই হন তো পাপ অমঙ্গল এল কোথা থেকে? আসলে জগতে এই অমঙ্গলের সৃষ্টি হয় মায়ার প্রভাবে, প্রকৃতির চাতুরীতে। ত্রিগুণের সাহায্যে প্রকৃতি কাজ করেন। এই গুণত্রয়ের অসামঞ্জস্য-হেতু বিভিন্নতার সৃষ্টি হয়, মানুষের মধ্যে পার্থক্য জন্মায়। মায়ার প্রভাবে অজ্ঞানতাবশে মানুষ ভুল করে; পাপ করে, নিজের অমঙ্গল নিজে ডেকে আনে। তাই জগতে এই অমঙ্গলের সৃষ্টি হয়েছে মায়ার প্রভাবের ও জীবের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের জন্য। মঙ্গলময় ভগবান্ অমঙ্গলের সৃষ্টি করেন না, তার উপরে অসামঞ্জস্যের দোষ আসে না। কিন্তু মানুষ যখন ভুলের বশে, প্রকৃতির চাতুরীতে পাপের পথে যায়, অমঙ্গলের সৃষ্টি করে, নিজের প্রকৃত স্বরূপ ভুলে নিজেকে প্রকৃতির হাতের ক্রীড়ার পুতুল করে তোলে; তখন ভগবান্ রুদ্ররূপে অমঙ্গল ধ্বংসের জন্য আবির্ভূত হন, মানুষকে সচেতন করে দিয়ে পথ প্রদর্শন করেন। এই ধ্বংসের মধ্যে পরম মঙ্গল দর্শন করে সাধক প্রার্থনা করেন রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যং। তাই ধ্বংস ও সৃষ্টি এই দুটিরই মধ্য দিয়ে ভগবানের মঙ্গলময় রূপ প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি একাধারে মঙ্গল ও অমঙ্গলের সৃষ্টিকর্তা, আবার অমঙ্গলের নাশয়িতা, – তাঁর প্রতি এই অসামঞ্জস্য দোষ আরোপ করা যায় না। সেইজন্যই মন্ত্রের মধ্যে, একসঙ্গে ভগবানকে অশস্তিহা জনিতা বৃত্ৰতু ও বলা হয়েছে। বৃত্র পদে আমরা পূর্বাপরই অজ্ঞানতা পাপ অর্থ করে আসছি]। [এই মন্ত্রটি হল এ ছন্দার্চিকেও (৩অ-৮দ-৯সা) পাওয়া যায়]।  

৮/২– হে ভগবন! মাতাপিতা যেমন শিশুকে অনুগমন করেন, তেমন ভাবে দুলোক-ভূলোকে অবস্থিত সকল লোক আপনার আশুমুক্তিদায়িকা শক্তি পেতে ইচ্ছা করেন। বলাধিপতি হে দেব! যেহেতু আপনি অজ্ঞানতারূপ রিপুকে বিনাশ করেন, সেই হেতু সকল শত্রু আপনার রিপুনাশিকা শক্তির জন্য হীনবল হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সকল লোক ভগবৎ-শক্তি লাভ করতে ইচ্ছা করেন; ভগবান্ লোকদের সকল রিপু বিনাশ করেন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির নমুনাস্বরূপ একটি বঙ্গানুবাদ- হে ইন্দ্র! মাতা যেমন শিশুর অনুগমন করে, তেমন মাতৃভূত দ্যাবাপৃথিবী তোমার বল-হিংসকের অনুগমন করে। যেহেতু তুমি বৃত্রকে বধ করো, অতএব সমস্ত সংগ্রামকারিগণ তোমার ক্রোধে ভিন্ন হয়। কিন্তু এই অনুবাদ ভাষ্যের অনুসারী নয়; বিশেষতঃ দু এক স্থলে ভাষ্যের বিপরীত ভাবই প্রকাশ করছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– অভিবর্তং]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৯– যজ্ঞ ইন্দ্রমবর্ধয়দ যদ ভূমিং ব্যবৰ্তয়ৎ। চক্ৰাণ ওপশং দিবি। ১৷৷ ব্য৩ন্তরিক্ষমতির মদে সোমস্য নোচনা। ইন্দ্রো যদভিন বল৷ ২৷৷ উদ গা আজঙ্গিরোভ্য আবিষ্কৃথন গৃহা সতীঃ। অর্বাঞ্চং নুনুদে বল। ৩৷৷

সূক্ত ১০– ত্যমু বঃ সত্ৰাসাহং বিশ্বাসু গীর্ষায়তম্। আ চ্যাবয়তয়ে৷১ যুধুং সন্তমনর্বাণং সোমপামনপচ্যুত নরমবার্যক্রতু৷৷ ২৷৷ শিক্ষা ণ ইন্দ্র রায় আ পুরু বিদ্বাং ঋচীষম। অবা নঃ পার্যে ধনে৷ ৩৷

সূক্ত ১১– তব ত্যদিন্দ্ৰিয়ং বৃহৎ তব দক্ষমুত ক্রতু। বজ্ৰং শিশাতি ধিষণা বরেণ্য। ১৷৷ তব দ্যৌরিন্দ্র পৌংস্যং পৃথিবী বর্ধতি শ্ৰবঃ পর্বতাসশ্চ হিন্বিরে৷৷ ২. ত্বাং বিষুবৃহন্ ক্ষয়য়া মিত্রো গৃণাতি বরুণ। ত্বাং শর্ধো মদত্যনু মারুত৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৯সূক্ত/১সাম– সৎকর্ম ভগবানকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করে অর্থাৎ সন্তুষ্ট করে; সেই সন্তোষহেতু, সেই ভগবান্ স্বর্গলোকে অবস্থিতি করেও, এই ভূলোককে– এর অন্তর্গত সৎকর্মের অনুষ্ঠাতাকে বিশেষভাবে রক্ষা করেন। (ভাব এই যে, সৎকর্ম ভগবানের সন্তোষবিধান করে এবং সৎকর্মের অনুষ্ঠাতাকে ও ভূলোককে পালন করে থাকে)। [এই মন্ত্রে মানুষ-মাত্রকেই সৎকর্ম করবার জন্য উদ্বোধিত করা হয়েছে। সৎকর্মই ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চতুর্বর্গ প্রাপ্তির সাধন। কর্ম না করলে, শরীর-যাত্রা (জীবিকা) নির্বাহিত অসম্ভব। কর্ম করো– ফল আপনিই আসবে। ফলাকাঙ্ক্ষার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভাষ্যের অনুসরণে মন্ত্রটির অর্থ প্রতিপন্ন হয় যে, যজমান কর্তৃক অনুষ্ঠিত যজ্ঞ ইন্দ্রদেবকে বর্ধিত করেছে। ভাষ্যের ভাবে ও আমাদের ভাবে একটু পার্থক্য ঘটার কারণ, এ মন্ত্রের যজ্ঞঃ অবধৎও ব্যবৰ্তয়ৎ– এই তিনটি পদের অর্থ ভিন্নভাবে গৃহীত হয়েছে। আমরা মনে করি, যজ্ঞ বলতে কেবলই যে অগ্নিকুণ্ডে ঘৃতাহুতি দান বোঝায়, তা নয়। আমরা যজ্ঞ পদে সৎকৰ্মৰ্মত্ৰকে লক্ষ্য করি। তাতে একটা বিশ্বজনীন উদার ভাব আসে। যজ্ঞ বা হোম ইত্যাদির দ্বারা ভগবানের তৃপ্তি বা সন্তোষ হয় বললে, যাঁরা তেমন যজ্ঞ করতে সমর্থ হবেন না, তাঁরা তবে ভগবানের সন্তোষ জন্মাতে পারবেন না? পরোপকার, রোগিচর্যা, বিপন্নত্রাণ, সক্কর্মের সহায়তা এই সব সৎকর্ম করলেও তথাকথিত যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়। কারণ ঐ-সব কর্মেও ভগবান্ অবশ্যই সন্তুষ্ট হবেন। তাই মনে হয়, মন্ত্রের যজ্ঞ-পদে সৎকর্ম মাত্রকেই সূচিত করে। যজ্ঞ যেমন সৎকর্ম, এগুলিও তেমনই সৎকর্ম। অবধয়ৎ পদের ভাষ্যানুসারী অর্থ-ভগবান্ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু যিনি পরমৈশ্বর্যশালী, যিনি প্রবৃদ্ধ, তাঁর আবার বৃদ্ধি কি? এখানে তার সন্তোষ-সাধনই তার পরিবৃদ্ধি মনে করতে হবে। এইরকম ব্যবৰ্তয়ৎপদ। এই পদ সম্বন্ধে ভাষ্যে উক্ত হয়েছে– পৃথিবীং বৃষ্ট্যাদিদানেন বর্তমানং অকরোৎ, তারও সঙ্গতি নেই। পৃথিবী তো বর্তমানা আছেই; তাকে আবার কিভাবে বর্তমানা করবে? এ এক বিসদৃশ উক্তি বলে মনে হয়। ব্যবৰ্তয়ৎপদে আমরা তাই ব্যবৰ্তয়েৎ মনে করে (বর্তমানে অতীত কাল প্রয়োগ করে) তার অর্থ গ্রহণ করেছি, -পৃথিবীকে রক্ষা করে থাকেন। ফলতঃ সৎকর্মের দ্বারাই ভগবান্ সন্তুষ্ট হন এবং সৎকর্মের প্রভাবেই পৃথিবী রক্ষিত হয়;- অবয়ৎ ও ব্যবৰ্তয়ৎ পদ দুটি এই ভাবই ব্যক্ত করছে। চক্রাণ ওপশং দিবি– এই বাক্যাংশের ভাব– স্বর্গ যাঁর আবাসস্থান, সৎকর্মের প্রভাবে এই মর্ত্যে এসেও তিনি অবস্থিতি করেন, মর্তবাসীর শ্রেয়ঃ সাধনে উদ্বুদ্ধ হন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-১দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৯/২– বলাধিপতি দেবতা যখন শত্রুবল নাশ করে সাধককে শক্তি প্রদান করেন, তখন সাধক শুদ্ধসত্ত্বজনিত পরমানন্দ লাভ করে জ্যোতির্ময় স্বলোক সম্যক্‌রূপে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের শক্তি লাভ করে সাধকগণ মোক্ষলাভে সমর্থ হন)। [মন্ত্রটিতে যুগপৎ ভগবানের মাহাত্ম্য এবং সাধকের সৌভাগ্য বর্ণিত হয়েছে। ভগবান্ সাধককে শক্তিদান করেন, এবং সেই শক্তিলাভ করে সাধক সাধনমার্গে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। যখন সাধক ভগবৎশক্তির অনুভূতি হৃদয়ে লাভ করেন, তখন ক্রমশঃ হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সঞ্চার হয়। তাই সাধককে বিমলানন্দ এ দানে ধন্য করতে পারে। ভগবানের কৃপায় সাধক মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হন]।

৯/৩– ভগবান্ নিগূঢ় জ্ঞানকিরণ প্রকাশিত করে জ্ঞানিদের প্রদান ক রন; এবং হীনবল অসহায় জনকে শক্তি প্রেরণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, – সাধকেরা ভগবানের কৃপায় প্রাকৃতজনের অপরিজ্ঞাত পরাজ্ঞান লাভ করেন; ভগবান্ হীনবল কৃপাপ্রার্থী জনকে শক্তি প্রদান করেন)। [ভাষ্য ইত্যাদিতে, এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায়, পণি অসুরের উপাখ্যানের উল্লেখ আছে। কিন্তু মূলে পণির কোনও প্রসঙ্গই নেই। মন্ত্রের প্রথম অংশের গাঃ পদের অর্থ কিরণ, জ্ঞানকিরণ। তা কেমন? গুহা সতীঃ– নিগূঢ় অবস্থিত। আসলে জ্ঞানশক্তি জগতে বিদ্যমান থাকলেও তা প্রাকৃত জনের অনধিগম্য। যাঁরা সাধনার বলে নিজেকে সেই পরমবস্তু লাভের উপযোগী করে তুলতে পারেন, তারাই জ্ঞানলাভ করতে পারবে। তরাং জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে গুহা সতীঃ- নিগূঢ়ধৰ্তমান। কিন্তু সেই জ্ঞানকে কে লাভ করতে পারেন? কিভাবেই বা তা লাভ করা যায়? বেদ বলছেন– অঙ্গিরোভ্য জ্ঞানিগণকে তা প্রদান করা হয়। অঙ্গিরাশব্দে যে জ্ঞানিগণকে লক্ষ্য করে, তা আমরা ইতিপূর্বে বহুবার ব্যক্ত করেছি। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ– অৰ্চাঞ্চং নুনুদে বল– হীনবল, অসহায়, কৃপাপ্রার্থী.জনকে, ভগবান্ শক্তি প্রদান করেন। — ইত্যাদি। কিন্তু ভাষ্যকার এইরকম সরল ও সঙ্গত অর্থ পরিত্যাগ করে কল্পিত অর্থ গ্রহণ করেছেন। তার অনুবাদ– অঙ্গিরা ঋষিগণকে বলানুচর পণিগণ কর্তৃক অপহৃত গাভীসমূহ প্রদান করেছিলেন। কিভাবে? কেউ দেখতে না পায়– এমনভাবে পণিগণ কর্তৃক নিগুঢ়ভাবে গুহাতে লুক্কায়িত গাভিগণকে প্রকাশিত করে। অপিচ, পণিদের অধিপতি বলনামক অসুরকে অধোমুখে প্রেরিত করেছিলেন। ভাষ্যকার অর্বাঞ্চং পদের অর্থ করেছেন- অধোমুখং। আমরা তা অস্বীকার করি না। আমরা বলেছি– যারা নতমুখে ভগবানের চরণে শরণ গ্রহণ করে]।

১০/১– হে আমার মন! তোমাদের নিজেদের রক্ষার জন্য শত্রুগণের অভিভবকারী, সকল ॥ স্তোত্রে বিস্তৃত অর্থাৎ স্তোত্ররূপে অবস্থিত, সেই প্রসিদ্ধ দেবতাকে উৎকর্ষের সাথে অভিমুখে আগমন করাও অর্থাৎ আনয়ন করো। (আত্ম-উদ্বোধন-প্রকাশক এই মন্ত্রটির ভাব এই যে, হে মানুষ! তোমার কর্মের দ্বারা তুমি যেন ভগবানের সামীপ্য লাভ করো, তার জন্য উদ্বুদ্ধ হও)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদে, কাকে সম্বোধন করে যে মন্ত্রটি উচ্চারিত, তা বোঝা যায় না। যেমন, — সকলের অভিভবকারী এবং তোমাদের সমস্ত স্তোত্রে বিস্তৃত ইন্দ্রকেই রক্ষাৰ্থ অভিমুখে আগমন করাও। ভাষ্য অনুসারে এই মন্ত্রটি স্তোতাকে সম্বোধন করে উচ্চারিত হয়েছে সিদ্ধান্ত করা যায়। আমাদের সিদ্ধান্ত প্রার্থনাকারী সাধক নিজের মনকে সম্বোধন করে এই মন্ত্রে বলছেন– হে আমার মন! তুমি সেই দেবতাকে নিকটে আনয়ন করো; অর্থাৎ তার সাথে তোমার মিলন হোক। সে মিলনে কি হবে? তোমার অর্থাৎ আমার রক্ষা হবে। কেননা সেই দেবতা শত্রুগণের অভিভবকারী। তার উদ্দেশে স্তোত্রমন্ত্র উচ্চারণ করো; তাঁর পূজায় প্রবৃত্ত হও; তার দ্বারাই তাঁকে প্রাপ্ত হবে; কেননা, তিনি সকল স্তোত্র-মন্ত্রের সাথে বিদ্যমান আছেন। মন্ত্র এমনই আত্ম-উদ্বোধনার ভাব প্রকাশ করছেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-উদ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১০/২– শনিবারক সৎস্বরূপ অপ্রতিহতগতি শুদ্ধসত্ত্বদাতা অপরাজেয় অনিবার্যশক্তি সর্বলোকের অধিপতি দেবতাকে আরাধনা করতে আমরা যেন সমর্থ হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই)। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক হলেও তার মধ্যে। আত্ম-উদ্বোধনার ভাবও বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। ভগবানকে যেন আমরা পূজা করতে পারি, তার সেবায় যেন আমরা আত্মনিয়োগ করতে পারি– আমাদের যেন সেই শক্তি লাভ হয়– এটাই প্রার্থনার সারমর্ম। এর মধ্যে ভগবানের মাহাত্ম্য-খ্যাপনও আছে। জগতে এমন কোনও বাধাবিঘ্ন নেই, যা তাঁর শক্তি প্রতিরোধ করতে পারে। তাই তিনি অনির্বাণং। তিনি অনপচুতং– অপরাজেয়। কারণ তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কেউই নেই। তিনি সোমপাং। ভাষ্যকার অর্থ করছেন, সোমপানকারী। কিন্তু আমরা মনে করি, পালনার্থক পা ধাতু এখানে প্রযুক্ত হয়েছে। তাই সোমপাং পদের অর্থ হয়– যিনি শুদ্ধসত্ত্ব রক্ষা করেন, অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বদাতা]।

১০/৩– পরমারাধনীয় হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সর্বজ্ঞ আপনি আমাদের প্রভূত পরিমাণে পরমধন, সম্যকরূপে প্রদান করুন; হৈ দেব! পরমধন দান করে আমাদের রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের পরমধন প্রদান করুন, এবং আমাদের সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করুন)। [মন্ত্রটি প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও প্রার্থনামূলক বলে গৃহীত হয়েছে। যেমন, হে

স্তুতির দ্বারা সম্বোধনযোগ্য ইন্দ্র! তুমি বিদ্বান, তুমি শত্রুদের নিকট হতে আমাদের প্রভূত ধন করো। শত্রুদের ধনের দ্বারা আমাদের রক্ষা করো। প্রার্থনামূলক বলে গৃহীত হলেও ভাষ্য ইত্যাদিতে প্রার্থনার ভাব বহুলপরিমাণে পরিবতিত হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম সত্ৰিসোহীয়ম]।

১১/১– হে ভগবননু! আপনার সম্বন্ধী প্রসিদ্ধ বীর্য এবং আপনার সম্বন্ধী মহৎ বল, সৎকর্মসাধনসামর্থ্য, অপিচ, পরমাকাক্ষণীয় রিপুনাশিকা শক্তিকে আমাদের প্রার্থনা সম্যকরূপে লাভ করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, প্রার্থনার দ্বারা আমরা যেন ভগবানের পরমধন এবং দিব্যশক্তি লাভ করতে পারি)। [আলোচ্য মন্ত্রটির একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে ইন্দ্র! স্তুতি তোমার সেই বৃহৎ বীর্য তোমার সেই বলকর্ম এবং বরণীয় বজ্রকে তীক্ষ্ণ করছে। প্রচলিত অর্থে ইন্দ্রদেবের আয়ুধ সেই বজ্রকে স্তুতি কিভাবে তীক্ষ্ণ করবে তা বোঝা যায় না। সুতরাং শিশাতি অথবা তীক্ষ্ণ করা ক্রিয়ার নিশ্চয়ই একটা বিশেষ অর্থ আছে। কিন্তু ব্যাখ্যায় তা পরিস্ফুট হয়নি। ভাষ্যকারও এ সম্বন্ধে বিশেষ কোনও উল্লেখ করেননি। প্রথমতঃ বজ্র শব্দের দ্বারা কি ভাব প্রকাশিত হয় তা দেখতে হবে। বজ্র সম্বন্ধীয় আখ্যায়িকা প্রায় সকলেই জানেন। দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা নির্মিত এই অস্ত্রের দ্বারা ইন্দ্র অসুরবধ করেন। এখানে একটি বিশেষ বিষয় অনুধাবনযোগ্য। যতই কেন শক্তিশালী হোক না, শেষপর্যন্ত অসুর বা অসদ্ভাব ধ্বংস হয়– দেবশক্তিই জয়লাভ করে। কিন্তু কোন্ উপায়ে সেই মহৎ কার্য সম্পন্ন হয়? তা-ও ঐ আখ্যায়িকাতেই বিবৃত হয়েছে। সাধক যখন জগতের হিতসাধনে, পরমমঙ্গলোভের জন্য আত্মবিসর্জন করেন, সাধনার উচ্চস্তরে আরোহণ করে সাধক যখন মর্ত্যের অবিনশ্বর বস্তুর মোহ অতিক্রম করে সৎ-বস্তুর সন্ধানে, সৎবস্তু লাভে আত্মনিয়োগ করেন, তখনই জগতে ধর্মশক্তির পুনরভ্যুদয় হয়। সাধকের প্রাণশক্তি, দধীচির অস্থিই লুপ্তপ্রায় দেবশক্তির পুনরুদ্ধার করতে পারে। দধীচির অস্থিই সেই অসুরবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের প্রকৃত উপাদান। দেবতাও মানুষের এই শক্তির সাহায্য গ্রহণ করেন। বজ্র নির্মাণের এটাই তাৎপর্য। আমাদের এই মন্ত্র বলছেন– ধিষণা বজ্ৰং শিশাতি– স্তুতি বজ্রকে তীক্ষ্ণ করে। আপাতদৃষ্টিতে এই বাক্যটি অসংলগ্ন বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। দধীচির আখ্যান থেকেই বোঝা গেছে– সাধক যখন সাধনায় (প্রার্থনা-আরাধনায়) আত্মনিয়োগ করেন, তখনই, পাপশক্তি অসুরগণ হীনবল কার হয়, এবং তেমনভাবেই দেবশক্তি, অসুরনাশক শক্তি, বজ্রশক্তি প্রবর্ধিত হয়। তাই সমগ্র মন্ত্রের সার এ অংশ ঐ বাক্যেই প্রকাশিত হয়েছে]।

১১/২– সর্বশক্তিমান হে দেব! দ্যুলোক আপনার শক্তি বর্ধন করে এবং ভূলোক আপনার যশঃ বর্ধন করে, অর্থাৎ দ্যুলোক-ভূলোকস্থিত সকলেই আপনার শক্তি এবং মাহাত্ম্য প্রখ্যাপিত (কীর্তন) করে। অমৃতপ্রাপিকা পাষাকঠোর সাধনা পরমদেবতা আপনাকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, বিশ্বস্থিত সকল লোক ভগবানের মাহাত্ম্য কীর্তন করে। মানুষেরা কঠোর সাধনার দ্বারা অমৃতস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হন)। [দ্যুলোক ও ভূলোক যথাক্রমে ভগবানের শক্তি বর্ধন করে ও শক্তি-মাহাত্ম্য কীর্তন করে। কিন্তু এই দুই বিভাগের দ্বারা তাঁর ভক্তগণের শ্রেণীবিভাগ করা হয়নি। মন্ত্রাংশের ভাব এই যে, — দ্যুলোক-ভূলোকের সকল প্রাণীই তাঁর মহিমা কীর্তন করে। দ্বিতীয় অংশের ভাব এই যে, সাধকেরা কঠোর সাধনার দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হন। আপঃ পদের সাথে পর্বতাসঃ পদের সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে তাই এই উভয় পদের অর্থ দাঁড়ায়– অমৃতপ্রাপকাঃ পাষাণকঠোরসাধনাঃ অর্থাৎ সাধনার দ্বারা সাধকেরা ভগবানকে লাভ করেন]।

১১/৩– হে ভগবন! পরমাশ্রয়স্বরূপ সর্বব্যাপী দেবতা, মিত্রভূত অভীষ্টবর্ষক দেবতা আপনাকে স্তুতি করেন; বিবেকসম্বন্ধিনী শক্তি আপনাকে প্রীত করে। (মন্ত্রটি ভগবৎ-মাহাত্ম্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবন সকলের আরাধনীয় এবং সকলের অধিপতি। এতএব তার শরণ গ্রহণ করো)। [মন্ত্রটির ভাষ্যে বলা হয়েছে– বিষ্ণু মিত্র বরুণ প্রভৃতি দেবতা ইন্দ্রের স্তুতি করেন। এর দ্বারা (প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারেই) বোঝা যায় যে, ইন্দ্রকে সর্বশ্রেষ্ঠরূপে গ্রহণ করা যায়েছে। মন্ত্রে ইন্দ্রের কোন উল্লেখ নেই। আমরা মনে করি, এখানে মন্ত্রের সম্বোধ্য দেবতা স্বয়ং ভগবান্। ভগবৎ-চরণেই সকলে প্রণত হয়। বিষ্ণু (সর্বব্যাপী দেবভগবানের বিভূতি), মিত্র (মিত্রভূত দেবতা– ভগবানের বিভূতি), বরুণ (অভীষ্টবর্ষক দেবতা– ভগবানের বিভূতি), মরুৎ (বিবেকরূপী দেবতা– ভগবানের বিভূতি)– সবই তার অংশ বা অংশের বিকাশ মাত্র। তাই সকলেই তাতে লীন হয়। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রে বহুত্বের মধ্য দিয়ে একত্বের ভাব প্রকাশ করা হয়েছে। এটাই মন্ত্রাংশের বিশেষত্ব]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রে একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম সৌভরম]।

.

 চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১২– নমস্তে অগ্ন ওজসে গৃণন্তি দেব কৃষ্টয়ঃ। অমৈরমিত্রময়৷৷৷৷ কুবিৎ সু নো গবিষ্টয়েইগ্নে সংবেষিযো রয়িম্। উরুকৃদুরু ণস্কৃধি৷৷ ২. মা নো অগ্নে মহাধনে পরা বগর্ভারভৃদ্যথা। সংবর্গং সং রয়িং জয়৷৩৷৷

সূক্ত ১৩– সমস্য মন্যবে বিশো বিশ্ব নমন্ত কৃষ্টয়ঃ। সমুদ্ৰায়ের সিন্ধবঃ ॥১৷৷ বি চিদ বৃত্রস্য দোধতঃ শিরো বিভেদ বৃষ্ণিনা। বক্রেণ শতপর্বণা৷ ২৷৷ ওজস্তদস্য তিত্বিষ উভে যৎ সমবর্তয়ৎ। ইন্দ্ৰশ্চর্মেব রোদসী৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৪– সুম বস্বী রন্তী সূনরী৷৷৷৷ সরুপ বৃষন্না গহীমৌ ভদ্রেী ধূর্যাবভি। তাবমা উপ সর্পতঃ ২৷৷ নীব শীর্ষাণি মৃঢ়বং মধ্য আপস্য তিষ্ঠতি।  শৃঙ্গেভির্দশভিৰ্দিশ৷৷ ৩৷

মন্ত্রাৰ্থ— ১২সূক্ত/১সাম– দ্যোতমান হে অগ্নিদেব (প্রজ্ঞানরূপ দেবতা)! আত্ম-উৎকর্ষ-নিষ্পন্ন জনগণ, জ্ঞানলাভের জন্য, আপনার উদ্দেশে নমঃসূচক স্তোত্র গান করে থাকেন (অতএব আমিও আপনাকে স্তব করছি)। আপনি অমিত বলপ্রভাবে (আমার) শত্রুকে বিনষ্ট করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! জ্ঞানলাভের জন্য সাধকবর্গ আপনাকে স্তুতি করেন। আপনিও অমিতপরাক্রমে শত্রুদের বিনাশ করে থাকেন)। [মন্ত্রের ওজসে পদের অর্থ, ভাষ্যকারের মতে বলায় অর্থাৎ বলোভের জন্য। আমরা ঐ পদের অং করছি — জ্ঞানলাভের জন্য। সাধনমার্গে উন্নতি লাভ করতে হলে বিশুদ্ধ জ্ঞানবলই একমাত্র প্রধান বল। হৃদয়ে জ্ঞানবল সঞ্চিত না হলে, হৃদয় জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হলে, ভগবানের করুণা-লাভ সম্ভবপর হয় না। তাই সাধক প্রার্থনা জানাচ্ছেন– হে দেব! আপনি জ্ঞানস্বরূপ; আপনি আমাদের হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত করুন, তার অব্যর্থ প্রভাবে অজ্ঞানজনিত কাম ক্রোধ ইত্যাদি অন্তঃশত্রু ভস্মীভূত হোক, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব বিকাশ পাক। — মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়। এর ঋষি– বামদেব]।

১২/২– হে জ্ঞানদেব! পরাজ্ঞানলাভের জন্য আমাদের প্রভূত পরিমাণে (শুদ্ধসত্ত্বরূপ) পরমধন প্রদান করুন। মহত্ত্বদাত হে দেব! আমাদের জ্ঞানভক্তির দ্বারা সমৃদ্ধিসম্পন্ন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক, প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের পরমধন এবং পরাজ্ঞান প্রদান করুন। আমাদের জ্ঞানভক্তিসম্পন্ন করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও মন্ত্রটিকে প্রার্থনামূলক বলেই গ্রহণ ও ও করা হয়েছে। যেমন, হে অগ্নি! আমরা গাভী লাভ করতে পারব বলে তুমি বহুধন দান করো; তুমি সমৃদ্ধিকারী, তুমি আমাদের সমৃদ্ধ করো। কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে আমরা একমত নই। গবিষ্টয়ে পদে ভাষ্য ইত্যাদিতে যে অর্থ গৃহীত হয়েছে, তার ভাব– গরু লাভের জন্য। কিন্তু এই পদে গরুলাভের কোনও প্রসঙ্গ নেই। গো শব্দে জ্ঞানকিরণ বোঝায়। সে মতে গোবিষ্টয়ে রয়িং, সংবেষিষঃ মন্ত্রাংশের ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান এবং পরমধন লাভ করতে পারি। মন্ত্রের শেষাংশের অর্থ সরল। তিনিই মানুষের আশ্রয়, সর্বশক্তির আধার। তিনিই মানুষকে শক্তি দান করতে পারেন। তাই সেই পরম-দেবতার চরণে শক্তি-লাভের প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে। যা মানুষকে জীবনের চরম অভীষ্টলাভে সাহায্য করতে পারে, তা-ই প্রকৃত শক্তি। সেই শক্তির মূলে আছে– জ্ঞানভক্তি। তাই মহত্ত্ব অর্থে আমরা জ্ঞানভক্তি ইত্যাদি শক্তিকে লক্ষ্য করেছি]।

১২/৩– হে জ্ঞানদেব! বিশ্বের ধারক আপনি রিপুসহ আমাদের সংগ্রামে আমাদের যেন পরিত্যাগ করবেন না। পরন্তু হে দেব! শজয়ে প্রভূতপরিমাণ পরমধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের রিপুশত্রু নাশ করুন এবং আমাদের .. পরমধন প্রদান করুন)। [ভারভৃৎ যথা পদ দুটিতে বিশ্বের ধারক ভগবানকেই বোঝাচ্ছে। সেই পরমদেবতার কৃপায় যেন আমরা পরমধন লাভে বঞ্চিত না হই, তিনি যেন কখনও আমাদের পরিত্যাগ না করেন- এটাই মন্ত্রের অন্তর্গত প্রার্থনার সারমর্ম]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– জরাবোধীয়ম]।

১৩/১– প্রবহমান নদীসকল, সমুদ্রের জন্য অর্থাৎ সমুদ্রের সাথে মিলনের জন্য প্রণত হচ্ছে অর্থাৎ তার উদ্দেশে নিজেকে প্রেরণ করছে। তেমনই, আত্ম-উৎকর্ষসাধক বিশ্ববাসী জনগণ, বিশ্বব্যাপক সেই ভগবানের অর্চনা করবার জন্য অর্থাৎ তার সাথে মিলিত হবার জন্য, প্রণত হচ্ছে অর্থাৎ তার উদ্দেশে আত্ম-প্রেরণ করছে। (ভাব এই যে, বিশ্ববাসী সকলেই ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণত হচ্ছে; অতএব হে মন! তুমিও সেই বিশ্বের অন্তর্গত হয়ে তার প্রতি তেমনই প্রণত হও)। [এই সামমন্ত্রে ভগবানের মহিমা প্রকাশ ও নিজের (আত্মার) উদ্বোধন-ভাব প্রতীত হয়। ভগবান্ কেমন? না তিনি বিশঃ– বিভু বিশ্বব্যাপক অনন্ত অসীম সমুদ্রের মতো– সমুদ্রায় সিন্ধবঃ। সমুদ্র যেমন এ বিশ্বসংসারে যত নদ-নদী আছে– সকলকেই, নিজেতে মেশাতে নিজের ধনে ধনী করতে, আপনজন করতে, তরঙ্গ নিকর কর প্রসারিত করে আহ্বান করতে থাকে; ভগবানও সকল দিকে সকল স্থানে থেকে বলছেন হে বিশ্ববাসী জীবগণ! তোমরা যদি আত্মার উৎকর্ষ সাধন করতে চাও, যদি আমাতে আত্মসমর্পণ করতে চাও, তাহলে নত হও, সত্ত্বভাবসম্পন্ন হও, আমার দিকে লক্ষ্য করো;-সকল কাজের ভেতর। দিয়ে, সংসারের তাপ-জ্বালার মধ্য দিয়ে, আমার পানে ছুটে এস। দেখবে– সংসারের যত কিছু মায়া মমতা, যতকিছু কামনা-প্রলোভন, কেউই তোমাকে বন্ধন করতে পারবে না, কেউই তোমাকে ঠকাতে পারবে না, তুমি তোমার লক্ষ্যকে (আমাকে) পাবেই পাবে। তাই বলি– মন! দৃঢ় অচল অটল সঙ্কল্প করো। আত্ম-উৎকর্ষ সাধনে প্রবৃত্ত হও। ভগবানকে লক্ষ্য করো। তার অর্চনায় রত হও। দেখবে তোমার সেই সাধনার ধন, নিদানের বন্ধু, ভব-পারাবারের কাণ্ডারী, সংসার-সাগর-তরী, ভগবান্ নিকটে আসবেন– তোমাকে ভব-পার করবেন, নিজের জন করবেন– তোমার সকলরকম দুঃখতাপজ্বালা দূর হবে। এই সামমুন্ত্রে এই ভাবটিই ব্যক্ত হচ্ছে বলে আমরা মনে করি]।

১৩/২– হে দেব! আপনি আপনি অভীষ্টবর্ষক প্রভূতশক্তিযুত রক্ষাস্ত্রের দ্বারা আমাদের হৃদয় এ আচ্ছাদক অজ্ঞানান্ধকারের কেন্দ্রশক্তিকে বিশেষরূপে বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের অজ্ঞানতা দূর করুন)। [বৃত্রস্য পদে ভাষ্যকার আবরকস্য ও অর্থ করেছেন, আবার তাকে অসুরও বলেছেন। প্রচলিত অর্থে বৃত্র শব্দে কোনও এক অসুরকে বোঝায়। বৃত্র শব্দের প্রকৃত অর্থ– জ্ঞানাবরক অর্থাৎ অজ্ঞানতা। সুতরাং এই দিকের বিচারে তাকে অসুর বলা যায়। কারণ, অজ্ঞানতার মতো মানুষের অনিষ্টকারক এমন আর কোনও শত্রু নেই, যা মানুষকে দেবত্ব বা দেবভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু অনেক স্থলে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে বৃত্র শব্দের সাথে অনেক উপাখ্যান সংযোজিত রয়েছে। এখানে অবশ্য এমন কোনও উপাখ্যানের সমাবেশ করেননি। তথাপি একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– তিনি কম্পক বৃত্রের মস্তক শতপর্ব বীর্যশালী বজ্রের দ্বারা ছেদ করেছিলেন। — অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১৩/৩– চর্ম যেমন প্রাণীকে আবরণ করে রক্ষা করে, তেমনই সর্বশক্তিমান সেই ভগবান্ যে তেজের দ্বারা দ্যাবাপৃথিবীকে আবেষ্টন করে রক্ষা করেন, সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেবের প্রসিদ্ধ সেই তেজঃ আমাদের হৃদয়কে সমুদ্ভাসিত করুক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের পরমজ্যোতিঃ হৃদয়ে ধারণ করতে সমর্থ হই)। [চর্মেব– মন্ত্রের এই একটি উপমা পদের ভাষ্যানুসারী ভাব-চর্ম যেমন কখনও বিস্তারিত হয়, কখনও বা সঙ্কোচিত হয়। কিন্তু এতে মন্ত্রার্থের কি সম্বন্ধ আছে, বোঝা যায় না। আমরা মনে করি, চর্মের স্বাভাবিক শক্তিই এখানকার উপমার লক্ষ্য– আবরণ। চর্ম যেমন শরীরকে আবৃত করে রেখে মানুষকে রক্ষা করে, ভগবানের শক্তিও তেমনইভাবে বিশ্বকে আবৃত করে রক্ষা করছে]।

১৪/১– পরমধনদায়ক, পরমরমণীয়, শ্রেষ্ঠনেতৃস্থানীয় পরাজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন সৎপথ-প্রদর্শন পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [আমরা এই মন্ত্রের প্রার্থনামূলক ভাব অধ্যাহার করেছি। সূনরী পদের অর্থ– শ্রেষ্ঠপথপ্রদর্শক। একমাত্র জ্ঞানই আমাদের শ্রেষ্ঠমার্গ প্রদর্শন করতে পারে। সেই পরমজ্ঞান হৃদয়ে আবির্ভূত হোক– এটাই মন্ত্রাংশের মর্মার্থ]।

১৪/২– নিত্য অপরিবর্তনীয় অভীষ্টবর্ষক হে দেব! আপনি আমাদের হৃদয়-নিহিত কল্যাণদায়ক মোক্ষপ্রাপক ভক্তি-জ্ঞানের অভিমুখে আগমন করুন, অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত হোন; সেই ভক্তিজ্ঞান আপনাকে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -ভক্তিজ্ঞান সাধনের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [ভগবান স্বরূপ অর্থাৎ নিত্য অপরিবর্তনীয়। তাঁর আদি নেই, অন্ত নেই। তাঁর পরিবর্তন নেই। তিনি যা ছিলেন, তা-ই আছে, অনন্তকাল তা-ই থাকবেন। জগতের এই বিবর্তন, আপাতঃপ্রতীয়মান পরিবর্তন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। — ভাষ্য ইত্যাদিতে অশ্বের উল্লেখ আছে; যথা- একটি ভাষ্যানুসারী হিন্দী অনুবাদ, হে নিত্য এক সমানরূপওয়ালে অভীষ্টফলদাতা ইন্দ্র! কল্যাণরূপ ইন রথমে জোড়েহুয়ে সর্তয়ারোকে যোগ্য ঘোড়কে দ্বারা হমারে যজ্ঞমে শীঘ্র আইয়ে। এ্যয়সে যহ ঘোড়ে আপকো ভলে প্রকারে সেবা করতে হ্যায়। কিন্তু আমরা মন্ত্রের মধ্যে কোথাও ঘোড়ার সন্ধান পাইনি]।

১৪/৩– উভয় হস্তের দ্বারা অর্থাৎ প্রভূতপরিমাণে পরমধন প্রদানকারী ভগবান্ অমৃতের মধ্যে বিদ্যমান আছেন অর্থাৎ তিনি অমৃতস্বরূপ হন। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা ভগবৎ-দত্ত পরমকল্যাণ ধারণ করো– লাভ করো। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, এ গু, ভগবানই অমৃতস্বরূপ হন; আমরা যেন তার কৃপায় পরমকল্যাণ লাভ করতে উদ্বুদ্ধ হই)। [মন্ত্রটি দুভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে ভগবানের মাহাত্ম্য পরিকীর্তিত হয়েছে। তিনি অমৃতস্বরূপ। আপস্য পদের ভাষ্যার্থ– রসস্য। ওর একটি হিন্দী অর্থ– সোমরসকে অর্থাৎ সোমরসের। কিন্তু আপশব্দে যে সোমরসকে লক্ষ্য করে, তার দৃষ্টান্ত আমরা এই প্রথম পেলাম। এখানে সোমরসের কোন সম্পর্ক নেই। ব্যাখ্যাকার অনর্থক সোমরসের প্রসঙ্গ এনে মন্ত্রের অর্থব্যত্যয় ঘটিয়েছেন মাত্র। আপস্য পদের সোমার্থ গ্রহণ করলে, আপস্য মধ্যে তিষ্ঠতি মন্ত্রাংশের অর্থ দাঁড়ায়– সোমরসের মধ্যে বর্তমান আছেন। মন্ত্রাংশটি যে ভগবানের উদ্দেশে উচ্চারিত, ভাষ্যকারও তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু ভগবান সোমরসের মধ্যে বর্তমান আছেন– এ তো একমাত্র সোমরস পানে উন্মত্ত ব্যক্তির চিন্তাতেই আসা সম্ভব। আমরা মনে করি, আপ শব্দে অমৃত বোঝায় এবং এই অর্থ বর্তমান স্থলেও সঙ্গত ভাবই প্রকাশ করে। ভগবান্ অমৃতস্বরূপ, অমৃতেই তিনি বাস করেন-এটাই মন্ত্রাংশের ভাবার্থ। দশতিঃ শৃঙ্গোভিঃ পদ দুটির ভাব তিনি দুই হাতে পরমধন বিতরণ করেন প্রভূতপরিমাণে দান করেন। ….মানুষের চিত্ত ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট করবার জন্য, ব্যাধিবিপত্তিনিগৃহীত জনগণকে যন্ত্রণার হাত থেকে পরিত্রাণ করবার জন্য, সন্তাপ-নিবারক ভগবানের এই করুণার বিকাশ। যুগে যুগে অবতার রূপ গ্রহণ করে তিনি জগত্বাসীকে যে স্নেহালিঙ্গন প্রদান করেছেন, এখানে সেই ভাবই প্রাপ্ত হই। ……ফলতঃ, এখানে প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে, আমাদের সৎকর্মসমুদ্ভুত সৎ-ভাবের সাথে ভগবান্। মিলিত হোন। সৎকর্ম-সাধনে ভগবান্ তুষ্ট হয়ে, আমাকে ক্রোড়ে নেবার জন্য নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবেন। ভক্তিসহকারে যেমন উপকরণেই তাঁর অর্চনা করি না কেন, তাই তিনি গ্রহণ করবেন। মন্ত্রের শেষ অংশে ভগবৎ-দত্ত কল্যাণলাভের উপযোগিতা প্রাপ্তির জন্য আত্ম-উদ্বোধন আছে]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নামবারবন্তীয়োত্তর। এই সামমন্ত্র অন্য কোন বেদে পরিদৃষ্ট হয় না]।

সপ্তদশ অধ্যায় সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী