সামবেদ-সংহিতা — আরণ্যক পর্ব [৬ষ্ঠ অধ্যায়]

প্রথমা দশতি

 ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। আরণ্যক পর্ব। ষষ্ঠ অধ্যায়।

মন্ত্রের দেবতা ১-৩ ইন্দ্র, ৪ বরুণ, ৫।৭।৮ পবমান সোম, ৬ বিশ্বদেবগণ, ৯ অন্ন।
ছন্দ–১ বৃহতী,
২।৫।৯ ত্রিষ্টুপ, ৩।৪।৭।৮ গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ অথবা চতুষ্পদা গায়ত্রী, ৬ একপাৎ জগতী বা গায়ত্রী। ইন্দ্র জ্যেষ্ঠং ন আ ভর ওজিং পুপুরি শ্রবঃ।
ঋষি ১ ভরদ্বাজ, ২।৫ বসিষ্ঠ, ৪ শুনঃ শেপ, ৭ অমহীয়ু এবং অন্য মন্ত্রগুলির ঋষির নাম অনুল্লেখিত।

ইন্দ্র জ্যেষ্ঠং ন আ ভর ওজিং পুপুরি শ্রবঃ। যদ দিবৃক্ষেম বজ্রহস্ত রোদসী উভে সুশি পপ্রাঃ। ১৷৷ ইন্দ্রো রাজা জগতশ্চর্যণীনামধিক্ষমা বিশ্বরূপং যদস্য। ততো দদাতি দাশুষে বসূনি চোদ্দভ্রাধ উপস্তুতং চিদা৷৷২৷৷ যস্যেদমা রজোযুজস্তুজে জনে বনং স্বঃ। ইন্দ্রস্য রত্যং বৃহৎ৷৷ ৩৷৷ উদুত্তমং বরুণ পাশমম্মদবাধমং বি মধ্যমং শ্ৰথায়। অথাদিত্য ব্রতে বয়ং তবানাগসো অদিতয়ে স্যাম৷৷৷৷ ত্বয়া বয়ং পবমানেন সোম ভরে কৃতং বি চিনুয়াম শশ্বৎ। তন্নো মিত্রো বরুণা মামহামদিতিঃ সিন্ধুঃ পৃথিবী উত দ্যৌঃ ॥ ৫৷ ইমং বৃষণং কৃণুতৈমি মা৷৬৷৷ স ন ইন্দ্রায় যজ্যবে বরুণায় মরুভঃ। বারিবোবিৎ পরি অব৷৷ ৭৷৷ এনা বিশ্বানর্য আ দ্যুম্নানি মানুষাণাম। সিসন্তো বনামহে৷৷ ৮৷ অহমস্মি প্রথমজা ঋতস্য পূর্বং দেবেভ্যো অমৃতস্য নাম। যো মা দদাতি স ইদেবমাবদহমনুমদন্তমদ্মি৷৷৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। বলাধিপতি হে দেব! যে কল্যাণ আমরা পেতে ইচ্ছা করি, এবং যে কল্যাণ আপনি দ্যুলোক-ভূলোকে পূর্ণ করে রেখেছেন, রক্ষাস্ত্রধারী, শ্রেষ্ঠজ্ঞানকারক হে দেব! আমাদের সেই শ্রেষ্ঠ আত্মশক্তিদায়ক তৃপ্তিপ্রদ কল্যাণ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমকল্যাণ প্রদান করুন)। [মঙ্গলময় ভগবানের মঙ্গলময় নীতিতেই বিশ্ব পরিচালিত হয়। মানুষের হৃদয়ে তার এই নীতির আভাষ প্রকাশিত হয়। মানুষ তার অংশ। সুতরাং তার মধ্যে দেবত্বের বীজও আছে। যে অমৃতের, যে কল্যাণের স্বাদ মানুষ একদিন পেয়েছিল; এই মর্ত্যলোকে আসবার আগে সে যে গৌরবময় অনন্ত সত্তায় অবস্থিত ছিল, সেই কল্যাণের, সেই মহিমার স্মৃতি, মানুষের মন থেকে একেবারে মুছে যায় না। সেই স্মৃতি কারো জীবনে বিদ্যুতের মতো একবার মুহূর্তের জন্য ঝলকিয়ে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। কিন্তু যিনি সৌভাগ্যবান, তিনি এই স্বর্গীয় স্মৃতির চাঞ্চল্যকে, পারমার্থিক অতৃপ্তিকে আঁকড়ে ধরেন, একে পূর্ণ তৃপ্তিতে পরিণত করেন। এই মন্ত্রের মধ্যে যদ্দিধৃক্ষেম পদ দুটিতে তা-ই প্রকাশিত হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানটির নাম উল্লেখিত নেই]।

২। বলাধিপতি দেব বিশ্বের সকল আত্ম-উৎকর্ষশীল সাধকদের প্রভু হন; অপিচ, বিশ্বে যে সকল ধন আছে, তিনি সেই ধনেরও ঈশ্বর হন; তিনি সেই ধন হতে ত্যাগশীল সাধককে পরমধন প্রদান করেন; তিনি আমাদের পরম আকাক্ষণীয় ধন নিশ্চিতরূপে প্রদান করুন (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সকল বিশ্বের অধিপতি; তিনি কৃপা করে আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [অতীত ভবিষ্যৎ বর্তমান–সৃষ্টি স্থিতি বিলয়-দৃশ্য বা অদৃশ্য সব কিছুর মূলেই তিনি, সব কিছুরই ধারক তিনি। সকল কর্মেরও তিনিই প্রভু। তিনি কেবল সত্তামাত্র নন। তিনি অসীম করুণার আধার। সাধকগণ তারই কৃপায় পরমধন মোক্ষের অধিকারী হন]] [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।

৩। অত্যন্ত তেজস্বী যে দেবতার স্বর্গীয় জ্যোতির্ময় মহৎ প্রসিদ্ধ পরমরমণীয় দান ত্যাগশীল সাধক লাভ করেন, সেই ভগবানের পরমদান আমরা যেন লাভ করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ হয়। যিনি নিজের সর্বস্ব ভগবানের চরণে অর্পণ করতে পারেন, ভগবান্ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তখন তার অপ্রাপ্য কিছু থাকে না। অর্থাৎ তার কামনা বাসনাও তিরোহিত হয়ে যায়। কোন কর্মের ফলভোগের জন্যও তার তৃপ্তি বা অতৃপ্তি কিছুই থাকে না। এরই নাম পরমা প্রাপ্তি–পরাশান্তি, অবিচ্ছিন্ন অবিমিশ্র সুখ, যার ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই–যা অনন্তকাল পূর্ণভাবে বর্তমান থাকে। সুতরাং যিনি সমস্ত ত্যাগ করেন, তিনি সকল পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পাওয়া–মোক্ষ লাভ করেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানটির নাম উল্লেখিত নেই]।

৪। দ্যোতমান্ হে বরুণদেব অর্থাৎ অভীষ্টপূরণকারী হে ভগবন! উত্তম মধ্যম অধম (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক) তিনরকমের দুঃখরূপ আমাদের (ইহসংসারের) বন্ধন শিথিল করে দিন। প্রার্থনাকারী আমরা যেন নিষ্পাপ হয়ে আপনার কর্মে আপনার সেবায় (আপনার শাসনাধীনে) উত্তম এ গতি লাভ করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে পরমেশ্বর! আমাদের এই এ সকলরকম পাপ থেকে মুক্ত করুন। নিষ্পাপ করে আমাদের মুক্তি–মোক্ষদান করুন)। [এই ঋকে তিনরকমের বন্ধন শিথিল করে দেওয়ার প্রার্থনা আছে। তা থেকে ভাষ্যকারেরা বলির জন্য উৎসর্গীকৃত ঋষিকুমার শুনঃশেপের কটিদেশ, গলদেশ এবং পাদদেশ বন্ধনের প্রতি নির্দেশ করেছেন। এখানে সেই উপাখ্যানের ব্যাপার অবাঞ্ছিত। এখানে ত্রিতাপের, তিনরকম দুঃখের, তারতম্যের বিষয়ই প্রকাশ পেয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানটির নাম উল্লেখিত নেই]।

৫। হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকার আপনার সাহায্যে আমরা যেন রিপুসংগ্রামে রিপুজয় ইত্যাদি সৎকর্ম সম্পাদন করি; সেই হেতু মিত্রস্থানীয় দেবতা, অভীষ্টবর্ষক দেবতা, অনন্তস্বরূপা দেবী স্নেহপরায়ণ, দেবতা, দ্যুলোক-ভূলোকে অবস্থিত সকল দেবতা আমাদের যেন পরমধন প্রদান করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [সোম–শুদ্ধসত্ত্ব। মিত্রঃ মিত্রস্থানীয় দেবতা। বরুণঃ–অভীষ্টবর্ষক দেবতা। অদিতিঃ– অন্তস্বরূপা দেবী! সিন্ধুঃ স্যন্দনশীল, স্নেহপরায়ণ দেবতা। পৃথিবী উত দৌ–দ্যুলোক ভূলোকস্থিত সকল দেবতা। এঁরা স্বতন্ত্র কোন দেবতা নন। একমেবাদ্বিতীয় ভগবানেরই ভিন্ন ভিন্ন বা যথাযথ বিভূতিসম্পন্ন রূপ বা বৈশিষ্ট্য বা অভিব্যক্তি। ভগবান্ জলে স্থলে অনলে অনিলে সর্বত্র বিদ্যমান্। তার এই বিভিন্ন বিকাশকে উপাসনার সুবিধার জন্য বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে মাত্র। সেই একতম পরমদেবতার কাছেই মোক্ষলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গান দুটির নাম উল্লেখিত নেই]।

৬। হে দেবগণ! দানকর্মে অদ্বিতীয় প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাবকে আমার জন্য নিশ্চিতভাবে মোক্ষপ্রাপক করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাকে মোক্ষ প্রদান করুন)। [বহুবচনান্ত কৃণুত ক্রিয়াপদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখবার জন্যই হে দেবাঃ! পদ অধ্যাহার করা হয়েছে। বস্তুতঃ হে দেবগণ! পদে সেই একমেব অদ্বিতীয়ং পরম পুরুষকেই লক্ষ্য করে]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই)।

৭। পরমধনদাতা হে সত্ত্বভাব! আপনি আমাদের আরাধনীয় বলাধিপতিদেবতাকে, অভীষ্টবষকদেবতাকে এবং বিবেকরূপী দেবগণকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন)। [এই মন্ত্রেও বহুদেবতার উল্লেখ দেখা যায়। এক পরমদেবতার নানা বিভূতিকেই বিভিন্ন নাম দিয়ে আরাধনা করা হয়ে থাকে। অ-নাম অ-রূপ সেই দেবতাকে মানুষ তার সসীম বুদ্ধি দ্বারা আয়ত্ত করতে পারে না। তাই তার যে ভাব, যে বিভূতি সাধকের হৃদয়গত হয়, তিনি সেই ভাবের ভাবুক হয়ে ভগবানের পূজায় রত হন। বস্তুতঃ বেদে তার বহুত্ব কল্পনা করা হয়নি। তার যে বিভূতি বলৈশ্বর্যের পরিচায়ক, সেই ভাবকে ইন্দ্রদেবতা বলে ডাকা হয়। যে ভাবে তিনি সাধকদের অভীষ্টপূর্ণ করেন, সেই ভাবকে বরুণ বলে অভিহিত করা হয়। যে ভাবে তিনি সাধকের হৃদয়ে বিবেকরূপে অভূদিত হন, সেই ভাবকে মরুৎ-দেবগণ বলে চিহ্নিত করা হয়। ভগবানের প্রত্যেক বিভূতিই মানুষের অভীষ্টবর্ষক হলেও তাঁর দানাত্মক বিভূতির বিশেষ নাম–বরুণ]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানটির নাম উল্লেখিত নেই]।

৮। হে ভগবন! সাধকদের প্রার্থিত সকল জ্ঞান কামনাকারী, প্রার্থনাপরায়ণ আমরা আপনাকে বিশেষভাবে আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [সাধকদের প্রার্থিত যে সকল জ্ঞান আমরা লাভ করতে পারি বলে প্রার্থনা করা হয়েছে, তা কেমন জ্ঞান? যাতে ত্রিতাপজ্বালা থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, যাতে অশান্তি দূরীভূত হয়ে, সাধকেরা এমন জ্ঞানেরই কামনা করছেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানটির নাম উল্লেখিত নেহ]।

৯। প্রার্থনাকারী আমি যেন পরমদেবভাবসম্পন্ন, এবং সত্যস্বরূপ অমৃতস্বরূপ ভগবানের শ্ৰেষ্ঠসাধক নিশ্চিতভাবে হতে পারি; যে দেবতা লোকদের আত্মশক্তি প্রদান করেন, সেই ভগবানই আমাকে রক্ষা করুন; এইভাবে রক্ষিত হয়ে আমি যেন আত্মশক্তিলাভে বিঘ্নস্বরূপ রিপুগুলিকে বিনাশ করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎপরায়ণ হয়ে আমি যেন রিপুজয়ী হতে পারি)। [শুধু ভগবৎপরায়ণ নয়, সাধকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠসাধক হবার জন্য ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। শুধু গতানুগতিক প্রার্থনা বা উপাসনা করে, সাধক-গায়ক সন্তুষ্ট নন। তিনি দেবেভ্যঃ পূর্বং যাঁরা দেবভাবসম্পন্ন, তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চস্থান লাভ করতে চান; শুধু তাই নয়, অমৃতস্য প্রথমজা– অমৃতস্বরূপ ভগবানের প্রথম সন্তান, শ্রেষ্ঠ সাধক হবার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। –ভাষ্যকার মন্ত্রটির সম্পূর্ণ অন্যরকম অর্থ কল্পনা করেছেন। অন্নের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা যেন এই মন্ত্রটির বক্তা, ভাষ্যে এমন ভাবই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এখানে অন্ন পদে আত্মশক্তি বোঝাচ্ছে। দুমুঠো অন্ন নয়, –এই মন্ত্রে সাধকদের সেই আত্মশক্তি লাভ করবার জন্য উদ্বোধিত করা হচ্ছে, যা লাভ করলে তারা ভগবৎপরায়ণ হতে পারবেন]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।

.

দ্বিতীয়া দশতি

 ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। আরণ্যক পর্ব। ষষ্ঠ অধ্যায়।

দেবতা—১।৩।৪।৭ ইন্দ্র, ২ পাবমান সোম, ৫ বিশ্বদেবগণ, ৬ বায়ু৷
ছন্দ—১।৩।৪।৬ গায়ত্রী, ২ জগতী, ৫ ত্রিষ্টুপ, ৭ অনুষ্টুপ৷৷
ঋষি ১ শ্রুতকক্ষ আঙ্গিরস, ২ পবিত্র আঙ্গিরস, ৩।৪ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র, ৫ প্রথ বাসিষ্ঠ, ৬ গৎসমদ শৌনক, ৭ নৃমেধ ও পুরুমেধ আঙ্গিরস৷৷

ত্বমেরদধারয়ঃ কৃজ্ঞাসু রোহিণীষু চ৷৷ পরষ্ণীষু রূশৎ পয়ঃ ॥ ১৷  অরুরুচদুষসঃ পৃশিরগ্রিয় উক্ষা মিমেতি ভুবনেষু বাজয়ুঃ। মায়াবিনো মমিরে অস্য মায়য়া নৃচক্ষসঃ পিতরো গর্ভমাদধুঃ ২৷৷ আরণ্যক পর্ব ইন্দ্র ইদ্ধর্যোঃ সচা সম্মি আ বচোষুজা। ইন্দ্রো বজী হিরণ্যয়ঃ ৷৷ ৩৷৷ ইন্দ্র বাজেযু নোহব সহস্রপ্রধনেষু চ। উগ্র উগ্রাভিরুতিভিঃ ৷৷ ৪৷৷ প্রথশ্চ যস্য সপ্রথশ্চ নামানুষ্ঠুভস্য হবিষো হবির্ষ। ধাতুদ্তানাৎসবিতুশ্চ বিষ্ণো রথন্তরমাজভারা বসিষ্ঠঃ ॥৫৷৷ নিযুত্বান্ বায়বা গহ্যয়ং শুক্রো অয়াভি তে। গন্তাসি সুন্বততা গৃহ৷৷৬৷৷ যজ্জায়থা অপূর্ব মঘবন্ বৃহত্যায়। তৎ পৃথিবীমপ্ৰথয়স্তদস্তভূনা উততা দিব৷৷ ৭৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১। হে ভগবন! আপনি মলিনহৃদয় জনে, ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিতে এবং সাধকগণের মধ্যে আপনার প্রসিদ্ধ জ্যোতির্ময় অমৃত প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধক এবং পাপীও ভগবানের কৃপায় অমৃত প্রাপ্ত হন)। [ভগবানের কৃপায় সকলেই জ্ঞান লাভ করতে পারে। কেউই তার কৃপা লাভে বঞ্চিত হয় না। তার করুণাধারা অবিরত মানুষের মাথায় বর্ষিত হচ্ছে। তিনি জ্ঞানস্বরূপ, জ্ঞানের আধার। তাঁর পদপ্রান্ত থেকেই পূত মন্দাকিনী-জ্ঞানধারা প্রবাহিত হয়ে জগৎকে শান্ত শীতল করেন]। [এই সামমন্ত্রের তিনটি গেয়গানের নাম উল্লেখিত, নেই]।

২। জ্ঞানের উন্মোষিকা দেবীর মুখ্য জ্যোতিঃ মানুষের হৃদয়কে জ্ঞানালোকিত করেন; সকল লোকের হৃদয়ে আত্মশক্তিপ্রদায়ক, কামাভিবৰ্ষক দেব মানুষকে আত্মশক্তিসম্পন্ন করেন; ভগবানের শক্তি দ্বারা দেবগণ জগতের উৎপত্তিবীজ ধারণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানই জগতের মূল কারণ; তার থেকে সমস্ত জগৎ প্রাদুর্ভূত হয়; তিনিই লোকগণের অভীষ্টপূরক এবং জ্ঞানদায়ক হন)। [ঋগ্বেদের নারদীয় সূক্তে উক্ত হয়েছে–কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মা-মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাসপ্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। …..সর্বপ্রথম মনের উপর কামের আবির্ভাব হলো, তা থেকে সর্বপ্রথম উৎপত্তিকারণ নির্গত হলো–রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমাসকল উদ্ধব হলেন। জগৎপতি সম্বন্ধে এর চেয়ে সুন্দর মীমাংসা হয় না। দেখা যায়, পাশ্চাত্য দার্শনিক মতও অনাদি বেদের অস্ফুট প্রতিধ্বনি বা অনুকরণ মাত্র। ভগবান্ থেকেই জগতের উৎপত্তি হয়েছে তিনি জগতের পিতামাতা ও পালক। এই বিশ্ব তারই বিকাশ মাত্র। বর্তমান মন্ত্রের শেষভাগে জগতের উৎপত্তি সম্বন্ধে একই সত্য প্রকাশিত হয়েছে। ভগবানের শক্তির দ্বারা দেবতাগণ সৃষ্ট হন, তাঁদের মধ্যে যাবতীয় বস্তুর বীজ নিহিত থাকে। অথবা, বলা যায়, এই জগৎ ভগবানের প্রজ্ঞা থেকে সৃষ্ট; সেই প্রজ্ঞা অনাদি অনন্ত। –বেদই প্রজ্ঞা; এই প্রজ্ঞা থেকে, দেবগণের উৎপত্তি। দেবগণ থেকে (অথবা জগতের বীজাধার থেকে) জগতের উৎপত্তি]। [এই সামমন্ত্রের দুটি গেয়গানের নাম উল্লেখিত হয়নি]।

 ৩। ভগবানের বাক্য-অনুরূপ (শাস্ত্র অনুযায়ী) কর্মের দ্বারা যুক্ত (প্রাপ্ত) জ্ঞানশক্তিরূপ-দিব্যকিরণ সহ ভগবান্ ইন্দ্রদেব নিশ্চয়ই সম্মিলিত হন; তিনি বজ্রের ন্যায় কঠোর; তিনি সুবর্ণের ন্যায় কমণীয় (স্নেহশীল)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। মন্ত্রের ভাব এই যে, সৎকর্মেব সাথে ভগবানের অবিছিন্ন সম্পর্ক। তিনি দুর্জনের দমনকারী এবং সঞ্জনের প্রতিপালক)। [এর গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।

৪। বলাধিপতি হে দেব! পরমশক্তিশালী আপনি আত্মশক্তি লাভের জন্য এবং অসংখ্য রিপুসংগ্রামে জয়লাভের জন্য আপনার পরম রক্ষাশক্তির দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন কৃপাপূর্বক আমাদের আত্মশক্তিসম্পন্ন এবং রিপুজয়ী করুন)। [ভগবানই মানুষের বন্ধু, তিনিই তার রক্ষাস্ত্র দ্বারা দুর্বল মানুষের রিপুদের বিনাশ করে থাকেন বলেই মানুষ তার চরম গন্তব্য পথে চলতে সমর্থ হয়। তাই সেই পরমদেবতার চরণেই শক্তিলাভ ও রিপুজয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

৫। প্রার্থনাপরায়ণ জ্যোতির্ময় জ্ঞানীব্যক্তির যে ভগবৎ-পূজোপকরণ বিখ্যাত এবং ভগবৎ-প্রাপক হয়, জ্ঞানীব্যক্তি সেই প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠ ভগবৎ-পূজোপকরণ-রূপ সৎকর্মসাধন-সামর্থ্যই জ্যোতির্ময় জগৎ প্রসবিতা এবং জগৎ-ধারণকারী জগৎ-ব্যাপক দেব হতে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, জ্ঞানী ব্যক্তি ভগবান্ থেকেই ভগবান্‌-প্রাপক সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রাপ্ত হন)। [এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার সায়ণাচাৰ্য কোথা থেকে বাসিষ্ঠের পুত্র প্রথ এবং ভরদ্বাজের পুত্র সপ্রথকে এনে উপস্থিত করেছেন। মন্ত্রের কোথায়ও তাদের বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই, এবং এই মন্ত্রের ব্যাখ্যার জন্য তাদের কোন আবশ্যকতাও নেই। প্রথ পদের ধাতুগত অর্থ বিখ্যাতঃ। সপ্রথঃ প্রসঙ্গেও তা-ই। বসিষ্ঠ পদের জ্ঞানী অর্থ পূর্বাপরই গৃহীত হয়েছে]।

৬। হে আশুমুক্তিদায়ক দেব! অসীম শক্তিশালী আপনি আমার হৃদয়ে আগমন করুন; আপনাকে পাবার জন্য, আপনাতে বর্তমান বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমার হৃদয়ে উৎপন্ন হোক; আপনি পবিত্রতাসম্পন্ন ব্যক্তির হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য আমার হৃদয়ে সত্ত্বভাব আবির্ভূত হোক)।

৭। অনাদি পরমদাতা হে দেব! আপনি যখন বিশ্বশত্রু নাশের জন্য প্রাদুর্ভূত হন, তখন পৃথিবীস্থিত লোকদের শত্ৰুজয়ক্ষম করেন; অপিচ, প্রসিদ্ধ স্বর্গহেতুভূত সত্ত্বভাব মানুষকে প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবাই কৃপাপূর্বক মানুষের রিপুনাশ করেন এবং মোক্ষপ্রাপ্তি জন্য তাদের সত্ত্বভাব প্রদান করেন)। [মঙ্গলময় ভগবান্ মানুষকে কেবলমাত্র রিপুকবল থেকে রক্ষার জন্য, অর্থাৎ দুষ্কৃতদের বিনাশের জন্যই রক্ষাস্ত্র নিয়ে যুগে যুগে আবির্ভূত হন না, ধর্মের সংস্থাপনও করেন, মানুষকে পবিত্র উন্নত করেন। যখন মানুষের হৃদয় পবিত্র হয়, হৃদয়ে সত্ত্বভাব দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই প্রকৃত ধর্মরাজ্য সংস্থাপিত হয়]। [এই মন্ত্রের সতেরোটি গেয়গান আছে, কিন্তু নাম উল্লেখিত নেই]।

.

তৃতীয়া দশতি

ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। আরণ্যক পর্ব। ষষ্ঠ অধ্যায়।

মন্ত্রগুলির দেবতা ১ প্রজাপতি, ২।৩ সোম, ৪।৫।৮।১৩ অগ্নি, ৬ অপাংনপাৎ, ৭ রাত্রি, ৯ বিশ্বদেবগণ, ১০ লিঙ্গোক্ত, ১১ ইন্দ্র, ১২ আত্মা বা অগ্নি। ইন্দ্র জ্যেষ্ঠং ন আ ভর ওজিষ্ঠং পুপুরি শ্রবঃ।
ছন্দ– ত্রিষ্ঠুভ, ১৭ অনুষ্ঠুভ, ৪ গায়ত্রী, ৮।৯ জগতী, ১০ মহাপঙক্তি।
ঋষি—১।৫।৭।১০ বামদেব গৌতম
, ২।৩ গৌতম রাহুগণ, ৪ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র, ৬ গৃৎসমদ শৌনক, ৮ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৯ ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ, ১১ হিরণস্তূপ আঙ্গিরস, ১২।১৩ বিশ্বামিত্র গাথিন।

ময়ি বর্চো অথৌ যশহথো যজ্ঞস্য যৎ পয়ঃ। পরমেষ্ঠী প্রজাপতির্দিবি দ্যামিব দৃংহতু৷ ১। সং তে পয়াংসি সমু যন্তু বাজাঃ সং বৃষ্ণয়ান্যভিমাতিষাহঃ। আপ্যায়মাননা অমৃতায় সোম দিবি শ্ৰবাংস্যুত্তমানি ধি৷৷ ২৷ বৃমিনা ওষধীঃ সোম বিশ্বাস্তুমপো অজনয়ৎ গাঃ। ত্বমাননারুবাহন্তরিক্ষং ত্বং জ্যোতিষা বি তমো ববৰ্থ৷৷ ৩৷৷ অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজ। হোতারং রত্নধাত৷৷ ৪৷৷ তে অমন্বত প্রথমং নাম গোনাং ত্রিঃ সপ্ত পরমং নাম জান। তা জানতীরভ্যন্ষত ক্ষা আবির্ভূবন্নরূণীৰ্যশসা গাবঃ ॥ ৫৷৷ সমন্যা যন্তুপয়ন্তান্যাঃ সমানমূর্বং নদণন্তি। তমু শূচিং শুচয়ো দীদিবাংসমপানপাতমুপ যন্ত্যাপঃ ॥৬৷৷ আ প্রাগাদ ভদ্রা যুবতিরহঃ কোতৃৎসমীৎর্সতি। অভূদ ভদ্রা নিবেশনী বিশ্বস্য জগতে রাত্রী। ৭৷৷ প্রক্ষস্য বৃষ্ণো অরুষস্য নূ মহঃ প্র নো বচো বিদথা জাতবেদসে। বৈশ্বানরায় মলির্নব্যসে শুচিঃ সোম ইব পবতে চারুরগয়ে৷৷ ৮৷৷ বিশ্বে দেবা মম শৃথন্তু যজ্ঞমুভে রোদসী অপাং নপাচ্চ মন্ম। মা বো বচাংসি পরিক্ষ্যাণি বোচং সুমেদি বো অন্তমা মদেম৷৷৷ যশো মা দ্যাবাপৃথিবী যশো মেন্দ্ৰবৃহস্পতী। যশো ভগস্য বিন্দতু যশো মা প্রতিমুচ্যতাম্ যশসাত স্যাঃ সংসদোহহম্ প্রবদিতা স্যাম্৷৷ ১০৷৷ ইন্দ্রস্য নু বীর্যাণি প্রবোচং যানি চকার প্রথমানি বর্জী। অহঃহিমন্বপস্তত প্ৰ বক্ষণা অভিনৎ পর্বর্তনা৷৷১১। অগিরশ্মি জন্মনা জাবেদা ঘৃতং মে চক্ষুরমৃতং ম আস। ত্রিধাতুরৰ্কো রজসো বিমানোহজং জ্যোতির্যাবরশ্মি সর্ব৷১২৷৷ পাত্যগ্নির্বিপো অগ্রং পদং বেঃ পাতি যহুশ্চরং সূর্যস্য। পাতি নাভা সপ্তশীর্ষাণমগ্নিঃ পাতি দেবানামুপমাদঃ ৷৷ ১৩৷

মন্ত্ৰার্থ–১। স্বর্গস্থ, লোকদের পালক, ভগবান্ স্বর্গীয় জ্যোতিঃ তুল্য ব্রহ্মতেজ এবং সুখ্যাতি, অপিচ, সৎকর্মজাত যে অমৃত, তা আমার হৃদয়ে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আপনার পরমজ্যোতিঃ আমাকে প্রদান করুন)। [প্রার্থনার প্রধান লক্ষ্য ব্রহ্মজ্যোতিঃ, স্বর্গীয়শক্তি। যে জ্যোতিঃ হৃদয়ে ধারণ করলে মানুষ ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হয়, যে শক্তি লাভ করলে মানুষ অনায়াসে ব্রহ্মসাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারে, সেই জ্যোতিঃ সেই শক্তি লাভ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। সেই স্বর্গীয় জ্যোতি লাভ করলে, মানুষের হৃদয়ের যত অন্ধকার চিরতরে দূরীভূত হয়। অনন্ত অক্ষয় জ্যোতিঃ সাধকের হৃদয়কে চির উজ্জ্বল করে রাখে।] [এই সামমন্ত্রের এবং এর পরবর্তী সব মন্ত্রেরই এক বা একাধিক গেয়গান আছে; কিন্তু সেগুলির নাম উল্লেখিত নেই]।

২। হে দেব! আপনি শত্রুনাশক রিপুবিমর্দক হন; আপনার সম্বন্ধীয় রূপসমূহ (অমৃতত্ব) সর্বতোভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোক; এবং আপনা হতে উদ্ভূত সৎকর্মসমূহ সর্বতোভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোক। আর আপনার অভীষ্টবর্ষক করুণাস্রোতসমূহ সর্বতোভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোক। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের অমৃতত্বের–অমরগণের জন্য, আমাদের মধ্যে বর্ধমান হয়ে–আমাদের আনন্দপ্রদ হয়ে, স্বর্গে উৎকৃষ্ট রক্ষাসমূহকে (ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ রূপ চতুর্বর্গের ফলসমূহকে) ধারণ করুন আমাদের প্রাপ্ত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে দেব! আমাদের সৎকর্মে নিয়োজিত করুন, আমাদের জন্য মোক্ষ বিধান করুন)।

৩। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকদের হৃদয়ে বর্তমান সকল মোক্ষপ্রাপিকা অবস্থা উৎপাদন করেন, এবং আপনিই অমৃত উৎপাদন করেন; অপিচ, আপনি জ্ঞান উৎপাদন করেন, মহান্ স্বলোককে আপনি ধারণ করেন এবং আপন তেজে আপনি অজ্ঞানতার অন্ধকার সম্যক্ রকমে বিনাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, –সত্ত্বভাবই জগৎ সৃষ্টির মূল কারণ)। [এই মন্ত্রে সত্ত্বভাবের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভাষ্যকার অবশ্য যথাপূর্ব সোমরসের মহিমাই কীর্তন করেছেন। কিন্তু এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, মন্ত্রের সোম পদে একমাত্র ভগবানের শক্তি ব্যতীত অন্য কোন অর্থেই অর্থের বা ভাবের সঙ্গতি রক্ষিত হয় না। সামান্য মাদকদ্রব্য সোমরস কিভাবে স্বর্গলোকের সৃষ্টিকর্তা হতে পারে অথবা (ভাষ্যকারের মতে) পশু ইত্যাদিই বা কিভাবে উৎপাদন করতে পারে? তাঁর জ্যোতির দ্বারাই বা অন্ধকার কিভাবে তিরোহিত হয়? তাই, এখানেও, পূর্বাপর বর্ণনার মতোই, সোম অর্থে, ৬ শুদ্ধসত্ত্ব বা সত্ত্বভাব গৃহীত হয়েছে। এই শুদ্ধসত্ত্বের মাদকতায় অবশ্য মানুষ ভগবৎ-চরণ প্রাপ্ত হয়, তার জীবনের ত্রিতাপ জ্বালা চিরদিনের জন্য বিনষ্ট হয়ে যায়]।

৪। সৎকর্মকারক–মনুষ্যবর্গের হিতসাধক, সৎকর্মের দেবতা অর্থাৎ সৎকর্ম-সঞ্জাত দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণস্বরূপ, সর্বদা সৎকর্মে নিয়োজক, দেবগণের বা দেবভাবসমূহের আহ্বানকারী, ধর্ম-অর্থ কাম-মোক্ষরূপ পরমধনের বিধাতা, জ্ঞানদেবতাকে–সেই চৈতন্যস্বরূপকে, আমি স্তব করি–যেন অনুসরণ করি। (এই মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক অথবা প্রার্থনা-জ্ঞাপক। আমি জ্ঞানদেবতার অনুসরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি; অথবা, হে ভগবন! আমায় জ্ঞানের অনুসারী করুন–এটাই তাৎপর্যার্থ)। [বিভিন্ন দৃষ্টিতে বিভিন্ন ভাবে সব বেদ-মন্ত্রেরই মতো, বিশেষভাবে এই মন্ত্রেরও, অর্থ নিষ্পন্ন হয়ে থাকে। মন্ত্রের প্রধান বাক্য অগ্নি ঈলে। এর সাধারণ অর্থ–অগ্নিকে স্তব করি। কিন্তু অগ্নি কে? কেউ মনে করেন–জ্বলন্ত অনল। কেউ সিদ্ধান্ত করেন অগ্নিনামক কোন ঋষিকে এখানে স্তব করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মত–আর একটু স্বতন্ত্র রকমের। বেদে অগ্নি শব্দের প্রয়োগ যেখানে যখন দেখা যায়, সেখানেই বুঝতে পারা যায়, লক্ষ্য–অগ্নির অতীত সামগ্রীর প্রতি। সে অগ্নি–জ্ঞানাগ্নি; সে অগ্নি-চৈতন্যরূপ অগ্নি। সেই অনুসারে প্রথম আগ্নেয় পর্ব থেকেই অগ্নি শব্দের প্রতিবাক্যে জ্ঞানাগ্নি, জ্ঞানদেবতা প্রভৃতি পদ গৃহীত হয়েছে। জ্ঞানাগ্নি–একমেবাদ্বিতীয় পরমব্রহ্মের জ্ঞানরূপ বা জ্ঞানদাতারূপ বিভূতি। –এই মন্ত্রে অগ্নিদেবের যে কয়েকটি বিশেষণ প্রযুক্ত হয়েছে, সব দিক থেকে সে বিষয় অনুশীলন করলে এখানে (আমাদের) গৃহীত সিদ্ধান্তের সমীচীনতা প্রতিপন্ন হবে। –অগ্নি যজ্ঞের পুরোহিত। কে হতে পারেন? যিনি পুরের হিতসাধনকারী। সুতরাং পুরোহিত ঋত্বিক, প্রভৃতি বিশেষণে সাধারণতঃ অগ্নিকে মানুষ বলেই মনে আসে। আবার অপর অগ্নিই (দৃশ্যমান্ জ্বলন্ত অগ্নিই) বা কিভাবে পুরোহিত বা ঋত্বিক হতে পারেন?–অগ্নিকে যজ্ঞের দেবতা বলা হয়েছে। অগ্নি স্বপ্রকাশ, দীপ্তিমান্। কিন্তু তিনি দানাদিগুণযুক্ত কেমন করে? অগ্নি অর্থে যদি আগুন হয় তবে তিনি তো সমস্ত ভস্মসাৎ করেন। তার মধ্যে আবার দাতৃত্ব গুণ কোথায়? হতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানবিদগণ এই অগ্নি থেকে বাষ্পীয় যান, বাষ্পীয় পোত, বিমান-বিহার, তড়িৎ-শক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে অগ্নির এই দাতৃত্বশক্তির পরিচয় পেয়েছেন। তবে কি, আত্মতত্ত্ব-লাভের পথে, কি কৰ্মসাফল্য (বৈজ্ঞানিক কর্মসাফল্যও) লাভের পথে, দুই দিকেই আবশ্যক মতো জ্ঞানের প্রয়োজন। ব্যবহারের উপযুক্ত জ্ঞান লাভ করেন বলেই কর্মজ্ঞানী সাফল্য পান। তত্ত্বজ্ঞানী আপনা-আপনিই পরমপদ মুক্তি লাভ করেন। অগ্নি-রত্নতমম্, অর্থাৎ ধনরত্নের অধিকারী। অগ্নির ব্যবহারে মানুষ ধনরত্নের অধিকারী হয়েছে, এ-কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু তিনি শ্রেষ্ঠ ধনের অধিকারী। মানুষের শ্রেষ্ঠ ধন কি? পরাগতি বা মোক্ষ। সাধারণ জ্বলন্ত অগ্নিকে উদ্দেশ করে কি এমন বিশেষণ প্রয়োগ করা যায়? তার উপরে আবার তিনি শ্রেষ্ঠ দাতা। এইসব বিশেষণে ভগবানের প্রতি মানুষের চিত্ত আকৃষ্ট করাই প্রাচীন ঋষিদের লক্ষ্য বলে মনে করা অসঙ্গত হয় না। তিনি যে করুণার সাগর-দয়াল প্রভু। ঋষিদের মাধ্যমে ভগবানই তার উদ্দেশ্য প্রকটিত করেছেন যে, জ্বলন্ত অগ্নির কাছ থেকে সাধারণ ধনের প্রত্যাশায় তাঁর অনুসরণ করতে গিয়ে, ক্রমশঃ মানুষ যেন তাতে শ্রেষ্ঠ ধন দেখতে পায়। যখনই তা দেখতে এ পাবে, তখনই বুঝতে পারবে, –তিনি কি অগ্নি। তখনই বুঝবে, –তিনি তেজোময় চৈতন্যস্বরূপ। সেই এ বিষয়টি বুঝতে পারলেই মানুষ শ্রেষ্ঠ ফলের মোক্ষের অধিকারী হবে। তখন আর তার তুচ্ছ ধনরত্নের কামনা থাকবে না; তখন সে পরম ধনের আশ্রয় পাবে। কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই যে জ্ঞানকাণ্ডে উপনীত হতে পারি, এখানে সেই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। ভক্ত সাধক-গায়ক যখন অগ্নির রূপ দেখে ভক্তিভরে তার অর্চনায়–প্রবৃত্ত হন, তখন ক্রমশঃ তার হৃদয়ের অন্ধকার দূর হয়। জ্যোতিত্মানের দিব্যজ্যোতিতে ক্রমশঃ তার হৃদয়রূপ আকাশ আলোকিত হতে থাকে; যে সংশয়ের কুম্ফটিকা তার হৃদয় ঘিরে বসেছিল; তখন ক্রমশঃ তা অপসৃত হয়ে যায়। তখন আর আত্মা-পরমাত্মায় ভেদাভেদ থাকে না। অগ্নিই যে সেই সৎ-চিৎ-আনন্দ-রূপ, অগ্নিই যে সেই পরমাত্মা, আর তারই উদ্দেশে যে আগ্নেয়-সূক্তে অগ্নিস্তোত্র বিহিত হয়েছে, জ্ঞানী তা-ই বুঝে থাকেন। বেদে অগ্নি শব্দ সর্বত্র ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সর্বত্র সকল অর্থের সামঞ্জস্য রাখতে হলে, বেদের অগ্নি শব্দে যে জ্ঞানাগ্নির প্রতি লক্ষ্য রয়েছে, তা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হয়। জ্ঞানই যে হোতা, জ্ঞানই যে পুরোহিত, তার আর বিশ্লেষণের আবশ্যক হয় না। এইভাবে অগ্নিং শব্দের লক্ষ্যস্থল নির্ণীত হলে (অর্থাৎ এই অগ্নিদেবতা সেই একমেবাদ্বিতীয় পরমব্রহ্মেরই জ্ঞানরূপ বিভূতি বলে বুঝতে পারলে), তারপর বোঝবার প্রয়োজন হয় ঈলে পদে কি ভাব প্রকাশ পেয়েছে। ঐ পদের অর্থ–আমি স্তব করি–উপাসনা করি। কিন্তু আমি অগ্নির স্তব করি–এমন উক্তির মর্ম কি? মর্ম কি এই নয় যে, আমি যেন জ্ঞানদেবতার অনুসরণে সঙ্কল্পবদ্ধ থাকি, দেবতা যেন আমায় জ্ঞানের অনুসারী করেন। জ্ঞানের অনুসারিতাই–জ্ঞানের পূজা। দেবত্বের অনুসরণই–দেবতার উপাসনা]।

৫। হে ভগবন! সাধকগণ জ্ঞানরশ্মির মূলকারণ-স্বরূপ আপনার প্রার্থনা জানেন; তার বহুসংখ্যক উৎকৃষ্ট স্তোত্র জানেন; সেই প্রার্থনায়-অভিজ্ঞ সাধকগণ জ্ঞানরশ্মি প্রার্থনা করেন; সেইজন্য সৎকর্মসাধন-সামর্থ্যের সাথে জ্যোতির্ময় জ্ঞানরশ্মিসমূহ সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, প্রার্থনাপরায়ণ সাধকেরা পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [হে

জ্যোতির্ময়! দিশাহারা পথভ্রান্ত আমাকে তোমার আলোকবর্তিকা প্রদান করো, যেন তার সাহায্যে আমি তোমার চরণে পৌঁছাতে পারি। ওগো জ্যোতিঃস্বরূপ! তোমার একটুখানি জ্যোতিঃ দাও, সর্বধ্বংসী এই (অজ্ঞানতার) অন্ধকার দূরীভূত হোক। –তমসো মা জ্যোতির্ময়। আলোকের জন্য মানুষের হৃদয়ের এই চিরন্তন প্রার্থনাই তাকে মুক্তি পথে নিয়ে যায়।

৬। জ্ঞানিগণ ভগবানকে প্রাপ্ত হন; এবং সৎকর্ম-সাধকগণ ভগবানকে প্রাপ্ত হন; সত্ত্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তিগণ পরমপুরুষকে প্রীত করেন অর্থাৎ তার কৃপা লাভ করেন; পবিত্র অমৃতপ্রবাহ, বিশুদ্ধ, জ্যোতির্ময়, প্রসিদ্ধ মোক্ষপ্রাপক জ্ঞানাগ্নিকে প্রাপ্ত হয়। (এই মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, বিভিন্ন মার্গ অনুসারী সাধকেরা ভগবানকেই প্রাপ্ত হন; অমৃতের প্রবাহ জ্ঞানাগ্নির সাথে মিলিত হয়)। [যিনি যে পন্থারই অনুসরণ করেন না কেন, হৃদয়ের ঐকান্তিকতা থাকলে তিনি ভগবৎ-চরণে পৌঁছাতে সমর্থ হন।

 ৭। হে ভগবন! কল্যাণদায়িনী আত্মশক্তি আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন, জ্ঞানরশ্মির সাথে মিলিত হোন; অজ্ঞানতারূপা রাত্রিও আপনার কৃপায় সকল জগৎবাসী প্রাণীদের শান্তিদায়িনী এবং কল্যাণপ্রদা হোক। (প্রার্থনার অন্তর্নিহিত ভাব এই যে, আমরা যেন আত্মশক্তি লাভ করতে পারি; ভগবান্ আমাদের অজ্ঞানতা বিনাশ করে আমাদের শান্তি প্রদান করুন)। [এই প্রার্থনার বিশেষত্ব– এ অজ্ঞানতারূপা রাত্রিও….শান্তিদায়িনী এবং কল্যাণপ্রদা হোক। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে–  এ কেমন প্রার্থনা? অজ্ঞানতা কল্যাণপ্রদ হয় কেমন করে? কিন্তু একটু প্রণিধান করে দেখলেই প্রার্থনার অন্তর্নিহিত ভাব স্পষ্ট হবে। যাঁর কৃপায় বোবাও কথা বলে, পঙ্গুও পর্বত লঙ্ঘন করে, তার দয়ায় ৫ কি না সম্ভব হয়? সেই পরম মঙ্গলময় ভগবান্ মানুষের প্রতি অসীম করুণায় ঘনান্ধকার অমানিশাকেও পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত মধুযামিনীতে পরিণত করতে পারেন। আর তিনি তা-ই করছেন। ঘোর অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানুষ কোথা থেকে জ্ঞানের জ্যোতিঃ পায়? দুর্বল মানুষ কোথা থেকে শক্তিলাভ করে রিপুর আক্রমণ প্রতিহত করে?–সে শক্তি ভগবানেরই দেওয়া–ভগবৎশক্তি। এই শক্তি (আত্মশক্তি) লাভ করলে সাধকের জীবনে সবই পাওয়া হয়ে যায়–সব অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়]।

৮। হে ভগবন! বিশ্বব্যাপক জ্যোতির্ময় অভীষ্টবর্ষক আপনার প্রার্থনীয় শক্তি ক্ষিপ্রলাভ করবার জন্য আমরা প্রাথনা করছি। (ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের আপনার মোক্ষপ্রাপিকা শক্তি প্রদান করুন)। জ্ঞানদায়ক দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের প্রার্থনা প্রকৃষ্টরূপে সৎকর্মে মিলিতা হোক; সত্ত্বভাব যেমন সাধকদের হৃদয়কে পবিত্র করে, তেমনই নবশক্তিপ্রদায়ক বিশ্বের নেতৃস্থানীয় জ্ঞানদেবতাকে প্রাপ্তির জন্য কল্যাণদায়িনী পবিত্রা নির্মলাত্মিকা সৎ-বৃত্তি আমাদের হৃদয়কে পবিত্র করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -সৎবৃত্তির প্রভাবে আমরা যেন জ্ঞানলাভ করতে পারি)।

৯। মোক্ষপ্রাপক জ্ঞানদেব এবং দুলোক-ভূলোকস্থিত সকল দেবতা আমার মননীয় অর্থাৎ সঙ্কল্পিত পূজা গ্রহণ করুন; হে দেবগণ! আপনাদের অপ্রিয় বাক্য আমরা যেন না বলি; আপনাদের আশ্রিত হয়ে আমরা যেন আপনাদের প্রদত্ত সুখই উপভোগ করে পরমানন্দ লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎদত্ত পরমানন্দ লাভ করি)। [বিশ্বের সকল দেবতার চরণে আমি প্রণিপাত করি। –প্রশ্ন হতে পারে, তবে কি জগতে বহু দেবতা বর্তমান?-হ্যাঁ, প্রকৃতপক্ষে দ্যুলোকে ভূলোকে, অন্তরীক্ষে এক পরমেশ্বর ব্যতীত দ্বিতীয় সত্তা নেই, –এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু এ-ও সত্য যে, বিভিন্ন দেবতা (তথা অনুমেয় সত্তা) তারই বিভিন্ন শক্তির বিকাশ মাত্র–একং সদ্বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি–আবার প্রশ্ন, এই সমস্তই যদি তাঁর প্রকাশ, এই বহুর পশ্চাতে যদি সেই এক-ই থাকেন, তবে এক সঙ্গে এই বহুর আহ্বান কেন?–এর কারণস্বরূপ বলা যায়–বহুর সবের মধ্যে তিনি আছেন, তবে এই বহু-র পূজাও কি তার পূজা নয়? তিনি অনিলে আছেন, তবে অনিলের পূজাও কি তার পূজা নয়? তিনি অনলে আছেন, তবে অনলের পূজাও কি তার পূজা নয়? এই নিখিল বিশ্বে তার প্রকাশ দেখে ভক্তিভরে তার চরণে প্রণতঃ হওয়া অবশ্যই উচ্চতর সাধনার পরিচায়ক। হৃদয়ে ভগবৎ-ভক্তি, পরাজ্ঞান দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ বিশ্বে ব্রহ্ম দর্শন করতে সমর্থ হয়। এদিক দিয়ে বলা যায়, –দেবতা বহু। শুধু তেত্রিশ কোটী নয়, অনন্ত কোটী কোটী দেবতা আছেন। তাদের সকলের উদ্দেশ্যেই ভক্তের পুস্পাঞ্জলি অর্পিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অঞ্জলির সব পুষ্পই সেই এক-এর চরণে গিয়ে পৌঁছাবে]। [এই সামমন্ত্রের ঋষির নাম–ভরদ্বাজ]।

১০। দ্যুলোক-ভূলোকস্থিত দেবগণ আমাকে সৎকর্মসাধনশক্তি প্রদান করুন; বলাধিপতিদেব এবং মহৎ দেবভাবসমূহের রক্ষক দেবতা আমাকে সৎকর্মসাধনশক্তি প্রদান করুন; ঐশ্বর্যাধিপতি দেবতার শক্তি আমাকে প্রাপ্ত হোক; সৎকর্মসাধনশক্তি যেন আমাকে ত্যাগ না করে; সৎকর্মপরায়ণ সৎ এ জনমণ্ডলের সাধনশক্তি যেন ক্ষয় না হয়; প্রার্থনাকারী আমি যেন জ্ঞানী হতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাকে সৎকর্ম সাধনের শক্তি এবং পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [ভগবানের প্রত্যেক বিভূতির কাছেই ব্যাকুলভাবে সাধনশক্তি লাভের জন্য এ প্রার্থনা করা হয়েছে। তার যে শক্তির কথা মনে হয়েছে, তার কাছেই প্রার্থনা রয়েছে।

১১। বজ্রধর (ভগবা) যে সকল মুখ্যকর্ম (সৃষ্টিরক্ষার জন্য) সম্পাদন করেন, তাঁর (ভগবান্ ইন্দ্রদেবের) সেই সকল অলৌকিক কার্যের বিষয় আমরা নিত্যই কীর্তন (প্রত্যক্ষ) করে থাকি। মেঘ বিদারণ করে তিনি ভূতলে জলধারা সেচন করেন (রিপুশত্রুকে নিহত করে তিনি হৃদয়ে সত্ত্ববাবলি বিস্তার করেন); গিরিকরে তিনি প্রবহনশীলা নদী প্রবাহিত করেন (পর্বতের ন্যায় কাঠিন্য-সম্পন্ন হৃদয়ে তিনি স্নেহকারুণ্য ইত্যাদির নিঝর-ধারা উন্মুক্ত করে দেন)। (ভগবানের মহিমা আমাদের নিত্যপ্রত্যক্ষীভূত হয়। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! শত্রু নাশ করে আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব নিত্য প্রবাহিত করুন)। [মন্ত্রে একদিকে, বাহ্য-প্রকৃতি-পক্ষে মেঘ-বিদারণ-পূর্বক বারিবর্ষণরূপ কল্যাণ সাধন, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক-পক্ষে শত্রু-বিমর্দন-পূর্বক হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সংরক্ষণ, প্রকাশ পাচ্ছে। সকল কালে সকল অবস্থাতেই এভাব প্রকাশ পেতে পারে। মন্ত্রের অপরাংশেও এমন, একপক্ষে, পাষাণ-বিদারণ-পূর্বক নিঝরিণীর উৎপত্তিরূপ স্নিগ্ধতা-বিস্তারের ভাব, এবং অন্য পক্ষে রিপুসঙ্কুল পাষাণ-সদৃশ হৃদয়ে স্নেহকারুণ্য ইত্যাদির সঞ্চারভাব প্রকাশ পেয়েছে। দেখাযায়, সকল কালে সকল অবস্থাতেই এই ভাব পরিগৃহীত হতে পারে। প্রার্থনা-পক্ষে এই মন্ত্রের মর্মার্থ এই যে, হে ভগবন! আপনার শক্তি ও করুণার পরিচয় নিয়তই প্রাপ্ত হচ্ছি। আমার এই রিপুসঙ্কুল পাষাণ-হৃদয় বিগলিত করে আপনি প্রেমের পীযুষ-ধারা প্রবাহিত করে দিন]।

১২। যেহেতু আমি ভগবান্ হতে উৎপন্ন, সেইহেতু আমিও সর্বজ্ঞ জ্ঞানদেব হই; আমার জ্ঞানদৃষ্টি সর্ববিশ্বদর্শনক্ষম; অমৃত আমার বদনে বর্তমান; আমিই ত্রিগুণাত্মিকা প্রাণশক্তি এবং জ্যোতিঃপ্রদাতা; আমি নিত্য তেজস্বরূপ, ভগবৎপূজোপকরণও আমি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –ভগবান্ থেকে উৎপন্ন হেতু মানুষ আমিও ব্রহ্ম শক্তির অধিকারী হই)। অথবা, –যেহেতু আমি ভগবান্ হতে এসেছি সেইহেতু আমি যেন সর্বতত্ত্বজ্ঞ জ্ঞানময় হতে পারি; আমার জ্ঞানদৃষ্টি প্রদীপ্ত হোক; এবং আমার বাক্য অমৃতময় হোক; আমার ত্রিগুণাত্মিকা প্রাণশক্তি জ্যোতির উপভোক্তা হোক; আমি যেন পরম জ্যোতির্ময় এবং সর্ব রকমে ভগবৎপূজাপরায়ণ হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন পরাজ্ঞান প্রাপ্ত হই; আমি যেন ভগবৎপূজাপরায়ণ হই)। [অতি উচ্চভাবপূর্ণ এই মন্ত্রের ভিন্ন অন্বয় অবলম্বনে দুটি মন্ত্ৰার্থ উদ্ধৃত হলো। প্রথমটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক, দ্বিতীয়টি প্রার্থনামূলক। .ভাষ্যকারও এই মন্ত্রের দুটি অর্থ করেছেন–তবে তা আমাদের অনুসরণীয় হয়নি। তিনি একটি অগ্নিপক্ষে, অন্যটি ব্রহ্মপক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ এক জায়গায় এই মন্ত্রটি যেন স্বয়ং অগ্নি উগ্নীত করছেন, অপরটায় স্বয়ং ব্রহ্ম যেন এর উদ্গাতা। অন্য একজন ব্যাখ্যাকার এই মন্ত্রের অনুবাদ করেছেন–আমি অগ্নি, জন্ম থেকেই জাতবেদা, ঘৃত আমাদের চক্ষু, অমৃত আমার মুখে আছে, (আমার) প্রাণ ত্রিবিধ, (আমি) অন্তরীক্ষের পরিমাণকারী, (আমি) অক্ষয় উত্তাপ, (আমি) হব্যস্বরূপ। বোঝা যায়, এই ব্যাখ্যাকার সায়ণাচার্য্যের দুটি ব্যাখ্যার মধ্যপথ অবলম্বন করেছেন, যদিও তার মতে অগ্নিপক্ষে (অর্থাৎ আমি অগ্নি) ব্যাখ্যাই সুসঙ্গত। তার মতে, ঋকে পরব্রহ্মের কোন উল্লেখ নেই, অগ্নির উল্লেখ আছে, অগ্নিই ঋকের বক্তা। তিনি বলেন, –ঋগ্বেদের এই মন্ত্রটির ঋষি ব্রহ্ম। তবে ব্ৰহ্মপক্ষে অর্থটি পরে আরোপিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্য পণ্ডিতের অন্ধ অনুসরণকারী এই এ ব্যাখ্যাকার মহাশয়ের ধারণা–প্রাচীন ভারতে নাকি ব্রহ্মজ্ঞান পরিস্ফুট হয়নি। –আরও বলা বাহুল্য– কোন কোন বেদব্যাখ্যাকার এইভাবেই বেদকে সাধারণের কাছে অনেক নীচু করে ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় সাধনা ও সাধকের দিক থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণই সঙ্গত। মন্ত্রটি সাধকের উক্তি। এখানে উদ্ধৃত দুটি ব্যাখ্যার একটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক, অন্যটি প্রার্থনামূলক। দুটি ব্যাখ্যারই কেন্দ্রশক্তি জন্মনা পদে পাওয়া যায়। যেহেতু আমরা ভগবান্ থেকে এসেছি, সেই হেতু আমরা তার শক্তি লাভের অধিকারী এই ভাবটিই মন্ত্রের মূলসূত্র]।

১৩। জ্ঞানদেবতা সমগ্র জগতের মুখ্য আশ্রয়স্থল অর্থাৎ সত্ত্বভাব রক্ষা করেন; পরমদেবতা জ্ঞানালোকের কিরণ জগতে প্রদান করেন; জ্ঞানের অধিপতি দেব সমগ্র বিশ্বকে পরাজ্ঞান দান করে ধ্বংস হতে রক্ষা করেন; জ্ঞানদাতা দেব দেবতাদের আনন্দদায়ক পরাজ্ঞান জগতে প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান্ জগতে পরাজ্ঞান এবং সত্ত্বভাব প্রদান করেন, বিশ্বকে রক্ষা ও পালন করেন)। [ভগবানই জগতের রক্ষার উপায়। তিনি নিজের শক্তিবলে জগৎকে ধারণ করে আছেন ও পালন করছে। জ্ঞানস্বরূপ (অগ্নিঅর্থে জ্ঞানদেবতা) ভগবান্ জগৎকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে রক্ষা করবার জন্য জগতে জ্ঞান বিতরণ করছেন। জ্ঞানই জীবন, অজ্ঞানতাই মৃত্যু। সেই মৃত্যু ধ্বংস থেকে ভগবান্ জগৎকে রক্ষা করেন–তার জ্ঞানশক্তির প্রদানে। তিনিই আনন্দবিধাতা, মানুষের পরম মঙ্গলদাতা]। [এই সামমন্ত্রের গেয়গানের নাম আগেরগুলির মতোই অনুল্লেখিত]।

.

চতুর্থী দশতি

ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। আরণ্যক পর্ব। ষষ্ঠ অধ্যায়।

মন্ত্রগুলির দেবতা১।২ অগ্নি, ৩-৭ পুরুষ, ৮ দ্যাবাপৃথিবী, ৯-১১ ইন্দ্র, ১২ গোগণ (রশ্মিগণ)।
ছন্দ-অনুষ্ঠুভ, ১-২ পঙক্তি, ৮।১১।১২ ত্রিষ্টুভ।
ঋষি মন্ত্রার্থের মধ্যেই
উল্লেখিত৷৷

ভ্ৰাজ্যগ্নে সমিধান দীদিবো জিহ্বা চরত্যন্তরাসনি। স ত্বং নো অগ্নে পয়সা বসুবিদ রয়িং বর্চো দৃশেহদাঃ ১। বসন্ত ইনু রন্ত্যো গ্রীষ্ম ইনুরন্ত্যঃ। বর্ষাণ্যনুশরদো হেমন্তঃ শিশির ইনু রন্ত্যঃ ২ সহস্ৰশীর্ষাঃ পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ। স ভূমিং সর্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ দশাঙ্গুল৷৷ ৩৷৷ ত্রিপাদূর্ধ্ব উদৈৎ পুরুষঃ পাদাহস্যেহাভবৎ পুনঃ। তথা বিম্বব্যক্ৰামদশনানশনে অভি৷৷ ৪৷৷ পুরুষ এবেদং সর্বং যদ ভূতং যচ্চ ভাব্য। পাদোহস্য সর্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি। ৫৷৷ এ তাবানস্য মহিমা ততো জ্যায়াংশ্চ পুরুষঃ। উমৃতত্বসেশানো যদন্নেনাতিবোহতি৷৷ ৬৷৷ ততো বিরাডজায়ত বিরাজো অধি পুরুষঃ। স জাতে অত্যরিচ্যত পশ্চাদ ভূমিমথো পুরঃ ৷৷ ৭৷৷ মন্যে বাং দ্যাবাপৃথিবী সুভোজসৌ যে অপ্রথেমমিতমভি যোজন। দ্যাবাপৃথিবী ভবতং স্যোনে তে নো মুঞ্চতমংহসঃ॥ ৮৷৷ হরী তে ইন্দ্র শ্মশ্রুতো তে হরিতৌ হরী। তং ত্বা স্তবন্তি কবয়ঃ পুরুষাসসা বনৰ্গবঃ৷ ৯৷৷ যৰ্চো হিরণ্যস্য যদ বা বর্চো গবামুত। সত্যস্য ব্ৰহ্মণো বৰ্চস্তেন মা সংসৃজামসি৷৷ ১০। সহস্তন্ন ইন্দ্র দদ্ধযোজ ঈশে হ্যস্য মহতো বিপশি। ক্রতুং ন নৃমণং স্থবিরং চ বাজং বৃত্ৰেষু শত্রুৎসহনা কৃধী নঃ৷৷ ১১। সহঃ সহবৎসা উদেত বিশ্বা রূপাণি বিভ্ৰতীর্দীঃ । উরুঃ পৃথুরয়ং বো অস্তু লোক ইমা আপঃ সুপ্রপাণা ইহ স্ত৷৷ ১২৷৷

মন্ত্রার্থ– ১। প্রজ্বলিত জ্যোতির্ময় হে জ্ঞানাগ্নি! তমোনাশক আপনার জ্ঞান আমাদের মুখে প্রকাশিত হোক অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক; পরমধনপ্রাপক হে জ্ঞানাগ্নি! সেই আপনি আমাদের অমৃতের সাথে পরমধন এবং জ্ঞানদৃষ্টি লাভের জন্য দিব্যজ্যোতিঃ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাবু এই যে, –হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান এবং পরমধন প্রদান করুন)। [এই সামমন্ত্রের ঋষির নাম–বামদেব। এর এবং এর পরের গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।

২। হে ভগবন! বসন্ত ঋতুই পরমানন্দদায়ক হোক; গ্রীষ্ম ঋতুও পরমানন্দদায়ক হোক; বর্ষা ঋতু অনুক্রমে শরৎ হেমন্ত শীত প্রভৃতি প্রত্যেক ঋতুই আমাদের পরমানন্দদায়ক হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –নিত্যকাল আমরা যেন পরমানন্দ লাভ করি)। [মানুষ নিজের সুবিধার জন্য কালকে বিভিন্ন নামে বিভক্ত করেছে। সেই বিভাজিত কালের প্রত্যেক অংশের উল্লেখ করে, সেই নির্দিষ্ট অংশে আনন্দ লাভের প্রার্থনা করার অর্থ–সেই অবিভাজিত সমগ্র নিত্যকালে পরমানন্দলাভ। প্রত্যেক অংশের উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়াতে প্রার্থনার ঐকান্তিকতাই প্রকাশিত হয়। তাছাড়া, এই প্রার্থনার মধ্যে, বিভিন্ন ঋতুর নামোল্লেখ করাতে আরও একটি ভাব প্রকাশিত হয়। মানুষের জীবন একভাবে চলে না। জীবনে বিপদ, রিপুর আক্রমণ, উন্নতি, পতন প্রভৃতি নানারকম অবস্থা উপস্থিত হয়, এবং আমাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়। জীবনের বসন্তকালে ভগবানের একটুখানি ও সাড়া হয়তো হৃদয়ে জেগে ওঠে, আবার দারুণ শিশিরে তা সঙ্কোচিত হয়ে যায়। ভগবানের করুণাবারি এ বর্ষণে জীবনক্ষেত্রে একটু সরলতা কোমলতা আসে, আবার ভীষণ গ্রীষ্মের অনলতাপে তা শুষ্ক হয়ে যায়–হৃদয় মরুভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু মানুষ চায়–অসীম অখণ্ড আনন্দ। তাই নিত্যকাল (অবিচ্ছিন্নভাবে) সেই পরমানন্দ উপভোগের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। [এই সাম মন্ত্রের ঋষির নাম ও গেয়গানের নাম উল্লেখিত নেই]।

৩। ভগবান অনন্তশক্তিশালী অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন, সর্বব্যাপক হন; সেই পুরুষ ব্রহ্মাণ্ডকে সর্বভাবে সকলদিকে পরিবেষ্টন করে ব্রহ্মাণ্ড হতে অধিকস্থান অতিক্রম করে বর্তমান আছেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সমগ্র বিশ্ব ভগবানের একাংশে অবস্থিত; তিনি সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ)। [মন্ত্রটি ঋগ্বেদের প্রসিদ্ধ পুরুষ-সূক্তের ১মা ঋক্‌। এই মন্ত্রের মধ্যে যে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে, তার ছায়ার অনুকরণ করে জগতের সকল দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মবিজ্ঞান রচিত হয়েছে। ভগবান্ সহস্ৰশীর্ষ। এটা অবশ্য-রূপক। ভগবানের সত্যসত্যই এক হাজার মস্তক নেই। ওটা তার অনন্তশক্তির পরিচায়ক মাত্র। তিনি সহস্রচক্ষু। সর্বত্রব্যাপী তার দৃষ্টি। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান, আদি অন্ত মধ্য, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়, সমস্তই তিনি দিব্যনেত্রে প্রতিমুহূর্তে অবলোকন করছেন। জগৎ তার জ্ঞানের মধ্যে অবস্থিত। –তিনি সহস্রপাৎ। তিনি সর্বব্যাপক এবং সর্বত্র তার গতি। শুধু সর্বব্যাপক নন, এই ব্রহ্মাণ্ড তার মধ্যেই অবস্থিত এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও তিনি বৃহত্তর, মহত্তর। তিনি ব্রহ্মাণ্ড থেকে দশাঙ্গুলি বেশী ভূমি ব্যেপে আছেন, –এ কথার অর্থ এই যে, তিনি শুধু ব্রহ্মাণ্ড মাত্রই নন, তিনি তারও চেয়ে বৃহৎ ও বহু উচ্চে অবস্থিত। এই মন্ত্র যে দার্শনিক মতবাদের জন্ম দিয়েছে পাশ্চাত্য দার্শনিকেরা তা স্বীকার করেছেন; অর্থাৎ ভগবান জগতে বর্তমান আছেন এবং তিনি জগতের অতীতও বটেন। এই মতবাদের পোষণকারী দার্শনিকেরা যুক্তিবাদী বলে অভিহিত, এবং বর্তমান জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক পণ্ডিতেরা এই মতবাদের অনুসরণ করে থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমান সময় পর্যন্ত জগতে যে সব দার্শনিক ও ধর্মসম্বন্ধীয় মতবাদ প্রচারিত হয়েছে, তার কোনটিই ভারতীয় সভ্যতাকে অতিক্রম করে তোত যেতে পারে-ইনি, অধিকন্তু সেইসব সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতা থেকেই উৎপন্ন]। [ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের ঋষি-নারায়ণ (নামধারী মানব)। সামমন্ত্রের গায়ক-ঋষির নাম এবং গেয়গানের নাম উল্লেখিত্ নেই]।

৪। ভগবান্ ত্রিগুণাতীত হয়ে বর্তমান আছেন, আবার তার অংশ ত্রিগুণাত্মক জগতে বর্তমান আছে; এবং তিনি চেতন অচেতন সকল সৃষ্ট বস্তু অধিকার করে সর্ববিশ্ব ব্যেপে অবস্থিত আছেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানের সত্তা বিশ্বে অনুষ্যত আছে; আবার, ভগবান্ বিশ্বকে অতিক্রম করে করেও বর্তমান আছেন)। [সত্ত্বরজ-তমঃ এই ত্রিগুণের সমবায়ে জগৎ সৃষ্ট হয়েছে। যখন ত্রিগুণ সাম্যাবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন প্রলয় হয়। সমস্ত বিশ্ব ভগবানে লীন হয়–তিনি তখন নিজেতে নিজে বর্তমান থাকেন, তখন তিনি বিশুদ্ধ সত্তা মাত্র হন। তাই এই মন্ত্রে তার ক্রিয়াশীল এবং নিষ্ক্রিয় অবস্থা বৃর্ণিত হয়েছে। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে–তিনি চেতন-অচেতন সমস্ত বস্তুতে বর্তমান আছেন। এখানে চেতন অচেতন বলায় বিশ্বের সমস্ত বস্তুকে লক্ষ্য করা হয়েছে মাত্র। বস্তুতঃ অচেতন বলে কোন বস্তু নেই–কারণ সমগ্র বিশ্বে সেই অনন্ত চৈতন্যসত্তা বিদ্যমান আছেন। গাছে, পাথরে, ধূলিকণাতেও চৈতন্য বর্তমান–সেই চৈতন্য অবিনাশী অক্ষয়]। [ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের ঋষি নারায়ণ। সামমন্ত্রের গায়ক-ঋষির নাম ও গেয়গানের নাম অনুল্লেখিত]।

৫। ভগবানই উৎপন্ন জগৎ এবং অনুৎপন্ন অর্থাৎ কারণাবস্থায় লীন সমগ্র বিশ্ব; সমস্ত উৎপন্ন বস্তু ভগবানের ত্রিগুণাত্মক অংশ, এবং তার অমৃতস্বরূপ ত্রিগুণাতীত অংশ স্বরূপে অবস্থিত আছে।  (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, এই বিশ্ব ভগবানের আংশিক প্রকাশ মাত্র)। [এই প্রকাশমান জগৎ তারই প্রকাশ, তা ছাড়া ভবিষ্যৎ জগৎও তাতে কারণাবস্থা বর্তমান আছে। তিনি জগতের মূলকারণ। সৃষ্টির পূর্বে জগৎ তাতেই ছিল, এবং প্রলয়ের পরেও তাতেই থাকবে। সেই আদি কারণ (ভগবা) থেকে জগৎ কার্যরূপে প্রকাশিত হয়। এই সত্যের উপর নির্ভর করেই ভারতে কার্যকারণভেদ এই দার্শনিক মতবাদ প্রচারিত হয়েছে। পাশ্চাত্য জাতেও এই মতবাদ সাদরে গৃহীত। চৈতন্যবাদী দার্শনিকদের মতে, বিশ্বের মধ্য দিয়ে ভগবানই নিজেকে প্রকাশ করছেন। শুধু তাই নয়। বিশ্ব-অতিরিক্ত তার অমৃতময় সত্তা আছে। তিনি স্বরূপে অবস্থিত থাকেন। ক্রিয়াশীল হলে ত্রিগুণাত্মক মায়াশক্তির প্রভাবে জগৎ সৃষ্টি করেন, আবার, প্রলয়ের কালে আত্মলীন হয়ে অবস্থিতি করেন। দর্শনশাস্ত্রে ব্রহ্মের এই শেষোক্ত অবস্থাকে কুটস্থ লক্ষণ বলা হয়েছে। তিনি জগৎ, তিনি জগৎ-অতীত, তিনি ত্রিগুণাত্মক, তিনি ত্রিগুণের অতীত]। [ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের ঋষি-নারায়ণ]।

৬। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান রূপে অবস্থিত জগৎসৃষ্টিরূপ কার্যসমূহ ভগবানের মহিমা বিশেষ; কিন্তু ভগবান্ এই মহিমা হতেও মহত্তর;অপিচ, যিনি আপন শক্তির দ্বারা বিশ্বকে অতিক্রম করেন সেই ভগবানই অমৃতের অধীশ্বর অর্থাৎ অমৃতপ্ৰদাতা। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, অমৃতপ্রাপক ভগবান্ অসীমশক্তিসম্পন্ন; তার মহিমার একাংশ মাত্র বিশ্বরূপে প্রাদুর্ভূত হয়)। [ভগবান্ অমৃতপ্রাপক–তিনি অমৃতের অধীশ্বর। তাঁর কৃপাতেই মানুষ অমৃতত্ত্ব লাভ করে। সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়– তার মহিমার তুলনায় অতি তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু এটাই তার মহিমার শেষ নয়। তিনি অমৃত-স্বরূপ, তার সন্তানদেরও অমৃতত্ব প্রদান করেন। সৃষ্টি–এই ত্রিগুণাত্মিকা সৃষ্টি, তার খেলা; আবার সেই ত্রিগুণের বেড়াজালের মধ্য থেকে মানুষকে বাহির করে নিয়ে তার অমৃতময় কোলে স্থান দেওয়াও তার খেলা। এইখানেই তার মহত্ত্ব প্রকটিত। মানুষ এই অমৃতের আশাতেই তার পানে তাকিয়ে থাকে। একফোঁটা অমৃতের বর্ষণে মানুষের অনন্ত পিপাসা চিরতরে নিবৃত্ত হয়ে যায়। তাঁর এই মুক্তিদায়ক মূর্তিই এই মন্ত্রে বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েদ্বে]। [ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের ঋষি-নারায়ণ]।

৭। সেই আদিপুরুষ হতে ব্রহ্মাণ্ডদেহ উৎপন্ন হয়, সেই ব্রহ্মাণ্ডদেহে আত্মা উৎপন্ন হন, অর্থাৎ পরমাত্মা বিশ্বাত্মারূপে ব্রহ্মাণ্ডদেহে প্রবেশ করেন; সেই বিরাট পুরুষ দেবতা, পক্ষী, মনুষ্য প্রভৃতিরূপ হন; তারপর পৃথিবী সৃজন করেন, তারপর জীবগণের আশ্রয়স্থান দেহ সৃজন করেন। (এই মন্ত্রে সৃষ্টির ক্রম বর্ণিত হয়েছে। ভাব এই যে, ভগবান্ থেকেই সমস্ত জগৎ উৎপন্ন হয়েছে)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় সৃষ্টিক্রম বোঝাতে অতীত কাল ব্যবহৃত হলেও এখানে বর্তমান কাল ব্যবহার করা হয়েছে। তার কারণ, ভগবানের কাছে সমস্ত কালই নিত্যবর্তমান। অনন্তের দিক দিয়ে একমাত্র বর্তমান ছাড়া অন্য কাল নেই। বিশেষতঃ সৃষ্টি ও প্রলয় প্রতি মুহূর্তেই সংঘটিত হচ্ছে। সুতরাং সৃষ্টিক্রমও অনন্তকাল ধরে চলছে। –সেই পরমপুরুষ ভগবান্ নিজের মহিমায় অবস্থিত। তার ইচ্ছায় প্রথমতঃ ব্রহ্মাণ্ড–এই বিশ্ব উৎপন্ন হয়। এই বিশ্বের মধ্যে তাঁর চৈতন্যশক্তি প্রবেশ করে। তার থেকে ক্রমশঃ দ্যুলোক ভূলোক স্থাবর জঙ্গম সমস্ত উৎপন্ন হয়। সুতরাং স্পষ্টই দেখা যায়–এই বিশ্ব তারই বিকাশ মাত্র। এই বিশ্বের প্রতি অনু-পরমাণুতেও তার শক্তি বর্তমান]। [ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের ঋষি-নারায়ণ]।

৮। হে দ্যুলোক-ভূলোক! আপনারা উত্তম পালনকারী তা আমি জানি; আপনারা অক্ষয় পরমধন আমাদের প্রদান করুন; হে দ্যুলোক-ভূলোক! আপনারা আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন; এবং, আমাদের পাপ হতে মোচন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, –হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন এবং পাপ থেকে আমাদের রক্ষা করুন)। [চন্দ্র সূর্য তারা বা প্রত্যেক পদার্থেই ভগবানের শক্তি বিভিন্নভাবে প্রকাশমান। সুতরাং তাঁর এই বিভিন্ন প্রকাশকে যদি মানুষ। বিভিন্নভাবে আরাধনা করে, তাহলে সেই আরাধনা, সেই পূজা ভগবানের চরণেই পৌঁছায়। অবশ্য এই প্রকাশকে তারই প্রকাশ হিসাবে পূজা করতে হবে–শুধু একটা বিচ্ছিন্ন বস্তু ভাবে নয়। উল্লেখ্য এই যে, পাশ্চাত্য মূর্তিপূজা ও ভারতীয় প্রতীক-উপাসনা এক নয়। বিভিন্ন বা প্রতিটি বস্তুতে ভগবানের এই বিকাশের দিক দিয়েই ভূলোক-দুলোকের কাছে অথবা দ্যুলোক-ভূলোকস্থিত দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে)। [এই সামমন্ত্রের ঋষির নাম–বামদেব]।

৯। বলাধিপতি হে দেব! আপনার জ্যোতিঃ পাপনাশক; অথবা আপনার শক্তি মায়ামোহ ইত্যাদির নাশক হয়; অপিচ, আপনার জ্ঞানভক্তিরূপ বাহনদ্বয় পাপনাশক; জ্ঞানজ্যোতিঃসম্পন্ন সাধকগণ প্রসিদ্ধ আপনাকে আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, –ভগবৎশক্তি পাপনাশিকা মোক্ষপ্রাপিকা হন। সাধকবর্গ ভগবৎপরায়ণ হন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রের শ্মশ্রণি পদের দাড়ীগোপ অর্থ করেছেন। কিন্তু সোমপানে দাড়ীগোপ কি সমস্তই হরিৎ-বর্ণ হয়ে যায়? আবার সাধকদের স্তুতির সাথে হরিৎ-বর্ণ দাড়ীরই বা কি সম্বন্ধ, বোঝা যায় না। এখানে ঐ পদের নিরুক্ত-সম্মত অর্থ মুখশ্রী, জ্যোতিঃ গৃহীত হওয়াই সঙ্গত। [এই সামমন্ত্রের ঋষি বামদেব। এর গেয়গানটির নাম অনুল্লেখিত]।

১০। পরম মঙ্গলদায়ক সৎকর্মের যে জ্যোতিঃ এবং জ্ঞানের যে জ্যোতিঃ, অপিচ, সত্যস্বরূপ ভগবানের (অথবা বেদজ্ঞানের) যে জ্যোতিঃ, তাদের সাথে আমাকে যেন আমি সংযোজিত করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন সৎকর্মসাধন-সামর্থ্য এবং পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [ভাষ্যকার হিরণ্য পদের বিভিন্ন স্থলে বিভিন্ন অর্থ করেছেন। বর্তমান মন্ত্রে হিরণ্য পদে স্বর্ণ ইত্যাদি ধনকে লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয়। কিন্তু হিরণ্যপদে, যা মানুষের প্রকৃত হিতকারক ও প্রার্থনীয়, সেই সম্পদকেই লক্ষ্য করাই সঙ্গত। হিরণ্য পদে এই মন্ত্রে সৎকর্মকে লক্ষ্য করা হয়েছে। ঐ অর্থে মন্ত্রের প্রার্থনার সঙ্গতিও রক্ষিত হয়েছে। ব্রহ্মজ্ঞানের সাথে অর্থাগমের কোন সঙ্গতি আছে বলে মনে করা যায় না। গো শব্দের অর্থ জ্ঞান ধরতে পারলে স্বীকার করতেই হয় যে, পশুলাভের সাথে ব্রহ্মজ্ঞানের বা বেদজ্ঞানের কোন সম্পর্ক সংসূচিত হয় না]। [এই সামমন্ত্রের ঋষিবামদেব। এর দশটি গেয়গান আছে; কিন্তু সেগুলিরও নাম উল্লেখিত নেই]।

১১। জয়প্রাপক বলাধিপতি হে দেব! আপনার শত্রনাশিকা শক্তি আমাদের প্রদান করুন; আপনিই মহা শক্তির অধীশ্বর; হে দেব! সৎকর্মের দ্বারা যেমন ধন লাভ হয়, তেমন পরমধন এবং প্রভূত শক্তি আমাদের প্রদান করুন; অপিচ, পাপনাশের জন্য আমাদের রিপুজয়ী করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের রিপুজয়ের শক্তি এবং পরমধন মোক্ষ প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রে বৃত্ৰেষু পদে ভাষ্যকার আবরকে উপায়েষু অর্থ গ্রহণ করেছেন। এবার বৃত্রাসুর প্রভৃতির আখ্যান আনা হয়নি। আমাদের মন্ত্রার্থেও পূর্বাপর বৃত্র বলতে আবরক বোঝানো হয়েছে। যা আমাদের দৃষ্টি আবরণ করে, যা আমাদের পবিত্রতা আবরণ করে, সেই মহা অসুর–অজ্ঞানতা, পাপ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। ভগবান্ সেই পাপ অজ্ঞানতা দূরীভূত করে অমৃতধারায় আমাদের এ হৃদয়ক্ষেত্রে অভিষিক্ত করেন, তাই তার আর এক নাম–বৃত্রঘ্ন]। [এই সামমন্ত্রের ঋষি বামদেব]।  

১২। অভীষ্টবর্ষক সৎকর্মপ্রাপক সকল সৃষ্টবস্তু ধারণকারী হে অমৃতপ্রবাহসমূহ! আপনারা আমাদের প্রাপ্ত হোন; বিস্তীর্ণ মহান্ এই বিশ্ব আপনাদের কৃপাধীন হোক। (ভাব এই যে, সকল লোক অমৃত প্রাপ্ত হোক)। আপনাদের সম্বন্ধীয় অমৃতের প্রবাহ অর্থাৎ আপনারা আমাদের জন্য অনায়াসলভ্য হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন অমৃত প্রাপ্ত হই)। [সহবৎসাসৎকর্মরূপসন্তানসহিতাঃ, সৎকর্মপ্রাপকাঃ। কিন্তু ভাষ্যকার গাভীকে সম্বোধন করে মন্ত্রের ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন–যদিও মূলে গাভীর কোন উল্লেখ নেই। বৎস শব্দ থাকলেই কি গাভীর সম্বন্ধ কল্পনা করতে হবে? যদি গাভীর সম্বন্ধেই মন্ত্রটি প্রযুক্ত হয়, তাহলে বিশ্বা রূপাণি বিভ্ৰতীঃ প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগের কোন সার্থকতা থাকত না]। [এই সামমন্ত্রের ঋষি—বামদেব]।

.

পঞ্চমী দশতি

ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। আরণ্যক পর্ব। ষষ্ঠ অধ্যায়।

মন্ত্রগুলির দেবতা–১ পবমান সোম ও অগ্নি, ২।১৪ সূর্য (৪-৬ সূর্য ও আত্মা)
 ছন্দ—১।৪।১৪ গায়ত্রী, ২ জগতী, ৩ ত্রিষ্টুভ।
ঋষি-১ শত বৈখানস, ২ বিভ্রাট সৌর্য, ৩ কুৎস আঙ্গিরস, ৪।৬ সর্পরাজ্ঞী, ৭।১৪ প্ৰস্কণ্ব কাণ্ব৷

অগ্ন আয়ুংসি পবস আসুবোর্জভিষং চ নঃ। আরে বাধস্ব দুছুনাম্৷৷ ১৷৷ বিভ্রা বৃহৎপিবতু সোম্যং মধ্বায়ুদ্ধদ্যজ্ঞপতাববিহ্রত। বাতজুতো যো অভিরতি অনা প্রজাঃ পিপর্তি বহুধা বি রাজতি৷৷ ২. চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরুণস্যাগ্নেঃ। আপ্রা দ্যাবাপৃথিবী অন্তরীক্ষং সূর্য আত্মা জগতস্তগুষশ্চ৷৷ ৩৷৷ আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমীদসদন্মাতরং পুরঃ। পিতরং চ প্রযৎঃ৷ ৪ অস্তশ্চরতি রোচনাস্য প্রাণাদপানতী। ব্যখ্যন্মহিষো দিব৷৷ ৫৷ ত্রিংশদ্ধাম বি রাজতি বা পতঙ্গায় ধীয়তে। প্রতি বস্তোরহ দ্যুভিঃ ৷৷ ৬৷৷ অপ ত্যে তায়বো যথা নক্ষত্রা যন্ত্যভিঃ । সূরায় বিশ্বচক্ষসে৷৷ ৭ ৷৷ অদৃশস্য কেতবো বি রশ্ময়ো জনা অনু। ভ্রাজন্তো অগ্নয়ো যথা৷ ৮৷৷ তরণির্বিশ্বদর্শতে জ্যোতিষ্কৃদসি সূর্য। বিশ্বমাভাসি রোচন৷৯৷৷ প্রত্যঙ দেবানাং বিশঃ প্রত্যঙঙুদেষি মানুষ। প্রত্যঙ বিশ্বং স্বধৃশে৷ ১০৷ যেনা পাবক চক্ষ ভুরণ্যন্তং জনাঁ অনু। ত্বং বরুণ পশ্যসি৷৷ ১১। উদ দ্যামেষি রজঃ পৃথ্বহা মিমানো অভিঃ। পশ্যঞ্জন্মানি সূর্য৷৷ ১২৷৷ অযুক্ত সপ্ত শুন্ধবঃ সূরো রথস্য নপূঃ। তাভির্মাতি স্বযুক্তিভিঃ৷৷ ১৩৷৷ সপ্ত ত্বা হরিততা রথে বহন্তি দেব সূর্য। শোচিঙ্কেশং বিচক্ষণ৷ ১৪।  

মন্ত্ৰাৰ্থ ১। হে জ্ঞানদেব (অগ্নি)! সৎকর্মসাধনশক্তি আমাদের প্রদান করুন; এবং শক্তিপ্রদায়ক সিদ্ধি প্রদান করুন। রিপুবর্গকে আমাদের নিকট হতে দূরে প্রেরণ করুন এবং তাদের বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুজয়ী এবং সৎকর্মসমর্থ করুন)। [মন্ত্রে সাধনশক্তি লাভ ও রিপুজয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথমে শক্তি লাভ ও পরে সিদ্ধি। শক্তিলাভের জন্য সাধনা ও প্রার্থনা প্রয়োজন। মুক্তিলাভের জন্য (সিদ্ধিলাভের জন্য) শক্তির বিকাশ করতে হবে। সেই শক্তিও সেই ভগবানই মানুষকে প্রদান করেন। মানুষের আয়ু অথবা জীবনীশক্তির পরিমাণ সময়ের উপরে নির্ভর করে না। হাজার বছর বেঁচেও যে আহার নিদ্রা মৈথুন প্রভৃতি প্রাকৃতিক কাজেই জীবন কাটিয়ে দেয়, তার জীবনমৃত্যু সবই সমান। তাই আয়ুংষি পদে সৎকর্মের শক্তি অর্থ গৃহীত হয়েছে। এর এবং এর পরের মন্ত্রগুলির এক বা একাধিক গেয়গান আছে; কিন্তু সেগুলির নাম উল্লেখিত হয়নি]।

২। পরমজ্যোতির্ময় দেব. সৎকর্মের সাধককে নিষ্কণ্টকে সৎকর্ম সাধনের শক্তি প্রদান করেন; তিনি আমাদের হৃদয়স্থিত মহান্ সত্ত্বভাবময় অমৃত গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদন করে তা গ্রহণ করুন)। আশুমুক্তিদায়ক ভগবান্ আত্মশক্তির দ্বারা লোকবর্গকে রক্ষা করেন এবং পালন করেন; অপিচ, তিনি বিশেষভাবে লোকদের জ্ঞানজ্যোতিঃ প্রদান করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –ভগবানই লোকদের রক্ষক এবং পালক হন)। [ভগবানই অপার করুণাবশে আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব প্রদান করেন, আবার তিনিই সেই সত্ত্বভার গ্রহণের জন্য আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন। বস্তুতঃ, তার জিনিষই তিনি গ্রহণ করেন। তিনি এই বিশ্বকে আত্মশক্তিতে রক্ষা করেন–তিনিই পালন করেন। মানুষের হৃদয়ে জ্ঞানের জ্যোতিঃ প্রদান করে তাকে অধঃপতন থেকে রক্ষা করেন।

৩। দেবগণের (দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণসমূহের) বিচিত্র যে তেজঃ, –মিত্রদেবতার, বরুণদেবতার, অগ্নিদেবতার প্রকাশক যে তেজঃ–ঊর্ধ্বে দেবলোকে বিদ্যমান রয়েছে; সেই তেজের দ্বারাই পরমাত্মরূপ সূর্যদেব স্বর্গমর্ত্যকে, গগনমণ্ডলকে স্থাবসমূহে জঙ্গমসমূহে অথবা গতিশীল সমগ্র জগৎকে সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। (ভাব এই যে, –দেবসমূহে, সূর্যে (পরমাত্মারূপ ঐশ্বরিক বিভূতিতে), বরুণে (ঈশ্বরের অভীষ্টবর্ষণশীল বিভূতিতে) ও অগ্নিতে (জ্ঞানদেবরূপী ঈশ্বরের বিভূতিতে), -খণ্ড খণ্ড ভাবে যে তেজঃ পরিলক্ষিত হয় সে তেজঃ পরমাত্মারই; সেই তেজঃ, খণ্ডভাব পরিত্যাগ করে পুঞ্জীভূত হলেই পরমাত্মা)। [বহুত্বের মধ্য দিয়েই একত্বকে লক্ষ্য করেই এই মন্ত্র প্রবর্তিত। এই মন্ত্র ব্রাহ্মণদের সন্ধ্যাবন্দনার মধ্যে সূর্যোপস্থানের জন্য স্থান পেয়েছে। কিন্তু সে কোন্ সূর্য? আকাশের সূর্য হলে কেবলমাত্র প্রাতঃকালে ব্যবহৃত হলেই তো হতো। ত্রিসন্ধ্যায় এটা পাঠের আবশ্যকতা কেন? আসলে, এই মন্ত্র আকাশের ঐ সূর্যকে লক্ষ্য করে প্রবর্তিত হয়নি। এটি পরমাত্মাকে লক্ষ্য করেই নির্দিষ্ট হয়েছে। সকল খণ্ড খণ্ড তেজের আধার সেই জ্যোতিঃস্বরূপ অখণ্ড অনির্বচনীয় তেজের–পুনঃ পুনঃ স্মরণ করতে, পুনঃ পুনঃ মনন করতে, পুনঃ পুনঃ নিদিধ্যাসন (ধ্যান) করতে এই মন্ত্রটি সন্ধ্যাবন্দনার মধ্যে ত্রিসন্ধ্যায় পঠিত হয়ে থাকে। যদি এইভাবে মহাভাবটি ফুটে ওঠে–এটাই বৈদিক মন্ত্রের লক্ষ্য। দেখা যায়, মন্ত্রের মধ্যে সূর্যঃ আত্মা পদ দুটির মাধ্যমে যে সূর্যকে লক্ষ্য করা হয়েছে, সে সূর্য আকাশের সূর্য নয়-তা পরমাত্মাই]।

৪। জ্যোতির্ময় পরাজ্ঞান জগতে ব্যাপ্ত হয়ে সাধককে আপন মাতৃস্থানীয় ভগবৎশক্তিকে (অথবা, ভক্তিতে) প্রাপ্ত করায়, এবং পিতৃস্থানীয় ভগবানকে (অথবা, সৎকর্মকে) প্রকৃষ্টরূপে প্রাপ্ত করায়। মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –সাধক জ্ঞানকর্মভক্তি লাভ করেন)। [গৌঃ পদে জ্ঞান জ্ঞানকিরণ প্রভৃতি অর্থের পরিবর্তে ভাষ্যকার সহসা গমনশীলঃ অর্থ গ্রহণ করে মন্ত্রটির ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, (যদিও ঐ পদে অন্যত্র গাভী অর্থ গ্রহণ করে একইরকম জটিলতা ঘটিয়েছেন)। মাতরং পিতরং-এর ব্যাখ্যায় বলা যায়–ভগবান, ও ভগবৎশক্তিই জীবের পিতামাতা। অথবা ভক্তিই মাতৃস্নেহে মানুষকে ভগবানের চরণে পৌঁছিয়ে দেন, এবং সৎকর্মের প্রভাবে মানুষ পাপ মোহ প্রভৃতি রিপুগণের হাত থেকে রক্ষা পায়। হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হলে মানুষ ভগবানের চরণ প্রাপ্ত হয়]।

৫। ভগবানের জ্যোতির্ময়ী শক্তি সৃষ্টিকালে বিশ্বের মধ্যে বিসর্পিত হয়, ব্যাপ্ত হয়; মহান দেব বিশ্বকে প্রকাশিত করেন অর্থাৎ রক্ষা করেন; প্রকাশের পরে অর্থাৎ প্রলয়কালে আপন দেহে বিশ্বকে সম্বরিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের মূলকারণ)। [এই মন্ত্রের সায়ণ-ভাষ্যে সূর্যের উদয়াস্তের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। এখানে কিন্তু আমরা ঋগ্বেদীয় নারদীয় সূক্তের উক্তিটি স্মরণ করছি– তিনিই আদিতে ছিলেন, এবং অনন্তকাল ধরে বিরাজ করছেন। তার থেকেই বিশ্ব উৎপন্ন হয়েছে। সুতরাং প্রলয়কালে বিশ্ব তাতেই অন্তর্হিত হবে। একই ভগবান্ ব্রহ্মারূপে সৃজন করছেন, বিষ্ণু রূপে পালন করছেন এবং মহেশ্বর রূপে প্রলয় সাধন করছেন। প্রলয়ের পর সবই সেই একমেবাদ্বিতীয়ম–এ লীন হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় তিনিই ঐ ত্রিমূর্তিতে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করছেন। এইভাবেই অনাদিকাল থেকে চলছে]।

৬। পরাজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভূত হোক; তারপর আমাদের হৃদয় হতে উথিত স্তুতি জ্ঞানসমন্বিত হয়ে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য উচ্চারিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি, ভগবৎপরায়ণ হই)।

৭। সূর্যের উদয়ে রাত্রি অপগত হলে নক্ষত্রসকল যেমন অদৃশ্য হয়, সর্বদ্রষ্টা জ্ঞানসূর্যের উদয়ে এ অজ্ঞানতার মধ্যগত অসৎবৃত্তি প্রভৃতি রূপ প্রসিদ্ধ দস্যুগণ (রিপুশত্রুগণ) তেমনই অপসৃত হয়ে থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়ে যায়)। [রাত্রির সাথে নক্ষত্রের অপগমনের উপমা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এক পক্ষে, ত্যে তায়বঃ বলতে কাদের বুঝিয়ে থাকে? সেই প্রসিদ্ধ দস্যু কারা? পূর্বাপর সঙ্গতি রেখে বলা যায়–অন্তরের সৎ-ভাব অপহরক অজ্ঞানতা বা অসৎ-বৃত্তি প্রভৃতিরূপ দস্যুগণ। আবার আর এক দিক দিয়েও উপমাটির বক্তব্য লক্ষ্য করা যায়। অন্ধকার রাত্রিতে নক্ষত্র দীপ্তি পায়। সূর্যের উদয়ে তাদের আর দেখা যায় না। তেমনই হৃদয় যতক্ষণ অজ্ঞানতারূপ অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে ততক্ষণ অসৎবৃত্তি প্রভৃতি-রূপ দস্যুগণ (রিপুশত্রুগণ) প্রবল হয়েই ওঠে। নৈশ অন্ধকারে তারাগুলি যেমন ঝিকিমিকি করে, অজ্ঞান অবস্থায় বিশেষ বিশেষ রিপুরও চাকচিক্য অনুভূত হয়, উপযোগিতার বিষয়ে ভ্রান্তি আসে। কিন্তু ভগবান্ যখন মানুষের হৃদয়ে জ্ঞানের উন্মেষ করেন অর্থাৎ যখন মানুষের জ্ঞানোদয় হয় (যখনই জ্ঞান-সূর্য হৃদয়ে আলোক বিতরণ করে দেয়) তখনই সব দস্যু অন্তর্হিত হয়–পলায়ন করে। এই উপমার মধ্যে আর একটি ভাবও আসে। সূর্যের উদয়ে নক্ষত্র আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে আর তখন আপন দীপ্তি প্রকাশ করতে পারে না। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও অদৃশ্য হয়ে পড়ে বটে, কিন্তু একেবারে লয়প্রাপ্ত হয় না; নিস্তেজ হয়ে থাকে। মনোবৃত্তি সম্বন্ধেও সেই কথা বলা যায়। বৃত্তির একেবারে ধ্বংস হয় না–একেবারে তারা মরে না। অবসর পেলে আবার তারা সতেজে জেগে উঠতে পারে, যেমন পুনরায় রাত্রির আগমনে নক্ষত্রগুলি ফুটে ওঠে। মন্ত্রের উপদেশ এই যে, –সাবধান! অজ্ঞানতারূপ রাত্রি যেন আর না আসে। একেবারে তাকে দূর করে দাও। হৃদয়ে জ্ঞান-সূর্যকে চিরপ্রতিষ্ঠিত করো। পদস্খলন যেন আর না হয়]।

৮। দীপ্যমান অগ্নিশিখাসমূহ যেমন পদার্থসকলকে প্রকাশ করে, তেমন সেই জ্ঞানের আধার পরমাত্মার প্রজ্ঞাপক রশ্মিসমূহ সকল লোককে অনুক্রমে প্রকাশ করে (অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে উত্তরণ করে)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, –প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা যেমন অন্ধকার নাশ করে, পরমাত্মার বিভূতিসমূহ তেমনই মানুষদের অজ্ঞানতা দূর করে থাকে)। অথবা, দীপ্তিশীল অগ্নির ন্যায় এই পরমাত্মার প্রজ্ঞাপক বিভূতিসকল অজ্ঞানপ্রযুক্ত সংসারে বদ্ধ জীবগণের হৃদয়ে বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে; অথবা উৎপত্তিশীল মহৎ-ইত্যাদি তত্ত্বসমূহকে ক্রমে প্রকাশ করে থাকে। অথবা, অগ্নি যেমন উৎপন্ন হয়ে আশ্রয়স্থিত তৃণকাষ্ঠ ইত্যাদি বিনষ্ট করে নিজে প্রকাশ পায় ও অপরাপর বস্তুগুলিকে প্রকাশ করে, তেমনই ভগবৎ-বিভূতি অথবা তত্ত্বজ্ঞান জীবের হৃদয়ে উৎপন্ন হয়ে সেখানকার কামক্রোধ ইত্যাদি রিপুগুলিকে সমূলে ধ্বংস করে স্বয়ং প্রকাশ পায় এবং পরমাত্মাকে প্রকাশ করে দেয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। এর ভাব এই যে, তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হলে সকল জীবের অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়ে পরমৈশ্বর্যশালী পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকারের দ্বারা মুক্তি হয়ে থাকে)। [পূর্ব সম্বন্ধ অনুসারে অস্য পদে জ্ঞানাধার পরমাত্মাকে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর প্রকাশক রশ্মিসমূহ বা বিভূতিসমূহ বলতে, অবশ্যই দেবভাব-নিবহকে (সত্ত্বভাব ইত্যাদিকে) বোঝায়। দেবভাবের বা সত্ত্বভাবের উদয়ে অজ্ঞানতা দূর হয়, জ্ঞানময়ের সন্ধান পাওয়া যায়। একপক্ষে উপমায় এখানে সেই তত্ত্বই পরিব্যক্ত। মন্ত্র ভগবানের মহিমা-প্রকাশক নিত্যসত্য তত্ত্ব প্রকাশ করছেন। পক্ষান্তরে আবার অন্যরকম অর্থের বিষয় বিচার করা যেতে পারে। প্রদীপ্ত অগ্নি যেমন আশ্রয়স্থিত তৃণদারু প্রভৃতিকে দগ্ধ করে স্বয়ং প্রকাশ পায় এবং অন্য বস্তুকে প্রকাশ করে, তেমনই মন্ত্রস্থিত কেতবঃ রসময়ঃ পদ প্রতিপাদ্য ভগবৎ-বিভূতি বা তত্ত্বজ্ঞানরূপ উপমেয় জীব-হৃদয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে মুক্তিপথের প্রধান বিঘ্নস্বরূপ কাম ইত্যাদি রিপুসমূহকে বিনষ্ট করে স্বয়ং প্রকাশ পায় ও পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার ঘটিয়ে দেয়। এর দ্বারা উপমানের ধর্ম যে উপমেয়ে বিদ্যমান আছে, তা স্পষ্টই প্রতীত হচ্ছে। অতএব জ্ঞানী ও তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে এবং ভক্ত ভক্তিরসের প্রতিদান-স্বরূপ ভগবানের অনুগ্রহে ভগবানের বিভূতি লাভ করে দুর্জয়–কাম ইত্যাদি শত্রুদের জয় করে অত্যজ্য সংসার-বাসনা ও স্ত্রীপুত্র প্রভৃতির মায়াকে পরিত্যাগ করে ভগবানের সামীপ্যলাভে পরমানন্দ উপভোগ করে থাকেন। দ্বিতীয় মন্ত্রার্থে (অর্থাৎ অথবা কল্পে) যে অর্থ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রথমটিই একটু পরিবর্তন করে প্রকাশিত। প্রথম পক্ষে, অগ্নি ও জ্ঞান স্বয়ং প্রকাশ হয়ে থাকে, –এই অর্থ করা হয়েছে। আবার, অন্য প্রকাশকত্ব ধর্মও তাতে আছে বলে, পরিশেষে পরমাত্মার প্রকাশক বলে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অর্থ ভগবানের বিভূতিরই বিশেষক বলে বোধ হলেও তার দ্বারা ভগবানই বিশেষিত হয়েছেন। পরবর্তী সামের দ্বারা এই দ্বিতীয় অর্থই স্পষ্টীভূত হয়। অতএব সারার্থ এটাই প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, ভগবানের কৃপায় তত্ত্বজ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা ভগবৎ-বিভূতি লাভ করে, জীব অনায়াসে ভবসাগর থেকে উত্তীর্ণ হতে পারবে। এর দ্বারা দেখা যায়, যদিও এখানে বিভিন্নভাবে অর্থ করা হয়েছে, কিন্তু সব দিকেই এখানে উদ্ধৃত মন্ত্রার্থের প্রতিপাদ্য বিষয়কেই যে বোঝাচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই]।

৯। হে সূর্য (সর্বান্তর্যামিত্ব হেতু সকলের প্রেরণকর্তা হে পরমাত্মা)! তুমি এই ভবসাগরে একমাত্র উদ্ধারকর্তা, মুক্তিলিঙ্গু জীবগণের দর্শনযোগ্য, জ্যোতিষ্কগণের সৃষ্টিকর্তা; তুমিই দৃশ্যমান সকল পদার্থকে প্রকাশ করছ। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, –হে পরমাত্মন! তুমিই এই জগতের স্রষ্টা, প্রকাশক ও উদ্ধারকর্তা)। [মন্ত্রটির সব পদই আত্মজ্ঞানের অনুকূল। কিন্তু রুচিবৈচিত্র্যে ভিন্নভাবে পরিণত। ভাষ্যকার অনুকূল পদ প্রয়োগ করেছেন; কিন্তু লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারেননি। তিনি লিখেছেন–হে সূর্য! তুমি খুব বেগশালী; যে পথে অপরে যেতে পারে না, তুমি সেখানে যেতে পারো। সূর্যের বেগগামিত্ব যে সম্ভব নয়, এখানে তা তিনি লক্ষ্য করতে পারেননি। ভৌগোলিক দৃষ্টান্তে সূর্য জড় ও স্থির, পৃথিবী গতিশীলা। উপনিষদ্‌চিন্তায় সকল বস্তুই এক চেতনের স্পন্দনে স্পন্দিত। সে পক্ষে তরণিঃ পদের লক্ষ্য–আত্মা বা চেতন। কারণ, বেগগামিত্ব আত্মারই সম্ভব; তাছাড়া অপরের এটি অসম্ভব। উপনিষদেই বলা হয়েছে–তার হাত নেই, কিন্তু সকল কর্মই যথানিয়মে সম্পন্ন করছেন; তার পা নেই, কিন্তু প্রবলবেগে অনন্ত বিশ্বে পরিভ্রমণ করছেন; তার চক্ষু নেই তাহলেও তিনি বিশ্বদ্রষ্টা; তার কর্ণ নেই, তবু কিন্তু তিনি সর্বশ্রোতা। সূর্য বলতে এখানে সেই আত্মাকেই বোঝাচ্ছে। আত্মা চেতন বা অন্তর্যামী এবং তরণিঃ অর্থে বেগগামী, এটা স্বীকার করলেই ভাষ্যকারের ভাবের মধ্যেও সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাবে। কিন্তু ভাষ্যকার তা লক্ষ্য করেননি এবং আত্মজ্যোতিঃ ভিন্ন যে জ্যোতিঃ নেই, তা চিন্তা করেননি। -ন তত্র সূর্যো ভাতি…….–সেখানে সূর্য নেই, চন্দ্র নেই, তারকা নেই, বিদ্যুৎ নেই, অগ্নি নেই, কেবল তার দীপ্তি। তাঁর দীপ্তিতেই সকল দীপ্ত। আর তাঁর বিভায় নিখিল জগৎ বিভাত। –এ কি আকাশের সূর্য হতে পারে? এ মন্ত্র সেই ভূমারই লক্ষ্যস্থল। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক এই তিনরকম পীড়াকেই; যেহেতু, মানুষ প্রতিনিয়ত এই ত্রিবিধ এই তিনরকম পীড়াকেই; যেহেতু, মানুষ প্রতিনিয়ত এই ত্রিবিধ সন্তাপে সন্তপ্ত। একদিকে জন্মজরামৃত্যুর ভীষণ আক্রমণ; অপরদিকে সর্পভীতি, ব্যাঘ্রের দারুণ শঙ্কা; আবার অন্যত্র ঝড়ঝঞ্ঝা ও বজ্রপাতের তীব্র শিহরণ। অতএব, তাপত্রয়ক্লিষ্ট ও সংসারযন্ত্রণায় প্রতিমুহূর্তে সহ্যমান মানব-হৃদয়ে আত্মবিকাশের অভিব্যক্তি দ্বারা চিরতরে এ নির্বেদলাভের জন্যই এ মন্ত্র আত্মাকে লক্ষ্য করে ধ্বনিত হচ্ছে। ঋকের সম্বোধ্য, সর্বান্তর্যামি ও সর্বপ্রেরক পরমাত্মন! মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে–হে ভগবন! তুমি ভবব্যাধিরূপ দুস্তর সংসার সাগরের নিস্তারক! তুমি পর জ্যোতিঃ! তুমি সর্বপ্রতিষ্ঠাতা! তোমা হতেই দৃশ্যমান প্রপঞ্চ পূর্ণদীপ্ত। তোমা হতেই এ বিশ্ব প্রকাশিত। তুমি হৃদয়-গগনে প্রকাশিত হও। জড়জগতের অন্ধকার যেমন সূর্যদীপ্তির ভয়ে কোন এক অতলস্পর্শী পর্বতগহ্বরে লুকিয়ে পড়ে, হে জ্যোতির্মূর্তে, তোমার পবিত্র প্রভায় আমার হৃদয়ে অজ্ঞান-অন্ধকার চিরদিনের জন্য দূরীভূত হোক। পথের অনুসরণ করতে সামর্থ্য পাই। আলোকময়! –আলোক বিতরণ করো]।

১০। হে পরমাত্মন! যদিও আপনি বিশ্বব্যাপক; তথাপি সত্ত্বভাবসম্পন্নের প্রতি গমন করেই আপনি নিজের রূপ প্রকাশ করেন, মনুষ্যত্বসম্পন্ন জনের প্রতি গমন করেই আপনি প্রকাশমান হন, এবং বিশ্বব্যাপ্ত স্বর্গলোকের (সত্ত্বভাবনিলয়ের) প্রতি গমন করে সকলের প্রত্যক্ষভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হন। (এই, মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, –যদিও ভগবান্ সমগ্র বিশ্ব ব্যেপে বিরাজমান, তথাপি সত্ত্ব-ভাব সান্নিধ্যেই তিনি প্ৰকটীভূত হয়ে থাকেন)। [এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বব্যাপ্ত স্বর্গলোক বলতে কি বোঝায়? সেই উপলক্ষ্যেই স্বঃ পদের প্রতিবাক্য সত্ত্বভাবনিলয়ঃ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই কি স্বর্গ নয়, যা সত্ত্বভাবের নিবাসস্থান? যেখানেই সত্ত্বভাব আছে, যেখানেই সত্যের জ্যোতিঃ স্ফুরিত হচ্ছে, যেখানেই সৎ ভিন্ন অসতের অস্তিত্ব নেই, সেই কি স্বর্গ নয়? সেই স্বর্গই বিশ্বব্যাপ্ত; সে স্বর্গ কখনও সীমাবদ্ধ হতে পারে না। তোমার আমার সকলের হৃদয়ই স্বর্গ হতে পারে, যদি তা অসতের সংশ্রব পরিশূন্য হয়। সর্বত্র সকলের সামনেই তিনি আছেন বটে, কিন্তু সর্বত্র সকলে তো তাকে দেখতে পায় না। এই মন্ত্র তাই অঙ্গুলি-নির্দেশে তাকে, তার স্বরূপে আত্মপ্রকটের স্থানকে দেখিয়ে দিচ্ছে]।

১১। হে পবিত্রকারক! প্রাণিগণের ধারণ-পোষণকারী এই সংসারকে যে রকম প্রকাশ-শক্তির প্রভাবে যথাক্রমে প্রকাশ করে আছেন, করুণাবারিবর্ষক হে পরমাত্মন, আপনার সেই প্রকাশ-শক্তিকে আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনার দিব্যজ্যোতিঃ এই প্রার্থনাকারী আমাদের হৃদয়ে উদ্ভাসিত হোক)। [যাঁর সম্বোধনে মন্ত্রটি প্রযুক্ত, এই সামে তাঁকে পাবক ও বরুণ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তাতে ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাকারগণ বিষম সমস্যায় পড়েছেন। যদি ঐ দৃশ্যমান সূর্যকে লক্ষ্য করে মন্ত্র প্রবর্তিত হয়ে থাকে, তাহলে তিনি পাবকও বরুণ হবেন কিভাবে? ফলে তারা পাবক পদের অর্থ সর্বস্য শোধকৃও বরুণ পদের অর্থ অনিষ্টানিবারক করে কোনরকমে ক্ষান্ত হয়েছেন। কিন্তু বলা বাহুল্য, এরকম কল্পিত অর্থেও মন্ত্রের ভাব পরিস্ফুট হয়নি। দৃশ্যমান সূর্য সম্পর্কে ঐ দুটি সম্বোধনই যথাপ্রযুক্ত বলে মনে করা যায় না। বরং ব্রহ্ম-সম্বন্ধে, পরমাত্মা-সম্বন্ধে, ঐ দুই সম্বোধন প্রযোজ্য বলে মনে করলে ভাবসঙ্গতি অব্যাহত থাকে। তাঁকে সবরকম সম্বোধনেই সম্বোধন করা যায়। তিনি পাবক, তিনি বরুণ, তিনি সূর্য, তিনি অগ্নি, তিনি বায়ু, তিনি আকাশ, তিনি বিশ্বমূর্তি, তিনি বিশ্বরূপ। তিনি–পাবক–পাপনাশক–পবিত্রকারক। তিনি বরুণ-করুণাবারিবর্ষক। মন্ত্রের শেষভাগে প্রার্থনার একটু নিগূঢ় তাৎপর্য আছে। এখানে ভগবানের সাকার ও নিরাকার দুই ভাবের প্রতি লক্ষ্য আছে। কিন্তু স্থূলশরীরী স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন আমরা, সহসা তার সেই অপ্রকাশ অদৃশ্য নিরাকার অব্যক্ত অবস্থার ধারণা করতে পারি না। সাকারের মধ্য দিয়েই তাঁর নিরাকার ভাবের দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হয়। এখানে তাই যেন বলা হচ্ছে–হে ভগবন! আপনার প্রকাশ-শক্তি ভক্তরূপ আমাদের দেখাও। সেই রূপের ধারণা করতে করতে আমরা যেন তোমার দিব্যজ্যাতিঃতে হৃদয় উদ্ভাসিত করে দিতে পারি; প্রাণ ভরে তোমায় দেখে নিতে পারি]।

১২। হে সর্বান্তর্যামিন! তুমি এই বিস্তৃত রজোগুণাত্মক মর্ত্যভূমিকে, অন্তরীক্ষলোককে, এবং রাত্রির ৫ সাথে দিবাকে নিয়মিত করে এবং সকল প্রাণীকে লক্ষ্য করে দ্রষ্ট্ররূপে অবস্থিত রয়েছ। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! তুমিই সর্বজগতের দ্রষ্টা ও নিয়ন্তা)। [সাধারণতঃ ত্রিগুণ ও ত্রিলোক। সত্ত্বগুণে স্বৰ্গ, রজোগুণে মর্ত, তমোগুণে পাতাল। যেখানে নিয়ত সুখ-শান্তি বিরাজিত তাই সত্ত্বভূমি বা স্বর্গলোক। যেখানে রাগদ্বেষ, অভাব ও লালসা, সেখানেই রজঃ বা মর্ত্যলোক। আর যেখানে বিষয়-স্পৃহা নেই, কার্য বা অকার্য নেই, কেবল জড়তা, তা-ই পাতাল বা অর্ধেলোক বা নিম্ন অধম বা জড় অবস্থা। অতএব এই মন্ত্রের রজঃ পদে রজোগুণাত্মক মর্ত্যলোক ও দ্যাং পদে স্বর্গলোক –এমন স্বতন্ত্রভাবে দুটি অর্থ পরিগৃহীত হওয়াই উচিত]।

১৩। জ্ঞানপ্রদাতা পরমাত্মা, আমাদের কর্মরূপ যানের অথবা হৃদয়ের সৎ-ভাবরক্ষয়িত্রী বহু বিশুদ্ধা ইচ্ছাশক্তিকে অথবা কর্মশক্তিকে হৃদয়ে সংযুক্ত রেখেছেন; সেই সকল কর্মশক্তির অথবা ইচ্ছাশক্তির দ্বারা আত্মজ্ঞান উন্মেষণের সাথে মানুষ ভগবানকে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। (ভাব এই যে, ভগবানের অনুকম্পায় আমরা যে বিশুদ্ধ কর্মশক্তিকে বা ইচ্ছাশক্তিকে লাভ করি, সেই শক্তিই আমাদের ভগবানকে প্রাপ্ত করিয়ে দেয়)। [এখানে সপ্ত পদটি লক্ষ্যণীয়। যদিও ঐ পদে এই মন্ত্রে বহুীঃ (বহু) প্রতিবাক্য প্রযুক্ত হয়েছে এবং তাতে কোনও আপত্তির কথা উঠতে পারে না, তথাপি ঐ পদে পূর্বের মন্ত্রে (৪র্থ অধ্যায়/১২শী দশতি/৭ম সাম) কথিত সেই দেহ ইত্যাদি সপ্ত উপাদানের প্রতিও লক্ষ্য আছে বলে মনে করা যেতে পারে। ভাব এই যে, দেহ ইত্যাদি সেই যে সাতটি শুন্ধুবঃঅর্থাৎ পরীক্ষায় বিশুদ্ধীকৃত সেই যে সাতটি মনুষ্যত্বের উপাদান–সেই সাতটিকে ভগবানই প্রদান করেন। ভগবানের অনুকম্পার প্রভাবেই আমাদের পঞ্চভূতাত্মক দেহ বিশুদ্ধ হয়, ভগবানের অনুকম্পাতেই আমাদের পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় বিশুদ্ধতা লাভ করে; ভগবানের অনুকম্পাতেই আমাদের মন বুদ্ধি অহঙ্কার ও চিত্ত বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তার অনুকম্পা ভিন্ন শুদ্ধ অবস্থা প্রাপ্তির কোনই সম্ভাবনা নেই। অতএব অযুক্ত থেকে নঃ পর্যন্ত অংশের ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের দেহ ইত্যাদিকে যে বিশুদ্ধ অবস্থায় প্রদান করেন, তার দ্বারা আমাদের কর্ম ও হৃদয় অব্যাহত থাকে–পতনের পথ থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। মন্ত্রের শেষ পাদের ভির্যাতি স্বযুক্তিভিঃ অংশের ভাব এই যে, ভগবানের

অনুকম্পাপ্রাপ্ত সেই ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তিই আমাদের ভগবানের সান্নিধ্যে নিয়ে যায়]।

১৪। জ্ঞানময় (সর্বপ্রকাশ) দ্যোতমান্ (স্বপ্রকাশ) হে পরমাত্মন্! তেজঃস্বরূপ (দীপ্তিমান) আপনাকে, জগৎসম্বন্ধকারক দেহ ইত্যাদি সপ্ত-উপাদান হৃদয়ে (কর্মমধ্যে) বহন করে আনে। (ভাব এই যে, সূর্যরশ্মিসমূহ যেমন সপ্তকিরণের দ্বারা জগৎকে সূর্য সম্বন্ধ প্রদান করে, সত্ত্বভাবসমূহ তেমনই দেহ-ইন্দ্রিয় প্রভৃতির দ্বারা হৃদয়ে ভগবানকে প্রতিষ্ঠিত করে)। [মন্ত্রের যা প্রচলিত ব্যাখ্যা আছে, তার ভাব এই যে, সাতটি ঘোড়ার রথে সূর্যকে বহন করে। এইরকম অর্থে বেদমন্ত্রের যে কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তার মর্ম কিছুই অনুধাবন হয় না। সপ্ত হরিতঃ পদ দুটির অর্থ নিষ্কাষণ করতে হলে পূর্বাপর সামের সূর্য পদটির লক্ষ্যস্থল জানতে হয়। এই সূর্য আকাশের সূর্য হলে তার আবার ছয় ঘোড়ার রথ কি? রূপকের অর্থ ধরলেও সূর্য অর্থে আকাশের সূর্যই বা বলা হবে কেন? এবং পরমাত্মাই বা বোঝা যাবে না কেন? বরং সূর্য অর্থে পরমাত্মা বুঝলে পূর্বাপর মন্ত্রার্থের সামঞ্জস্য থাকে। বুঝতে পারা যায়, রূপকালঙ্কারে এক সুষ্ঠু উপমার দ্বারা, এখানে পরমার্থতত্ত্ব বিবৃত হয়েছে]।

— ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত —

<

Durgadas Lahiri ।। দুর্গাদাস লাহিড়ী