ডানে যেতে হবে, রবিন বলল। ভাল করে দেখে রেখেছি আমি।

তা তো বুঝলাম,  কিশোর বলল। কিন্তু দরজা তো দুটো। কোনটায় টোকা দেব?

প্রথম দরজাটায় গিয়ে কান পাতল মুসা। রেডিও বাজছে, জানাল সে।

পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎ মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনতে পেল। দরজার একেবারে কাছে। চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল।

জন, তোমার ওষুধ রাখলে কোথায়? বৃদ্ধার কাপা কাঁপা কণ্ঠ। টেবিলেই রেখেছিলে? ঠিক মনে আছে?

এ ঘরে থাকবে না, ফিসফিস করে বলল কিশোর। সরে এসে দ্বিতীয় দরজাটায় গিয়ে কান রাখল মুসা। খানিকক্ষণ কান লাগিয়ে রেখে জানাল, কোন শব্দই আসছে না।

তারমানে আছে এটাতেই, মাথা দোলাল রবিন। হয়তো ভয় পাচ্ছে কিডন্যাপকারীরা ফিরে আসবে আবার। আলো নিভিয়ে চুপ করে আছে।

বেল বাজালেই বোঝা যাবে, কিশোর বলল। এমন করে হাতে নিল পোশাকটা, যাতে শুরুতেউ লোকটার চোখে পড়ে। তারপর টিপে দিলু বেলপুশ।

তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠল বেল।যেকোন মুহূর্তে খুলে যেতে পারে এখন।

কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া বা কোন রকম শব্দ এল না।।

রবিন, এ তলাটাই তো? মুসার প্রশ্ন। ভুল হয়নি তোমার?

আবার বেল টিপল কিশোর। আবার শোনা গেল বেলের শব্দ।

বাজাতেই থাকো, রবিন বলল। থেমো না। দেখা যাক কতক্ষণ না খুলে থাকতে পারে। ঘণ্টা বাজানো থামাতে হলে দরজা তাকে খুলতেই হবে। ও এই ঘরেই আছে।

হাসল কিশোর। রবিনের পরামর্শটা পছন্দ হয়েছে তার। বাজাতেই থাকল।

অন্তত বিশবার বাজানোর পর দরজার ওপাশে হুক থেকে শিকল খোলার শব্দ পাওয়া গেল।

বললাম না আছে,উত্তেজিত স্বরে রবিন বলল। টিপতে থাকো।

অবশেষে, খুব ধীরে সামান্য ফাঁক হলো দরজা। দেখা গেল ওকে। কিশোর ভেবেছিল রেগে যাবে। কিন্তু শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল তরুণ, কি ব্যাপার?

কিশোর জবাব দেবার আগেই তার হাতের ফাদার ক্রিস্টমাস পোশাকটা দেখে ফেলল সে। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। দ্রু নড়ে উঠল সে। এগিয়ে এসে একটানে পোশাকটা কিশোরের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মুহূর্তে লাগিয়ে দিতে গেল আবার দরজা।

কিন্তু তৈরি ছিল কিশোর। চোখের পলকে পাটা ঠেলে দিল দরজার ভেতরে।

পায়ে শক্ত জুতো ছিল বলে রক্ষা। নইলে পাল্লার চাপে প্রচন্ড ব্যথা পেত।

মরিয়া হয়ে আবার দরজা লাগানোর চেষ্টা করল ফাদার ক্রিস্টমাস।

সরো! চিৎকার করে উঠল সে। সরে যাও দরজার সামনে থেকে। ভাগো!

এর একটা ব্যাখ্যা না শুনে যাচ্ছি না আমরা, জবাব দিল কিশোর।

সব জানি আমরা, মুসা বলল।

কি জানো তোমরা? রেগে উঠল ফাদার ক্রিসমাস।ভাল চাও তো যাও বলে দিচ্ছি।

আমাদের আপনি ভয় দেখাতে পারবেন না, জবাব দিল কিশোর। নিচে আমাদের বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। বলে দিয়ে এসেছি দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ফিরে না গেলে ওরা যেন পুলিশের কাছে চলে যায়।

পুলিশ! চমকে গেল ফাদার ক্রিস্টমাস।

অসুবিধে কি? ভুরু নাচাল কিশোর। জাল মুদ্রা পাচার, কিডন্যাপিং-আরও কি কি করছেন সেটা আপনারাই ভাল জানেন। আমার ধারণা, বিশ বছরের কমে জেল থেকে বেরোতে পারবেন না।

হ্যাঁ, ঠিক, মাথা ঝাকাল রবিন, ততদিনে বুড়ো হয়ে যাবেন। চান সেটা?

ফ্যাকাসে হয়ে গেল ফাদার ক্রিস্টমাসের চেহারা। মনে মনে হাসল কিশোর।

ধাপ্পাতে কাজ হয়েছে।

এই সময় লিফটের শব্দ কানে এল। ওপরতলায় উঠে আসছে।

এসো। ভেতরে চলে এসো, জলদি! গোয়েন্দাদের বলে আবার দরজা ফাঁক করে দিল ফাদার ক্রিস্টমাস। বোঝা গেল, পড়শীদের দেখতে দিতে চায় না।

কিশোররা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর জানতে চাইল ওরা কেন এসেছে। আধঘণ্টার মধ্যেই আমার বাবা-মা চলে আসবে। তোমাদের দেখলে খুশি হবে না।

ঠিক আছে কিশোর বলল, তার আগেই চলে যাব আমরা। অবশ্য যদি আমাদের বলেন, কেন করছেন এ কাজ।

কি কাজ করছি বলব? তোমাদের কথা কিছু বুঝতে পারছি না আমি, জবাব দিল ফাদার ক্রিস্টমাস।

সত্যি বলছে! না ভান?

পারছেন না মানে? রেগে উঠল মুসা। জাল কয়েন পাচার করে বেড়াচ্ছেন আর এখন বলছেন কিছু জানেন না? ওসব চালাকি বাদ দিন!

জাল কয়েন? কি বলছ? আমার কাছে কোন জাল কয়েন নেই।

তাহলে এগুলো কি? পকেট থেকে দুটো মুদ্ৰা বের করে দেখাল কিশোর আজ বিকেলে এগুলো আমাকে দিয়েছে আপনার দোস্ত।

আমি বিশ্বাস করি না।

তাহলে শুনুন কি ঘটেছে, কিশোর বলল, বিকেল বেলা তাকে গিয়ে একটা ডলার দিয়ে ভাঙতি চাইলাম। বানিয়ে বানিয়ে বললাম, আমার বোনকে পঞ্চাশ পেল দেব একটা কার্ড কেনার জন্যে। মাকে উপহার দেব। শুনতে পাননি? কাছেই তো ছিলেন

হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে, জবাব দিল লোকটা। কিন্তু ওগুলো জাল, কে বলল তোমাকে?

কয়েন দুটো লোকটার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা বাড়ি দিয়ে শব্দ করল কিশোর। শুনুন শব্দটা। কি মনে হচ্ছে? স্বাভাবিক।

এখনও বিশ্বাস না হলে আরও ভালমত প্রমাণ করে দিতে পারি, রবিন বলল। একটা লোহাকাটা করাত নিয়ে আসুন। কাটলেই দেখতে পাবেন ভেতরে কি আছে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম, হাল ছেড়ে দিল লোকটা। করতাম না। কিন্তু যা সব কাও ঘটতে আরম্ভ করেছে, জাল কয়েন হলে আর অবাক হওয়ার কি আছে।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। হাতে রয়ে গেছে এখনও ফাদার ক্রিস্টমাসের পোশাকটা। হয়তো তোমাদের কথাই ঠিক, বলল সে। খানিক আগে আমাদের ওপর কেন হামলা চালিয়েছিল লোকগুলো, এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ এমন ভাবে আক্রমণ করে বসল…. ভাবতেই পারিনি….

আসলে কির্ডন্যাপ করতে চেয়েছিল আপনাদের, রবিন বললু। দুজনকেই।

আপনি পালিয়ে আসাতে বেঁচে গেছেন। আপনার বন্ধুকে কোথায় নিয়ে গেল ওরা, কিছু আন্দাজ করতে পারেন?

জানলে কি আর এখানে বসে থাকতাম মনে করেছ? জবাব দিল লোকটা।

টাকার ব্যাপারটা কি বলুন তো? পঞ্চাশ পেন্সের জাল মুদ্রা কোত্থেকে আসছে? জানতে চাইল কিশোর.

কাস্টোমারদের দেয়ার জন্যে প্রচুর ভাঙতি রাখতে হয় আমাদের, লোকটা জানাল। ছবি তুলে অনেকেই দুই ডলার দেয়। এক ডলার দশ পেন্স রেখে বাকিটা ভাঙতি দিতে হয়। কয়েন রাখা ছাড়া উপায় কি। কিন্তু আমরা জাল কয়েন পাচার করছি এ ধারণা হলো কি করে তোমাদের?

আপনি নাহয় রাখেন না, লোকটার প্রশ্নের জবাব দিল না কিশোর। কিন্তু আপনার বন্ধু?

তার কথা তাকেই জিজ্ঞেস কোরো, বিষন্ন কষ্ঠে জবাব দিল লোকটা।

প্রশ্ন খুঁজে পেল না আর কিশোর। রহস্যটা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।

রবিন আর মুসাও বুঝতে পারছে না আর কি প্রশ্ন করা যায়। আগুপিছু বিবেচনা না করে হুট করে লোকটাকে অভিযুক্ত করে বসায় লজ্জা পাচ্ছে এখন তিনজনেই। মনে হচ্ছে, দুই ফাদার ক্রিস্টমাস-যাদেরকে ওরা সন্দেহ করেছে, দুজনেই নির্দোষ

বুঝতে পেরেছি! ওদেরকে চমকে দিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল লোকটা।

চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে, একসঙ্গে সব বলতে গিয়ে কথাই বেরোতে চাইল না।

শান্ত থেকে ধীরেসুস্থে বলার অনুরোধ করল তাকে কিশোর।

পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা, না? গত হপ্তায় বনের মধ্যে কি পেয়েছি, কল্পনাও করতে পারবে না। বনের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ডগলাস ফার্মের দিকে। সেই রাস্তার এক জায়গায় দেখি অনেকগুলো কয়েন পড়ে আছে। রাস্তার ধারে ঘাসের মধ্যে। তুলে নিলাম ওগুলো। তারমানে ওগুলোই ছিল তোমাদের এই জাল মুদ্রা। আমরা কল্পনাই করতে পারিনি। কে হারিয়েছে সে-খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করিনি। পরের দিন হেনরির দোকানে কাজে গেলাম। কুড়িয়ে পাওয়া পয়সাগুলো দিয়ে লোকের ভাঙতি শোধ করতে লাগলাম।

আমরা মানে কে কে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আমি আর আমার বন্ধু টনি। একটু আগে যাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

দম নেয়ার জন্যে থামল সে। তারপর বলল, আমার নাম রোভার।….এখন বুঝতে পারছ তো, কোনও ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই আমরা?

পয়সাগুলো পুলিশকে দিয়ে আসা উচিত ছিল আপনাদের, গম্ভীর মুখে কিশোর বলল। তাহলে আজকে আর এই ঝামেলার মধ্যে পড়তে হত না।

জানি! কিন্তু নিজেকে আমাদের জায়গায় কল্পনা করলেই আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পারবে। রোভার বলল। খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। আমরা ছাত্র। বড়দিনের এই ছুটিতে কাজ করছি কলেজে পড়ার টাকা রোজগারের জন্যে। খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্যে আমাদের ভাড়া করেছে হেনরি।

ছবি তোলার টাকার লাভ সে নেয় না, সব আমরাই পাই। কাজেই সব খরচ খরচাও আমাদের। ফিল্মমের দাম, দামী ক্যামেরার ভাড়া ইত্যাদির খরচ মিটানোর পর লাভ খুব কমই থাকে আমাদের।

টাকার দরকার কার না আছে? রোভারের এ সব কৈফিয়তে মন ভিজল না মুসার। তাই বলে রাস্তায় পাওয়া টাকা তুলে নিতে হবে? ক্ষতি যা করার করে ফেলেছেন। এখন পস্তানো তো লাগবেই।

চুপ করে রইল রোভার।

কিশোর বলল, আমরা এখনও জানি না ওই মুদ্রাগুলো এল কোত্থেকে? ওগুলোর সঙ্গে গালকাটা লোকটার সম্পর্ক কি?

গালকাটা? বোকা হয়ে তাকিয়ে রইল রোভার।

যে লোকটা আপনার বন্ধু টনিকে কিডন্যাপ করেছে। যে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল হেনরির দোকানের সামনে যতই শুনছে, বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছে রোভার। জিজ্ঞেস করল, রহস্যটার সন্ধান অনেক আগেই পেয়েছ মনে হচ্ছে?

মাত্র গতকাল, জবাব দিল কিশোর।

দেখো, একটা অনুরোধ করব, কাতর কণ্ঠে বলল রোভার, দয়া করে পুলিশের কাছে যেয়ো না। গেলে হয়তো টনির সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ঠিক আছে, যাব না, কথা দিল কিশোর। আমরা নিজেরাই এটা সমাধানের চেষ্টা করব।

কিন্তু বাড়ি ফিরে না গেলে টনির বাবা-মা যদি পুলিশে খবর দেন? প্রশ্ন তুলল মুসা।

তুলবে না, রোভার বলল। কারণ ওরা এখানে নেই। ছুটি কাটাতে চলে গেছে হলিডে কটেজে। হেনরির দোকানে আমাদের ক্রিস্টমাস ইভের কাজ শেষ হয়ে গেলে টনিও চলে যাবে।..তা তোমরা এখন কি করার কথা ভাবছ?

রীতিমত অসহায় বোধ করছে এখন রোভার। কাচুমাচু ভঙ্গিতেই বোঝা যায়।

কয়েনগুলো যেখানে পেয়েছেন আপনারা, প্রথমে সেখানে যাব, কিশোর বলল। আকাশ থেকে তো আর পড়েনি ওগুলো। কোন না কোন সূত্র পেয়েই যাব জায়গামত যেতে পারলে।

হুঁ, উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে চোয়াল ডলল রোভার। কাল যে কি হবে বুঝতে পারছি না।টনিকে ছাড়া হেনরির দোকানের কাজটা চালাব কি করে? হেনরির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে-বড় দিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার ওখানে কাজ করব আমরা। কলি যদি দুজনের একজন হাজির হতে না পারি, কি বলবে সে?

সেটা নিয়ে ভাববেন না, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর। টনির বদলে আমাদের কাউকে দিয়ে দেব। রবিন যেতে পারে।

রবিন। ভুরু কুঁচকে ফেলল রোভার।

কিশোরের কথা শুনে মুসা আর রবিনও চমকে গেল।

হ্যাঁ, আমার এই বন্ধুটি, রবিনকে দেখাল কিশোর। টনির চেয়ে সামান্য খাটো হবে। হাই হিল জুতো পরে নিলেই লম্বা হয়ে যাবে অনেকটা। বাকিটা পরণ করে নেবে ফাদার ক্রিসমাসের পোশাক দিয়ে।আলখেল্লা আর দাঁড়ি-গোঁফের আড়ালে কেউ চিনতে পারবে না ওকে।

সত্যিই পারবে না, মুসা বলল।

আমি কি তোমাদের তদন্তে কোন সাহায্য করতে পারি? জিজ্ঞেস করল রোভার।

আপাতত লাগবে না, কিশোর বলল। আপনি বরং খেয়েদেয়ে শান্তিতে একটা ঘুম দিন। তাজা না হয়ে কাল সকালে চাকরিতে যেতে পারবেন না।

রোভারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, তাকে গুড নাইট জানিয়ে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।

বেরোনোর আগে দরজার কাছ থেকে রবিন বলল, কাল সকালে দেখা হবে।

সকাল সাড়ে আটটায় আপনার এখানে চলে আসব আমি। ফাদার ক্রিস্টমাস সেজে আপনার সঙ্গে দোকানে যাব।

আহ, বাঁচালে আমাকে, ভাই! অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদেরকে, কৃতজ্ঞ স্বরে বলল রোভার। তোমরা না এলে কি যে করতাম!

কথা শেষ। ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লিফটের কাছে ওদেরকে এগিয়ে দিয়ে গেল রোভার।

ভাবছি, লিফটে করে গ্রাউন্ড ফোরে নামতে নামতে বিড়বিড় করল কিশোর, আগামী কাল কি ঘটবে?

<

Super User