বাসে করে বিকেল চারটের সময় এসে ডগলাসের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে নামল ওরা। বড় দিনের সময় এখন, সকালে যেমন ক্রেতার ভিড় ছিল, বিকেল বেলাও একই রকম ভিড়।

ওই যে ওরা!, উত্তেজিত ভঙ্গিতে দুই ফাদার ক্রিস্টমাসকে দেখাল বব।

এ ভাবে চেঁচিও না, সাবধান করল কিশোর। এসো আমার সঙ্গে।

সবাইকে নিয়ে চলে এল এক ক্রিস্টমাস ট্রী বিক্রেতার দোকানের কাছে। তৈরি

করা ক্রিস্টমাস গাছের ছোটখাট একটা জঙ্গল হয়ে আছে। তার আড়ালে এসে

দাড়াল ওরা কি করা যায় পরামর্শ করার জন্যে।

ওই যে ওই লোকটা জুলিয়ার ছবি তুলেছিল, গাছের ফাঁক দিয়ে হাত তুলে

দেখাল বব।

সাথে পিস্তল-টিস্তল নেই তো? অনিতা বলল।

হ্যাঁ, তা তো আছেই, মুসা বলল। দাড়ির মধ্যে লুকানো।

বাজে কথা একদম বলবে না আমার সঙ্গে! রেগে উঠল অনিতা। ছাগল

পেয়েছ নাকি আমাকে কিছু বুঝি না মনে করেছ?

চুপ করে থাকা কিংবা আস্তে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠল সে।

চুপ! আস্তে। ধমক লাগাল কিশোর। কাজের কথা শোনো এখন, সমস্ত

বিকেল এখানে দাড়িয়ে থাকার জন্যে আসিনি আমরা। কিছু করতে হবে। ভাগ

ভাগ হয়ে যাব। তোমরা গিয়ে দাঁড়াও উল্টোদিকের ওই চত্বরটাতে। খবরের

কাগজের স্ট্যান্ডটার অাড়ালে দাড়াবে, ওরা যাতে দেখতে না পায়। সাথে করে

টিটুকে নিয়ে যাও। ফারিহা আর ডলিকে নিয়ে আমি যাচ্ছি দোকানের কাছে,

জানালা দিয়ে চোখ রাখব লোকগুলোর ওপর।

বলার পর আর এক মুহূর্তও দেরি করল না কেউ। ঘুরতে বেরোনো অতি

সাধারণ কয়েকটা ছেলের মত ভঙ্গি করে রইল ওরা। যার যার জায়গায় থেকে

নজর রাখতে লাগল ফাদার ক্রিস্টমাসদের ওপর।

অন্য দোকানের ফাদারদের মতই এই দুজনও স্বাভাবিক আচরণ করছে।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ছবি তোলার জন্যে অনুরোধ করছে তাদের বাবা-মাকে। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করছে। চওড়া হাসি হাসছে তুলার তৈরি দাড়ি-গোঁফের আড়াল থেকে।

নাহ, কোন কিছুই সন্দেহ করার মত নয়, চাপা স্বরে মুসাকে বলল রবিন।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। সে-রকমই তো লাগছে। আসার সঙ্গে সঙ্গে

এত তাড়াতাড়ি কিছু একটা দেখে ফেলব, সে-আশাও আমি অবশ্য করছি না। তা ছাড়া কিশোর তো বললোই ফাদারদের কোন দোষ না-ও থাকতে পারে; হতে পারে। ওদের অজান্তেই ওদের হাত দিয়ে হয়তো কেউ পাচার করে দিচ্ছে নকল মুদ্রাগুলো।

হ্যাঁ, তা পারে, কিছুটা হতাশ কণ্ঠেই জবাব দিল রবিন। আর ববের আম্মা

যে কয়েনটা ববকে দিয়েছেন, সেটাও ফাদারদের কাছ থেকেই পাওয়া, সেটাও

তো ঠিক না হতে পারে। বাজার করেছেন। আরও অনেকে পঞ্চাশ পেন্সের কয়েন তাকে দিয়ে থাকতে পারে।

কিশোররা তখন দোকানের বাইরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে।

ভঙ্গিটা যেন দোকানের উইন্ডোতে সাজানো খেলনা আর অন্যান্য জিনিস দেখছে।

রাস্তার দিকে পেছন করে আছে, উইন্ডোর কাছে দাঁড়ানো অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মত। উইভোর কাচে চত্বরের লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাদেরকে দেখছে ওরা। ফাদার ক্রিস্টমাসদেরও দেখা যাচ্ছে, কাজেই ওই দুজনকে দেখার জন্যেও সরাসরি তাকানো লাগছে না ওদের।

দুই ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় দাড়িয়ে থাকল ফারিহা আর ডলি। বাজার

করতে আসা ছেলেমেয়েরা দোকানে ঢুকছে বেরোচ্ছে, উত্তেজিত কলরব করছে। অস্বাভাবিক কোন কিছুই চোখে পড়ল না ওদের। কিছুই করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে গেল টিটু। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘটনাটা ঘটল তখনই। তার থাবা মাড়িয়ে দিল একজন লোক। চিৎকার দিয়ে উঠল টিটু।

প্রায় একই সময়ে চিৎকার দিয়ে ববের হাত খামচে ধরল অনিতাও।

আরে কি করছ। হাতে নখ বসে যেতে চেচিয়ে উঠল বব।

স্বপ্ন দেখছি নাকি আমি! অনিতা বলল।

তা কি করে বলব? কিন্তু আমার হাতের চামড়া যে তুলে দিচ্ছ এটা ঠিক।

ওই যে লোকটা-কালো ওভারকোট পরা, ববের কথা যেন কানেই যায়নি

অনিতার, রাস্তা পার হয়ে গেল এইমাত্র-দেখলে না?

কাচের দিকে এমন করে তাকাতে লাগল বব, যেন পারলে কাচ থেকে খামচি দিয়ে বের করে আনে লোকটাকে। কালো কোট পরা একজন লোককে চত্বর থেকে নেমে যেতে দেখল সে-ও।

ওই লোকটাকেই দেখেছিলাম আমি বেকারিতে, গালে কাটা দাগ, উত্তেজিত

স্বরে বলল অনিতা। ও গিয়ে কথা বলেছিল ফাদার ক্রিস্টমাসদের সঙ্গে। বুঝতে পারছি না কি ঘটবে এখন!

উত্তেজনায় টানটান হয়ে কাচের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। আশেপাশে

ঘোরাফেরা করছে ছেলেমেয়ের দল, হই-চই হাসাহাসি করছে: কোন কিছুই যেন

কানে ঢুকছে না বব বা অনিতার।

কই, কিছুই তো করছে না! হতাশ কষ্ঠে বলল বব। লোকটা থামছে না।

রাস্তার ধার দিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছে।

আরে না না! হঠাৎ দম আটকে ফেলল অনিতা। দেখো, কি করছে–যুরে

গেল…এগিয়ে যাচ্ছে সিড়ির দিকে!.-আরে, কি কাণ্ড!

জোরে চিৎকার দিয়ে নিজের অজান্তেই ঘুরে সরাসরি তাকিয়ে ফেলল লোকটার দিকে। তার চিৎকার শুনে অন্য ছেলেমেয়েরাও ফিরে তাকাল। হাসির রোল উঠল। চত্বরে লম্বা হয়ে পড়ে গেছে কোটওয়ালা লোকটা। সঙ্গে নিয়ে পড়েছে একজন ফাদার ক্রিস্টমাসকে।

আরি দেখো না অবস্থা বব বলল। চত্বরে কয়েনের ছড়াছড়ি। ফাদারের

পকেট থেকে পড়েছে। কম করে হলেও দশটা পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা আছে ওর

মধ্যে।

প্রায় ছোঁ দিয়ে দিয়ে পঞ্চাশ পেন্সের কয়েকটা মুদ্রা তুলে নিল কোটওয়ালা

লোকটা।

চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে উঠে বসল ফাদার ক্রিস্টমাস। ছড়িয়ে থাকা পয়সাগুলো তুলে তুলে পকেটে ভরতে শুরু করল। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল ছেলেমেয়েরা। এই হট্টগোলের মধ্যে সবার অলক্ষে উধাও হয়ে গেল কোটওয়ালা লোকটা।

আপনাআপনি পড়েনি ফাদার, বব বলল। তাকে ফেলে দিয়েছে

কোটওয়ালা লোকটা। পঞ্চাশ পেন্সের কয়েনগুলো হাতানোর জন্যে।

আমারও তাই ধারণা, অনিতা বলল।

কিশোর, ফারিহা আর ডলি পুরো ঘটনাটাই ঘটতে দেখেছে। ওরাও পড়ে

যেতে দেখেছে কোটওয়ালা লোকটাকে, দেখেছে তার গালের কাটা দাগ।

গতকালের বেকারির সেই লোকটা বলেই তাকে চিহ্নিত করেছে ডলি।

কয়েকটা কয়েন তুলে নিয়ে গেছে সে! ঘন ঘন দম নিতে নিতে বলল ডলি। চট করে পঞ্চাশ পেন্সের কয়েনগুলো তুলে পকেটে ভরে ফেলেছে।

তারমানে আমাদের মত একই ব্যাপারে তারও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, কিশোর বলল। গুড। তারমানে সত্যি সত্যি এগোনো শুরু করেছি আমরা।

কিন্ত লোকটা গোয়েন্দা না জালিয়াত? ফিসফিস করে বলল ফারিহা।

জানি না, জবাব দিল কিশোর। তবে একটা ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই

আমার, ওই দুজন ফাদার ক্রিস্টমাসের মধ্যে গোলমেলে কিছু একটা রয়েছে।

আমি ভাবছি পড়ে যাওয়া পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রাগুলো আসল ছিল, না নকল, ডলির প্রশ্ন।

জেনে নিলেই তো পারি, কিশোর বলল। পকেট থেকে টাকা বের করে দিল ফারিহাকে। ফারিহা এই নাও দুই ডলার। একটা ছবি তুলে এসোগে ফাদার ক্রিস্টমাসদের সঙ্গে।

আমি! আঁতকে উঠল ফারিহা।

অসুবিধে কি? কিশোর বলল। ফাদারদের পয়সা দরকার। তোমার ছবি

তুললে পয়সা পাবে। তুলবে না কেন? তা ছাড়া তোমাকে মানাবেও। কারণ তুমি এখনও ছোট আছ। অামি তুলতে গেলে মানাবে না।

বাচ্চাদের মত করে কোলের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একজন

ফাদার ক্রিস্টমাস, আরেকজন তার ছবি তুলছে-দৃশ্যটা কল্পনা করেই হেসে ফেলল ডলি। কিন্তু ফারিহা হাসল না। ফাদার ক্রিস্টমাসদের সঙ্গে ছবি তুলতে মোটেও ভাল লাগছে না তার। কিন্তু উপায় নেই। গোয়েন্দাগিরিতে অত বাছবিচার করলে চলে না। অনিচ্ছা সত্তেও মুখে হাসি ফুটিয়ে ছবি তুলতে গেল সে।

উল্টো দিকের উইনডোতে দাড়িয়ে ফারিহাকে ফাদার ক্রিস্টমাসদের দিকে

এগিয়ে যেতে দেখল বব আর অনিতা। টিটু ওকে দেখেই ছুটে যাওয়ার জন্যে

টানাটানি শুরু করল। এক জায়গায় বসে থেকে মহা বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে।

ফারিহাকে ফাদারদের সঙ্গে ছবি তুলতে দেখে কাগজের স্ট্যাভের ওপাশে

দাড়িয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না মুসা আর রবিন। কয়েক

মিনিটের মধ্যেই ফারিহার হাতে তার ছবিটা ধরিয়ে দেয়া হলো

টাকা বের করে দিল ফারিহা।

আড়ালে দাড়িয়ে একজন ফাদার ক্রিস্টমাসের হাত থেকে ফারিহাকে ভাঙতি পয়সা নিতে দেখল গোয়েন্দারা সবাই।

বেচারি ফারিহা!আষাঢ়ের আকাশের মত মুখ কালো করে তাকে ফিরে

আসতে দেখল ওরা। কাছে এসে কিশোরকে জানাল সে, একটা পঞ্চাশ পেন্সের কয়েনও দেয়নি।

হুঁ, মোটেও হতাশ মনে হলো না কিশোরকে। যাই, দেখি, আমার ভাগ্যটা

পরীক্ষা করে আসি।

দোকান থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। খানিক আগে পড়ে গিয়েছিল যে

লোকটা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা ডলার বের করে বাড়িয়ে।দিয়ে অনুরোধ করল সে, আমাকে দুটো পঞ্চাশ পেন্সের কয়েন দিতে পারেন? আমার ছোট বোনকে পঞ্চাশটা পেন্স দিতে হবে কার্ড কেনার জন্যে। আমার কাছে

ভাঙতি নেই।

নিশ্চয়ই, হাসিমুখে জবাব দিল ফাদার ক্রিস্টমাস। পকেট থেকে খুচরা বের করে কিশোরকে দিয়ে দিল। কিশোর সে-দুটো পকেটে ভরে, লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ফিরে এল দোকানের ভেতর।

ডলি আর ফারিহার কাছে এসে মুদ্রা দুটো বের করে বাজিয়ে শোনাল ডলি আর ফারিহাকে। নিজেও শুনল। তারপর বলল, শুনলে তো? আরও দুটো নকল কয়েন।

<

Super User