উত্তরার্চিক — সপ্তম অধ্যায়

এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্তানুসারে)– ১-৬, ১১-১৩, ১৭-২১ পবমান সোম; ৭/২২ অগ্নি; ৮ আদিত্য; ৯/১৪/১৬ ইন্দ্র; ১০ ইন্দ্র ও অগ্নি; ১৫ সোম; ২৩ বিশ্বদেবগণ; ২৪ ইন্দ্র।
ছন্দ– ১
/৭ জগতী; ২-৬, ৮-১১, ১৩-১৫।১৭ গায়ত্রী; ১২ প্রগাথ বার্হত; ১৬ মহাপঙক্তি; ১৮ (১) যবমধ্যা গায়ত্রী; ১৮ (২) সতো বৃহতী; ১৯ উষ্ণিক; ২০ অনুষ্ঠুভ; ২১ ত্রিষ্ঠুভ; ২২ দ্বিপদা বিরাট (বা ভুরিগবৃহতী); ২৩ দ্বিপদা ত্রিষ্ঠুভ; ২৪ দেবা বৃহতী।
ঋষি– প্রতি সূক্তের শেষে উল্লেখিত আছে।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– জ্যোতির্মজ্ঞস্য পবতে মধু প্রিয় পিতা দেবানাং জনিতা বিভূবসু। দধাতি রত্নং স্বধয়োরপীচ্যং মদিন্তমো মৎসর ইন্দ্রিয়ো রসঃ ॥১॥ অভিক্রন্দন কলশং বাজ্যৰ্ষতি পতির্দিবঃ শতধাররা বিচক্ষণঃ। হরির্মিত্রস্য সদনেষু সীদতি মম্‌জানোহবিভিঃ সিন্ধুভিষা॥২॥ অগ্রে সিন্ধুনাং পবমাননা অর্ষস্যগ্রে বাচো অগ্রিয়ো গোষু গচ্ছসি। অগ্রে বাজস্য ভজসে মহদ ধনং স্বায়ুধঃ সোতৃভিঃ সোম সূয়সে৷৩৷৷

সূক্ত ২– অসৃক্ষত প্র বাজিনো গব্যা সোমাসো অশয়া। শুক্রাসো বীরয়াশবঃ ॥১॥ শুম্ভমানা ঋতায়ুভিজ্যুমানা গভস্ত্যোঃ । পবন্তে বারে অব্যয়ে৷৷২৷ তে বিশ্বা দাশুষে বসু সোমা দিব্যানি পার্থিবা। পবন্তামান্তরিক্ষ্যা৷৩৷৷

সূক্ত ৩– পবস্ব দেববীরতি পবিত্র সোম রংহ্যাঁ। ইন্দ্ৰমিন্দো বৃষা বিশ৷৷৷৷৷ অ বচ্যস্ব মহিপসরো বৃষেন্দো দ্যুম্নবমঃ। আ যযানিং ধর্ণাসিসদঃ ॥২৷৷ অধুক্ষত প্রিয়ং-মধু ধারা সুতস্য বেধসঃ। অপো বসিষ্ট সুতুঃ ॥৩৷৷ মহান্তং ত্বা মহীরাপো অর্ষন্তি সিন্ধবঃ। যদ গোভির্বাসয়িষ্যসে৷৷৷৷ সমুদ্রো অপসু মামৃজে বিষ্টম্ভো ধরুণণা দিব। সোম পবিত্রে অময়ুঃ ॥৫৷৷ অচিক্ৰদদ বৃষা হরির্মহা মিত্রো ন দর্শতঃ। সং সূর্যেণ দিদ্যুতে৷৬৷৷ গিরস্ত ইন্দ ওজসা মম্‌জ্যন্তে অপসুবঃ। যাভিমদায় শুম্ভতে৷৷৷৷ তং ত্বা মদায় ধৃদ্বয় উ লোককৃতুমীমহে। তব প্রশস্তয়ে মহে৷৮৷৷ গোষা ইন্দো নৃষা অস্যশ্বসা বাজসা উত। আত্মা যজ্ঞস্য পুর্বঃ ॥৯॥ অস্মভ্যমিন্দবিন্দ্ৰিয়ং মধধাঃ পবস্ব ধারয়া। পর্জন্যে বৃষ্টিমা ইব৷১০৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– হে ভগবন! আপনি সৎকর্মের দীপক অর্থাৎ উদ্দীপক (সৎকর্মে নিয়োগকর্তা) হন। অপিচ, আপনি প্রার্থনাকারিদের তাদের প্রতিদায়ক অভীষ্টপূরক পরমানন্দ প্রদান করেন। আপনি পিতা, আপনি সৎ-ভাবের জনয়িতা, অপিচ, আপনি পরমধনদাতা। আপনি শুদ্ধসত্ত্বরূপ অবিনশ্বর রত্নকে (পরমধনকে) ধারণ (অর্থাৎ প্রদান) করেন। অপিচ, হে ভগবন! আপনি পরমানন্দদায়ক, সকলের আকাঙক্ষণীয়, আপনার আপন শক্তিদায়ক বীর্য প্রদান করুন। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — ভগবানের অনুগ্রহে সৎকর্মের সুফল উপজিত হয়। ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের কর্ম সুফলপ্রদ ও পরমানন্দদায়ক হোক)। অথবা– হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সৎকর্মের দীপক বা প্রেরক; অপিচ, ভগবানের প্রীতিহেতুভূত পরমানন্দস্বরূপ হয়ে ক্ষরিত হও। তারপর তুমি সৎকর্মের পালক, দেবভাবসমূহের উৎপাদক এবং শ্রেষ্ঠধনের প্রাপক হও। রসস্বরূপ অর্থাৎ আদিভূত পরমানন্দদায়ক, সকলের আকাঙক্ষণীয়, ভগবানের আত্মভূত তুমি অবিনাশী হয়ে ইহলোক-পরলোকের ব্যবধায়ক পরমধন ধারণ (প্ৰদান) করো। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-জ্ঞাপক। ভাব এই যে, ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সহায়ক হোক)। [দুরকম অন্বয়ে মন্ত্রে যে উচ্চভাব সূচিত হতে পারে, তার জন্যই দুটি অনুবাদ দেওয়া হয়েছে। প্রথম পক্ষে মন্ত্রটি ভগবৎসম্বন্ধে এবং দ্বিতীয় পক্ষে মন্ত্রটি শুদ্ধসত্ত্ব সম্বোধনে বিনিযুক্ত হতে পারে। দুই পক্ষেই নানারকম গুণবিশেষণে ভগবানের মাহাত্ম্যই প্রকাশ পেয়েছে। পরমপিতা ভগবান্ যে এই বিশ্বের ভাবয়িতা, স্থাবর-জঙ্গম চরাচরাত্মক বিশ্বের পালক ও রক্ষক, স্থূলতঃ তিনিই যে সকলের উৎপত্তির কারণ রসস্বরূপ, — মন্ত্র তা-ই ঘোষণা করছেন। — মন্ত্রের যে একটি ব্যাখ্যানুবাদ প্রচলিত আছে, সেটি এই– এই সোম : (সোমরস) যজ্ঞের ঔজ্জ্বল্যসম্পাদক আলোকস্বরূপ; ইনি সুমিষ্ট মধুর ন্যায় ক্ষরিত হচ্ছেন। ইনি দেবতাদের জন্মদাতা পিতা, ধনের অধিপতি। ইনি নানারকম অপ্রত্যক্ষ-ধন দ্যুলোকে ও ভূলোকে বিতরণ করেন। ইনি ইন্দ্রের পানের উপযোগী অতি চমৎকার রস, এঁর মাদকতা-শক্তি নিরুপম। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১/২– পরমশক্তিসম্পন্ন শুদ্ধসত্ত্ব শত্রুসমূহকে অভিভূত করে হৃদয়রূপ আধারকে প্রাপ্ত হন। অপিচ, অন্তরিক্ষের ন্যায় উন্নত-স্থানের পালক অর্থাৎ হৃদয়ের বিশ্বদ্রষ্টা পাপহারক সেই শুদ্ধসত্ত্ব অসংখ্য ধারায়, সৎকর্মকারিগণের মিত্রভূত অর্থাৎ ভগবানের সাথে মিত্রতাসাধক সৎকর্মের স্থানে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন। সেই শুদ্ধসত্ত্ব সাগর-সঙ্গমে অভিলাষী স্যন্দনশীল নদীর মতো ভগবানের অনুসারী জনকে স্নেহধারায় পরিশুদ্ধ করে, তাদের অভীষ্টফল– ধর্ম-অর্থকাম-মোক্ষরূপ চতুর্বর্গ ফলবর্ষণ (সাধন) করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — মায়ায় আবদ্ধ জীব যদি ভগবানের অনুসারী হন, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে তিনি মুক্তি লাভ করতে পারেন)। [যখনই কোনও সৎ ভাবের বিকাশ সূচনা হয়, রিপুশত্রুগণ এসে প্রতিবন্ধকতা-আচরণ করে। অজ্ঞানতাই– সকল শত্রুর জনক। শুদ্ধসত্ত্ব-দিব্যজ্ঞান সেই অন্তঃশত্রু-সমূহকে বিনাশ করেন অর্থাৎ জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞানতার বিনাশের ফলে– মূল শত্রুর উচ্ছেদ-সাধনে সকল শই বিনষ্ট হয়। প্রথমাংশে সেই অন্তঃশত্রু-নাশের কামনাই প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় অংশের বক্তব্য– সৎ-ভাবের প্রভাবে মানুষ ভগবানের সখিত্ব লাভ করতে পারে। তাই এই অংশের উদ্বোধনা, শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবানের ভাবে ভাবান্বিত হতে পারলেই, আমরা তার স্বারূপ্য সাযুজ্য লাভে সমর্থ হবো। তৃতীয় অংশে আত্মায় আত্মসম্মিলনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। নানাদিক্‌-দেশগামী নদী যেমন বিভিন্নমুখে প্রধাবিত হয়ে পরিশেষে সমুদ্রেই গিয়ে মিলিত হয়; তেমনই, ভগবানের অনুসারী জন সাধনক্ষেত্রে বিভিন্ন পন্থায় অগ্রসর হলেও পরিশেষে সেই সর্বদ্রষ্টা বিশ্বপতি ভগবানেই আত্মলীন করে থাকেন]।

১/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি উৎকর্ষের দ্বারা বিশুদ্ধ হয়ে, ভগবৎ-অনুসারী জনের হৃদয়ে সৎ ভাবজননের জন্য গমন করেন। (শুদ্ধসত্ত্ব সৎভাবজনক এবং সৎকর্মের প্রেরক। সৎকর্মের দ্বারা উৎকর্ষসাধনে-শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাব উৎপন্ন করে)। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! স্তোত্রমন্ত্রের মধ্যে জ্ঞানকিরণের দ্বারা প্রবর্ধিত হয়ে আপনি সাধকদের হৃদয়ে উপজিত হন। এই রকম আপনি, অর্চনাকারিদের পরমধন প্রদানের জন্য তাদের রিপুসংগ্রামে রিপুসমূহকে বিনাশ করেন। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সৎকর্মের অনুষ্ঠাতৃদের সৎকর্মসাধন-সামর্থ্য বিধান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। রিপুসংগ্রামে সৎ ভাবসমূহই রক্ষক এবং পালক। ভগবৎ-অনুসারী ব্যক্তির সৎ-ভাব সঞ্চয় করা একান্ত আবশ্যক)। [এই সূক্তের তিনটি সামমন্ত্রের ঋষি– (১) আকৃষ্ট মাষত্রয়ও (২-৩) সিকতা নিবাবরী। এই মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম যথাক্রমে, — মরুতান্ধেনু এবং বরুণসাম]।

২/১– জ্ঞানলাভের ইচ্ছায়, পরাজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য, এবং কর্মে সামর্থ্য লাভের জন্য বীর্যবন্ত বলবন্ত আশুমুক্তিদায়ক সত্ত্বভাব সাধকগণ কর্তৃক হৃদয়ে প্রকৃষ্টরূপে উৎপাদিত হয়। (ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধনের দ্বারা সাধকেরা অভীষ্টপূরক সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সত্ত্বভাবের সাথে জ্ঞানেরও উন্মেষ হয়। তা মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। তাই সত্ত্বভাব আশুমুক্তিদায়ক (আশবঃ)। [এই সামমন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫৩-২দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২/২– সৎকর্মকারী আত্মদর্শিগণের দ্বারা পরিশুদ্ধ হয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ, স্নেহধারায় ক্ষরিত হয়। অপিচ, জ্ঞানভক্তিরূপ বাহু দুটির দ্বারা উৎপাদিত সেই শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ সৎ-ভাব-অবরোধক শত্রুসমূহের মধ্যে ক্ষরিত হয়ে তাদের পবিত্র করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সৎ ভাবের প্রভাবে শত্রুও মিত্রভূত হয়ে থাকে)।

২/৩– সাধকদের আকাঙক্ষণীয় সেই শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎকামী প্রার্থনাকারীদের দিবিভব, পৃথিবী সম্বন্ধী এবং অন্তরিক্ষলোক-সম্বন্ধি সকল রকম ধন সর্বতোভাবে প্রদান করেন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। উদ্বোধনার ভাব এই যে, সৎভাব শুদ্ধসত্ত্ব পরমধন লাভের হেতুভূত। অতএব সৎ-ভাবের সঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হওয়া একান্ত কর্তব্য)। [সোম বা শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ ইহলোক (পৃথিবী) পরলোক (দিবি বা স্বর্গলোক)– সর্বলোকসম্বন্ধি কল্যাণ প্রদান করেন; তারই করুণা বলে ধর্ম-অর্থকাম-মোক্ষ চতুর্গের ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়, — মন্ত্র এই উপদেশই প্রদান করছেন]। [এই সূক্তের ঋষি কশ্যপ, মারীচ]।

৩/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি দেবভাবের উৎপাদক। অতএব ত্বরায় আমার হৃদয়ে প্রভূত পরিমাণে সৎ-ভাব সংজনন করুন। অথবা, হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎ-ভাবের অবরোধক অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করে, আমাদের হৃদয় যাতে পবিত্রতা প্রাপ্ত হয়, সেইভাবে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। স্নিগ্ধতাকারক পরমানন্দদায়ক হে শুদ্ধসত্ত্ব! অভীষ্টবর্ষক আপনি সর্বশক্তিমান্ ভগবানের সাথে সম্মিলিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাবজনক ও পরমানন্দ-প্রদায়ক। ভাব এই যে, — সৎ-ভাব আমাদের পক্ষে ভগবৎ-প্রাপক হোক)। [এই মন্ত্রটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা, — এই বলবান সোম, (অবশ্যই সোমরস), অন্তরিক্ষে গমন করছেন, ইনি অভিলাষপ্রদ পবিত্রকারী এবং দীপ্ত ইন্দ্রের অভিমখে গমন করছেন। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৩/২– স্নিগ্ধতা সম্পাদক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি অভীষ্টবৰ্ষক অতিশয়িতরূপে শ্রেষ্ঠধনযুক্ত অথবা পরমধনপ্রাপক এবং সকলের ধারক (রক্ষক) হন। অতএব (লোকরক্ষার জন্য) আপনি পরমকল্যাণপ্রদ শ্রেষ্ঠ সৎ-ভাবরূপ অন্ন আমাদের প্রদান করুন। অপিচ, হৃদয়রূপ সৎ-বৃত্তির মূলকে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সৎ-ভাবেই জগৎ সংরক্ষিত হয়। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরম কল্যাণময় ভগবান্ আমাদের সৎপথে প্রতিষ্ঠিত করে, পরাশান্তি প্রদান করুন)।

 ৩/৩– পরমপবিত্র অভিলষিত সামগ্রী (পরমার্থ) প্রদাতা শুদ্ধসত্ত্বের অমৃতের দ্বারা ভগবানের প্রীতিসাধক অমৃতময় সৎ-ভাব উৎপাদন করে। অতএব শোভনকর্মা (কর্মফল-প্রদাতা) শুদ্ধসত্ত্ব আমাকে সৎ-ভাবের দ্বারা পরিবৃত করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যজ্ঞাপক এবং প্রার্থনামূলক। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমাদের মধ্যে সৎ-ভাবের সঞ্চার হোক এবং সেই সৎ-ভাব আমাদের পরমার্থপ্রদ হোক)।

৩/৪– হে ভগবন! আপনি নিত্যকাল ভগবৎ-পরায়ণ আত্মদর্শিগণকে জ্ঞানজ্যোতিঃর দ্বারা পরিবৃত করেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক ভক্ত সাধকদের মধ্যে আপন স্বরূপ প্রকটিত করেন)। সাধক যখন ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করেন, তখন ভগবৎ-ভাবে প্রবর্ধিত হয়ে, স্যন্দনশীলা নদীর মতো (অর্থাৎ সাগর-সঙ্গমে অভিলাষিণী নদী যেমন নিজের জলরাশি সমুদ্রে নিঃসারণ করে, তেমনভাবে) এ নিজের হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব ভক্তিধারাকে আপনার উদ্দেশে প্রবাহিত করেন অর্থাৎ আপনার সাথে মিশিয়ে দেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। মন্ত্রে আত্মসম্মিলনের জন্য উদ্বোধনা বর্তমান। ভাব এই যে, নদী যেমন সাগর-সঙ্গমের অভিলাষে সাগরের অভিমুখে প্রধাবিত হতে হতে পরিশেষে নিজেকে সাগরের সাথে মিলিয়ে দেয়, তেমনি শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধক ভগবানের সাথে আত্মার সম্মিলন সাধন করেন)। অথবা– হে শুদ্ধসত্ত্ব! যখন কর্মসমূহে আপনি ভগবৎপরায়ণ শরণাগত। ব্যক্তিকে জ্ঞানকিরণের দ্বারা পরিব্যাপ্ত করেন (অর্থাৎ সৎকর্মসাধনে সাধক যখন কর্মফলস্বরূপ দিব্যজ্ঞান লাভ করে), তখন মহিমান্বিত আপনাকে উদ্দেশ করে, স্যন্দনশীলা নদীর মতো তার অন্তরের ভক্তিসুধা আপনাকে সমর্পণ করেন। (ভাব এই যে, — দিব্যজ্ঞান লাভ করে সাধক নিজেকে পরমাত্মায় সংযোজিত ও সম্মিলিত করেন)। [দুরকম অন্বয়েই মন্ত্রে চরম প্রার্থনা– পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় অন্বয়ে আত্মসম্মিলন-ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে কর্মের প্রাধান্য প্রখ্যাপিত দেখা যায়। কিন্তু এমন যে উচ্চভাবমূলক বেদমন্ত্র, প্রচলিত ব্যাখ্যায় তার কেমন বিকৃতি হয়েছে, প্রত্যক্ষণীয়– যখন তুমি গব্যের দ্বারা আচ্ছাদিত হও, তখন হে মহান্ সোম (অবশ্যই সোমরস নামক মাদকদ্রব্য)! তোমার অভিমুখে ক্ষরণশীল মহৎ জল গমন করে। — অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৩/৫– হে ভগবন! আপনি সমুদ্রের ন্যায় রসয়িতা হন। (সমুদ্র যেমন স্নেহার্দ্রতাসাধক উদক ইত্যাদি ধারণ করে অথবা স্নেহার্দ্রতাসাধক উদকসমূহ নদীসরিত ইত্যাদিতে প্রেরণ করে, তেমন ভগবানও ভগবৎ-পরায়ণ জনকে আপন সত্তায় আশ্রয় প্রদান করেন, তাদের সৎ-ভাব পোষণের সামর্থ্য পোষণ করেন ও তাদের মধ্যে স্নেহধারা ক্ষরণ করেন)। অপিচ, হে ভগবন! শত্রুর প্রতিবন্ধকতা নাশক আপনি দ্যুলোকের মতো উন্নত সৎ-ভাবমণ্ডিত হৃদয়কে ধারণ রক্ষণ ও পোষণ করেন। অতএব আপনার অনুগ্রহে আমাদের আকাঙ্ক্ষণীয় শুদ্ধসত্ত্ব, সৎ-ভাব ইত্যাদি পোষণের দ্বারা আমাদের অভিসিঞ্চিত করুক। (মন্ত্রটি ভগবৎ-মাহাত্ম্য-প্রকাশক। প্রার্থনামূলকও বটেন। ভগবান্ শরণাগতকে রক্ষা করেন। শরণাগতের পালক সেই ভগবানকে কেবল সৎ-ভাবের দ্বারাই প্রাপ্ত হওয়া যায়। ভাব এই যে, — ঈশ্বরে আত্মসম্মিলনের জন্য সৎ-ভাব সঞ্চয় করা বিধেয়)। [মন্ত্রের একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা দেখা যায়; যথা, সোম হতে (রস) উৎপন্ন হয়, তিনি (সোম) স্বৰ্গকে ধারণ করেন, তিনি জগৎ স্তম্ভিত করেন, তিনি আমাদের কামনা করেন এবং জলের মধ্যে সংস্কৃত হন। মন্ত্রে এ অর্থের আদৌ সঙ্গতি নেই। রসবাচক কোন পদই মন্ত্রে নেই। তবে সমুদ্রং পদের ভাষ্যকার অর্থ করেছেন সমুদ্রবৎ দ্রবন্তি অস্মাৎ রসা ইতি। তা থেকেই (সোম হতে) রস উৎপন্ন হওয়ার অসঙ্গত কল্পনা ব্যাখ্যায় গৃহীত হয়েছে বলে মনে করা যায়]।

৩/৬– জ্ঞানদায়ক, অভীষ্টবর্ষক, পাপহারক পূজ্য মিত্রতুল্য সর্বজ্ঞ ভগবান্ জ্ঞানকিরণের সাথে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — জ্ঞানসমন্বিত আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। অথবা– সর্বাভীষ্টপূরক পাপহারক মহত্ত্ব ইত্যাদি সম্পন্ন ও সকলের বরণীয়, সখির ন্যায় পরমপ্রিয় এবং সকলের প্রতিদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব সকলের জ্ঞানের উন্মেষণ করেন। সেই শুদ্ধসত্ত্ব পরমজ্যোতিঃর সাথে অন্তরকে সম্যকমে উদ্ভাসিত করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। মন্ত্র শুদ্ধসত্ত্বের শক্তি প্রকটন করছেন। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে লোকসকল জ্ঞানের জ্যোতিঃ লাভ করে)। [শুদ্ধসত্ত্বই মূলীভূত, শুদ্ধসত্ত্বই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধারস্থানীয়। মন্ত্র বলছেন– যদি পরমপদ লাভ করতে চাও, শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চয়ে প্রত্নপর হও। ভগবান ও তার বিভূতি ও অভিন্ন। ভগবানকে পেতে হলে তাঁর বিভূতিসমূহের আরাধনা করো; সেই ভাবে ভাবান্বিত হতে এই সচেষ্ট হও। যখন তাঁর বিভূতিসমূহ তোমার অধিগত হবে, তখনই আধারস্থানীয় ভগবান্ স্বয়ং আবির্ভূত হবেন। মন্ত্র এই সত্যই প্রকটন করছেন। দ্বিতীয় অন্বয়েরও এটাই তাৎপর্য]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ-আর্চিকেও (৫অ-৪দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়।

৩/৭– হে স্নিগ্ধসত্ত্বস্বরূপ পরমেশ্বর! আমাদের আনন্দবর্ধনের জন্য ভগবৎ-প্রীতিসাধক যে সকল স্তুতির (কর্মের) দ্বারা প্রবর্ধিত হয়ে আপনি অর্চনাকারীকে অলঙ্কৃত করেন অর্থাৎ তাদের হৃদয়ে উপজিত হন; আপনার সম্বন্ধি সৎকর্মে প্রেরণকারী সেই স্তুতিসমূহ আপনার পরম শক্তির দ্বারা পরিশোধিত হয়, অর্থাৎ ভগবনকামী ব্যক্তিকে পরিশোধিত করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং ভগবৎ মাহাত্ম্যখ্যাপক। ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কর্মই ভগবানের প্রীতির হেতুভূত হয়। অতএব সঙ্কল্প– আমাদের কর্মশক্তি ভগবানের প্রতিদায়ক হোক। ভাব এই যে, আমাদের কর্মশক্তি আমাদের ভগবানের সাথে সম্মিলিত করুক)। অথবা-হে স্নেহসত্ত্বস্বরূপ ভগবন! আপনার পরমশক্তির প্রভাবে, আমাদের সৎকর্মসাধক (অথবা সৎকর্মের প্রেরক) ভগবৎপ্রীতিসাধক স্তুতিসমূহ বিশুদ্ধ অর্থাৎ আমাদের কল্যাণসাধক হোক। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সেই সকল স্তুতির দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন এবং আমাদের অলঙ্কৃত অর্থাৎ ভগবানের সাথে সংযোজিত করুন)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যা-হে ইন্দ্র! মত্ততার জন্য তুমি যার দ্বারা অলঙ্কৃত হও, সেই কমেচ্ছা-সম্বন্ধীয় স্তুতি তোমার বলপ্রভাবে সংশোধিত হোক। অথচ মন্ত্রের মধ্যে মত্ততার জন্য বোঝারার উপযোগী কোন পদই নেই। ভাষ্যকার মদায় পদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অহেতুক এই অর্থ অধ্যাহার করেছেন। আসলে সোম-কে মাদকদ্রব্য হিসাবে চিহ্নিত করার জন্যই এতসব প্রচেষ্টা। তন্ত্রশাস্ত্রে আছেব্রহ্মরন্ধ্র থেকে সহস্ৰারে যে সোমধারা ক্ষরিত হয়, সেই ধারা পান করে যিনি আনন্দ লাভ করেন, তাঁকেই মন্ত্রসাধক বলা যায়। আর, মদ্যপান করলেই মানুষ যদি সিদ্ধিলাভ করত, তাহলে মদ্যপানরত পাষণ্ডেরা সকলেই তো সিদ্ধিলাভ করেছে। ফলতঃ, সোমে বা শুদ্ধসত্ত্বে যে মত্ততার উদয় হয়, এ সেই মত্ততা। সাধকের মনমধুকর যখন শ্রীভগবানের চরণ-সরোজে মধুপানে মত্ত হয়ে পড়ে, সেই সময়ের সেই অবস্থাতেই– সেই পরম আনন্দময় অবস্থাকেই সোমের মত্ততা বলে। অভিহিত করা উচিত। সোম সুসংস্কৃত হয় তখনই– যখন তোমার (ভগবানের) আমার (সাধকের) সম্বন্ধ অবিচ্ছিন্ন হয়; উপাস্য উপাসক যখন এক হয়ে যায়। ভগবাকে সোম প্রদান করা সার্থক হয় তখনই– যখন সামীপ্য আসে, যখন স্বারূপ্য লাভ হয়, যখন সাযুজ্য ঘটে। এই লক্ষ্য নিয়েই বেদমন্ত্রের অবতারণা। — দ্বিতীয় অন্বয়টিও সেই একই উচ্চ-ভাবমূলক। সেখানেও কর্ম-সামর্থ্য-লাভের এবং সেই কর্মের প্রভাবে ভগবানে আত্মশীল করবার আকাকা প্রকাশ পেয়েছে।  ৩/৮-স্নেহসত্ত্বস্বরূপ হে ভগবন। অন্তঃশনাশের নিমিত্ত, অপিচ, পরমানন্দলাভের জন্য, সর্বশক্তিমান্ বিশ্বপতি আপনার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি। অপিচ, আপনার সম্বন্ধি শ্রেষ্ঠ আরাধনার নিমিত্ত আপনার করুণা প্রার্থনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবানের অনুগ্রহ ভিন্ন ভগবানের পূজা সম্ভব নয়। তাই প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পূজার সামর্থ্য প্রদান করুন)।

৩/৯– স্নেহসত্ত্বস্বরূপ হে ভগবন! আপনি সৎকর্মের স্বরূপ অথবা কর্মে নিত্যবিদ্যমান পুরাণপুরুষ এবং আত্মস্বরূপ পরমাত্মারূপে নিত্যবিরাজমান হন। (শুদ্ধসত্ত্ব বা ভগবান্ সৎকর্মের স্বরূপ অর্থাৎ কর্মহ ব্রহ্মস্বরূপ)। বিশ্বকর্মী আপনি জ্ঞানধন-দানে আমাদের প্রবৃদ্ধ করুন। আপনি মরণধর্মশীল মানবের শোভন আয়ুঃপ্রদাতা, কর্মশক্তি-বিধাতা, এবং পরমধনদাতা। (অতএব আপনি আমার প্রতি এ প্রসন্ন হোন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় ইন্দ্রকে যজ্ঞের পুরাতন আত্মা বলা হয়েছে এবং তার কাছ থেকে গো পুত্র অশ্ব ও অন্ন প্রার্থনা করা হয়েছে। ভাব এই যে, মদ্যপানে উন্মত্ত ইন্দ্র নামে এক বিকৃতমস্তিষ্ক অপ্রকৃতিস্থ ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে ঐসব পদার্থ আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু এ ঐ ইন্দ্র নন, ইনি সেই সর্বব্যাপী ব্রহ্ম, যিনি সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তিনি কর্মময় এবং কর্ম ব্রহ্মময়। এখানে গো বা গোষা গাভী নয়, জ্ঞানকিরণ বা জ্ঞানজ্যোতিঃ। অশ্বসা পদের কর্মশক্তি অর্থই সুসঙ্গত, অশ্ব বা ঘোড়া নয়। নৃষা অর্থে পুত্র নয়, মরণধর্মশীল মানবগণ বোঝাই যুক্তিসম্মত। বাজ অর্থে পরমধনবিধাতা]।

৩/১০– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বর্ষণকারী মেঘের ন্যায়, অর্থাৎ মেঘ যেমন পৃথিবীকে বারিবর্ষণের দ্বারা রসসঞ্চার করে, তুমিও তেমন ভগবানের প্রীতিসাধক হয়ে, আনন্দদায়ক ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভূত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং সঙ্কল্পজ্ঞাপক। ভাব এই যে, আমাদের সৎ-ভাবসমূহ ভগবৎপ্রাপক হোন)। [এই সূক্তের অন্তর্গত সামমন্ত্রগুলির ঋষি– মেধাতিথি কাণ্ব]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৪– সনা চ সোম জেষি চ পবমান মহি শ্ৰবঃ। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৷৷৷৷ সনা জ্যোতিঃ সনা স্বতর্বিশ্বা চ সোম সৌভগা। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৷২৷৷ সনা দক্ষত ক্রতুমপ সোম মৃধা জহি। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৩৷৷ পবীতারঃ পুনীতন সোমমিন্দ্রায় পাতবে। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৷৷৷ ত্বং সূর্যে ন আ ভজ তব ক্ৰত্বা তবোতিভিঃ। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৷৷৷ ত্বব ক্ৰত্বা তবোতিভিক্রোক পশ্যেম সূর্য। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৬৷৷ অভ্যর্ষ স্বায়ুধ সোম দ্বিবহসং রয়িম্। অথা নো বস্যসস্কৃধি৷৷৷৷ অভ্যর্যানপচ্যুততা বাজিৎসমৎসু সাসহিঃ। অথা নো বস্যসস্কৃধি। ৮। ত্বাং যজ্ঞৈরবীবৃধন্ পবমান বিধর্মণি। অথা নো বস্যসস্কৃধি। ৯৷ রয়িং নশ্চিমশ্বিনমিন্দো বিশ্বায়ুম ভর। অথা নো বস্যসস্কৃধি ॥১০৷৷

সূক্ত ৫– তরৎ স মন্দী ধাবতি ধারা সুতস্যান্ধসঃ। তরৎ স মন্দী ধাবতি। ১। উস্রা বেদ বসূনাং মর্তস্য দেব্যবসঃ। তরৎ স মন্দী ধাবতি ॥২৷৷ ধ্বস্ৰয়োঃ পুরুষন্ত্যোরা সহস্রাণি দগ্নহে। তরৎ স মন্দী ধাবতি ॥৩॥ আ যয়োস্ত্রিংশতং তনা সহস্রাণি চ দগ্নহে। তরৎ স মন্দী ধাবতি৷৷৷৷

সূক্ত ৬– এতে সোমা অসৃক্ষত গৃণানাঃ শবসে মহে। মদিন্তমস্য ধারয়া৷১৷৷ অভি গব্যানি বীতয়ে নৃণা পুনাননা অর্যসি। সনদ্বাজঃ পরিস্ৰব৷৷২৷৷ উত নো গোমতীৱিষো বিশ্ব অর্য পরিষ্ঠুভঃ। গৃণানো জমদগ্নিনা৷৩৷৷

সূক্ত ৭) ইমং স্তোতমমহঁতে জাতবেদসে রথমিব সং মহেমা মনীষয়া। ভদ্রা হি নঃ প্রতিরস্য সংসদ্যগে সখ্যে মা রিমা বয়ং তব৷১। ভরামেং কৃণবামা হবীংষি তে চিতয়ন্তঃ পর্বণা পর্বণা বয়ম। জীবাতবে প্রতরাং সাধয়া ধিয়োহগে সখ্যে মা রিমা বয়ং তব৷২৷৷ শকেম ত্বা সমিধং সাধয়া ধিয়ত্ত্বে দেবা হবিরদন্ত্যাহুত৷৷ ত্বমাদিত্যাং আ বহ তা ৩শস্যগ্নে সখ্যে মা রিমা বয়ং তব৷৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ–- সূক্ত/১সাম– বিশ্বের প্রাণস্বরূপ পবিত্রতাসাধক হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবন! আপনি আমাদের এই কর্মে দেবভাবসমূহ উৎপাদন করুন এবং কর্মবিঘ্নকারী শত্রুগণকে বিনাশ করুন (অথবা আপনি নিত্যকাল অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করেন)। তারপর (শত্রুদের বিনাশ করে এবং অন্তরে দেবভাব উপজিত করে) আমাদের পরম কল্যাণ দান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরম মঙ্গল বিধান করুন)। [প্রচলিত এক ব্যাখ্যা-হে মহৎ অনুভূত, পবমান সোম! ভজনা করো, জয় করো, অনন্তর আমাদের মঙ্গল বিধান করো। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৪/২– হে শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ ভগবন! আমাদের সম্যক রকমে জ্ঞানজ্যোতিঃ প্রদান করুন। অপিচ, আপনি আমাদের স্বর্গের ন্যায় উন্নত শ্রেষ্ঠ পরমস্থানের বিধান করে দিন। এবং বিশ্বের যাবতীয় সৌভাগ্য আমাদের প্রদান করুন। তারপর, জ্ঞানজ্যোতিঃর্তে অন্তর উদ্ভাসিত করে আমাদের পরম কল্যাণ বিধান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সৎ-জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে আমরা যেন পরমপদ প্রাপ্ত হই)।

৪/৩– শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন! আপনি (আমাদের) কর্মশক্তি প্রদান করুন এবং সৎকর্মের সুফল বিধান করুন। অপিচ, কর্মপ্রতিবন্ধক অন্তঃশত্রুদের আপনি বিনাশ করুন। তারপর (কর্মসামর্থ্য, সৎকর্মের সুফল এবং অন্তঃশত্রুর বিনাশ সাধিত করে) আমাদের পরম ধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এই মন্ত্রে সাধক কর্মশক্তি, সৎকর্মের সুফল এবং অন্তঃশনাশের কামনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের কর্ম প্লবের (অর্থাৎ, ভেলার) ন্যায় সংসার রূপ সমুদ্র পারায়ণে সমর্থ এবং ভগবৎপ্রাপক হোক)।

৪/৪– হে মোক্ষকামী সৎকর্মসাধক! পাপনাশক পরিত্রাণকারক সর্বশক্তিমান্ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করুন। তারপর আপনারা মিক্ষকামী আমাদের জন্য পরমকল্যাণ সাধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। মন্ত্রে সাধুসঙ্গের মাহাত্ম্য প্রকটিত। ভাব এই যে, সাধকেরা সৎ-ভাবের প্রভাবে অকিঞ্চনেরও পরম কল্যাণ সাধন করেন)। [সৎপ্রসঙ্গ সাধুসঙ্গ ভগবানের স্বরূপ-জ্ঞান-লাভের এক প্রকৃষ্ট পন্থা। সাধুসঙ্গ সম্প্রসঙ্গ– পরমপদ, প্রভুপদ ও সর্বার্থসিদ্ধির মূলীভূত। নিরতিশয় নিন্দিতকর্ম-পরায়ণ ব্যক্তিও যদি সাধুসঙ্গে শ্রবণ-কীর্তন ইত্যাদি দ্বারা ভগবানের ভজনা করে, তাহলে সে ব্যক্তিও সাধুদের মধ্যে গণ্য হয়। সেই সাধুসঙ্গ সংপ্রসঙ্গের উপদেশই দেওয়া হয়েছে। — ৪/৫– হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবন! আপনি আপনার সম্বন্ধি কর্মের দ্বারা এবং আপনা কর্তৃক রক্ষার দ্বারা আমাকে রক্ষা করুন। অপিচ আমাদের আপনার জ্যোতিঃস্বরূপ প্রকাশরূপে সংস্থাপন করুন। তারপর (জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণে আমাদের পরিত্রাণ করে) আমাদের পরম মঙ্গল বিধান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সেই ভগবান্ আমাদের জ্ঞানসমন্বিত ও সৎকর্মপরায়ণ করে আমাদের পরম মঙ্গল বিধান করুন)।

৪/৬– শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হে ভগবন! আপনার সম্বন্ধি কর্ম বা জ্ঞানের দ্বারা এবং আপনার আত্মভূত রক্ষার দ্বারা আপনি আমাদের প্রবর্ধিত করুন। অপিচ, সেই জ্ঞান লাভ করে আমরা যেন নিত্যকাল স্বপ্রকাশ জ্ঞানস্বরূপ জ্যোতির্ময় আপনাকে সর্বত্র দর্শন করতে সমর্থ হই। তারপর আপনি যেন আমাদের পরম কল্যাণ বিধান করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -কর্মের প্রভাবে পরাজ্ঞান লাভ করে যেন আমরা সৎস্বরূপ আপনাকে (ভগবানকে) প্রাপ্ত হই)।

৪/৭-শোভন আয়ুধ অর্থাৎ শত্রুধর্ষক শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হে ভগবন! আপনি আমাদের ইহকাল পরকাল সম্বন্ধী পরমধন প্রদান করুন। তারপর আমাদের পরমকল্যাণ বিধান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তঃশনাশে পরমধন প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহে আমাদের পরমকল্যাণ সাধিত হোক)।  [পরমধন– অর্থাৎ ইহলোকে এবং পরলোকে মঙ্গলপ্রদ ধন, যে ধন প্রাপ্ত হলে, ইহকালে এবং পরকালে প্রবর্ধিত হতে পারা যায়, এখানে দ্বিবহসং রয়িং পদে তা-ই বোঝাচ্ছে। ফলতঃ, ইহলোক এবং পরলোকে উভয়ই জয়যুক্ত হবার কামনা এখানে প্রকাশ পাচ্ছে]। — ৪/৮– হে শুদ্ধসত্ত্ব-স্বরূপ ভগবন! রিপুসংগ্রামে শত্রুগণ কর্তৃক অনাহত অপিচ, শত্রুগণের অভিভবিতা আপনি আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। আপনি আমাদের পরমমঙ্গল বিধান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। শত্রুনাশে সৎ-ভাব-সঞ্চয়ের জন্য মন্ত্রে উদ্বোধনা বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! হৃদয়ের অন্তঃশত্রনাশে হৃদয়ে সৎ-ভাবের সঞ্চার করে আমাদের পরমকল্যাণ বিধান করুন)। [ভগবান্ অন্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তঃশত্রুগুলিকে বিনাশ করেন। অর্থাৎ– অন্তরে সৎ-ভাবের সমাবেশ হলেই অসৎ-ভাবরূপ অন্তঃশত্রু বিনষ্ট হয়-মন্ত্রের মধ্যে ভগবানের বিশেষণগুলিতে সেই ভাবই প্রকাশিত হয়েছে। শত্রুর বিনাশে যখন হৃদয়ে সৎ-ভাবের উদয় হয়, সৎ-স্বরূপ ভগবানের প্রতি মন ক্রমশঃ আকৃষ্ট হতে থাকে। এইভাবে ক্রমশঃ তার প্রতি যখন অনন্যাভক্তির উদয় হয়, তখনই তার সাথে সম্মিলন ঘটে। সেই সম্মিলনই– সেই পরমার্থ-লাভই বাজিনৎ]।

৪/৯– পবিত্রতাসাধক হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবন! বিশিষ্টফলসাধক অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপক কর্মে আমরা আপনাকে (আপনার সম্বন্ধি কর্মসাধক) সৎ-ভাব সমূহের দ্বারা প্রবর্ধিত অর্থাৎহৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করছি। তারপর (হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে) আপনি আমাদের অশেষ কল্যাণ বিধান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সভাব-সমূহ ভগবৎপ্রাপক। সৎ-ভাবের প্রভাবেই সাধক মোক্ষলাভ করেন। তাই ভাব এই যে, আমি যেন মোক্ষলাভের জন্য সৎ-ভাব সঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হই)। [সৎকর্ম সৎ-ভাব– মোক্ষপ্রাপক হয়। সৎকর্মের দ্বারা সৎ-ভাবের উদয়ে অনুষ্ঠানকারী ভগবানের প্রীতিলাভে সমর্থ হন, — মন্ত্র এই সত্য প্রকটিত করছেন]।

৪/১০– স্নেহ-সত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন! আপনি আমাদের ভোগের উপযোগী পর্যাপ্ত অর্থাৎ সকলের জীবনস্বরূপ অক্ষয় বিচিত্র মোক্ষসাধক পরমধন প্রদান করুন। তারপর আমাদের পরমমঙ্গল সাধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মোক্ষলাভের জন্য সাধক ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [সূক্তের উপসংহারে চরম প্রার্থনা ফুটে উঠেছে। প্রার্থনাকারী মুক্তিলাভের জন্য– আত্মায় সম্মিলনের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। যেন প্রার্থনাকারীর আর কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। ভগবানের অনুগ্রহে তার সব আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হয়েছে। এখন তিনি চান মোর্চ। এখন চাই সকল আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি। পার্থিব ধনজনসম্পদে তার আর প্রয়োজন নেই। তিনি এমন ধন চান, যে ধন পেলে চাইবার আশা মিটে যায়– সব আকাঙ্ক্ষার অবসান হয়। দয়া করে ভগবান্ যেন তাকে সেই পরমধন– মোক্ষধন-প্রদান করেন। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! তুমি আমাদের নানারকম অশ্ববান্ সর্বগামী ধন প্রদান করো। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন এই অশ্ববান্ সর্বগামী ধন থেকে প্রাচীন ভারতের বাণিজ্যে উন্নতির বিষয় বুঝতে পারা যায়। তখন বাণিজ্যের প্রসার এত বেশী বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তাতে বণিকগণ প্রভূত লাভবান হতেন। অশ্ববান্ সর্বগামী ধন বলতে সবদিকে– দেশে-বিদেশে বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধির এবং সেই বাণিজ্যলব্ধ এ অর্থ ঘোড়ার পিঠে বহন করে নিয়ে আসার ভাব উপলব্ধ হয়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দশটি সাম মন্ত্রের ঋষি– হিরণ্যস্তূপ আঙ্গিরস]।

৫/১– বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের পরমানন্দদায়ক সেই প্রবাহ স্তোতাদের পাপ হতে ত্রাণ করে তাদের এ হৃদয়ে প্রবাহিত হয়; সেই সত্ত্বপ্রবাহ স্তোতৃদের পাপ হতে ত্রাণ করে তাদের হৃদয়ে প্রবাহিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রকাশক। ভাব এই যে, -সত্ত্বভাব স্তোতৃবর্গের পাপনাশক হয়)। [সত্ত্বভাবে– পাপনাশিনী-শক্তি এই মন্ত্রে বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। তরৎ স মন্দী ধাবতি পদগুলি মন্ত্রে দুবার উক্ত হয়েছে। এটা নিশ্চয়তা-জ্ঞাপক। সত্ত্বপ্রবাহ দেবতাদেরও আনন্দদায়ক, মানুষের তো কথাই নেই। যেখানে সত্ত্বভাব দেখেন, দেবতারা, সেইখানে অধিষ্ঠান করেন। মানুষের হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হলে সেখানে দেবতার-দেবভাবের আবির্ভাব হয়; সুতরাং পাপ দূরে পলায়ন করে। দেবভাব ও পাপ একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই দেবভাব অথবা সত্ত্বভাব উপজিত হলে মানুষ মোক্ষলাভের অধিকারী হয়– পরমানন্দ লাভ করে]। [ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৪দ-৪সা) এই মন্ত্রটি দৃষ্ট হয়।

৫/২– শ্রেষ্ঠধন সমূহের প্রদাত্রী– সৎ-জ্ঞান প্রদাত্রী (ভক্তিরূপিণী) দেবী মরণ-ধর্মশীল অর্চনাকারী আমার রক্ষা বিধান করুন। সেই ভক্তিদেবী আমাদের পাপ হতে পরিত্রাণ করে, আমাদের পরমানন্দদায়িকা হোন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভক্তি আমাদের সৎ জ্ঞান প্রদান করুন)। অথবা–পয়স্বিনী গাভী যেমন, পয়ঃনিঃসারক লোকরক্ষাকর স্তন ধারণ করে, অথবা জ্ঞানকিরণ যেমন পাপনিঃসারক বল ধারণ করে, তেমন দ্যোতমানা ভক্তিরূপিণী দেবী লোকহিতকর শুদ্ধসত্ত্ব এবং সৎ-জ্ঞান অথবা সৎ-ভাব-সৎ-জ্ঞানরূপ পরমধন ধারণ করে আছেন। সেই দেবী মরণশীল শরণাগত আমার রক্ষার বিধান করুন। অপিচ, পরমানন্দদায়িকা সেই দেবী আমাদের পাপনাশিকা এবং পরিত্রাণসাধিকা হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্বোধক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের মধ্যে ভক্তির প্রবাহ প্রবাহিত হোক। আর তাতে যেন আমরা পরমধন প্রাপ্ত হই)। [এখানে দুরকম অন্বয়ে মন্ত্রে একই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ভাষ্যে ও ব্যাখ্যায় মন্ত্রের অর্থের একটু ভাবান্তর দেখা যায়। একটি ব্যাখ্যা-সেই সোম ধনের প্রস্রবণস্বরূপ, সেই জ্যোতিঃপুঞ্জ সোম মানুষকে রক্ষা করতে জানেন। সেই আনন্দকর সোম গড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন অর্থ। থেকে কি ভাব উপলব্ধ হতে পারে? যে সোম মানুষকে রক্ষা করে, যে সোম ধনের প্রস্রবণ, — সেই সোমই বা কি পদার্থ? আর যে সোম গড়িয়ে যায়, সেই সোমই বা কি সামগ্রী? সোমের এমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির মনে নানা বিতণ্ডার সৃষ্টি করে থাকে। দেবতার উদ্দেশ্যে মাদকদ্রব্য ইত্যাদি উৎসর্গ করে, তাদের সেই মাদক দ্রব্য উপহার দিয়ে, সৎ-ভাবের অধিকারী হতে পারা যায়। কি? যে সোম জ্যোতিঃপুঞ্জ– দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত, যে সোম ধনের প্রস্রবণ, যে সোম মানুষকে রক্ষা করে, সে সোমকে মাদকদ্রব্য হিসাবে গণ্য করা যায় কি? আর মাদকতা-উৎপন্নকারী সেই সোমকে দেবীবলে সম্বোধন করা চলে কি? অজ্ঞ-জন যা-ই বুঝুন না কেন?বিবেকিজনের বিশ্বাস মাদকদ্রব্য ভগবান্‌কে অর্পণ করা বলতে মাদকদ্রব্য পরিবর্জনের ভাবই বুঝিয়ে থাকে। ফলতঃ, সোম বলতে সোমলতার রস রূপ মাদকদ্রব্য অর্থ কখনই সঙ্গত হতে পারে না। বেদের সোম– অন্তরের অন্তরতম সামগ্রী– শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাব প্রভৃতি]।

৫/৩– পাপধ্বংসকারী জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে আমরা যেন বহু ধন প্রাপ্ত হই। অথবা, পাপনাশক শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সম্যক্ রকমে বহুধন প্রদান করুন। তারপর পরমানন্দদায়িকা সেই জ্ঞানভক্তি, তা আমাদের পাপনাশিকা ও পরমানন্দদায়িকা হোন। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পজ্ঞাপক। ভাব এই যে, — জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে আমরা যেন পরমার্থ প্রাপ্ত হই)।

৫/৪– পাপের প্রভাবে আমরা বহুজন্ম ধারণ করেছি। জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে পাপক্ষালনের দ্বারা আমাদের জন্মগ্রহণ অপ্রতিগৃহীত হোক অর্থাৎ আমাদের জন্মগতি রোধ হোক। পরমানন্দদায়িকে জ্ঞানভক্তি আমাদের পাপ হতে উদ্ধার করে হৃদয়ে প্রবাহিত হোন। অথবা সেই জ্ঞানভক্তি আমাদের জন্মগতি নিরোধ করে পরমানন্দের হেতুভূত হোন। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পজ্ঞাপক ও প্রার্থনামূলক। জন্মগতি রোধের জন্য এখানে সঙ্কল্প বিদ্যমান। মানুষ যদি জ্ঞান ও ভক্তির অনুবর্তী হয়, তাহলে তাদের আর পুনর্জন্ম সম্ভব হয় না। সঙ্কল্পের ভাব এই যে, জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে আমরা যেন পুনর্জন্ম নিরোধে সমর্থ হই)। [পূর্বের মন্ত্রটিতে ভাষ্যকারের বক্তব্য অনুযায়ী ব্যাখ্যাকার বলেছেন– ধ্বস্র ও পুরুষন্তি নামক রাজাদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থ গ্রহণ করা হয়েছিল। এই মন্ত্রে ঐ অর্থের সাথে বস্ত্র ইত্যাদি প্রাপ্তির স্বীকারোক্তি দেখা যায়। ঐ ব্যাখ্যাকারের মতে, সোমদানকারীরা কেবল যে রাজাদের অর্থ লুণ্ঠন করেই নিশ্চিত হয়েছিলেন, তাই নয়; পরন্তু তারা সোমরস পান করিয়ে অর্থের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র ইত্যাদিও লুণ্ঠন করে নিয়েছিলেন। এক-আধখানি বস্ত্র নয়; ত্রিংশতং সহস্রাণি অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ সহস্র সেলুণ্ঠন ব্যাপারে তারা পেয়েছিলেন। এমন উপাখ্যান অবলম্বনেই ভাষ্যকার মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। ব্যাখ্যাকারও তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মন্ত্রের অর্থ করেছেন, — ঐ দুইজনের নিকট ত্রিশ সহস্র বস্ত্র গ্রহণ করেছি। সেই আনন্দকর সোম গড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা মন্ত্রের মধ্যে কোনও উপাখ্যানের সম্বন্ধসূচনাই দেখি না। পূর্বের মন্ত্রে ধ্বয়োঃ পুরুষন্ত্যো পদে জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে এমন ভাব গৃহীত হয়েছিল। তারই রেশ ধরে এই মন্ত্রে স পদে তে জ্ঞানভক্তি ইতি যাবৎ অর্থ গৃহীত হয়েছে। ত্রিংশতং সহস্রাণি পদদুটি সংখ্যাধিক্যের ভাব প্রকাশ করছে। তনা পদের জন্মানি অর্থই সঙ্গত। সুতরাং ত্রিংশতং সহস্রাণি তনা মন্ত্রাংশের সমাবেশে অর্থ হয়, — অসংখ্য জন্ম পরিগ্রহণ করেছি। তার সাথে যয়োঃ পদের সংযোজনে মন্ত্রের অর্থ হয়, — পাপের প্রভাবে আমরা বহুজন্ম ধারণ করেছি। — ইত্যাদি]। [এই সূক্তের চারটি সামমন্ত্রের ঋষি– অবৎসার কাশ্যপ]।

৬/১– আমাদের আকাঙ্ক্ষিত শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবসমূহ পরমানন্দদায়ক প্রবাহে প্রার্থনাকারী শরণাগত আমাদের বলপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য (অথবা, সৎস্বরূপের সাথে মিলনসাধনের উদ্দেশ্যে) অথবা, আমাদের পূজা সর্বদেবগণকে প্রাপ্ত করাবার জন্য (আমাদের হৃদয়ে) ক্ষরিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, সৎ-ভাবসমূহ আমাদের পরমার্থসাধন-সমর্থ করুক)।

৬/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! কর্মশক্তির দ্বারা এবং জ্ঞানজ্যোতিঃর দ্বারা প্রবর্ধিত হয়ে আমাদের কর্মের সাথে সম্মিলনের জন্য অথবা আমাদের কর্মসকলকে দেবভাব সমন্বিত করবার জন্য, আপনি আগমন করুন– আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎ-ভাবজনক আপনি, দেবগণ সমীপে আমাদের পূজা সংবাহনের জন্য আমাদের হৃদয়ে বা কর্মে সমুদ্ভুত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্মসমূহ দেবভাব-সমন্বিত হোক; অপিচ, সেই কর্ম আমাদের পরম পদে প্রতিষ্ঠিত করুক)। [ভাষ্যকারের মতে মন্ত্রের অর্থ হয়, দেবগণের ভক্ষণের নিমিত্ত প্রিয়তর ক্ষীর ইত্যাদির সংমিশ্রণে পূয়মান সোম ক্ষরিত হও। অন্নের দাতা হে সোম! তুমি দশাপবিত্রে ক্ষরিত হও। এই অর্থের অনুসরণে ব্যাখ্যাকার বললেন– হে সোম! তুমি শোধনকালে গব্য ক্ষীর ইত্যাদির সাথে মিশ্রিত হয়ে ভক্ষণের উপযোগী হয়ে থাক। সেই তুমি এখন অন্নদান করতে করতে ক্ষরিত হও। বীতয়ে-পদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থ দাঁড়িয়ে যায়। কি মনুষ্যভাবে ভাবতে গেলে, সুভোজ্য সুপেয় আহারের বিষয় মনে আসে; যজ্ঞ পক্ষে দেখতে গেলে, চরুপুরোডাশ ইত্যাদি ভক্ষণের ভাব মনে আসে; আর সাধকের লক্ষ্য অনুধাবন করলে বুঝতে পারা। যায়, তারা তাদের ভক্তিসুধা পান করাবার নিমিত্ত যেন তাদের ইষ্টদেব ভগবানকে আহ্বান করছেন। এ পক্ষে আমাদের ভাব এই যে, -কর্মসকলকে জ্ঞানসমন্বিত করবার এবং সেই জ্ঞানসমন্বিত কর্ম ভগবানে ন্যস্ত করবার আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে। ফলতঃ ভগবানের অনুগ্রহের উপর সবই নির্ভর করে]।

৬/৩– অপিচ (উত) হে ভগবন! আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধক কর্তৃক অথবা কালচক্রে চিরবর্তমান জমদগ্নি নামক ঋষি কর্তৃক সম্পূজিত অর্থাৎ অনুসৃত আপনি, আমাদের বিশুদ্ধ জ্ঞানসহযুত স্তোত্র সমূহ গ্রহণ করে আমাদের সকল অভীষ্ট পূরণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের কর্মে পরিতুষ্ট হয়ে ভগবান্ আমাদের পরমমঙ্গল বিধান করুন)। [ভাষ্যকার এবং ব্যাখ্যাকার সকলেই মন্ত্রের সাথে জমদগ্নি ঋষির সম্বন্ধ খ্যাপন করেছেন। ঋষি সোমরস প্রস্তুত করে যেন বলছেন– হে সোম! আমি জমদগ্নি ঋষি তোমার স্তুতি করছি। তুমি আমাদের অন্ন ও গোধন প্রদান করো। আমরা কিন্তু এই মন্ত্রে কোনও মরণশীল ঋষির সম্বন্ধ নাম দেখতে পাচ্ছি না। অথবা, অনাদি অনন্ত কাল থেকে জমদগ্নি প্রভৃতি যে সব ঋষি অনন্ত কালসাগরে জলবুবুদের মতো উদ্ভূত ও বিলীন হয়েছেন, মন্ত্রে তাদের প্রতিও লক্ষ্য থাকতে পারে। কিন্তু তাতেও দুই পক্ষে একই অর্থ অধ্যাহার করা যায়। অন্বয় অনুসারে জমদগ্নিনা পদের প্রতি লক্ষ্য করা যেতে পারে। জমজম ধাতু থেকে জমদগ্নি পদ নিষ্পন্ন। ঐ ধাতুর অর্থ– ভক্ষণ করা। তা থেকে ভক্ষণ করে যে অগ্নি, তাকেই জমদগ্নি বলা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন– অগ্নি কি ভক্ষণ করেন? লৌকিক অগ্নি এখানকার লক্ষ্য নয়। এখানে অগ্নি বলতে জ্ঞানাগ্নির প্রতিই লক্ষ্য আছে। সেই জ্ঞানরূপ অগ্নি ভক্ষণ করেন– অজ্ঞানতা– পাপরাশি; সে অগ্নি ভক্ষণ করেন, — কামক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রু। যাঁরা সাধনার প্রভাবে হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত করতে সমর্থ হয়েছেন, যাঁদের আত্মার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, তাদের অন্তরস্থিত অগ্নিই পাপরাশি ভক্ষণের শক্তি-সামর্থ্য লাভ করেছে তাদের হৃদয়াগ্নিই কামক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রুদের বিমর্দিত করতে পেরেছে। ফলতঃ, সেই আত্মদর্শী ও আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকেরাই জমদগ্নি পদবাচ্য। জমদগ্নিনা গৃণানঃ পদদুটিতে তাই আত্মদর্শীদের পূজাই ভগবান্ গ্রহণ করেন, এই নিত্যসত্য প্রকাশ করছে। [এই সূক্তের তিনটি সামমন্ত্রের ঋষি জমদগ্নি ভার্গব]।

৭/১– পূজ্য সদাকাল অনুসরণযোগ্য জাতপ্রজ্ঞ দেবতার উদ্দেশ্যে অর্থাৎ জ্ঞান-দেবতার উদ্দেশ্যে, পরিত্রাণের উপায়স্বরূপ অথবা অভীষ্টদেব ভগবানের চরণস্বরূপ, বক্ষ্যমাণ শ্রেষ্ঠ স্তোত্রকে (বেদমন্ত্রকে) মনীষার দ্বারা অর্থাৎ বিচারপূর্বক আমরা সম্যক্ পূজা করব– হৃদয়ে অনুধ্যান করব। (ভাব এই যে, — জ্ঞানলাভের জন্য বেদমন্ত্রের অনুধ্যান অবশ্য কর্তব্য); এই জ্ঞানদেবতার সখ্যতার অর্থাৎ জ্ঞানের অনুসারিতার ফলে আমাদের প্রকৃষ্ট বুদ্ধি নিশ্চয়ই কল্যাণদায়িকা হয়। (ভাব এই যে, জ্ঞানের অনুসারিতায় কল্যাণ অবশ্যম্ভাবী)। হে জ্ঞানদেব! আপনার সখিত্বে, আপনার ভাবে ভাবাপন্ন হয়ে অর্থাৎ আপনার অনুসারিতার ফলে, অনুসরণকারী অর্চনাকারী আমরা যেন কারও দ্বারা হিংসিত হই– সর্বত্রই যেন রক্ষাপ্রাপ্ত হই। (প্রার্থনা এই যে, — জ্ঞানের অনুসারিতার ফলে জ্ঞানই আমাদের রক্ষা করুন)। [সামবেদীয় সর্বকর্মসাধারণী কুশণ্ডিকায় পরিসমূহন-কার্যে অর্থাৎ অগ্নির বিক্ষিপ্তাবয়বসমূহের একীকরণের কার্যে এই ঋটির প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়]।

৭/২– হে জ্ঞানদেব! ইন্ধনসাধন জ্ঞান-উদ্দীপক উপকরণকে যেন হৃদয়ে সম্পাদন করি উৎপাদন করি; প্রতি কর্মের অনুষ্ঠানে আপনাকে প্রজ্ঞাপিত করে– উদ্বোধিত করে উপাসক আমরা যেন আপনার উদ্দেশে কর্মসমূহ সম্পাদন করি; আমাদের জীবন-ঔষধের নিমিত্ত, চিরকাল আমাদের মধ্যে অবস্থানের নিমিত্ত, আমাদের কর্মসমূহকে প্রকৃষ্টরূপে নিম্পাদন করে দিন। হে জ্ঞানদেব! আপনার সখিত্বে– জ্ঞানসংসর্গের লাভে আমরা যেন হিংসিত না হই– যেন রক্ষা প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি যুগপৎ সঙ্কল্প ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চয়ের জন্য জ্ঞানের অনুমোদিত কর্মের সম্পাদনের জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি; সেই জ্ঞানদেব আমাদের রক্ষা করুন)। [এই ঋকেও ইং পদটি মন্ত্রাৰ্থ নিষ্কাশনে অন্তরায় এনেছে। ঐ পদ উপলক্ষে অগ্নিতে ইন্ধন সংযোগ করে অগ্নিকে প্রজ্বলিত করবার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রটিতে যুগপৎ আত্ম-উদ্বোধনা ও প্রার্থনা আছে, এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ইংভরাম বাকাংশে হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নির উদ্দীপনার সঙ্কল্প প্রকাশ পায়। এইভাবে পর্বণাপর্বণা চিতয়ন্তঃ বয়ং তে হবীংষি কৃণবামা বাক্যাংশে, জ্ঞানকে জাগিয়ে উদ্বুদ্ধ করে জ্ঞানের অনুসারী কর্ম-সম্পাদনের প্রতিজ্ঞা পরিব্যক্ত দেখা যায়। ইত্যাদি)।

৭/৩– হে জ্ঞানদেব! আপনাকে সম্যক প্রদীপ্ত করতে অর্থাৎ হৃদয়ে উদ্বুদ্ধ করতে যেন আমরা সমর্থ হই; হে দেব! আমাদের কর্মসমূহকে আপনি সম্পাদন করে দিন, অথবা, আমাদের জ্ঞানসমূহকে বর্ধিত করে দিন; আপনাতে প্রদত্ত অর্থাৎ সম্মিলিত হবনীয় কর্মকে– বিহিত কর্মানুষ্ঠানকে দেবগণ গ্রহণ করুন, অর্থাৎ সকল দেবভাবের সাথে মিলিত হোক; অদিতির অর্থাৎ অনন্তের সকাশ হতে উৎপন্ন সকল দেবভাবকে (সকল সৎ-গুণকে) আপনি আমাদের প্রাপ্ত করুন– আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করুন; সেই দেবগণকে যেন আমরা সর্বদা কামনা করি। হে জ্ঞানদেব! আপনার সাথে সখ্যস্থাপনে– জ্ঞানের অনুসারী হয়ে, আমরা যেন কারও দ্বারা হিংসিত না হই– যেন রক্ষা প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে, জ্ঞানের অনুসারী জন সকল দেবভাবের অধিকারী হন এবং সর্বদা রক্ষা প্রাপ্ত হন)। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– সমন্তং। এই সূক্তের ঋযির নাম– কুৎস আঙ্গিরস]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৮– প্রতি বাং সুর উদিতে মিত্রং গৃণীষে বরুণ। অর্যমণং রিশাদসম্৷৷৷৷৷ রায়া হিরণ্যয়া মতিরিয়মবৃকায় শবসে। ইয়ং বিপ্রা মেধসাতয়ে৷৷২৷৷ তে স্যাম দেব বরুণ তে মিত্র সুরভিঃ সহ। ইষং স্বশ্চ ধীমহি৷৩৷৷

সূক্ত ৯– ভিন্ধি বিশ্বা অপ দ্বিষঃ পরি বাধো জহী মৃধঃ। বসু স্পাহং তদা ভর৷১৷৷ যস্য তে বিশ্বমানুষ ভূরেদত্তস্য বেদতি। ব, পাহং তদা ভর৷২। যদ্বীড়াবিন্দ্র যৎ হিরে যৎ পৰ্শানে পরাভূতম্। বসু পাহং তদা ভর৷৩৷৷

সূক্ত ১০– যজ্ঞস্য হি স্থ ঋত্বিজা সী বাজে কর্মসু। ইন্দ্রাগ্নী তস্য বোধত৷১। তোশাসা রথায়াবানা বৃত্ৰহনাপরাজিতা। ইন্দ্রাগ্নী তস্য বোধত৷২৷৷. ইদং বা মদিরং মধ্বধুক্ষন্নদ্রিভির্নরঃ। ইন্দ্রগী তস্য বোধত৷৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৮সূক্ত/১সাম– হে আমার সৎ-অসৎ-চিত্তবৃত্তি! জ্ঞানসূর্য হৃদয়ে সমুদিত হলে, মিত্রস্থানীয় অর্থাৎ মিত্রবৎ পরমহিতাকাঙ্ক্ষী শত্রুদের অভিভবকারী স্নেহকরুণাসম্পন্ন সর্বশ্রেষ্ঠ আত্ম উৎকর্ষসাধক ভগবানকে তোমরা উভয়ে প্রার্থনা (প্রতিষ্ঠিত) করো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক ও আত্ম উদ্বোধক। মানুষ যখন জ্ঞানসম্পন্ন হয়, তখনই সে ভগবানের পূজায় সমর্থ হয়ে থাকে। জ্ঞান ভিন্ন ভগবানের পূজা সম্ভবপর হয় না। অতএব সঙ্কল্প-ভগবানের পূজার জন্য আমরা জ্ঞানলাভে যেন প্রযত্নপর হই)। অথবা– হে মিত্র ও বরুণ দেবদ্বয়! (সর্বজীবের) মিত্রদেব আপনি এবং সকলের প্রতি অভীষ্টবর্ষক) বরুণদেব– আপনাদের উভয়কে এবং (সকলের মধ্যে জ্ঞানরশ্মি-প্রদাতা) অর্যমা দেবতাকে– প্রত্যেককে স্তুতি করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্বোধক। প্রার্থনার ভাব এই যে ভগবানের পূজায় আমরা যেন জ্ঞানসম্পন্ন হই, আর তাতে যেন ভগবানের করুণা লাভ করতে পারি)। [ভক্ত সাধকের দৃষ্টিতে মন্ত্রে কর্ম জ্ঞান ও ভক্তি– তিনেরই প্রভাব প্রখ্যাত। ফলতঃ, জ্ঞান ভক্তি ও কর্মমিত্র, বরুণ ও অর্যমা দেবের স্বরূপ; তাই মিত্রের সাথে জ্ঞানের, বরুণের সাথে ভক্তির এবং অর্যমার সাথে কর্মের উপমার ভাবও মন্ত্রের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। সেই উপমা লক্ষ্য করবার হেতু এই যে, লৌকিক হিসাবে সূর্য যেমন বরুণের (জলের) জনয়িতা, সূর্যরশ্মি সম্পাত ভিন্ন যেমন বারিবর্ষণ হয় না; জ্ঞানের (জ্ঞানসূর্যের) উদয় ভিন্ন তেমনি ভক্তি (ভক্তিবারি) বর্ষণ হতে পারে না। লৌকিক জগতে মিত্রের প্রভাবে বরুণ যেমন অমৃতধারা বর্ষণ করে ধরণীর উর্বরতা বৃদ্ধি করে থাকেন, আধ্যাত্মিক জগতেও তেমনি জ্ঞানের প্রভাবে ভক্তির অমৃত উৎস উৎসরিত হয়ে হৃদয়ের এ সবৃত্তিগুলিকে জাগরিত করে তোলে। এ ৮/২– মেধাবী অর্থাৎ আত্ম-উৎকর্ষ সম্পন্ন সাধকগণ তাদের অনুষ্ঠীয়মান কর্ম, পরমধনলাভের জন্য, এবং অন্তঃশত্রনাশে কর্মশক্তিলাভের জন্য ভগবানে সমর্পণ করে থাকেন। অতএব আমাদের এ অনুষ্ঠিত এই কর্মও ভগবানে কর্মফলসমর্পণে বিনিযুক্ত হোক অথবা যেন বিনিযুক্ত হয়। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে, — আত্ম-উৎকর্ষ সম্পন্ন সাধকদের কর্মফল স্বয়ং ভগবানে সংন্যস্ত হয়েছে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে আমরাও ভগবানে কর্মফল সমর্পণের সামর্থ্য লাভের জন্য উদ্বোধিত হচ্ছি)। [আত্ম-উৎকর্ষ সম্পন্ন সাধক যাঁরা– সাধনার প্রভাবে যাঁদের অন্তর কলুষ-কালিমা পরিশূন্য, তাদের কর্ম তো আপনা থেকেই ভগবৎ-অভিমুখী হয়। কিন্তু পাপনিমগ্ন-প্রকৃতি যারা, তাদের উপায় কি হবে? তারা কি পাপের পক্ষেই নিমগ্ন রয়ে যাবে? না, তা নয়। আদর্শতা সামনেই রয়েছে। সাধকেরাই তো সৎ-দৃষ্টান্তের দ্বারা পরিত্রাণ-সাধন করে থাকেন। সুতরাং ঐ পাপকলুষিত মানুষেরা যদি সাধকদের অনুবর্তন করে, তাহলে তাদেরও পরিত্রাণের পথ সুগম হয়ে আসে। তাই মন্ত্রে, তাদের দৃষ্টান্তের অনুসরণে, সৎ-ভাব-সমন্বিত-চিত্তে সৎকর্মের উদ্যাপনে সর্বকর্মফল ভগবানে ন্যস্ত করবার উদ্বোধন ও সঙ্কল্প দেখতে পাওয়া যায়]।

৮/৩–- দ্যোতমান স্বপ্রকাশ করুণাময় হে ভগবন (অথবা, হে বরুণদেব)! জ্ঞানজ্যোতিঃসমূহের দ্বারা সম্বন্ধ হয়ে আমরা আপনার শরণ গ্রহণ করছি। অপিচ, হে মিত্রদেব (অর্থাৎ, মিত্রের ন্যায় পরম কল্যাণময় হে ভগবন)! জ্ঞানজ্যোতিঃর দ্বারা উদ্ভাসিত হয়ে আমরা আপনার শরণ গ্রহণ করছি। হে ভগবন! আমরা (আপনার নিকট) অভীষ্ট এবং পরমগতি যাচ্ঞা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! আপনি আমাদের পরাগতি বিধান করুন)। [মন্ত্রটি সরল প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান জ্ঞানের জ্যোতিঃবিচ্ছুরণ করে আমাদের অন্তরের অন্ধকার রাশি অপনোদন করে আমাদের পরাগতি বা মোক্ষ প্রদান করুন। জ্ঞানই যে শ্রেষ্ঠগতি লাভের একমাত্র সহায়-জ্ঞানই যে ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করবার পক্ষে প্রধান অবলম্বন, মন্ত্রে তা-ই প্রকটিত হয়েছে। [এই সূক্তের অন্তত তিনটি সামমন্ত্রের ঋষি বশিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি]।  

৯/১– হে ভগবন! অজ্ঞানরূপ আমাদের অবিদ্যা-শত্রুদের আপনি বিনাশ করুন, এবং পীড়নকারী কামনা-সংগ্রামকে সর্ব রকমে বিদূরিত করুন। তারপর, আমাদের আকাঙক্ষণীয় সেই জ্ঞানধন প্রদান করুন; অর্থাৎ, আমাদের হৃদয়ে জ্ঞান জন্মিয়ে দিন। (ভাব এই যে, — অজ্ঞানের নিবৃত্তি হলে, কামনার নিবৃত্তি হয়; তারপর, প্রকৃষ্ট জ্ঞান প্রকাশিত হয়)। [এই সাম-মন্ত্রে প্রাণের কথা, হৃদয়ের উদ্বেগ, অন্তরের প্রার্থনাসকল ভগবানকে জানান হচ্ছে। বলা হয়েছে-হে ভগবন! আমাদের অবিদ্যা অজ্ঞানরূপ শত্রুসকলকে বিনাশ করুন। প্রত্যহ কামনার সঙ্গে যে সংগ্রাম চলছে, তা বিদূরিত করুন, আর আমাদের আকাঙক্ষণীয় সেই জ্ঞানধন প্রদান করুন। সাধক যেন নিজের স্বরূপ বুঝতে পেরেছেন, — যেন নিজের দোষ-ত্রুটি অজ্ঞানতা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন; তার আপন গৃহস্থগণ যে শত্রুর কাজ করছে, তা যেন অনুভব করতে পেরেছেন। তাই আজ আকাঙ্ক্ষা জেগেছে, কাতরতা এসেছে, ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানান হয়েছে। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ-২দ-২সা) দৃষ্ট হয়]।

৯/২-হে ভগবন! আপনার প্রদত্ত যে শ্রেষ্ঠধন বিশ্বের যাবতীয় ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ লাভ করেন; সকলের আকাঙক্ষণীয় সেই পরম ধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার সে ভাব এই যে, -হে ভগবন! আপনি আমাদের পরমধন– মোক্ষধন প্রদান করুন)।

৯/৩-হে ভগবন ইন্দ্রদেব! যে ধন দৃঢ় স্থানে সুরক্ষিত অবস্থায় আছে, যে ধন স্থির অপরিবর্তনীয়, অবস্থায় রক্ষিত আছে, আর যে ধন অজ্ঞাত স্থানে রক্ষিত আছে, সেই সকল রকম ধন আমাদের প্রদান করুন। (ভাব এই যে, — দৃরক্ষিত অজ্ঞাত নিত্যস্বরূপ যে ধন আপনানে বিদ্যমান আছে, সেই ধন আমাকে প্রদান করুন– এটাই প্রার্থনা)। [মন্ত্রের মধ্যে ধনের প্রার্থনা উগ্নীত হয়েছে। ধন বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন ভাবে রক্ষিত হয়ে থাকে। পার্থিব অপার্থিব সব রকম ধনের সম্বন্ধেই এমন পরিকল্পনা করা যেতে পারে। বিড়ৌ স্থিরে ও বিপর্শানে– এমন তিনরকম স্থানে– তিনরকম আবরণে আমাদের স্পৃহনীয় (সিহং) ধন রক্ষিত আছে। ইন্দ্রদেবরূপী একেশ্বর ভগবানের বিভূতির কাছে সেই ধনের প্রার্থনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে– যে ধন বিড়ৌ অর্থাৎ দৃঢ়স্থানে আছে অর্থাৎ অপরে যে ধন কাঁপাতে বা নড়াতে সমর্থ নয়, আমাদের তিনি যেন সেই ধন প্রদান করেন। আর যে ধন স্থিরেঅর্থাৎ অপরিবর্তনীয়, অর্থাৎ যে ধন নিত্য, সেই ধন আমাদের প্রদান করুন। তৃতীয়তঃ, যে ধনের বিষয় সকলে জ্ঞাত নয়, অর্থাৎ আমাদের সকলের অজ্ঞাত স্থানেই (বিপর্শানে) যে ধন রক্ষিত আছে, সেই ধন আমাদের প্রদান করুন। এইসব ধনই একমাত্র সেই ভগবানেরই অধিকারগত]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ-১০দ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত সামমন্ত্র তিনটির ঋষি– ত্রিশোক কাণ্ব]।

১০/১– শক্তিজ্ঞান রূপ হে দেবগণ! আপনারা সৎকর্মের প্রজ্ঞাপক বা সম্পাদক হন। অতএব সৎকর্মের সুফলপ্রদায়ক আপনারা উভয়ে শরণাগত আমাকে, সৎকর্মের সুফলোভের নিমিত্ত অর্থাৎ ভগবানে কর্মফল সমর্পণের জন্য উদ্বোধিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সাধকের আত্ম-উদ্বোধন প্রকাশ পেয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের কর্মশক্তি ও দিব্যজ্ঞান প্রদান করুন। আমাদের কর্ম ক্ষয় হোক)। [ইন্দ্রাগ্নী ইন্দ্র ও অগ্নি, ভগবানের শক্তি ও জ্ঞানরূপী দুই বিভূতি। অথচ, প্রচলিত এক বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে– হে ইন্দ্র ও অগ্নি! তোমরা বিশুদ্ধ ও ঋত্বিক, যুদ্ধে এবং কর্মে আমাকে অবগত হও]।

১০/২– শক্তি ও জ্ঞান রূপ হে দেবদ্বয়! পরমজ্যোতিঃ সম্পন্ন বহিঃ ও অন্তঃশত্রুনাশক, সর্বত্র জয়যুক্ত কর্মরূপ রথে গমনকারী আপনারা উভয়ে শরণাগত আমাকে সৎকর্মের সুফলোভের জন্য অর্থাৎ কর্মফল ভগবানে সমর্পণের জন্য উদ্বোধিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে বাহিরের ও অন্তরের (অর্থাৎ দস্যু বা জীবজন্তু এবং কাম-ক্রোধ ইত্যাদি) শত্রুদের বিনাশে সৎবৃত্তির উন্মেষণের প্রার্থনা বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে দেব! আমাদের বাহিরের ও অন্তরের শত্রুদের বিনাশ করুন। আর শত্রুনাশে জ্ঞানের জ্যোতিঃ বিচ্ছুরণে হৃদয় উদ্ভাসিত করে আমাদের পরাগতি– মোক্ষ প্রদান করুন)। [নিগুণ গুণাতীত ব্ৰহ্মকে গুণবিশেষণে বিশেষিত করার গুঢ় তাৎপর্য আছে। অরূপের অনন্ত রূপ ধারণা হয় না বলেই অরূপে রূপের কল্পনা করা হয়। অগুণের (নিগুণের) অনন্ত গুণ বলে, নিগুণে গুণ-কল্পনা দেখা যায়। এ কল্পনা কেবল আত্মতৃপ্তির জন্য। রূপ বর্জিত তিনি আমাদের কাছে রূপময়, গুণাতীত তিনি আমাদের ক্ষুদ্র ধারণাশক্তির কাছে গুণময়। বাক্যাতীত তিনি আমাদের প্রার্থনাবাক্যে বিশেষিত। সর্বব্যাপী তিনি, তবু তীর্থ ইত্যাদিতে কিংবা মন্দিরে মন্দিরেই তার অধিষ্ঠানের বিশ্বাস। এই ক্ষুদ্র বুদ্ধির জন্য তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করেন]।

১০/৩– শক্তি-জ্ঞানরূপ হে দেবদ্বয়! তোমরা উভয়ে সৎকর্মসমূহের নেতা অর্থাৎ সৎকর্মের এ নিয়োজক হও। তোমাদের অনুগ্রহে অদ্রির ন্যায় পাপ-কঠোর হৃদয়েও পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্বের এ অমৃতধারা ক্ষরিত (বিগলিত) হয়। অতএব তোমরা পাপ-কলুষ-পূর্ণ কঠোর-হৃদয় আমাকে (সৎ-ভাব জননের জন্য) উদ্বোধিত করো। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক ও প্রার্থনামূলক। ভগবানের কৃপায় পাপাত্মাও সাধু বলে পূজিত হয়। অতএব প্রার্থনা– হে ভগবন! পাপ-কলুষ-পূর্ণ আমার ভক্তিশূন্য কঠোর-হৃদয় উদ্ভিন্ন করে আমাকে সৎ-ভাব-সমন্বিত করুন)। [ভগবান্ সর্বভূতেই সমান; তার কেউ শত্রু নেই, তাঁর কেউ মিত্রও নয়। এই জ্ঞান লাভ করে যিনি ভক্তি সহকারে তার ভজনা করেন, তিনি ভগবানকেই প্রাপ্ত হন। সুতরাং ভক্তিহীনের হৃদয়ে তিনিই ভক্তি প্রদান করে তাকে মোক্ষপথে নিয়ে যান। চাই শুধু আকুল প্রার্থনা। এই প্রার্থনার দ্বারা সব অসম্ভবই সম্ভব। তার কৃপায় অসাধুও সাধু হয়, পাষাণে বারিনিঝর প্রবাহিত হয়, শুষ্কতরু মুঞ্জরিত হয়ে ওঠে। সুতরাং অদ্রিভিঃ (পাষাণের মতো কঠিন) হৃদয়েও সৎ-ভাবের স্নেহধারা প্রবাহিত হওয়াতে আশ্চর্যের কিছু নেই]। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে ইন্দ্র ও অগ্নি! যজ্ঞের নেতাগণ তোমাদের উদ্দেশ্যে প্রস্তরের দ্বারা এই মদকর মধু দোহন করেছেন। তোমরা আমাকে অবগত হও। মন্তব্য নিরর্থক]। [এই সূক্তান্তর্গত সামমন্ত্র তিনটির ঋষি শ্যাবাশ্ব আত্রেয়]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১১– ইন্দ্রায়েন্দো মরুত্বতে পবস্ব মধুমত্তমঃ। অর্কস্য যোনিমাসদম্৷১৷ তং ত্বা বিপ্রা বচোবিদঃ পরিষ্কম্বন্তি ধর্ণসিম। সং ত্বা, মৃজন্ত্যায়বঃ ॥২৷৷ রসং তে মিত্রো অর্যমা বিপন্ত বরুণঃ কবে। পবমানস্য মরুতঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ১২– মৃজ্যমানঃ সুহস্ত্যা সমুদ্রে বাচমিসি। রয়িং পিশঙ্গং বহুলং পুরুস্পৃহং পবমানাভ্যর্ষসি৷১। পুনানো বারে পবমাননা অব্যয়ে অচিক্রদানে। দেবানাং সসাম পবমান নিষ্কৃতং গোভিরঞ্জানো অসি৷৷২৷৷

সূক্ত ১৩– এতমু ত্যং দশ ক্ষিপো মৃজন্তি সিন্ধুমাতরম্। সমাদিত্যেভিরখ্যত৷১৷৷ সমিন্দ্রেপোত বায়ুনা সুত এতি পবিত্র আ৷ সং সূর্যস্য রশ্মিভিঃ ॥২॥ স নো ভগায় বায়বে পূষ্ণে পবস্ব মধুমা। চারুর্মিত্রে বরুণে চ৷৩৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১১সূক্ত/১সাম– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিবেকলাভের জন্য জ্ঞানযজ্ঞের উৎপত্তিমূল আমার হৃদয়কে প্রাপ্ত হও; অপিচ, ভগবৎ-প্রাপ্তির নিমিত্ত মধুরতম অর্থাৎ অভীষ্টপূরক হয়ে করুণাধারায় আমার হৃদয়ে উপজিত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানকে লাভের নিমিত্ত আমার, হৃদয়ে সত্ত্বভাব আবির্ভূত হোক)। [হৃদয়েই জ্ঞানের জন্ম। তাই অকস্য যোনিঃ পদ দুটিতে হৃদয়কে লক্ষ্য করে। হৃদয় নির্মল হলে, পবিত্র হলে, সেখানেই বিবেকজ্ঞানের– পরাজ্ঞানের আবির্ভাব হয়। অই সেই পরমজ্ঞান লাভের জন্য, সত্ত্বভাবের আবাহন করা হয়েছে। দেবতা ও সত্ত্বভাব অভিন্ন। এখানেও ইন্দো পদে ব্যাখ্যাকার সোম (মাদকদ্রব্য) অর্থ করেছেন। আমরা শুদ্ধসত্ত্ব-কে সম্বোধন করেছি। মরুত্বতে অর্থে ভগবানের বিবেকরূপী বিভূতিকে লক্ষ্য করা হয়েছে। অর্কস্য জ্ঞানযজ্ঞের– ইত্যাদি অর্থই সমীচীন। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে সোম! ইন্দ্রের পানের জন্য এবং তার সহচর মরুৎগণের পানের জন্য, তুমি অতি চমৎকার আস্বাদন ধারণপূর্বক ক্ষরিত হও, যজ্ঞের স্থানে উপবেশন করো। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-১দ-৬সা) এই মন্ত্রটি দৃষ্ট হয়]।

১১/২– হে ভগবন! শরণাগতপালক জগতের ধারক আপনাকে ক্ৰান্তপ্রজ্ঞ এবং আপনার পূজায় অভিজ্ঞ (স্তোতের অভিজ্ঞগণ) আপনার পূজায় সমর্থ হন। অতএব অকিঞ্চন আমরা আপনাকে (আপনার অনুগ্রহ) প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক ও সঙ্কল্পজ্ঞাপক। ভাব এই যে, আমরা ভগবানের জন্য যেন সম্বুদ্ধ হই)। [মন্ত্রের বিচোবিদ পদে ভগবৎ-স্তোত্রে অভিজ্ঞগণকেই বুঝিয়েছে। বি পদে আত্মজ্ঞানসম্পন্ন ক্রান্তপ্রজ্ঞদেরই বোঝায়। আয়ধঃ পদ মনুষ্য-নামের মধ্যে নিরুক্তে পঠিত হয়েছে। সেই অনুসারে এখানে মরণধর্মশীলঅর্থাৎ অনভিজ্ঞ আমাদেরঅর্থ গৃহীত হয়েছে।

১১/৩– ক্ৰান্তকর্মা (বিশ্বকর্মা), হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎ-ভাবের সঞ্চারক আপনার অমৃতের ধারা, পরমমঙ্গলদায়ক মিত্রদেবতা, আত্ম-উৎকর্ষসাধক অর্যমাদেবতা, স্নেহকারুণ্য-সঞ্চারক বরুণদেবতা, বলপ্রাণ-সঞ্চারক মরুৎ-দেবতা– সর্বদেবগণ গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমাদের প্রদত্ত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে সকল দেবগণ আমাদের অনুগ্রহ করুন)। [সোম মাদক দ্রব্য নয়, সাধক-হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাব। অশরীরী দেবগণ সেই শুদ্ধসত্ত্বের সাথে ওতঃপ্রোতঃ সর্বত্র বিদ্যমান। মন্ত্রের মধ্যে মিত্র ইত্যাদি যে বিভিন্ন দেবতার নামোল্লেখ আছে, তাতেও এক উচ্চ আদর্শের কল্পনা করা যেতে পারে। বোঝা যায়, — মিত্র, অর্যমা, বরুণ, মরুৎ প্রভৃতি সকলেই সেই একেরই অভিব্যক্তি, সকলেই সেই একেরই ভিন্ন ভিন্ন বিভূতির বিকাশ। বোঝা যায়, তিনি স্বর্গ, মর্ত্য প্রভৃতি ভুবনে সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান, আর সকলই তাতে পরিব্যাপ্ত আছেন। মন্ত্রে সামরূপে সেই বহুরূপের সেই বিশ্বরূপের বিষয়ই উল্লিখিত হয়েছে। সকল দেবরূপে সর্বত্র তিনি বিরাজিত, তিনি সোমরূপে পরিচিত। সেই পরব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছু নন। মন্ত্রে তারই রূপ-গুণের ব্যাখ্যান হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষি কশ্যপ মারীচ। এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রসংগ্রথিত নটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– ইষোবৃধীরং, গায়ত্রীকৌঞ্চং, বাজদাবদাসয়ং, অশ্বসূক্তং, আমহীবয়ং, দাঢ়জ্যুতং, বারবন্তীয়োত্তরং, ইহবদ্বামহদ্ধব্যং, এবং মার্গীয়বাদ্যং]।

১২/১– হে পরমদাতঃ! পবিত্রতাসাধক আপনি ইহজগতে অথবা সমুদ্রের ন্যায় বিশাল হৃদয়, প্রদেশে জ্ঞান প্রদান করেন; হে পবিত্রতাকারক দেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের প্রভূতপরিমাণে সর্বলোকের প্রার্থনীয় পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞানরূপ পরমধন প্রদান করুন)। [জ্ঞানস্বরূপ, পবিত্রতাস্বরূপ ভগবানের কৃপায় মানুষ নিজের চরম গন্তব্য পথে চলতে সমর্থ হয়– এটাই নিত্যসত্য। তিনি মোক্ষপ্ৰদায়ক। সেই পরমধনের (মোক্ষের) জন্য পরমদাতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত সমুদ্রে পদে নিরুক্ত-সম্মত ইহজগতি অর্থ গৃহীত হয়েছে। [ছন্দ আর্চিকেও (৫অ ৫দ-৭সা) এই মন্ত্রটি পরিদৃষ্ট হয়]।

১২/২– অভীষ্টবর্ষক পবিত্রতাসাধক হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব, সৎ-ভাব অবরোধক শত্রুদের হৃদয়েও এবং অরণ্যের ন্যায় শুষ্ক হৃদয়েও ক্ষরিত হয়ে তাদের পরিত্রাণ করে থাকে। অপিচ, শুদ্ধসত্ত্ব উদকের মতো দ্রাবক সৎ-ভাব-সমন্বিত হৃদয়ে আপনা-আপনিই সঞ্চারিত হয়ে, তাকে রক্ষা করে থাকে। (অথবা সৎ-ভাবের প্রভাবে অতি পাষাণকঠোর হৃদয়েও উদকের ন্যায় দ্রাবক শুদ্ধসত্ত্ব প্রকৃষ্টরূপে ক্ষরিত হয়)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। সঙ্কল্পজ্ঞাপক তো বটেই। অতি কঠিন হৃদয়ও সৎ-ভাবে বিগলিত হয়ে থাকে। সঙ্কল্পের ভাব এই যে, আমরা যেন সৎ-ভাবের সঞ্চারে সমর্থ হই)। [দেবতা ও সোম এই উভয়ের সম্বন্ধ খ্যাপন-মূলক ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে প্রদত্ত হয়েছে। এই মন্ত্রে যে ভাব পরিব্যক্ত, সে বিষয়েও পুর্বে আলোচনা প্রসঙ্গে বিবৃত হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্বের সৎ-ভাবের প্রভাবে অতি অজ্ঞান হৃদয়ও জ্ঞানালোকে প্রদীপ্ত হয়; পাপী ব্যক্তির হৃদয়ও নির্মলতা ধারণ করতে পারে-মন্ত্রে এই নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে। বক্তব্য– শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে অরণ্যের মতো নিবিড় অন্ধতমসাচ্ছন্ন রিপুরূপ হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল হৃদয়ও জ্ঞানের জ্যোতিঃতে উদ্ভাসিত হয়। পাষাণের মতো কঠিন। হৃদয়েও অমৃতের প্রবাহ প্রবাহিত হতে থাকে। আবার সৎ-ভাব সম্পন্ন হৃদয় জ্ঞানভক্তির সাথে সাথে মিলিত হয়ে, পরমস্থানে (ঈশ্বরের চরণে) নিয়ে যায়। প্রার্থনা– এমন যে শুদ্ধসত্ত্ব, তিনি আমাদের হৃদয়ে উপজিত হয়ে, আমাদের সেই পরমস্থান প্রদান করুন]। [এই সূক্তের ঋষি– ভরদ্বাজ, কশ্যপ, গোতম, অত্রি, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি ও বসিষ্ঠ। এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত মোট চৌদ্দটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– ঔক্ষ্ণোরন্ধ্রম, স্বাবৈড়মৌক্ষোরন্ধ্রম, বাজজিৎ বরুণসাম, আঙ্গিরসাঙ্গোষ্ঠস ইত্যাদি]।

১৩/১– মাতার স্নেহধারার দ্বারা সর্বলোকপালক মহামহিমান্বিত সৎ-ভাব-প্রেরক ভগবানকে অর্চনাকরিগণ সর্বতোভাবে পরিচর‍্যা করেন। অপিচ, সেই অর্চনাপরায়ণগণ জ্ঞানজ্যোতিঃর দ্বারা সেই ভগবানকে নিজেদের সাথে সংযোজিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-খ্যাপক ও আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, সৎ-ভাব-সম্পন্ন সাধকেরা জ্ঞানের প্রভাবে ভগবানের সাথে আত্মসম্মিলন সাধন করেন)। অথবা-মাতার স্নেহ ধারার দ্বারা সর্বলোকপালক, মহামহিমান্বিত ও সৎ-ভাব-প্রেরক সেই ভগবান আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্ত বিশ্বভুবনকে সৎ-ভাবের দ্বার পরিব্যাপ্ত করেন; এবং সেই ভগবান্ জ্ঞানজ্যোতিঃর দ্বারা শরণপরায়ণদের সম্যরকমে উদ্ভাসিত করেন। [মন্ত্রের দুটি অন্বয়েই সর্বত্র একই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। দুটিরই আকাঙ্ক্ষা– আত্মার আত্মসম্মিলন। প্রচলিত ব্যাখ্যায় যে ভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা এই, নদীগণ এই সোমের (সোমরসের) মাতা। দশ অঙ্গুলি মিলিত হয়ে এঁকে শোধন করে। ক ইনি অদিতির সন্তান দেবতাদের সাথে মিলিত হন। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যায় দশক্ষিপঃ পদের অর্থ ও গৃহীত হয়েছে– বিশ্বভুবন। সিন্ধুমাতরং পদের প্রচলিত ব্যাখ্যায় সিন্ধবো নব মাতরো প্রভৃতি অর্থ পরিগৃহীত হওয়ায় গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, শতদ্রী, পরুষী (ইরাবতী), অসিক্লী, মরুবৃধা, বিতস্তা এ আর্জিকায়া (বিপাট) প্রভৃতিকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের মতে ঐ সিন্ধুমাতরংপদের অর্থ অনুধাবনীয়। যিনি পালন করেন, রক্ষা করেন, তিনিই মাতা। যিনি স্নেহধারা-প্রদানে জীবনরক্ষা করেন– তিনিই মাতৃ-পদবাচ্য। সিন্ধু পদে সেই স্নেহধারাকেই বোঝাচ্ছে। ভগবান, মায়ের স্নেহধারার দ্বারা সদাকাল আমাদের পালন ও রক্ষা করেন, সিন্ধুমাতরং প্রভৃতি মন্ত্রের প্রথম অংশে সেই ভাবই প্রস্ফুট। আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত বিশ্বভুবনকে প্রাণিপর্যায়কে– চেতন, অচেতন, জড়, অজড় সকলকেই ভগবান্ রক্ষা করে থাকেন। তাদের করুণাধারা-বিতরণে পালন করেন, দশক্ষিপঃ ও সিন্ধুমাতরং পদ দুটিতে এই ভাবই উপলব্ধ হয়েছে।

১৩/২– পবিত্র শুদ্ধসত্ত্ব বিশুদ্ধ হৃদয়রূপ আধারে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের সাথে সম্যক্‌রকমে সম্মিলিত হয় বা হোক। অপিচ, সেই শুদ্ধসত্ত্ব পবিত্রকারক জীবনস্বরূপ বায়ু দেবতার এবং স্বপ্রকাশ সূর্যদেবের কিরণসূহের সাথে অর্থাৎ জ্ঞানজ্যোতিঃর সাথে সঙ্গত হোক। [এই স্থলে পবিত্র শব্দে কুশ অর্থ গ্রহণ না করে ঐ পদে হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্র অর্থ গ্রহণই সঙ্গত হয়েছে। ভগবৎসম্মিলনের হৃদয়ই পবিত্র স্থান]।

১৩/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি পরমানন্দময় এবং পরমকল্যাণসাধক হও। সেই তুমি (শুদ্ধসত্ত্ব) আমাদের পরমমঙ্গলের জন্য, সৌভাগ্য-বিধাতা ভগদেবতার, জীবনস্বরূপ বায়ুদেবতার, পুষ্টিসাধক পূষাদেবতার, মিত্রের ন্যায় পরম-উপকারী মিত্রদেবতার এবং স্নেহকারুণ্য-স্বরূপ বরুণদেবতার সর্বদেবতার প্রীতির নিমিত্ত, আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সর্বদেবতার প্রীতির নিমিত্ত আমরা যেন সৎ-ভাব-সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হই)। [এখানে ব্যষ্টিভাবে বিভিন্ন দেবতার এবং সমষ্টিভাবে সেই বিশ্বদেবরূপ একমেবাদ্বিতীয় ভগবানের পূজার বিষয় বিবৃত হয়েছে। পূর্বের মন্ত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে– দেবতা ও ভগবৎ-বিভূতি অভিন্ন। ভগ, বায়ু, মিত্র প্রভৃতি– সেই একেরই বিভিন্ন অভিব্যক্তি বা বিভূতির প্রকাশ। দেবগণ অশরীরী সূক্ষ্ম। তাদের পেতে হলে সেই সূক্ষ্ম সামগ্রীরই আবশ্যক হয়। তাই সূক্ষ্ম শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা তাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করবার উপদেশ মন্ত্রে দেওয়া হয়েছে। — এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তুমি মধুর রস ও সুন্দর রূপ ধারণপূবক ভগনামক দেবতার জন্য এবং পূষা, বায়ু, মিত্র ও বরুণের জন্য ক্ষরিত হও]। [এই সূক্তের ঋষি– অমহীয়ু আঙ্গিরস। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– ইহবদ্বামদেব্যং এবং অয়াসোমীয়ং]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৪– রেবতীর্নঃ সধমাদ ইন্দ্রে সন্তু তুবিবাজাঃ। ক্ষুমন্তো যাভিৰ্মদেম৷১। আ ঘ ত্বাবান্ অনাযুক্তঃস্তোতৃভ্যো ধৃষ্ণবীয়ানঃ। ঋণোবক্ষং ন চক্র্যোঃ ॥২৷৷ আ যদুবঃ শতক্ৰবা কামং জরিতৃণা। ঋণেরক্ষং ন শচীভিঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ১৫– সুরূপকৃতুমূতয়ে সুদুঘামিব গোদুহে। জুহুমসি দ্যবিদ্যবি৷৷৷৷ উপ নঃ সবুনা গহি সোমস্য সোমপাঃ পিব। গোদা ইদ রেবততা মদঃ ॥২॥ অথা তে অন্তমানাং বিদ্যাম সুমতীনা। মা নো অতি খ্য আ গহি৷৷৩৷৷

সূক্ত ১৬– উভে যদি রোদসী আপথোষা ইব। মহান্তং ত্বা মহীনাং সাম্রাজংচর্ষণীনাম। দেবী জনিৰ্যজীজনদ ভদ্রা জনিজীজনৎ ॥১॥ দীর্ঘং হ্যঙ্কুশং যথাশক্তিং বিভর্ষি মন্তুমঃ। পূর্বেণ মঘবন্ পদা বয়ামজো যথা যমঃ। দেবী জনিজীজন ভদ্রা জনিজীজনৎ৷৷৷ অব স্ম দুর্থণায়তো মর্তস্য তনুহি স্থির। অধম্পদং তমীং কৃধি যো অশ্ম অভিদাসতি। দেবী জনিৰ্যজীজন ভদ্রা জনিৰ্যজীজনৎ ৷৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৪সূক্ত/১সাম– সেই পরমাত্মাতে (ইন্দ্রদেবে) প্রীতিযুক্ত হলে, স্তুতিপরায়ণ আমরা যে শুদ্ধসত্ত্বভাবের উদয়ে আনন্দ অনুভব করি, আমাদের সেই শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ পরমার্থযুক্ত (পরমাত্মায় বিনিবিষ্ট) হোক। (ভাব এই যে, ভগবানের প্রীতি কামনায় উদ্বুদ্ধমনা আমরা সেই আনন্দতম শুদ্ধসত্ত্ব যেন প্রাপ্ত হই, আর সেই শুদ্ধসত্ত্ব যেন ভগবানের প্রীতিসাধনে বিনিযুক্ত হয়)। [এই বঙ্গদেশেই এ মন্ত্রের নানা বিপরীত অর্থ প্রচলিত দেখা যায়। কেউ অর্থ করেছেন, — -ইন্দ্রদেব আমাদের সাথে সোমরস পান করে হর্ষযুক্ত হলে আমাদের প্রচুর অন্নবিশিষ্ট সম্পৎ প্রদান করুন, তার দ্বারা আমরা অন্নযুক্ত হতে পারি। কেউ বা অর্থ করেছেন, -ইন্দ্রদেব আমাদের প্রতি হৃষ্ট হলে আমাদের (গাভীগণ) দুগ্ধবতী ও প্রভূত বলশালিনী হবে, (সে গাভী) হতে খাদ্য পেয়ে আমরা হৃষ্ট হবো। কিন্তু প্রকৃত মর্মার্থ এই যে, ভগবানের প্রতি প্রীতিযুক্ত হয়ে, ভগবনকার্যে ভগবানের এ উপাসনায় প্রবৃত্ত হলে সত্ত্বভাবের উদয়ে আপনা-আপনিই আনন্দের সঞ্চার হয়; সেই ভাব, সেই। আনন্দ, ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে চির-বিদ্যমান থাকুক। কর্ম, ভাব, আনন্দ-ভগবানে মিলিত হলে শ্ৰেয়োলাভের পক্ষে আর বিঘ্ন থাকতে পারে না]।

১৪/২– জগৎ-ধারক হে দেব! আপনার তুল্য অনুগ্রহপরায়ণ সখা আর নেই; চক্রের আবর্তনে অক্ষাংশ যেমন ভূমি স্পর্শ করে থাক, তেমন হে দেব, স্তোতৃগণের অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত, প্রার্থনাকারী আমি আপনার অনুগ্রহে আপনাকে প্রাপ্ত হবার আশা করছি। মন্ত্রের মধ্যে সুষ্ঠু উপমা বিদ্যমান। চালকের সাহায্যে অক্ষাংশ যেমন ভূমিস্পর্শ করে, তেমন ভগবানের অনুকম্পায় সংসার-চক্রে ভ্রাম্যমাণ পুরুষ ভগবানকে প্রাপ্ত হয়)।

১৪/৩– পরমপ্রজ্ঞাসম্পন্ন হে দেব! আপনার সামীপ্যলাভ রূপ ধনই আমার ন্যায় প্রার্থনাকারীর সর্বতোভাবে কামনার বিষয়; চক্ৰবিবর্তনরূপ কর্মের দ্বারা অক্ষাংশ যেমন ভূমি প্রাপ্ত হয়, সেইরকমভাবে আমাকে আপনাকে প্রাপ্ত করিয়ে দেন। (অর্থাৎ, সংসারচক্রে ঘূর্ণমান হয়ে কর্মের দ্বারা : আমি যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই)। [এই মন্ত্র পূর্ব মন্ত্রের সাথে বিশেষ সম্বন্ধবিশিষ্ট। সংসারচক্রে কেন জীব বিঘূর্ণিত হচ্ছে? সে তার কর্মফল। পূর্ব মন্ত্রে ইঙ্গিতমাত্র আছে; এ মন্ত্রে সে ভাব পূর্ণ-পরিস্ফুট। এ মন্ত্রের মর্ম এই যে, — হে ভগবন! আমি যেন কর্মের দ্বারা (শচীভিঃ) আমার এই জীবন-রূপ ঘূর্ণমান অক্ষাংশকে আপনার সাথে সম্মিলিত করতে সমর্থ হই। চক্ৰবিবর্তন রূপ শক্তির দ্বারা অক্ষ চালিত হয়েছিল। আবার পুনরায় সেই শক্তির সহায়তা লাভ না করলে, অক্ষাংশ ভূমিপ্রাপ্ত হতে পারে না। ভক্ত-সাধক তাই গেয়েছেন, — আত্মকর্মফলে তোমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম; এখন, আমার আত্মকর্ম তোমাতে সংন্যস্ত হয়ে, যেন তোমাকেই প্রাপ্ত হয়। প্রার্থনাকারী আমি; আমি ধনলাভের কামনা করছি। কিন্তু কি ধনের কামনা করি? আমি ক্ষণস্থায়ী ঐশ্বর্যের প্রার্থী নই; আমি মান যশ প্রভৃতিরও কামনা করি না। আমি চাই পরমধন– তোমার সামীপ্যলাভ-রূপ পরমধন। হে পরম প্রজ্ঞাসম্পন্ন শতক্রতো জ্ঞানাধার! আপনি জ্ঞানধনদানে আপনার সামীপ্যলাভের পক্ষে আমার সহায় হোন। এই প্রার্থনার চেয়ে বড় প্রার্থনা খুঁজে মেলা ভার]। [এই সূক্তের ঋষি– শুনঃশেপ আজীগতি। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের গেয়গানের নাম—বারবন্তীয়োত্তর]।

১৫/১– সৎকর্মশীল (অথবা– সৎকর্মের পোষণকর্তা, অথবা, সৎকর্মের শ্ৰেষ্ঠসম্পাদয়িতা) ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে আমাদের রক্ষণার্থ প্রত্যহ আহ্বান করছি (অথবা, তার নিকট প্রার্থনা জানাচ্ছি); গোদুহে সুদুঘার ন্যায় (অর্থাৎ, আপনা-আপনি বর্ষণশীল স্নিগ্ধ চন্দ্ৰসুধার ন্যায়, অথবাসুদোহা গাভীর ন্যায়) আমাদের নিকট আগমন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — চন্দ্রকিরণ যেমন আপনা আপনি বর্ষণশীল, অভিন্নভাবে সর্বলোকের তৃপ্তিসাধক, হে দেবগণ, সেইরকমভাবে আপনি আমাদের প্রতি করুণাপরায়ণ হোন)। [ব্যাখ্যাকারগণ সুদুঘামিব গোদুহে উপমার অর্থ করেছেন, গোদুহে, (গোদোহনায় গোধুগৰ্থং) সুদুঘাং (সুষ্ঠুদোগ্ধীং গামিব); অর্থাৎ, দোহনকালে অনায়াসে যে গাভীর দুধ দহন করা যায়, সেই গাভীর মত। এ থেকে অর্থ- নিষ্পন্ন করা হয়েছে-দুগ্ধ দোহনকালে সুদোগ্ধ গাভীকে যেমন লোকে আহ্বান করে, হে শোভনকর্মশীল ইন্দ্রদেব, আমরা সেইভাবে তোমাকে আহ্বান করছি। কিন্তু আমাদের মতে, গোদুহে শব্দে পৃথ্বীমাতাকে বা চন্দ্রদেবকে দোহনের অর্থ আসছে। সুদুঘাং-সহজে দোহন করবার উপযোগী– আপনা থেকে অমৃতধারা ক্ষরণের উপযোগী তাদের মতো আর কে আছে? চন্দ্রের রশ্মিকণা যাচ্ঞা করতে হয় না। আবার পৃঙ্খীমাতা যে সুদুঘা তিনি যে অনন্তরত্ন আপনিই বিতরণ করে থাকেন, তার কি তুলনা আছে? মন্ত্রে তাই বলা হচ্ছে—হে দেব! তুমি নিজেই করুণা করো। আমরা অকৃতী অধম। আমাদের কর্ম-সামর্থ্য এমন কিছুই নেই যে, তোমাকে আকর্ষণ করি। পৃথ্বীমাতার রস-রূপ দুগ্ধ যেমন আপনিই আকৃষ্ট হয়, চন্দ্রের রশ্মি যেমন আপনিই ক্ষুদ্র মহৎ উচ্চ নীচ সর্বনির্বিশেষে নিপতিত হয়, তুমি তেমনভাবে এস। আমাদের আশ্রয় দান করো। মন্ত্রের এই অর্থই সমীচীন ও সঙ্গত]।

১৫/২– হে অমৃতপায়ি (হে শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণশীল)! আপনি আমাদের ভক্তিসুধা (সারাংশভূত সত্ত্বভাব) গ্রহণ করুন; পরমধনৈশ্বর্যসম্পন্ন আপনার আনন্দ, আমাদের পরম ধনদানে প্রবর্ধিত হোক। (ভাব এই যে, — হে দেব! আমাদের পরম ধনদানে প্রবর্ধিত হোক। (ভাব এই যে, হে দের! আমাদের সকল কর্মের সাথে আপনার সম্বন্ধ হোক; আমাদের পরমার্থদানে আপনার প্রীতি হোক)। [ব্যাখ্যাকারগণ সাধারণতঃ অর্থকরে গেছেন-হে সোমপায়ী মদ্যপ ইন্দ্রদেব! আমাদের ত্ৰৈকালিক যজ্ঞে তুমি আগমন করো। সোম-মদ্য পান করো। আর মদ্যপানের আনন্দে বিভোর হয়ে আমাদের গোধন ইত্যাদি দান করো। কোনও দেবতাকে তো দূরের কথা; কোন মানুষকেও যদি এমনভাবে উপাসনা করা হয়, সে মানুষও রুষ্ট না হয়ে পারেন না। কিন্তু এমন অর্থই প্রচলিত। অথচ, এ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত-ভাবাত্মক]।

১৫/৩– তারপর (পার্থিব ঐশ্বর্যের সাথে বিগত-সম্বন্ধ হওয়ার পর আমরা আপনার অতিশয় সমীপবর্তী উত্তম বুদ্ধিযুক্ত পুরুষগণকে জ্ঞাত হই, (তাদের জেনে তাদের মঙ্গলাভে সমর্থ হই; তখন, আপনার অনুগ্রহে আমরা শুদ্ধবুদ্ধি লাভ করতে সমর্থ হই)। আপনি আমাদের অতিক্রম করে খ্যাত হবেন না (অর্থাৎ, আমাদের উপেক্ষা করে আপনার স্বরূপ ব্যক্ত করবেন না– আমাদের কাছে আপনি স্বপ্রকাশ হরেন)। আপনি আমাদের নিকট আগমন করুন। (ভাব এই যে, — আপনি স্বরূপ বিজ্ঞাপিত করে, আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন)। [পূর্ববর্তী মন্ত্রের মদশব্দের অর্থ নিষ্কাশনে ভাষ্যকারগণ যেমন গণ্ডগোলের সৃষ্টি করেছেন, এই মন্ত্রের অন্তর্গত অর্থ শব্দের ক্ষেত্রেও তেমন করেছেন। এই শব্দটির অর্থে তারা বলেছেন– সোমরস পান করে আপনার হর্ষ উপস্থিত হলে…। এখানেও ইন্দ্রদেব যেন এক মদ্যপ ব্যক্তি, মনে হয় মদ্যপানেই যেন তার আনন্দ। অথচ এই মন্ত্রে অন্তর্গত অথ শব্দটি পূর্বৰ্মন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্যই ব্যবহৃত। সুতরাং এর অর্থ হয়, পার্থিব ঐশ্বর্যের সাথে বিগত সম্বন্ধ হবার পর। এটাই সমীচীন এবং যুক্তিযুক্ত]। [এই সূক্তের ঋষি-মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র]।

১৬/১– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! জ্ঞানের উন্মোষিকা বৃত্তি যেমন অজ্ঞানতা বিনাশ করেন, তেমন আপনিও দ্যুলোক-ভূলোককে আপনার জ্যোতিঃতে পূর্ণ করেন; সেই জন্য, দেবভাবপ্রদাতা, আত্ম উৎকর্ষসাধক জনবর্গের রক্ষক আপনাকে দ্যুলোক-ভূলোক অনুসরণ করে; দেবভাব-উৎপাদিকা আপনার শক্তি লোকবর্গকে দেবর্ভাব প্রদান করেন; মঙ্গল-উৎপাদিকা আপনার শক্তি লোকবর্গকে মঙ্গল প্রদান করেন। (ভাব এই যে, — সর্বলোক-কর্তৃক আরাধনীয় দেবতা মানুষকে দেবভাব ও পরমমঙ্গল প্রদান করেন)। [উত্তরার্চিকের এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৩দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৬/২– পরমপ্রজ্ঞাসম্পন্ন হে ভগবন ইন্দ্রদেব! বিস্তীর্ণ সুদৃঢ় অঙ্কুশ-দণ্ড যেমন শক্তি ধারণ করে, তেমনই আপনি পরাশক্তি ধারণ করেন। অথবা সুদৃঢ় অঙ্কুশ যেমন মত্তবারণ (উন্মত্ত হস্তী)-কে নিয়মিত করার শক্তি ধারণ করে; সেইরকম, আপনি মত্তবারণের মতো দুর্দমনীয় মনের চাঞ্চল্য নিবারক শক্তি ধারণ করেন। অতএব প্রভূত-ধনবান্ হে ইন্দ্রদেব! আপনার অনুগ্রহে মনের চাঞ্চল্য এ পরিহারের দ্বারা, অজ যেমন বৃক্ষশাখা আকর্ষণ করে, তেমনভাবে আমাদের হৃদয়ের পুরোভাগে– বর্তমান জ্ঞান ও ভক্তিরূপ আকর্ষণীর সাহায্যে আপনাকে যেন আকর্ষণ করতে পারি। অপিচ, হে ভগবান্ ইন্দ্রদেব! দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত দেবভাব-উৎপাদিকা আপনার সেই শক্তি, আমাদের মধ্যে অনুরূপ শক্তি উৎপাদন করুক; এবং মঙ্গলপ্রদ শক্তির উৎপাদিকা আপনার সেই পরাশক্তি আমাদের পরমমঙ্গল সাধন করুক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। মনের চাঞ্চল্যই সকল অনিষ্টের মূল। অতএব মনের চাঞ্চল্য পরিহারে জ্ঞানভক্তির উন্মেষণে ভগবৎপ্রীতি-সম্পাদনের জন্য সঙ্কল্প এখানে বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আমাদের শক্তিদানে সত্ত্বসমন্বিত এবং স্থিতপ্রজ্ঞ করুন)।

১৬/৩– হে দেব! মরণধর্মশীল মনুষ্যের (আমাদের) উপক্ষয়িত সৎ-ভাবহারক বহিঃ ও অন্তঃশত্রুর সুদৃঢ় শক্তিকে নিঃশেষে বিনাশ করুন। অপিচ, সৎ-ভাব-রোধক যে শত্রু আমাদের অভিভূত করে, সেই প্রসিদ্ধ বহিঃ ও অন্তঃশত্রুকে পরাভূত করুন। হে দেব! দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত দেবভাব উৎপাদিকা আপনার সেই শক্তি আমাদের মধ্যে শক্তি উৎপাদন করুক; এবং মঙ্গলপ্রদ আপনার সেই সৎ-ভাব-জনয়িতা শক্তি আমাদের পরমমঙ্গল সাধন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে বাহিরের শত্রুর (অর্থাৎ দুরাত্মা মানুষদের বা জীবজন্তু ইত্যাদির) এবং অন্তরের শত্রুর (অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গের) বিনাশের প্রার্থনা বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের সৎ-ভাবসম্পন্ন করে সৎপথ প্রদর্শন করুন)। [পূর্বের মন্ত্রে যে চিত্তস্থৈর্যসাধনের বিষয় উত্থাপিত হয়েছে, অন্তঃশত্রু কাম-ক্রোধ ইত্যাদিই তার প্রধান অন্তরায়। লোভজনক দ্রব্য ইত্যাদি দর্শনে, তা পাবার যে উৎকট আকাঙ্ক্ষা জন্মায়, এবং তা অধিগত না হলে যে দুপ্রবৃত্তির উন্মেষ হয়, তারাই চিত্তের চাঞ্চল্য আনে। অন্তরের সেই সকল শত্রু বিনষ্ট হলেই বহিঃশত্রুর বিনাশ সুগম হয়ে আসে। [এই সূক্তটির ১ম, ৩য় ও ২য়ের পূর্বাধ সামের ঋষি-মান্ধাতা যৌবনাশ্ব এবং ২য় সামের উত্তরাধের ঋষি গোধা ঋষিক]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ১৭– পরিস্বাননা গিরিষ্ঠাঃ পবিত্রে সোমমা অক্ষরৎ মদেষু সর্বধা অসি৷৷৷৷৷ ত্বং বিপ্রং কবিমধু প্র জাতমন্ধসঃ। মদেষু সর্বধা অসি৷৷২৷৷… ত্বং বিশ্বে সজোষসো দেবাসঃ পীতিমাশত। মদেষু সর্বধা অসি৷৩৷৷

সূক্ত ১৮– স সুন্থে যো বস্নাং যো রায়ামানেতা ষ ইড়ানা। সোমে যঃ সুক্ষিতীনা৷১। যস্য ত ইন্দ্রঃ পিবাদ যস্য মরুতে যস্য বাৰ্য ভগঃ। আ যেন মিত্রাবরুণা করামহ এমবসে মহে৷২৷

সূক্ত ১৯– তং বঃ সখায়ো মদায় পুনানমভি গায়ত। শিশুং ন হব্যৈঃ স্বদয়ন্ত ঘূর্তিভিঃ ॥১৷৷ সং বৎস ইব মাতৃভিরিন্দুৰ্হিানো অজ্যতে। দেবাবীমদো মতিভিঃ পরিষ্কৃতঃ ॥২॥ অয়ং দক্ষায় সাধনোবয়ং শর্ধায় বীতয়ে। অযং দেবেভ্যো মধুমত্তরঃ সুতঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ২০– সোমাঃ পবন্ত ইন্দবোহস্মভ্যং গাতুবিত্তমাঃ। মিত্রাঃ স্বানা অরেপসঃ স্বর্বিদঃ ॥১॥ তে পূতাসসা বিপশ্চিতঃ সোমাসোদধ্যাশিরঃ। সূরাসোন দর্শসো জিগত্নবো ধ্ৰুবা ঘৃতে৷৷২৷৷ সূম্বাণাসসা ব্যদ্রিভিশ্চিতানা গোরধি ত্বচি। ইষমস্মভ্যমমিতঃ সমস্বর বসুবিদঃ ॥৩॥

সূক্ত ২১– অয়া পবা পবম্বৈনা বসূনি মাংশ্চত্ব ইন্দো সরসি প্রধন্থ। ব্ৰধশ্চিদ যস্য বাতো ন জুর্তি পুরুমেধাশ্চিত্তকবে নরং ধাৎ ॥১॥ উত ন এনা পবয়া পবধি শুতে শয্যস্য তীর্থে। ষষ্টিং সহস্রা নৈগুতো বসূনি বৃক্ষং ন পক্কং ধূনব রণায়। ২৷৷ মহীমে অস্য বৃষ নাম শুষে মাংশ্চত্বে বা পৃশনে বা বধত্রে। অস্বাপয়ন্ নিগুতঃ স্নেহয়ঞ্চাপামিত্র অপাচিতো অচেতঃ ॥৩৷৷

মন্ত্রার্থ— ১৭সূক্ত/১সাম– শ্রেষ্ঠতম অর্থাৎ ভক্তগণের অভীষ্টপূরক পবিত্রতা সাধক শুদ্ধসত্ত্ব আত্ম-উৎকর্ষর্সম্পন্ন হৃদয়ে আপনা-আপনিই সঞ্চারিত হয়। অতএব হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের পরমানন্দ- .. দানের জন্য তুমি সর্বাভীষ্ট-পূরক হও। (নিত্যসত্য-প্রকাশক এই মন্ত্রটি প্রার্থনামূলকও। ভাবার্থ– আত্ম উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধকদের হৃদয়ে আপনা-আপনিই শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্জাত হয়। অকিঞ্চন আমরা শুদ্ধসত্ত্বকে প্রার্থনা করছি। শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সর্বাভীষ্ট পূরণ করুন)। [হৃদয় উপযুক্তভাবে সংগঠিত না হলে, সে হৃদয় ভগবানের দান গ্রহণ করবার শক্তি পায় না এবং সেই দান পেলেও তা রক্ষা করতে সমর্থ না হয় না। বিশুদ্ধ পবিত্র হৃদয়ে যে ভাবের উদয় হয়, তা-ই মানুষকে পরিণামে শক্তির পথে নিয়ে যায়, : সুতরাং ভক্তগণের অভীষ্টপূরক পবিত্রতাসাধক শুদ্ধসত্ত্বলাভের প্রার্থনার মধ্যে হৃদয়ের পবিত্রতা লাভের জন্য প্রার্থনাও নিহিত আছে)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-১দ-৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৭/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি প্রজ্ঞানস্বরূপ জ্ঞানদাতা এবং কর্মকুশল হন। অতএব আপনি আমাদের সৎ-ভাব-সঞ্জাত পরমানন্দ প্রদান করুন। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমাদের পরমানন্দদানে সর্বাভীষ্টপূরক হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক ও প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সৎ-ভাবের প্রভাবে পরমানন্দ-লাভের কামনা বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত এবং পরমানন্দ প্রদান করুন)।

১৭/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশ্বের সকল দেবভাব সমান প্রীতিযুক্ত হয়ে আপনাকে গ্রহণ ও পালন করুন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমাদের পরমানন্দদানে সর্বাভীষ্টপূরক হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। দেবভাবসমূহ আমাদের রক্ষা করুন এবং আমাদের অভীষ্ট পূরণ করুন– প্রার্থনায় এই ভাব। পরিব্যক্ত)। [পীতিং পদে মন্ত্রের একটু অর্থান্তর ঘটেছে। তাতে সোমপানের ভাব মনে আসে। কিন্তু এখানে পান অর্থ গ্রহণ না করে গ্রহণ বা পালন অর্থেই সঙ্গতি উপলব্ধি করা যায়। এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সকল দেবগণ সমান-প্রীতিযুক্ত হয়ে তোমাকে (সোমরস– মাদক দ্রব্যকে) পান করেন। তুমি মাদক-পদার্থের মধ্যে সকলের ধারক হও। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই সূক্তটির ঋষি– অসিত কাশ্যপ বা দেবল। সূক্তান্তর্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত তেরটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– তৃতীয়ং বৈদন্বতম, বৈদন্বতাদ্যম, চতুর্থবৈদন্বতম্ ইত্যাদি]।

১৮/১– যে সত্ত্বভাব ধনপ্রদায়ক, যিনি পরমধনপ্রাপক, যিনি জ্ঞানরশ্মিসমূহের প্রেরক, যিনি সাধকদের রক্ষক, সেই সত্ত্বভাব আমাদের দ্বারা স্তুত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা যেন সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনাপরায়ণ হই)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১১দ ৫সা) পরিদৃষ্ট হয়]। ১৮/২হে শুদ্ধসত্ত্ব! সকলের প্রীতিহেতুভূত বা গ্রহণীয় তোমাকে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ গ্রহণ করেন। অপিচ, মরুৎ-দেবগণ তোমাকে অনুগ্রহ করেন। অর্যমাদের সাহচর্যে ভগদেবতা তোমাকে অনুগ্রহ করেন। অতএব সকলের প্রীতিসাধক তোমার প্রভাবে মিত্রভূত স্নেহকারুণ্যময় (মিত্রাবরুণরূপী) ভগবানকে যেন আকর্ষণ করতে পারি, এবং পরম-আশ্রয় লাভের জন্য পরম-ঐশ্বর্যশালী ভগবানকে যেন হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হই) (মন্ত্রটি সঙ্কল্পজ্ঞাপক। সৎ ভাবের প্রভাবে দেববিভূতি-লাভের এবং আত্মায় আত্মসম্মিলনের সঙ্কল্প এখানে বর্তমান)। [ইতিপূর্বে একাধিক মন্ত্রবিশেষের আলোচনায় মিত্র, বরুণ, ভগ প্রভৃতি দেবতার উল্লেখ প্রসঙ্গে দেখা গেছে যে, তাঁরা পরস্পর বিভিন্নভাবে দৃষ্ট হলেও মূলতঃ অভিন্ন– সেই একেরই বিভিন্ন বিকাশ মাত্র]। [এই সূক্তের ১ম সামের ঋষিঋণঞ্চয় রাজর্ষি এবং ২য়টির ঋষিশক্তি বাসিষ্ঠ। এই দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গান দুটির নাম যথাক্রমে– দীর্ঘম এবং সঙ্কম)।

১৯/১– সকর্মে সখিভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা পরমানন্দ-লাভের জন্য পবিত্রকারক ভগবানকে পূজা করো; মানুষ যেমন শিশুকে ক্ষীর ইত্যাদি দ্বারা তৃপ্ত করে, তেমনভাবে সৎকর্মের সাধন এবং প্রার্থনার দ্বারা ভগবানকে আরাধনা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমি যেন সৎকর্ম-সমন্বিত প্রার্থনাপরায়ণ হই)। (পূর্বের মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রেও একই রকমের উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। শিশু যেমন ক্ষীর ইত্যাদি মিষ্টদ্রব্য পেয়ে সন্তুষ্ট হয়, আমাদের এ সৎকর্মের সাধন ও প্রার্থনার দ্বারাও ভগবান তেমন সন্তুষ্ট হন। অপরিস্ফুটমতি শিশুর কাছে সুমিষ্ট, এ খাদ্যদ্রব্যের তুল্য আনন্দপ্রদ তৃপ্তিদায়ক আর কিছুই নেই। এখানে শিশুর তৃপ্তির গভীরতার সাথে ভগবানের তৃপ্তির গভীরতার তুলনা হয়েছে, শিশুর সাথে ভগবানের তুলনা হয়নি। আমাদের। সৎকর্মান্বিত ও প্রার্থনাপরায়ণ দেখলে ভগবান্ যেমন সন্তুষ্ট হন, এমন আর কিছুতেই নয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-১০দ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৯/২– দেবভাবসমূহের সংরক্ষক (উৎপাদক), পরমানন্দদায়ক, উপাসকদের শৌর্যসম্পাদনে প্রযত্নপর শুদ্ধসত্ত্ব, আত্ম-উল্কর্য সম্পন্ন সাধকগণ কর্তৃক বিশুদ্ধতাপ্রাপ্ত হয়ে, বৎসগণ যেমন তাদের মাতার সাথে সঙ্গত হয় তেমনভাবে, মনীষিগণ কর্তৃক সম্যক্ রকমে যোজিত হচ্ছেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। সাধকগণই সৎ-ভাবের অধিকারী। আত্ম-উৎকর্ষের দ্বারা সাধকগণ সৎ-ভাব প্রাপ্ত হন। সেই সাধকগণই ভগবানের পূজায় সমর্থ। অতএব সঙ্কল্প– আমরা যেন সৎ-ভাবের সঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হই)।

১৯/৩– আমাদের হৃদয়সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্ব কর্মশক্তির বিধায়ক হোক। সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরিত্রাণের জন্য অথবা আমাদের কর্ম-সমূহকে জ্ঞান-সমন্বিত করবার নিমিত্ত আগমন করুক (হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোক)। জ্ঞানভক্তিসমন্বিত সেই শুদ্ধসত্ত্ব দেবগণের প্রীতির নিমিত্ত তাদের পরমানন্দ বিধায়ক হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে, সৎ-ভাব প্রদানে যেন ভগবানের প্রীতি-সম্পাদনে সমর্থ হই)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত বীতয়ে পদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের অর্থ দাঁড়িয়ে যায়। মনুষ্যভাবে ভাবতে গেলে, সুভোজ্য সুপেয় আহার্য ইত্যাদির ভাব মনে আসে; যজ্ঞপক্ষে চরুপুরোডাশ ইত্যাদি ভক্ষণের ভাব মনের মধ্যে উদয় হয়। কেউ আবার ভগবানের উদ্দেশ্যে সোমরস মাদক-দ্রব্য প্রদান করে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন; কিন্তু আবার অন্য স্তরের সাধকের লক্ষ্য অনুধাবন করলে বুঝতে পারা। যায়, তাদের হৃদয়-সঞ্জাত ভক্তি-সুধা পান করবার জন্য যেন তারা ভগবানকে আহ্বান করছেন। [এই সূক্তের ঋষি-পর্বতও নারদ কাণ্ব। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম, যথাক্রমে-কার্ণশ্রবসম্, সুজ্ঞানম এবং কাশীতম]।

২০/১– সৎ-মার্গ-প্রাপক সৎকর্মসাধনে সখিভূত সত্ত্বভাব আমাদের জন্য হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন; সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, প্রার্থনীয়– এবং সর্বজ্ঞ হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরমধনপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করি)। [সত্ত্বভাব সৎ-মার্গ প্রাপ্ত করান। যার অন্তরে পাপ অপবিত্রতা থাকে সে স্বভাবতঃই অপবিত্র পথে চলে, অসতের অনুসন্ধান নিজেকে নিয়োজিত করে নীচ-পথে ধাবিত হয়। কিন্তু হৃদয়ে যাঁদের সত্ত্বভাব উপজিত হয়, তারা তারই প্রভাবে ভগবানের দিকে প্রেরিত হন। সত্ত্বভাব ভগবানকে প্রাপ্তির পথ প্রদর্শন করে। তাই সত্ত্বভাবকে গাতুবিত্তমাঃ বলা হয়েছে। যিনি আমাদের এমন কল্যাণ-সাধনের উপায় বিধান করেন, তিনিই প্রকৃত মিত্র– মিত্রাঃ]। [ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৮দ-৪সা) এই মন্ত্রটি পরিদৃষ্ট হয়]।  

২০/২– আত্ম-উৎকর্ষ সম্পন্ন সাধকগণ জ্ঞানভক্তি-সহযুত কর্মের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বকে সম্যক্ রকমে বিশুদ্ধ অর্থাৎ হৃদয়ে উদ্দীপিত করেন। (এইভাবে প্রবৃদ্ধ হয়ে) সেই শুদ্ধসত্ত্ব স্নেহসত্ত্বসমন্বিত জ্ঞানশক্তি সহযুত হৃদয়ে গমন করে স্থির অবিচলিত হন। তখন সকলের আকাঙক্ষণীয় সেই শুদ্ধসত্ত্ব সূর্যের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন হয়ে সকলের দর্শনীয় বা সকলের দ্রষ্টী ও পরমার্থ-প্রকাশক অর্থাৎ জ্ঞানদায়ক ও মুক্তির হেতুভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সমুদিত হয়ে মানুষকে। এ জ্ঞানজ্যোতিঃর দ্বারা উদ্ভাসিত করে এবং মোক্ষপথে প্রতিষ্ঠাপিত করে থাকে)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা এই, — এরা শোধিত হয়েছে, এরা বিজ্ঞ, এরা দধির সাথে মিশ্রিত হয়ে সূর্যের ন্যায় সুদৃশ্য হয়েছে। এরা.চলছে, কিন্তু ঘৃতের সংসর্গ ত্যাগ করছে না। এ অর্থ থেকে কোনই ভাব উপলব্ধ হচ্ছে না। এরা কারা? এরা কিছুতেই সোমরস নয়, শুদ্ধসত্ত্ব। শুদ্ধসত্ত্ব– মানুষের জন্মসহজাত। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এর বীজ অন্তরে নিহিত থাকে। কর্ম ও সামর্থ্য অনুসারে সে বীজ অঙ্কুরিত পল্লবিত ও মুকুলিত হয়। অধিকারী অনুসারে তার ফলভোগ হয়ে থাকে]।

২০/৩– আমাদের হৃদয়-সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বসমূহ আমাদের হৃদয়রূপ অভিষবণ ক্ষেত্রে জ্ঞানকিরণসমূহের উদ্দীপক হোন। আর সেই হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্রে অবিচলিত জ্ঞানভক্তি প্রভৃতির দ্বারা প্ররিত ভগবৎ-সম্বন্ধযুত হয়ে সেই শুদ্ধসত্ত্বসমূহ শ্রেষ্ঠ ধনসমূহের প্রাপক হোন। অপিচ, আমাদের পরমানন্দদানে উন্মাদিত করে আমাদের অভীষ্ট প্রদান (পূরণ) করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বসমূহ আমাদের পরমার্থ-লাভের সহায় হোক)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় প্রকাশ– প্রস্তরের আঘাতে চৈতন্যযুক্ত হয়ে এরা (সোমরসেরা) সশব্দে গোচর্মের উপরে পড়ছে। ধন কোথায় আছে, তা এরা জানে। এদের ঐ যে মধুর শব্দ, তাই আমাদের অন্ন। ভাষ্যের ও ব্যাখ্যার এই ভাবে বোঝা যায়, সোমলতাকে দুটি প্রস্তরে হেঁচে রস বার করা হচ্ছে, আর সেই প্রস্তরের নীচেরটি গোচর্মের উপরে স্থাপিত আছে। এ পর্যন্ত বোঝবার পক্ষে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু পুনরায় যখন বলা হলো– ধন কোথায় আছে…আমাদের অন্ন; অমনি, গোল বেঁধে গেল। আগের অংশের সাথে পরবর্তী অংশের যে কোনই সামঞ্জস্য নেই, তা সহজেই অনুমেয়। এমন কুব্যাখ্যায়েই বেদ হেয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। এরই ফলে বেদ কৃষকের গান বলে উপেক্ষিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সোম সোমলতা নয়। এই শব্দে সেই জ্ঞান ভক্তি ও কর্মের সংমিশ্রণে অন্তরে যে সুধার সঞ্চার হয়, তা-ই। গো পদের জ্ঞানকিরণ অর্থ নিরুক্তসম্মত। অধিত্বচি পদে হৃদয়রূপ অভিষরণক্ষেত্র অর্থই সঙ্গত]। [এই সূক্তটির ঋষিমনু সাংবরণ। এই তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত নটি গেয়গান আছে। তাদের নাম– গৌরীবিতম, ঐড়ক্রৌঞ্চম, শ্যাবাশ্বম্, আন্ধীগবম ইত্যাদি]।

২১/১– হে সত্ত্বভাব! তোমার পবিত্রকাব্রক ধারার সাথে পরমধন প্রদান করো; হে সত্ত্বভাব! তোমাকে কামনাকারী আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হও। (ভাব এই যে, আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি)। প্রাজ্ঞব্যক্তি যে দেবতার আশুমুক্তিপ্রদ জ্যোতিঃ প্রাপ্ত হন, সকলের মূলীভূত সেই ব্ৰহ্ম সৎকর্মবেতাকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — জ্ঞানী ব্যক্তি ভগবানকে লাভ করেন)। [ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৭দ-৯সা) এই মন্ত্রটি পরিদৃষ্ট হয়]।

২১/২– অপিচ (উত), হে শুদ্ধসত্ত্ব! পরমধনপ্রদাতা আপনি, শ্রুতিপ্রসিদ্ধ অর্থাৎ সৎ-ভাব-সমন্বিত পবিত্ৰহৃদয়ে– আমাদের মানস-যজ্ঞে, মোক্ষদায়ক পাপহারক প্রবাহে ক্ষরিত হোন– প্রকৃষ্টরূপে সঞ্জাত হোন। (ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উপজিত হয়ে আমাদের কর্মকে ফলসমন্বিত এবং ভগবৎপ্রাপ্তির হেতুভূত করুন)। তারপর, শত্রুগণের ধ্বংসকারী হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমাদের অন্তঃশত্রুনাশের দ্বারা, বৃক্ষের পকফল-দানের ন্যায় অর্থাৎ বৃক্ষ যেমন ফর্থী ব্যক্তিকে সুপক্ক ফল প্রদান করে পরিতুষ্ট করে এবং অভীষ্ট পূরণ করে– তেমনভাবে, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ রূপ শ্রেষ্ঠ। ধন প্রদান করে ফলকামী আমাদের ধনবন্ত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! বৃক্ষ যেমন পূর্ণফল দান করে ফলাকাঙ্ক্ষীজনের অভীষ্ট পূরণ করে, তেমনই ভাবে আপনি আমাদের হন ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ চতুর্বর্গের ফল প্রদান করুন)।

২১/৩– শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন! শত্রুগণের ধর্ষক আমার জ্ঞান ও কর্ম শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ আপনার, প্রভূত সুখকর ও পরমানন্দদায়ক হোক। অপিচ, সেই জ্ঞান ও কর্ম অন্তঃশনাশে ও বহিঃশত্রুনাশে বধসাধক হোক। সেই জ্ঞান ও কর্ম সকল রকম বহিঃশত্রুকে নাশ করুক এবং নিঃশেষে বিতাড়িত করুক। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ ভগবন! দেবভাবের বিরোধী শত্রুদের আমাদের নিকট হতে এবং সৎকর্মের বিরোধী শত্রুদের আমাদের কর্মের নিকট হতে দূরে নিঃসারিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে বহিঃশত্রুনাশে সৎকর্মের সুফল প্রাপ্তির সঙ্কল্প বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের ভূতজাত বাহিরের শত্রুদের এবং অজ্ঞানতা সহ-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তরের রিপুবর্গকে নাশ করে আমাদের কর্মফলসমন্বিত করুন)। [বাহিরের শত্রু বলতে দস্যু বা হিংস্র জীবই শুধু নয়, আমাদের দশেন্দ্রিয় এবং তাদের বিষয়ীভূত বন্ধনহেতুর্ভূত পার্থিব সামগ্রীও বটে। বাহ্য দৃশ্যবস্তু অবস্থাভেদে ইন্দ্রিয়বিশেষের বিক্ষোভ জন্মিয়ে অন্তরস্থায়ী কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাতে বাহিরের শত্রুর সহায়তায় অন্তরের শত্রু পুষ্ট ও সমৃদ্ধ হয়ে অন্তরকে অভিভূত করে ফেলে। যতদিন তাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকে, মানুষের কি সাধ্য যেসৎ-ভাবের উন্মেষণে সৎ-ভাবের সঞ্চয়ে সৎকর্মের সাধনে সমর্থ হয়। এখানে এ মন্ত্রে সেই দুরকম শনাশের কামনাই প্রকাশ পেয়েছে। [এই সূক্তটির ঋষি– কুৎস আঙ্গিরস। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– শ্রৌষ্টস্বম, ইহবদ্বাসিষ্ঠম এবং বার্ত্রতুরম্]।

.

সপ্তম খণ্ড

সূক্ত ২২– অগ্নে ত্বং নো অন্তম উত ত্রাতা শিববা ভুবে। বরূথ্যঃ ॥১॥ বসুরগ্নিসুবা অচ্ছা নক্ষি দ্যুমত্তমো রয়িং দাঃ॥২॥ তং ত্বা শোষ্ঠি দীদিবঃ সুমায় নূনীমহে সখিভ্যঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ২৩– ইমা নু কং ভুবনা সীষধেমেন্দ্র বিশ্বে চ দেবাঃ ॥১॥ যজ্ঞং চ নস্তম্বং চ প্রজাং চাদিতৈরিন্দ্রঃ সহ সীষটাতু৷৷২৷৷ আদিতৈরিন্দ্রঃ সগণণা মরুদ ভিরশ্মভ্যং ভেষজা করৎ৷৩৷৷

সূক্ত ২৪– প্র ব ইন্দ্রীয় বৃত্র হন্তায়….॥১॥ উর্জা মিত্রো বরুণ… ॥২৷৷ উপ প্রক্ষে মধুমতি…. ॥৩

মন্ত্ৰার্থ— ২২সূক্ত/১সাম– হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! আপনি সংসার বন্ধননাশক পরমাশ্রয়রূপ পরম- মঙ্গলময়; আপনি আমাদের প্রিয়তম বন্ধুভূত এবং ত্রাণকারী হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনি আমাদের মিত্রস্বরূপ হয়ে আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করুন এবং সংসারের বন্ধন নাশ করুন)। [মন্ত্রের বরুথ্যঃ পদটি লক্ষণীয়। নিরুক্তে ঐ পদ গৃহনামের মধ্যে পঠিত। আবার ঋগ্বেদের অন্যত্রও ঐ পদে রোগনাশক অর্থ গৃহীত হয়েছে। দুটি অর্থেই ভাবসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। সংসারে গতাগতি– সংসারের বিষম বন্ধন– এর চেয়ে কঠিন ব্যাধি আর কিছু হতে পারে না। সেই ভবব্যাধি নাশ করেন বলে, সংসার বন্ধন নাশ করেন বলে, ভগবানকে (বা ভগবানের জ্ঞানদেব রূপ– অগ্নিদেবতা-রূপ-বিভূতিকে) বরুথ্যঃ বলা হয়। আবার ভগবানের মতো শ্রেষ্ঠ আবাসও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চরাচর লীন হয়ে আছে, সকলই তার থেকে উৎপন্ন হয়ে আবার তাতেই লয় হচ্ছে। তাই তাতে একবার আশ্রয় লাভ করতে পারলে, সংসার বন্ধন টুটে যায়, জন্মগতি রোধ হয়। তখন সাগর-জল, নদীর জল-নামরূপ হারিয়ে এক হয়ে যায়। সুতরাং তাকে বরুথ্যঃ বলা. সম্পূর্ণ সঙ্গত]। [ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-১১-২সা) এই মন্ত্রটি প্রাপ্তব্য]।

২২/২– শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন! আপনি সকলের ধারক, সকলের নেতা– সৎপথের প্রদর্শক এবং সৎ-ভাবসমূহের ও শ্রেষ্ঠধনের আধার হন। আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠধনের এবং সৎ-ভাবের দ্বারা ব্যাপ্ত করুন। অপিচ, অতিশয়-দীপ্তিমান, পরম তেজঃসম্পন্ন আপনি আমাদের পরমধন প্রদান করুন। অথবা, পরমধনদাতা আপনি (আমাদের হৃদয়ে) আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -সেই ভগবান্ আমাদের সৎ-ভাবসম্পন্ন এবং পরমধন প্রদান করুন)। [ভাষ্যকার অগ্নি পদে এবার আর হোমাগ্নি বা সাধারণ অগ্নি অর্থ করেননি। এখানে তিনি ঐ পদের অর্থ করেছেন– সবৈষামিগ্রণীঃ। অগ্নি-জ্ঞানাগ্নি তো বটেই। জ্ঞানাগ্নি জ্ঞানদৃষ্টি ভিন্ন কেউ সৎপথে অগ্রসর হতে পারে কি? জ্ঞানাগ্নিই সকল কর্মের নেতা, জ্ঞানাগ্নিই সকলের সকল সৎপথের প্রদর্শক]।

২২/৩– অতিশয় তেজঃসম্পন্ন অর্থাৎ পরমশক্তিসম্পন্ন, আপনার জ্যোতিঃতে আপনি দীপ্যমান্ — স্বপ্রকাশ প্রজ্ঞানরূপী হে ভগবন! শরণাগতের পালনে মহামহিমান্বিত আপনাকে পরম সুখের জন্য প্রার্থনা করছি। অপিচ, আপনার সখ্যলাভের যাচ্ঞা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহে যেন জ্ঞানদৃষ্টি এবং আপনার সঁখিত্ব লাভ করতে সমর্থ হই, আপনি তা বিধান করুন)। [ভাষ্যে ও ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে, তা এই– হে প্রদীপ্ত অগ্নি! আমরা সুখ ও পুত্রের জন্য হৃদয়ের সাথে তোমাকে প্রার্থনা করছি। কিন্তু এখানে সুখ বলতে পরমসুখের প্রতি লক্ষ্য আছে। আর পুত্র বিত্ত ইত্যাদি ঐহিক সুখসাধক সামগ্রী এখানে প্রার্থনাকারীর প্রার্থনীয় নয়। তিনি মোক্ষকামী। ভগবানের সাথে সখ্য-স্থাপনে পরম-সুখ লাভই তার মুখ্য উদ্দেশ্য]। [এই সূক্তটির ঋষিবন্ধু, সুবন্ধু, বন্ধু, বিপ্ৰবন্ধু, গোপায়ন বা লোপায়ন। এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– গূর্দম ও সত্ৰাসাহীয়ম]।

২৩/১– এই পরিদৃশ্যমান্ জগৎ– মায়াপ্রপঞ্চ– আমাদের কি সুখ প্রদান করে? অর্থাৎ প্রকৃত কোনই সুখ দিতে পারে না। পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ এবং ভগবানের বিভূতিরূপ সকল দেবতাই আরাধনার দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের নিশ্চিতভাবে (অথবা শীঘ্র) পরম-সুখ প্রদান করুন। (ভাবার্থ-ভগবানই পরমসুখদায়ক)। [একমাত্র ভগবানের উপাসনায় পরমসুখ পাওয়া যায়, অর্থাৎ জাগতিক সকল পাওয়া না পাওয়ার ঊর্ধ্বে যেতে পারাতেই পরমসুখ। জাগতিক সব কিছুই যে মায়া বৈ আর কিছু নয়, তা নিজে থেকে বোঝা যায় না। ভগবানের কৃপায় ক্রমশঃ মানুষের হৃদয়ে সত্যের আলোক ফুটে উঠলেই সে মিথ্যার স্বরূপ বুঝতে পারে। তখনই তার মিথ্যার মোহ দূর হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ ১১দ-৬সা) দৃষ্ট হয়]।

২৩/২– অনন্ত জ্ঞানরশ্মির সঞ্চারে অর্থাৎ অন্তদৃষ্টিসম্পাদন করে ভগবান্ ইন্দ্রদেব– পরমৈশ্বর্যশালী সর্বশক্তিমান্ ভগবান, শরণাগত প্রার্থনাকারীর অর্থাৎ আমাদের সৎকর্ম (ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কর্ম), বিশ্বপ্রীতি– জন-অনুরাগ এবং সৎকর্মশীল জীবন সাধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি ভগবানের শরণ নিচ্ছি। তিনি আমাকে পরিত্রাণ করুন। সর্বতোভাবে তিনি আমাকে রক্ষা করুন। শরণাগত আমি তার করুণা প্রার্থনা করি)। [মানুষ অহংজ্ঞানে মোহাচ্ছন্ন থেকেই আমি আমার আমিত্ব নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়। কিন্তু যখন ভগবানের অনুগ্রহে তার অন্তদৃষ্টির উন্মেষ হয়, তখনই তার কর্তৃত্বাভিমান দূর হয়। সেইকালেই, অর্থাৎ অন্তদৃষ্টি জন্মালেই মানুষ ভগবানের মাহাত্ম্য হৃদয়সঙ্গম করে, তার শরণাপন্ন হতে সমর্থ হয়]।

২৩/৩– সকল দেবতার সাথে অথবা অনন্ত জ্ঞান-রশ্মির সঞ্চারে অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টি সম্পাদন করে, মরুৎ-দেবগণের সাথে অথবা প্রাণবায়ুসংরক্ষক ভক্তিরূপিণী দেববিভূতির সাথে অর্থাৎবলপ্রাণ সংরক্ষণের দ্বারা এবং অপরাপর দেববিভূতির সাথে ইন্দ্রদেব অর্থাৎ পরমৈশ্বর্যশালী সর্বশক্তিমান ভগবা, শরণাগত প্রার্থনাকারী আমাদের ভবব্যাধিনাশক ঔষধিসমূহ (পরমমঙ্গল) সম্পাদন (প্ৰদান) করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে ভববন্ধন-নাশের প্রার্থনা বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের মধ্যে সৎ-ভাব-রূপ ভেষজ উৎপন্ন করে ভববন্ধন নাশ করুন)। [ভববন্ধন– ভবব্যাধি। এর বিনাশক ভেষজ কি সামগ্রী? মন্ত্রের প্রথমেই আদিত্যৈঃ, মরুদ্ভিঃ, সিগণঃ প্রভৃতি পদে তা পরিব্যক্ত হয়েছে। পূর্বের মন্ত্রেও ভাষ্যকার আদিত্যৈঃ পদে অর্থ করেছে অদিতিপুত্রৈঃ অন্যৈঃ দেবৈঃ। কিন্তু আমরা ঐ পদে অন্তদৃষ্টি-লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে বলে স্থিরনিশ্চয় হয়েই প্রকৃত অর্থটি নিষ্কাশন করেছি। আদিত্য পদে সূর্যকে বোঝায়। আদিত্যৈঃ বলতে সূর্যের সপ্তরশ্মির ভাবই মনে আসে। তা থেকে জ্ঞানসূর্য এবং সেই জ্ঞানসূর্য থেকে ভাবে অন্তদৃষ্টি অর্থ গৃহীত হয়েছে। এখানেও সেই অর্থই প্রযোজ্য। মরুদ্ভিঃ পদে প্রাণবায়ুসংরক্ষক দেববিভূতিকে বোঝাচ্ছে। মরুৎ-গণবায়ু, জীবের জীবন। আবার বায়ুর পবিত্ৰকারিতাও শ্রুতি বিশ্রুত। এই বিচারে প্রাণবায়ুসংরক্ষকেঃ দেববিভূতিভিঃ ভাব পরিগৃহীত হয়েছে। সগণঃ– অপরাপর দেববিভূতির সাথে। তাই আদিত্যৈঃ পদে জ্ঞানলাভের, মরুদ্ভিঃ পদে ভক্তি-সঞ্চারের এবং সিগণ পদে কর্মের বিষয় খ্যাপিত হয়েছে। সুতরাং আদিত্য, মরুৎ প্রভৃতিকে বিশেষভাবে এবং ভগবানের অন্যান্য বিভূতিকে সমষ্টিভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তার তাৎপর্য এই যে, ব্যষ্টিভাবে এবং সমষ্টিভাবে ভগবানের বিভিন্ন বিভূতি হৃদয়ে সমাবিষ্ট হয়ে সেই ভেষজ (জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম) প্রদান করুন]। [এই সূক্তের ঋষিভুবন আপ্তা সাধন বা ভৌবন]।

২৪/১-২-৩-এই মন্ত্রগুলি পূর্বে উল্লিখিত মন্ত্রের সংক্ষিপ্ত রূপ। যথা– ১ম সাম– ঐন্দ্রপর্ব (৩), ৪র্থ অধ্যায়, ১০মী দশতি, ১০ম সাম। ২য় সাম– ঐন্দ্রপর্ব (৩), ৪র্থ অধ্যায়, ১১শী দশতি, ৯ম সাম। ৩য় সাম– ঐন্দ্রপর্ব (৩), ৪র্থ অধ্যায়, ১০মী দশতি, ৮ম সাম। [এই সূক্তের গেয়গানের নাম– উদ্ব শপুত্রম]।

– সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী