হয়তো গড়িয়ে-টড়িয়ে নেমে চলে গেছে সাগরে, বলল বটে মুসা, কিন্তু কথাটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

অসম্ভব, রবিন বলল, যা শুকনো বালি…নাহ, ইমপসিবল।

কিশোর চুপ। গর্তের আশেপাশে ঘুরছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি দেখছে বালিতে।

একটা ট্রাক এসেছিল, সঙ্গীদের দিকে ফিরল কিশোর, ফোর হুইল ড্রাইভ। ওই ওদিকে কোথাও দিয়ে নেমেছিল, তারপর সৈকত ধরে এগিয়ে এসেছে। এই যে এখানটায়, গর্তের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ, কয়েক ইঞ্চি দেবে গিয়েছিল চাকা, পরে সামনের চাকার নিচে বোর্ড ফেলে তুলতে হয়েছে।

কোনটা কিসের দাগ বুঝিয়ে দিল কিশোর।

ট্রাক! বিড়বিড় করল মুসা।

কেন, কোন সন্দেহ আছে?

তারমানে তুলে নিয়ে গেছে তিমিটাকে?

তাই করেছে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। কিন্তু কারা? চরায় আটকা পড়ায় তিমি কারা নিতে পারে? কাদের দায়িত্ব?

জবাবের অপেক্ষা করল সে। এগিয়ে গিয়ে গর্ত থেকে তারপুলিনটা ধরে টান দিল। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল রবিন আর মুসা।

 

ওশন ওয়াল্ড, আধ ঘণ্টা পরে প্রশ্নের জবাব দিল কিশোর নিজেই। সকালে আমরা চলে আসার পর কেউ গিয়েছিল সৈকতে, তিমিটাকে দেখে ওশন ওয়ারন্ডে খবর পাঠিয়েছিল। ওরাই এসে তুলে নিয়ে গেছে।

হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা।

তিরিশ ফুট লম্বা একটা মোবাইল হোম ট্রেলারের ভেতরে গঠিত হয়েছে হেডকোয়ার্টার। অনেক আগে ওটা কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা, বিক্রি হয়নি। নানা রকম লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে এখন পুরোপুরি চাপা পড়ে গেছে ট্রেলারটা। তার ভেতরে ঢোকার কয়েকটা গোপন পথ আছে, জানে শুধু তিন গোয়েন্দা। পথগুলো ওরাই বানিয়েছে।

অনেক যত্নে হেডকোয়ার্টার সাজিয়েছে ওরা। ভেতরে ছোটখাট একটা আধুনিক ল্যাবরেটরি বসিয়েছে, ফটোগ্রাফিক ডার্করুম করেছে, অফিস সাজিয়েছে– চেয়ার টেবিল ফাইলিং কেবিনেট সবই আছে। একটা টেলিফোনও আছে, বিল ওরাই দেয়। অবসর সময়ে ইয়ার্ডে কাজ করে, মুসা আর কিশোর, পারিশ্রমিক নেয়। স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে বই সাজানো-গোছানোর পার্ট টাইম চাকরি করে রবিন। তাছাড়া গোয়েন্দাগিরি করেও আজকাল বেশ ভাল আয় হচ্ছে।

টেলিফোন ডিরেক্টরিটা টেনে নিল কিশোর, ওশন ওয়ারন্ডের নাম্বার বের করে। ডায়াল করল।

ফোনের সঙ্গে স্পীকারের যোগাযোগ করা আছে, ওপাশের কথা তিনজনে একই সঙ্গে শোনার জন্যে এই বিশেষ ব্যবস্থা।

রিঙ হওয়ার শব্দ শোনা গেল, তারপর জবাব এল।

ওশন ওয়ারন্ডে ফোন করার জন্যে ধন্যবাদ কেমন যেন যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, সাজানো কথা। টোপাঙ্গা ক্যানিয়নের উত্তরে, প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ের ঠিক পাশেই মিলবে ওশন ওয়ারল্ড। গড়গড় করে আরও অনেক কথা বলে গেল লোকটাঃ টিকেটের দাম কত, দেখার কি কি জিনিস আছে, কোন দিন কটা থেকে কটা পর্যন্ত খোলা থাকে, ইত্যাদি। বলল, ওশন ওয়াল্ড রোজই ভোলা থাকে, সকাল দশটা থেকে বিকেল ছটা পর্যন্ত সোমবার ছাড়া… রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। এটাই জানতে চেয়েছিল।

হায় হায়রে, কপাল চাপড়াল মুসা, বদনসীব একেই বলে। হপ্তার যে দিনটায় বন্ধ সেদিনই ফোন করলাম আমরা।

আনমনে মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ভাবছে কি যেন, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়েছে।

তো এখন কি করব? জিজ্ঞেস করল রবিন। আগামীকাল আবার ফোন করব?

ফোন করে আর কি হবে? বলল কিশোের। যা জানার তো জেনেছিই। মাত্র কয়েক মাইল এখান থেকে। সাইকেলেই যাওয়া যাবে। কাল একবার নিজেরাই গিয়ে দেখে আসি না কেন?

পরদিন সকাল দশটায় ওশন ওয়ারন্ডের বাইরে সাইকেল-স্ট্যাণ্ডে সাইকেল রেখে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াল বিশাল অ্যাকোয়ারিয়ামের আশেপাশে, কৃত্রিম ল্যাগুনে সী-লায়নের খেলা দেখল, তীরে পেইনের হুটোপুটি দেখল, তারপর চলল অফিসবিল্ডিঙের দিকে। একটা দরজার ওপরে সাদা কালিতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে : অ্যাডমিনিসট্রেশন।

দরজায় টোকা দিল কিশোর।

মোলায়েম মেয়েলী গলায় সাড়া এল ভেতর থেকে, কাম ইন।

অফিসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।

ডেস্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক তরুণী পরনে টু-পীস সুইম স্যুট-সাঁতার কাটতে যাচ্ছিল বোধহয়। গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, গাঢ় বাদামী। ছোট করে ছাটা কালো চুল, কোমল, রেড ইণ্ডিয়ানদের মত। মুসার চেয়েও লম্বা, চওড়া কাঁধ, অস্বাভাবিক সরু কোমর, কেন যেন মাছের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়, ডাঙার চেয়ে পানিতেই তাকে মানাবে ভাল।

আমি চিনহা শ্যার্টানোগা, বলল তরুণী। কিছু বলবে?

একটা তিমির খবর নিতে এসেছি, বলল কিশোর। চরায় আটকা পড়েছিল… খুলে বলল সে।

নীরবে সব শুনল টিনহা। কিশোরে কথা শেষ হলে বলল, কবের ঘটনা? গতকাল?

মাখা ঝোঁকাল কিশোর।

গতকাল আমি ছিলাম না। আলমারি খুলে একটা ডাইভিং মাস্ক বের করল টিনহা। সোমবারে দু-চারজন শুধু স্টাফ থাকে, আর সবার ছুটি! মাস্কের ফিতে খুলে নিয়ে আবার ছেলেদের দিকে ফিরল সে, কিন্তু গতকাল কোন তিমি আনা হলে, আমি আজ আসার সঙ্গে সঙ্গে জানানো হত আমাকে।

আনা হয়নি? হতাশ শোনাল রবিনের কণ্ঠ।

মাথা নাড়ল টিনহা। মাস্কটা দেখতে দেখতে বলল, না, আনলে জানানো হতই। সরি, কিছু করতে পারলাম না তোমাদের জন্যে।

না না, দুঃখ পাওয়ার কি আছে… তাড়াতাড়ি বলল মুসা।

আমি দুঃখিত, আবার বলল টিনহা। আমাকে এখন যেতে হচ্ছে। একটা শো আছে।

যদি তিমিটা সম্পর্কে কিছু জানতে পারেন, তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর, আমাদের জানালে খুব খুশি হব।

কার্ডটা নিয়ে টেবিলে রেখে দিল টিনহা, একবার চোখ বুলিয়েও দেখল না।

ঘুরে সারি দিয়ে দরজার দিকে এগোল ছেলেরা। দরজা খোলার জন্যে সবে হাত বাড়িয়েছে মুসা, পেছন থেকে ডেকে বলল টিনহা, তিমিটার জন্যে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে তোমাদের, না? সাধারণ একটা পাইলট কিংবা গ্রে…

হ্যাঁ, হচ্ছে, বাধা দিয়ে বলল রবিন। কারণ ওটাকে বাচাতে অনেক কষ্ট করেছি।

চিন্তা কোরো না, হাসল টিনহা। ভালই আছে ওটা। কেউ ওটাকে নিশ্চয় উদ্ধার করে নিয়ে গেছে, বলেই আরেক দিকে তাকাল সে।

স্ট্যাণ্ড থেকে সাইকেল নিয়ে ঠেলে এগোল কিশোর, চড়ল না। নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে, বুঝতে পারল অন্য দুজন, তারাও ঠেলে নিয়ে এগোল।

ওশন ওয়ার থেকে একটা সরু পথ গিয়ে মিশেছে বড় রাস্তার সঙ্গে। সেখানে এসে সরু রাস্তার পাশের দেয়ালে সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখল কিশোর। দেখাদেখি অন্যেরাও তাই করল। কিশোরের হাসি হাসি মুখ, কোন জটিল রহস্যের সন্ধান পেলে যেমন হয়, তেমনি।

রবিন বিষণ্ণ, মুসা হতাশ। তিমিটার খোঁজ মেলেনি।

এত হাসির কি হলো, ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল মুসা।

কোন কাজই তো হলো না।

কে বলল? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।

কে বলল মানে? তিমির খোজ পাওয়া গেছে?

পুরোপুরি নয়, তবে নিরাপদে আছে বোঝা গেছে, বলল কিশোর। বিশদ পর্যালোচনা করে দেখা যাক। ওশন ওয়ারল্ডের কথাই ধরো, সোমবারে বন্ধ থাকে। সেদিন কেউ ওখানে ফোন করলে জ্যান্ত মানুষের সাড়া পাবে না, শুনতে পাবে কতগুলো টেপ করা কথা। ও হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস, কাল ফোনে যে কথাগুলো আমরা শুনেছি, সব টেপ করা বখা। সোমবারের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা। কেউ রিঙ করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিন চালু হয়ে যায়, গড় গড় করে শ্রোতাকে শুনিয়ে দেয় একগাদা তথ্য। এর মানে কি? কোন মানুষ যদি ফোন না ধরে…

তাহলে তিমিটার কথা জানানো যাবে না, কিশোরের কথা শেষ করে দিল মুসা।

না। তবে টিনহা শ্যাটানোগাকে বাড়িতে ফোন করতে কোন বাধা নেই, যদি তার নম্বর জানা থাকে। এবং সেটাই কেউ করেছিল।

কে বলল তোমাকে? রবিনের প্রশ্ন। কেউ বলেনি, অনুমান করে নিয়েছি, টিনহার কথা থেকেই। তিমিটার চরায় আটকা পড়ার কথা শুনে অবাক হয়নি, গায়েব হওয়ার কথা শুনে হয়নি। আমি বলে গেছি, সে শুনেছে, যেন শোনা কথাই আরেকবার শুনছে। তাছাড়া সে জানল কি করে, গতকালের ঘটনা এটা? আমি তো একবারও বলিনি।

ওটা তো প্রশ্ন করেছে, তর্ক করল মুসা।

ওই প্রশ্নটাই জবাব! কবের ঘটনা, এটুকু বললেই তো পারত। আবার উল্লেখ করার কি দরকার ছিল। আসলে কথাটা ঘুরছিল তার মনে, ফলে বলে ফেলেছ। তারপর আরও একটা ব্যাপার, প্রথমে স্বীকারই করতে চায়নি তিমিটার কথা, গতকাল অফিসে আসেনি বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শেষে রবিনের উৎকণ্ঠা দেখে বলেই ফেলেছে নিরাপদ আছে। কিছুই যদি না জানে নিরাপদে আছে, জানল কি করে?

ঠিকই বলেছ, মাথা দোলাল রবিন। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? বলল পাইলট কিংবা গ্রে হোয়েল। শুধু ওই দু-জাতের নাম কেন? আরও তো অনেক জাতের তিমি আছে। তাছাড়া পাইলটের নামই বা প্রথমে কেন…

তুমি জানো ওটা পাইলট? ভুরু কোচকাল মুসা।

জানি, বলল রবিন। গতকালই বুঝতে পেরেছি। বলার সুযোগ পাইনি, তারপর আর মনে ছিল না।

অ।…পাইলট আর গ্রে-র তফাতটা কি?

গ্রে-র ফোয়ারার ছিদ্র থাকে দুটো, নাকের ফুটোর মত পাশাপাশি পাইলটের থাকে একটা। আকারেও পাইলটের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেল যেটাকে বাঁচিয়েছি আমরা, ওটা শিশু নয়, যুবক পাইলট বলেই এত ছোট। রবিনের জ্ঞানের বহর দেখে অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, তার আগেই কিশোর বলল, হুঁ, তা যা বলছিলাম। তিমিটার কথা ভালমতই জানে টিনহা। কিন্তু বুঝতে পারছি না, ওশর্ন ওয়ারন্ডের একজন ট্রেনার সাধারণ একটা তিমি হাইজ্যাক করতে যাবে কেন? কেন মিছে…।

গাড়ির হর্নের তীক্ষ্ণ শব্দে বাধা পড়ল কথায়।

ওশন ওয়ারল্ড থেকে বেরিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে এল একটা সাদা পিকআপ, বড় রাস্তায় উঠে মোড় নিয়ে চলে গেল দ্রুত। চালাচ্ছে টিনহা শ্যাটানোগো।

হুঁ, খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করেছে ঘটনা, বিড়বিড় করল কিশোর।

মানে? বুঝতে পারছে না মুসা।

কয় মিনিট আগে কি বলেছিল আমাদেরকে? ভুরু নাচাল কিশোর। একটা জরুরী শশা দেখাতে যাচ্ছে। শশা হলে তো অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতরে হবে, বাইরে কি? আর এত তাড়াহুড়ো কেন?

শো দেখাতেই তৈরি হচ্ছিল, মুসার কথায় বিশেষ কান দিল না কিশোর, কিন্তু বাধ সেধেছি আমরা। হয়তো কোন ভাবে চমকে দিয়েছি। তাই শো ফেলে রেখে আরও জরুরী কোন কাজ করতে চলে গেছে।

<

Super User