উত্তরার্চিক — চতুর্থ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্তানুসারে)– ১-৪/৯/১০/১৪-১৬ পবমান সোম; : ৫/১৭ অগ্নি; ৬ মিত্র ও বরুণ; ৭ মরুৎগণ ও ইন্দ্র, ৮ ইন্দ্রাগ্নী; ১১-১৩/১৮/১৯ ইন্দ্র।
ছন্দ– ১-৮/১৪ গায়ত্রী; ৯ (৩) দ্বিপদা বিরাট; ১০ ত্রিষ্ঠুভ; ৯ (১, ২)/১১-১৩ বার্হত প্রগাথ; ১২ বৃহতী; ১৫/১৯ অনুষ্ঠুভ; ১৬ জগতী; ১৭ (১) বিষমা ককুভ; (২) সমা সতোবৃহতী; ১৮ উষ্ণিক। ঋষি—১ জমদগ্নি ভার্গব; ২ ভৃগু বারুণি বা জমদগ্নি ভার্গব; ৩ কবি ভার্গব; ৪ কশ্যপ মারীচ; ৫ মেধাতিথি কাণ্ব; /৭ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র; ৮ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য; ৯ সপ্ত ঋষি (১ম অধ্যায় দ্রষ্টব্য); ১০ পরাশর শাক্ত্য; ১১ পুরুহম্মা আঙ্গিরস; ১২ মেধ্যাতিথি কাণ্ব; ১৩ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ১৪ ত্ৰিত আপ্তা; ১৫ যযাতি নাহুষ; ১৬ পবিত্র আঙ্গিরস; ১৭ সৌভরি কাণ্ব; ১৮ গোযুক্তি ও অশ্বসূক্তি কাণ্বায়ন; ১৯ তিরশ্চী আঙ্গিরস।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– এতে অগ্রমিন্দবস্তিরঃ পবিত্ৰমাশবঃ। বিশ্বান্যভি সৌভগা৷৷ ১৷ বিঘ্নস্তো দুরিতা পুরু সুগা তোকায় বাজিনঃ। অনা কৃন্তো অবতঃ৷৷ ২৷৷ কৃম্বন্তো বরিবো গবেহভ্যর্ষন্তি সুষ্ঠুতি ইডামস্মভ্যং সংযতম্৷ ৩৷৷

সূক্ত ২– রাজা মেধাভিরীয়তে পবমাননা মনাবধি। অন্তরিক্ষেণ যাবে৷৷ ১। আ নঃ সোম সহো জুবো রুপং ন বসে ভর। সুষণো দেববীতয়েঃ৷ ২৷৷ আ ন ইন্দো শাতথিনং গবাং পোষং স্বশ্বাম্। বহা ভগত্তিমূতয়ে৷ ৩৷৷

সূক্ত ৩– তং ত্বা নৃানি বিভ্রতং সবষু মহো দিবঃ চারুং সুকৃত্যয়েমহে৷৷৷৷ সবৃক্তধৃষ্ণুমুকথ্যং মহামহিব্রতং মদম্। শতং পুরো রুরুণিম্। ২৷৷ অতস্তা রয়িরভ্যাজানং সুক্ৰততা দিবঃ। সুপর্ণো অব্যথী ভরৎ৷৷ ৩৷৷ অধা হিনান ইন্দ্রিয়ং জ্যায়ো মহিমত্বমানশে। অভিষ্টিকৃদ বিচৰ্ষণিঃ। ৪বিশ্বম্মা ইৎ স্বদৃশে সাধারণং রজস্তুরম্। গোপামৃতস্য বির্ভরৎ। ৫৷৷

সূক্ত ৪– ইষে পবস্ব ধারয়া মৃজ্যমাননা মনীষিভিঃ। ইন্দো রুচাভি গা ইহি৷৷ ১৷৷ পুনানো বরিবস্কৃধৰ্জনং জনায় গির্বণঃ। হরে সৃজন অশির৷৷ ২. পুনানো দেববীতয়ে ইন্দ্রস্য যাহি নিষ্কৃতম্। দ্যুতাননা বাজিভিহিতঃ ॥ 3

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– সর্বপরমধন শীঘ্র প্রাপ্তির জন্য, পরমধনদাতা আশুমুক্তিদায়ক সত্ত্বভাব সমূহ সাধকগণ কর্তৃক তাদের পবিত্র হৃদয়ে উৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকেরা পরমধনদাতা শুদ্ধসত্ত্বকে লাভ করেন)। [সাধকেরা তাদের হৃদয়ে মোক্ষদায়ক সত্ত্বভাব লাভ করে থাকেন। আশবঃ পদটি ইন্দবঃ পদের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। আশবঃ পদের ভাষ্যানুগত অর্থ শীঘ্রগমনকারী। কোথায় গমন করে? পবিত্রং অভি– পবিত্র হৃদয়ে। কিন্তু কিভাবে গমন করে? সাধকগণ কর্তৃক তাঁদের পবিত্র হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ সাধকগণ তাদের সাধনপ্রভাবে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন। কি জন্য উৎপাদিত হয়? পরমধন প্রাপ্তির জন্য অর্থাৎ জীবনের চরম পরিণতি স্বরূপ ভগবানের চরণ প্রাপ্তির জন্য সাধকেবা হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদন করেন। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই মানুষ মোক্ষলাভে সমর্থ হয়। মন্ত্রের মধ্যে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে।  এ আশবঃ শব্দের অর্থ শীঘ্র গমনকারী। সাধনের প্রভাবে সাধকের হৃদয়ে ত্বরায় শুদ্ধসত্ত্বের আবির্ভাবে সাধক আশুমুক্তিলাভ করতে সমর্থ হন। তাই আশবঃ পদে আশুমুক্তিদায়কাঃ অর্থই সঙ্গত। বিশেষতঃ মন্ত্রের অন্যান্য পদ এবং মন্ত্রের স্বাভাবিক ভাবও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করে। তির পদে ত্বরয়া অর্থ গৃহীত হয়েছে]।

১/২– সর্বশক্তিমান্ দেবগণ আমাদের সকল রিপুশত্রুকে সম্যকরূপে বিনাশ করুন; তারা স্বয়ংই আমাদের বংশানুক্রমে সকলকে অর্থাৎ সকল লোককে আশুমুক্তিদায়ক পরমধন দান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা সকলে যেন রিপুজয়ী; বিশ্ববাসী সকল লোক মোক্ষলাভ করুক)। [মন্ত্রটি অতি উচ্চভাব-মূলক। এই মন্ত্রের প্রার্থনার মধ্যে কেবল নিজের জন্য নয়, পরন্তু বিশ্ববাসী সকলের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে অশ্বলাভ, পুত্রলাভ প্রভৃতির জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এই সকল অতি তেজস্বী সোমরস যাবতীয় দুষ্কর্ম নষ্ট করছেন, আমাদের সন্তান সন্ততি ও অশ্ব দিতে মনস্থ করেছেন এবং আমাদের চমৎকার বস্ত্র ইত্যাদি দিচ্ছেন। ব্যাখ্যাকার বস্ত্র ইত্যাদি কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন তা বোঝ যায় না]।

১/৩– পরাজ্ঞান প্রদানের জন্য দেবগণ আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা গ্রহণ করুন; তাতে প্রীত হয়ে আমাদের শ্রেষ্ঠ পরমধন এবং মন্ত্রশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান এবং পরমধন প্রদান করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটির ভাব অন্যরূপ ধারণ করেছে– এই সকল সোমরস আমাদের জন্য এবং গোধনের জন্য চমৎকার অন্নবিধান করতে করতে আমাদের স্তুতিবাক্য গ্রহণ করেছেন। এইসব ব্যাখ্যায় গবে পদে গোধনের নিমিত্ত অর্থ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যায় পূর্বাপর জ্ঞানলাভের নিমিত্ত প্রভৃতি অর্থ সূচিত করে। ইড়া প্রভৃতি অনেকগুলি পদের ব্যাখ্যায় অন্ন অর্থ গৃহীত হয়। কিন্তু এই অন্ন শব্দে কি ভাব প্রকাশ করে, তা বোঝা দুষ্কর। বাংলা ভাষায় বর্তমানে অন্ন শব্দ যে ভাবের দ্যোতনা করে, ইড়া বাজং প্রভৃতি শব্দগুলির ব্যাখ্যায় সেই ভাবের প্রয়োগ করলে ব্যাখ্যা শুধু জটিল হয় না, সঙ্গে সঙ্গে অবোধ্য অর্থহীন হয়ে ওঠে। অনেক সময়েই এটা লক্ষ্য করা যায় যে, সংস্কৃত ব্যাখ্যার অনুকরণে অনেক বাংলা এবং হিন্দী ব্যাখ্যাতেও অন্ন শব্দ অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহৃত হয়। তাতে ব্যাখ্যার কোন সার্থকতা সম্পাদিত হয় না। ইড়া বাজং শ্ৰবঃ প্রভৃতি শব্দের নির্দিষ্ট অর্থ আছে, এবং ব্যাখ্যাকালে তা-ই ব্যবহার করা সঙ্গত। ইড়া শব্দের অর্থ শক্তি–আত্মশক্তি। এখানে, তা-ই গৃহীত হয়েছে]।

২/১– সর্বলোকাধীশ পবিত্রকারক পরমদেবতা স্তুতির দ্বারা প্রীত হয়ে সাধকদের হৃদয়কে (অথবা সাধকদের সৎকর্মকে) প্রাপ্তির জন্য দ্যুলোক হতে এসে তাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান্ প্রার্থনাপরায়ণ সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন)। [মন্ত্রটির ব্যাখ্যাকালে ভাষ্যকার অন্তরিক্ষেণ পদের ব্যাখ্যায় লিখেছেন– আকাশ মার্গেন। তার পর দ্রোণকলশং প্রতি পদ দুটি অধ্যাহার করেছেন। তাই তার অর্থ দাঁড়িয়েছে-আকাশ মার্গে দ্রোণ কলশের প্রতি (যাতবে যাবার জন্য)। অন্য একটি বাংলা ব্যাখ্যায় লিখিত হয়েছে ইনি আকাশের দিকে যাবার জন্য রাজার ন্যায় মানুষের প্রতি যাচ্ছেন। ইনি পদে ব্যাখ্যাকার সোমরসকে লক্ষ্য করেছেন, তা ব্যাখ্যার অপরাংশ থেকে বুঝতে পারা যায়। এই দুটি ব্যাখ্যায়ই একটি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। দ্রোণকলশই হোক আর মানুষই হোক, তারা সকলেই পৃথিবীর বস্তু এবং ব্যাখ্যাকাররাই বলেন যে, সোমরসও পৃথিবীতেই প্রস্তুত হতো। ভাষ্যকার বলছেন– সোমরস যখন দ্রোণকলশে যায়, ও তখন তাকে স্তুতি করা হয়। এই পৃথিবীর সোমরস, পৃথিবীরই দ্রোণকলশে যাবার জন্য আকাশ মার্গে চললেন কেন, তার কি কোন সঙ্গত কারণ পাওয়া যায়? আর তা আকাশ মার্গে যাবেই বা কিভাবে? সুতরাং প্রচলিত ব্যাখ্যার দ্বারা জটিলতা বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র। আমরা অন্তরিক্ষেণ পদে বিভক্তিব্যত্যয় স্বীকার করেছি সত্য, কিন্তু তাতে মূল ভাবের কোন ব্যত্যয় হয়নি। গমনার্থক ক্রিয়াযোগে তৃতীয়া বা পঞ্চমী দুটি বিভক্তিই ব্যবহৃত হয়। মন্ত্রের অন্তর্গত মনৌ পদে মনুষ্যে, সাধকহৃদয়ে সাধকহৃদয়ং যদ্বা সৎকর্মণি, সাধকাশং সৎকর্ম অর্থাৎ সাধক ও সৎকর্ম এই দুটি অর্থ গ্রহণ করেছি। ভাষ্যকারও দুটি ব্যাখ্যা করেছেন। দুটি অর্থেই এক ভাবকে লক্ষ্য করে। সাধকের হৃদয়ে ভগবান্ আবির্ভূত হন; অথবা সাধকের সর্মরূপ পূজাকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ পূজা গ্রহণ করেন, এই দুটি ব্যাখ্যা এক ভাবেরই দ্যোতনা করে। ভগবান্ কৃপাপূর্বক প্রার্থনাপরায়ণ সাধকদের হৃদয়ে আগমন করেন, তাদের পূজা গ্রহণ করেন, মন্ত্রে এই ভাবই সূচিত হয়েছে]।

২/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধ আপনি আমাদের দেবত্ব প্রাপ্তির (অথবা ভগবৎপ্রাপ্তির) জন্য দিব্যজ্যোতিঃ, এবং দিব্যজ্যোতিঃলাভের জন্য রিপুজয়কারক শত্রুনাশক শক্তি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনার কৃপায় আমরা যেন রিপুনাশক। দিব্যজ্যোতিঃ লাভ করতে পারি)। [রিপুগণ মোক্ষার্থীকে পদে পদে বাধা প্রদান করে এবং দুর্বল সাধককে অচিরাৎ অধঃপতনের পথে টেনে নেয়। তাই এই রিপুদের পরাজয় করবার উপযুক্ত শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন। সেই জন্যই প্রথমে রিপুজয় করবার উপযুক্ত শক্তি লাভের জন্য ভগবানের চরণে প্রার্থনা করা হয়েছে। এই রিপুজয়ের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় থেকে পাপ মোহ-কালিমা দূরীভূত হয়, হৃদয় দিব্যজ্যোতিতে পরিপূর্ণ হয়। সেই জ্যোতিঃই মানুষকে মোক্ষমার্গের আবরক অন্তরায়। অজ্ঞানতার অন্ধতমসা দূর করে দেয়। পরিশেষে– ই মানুষকে ভগবানের চরণে পৌঁছে দেয়। তাই এই মন্ত্রে শক্তি ও জ্যোতিঃলাভের প্রার্থনার ভিতর দিয়ে ভগবানের চরণপ্রাপ্তির প্রার্থনাই স্পষ্টীকৃত হয়েছে]।

২/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পাপকবল হতে রক্ষা পাবার (অথবা উদ্ধার করবার জন্য আমাদের প্রভূতপরিমাণ. জ্ঞান, আত্মশক্তি এবং প্রাজ্ঞানযুক্ত পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; প্রার্থনার ভাব এই যে, -কৃপাপূর্বক ভগবান্ আমাদের পরমধন পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [প্রার্থনামূলক বেদমন্ত্রগুলির মূলভাব– পারমার্থিক পরমধন প্রাপ্তি। …বিভিন্ন স্তরের মানুষ তথা সাধক বিভিন্নভাবে নিজের চিন্তাধারা প্রকাশ করেন বটে, কিন্তু তাদের সকলেরই চরম লক্ষ্য এক। সেই লক্ষ্য মোক্ষ। সুতরাং এই এক ভাব প্রকাশের জন্যই বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। বাহ্য দৃষ্টিতে তা পুনরুক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু মন্ত্রের ভাব হৃদয়ঙ্গম করলে, বেদমন্ত্রের গুঢ়-অর্থে প্রবেশ করলে বুঝতে পারা যায় যে, ঐ পুনরুক্তি প্রার্থনার ঐকান্তিকতাই পরিব্যক্ত করছে। অনেক স্থলে আবার আপাতঃ প্রতীয়মান পুনরুক্তি সাধনার বিভিন্ন স্তর নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান মন্ত্রটিকে গ্রহণ করা যাক। এখানেও প্রার্থনার উদ্দেশ্য মুক্তিলাভ। সেই মুক্তি লাভের উপায় স্বরূপ পরাজ্ঞান আত্মশক্তি প্রভৃতি লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রত্যেকটিই মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারে। অধিকন্তু, এরা দেবদূত, — পরস্পর পরস্পরের সাথে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। এদের একটির উপস্থিতিতে অন্যগুলির উপস্থিতিও অনুমান করা যায়। সুতরাং বর্তমান মন্ত্রে এতগুলি উপায়ের জন্য বিশিষ্টভাবে প্রার্থনা করায়, প্রার্থনার দৃঢ়তা ও ঐকান্তিক প্রকাশ পাচ্ছে। এই মন্ত্রটির শাতথিনং পদে বিবরণকারের অনুসরণে শতসংখ্যাতংঅর্থের সঙ্গত প্রভূতপরিমাণ প্রতিবাক্য গৃহীত হয়েছে। ভাষ্যকার বলেছেন শতসহস্ৰসংখক। ভাষ্যকার উতয়ে পদের ব্যাখ্যা প্রদান করেননি; তাতে মন্ত্রের মূলভাবই নষ্ট হয়েছে বলে মনে করি]।

৩/১– হে ভগবন। স্বলোকে স্থিত পরমধনদাতা মঙ্গলময় মুক্তিদায়ক আপনাকে আমরা যেন সৎকর্ম সাধনের দ্বারা আরাধনা করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্ম সমন্বিত এবং ভগবৎপরায়ণ হই)। [ভগবানের চরণে তাকেই আরাধনা করবার শক্তিলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। …এখানে প্রশ্ন হতে পারে– তবে কি মানুষের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে ভগবানেরই দয়ার উপর নির্ভর করে? তার পূজা করবার স্বাধীন অধিকারও কি মানুষের নেই? হ্যাঁ, মানুষ সম্পূর্ণভাবেই তার দয়ার উপরে নির্ভর করে। মানুষের আপেক্ষিক স্বাধীনতাও তারই দান। আবার, এই আপেক্ষিক স্বাধীনতার জন্যই মানুষের উন্নতি-অবনতি আছে, পাপ-পুণ্য আছে। সেইজন্যই মানুষ যন্ত্রমাত্র নয়, মানুষ মানুষ। এই স্বাধীনতার দৌলতেই মানুষ প্রার্থনা করতে পারে, কিছু পরিমাণে নিজের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই ভগবৎপরায়ণ হবার জন্য, নিজেকে মোক্ষপথে পরিচালনে শক্তিলাভের জন্য মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। ভাষ্যকার প্রভৃতি এই মন্ত্রের মধ্যেও সোমরসের কল্পনা করেছেন]।

৩/২– হে দেব! রিপুনাশক সর্বলোকের পূজনীয় মহামহিমান্বিত পরমানন্দদায়ক অসৎবৃত্তি নাশকারী আপনাকে আমরা যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই)। [এই মন্ত্রটিও পূর্বৰ্মন্ত্রের অনুরূপ। উভয় মন্ত্রের মধ্য দিয়েই একই সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই প্রার্থনার মধ্যে প্রসঙ্গতঃ ভগবানের মহিমাও পরিকীর্তিত হয়েছে। ধৃষ্ণু অর্থাৎ ধর্ষণশীল, ভয়ঙ্কর শত্রুদের যিনি বিনাশ করতে পারেন তিনিই, সংবৃক্তধৃষ্ণু। মহামহিব্রতং– মহামহিমান্বিত তিনি তাঁর মহিমায় জগৎ মহিমান্বিত– তার জ্যোতিঃতে বিশ্ব জ্যোতিষ্ম। শতং পুরো পদ দুটির প্রচলিত ব্যাখ্যা ও ভাষ্যকে অনুসরণ করে যে ভাব পাওয়া যায়, তাকে লক্ষ্য করেই আমরা মানুষের অন্তরস্থিত অসংখ্য অসৎ-বৃত্তি অর্থই গ্রহণ করেছি]।

৩/৩– শোভনকর্মা, মোক্ষদায়ক হে দেব! রিপুজয়ী অথবা ত্রিগুণ-সাম্য-অবস্থা প্রাপ্ত উধ্বগতিসম্পন্ন। সাধক পরমজ্যোতির্ময় আপনাকে প্রাপ্ত হন; আপনি স্বলোক হতে পরমধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [সুতো পদে শোভনকর্ম-মোক্ষদায়ক অর্থ গৃহীত হয়েছে। ভগবানের নিজের কি কর্ম থাকতে পারে যে, তা শোভন অথবা অশোভন হবে? তাঁর নিজের কোন কর্ম নেই সত্য, কিন্তু তার সন্তানদের জন্য তিনি কর্ম করেন– তাদের মুক্তিবিধান করেন। এর চেয়ে শোভনকর্ম কি হতে পারে? এই লোকহিতকর্মকেই লক্ষ্য করে তাই আমরা ঐ পদে মোক্ষদায়ক অর্থ গ্রহণ করেছি। অব্যথী পদের অর্থ ব্যথারহিত। যার কোন রকম দুঃখ নেই, যিনি ত্রিবিধং দুঃখং হেয়ঃ থেকে মুক্ত, তিনিই অব্যথী। দুঃখের মূল কারণ– কামনা বাসনা প্রভৃতি রিপুগণ। যিনি রিপুজয় করতে সমর্থ তিনি দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারেন। ভারতীয় দর্শন এই দুঃখনাশের উপায় নির্ধারণ করবার জন্য সৃষ্ট হয়েছে। প্রত্যেকেরই চরম কথা, — আত্মস্থ হও, প্রকৃতির উপরে যাও, স্বরূপ-জ্ঞান লাভ করো, ॥– দুঃখের অবসান হবে– অব্যথী হবে। বর্তমান মন্ত্রে সেই পরম-সাধককেই নির্দেশ করছে। রাজানং পদ দীপ্তার্থক রাজ ধাতু নিষ্পন্ন। তাই ঐ পদে পরমজ্যোতির্ময় অর্থ গৃহীত হয়েছে]।

৩/৪– সর্বজ্ঞ (অথবা আত্মোৎকর্ষদায়ক) সাধকদের অভীষ্টদায়ক ভগবান সাধকদের শ্রেষ্ঠ সকৰ্মসামর্থ্য এবং জ্ঞান ও আত্ম-উৎকর্ষ প্রদান করে তাদের প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানই কৃপাপূর্বক সাধকদের মোক্ষ বিধান করেন)। [ভগবান্ যদি দয়া না করেন, তবে মানুষের কি সাধ্য যে, তাকে নিজের হৃদয়ে বসাবার জন্য আহ্বান করতে পারে? মানুষের মনে যে চিরন্তন সত্য সাড়া দেয়, তা-ই আমরা বেদমন্ত্রের মধ্যে বিকশিত হতে দেখতে পাই। — প্রচলিত ব্যাখ্যার ভাব– তিনি মহত্ত্ব লাভ করেন। কিন্তু তিনি তো নিজেই মহত্ত্বের আধার, তিনি আবার মহত্ত্ব লাভ করবেন কি? সাধকদের– তাঁর সন্তানগণকে, তিনি মহত্ত্ব আত্ম-উৎকর্ষ প্রদান করেন– এটাই সঙ্গত অর্থ। তাই আমাদের মন্ত্রার্থে মহিত্বংপদকে হিদানঃপদের কর্মরূপে গৃহীত হয়েছে। ইন্দ্রিয়ং পদে ইন্দ্রিয়সাধ্য জ্ঞান কর্ম ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে, তাই ঐ পদে সৎকর্মসামর্থং জ্ঞানঞ্চ অর্থই সঙ্গতভাবে গৃহীত হয়েছে]।

৩/৫– সাধক অমৃতদায়ক, সত্যের (অথবা সৎকর্মের) রক্ষক, সকল দেবভাব প্রাপ্তির অর্থাৎ ভগবৎপ্রাপ্তির উপায়ভূত, আকাঙক্ষণীয় পরাজ্ঞান প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকগণ দেবত্বপ্রাপক পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [পূর্বের মন্ত্রে ভগবানের মহিমা ও মানুষের প্রতি তাঁর অসীম দয়ার বিষয় কীর্তিত হয়েছে। বর্তমান মন্ত্রে সাধকের সৌভাগ্যের বিষয় বিবৃত হচ্ছে। ভগবান্ যেমন মানুষের দিকে অগ্রসর হন, সৌভাগ্যসম্পন্ন সাধকও তেমনি নিজের সাধনবলে ভগবানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ভগবানকে প্রাপ্তির উপায়-পরাজ্ঞান। সত্যং জ্ঞানং সেই পরম দেবতাকে লাভ করতে হলে তার শক্তিস্বরূপ পরাজ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করা চাই। সাধক সেই পরাজ্ঞান লাভ করে ভগবৎপদ প্রাপ্ত হন-মন্ত্রে এই সত্যই প্রখ্যাপিত হয়েছে]।

৪/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! সাধকদের সৎকর্মের দ্বারা বিশুদ্ধ তুমি আমাদের শক্তিদান করবার জন্য ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও; এবং জ্যোতিঃর সাথে জ্ঞানকিরণসমূহ আমাদের প্রাপ্ত করাও। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই)। [হীরক ইত্যাদি মহামূল্য মণি অপরিষ্কৃত অবস্থায় খনির মধ্যে থাকে। খনি থেকে উত্তোলন করে নানা প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিষ্কৃত করলে, তা ব্যবহারযোগ্য হয়। আমাদের হৃদয়ের মধ্যেও এমন বহুমূল্য রত্নরাজি আছে। সেই সমস্তকেও সৎকর্ম প্রভৃতির দ্বারা আমাদের লক্ষ্যসাধনের উপযোগী করা যায়। সত্ত্বভাব জগৎকে ধারণ করে আছে। ওটি সর্বত্রই বিদ্যমান। কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য সৎকর্মের সাধনের দ্বারা তা বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। সাধকের নিজের হৃদয়ও বিশুদ্ধ হওয়া চাই। সাধকেরা সাধনপ্রভাবে তাদের অন্তর্নিহিত সত্ত্বভাবকে বিশুদ্ধ করেন। জ্ঞান ও সৎকর্মসমন্বিত এই শুদ্ধসত্ত্বই মানুষকে মোক্ষপ্রদানে সমর্থ। মনীষিভিঃ মৃজ্যমাননা পদ দুটিতে এই শুদ্ধসত্ত্বকেই লক্ষ্য করা হয়েছে এবং এই মন্ত্রে সেই শুদ্ধসত্ত্ব লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৪দ-৯সা) প্রাপ্তব্য]।

৪/২– পরম আরাধনীয় পাপহারক আপনি আমাকে আত্মশক্তি এবং পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের আত্মশক্তিযুত পরমধন প্রদান করুন)। [মন্ত্রটিকে প্রার্থনামূলক বলে গ্রহণ করলেও প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব পরিবর্তিত তা হয়েছে। ভাষ্যকার এবং প্রচলিত ব্যাখ্যাকারগণ মন্ত্রের ব্যাখ্যায় সোমরসের প্রসঙ্গ আনয়ন করেছেন, এ যেন সোমরসকেই লক্ষ্য করে প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু এই মন্ত্রে সোম প্রসঙ্গের অবতারণা করবার কোন আবশ্যকতা আছে বলে মনে হয় না। এই মন্ত্রটিতে ভগবানের মাহাত্ম্যও কীর্তিত হয়েছে। তিনি অমৃত প্রদান করেন। তার কৃপাতেই মানুষ অমৃতত্ব প্রাপ্ত হয়। তার কৃপাদৃষ্টিতেই মানুষের চিত্ত নির্মল হয়, পবিত্র হয়– তাই তিনি পবিত্রকারক। সেই পরমদেবতার কাছে আত্মশক্তি ও পরমধন প্রাপ্তির জন্যই এই প্রার্থনা। — মন্ত্ৰান্তৰ্গত হরে পদে আমরা পাপহারক অর্থ গ্রহণ করেছি। ভাষ্যকারও কোন কোন স্থলে ঐ অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রে সোমরসের প্রসঙ্গ আনয়ন করে হরে পদে হরিত্বর্ণ অর্থ গ্রহণ করেছেন]।

৪/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আত্মশক্তিশালী সাধকদের দ্বারা জ্যোতির্ময়, পবিত্রকারক পরম মঙ্গলদায়ক আপনি সেই সাধকদের ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের চরণাশ্রয় প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের পরম পদ প্রাপ্ত করায়)। [প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলি মন্ত্রটিকে নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক বলে গ্রহণ করলেও তাতে ভাবের কিছু অসামঞ্জস্য আছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তোমার মূর্তি দীপ্তিশীল। বলশালী যজ্ঞকর্তা ব্যক্তিগণ তোমাকে সংগ্রহ করেছেন, যজ্ঞের জন্য তোমার শোধন হচ্ছে, তুমি এখন ইন্দ্রের নিকট যাও। দেববীতয়ে পদে যজ্ঞের জন্য অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ঐ পদে দেবকামায় ভগবৎ প্রাপ্তয়ে প্রভৃতি অর্থের সঙ্গতি লক্ষ্য করি। সত্ত্বভাব ভগবৎপ্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ উপায়। সত্ত্বভাব হৃদয়ে সমুৎপন্ন হলে মানুষ ভগবানের দিকে অগ্রসর হতে সমর্থ হয়। এটি ভগবৎ-আরাধনার শ্রেষ্ঠ সাধন অঙ্গ। তাই এখানে দেববীতয়ে পদের সার্থকতা। বাজিভিঃ পদে ভাষ্যকার যে অর্থ গ্রহণ করেছেন তাতে ভাষ্যার্থ হয়-যজমানদের সাথে তুমি ইন্দ্রের স্থানে যাও। এই ব্যাখ্যার ভাব বোঝা দুঃসাধ্য। সোমরস যজমানদের সাথে ইন্দ্রের কাছে যাবে কিভাবে? অবশ্য সোম অর্থে যদি মাদকদ্রব্য সোমরস ব্যতীত অন্য কোন উচ্চভাবমূলক বস্তু নির্দেশ করে, তবেই ঐ ব্যাখ্যার সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়, এবং ভাবেরও সঙ্গতি রক্ষিত হয়]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৫– অগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে কবির্গহপতির্যবা। হব্যবাড় জুহস্যঃ ১। যামগ্নে হবিস্পতিতং দেব সপতি। তস্য স্ম প্রাবিতা ভব৷৷ ২৷৷ যো অগ্নিং দেববীতয়ে হবিগ্ম আবিবসতি। তস্মৈ পাবক মৃড়য়৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৬– মিত্রং হুবে পূতদক্ষং বরুণং চ রিশাদসম। ধিয়ং ঘৃতাচীং সাধা৷৷ ১৷৷ ঋতেন মিত্রাবরুণাবৃতাবৃধাবৃতস্পশা। তুং বৃহত্তমাশাথে৷৷ ২৷৷ কবী নো মিত্রাবরুণা তুবিজাতা উরুক্ষয়া। দক্ষং দধাতে অপসম্৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৭– ইন্দ্ৰেন সং হি দৃক্ষসে সংজগমাননা অবি্যুষা। মন্দু সমানবচসা৷ ১৷৷ আদহ স্বধামনু পুনর্গৰ্ভত্বমেরিরে। দধানা নাম যজ্ঞিয়৷৷ ২৷৷ বীলু চিদারুজতুভিগুহা চিদি বহ্নিভিঃ। অবিন্দ উসিয়া অনু৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৮– তা হুবে যয়োরিদং পরে বিশ্বং পুরা কৃতম্। ইন্দ্রাগ্নীন মতঃ ৷৷ ১৷৷ উগ্রা বিঘনিনা মৃধ ইন্দ্রাগ্নী হবামহে। তা নো মৃড়াত ঈদৃশে৷ ২. হথো ৰূত্রাণ্যার‍্যা হথো দাসানি সৎপতী। হথা বিশ্বা অপ দ্বিষঃ ৷৷ ৩৷৷

মর্মার্থ— ৫সূক্ত/১সাম– মেধাবী, কর্মকুশল, লোকসমূহের পালক বা রক্ষক, নিত্যতরুণ চিরনূতন, সত্ত্বপ্রাপক-ভগবৎসমীপে কৰ্মৰ্বাহক, প্রকাশরূপে সত্য-জ্যোতিসম্পন্ন, জ্ঞানাগ্নি (জ্ঞানদেব), জ্ঞানের দ্বারাই সম্যক্ দীপ্যমান বা পরিবৃদ্ধিপ্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, — আলোকের সাহায্যে যেমন আলোক প্রকাশ পায়, জ্ঞানই তেমন জ্ঞানের প্রকাশক হন)। [উৎপত্তিস্থান বিভিন্ন হতে পারে; উৎপত্তির হেতুভূত নামেরও বিভিন্নতা ঘটতে পারে; কিন্তু বস্তু সেই একই থাকে। জলবৃষ্টিরূপেও জল, কূপ থেকে উত্তোলিত হলেও জল, ঝরণা থেকে প্রাপ্ত হলেও জল, সমুদ্র-নদী-পুষ্করিণী থেকে। নীত হলেও জল। অগ্নি সম্বন্ধেও সেই একই উক্তি প্রযুক্ত হতে পারে। স্বরূপতঃ সর্বত্র অগ্নি অভিন্ন, ঐ মন্ত্র তারই আভাস দিলেন। অগ্নিদেবের আর আর যে বিশেষণ, তার সবগুলির বেশী আলোচনা বাহুল্য মাত্র। যজ্ঞে হবিঃ প্রদানের পাত্র থেকে জুহাস্যঃ নামের উৎপত্তি বিষয়ে সায়ণ যা বলেছেন, তা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু বস্তূপক্ষে সর্বত্র যখন সেই একই লক্ষ্য রয়েছে, তখন আর সে বিতর্কে। অবিশ্বাসীর হৃদয়ে সংশয়ের ভাব দৃঢ় করার কি সার্থকতা আছে? ফলতঃ যদি অগ্নিদেবের কৃপা লাভ করতে চাও, তার মতো গুণসম্পন্ন হতে চেষ্টা করো। হও– মেধাবী হওকর্মকুশল, হও–উৎসাহসম্পন্ন। আর হও হব্যবাটু ও জুহাস্য, অর্থাৎ দানে মুক্তহস্ত হও এবং মুখে সত্যের জ্যোতিঃ এক বিচ্ছুরিত হোক। তাহলেই বুঝবে, — জ্ঞানাগ্নির অভিন্নতা সর্বত্র, পার্থক্য কোথাও নেই]।

৫/২– দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুত হে জ্ঞানদেব! ভগবানের উদ্দেশে সৎকর্মানুষ্ঠায়ী (হবিঃ দানকারী) যে জন ভগবানে মিলনসাধক সেই আপনাকে (জ্ঞানদেবতাকে সেবা করেন, আপনি সেই। সুকর্মকারীর প্রকৃষ্ট রক্ষক হন। (ভাব এই যে, জ্ঞানের আরাধনায় এবং অনুসরণে সকর্মাপর হয়ে মানুষ শ্রেয়ঃ-সকল লাভ করে)। [হবিঃ-দানে যিনি শ্রেষ্ঠত্ব বা লাভ করেছেন, অর্থাৎ যিনি ভগবানের প্রীতিকর সৎকর্মের অনুষ্ঠান সর্বদা নিযুক্ত থাকেন, তিনিই হবিষ্পতিঃ। ভগবানের উদ্দেশ্যে যজ্ঞে অগ্নিতে আহুতি প্রদান করতে করতে সর্বস্ব-দানের সামর্থ্য আসে। তখন ভগবানকে সর্বস্ব দান ভিন্ন সাধকের পরিতৃপ্তি আসে না। তখন হৃদয়ে ত্যাগের প্রেরণা এসে সাধককে নিষ্কাম কর্মের দিকে নিয়ে যায়। সেই নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানে প্রাধান্যের বিষয় হবিস্পতিঃ শব্দে বিজ্ঞাপিত হয়েছে। — দূতং পদটি লক্ষণীয়। অগ্নিকে পুনঃ পুনঃ দূতরূপে ঘোষণা করা হচ্ছে। এর একটি নিগুঢ় তাৎপর্য আছে। এই দৃশ্যমান অগ্নি, সত্যই ইনি তো ব্রহ্ম বা ঈশ্বর নন। ইনি ভগবানের অংশ বা বিভূতি মাত্র। এঁর মধ্য দিয়ে, এঁকে উপলক্ষ্য করে, ইনি যাঁর অঙ্গীভূত, এঁতে যাঁর একতম বিকাশ, তাতে পৌঁছাতে হবে। এ হিসাবে এ অগ্নি যেন মধ্যস্থ স্থানীয়। তাই দূত বলে তাকে আহ্বান করা হয়েছে। — মন্ত্রের সপতি ও প্রাবিতা পদ দুটিতে, তোমার সেবাপরায়ণ আমি, আমায় সর্বতোভাবে রক্ষা করো, — এই ভাব ব্যক্ত হচ্ছে। মানুষ একটা উদ্দেশ্য নিয়েই কর্ম করে। এখানে সেবার উদ্দেশ্য– রক্ষাপ্রাপ্ত। এটাই স্বাভাবিক। এই সকাম প্রার্থনাই নিষ্কাম অবস্থায় নিয়ে যায়]।

৫/৩– সৎকর্মকারী যেজন দেবভাবের পরিবৃদ্ধিকর জ্ঞানদেবতাকে অনুসরণ করে, জগৎপাপন হে জ্ঞানদেব! আপনি সেই সুকর্মকারীকে সুখী করেন– আনন্দ দেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমুলক। ভাব এই যে, — জ্ঞান-অনুসারী-জনগণ সদানন্দ লাভ করে থাকেন)। [এ মন্ত্রে অগ্নিদেবের নূতন বিশেষণ রয়েছে– পাবকঅর্থাৎ পিবত্রকারক। লৌকিক বা অলৌকিক দুরকম ভাবেই এ বিশেষণের সার্থকতা। উপলব্ধ হয়। কাণ্বন, অগ্নিসংযোগে ঔজ্জ্বল্য লাভ করে; সংসারের ক্লেদরাশি অগ্নির মধ্যে পড়ে ভস্মসাৎ হয়ে যায়। জ্বলন্ত অগ্নির পক্ষে উপমার মধ্যে এই যে ভাব প্রকটিত, পক্ষান্তরে আবার, অগ্নি যে পাবক, তার সেই অলৌকিকত্ব নিজের অন্তরের প্রতি লক্ষ্য করে দেখা যায়। হৃদয়ে যেই জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত হবে, অমনই কষিত কাণ্বনের দ্যুতি প্রকাশ পাবে, অর্থাৎ অজ্ঞান আঁধার দূরীভূত হবে, পাপতাপ ভস্মীভূত হয়ে যাবে। তাই সেই জ্ঞানাগ্নির নাম– পাবক। যিনি হবিষ্মন, ভগবনকর্মে উৎসৃষ্টপ্রাণ, অগ্নির পাবকত্ব তাতেই বিকাশমান। জ্ঞানই এখানে অগ্নি নামের দ্যোতক]।

৬/১-পবিত্রবলযুক্ত মিত্রদেবকে এবং হিংস্রকশনাশক বরুণদেবকে আহ্বান করছি। সেই দেবদ্বয় আমাদের সত্ত্বভাবান্বিতা বিশুদ্ধা বুদ্ধিকে প্রেরণ করে থাকেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, সত্ত্বভাবান্বিত বুদ্ধি প্রাপ্তির জন্য শত্রুনাশক পবিত্ৰবল দেবদ্বয়কে আমি প্রার্থনা করছি)। [এই মন্ত্রে বৈজ্ঞানিক দেখবেন, কিভাবে মিত্রের (সূর্যের) খরকরতাপে জল থেকে বাষ্প উত্থিত হয়ে আকাশে মেঘরূপে সঞ্চিত হচ্ছে; আর কিভাবে সেই মেঘ থেকে বারিবর্ষণ হয়ে পৃথিবীর উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করছে। লৌকিক হিসাবে, বরুণদেব ও সূর্যদেব উভয়ের সহযোগে বর্ষণক্রিয়া সমাহিত হয়। যজ্ঞ ইত্যাদির দ্বারা, হবিঃ ইত্যাদি আহুতি প্রদানে তারা পরিতুষ্ট হন (অর্থাৎ মেঘের সঞ্চার হয়); আর তাঁদের প্রসাদে (মেঘের সঞ্চারে) যথাসময়ে সুবর্ষণ সুকর্ষণ ক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়। ধরণী শস্যশ্যামলা হয়। সুশস্যের প্রভাবে সুপ্রজাদের উদ্ভব ঘটে; তাতে জনসমাজ শান্তিসুখে কালযাপন করে। এ মন্ত্রের অন্য অর্থ– আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ভক্তিমূলক। মন্ত্রে বলা হচ্ছে, — হে মিত্রদেব! হে বরুণদেব! আপানারা পবিত্র বলশালী এবং হিংস্রস্বভাব শত্রুদের বিনাশকারী। আপনাদের অনুগ্রহে আমরা যেন ও সেইরকম কর্মের অনুষ্ঠান করতে পারি, যাতে অন্তরের শত্রু (অজ্ঞানতা, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি) বিনাশপ্রাপ্ত হয় এবং হৃদয় ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে ওঠে। আর আমরা যেন অনুক্ষণ আপনাদের অনুধ্যানে রত থাকতে পারি। এ স্থলে মিত্র (সূর্যের) জ্ঞানের সাথে এবং বরুণ ভক্তির সাথে উপমিত হয়েছেন। লৌকিক হিসাবে সূর্য যেমন বরুণের (জলের) জনয়িতা, সূর্যের রশ্মিসম্পাত ভিন্ন যেমন বারিবর্ষণ হয় না; আধ্যাত্মিক হিসাবে তেমনই জ্ঞান ভক্তির জনয়িতা, জ্ঞানের উদয় ভিন্ন হৃদয়ে ভক্তির সঞ্চার হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে মিত্র বা বরুণ সেই একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই দুই বিভূতির নাম। যে রূপে ঈশ্বর মানুষের মিত্ররূপে সহায়ক হন, তা-ই মিত্রদেব এবং যে রূপে তিনি মানুষের অভীষ্ট বর্ষণ করেন, তা-ই বরুণদেব। এখানে প্রার্থনা, সেই পরব্রহ্মের চরণেই উপনীত হবার প্রার্থনা। — ভগবানের বিভূতিধারী দেবগণ আমাদের সেই সামর্থ্য প্রদান করুন, যেন আমাদের শক্তি যথার্থরূপে সেই একতম সত্যের উদ্দেশে নিয়োজিত হয়, — যেন আমরা শ্রেষ্ঠ শক্তিবলে হিংস্রস্বভাব রিপুদের বিনষ্ট করতে পারি। তাদের প্রসাদে রিপুনাশ হলে, তাদের কৃপায় হৃদয় নির্মল হলে, চিত্তক্ষেত্রে তিনি (সেই পরব্রহ্ম) উদ্ভাসিত হবেন, তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে সমর্থ হবো। তার স্বরূপ উপলব্ধি করলে, তাকে হৃদয়-সিংহাসনে বসাতে পারলে, তার পূজায় নিমগ্ন থাকলে, তবে তো জীবন সার্থক হবে। তাই ডাকি, এস দেব! মিত্ররূপে অন্তরে জ্ঞানবহ্নি প্রজ্বলিত করো; তাই ডাকি, এস দেব! বরুণরূপে হৃদয়ের অশান্তি অনল নির্বাপিত করে। ফলে, হৃদয়ে ভক্তির অনন্ত প্রস্রবণ প্রবাহিত হোক। তোমার দাসানুদাস রূপে তোমার সেবায় আত্মনিয়োগ করে তোমাতেই বিলীন হই]।

৬/২– হে ঋতাবৃধ (জলবৃদ্ধিকারী অর্থাৎ শস্য উৎপাদনে সহায়ক অথবা সত্যের বা যজ্ঞের পালক) ঋতস্পৃশ (অর্থাৎ সংসার স্নিগ্ধকারী সলিলের সাথে সংশ্রব-বিশিষ্ট, অথবা সত্যের বা যজ্ঞের সাথে বিদ্যমান)। মিত্র ও বরুণ দেবদ্বয়! আমাদের এই অঙ্গোপাঙ্গসমন্বিত বৃহৎ যজ্ঞে (সকল রকম কর্মে) অবশ্যম্ভাবী ফলের সাথে আপনারা পরিব্যাপ্ত (বিদ্যমান) আছেন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবদ্বয়! আপনারা আমাদের সকল কর্ম ব্যেপে বিদ্যমান্ হোন)। [মন্ত্রে মিত্র ও বরুণ দেবতাকে ঋতাবৃধৌ ও ঋতস্পৃশৌ — এই গুণবিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে। সাধারণভাবে ঋত শব্দে জলঅর্থ উপলব্ধ হয়। এর আর এক অর্থ সত্য। ঋতশব্দে আর বোঝায়– সত্যধর্ম। কিন্তু এখানে প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, জলের জন্য আকুল মানুষ বরুণদেবকে ঋতাবৃধ বা, জলাধিপতি বুঝে তার কাছে বারিবর্ষণের প্রার্থনা করে। কিন্তু একটু উচ্চস্তরের মানুষ যাঁরা, তাঁরা দেখেন– তিনি কেবল এই সাধারণ জলের অধিপতি নন; তিনি যে শান্তিদাতা স্নিগ্ধতা-প্রদানকর্তা। সুতরাং সংসারের জ্বালামালায় যার অন্তর জ্বলছে, সে তাকে শান্তিদাতা জেনে তার কাছে শান্তির প্রার্থনা করে। তাদের কাছেও তিনি ঋতাবৃধৌ। আবার আরও একটু উচ্চস্তরের সাধক-সংসারের দৃঢ়গণ্ডী অতিক্রম করে যিনি কিছুটা উধ্বক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছেন, তিনি বুঝে থাকেন, এ মিত্র ও বরুণদেব তারই নাম মাত্র; যার নাম নেই, তার নাম; যাঁর রূপ নেই, তারই রূপের কল্পনা মাত্র। সেই সাধকের চক্ষেই প্রতিভাত হয়– ঋতাবৃধৌ সত্যস্বরূপৌ; অর্থাৎ তিনিই সৎ, তিনিই সত্যস্বরূপ। এ মিত্রদেব, এ বরুণদেব, তারই বিভূতি-বিকাশ। যিনি সৎ, যিনি সত্য, যিনি সনাতন, যিনি অক্ষয়, যিনি অনাদি, যিনি অনন্ত। সৎস্বরূপ বোধগম্য হলেই, তাকে সত্যধর্মের আশ্রয়স্থান বলে বুঝতে পারা যায়। তিনি সৎস্বরূপ, তাতেই সত্যধর্ম, তিনিই সত্যের রক্ষক, তিনিই সত্যধর্মের প্রতিপাদক, এই ভাব-প্রবাহ যখন, সাধকের চিত্তে প্রবাহিত হয়, তিনি যখন সত্যের ধারণায় সমর্থ হন, তখনই তিনি মিত্র-বরুণের স্বরূপ তত্ত্ব উপলব্ধি করেন, ঋতাবৃধৌ, ঋতস্পৃশৌ বিশেষণ দুটির চরম লক্ষ্য তখনই তার হৃদয়গত হয়। সর্বোচ্চ স্তরের সাধকেই এই ভাব প্রস্ফুটিত থাকে। ঐ শব্দ দুটি একার্থমূলক হলেও দুটিই ভিন্নার্থদ্যোতক; প্রথম শব্দে ঋতের বর্ধক বা পালক ভাব আসছে; দ্বিতীয় শব্দে ঋতের সুথে সংযোগ বা নিরত অর্থ সূচিত হচ্ছে। ক্রতু শব্দের সাধারণ অর্থ-যজ্ঞ। এই শব্দের আর অর্থ– বাঞ্ছা, ইচ্ছা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা। ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা– কিসের? সেই সত্যস্বরূপের সাথে মিলনের। ক্রতু শব্দের যে চরম অর্থ প্রজ্ঞা সেই প্রজ্ঞাসম্পন্ন জনেই তেমন আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়ে থাকে। তেমনই প্রজ্ঞাসম্পন্ন জনই স্থিতপ্রজ্ঞ নামে অভিহিত হন। যিনি স্থিতপ্রজ্ঞ, তিনি আত্মজ্ঞানসম্পন্ন। যখন অন্তরের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা, তৃষ্ণা-অভিলাষ এককালে বিসর্জিত হয়, যখন কোনও বিষয়ে কোনও কামনা বাঞ্ছা বা তৃষ্ণা আদৌ থাকে না, যখন পরমার্থ-তত্ত্বরূপ আত্ম-সম্মিলনে চিত্তের সন্তোষ জন্মে, তখনই যজ্ঞফলের সাথে তিনি ব্যাপ্ত হন। মন্ত্রের চরম লক্ষ্য সেই মিলনের অবস্থা। এ মন্ত্রের নিগূঢ়। উদ্দেশ্য– আত্ম-সম্মিলন]।

 ৬/৩– কবি (মেধাবী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন), তুবিজাত (জনহিতসাধক, অথবা আজন্ম বহুবলশালী) উরুক্ষয় (বহুজনের আশ্রয়স্থল, অথবা বহুব্যাপী) হে মিত্র ও বরুণদেব! আপনারা আমাদের সৎকর্মসম্বন্ধী জ্ঞান এবং সৎকর্মসাধন-সামর্থ্য অথবা কুশলবৃত্তি প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবদ্বয়! আমাদের সৎকর্মসম্পাদনে সামর্থ্য ও সৎ-বুদ্ধি প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রে মিত্র ও বরুণ দেবকে কবি বলে অভিহিত করা হয়েছে। কবি শব্দে প্রজ্ঞা-স্বরূপঅর্থ সূচিত হয়। কবি ব্রহ্মা;কবি– সূর্য; কবি জ্ঞানাধার। মিত্রাবরণ যখন সাধারণভাবে মানুষের আকার-বিশিষ্ট দেবতারূপে সম্পূজিত হন, তখন তার মেধাবী অর্থাৎ সাধারণ স্তরের মানুষ থেকে একটু উচ্চে প্রতিষ্ঠিত বলে কল্পিত সামান্য আয়াস-স্বীকারে তার কাছে পৌঁছাতে পারা যায়, তার কাছে উপস্থিত করার পক্ষে বেদবাক্যের এটি প্রথম প্রযত্ন। যদি মানুষ প্রথমে বুঝতে পারে, — আমার আরাধ্য দেবতা আমার চিন্তার অতীত, আমার স্তবনীয়, আমার ধ্যান-ধারণার অনায়ত্ত; তখন সে আর সেদিকে অগ্রসর হতে চায় -হতাশায় দেবারাধনায় বিমুখ হয়। এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। এক একটি মন্ত্রের মধ্যে, মন্ত্রের এক একটি শব্দের মধ্যে, সকল প্রকৃতির সকল স্তরের মানুষকে ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট করবার গূঢ় অভিপ্রায় প্রচ্ছন্ন রয়েছে দেখা যায়। ঐ কবি শব্দে যখন সাধারণ মেধাবী বা পণ্ডিতজনের স্মৃতি মনের মধ্যে উদয় হবে, তখন যাজ্ঞিকের প্রাণে তার সাথে মিলনের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটু আশার সঞ্চার হবে। এই আশায় অনুপ্রাণিত হয়ে, যাজ্ঞিক যখন যজ্ঞে প্রবৃত্ত হবেন; তখন কর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে, নিজের মিথ্যা-দর্শনের ও জ্ঞানবুদ্ধির তারতম্য অনুসারে, ভগবানের ঐশ্বর্য মহিমা উপলব্ধি করবার পক্ষে তার সামর্থ্য আসবে। তখন ক্রমশঃ, যে কবিশব্দে তাকে মেধাবী বা পণ্ডিত বলে জ্ঞান হয়েছিল, সেই শব্দেই তাকে প্রজ্ঞাস্বরূপ জ্ঞানময় বলে বুঝতে পারবেন। সকল শ্রেণীর সাধক, সকলভাবের মধ্য দিয়ে জগদীশ্বরকে বুঝতে পারবেন, যেমন এমনই লক্ষ্য করেই এক একটি মন্ত্রের এক একটি শব্দ বিন্যস্ত হয়েছে। মন্ত্রের আর একটি শব্দ তুবিজাতা (তুবিজাতৌ)। বহুজনের উপকারের জন্য যাঁর জন্ম, তিনিই তুবিজাত। অথবা জন্ম-অবধি যিনি বলশালী, তিনিই তুবিজাত। এই দুই অর্থ তার প্রতি মানুষের চিত্ত আকৃষ্ট করে। তিনি (ভগবা) বহুজনের জন্য; সুতরাং আমি যদি তাঁর শরণাপন্ন হই, আমার উপকার অবশ্যই তিনি করবেন। এই লক্ষ্যেই মানুষ ভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হতে পারে। কিন্তু তুবিজাত শব্দের নিগূঢ় অর্থ অনুধাবন করলে শেষ পর্যন্ত সাধক বুঝতে পারবেন যে, তিনি (সেই ভগবান) সাধারণের চিন্তা-ধারণার অতীত, যোগপরায়ণদের ধ্যেয় বিজ্ঞানময় পরমপুরুষ। জন্মমাত্রই বলশালী, অর্থাৎ সাধকের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হওয়ামাত্রই বলশালী, তখন সাধক তাকে জানতে পারেন। এইভাবে উরুক্ষয় শব্দও মিত্রাবরুণ দেবদ্বয়ের প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রদান করেছে। তারা বহুজনের আশ্রয়স্থল, আবার তারা বহুব্যাপী। তারাই আশ্রয়, আবার তারই আশ্রয়ভূত। তারাই ব্যাপ্ত, আবার তারাই ব্যাপক। এখানে মিত্রাবরুণ সেই সর্বমূলাধার পরমেশ্বর ভিন্ন অন্য কিছুই নন। তারা আমাদের কর্ম-সামর্থ্য প্রদান করুন, তারা আমাদের কুশল বুদ্ধি প্রদান করুন; অর্থাৎ আমরা যেন সেই কর্ম করতে পারি, যে কর্মের ফলে তাদের স্বরূপ-জ্ঞানরূপ কুশলবুদ্ধি (মঙ্গলজনক বুদ্ধি) সঞ্জাত হয়। ভগবানের উদ্দেশে কর্ম কবতে করতে ভগবানের স্বরূপতত্ত্ব উপলব্ধ হবে, তার কর্মের দ্বারাই তাকে প্রাপ্ত হওয়া যাবে, এটাই স্থূল মর্ম]।

৭/১– হে বিবেকরূপী দেবগণ! আপনারা নিশ্চয়ই (ভগবানের– পরমব্রহ্মের) সাথে অভিন্নরূপে পরিলক্ষিত হন; এবং (সেই অভিন্নভাবের কারণে আপনারা পরস্পর তুল্যদীপ্তিমান্, আনন্দময় ও অমিতপরাক্রমশালী। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ব্রহ্মের সাথে সকল দেবগণের অভিন্নত্ব সূচিত হচ্ছে; সকল দেবতাই সমান ঐশ্বর্যশালী প্রতীত হন)। [ব্যাখ্যাকারগণ এই মন্ত্রের অর্থ নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন। সকলেই মরুৎ দেবতাগণকে উদ্দেশ করে মন্ত্রটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা মরুৎদেবতাগণ অর্থে পূর্বাপরই বিবেকরূপী দেবগণ উল্লেখ করেছি। যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুন, আমরা মনে করি, মন্ত্রের নিগূঢ় তাৎপর্য– আধ্যাত্মিক ভাব। মন্ত্রের সকল দেবকেই সমান বলা হয়েছে। সমানবচসা বিশেষণটিতেই ঐ ভাব আসে। বিশেষণটির অর্থ– সমান হয়েছে বৰ্চঃ (তেজঃ) যাঁদের। মন্ত্রের সংদৃক্ষসে পদে প্রতীত হয়– যখন তোমরা সম্যকরূপে পরিদৃষ্ট হও, অর্থাৎ যখন তোমাদের স্বরূপ সম্যক উপলব্ধি করতে পারি। তাহলেই বোঝা যায়, মন্ত্র যেন বলছেন, — সেই যখন তোমাদের সম্বন্ধে সম্যক্ জ্ঞান সঞ্জাত হয়– তখন, নিশ্চয়ই তোমাদের সমানদীপ্তিশালী অপ্রতিহত-প্রভাব সম্পন্ন নিত্য-প্রমুদিত অভিন্ন বলেই জানতে পারি। মন্ত্রে বোঝা গেল, একটু অগ্রসর হলেই, একটু জ্ঞান সঞ্চার হলেই, তাদের অভিন্ন বলে প্রতীত হবে। এই জন্যই বলা হয়, তপস্যার দ্বারা, কর্মের দ্বারা তাকে জানতে হবে, জ্ঞানের দ্বারা তার স্বরূপ উপলব্ধ হলেই পরাগতি প্রাপ্ত হবে]।

৭/২– অজ্ঞানতার অন্ধকার নাশের পর প্রসিদ্ধ যাজ্ঞিক-নামধেয় জন, মন্ত্র-রূপ ব্রহ্মের অনুধ্যান- পূর্বক, মুক্তপুরুষলক্ষণ নবজীবন লাভ করেন। (ভাব এই যে, যিনি জ্ঞানবান, তিনিই যাজ্ঞিক; তিনি ব্রহ্মস্বরূপ ধ্যান করে পরাগতি লাভ করেন)। [ভাষ্যকারদের গবেষণার প্রভাবে এই মন্ত্রের অর্থ এতই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, পূর্বাপর সামঞ্জস্য রক্ষার পক্ষে দারুণ অন্তরায় ঘটছে। মহামতি সায়ণাচার্যের অর্থের অনুসরণ করলে একরকম অর্থ নিষ্পন্ন হয়; আবার পাশ্চাত্য মত-অনুযায়ী অন্যান্য পণ্ডিতের মতে সে অর্থ অন্য আর একরকম হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, প্রচলিত দুটি বঙ্গানুবাদ উদ্ধৃত হচ্ছে। প্রথম তার পর (মরুৎগণ) যজ্ঞার্থ নাম ধারণ করে আপন প্রকৃতি অনুসারে মেঘের মধ্যে গর্ভাকার রচনা করলেন। দ্বিতীয়– অব্যবহিত পরেই ঈদৃঙ অনাদৃঙু প্রভৃতি যজ্ঞীয়নামধারী মরুৎসংজ্ঞক-দেবগণ, হবিঃ-অন্ন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে প্রতিদিন উৎপন্ন হয়। অন্যান্য কেউ আবার বলেছেন– আদহ স্বধামনু এই মন্ত্রে যজ্ঞ সমাপন করে যাজ্ঞিকেরা অগ্নিহোত্রী প্রভৃতি যজ্ঞীয় নাম গ্রহণ করে নিজেদের পুনর্জাত বলে ঘোষণা করেন। মন্ত্রে সেই ভাব ব্যক্ত রয়েছে। আমরা কোনও অর্থের উপেক্ষা প্রদর্শন করি না। আমরা জানি, অধিকারী অনুসারে প্রতি মন্ত্রেই বিভিন্ন রকম অর্থের আগম হবে]। এবার আমাদের বিশ্লেষণ লক্ষণীয়। মন্ত্রের প্রথম শব্দ-আদহ। ঐ শব্দের অর্থ অনন্তর তার পর। ঐ অর্থে একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে– কিসের বা কার? হৃদয় জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হলে হৃদয়েশ্বরের আবির্ভাব ঘটলে, যে অবস্থা হয়, তার পর– এই ভাব আসতে পারে। দনা নাম যজ্ঞিয়– এই পদে কোন্ অবস্থার সাধককে বোঝাচ্ছে, তা আপনা-আপনিই উপলব্ধ হয়। প্রকৃত যাজ্ঞিক (যাজ্ঞিয়ং) নাম পাবার অধিকারী কোন জন? যিনি সাধনার উচ্চস্তরে আরোহণ করতে পেরেছেন, যিনি পরব্রহ্মের স্বরূপ তত্ত্ব হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যাজ্ঞিক নাম তারই যোগ্য; তিনিই প্রকৃত যাজ্ঞিক (যজ্ঞিয়ং) নামের যোগ্য। স্বধাং শব্দের প্রকৃত অর্থ– যিনি আপন লোককে ধারণ বা পোষণ করেন; অর্থাৎ, যিনি সেই জগৎপতি জগদীশ্বর, তিনি আপন সৃষ্টি আপনিই রক্ষা করে থাকেন। এ স্থলে ঐ স্বধা শব্দে একমাত্র পরব্রহ্মকেই বোঝাচ্ছে ব্যতীত আর কি বলা যায়? সেই স্বধাকে (পরব্রহ্মকে) অনুক্ষণ ধ্যান করতে যিনি সমর্থ, তাতেই যিনি নিমজ্জমান আছেন, তিনি যে নবজীবন লাভ করবেন, তিনি যে মুক্ত পুরুষলক্ষণ প্রাপ্ত হবেন, তাতে বিচিত্রতা থাকতে পারে না]।

৭/৩– হে ইন্দ্রদেব! গিরিগুহার ন্যায় দৃঢ়, রিপুদস্যু-পরিবৃত হৃদয় কন্দর জ্ঞান রূপ বজ্রাগ্নির দ্বারা উদ্ভিন্ন করে, আপনি তার মধ্যে সত্যধর্মের দিব্যজ্যোতিঃ বিকিরণ করেন (অথবা–করুন)। (মন্ত্র, এক পক্ষে, ভগবৎ-মহিমাপ্রকাশক; অন্য পক্ষে, জ্ঞানলাভের প্রার্থনামূলক। প্রথমার্থ-ভগবান্ অজ্ঞানতানাশকারী; অন্য অর্থ-হে ভগবন! আপনি আমার অজ্ঞানতা দূর করুন)। [সাধারণতঃ এ মন্ত্রের অর্থ নিষ্পন্ন করা হয়, — যেন কতকগুলি গাভীকে অসুরগণ অতি দুর্গম গিহিগুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। ইন্দ্রদেব বহ্নিদ্বারা বজ্ৰদ্বারা বা মরুৎগণের সহায়তায় সে গুহা ভেদ করে গাভীগুলিকে উদ্ধার করেন। মরুৎগণ রূপ সাঙ্গোপাঙ্গের সাহায্যে গো-চোরের হাত থেকে গাভীর উদ্ধার-রূপ কৃতিত্ব প্রদর্শন, আর তার জন্য স্তব-স্তুতি, — এটাই হলো মন্ত্রের তথাকথিত ব্যাখ্যা-বিবৃতি। প্রমাণক্ষেত্রে পুরাণের উপাখ্যান এনে কতই রঙ্গ-রঞ্জিত করে উপস্থাপিত করা হয়েছে। অথচ, মন্ত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে, পূর্বাপর মন্ত্রগুলির অর্থসামঞ্জস্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় মন্ত্রের সাথে ঐ উপাখ্যানের অনুমাত্র সম্বন্ধ নেই। মন্ত্রের সাদাসিধা অর্থ এই যে, ইন্দ্রদেবের (শ্রীভগবানের) শরণাপন্ন হলে পাপকলুষিত হৃদয়েও পুণ্যের জ্যোতিঃ প্রকাশ পেতে পারে। পাপীর হৃদয় রিপুদস্যুপরিবৃত, সুতরাং দুর্গমগিরিগুহাসদৃশ নিবিড়-অরণ্যানী পরিবেষ্টিত দুর্গম গুহার অভ্যন্তরে সূর্যের কিরণ পৌঁছাতে পারে না। অগ্নির দ্বারা (অগ্নিভিঃ) অরণ্য ভস্মসাৎ করতে পারলে, বজ্রের দ্বারা গুহা উদ্ভিন্ন করতে সমর্থ হলে, তবে সেখানে সে কিরণ বিচ্ছুরিত হতে পারে। সে কার্য সাধারণ মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়। যিনি মানুষের অতীত, পরাৎপর পরমপুরুষ, একমাত্র তাঁর কৃপা প্রাপ্ত হলেই সে কার্য সম্পন্ন হয়। এখানে সেই ভাবমাত্র ব্যক্ত হয়েছে]।

৮/১– প্রসিদ্ধ জ্ঞানৈশ্বর্যাধিপতি দেবদ্বয়কে আমরা যেন আরাধনা করি; এই পরিদৃশ্যমান বিশ্ব যে দেবদ্বয়ের সৃষ্ট সেই দেবদ্বয় সাধকগণ কর্তৃক নিত্যকাল আরাধিত হন; স্তোতাদের মঙ্গলসাধক সেই দেবদ্বয়, আমাদের পরম মঙ্গল করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -সাধকেরা বিশ্বস্রষ্টা মঙ্গলময় ভগবানকে আরাধনা করেন; সেই পরম দেবতা আমাদের পরম মঙ্গল সাধন করেন)। [সাধকেরা ভগবানের আরাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। সাধনবলে তারা। এই জগতের কার্যপরম্পরা বিচার করে বিশ্বস্রষ্টা সেই পরমপুরুষের আরাধনাকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন বলে উপলব্ধি করতে পারেন। তিনিই জগতের স্রষ্টা ও রক্ষাকর্তা বিশ্ব তারই অসীম করুণার মঙ্গলময় পথে পরিচালিত হয়। জীবনের চরম উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে একমাত্র সেই বিশ্বনিয়ন্তার চরণে আশ্রয় গ্রহণ ব্যতীত অন্য উপায় নেই। সাধকেরা তা অবগত হয়ে সেই মহিমাময়ের চরণেই আত্মনিবেদন করেন। এই সত্যের উপরেই মন্ত্রের প্রার্থনাংশের ভিত্তি স্থাপিত। মহাজনবর্গের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাতে আমরাও ভগবৎপরায়ণ হই, মন্ত্রে এই ভাবের উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। চারদিকের মায়ানমাহের দিকে লক্ষ্য না করে মহাজনদের অনুসৃত পথেই নিজেকে পরিচালিত করবার ভাবও মন্ত্রে পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– প্রভূত শক্তিসম্পন্ন শত্রুনাশক বলাধিপতি দেবতা ও জ্ঞানদেবকে (অর্থাৎ ভগবানকে) আমরা যেন আরাধনা করি। তারা রিপুসংগ্রামে আমাদের সুখ প্রদান করুন (অর্থাৎ রিপুনাশ করে আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুজয়ী করুন আমরাও যেন ভগবৎপরায়ণ হই)। [মন্ত্রে ভগবানের শক্তি ও জ্ঞান এই দুই বিভূতির পৃথক উল্লেখ করা হয়েছে। শক্তিরূপে তিনি বজ্রধারী ইন্দ্র, জগতের পাপ অমঙ্গল নাশে নিরত। দুর্বলকে তিনি বল প্রদান করেন, প্রার্থনাকারীকে তিনি অতুল ঐশ্বর্যে অধিকারী করেন। আবার, অগ্নিরূপে তিনি জ্ঞান দান করেন। এই জ্ঞানের বলে মানুষ দিব্যজ্যোতিঃর সন্ধান পায়। মন্ত্রে ভগবানের এই জ্ঞান ও শক্তিরূপেরই উপাসনা করা হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– আমরা প্রচণ্ড বলশালী শনিধনকারী ইন্দ্র ও অগ্নিকে আহ্বান করছি। তারা যেন এমন সংগ্রামে আমাদের (কৃতকার্য করে) সুখী করেন। বলা বাহুল্য, সংগ্রামে কৃতকার্য করার অর্থ সংগ্রামে বিজয়ী করা]।

৮/৩– সৎ-জনের পালক হে দেবদ্বয়! আপনারা ভগবৎ-অনুসারীদের জ্ঞান-আবরক রিপুসমূহকে বিনাশ করেন; এবং সৎকর্মবিঘ্ন শত্রুদের বিনাশ করেন; অপিচ, হে দেবদ্বয় আপনারা সকল সাধনবিঘ্নকারী রিপুদের সর্বতোভাবে বিনাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সঞ্জনের পালক ভগবানই লোকদের রিপুনাশক হন)। [মন্ত্রে ভগবানের রিপুনাশিকা শক্তির মাহাত্ম্য পরিকীর্তিত হয়েছে। তিনিই বিশ্ববাসীকে পাপ, মোহ, অজ্ঞানতা প্রভৃতির কবল থেকে উদ্ধার করেন। তারই কৃপায় মানুষ এই সব ভীষণ রিপুকুলের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাধনমার্গে অগ্রসর হতে পারে। জগতে পাপ আছে সত্য, অজ্ঞানতা অন্যায় অসত্য আছে বটে, কিন্তু মূলতঃ তাদের কোন বাস্তব সত্তা নেই। তারা মায়ার পুতুলী, মোহের ইন্দ্রজাল মাত্র। পথিককে তারা আলেয়ার আলো দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে। বাস্তবিক তারা আলোও নয়, অন্ধকারও নয়; অর্থাৎ তাদের বাস্তব সত্তা নেই। ভগবানের রাজত্বে তাদের সত্যিকার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে মানুষ নানারকম বিভীষিকা দেখে ভয় পায়। ভগবান্ যখন কৃপা করে তার জ্ঞাননেত্র উন্মীলন করেন, তখন সে দেখতে পায় যে, এতদিন সে ছায়ার সাথে যুদ্ধ করেছে, নিজের অন্তরের কল্পনা-প্রসূত বিভীষিকা দেখে নিজে শিহরিত হয়ে উঠেছে। ভগবান্ মানুষের শত্রুনাশ করেন, তার অর্থ এই যে, তিনি মানুষকে এই ভ্রান্তি থেকে, মায়ার মোহজাল থেকে উদ্ধার করেন। তিনি জ্ঞানরূপ অঞ্জন-শলাকার দ্বারা মানুষকে দেখিয়ে দেন যে, সে সত্যসত্যই অজাতশত্রু, অপাপবিদ্ধ। যখন মানুষ নিজের স্বরূপের পরিচয় পায়, তখনই মোক্ষলাভ করে। জপ তপ পূজা আরাধনা সবই স্বরূপস্থ হবার জন্য, নিজেকে চেনবার জন্য। ভগবান্ মানুষকে ও সেই পরম জ্ঞান দান করেন, রিপুদের বিনাশ করে মানুষকে আত্মস্থ করেন। মন্ত্রের মধ্যে ভগবানের এ এই মহিমাই বিঘোষিত হয়েছে]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৯– অভি সোমাস আয়বঃ পবন্তে মদ্যং মদম্। সমুদ্রস্যাধি বিষ্টপে মনীষিণো মৎসরাসসা মদচ্যুতঃ। ১৷৷ তরৎ সমুদ্রং পবমান ঊর্মিণ রাজা দেব ঋতং বৃহৎ। অর্ষা মিত্রস্য বরুণসা ধর্মণাপ্র হিব্বান ঋতৎ বৃহৎ৷৷ ২ নৃভির্যেমাণে হর্ষতো বিচক্ষণো রাজা দেবঃ সমুদ্রয়ঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১০– তিম্রো ব্যচ ঈরয়তি প্র বহ্নিগ্ধতস্য ধীতি ব্ৰহ্মণণা মনীষাম। গাবো যন্তি গোপতিং পৃচ্ছমানাঃ সোমং যন্তি মতয়ো বাবশানাঃ৷৷৷৷ সোমং গাবো ধেনবো বাবশানাঃ সোমং বিপ্রা মতিভিঃ পৃচ্ছমানাঃ। সোমঃ সুত ঋচ্যতে পূয়মানঃ সোমং অর্কাস্ৰিষ্ঠুভঃ সং নবন্তে৷৷ ২। এবা নঃ সোম পরিষিচ্যমান আ পবস্ব পূয়মানঃ স্বস্তি ইন্দ্রমা বিশ বৃহতা মদেন বর্ধয়া বাচং জনয়া পুরন্ধি৷৷ ৩৷

মন্ত্ৰার্থ— ৯সূক্ত/১সাম– আশুমুক্তিদায়ক প্রজ্ঞানস্বরূপ, আনন্দজনক, পরমানন্দ প্রদায়ক সত্ত্বভাব। পৃথিবীর উপরে অর্থাৎ হৃদয়ের পরম পবিত্র প্রদেশে আনন্দজনক অমৃতের স্রোত প্রবাহিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাবের দ্বারা মানুষ অমৃত লাভ করে)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এই সমস্ত সোমরস, যারা দ্রুতগামী, পণ্ডিত, আনন্দকর এবং সেই সকল বস্তু দিতে পারে, তারা কলসের উপরিস্থিত উন্নত পবিত্রে ক্ষরিত হচ্ছে। এই ব্যাখ্যাতে সোমের কয়েকটি বিশেষণের প্রতি লক্ষ্য করা প্রয়োজন। সোমের একটি বিশেষণ পণ্ডিত। অবশ্য জ্ঞানদায়ক অর্থে পণ্ডিত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এইভাবে যতই সোমরসের বিশেষণগুলির সম্বন্ধে আলোচনা করা যাবে, ততই দেখা যাবে যে, সোমরস সাধারণ বস্তু থেকে স্বতন্ত্রজাতীয় পদার্থ। পূর্বেও এ কথা আলোচিত হয়েছে। পরেও ঐ ভাবই গৃহীত হয়েছে। নিত্যসত্য-প্রকাশক হলেও মন্ত্রে প্রচ্ছন্নভাবে প্রার্থনার ভাবও বিদ্যমান রয়েছে। ভগবানের বিভূতি-স্বরূপ শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উপজিত হয়ে আমাদের পরমানন্দদানে অমৃতত্ত্বের অধিকারী করুক। মন্ত্রে এই প্রার্থনার ভাব বিদ্যমান]।

৯/২– পবিত্রকারক, সকলের অধিপতি মহান্ সত্যস্বরূপ পরমদেব সত্ত্বভাব ধারারূপে অমৃতের সমুদ্রকে প্রাপ্ত হন; অর্থাৎ সত্ত্বভাব অমৃতপ্রাপক হন; মহান্ সত্যস্বরূপ সেই শুদ্ধসত্ত্ব সাধকের হৃদয়ে, উৎপাদিত হয়ে মিত্রভূত অভীষ্টবর্ষক দেবতার ধারণের জন্য অর্থাৎ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য গমন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাব ভগবান্‌-প্রাপক হন)। [প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদির কোন কোন স্থলে মর্মার্থ সম্বন্ধে অনৈক্য ঘটেছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সোম যিনি, তিনি রাজা, তিনি দেব, তিনি প্রধান সত্য, তিনি তরঙ্গে তরঙ্গে ক্ষরিত হয়ে কলসে যাচ্ছেন। মিত্র ও বরুণের নিমিত্ত প্রস্তুত হয়ে তিনি চলেছেন। তিনি অতি প্রধান সত্যস্বরূপ। বঙ্গানুবাদে সোমরসের প্রসঙ্গ আনয়ন করা হয়েছে, সেখানেই আমাদেব আপত্তি। সমুদ্রং পদে ভাষ্যকার অন্তরীক্ষংকলশং প্রভৃতি অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সোমরসের সাথে অন্তরীক্ষের কোন সম্বন্ধ সূচিত হয় কি? এছাড়া, ভাষ্য মতেই সোমরসের যে সব বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে, তার দ্বারা অর্থের কোন সামঞ্জস্য রক্ষিত হওয়া সম্ভবপর নয়। অসত্যের জনয়িতা মাদকদ্রব্য সোম কিভাবে প্রধান সত্য বা অতি প্রধান সত্য হতে পারে, তা ঐ সোমপানাসক্তরাই বলতে পারেন। মন্ত্রে অহেতুক সোমরসের অবতারণা করলেই মন্ত্রার্থে এমনতর অসামঞ্জস্য হওয়া স্বাভাবিক। রাজা অর্থে সর্বেশ্বর এবং দেব অর্থে (সোমের পরিবর্তে) পরমদেব সত্ত্বভাব বোঝায় কোনই অসঙ্গতি হয় না]।

৯/৩– দিব্য, পাপহারক (অথবা পরমস্পৃহণীয়) সর্বজ্ঞ সকলের অধিপতি দীপ্যমান পরমদেব শুদ্ধসত্ত্ব সাধকগণ কর্তৃক তাদের হৃদয়ে উৎপন্ন হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকেরা পরম আকাঙ্ক্ষণীয় সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সাধকগণ সত্ত্বভাব লাভ করেন। সৎকর্মসাধনের দ্বারা তারা নিজেদের হৃদয়কে নির্মল করেন। সেই পবিত্র হৃদয়ে সত্ত্বভাব সমুদ্ভূত হয়। নৃভিঃ যেমনঃ পদ দুটিতে এই সত্যকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। ভাষ্যকার সমুদ্রঃ পদে অন্তরীক্ষেভবঃ অর্থ গ্রহণ। করেছেন। অবশ্য সোম বলতে যদি মাদকদ্রব্য সোমরস ব্যতীত অন্য কোন স্বর্গীয় বস্তু বোঝায়, তাহলে ঐ অর্থ সঙ্গতই হয়। বিবরণকার ঐ পদে সমুদ্ৰাত্মকংঅর্থ গ্রহণ করেছেন। এই ব্যাখ্যা পরিষ্কার হয়নি। মন্ত্রের অন্তর্গত হযতঃ পদে ভাষ্যকার স্পৃহণীয় অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা সেই সঙ্গে ঐ পদের মূলার্থ পাপহারকঃ ব্যাখ্যাও গ্রহণ করেছি, অর্থাৎ সত্ত্বভাব পাপহারক বলেই স্পৃহণীয়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত সাতাশটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– পৌরুমদ্রম্, উভয়তঃ স্তোভং গৌতমম, দ্বিতীঙ্কারং, বামদেব্যং গায়ত্ৰপার্শ্বম পৌরুহম্মনম, দ্বৈগতম, হারায়ণম অচ্ছিদ্রম, রৌরবম, মানরোত্তরম ইত্যাদি]।

১০/১– অগ্নিপ্রতিম সৎকর্মসাধক ঋক-যজু-সামাত্মিকা স্তুতি উচ্চারণ করেন অর্থাৎ বেদমার্গের অনুসরণে ভগবানকে আরাধনা করেন; এবং সত্যের ধারণকারী ভগবানের প্রার্থনা উচ্চারণ করেন (অথবা তিনি সত্যের ধারণকারী বেদোক্ত কর্ম সম্পাদন করেন)। জ্ঞানরশ্মি যেমন জ্ঞানীকে প্রাপ্ত হয়, তেমনই জ্ঞানার্থী মোক্ষ-অভিলাষী স্তোতাগণ সত্ত্বভাবকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধক বেদমার্গের অনুসরণে ভগবানকে আরাধনা করেন, এবং সত্যের ধারণকারী ভগবানের প্রার্থনা উচ্চারণ করেন অথবা তিনি সত্যের ধারণকারী বেদোক্ত কর্ম সম্পাদন করেন, এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেন; প্রার্থনাপরায়ণ সৎকর্মসাধক সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলিতে একের সঙ্গে অপরের মিল নেই। এর অন্তর্গত প্রায় প্রত্যেক পদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বিবরণকারই দুতিন রকমের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা-বশ্যাদিগুণহেতু বহ্নিই আত্মা। তিনি বিদ্যা-বুদ্ধি-মনরূপ তিন রকম বৃত্তি প্রেরণ করেন। বিদ্যা মহৎ; বুদ্ধি অহঙ্কার; প্রাধান্যবশতঃ মন ইন্দ্রিয়দের প্রেরণ করে। ব্ৰহ্মণঃও ঋতস্য পদের অর্থ করা হয়েছে আত্মা। আত্মা প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রিয়গণের অধিপতি। আত্মাই তাদের রক্ষক ও পরিচালক। আত্মার জন্যই ইন্দ্রিয় ইত্যাদি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। এই ব্যাখ্যা থেকে এটা পরিদৃষ্ট হবে যে, — আত্মার প্রাধান্য স্থাপন করতে গিয়ে, ব্যাখ্যাকার নানারকম শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই সব শাস্ত্রই বেদের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বেদজ্ঞান থেকেই অন্যান্য জ্ঞানধারা প্রবাহিত হয়। উদাহরণ– তিঃ বাচঃ পদ দুটির ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাকার সাঙ্খদর্শনের অনুসরণ করেছেন। এ থেকে এ কথাই প্রতিপন্ন হয় যে, সমস্ত শাস্ত্রই বেদ থেকে উৎপন্ন। বেদ দর্পণস্বরূপ। সকলেই তার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান। সুতরাং একই মন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হওয়া অসম্ভব নয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৫ম অধ্যায়ের ৬ষ্ঠী দশতির ৩য় সামেও দৃষ্ট হয়]।

১০/২– ভগবানের প্রীতিকারক জ্ঞানকিরণসমূহ অর্থাৎ পরাজ্ঞান শুদ্ধসত্ত্বের সাথে মিলিত হয়; প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ প্রার্থনার দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বকে পেতে ইচ্ছা করেন; পবিত্রকারক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক; আমাদের জ্যোতির্ময় প্রার্থনা শুদ্ধসত্ত্বে মিলিত হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — জ্ঞানিগণ জ্ঞানের প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন; ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করুন)। [জ্ঞানের বলে মানুষ আপন ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করতে পারে এবং তা সংশোধনের জন্য চেষ্টা করে। হৃদয় পবিত্র হলে, তাতে সত্ত্বভাব উপজিত হয়। এই শুদ্ধসত্ত্বের শক্তিতে সাধক মুক্তিলাভে সমর্থ হন। জ্ঞানের বলে তিনি সত্ত্বভাবের এই মহিমা অবগত হয়ে তা লাভ করবার জন্য সাধনায় প্রবৃত্ত হন এবং ভগবানের কৃপায় তা লাভ করে থাকেন। কিন্তু আমরা তো অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে আছি। আমাদের উপায় কি? একমাত্র উপায় ভগবানের চরণে ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা। ওগো দয়াময়, তুমিই আমাকে মুক্তিমার্গে নিয়ে চলো– মানবাত্মার এই চিরন্তন ক্রন্দনধ্বনিই যুগে যুগে অজ্ঞানী-পাপীর ভগবৎ-আরাধনার মন্ত্র]।

১০/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়স্থিত পবিত্রকারক আপনি আমাদের কল্যাণ প্রদান করুন; হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি মহৎ পরমানন্দের সাথে আমাদের প্রার্থনা, অর্থাৎ পূজাশক্তি প্রবর্ধিত করুন, আমাদের হৃদয়ে পরাজ্ঞান প্রদান করুন এবং ভগবানকে প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা যেন ভগবানকে লাভ করি)। [আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়েই প্রচ্ছন্নভাবে সত্ত্বভাব আছে। তাকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে পারলে তা-ই আমাদের ভগবৎ সমীপে নিয়ে যাবে। যাতে আমরা সেই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে ভগবানের চরণ লাভ করতে পারি, মন্ত্রে তার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যায় এই প্রার্থনার ভাব পরিষ্কার হয়নি। যেমন, এই প্রচলিত অনুবাদ হে সোম! তোমাকে সেচন করা হচ্ছে। তুমি শোধিত হয়ে ক্ষরিত হও। যাতে আমাদের কল্যাণ হয়, উচ্চৈঃস্বরে রব করতে করতে ইন্দ্রের দেহের মধ্যে প্রবেশ করো। স্তবের বৃদ্ধি করো, স্তব বিস্তারিত করো। এই মন্ত্রের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে রব করতে করতে কোথা থেকে এল, তা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুবাদে দুবার স্তব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাচং এবং পুরন্ধিং পদ দুটি একার্থক নয়। প্রকৃতপক্ষ, যাতে আমাদের পূজাশক্তি বৃদ্ধি হয়, যাতে আমরা ভগবৎপরায়ণ হই, মন্ত্রে তারই জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য সোমের প্রভাবে নয়, একমাত্র শুদ্ধসত্ত্বেরই প্রভাবে মানুষের মন ভগবৎ-অভিমুখী হয়]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১১– যদ্দ্যাব ইন্দ্রতে শতং শতংভুমীরূত স্যুঃ ন ত্বা বজিৎসহস্রং সূর‍্যা অনু ন জাতমষ্ট রোদসী। ১ আ পপ্রাথ মহিনা বৃষ্যা বৃষ বিশ্বা শবিষ্ঠ শবসা। অশ্ম অব মঘব গোমতি ব্ৰজ্বে বর্জিং চিত্রাভিরুতিভিঃ ৷৷ ২৷৷

 সূক্ত ১২– বয়ং ঘ ত্বা সুতাবন্ত আপোন বৃক্তবহিষঃ। পবিত্রস্য প্রস্রবণেষু বৃহ পরি স্তোতার আসতে৷৷ ১৷৷ স্বরন্তি ত্বা সুতে নরো বসো নিরেক উথিনঃ। কদা সুতং তৃষাণ ওক আগম ইন্দ্র স্বীব বংসগঃ ॥ ২৷৷ কম্বোভিধৃষ্ণবা ধৃষদ বাজং দর্ষি সহণিম্। পিশঙ্গরূপং মঘব বিচৰ্ষণে মক্কু গোমমীমহে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৩– তরণিরিৎ সিষাসতি বাজং পুরন্ধ্যা, যুজা। আ ব ইন্দ্রং পূরুহৃতং নমে গিরা নেমিং ষ্টেব সুবঃ ১। ন দুষ্টুতিট্রবিণোদেষু শস্যতে ন সুধন্তং রয়িনশৎ। সুশক্তিরিন্মঘবং তুভ্যং মাবতে দেষ্ণং যৎ পার্ষে দিবি। ২

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১১সূক্ত/১সাম– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যদি দ্যুলোক অসংখ্য হয় এবং পৃথিবী অসংখ্য হয়, তথাপি তারা আপনার পরিমাণ করতে করতে অসমর্থ; হে বজ্রধারিণ! অসংখ্য সূর্যও আপনাকে প্রকাশ করতে পারে না; পূর্বে উৎপন্ন কিছুই এবং স্বর্গমর্তও আপনার পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হয় না। (ভাব এই যে, ভগবান্ সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; তাঁর সৃষ্ট কোনও বস্তু তাঁকে পরিমাণ করতে পারে না) [যার থেকে জগৎ উৎপন্ন, যাঁর কণামাত্র করুণায় জগৎ স্থিত হয়ে আছে, সেই অনন্ত অসীম বিরাট পুরুষকে পার্থিব কোনও বস্তুর সাহায্যে পরিমাণ করা অসম্ভব, আর পরিমাণ করতে যাওয়া শিশুবুদ্ধির পরিচায়ক। জ্ঞানী সাধক জানেন, — যতই জাগতিক পদার্থের উপমা ও মাননীয় ভাষা ব্যবহার করা যাক না কেন, তিনি সচ্চিদানন্দ ভগবান– এই সমস্তের ঊর্ধ্বে। কিন্তু যে ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা মানুষকে তার দিকে ঠেলে দেয়, ভগবানকে অন্তরতর অন্তরতম রূপে পেতে চায়, এ সেই আকাঙ্ক্ষাই ভগবানকে মানুষের নিত্য-পরিচিত জাগতিক বস্তুর ও সম্বন্ধের মধ্যে টেনে আনে। পাছে মানুষ হৃদয়ের পার্থিব প্রেরণাবশে ভগবানের স্বরূপ ভুলে শুদ্ধ জাগতিক সম্বন্ধের মধ্যে দিয়ে তাঁকে দেখে, সেই জন্য ঋষি মানুষকে সম্বোধন করে বলছেন– তমেব ভান্তং অনুভাতি সর্বঃ। ভগবানের সেই অপার মহিমাই এই মন্ত্রে প্রখ্যাপিত হয়েছে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকে ও (৩অ-৫দ ৬সা) পাওয়া যায়]।

১১/২– অভীষ্টবর্ষক পরমশক্তিসম্পন্ন হে দেব! মহৎ অভীষ্টদায়ক আত্মশক্তির দ্বারা সর্বতোভাবে আমাদের পূর্ণ করুন। পরমধনদাতা রক্ষাস্ত্রধারী হে দেব! আমাদের হৃদয়ে পরাজ্ঞান প্রদানের জন্য আমাদের বিচিত্র রক্ষাশক্তিব দ্বারা রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরাজ্ঞান এবং পরমশক্তি প্রদান করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের প্রথমাংশটিকে নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক রূপে প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন, — হে অভিলাষপ্রদ, অত্যন্ত বলবা, ধনবান, বজ্ৰবান্ ইন্দ্র! তুমি মহৎ বলের দ্বারা বল ব্যাপ্ত করেছ। আমাদের গোসমূহের নিমিত্ত আমাদের বিচিত্র রক্ষা কার্যের দ্বারা রক্ষা করো। ভাষ্যকারকে অনুসরণ করে গোমতি ব্ৰজে পদ দুটির অর্থ, এক হিন্দী ব্যাখ্যাকার গরুপূর্ণ মাঠে করেছেন, বাংলা অনুবাদকার লিখেছেন– গো-সমূহের নিমিত্ত। দেখা যাচ্ছে প্রায় সকলেই গোমতি পদের সাথে গরুর সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন যদিও বিভক্তি সম্বন্ধে কারও সাথে অন্য কারও মিল নেই। ব্রজে পদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। আমরা গো শব্দে জ্ঞান অথবা জ্ঞানকিরণকে বরাবরই লক্ষ্য করেছি। ব্রজে শব্দেও আশ্রয়স্থল অর্থাৎ হৃদয় প্রভৃতি অর্থ পরিগ্রহণ করেছি। তাই ঐ দুই পদে জ্ঞানযুতে আশ্রয়স্থলে অর্থাৎ অস্মাকং হৃদি পরাজ্ঞানপ্রদানায় অর্থ সঙ্গতভাবেই গৃহীত হয়েছে। এর পরই উতিভিঃ অব পদ দুটি থাকাতে উপরে উক্ত পদ দুটির চতুর্থ্যন্ত ব্যাখ্যা গ্রহণ সমর্থিত হচ্ছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম– মহাবৈষ্টম্ভব]।

১২/১– বাহিরের অন্তরের শত্রুনাশক হে ভগবন! আপনার প্রীতিসাধনের জন্য আপনার অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী আমরা শুদ্ধসত্ত্বকে (ভক্তিসুধাকে) নিশ্চিত যেন অভিযুত করি; অর্থাৎ সঞ্চিত করি; সাগরগামী জলের ন্যায় অর্থাৎ জলসমূহ যেমন জলাধার বারিনিধির সাথে মিশবার জন্য তার অভিমুখে প্রধাবিত হয়, তেমন, আমাদের হৃদয়ে উপজিত শুদ্ধসত্ত্ব (অর্থাৎ ভক্তিসুধা) শুদ্ধসত্ত্বাধার আপনার সাথে সম্মিলিত হোক। (ভাব এই যে, — সেই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে, আমরা সাগরগামী জলের ন্যায় যেন আপনার সাথে সম্মিলিত হই;-জল যেমন আপনা-আপনিই সাগরসঙ্গম অভিলাষ করে, আমাদের কর্মসমূহ তেমন ভগবৎপরায়ণ হোক, — এটাই আকাঙ্ক্ষা)। আপনার সাথে সম্মিলনের আশায়, বিশুদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বের বা ভক্তিসুধার প্রস্রবণের মতো আপনা-আপনি প্রবহমান ও অপ্রতিহত গমন স্রোতের অভিমুখে আত্ম-উৎকর্ষের দ্বারা বন্ধনমুক্ত অর্থাৎ পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের অভিলাষী সাধকগণ বা উপাসকগণ আপনাকে অর্চনা করছেন– আপনাকে পাবার কামনায় আপনাদের প্রেরণ করছেন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক; ভাব এই যে, বিশ্ববাসী সকলেই আত্ম-উৎকর্ষ-লাভের জন্য ভগবানের উদ্দেশে প্রণত হচ্ছে। হে আত্মণ! বিশ্বের অন্তর্গত তুমিও তেমন হও। নদীসমূহ যেমন বারিনিধির সাথে মিশবার জন্য আপন জলরাশিরূপ আত্মাকে প্রেরণ করে, তেমন ভগবানে আত্মসম্মিলনের জন্য তুমিও তোমার আত্মাকে নিয়োজিত করো)। [মন্ত্রটি এক আধারে দুরকম ভাব নিয়ে অবতীর্ণ। এতে একদিকে যেমন ভগবানের অপার করুণার বিষয় প্রকাশিত হচ্ছে, অন্য দিকে, তেমনি আত্মার উদ্বোধনার ভাব প্রতীত হচ্ছে। মন্ত্র বলছেন– বারি হতে পারবে কি? বারি হয়ে বারিনিধির সাথে মিশবার জন্য প্রস্তুত হও। সমুদ্রের আহ্বানে নদীর মতো, ঈশ্বরের আহবানে তার চরণে পতিত বা মিলিত হও। নদী যেমন সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সাগরের দিকে ছোটে, তুমিও তেমনই সংসারের সকল আবর্জনা, পঙ্কিলতা, বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে একাগ্রতার সাথে তাকে প্রাপ্তির পথে ছুটে চলো। সর্বব্যাপী সর্বভূতাত্মন ভগবান বলছেন, হে বিশ্ববাসী জীবগণ! তোমরা যদি আমার সাথে মিশতে চাও, তাহলে আমাতে আত্মসমর্পণ করো। তাহলে সংসারের কোন কিছু মায়া-মমতা, কামনা-বাসনা, লোভ-প্রলোভন, — কেউই তোমাকে বন্ধন করতে পারবে না। — ভাষ্যকার সুতাবন্তঃ পদের অর্থ করেছেন– আমরা সোম অভিযুত করেছি। কারণ তিনি সুত পদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সর্বত্রই সোমরসরূপ মাদক দ্রব্যের সম্বন্ধ টেনে এনেছেন। তাতে মন্ত্রের ভাব দাঁড়িয়েছে– আমরা আপনার জন্য সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য প্রস্তুত করেছি। আপনি তা পান করুন। আমরা জলের ন্যায় আপনার দিকে অগ্রসর হই। কিন্তু আমরা মনে করি, সুতাবন্তঃ পদের ও আপো ন উপমার ভাব অন্যরকম (যথাক্রমে শুদ্ধসত্ত্বং ভক্তিসুধাং অভিযুতবন্তঃ ও সাগরগামিনঃ জলমিব)। পবিত্রস্য ও প্রস্রবণেষু পদ দুটির ভাবও আপো ন উপমার অনুরূপ। নদী প্রস্রবণ যেমন সকল বাধা অতিক্রম করে সাগরসঙ্গমে প্রধাবিত হয়, অন্তরে সত্ত্বভাবের উদয় হলে, (পেটে সোমরসরূপ মাদক-দ্রব্য পড়লে নয়), হৃদয়ে ভক্তিরস সঞ্চারিত হলে, সে শুদ্ধসত্ত্বের ধারা, সে ভক্তির প্রস্রবণ সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে, ভগবানের প্রতি প্রধাবিত হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৩দ-৯সা) প্রাপ্তব্য]।

১২/২– পরমধনপ্রাপক হে দেব! পবিত্র পরমধনদায়ক সৎকর্মে অর্থাৎসৎকর্মসাধনে প্রার্থনাপরায়ণ সৎকর্মের নেতাগণ আপনাকে আরাধনা করেন; স্বর্গপ্রাপক বলাধিপতি দেব, পরাজ্ঞানদায়ক হয়ে কখন আমাদের হৃদয়ে আগমন করবেন? (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আগমন করে আমাদের কৃতার্থ করুন)। [একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে নিবাসপ্রদ ইন্দ্র! অভিযুত সোম নির্গত হলে উথবিশিষ্ট নেতাগণ স্তোত্র করছে। ইন্দ্র কখন সোমের জন্য তৃষ্ণাত হয়ে বৃষভের ন্যায় শব্দ করে (যজ্ঞ) স্থানে আগমন করবেন? — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১২/৩– শত্রুনাশক হে দেব! আপনি প্রজ্ঞাসম্পন্ন জনগণের দ্বারা স্তুত হয়ে তাঁদের প্রভূতপরিমাণ রিপুনাশক আত্মশক্তি প্রদান করেন; পরমধনদাতা সর্বজ্ঞ হে দেব! আপনার পরাজ্ঞান সমন্বিত অমূল্য পরমধন নিত্যকাল আমরা প্রার্থনা করি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, পরমদাতা ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞানযুত পরমধন প্রদান করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে আমাদের মন্ত্রার্থের কিছু অনৈক্য ঘটলেও কোনও কোনও বিষয়ে মিল আছে। যেমন, একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে শত্রুদমনকারী ইন্দ্র! কথগণকে সহস্ৰসংখ্যক অন্ন দান করো। হে মঘবা, বিচক্ষণ ইন্দ্র! আমরা ধৃষ্ট, পিশঙ্গরূপবিশিষ্ট ও গোমান (অন্ন) যাচ্ঞা করছি।  –পার্থক্য এই যে, ভাষ্যকার কথেভিঃ পদে কথদেশীয় লোকদের অর্থ করেছেন, আমরা বলেছি– প্রজ্ঞাসম্পন্ন জনগণের। ইত্যাদি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– মহাবৈষ্টম্ভং অভিনিধনঙ্কাণ্বম, অভীবর্তম]।

১৩/১-সংসার-সাগরে তরণীর ন্যায় উদ্ধারকারী কর্মনিবহ অর্থাৎ সংসার-সাগর-ত্রাণকারক হ ভগবান, মহতী বুদ্ধির সাথে নিত্যকাল আমাদের কল্যাণ সাধনের দ্বারা, শুদ্ধসত্ত্বের সাথে সম্মিলিত হয়ে অথবা আমাদের শুদ্ধসত্ত্বের সাথে সংযোজিত করে অর্থাৎ আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন করে, অভীষ্টফল প্রদান করেন; পরিত্রাণকারী দেবতার ন্যায়, সেই সৎকর্মনিবহ আমাদের পরিত্রাণসাধক জ্ঞানভক্তিসহযুত যানকে প্রাপ্ত করান অর্থাৎ প্রদান করুন। আরও, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ (আত্মসম্বোধন)! তোমাদের হিতসাধনের জন্য অর্থাৎ আত্মার পরিত্রাণসাধনকল্পে, অখিলব্রহ্মাণ্ডের আরাধ্য জগৎপূজ্য সেই পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে ভক্তিসহযুত স্তুতির দ্বারা এবং সৎকর্মের দ্বারা, তোমাদের (অর্থাৎ আমাদের মধ্যে) অবনমিত করছি (অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত করছি)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্বোধক। সংসারসমুদ্রে সৎকর্মস্বরূপ ভগবানই একমাত্র পরিত্রাণকারক। সৎ ভাবের ও সৎকর্মের দ্বারাই তিনি একমাত্র প্রাপ্তব্য। তার অনুগ্রহলাভের জন্য আমরা যেন সৎ-ভাব সম্পন্ন এবং সৎকর্মপরায়ণ হই)। অথবা– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! সংসার-সাগর-ত্রাণকারক অর্থাৎ সর্বদা সৎকর্মপরায়ণ জনই, মহতী পরমার্থবুদ্ধি-সহযুত হয়ে, অভীষ্টফলকে সম্ভজনা করেন অর্থাৎ প্রাপ্ত হন। পরিত্রাণকারক দেবতা যেমন জ্ঞানভক্তিসহযুত সৎকর্মরূপ যানকে প্রাপ্ত করান, তেমনই তোমাদের জন্য অর্থাৎ তোমাদের উৎকর্ষসাধনের অথবা আমাদের নিজেদের মঙ্গল সাধনের নিমিত্ত, জগৎপূজ্য পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে ভক্তিসহযুত স্তুতির দ্বারা যেন আহ্বান করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, — সৎকর্মপরায়ণ সাধকের ন্যায় আমি যেন ভগবানের অনুসরণে সঙ্কল্পবদ্ধ হই)। [মন্ত্রের অন্তর্গত বঃ পদে ঋত্বিক-যজমানের প্রতি লক্ষ্য আসে। ভাষ্যে বঃ পদের অর্থ তোমাদের নিমিত্ত, আমাদের ব্যাখ্যায় ঐ পদের লক্ষ্য-চিত্তবৃত্তিসমূহ। তরণিঃ পদের ভাষ্য-অনুসারী অর্থ– যুদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে ত্বরিতগতি। ভাবার্থ– যুদ্ধ ইত্যাদিতে পারদর্শী। কিন্তু যুদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে পারদর্শী ব্যক্তির যে শ্রেয়ঃ লাভ হয়, তা ভগবৎপরায়ণ জুনের কামনার সামগ্রী হতে পারে কি? তরণিঃ পদের এমন অর্থও সর্বথা সিদ্ধ হয় না। এই পদের সাধারণ অর্থ– নৌকা বা ভেলা। যার দ্বারা নদী প্রভৃতি উত্তীর্ণ হওয়া যায়। তা থেকে আমরা ভাব গ্রহণ করেছি সংসার-সমুদ্রত্ৰাণকারকঃ। অভিজ্ঞ কর্ণধার যেমন তরণীর সাহায্যে বিপদসঙ্কুল সমুদ্র অনায়াসে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়; তেমনই সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি নিজের সৎকর্মরূপ তরণীর সহায়তায় সংসার-রূপ মহা-সমুদ্র অনায়াসে পার হয়ে থাকেন। এই ভাবে মন্ত্রের অন্যান্য অংশেও পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। যেমন– নেমিং ত্বষ্টেব সুব-উপমা-বাক্যাংশে কোনও ক্রিয়াপদ না থাকলেও ভাষ্যে আনময়তে ক্রিয়াপদটি অধ্যাহার করে অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে– ত্বষ্টা যেমন উত্তম কাষ্ঠ-বিশিষ্ট নেমিকে নমিত করেন। তার সাথে দ্বিতীয় পদের অবশিষ্ট অংশের অর্থ দাঁড়িয়েছে– তেমন, স্তুতির দ্বারা পুরুহুত ইন্দ্রকে নমিত করব। উপমার এমন অর্থে মন্ত্রাংশটির কোনও সুষ্ঠু সাত্ত্বিক ভাব প্রকটিত হয়েছে বলে মনে করা বাতুলতা। আমাদের মতে, ত্বষ্টা পদে ত্রাণকারী দেবতার প্রতি লক্ষ্য আছে। এই লক্ষ্যেই পূর্বের অনেক স্থলে মতোই এখানেও ঐ অর্থই অব্যাহত রাখা হয়েছে। সুবং পদের ভাষ্যানুসারী অর্থ-শোভনদারুং (উত্তম কাষ্ঠ)। আমাদের মতে, সুবংপদে জ্ঞানভক্তিসহযুতংঅর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে। নেমি পদে কর্মরূপ যানকে লক্ষ্য করাই সঙ্গত। কর্ম সুশোভন হয় তখনই, যখন তা জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। মন্ত্রাংশের ভাব এই যে, শোভনদারুবিশিষ্ট অর্থাৎ সুদৃঢ় যান যেমন সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আরোহীকে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যায়; তেমনই ভগবানের অনুগ্রহে জ্ঞানসহযুত হলে সৎকর্ম-সাধনের দ্বারা ও সৎ-জ্ঞানের সাহায্যে মানুষ অনায়াসে সংসার-সমুদ্র উত্তীর্ণ গ হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, ভাষ্যের অনুসরণে মন্ত্রের অর্থ হয়, -ত্বরাবান্ ব্যক্তিই মহৎ কর্মের বলে। এ অন্ন ভজনা করে। ত্বষ্টা যেমন উত্তম কাষ্ঠবিশিষ্ট নেমিকে নমিত করেন, তেমন স্তুতির দ্বারা পুরুহূত ইন্দ্রকে নমিত করব। আমরা বলছি– সৎকর্মপরায়ণ সাধক যেমন অনায়াসে ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করতে সমর্থ হন; আমিও যেন তেমন সৎকর্ম-সাধনের দ্বারা ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করতে পারি। উপমার ভাব বিশ্লেষণে বোঝা যায়, ভগবানের অনুগ্রহে জ্ঞানভক্তিসহযুত সৎকর্ম আপনিই অধিগত হয়। প্রার্থনা এই যে, আমিও যেন আমার মঙ্গলের জন্য জ্ঞানভক্তিসহযুত সৎকর্মরূপ স্তুতির দ্বারা ভগবানের অনুগ্রহ লাভে সমর্থ হই। — প্রথম প্রকার অন্বয়েও মন্ত্রের ভাব অপরিবর্তিত রয়েছে। বরং ঐ অন্বয়ে মন্ত্রের ভাবের একটু উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। যুজাপদের এক সুষ্ঠু সঙ্গত অর্থ পাওয়া গেছে। ঐ পদের অর্থ দাঁড়িয়েছে– শুদ্ধসত্ত্বেন সহ সংযোজয়িত্ব, যদ্বা, হৃদি শুদ্ধসত্ত্বং উৎপাদয়িত্বা ইতি যাবৎ। এইভাবে মন্ত্রের প্রথমাংশে নিত্যসত্যমূলক ভগবানের অপার করুণার বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য করুণাময় ভগবান্ তাদের শুদ্ধসত্ত্বের সাথে মিলিত হয়ে, অথবা মানুষকে শুদ্ধসত্ত্বে যোজিত করে। কিংবা তাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করে তাদের অভীষ্ট পূরণ করেন। এই সত্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে মানুষ যদি সৎকর্মপরায়ণ হয়, ভগবান্ তরণীর মতো তাদের উদ্ধার সাধন করেন। সে ক্ষেত্রে, মন্ত্রের এ অংশের উপদেশ, — মানুষ, তুমি সৎকর্মশীল হও, সৎ ভাবে মণ্ডিত হও। তাহলেই ভগবান্ তোমার সর্বাভীষ্ট পূরণ করবেন। তার পরেই, প্রার্থনার ভাব প্রকাশ পেয়েছে, ভগবান্ যখন এইরকম করুণাপরায়ণ, সুতরাং সংসারসমুদ্র উত্তীর্ণ হবার একমাত্র সহায় পরিত্রাণসাধক জ্ঞানভক্তি সমন্বিত সৎকর্মরূপ তরণীকে আমাদের প্রাপ্ত করান। ভাব এই যে তাঁর অনুগ্রহে যেন আমরা সৎ-ভাব-সমন্বিত হয়ে সত্যজ্ঞান লাভ করে সৎকর্মের সাধনে সমর্থ হই; আর, সেই সৎকর্মই যেন আমাদের ভবসমুদ্র (সংসাররূপ সমুদ্র) উত্তরণের সহায় হয়। পরবর্তী অংশ আত্মসম্বোধনমূলক বলে মনে করা যায়। তাতে সঙ্কল্পের ভাবও প্রকাশ পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এমন যে করুণাময় ভগবান্। আমরা আমাদের সৎকর্মের দ্বারা, জ্ঞানভক্তিসহযুত হয়ে, তাকে যেন হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হই। তার অনুগ্রহ লাভ করলে, সংসার বন্ধনের ভয় আর থাকবে না। পরমার্থ লাভে আমরা সমর্থ হবো]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১দ-৬সা) দ্রষ্টব্য]।

১৩/২– পরমধনদাতা ভগবানে অর্থাৎ তার সম্বন্ধে অনুপযুক্ত ভক্তিবিহীন প্রার্থনা ভগবানকে প্রাপ্ত হয় না। পরমধন সৎকর্মরহিত ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হয় না; পরমধনদাতা হে দেব! পরম-আকাঙক্ষণীয় স্বলোক প্রাপ্তির জন্য আপনার নিকট হতে আমাদের প্রাপ্তব্য যে পরমধন আছে, সেই ধন প্রার্থনাপরায়ণ আমাকে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাকে মোক্ষপ্রাপক পরমধন তথা পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [মোক্ষ বা মুক্তি সৎকর্মসাধনের দ্বারা লাভ করা যায়। যারা সৎকর্মসাধনে পরায়ুখ, অথবা যারা সৎকর্মের বিদ্বেষী, যারা অসার কাৰ্যে অমূল্যজীবন নষ্ট করছে, তারা কখনও পরমসম্পদের অধিকারী হতে পারে না। দুর্বলাত্মগণ, অসৎকর্মান্বিত অথবা সৎকর্মবিহীন ব্যক্তিগণ, কখনও আত্মলাভ করতে পারে না। মন্ত্রে সেই কথাই ব্যক্ত হয়েছে। এর অপর অংশে পরমধনের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। ভগবানই পরমধনদাতা। সেই ধনভাণ্ডার তার সন্তানগণের জন্যই আছে। তাই বলা হয়েছে তুভ্যং দেষ্ণং অর্থাৎ আপনি মানুষকে সে ধন প্রদান করেন। এর দ্বারা মানুষের পরম আকাঙক্ষণীয় মুক্তিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে এবং সেটির নাম– রৌরবম্]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৪– তিম্রো বাচ উদীত গাবো মিমন্তি ধেনবঃ হরিরেতি কনিকদৎ৷৷ ১৷৷ অভি ব্ৰহ্মীরনুষত যীখুঁতস্য মাতরঃ। মর্জয়ন্তীর্দিৰঃ শিশুম্ ৷৷ ২ রায়ঃ সমুদ্রাংশ্চতুররাহম্মুভ্যং সোম আ পবস্ব সহণিঃ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৫– সুতাসসা মধুমত্তমাঃ সোমা ইন্দ্রায় মন্দিনঃ। পবিত্রবন্তো অক্ষর দেবান্ গচ্ছতু বো মদাঃ । ১ ইন্দুরিন্দ্রায় পবত ইতি দেবাসো অব্রুবন্। বাচস্পতিমখস্যতে বিশ্বসেশান ওজসঃ ॥ ২॥ সহস্র ধারঃ পবতে সমুদ্রো বাচমীঙ্খয়ঃ। সোমস্পতী রয়ীণাং সখেন্দ্রস্য দিবেদিবে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৬– পবিত্রং তে বিততং ব্ৰহ্মণস্পতে প্রভুর্গাত্রাণি পর্যেষি বিশ্বতঃ। অতপ্ততদূর্ন তদামো অশ্রুতে শৃতাস ইদ্বন্তঃ সং তদাশত৷৷ ১. তপোষ্পবিত্রং বিততং দিবম্পদেহৰ্চন্তো অস্য তন্তবো ব্যস্থির। অবন্ত্যস্য পবিতারমাশবো দিবঃ পৃষ্ঠমধি রোহন্তি তেজসা৷ ২৷৷ অরূরুচদুষসঃ পৃশ্মিরগ্রিয় উক্ষা মিমেতি ভুবনেষু বাজয়ুঃ। মায়াবিনো মমিরে অস্য মায়য়া নৃচক্ষসঃ পিতরো গর্ভমা দধুঃ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৪সূক্ত/১সাম– ঋক্‌-যজুঃ-সাম মন্ত্রের দ্বারা আমরা প্রার্থনা করছি; তার দ্বারা জ্ঞানকিরণসমূহ আমাদের হৃদয়ে উদ্দীপিত হাৈক; অপিচ, জ্ঞানরশ্মিসমূহ আমাদের চিত্তবৃত্তিকে উদ্বোধিত করুক। পাপহারক সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে আগমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাবসমন্বিত জ্ঞান আমরা যেন লাভ করি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় প্রাচীন ভারতের গার্হস্থ্য এ জীবনের একটি চিত্র অঙ্কিত হয়ে থাকে। ঋষিদের মধ্যে কেউ কেউ বেদগানে দ্যুলোক-ভূলোক পূর্ণ করছেন, — পবিত্র করছেন; কেউ কেউ বা পবিত্র সোমরস প্রস্তুত করছেন এবং তারই অদূরে দাঁড়িয়ে পয়স্বিনী গাভীগণ হাম্বারবে দিক মুখরিত করছে, যেন তারা তাদের অসীম স্নেহের দান গ্রহণ করবার।

জন্য ঋষিবর্গকে আহ্বান করছে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১দ-৫সা) দ্রষ্টব্য]।

১৪/২– ব্রহ্মপরায়ণ কর্তৃক প্রেরিত অর্থাৎ উচ্চারিত মহৎ পবিত্রকারক সত্যের মাতৃস্থানীয় প্রার্থনা স্বর্গজাত দেবভাবকে কামনা করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবৎ-পরায়ণ সাধকগণ দেবভাব প্রার্থনা করেন)। [ভাষ্যকার এবং প্রচলিত ব্যাখ্যাকারগণ সোম পদ অধ্যাহার করায় মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্ধিত হয়েছে। যেমন, — স্তোতা কর্তৃক প্রেরিত যজ্ঞের মাতৃস্বরূপ, বহু স্তুতি উচ্চারিত হচ্ছে। এবং দ্যুলোকের শিশুসদৃশ সোম মার্জিত হচ্ছেন। কিন্তু সোম কিভাবে দুলোকের শিশু হন, তা বুঝতে আমরা অসমর্থ। দেবভাবই স্বর্গজাত, স্বর্গেই বিশুদ্ধ সত্ত্ব বা দেবভাবের জন্ম, সুতরাং দিবঃ শিশুং বলতে স্বৰ্গজাত দেবভাবকেই লক্ষ্য করে, এমন ভাবাই সঙ্গত]।

১৪/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের পরমধন সম্বন্ধীয় চতুঃসমুদ্র অর্থাৎ প্রভূতপরিমাণ পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের প্রমধন প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! ধনসম্বন্ধীয় চারটি সমুদ্রকে চারদিকে হতে আমাদের নিকট আনয়ন করো এবং অপরিমিত অভিলাষসমূহকেও আনয়ন করো। কিন্তু মন্ত্রে কামনা বা অভিলাষের কোন উল্লেখ নেই। সহসিণঃ পদে মন্ত্রের মধ্যে বিবৃত পরমধনকেই লক্ষ্য করছে]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত ছটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম, পাষ্টৌহম, ক্ষুল্লকবৈষ্টম্ভব, সাংহিত, ঐড়সৈঙ্কুক্ষিত, গায়ত্রৌশন, বৈরূপ]।

১৫/১– অমৃতোপম বিশুদ্ধ পরমানন্দদায়ক পবিত্রকারক সত্ত্বভাবসমূহ ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে ক্ষরিত হোন। (ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি)। হে সত্ত্বভাব! আমাদের হৃদয়স্থিত আপনাদের পরমানন্দদায়ক বল ভগবৎ-অভিমুখে ঊর্ধ্বগমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [প্রথমে হৃদয়ে সত্ত্বভাব প্রাপ্তি ও তার পরে ভগবানের চরণ লাভ। সত্ত্বভাবের দ্বারা হৃদয় ভগবানের অভিমুখে পরিচালিত হয়। সেই সত্ত্বরূপ পরম দেবতাও কৃপা করে সাধকের দিকে অগ্রসর হন। ক্ষুদ্র নদীর বৃহৎ সমুদ্রে আত্মসমর্পণের মতো ক্ষুদ্র সত্ত্বভাবকণা বৃহৎ অসীম সত্ত্বসমুদ্রে বিলীন হয়। যার থেকে উৎপত্তি তাতেই বিলয় প্রাপ্ত হয়। এটাই মানুষের– জগতের একমাত্র পরিণতি। প্রথমে হৃদয়ে ভগবনদ্ভক্তির উদ্দীপনা, তারপর তাঁর চরণে আত্মবিলয়। এই মন্ত্রে সাধনা ও সিদ্ধির এই ক্রমেরই অভিব্যক্তি দেখা যায়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৮দ-৩সা) পাওয়া যায়]।

১৫/২– শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য লোকগণের হৃদয়ে সমুদ্ভূত হন– দেবতাভিলাষী সাধকগণ এমন বলেন; সকল শক্তির অধিপতি জ্ঞানাধিপতি দেবতা প্রার্থনাযুক্ত সৎকর্মে সাধকদের প্রবর্তিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই লোকবর্গকে মোক্ষমার্গের অনুসারী করেন)। [যাঁর হৃদয়ে সত্ত্বভাব আবির্ভূত হয়, তিনি অনায়াসেই মোক্ষলাভ করতে পারেন, ভগবানের চরণে পৌঁছাতে সমর্থ হন। দেবত্ব-অভিলাষী ব্যক্তিগণ এই সত্য অবগত আছেন এবং সেই জন্য তারা শুদ্ধসত্ত্ব লাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। কারণ শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই তারা দেবত্বলাভ করতে সমর্থ হন। ভগবান্ মানুষকে যে অনন্ত উন্নতির বীজ দিয়েছেন, যে অনন্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা। না দিয়েছেন, তাই মানুষকে ঊধ্বদিকে নিয়ে যায়। ভগবৎশক্তি মানুষকে মোক্ষমার্গে পরিচালন করে। এ মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশে এটাই বিবৃত হয়েছে]।

 ১৫/৩– সমুদ্রের ন্যায় বহুধারোপেত ভগবৎ-ভক্তিদাতা পরমধন প্রদাতা ভগবৎশক্তি-স্বরূপ সত্ত্বভাব নিত্যকাল আমাদের হৃদয়ে– আবির্ভূত থাকুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা যেন ভগবৎপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– দিন দিন সোম সহস্রধারায় ক্ষরছেন, ইনি সমুদ্রবৎ, এর থেকে বাক্যের ঘূর্তি হয়, ইনি ধনের অধিপতি এবং ইন্দ্রের বন্ধু। এই বঙ্গানুবাদ অনেকটাই ভাষ্যের অনুযায়ী। ভাষ্যকার সমুদ্রং পদে সমুদ্রবন্তি রসঃ, রসস্থানীয়ঃ অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা এখানে সমুদ্র পদের অর্থব্যত্যয় ঘটাবার কোন কারণ খুঁজেপাই না। মনে হয়, সমুদ্রং পদে এখানে সত্ত্বভাবের অসীমত্ব, ও বহুশক্তির প্রতি লক্ষ্য করা হয়েছে। সহস্রধারঃ পদে এই পদেরই সমর্থন করছে। বাচমীঙ্খয়ঃ পদে ভগবৎ-ভক্তিদায়ক অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। সত্ত্বভাবই ভগবানের মঙ্গলময় নীতি অনুসারে জগৎকে পরিচালনা করে। তাই সত্ত্বভাবকে সখেস্য বলা হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দশটি গেয়গান আছে। যথা, –গৌরীবিতম, তৃতস্ত্বাষ্ট্রীসাম, আন্ধীগবম, স্বারত্বাষ্ট্রীসাম ইত্যাদি]।

১৬/১– হে পরমব্রহ্ম! আপনার পবিত্র সত্তা সর্বত্র ব্যাপ্ত আছে; সকলের অধীশ্বর আপনি সর্বতোভাবে আমাদের (অথবা বিশ্ববাসী সকলকে), প্রাপ্ত হোন। (ভাব এই যে, — সকল লোক ভগবানকে প্রাপ্ত হোন)। অপরিপক্কমতি জন শান্তিদায়ক আপনাকে লাভ করে না; সত্যশীল জ্ঞানিগণই আপনাকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্যের দ্বারা জ্ঞানের দ্বারা ভগবৎপ্রাপ্তি হয়)। [এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ভগবান্ যদি সর্বত্র বিদ্যমান থাকেন, তাহলে সকলে তাকে পায় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়– সূর্যকিরণ তো সকল বস্তুর উপরই পতিত হয়, তবে কেবল সূর্যকান্তমণিই সূর্যকিরণের স্পর্শে অগ্নিবিকীরণ করে কেন? ভগবান্ সর্বত্রই বিরাজমান আছেন সত্য, কিন্তু তাকে দর্শন করবার উপযোগী চক্ষু থাকা চাই; তাকে ধারণ করবার উপযোগী হৃদয় থাকা চাই। তবেই তাকে লাভ করা যায়। সকলের সেই চক্ষু বা হৃদয় নেই বলেই তো এই বিশ্বজনীন প্রার্থনা]। [ছন্দার্চিকের ৫অ-৯দ-১২সা দ্রষ্টব্য]।

১৬/২– শত্রুনাশক শুদ্ধসত্ত্বের পবিত্র, দ্যুলোকে বিস্তৃত, অমৃত, সাধকদের হৃদয়ে বর্তমান থাকে; এর দীপ্যমান আশুমুক্তিদায়ক জ্ঞানজ্যোতিঃ সাধকদের সর্ববিপদ হতে রক্ষা করেন। সেই সাধকগণ সেই শক্তির দ্বারা স্বলোক প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা জ্ঞানসমন্বিত মোক্ষপ্রাপক সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হন)। [এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা সম্বন্ধে প্রচলিত ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে নানারকম মতভেদ আছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-উত্তপ্ত সোমরস শোধনের জন্য শোধনযন্ত্র (ছাকুনী) বিস্তারিত আছে। এর প্রতানগুলি (ডাঁটা) অগ্নি-স্থানের উপর নিক্ষিপ্ত হয়ে দীপ্যমানভাবে গগনাভিমুখে যাচ্ছে। তারা চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হয়ে যজ্ঞকর্তা ব্যক্তিকে রক্ষা করেছে। তারা সতেজভাবে আকাশের দিকে উঠছে। ভাষ্যের সাথে ঐ ব্যাখ্যার কোন সাদৃশ্য নেই। শুধু তাই নয়, অধিকাংশস্থলে মূলভাবের সাথেও কোন সামঞ্জস্য লক্ষিত হয় না। বিশেষতঃ, উত্তপ্ত সোমরসমন্ত্রের অন্তর্গত কোনও পদের ব্যাখ্যা হতে পারে, তা খুঁজে পাওয়া যায় না]।

১৬/৩– জ্ঞানোন্মেষিকা দেবীর দিব্যজ্যোতিঃ, জগৎকে উদ্ভাসিত করে; অমৃতবৰ্ষক দেব সমগ্র বিশ্বে অমৃত প্রদান করেন; ভগবানের প্রজ্ঞার দ্বারা আত্মশক্তিকামী প্রজ্ঞাবান্ সাধক সৃষ্ট হন; এবং ভগবানের প্রজ্ঞায় জ্ঞানবান লোকপালক দেবগণ সৃষ্টিকে ধারণ করেন– রক্ষা করেন। (মন্ত্রটি এ নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সর্বময়। তার শক্তির দ্বারা জগৎ সৃষ্ট হয়; ভগবানই, জগৎকে ধারণ করেন এবং রক্ষা করেন)। [মন্ত্রটিতে ভগবানের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভগবানই বিশ্বের উৎপত্তির মূলকারণ, তার থেকেই জগৎ সৃষ্ট হয়েছে, তার শক্তিরবলেই জগৎ বিধৃত ও পরিচালিত হচ্ছে। তার করুণা-বলেই মানুষ জ্ঞানলাভ করে, অমৃত লাভে ধন্য হয়। সাধকেরা তার কৃপাতেই প্রজ্ঞালাভ করেন, আত্মশক্তির অধিকারী হন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, ইনি (সোমরস) প্রভাত কালেই সর্বাগ্রে সূর্যের ন্যায় দীপ্তি পেয়েছেন। ইনি অভিষেককারী অর্থাৎ জলাত্মক। ইনি অন্নবিতরণ কর্তা, এঁর প্রভাবে ভুবন রক্ষা হয়। এঁর অদ্ভুত ক্ষমতা, যখন পূর্বপুরুষদের সমাবৃত করল তখন তারা সন্তান উৎপাদন করলেন, তাঁরা অনেক মনুষ্য সৃষ্টি করলেন। এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যের যথেষ্ট অনৈক্য দৃষ্ট হবে। ভাষ্যকারও মন্ত্রটিকে সোমের মাহাত্ম্যসূচক বলে গ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলেছেন যে, এখানে সোম বলতে সূর্যকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু মূলমন্ত্রে সোমরসের আদৌ কোন উল্লেখ নেই। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে অস্য পদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে সোমস্য। এখানে সোমরসের প্রসঙ্গের অবতারণা করবার কোনও প্রয়োজনই দেখা যায় না। অস্য পদে এখানে ভগবানকেই লক্ষ্য করে। এবং এই অর্থে মন্ত্রে সঙ্গত অর্থ পাওয়া যায়। ভাষ্যকার এখানকার মতো অন্যত্রও, কখনও কখনও, সূর্যাত্মক সোমের উল্লেখ করেছেন। যাই হোক, আমরা দেখলাম, সোম বলতে ভাষ্যকার সর্বত্র সোমরস নামক মাদকদ্রব্যকে বোঝন না। ঋগ্বেদের কোন কোন স্থানে সোমকে চন্দ্র বলা হয়েছে। অথর্ববেদের অনেকস্থলে সোম চন্দ্রের একটি নামান্তর মাত্র। এবং এই জন্য চন্দ্রের অমৃতকিরণ সুধাকর প্রভৃতি নাম হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। চন্দ্রে সোমঅর্থাৎ অমৃত আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, নানারকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সোমের অর্থ দাঁড়িয়েছে– অমৃত। আমাদের ব্যাখ্যাও তাই– অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বরূপ অমৃত]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। যথা– স্বারসাম্, কাষম, পবোবা]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ১৭– প্র মংহিষ্ঠায় গায়তে ঋতারে বৃহতে শুক্ৰশোচিষে। উপস্তুতাসো অগ্নয়ে৷৷ ১৷৷ আ বংসতে মঘবা বীরব যশঃ সমিদ্ধো দ্যুম্নাহুতঃ। কুবিগ্নে অস্য সুমতিৰ্ভবীয়স্যচ্ছা বাজেভিরাগমৎ৷৷ ২৷৷

সূক্ত ১৮– তং তে মদং গৃণীমসি বৃষণং পৃষ্ণুঃ সাসহি। উ লোকতুমদ্রিবো হরিশ্রয়৷ ১৷৷ সামবেদ-সংহিতা যেন জ্যোতীংষ্যায়বে মনবে চ বিবেদিথ। মন্দানো অস্য বহিষো বি রাজসি৷৷ ২৷৷ তদদ্যা চিত্ত উথিনোহনু ষ্টুবন্তি পূর্বথ। বৃষপত্নীরপো জয়া দিবেদিবে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৯– শ্রুধী হবং তিরস্ট্যা ইন্দ্র বস্তু সপতি সুবীর্যস্য গোমতো রায়শ্রুধি মহা অসি৷৷৷৷ যস্ত ইন্দ্র নবীয়সীং গিরং মামজীজন। চিকিত্বিন্মনসং ধিয়ং প্রত্নামৃতস্য পিপুষী৷৷ ২৷৷ তমু ষ্টবাম যং গিরি ইন্দ্রমুথ্যানি বাবৃধুঃ। পুরূণ্যস্য পৌংস্যা সিসন্তো বনামহে৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৭সূক্ত/১সাম– হে অর্চনাকারী আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা হৃদয়ে অধিষ্ঠিত দাতৃশ্রেষ্ঠ, সৎস্বরূপ, ষড়ৈশ্বর্যশালী, দীপ্ততেজঃ সম্পন্ন জ্ঞানদেবতার উদ্দেশে প্রকৃষ্টরূপে স্তব করো– তার অনুসারী হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। এখানে সাধক জ্ঞানার্জনে নিজের চিত্তবৃত্তিগুলিকে উদ্বুদ্ধ করছেন)। [মন্ত্রে জ্ঞানদেবতার স্বরূপ পরিব্যক্ত হয়েছে। জ্ঞানদেব যে সেই সৎ-চিৎ-আনন্দ সৎস্বরূপেরই অংশীভূত, বিশেষণগুলিতে তা-ই প্রকাশ পেয়েছে। জ্ঞানের দাতৃত্ব-শক্তি অপরিসীম। আত্মজ্ঞানসম্পন্ন ভগবৎ-ভক্ত জনের ভগবৎ-প্রাপ্তিই তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। সৎস্বরূপ ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত বলে সৎ-জ্ঞান ভগবৎ-প্রাপ্তির হেতুভূত। যে জ্ঞান ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবানের সাথে আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করায়, তাই ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্ন। সেই জন্যই সৎস্বরূপ জ্ঞানদেব বৃহতে বিশেষণে বিশেষিত। ভাষ্যকার অগ্নি অর্থে কোথাও জ্ঞানদেব লক্ষ্য করেননি। তাই ভাষ্যানুসরণে প্রচলিত বঙ্গানুবাদ দাঁড়িয়েছে– হে স্তোতাগণ! তোমরা সর্বাপেক্ষা দাতা, যজ্ঞবান, বৃহৎ, দীপ্ততেজোবিশিষ্ট অগ্নির উদ্দেশে স্তোত্র পাঠ করো। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ১অ-১২দ-১সা রূপেও দেখা যায়]।

১৭/২– পরমধনসম্পন্ন জ্যোতির্ময় তেজোস্বরূপ আরাধনীয় পরমদেবতা সাধকবর্গকে আত্মশক্তিযুত সৎকর্মসাধনজনিত সুখ্যাতি সম্যকরূপে প্রদান করেন; সেই পরম দেবতার পরমমঙ্গলদায়ক পরাজ্ঞান আত্মশক্তির সাথে আমাদের প্রতি নিত্যকাল আগমন করুক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ সাধকদের পরমধন প্রদান করেন। তিনি কৃপাপূর্বক আমাদের সেই ধন– পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথম অংশে ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। তিনি মানুষকে, — সাধকদের পরমধন প্রদান করে থাকেন। ভগবানের এই করুণার কথা স্মরণ করেই মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়, পাপীতাপী হৃদয়ে শক্তিলাভ করে। ভগবানের করুণার উপর নির্ভর করে মানুষ তার কাছে প্রার্থনায় নিযুক্ত হয়। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে তাই পরমধন পরাজ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রেও অগ্নিসম্বন্ধ এ সূচিত হয়েছে– ধনবান্ অন্নবান্ অগ্নি সসিদ্ধ ও আহুত হয়ে যশস্কর অন্ন প্রদান করেন, তার নূতন অনুগ্রহবুদ্ধি অন্নের সাথে বহুবার আমাদের অভিমুখে আগমন করুক। — আহুতঃ পদে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন অভিমুখ্যেন হুতঃ। কিন্তু আমরা মনে করি আহ্বানার্থক হে ধাতুমূলক এই পদে ভগবানের আহ্বান অর্থাৎ আরাধনাকেই বোঝাচ্ছে]। [এই সূক্তান্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– প্রমংহিষ্ঠীয়ম]।

১৮/১– পাপনাশে বজ্রের ন্যায় পাষাণ কঠোর হে দেব! আপনার অভীষ্টবর্ষক রিপুসংগ্রামের শত্রুজয়কারী লোকসমূহের রক্ষক এবং জ্ঞানভক্তি-সঞ্চারকারী, মোক্ষসাধক সেই পরমানন্দ আমরা প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব.এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের মোক্ষসাধক পরমানন্দ প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রের মধ্যে সেই আনন্দের স্বরূপ ব্যক্ত করা হয়েছে, যে আনন্দ– অভীষ্টবর্ষক। মানুষের চরম অভীষ্ট মুক্তি, মোক্ষ। যিনি পরমানন্দ লাভ করেছেন, তিনি মুক্তির অধিকারী। সুতরাং একদিক দিয়ে মোক্ষ ও আনন্দ অভেদার্থক। ভগবান্ সচ্চিদানন্দ, যিনি কেবলমাত্র আনন্দ স্বরূপের উপাসনায় মুক্তিলাভ করতে চান, তিনি পরমানন্দকেই মুক্তি বলে গ্রহণ করেন। সুতরাং একদিক দিয়ে আনন্দ প্রাপ্তিই মুক্তি। আনন্দ শত্ৰুজয়কারী। যিনি আনন্দ লাভ করেছেন, শত্রু তাঁকে আক্রমণ করবে তো দূরের কথা, শত্রুগণ তার ভয়ে পলায়ন করে। যিনি আনন্দ লাভ করেছেন, জগতে তার ভয় করবার কিছু থাকে না। তার হৃদয়-মন আনন্দে ভরপুর। তার কাছে বৰ্হিজগৎ ও অন্তর্জগৎ আনন্দপূর্ণ]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৪দ-৩সা) প্রাপ্তব্য]।

১৮/২– হে ভগবন! আপনি যে কৃপাবশে আয়ুষ্কামী অর্থাৎ সৎকর্মজনিত দীর্ঘজীবনকামী ॥ সাধককে পরাজ্ঞান প্রদান করেন, সেই কৃপাবশে আপনি সেই সাধকের হৃদয়ের পরমানন্দদায়ক হয়ে বিশেষরূপে বিরাজ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকদের পরাজ্ঞান এবং পরমানন্দ প্রদান করেন)। [যিনি প্রকৃত পক্ষে উন্নত জীবন লাভ করতে চান, তিনি ভগবানের কৃপায় ঊর্ধ্বমার্গে গমন করতে সমর্থ হন। তার হৃদয় জ্ঞানের আলোকে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। সেই আলোকে তিনি নিজের গন্তব্য পথ নিরূপণ করতে সমর্থ হন। হৃদয়ের পরম আনন্দলাভ তার আবির্ভাবেই সম্ভবপর হয়]।

১৮/৩- হে ভগবন! প্রার্থনাপরায়ণ সাধকগণ পূর্বের ন্যায় অদ্যাপি অর্থাৎ নিত্যকাল আপনার প্রসিদ্ধ মাহাত্ম্য বিশেষরূপে প্রখ্যাপন করেন; অভীষ্টদাতা অমৃতপ্রবাহকে আপনি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -সাধকেরা নিত্যকাল ভগবানের মাহাত্ম্য কীর্তন করেন; ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [সাধকেরা ভগবানের মহিমা জীবনে উপলব্ধি করেন, তাই স্বভাবতঃই সেই মহিমা কীর্তনে রত হন। শুধু তাই নয়, ভগবৎ-, মহিমা কীর্তন, শ্রবণ ও আলাপনে মানুষ পবিত্র হয়– মোক্ষপথে অগ্রসর হয়। তাই সাধকদের পক্ষে ভগবানের মহিমা কীর্তনে আত্মনিয়োগ স্বাভাবিক। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের এই অংশের ॥ ব্যাখ্যা বিশেষ পরিবর্তিত হয়নি। তবে মন্ত্রের শেষাংশের জয় পদের ভাষ্যার্থস্বায়ত্ত্বং কুরু– প্রচলিত অনুবাদে অর্থ জয় করো। কিন্তু জয় করার কোন সঙ্গত অর্থ হয় না। অপঃ অর্থাৎ অমৃতপ্রবাহ, আমাদের প্রদান করো এই অর্থেই সঙ্গতি রক্ষিত হয়। ভগবানের অজেয়, অথবা জেতব্য কিছুই নেই; তিনি যা করেন, তা লোকহিতার্থে। এই দৃষ্টিতেই মন্ত্রের পদগুলির ব্যাখ্যা গৃহীত হওয়া ) এ উচিত]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির প্রথম দুটির নাম– হরিবর্ণম, এবং শেষেরটির নাম– সৌভরম]।  

১৯/১–- বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! দিভ্রান্ত (বিপথগামী) আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন; যে জন আপনাকে আরাধনা করে আপনার অনুসরণ করে, আত্মশক্তি এবং পরাজ্ঞান দান করে আপনি তাকে প্রবর্ধিত করেন। আপনি মহান্ হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! এই প্রার্থনাকারী দিগভ্রান্ত আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন]। [সকলের প্রার্থনাই তো তিনি শ্রবণ করেন। তবে আমার সম্বন্ধে বিশেষভাবে উল্লেখ কেন? আমি যে দিগভ্রান্ত পতিত। তাই মনে হয়– আমার প্রার্থনা বুঝি তাঁর কাছে পৌঁছবে না, আমি বুঝি পতিতই থাকব। তাই আমার প্রার্থনা শ্রবণ করবার জন্যই এই প্রার্থনা। — কি আমার প্রার্থনা? আমাকে উদ্ধার করবার জন্য, আমাকে সেই পরমধন দাও– যে ধন পেলে আমি আমার সঠিক গন্তব্য পথে চলতে পারব, আমি আমার চরম লক্ষ্যসাধনের দিকে অগ্রসর হতে পারব। আমাকে পরাজ্ঞান দাও, আমি যেন সেই জ্ঞানালোকের সাহায্যে, এই ঘনান্ধকারের মধ্যে আমার পথ চিনে নিতে পারি, চিরদিনের জন্য যেন আমার ভ্রান্তি টুটে যায়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১২দ-৫সা) প্রাপ্তব্য]।

১৯/২– বলাধিপতি হে দেব (ইন্দ্র)! যে সাধক সর্বকালে আপনার সম্বন্ধীয় আনন্দদায়ক প্রার্থনা উচ্চারণ করেন, সেই সাধককে আপনি সত্যের নিত্য প্রবৃদ্ধ পরাজ্ঞানসম্পন্ন বুদ্ধি প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — ভগবান্ সাধকদের পরাজ্ঞানদায়ক শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি প্রদান করেন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রটিকে প্রার্থনামূলক বলে গ্রহণ করেছেন। তাতে ভাব দাঁড়িয়েছে– হে ইন্দ্র! প্রার্থনাকারী যজমানদের রক্ষার জন্য অতীন্দ্রিয়দর্শিকা বুদ্ধি বা কর্ম করুন। ভাষ্যকার কুরু পদ অধ্যাহার করেছেন। আমরা প্রযচ্ছসি পদ গ্রহণ করেছি। নবীয়সীং পদের ব্যাখ্যায় আমরা সর্বকালং অর্থ গ্রহণ করেছি। অধিকাংশ স্থলেই ভাষ্যের সাথে আমাদের ব্যাখ্যার মূল ভাবগত ঐক্য আছে]।

১৯/৩– যে বলাধিপতি দেবতাকে অর্থাৎ ভগবানকে সাধকগণের স্তুতি ও প্রার্থনা প্রবৃদ্ধ করে, অর্থাৎ যাঁর মহিমা প্রখ্যাপন করে, সেই ভগবানকেই যেন আমরা আরাধনা করি; ভগবানের প্রভূতপরিমাণ শক্তি কামনাকারী হয়ে আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সর্বলোকপূজক ভগবানকে আরাধনা করি)। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাষ্য ইত্যাদি প্রচলিত ব্যাখ্যার সাথে আমাদের বিশেষ কোনও অনৈক্য নেই। মন্ত্রে সর্বপোকপূজ্য ভগবানের আরাধনা করবার জন্য আত্ম-উদ্বোধনা আছে। ভাব এই যে, সাধকবর্গ তার আরাধনা করেন। মহাজনদের অনুসৃত পন্থা অবলম্বন করে আমরাও যেন ভগবানের পূজায় ব্রতী হই। শক্তির আধার ভগবান। সুতরাং তার কাছ থেকে মানুষ শক্তিলাভ করতে পারে। তাই বলা হয়েছে– পৌংস্যা সিষাসন্তো অর্থাৎ তার শক্তি কামনা করে যেন আমরা তাঁর পূজা করি। ভগবান বাঞ্ছাকল্পতরু; তিনি অবশ্যই আমাদের কামনা পূর্ণ করবেন। তাই তাঁর চরণেই আমাদের প্রার্থনা নিবেদন করছি। মন্ত্রের মধ্যে এই ভাবই আমরা দেখতে পাই]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের দুটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– তৈরশ্চ্যম এবং বারবন্তীয়ম্]।

চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী