সামবেদ-সংহিতা –- উত্তরার্চিক — প্রথম অধ্যায়

এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্তানুসারে)–১-৩/৮-১০/১৫-১৯, পবমান সোম; ৪/২০/২১/ অগ্নি; ৫ মিত্র ও বরুণ; ৬/১১-১৪/২২/২৩ ইন্দ্র; ৭ ইন্দ্র ও অগ্নি।
ছন্দ– ১-৮/১২
/১৫/২১ গায়ত্রী; ৯/১১/১৪/২০ বৃহতী প্রগাথ; ১০ ত্রিষ্টুপ; ১৩ প্রাগাথ; ১৬/২২ কাকুভ প্রগাথ; ১৭ উষ্ণিক্; ১৮ অনুষ্টুপ; ১৯ জগতী; ২৩ উষ্ণিক, ককুপ, পুর উষ্ণিক৷৷
ঋষি-১ অসিত কাশ্যপ বা দেবল; ২ কশ্যপ মারীচ; ৩ শত বৈখানস আঙ্গিরস; ৪
/২১ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য; ৫ বিশ্বামিত্র গাথিন অথবা জমদগ্নি ভার্গব; ৬ ইরিম্বিঠি কাণ্ব; ৭ বিশ্বামিত্র গাথিন; ৮ অমহীয়ু আঙ্গিরস; ৯ সপ্ত ঋষি (ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, কশ্যপ মারীচ, গৌতম রাহুগণ, অত্রি ভৌম, বিশ্বামিত্র গাথিন, জমদগ্নি ভার্গব এবং বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি); ১০ উশনা কাব্য; ১১ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ১২ বামদেব গৌতম; ১৩ নোধা গৌতম; ১৪ কলি প্রাগাথ; ১৫ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র; ১৬ গৌরবীতি শান্তা; ১৭ অগ্নিচাক্ষুষ; ১৮ আন্ধীগু শ্যাবাশ্বি; ১৯ কবি ভার্গব; ২০ শংযু বার্হস্পত্য; ২২ সৌভরি কাণ্ব; ২৩ নৃমেধ আঙ্গিরস৷৷

প্ৰথম খণ্ড

সূক্ত ১– উপাস্মৈ গায়তা নরঃ পবমানায়েন্দবে। অভি দেবান্ ইয়ক্ষতে৷৷ ১। অভি তে মধুনা পয়োহথবাণণা অশিশ্ৰয়ুঃ। দেবং দেবায় দেবয়ু৷ ২৷৷ স নঃ পর্বস্ব শং গবে শং জনায় শমতে। শং রাজন্নেষধীভ্যঃ ॥৩॥

 সূক্ত ২– দবিদ্যুতত্যা রুচা পরিষ্টোভ্যা কৃপা। সোমাঃ শুকা গবাশিরঃ৷ ১৷ হিব্বানো হেতৃভিহিত আ বাজং বাজ্যক্রমীৎ। সীদন্তো বনুষো যথা৷৷ ২। ঋধসোম স্বস্তয়ে সংজগ্মাননা দিবা কবে। পবস্ব সূর্যো দৃশে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৩– পবমানস তে কবে বাজিৎসর্গা অসৃক্ষত। অর্বন্তো ন শ্ৰবস্যবঃ৷৷ ১। অচ্ছা কোশং মধুশ্চতমসৃং বারে অব্যয়ে। অবাবশন্ত ধীতয়ঃ৷৷ ২৷৷ অচ্ছা সমুদ্রমিন্দবোহস্তং গাবো ন ধেনবঃ। অগ্মমৃতস্য যোনিমা৷৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম–সৎকর্মের নেতা হে মম চিত্তবৃত্তিনিবহ! দেবভাবপ্রাপক, পবিত্রকারক, প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাবলাভের জন্য প্রার্থনা করো। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই)। [চিত্তবৃত্তির সাহায্যেই মানুষ সৎকর্ম বা অসৎকর্ম সম্পাদন করে। যার চিত্তবৃত্তি যেমনভাবে গঠিত, সে সেই অনুরূপ কার্যে প্রবৃত্ত হয়। সৎকর্মের পথে চলবার জন্য বিশুদ্ধ চিত্তবৃত্তিই প্রধান সহায়। তাই চিত্তবৃত্তিকে সৎকর্মের নেতা বলা হয়েছে। আর এই চিত্তবৃত্তি কর্মের নেতা বলেই তাকে উদ্বোধিত করা হয়েছে। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হলেই মানুষ দেবত্ব প্রাপ্ত হয়, পবিত্রতা লাভ করে। এই পবিত্রতা মোক্ষলাভের প্রধান সহায়। তাই মন্ত্রে পবিত্রতার প্রধান কারণস্বরূপ সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। [এই মন্ত্রটি উত্তরার্চিকেরই ২য় অধ্যায়ের ৫ম দশতির ১৮শ সূক্তের ৩য় সাম]।

১/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আত্মমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিগণ দেবভাবযুক্ত, দেবত্বপ্রাপক আপনাকে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য অমৃতের সাথে সংমিশ্রিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাব-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ অমৃত লাভ করেন)। [সত্ত্বভাব হৃদয়ে জাগরিত হলে মানুষ অমৃতের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করে এবং হৃদয়ে দেবভাবের উন্মেষ হওয়ায় দেবতার চরণে আত্মনিবেদন করে। সত্ত্বভাবের সাথে অমৃত প্রাপ্তির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বর্তমান। মানুষ যখন বিশুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারেন, তখন তার পক্ষে অমৃতত্ব লাভ আয়াসসাধ্য হয় না, অর্থাৎ সত্ত্বভাব স্বভাবতঃই অমৃতত্বের পথে মানুষকে পরিচালনা করে। আত্মমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি সেই পন্থাই গ্রহণ করেন]।

১/৩–- হে বিশ্বস্বামিন (অথবা, হে জ্যোতির্ময় দেব! ) আপনি আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন; আপনি আমাদের জ্ঞানলাভের জন্য মঙ্গলকর হোন; বিশ্ববাসী সকলের হিতের জন্য মঙ্গলকর হোন; আর আমাদের পাপ নাশের জন্য মঙ্গলকর হোন এবং মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য মঙ্গলকর হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, –মঙ্গলময় ভগবান্ আমাদের সর্বমঙ্গল সাধন করুন)। [ভগবান্ মঙ্গলময়। তাঁর মঙ্গলময় বিধানে বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বিশ্বের অধীশ্বর, তার বিশ্বমঙ্গলনীতি বশেই জগৎ বিধৃত আছে, ধ্বংস থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তিনি শিবং। তার মঙ্গলময় প্রভাবে মানুষ মঙ্গলের পথে। চরম কল্যাণের পথে পরিচালিত হয়। তাই সেই মঙ্গলময়ের চরণেই প্রার্থনা নিবেদন করা হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি সামের একটি গেয়গান আছে]।

২/১– ভগবানের কৃপায় এবং শক্তিসমন্বিত ঐকান্তিক প্রার্থনায় বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব পরাজ্ঞানযুক্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –ভগবানের কৃপায় সত্ত্বভাবসমন্বিত প্রার্থনাপরায়ণ ব্যক্তি পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [এই মন্ত্রটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যায় সম্পূর্ণ অন্য রূপ পরিগ্রহ করেছে, দেখা যায়। –শুক্লবর্ণ সোমরসসকল অত্যন্ত দীপ্তিশালী রূপ পরিগ্রহ পূর্বক এবং ধারা সহযোগে শব্দ করতে করতে ক্ষীরের সাথে গিয়ে মিলিত হচ্ছে। কিন্তু ভাষ্যকার ও অপর অনুবাদকার যে কৈফিয়ৎ-ই দিন না কেন, শুক্রাঃ পদের অর্থ শ্বেতবর্ণ হলেও, এই শ্বেতবর্ণ অর্থে বিশুদ্ধতাই বোঝায় এবং সোমাঃ কখনই সোমরস (মাদকদ্রব্য) হতে পারে না; কারণ সোমরসকে তো কোথাও শুক্লবর্ণ বলা হয়নি! আসলে, মূলেই গলদ রয়েছে। বেদে উল্লেখিত সোম বলতে কোন মাদক দ্রব্য বোঝায় না। প্রচলিত ব্যাখ্যাকারগণ তাই নানারকম কৈফিয়ৎ দিয়েও সমস্যার সমাধান করতে পারেননি]।

২/২– দুর্বল মানুষ প্রার্থনার দ্বারা যে আত্মশক্তি লাভ করে, পরমশক্তি সম্পন্ন দেবতা প্রীতিযুক্ত এবং হিতকারক হয়ে দুর্বল আমাদের সেই আত্মশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক প্রার্থনাকারী আমাদের আত্মশক্তি প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা উপলক্ষে প্রচলিত ব্যাখ্যাকারদের মধ্যেও অনৈক্য দেখা যায়। আমাদের ব্যাখ্যার সাথেও কারও সম্পূর্ণ মিল হয়নি। প্রচলিত একটি অনুবাদ–যেমন যোদ্ধারা (বিপক্ষদের দর্শন পরিহারের জন্য) বসতে বসতে (গুড়ি মেরে) গিয়ে যুদ্ধে প্রবেশ করে, তেমনই দ্রুতগামী সোমরস সতর্কভাবে যজ্ঞে প্রবেশ করলেন, কারণ যাঁরা তাকে প্রস্তুত করেন তারা তাকে চালিয়ে দিলেন। প্রধানতঃ সীদন্ত বনুষঃ যথা পদ তিনটি থেকেই অনৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভাষ্যেও যুদ্ধের উপমার একটা আভাষ পাওয়া যায়। কিন্তু উপরোক্ত অনুবাদ সেই ক্ষীণ আভাষকে অনেক দূর অতিক্রম করে গিয়েছে। অথচ তাদের ব্যাখ্যা মতোই সোমরসের কল্পনা করলেও, সেই সোমরস কার সাথে কেমনভাবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন, তার কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। তারপর ঐ ব্যাখ্যায় দ্রুতগামী এবং সতর্কভাবে পদ দুটি কোথা থেকে এল, তা-ও বোঝা যায় না। প্রকৃতপক্ষে, এত কষ্টকল্পনার কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না। দুর্বল মানুষ ভগবানের কাছে শক্তি প্রার্থনা করছেন–এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত অর্থ। বনুষঃ এবং অক্রমীৎ পদ দুটি একবচনান্ত। তাই বনুষঃ পদের বিশেষণে সীদন্তঃ পদের একবচনান্ত অর্থ করাই সঙ্গত]।

২/৩–সর্বজ্ঞ হে শুদ্ধসত্ত্ব! স্বতন্ত্র (অথবা দীপ্তিমান) সর্বত্র বিদ্যমান পরমজ্যোতির্ময় আপনি আমাদের দিব্যদৃষ্টি লাভের জন্য এবং পরম কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য ভগবানের নিকট হতে আগমন করে আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন পরমকল্যাণদায়ক সত্ত্বভাব লাভ করতে পারি)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলি অনেকস্থলে ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রকৃত অর্থে-ভগবানের নিকট হতেই সত্ত্বভাব আসে। সেই সত্ত্বভাব লাভ করলে মানুষের দিব্যভাব বিকশিত হয়, পরম কল্যাণের পথে মানুষ অগ্রসর হয়। মন্ত্রে সত্ত্বভাবের এই মাহাত্ম্য কীর্তন ও তা প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্র গ্রথিত একটি গেয়গান আছে]।

৩/১– সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিসম্পন্ন হে দেব! আত্মশক্তিকামী সৎকর্মসাধকগণ যেমন তাদের হৃদয়ে অমৃতধারা সৃজন করেন, তেমনই পবিত্রকারক আপনার অমৃতধারা আপনি আমাদের হৃদয়ে উৎপাদন। করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃতত্ব প্রদান করুন)। অথবা সর্ব সর্বশক্তিম হে দেব! আত্মশক্তিকামী পাপী যেমন পাপমার্গ পরিত্যাগ করে, তেমন আপনি পবিত্রকার আপনার অমৃতের ধারা পরিত্যাগ করুন অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [এখানে দুটি ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে; দুরকম অন্বয়ে দুরকম অনুবাদেই মূলভাব এক। দুটিতেই সত্ত্বভাব লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যভাব পরিদৃষ্ট হয়। যেমন, হে সৎকর্মশীল বলশালী সোম! যখন তুমি ক্ষরিত হও, তখন তোমার ধারাগুলি এমনভাবে প্রবাহিত হতে থাকে, যেমন, ঘোটকগণ অন্ন-আহরণ করবার অভিপ্রায়ে ধাবিত হয়ে থাকে। এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যেরও ঐক্য নেই। যেমন, -…… ঘোটকগণ অন্ন-আহরণ………ধাবিত হয়ে থাকে অর্থ ভাষ্যানুগত নয়, সঙ্গতও নয়]।

৩/২– ধীসম্পন্নব্যক্তিগণ অমৃতপ্রবাহ তাদের হৃদয়ে কামনা করেন; তাঁরা নিত্যজ্ঞান লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা অমৃত এবং পরাজ্ঞান লাভ করেন। যাঁরা বুদ্ধিমান তাঁরাই মঙ্গলের পথে নিজেকে পরিচালনা করেন। তাদের হৃদয়ে অমৃতের আকাঙ্ক্ষা জাগরিত হয়, এবং সেই আকাঙ্ক্ষাকে তারা পূর্ণ করবার উপায় অবলম্বন করেন। নিজেকে সৎকর্মে নিয়োজিত করেন, সৎপথে চলেন, সৎ-চিন্তায় নিজের হৃদয়কে মনকে পবিত্র করেন। সুতরাং তাদের সেই পবিত্র হৃদয়ে পরাজ্ঞানের উদয় হয়। যিনি যেমন ভাবে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করেন, তার হৃদয়ে যে আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়, সেই আকাঙ্ক্ষা বিশ্বের মূলনীতির বিরোধী না হলে ভগবান্ তা পূর্ণ করেন। যাঁরা সাধক, যাঁরা জ্ঞানী, তারা চরম মঙ্গলজনক অমৃত প্রার্থনা করেন এবং ভগবানের কৃপায় তা প্রাপ্ত হন। মন্ত্রে এই সত্যই প্রখ্যাপিত হয়েছে।

৩/৩– জ্ঞানপ্রবাহ যেমন অমৃতসমুদ্রকে প্রাপ্ত হয়, এবং জ্ঞান যেমন সাধকের হৃদয়কে প্রাপ্ত হয়, তেমন সত্ত্বভার আমাদের হৃদয়ে আগমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করতে পারি)। [এই মন্ত্রের মধ্যে দুটি উপমা পরিদৃষ্ট হয়। গাবঃ এবং ধেনবঃ পদ দুটি একার্থক। সুতরাং গাবঃ ন ধেনবঃ পদে একটি মাত্র উপমা বোঝায় না। ভাষ্যকার ঐ পদগুলির দ্বারা একটি উপমা প্রকাশ করতে গিয়ে কষ্ট কল্পনার অবতারণা করেছেন। কিন্তু গাবঃ ন এবং ধেনবঃ ন এই দুটি উপমা স্বীকার করলে এত কষ্টকল্পনার প্রয়োজন হয় না। সাধক নিজের হৃদয়ে সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করছেন এবং সেই প্রাপ্তির স্বরূপ বোঝাবার জন্য দুটি উপমা ব্যবহার করেছেন। জ্ঞান প্রবাহ যেমন অমৃত সমূহকে প্রাপ্ত হয়–এটি জ্ঞান ধারার স্বাভাবিক পরিণতি। সেই জ্ঞানধারা সাধকের হৃদয়কেও শীতল ও সরস করে। তাই যাতে প্রার্থনাকারীর হৃদয়ে এই উভয় ভাবের মিলন হতে পারে, তিনি সেই জন্যই প্রার্থনা করেছেন। অর্থাৎ স্বাভাবিক পরিণতিবশেই জ্ঞান যেন তার হৃদয়ে উপজিত হয়। মন্ত্রে এই প্রার্থনাই দেখা যায়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি সামমন্ত্রের একটি গেয়গান আছে]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৪– অগ্ন আ যাহি বীতয়ে গৃণানো হব্যদাতয়ে। নি হোতা সৎসি বহিষি৷৷ ১৷৷ তং ত্বা সমিদ্ভিাঙ্গিরো ঘৃতেন বর্ধয়ামসি। বৃহচ্ছোচা যবিষ্ঠয়৷ ২৷ স নঃ পৃথু শ্ৰবায্যমচ্ছা দেব বিবাসসি। বৃহদগ্নে সুবীর্য৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৫– আ নো মিত্রাবরুণা ঘৃতৈর্গন্যূতিমুক্ষতম্। মধ্বা রজাংসি সুক্ৰতু। ১৷ উরুশংসা নমোবৃধা মহা দক্ষস্য রাজথঃ। দ্রাঘিষ্ঠাভিঃ শুচিতা৷ ২৷৷ গৃণানা জমদগ্নিনা যোনাবৃতস্য সীদতম্। পাতং সোমমৃতাবৃধা৷৷ ৩৷

সূক্ত ৬– আ যাহি সুষুমা হি ত ইন্দ্র সোমং পিবা ইমম্। এদং বহিঃ সদো মম। ১৷৷ আ জ্বা ব্রহ্মযুজা হরী বহতামিন্দ্র কেশিনা। উপ বহ্মাণি নঃ শৃণু৷৷ ২৷৷ ব্ৰহ্মাণস্থা যুজা বয়ং সোমপামিন্দ্র সোমিনঃ। সুতাবন্তো হবামহে৷৷ ৩৷

সূক্ত ৭– ইন্দ্রাগ্নী আ গতং সুতং গীভির্নভো বরেণ্য। অস্য পাতং ধিয়েষিতা৷ ১৷ ইন্দ্রাগ্নী জরিতুঃ সচা যজ্ঞো জিগাতি চেতনঃ। অয়া পাতমিমং সুত৷ ২৷৷  ইন্দ্ৰমগিং কবিচ্ছদা যজ্ঞস্য জুতা বৃণে। তা সোমস্যেহ তৃম্পতা৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৪সূক্ত/১সাম– অঙ্গনাদিগুণবিশিষ্ট সর্বব্যাপি হে জ্ঞানদেব! আমাদের কর্তৃক স্তুত হয়ে অর্থাৎ অনুসৃত হয়ে যজ্ঞংশগ্রহণের নিমিত্ত–আমাদের কর্মের সাথে মিলনের জন্য অর্থাৎ আমাদের কর্মসকলকে জ্ঞানসমন্বিত করবার জন্য অর্থাৎ আমাদের কর্মসকলকে দেবভাব-সমন্বিত করবার জন্য, আপনি আগমন করুন–আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন; দেবগণের অর্থাৎ দেবভাবসমূহের আহ্বতা হয়ে, বিস্তীর্ণদর্ভেঅর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে বা কর্মে উপবেশন করুন অবস্থান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনি সর্বব্যাপী; আমাদের মধ্যে প্রকটিত হোন; আমাদের দেবভাবসমন্বিত করুন)। [বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নভাবে সব সামমন্ত্রেরই ব্যাখ্যা হতে পারে। কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান এই তিন ভাব, ব্যষ্টিভাবে ও সমষ্টিভাবে প্রতি মন্ত্রে ব্যক্ত করা যায়। আবার সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক–এই তিন ভাবও পৃথক ভাবে এবং একযোগে প্রতি মন্ত্রে প্রকাশ পেতে পারে। –তিন শ্রেণীর লোক সাধারণতঃ তিন ভাবে এই মন্ত্রের মর্ম গ্রহণ করতে পারেন। কেউ মনে করতে পারেন, অগ্নি একজন ঋষি ছিলেন; দেবগণের কাছে তার গতিবিধি ছিল; তাঁকে হোতৃপদে বরণ করলে তাঁর দ্বারা যজমানের প্রার্থনা দেবসমীপে পৌঁছাতে পারত। কোনও রাজার সাথে বা কোনও বড়লোকের সাথে পরিচিত হতে হলে এবং তার অনুগ্রহ পেতে হলে, সময় সময় যেমন একজন মধ্যস্থের প্রয়োজন হয়, অগ্নিদেব যেন সেই মধ্যস্থ-স্থানীয় ছিলেন। মন্ত্রে তাই তার উপাসনা। — সাধারণ যাজ্ঞিকগণ মনে করতে পারেন, তাঁদের সামনে যে প্রজ্বলিত হোমাগ্নিকুণ্ড, তারই মধ্যে অগ্নিদেবের অধিষ্ঠান হয়েছে; ঐ অগ্নিদেব পৌঁছিয়ে দেবেন। এ ক্ষেত্রে অগ্নিদেব যে কখনও মূর্তিমান প্রকাশ পেয়েছিলেন, তা অনুভব করে নিতে হয়। কারণ, তাঁর সেই প্রকাশের বিষয় পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্রগ্রন্থে লিখিত থাকলেও কলির মানুষ কেউ দেখেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং সে ভাব অনুভাবনার বিষয় মাত্র। অন্য এক শ্রেণীর সাধক অগ্নিদেবকে আর এক মূর্তিতে দর্শন করে থাকেন। সায়ণ যে অগ্নে শব্দের প্রতিবাক্যে অঙ্গনাদিগুণবিশিষ্ট পদ প্রয়োগ করে গেছেন, তাদের অনুভাবনায় ঐ অর্থের সার্থকতা উপলব্ধ হয়। তারা দেখতে পান, বুঝতে পারেন–সত্যই অগ্নিদেব অঙ্গনাদিগুণবিশিষ্ট। যিনি সর্বত্রগতিশীল, অর্থাৎ যাঁতে সর্বব্যাপকত্ব ভাব আসে, ঐ পদে তাকেই বুঝতে পারা যায়। জ্যোতিরূপে, তেজোরূপে, অগ্নিরূপে প্রকাশমান ভগবৎ বিভূতি যে সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে, সে দৃষ্টিতে তা-ই প্রতিপন্ন হয়। বিতয়ে পদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম অর্থ দাঁড়িয়ে যায়। মনুষ্যভাবে ভাবতে গেলে, সুভোজ্য সুপেয় আহারের বিষয় মনে আসে; যজ্ঞপক্ষে দেখতে গেলে, চরুপুরোডাশ ইত্যাদি ভক্ষণের ভাব মনে উদয় হয়; আবার অন্য স্তরের সাধকের লক্ষ্য অনুধাবন করতে গেলে, বুঝতে পারা যায়, তাদের ভক্তিসুধা পান করবার জন্য যেন তারা ভগবানকে আহবান করছেন। এ পক্ষে আমাদের ভাব এই যে, কর্মসকলকে জ্ঞানসমন্বিত করার আকাঙ্ক্ষাই এখানে প্রকাশ পাচ্ছে। হব্যদাতয়ে পদেও ঐরকম নানা ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। প্রথম পক্ষের সম্বন্ধে মনুষ্যরূপ বা ঋষিরূপ দেবমধ্যস্থকারীকে পূজোপহার প্রদান অর্থ সূচিত করে। যাজ্ঞিক বিশ্বাস করেন, তার প্রদত্ত আহ্বানীয় দ্রব্যাদি অগ্নিমুখেই দেবসমীপে সংবাহিত হচ্ছে। তৃতীয় স্তরের সাধক বুঝছেন, –ভগবানের অনুগ্রহের উপর সবই নির্ভর করছে। আমরা যে দেবতার উদ্দেশে হবিষ্য ইত্যাদি প্রদান করি, সে সামগ্রীর গ্রহণ ইত্যাদির কর্তাও তিনি, প্রদানের কর্তাও তিনি। অতএব নির্ভর তাঁরই উপর। তিনি এসে যদি হোতৃরূপে যজ্ঞস্থলে উপবেশন করেন এবং যজ্ঞভাগ গ্রহণ করেন;, তা হলেও সঙ্কল্প সিদ্ধ হয়। তিনি ভিন্ন হোতাও কেউ নেই, হবিঃ-দানকর্তাও কেউ নেই। তাই দীনতা জানিয়ে সাধক যেন বলছেন –হে দেব! এস; আমার হৃদয়-রূপ যজ্ঞক্ষেত্রে আসন গ্রহণ করো;; আর আমার হৃদয়-সঞ্জাত ভক্তিসুধা গ্রহণ করে আমায় কৃতকৃতার্থ করো। জানি, তুমি এক, তুমিই অনন্ত। কিন্তু দেখতে পাই, তুমি অসংখ্য অনন্ত রূপে বিরাজমান। তাই এক ভেবেও পূজা করছি। আবার বহু পূজাও তুমি প্রাপ্ত হও। নির্ভর তোমার উপর। হৃদয়ে সৎ-গুণ ও সৎ-ভাবরূপ কুশ আসন আস্তীর্ণ করে রেখেছি। এস, তার উপরে উপবেশন করো। –বহিষি নিসৎসি পদদুটিতে, সাধারণ দৃষ্টিতে কুশ-আসনে উপবেশন; যজ্ঞপক্ষে মানসনেত্রে বক্ষস্থলে কুশ-আসনে উপবেশন, দর্শন; এবং সাধনার পক্ষে হৃদয়দেশে সৎবৃত্তির মধ্যে ওতঃপ্রোতঃ অবস্থান বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিভিন্ন ভাব গ্রহণ করতে পারেন। আমাদের ব্যাখ্যার নিগূঢ় তাৎপর্য এই যে, কর্মকে জ্ঞানসমন্বিত বা দেবভাবমণ্ডিত করবার কামনাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের প্রথম অধ্যায়ের (আগ্নেয়পর্বের) প্রথমেই আছে, অর্থাৎ এটি সামবেদের প্রথম মন্ত্র। উত্তরার্চিকে এই খণ্ডের দ্বাদশটি মন্ত্রের কোন গেয়গান নেই]।

৪/২– জ্যোতির্ময় হে দেব! প্রসিদ্ধ আপনাকে আমরা সৎকর্মসাধনের দ্বারা আমাদের হৃদয়ে যেন সম্যকরূপে প্রাপ্ত হই; নবজীবনপ্রদাতঃ হে দেব! আপনি অমৃতের সাথে সর্বতোভাবে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মপরায়ণ হই; ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [দুভাগে বিভক্ত এই মন্ত্রটির উভয় অংশেই ভগবৎপ্রাপ্তির জুন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথম প্রার্থনাটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। সৎকর্মসাধনের দ্বারা হৃদয়-মন পবিত্র হলে সেই বিশুদ্ধ হৃদয়ে ভগবানের আবির্ভাব হয়। তাই বলা হয়েছে যে, আমরা যেন সৎকর্মসাধনে সমর্থ হই এবং তার দ্বারা যেন আমাদের হৃদয়ে ভগবানের আসন প্রস্তুত করতে পারি। কিন্তু মানুষের ইচ্ছা দ্বারাই সকল কার্য সম্পাদন হয় না। তার জন্য তার কৃপা চাই। সেই কৃপা লাভের জন্য, মন্ত্রের শেষাংশে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এটি শুক্লযজুর্বেদের তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় কণ্ডিকাতেও আছে]।

৪/৩–হে জ্ঞানদেব! আপনি মহৎ আকাঙক্ষণীয় আত্মশক্তিকারক প্রভূত পরিমাণ পরমধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–হে দেব অগ্নি! তুমি আমাদের প্রশস্ত পুত্রপৌত্রাদি সহকারে বিপুল উৎকৃষ্ট ধন প্রদান করো। মূলমন্ত্রে পুত্রপৌত্রাদির কোন উল্লেখ নেই। –মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৫/১–শোভনকর্মযুক্ত (সৎকর্মপ্রাপক) হে মিত্রবরুণ দেবতাদ্বয়! (মিত্রস্থানীয় আর অভীষ্টপূরক সেই দেবদ্বয়) আমাদের জ্ঞানমার্গকে অথবা নিবাসস্থানকে শুদ্ধসত্ত্বের অথবা ভক্তিরসের দ্বারা সর্বতোভাবে সিঞ্চন করুন; আর রজোভাবসমূহকে অথবা পারলৌকিক আবাসস্থানসমূহকে অমৃতের দ্বারা (মধুর রসের দ্বারা) অভিসিঞ্চন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! মিত্ররূপে করুণাবারিবর্ষণের দ্বারা ইহলোক ও পরলোকে আমাদের শান্তি দান করুন)। [এই মন্ত্রের মিত্র ও বরুণ যুগ্ম দেবতার সম্বোধন পরিদৃষ্ট হয়। দেবতা মিত্র; দেবতা বরুণ। ভাব এই যে, -দেবতা মিত্ররূপে আসুন–দেবতা অভীষ্টপূরক হোন। (মিত্র বা বরুণ স্বতন্ত্র দুই দেবতা নন। মানুষের কাছে এ মিত্ররূপে আবির্ভূত বা মানুষের অভীষ্টপূরণকারী রূপে আবির্ভূত সেই এক ও অদ্বিতীয় ভগবানেরই দুই বিভূতি)। তিনি কেমন? না–শোভন-কর্মকারী বা সুকর্ম প্রাপক। অর্থাৎ সেই মিত্র-বরুণ নামধারী, ঈশ্বরীয় বিভূতি সৎকর্মের নিয়ন্তা। এখন, তাঁদের কাছে কোন সামগ্রী প্রার্থনা করা হচ্ছে? প্রথমে বলা হয়েছে–নঃ গদ্যুতিং ঘৃতৈঃ আ উক্ষত। তার পর বলা হয়েছে, –রক্ষাংসি মধ্ব উক্ষতং। প্রার্থনা–বিবিধ সামগ্রী। কিন্তু প্রচলিত অর্থসমূহে প্রার্থিতব্য সেই সামগ্ৰী অতি হেয় সামগ্রীর মধ্যেই পরিগণিত হয়ে আছে। কেন না গোব্যুতিংপদে সাধারণতঃ গবাং মার্গং গোনিবাসস্থানংঅর্থাৎ গাভী চলাচলের পথ বা গরুর গৃহ (গোয়াল) অর্থ গ্রহণ করা হয়। গরুর পথকে বা গরুর গৃহকে ঘৃতের দ্বারা সিঞ্চিত করো-মন্ত্রের প্রথমাংশে এই অর্থই সিদ্ধ হয়। যদিও তা নিরর্থক, কিন্তু তা থেকে ভাব গ্রহণ করা হয়ে থাকে, –আমাদের দুগ্ধবতী গাভীদান করুন। তার পর রজাংসি পদে পরলোক সংক্রান্ত বাসস্থানসমূহ অর্থ গ্রহণ করে সেই বাসস্থানকে দুগ্ধের দ্বারা (মধ্ব) সেচন করা হোক– এইরকম প্রার্থনা প্রকাশ পায়। এইভাবে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে, -হে মিত্র-বরুণ দেবদ্বয়! তোমরা আমাদের কতকগুলি গাভী দান করো। আর, আমাদের পরলোকের আবাসস্থানসকল যেন দুগ্ধ দ্বারা সিঞ্চিত হয়, অর্থাৎ সেখানে গিয়েও যেন পর্যাপ্ত দুগ্ধ প্রাপ্ত হই। –যার যতটুকু আকাঙ্ক্ষা, বেদমন্ত্র তার পক্ষে ততটুকু সামগ্রী প্রদানের ভাব দ্যোতনা করে। তাই, পক্ষান্তরে দেখতে গেলে এই মন্ত্রে পরমার্থের পরমতত্ত্বেরও সন্ধান প্রাপ্ত হই। গোব্যুতিং পদে দুরকম অর্থ গ্রহণ করতে পারি। জ্ঞানমার্গ অথবা নির্বাণস্থান এই দুই অর্থ ঐ পদে প্রাপ্ত হওয়া যায়। ঘৃতৈঃ পদে শুদ্ধসত্ত্বসমূহের দ্বারা অথবা ভক্তিরসের দ্বারা অর্থ এসে থাকে। তাহলে এই মন্ত্রের প্রথমাংশের, ন থেকে উক্ষতং, প্রভৃতি পদ কয়েকটির প্রার্থনার মর্ম এই দাঁড়ায় যে, হে দেবগণ! আমাদের জ্ঞানমার্গ ভক্তিরসের দ্বারা আর্দ্র হোক; অর্থাৎ, আমরা যেন শুষ্ক জ্ঞানের বৃথা বিতর্কে কালাতিপাত না করি। আর এক অর্থে–আমাদের নিবাসস্থানকে অর্থাৎ এই পৃথীলোককে শুদ্ধসত্ত্বসমূহের দ্বারা সিঞ্চিত করুন; ইহলোকে যেন আর অসতের প্রাধান্য পাপের প্রকোপ বৃদ্ধি না পায়, সকলেই যেন সত্ত্বসম্পন্ন হয়। ফলতঃ মন্ত্রের প্রথমাংশের প্রার্থনায় ঐ দুই সুষ্ঠুভাবই সঙ্গত হয়। মন্ত্রের রজাংসি পদে রজোভাবসমূহ অথবা পারলৌকিক অবস্থানসমূহ অর্থ গ্রহণ করতে পারি। সে পক্ষে মধ্বা পদে মধুররসের দ্বারা বাঅমৃতের দ্বারা অর্থ গ্রহণ করা যায়। মানুষের রজোভাব নাশ করার পক্ষে মধুররসের একান্ত আবশ্যক। আবার পারলৌকিক আবাসস্থানে অমৃতই পরম বাঞ্ছনীয়। স্বর্গ ইত্যাদির পর যে মোক্ষের স্থান, সেই স্থান পাবার কামনাই রজাংসি মধ্বা সিঞ্চতং বাক্যে প্রকাশ পায়। এইসব বিষয় বিবেচনা করলে, এই মন্ত্রে ইহলোকে ও পরলোকে শক্তিলাভের প্রার্থনাই প্রকাশ পেয়েছে, বুঝতে পারা যায়] [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ২অ-১১দ-৭সা রূপেও পরিদৃষ্ট হয়]।

৫/২– পবিত্রকারক হে দেবদ্বয়! পরম মহিমান্বিত, প্রভূত প্রার্থনার দ্বারা আরাধনীয় আপনারা আত্মশক্তির মহত্ত্বে বিরাজ করেন (অথবা বিশ্বের প্রভু হন)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ সকলের আরাধিত পরম-শক্তিসম্পন্ন বিশ্বস্বামী হন)। [ভগবান্ নিজের মহিমায় নিজে বিরাজ করেন। তিনি শক্তির আধার, তার থেকেই জগৎ শক্তি লাভ করে। জগৎ তাঁর চরণে প্রণত হয়। বিশ্ববাসী নিজের পরম মঙ্গলের জন্য, জীবনের চরম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সেই পরমমহিমাময় দেবতার শরণ গ্রহণ করে। তিনি জগতের মিত্রভূত, এবং মানুষের অভীষ্টবর্ষক। ভগবানের এই দুই স্বরূপকে লক্ষ্য করেই মন্ত্র তাঁর মহিমাখ্যাপন করেছেন। সেই জন্যই দ্বিবচনান্ত পদ ব্যবহৃত না হয়েছে। বস্তুতঃ তিনি একামেবাদ্বিতীয়]।

৫/৩– হে দেবদ্বয়! পরাজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির দ্বারা আরাধিত হয়ে আপনারা তার হৃদয়কে প্রাপ্ত হন; সত্যপ্রাপক হে দেবদ্বয়! আপনারা কৃপাপূর্বক অজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদন করে তা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক সত্ত্বভাব প্রদান করে, আমাদের মোক্ষলাভসমর্থ করুন)। [জ্ঞানীর হৃদয়ই জ্ঞানস্বরূপ ভগবানের নিবাস স্থান। প্রজ্বলিত জ্ঞানাগ্নি সাধকের হৃদয়ের সকল আবর্জনা পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। হৃদয় বিশুদ্ধ ও নির্মল হলেই তাতে ভগবানের ছায়া প্রতিফলিত হয়। বিশুদ্ধ হৃদয় জ্ঞানী সাধক হৃদয়ে ভগবানের আবির্ভাব উপলব্ধি করতে পারেন। মন্ত্রের প্রথমাংশে এই সত্যই প্রখ্যাপিত হয়েছে। কিন্তু যারা জ্ঞানসম্পন্ন নন, যাদের সাধনা ইত্যাদি প্রখর উজ্জ্বল নয়, তাদের উপায় কি? তারা কি চিরদিনই পতিত থাকবে? তারা কি মুক্তি পাবে না? পাবে। তাদের মুক্তির উপায়–ভগবানের কাছে একান্তভাবে প্রার্থনা]।

৬/১– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আমাদের নিকট আগমন করুন। আমরা সত্ত্বদেহ বিশিষ্ট মানুষ (অথবা, আপনার প্রভাবের দ্বারা আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন হতে পারি, তা বিহিত করুন); অতএব জন্মসহজাত এই যে অতি সামান্য শুদ্ধসত্ত্ব আছে, সর্বতোভাবে তা গ্রহণ করুন, এবং আমার এই উপেক্ষিত হৃদয়রূপ দর্ভাসনে আসীন হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাকে সত্ত্বসম্পন্ন করুন এবং আমার এই উপেক্ষিত হৃদয়ে আসন গ্রহণ করুন)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত সুষুমা সোমং এবং বহি –এই তিনটি পদের অর্থ উপলক্ষে মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে আছে। সুষুমা পদে আমরা সোমরস অভিযুত করে রেখেছি –এমন অর্থ গ্রহণ করা হয়। এ অর্থ যে সম্পূর্ণ কষ্টকল্পনাপ্রসূত, তা সহজেই বোঝা যেতে পারে। সোমং পদের সাথে ঐ পদের প্রয়োগ রয়েছে বলেই এখানে অভিষব-ক্রিয়াকে টেনে আনা হয়েছে নচেৎ নির্ঘন্ট নিরুক্ত অনুসারেও ঐ পদের অর্থ সিদ্ধ হয় না; আবার, যুক্তি অনুসারেও ঐ পদের অন্য অর্থ সিদ্ধান্তিত হতে পারে। সুষুমাঃ পদ মনুষ্য নাম মধ্যে নিরুক্তে পঠিত হয়। সে অর্থের অনুসরণ করলে ঐ পদের প্রতিবাক্যে বয়ং মনুষ্যাঃ মরদেহবিশিষ্টাঃ এমন অর্থ গ্রহণ করতে পারি। সোমংপদে যথাপূর্ব শুদ্ধসত্ত্ব অর্থ-ই সঙ্গত হয়। তাহলে প্রার্থনার ভাব পাওয়া যায়–হে ভগবন! আমরা মরদেহধারী, আপনি অশরীরী, সুতরাং আমাদের সাথে আপনার সাক্ষাৎ মিলন সম্ভবপর নয়। আরও, আমরা এমন কোনও সৎকর্ম করতে পারিনি, যার দ্বারা আপনাকে লাভ করতে পারি। তাই প্রার্থনা–জন্মসহজাত স্বতঃসঞ্জাত যে শুদ্ধসত্ত্বটুকু হৃদয়ে আছে, তা আপনি গ্রহণ করুন; আর এই হৃদয়ে এসে সমাসীন হোন। কিন্তু প্রচলিত অর্থের ভাব, -হে ইন্দ্র! তুমি এস। তোমার জন্য সোমরস প্রস্তুত করে রেখেছি। তা পান করো, আর এই কুশের উপর উপবেশন করো। ভাবের যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দাঁড়াল, তার কারণ–মন্ত্রের অন্তর্গত পদ কয়েকটির মর্মপরিগ্রহণেই উপলব্ধ হবে]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৮দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৬/২– বলাধিপতি হে দেব! প্রার্থনাসমন্বিত সুপথপ্রদর্শক পাপহারক ভক্তিজ্ঞান আপনাকে সাধকহৃদয়ে প্রাপ্ত করায়; হে দেব! আমাদের প্রার্থনা, পূজা গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে,– জ্ঞানশক্তিসমন্বিত প্রার্থনার দ্বারা সাধক ভগবানকে প্রাপ্ত হন)। [জ্ঞান ও ভক্তি–এই দুয়ের প্রত্যেকটিই সাধককে মোক্ষমার্গে নিয়ে যেতে পারে। যদি সাধকের হৃদয়ে জ্ঞান ও ভক্তির একত্র মিলন হয় এবং তার উপরে প্রার্থনার সংযোগ ঘটে, তাহলে সাধকের ভগবৎপ্রাপ্তির বিলম্ব হয় না। তাই বলা হয়েছে–প্রার্থনাসমন্বিত ভক্তিজ্ঞান আপনাকে সাধক-হৃদয়কে প্রাপ্ত করায়। ভক্তি ও জ্ঞানই মানুষের মোক্ষমার্গের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্বল। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–হে ইন্দ্র! মন্ত্রদ্বারা যোজিত, কেশরবিশিষ্ট হরিদ্বয় তোমাকে আনয়ন করুক, তুমি (যজ্ঞে) এসে আমাদের স্তোত্র শ্রবণ। করো। –হরী পদে ভাষ্যকার হরণশীলৌ বা অশ্বৌ অর্থ গ্রহণ করেছেন। অন্য একজন ব্যাখ্যাকার উভয়দিক রক্ষা করে পাপনাশক অশ্ব অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অশ্ব হরণশীলঅথবা পাপনাশক অথবা ব্রহ্মযুজ্য হয় কেমন করে? ঐ সব ব্যাখ্যার দ্বারা কি কোন সঙ্গত অর্থ প্রাপ্ত হওয়া যায়? আমরা পূর্বাপরই হরী পদে পাপহারকৌ (পাপহারক দুই শক্তি) অর্থ গ্রহণ করে আসছি। এখানেও ঐ অর্থে সঙ্গতি লক্ষিত হয়। জ্ঞানভক্তিই পাপহারক; হরী পদে জ্ঞান-ভক্তি অথবা জ্ঞান ও সৎকর্মকে লক্ষ্য করে]।

৬/৩– বলাধিপতে হে দেব! প্রার্থনাকারী সত্ত্বভাবকামী আমরা বিশুদ্ধ হৃদয় হয়ে সত্ত্বভাবদাতা আপনাকে যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাদায়ক ভগবানকে আরাধনা করি)। [মন্ত্রটির মধ্যে আত্ম-উদ্বোধনের ভাবও আছে। ভগবানই সত্ত্বভাবের আধার; তার কাছ থেকেই মানুষ সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হয়। তাই, তাকে আরাধনা করা হয়েছে। এবং তার কাছেই প্রার্থনা নিবেদন করা হয়েছে। যারা সত্ত্বভাব পেতে কামনা করেন, তারা সেই কল্পতরুমূলেই কামনা নিবেদন করেন। আর ঐকান্তিকতার সাথে প্রার্থনা করলে তা কখনও বিফল হয় না]।

৭/১– হে বলাধিপতিদেব এবং জ্ঞানদেব! আপনারা সাধকের প্রার্থনার দ্বারা প্রীত হয়ে দ্যুলোক হতে আগমন করেন এবং আত্মশক্তিদ্বারা এর বরণীয় বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব রক্ষা করেন (অথবা গ্রহণ করেন)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান সাধককে সর্বতোভাবে রক্ষা করেন)। [সুতং পদটি দেখেই প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসের সম্বন্ধ কল্পনা করা হয়েছে। যেমন একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–হে ইন্দ্রাগ্নি! তোমরা স্তুতিদ্বারা (আহুত হয়ে) স্বর্গ হতে অভিযুত ও বরণীয় (এই সোমের উদ্দেশে) আগমন করো। আমাদের ভক্তি হেতু আগত হয়ে (এই সোম) পান করো। মূলে সোমরসের উল্লেখ নেই, তা ঐ বঙ্গানুবাদিত ব্যাখ্যার বন্ধনী চিহ্ন থেকেই উপলব্ধ হবে]।

৭/২– হে বলাধিপতি এবং হে জ্ঞানদেব! প্রার্থনাকারীদের মোক্ষলাভে সহায়ভূত, জ্ঞানদায়ক, সৎকর্ম আপনাদের প্রাপ্ত হয়; সাধকের প্রার্থনা দ্বারা আগত হয়ে আপনারা সাধকের হৃদয়স্থিত বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে গ্রহণ করেন (অথবা রক্ষা করেন)। [জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম এই তিন সাধনের উপায়ের মধ্যে যে কোন একটির দ্বারাই ভগবানের সামীপ্য লাভ করা যায়। কর্মের দ্বারা মানুষ হৃদয়কে বিশুদ্ধ করতে পারে। কর্মের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে জ্ঞানের উদয় হয়। জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম পরস্পর অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। সাধক রুচি প্রবৃত্তি ও শক্তি অনুযায়ী যে কোন একটির আশ্রয় গ্রহণ করে সাধনমার্গে অগ্রসর হতে পারেন। ভগবান্ আমাদের হৃদয় দেখেন। সেখানে যে ব্যাকুলতা থাকে, তা-ই সাধকের উন্নতির সহায়ক হয়। সাধক হৃদয়ে ভগবানের যে সাড়া পান, তা-ই তাকে মোক্ষমার্গে পরিচালিত করে]।

৭/৩– সাধকবর্গের মোক্ষদাতা বলাধিপতি দেব এবং জ্ঞানদেবকে আমি আরাধনা করছি; তাঁরা সৎকর্মের সাধনভূত আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবের দ্বারা তৃপ্ত হোন। (প্রার্থনার অন্তর্নিহিত ভাব এই যে, আমাদের সৎকর্মের দ্বারা প্রীত হয়ে ভগবান্ আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন)। [আমরা দুর্বল, আমরা অক্ষম। আমাদের জন্মসহজাত তারই দেওয়া যে সত্ত্বভাব রয়েছে, তা-ই আমাদের সকর্মে এ প্রেরণা দেয়। তারই দেওয়া সেই উপহারে তাকেই অর্ঘ্য প্রদান করছি। তাই তিনি গ্রহণ করুন, ৭ ম তাতেই তিনি তৃপ্ত হয়ে যেন আমাদের পরম ধন মোক্ষ প্রদান করেন]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৮– উচ্চা তে জাতমন্ধস্যে দিবি সদ ভূম্যাদদে। উগ্রং শর্ম মহি শ্ৰবঃ ৷৷ ১৷ : স ন ইন্দ্রায় যজ্যবে বরুণায় মরুভ্যঃবরিবোবিৎ পরিস্ৰব৷ ২৷৷ এনা বিশ্বানার্য আ দুমানি মানুষাণাম্। সিষাসন্তো বনামহে৷৷ ৩৷

 সূক্ত ৯– পুনানঃ সোম ধারয়াপো বসানো অসি৷ আ রত্নধা যযানিমৃতস্য সীদ্যুৎসো দেবো হিরণ্যয়ঃ ১। দুহান ঊধর্দিবং মধু প্রিয়ং প্রত্নং সধস্থমাসদৎ। আপৃচ্ছ্যং ধরুণ বাজ্যৰ্ষসি নৃভিধোতো বিচক্ষণঃ৷৷ ২৷৷

 সূক্ত ১০– প্র তু দ্রব পরি কোশং নি যীদ নৃভিঃ পুনাননা অভি বাজমর্ষ। অশ্বং ন ত্বা বাজিনং মর্জয়ন্তোহচ্ছা বহী রশনাভির্নয়ন্তি৷৷৷৷ স্বায়ুধঃ পবতে দেব ইন্দুরশস্তিহা বৃজনা রক্ষমাণঃ। পিতা দেবানাং জনিতা সুদক্ষো বিষ্টম্ভো দিবো ধরুণঃ পৃথিব্যাঃ ২৷৷ ঋষিবিপ্রঃ পুরএতা জনানামৃভুর্ধীর উশনা কাব্যেন। স চিদ বিবেদ নিহিতং যদাসামপীচ্যাং গুহ্যং নাম গোনা৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৮সূক্ত/১সাম—হে শুদ্ধসত্ত্ব! স্বর্গলোকে তোমার সম্বন্ধীয় রসের জন্ম; অর্থাৎ সত্ত্বভাব দেবলোকজাত; স্বলোকে অবস্থিত হয়ে আমাদের ন্যায় পাপীবর্গকে তেজোময় কল্যাণ এবং মহতী শক্তি প্রদান করো। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরমকল্যাণ লাভের জন্য আমরা যেন সত্ত্বভাবপূর্ণ হই)। [সত্ত্বভাব দেবতার করুণাধারারূপে পৃথিবীর মানুষের মস্তকে নেমে আসে। দেবতার ধন, দেবতাই কৃপা করে মানুষকে সেই স্বর্গীয় অমৃতের আস্বাদ দেন। এই মন্ত্রে সত্ত্বভাবকেই সাক্ষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। আমাদের হৃদয় সত্ত্বভাবে পূর্ণ হোক এবং তার আনুসঙ্গিক পরম কল্যাণ আমরা লাভ করি–এটাই প্রার্থনার সারমর্ম। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যায় (ভাষ্যকারের ভাষ্য অনুসারে) সোমরস নামক মাদকদ্রব্যকে সম্বোধন করে মন্ত্রটি উদ্গীত হয়েছে। একটা মাদকদ্রব্য কিভাবে মানুষকে শক্তি ও কল্যাণ দিতে পারে, তা বুঝতে পারা যায় না। শুধু তাই নয়, সোম নামক মাদকদ্রব্য কিভাবে স্বর্গজাত বা দিব্যশক্তিসম্পন্ন হইতে পারে, তাও বোঝা দুষ্কর। আমরা পূর্বাপরই সোম শব্দে সৰ্বভাবঅর্থ গ্রহণ করেছি। এখানেও সোম পদে ঐ অর্থের সার্থকতা পরিলক্ষিত হয়। সত্ত্বভাবই দেবভাব, দিব্যশক্তিসম্পন্ন ও কল্যাণদায়ক। সত্ত্বভাব পরমব্রহ্মেরই শক্তি]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১দ-১সা) প্রাপ্তব্য]। বর্তমান সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত বাইশটি গেয়গান আছে]।

৮/২– পরমধনদাতা হে সত্ত্বভাব! আপনি আমাদের আরাধনীয় বলাধিপতি দেবতাকে, অভীষ্টবর্ষকদেবকে এবং বিবেকরূপী দেবগণকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন)। [ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাবের উপজন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। আরাধনায়, ভগবৎপূজায় প্রধান উপকরণ–হৃদয়ের সত্ত্বভাব। ভগবান মানুষের হৃদয়স্থ, সত্ত্বভার গ্রহণ করেন। অর্থাৎ হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হলে মানুষ ভগবানের চরণে আশ্রয় প্রাপ্ত হন। এই মন্ত্রে বহুদেবতার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। একমেবাদ্বিতীয় পরমদেবতার বহু বিভূতিকেই বিভিন্ন নাম দিয়ে আরাধনা করা হয়। অ নাম অ-রূপ সেই পরমদেবতাকে মানুষ তার সসীম বুদ্ধির দ্বারা আয়ত্ত করতে পারে না। তাই তার যে ভাব, যে বিভূতি সাধকের হৃদয়গত হয়, তিনি সেই ভাবের ভাবুক হয়ে ভগবানের পূজায় রত হন। বস্তুতঃ তার বহুত্ব কল্পনা করা হয়নি। তাঁর যে বিভূতি বলৈশ্বর্যের পরিচায়ক, তাকে ইন্দ্রদেবতা বলে অভিহিত করা হয়। যে ভাবে তিনি সাধকদের অভীষ্টপূর্ণ করেন, সেই ভাবকে বরুণ বলে ডাকা হয়। ভগবানের যে বিভূতি সাধক-হৃদয়ে বিবেকরূপে আবির্ভূত হন, তারা মরুৎ নামে অভিহিত হন। প্রকৃতপক্ষে তিনি এক অদ্বিতীয়, অরূপ–আবার তিনিই বহু, তিনিই নাম-রূপ ধারণ করে জগতে প্রকাশিত হন]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৬অ-১দ-৭সা) প্রাপ্তব্য]। [এই মন্ত্রের পৃথক একটি গেয়গান আছে]।

৮/৩– হে ভগবন! সাধকদের প্রার্থিত সকল জ্ঞান-কামনাকারী প্রার্থনাপরায়ণ আমরা আপনাকে বিশেষরূপে আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান প্রদান করুন)। [সাধকদের প্রার্থিত সকল জ্ঞান যেন আমরা লাভ করতে পারি–এটাই এই মন্ত্রের প্রার্থনার সারমর্ম। সাধকগণ কেমন জ্ঞান কামনা করেন? যাতে ত্রিতাপজ্বালা (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক জ্বালা) থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, যাতে অশান্তি দূরীভূত হয়, তারা এমন জ্ঞানেরই কামনা করেন। সেই জ্ঞান–পরাজ্ঞান। মন্ত্রে এই পরাজ্ঞান লাভের প্রার্থনাই আছে]। [এই মন্ত্রটি. ছন্দার্চিকেও (৬অ-১দ-৮সা) প্রাপ্তব্য। এই মন্ত্রের একটি গেয়গান আছে]।

৯/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক তুমি অমৃত প্রদান করবার জন্য ধারারূপে আমাদের প্রাপ্ত হও; জ্যোতির্ময় লোকের পরম হিতসাধক, শ্রেষ্ঠধনের উৎসস্বরূপ, পরমধনদাতা, সত্যস্বরূপ তুমি, আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –সত্যস্বরূপ পরমধনদাতা সত্ত্বভাবকে আমরা যেন প্রাপ্ত হই)। [মন্ত্রটি দুভাগে বিভক্ত হলেও উভয় ভাগেই সত্ত্বভাব লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলির সাথে শুধু আমাদেরই নয়, ওগুলির একের সাথে অপরেরও যথেষ্ট অনৈক্য দৃষ্ট হয়। যেমন একটি প্রচলি অনুবাদ–হে সোম! তুমি তা শোধিত হতে হতে জলের সাথে মিশ্রিত হয়ে ধারার আকারে যাচ্ছ। হে দেব! তুমি সুবর্ণের  আকরস্বরূপ, তুমি উত্তম বস্তু দেবে বলে যজ্ঞস্থানে উপবেশন করছ। বলা বাহুল্য, এই অনুবাদটি ভাষ্যকারের ব্যাখ্যাকেও অতিক্রম করেছে। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৫দ-১সা) প্রাপ্তব্য]।

৯/২– অমৃতময়, সকলের আনন্দদায়ক, দ্যুলোকজাত, সনাতন, অমৃতদাতা সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক; শক্তিশালী (অথবা শক্তিদায়ক) সর্বদর্শী সত্ত্বভাব সাধকগণকর্তৃক বিশুদ্ধ হয়ে বিশ্বের অবলম্বনভূত বিশ্বরক্ষক ভগবানকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সাধকগণ বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের প্রসাদে ভগবানকে লাভ করেন; আমরা সেই অমৃতদায়ক সত্ত্বভাবকে যেন প্রাপ্ত হই)। [দুটি ভাগে বিভক্ত এই মন্ত্রটির প্রথম ভাগে সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা আছে। এবং দ্বিতীয় ভাগে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত আছে। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব ভগবানের শক্তি। যেখানে শুদ্ধসত্ত্ব দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে ভগবানের বিশেষ আবির্ভাব হয়েছে বলে অবধারণ করা যায়। সাধকগণ তাঁদের সাধনার প্রভাবে হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের উপজন করেন। সুতরাং সেই সত্ত্বভাবের কল্যাণে তারা ভগবৎ-চরণে পৌঁছাতে সমর্থ হন। মন্ত্রের মধ্যে এই সত্যই প্রকটিত হয়েছে। যে বস্তুর সাহায্যে মানুষের চরম কল্যাণ সাধিত হয়, যে পরম ধন লাভ করতে পারলে মানুষের সকল আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়, সেই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য সাধক প্রার্থনা করছেন। –মন্ত্রের অন্তর্গত অসি পদের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার হে সোম পদ অধ্যাহার করেছেন। কিন্তু তাতে মন্ত্রের সঙ্গতি নষ্ট হয়]।

১০/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! শীঘ্র আগমন করুন; এবং আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; সৎকর্মকারীবর্গের দ্বারা পবিত্রতাসম্পন্ন আপনি শক্তি প্রদান করুন; আত্মহৃদয়-পবিত্রকারী সাধকগণ–অশ্বের ন্যায় মার্জনে প্রবৃদ্ধ, শক্তিসম্পন্ন ও পবিত্র আপনাকে প্রার্থনার দ্বারা পূজা করছে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -ভগবান সাধকদের আত্মশক্তি প্রদান করেন, সাধকেরাও ভগবৎপরায়ণ হন)। [মন্ত্রটির প্রথম দুভাগ প্রার্থনা-মূলক এবং শেষাংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপন আছে। ভগবানকে পাবার ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রের প্রার্থনাংশে লক্ষিত হয়। যাদের হৃদয়ে সৎকর্মসাধনের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান আছে, অথচ শক্তির অভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হতে সমর্থ নন, তাদের একমাত্র ভরসা ভগবানের কৃপা। যাদের হৃদয় কলুষিত, অথচ দুর্বলতার জন্য হৃদয়কে পবিত্র করতে পারছে না, ভগবানের করুণাবারিই তাদের একমাত্র সম্বল। তাই ভগবানের সেই কৃপা ও করুণার জন্যই প্রার্থনা। –দ্বিতীয়াংশে সাধকের সাধনার চিরন্তন চিত্র উদঘাটিত হয়েছে। সাধক ভগবৎপরায়ণ হন; সেই চির-পবিত্র সর্বশক্তিমান দেবতার চরণে নিজের প্রার্থনা-পুস্পাঞ্জলি প্রদান করেন। যাঁরা নিজেকে উন্নত করতে চান, তারা ভগবানের চরণেই আশ্রয় গ্রহণ করেন। মন্ত্রে আমরা এই চিত্রই দেখতে পাই]।

১০/২– দ্যুতিমান, অমঙ্গলনাশক, বিপদ হতে রক্ষাকারী, দেবভাবসমূহের জনয়িতা ও পালক, শক্তিসম্পন্ন, দ্যুলোকের ধারণকারী, ভূলোকের রক্ষক, রক্ষাস্ত্রধারী সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরম মঙ্গলদায়ক সত্ত্বভাব লাভ করতে পারি)। [সত্ত্বভাব অমঙ্গলনাশক, বিপদ থেকে রক্ষাকারী। মানুষের সর্বাপেক্ষা অমঙ্গল-পাপের পথে পদার্পণ–অধঃপতন। সর্বাপেক্ষা ভীষণ বিপদ-রিপুর আক্রমণ। কিন্তু যাঁর হৃদয়ে সত্ত্বভাব পূর্ণভাবে বিকশিত হয়, তার এই বিপদের, এই অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে না। তাই সত্ত্বভাব অমঙ্গলনাশক। –সত্ত্বভাবের প্রভাবেই জগৎ সৃষ্ট ও রক্ষিত হচ্ছে। ত্রিগুণের মধ্যে যখন সত্ত্বের প্রাধান্য ঘটে, তখনই জগৎ স্থৈর্যলাভ করে। তাই সত্ত্বভাবকে দ্যুলোক-ভূলোকের ধারণকারী ও রক্ষাকারী এ বলা হয়েছে। সত্ত্বভাব-দেবভাবসমূহের জনয়িতা ও পালক। মানুষের হৃদয়ের সমস্ত সৎ-বৃত্তি সত্ত্বভাবের উপজনের সঙ্গে সঙ্গেই বিকশিত হয় ও স্ফুর্তিলাভ করে। এই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের জন্যই পাপতাপ মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না–আলোকের আগমে অন্ধকারের মতো, মোহ অজ্ঞানতা দূরে পলায়ন করে–সত্ত্বভাবের এই জ্যোতিঃই তার রক্ষাস্ত্র। তাই সত্ত্বভাব রক্ষাস্ত্রধারী]।

১০/৩– যিনি তত্ত্বদর্শী, মেধাবী, ধীমান্ লোকদের সৎকর্মে অধিনায়ক, মোক্ষাভিলাষী সাধক তিনিই জ্ঞানের অন্তর্নিহিত নিগূঢ় দুর্লভ যে অমৃত, তা প্রার্থনার দ্বারা লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -মোক্ষাভিলাষী প্রার্থনাপরায়ণ সাধক অমৃত লাভ করেন)। [মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। কিরকম সাধক অমৃত লাভের অধিকারী, তা-ই মন্ত্রে বিবৃত হয়েছে। অমৃতলাভের জন্য কিরকম কঠোর সাধনার প্রয়োজন, সাধককে কেমন ভাবে নিজের জীবন গঠন করতে হবে, মন্ত্রে তার একটা উজ্জ্বল আভাষ পাওয়া যায়। প্রথমতঃ অমৃতলাভের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা না থাকলে ইষ্টসিদ্ধি হয় না। আবার শুধুমাত্র ব্যাকুলতাটাই যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে অভীষ্ট সাধনের উপযোগী সকর্মেও আত্মনিয়োগ করা চাই। জ্ঞানলাভ করতে হবে বটে, কিন্তু সেই জ্ঞানকে, হৃদয়ে অনুপ্রবিষ্ট করা চাই। শুধু বিদ্যা-অধ্যয়ন প্রভৃতির দ্বারা আত্মলাভ হয় না। অমৃতলাভের জন্য তত্ত্বদর্শী হতে হবে। ধীরভাবে, অন্তরের সমগ্র শক্তির সাথে, ভগবানের নিকট প্রার্থনা করা চাই। –জ্ঞানের মধ্যে যে অমৃত লুক্কায়িত আছে, পাণ্ডিত্যের দ্বারা তা লাভ করা যায় না। যে পর্যন্ত পাণ্ডিত্যের অভিমান থাকে, সেই পর্যন্ত শুধু পাণ্ডিত্যই লাভ হয়, পরাজ্ঞান বা অমৃতত্ব লাভ হয় না। তাই অমৃতকে জ্ঞানের অন্তর্নিহিত নিগূঢ় দুর্লভ বস্তু বলা হয়েছে। সকলের ভাগ্যে এই বস্তুলাভ ঘটে না। যিনি ভগবৎপরায়ণ একনিষ্ঠ-সাধক, সৎকর্ম ও প্রার্থনার বলে তিনিই তা লাভ করতে পারেন। মন্ত্রে এই সত্যই প্রকটিত দেখতে পাওয়া যায়]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১১– অভি ত্বা শূর নোনুমোহদুগ্ধা ইব ধেনবঃ। ঈশানমস্য জগতঃ স্বদৃশমীশানমিন্দ্র তস্তুষঃ ১। ন ত্বাবাঁ অনন্যা দিবো ন পার্থিবো ন জাতো ন জনিষ্যতে। অশ্বায়ন্তো মঘবন্নি বাজিনো গব্যন্তস্তা হবামহে৷৷ ২৷৷

সূক্ত ১২– কয়া নশ্চিত্র. আ ভুবদূতী সদাবৃধঃ সখা। কয়া শবিয়া বৃতা৷ ১। কা সত্যো মদানাং মংহিষ্ঠা মৎসন্ধসঃ। দৃঢ়া চিদারুজে বসু৷ ২। অভী যুণঃ সখীনামবিতা জরিতৃণা। শতং ভবাস্তুতয়ে৷৩৷৷

 সূক্ত ১৩– তং বো দস্মমৃতীযহং বসোর্মন্দানমন্ধসঃ। অভি বৎসং ন স্বসরেষু ধেনব ইন্দ্রং গীর্ডিনুবামহে৷৷ ১৷৷ ক্ষং সুদানুং তবিষীর্ভিরাবৃতং গিরিং ন পুরুভোজস৷ ক্ষুমন্তং বাজং শতিনং সহণিং মক্ষু গোমন্তমীমহে৷৷ ২।

সূক্ত ১৪) তরোভির্বো বিদদ্বসুমিং সবাধ উতয়ে। বৃহদ গায়ন্তঃ সুতসোমে অধূরে হুবে ভরং ন কারিণ৷৷৷৷৷ ন যং দুর্ভা বরন্তে ন স্থিরা মুরো মদেষু শিপ্রমন্ধসঃ। য আদৃতা শশমানায় সুন্বতে দাতা জরিত্র উথ্য৷৷ ২৷

মন্ত্ৰার্থ— ১১সূক্ত/১সাম– শৌর্যসম্পন্ন হে ভগবন ইন্দ্রদেব! দৃশ্যমান জগতের ঈশ্বর এবং স্থাবরের ঈশ্বর সর্বদ্রষ্টা আপনাকে লক্ষ্য করে, ভক্তিসহযুত জ্ঞানিগণের ন্যায় অথবা ভক্তিশূন্য বৃথা তর্কপরায়ণগণের ন্যায়.(অর্থাৎ চার্বাক-ধর্মানুসারিগণের ন্যায়) আমরা আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক। এই মন্ত্রের ভাব এই যে, স্থাবর-জঙ্গমাত্মক চরাচর-বিশ্বের অধিপতি ভগবানকে আরাধনা করতে মূঢ় আমরা সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত অদুগ্ধাঃ ইব ধেনবঃ উপমাংশ বিশেষ সমস্যামূলক। ভাষ্যে এবং প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলিতে এর অর্থ দাঁড়িয়েছে –অকৃতদোহা গাবঃ আদরেণ বৎসান প্রতি হরবং কুবন্তি…..ইত্যাদি। তা থেকে ভাব পরিগৃহীত হয়ে থাকে– সোমরসপূর্ণ চমসের সাথে বিদ্যমান্। দুগ্ধবতী গাভীসকলকে যেমন লোকে আদর করে, সোমরসপূর্ণ চমস-পাত্র-বিশিষ্ট মনুষ্যকে ইন্দ্রদেব তেমন আদর করে থাকেন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে ঐ উপমাংশে এমন ভাবই পরিগৃহীত হতে দেখি। এই অনুসারে এই মন্ত্রের প্রার্থনায় ইন্দ্রদেবকে সম্বোধন-পূর্বক যেন বলা হচ্ছে–হে শূর ইন্দ্র! স্থাবরসমূহের ঈশ্বর এবং জঙ্গমসমূহের ঈশ্বর যে আপনি, সেই আপনার জন্য চমসে সোমরস-রূপ মাদকদ্রব্য প্রস্তুত রেখে আমরা নমস্কার করছি। ভাব এই যে, –আমরা সোমরসের প্রস্তুতকারী; সোমরস প্রস্তুত করে রেখেছি; আপনি এসে তা গ্রহণ করুন। –এই একমাত্র স্থানে আমাদের মতান্তর–অদুগ্ধাঃ ইব ধেনবঃ উপমার অর্থ বিষয়ে। অদুগ্ধাঃ পদে আমরা দুরকম ভাব গ্রহণ করতে পারি। যাতে দুগ্ধ নেই; আবার যাতে দুগ্ধ আছে। সেই অনুসারে এই বাক্যাংশে দুগ্ধবতী ধেনুসমূহের ন্যায় অথবা দুগ্ধহীন গাভীসমূহের মতো দুই অর্থই পেতে পারি। মন্ত্রার্থে সেই দুরকম ভাবেরই সামঞ্জস্য দেখা যায়। তা থেকে দুগ্ধবিশিষ্ট গাভীর মতো আমরা অথবা দুগ্ধশূন্য গাভীর ন্যায় আমরা এই দুরকম অর্থই প্রকাশ পেয়ে থাকে। বুঝে দেখতে হবে–এমন বাক্যের তাৎপর্য কি? সেই তাৎপর্যের অনুসরণেই ভাষ্য ইত্যাদিতে চমসের। র ও সোমরসের প্রসঙ্গ এসে পড়েছে। কিন্তু এমন সামগ্রীর পরিকল্পনা করবার কোনই কারণ দেখা যায় না। দেবতার আরাধনায় বা ভগবানের পূজায়–প্রয়োজন কোন্ সামগ্রীর? হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানসমন্বিতা ভক্তি–তা-ই হবিঃ–তা-ই পূজোপকরণ–তা-ই ভগবানের প্রীতির আস্পদ। এখানে প্রার্থনাকারী বলছেন–অদুগ্ধাঃ ইব ধেনবঃ আমরা। এতে কি ভাব সহসা অন্তরে উপস্থিত হয়? প্রধানতঃ, এখানে দুরকম ভাব অধ্যাহার করা যায়। এক ভাবে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ পায়; অর্থাৎ, অতি-নীচ অতি হেয় আমরা–এই অর্থ ব্যক্ত হয়। অন্য ভাব-ভক্তিযুত জ্ঞানসমন্বিত হয়ে যেন (অর্থাৎ আপনার উপাসনার যোগ্যতা লাভ করে যেন) আমরা আপনার পূজায় ব্রতী হতে পারি–এরকম অর্থও আমনন করা যায়। অতএব এই মন্ত্রার্থে অদুগ্ধাঃ পদে ভক্তিহীন বা ভক্তিযুত এই দুই অবস্থারই পরিকল্পনা করা হয়েছে। ধেনবঃ পদে জ্ঞানরশ্মিসমূহ ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। অথবা একান্ত অনুরাগী অর্থও পেতে পারি। ফলতঃ, এই উপমায় ভক্তিসহযুত জ্ঞানী হয়ে অথবা একান্ত অনুরাগী হয়ে আমরা যেন আপনার উপাসনায় ব্রতী হতে পারি–এই এক ভাব প্রকাশ পায়। আর এক ভাবে, বৃথা তর্কপরায়ণ চার্বাকধর্মী আমরা যেন আপনার পূজায় ব্রতী হতে পারি–এমন অর্থেরই সঙ্গতি দেখা যায়। মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক; নিজেকে প্রস্তুত করবার জন্য অধ্যায়ের প্রারম্ভে প্রার্থনাকারী সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছেন। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৩য় অধ্যায়ের ১মা দশতির ১ম সাম রূপেও পরিদৃষ্ট হয়]। [এখানে এই সূক্তের দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে]।

১১/২– পরমধনদাতা বলাধিপতি হে দেব! আপনার ন্যায় দ্যুলোকজাত আর কেউই নেই; ভূলোকজাত কেউও নেই; আপনার সদৃশ কেউই সৃষ্ট হয়নি এবং কেউ হবেও না; (ভাব এই যে, ভগবান্ দেশকাল পাত্রকে অতিক্রম করে বর্তমান আছেন)। হে দেব! ব্যাপকজ্ঞানকামী আত্মশক্তিলাভার্থী পরাজ্ঞান প্রাপ্তিকামী আমরা আপনাকে আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান এবং আত্মশক্তি প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথম ভাগে, ভগবানের মহিমা পরিত্যক্ত হয়েছে এবং দ্বিতীয় অংশে তার কাছে পরাজ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। ভগবান্ দেশকালের অতীত। দেশ ও কাল তাতেই অবস্থিত আছে। বিশ্ব তার থেকেই সমুদ্ভূত হয়েছে, সুতরাং দ্যুলোক-ভূলোকে অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বে তার সমান কেউই নেই এবং থাকতেও পারে না। তার শক্তি পেয়ে জগৎ শক্তি লাভ করে, তার কৃপায় বিশ্ব বেঁচে আছে। তার জ্যোতি পেয়েই চন্দ্রসূর্য জ্যোতির্মান হয়, তার শক্তিতে সকলে শক্তি লাভ করে। তিনি বিশ্ববিধাতা, বিশ্বের রক্ষা কর্তা ও পালন কর্তা। সুতরাং তার সমান কে থাকতে পারে?–সেই পরম পুরুষের কাছেই পরাজ্ঞান ও আত্মশক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১২/১– চিরনবীনত্বসম্পন্ন, অভিনব কর্মযুক্ত, সুহৃৎস্থানীয় সেই দেবতা– কি রকম কর্মের দ্বারা আমাদের অভিমুখী হন? আর, প্রজ্ঞা-সহ অনুষ্ঠীয়মান্ কোন্ কর্মের দ্বারাই বা তিনি প্রাপ্তব্য হন? (কোন্ কর্মের দ্বারা কি রকমে ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেই বিষয়ে প্রার্থনাকারী অনুসন্ধিৎসু হয়েছেন; মন্ত্রে তাঁর সেই ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে)। [মন্ত্রটি পাঠ করলে এবং এর প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদি দেখলেই সহসা মনে হয়– এই মাত্র যেন কেউ কারও কাছে ভগবানের পূজার পদ্ধতি শিক্ষা করতে চাইছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আত্মজিজ্ঞাসা। কোন্ কর্মের দ্বারা তাঁকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, আর কোন্ কর্মের দ্বারা তিনি নিকটে আসেন, — এমন আত্ম-অনুসন্ধানই এই মন্ত্রের লক্ষ্য। — মন্ত্রে প্রশ্নমূলক দুটি কয়া পদ আছে। সেই দুই পদের সাথে যথাক্রমে উতী ও বৃতা পদ দুটির সম্বন্ধ এ প্রতিপন্ন হয়। ……যে কর্মে আত্মরক্ষা হয়, তা-ই উতী পদের লক্ষ্য। আর যা নিত্য-অনুষ্ঠিত, , তা-ই বৃতা পদে নির্দেশ করছে]। মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৭-৫সা) পাওয়া যায়। এটি যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদেরও মন্ত্র]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে]।

১২/২– আনন্দদায়ক বস্তুগুলির মধ্যে কোন্ বস্তু আপনাকে আনন্দ প্রদান করে? নিশ্চয়ই সাধকদের হৃদয়স্থিত সত্যভূত সত্ত্বভাবজাত শ্রেষ্ঠ ধন আপনাকে আনন্দ প্রদান করে। হে দেব! কঠোর রিপুদের সম্যকরূপে বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকদের বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের দ্বারা ভগবান্ প্রীত হন)। [সন্তানকে উন্নত ও পবিত্র দেখলে পিতা যেমন আনন্দিত হন, তেমন আর কিছুতেই নয়। জগৎপিতা ভগবানও তেমনই তাঁর সন্তানদের মধ্যে বিশুদ্ধসত্ত্বভাবের সঞ্চার দেখলে আনন্দলাভ করেন। বিশ্ব তারই প্রতিচ্ছবি। তাই, এই বিশ্ব যত তার উৎপত্তিনিলয়ের দিকে অগ্রসর হয়, ততই আনন্দের বিষয়। তাই, কোন বস্তু আপনাকে আনন্দদান করে? প্রশ্নটির অবিসংবাদী উত্তরও সঙ্গে সঙ্গে প্রদত্ত হয়েছে– সাধক হৃদয়ের সত্ত্বভাব। মঙ্গলময় ভগবান এটাই ইচ্ছা করেন যে, বিশ্ববাসী সকলেই মঙ্গলের পথে চলুক! তাই সাধকের এই ঊর্ধ্বগ হতে তার আনন্দ]।

১২/৩– হে ভগবন! আপনার সখীভূত সাধকদের রক্ষক আপনি বহু রক্ষাশক্তির সাথে আমাদের সম্যকারে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করুন)। [সাধকগণ ভগবানের মিত্রভূত– অতিশয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভক্তগণকে তিনি নিজের প্রাণের তুল্য মনে করেন। মানুষের একমাত্র রক্ষক সেই ভগবানের কাছেই। বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১৩/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ অথবা হে আমার মন! তোমাদের জন্য, অর্থাৎ আমাদের নিজেদের মঙ্গল-সাধনের জন্য, সত্যপ্রদর্শক, শত্রুনাশক, নিজেদের প্রীতিকর শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণে আনন্দিত, সেই ইন্দ্রদেবকে লক্ষ্য করে (তাঁর অভিমুখে) একান্ত অনুরাগী ভক্তিমানের মতো, আত্মহৃদয়ক্ষেত্রে তাঁকে স্থাপন-পূর্বক, স্তুতিমন্ত্রের দ্বারা আহ্বান করছি। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, আত্মহিতসাধনের জন্য ভগবানের আরাধনা কর্তব্য। এই বিষয়ে আমরা সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি)। [কয়েকটি পদের অর্থ উপলক্ষে ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রটির প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে — হে ঋত্বিগ-যজমাণ! তোমাদের সম্বন্ধবিশিষ্ট, সেই দর্শনীয়, শত্রুর অভিভবকারী, পাত্রস্থিত অথবা দুঃখনাশক সোমরসপানে প্রমত্ত, ইন্দ্রদেবের অভিমুখে, নবপ্রসূতা গাভী যেমন বৎসের অনুসরণে হরব করে গোষ্ঠ-অভিমুখে বা দিবসে ধাবিত হয়, আমরা সেইরকমভাবে উচ্চৈঃস্বরে স্তুতিমন্ত্রে স্তব করি। এ পক্ষে বসোপদে পানপাত্রে অথবা দুঃখনাশক এবং স্বসরেষু পদে গোষ্ঠে বা দিবসে অর্থ গৃহীত হয়ে থাকে। এইভাবে প্রচলিত বঙ্গানুবাদে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে, — গোষ্ঠে ধেনুগণ দিবসে যেমন বসকে আহ্বান করে, তেমন দর্শনীয়, শত্রুনাশক, দুঃখ দূর করো। সোমরস-পানে প্রমত্ত ইন্দ্রকে স্তুতির দ্বারা আমরা আহ্বান করছি। বলা বাহুল্য এখানে স্বসরেষুপদের অর্থ দিবসে এবং গোষ্ঠে দুই-ই রাখা হয়েছে।– আমরা মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক মনে করি। সেই অনুসারে মন্ত্রের সম্বোধন চিত্তবৃত্তিসমূহ বা মন। বঃ পদে তোমাদের জন্য অথবা আমাদের আপনার হিতসাধনের জন্য এই ভাব গ্রহণ করি। পূর্ব-মন্ত্রেও এই অর্থে বঃ পদের প্রয়োগ সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্তিত হয়েছে। বসো ও অন্ধসঃ পদ দুটিতে আপনার প্রীতিকর শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণে ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। মন্দানং পদে শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণে হা আনন্দের গ্রহণে ভাব আসে। ..আনন্দময়ের আনন্দ-নিবাস হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বের অভ্যন্তরে। এখানে তাই পরিকীর্তিত। বসো অন্ধসঃ মন্দানং পদ তিনটিতে দেবতার সেই আনন্দের অবস্থাই প্রকাশ পায়। এরপর বৎসং ন ধেনব উপমার তাৎপর্য অনুধাবনীয়। তাতে একান্ত-অনুরাগিতার ভক্তিমত্তার ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। বৎসের অভিমুখে গাভীর অনুসরণের উপমার ভাব গ্রহণ করলে, সেই একান্ত-অনুরাগিতার অর্থই সিদ্ধ হয়ে থাকে। আমরা যেন একান্ত অনুরাগের সাথে সর্বদা ভক্তিমান্ হয়ে ভগবানের আরাধনায় ব্রতী হই, এইরকম আকাঙ্ক্ষাই এখানে প্রকাশ পাচ্ছে। স্বসরেষু পদে হৃদে হৃদয়রূপ যজ্ঞগৃহে তাকে স্থাপন করার ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেই ভগবানকে হৃদয়ে স্থাপন করে আমরা যেন একান্তে তার পূজায় ব্রতী হই, — এই ভাবই এখানে প্রকাশমান]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১দ-৪সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে এই সূক্তের দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত নটি গেয়গান আছে]।

১৩/২– জ্যোতির্ময় পরমধনদাতা বিশ্বপালক পর্বততুল্য মহাশক্তিসম্পন্ন ভগবানকে আমরা আরাধনা করছি; তিনি আমাদের জ্ঞানযুক্ত, প্রভূতপরিমাণ পরাজ্ঞানযুত আত্মশক্তি নিত্যকাল প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [জগতের সকল প্রাণীকেই সেই বিশ্বপালক বিধাতা অপার করুণায় পালন করছেন। তাঁর কৃপা লাভেই মানুষ বেঁচে আছে। তিনি পর্বততুল্য মহাশক্তিসম্পন্ন। পর্বত যেমন অচল অটল জগতের যে-কোন শক্তিই যেমন তাতে প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়, ভগবানও তেমন অনন্ত অপ্রতিহত শক্তির আধার। অবশ্য পর্বত বা জাগতিক কোন শক্তির সাথেই তার তুলনা হয় না। কিন্তু সসীম মানুষ তার সান্তজ্ঞানের দ্বারা, পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বুদ্ধির সাহায্যেই, সেই অসীম অনন্তের স্বরূপ নিরূপণ করতে চায়। তাই জাগতিক বস্তুর সাথে তার তুলনা করে। সেই অবামনসোগোচর দেবতার কাছেই পরাজ্ঞান ও আত্মশক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১৪/১- হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমাদের হিতসাধনের জন্য (আমাদের আত্মমঙ্গল সাধনের জন্য) বাধাপ্রাপ্ত হয়েও (রিপুগণ কর্তৃক আক্রান্ত তোমরা) আত্মরক্ষণের জন্য বিশুদ্ধ সত্ত্বসমন্বিত সৎকর্মে (হিংসারহিত-্যাগে) সৰ্বৰ্থ স্তোত্রপরায়ণ হয়ে পরমার্থতত্ত্বজ্ঞাপক ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে অবিলম্বে (সত্বর) পূজা করো; তার জন্য উপাসকগণের পালক সেই ভগবাকে আমি আহ্বান করছি। (সেই ভগবান্ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন, আমাদের চিত্তবৃত্তিগুলিকে সেই অনুসারী করুন, — প্রার্থনার এটাই ভাবার্থ)। [মন্ত্রের অন্তর্গত সবাধঃ পদ ভগবানের প্রতি অগ্রসর হবার পথে যেসব বাধা আছে, তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কাম ক্রোধ প্রভৃতি রিপুদের বাধাঁই এখানকার লক্ষ্যস্থল। উতয়ে পদে আত্মরক্ষার কামনা প্রকাশ পায়। সুতসোমেও অধ্বরে পদ দুটিতে সত্ত্বভাব-সমন্বিত সৎকর্মের প্রতি লক্ষ্য আসে। বৃহৎ গায়ন্তঃ পদ দুটিতে প্রকৃষ্টরূপে অর্চনার ভাব প্রাপ্ত হই। তিরোভিঃ পদে সত্বর অর্থাৎ অবিলম্বে ভগবানের কার্যে ব্রতী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে– এমন ভাব প্রকাশ পায়। ভরং ন কারিণম্ বাক্যাংশে সৎকর্মের অনুষ্ঠানকারিদের রক্ষক ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আসে। তিনি কারিণং অর্থাৎ সৎকর্মকারীকে ভরং অর্থাৎ পোষণ করেন– এই ভাব ঐ বাক্যাংশে প্রাপ্ত হওয়া যায়। উপমার ভাব বিশ্লেষণ করতে গেলে বলা যায়, সৎকর্মকারিদের তিনি যেমন পোষণকর্তা, আমাদেরও তেমনই পোষণকর্তা হোন। তারই গুণে গুণান্বিত সেই তাকে, তাঁর কৃপা পাবার জন্য, আমি অর্চনা করছি] [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১দ-৫সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে এই সূক্তের দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে]।

১৪/২– জ্যোতির্ময় যে দেবতাকে দুর্ধর রিপুগণ সংগ্রামে পরাজিত করতে পারে না, দেবগণ এবং মনুষ্যগণও বারণ করতে পারে না, যে দেবতা সত্ত্বভাবের পরমানন্দের জন্য আদরপূর্বক ভগবৎপরায়ণ পবিত্র হৃদয় প্রার্থনাকারীকে প্রার্থনীয় ধন প্রদান করেন, সেই দেবতাকেই আমরা যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরমমঙ্গলময় ভক্তবৎসল ভগবানকে আরাধনা করি)। [ভগবানের শক্তি অপ্রতিহত। তার মঙ্গলময় শক্তির প্রভাবেই জগতে অমঙ্গল স্থায়ী অধিকার বিস্তার করতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে কখনও কখনও অমঙ্গলের প্রাদুর্ভাব হয়েছে বলে মনে হয় বটে, কিন্তু তা আমাদের সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ফলমাত্র। অমঙ্গল, পাপ। আমাদের অসম্পূর্ণ আপেক্ষিক স্বাধীনতার ফল। যখন আমরা সেই অসম্পূর্ণতাকে জয় করতে পারি, যখন আমাদের শক্তি ও প্রবৃত্তি অনন্তমুখী হয়, তখন সূর্যের উদয়ে শিশিরকণিকার মতো তা অন্তর্হিত হয়ে যায়। ভগবৎশক্তির বলেই তা সম্ভবপর হয়ে থাকে। তাই বলা হয়েছে– দেবাসুর-মানব কেউই ভগবানের শক্তি প্রতিরোধ করতে পারে না। তিনি শুধু পূর্ণশক্তি বা পূর্ণমঙ্গলের অধিকারীই নন– সেই শক্তি, সেই পরমানন্দ তিনি মানুষকেও বিতরণ করেন। তার প্রিয় সন্তানকে তাঁর পরমধন থেকে বঞ্চিত করেন না। তাই মানুষ তার কাছে পরমানন্দের জন্য প্রার্থনা করে এবং অভীষ্ট ধনও লাভ করে ধন্য হয়]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৫– স্বাদিষ্ঠয়া মদিয়া পবস্ব সোম ধারয়া ইন্দ্রায় পাতবে সুতঃ ৷৷ ১. রক্ষোহা বিশ্বচৰ্ষণিরভিযোনিমযোহতে। দ্রোণে সধস্থমাসদৎ৷৷ ২. বরিবো৮তমা ভুবো মংহিষ্ঠা বৃত্ৰহ পর্ষি রাধো মঘোনা৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৬– পবস্ব মধুমত্তম ইন্দ্রায় সোম ক্রতুবিত্তমো মদঃ। মহি দুক্ষতমো মদঃ ১। যস্য তে পীত্বা বৃষভো বৃষায়তেহস্য পীত্বা স্বর্বিদ। স সুপ্রকেত অভ্যক্রমীদিযোহচ্ছা বাজং নৈতঃ ॥২॥

 সূক্ত ১৭– ইন্দ্ৰমচ্ছ সুতা ইমে বৃষণং যন্তু হরয়ঃ। শ্রুষ্টে জাতাস ইন্দবঃ স্বর্বিদঃ৷৷ ১৷৷ অয়ং ভরায় সানসিরিন্দ্রায় পবতে সুতঃ। সোমো জৈত্রস্য চেততি যথা বিদে৷৷ ২ অস্যেদিন্দ্রো মদো গ্রাভং গৃতি সানসি৷৷ বর্জং চ বৃষণং ভরৎ সমপসুজিৎ ॥৩॥

সূক্ত ১৮– পুররাজিতী বো অন্ধসঃ সুতায় মাদয়িত্নবে। অপ শ্বানং শথিষ্টন সখায়ো দীর্ঘজ্যি৷৷৷৷৷ যো ধারয়া পাবকয়া পরিপ্রস্যন্দতে সুতঃ। ইন্দুরশ্বে ন কৃত্বঃ ৷৷ ২. তং দূরোষমভী নরঃ সোমং বিশ্বচ্যা ধিয়া। যজ্ঞায় সন্তুদ্রয়ঃ৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৯) অভি প্রিয়াণি পবতে চনোহিতো নামানি যত্মো অধি যে বর্ধতে। আ সূর্যস্য বৃহততা বৃহন্নধি রথং বিশৃঞ্চমরুহদ বিচক্ষণঃ ৷৷ ১৷৷ ঋতস্য জিহ্বা পবতে মধু প্রিয়ং বক্তা পতিধিয়ো অস্যা অদাভ্যঃ। দধাতি পুত্রঃ পিত্রোরপীচ্যাং নাম তৃতীয়মধি রোচনং দিবঃ। ২৷৷ অব দুতানঃ কলশা অচিক্রদভিযেমাণঃ কোশ আ হিরণ্যয়ে। অভী ঋতস্য দোহনা অনূষধি ত্রিপৃষ্ঠ উষসসা বি রাজসি৷৷ ৩।

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৫সূক্ত/১সাম– হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হয়ে আমাদের ভগবানের সমীপে নিয়ে যাবার জন্য প্রীতিজনক পরমানন্দদায়ক ধারারূপে প্রবাহিত হও। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে, ভগবৎ-লাভের জন্য আমাদের হৃদয়স্থ শুদ্ধসত্ত্ব উদ্বোধিত হোক)। [সত্ত্বভাব সকলের হৃদয়েই বর্তমান আছে। সাধনার দ্বারা বিশুদ্ধ হলে তা মানুষকে মোক্ষলাভের পথে প্রেরণ করে। মানুষের হৃদয়ের সুপ্ত দেবভাব যখন জাগরিত হয়, সাধনার দ্বারা মানুষ যখন অন্তরের সুপ্ত চৈতন্যকে নিজের বশীভূত করে ঊর্ধ্বমুখে প্রেরণ করতে সমর্থ হয়, প্রকৃতপক্ষে তখনই তার আধ্যাত্মিক জীবন আরম্ভ হয়। সেই দেবভাবকে জাগাবার জন্য সাধনার ও প্রার্থনার প্রয়োজন। হৃদয়স্থ সত্ত্বভাবকে উদ্বোধিত করবার প্রার্থনাই এখানে দেখতে পাওয়া যায়। ভগবান্ আমাদের হৃদয়ের ভাব গ্রহণ করেন। হৃদয়ের ভক্তি দিয়েই তাঁর আরাধনা করতে হয়। ভগবান্ যখন আমাদের হৃদয়ের সেই ভাবপুস্পাঞ্জলি গ্রহণ করেন, তখনই আমাদের পূজা আরাধনা সার্থক হয়। প্রকৃত পূজা পুষ্পবিল্বদল দিয়ে নয়– এটা তো একটা বাহ্য অনুষ্ঠান মাত্র। প্রকৃত পূজা হৃদয়ের পূজা। এখানে সেই মহাপূজারই প্রচেষ্টা দেখা যায়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১দ-২সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে I এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তেরটি গেয়গান আছে]।

১৫/২– রিপুনাশক সর্বজ্ঞ দেবতা সাধকদের পরম বিশুদ্ধ হৃদয়ে আগমন করেন। তিনি কৃপাপূর্বক সত্ত্বভাবের উৎপত্তিস্থান আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [মন্ত্রটিতে সোমরসের কোন প্রসঙ্গ না থাকলেও ব্যাখ্যাকারগণ তাদের সোমরসকে টেনে এনেছেন। যেমন, -রাক্ষসহন্তা সকল দর্শক সোম লৌহদ্বারা পিষ্ট হয়ে দ্রোণকলসবিশিষ্ট অভিষবণ স্থানে উপবিষ্ট হলেন। ভাষ্যকার আবার অয়ঃ শব্দে হিরণ্য অর্থ গ্রহণ করেছেন কিন্তু উপরের ব্যাখ্যায় ঐ পদে লৌহ অর্থ গৃহীত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হিরণ্যময় দ্রোণ সাধকের বিশুদ্ধ হৃদয়কে লক্ষ্য করে। সর্বদর্শী ভগবান্ সেই পবিত্র হৃদয়ে আসন গ্রহণ করেন]।

১৫/৩– হে ভগবন! আপনি শ্রেষ্ঠধনদাতা এবং পরমরিপুনাশক হন; সর্বধনদাতা আপনি সাধকগণ যে পরমধন লাভ করেন, সেই ধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — শ্রেষ্ঠতম দাতা ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [ভগবান্ একমাত্র ভগবানের শরণ গ্রহণ ব্যতীত আর কোন উপায় থাকে না। সাধকদের দ্বারাই ধর্মরাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়ে থাকে। তারা যে হৃদয়ের পবিত্রতা, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব লাভ করেন, তা প্রত্যেক মানুষেরই একান্ত আকাঙ্ক্ষার বস্তু। তাই সাধকদের বাঞ্ছিত সেই পরমধন লাভের জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]।

১৬/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! অমৃতময়, পরমানন্দদায়ক, সৎকর্মপ্রাপক, (অথবা প্রজ্ঞারহিত) মহান, পরমদীপ্তিমান্ আপনি আমাদের পরমানন্দদায়ক হয়ে ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন অমৃতপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করি)। [যিনি পরমানন্দদায়ক, তাকে পরমানন্দদায়ক হবার জন্য প্রার্থনা কেন? তার উত্তর এই যে, সূর্যের আলোকে তো জগৎ উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু তাতে কি অন্ধের কোন উপকার হয়? ভগবান্ তো আনন্দং অমৃতরূপং– তার আনন্দের প্রবাহে জগৎ প্লাবিত হচ্ছে, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে কি সেই আনন্দের স্পন্দন অনুভূত হয়? উৎসবের আনন্দকোলাহল কি অন্ধকারে আবৃত কারাগৃহের ভিতরে প্রবেশ করে? আর তার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি প্রবেশ করলেও হস্তপদ-শৃঙ্খলাবদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রীর বুকে এই আনন্দতরঙ্গ কি কোন সাড়া জাগাতে পারে? যার উপভোগ করবার শক্তি নেই, যার গ্রহণ করবার অধিকার নেই, তার কাছে বিশ্বের সম্পদ ভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত রাখলেও তা তার কোন কাজে লাগে না। — সত্ত্বভাব আনন্দদায়ক নিশ্চয়ই, কিন্তু ভগবানের কৃপা না হলে আমরা সেই আনন্দ লাভ করব কিভাবে? তিনি যদি দয়া করে আমাদের তার ধন উপভোগ করবার শক্তি ও অধিকার দেন, তবেই আমরা তা উপভোগ করতে পারি]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১১দ-১সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত নটি গেয়গান আছে]।

১৬/২– যে সাধকের সত্ত্বভার গ্রহণ করে অভীষ্টবর্ষক দেব তার অভীষ্ট প্রদান করেন, হে সত্ত্বভাব! সর্বজ্ঞ তোমার সেই অমৃত লাভ করে জ্ঞানবান হয়ে, মোক্ষপ্রদ জ্ঞান যেমন আত্মশক্তি লাভ করে, তেমনই সেই সাধক আত্মশক্তি সম্যকরূপে লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাবের দ্বারা মোক্ষ এবং আত্মশক্তি লাভ করা যায়)। [মন্ত্রটি একটু জটিলতাপূর্ণ। ভাষ্যকার যস্যতে পদ দুটির বিভক্তিব্যত্যয় স্বীকার করে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু প্রচলিত অন্যান্য ব্যাখ্যার সাথেও এই ব্যাখ্যার মিল দেখা যায় না। আমাদের মন্ত্রার্থে বিভক্তি-ব্যত্যয় স্বীকৃত হয়নি। অর্থ সঙ্গতির দিকে লক্ষ্য রেখে সত্ত্বভাবঃ পদটি অধ্যাহার করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসকে আনা হয়েছে। সেখানে প্রায়ই লুণ্ঠন ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। ইন্দ্র কিংবা এ কে অন্য কোন দেবতা শত্রুদের গো-মহিষ ইত্যাদি এবং ধনরত্ন লুণ্ঠন করছেন– এমন বর্ণনা প্রায়ই দৃষ্ট হয়। এইসব ব্যাখ্যা থেকে আবার প্রাচীন ভারতের অবস্থাও চিত্রিত হয়ে থাকে। অথচ মূলবেদে এসব। অপকর্মের কোন উল্লেখ নেই]।

১৭/১– আশুমুক্তিদায়ক, সর্বজ্ঞ, আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন, পাপহারক, সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ হয়ে অভীষ্টবর্ষক ভগবানের প্রতি গমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সত্ত্বভাবের সহায়ে আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [ভগবান্ অভীষ্টবর্ষক। সেই কল্পতরুমূলে যে যা প্রার্থনা করে, সে তা-ই পায়। অবশ্য সেই প্রার্থনা বিশ্ব-মঙ্গলনীতির অনুগামী হওয়া চাই, নতুবা প্রার্থনাকারীকেই দুঃখ পেতে হবে। সাধকদের চিত্ত নির্মল, তাদের হৃদয়ে ভগবানের মঙ্গলনীতি উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে। সুতরাং তাদের প্রার্থনাও মঙ্গলনীতির অনুগামী হয়। তাদের কোন প্রার্থনা অপূর্ণ থাকে না। -সত্ত্বভাব সর্বত্রই সকলের হৃদয়েই বীজরূপে নিহিত আছে। সেই বীজকে সাধনার দ্বারা বিশুদ্ধ ও বিকশিত করতে পারলেই তার দ্বারা দেবপূজা করা যায়। খনিতে রত্ন থাকে বটে, কিন্তু তাকে ব্যবহারে লাগাতে হলে পরিষ্কৃত করে নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব সম্বন্ধেও একথা প্রযোজ্য]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১০দ-১সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত বারটি গেয়গান আছে]।

১৭/২– রিপুসংগ্রামে জয়লাভের জন্য প্রার্থনীয়, প্রসিদ্ধ, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন; লোক যেমন বস্তুজ্ঞান লাভ করে, তেমনভাবে সত্ত্বভাব জয়শীল ভগবানকে জানেন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি, তারপর সত্ত্বভাবের সহায়ে ভগবানকে যে প্রাপ্ত হই)। [সত্ত্বভাব মানবজীবনের চরম উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র। ভগবৎচরণপ্রাপ্তিই মানুষের পরম পুরুষার্থ। সেই উদ্দেশ্য সাধনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় বলেই সত্ত্বভাব মানুষের এমন একান্ত আকাঙ্ক্ষার বস্তু। — সাধারণ মানুষ যেমন জাগতিক বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে, সত্ত্বভাবসম্পন্ন মানুষ তেমনই পরম পুরুষের জ্ঞান প্রাপ্ত হন। সত্ত্বভাবের দ্বারা ভগবৎ-প্রাপ্তির অসাধারণ শক্তি মন্ত্রে বিঘোষিত হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত জৈত্রস্য পদে দ্বিতীয়ান্ত জয়শীলং অর্থ গৃহীত হয়েছে]।

১৭/৩– মোক্ষদানের জন্য বলাধিপতি দেবই সাধকের সম্ভজনীয় গ্রহণীয় সত্ত্বভাব সম্যকরূপে গ্রহণ করেন এবং অমৃতপ্রাপক সেই দেবতা অভীষ্টবর্ষক রক্ষাস্ত্র সাধকরক্ষার জন্য ধারণ করেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকের পূজা গ্রহণ করে তাঁকে সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করেন)। [ভগবানের পূজার জন্যই মানুষের যত কিছু উদ্যোগ আয়োজন। তিনি কৃপা করে গ্রহণ করবেন বলেই তার পূজার শ্রেষ্ঠ উপচার সত্ত্বভাব লাভের জন্য সাধনা। তিনি যখন সেই পূজা গ্রহণ করেন তখনই জপতপ প্রভৃতি উদ্যোগ আয়োজন সার্থক হয়]।

১৮/১– সৎকর্মের সাধনে সখীভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! রিপুসংগ্রামে জয়-প্রদানকারী সত্ত্বভাবের বিশুদ্ধ পরমানন্দ লাভের জন্য তোমরা সৎ-ভাবনাশক রিপুনিবহকে বিনাশ করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, — মোক্ষলাভের জন্য যেন আমি রিপুজয়ী হই)। [মানুষ যে ইচ্ছাশক্তির পরিচালনার দ্বারা কর্মসম্পাদন করে, তার প্রেরয়িতা– চিত্তবৃত্তি। এই চিত্তবৃত্তি যখন মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করে, তখন তারা মানুষের পরম উপকারী বন্ধু। …….তাই সকার্যসাধনে সহায়ভূত চিত্তবৃত্তিগুলিকে সখা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এই মন্ত্রের অন্তর্গত শানং পদে হৃদয়স্থিত পশুকেই লক্ষ্য করা সঙ্গত। (ভাষ্যকার এর অর্থ করেছেন রাক্ষস এবং অপর এক ব্যাখ্যাকার অর্থ– করেছেন কুকুর)। আমাদের হৃদয়স্থিত এই রিপুরূপী পশুগণ দীর্ঘজিহ্বা, আমাদের সকল সৎবৃত্তি সত্ত্বভাবপ্রবাহ প্রভৃতি বিনষ্ট করে। আমাদের যা কিছু পরমার্থপ্রদ, তা সমস্তই এই পশুগণ নষ্ট করে। তাই শ্বানং পদে রিপুনিবহঅর্থ গৃহীত হয়েছে]। [এই সাম-মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৮দ-১সা) প্রাপ্তব্য]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত সাঁইত্রিশটি গেয়গান আছে]।

১৮/২– ব্যাপকজ্ঞান তুল্য সৎকর্মসাধক বিশুদ্ধ যে সত্ত্বভাব পবিত্রকারক ধারারূপে সাধকগণের হৃদয়ে উপজিত হয়, সেই সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে সর্বতোভাবে উপজিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হৃদয়শুদ্ধিকারক সত্ত্বভাব আমরা যেন লাভ করতে পারি)। [যা সৎকর্মসম্পাদনে সাহায্য করে, তাই-ই কৃত্বঃ। এই পদের সাথে অশ্ব অর্থাৎ ব্যাপকজ্ঞানের সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। ব্যাপকজ্ঞান লাভ করলে মানুষের সৎকর্মে প্রবৃত্তি জন্মে, মানুষ সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করে। সত্ত্বভাব প্রাপ্তি ঘটলেও মানুষ তেমনই সৎকর্মপরায়ণ হয়। সত্ত্বভাবের দ্বারা হৃদয় বিশুদ্ধ ও পবিত্র হয়, তাই সত্ত্বভাব সম্বন্ধে বলা হয়েছে, পাবকয়া ধারয়া — পবিত্র ধারারূপে হৃদয়ে উপজিত হয়]।

১৮/৩-সাধকগণ সৎকর্মসাধনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তারা প্রসিদ্ধ পাপনাশক সত্ত্বভাবকে লাভ করবার জন্য অভীষ্টপূরণকারিণী বুদ্ধির দ্বারা (অথবা প্রার্থনার দ্বারা) ভগবানকে আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবৎপরায়ণ সাধকগণ সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা মোটেই পরিষ্কার হয়নি। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির মধ্যেও পরস্পরের সাথে ঐক্য নেই। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– তিনি দুর্ধর্ষ, তিনিই যজ্ঞ; অধ্যক্ষগণ বিবিধ স্তুতি বাক্য উচ্চারণ করতে করতে প্রস্তর সহকারে নিপীড়ন পূর্বক তাকে চালিয়ে দিচ্ছে। — তিনিই যজ্ঞ প্রস্তর সহকারে নিপীড়ন পূর্বক প্রভৃতি বাক্যাংশে কোথা থেকে এই ব্যাখ্যায় এল, তা বোঝা যায় না।

১৯/১– আত্মশক্তিদায়ক সত্ত্বভাব সকলের প্রিয় অমৃতপ্রবাহের অভিমুখে ক্ষরিত হন; (ভাব এই : যে, সত্ত্বভাব অমৃতপ্রবাহের সাথে মিলিত হন); অমৃতপ্রবাহে এই সত্ত্বভাব সম্যক্ প্রকারে প্রবৃদ্ধ হন; মহান্ সর্বদর্শী সত্ত্বভাব মহাজ্ঞানমূলক ভগবৎপ্রাপক সৎকর্মরূপ যানকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, বিশুদ্ধসত্ত্বভাব জ্ঞান এবং সৎকর্মের সাথে মিলিত হন)। [সত্ত্বভাব অমৃতপ্রাপক। সত্ত্বভাবের সাথে জ্ঞান ও কর্ম মিলিত হলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা করবার মতো আর কিছুই থাকে না। যা কিছু মানুষের প্রার্থনীয়, তা সমস্তই তিনি প্রাপ্ত হন। এই নিত্যসত্যই মন্ত্রের মধ্যে প্রকটিত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে মন্ত্রটি সম্পূর্ণ অন্যরূপ পরিগ্রহ করেছে। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৯দ-১সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গান আছে]।

১৯/২– ভগবৎ-প্রাপিকা বুদ্ধির (অথবা প্রার্থনার অধিপতি), জ্ঞানদায়ক সত্যপ্ৰাপক সত্ত্বভাব, কল্যাণকর অমৃতকে আমাদের হৃদয়ে প্রদান করুন; রিপুজয়ী সাধক পৃথিবীর ও অন্তরীক্ষের এবং ভূর্ভুবলোকের মধ্যে তৃতীয় স্থানীয় স্বলোকের নিগুঢ় জ্যোতির্ময় অমৃত সম্যক্‌রূপে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সাধক অমৃত লাভ করেন; ভগবৎ-কৃপায় আমরাও যেন অমৃত প্রাপ্ত হই)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটির মর্ম সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন, সোম যজ্ঞের জিহ্রস্বরূপ; সেই জিহ্বা হতে অতি চমৎকার মাদকতা শক্তিযুক্ত রস ক্ষরিত হচ্ছে। তিনি শব্দ করতে থাকেন, তিনি এই যজ্ঞানুষ্ঠানের পালনকর্তা, তাকে কেউ নষ্ট করতে পারে না। এ আকাশের ঔজ্জ্বল্য বর্ধনকারী সোমরস প্রস্তুত হলে পুত্রের এমন একটি নূতন নাম উৎপন্ন হয়, যা তার পিতামাতা জানতেন না। বাবা-মা পুত্রের নাম জানতেন না এর অর্থ কি? নূতন শব্দই বা কোথা থেকে এল? ভাষ্যকার নাম পদে পূর্বে পয়োলক্ষণং রস (উঃ আঃ ১অ-৩খ-৩সূ-৩সা) অর্থ গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমান মন্ত্রে তার বিপরীত এক অর্থ করেছেন]।

১৯/৩– সাধকগণ কর্তৃক স্তুত হয়ে জ্যোতির্ময় সত্ত্বভাব তাদের হৃদয়ে জ্ঞান প্রদান করেন; সত্যসাধকগণ বিশুদ্ধ হৃদয়ে সত্ত্বভাবকে প্রার্থনা করেন। হে সত্ত্বভাব! সর্বব্যাপক আপনি জ্ঞানের উন্মোষিকা বৃত্তীকে উদ্বোধিত করে বিশেষভাবে দীপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে,– প্রার্থনাপরায়ণ সত্যব্রত সাধক সত্ত্বভাব লাভ করেন, সত্ত্বভাব পরাজ্ঞান প্রদান করেন)। [মন্ত্রটি তিন ভাগে বিভক্ত। সাধকগণ সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করেন। তাদের হৃদয় বিশুদ্ধ, সুতরাং সেই বিশুদ্ধ হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত হয়। এবং সেই সঙ্গে পরাজ্ঞানের জ্যোতিতেও তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উন্মেষে মানুষের সকল উচ্চবৃত্তিগুলি জাগরিত হয়ে ওঠে; অর্থাৎ মানুষের সকল সুপ্ত সৎবৃত্তি, জ্ঞানবৃত্তি জেগে উঠে নিজেদের কর্তব্যের সন্ধান পায়। সেই জাগরণে মানুষ দিব্যজ্যোতিঃর অধিকারী হয়। সত্ত্বভাবে অধিকারী মানব নিজেকে মোক্ষমার্গে পরিচালিত করতে পারেন। সেই শক্তি, সেই উদ্দীপনা, মানুষ সত্ত্বভাব থেকেই লাভ করেন]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ২০– যজ্ঞাযজ্ঞা বো অগয়ে গিরাগিরা চ দক্ষসে। প্ৰ প্ৰ বয়মমৃতং জাতবেদসং প্রিয়ং মিত্রং ন শংসিষ৷৷ ১৷৷ ঊর্জো নপাতং স হিনায়ময়ুদাশেম হব্যদাতয়ে। ভুবদ বাজেযুবিতা ভুবদ বৃধ উত ত্রাতা তন্না৷৷ ২৷৷

 সূক্ত ২১– এ যু ব্ৰবাণি তেহগ্ন ইথেতরা গিরঃ। এভিবাস ইন্দুভিঃ ৷৷ ১৷৷ যত্র কুচ তে মনো দক্ষং দধস উত্তর। তত্র যোনিং কৃণবসে৷৷ ২. ন হি তে পূর্তমক্ষিপ ভুবনুমানাং পতে। অথা দুবো বনবসে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২২– বয়মু স্বামপূর্ব সুরং কচ্চিদ ভরন্তোহবস্যবঃ। বজিং চিত্রং হবামহে৷৷ ১৷৷ উপ জ্বা কর্ময়ূতয়ে স নো যুবোশ্চক্রাম যো ধৃষৎ। স্বামিদ্ধ্যবিতারং ববৃমহে সখায় ইন্দ্র সানসিম্ ৷৷ ২

সূক্ত ২৩– অধা হীন্দ্র গির্বণ উপ জ্বা কাম ঈমহে সমৃগ্নহে। উদেব গন্ত উদভিঃ ১। বার্ণ ত্বা যব্যাভির্ধন্তি শূর ব্রহ্মাণি। বাবৃধাংসং চিদদ্রিবো দিবেদিবে৷ ২৷৷ যুঞ্জন্তি হরী ইষিরস্য গাথযোরৌ রথ। উরুযুগে বচোযুজা ইন্দ্রবাহা স্বর্বিদা৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ২০সূক্ত/১সাম– হে দেবভাবসমূহ! তোমাদের অনুগ্রহে আমরা অর্চনাকারিগণ, কর্মসমৰ্থ লাভের নিমিত্ত এবং জ্যোতিস্বরূপ জ্ঞান লাভের জন্য, স্তুতিরূপ বাক্যের দ্বারা নিত্যমিত্রের ন্যায় অনুকূল সর্বজ্ঞ দেবকে সকল যজ্ঞেই স্তব করতে সমর্থ হই। [মন্ত্রের মধ্যে বঃ পদ আছে বলে, ভাষ্যকার, অন্বয়মুখে হে স্তোতারঃ পদ অধ্যাহার করেছেন; এবং দক্ষসে অগ্নয়ে পদ দুটির অর্থ অগ্নিদেবকে বর্ধিত করবার নিমিত্ত বলে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ হে স্তোতৃগণ! তোমরা অগ্নিদেবকে বর্ধিত করবার জন্য সকল যজ্ঞের স্তুতিরূপ বাক্যের দ্বারা স্তব করো। মন্ত্রের চ শব্দটিরও ভিন্নক্রম বলে বঃ পদের পরেই অন্বয় করেছেন। তাতে অপরাংশের অর্থ হয়, তোমরা স্তব করো এবং আমরাও সেই অগ্নিকে প্রশংসিত করি। আমরা মনে করি, মন্ত্রের অন্তর্গত বঃ পদটিতে হৃদয়নিহিত দেবভাবকেই বোঝাচ্ছে। দক্ষসে পদের অর্থ কর্মর্সমর্থলাভের জন্য, এবং অগ্নয়ে পদের অর্থ অগ্নির ন্যায় জ্ঞানলাভের জন্য, মন্ত্রের চপদেরও এ পক্ষে সার্থক প্রয়োগ দেখা যায়। তাতে এই মন্ত্রের ভাবার্থ হয় এই যে, হৃদয়ে দেবভাবসমূহ পরিস্ফুট হলেই সাধক তার প্রতি কর্মেই নিত্যস্বরূপ পরব্রহ্মকে স্তব করতে সমর্থ হয়। তার প্রভাবে সৎকর্মসাধনে যুগপৎ সামর্থ্য ও প্রকৃষ্ট জ্ঞানলাভে অধিকার জন্মায়। তখনই দেবতা মিত্রের ন্যায়, সাধকের সৎকর্ম-সাধনে অনুকূল হন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-৪দ-১সা) প্রাপ্তব্য]। [এখানে এই সূক্তের দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত ছটি গেয়গান আছে]।  

২০/২– হীনপ্রজ্ঞ আমরা ভগবানকে যেন আরাধনা করি; শক্তিদায়ক, . আমাদের প্রতি কৃপাপরায়ণ, সেই ভগবান্ প্রার্থনাকারী আমাদের জ্ঞান প্রদান করুন; তিনি আমাদের আত্মশক্তিলাভে রক্ষক হোন, সর্বপ্রাণীর পরিত্রাণদাতা অপিচ, শক্তিদায়ক হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সর্ববিপদ হতে রক্ষা করুন এবং আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [সমস্ত মন্ত্রটিতেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। এই প্রার্থনার একটি বিশেষত্ব এই যে, — কেবল মানুষের জন্য নয়, সমগ্র প্রাণীজগতের জন্য প্রার্থনা এতে পরিদৃষ্ট হয়। বিশ্ববাসী ও ( সকলেই যেন শক্তিলাভ করে, বিপদ হতে পরিত্রাণ পায়, সকলেই যেন অন্তিমে ভগবানের চরণে স্থান পায়। — এমনই সর্বমঙ্গল্যের প্রার্থনাই এই মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়]।

২১/১– হে জ্ঞানদেব! আসুন– হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; আপনার সম্বন্ধীয় স্তুতিমন্ত্র যেন যথাযযাগ্যভাবে উচ্চারণ করতে সমর্থ হই; যদিও উচ্চারণ বৈকল্যাদিরূপ দোষযুক্ত হয়, তথাপি কৃপা করে সে স্তব গ্রহণ করুন; এবং অন্তরস্থিত এই ভক্তিসুধার দ্বারাই আমাদের মধ্যে পরিবৃদ্ধ হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — মন্ত্রসকল নিশ্চিত সর্বসিদ্ধিপ্রদ; উচ্চারণের বৈকল্য হেতু যদি দোষযুক্ত হয়, সে অপরাধ ক্ষমা করুন; আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করুন; আমাদের অন্তরস্থিত ভক্তিসুধার দ্বারা প্রহৃষ্ট হোন)। [এই উচ্চভাবপূর্ণ মন্ত্রে ভগবানের সান্নিধ্যলাভের জন্য সাধকের ভক্তের যাজ্ঞিকের আকুল আহ্বান প্রকাশ পেয়েছে। উচ্চারণের ত্রুটিতে মন্ত্রফল পণ্ড হয়। আনুষঙ্গিক অন্যান্য ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যও যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটে। এ মন্ত্রের লক্ষ্য, সেই বিঘ্ন দূর করার প্রার্থনা; ভগবান্ যেন ভক্তকে সেই শক্তি দেন, যার ফলে ভক্ত যেন সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে ভগবানের প্রীতিপ্রদ করে (ত্রুটিহীনভাবে) মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেন। আর যদি বা কোনরকম অঙ্গ-বৈকল্য হয়, মন্ত্র দোষ-দুষ্ট হয়, তাহলেও ভগবান্ যেন তাকে ক্ষমা করেন– মন্ত্র গ্রহণ করেন। কারণ ভক্তের হৃদয়ে ঈশ্বরের জন্য আকুলতা, ভক্তি ও ঐকান্তিকী নিষ্ঠায় কোন ফাঁকি নেই। এগুলির প্রতি লক্ষ্য রেখেই ভগবান্ যেন তাঁর পূজা গ্রহণ করেন]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। তাদের নাম-সাকুমশ্বম্]। [ছন্দার্চিকেও (১অ-১দ-৭সা) প্রাপ্তব্য]।

২১/২–- কোনও সাধকের হৃদয়ে আপনার অনুগ্রহাত্মিকা শক্তি বর্তমান থাকলে অর্থাৎ আপনি তার প্রতি কৃপাপরায়ণ হলে, তার হৃদয়ে আপনি আসন পরিগ্রহ করেন; এবং তাঁকে শ্রেষ্ঠ শক্তি প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবৎকৃপাতেই সাধক পরমধন লাভ করতে সমর্থ হন)। [মানুষ কিছু পরিমাণে কর্মসাধনের অধিকারী; কিন্তু ফলোভের অধিকার তার নেই। ভগবানের কৃপার উপর ফল-লাভ নির্ভর করে। আবার, সেই কর্মসাধনের শক্তিলাভও ভগবানের, কৃপাসাপেক্ষ। তিনি কৃপা করে যদি সাধকের হৃদয়ে আবির্ভূত হন, তবেই সাধকের জীবন ধন্য হয়। নতুবা মানুষের এমন শক্তি নেই, যার দ্বারা তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে। এই মন্ত্রে সেই কথাই বিবৃত হয়েছে। — প্রচলিত ব্যাখ্যায় এই মন্ত্রে অগ্নিকে আহ্বান করা হয়েছে; কিন্তু তার কোন প্রয়োজনীয়তাই দেখা যায় না। এটি ভগবান্ সম্বন্ধেই প্রযুক্ত]।

২১/৩– সর্বপ্রাণীদের পালক হে দেব! আপনার পূর্ণত্ববিধায়ক জ্যোতিঃ নিশ্চয়ই দিব্যদৃষ্টিদায়ক হয়; সেই জন্য অর্থাৎ দিব্যদৃষ্টি-প্রদানের নিমিত্ত, আপনি আমাদের পূজা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! প্রার্থনাকারী আমাদের দিব্যদৃষ্টি প্রদান করুন)। [ভগবানের জ্যোতিঃ থেকেই জগৎ আলোকিত হয়। তার জ্যোতিঃ-কণা পেয়েই জ্যোতিষ্কমণ্ডলী দীপ্তিমান্ হয়; তাঁর দিব্য আলোকেই মানুষের হৃদয় আলোকিত হয়, অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যায়। এই পরম জ্যোতিঃলাভের জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে]।

২২/১– রক্ষাস্ত্রধারী অর্থাৎ সর্বশক্তিমান্ আদিভূত হে দেব! সাধক যেমন আপনাকে আহ্বান, করেন, তেমনই রিপু সংগ্রামে প্রবৃত্ত আমরাও যেন বিচিত্র শক্তিযুক্ত আপনাকে রিপুর কবল হতে পরিত্রাণ লাভের জন্য আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের অনুসারী হই)। [হে প্রভো! সাধক যেমনভাবে আপনাকে আহ্বান করেন, আপনাকে আমরা যেন ঠিক তেমনিভাবে আহ্বান করতে পারি, তেমনিভাবে যেন আপনার অভিমুখে ছুটে যেতে পারি। রিপুগণ কর্তৃক আক্রান্ত হলে আপনার কৃপালাভ করে যেন রিপুজয়ে সমর্থ হই। আপনিই মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল ও বিপদ থেকে ত্রাণকারী। আপনিই মানুষকে রিপুজয়ের শক্তি প্রদান করেন। আমরা যেন কখনও আপনার চরণ ভুলে না থাকি। আমাদের কর্ম চিন্তা ও বাক্য যেন আপনার মঙ্গলনীতির অনুবর্তী হয়। আমাদের জীবন যেন আপনার সেবায় উৎসর্গ করতে পারি। মন্ত্রের মধ্যে এই প্রার্থনাই দেখতে পাওয়া যায়। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অপূর্ব ইন্দ্র! আমরা তোমাকে স্থূল ব্যক্তির ন্যায় পোষণ করে রক্ষালাভের অভিলাষে সংগ্রামে তোমায় আহ্বান করছি। তুমি নানারূপধারী। এই ব্যাখ্যায় যে, উপমা দেওয়া হয়েছে, তার সার্থকতা কি? সাধক বলছেন, তিনি দেবতাকে হোঁতকা চেহারা করিয়েছেন (অর্থাৎ পালোয়ান তৈরী করার উপযুক্ত খাবার খাইয়েছেন)। কারণ? কারণ সাধকের সাথে যুদ্ধ করতে প্রবৃত্ত শত্রুদের বিরুদ্ধে তাকে (অর্থাৎ দেবতাকে) লড়িয়ে দেবেন। — এইসব ব্যাখ্যা দৃষ্টেই ভিন্ন দেশবাসী ভিন্নধর্মাবলম্বী (এবং তথাকথিত কিছু স্বদেশীয়) জনগণ বেদ-সম্বন্ধে বিরুদ্ধ মন্তব্য প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু এসব ব্যাখ্যাও যে পাশ্চাত্যের অনুকারী তা বলাই বাহুল্য। — ভাষ্যকারের ব্যাখ্যাও সন্তোষজনক নয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৬দ-১০সা) পাওয়া যায়]। [এখানে এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রে একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম যথাক্রমে সৌভর এবং কালেয়]।

২২/২– হে দেব! সৎকর্মসাধনসামর্থ্যকে রক্ষা করবার জন্য আপনাকে আরাধনা করছি (অথবা হে সৎকর্মে! পাপকবল হতে রক্ষা পাবার জন্য যেন তোমাকে সম্পাদন করতে পারি)। যে দেবতা শত্রুনাশক নবজীবনদায়ক মহাতেজসম্পন্ন, সেই দেবতা আমাদের প্রাপ্ত হোন। বলাধিপতি হে দেব! আপনার স্নেহকামী আমরা সম্যকরূপে ভজনীয়, সকলের রক্ষক, আপনাকেই যেন আরাধনা করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই; সেই দেবতা আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [মন্ত্রটিতে আত্ম-উদ্বোধনমূলক প্রার্থনা রয়েছে। উপরে মন্ত্রের প্রথম পাদে। দুটি ব্যাখ্যা লক্ষণীয়। একটি ভগবানকে সম্বোধন করে এবং অপরটি সৎকর্মকে সম্বোধন করে। ভাষ্যকার কেবলমাত্র দেবতাকে সম্বোধন করে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাতে অবশ্য বিভক্তিব্যত্যয় স্বীকার করতে হয় এবং আমাদের মন্ত্রার্থে তা স্বীকৃতও হয়েছে। এতে ঐ ব্যাখ্যায় অর্থসঙ্গতিও রক্ষিত হয়েছে। বিবরণকার কর্ম শব্দকে সম্বোধন পদরূপে গ্রহণ করে এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অনর্থক জটিলতার সৃষ্টি হয় মাত্র। সৎকর্মসাধনসামর্থ্য ও ভগবানের শক্তি, এবং তাকে সম্বোধন করেই ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! যজ্ঞরক্ষাৰ্থ তোমার নিকট যাচ্ছি। এই ইন্দ্র শত্রুদের অভিভবকর, তিনি যুবা এবং উগ্র, তিনি আমাদের অভিমুখে আগমন করুন। আমরা সখা, হে ইন্দ্র! তুমি ভজনীয় ও রক্ষাকারী, আমরা তোমাকেই বরণ করছি। অথচ এই মন্ত্রবিধৃত প্রার্থনার মর্মার্থ এই যে, আমরা যেন সর্বদা কায়মনোবাক্যে ভগবানেরই অনুসরণ করতে পারি; ভগবান্ যেন আমাদের সেই শক্তি প্রদান করেন, তিনি যেন আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন]।

২৩/১– আরাধনীয় পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে দেব! সম্প্রতি পরমধনের জন্য আপনার নিকট প্রার্থনা করছি; সত্ত্বভাবযুক্ত সাধক যেমন সত্ত্বভাব প্রদানের দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হয়, তেমনি আমরা যেন এ আপনাকে প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি)। [শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং সেই পরমদেবতাকে শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারাই লাভ করা যায়। হৃদয় যে পর্যন্ত বিশুদ্ধ না হয়, কর্মে বাক্যে চিন্তায় সাধক যে পর্যন্ত বিশুদ্ধভাবে চলতে না পারেন, সে পর্যন্ত ভগবানের সান্নিধ্য লাভ হয় না। সমস্তই পরস্পর মিলনের মধ্যে যোগসূত্র। অসম কখনও অসমের সাথে মিলিত হতে পারে না। ভগবান্ বিশুদ্ধভাব ও বিশুদ্ধজ্ঞানের আধার। সুতরাং মুক্তিকামী সাধক নিজেকে সকলরকম অবিশুদ্ধ, অসৎ কর্মের ও চিন্তার সংস্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করেন। যে ভাবধারার সাহায্যে সাধক ভগবানের চরণে পৌঁছাতে পারেন, সেই ভাবধারা লাভের জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা দেখতে পাই। প্রচলিত ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যার একটি বঙ্গানুবাদ –হে স্তুতিভা ইন্দ্র! জলে গমনকারী ব্যক্তিগণ যেমন (ক্রীড়াৰ্থে নিকটবর্তী ব্যক্তিদের প্রতি) জল বিসৃষ্ট করে, তেমন আমরা সম্প্রতি তোমার সাথে মিলিত হবো। এই উপমার মর্মার্থ-গ্রহণে আমরা অসমর্থ। এমন প্রার্থনার অর্থও বোধগম্য হয় না]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৬দ-৮সা) প্রাপ্তব্য]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে]।

২৩/২– মহাশক্তিসম্পন্ন হে দেব! সমুদ্রতুল্য আপনাকে সাধকবর্গ ঐকান্তিক প্রার্থনার দ্বারা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন; রিপুনাশে পাষাণকঠোর হে দেব! আপনি নিত্যকাল আমাদের প্রবর্ধিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -সাধকগণ প্রার্থনার দ্বারা ভগবানকে লাভ করেন; ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [প্রার্থনার বলেই ভগবান্ সাধকের নিকট আগমন করেন– অবশ্য সেই আন্তরিক হওয়া চাই। অন্তরের অন্তর থেকে উদ্ভূত না হলে সেই প্রার্থনা, প্রার্থনাই নয়। তাই সাধক নিজেকে প্রার্থনার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চান, তার অস্তিত্ব প্রার্থনায় পর্যবসিত হয়। ভগবানের কৃপায় মানুষের রিপুগণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, ভববন্ধন টুটে যায়। ভগবানই এই রিপুগণকে বিনাশ করেন; সেইসঙ্গে ভক্ত সাধকদের হৃদয়ে পরাজ্ঞান বিতরণ করে চিরদিনের জন্যই রিপু আক্রমণের ভয় নিবারণ করেন। তাই সেই পরাজ্ঞান লাভ করবার জন্য মন্ত্রের শেষে প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়]।

২৩/৩– অভীষ্টসাধক মহৎ সৎকর্মে, সাধকগণ প্রার্থনাসমন্বিত স্বর্গপ্রাপক ভগবৎপ্রাপক পাপহারক ভক্তিজ্ঞানকে নিত্যকাল স্তোত্রের দ্বারা সম্মিলিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা কর্ম ভক্তি জ্ঞানের দ্বারা ভগবানকে লাভ করেন)। [ভগবানকে প্রাপ্তির তিনটি পন্থা অথবা ধন-উপায় আছে। তারা কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান। এই তিনটির যে কোন একটির অবলম্বনে সাধক সাধনের পথে অগ্রসর হতে পারেন। কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞানের মধ্যে পরস্পরের অতি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। একটির উপস্থিতিতে, উপযুক্ত সাধনায় অন্য দুটির আবির্ভাব অনুমান করা যায়। প্রার্থনাপরায়ণ সাধক এই তিনের সম্মিলন সাধন করে মোক্ষলাভে সমর্থ হন। মন্ত্রের মধ্যে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ পরিদৃষ্ট হয়। যেমন, একটি বঙ্গানুবাদ– গমনশীল ইন্দ্রের প্রশস্ত যুগবিশিষ্ট মহৎ রথে তাঁর বাহনভূত এবং বচনমাত্রেযোজিত অশ্বদ্বয়কে স্তোতাগণ স্তোত্রের দ্বারা যোজিত করেন। স্তোতাগণ স্তোত্রের দ্বারা কিভাবে যোজনা করবেন? রথ শব্দে পূর্ব-অনুসারে এখানেও আমরা সৎকর্ম অর্থে সঙ্গতি লক্ষ্য করি। হরী পাপহারক জ্ঞানভক্তি, সাধক প্রার্থনার দ্বারা জ্ঞান-ভক্তি-কর্মের সমন্বয় সাধন করেন। জ্ঞানভক্তি ভগবৎপ্রাপক– জ্ঞানভক্তির সাহায্যেই স্বর্গপ্রাপ্তি সম্ভবপর। মন্ত্রে প্রার্থনাপরায়ণ সাধকের জ্ঞান-ভক্তি কর্মের সাহায্যে মোক্ষলাভের তথ্যই বিবৃত হয়েছে]।

— প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত–

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী