নীল বনেটের, বলল কিশোর, এই রহস্যের সঙ্গে কি সম্পর্ক?

প্রশ্নটা করেছে সে নিজেকেই। মুখ ফুটে ভাবনা বলা যেতে পারে একে।

টিনহার সঙ্গে উলফের বাড়ি গেছে, তার পরের দিনের ঘটনা। স্যালভিজ ইয়ার্ডের গেটে অপেক্ষা করতে করতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে তিন গোয়েন্দা, বা বার তাকাচ্ছে পথের দিকে। বিকেলে ওশন ওয়ারল্ড থেকে ছুটি নিয়ে লাঞ্চ খেয়ে সোজা এখানে চলে আসার কথা টিনহার, তিন গোয়েন্দাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা :

এই কাহিনীর একটা অংশ বনেট, আপনমনেই বিড়বিড় করল কিশোর। টিনহা ওকে চেনে না। কিন্তু নোকটা সব জানে বলে মনে হলো, টিনহার বাবার মেকসিকোতে ট্রিপ দেয়ার কথাও নিশ্চয় অজানা নয়।

ক্যাপটেন শ্যাটানোগার বাড়িতেও সার্চ করতে গিয়েছিল, রবিন বলল।

ক্যাপটেন কাটানোগার নাকি আবার বন্ধু, বলল রবিন। তাহলে চুরি করে তার বাড়িতে ঢোকে কেন?

উলফেরও বন্ধু, কিশোর বলল। সেদিন বোটে যে দুজনকে দেখেছিলাম, একজন বনেট হতে পারে।

কারও ভাল বন্ধু নয় সে। উলফকেও তো জানাতে চাইল না, আমাদের সঙ্গে স্যান পেড্রোতে তার পরিচয় হয়েছে।

একটা কথা ঠিক, মুসা মুখ খুলল, আগে থেকেই ও আমাদের নাম জানে, নইলে স্যান পেড্রোতে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিনল কিভাবে?

আমিও তাই বলি, চিন্তিত ভঙ্গিতে পথের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। ব্যাটা সবই জানে। স্মাগলিঙের কথা জানে, ঝড়ে বোট ডুবে যাওয়ার কথা জানে, তিমির সাহায্যে পকেট ক্যালকুলেটর উদ্ধারের কথাও জানে। শুধু বুঝতে পারছি না, ও এর মাঝে আসছে কি চুপ হয়ে গেল সে। পথের মোড়ে দেখা দিয়েছে সাদা পিকআপ।

ছুটে গিয়ে নিজের ঘর থেকে ছোট একটা ধাতব বাক্স নিয়ে এল কিশোর।

পিকআপে উঠল তিন গোেয়ন্দা, আগের দিনের মতই কিশোর আর রবিন সামনে, মুসা পেছনে।

বাক্সটা টিনহাকে দেখিয়ে বলল কিশোর, এই জিনিসই চেয়েছিলেন আপনি।

বানিয়ে ফেলেছ? খুশি হলো টিনহা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ভোর পাঁচটায় উঠে কাজে লেগেছিল, আগের রাতে নির্দেশ পেয়েছে টিনহার কাছ থেকে, সারাটা সকাল ব্যয় করে বানিয়েছে জিনিসটা। বাক্সটা কি করে খোলে দেখাল সে।

ভেতরে একটা টেপ রেকর্ডার ব্যাটারিতে চলে, একটা মাইক্রোফোন আর স্পীকারও আছে। এমনভাবে সাজিয়েছে জিনিসগুলো, বাক্সটা বন্ধ করে রাখলেও রেকর্ড কিংবা ব্রডকাস্ট করতে পারবে। বাথটাবে পরীক্ষা রে দেখেছে। পানির নিচে নিখুঁত কাজ করে যন্ত্রটা, এক বিন্দু পানি ঢোকে না বাক্সের ভেতরে।

ইলেকট্রনিক্সের যাদুকর তুমি, প্রশংসা করল টিনহা।

আরে না না, কি যে বলেন। সাধারণ একটা হবি, মুখে বিনয় প্রকাশ করছে বটে কিশোর, কিন্তু রবিন জানে নিজেকে টমাস এডিসন মনে করে সে। তবে ইলেকট্রনিক্সের টুকটাক কাজে যে তার বন্ধু ওস্তাদ এটা স্বীকার করতেই হয়। ওই তো, চোখের সামনেই তো রয়েছে কিশোরের অ্যাসেমবল করা একটা জিনিস।

সঙ্গে স্কুবা মাস্ক আর ফ্লিপার নিয়েছে তিন গোয়েন্দা। র্যাঞ্চে পৌঁছে পোশাক বদলে সুইমস্যুট পরে নিল। পুলের কাছে জড় হয়েছে সবাই।

উলফ কিংবা তার বন্ধু নীল বনেটকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

আমাদের কাজে নাক গলাতে নিষেধ করে দিয়েছি ওদের, বলল টিনহা। যদি শোনে… বাক্যটা শেষ করল না সে।

না শুনলেও না করে পারবেন না, তাই না? নরম গলায় বলল রবিন।

হতাশ ভলিতে কাঁধ ঝাঁকাল টিনহা। ঠিকই বলেই, পারব না। বাবার খুব টাকার দরকার। ওই মালগুলো খুঁজে আনতেই হবে।

আপনার বাবা কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।

ভাল না। তবে জান খুব শক্ত, খাটি মেকসিকান বুড়ো তো, বেশ গর্বের সঙ্গেই বলল টিনহা। ডাক্তাররা লছে, ভাল হয়ে যাবে। রোজ কয়েক মিনিট দেখা করার সময় দেয়, বাবা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। একটা কথাই বার বার বলে থামল সে, টেনেটুনে পায়ে জায়গামত লাগিয়ে লি ফ্লিপার, তারপর বলল, তোমরা গোয়েন্দা। হয়তো কিছু বুঝতে পারবে। বাবা বলে : দুটো পোলের দিকে নজর রাখবে। একই লাইনে রাখবে।

পুলে নামল টিনহা। পানির তলা দিয়ে উড়ে এসে তাকে স্বাগত জানাল রেজর।

দুটো পোল, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হলো কিশোরের, একই লাইনে রাখবে। দুই সহকারর দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে পেরেছ?

পোল পোলিশকে বুঝিয়েছে হয়তো, বলল রবিন। নীল বনেট পোল্যান্ডের লোক হতে পারে। নামটা এরকম, কথায় টান নেই বটে, কিন্তু বলার ভঙ্গি…

লক্ষ করেছ তাহলে, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। বলার ভঙ্গির মধ্যে পোলিশ একটা গন্ধ রয়েছে। আচ্ছা, একজন যদি বনেট হয়, আরেকজন কে? মুসার দিকে চেয়ে বলল সে।

আমাকে মাপ করো, বলতে পারব না। পূলের দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল মুসা, আরে দেখো, দেখো!

পুলের মধ্যে চক্কর দিচ্ছে রোভার, তার পিঠে সওয়ার টিনহা, জড়িয়ে ধরে রেখেছে দুই বাহু দিয়ে।

পরের আধ ঘন্টা রোভার আর টিনহার খেলা দেখল তিন গোয়েন্দা। আনাড়ি যে কেউ দেখলে বলবে খেলা, কিন্তু টিনহা জানে, এটা খেলা নয়, কঠিন ট্রেনিং। ওর বাধ্য করে নিচ্ছে তিমিটাকে। কোন ইঙ্গিতে কি করতে হবে বোঝাচ্ছে।

মানুষ আর তিমিতে আজব বন্ধুত্ব। ভাবল মূসা। কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, একে অন্যের মনের কথা পড়তে পারছে টিনহা আর রোভার। টিনহার মুখের সামান্যতম ভাব পরিবর্তনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটছে তিমিটার মাঝে!

রোভারকে খাওয়াল টিনহা। তিন গোয়েন্দাকে পুলে নেমে তিমিটার সঙ্গে খেলতে বলল।

রোভারের পাশে সাঁতরাতে প্রথম একটু ভয় ভয় করুল মুসাব, রোভার তার গায়ে ঠোঁট ঘষতে এলেই ভয় পেয়ে সরে গেল, আস্তে আস্তে সহজ হয়ে এল সে। রবিন আর কিশোরের চেয়ে তার সঙ্গেই বেশি বড় হয়ে গেল বিশাল, বুদ্ধিমান জীবটার। টিটকারি মারতেও ছাড়ল না একবার রবিন। গায়েগতরে এক রকম তো, কাজেই দোস্ত।

কিছু মনে করল না মুসা, হাল শুধু।

দেখাচ্ছে ভালই, মুসাকে বলল টিনহা। কিশোর, তোমার যন্ত্রটা কাজে লাগাও।

পুলের অন্য প্রান্তে ভাসছে রোভার। ওখানেই থাকতে শিখিয়েছে টিনহা, না ডাকলে আর কাছে আসবে না।

দেখি, দাও আমার কাছে, কিশোরের হাত থেকে রেকর্ডারটা নিল টিনহা। রেকর্ডিং সুইচ টিপে দিল।কোমরে একটা ওয়েটকেট পরে নিয়ে ডাইভ দিয়ে পড়ল পুলে। ইঙ্গিত পেয়ে রোভারও ডাইভ দিয়ে চলে গেল পুলের তলায়।

তাজ্জব হয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দা। টিনহা ডুব দিয়েছে তত দিয়েছেই, ওঠার নাম নেই। এতক্ষণ দম রাখছে কি করে? পরিষ্কার পানিতে দেখা যাচ্ছে তিমির মুখের কাছে যন্ত্রটা ধরে রেখেছে টিনহা, আরেক হাতের আঙুল নাড়ছে, মাঝেমধ্যে মটকাচ্ছে-দেখেই অনুমান করা যায়।

প্রায় দুই মিনিট পর ভেসে উঠল টিনহা। আস্তে আস্তে দম নিচ্ছে, ছাড়ছে, তাড়াহুড়ো করছে না। ফুসফুসকে শান্ত করে হাসল। ডেকে বলল, রেকর্ড করেছি। শোনা যাক, কেমন উঠেছে।

টেপটা শুরুতে গুটিয়ে নিল কিশোর, তারপর প্লে করল। প্রথমে ঢেউয়ের মৃদু ছলাতছল ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তারপর কয়েকটা মটমট, টিনহার আঙুল ফুটানোর আওয়াজ।

তারপর স্পীকারে স্পষ্ট ভেসে এল পাখির কাকলীর মত শব্দ, একবার উঁচু পর্দায় উঠেছে, আবার নামছে, সঙ্গে করতালি দিয়ে সঙ্গত করা হচ্ছে যেন।

হাতহালি বাদ দিলে একেবারে পাখি, ডাবল কিশোর। তবে অনেক বেশি জোরাল, গভীর, কম্পন সৃষ্টি করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এ-জাতীয় শব্দ আগে কখনও শোনেনি সে, ডাঙার কোন কিছুর সঙ্গেই পুরোপুরি তুলনা করা যায় না।

রোভার? ফিসফিস করে বলল রবিন, জোরে বললে ধেন আবেশ নষ্ট হবে। বোডারের গান?

গান বলো, কথা বলো, যা খুশি বলতে পারো, বলল টিনহা। এরকম শব্দ করেই ভাব প্রকাশ করে তিমি। তিমির ভাষা বোঝা সম্ভব হয়নি। হলে হয়তো দেখাযাবে, আমাদের কথার মতই অর্থবহ, জটিল ওদের কথাও।

ফ্লিপার খুলে নিল টিনহা। তবে মানুষের মত ঝগড়া করে না ওরা, লড়াই করে না। মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য। মিথ্যেও বলে না নিশ্চয়। কথা বলেই বা কি লাভ, যদি সেটাকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে খালি খারাপের দিকে নিয়ে যাই

আবার শুনি? মূসা অনুরোধ করল।

দাঁড়াও, আগে রোভারকে শুনিয়ে নিই।

টেপটা আবার শুরুতে এনে প্লে টিপে যন্ত্রটটিনহার হাতে দিল কিশোর। পুলের কিনারে ঝুঁকে বাক্সটা পানির তলায় নিয়ে গেল টিনহা। রোভারকে লক্ষ করছে তিন গোয়েন্দা।

আরাম করে শুয়ে আছে পলের তলায় রোভার। হঠাৎ শিহরণ খেলে গেল বিশাল শরীরটায়। শরীরের দুপাশে টান টান হয়ে গেল পাখনাগুলো। শাঁ করে এক ছুটে চলে এল পুলের এপাশে। রবিনের মনে হলে হাসছে তিমিটা, প্রথমদিন যেমন করে হেসেছিল, তেমনি।

কাছে এসে থামল রোভার। এক মুহুর্ত দ্বিধা করে ঠোঁট ছোয়াল বাক্সের গায়ে।

ও-কে, গুড, কক্সটা পানি থেকে তুলল টিনহা। লক্ষ্মী রোভার, লক্ষ্মী ছেলে। সন্তুষ্ট হতেছে। একটা মাছ উপহার দিল।

পানি থেকে লাফিয়ে উঠে শুন্যেই খপ করে মাছটা ধরল রোভার, ঝপাত কর, পড়ল আবার পানিতে।

এটাই দেখতে চেয়েছিলাম, বাক্সের দিকে ইঙ্গিত করে বলল টিনহা। মনে হচ্ছে কাজ হবে। সাগরে ছাড়লে দূরে চলে গেলেও এর সাহায্যে ডেকে আনতে পারব। ওর ডাকই একে ফিরিয়ে আনবে।

আরেকটা ক্যাসেটে রি-রেকর্ড করে দিতে পারি, কিশোর পরামর্শ দিল। এটাকে বার বার প্লে করে অন্য ক্যাসেটে রেকর্ড করতে থাকব, এখানে আছে দেড়দুই মিনিট, আধ ঘণ্টা বানিয়ে ফেলতে পারব এটাকে।

মন্দ বুদ্ধি না, বাক্সটা বাড়িয়ে দিল টিনহা। হাসপাতালে যাওয়া দরকার। চলো, তোমাদেরকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাই।

র‍্যঞ্চ হাউসের বাইরে পথের পাশে পার্ক করা আছে সাদা পিকআপ। আগের মতই এবারেও মুসা উঠল পেছনে, অন্য তিনজন সামনে।

খুব সতর্ক, দক্ষ ড্রাইভার টিনহা। কিন্তু এখন তার চালানো দেখে মনে হচ্ছে, কেমন যেন বেসামাল। মোড়ের কাছেও গতি কমাচ্ছে না, বেপরোয়া গতির রেকর্ড ভঙ্গ করতে চলেছে যেন।

সামনে ডান দিকে তীক্ষ্ণ একটা মোড়। লাগামছাড়া পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে যাচ্ছে গাড়ি।

হ্যাণ্ডব্রেক টানল টিনহা। কিছুই হলো না! গতি কমল না গাড়ির। ইমারজেন্সী ব্রেকটা পুরো চাপল। কিন্তু স্পীডোমিটারের কাটা তোয়াক্কাই করল না, দ্রুত সরে যাচ্ছে ডানে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ।

কি হয়েছে…, কথা আটকে যাচ্ছে রবিনের। ব্রেকে গোলমাল।

মাথা ঝাঁকাল টিনহা। কিছুতেই কাজ করাতে পারছি না। শীয়ারের হাতল চেপে ধরে টান দিল, ইঞ্জিন নিচু গীয়ারে এনে গতি কমাতে চাইছে। থরথর করে কাপছে গাড়ি। মিটারের কাঁটা অস্থির।

<

Super User