আমাদের কার্ড তাহলে কোথায় দেখল সে? মুসার প্রশ্ন।

দেখেনি, রবিন বলল। নিশ্চয় শুঁটকি বলেছে।

মনে হয় না, জোর দিয়ে বলল কিশোর। শুঁটকির কাছে যাওয়ার আগেই আমাদের কথা জেনেছে সে, আমি শিওর। আর শুঁটকি আমাদের সুনাম কিছুতেই করবে না, হিসুংক নাম্বার ওয়ান। তাছাড়া ওর কাছে শুনে থাকলে সেকথা বলত টনি।

কিন্তু বলেনি, বুঝতে শুরু করেছে রবিন। আমরা তিন গোয়েন্দা, জেনেও চুপ থেকেছে। আমরা বলার আগে মুখেও আনেনি।  তারমানে, মুসা বলল, বলতে চাইছ, আগেই জেনেছে। অথচ জানে যে সেটা জানাতে চায়নি?

কিন্তু কেন? প্রশ্ন করল রবিন। আমাদের কার্ড দেখেও না বলার কি কারণ থাকতে পারে?

একটাই কারণ, ভেবেচিন্তে বলল কিশোর। এমন কোন উপায়ে জেনেছে, যেটা আমাদের বলা উচিত মনে করছে না। আচ্ছা, তোমাদের কার্ডগুলো গুণে দেখো তো? কার পকেটে কটা রেখেছিল?

সঙ্গে কয়েকটা করে কার্ড রাখে তিনজনেই। বের করে গুণে দেখল মুসা আর রবিন।

আমার একটা কম, বলল মুসা। কালও দেখেছি, পাচটা ছিল।

কাল কখন?

সকালে।

রাতে ফেলেছ তাহলে। পেদ্রোজ এস্টেটের গেটের কাছে। পকেট থেকে রুমাল বের করেছিলে পুতুল জড়ানোর জন্যে, তখনই টান লেগে পড়েছে, বলল রবিন।

এবং টনি সেটা পেয়েছে, কিশোর যোগ করল। হয়তো রাতেই গেটের কাছে এসেছিল সে। যেহেতু বলছে না…।

খাইছে। বাধা দিল মুসা। সে-ই পুতুল চুরি করেছিল ভারছ?

অসম্ভব কি?

কিন্তু, কিশোর, রবিন বলল, সে-ই যদি চুরি করবে, আমাদের সাহায্য চাইতে এল কেন? চাপাচাপি করে সে-ই তো তার দাদীকে রাজি করাল, আমাদের সাহায্য নেয়ার জন্যে।

চাপাচাপি খুব বেশি করেছে, বলল কিশোর, সেটাই সন্দেহজনক। ওর হয়তো ধারণা, পুতুলটা আমাদের কাছে আছে। ফেরত চায়। পুরস্কারের লোভ দেখিয়েছে সে-জন্যেই।

তাতে তার কি লাভ? পুতুল পেলে তো আমরা নিয়ে দেব মিস পেদ্রোর কাছে। আমাদের কাছে সরাসরি চাইলেই পারত। পারত না?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল দু-বার কিশোর। এই প্রশ্নটাই খোঁচাচ্ছে আমাকে। দুটো ব্যাপার শিওর। এক, পুতুলটা ফেরত চায় টনি। দুই, দরকার হলে, ওটার যা বাজারদর, তার চেয়ে বেশি দিতে রাজি।

কিন্তু হারিয়ে বসে আছি আমরা, গুঙিয়ে উঠল মুসা ফেরত পাওয়ারও কোন আশা নেই।

হয়তো আছে, সহজে নিরাশ হওয়ার ছেলে নয় কিশোর। চুরি হওয়ার পর থেকেই ভাবছি, কি করে আবার ফেরত আনব। লোকটার যা চেহারা আর পোশাক-আশাক, রকি বীচে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না। ভূত-থেকেভূতের সাহায্য নেব আমরা।

ঠিক, তুড়ি বাজাল মুসা।

হ্যাঁ, কটা ছেলেমেয়ের চোখ ফাঁকি দেবে? রবিন বলল।

তাড়াতাড়ি করা দরকার, বলল কিশোর। এসো, মালগুলো গুছিয়ে নিই। বোরিস একা পারছে না।

এক ঘণ্টার মধ্যেই পছন্দসই জিনিসগুলো আলাদা করা হয়ে গেল, প্রতিটির লিস্ট করে নিয়েছে কিশোর। ফিরে চলল ইয়ার্ডে।

লিস্ট দেখে খুব খুশি হলেন মেরিচাচী। কোনটার দাম কত হতে পারে, তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলেন। এখানে আর কিছু করার নেই। হেডকোয়ার্টারে চলল তিন গোয়েন্দা।

পুতুল ছিনতাইকারী আর তার সঙ্গীর চেহারার বর্ণনা নিখুঁতভাবে লিখে নিল কিশোর। তারপর এক এক করে ফোন শুরু করল তার পাঁচজন বন্ধুকে। লোকগুলো আর ঝরঝরে গাড়িটার কোন খবর পেলে জানাতে অনুরোধ করে রিসিভার তুলে দিল মুসার হাতে। সে ফোন করল তার পাঁচ বন্ধুকে। তারপর রবিন করল তার পাঁচ বন্ধুকে। ওই পনেরো জন আবার তাদের পাঁচ বন্ধুকে জানাবে, তারা জানাবে তাদের পাচজন করে বন্ধুকে। দেখতে দেখতে সারা রকি বীচের কিশোর মহলে ছড়িয়ে পড়বে খবরটা।

এবার, হেসে বলল কিশোর, শুধু অপেক্ষার পালা।

কিন্তু ছ-টা পর্যন্ত করার পরও কোন খবর এল না। নির্বাক একে অন্যের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। ব্যাপারটা কি? রকি বীচের কোন ছেলেমেয়ে দেখেনি নাকি? বাতাসে মিলিয়ে গেল ওরা?

লুকিয়ে পড়েছে, রবিন বলল।

রকি বীচে আছে কিনা, কে জানে, বলল মুসা।

আমি শিওর, আছে, আশা ছাড়তে পারছে না কিশোর। খোঁজ পেতে সময় লাগবে, এই আরকি। খবর পাবই। এখন…।

এখন আমরা বাড়ি যাব, ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল মুসা। খিদে লেগেছে।

অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মুখ বকাল কিশোর। মুসার এই খাওয়ার ব্যাপারটায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় সে। যত জরুরী কাজই থাকুক, তার কাছে খিদেটাই আসল।

ঠিক আছে, বলল কিশোর, যাও। রবিন, ডিনার সেরে লাইব্রেরিতে যাবে একবার। লোকাল হিস্টরির ওপর অনেক বই আছে, সেদিন দেখলাম। ওগুলো ঘাঁটলেই পেয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, মিস ভেরা পেদ্রোর ভাইয়ের কথাও কিছু লেখা আছে কিনা, দেখো তো।

আমার কি কাজ? জানতে চাইল মুসা।

তুমি? সোজা এখানে চলে আসবে। আমরা দুজন যাব পেদ্রোজ এস্টেটে। রহস্যময় কিছু ঘটছে ওখানে। কি, সেটা জানা দরকার।

কি জানার আছে? বুঝতে পারছে না মুসা।

হয়তো অনেক কিছুই। প্রথমেই ধরো, সেই ছায়ামূর্তির কথা, অদ্ভুত ছায়া আর হাসি। ওটাকে দেখতে চাই একবার। নিজের চোখে।

আবার! চমকে উঠল মুসা।

খাওয়ার পর সোজা এখানে আসবে, আবার বলল কিশোর। কালো শার্টপ্যান্ট পরে আসবে।

 

পশ্চিমের উঁচু পাহাড়গুলোর ওপাশে অস্ত যাচ্ছে টকটকে লাল সূর্য। এস্টেটের লোহার গেটের সামনে পৌঁছল কিশোর আর মুসা। ঝোপের ভেতর সাইকেল লুকিয়ে রেখে ক্যারিয়ার থেকে ছোট, পেটফোলা ব্যাগটা খুলে নিল কিশোর। খুব উঁচু দেয়াল, ফিসফিসিয়ে বলল সে, তাই তৈরি হয়ে এসেছি।

ব্যাগ খুলে ঘোট দুটো ওয়াকি-টকি বের করল কিশোর। চার কাঁটাওয়ালা মাঝারি সাইজের একটা হুক আর মোটা দড়ির বাণ্ডিলও বের করে নিল। যদি আমরা কোন কারণে আলাদা হয়ে যাই, সে-জন্যে, ওয়াকিটকি দেখিয়ে বলল সে। হুক আর দড়ি দেয়াল টপকানোর জন্যে।

হুকের ছিদ্র দিয়ে দড়ির এক মাথা ঢুকিয়ে শক্ত করে বাঁধল কিশোর, ছুঁড়ে দিল ওপর দিকে। দেয়ালের ওপরে আটকে গেল হুকের একটা কাটা। দুজনে মিলে দড়ি ধরে টেনে দেখল, খুলে আসছে না।

দড়ি বেয়ে আগে উঠে গেল মুসা। উঁকি দিয়ে দেখল ওপাশে। উঠে বসে ফিরে চেয়ে কিশোরকে ওঠার ইঙ্গিত করল।

উঠে এল কিশোর।

দেয়াল থেকে হুকটা খুলে নিয়ে দড়ি গুটিয়ে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল কিশোর। দুজনে লাফিয়ে নামল এস্টেটের সীমানার ভেতরে। ব্যাগটা একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।

বাড়িটাতে ঢুকব, বলল কিশোর। খুব সাবধান।

ম্লান হয়ে আসছে সাঁঝের আলো। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আড়ালে সাবধানে এগোল ওরা। ছোট একটা টিলায় উঠে থামল, এখান থেকে মূল বাড়ি আর গোলাঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়। চোখ রাখা যাবে।

দিনের আলো শেষ, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে যেন অন্ধকার। আলো জ্বলে উঠেছে বাড়িটার ঘরে ঘরে। জানালার শার্সিতে মানুষের ছায়া, কিন্তু কেউ বেরোল না, ঘরের ভেতরেই হাঁটাচলা করছে। চারদিক শান্ত। দূরে রাস্তার দিক থেকে কদাচিত ভেসে আসছে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ।

এক জায়গায় একই ভঙ্গিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থেকে শরীর ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, জমে যাচ্ছে যেন মাংসপেশী। মুসার একটা পা প্রায় অবশ, মৃদু ডলাডলি করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিল।

কিশোর নড়ল না, পড়ে আছে তো আছেই। স্থির, পাথরের মূর্তি যেন।

সময় যাচ্ছে।

এক সময় বাড়ির নিচতলার আলো নিভে গেল। চাঁদ নেই আকাশে। আরও ঘন হলো অন্ধকার।

হঠাৎ, মুসার বাহুতে হাত রাখল কিশোর।

কি? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল অবাক মুসা।

ওই যে!

লম্বা, আবছা একটা মূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে বাড়িটার দিকে। দাঁড়িয়ে পড়ল, কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে বোধহয়, তারপর আবার চলতে শুরু করল। গোলাঘরের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে পুবের বনের দিকে।

ও বনে ঢুকলেই আমরা… কথা আর শেষ করতে পারল না কিশোর।

তীক্ষ্ণ, তীব্র, বুনো হাসি ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে, খান খান করে দিল যেন আঁধার রাতের স্তব্ধ নীরবতা।

<

Super User