[ স্থান জঙ্গীপুরের ডাকবাংলা | কাল রাত দশটা | পাত্র মন্টু গুপ্ত ]

মন্টু
‘আজি কী মুরতি হেরিনু তোমার----”
মশার জ্বালায় হই জেরবার |
হাত চুলকায় পা চুলকায়
চুপ ক’রে বসা হলো দেখি দায় |
তাই বলে কত পায়চারি করি
বাইরে আঁধার পা বাড়াতে ডরি |
ঘন জঙ্গল ঘেরা চারি ধার
অদ্ ভুত তার পাতার বাহার
কিন্তু যাদের লোকে ‘লতা’ বলে
তাদের বিহার বারান্দাতলে |
মশার কামড় বিরক্তিকর
তা বলে কি খাব ‘লতা’-র কামড় !
জঙ্গীপুরের ডাকবাংলায়
সঙ্গীবিহীন প্রাণ যদি যায়
তবেই হয়েছে ! তার চেয়ে ভালো
হ্যাজাগ্ বাতিটা আরো জোরে জ্বালো |
বেয়ারা ! বেয়ারা !---- কোথায় বেয়ারা !
চাপরাশিটারও দেখিনে চেহারা |
খাইয়ে আমাকে ওরা গেছে খেতে
কেউ কোথা নেই এ রাতে-বিরেতে |
ঘুম আসে নাকো রাত দশটায়
মশারি খাটিয়ে গরম বেজায় |
ফাইল ! ফাইল ! চারি দিকে স্তূপ
দেখলেই চোখ ব্যথা করে খুব |
তার চেয়ে ভালো গুন গুন করা
যত রাজ্যের কবিতা ও ছড়া |
“হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ----”

[  অতিথির প্রবেশ ]

কে ?  কে ?
কে আসছে ওই পা টিপে পা টিপে ?
টর্চের বাতি জ্বলে আর নিবে |
.                  কে ? কে ?

শৈলেশ
আমি শৈলেশ | চিনতে পারলে ?
পারলে না ? কবে কলেজ ছাড়লে
মনে পড়ে? প্রায় একুশ বছর
পাইনিকো ভাই তোমার খবর |

মন্টু
শৈলেশ ? ওহো ! শৈলেশ পাল
তুমি এইখানে !আহা ! কত কাল
পরে দেখা হলো তোমার সঙ্গে !
আরে বোসো বোসো | হঠাৎ বঙ্গে
এরূপ স্থানে যে আশাই করিনি |
তাই তো ভাবছি চিনি কি না চিনি |

শৈলেশ
বেহারেই থাকি | তবে মাঝে মাঝে
এদিকেও আসি জমিদারি কাজে |
শুনলুম তুমি এসেছ বেড়াতে
ভাবলুম যাই দেখা করি সাথে |
সময়ও বুঝি হয়েছে বেয়াড়া
বদলেও গেছে আমার চেহারা |
তবু যে চিনেছ এই যথেষ্ট,
না যদি চিনতে সেও অদেষ্ট |
তুমি বড়লোক-----

মন্টু
আমি বড়লোক ! আর হাসিয়ো না |
ওসব ঠাট্টা ঢের আছে শোনা |

শৈলেশ
কেন ভাই ! কেন ! কত বড় পদ !
পদের সঙ্গে নেই সম্পদ ?

মন্টু
পদমর্যাদা রাখতে রাখতে
কোথা চলে যায় রূপোর চাকতি !
মাসের অন্তে সব বাড়ন্ত
তবু লোকে বলে ভাগ্যবন্ত !

শৈলেশ
তুমি ওকথা বলো যদি ভাই
আমরা সকলে কোতা তবে যাই !
জমিদারি উঠে যাবার দাখিল
ম্যানেজারি গেলে আঁধার নিখিল !
লক্ষ্মী ছাড়ে তো ষষ্ঠী ছাড়ে না
বয়স বাড়ে তো শক্তি বাড়ে না |
থাক গে ওসব বলতে আসিনি
রসনাটা নয় মধুরভাষিণী |
অনেক দিন তো যাোনি ওদিকে
বন্ধুরা সাড়া পায় নাকো লিখে |
এসে একবার ছুটিতে ছাটাতে
বেহারে দু’দিন সময় কাটাতে |

মন্টু
ইচ্ছে তো আছে | ছুটি মিলবে কি ?
বন্ধুরা আছে কে কোথায় দেখি |
কে কী হয়েছে ?  কে কী করছে ?
সুখে সাফল্যে জীবন ভরছে ?
কোথায় প্রভাত ? মুকুন্দ সেন ?
নওলকিশোর ?  নাজিম হুসেন ?
কামতা বঙ্কু কোথা এরা সব ?
খোঁড়া হেমন্ত ?  পাগলা কেশব?

শৈলেশ
এই তো স্মরণ রেখেছ, মন্টু |
বাদ পড়ে কেন বুড়ো ও ঝন্টু ?
বেঁচে আছে ওরা সব ক’জনেই
রণজিৎ লালা সেই শুধু নেই |

মন্টু
পড়েছি, পড়েছি শোকসংবাদ
চিকিত্সকের বিষম প্রমাদ |
সেই শুধু নেই | সেই শুধু নেই !
কোথায় গেল সে জিজ্ঞাসা এই |

শৈলেশ
থাক গে ওসব বৃথা জিজ্ঞাসা
বাড়ীখানা লালা হাঁকিয়েছে খাসা |
ব্যাঙ্কে নগদ রেখে গেছে ঢের
ভাবনা কেবল গৃহবিবাদের |
মুকুন্দ, জানো, ডেপুটি হয়েছে
‘সাব’ খসে গেল অনেক বয়েসে |
প্রভাত এখন মস্ত হাকিম
মস্তকে তার কত শত স্কীম |
নাজিম হুসেন পাকিস্তাঁ গিয়ে
ভুল করেছিল, এসেছে পালিয়ে |
খান থেকে নোকরিটা নেই |
লোকে ভালবাসে, মূলধন এই |
নওলকিশোর ভূমিহার নয়
মনের দুঃখ মনে চেপে রয় |
চাকা ঘুরে গেলে উঠবে উপরে
দল নিয়ে আছে, প্র্যাকটিস করে |
খোঁড়া হেমন্ত খোঁড়ায় না আর
সারা বেলা করে মোটর বিহার
মোটরগাড়ীর এজেন্সী নিয়ে
কী ফোলা ফুলেছে মুটিয়ে মুটিয়ে !
ঐ যে তোমার পাগলা কেশব
আশা করি ভুলে যাওনি সে-সব |
সে-সব ব্যাপার ধুয়ে মুছে গেছে
কেশব এখন সিনেমা খুলেছে |
পুরুষ না হয়ে নারী হলে আজ
বেচারির হতো পতিতা সমাজ |

মন্টু
মোটের উপর জীবন আহবে
ভালোই করেছে বন্ধুরা সবে |

শৈলেশ
ভালোই করেছে, তবু সুখী নয় |
ভালো ছিল সেই তরুণ সময় |
অল্পেই সুখী, অল্পেই সুখ
চালচুলো নেই তবু হাসিমুখ |


মন্টু
আমাদের গেছে সে একদিন
তখন ছিলাম কেমন স্বাধীন !
কত যে স্বপন কত কল্পনা
আকাশেতে আঁকা কত আল্ পনা !
সেদিনের চোখে দুনিয়াকে আর
যায় না দেখা | এ দোষটা কার !

শৈলেশ
কী দেখতে চাও ? কী দেখবে বলো ?

মন্টু
সেও ভুলে গেছি কত কাল হলো |
কী যে আজ চাই ! কী পাওয়া বাকী |
বুঝিনে, বুঝতে পারিনে সেটা কী |
আরো ধন নয়, আরো মান নয়,
আরো আয়ু নয়, আরো প্রাণ নয় !
তবে কী ! তবে কী ! কী আমার চাই !
সব আছে, তবু কী আমার নাই !

শৈলেশ
গুরু করেছ কি ? দীক্ষা নিয়েছ ?
দেবতাকে তাঁর প্রাপ্য দিয়েছ ?

মন্টু
ধর্মে আমার হলো নাকো মতি
ভাবিনে কী হবে পরকালে গতি |
ইহকালে যদি না জানি বাঁচতে
পরকালে কেন চাইব নাচতে ?

শৈলেশ
আমি বলি তুমি নাম জপ করো
ক্রতু আর কৃত আজ হতে স্মরো
জীবনের আর ক’টা দিন বাকী !
দিতে যদি চাও শমনকে ফাঁকি
তবে জপ করো ঠাকুরের নাম
তা হলেই যাবে কৈবল্যধাম |

মন্টু
ইহকালে যদি না জানি বাঁচতে
কেন যাব কৈবল্য যাচতে !

শৈলেশ
কী যে বলো আর হয় না অর্থ |
ধর্মই সার | অসার মর্ত্য |

মন্টু
ধর্ম না যদি বাঁচতে শেখায়
তারে নিয়ে আমি করব কী, হায় !
জানি নাকো আমি কত দিন আছি
বাঁচতে শিখব যত দিন বাঁচি |
ধর্ম যদি-না বাঁচতে শেখায়
শিল্পের কাছে যাব পুনরায় |
দিবসরাত্রি সৃষ্টি যে করে
রসমাধুর্য বৃষ্টি যে করে
জীবন কি তার কখনো ফুরায় !
পেয়ালা যে তার বরে পুনরায় |

শৈলেশ
আমি তো দিয়েছি ধর্মেই মন
নয়তো পাগল হতে কতক্ষণ !
চারিদিকে দেখি ভূতের নৃত্য
শত অবিচার নিত্য নিত্য |
চৌর্যের জয়, কে কাকে ধরবে !
ছোট আর বড় অসাধু সর্বে |
প্রতিকার নেই, জ্বলছে মর্ম
তাই তো শরণ করেছি ধর্ম |

মন্টু
ধর্ম না-যদি জানে প্রতিকার
তবে কেন যাও ধর্মের দ্বার ?

শৈলেশ
তবে তাই হোক, আমার ধর্ম
সব ছেড়ে দিয়ে শিল্পকর্ম |
আসবে না ফিরে তরুণ সময়
অন্তর হবে তারুণ্যময় |
প্রথম যৌবনের হলো ইতি
দ্বিতীয় যৌবনের হবে স্থিতি |

শৈলেশ
একদিন হবে তারও অন্ত
শমনের দূত অতি দূরন্ত |
পরলোকে যেতে নেবে কী পাথেয় ?
শিল্প কি যাবে তোমার সাথেও !
ওপারের কথা কখন ভাববে
মন যদি যায় গল্পে কাব্যে !
নাম যশ নিয়ে করবে কী, ভাই !
নাম জপ করো, সাথী হবে তাই |

মন্টু
এপারেই যারা জীবন্মুক্ত
সত্যের সাথে নিত্য যুক্ত
সমান তাদের ইহপরকাল
যেমন সকাল তেমনি বিকাল !
আমার মুক্তি নীরবে নিজনে
অপ্রতিমের প্রতিমা সৃজনে |

শৈলেশ
পাগল ! পাগল ! অসার যুক্তি
নামজপ বিনা কোথায় মুক্তি !
কঠিন বাঁচন কঠিন মরণ
তাই ধরি কষে গুরুর চরণ |
পাপ যদি করি তিনিই ভরসা
নইলে যে পরকালটি ফরসা |

মন্টু
আমি ধ্যান করি পরম রূপের
বীভত্সতাও তাঁরই হেরফের |
তাঁকেই দেখেছি চোখ খোলা রেখে
তাঁকেই এঁকেছি হাতে কালি মেখে |
এ জীবনে তাঁরে দেখা আর আঁকা
এই তো মুক্তি | আর সব ফাঁকা |

শৈলেশ
তার মানে ফাঁকা গুরুর চরণ !
শুনলেও পাপ ! মানলে মরণ !
বিদায়, মন্টু ! চললেম, ভাই |
পাটনায় এসো | ছুটি নেওয়া চাই |

[ অতিথির প্রস্থান ]

মন্টু
অবাক কান্ড ! শৈলেশ পাল
হঠাৎ কেমন করে এত কাল
পরে এলো আর হলো অদৃশ্য !
বিস্ময়কর এ মহাবিশ্ব !
সত্যি কি কেউ এসেছিল রাতে !
হ্যাজাগ্ নিবেছে  তেল নেই তাতে |
বেয়ারা ! বেয়ারা !

Annada Shankar Ray ।। অন্নদাশঙ্কর রায়