জহির লাজুক মুখে বলল, স্যার আজ একটু সকাল-সকাল বাড়ি যাব, একটা জরুরি কাজ।

বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে গেল, গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। কথার মাঝখানে খুখুক করে কয়েকবার কাশল, নাকের ডগা ঈষৎ লালচে হয়ে গেল। হেডক্যাশিয়ার করিম সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন, ব্যাপারটা কি? জহির মাথা নিচু করে। অস্পষ্ট গলায় দ্বিতীয়বার বলল, একটা জরুরি কাজ।

করিম সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। জরুরি কাজে বাড়িতে যাবে এটা বলতে গিয়ে লজ্জায় ভেঙে পড়ার অর্থ তিনি ধরতে পারলেন না।

জহির অবশ্যি এনিতেই লাজুক ধরনের ছেলে। লজ্জার সঙ্গে আরো একটা অস্বস্তিকর জিনিস তার মধ্যে আছে, যার নাম বিনয়। সেই বিনয়ও বাড়াবাড়ি বিনয়। হাইকোর্টের সামনে একবার জহিরের সঙ্গে দেখা, সে সাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছিল। করিম সাহেবকে দেখে আচমকা ব্রেক কষে নেমে পড়ল। বাকি পথটা সাইকেল টেনে পেছনে-পেছনে আসতে লাগল। করিম সাহেব বললেন, তুমি পেছনেপেছনে আসছ কেন? যেখানে যাচ্ছ যাও। জহির বলল, অসুবিধা নেই স্যার। করিম সাহেব বুঝতে পারলেন এটা হচ্ছে জহিরের বিনয়ের একটা নমুনা। তিনি হেঁটে যাবেন আর জহির সাইকেলে তাকে পাস করে যাবে তা সে হতে দেবে না। তিনি বাধ্য হয়ে একটা রিকশা নিলেন, এবং জহিরের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। তিনি মিতব্যয়ী মানুষ। অকারণে টাকা খরচ করতে তাঁর ভালো লাগে না।

ক্যাশ সেকশনে জহির তিন বছর ধরে আছে। এই তিন বছরে জহিরের বিখ্যাত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অনেক পরিচয় হয়েছে। প্রতিবারই তিনি বিরক্ত হয়েছেন। শুরুতে তাঁর মনে হয়েছিল জহিরের লজ্জা এবং বিনয় দুইই এক ধরনের ভড়ং, যা প্রথম কিছুদিন থাকে; তারপর আসল মূর্তি বের হয়। ইউনিয়ন-টিউনিয়ন করে গায়ে চর্বি জমে যায়; তখন মুখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মেয়েমানুষ বিষয়ক রসিকতা করে হা-হা করে হাসে। জহিরের বেলায় এখনো তা হয় নি। কে জানে হয়ত তার চরিত্রই এরকম। অফিস ছুটির দশ মিনিট আগেও যদি তার হাতে একটা মোটা ফাইল ধরিয়ে বলা হয়, জহির, হিসেবটা একটু দেখে দাও তো। সে তৎক্ষণাৎ বলবে, জ্বি আচ্ছা স্যার। বিনয়ী এবং ভদ্রমানুষেরা কাজ-কর্মে সুবিধার হয় না। তারা সাধারণত ফাঁকিবাজ হয়। জহির সে রকম নয়। ক্যাশের কাজ-কর্ম সে শুধু যে বোঝে তাই নালোই বোঝে। করিম সাহেব তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করেন।

আজ অফিসে কাজের চাপ আছে। ইয়ার এডিং, হিসাবপত্ৰ আপটু ডেট করতে হবে। করিম সাহেব, অডিট ঝামেলা করতে পারে এমন সব ফাইলগুলো আলাদা করে রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন, ছুটির পরও কাজ করবেন। ক্ৰস চেকিং করবে জহির। অথচ বেছে-বেছে আজই তার সকাল-সকাল বাড়ি যেতে হবে। কোনো মানে হয়?

করিম সাহেব বললেন, তুমি কি এখনি চলে যেতে চাও?

জহির হাত কচলাতে লাগল। তার কানের ডগাও এখন ঈষৎ লাল। করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কী? জহির প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, কিছু না স্যার।

বাড়িতে কোনো অসুখ-বিসুখ?

জ্বি না।

বলতে কি কোনো অসুবিধা আছে?

একটা বিয়ের ব্যাপার স্যার।

বিয়ে? কার বিয়ে?

জহির জবাব দিল না, ঘামতে লাগল। করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বিয়ে?

ঠিক বিয়ে না স্যার। মেয়ে দেখা।

তোমার জন্য?

জহিরের মাথা আরো নিচু হয়ে গেল। করিম সাহেব হাসিমুখে বললেন, এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? এটা তো ভালো কথা। ইয়াং ম্যান বিয়ে করে সংসারী হবে, এ তো আনন্দের কথা। আজকাল ছেলেপুলেরা বিয়ে করতে চায় না। দায়িত্ব এড়াতে চায়। মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করবে অথচ বিয়ে করবে না।

জহির আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে রইল। করিম সাহেব ফাইলপত্ৰ গুছাতে শুরু করলেন। জহির না থাকলে তাঁর থাকাও অর্থহীন। আজ তিনিও একটু সকাল-সকাল ফিরবেন। করিম সাহেব স্লয়ার বন্ধ করতে-করতে বললেন, মেয়ে কোথায় দেখতে যাবে?

যাত্ৰাবাড়িতে। মেয়ে ওর বড় চাচার সঙ্গে থাকে।

যাত্ৰাবাড়িতে অনেক দূর। যাবে কিসে? তোমার সাইকেলে করে নাকি?

জহির রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। করিম সাহেব বললেন, অফিসের গাড়ি নিয়ে যাও না কেন? অফিসের কর্মচারীরা বিশেষ-বিশেষ প্রয়োজনে গাড়ি নিতে পারবে এরকম নিয়মত আছে।

গাড়ি লাগবে না স্যার।

লাগবে না কেন? পাওয়া গেলেতো অসুবিধা কিছু নেই।

আমাকে দিবে না স্যার। গাড়ি অফিসারদের জন্যে।

দাঁড়াও আমি মোজাফফর সাহেবকে বলে দেখি। রিকশা করে মেয়ে দেখতে যাওয়া আর গাড়ি করে দেখতে যাওয়া তো এক না।

করিম সাহেব উঠে গেলেন। জহির খুবই অবাক হল। সে ভাবতেও পারে নি করিম সাহেব সত্যি-সত্যি তার জন্যে এতটা করবেন। তার ধারণা করিম সাহেব তাকে পছন্দ করেন না। গত বছর ইনক্রিমেন্ট সিস্টে তিনি তার নাম দেন নি। অফিসের মধ্যে একমাত্র তারই কোনো ইনক্রিমেণ্ট হয় নি। সে বড় লজ্জা পেয়েছিল।

করিম সাহেব যেরকম হাসি-খুশি মুখে ভেতরে গিয়েছিলেন সে রকম ফিরলেন না, ফিরলেন মুখ কালো করে। শুকনো গলায় বললেন, একটা গাড়ি নাকি গ্যারেজে, আর অন্য গাড়িটার ড্রাইভার নেই। বলতে-বলতে তিনি আরো গভীর হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, ড্রাইভার নেই এটা নিতান্তই ফালতু কথা। দিবে না এটা হচ্ছে কথা। জি. এম. সাহেবকে বলব। উনি একটা মিটিঙে আছেন।

আমার গাড়ি লাগবে না স্যার। আপনার কিছু বলার দরকার নেই।

তুমি থাক কোথায়?

কল্যাণপুর।

বাবা-মা সঙ্গে আছেন, না একাই থাক?

বাবা-মা বেঁচে নেই স্যার।

ও আচ্ছা-আচ্ছা।

করিম সাহেব খানিকটা বিব্রত বোধ করলেন। এই ছেলে তিন বছর ধরে তার সামনের টেবিলে মাথা গুজে কাজ করছে অথচ তিনি তার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, ব্যাপারটা অন্যায়ই হয়েছে। খুবই অন্যায়।

বাসা ভাড়া করে থাক?

জি স্যার।

ভাড়া কত?

নয় শ টাকা।

বল কি, নয় শ টাকায় বাড়ি হয়?

ছোট বাসা। দুইটা রুম। অনেক ভেতরের দিকে। গ্যাস নাই তাই…..

করিম সাহেব খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, টাকা যা পাও তাতে চলে? চলার তো কথা না।

দুইটা টিউশানি করি।

অফিসের কাজের পরে টিউশানির ধৈর্যও থাকে?

উপায় কি স্যার?

তা ঠিক। উপায় নেই, বাঁচাই মুশকিল। তবু যে মানুষ বেঁচে আছে এইটাই আশ্চর্য।

আমি স্যার যাই।

দাঁড়াও একটু। জি. এম. সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিই।

কোন দরকার ছিল না স্যার।

একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি তো কিছু নেই। তুমি তোমার টেবিলে গিয়ে বস খানিকক্ষণ। কিংবা যাও কেন্টিনে বসে এককাপ চা খাও।

জহির অস্বস্তি নিয়ে কেন্টিনে চলে গেল। অস্বস্তির কারণ হচ্ছে, করিম সাহেব খুবই গচটা ধরনের মানুষ। হঠাৎ-হঠাৎ অসম্ভব রেগে যান। আজ তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, মোজাফফর সাহেবের সাথে একটা ছোটখাট চটচটি হয়েছে। জ্বি এম সাহেবের সঙ্গেও হয় কি না কে জানে। হওয়া বিচিত্র না।

অফিস কেন্টিনে চা ভালো বানায়, কিন্তু আজকেই চা-টা মুখে দেয়া যাচ্ছে না। কেমন একটা বিস্বাদ, তিতকুটে ভাব। জহির সিগারেট ধরাল। সে দরজার দিকে মুখ করে বসেছে, যাতে করিম সাহেবকে আসতে দেখলে চট করে ফেলে দিতে পারে। সিগারেটও ভালো লাগছে না, বরং মাথা ঘুরছে। মেয়ে দেখতে যাবার উত্তেজনায় এরকম লাগছে কি না কে জানে। এই মেয়েটির আগে সে আরো দুজনকে দেখেছে, তখন এরকম অস্বস্তি লাগে নি। আজকের বাড়াবাড়ি উত্তেজনার কারণ হচ্ছে জহিরের মামা বলেছেন, একটা আংটি সাথে করে নিয়ে যাও। পছন্দ হলে বিসমিল্লাহ বলে আংটি পরিয়ে দিলেই হবে। এনগেজমেন্টের যন্ত্রণা মিটে গেল। তবে মেয়ে তোমার পছন্দ হবে। রূপবতী মেয়ে, একটু অবশ্যি রোগা। তাতে কি? আজকালকার মেয়ে সবাই লোগা।

আংটি জহির গতকাল কিনেছে। পাথর বসানো আংটি। এতটুকু একটা জিনিস দাম নিল সাত শ টাকা। রোগা মেয়েদের আঙুলও সরু সরু হয় কি না কে জানে। অবশ্যি না লাগলে অসুবিধা হবে না, দোকানে বলা আছে ওরা বদলে দেবে। জহির পকেট থেকে আংটির বাক্সটি বের করে আবার সঙ্গে সঙ্গে পকেটে ভরে ফেলল। করিম সাহেব হঠাৎ চলে এলে লজ্জায় পড়তে হবে। আচ্ছা আংটিটা আগ বাড়িয়ে কেনা ঠিক হয়েছে কি? যদি মেয়ে পছন্দ না হয়? পছন্দ না-ও তো হতে পারে।

অবশ্যি জহিরের মন বলছে, মেয়ে পছন্দ হবে। এর আগে যে দুজনকে সে দেখেছে তাদেরকে সে পছন্দ করেছে। প্রথম যে মেয়েটাকে দেখল তার নাম আসমা। কী শান্ত নিগ্ধ চেহারা। চায়ের ট্রে নিয়ে খালি পায়ে ঘরে ঢুকেছিল। ঘরে ঢুকবার সময় চৌকাঠে হোঁচট খেল। একটা চায়ের কাপ উলটে গেল। মেয়ের এক চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী যন্ত্রণা চাচার কথা শুনে মেয়েটার মুখ লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জহিরের মনটা মায়ায় ভরে গেল। সে মনে-মনে বলল, আহা বেচারি।

এত পছন্দ হয়েছিল মেয়েটিকে অথচ বিয়ে হল না। কথা বাৰ্তা ঠিকঠাক হবার পর হঠাৎ শুনল মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে সিলেটের চা বাগানের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার। ভালো একটা ছেলে পেয়ে মেয়ের বাবা-মা রাতারাতি বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মাসখানিক জহির খুব কষ্টে কাটিয়েছে। শুধু মেয়েটার কথা মনে পড়ত। তিনবার তাকে স্বপ্নেও দেখল। একটা স্বল্প খুব অদ্ভুত। যেন তাদের বিয়ে হয়েছে। জহির বিয়ের পরদিনই একটা চা বাগানে ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে চলে গেছে। কী আশ্চর্য, একা-একা আসমা সেই চা বাগানে এসে উপস্থিত। জহিরকে দেখে কান্না-কান্না গলায় বলল, তুমি পারলে আমাকে ফেলে চলে আসতে? তুমি এত পাষাণ? জহির হাসতে-হাসতে বলল, কি মুশকিল, আমার কাজ-কর্ম আছে না? চা বাগানের ম্যানেজারির যে কী যন্ত্রণা তা তো তুমি জান না। আসমা এই কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তুমি যদি এই মুহূর্তে সব ছেড়ে আমার সঙ্গে না  আস তাহলে আমি বিষ খাব। এই দেখ, আমার শাড়ির আঁচলে বিষ বাঁধা আছে। স্বপ্নে ব্যাপারগুলো খুব দ্রুত ঘটে। এই স্বপ্নেও তাই হল। আসমা হঠাৎ শাড়ির আঁচল খুলে সবটা বিষ মুখে দিয়ে দিল।

জহির।

জহির চমকে উঠে দাঁড়াল। করিম সাহেব কখন ঘরে এসে ঢুকেছেন সে বুঝতেই পারে নি।

তুমি চলে যাও জহির। গাড়ি পাওয়া যায় নি। কিছু মনে করে না, তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।

জ্বি না স্যার। মনে করার কি আছে।

মনে করার অনেক কিছুই আছে। এখন এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। আচ্ছা। তুমি যাও।

করিম সাহেবের মুখ থমথম করছে। জহিরের অস্বস্তির সীমা রইল না। স্যার নিশ্চয়ই জি, এম, সাহেবের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছেন। ব্যাপারটা ভালো হল না। জহিরের মনে কঠিন একটা কাঁটা বিধে রইল। জি. এম. সাহেব লোক সুবিধার না। করিম সাহেবের সঙ্গে যদি কথা কাটাকাটি হয় তাহলে ব্যাপারটা তিনি সহজে ভুলবেন না। এবং সুযোগ বুঝে শোধ তুলবেন।

আসলে আজকের দিনটিই জহিরের জন্যে খারাপভাবে শুরু হয়েছে। গতরাতে একটা পাউরুটি এনে রেখেছিল, সকালে উঠে চায়ের সঙ্গে খেয়ে নেবে। সকালবেলা দেখা গেল পাউরুটি বাসি। মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিতে হল। মুখে দেয়া যায় না এমন টক।

বাসে আসবার সময় পাঁচটা টাকা শুধু-শুধু চলে গেল। ভাংতি ছিল না বলে কন্ডাকটারকে পাঁচ টাকা দিয়েছে। কন্ডাকটার বলল, লামনের সময় লইবেন। ব্যাপারটা সারাক্ষণই মনে ছিল, অথচ সে নেমে গেল টাকা না নিয়েই। আজকের দিনে আরো কত অঘটন তার জন্যে অপেক্ষা করছে কে জানে। হয়ত মেয়ে দেখে পছন্দ করে আংটি দেবার সময় মেয়ে বলবে, না না, আমি আংটি পরব না। বিচিত্র কিছু না, এমন হতে পারে।

দ্বিতীয় মেয়েটির বেলায় ঠিক এই জিনিস হল। এই মেয়েটিকে সে দেখেছিল বাসাবোতে, তার ফুপার বাসায়। মেয়েকে দেখার আগেই সে তার ছবি দেখেছিল। ছবিতে সে ডোরাকাটা একটা শাড়ি পরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। হাসি-হাসি মুখ তবে চোখ দুটো বিষণ্ণ। বিয়ের পর এই মেয়ে তার পাশে-পাশে থাকবে, তাঁর বাসার রেলিং ধরে ঠিক এই ভঙ্গিতে দাঁড়াবে ভাবতেই কেমন যেন লাগে। জহিরের বাসায় রেলিং নেই, সে ছবি দেখার পর ঠিক করে ফেলেছিল বিয়ের পর রেলিং আছে এমন একটা বাড়িতে সে উঠে যাবে। ভাড়া যদি কিছু বেশি দিতে হয় দেবে। সবসময় টাকাপয়সার কথা ভাবলে তা হয় না।

মেয়েটিকে চাক্ষুষ দেখে তার অবশ্যি একটু মন খারাপ হয়েছিল। সে ছবির মতো সুন্দর না। তবু তাকে ভালো লাগল। জহিরের মনে হল এই মেয়ের মধ্যে মায়া ভাবটা খুব প্রবল। তার হাঁটা, কথা বলা সব কিছুর মধ্যে কোমল একটা ব্যাপার আছে। তাকে দেখে মনে হয় এই মেয়ে কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারে না। তার সেই ক্ষমতাই নেই। অথচ এই মেয়েটিই কি না তাকে অপছন্দ করল। মেয়ের ফুপা জহিরের মামাকে বললেন, সবলতা ঠিকঠাকই ছিল তবে মেয়ে রাজি হচ্ছে না। খুব কান্নাকাটি করছে। মেয়ের মতের বিরুদ্ধে জোর করে কিছু করা ঠিক হবে না।

তার সঙ্গে বিয়ে হতে পারে এই সম্ভাবনাতে একটা মেয়ে খুব কান্নাকাটি করছে। এটা ভাবতেও মন ভেঙে যায়। কয়েক রাত জহির ঘুমুতে পারল না। সে কি এতই নগণ্য, এতই তুচ্ছ? সে একটা ছোট চাকরি করে। তাতে কী? সবাই কি বড় চাকরি করবে? আর চেহারা? তার চেহারা খুব কি খারাপ? তার চেয়ে খারাপ চেহারার ছেলেদেরকে কি মেয়েরা পছন্দ করে বিয়ে করে না?

এই মেয়েটার ছবি জহিরের দ্রুয়ারে এখনো আছে। তার শোবার ঘরের দুনম্বর ডুয়ারে। এই ড্রয়ারে তার দরকারি কাগজপত্রও থাকে। এইসব কাগজপত্র ঘাঁটতে গেলে প্রায়ই ছবিটা তার চোখে পড়ে, তখন বুকের মধ্যে হুহু করতে থাকে। ছবিটার উল্টো পিঠে ইংরেজিতে লেখা নুরুন নাহার। কে জানে, হয়ত মেয়েটা নিজেই লিখেছে। সুন্দর হাতের লেখা। বিয়ে হলে সে তাকে নাহার বলে ডাকতো।

এই নাহার, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।

এই নাহার, জানালাটা একটু বন্ধ করো না, রোদ আসছে।

নাহারের বিয়ে হয়েছে কি-না কে জানে। বিয়ে হয়ে থাকলে তার স্বামী তাকে কি নাহার নামেই ডাকে? এই একটা তুচ্ছ জিনিস কেন জানি জহিরের খুব জানতে ইচ্ছা করে। তার মনে আরেকটা গোপন ইচ্ছাও আছে। একদিন সে নাহারদের বাড়িতে উপস্থিত হবে। নাহার চমকে উঠে বলবে, আপনি কী চান? জহির বলবে, কিছু চাই না। ছবিটা ফেরত দিতে এসেছি। নাহার বিস্মিত হয়ে বলবে, কিসের ছবি?

আপনি রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ছবিটা। আপনার ফুপা আমাকে দিয়েছিলেন।

এই জন্যে কষ্ট করে এসেছেন? ছিঃ ছিঃ। আপনার কাছে থাকলেই হত। ফেরত দেয়ার কোন দরকার ছিল না। আচ্ছা, এনেছেন যখন দিন।

যাই তাহলে।

যাবেন কেন, বসুন। চা খান। আর আপনাকে আরেকটা কথা বলা হয় নি।

কী কথা?

আপনাকে বোধহয় বড় ফুপা বলেছেন যে আমি আপনাকে অপছন্দ করেছি। আসলে তা ঠিক না। আমি আপনাকে খুবই পছন্দ করেছিলাম, ওরাই রাজি হলেন না। মিথ্যা করে আমার নামে দোষ দিয়েছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না।

আমি কিছু মনে করি নি।

এসব কথা ভাবতে জহিরের খুব ভালো লাগে। মাঝে-মাঝে চোখে পানি পর্যন্ত এসে যায়। মনে হয়, সে যা ভাবছে তাই সত্যি, আশেপাশের পৃথিবীটা সত্যি নয়।

দুপুর তিনটার দিকে জহির ঝিকাতলায় তার মামার বাসার সামনে উপস্থিত। জহিরের সঙ্গে তার মামা বদরুল সাহেবও যাবেন। তাদের যাবার কথা পাঁচটার দিকে। দুঘন্টা আগে চলে আসায় জহিরের কেমন লজা-লজ্জা লাগছে। তারা কী ভাববে, কে জানে। আরো কিছুক্ষণ পরে এলে কেমন হয়? কোন একটা চায়ের দোকানে ঘন্টাখানিক কাটিয়ে আসা যায় না? সেটাই ভালো। জহির বসবার ঘরের বারান্দা থেকে চুপিচুপি নেমে গেল।

বসবার ঘরের জানালার পাশে তরু দাঁড়িয়েছিল। তরু বদরুল সাহেবের মেজো মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে এইবার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। বোটানিতে অনার্স। আজ তাদের একজন স্যার মারা যাওয়ায় ইউনিভার্সিটি একটার সময় ছুটি হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল আরাম করে দুপুরে ঘুমুবে। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকেও ঘুম না আসায় সে বসার ঘরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। ভাগ্যিস দাঁড়িয়েছিল। না দাঁড়ালে এই অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেত না। জহির ভাই কেমন ঘামতে-ঘামতে এলেন। দরজার কড়া নাড়তে গিয়েও না নেড়ে কেমন চুপিচুপি নেমে গেলেন। যেন বিরাট একটা অপরাধ করেছেন। আশ্চর্য কাণ্ড, জহির ভাইকে দেখা গেল রাস্তার ওপাশে বিসমিল্লাহ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকছেন। তরু ভেবেছিল ঢুকেই বোধহয় বের হয়ে আসবেন। সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। জহির ভাই বেরুলেন না। তরুর খুব ইচ্ছা করছে ঐ রেস্টুরেন্টে উঁকি দিয়ে দেখে ব্যাপারটা কি। ইচ্ছা করলেও যাওয়া যাবে না। ঐ রেস্টুরেন্টটা হচ্ছে বখা ছেলেদের আড্ডা। ঐসব বখাদের একজনের গানের গলা আবার খুব ভালো! স্কুল-কলেজের মেয়েরা সামনে দিয়ে গেলেই সেই বখা গায়ক গান ধরে—ও চেংড়ি চেংড়ি রে, ফিরে-ফিরে তাকায় রে। বড় সুন্দর দেখায় রো দল বেঁধে মেয়েরা যখন যায় তখন এই গান উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু একা-একা যাবার সময় গান শুনলে দুঃখে-কষ্টে চোখে পানি এসে যায়। বখাগুলো দুপুরবেলা দুটা টেবিল একত্র করে তাস খেলে। জহির ভাই ঐ বখাগুলোর সঙ্গে কী করছে? তরুর মন অস্বস্তিতে ভরে গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ