এখানে কিছু রহস্য আছে।

অতীন্দ্রিয় রহস্য। মাঝেমাঝে কড়া ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। এমন কড়া যে, গা ঝিমঝিম করে-মাথা ধরে যায়।

জায়গাটা হচ্ছে রিং রোডের মাঝামাঝি শ্যামলী থেকে আদাবরের দিকে যাবার ইট-বিছানো রাস্তা। আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ নেই যে, ফুলের গন্ধ আসবে। তাছাড়া ফুলের গন্ধে গা ঝিমঝিম করে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার। কোনো জটিল রহস্য।

আহসান আজ আবার গন্ধটা পাচ্ছে। গতকাল ছিল না, তার আগের দিনও ছিল না। ব্যাপারটা কী? রাত প্রায় এগারটা। আহসান চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরাল। এরকম নিৰ্জন রাস্তায় এত রাতে সিগারেট ধরিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আশেপাশে খুব ছিনতাই হচ্ছে। দাড়ি-গোঁফ এখনো গজায় নি এমন সব ছেলেপুলেরা পেনসিল-কাটা ছুরি দেখিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে। এরকম সময়ে গন্ধ-রহস্য ভেদ করার জন্যে মাঝরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কোন অর্থ হয় না।

আশ্চর্য, গন্ধটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। এই রহস্যের কোন মানে হয়? এটা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করলে হয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা আদাবরের রাস্তায় পা না-দেয়া পর্যন্ত মনে আসে না। যখন মনে আসে তখন আশেপাশে কেউ থাকে না যার সঙ্গে আলোচনা করা যায়।

আদাবরের দিক থেকে পাঁচ-টনি ট্রাক আসছে। রাস্তায় লোকজন নেই বলেই ট্রাক আসছে টিমে-তেলা গতিতে। লোজন থাকলে ঝড়ের গতিতে চলে আসত। আহসান একপাশে সরে দাঁড়াল। হেড-লাইটের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তাকানো যাচ্ছে না, আবার চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। কড়া আলোর একধরনের সম্মােহনী শক্তি আছে। শুধু পতঙ্গ না—এই আলো মানুষকে আকৃষ্ট করে।

ট্রাকটা আহসানের ঠিক গায়ের ওপর এসে আচমকা ব্ৰেক কষল। ড্রাইভার দরজা খুলে অর্ধেকটা শরীর বের করে তাকে হাত ইশারা করে ডাকছে। ড্রাইভার বা দারোয়ান শ্ৰেণীর কেউ হাত ইশারা করে ডাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তবে এই ড্ৰাইভার আহসানের চেনা। তার বাড়িওয়াল করিম সাহেবের ড্রাইভার। বাড়িওয়ালার বাড়ির একতলায় থাকে। নাম নাজিম, নিজাম কিংবা এই ধরনের কিছু। আহসানের সঙ্গে দেখা হলে লাল চোখে তাকায় এবং পান খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে হাসে। আবার মাঝে-মাঝে না-চেনার ভঙ্গি করে।

প্ৰবেসার সাব, খবর হুনছেন?

না। কি খবর?

করিম সাবের কথা কিছু হুনছেন?

না। যায়-যায় অবস্থা। অক্সিজেন চলছে….

কী হয়েছে?

এক্সিডেন—টেম্পোর লগে ধাক্কা–মাথা গুড়া। খুবই আফসোসের কথা, কি কন প্রবেসার সাব?

আহসান কিছু বলল না। ফুলের গন্ধটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। পেট্রল এবং ধোঁয়ার গন্ধ ছাপিয়ে মিষ্টি একটা গন্ধ। এর মানেটা কী? রহস্যটা কোথায়?

আরিচা থনে টিরিপ আইন্যা খবর হুনলাম। মিজাজ ঠিক নাই আমার বুঝছেন প্রবেসার সাব। দেখবার যাইতাছি।

ড্রাইভার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। গিয়ার বদলাতে-বদলাতে বলল, এর নাম হালার দুনিয়া। আজিব জাগা। প্ৰবেসার সাব, যাই।

এবার ট্রাক ছুটছে ঝড়ের মতো। আহসানের মনে হল একটা ভুল হয়ে গেছে—তার উচিত ছিল ড্রাইভারের সঙ্গে যাওয়া। ব্যাপারটা মনে হয় নি। ফুলের গন্ধ সব এলোমেললা করে দিয়েছে।

করিম সাহেব লোকটিকে সে পছন্দ করে। বেঁটেখাটো মানুষ। মুখভর্তি পান। হাসিখুশি। পাশ দিয়ে গেলে জরদার চমৎকার গন্ধ পাওয়া যায়। ভদ্রলোক এমন ভঙ্গিতে পান খান যে, মনে হয় স্বগীয় কোনো খাদ্য চিবুচ্ছেন। তাঁকে দেখলেই পান খেতে ইচ্ছা করে।

বাড়িওয়ালারা প্রায়ই বেশ নামাজি হয় ইনিও তাই। তাঁর গায়ে সবসময় পরিষ্কার ঝকঝকে একটা পাঞ্জাবি থাকে। মাথায় তার চেয়েও পরিষ্কার একটা টুপি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ নাদুসনুদুস। দেখলেই মনে হয়, খুব শিগগিরই এর হার্ট অ্যাটাক বা মাইল্ড স্ট্রোক জাতীয় কিছু হবে। কিন্তু হয় না। তাঁর তিন জন ভাড়াটে আছে। যাদের সবার সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক। দুজন ভাড়াটে তাঁকে চাচা ডাকে। আহসান তাঁকে কিছুই ডাকে না; তবে তিনি আকার-ইঙ্গিতে প্রায়ই বুঝিয়ে দেন যে, আহসানকে তিনি নিজের ছেলের মতো দেখেন।

ভদ্রলোকের পাঁচ মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। বড় তিনটি মেয়ে স্কুল-কলেজে কোথাও যায় না। সম্ভবত বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করে। ছোট দুটি স্কুলে যায়। আহসানের সঙ্গে দেখা হলে এই দুই স্কুল-যাত্রী মৌলানাদের মতো টেনে-টেনে বলে, আসোলামু আলায়কুম। আহসান তার উত্তরে সবসময় বলে, কী খবর ভালো?

এই প্রশ্নের উত্তর এরা দেয় না। গম্ভীর হয়ে থাকে। হাসেও না। মনে হয় খানিকটা বিরক্ত হয়।

করিম সাহেব মাঝেমধ্যে তাকে খেতে ডাকেন। অন্য ভাড়াটেদের ডাকেন না। সে একা-একা থাকে, এই কারণেই হয়ত; কিংবা কে জানে হয়ত তাঁর কোনো পরিকল্পনা আছে। যাঁর বড়-বড় তিনটি মেয়ে বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে তাঁর পরিকল্পনা থাকা অন্যায় নয়। অবশ্যি তিনি এখন পর্যন্ত ইশারা বা ইঙ্গিতে এ বিষয়ে কিছু বলেন নি। মেয়েদের প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন তার সারমর্ম হচ্ছে—মেয়েগুলো মহা অপদার্থ। সংসারের কিছু জানে না কিছু বোঝে না। দিনরাত ঝগড়া করে আর টাকা জমায়।

আহসান অবাক হয়ে বলেছিল, টাকা জমায় মানে?

জমায় মানে জমায়-সঞ্চয়।

পায় কোথায় টাকা? আপনি দেন?

পাগল, আমি দিব কেন? ওরা চুরি করে। মার কাছ থেকে চুরি করে, মাঝে-মাঝে আমার পকেটে হাত দেয়; মহা হারামী। আগে চড়-থাপ্পড় দিতাম, এখন বড় হয়ে গেছে, চড়-থাপ্পড় দিতে পারি না। যখন মেজাজ ঠিক থাকে না দিই। তখন তাদের মা কান্দে। এরা হইল কান্দন পার্টি। মা কান্দে, মেয়ে কান্দে। একবার কী হইল শুনেন-প্রাইভেট মাস্টার আসছে। বড় মেয়েটাকে পড়াইছে, হঠাৎ কারেন্ট নাই। মাস্টার হারামজাদা সুযোগ বুইঝা গায়ে হাত দিছে। বুঝেন অবস্থা। মেয়ে কোন শব্দ করে না—ফিচ-ফিচ কইরা কান্দে। বুঝেন অবস্থা। মা যেমুন বোকা—আমার মেয়েগুলোও হইছে বোকা। বাজারের সেরা বোকা।

কোনো বাবা নিজের মেয়েদের নিয়ে এ জাতীয় কথা বলতে পারে তা আহসানের ধারণার বাইরে ছিল। এই লোক বলে।

ভদ্রলোকের কথাবার্তার ভঙ্গি থেকে আহসানের মাঝে-মাঝে মনে হয় তাকে নিয়ে ভদ্রলোকের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। থাকলে মেয়েদের সম্পর্কে এ জাতীয় কথাবার্তা বলতেন না। তাছাড়া খেতে যখন ডাকেন তখনও মেয়েরা কেউ আসে না বা উকি-ঝুকি দেয় না। তাঁর বাড়ির পর্দা প্রথাটি বেশ কঠিন। মেয়েগুলো নিউমার্কেটে যায় বোরা পরে।

আহসানের বাসা তিনতলার ডানদিকে। বাঁদিকটা খালি। দরজা-জানালা এখনো লাগানো হয় নি। আহসানের বাসাও পুরোপুরি তৈরি হয় নি। চুনকাম বাকি আছে। দরজায় রঙ লাগানো হয় নি। তিনটি রুমের একটিতে এখনো দরজা-জানালা লাগানো বাকি। সেকারণেই ভাড়া কমতের শ টাকা। গ্যাস-ইলেকট্রিসিটি সবই এর মধ্যে। তবে গ্যাস লাইন এখনো বসে নি বলে এই সুবিধাটি পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে সুযোগ পেলেই করিম সাহেব এই কথা শুনিয়ে দেন

কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন। গ্যাস লাইন বসলে কত আরাম হবে দেখেন। এক পয়সা বাড়ি ভাড়া বাড়াব না। ভদ্রলোকের এক জবান। এত সস্তায় ঢাকা শহরে আর বাড়ি নাই। কী রকম আলো-হাওয়া, দেখতেছেন? ভাদ্র মাসেও ফ্যান ছাড়তে হয় না। দক্ষিণমুখী বাড়ি।

বাড়ি দক্ষিণমুখী খুবই ঠিক কথা। আলোহাওয়াও প্রচুর অস্বীকার করার উপায় নেই; তবে তিনতলায় যেতে হয় বাড়িওয়ালার ঘরের ভেতর দিয়ে। বাইরে সিঁড়ি নেই। ভাড়া দেওয়ার জন্যে যে বাড়ি বানায় সে কখনো এমন অদ্ভুত ব্যবস্থা রাখে? কিন্তু করিম সাহেব রেখেছেন। এবং তাঁর কথায় মনে হয় তিনি এটা রেখেছেন ইচ্ছা করেই।

বাইরে সিঁড়ি থাকলে চুরি-চামারির সুবিধা। হুট করে চেনা-অচেনা লোক ঢুকে পড়বে। এখন সেটা পারবে না। সব থাকবে চোখে-চোখে। রাতের বেলা কলাপসেবল গেট বন্ধ করলে একেবারে নিশ্চিন্ত। দরজা-জানালা খোলা রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমান। কোনো অসুবিধা নাই।

আসতে-যেতে বারবার বিরক্ত করতে হয় আপনাদের।

বিরক্ত করতে হলে করবেন। পয়সা দিচ্ছেন বিরক্ত করবেন না? মাগনা থাকলে একটা কথা ছিল। আর পরের বাড়ি মনে করেন কেন? নিজের বাড়ি মনে করবেন। একদম নিজের বাড়ি।

করিম সাহেবের এই বাড়িটিকে নিজের বাড়ি মনে করার কোনোই কারণ আহসানের ঘটে নি। এই পরিবারের অন্য কারোর সঙ্গে তার সামান্যতম পরিচয়ও নেই। তাঁর স্ত্রীকে সে এখনো চোখে দেখে নি। অথচ সে দুমাসের ওপর এ-বাড়িতে আছে। তাঁর বড় তিনটি মেয়ের সঙ্গে হঠাৎ-হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, তবে তখন তারা এমন চমকে ওঠে যে আহসানের নিজেরই অস্বস্তি লাগে। মেয়ে তিনটি দেখা হলেই বিদ্যুতের মত মাথা ঘুরিয়ে নেয়। মহা বিরক্তির ব্যাপার। ছোটো দুটি এরকম না করলেও রোবটের মতো গলায় বলে—আসোলামু আলায়কুমসেটা আরো বিরক্তিকর। সালাম দেওয়ার অদ্ভুত কায়দা তারা কোথায় শিখেছে কে জানে!

করিম সাহেবের বারান্দায় আজ বাতি জ্বলছে। বারান্দায় সাত-আটটি চেয়ার পাতা। তাঁর বড় মেয়েটি ছোট দুটি বোনকে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। আহসানকে দেখে এরা তিনজনই উঠে দাঁড়াল। যেন তারা আহসানের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। এই প্রথম বার ছোট মেয়ে দুটি আসোলামু আলায়কুম বলল না। বড় মেয়েটিও মাথা ঘুরিয়ে মূর্তির মতো হয়ে গেল না। আহসান কি করবে ভেবে পেল না। দাঁড়াবে খানিকক্ষণ? করিম সাহেবের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেবে নাকি সরাসরি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে ওপরে? সে সবচেয়ে ছোট মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার আৰ্ব এখন কেমন আছেন?

জানি না।

দেখতে যাও নি?

সবাই গেছে। আমরা তিন জন শুধু আছি।

তোমরা যাও নি কেন?

মেয়েটি এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কাল বড় বোনের দিকে। বড় মেয়েটি বলল, আপনি এখানে একটু বসুন।

মেয়েটির গলার স্বর ঠাণ্ডা এবং কোমল। উচ্চারণ স্পষ্ট। বাবার মতো আঞ্চলিক সুর নেই; যদিও একটু টেনে-টেনে কথা বলছে। তার কথা বলার মধ্যে কোনো জড়তাও নেই। তাকিয়েও আছে সরাসরি আহসানের দিকে। সুন্দর চেহারা। বেশ ফর্সা—একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে। সম্ভবত অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। চোখ-মুখ ফোলাফোলা, সেই কারণেই কি একটা আদুরে ভাব চলে এসেছে? করিম সাহেবের কথা অনুসারে এই মেয়েটিও টাকা চুরি করে এবং নিজের ট্রাংকে গোপনে জমায়। মেয়েটিকে দেখে এটা ভাবতে বেশ কষ্ট হয়।

আমাকে বসতে বলছ?

জ্বি। আপনি একটু বসুন। আমাদের ভয় লাগছে।

কীসের ভয়?

বাথরুমে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন শব্দ করছে।

ইঁদুর-টিদুর হবে বোধ হয়। জ্বি না।

ইঁদুর না। অন্য কিছু।

অন্য কিছু কী?

বড় মেয়েটি তার জবাব দিল না। ছোট মেয়ে দুটি এ ওর দিকে তাকাতে লাগল। এদের কারোর নামই আহসানের জানা নেই। সবার নামই একই ধরনের। পাঁচটি একধরনের নাম মনে রাখা কষ্ট। আহসান বলল,

চোর-টোর নাকি?

বড় মেয়েটি বলল, জ্বি না, চোর না। সাদা কাপড় পরা একজন কে যেন বাথরুমে। ঢুকল। আমি বাথরুমে গিয়ে দেখি কিছু নেই।

ভূত-প্ৰেত?

মেয়েটি জবাব দিল না। আহসান বলল, বাবার ব্যাপারে তোমাদের মন দুর্বল হয়ে আছে, তাই এইসব দেখেছ। ঢাকা শহরে অনেক কিছুই আছেভূত নেই।

আমি এই সাদা কাপড় পরা মেয়েটাকে আগেও একদিন দেখেছি, ছাদে বসেছিল।

বল কী তুমি?

মেয়ে তিনটি ভূতের ভয়েই মুখ শুকনো করে বসে আছে। বাবার অসুখের চেয়ে এই ভয়টিই বর্তমানে তাদের কাবু করেছে। ঠিক এই মুহূর্তে তারা সম্ভবত বাবার কথা ভাবছে না! আহসান বসল, ঠিক তখন সত্যি-সত্যি খটখট শব্দ শোনা গেল ভেতর থেকে। দারুণ চমকে উঠল মেয়ে তিনটি। আহসান বলল, চল দেখে আসি।

আপনাকে কিছু দেখতে হবে না। আপনি এখানে খানিকক্ষণ বসুন। বেশিক্ষণ বসতে হবে না। জালাল মিয়া চলে আসবে।

জালাল মিয়া কে? ট্রাকের ড্রাইভার।

ঠিক আছে আমি বসলাম। এত জায়গা থাকতে ভূতটা বাথরুমে গিয়ে বসে আছে। কেন? এই রাতদুপুরে গোসল করার তার কি দরকার পড়ল? বোধ হয় গরম লাগছে।

একটি সহজ এবং সাধারণ রসিকতা। পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে এরকম রসিকতা করা যেতে পারে। কিন্তু বড় মেয়েটি এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন খুব আহত হয়েছে। এই সাধারণ রসিকতাটিতে আহত হবার কী আছে? আহসান বলল,

অন্য ভাড়াটেরা কেউ নেই?

জ্বি না।

অন্য ভাড়াটেরা কেউ যে নেই এই তথ্যটি আহসানের জানা। দোতলার বাঁদিকের ভাড়াটে আসিক সাহেব তাঁর স্ত্রীকে দেশের বাড়িতে রেখে আসতে গিয়েছেন। ডানদিকের ভাড়াটে বজলু সাহেব গত সপ্তাহে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। বজলু সাহেবকে আহসানের সবসময় ভালোমানুষ বলে মনে হত। কিন্তু লোকটি চলে যাবার পর জানা গেল সে বাথরুমের কমোড ভেঙে দু টুকরা করেছে। একটি আয়না এবং রান্নাঘরের বেসিন ভেঙেছে। শোবার ঘরের জানালার সব কটি কাচ ভেঙেছে। এই কাজগুলো তাকে বেশ পরিশ্রম করে করতে হয়েছে বলাই বাহুল্য।

করিম সাহেব আহসানকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সব দেখালেন। তার মনে হল রাগের বদলে ভদ্রলোকের বিস্ময়টাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বার-বার বলছেন, এরকম কেন করল বলেন তো?

বলা মুশকিল। আপনার ওপর হয়ত রাগ আছে।

রাগ থাকবে কেন? আমাকে সবসময় চাচা-চাচা বলত। যাবার সময় পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি পনের দিনের ভাড়া নিই নাই।

দুনিয়ায় অনেক রকমের মানুষ আছে।

আমাকে ক্ষতি করিয়ে তার লাভ কি হল? ক্ষতি করেছে এইটাই লাভ।

যদি কোনোদিন দেখা হয় আপনার সঙ্গে, তাহলে কথাটা জিজ্ঞেস করবেন? বলবেন-আমি মনে কষ্ট পেয়েছি। খুব কষ্ট।

দেখা হলে বলব। দেখা হবে না। এই জাতীয় লোকদের সঙ্গে দেখা হয় না।

তাও ঠিক। কি সমস্যায় পড়েছি বলেন তো দেখি। বাড়ি ঠিকঠাক না-করে ভাড়াও দিতে পারব না। ইংলিশ কমোড আর বেসিন ছিল। শখ করে কিনেছিলাম। আগে জানলে বাংলাদেশিটা কিনতাম।

আহসান সিগারেট ধরাল। খালি পেটে সিগারেট টানতে ভালো লাগছে না। মুখ বন্ধ করে বারান্দায় বসে থাকাও বিরক্তিকর। বড় মেয়েটি এখন আবার কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদছে নিঃশব্দে। এবং খুব চেষ্টা করছে নিজেকে আড়াল করে রাখতে। ছোট মেয়ে দুটি বোনের গা ঘেঁষে বসে আছে এবং এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। এদের ভাব-ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে এরাও কাঁদতে শুরু করবে। আহসানের কারণে সংকোচ বোধ করছে বলে কাঁদছে না।

রাস্তায় ট্রাকের আলো দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত জালাল মিয়া ট্রাক নিয়ে আসছে। মেয়ে তিনটি উঠে দাঁড়িয়েছে। গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। বড় মেয়েটি বলল, আপনি এখন যেতে পারেন, জালাল এসেছে।

আহসান নিজের ঘরে চলে এল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় মনে হল—জালাল কী খবর আনল জানা দরকার ছিল। অতি সাধারণ ভদ্রতা। কেন জানি ভদ্রতাটা করা হল না। মেয়েদের সঙ্গে আলাপে সে করিম সাহেবের প্রসঙ্গ আনে নি। এটাও অন্যায় হয়েছে। খুবই অন্যায়। এ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে হল এইসব জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।

দরজায় খুট-খুট শব্দে টোকা পড়ছে। আহসান দরজা খুলল, জালাল মিয়া দাঁড়িয়ে আছে।

বিরক্ত করলাম প্রবেসার সাব।

না-বিরক্তের কিছু না। উনার খবর কি?

খবর খারাপ। মেয়েগুলিরে নিতে আসছি। রাতে আর ফিরব না। আপনারে বলে গেলাম। একটু লক্ষ রাখবেন।

রাখব, লক্ষ রাখব।

যা মুশকিলে পড়লাম ভাইজান—মেয়েগুলি খুব কানতেছে। আচ্ছা যাই। আপনার কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা দেন।

প্যাকেটে দুটি সিগারেট ছিল। আহসান প্যাকেটটাই হাতে তুলে দিল।

বিপদের উপরে বিপদ বুঝলেন বেসার সাব। আমার হেল্লার ব্যাটারে কুত্তায় কামড় দিছে। পনরখান ইনজিকশন লাগে। কি সমস্যা চিন্তা করেন দেহি।

সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়ে দেওয়া ভুল হয়েছে। আহসানের ধারণা ছিল ড্রয়ারে একটা নতুন প্যাকেট আছে, এখন দেখা যাচ্ছে নতুন প্যাকেট নেই। পুরনো চিঠি-পত্ৰ, একটা মোমবাতি, এক প্যাকেট নতুন দেয়াশলাই ছাড়া ড্রয়ার পুরোপুরি শূন্য। রাত বাজছে এগারটা পঁচিশ। সিগারেটের জন্যে হেঁটে-হেঁটে রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতে হবে। প্রায় বিশ মিনিটের পথ। যে পাগলা কুকুর ড্রাইভারের হেপ্পারকে কামড়েছে সে নিশ্চয়ই এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা।

সুযোগ পেলে তাকেও কামড়াবে। পাগলা কুকুরের নিয়ম হচ্ছে সাত জনকে কামড়ানো। তারিন তাই বলত। অদ্ভুত-অদ্ভুত সব তথ্য তারিনের মাথায়। বিড়াল নাকি চোখ ফোটার আগে তার বাচ্চাকে সাত বাড়ি ঘুরিয়ে আনে। জোড় বাচ্চা রাখে না। যে বিড়ালের চারটা বাচ্চা সে একটাকে মেরে সংখ্যা বিজোড় করে ফেলে। কোত্থেকে সে এইসব যোগাড় করত কে জানে?

খিদে লেগেছে। ভাত খাবার পর একটা সিগারেট খাওয়া যাবে না—এই চিন্তাটি তাকে অস্থির করে তুলল। আকাশের অবস্থাও ভালো না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির সময়। অথচ যেতে হবে ছাতা ছাড়া। প্রতি বর্ষাতেই তাকে একটি করে ছাতা কিনতে হয়। এবারের ছাতাটি সে গত সপ্তাহে কিনেছে। একদিন মাত্র ব্যবহার করেছে। তারপরই ছাতা নিখোঁজ। আরেকটি কিনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই বৰ্ষা ভিজেই কাটুক। আহসান খুলে ফেলা জুতো আবার পরতে বসল, সিগারেট না আনলেই নয়। নেশার জিনিস ফুরিয়ে গেলে খুব অস্থির লাগে।

জায়গাটার আসলেই একটা রহস্য আছে। গন্ধটা এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। যদি পাওয়া যায়। অপেক্ষাটা বিপজ্জনক-আকাশের অবস্থা বেশ খারাপ। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে তুমুল বৰ্ষণ হবে। কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেন মাঝেমাঝে চমৎকার একটা গন্ধ এজায়গাটায় পাওয়া যায়? কারো সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলে হয়। আলাপের জন্যে বিষয়টি অবশ্যি খুবই তুচ্ছ। তবু মাঝে-মাঝে তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছে করে। চার বছর আগে তারিন ছিল। যেকোনো তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করা যেত তার সঙ্গে। চমৎকার সময় কাটত। একবার তারিন নিউমার্কেটে যাবার পথে দেখল একটা মহিষকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে। সে বাসায় ফিরল দারুণ উত্তেজিত হয়ে।

আজ একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম-মহিষকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে।

আহসান হাই তুলে বলল, এটা অদ্ভুত কিছু না। গরু-মহিষকে প্রায়ই ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যায়। এরা হাঁটতে পারে না বলে এই ব্যবস্থা। তুমি যদি দেখতে একটা বাঘকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে তাহলেও একটা কথা ছিল।

মহিষটা অসুস্থ না, খুবই সুস্থ।

সুস্থ হলে একে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাবে কেন?

তারিন হাসতে-হাসতে বলল, আমি জানি কেন নিয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি বলতে পার তাহলে তোমার জন্যে পুরস্কার আছে।

কী পুরস্কার আগে বল।

না—আগে-ভাগে বলা যাবে না।

তুমি যদি একটি বিশেষ পুরস্কার আমাকে দাও তাহলে চেষ্টা করে দেখতে রাজি আছি।

কি অসভ্যতা করছ? ছি।

অসভ্যতা কি করলাম? আমি একটি বিশেষ পুরস্কারের কথা বলছি। এর বেশি। তো কিছু বলি নি।

থাক তোমাকে কিছু বলতে হবে না।

রাগ করে উঠে চলে যায় তারিন। সেই রাগ ভাঙাতে আহসানকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়। শেষ পর্যন্ত রাগ ভাঙে এবং আহসান অনুমান করতে চেষ্টা করে কেন মহিষটিকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে।

মহিষটার একটা পা ছিল খোঁড়া?

হল না।

গাড়ির নিচে পড়ে জখম হয়েছে, হাঁটতে পারছে না তাই—

হল না।

মহিষটা সম্ভবত বিয়ে করতে যাচ্ছে—

ফাজলামি করবে না ঠিকমতো বল।

পারছি না। তুমি বলে দাও।

মহিষটার একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা হাঁটতে পারে না বলে বাচ্চা এবং মা ঠেলাগাড়িতে করে যাচ্ছে। এই সহজ জিনিসটা বলতে পারলে না?

তুমি বলছ মহিষ। মহিষ হচ্ছে পুংলিঙ্গ। ম্যাসকুলিন জেন্ডার। আমি বুঝব কী করে এর একটা বাচ্চা আছে?

মহিষ-এর স্ত্রীলিঙ্গ কী?

মহিষী কিংবা মহিষিনী কিংবা মহিলা মহিষ।

ওমা তুমি জান না নাকি?

না, জানি না।

প্রফেসর মানুষ আর এই সাধারণ জিনিসটা তুমি জান না?

আমি কি বাংলার প্রফেসর নাকি যে জানব? আমি হচ্ছি যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক।

যুক্তিবিদ্যা তো তুমি আরো কম জান।

কী করে বুঝলে?

আমার সঙ্গে তো কোনো যুক্তিতেই তুমি পার না।

অর্থহীন কথা। বলার জন্যেই কথা বলা। এর বেশি কিছু না। কিন্তু কি অপূর্ব ছিল সেই অর্থহীন কথাবার্তা। তারিন যদি আজ থাকত তাহলে নিশ্চয়ই এই হঠাৎ আসা গন্ধের রহস্য বের করে ফেলত। কোনো এক রাতে ঘুমুতে যাবার আগে কৃত্রিম একটা হাই তুলে বলত, গন্ধ-রহস্যের সমাধান হয়েছে।

কী সমাধান?

আজ বলা যাবে না ঘুম পাচ্ছে।

আহ, বল না।

বললাম তো ঘুম পাচ্ছে।

আরেকবার হাই তুলে এমন ভাব করত যাতে মনে হতে পারে সত্যি-সত্যি ঘুম পেয়েছে।

আহসান অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। ছোট ছোট কয়েকটি বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। রাত অনেক হয়েছে। বৃষ্টিবাদলা দেখলে দোকানপাট বন্ধ করে দোকানীরা বাড়ি চলে যাবে। মস্তান ধরনের ছেলেপুলে বোতল হাতে নিরিবিলি জায়গার খোঁজে আসবে এদিক দিয়েই। এটি মোটামুটি নির্জন অঞ্চল। ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে এরকম একটি ঘরে তাদের আসর বসবে।

এ-জাতীয় একটি দলের সামনে একবার আহসান পড়ে গিয়েছিল। রাত বেশি হয়। নি, দশটা-সাড়ে দশটা। পাঁচ-ছটি ছেলের একটা দল একটি মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি যেতে চাচ্ছে না। ল্যাম্প-পোস্টের আলোয় মেয়েটিকে চমৎকার লাগছে। রোগা, লম্বা একটি মেয়ে, কচি মুখ। এসব ক্ষেত্রে কোনোরকম কথা না-বলাই বিচক্ষণতার লক্ষণ। কিন্তু আহসান, অসম্ভব সাহস দেখাল। কড়া গলায় বলল এ্যাই, কী ব্যাপার? কী হচ্ছে?

দলটি থেমে গেল। মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। যে তার হাত ধরে আছে সে চিকন গলায় বলল, আপনি যা ভাবছেন তা না ব্রাদার। ভদ্রঘরের মেয়ে না। ট্রিপ দেওয়া মেয়ে। জায়গায়-জায়গায় ট্রিপ দেয়। একসঙ্গে বেশি কাস্টমার দেখে ঘাবড়ে গেছে।

বলার ভঙ্গিটি এতই কুৎসিত যে গা জ্বালা করে। কিন্তু জ্বালা করা পর্যন্তই। কিছুই করবার নেই। তবে ঐ মেয়েটি আজেবাজে ধরনের মেয়েই ছিল। কারণ আহসান দেখল মেয়েটি বেশ সহজভাবেই যাচ্ছে। তাকে আর আগের মতো টেনে-হিচড়ে নিতে হচ্ছে না। অল্প বয়সের এ-রকম সুশ্রী একটি মেয়ের একি দুর্দশা! মেয়েটি যেতে যেতে একবার বলল, এমুন করেন ক্যান? যাইতেছি তো। সকাল সকাল ছাড়বেন কিন্তুক।

এর উত্তরে ছেলেদের একজন কি বলল ঠিক বোঝা গেল না, তবে নিশ্চয়ই হাসির কিছু মেয়েটি খিল-খিল করে হাসছে। অর্থহীন হাসি।

আহসান দু প্যাকেট সিগারেট কিনল। সবকিছু বেশি-বেশি থাকাই ভালো। সিগারেটওয়ালার মুখে অসম্ভব বিরক্তি। শেষ সময়ে দু প্যাকেট সিগারেট বিক্রি করেও তার বিরক্তি দূর হল না। টাকার ভাংতি হিসাব করছে এই জন্যেই কি বিরক্তি? নাকি তারও খিদে পেয়েছে, বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছে; কিন্তু যেতে পারছে না, কারণ বিক্রি ভালো হয় নি। আহসান লোকটির বিরক্তি কমাবার জন্যে হালকা গলায় বলল, একটা পাগলা কুকুর নাকি বেরিয়েছে, জান নাকি?

জানি না।

লোকটি মুখ আরো বিরস করে ফেলল। পাগলা কুকুর কেন, বাঘ বেরুলেও তার কিছু যায়-আসে না।

আহসানের ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। একবার ঘরে ঢুকলে বেরুতে ইচ্ছে করে না, আবার বেরুলে ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। অদ্ভুত অবস্থা। সকালে নাশতার কিছু নেই। নূর বেকারি খোলা। সে কলা এবং রুটি কিনল।

আজ সকালে ঘরে নাশতার কিছু ছিল না বলে, না খেয়ে কলেজে ছুটতে হয়েছে। দুটি দেয়াশলাই কিনে টাকা দেবার সময় মনে পড়ল ড্রয়ারে পুরো এক প্যাকেট দেয়াশলাই দেখে এসেছে। কোন জিনিস আছে কোন জিনিস নেই তার কোনো হিসাব থাকছে না। যা নেই তা কেনা হচ্ছে না। যেটা আছে সেটাই কেনা হচ্ছে। হয়ত ঘরে গিয়ে দেখবে পাউরুটিও একটি পড়ে আছে।

নূর বেকারির ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে আলাপী। আহসান অন্তরঙ্গ সুর বের করল, একটা নাকি পাগলা কুকুর বের হয়েছে, জান কিছু?

ছেলেটি জবাব দিল না। রাগী চোখে তাকাল। তুমি করে বলায় হয়ত রক্ত গরম হয়ে গেছে। মাস্টারি করে এই সমস্যা হয়েছে—সবাইকে ছাত্র মনে হয়।

খিদে জানান দিচ্ছে। আহসান খিদে-পেটেই সিগারেট ধরাল, ঠিক তখন। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। ধুম বৃষ্টি। এ-বৃষ্টি থামবে না। ধরন দেখেই বলে দেওয়া যায় সারা রাত চলবে। দৌড়ে কোথাও দাঁড়ানোর কোনো মানে হয় না। শেষ পর্যন্ত কাকভেজা হয়েই বাসায় ফিরতে হবে। তবুবৃষ্টি নামলেই কোথাও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। আহসান ছুটে গিয়ে দাঁড়াল মেসার্স রহমানিয়ার বারান্দায়। মাথার ওপর খানিকটা ছাদের মতো আছে। তাতে বৃষ্টি আটকাচ্ছে না। আশ্রয়ের খোঁজে আরো কিছু লোকজন এসেছে। একজন ভিখিরি, সঙ্গে ইদুরের বাচ্চার মতো কৃশ একটি বাচ্চা। বাচ্চাটি গভীর রাতেও জেগে আছে। চোখ বড়-বড় করে তাকাচ্ছে। একজন বুড়ো লোক যাকে প্রথম দৃষ্টিতে ভিখিরি মনে হলেও সে ভিখিরি নয়। কারণ তার হাতে একটি বাজারের থলে আছে। সেই থলের ভেতর থেকে লাউয়ের মাথা বের হয়ে আছে। ভিখিরির কাছে বাজারের থলে থাকে না। এই বুড়ো গভীর রাতে বাজার করে কোথায় ফিরছে কে জানে। একেকবার বৃষ্টির ঝাপটা আসছে আর এই বুড়ো করে থুথু ফেলছে।

কোণের দিকে প্রায় দেয়াল ঘেঁষে লম্বা রোগা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ঐদিনকার সেই মেয়েটি। মেয়েটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আলো নেই, মুখ দেখা যাচ্ছে না। মুখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আবার হচ্ছেও না। থলে হাতে বুড়োটি মেয়েটির দিকে কয়েকবার তাকিয়ে ঝাঁজালোভাবে কিসব বলল। আহসান শুনতে পেল না। ভিখিরি মেয়েটি শুনল এবং হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ার মতো হল। ভিখিরির শিশুটি হয়ত তার মা হাসি শুনে অভ্যস্ত নয়। সে কেঁদে উঠল। ভিখিরিটির হাসি আর থামেই না। আহসানের বুকে ছোট্ট একটি ধাক্কা লাগল। তারিনের হাসির সঙ্গে এই মেয়েটির হাসির মধ্যে কোথায় যেন একটি মিল আছে। ধ্বনির মিল—যা মাথায় ঢুকে ঝন-ঝন করে বাজে। কেন জানি হাসি শুনতে ইচ্ছে করছে না। আহসান বৃষ্টি মাথায় করেই রাস্তায় নামল। আশ্চর্যের ব্যাপার, লম্বা মেয়েটিও তার সঙ্গে-সঙ্গে নেমে আসছে। আজ বোধ হয় বেচারীর ভাগ্যে কিছু জোটে নি।

একজনের সঙ্গে অন্য একজনের মিলের ব্যাপারটা বোধ হয় মনগড়া। আসলে তেমন কোনো মিল থাকে না। মিল কল্পনা করা হয়। আমরা একজনের চোখে অন্য একজনের ছায়া দেখি। একজনের চুল অন্য একজনের চুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। তারিনের মৃত্যুর পরপর এই ব্যাপারে খুব ঘটত। হয়ত একটা মেয়ে রিকশা করে যাচ্ছে। হুড তোলা হয় নি, বাতাসে মেয়েটির চুল উড়ছে। সাধারণ দৃশ্য। তবুবুকের মধ্যে ধক করে উঠবে আরে এই মেয়েটি তো তারিনের মতো। রিকশা চলে না-যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতে হবে। বুকের কোন গহীন গোপনে ব্যথা ছলছলিয়ে উঠবে।

একবার ক্লাসে এরকম হল। সেকেন্ড ইয়ার অনার্স ক্লাস। এসথেটিকস পড়ানো হবে। রোল কল করা হচ্ছে। রোল ফিফটি এইট বলা মাত্র একটি মেয়ে বলল, প্রেজেন্ট স্যার। আহসান হতভম্ব! আরে এর গলা তো অবিকল তারিনের গলার মতো।

আহসান সেই স্বর দ্বিতীয় বার শোনার জন্যে আবার বলল, রোল ফিফটি এইট।

প্রেজেন্ট স্যার।

আবার শুনতে ইচ্ছে করছে। একটা রোল তিনবার ডাকা যায় না। আহসান বলল, রোল ফিফটি এইট তুমি এত এ্যাসেন্ট থাক কেন?

স্যার, আমি তো এ্যাবসেন্ট থাকি না।

ও আচ্ছা। আমার ভুল হয়েছে—বস।

মেয়েটি বসে পড়ল। সে বেশ বিব্রত বোধ করছে। তার দু পাশের বান্ধবীরা মুখ টিপে হাসছে। একজন সম্ভবত পেনসিল দিয়ে খোঁচাও দিল। এ-কালের মেয়েগুলি ফাজিলের চূড়ান্ত। সহজ কথারও তিন রকম অর্থ করে মজা পায়।

বৃষ্টি যতটা জোরাল মনে হচ্ছিল ততটা জোরাল নয়। কুয়াশার মতো পড়ছে। বাসা পর্যন্ত যেতে মাথা সামান্য ভিজবে, এর বেশি কিছু হবে না। ঝম-ঝম বৃষ্টি হলে মন্দ হত না। অনেকদিন ধুম বৃষ্টিতে ভেজা হয় না।

মেয়েটি আসছে তার পিছনে-পিছনে। স্যাভেল খলে হাতে নিয়েছে, পা ফেলছে খুব সাবধানে। এর বাড়ি বোধ হয় আশেপাশে কোথাও হবে। একা-একা যেতে ভয় পাচ্ছে। বলে সঙ্গে আসছে। আসুক ক্ষতি তো কিছু নেই। এত সাবধানতায়ও কাজ দিল না। মেয়েটি পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে যে কাদায় মাখামাখি হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে হাত ধরে তোলার কোনো অর্থ হয় না। আবার পাশ-কেটে চলে যেতেও খারাপ লাগে।

এই জাতীয় মেয়ের সংখ্যা শহরে দ্রুত বাড়ছে। কলেজের ইসমাইল সাহেবের ধারণা শহরটা প্ৰসটিটিউটের শহর হয়ে যাচ্ছে। ইসমাইল সাহেব লোকটি বেশ রসিক। যাই বলেন শুনতে ভালো লাগে।

বুঝলেন সাহেব, ঐরকম একজনের পাল্লায় পড়েছিলাম। রাত দশটার মতো। বাজে। আমার ভায়রার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি ঝিকাতলা। একটু ভেতরের দিকে। রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটছি, তখন এই মেয়েটা এসে উপস্থিত। নরম গলায় বলল,

আজ রাতটা কি আপনি আমাকে থাকতে দিতে পারেন?

আমি তো বুঝতেই পারি নাই রে ভাই। কচি চেহারা, ভদ্ৰ সাজ-পোশাক।

আপনি কী বললেন?

আমি বললাম, কী অসুবিধা তোমার?

জিওগ্রাফির মনসুর সাহেব চাপা হাসি হেসে বললেন, মা বলে ডাকলেন না? আপনার তো আবার মেয়েদের মা ডাকার একটা প্রবণতা আছে।

নামা ডাকি নি। কলেজের মেয়েগুলিকে মা বলি। বাইরে বলি না। তারপর কি হল শোনেন—আমি বললাম, কী অসুবিধা তোমার? … সে বলল, অনেক অসুবিধা। বলেই হাসল, তখনই ব্যাপারটা বুঝলাম।

কি করলেন?

পাঁচটা টাকা দিলাম। টাকাটা নিল না। তখনই বুঝলাম ভালো ফ্যামিলির মেয়ে, ছ্যাচড়া ধরনের হলে নিত।

মনসুর সাহেব বাঁকা হাসি হেসে বললেন, আপনার মনের অবস্থাটা তখন কী হল বলুন।

কী আবার হবে। কিছু হয় নি-একটু স্যাড ফিল করেছি।

শুধুই স্যাড আর কিছু না? একবারের জন্যেও কি মনে হয় নি এই মেয়েটির সঙ্গে কিছু সময় কাটালে কি আর এমন ক্ষতি হবে? ঘরে ফিরলে সেই তো বাসি স্ত্রী। অর্থের বিনিময়ে টাটকা একজন তরুণীর সঙ্গ মন্দ কি?

কী-সব বাজে কথা বলছেন মনসুর সাহেব?

বাজে কথা একেবারেই বলছি না। নিতান্ত সত্যি-সত্যি কথাটা বলছি। হার্ড টুথ।

নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করবেন না।

নিজেকে দিয়ে বিচার করছি না আপনাকে দিয়েই আমি আপনাকে বিচার করছি। এই যে মেয়েগুলিকে আপনি মা মা ডাকেন, তার পিছনে কি অন্য কিছু কাজ করে না? মা বলে সহজেই একজনের পিঠে হাত রাখতে পারছেন। স্পর্শের আনন্দটুকুর জন্যে আপনি মা ডাকছেন। আমি খুব ভুল বলছি?

ইসমাইল সাহেব স্যান্ডেল খুলে মনসুর সাহেবকে মারতে গেলেন। কেলেঙ্কারি ব্যাপার। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত জিনিসটা গড়াল। প্রিন্সিপ্যাল দার্শনিকের মতো বললেন, মেয়েমানুষ কী জিনিস দেখলেন। সামান্য মেয়েমানুষের কথা থেকে স্যান্ডেল নিয়ে ছোটাছুটি। এই খবর বাইরে লিক হলে টিচার্স ক্যুনিটি হিসাবে আমাদের স্থান কোথায় হবে বলেন দেখি? আপনাদের মতো হাইলি এড়ুকেটেড লোক যদি ……

বৃষ্টি এবার বড় বড় ফোঁটায় পড়তে শুরু করেছে। আহসান তার পাউরুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভেজা পাউরুটি নিয়ে ঘরে ফেরার কোন অর্থ হয় না। মেয়েটিকে পাউরুটিটা দিয়ে দিলে কেমন হয়? চিন্তাটা মাথায় আসায় আহসান অস্বস্তি বোধ করছে। হঠাৎ একটা পাউরুটি দেওয়ার কথা তার মনে হল কেন? কেন সে পাউরুটি দিতে চাচ্ছে?

মেয়েটি অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে কী যেন খুজছে। তার মধ্যে একধরনের ব্যাকুলতা। কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও আহসান বলল, কি খুঁজছ? বলেই সে নিজে চমকে উঠল। সে কি খুঁজছে না খুঁজছে তা নিয়ে আহসানের মাথাব্যথা কেন?

মেয়েটি খোঁজা বন্ধ করে আহসানকে দেখছে। জায়গাটা অন্ধকার, সে নিশ্চয়ই কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটি নিচু গলায় বলল, আমার স্যান্ডেল খুঁজতেছি।

তুমি কি এই দিকে থাক?

না।

কোথায় থাক?

মেয়েটি জবাব দিল না। ধুম বৃষ্টি চলছে। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে মনে হতে পারে সে অপেক্ষা করছে। মেয়েটির জন্যে।

স্যান্ডেল পাওয়া গেছে?

না।

নাম কি তোমার?

রেবা।

এটা নিশ্চয়ই ছদ্মনাম। আসল নাম অন্য কিছু। ঠিক নামটি এরা ্কখনো বলে না।

এটা তোমার ঠিক নাম?

না।

আহসান পা বাড়াল। আশ্চর্য মেয়েটিও আসছে। আহসান থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শীতল গলায় বলল, আমার সঙ্গে-সঙ্গে আছ কেন?

মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আবার হাঁটতে শুরু করল, আহসানের পাশে পাশে আসছে। দু জন মানুষ পাশাপাশি হাঁটছে অথচ কেউ কোনো কথা বলছে না। জায়গায়জায়গায় পানি জমে আছে। পা পড়তেই ছপ-ছপ শব্দ হচ্ছে। চারদিকে ব্যাঙ ডাকছে। জায়গাটা পুরোপুরি গ্রামের মতো হয়ে গেছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে নিকষ অন্ধকার। তারিনকে নিয়ে একবার ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আঠারবাড়ি স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে কুতুবপুর যেতে হয়েছিল। কি ফুর্তি তার। আহসান বার বার বলছিল, হাত ধরে হাঁট, পিছলে পড়বে।

তারিন হাসতে-হাসতে বলেছে, পিছলে পড়লে একা পড়ব। তোমার হাত ধরে থাকলে তুমিও পড়বে। দু জন পড়লে লাভ কি বল? তার কথা শেষ হবার আগেই আহসান নিজে পিছলে পড়ল। তারিনের হাসি আর থামেই না।

আহ কী করছ? লোকজন জড়ো হবে।

হোক জড়ো। হাসার সময় হাসব। কাঁদার সময় কাঁদব।

সত্যি-সত্যি। তারিনের হাসিতে লোকজন এসে পড়ল। তারা কিছুতেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যেতে দেবে না। তারিন যাবেই। শেষ পর্যন্ত একদল লোক সঙ্গে নিয়ে রওনা হতে হল। একজন একটি ছাতা ধরে থাকল তারিনের মাথায় একটা ট-লাইটও যোগাড় হয়েছিল। টর্চলাইটধারী আগে-আগে আলো ফেলতে লাগল। তারিনের আনন্দ পুরোপুরি মাঠে মারা গেল। এইসব যেন অন্য কোন জন্মের কথা। এই জন্মের নয়। এই জন্মে লম্বা রোগা একটি মেয়ে তার সঙ্গে-সঙ্গে আসছে। তার একহাতে একটিমাত্র স্যাভেল অন্য স্যান্ডেলটি সে খুঁজে পায় নি। হয়ত দিনের বেলা গিয়ে খুঁজবে। সেইজন্যেই এটি সে সঙ্গে করে আনছে।

এই মেয়ে?

হুঁ। তুমি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসছ কেন? স্টপ। আসবে না। যত বাজে ঝামেলা। বাড়ি যাও।

এই জাতীয় মেয়েরা কত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে কে জানে। এরা কি একা-একাই বাড়ি ফেরে, না কেউ এসে নিয়ে যায়? হয়ত বাড়ি থেকে কেউ এসে নিয়ে যায়। কিংবা কোনো রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঠিকঠাক করা থাকে। এরা এসে বাড়ি নিয়ে যায়। আজ ঝড়-বৃষ্টির জন্যে কেউ আসে নি।

মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এখন আর পিছনে-পিছনে আসছে না। মেয়েটি একা-একা কোথায় যাবে? আহসান ঠাণ্ডা গলায় বলল,

বাড়ি চলে যাও। আমার পিছনে-পিছনে এসে লাভ হবে না। বাড়ি যেতে পারবে না একা-একা?

মেয়েটি জবাব দিল না।

বাসা কোথায় তোমার?

কল্যাণপুর।

রিকশা এখন পাবে না। যাবে কীভাবে?

মেয়েটি উল্টোদিকে ফিরে হাঁটতে শুরু করল।

এ্যাই শোন। এ্যাই।

মেয়েটি ফিরল না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। যাক যেখানে ইচ্ছে। আহসান হাঁটতে শুরু করল। ঠাণ্ডায় গা কাঁপছে, নিৰ্ঘাৎ জ্বর আসবে। বাড়ির গেট পর্যন্ত এসে একবার পিছনে তাকাল।

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোয় দেখা যাচ্ছে মেয়েটি রাস্তার একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়ত ভাবছে এই লোকটি আবার তাকে ডাকতে আসবে। কিংবা একা-একা ফিরে যেতে সে ভয় পাচ্ছে।

আহসান তাকে সত্যি-সত্যি ডাকল। কেন ডাকল তা সে নিজেই জানে না। এই মেয়েটির গলার স্বর তারিনের মতো শুধু এই কারণে, নাকি সে ঝড়-বৃষ্টির রাতে নারী কামনা করছে?

তারিনের শাড়ি মেয়েটিকে পরতে দেওয়া উচিত হয় নি। খুব অন্যায় হয়েছে। অন্যায়ের ব্যাপারটা অনেকটা চেইন রিএকশনের মতো একটি অন্যায় করলেই পরপর অনেকগুলো করতে হয়।

মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজছিল, এত রাতে কোথায় কীভাবে যাবে, শুধু এই ভেবেই কি আহসান তাকে ডেকেছে? তার অবচেতন মনে কি অন্য কিছু লুকিয়ে আছে? থাকাটাই কী স্বাভাবিক নয়? এই নিৰ্জন বাড়ি, বৃষ্টির রাত, সুশ্রী চেহারার একটি মেয়ে, আহসানের মাথা ধরে গেল।

ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলে, যাবার জায়গা নেই এইজন্যেই তোমাকে এনেছি। অন্য কিছু নয়।

মেয়েটি কিছু বলল না। কিন্তু আহসানের মনে হল মেয়েটি ঠোঁটের ফাঁকে একটু যেন হাসল। আহসানের কথা ঠিক বিশ্বাস করল না। শুধু কি এই মেয়ে? আহসান নিজেও কী নিজের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে? তারিনের হালকা সবুজ শাড়িতে মেয়েটিকে সত্যি-সত্যি চমৎকার লাগছে। কত বয়স হবে মেয়েটির? আঠার, উনিশ নাকি তার চেয়েও কম? তারুণ্যের আভা চোখে-মুখে। চোখের কোলে অবশ্যি কালি পড়েছে। তাতে আরো চমৎকার লাগছে। মেয়েটি কী মনে করে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল। এটা সে কেন করল কে জানে। এখন বউ-বউ একটা ভাব মেয়েটির মধ্যে চলে এসেছে। বউ মানেই তো কোমল একটা ব্যাপার। স্বপ্ন এবং কল্পনা মেশানো ছবি।

আহসান বলল, আমি এখন ভাত খাব। তুমি কি খাবে?

না।

খেতে চাইলে খেতে পার। রাতে খেয়েছ কিছু?

না।

তাহলে খাবে না কেন?

মেয়েটি কিছু বলল না। আহসানের দিকে তাকিয়ে ঠোট টিপে হাসল। ভালো লাগল দেখতে। কিন্তু এই হাসি তৈরি হাসি। মানুষ ভোলানো হাসি। যেকোনো পুরুষের কাছে গিয়েই এই মেয়ে এমন সুন্দর করে হাসে। তা-ই নিয়ম।

তুমি এমন ঠোট টিপে হাসছ কেন?

মেয়েটি জবাব দিল না। কৌতূহলী চোখে চারদিকে দেখতে লাগল। তার দৃষ্টি আটকে গেল পড়ার টেবিলে রাখা চীনামাটির পুতুলটির ওপর। তারিনের পুতুল। বিয়ের পর সে অল্প যে-সব জিনিস বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে এটি তার একটি। তারিনের খুব শখের জিনিস।

ভাত-তরকারি ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাবার মতো হয়ে আছে। আহসান কেরোসিনের চুলা ধরাল। গরম না-করে কিছু মুখে দেওয়া যাবে না। মেয়েটি পিছনে-পিছনে এসেছে, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

এই বাড়িতে আর কেউ থাকে না?

প্রশ্নটি সে করল এমনভাবে যেন জবাবের জন্যে তার কোনো আগ্রহ নেই। আহসান। ঠাণ্ডা গলায় বলল, না।

রান্না করে কে?

একটা কাজের মেয়ে আছে। সে রান্না করে দিয়ে যায়। আমি এখানে শুধু রাতে খাই। দিনে বাইরে খাই। হোটেল-টোটেলে খেয়ে নিই।

এতগুলো কথা মেয়েটিকে বলার দরকার ছিল কি কোনো? কোনোই দরকার ছিল না। কিন্তু তবু সে বলেছে। কেন বললঃ

পেটে খিদে থাকলে এস খাও।

মেয়েটি এল। তার সম্ভবত প্রচুর খিদে ছিল। খুব আগ্রহ করে খেতে লাগল। খাবার সময়টায় একবারও আহসানের দিকে তাকাল না। এখনো মাথায় ঘোমটা।

তোমার কি যেন নাম?

পারুল।

আগে তো বলেছিলে রেবা? কোনটা তোমার আসল নাম?

পারুল।

শোন পারুল, তুমি সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাবে এবং আর কোনদিন আসবে না।

আচ্ছা।

রোজই কি তুমি রাতে বের হও?

না।

তোমার বাসায় কে-কে আছে?

মেয়েটি জবাব দিল না।

এই যে আজ রাতে বাসায় ফিরলে না। বাসার লোকজন চিন্তা করবে না?

না।

বাসায় তোমার কে-কে আছে?

মেয়েটি জবাব দিল না। একবার শুধু মুখ তুলে তাকাল।

সংসার আছে? অর্থাৎ স্বামী পুত্ৰ কন্যা এরা কেউ?

মেয়েটি উত্তর না দিয়ে থালা হাতে উঠে পড়ল। তার খাওয়া হয়ে গেছে। আহসান বলল, থালা-বাসন ধোয়ার দরকার নেই। সকালে রহিমার মা এসে ঘোবে। রেখে দাও ওখানে।

মেয়েটি রাখল না। অনেকখানি সময় নিয়ে নিজের প্লেট পরিষ্কার করল।

বললাম না এগুলো ধোয়ার দরকার নেই। রেখে দাও। এস আমার সঙ্গে। ঘুমুবার জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি।

মেয়েটি উঠে এল।

এই ঘরে শোবে। মশারি-টরি সবই আছে। তোমার যদি আগে ঘুম ভাঙে আমাকে ডাকবে। আমি গেট খুলে দেব। বাসায় চলে যাবে।

আচ্ছা।

দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়।

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আপনার আর কিছু লাগবে না?

না লাগবে না। তুমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ কর। নিচে ছিটকিনি আছে। আহ দেরি করছ কেন ছিটকিনি লাগাও।

আপনি কি আমার উপর রাগ করলেন?

না, রাগ করি নি। রাগের কোনো ব্যাপার না। ছিটকিনি দাও। সকালে উঠে চলে যাবে।

ছিটকিনি পড়ার শব্দ হল।

জালাল মিয়া ট্রাক নিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। একটু আগে ট্রাকের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল এখন কোলাপসিবল গেটের তালা খোলার শব্দ আসছে।

করিম সাহেব নিজে এই লাটি রাত দশটার দিকে লাগিয়ে দেন। সব ভাড়াটেদের কাছে এর একটা চাবি আছে। দশটার পর এলে নিজেদের চাবিতে গেট খুলতে হয়।

জালাল মিয়া একা আসে নি আরো লোকজন এসেছে। কান্না-কাটির কোনোরকম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে করিম সাহেব এখনো টিকে আছেন। নিচে একবার যাওয়া উচিত কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি কমে আসছে। বাতাসের বেগও কমছে। ঘটাং-ঘটাং করে জানালার একটা পাট এতক্ষণ নড়ছিল। এখন আর নড়ছে না।

পরপর তিনটি সিগারেট শেষ করে আহসান ঘুমুতে গেল। তার ধারণা ছিল—ঘুম আসবে না, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার শোয়ামাত্রই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।

ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। রোদে ঝলমল করছে চারদিক। ঘড়িতে বাজছে নটা। চমৎকার সকাল। মন ভালো করে দেবার মতো চমৎকার।

আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েটি তাকে কিছু না বলেই চলে গেছে। বিছানা পরিপাটি করে গোছানো। পরনের শাড়ি ভাঁজ করে আলনায় রাখা। বারান্দায় এক পাটি স্যান্ডেল ছিল সেটিও নেই। মেয়েটি গেট দিয়ে বেরুবার সময় কেউ কি দেখেছে? আহসানের অস্বস্তির সীমা রইল না। একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল।

একতলায় কে যেন রেডিও চালিয়েছে। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কেউ একজন এক ঘেঁয়ে গলায় ভ্যাজার-ভ্যাজর করছে।

ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক। যে-বাড়ির প্রধান ব্যক্তিটি হাসপাতালে মর-মর সেবাড়িতে শিল্প-সাহিত্য শুনবার জন্যে কেউ রেডিও খুলবে এটা ভাবা যায় না। আহসান বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রেডিও বন্ধ হয়েছে। কেউ বোধ হয় মনের ভুলে সুইচ টিপেছিল।

এ-রকম হয়। তারিন মারা যাবার পর ঠিক এই জিনিসই হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে আহসান একটা বেবিটেক্সি নিয়ে চলে গেল ঝিকাতলার বাসায়। সেই সময় বাসায় আসার তার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। কেন যে এসেছে সে সম্পর্কে তার ধারণাও স্পষ্ট নয়। পাশের বাড়ির নীলা ভাবি বললেন, হাসপাতাল থেকে আসছেন নাকি ভাই? খবর আছে কিছু?

আহসান কিছু বলল না। নীলা ভাবি বললেন, বুঝতে পারছি আনন্দের কোনো খবর এখনো হয় নি। এত যখন ঝামেলা হচ্ছে তখন ছেলে হবে। ছেলেগুলো বড় ঝামেলা করে রে ভাই। সহজে পৃথিবীতে আসতে চায় না।

আহসান জবাব না দিয়ে ঘরে ঢুকল। কাজের একটি বার-তের বছরের মেয়ে ছিল, তাকে চা বানাবার কথা বলে সে শোবার ঘরের খাটে বসে রইল। তার নিজেরও খেয়াল নেই কখন সে বিছানার ওপর রাখা ক্যাসেট প্লেয়ারটি চালু করেছে। কি একটা হিন্দি গান হচ্ছে। যেখানে ছুপ ছুপ কে এই কথাগুলো বারবার আছে। কাজের মেয়েটি চা এনে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান, আইজ হাসপাতালও খাওন নিবেন?

ঠিক তখনই সমস্ত ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা আহসানের কাছে ধরা পড়ল। ক্যাসেটে গান হচ্ছে। চিকন গলায় একটি মেয়ে এবং মোটা গলায় একটি ছেলে খুব রহস্যময় ভঙ্গিতে গাইছে ছুপ ছুপ কে। আহসান ক্যাসেট বন্ধ করল না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, জাহানারা, খারাপ খবর আছে। তোর ভাবি মারা গেছে। এই কিছুক্ষণ আগে।

জাহানারা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আহসান চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, চিনি দিয়ে তো সরবত বানিয়ে ফেলেছিস। এককাপ চা-ও ঠিকমতো বানাতে পারি না। যা নতুন করে বানিয়ে আন।

জাহানারা অবিশ্বাসী গলায় বলল, ভাবি মারা গেছে? কী কন ভাইজান।

হুঁ। ছেলেটা ভালো আছে। ছেলে হয়েছে একটা। বলেছি?

আহসান উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটটা বন্ধ করে সহজ গলায় বলল, ভালো করে চা বানিয়ে আন। অনেক রকম ঝামেলা আছে।

জাহানারা প্রায় দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পর শোনা গেল সে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বডড বিরক্ত লেগেছিল কান্না শুনে। ইচ্ছে করছিল উঠে গিয়ে কড়া একটা ধমক দিতে। ধমক দেওয়া হয় নি। কিছুক্ষণ পর জাহানারা চা নিয়ে এল। সেই চা-ও মুখে দেওয়া যায় নি। আগের বারের মতো চিনি দিয়ে সরবত। গরম করেছে। আগুনের মত। মুখে দিতেই জিব পুড়ে গেল।

আজ এ-বাড়িতেও হয়ত তাই হয়েছে। অবশ্যি কান্নার কোনো শব্দ আসছে না। ভদ্রলোকের পাঁচ মেয়ে। কিছু একটা হলে এরা কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। ঘন-ঘন ফিট-টিট হবে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গিজগিজ করবে। হৈ-চৈ চেঁচামেচি। মৃত্যু যেমন কুৎসিত, তার পরবর্তী ব্যাপারগুলো তার চেয়েও কুৎসিত।

এ-বাড়িতে কুৎসিত অংশগুলো এখনো শুরু হচ্ছে না। তবে শুরু হতে কতক্ষণ। যেকোনো সময় শুরু হয়ে যাবে। তার আগে একবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা দরকার। এটা হচ্ছে সামাজিকতা। করুণ মুখে খোঁজ-খবর করতে হবে। একবার হাসপাতালে যেতেও হতে পারে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ