সেদিন সকালে হাসপাতালে বাবাকে দেখে সবে ফিরে এসেছি, শুরু করল টিনহা, ওর অফিসে ফোন বাজল। ধরলাম। বিংগো উলফ। দক্ষিণ অঞ্চলের লোক, বড়ি খুব সম্ভব অ্যালাবামায়। এর আগেও দু-তিনবার দেখেছি ওকে, বাবার সঙ্গে মাছ। ধরতে গেছে। ফোনে উলফ বলল, সৈকতে আটকে পড়া একটা তিমি দেখেছে সে।

বলে গেল টিনহা, কিভাবে উদ্ধার করেছে ওরা তিমিটাকে। তার দুজন মেকসিকান বন্ধুকে নিয়ে গেছে ট্রাকসহ। ক্রেনের সাহায্যে তিমিটাকে ট্রাকে তুলেছে, ভেজা স্পঞ্জ দিয়ে জড়িয়ে বেঁধেছে সারা গা, যাতে ডিহাইড্রেটেড না হয়। তারপর তাড়াতাড়ি এনে ছেড়ে দিয়েছে উলফের সুইমিং পুলে, তারই অনুরোধে। টিনহা তিমিটার নাম রেখেছে রোভার, ওটার সঙ্গে সাঁতরেছে বণ্টার পর ঘণ্টা,ওটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে।

একটা স্টোর থেকে জ্যান্ত মাছ জোগাড় করে দিয়েছে উলফ, তিমিটার খাবার জন্যে। ভালই চলছিল সব কিছু। খুব দ্রুত শিখে নিচ্ছিল রোভার, বুদ্ধিমান জীব তো।

সব তিমিই বুদ্ধিমান, সান্তা মনিকার দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল টিনহা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দেয়, হাজার, হোক, এতবড় একটা মগজ। কিন্তু রোভারের বুদ্ধি যেন আর সব তিমিকে ছাড়িয়ে গেছে। অনেক বছর ধরে তিমিকে ট্রেনিং দিচ্ছি, কিন্তু ওর মত এত দ্রুত কেউ শিখতে পারেনি। বয়েস আর কত হবে, বড়জোর দুই-মানুষের তুলনায় অবশ্য পচ কিংবা ছয়, বাচে তো মানুষের তিন ভাগের এক ভাগ সময়-কিন্তু দশ বছরের বুদ্ধিমান ছেলেকে ছাড়িয়ে গেছে ওর বুদ্ধি।

তারপর উলফের বাড়িতে সেদিন কি হয়েছে, বলল টিনহা।

রোভারকে মাছ খাওয়ানো শেষ হলো। টিনহা ঠিক করল, স্যান পেড্রোতে যাওয়ার পথে হাসপাতালে নেমে বাবাকে আরেকবার দেখে যাবে। গাড়িতে করে তাকে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করল উলফকে। পুলের ধারে দাঁড়িয়েছিল উলফ, রোদে চকচক করছিল তার টাক।

হিসেবী ভঙ্গিতে টিনহার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ উলফ।

অস্বস্তি বোধ করতে লাগল টিনহা। বলল, আগামীকাল ওশন ওয়ারন্ডে লোক পাঠাব, ওরা তিমিটাকে সাগরে ছেড়ে দিয়ে আসবে, বলেই গাড়িপথের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

থামাল তাকে উলফ। এক মিনিট, টিনহা। একটা কথা তোমার জানা দরকার, তোমার বাবা সম্পর্কে।

তোমার বাবা চোরাচালানী। টেপ রেকর্ডার, পকেট রেডিও, আরও নানারকম ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র মেকসিকোতে নিয়ে গিয়ে তিন-চার গুণ দামে বিক্রি করে। কয়েক বছর ধরে করছে একাজ।

চুপ করে রইল টিনহা। উলফের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। তবে অবিশ্বাসও করতে পারল না। কি জানি, হতেও পারে। মাঝে মধ্যেই মুখ ফসকে বেশি কথা বলে ফেলে বাবা, উলফের কাছেও হয়তো বলেছিল। বাবাকে ভালবাসে টিনহা, আর দশটা মেয়ের চেয়ে বেশিই বাসে। ছোটবেলায় টিনহার মা মারা গেছে, তারপর আর বিয়ে করেনি বাবা, মা-বাবা দুজনের আদর দিয়েই মানুষ করেছে। এটাও অশ্য অস্বীকার করে না টিনহা, তার বাবা পুরোপুরি সৎ নাগরিক নয়।

গত ট্রিপে বেশ কিছু মাল নিয়ে চলেছিল,  আবার বলল উলফ। বেশিরভাগই পকেট ক্যালকুলেটর, মেকসিকোয় খুব চাহিদা। ঝড়ে পড়ে বোট ডুবল, সেই সঙ্গে মালগুলোও।

তবুও কিছু বলল না টিনহা।

বিশ তিরিশ হাজার ডলারের কম দাম হবে না, আমেরিকাতেই, বলে চলল উলফ। তার অর্ধেক আমার। দুজনে শেয়ারে ব্যবসা করতাম আমরা। ওয়াটারপ্রুফ কনটেইনারে রয়েছে ক্যালকুলেটরগুলো, পানি ঢুকতে পারবে না, নষ্ট হবে না। আমার ইনভেস্টমেন্ট আমি হারাতে রাজি নই। বোটটা খুঁজে বের করে জিনিসগুলো তুলে আনা দরকার। তুমি আমাকে সাহায্য করবে, শেষ কথাটা বেশ জোর দিয়েই বলল সে। ভয় দেখানোর একটা ভঙ্গিও রয়েছে। টিনহার মুখের দিকে তাকাল উলফ। তুমি আর তোমার এই তিমি। করছ তত সাহায্য?

জবাব দেয়ার আগে ভালমত ভেবে দেখেছে টিনহা। ও জানে, আমেরিকান সরকার ধরতে পারবে না তার বাবাকে বেআইনী কাজ বলতে পারবে না। পকেট ক্যালকুলেটর কিনে আমেরিকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার মাঝেও বেআইনী কিছু নেই। আর যাই করুক, আমেরিকান পুলিশের ভয় দেখিয়ে টিনহাকে ব্লেকমেল করতে পারবে না উলফ। মেকসিকান পুলিশের ভয় দেখিয়েও লাভ নেই। কারণ। হাতে-নাতে ধরতে না পারলে কোন চোরাচালানীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারবে না ওরাও।

তবে সমস্যা হলো তার বাবাকে নিয়ে। বোটের বীমা করায়নি, কাজেই গেছে ওটা। নিজেরও চিকিৎসা-বীমা নেই। অথচ হাসপাতালে রোজ শয়ে শয়ে ডলার খরচ, আসবে কোথা থেকে? যদি উলফকে সাহায্য করে টিনহা, বোর্টটা খুঁজে পায়, ক্যালকুলেটরগুলো তুলতে পারে, শেয়ারের অর্ধেক টাকা মিলবে। দশ পনেরো হাজার দিয়ে হাসপাতালের বিল তো মেটাতে পারবে।

ভেবে দেখেছে টিনহা, সে-ও কোন বেআইনী কাজ করছে না। বোটটা তাদের। সেটা খোঁজার মধ্যে দোষের কিছু নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক।

কাজেই রাজি হয়ে গেলাম, পাহাড়ী পথের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল নিহা। ওপরের দিকে উঠছে এখন গাড়ি। বোটটা খুঁজে বের করার জন্যেই রোভারকে ট্রেনিং দিচ্ছি।

চুপচাপ সব শুনেছে এতক্ষণ কিশোর, একটি কথাও বলেনি। আরও এক মিনিট চুপ থেকেবলল, তাহলে এই ব্যাপার। রোভারকে কলার পরিয়েছেন এ-কারণেই। গলায় একটা টেলিভিশন ক্যামেরা বলিয়ে দেবেন, গভীর পানিতে ডুব দিয়ে ছবি তুলে আনবে। ভাল বুদ্ধি। দুনিয়ার যে কোন ভাল ডুবুরীর চেয়ে ভাল পারবে রোভার, ওর মত এত নিচে কোন ডুবুরীই নামতে পারবে না। অনেক কম সময়ে অনেক বেশি জায়গা ঘুরে দেখতে পারবে।

ঠিক বুঝেছে, হেসে প্রশসা করল টিনহা। তুমি আসলেই বুদ্ধিমান, তোমার বয়েসী অনেক কিশোরের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান।

হাসি ফিরিয়ে দিল কিশোর। রোভারের চেয়েও বেশি?

তার রসিকতায় আবার হাসল টিনহা। ওকে। এবার তোমার কথা বলো। রোভারের ব্যাপারে এত আগ্রহনে? কি তদন্ত করছ তোমরা?

ভাবল কিশোর। একশো ডলার পুরস্কার ঘোষণার কথা বলবে? সত্যি বলাই স্থির করল সে, টিনহা যখন তার সঙ্গে মিথ্যে বলেনি, সে-ও কলবে না। আমাদের এক মক্কেল-নাম বলতে পারব না, বলেনি সে-তিমিটাকে খুঁজে বের করে সাগরে কিরিয়ে দিতে পারলে একশো ডলার পুরস্কার দেবে বলেছে।

সাগরে ফিরিয়ে দিতে পারলে! কেন? কি লাভ তার?

জানি না, মাথা নাড়ল কিশোর।

হুঁ? তো অর্ধেক কাজ তো তোমরা সেরে ফেলেছ, উলফের বিরাট র‍্যঞ্চ হাউসের সামনে এনে গাড়ি রাখল টিনহা। বাকি কাজটা আমাকেই করতে দাও। পারলে সাহায্য কোনো আমাকে।

নিশ্চয় করব, এতক্ষণে মুখ খুলল রবিন। কিন্তু কিভাবে?

ডাইভিং জাননা?

কিশোর জানাল, জানে তিনজনেই। তবে এ-ব্যাপারে মুসা ওস্তাদ, দক্ষ সাঁতারু, একথাও বল।

দারুণ, বলল টিনহা, তোমাদের ওপর ভক্তি বাড়ছে আমার। তাহলে এক সঙ্গে কাজ করছি আমরা? যত তাড়াতাড়ি পারি রোভারকে সাগরে ছেড়ে দেব। তবে ছাড়লে চলে যাবে না এব্যাপারে শিওর হয়ে নিতে হবে। তারপর বাবার বোর্টটা খুঁজতে সাহায্য করবে তোমরা আমাকে। কি বলো?

রাজি, একই সঙ্গে জবাব দিল রবিন আর কিশোর। ওরা তো এইই চায়, রহস্য, রোমাঞ্চ, উত্তেজনা। খুশি হয়ে উঠেছে। ছুটিটা ভালই কাটবে। সাগরে ডুবন্ত একটা বোট উদ্ধার, তিমির সাহায্যে, চমৎকার!

এসো আমার সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে এক পাশের দরজা খুলে ফেলল টিনহা, রোভারের সঙ্গে দেখা করবে।

চোখ বুজে পানিতে চুপচাপ ভেসে রয়েছে রোভার, শরীরের অর্ধেক পানির নিচে। পূলের আলো জ্বেলে দিল টিনহা, সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলল তিমিটা। নড়ে উঠল। সাঁতরে চলে এল কিনারে, প্রভু বাড়ি ফিরলে কুকুর যে চোখে তাকায়, সেই দৃষ্টি। পাখনা আর লেজ নেড়ে স্বাগত জানাল টিনহাকে।

মনে হলো, তিন গোয়েন্দাকেও চিনতে পেরেছে সে। ওরা পুলের কিনারে বসে পানিতে হাত রাখল। সবার হাতেই ঠোঁট দুইয়ে আনন্দ প্রকাশ করল রোভার।

খাইছে, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার। ও আমাদের চিনতে পেরেছে।

চিনবে না মানে? টিনহা বলল। ওর প্রাণ বাঁচিয়েছ তোমরা। ও কি মানুষের মত অকৃতজ্ঞ যে ভুলে যাবে?

কিন্তু একটা…

কনুয়ের গুতো মেরে তাকে থামিয়ে দিল রবিন তাড়াতাড়ি, নইলে মুসা বলেই ফেলছিল একটা সাধারণ তিমি, তাতে মনঃক্ষুন্ন হত টিনহা। মুসাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে যা যা কথা হয়েছে, সংক্ষেয়ে সব জানাল রবিন।

রোভারকে আগে খাওয়াল টিনহা। তারপর ফ্লিপার পরে নিল পায়ে। পানিতে পা নামাতে যাচ্ছিল, থেমে গেল একটা শব্দে। ঘুরে তাকাল। র‍্যঞ্চ, হাউস থেকে বেরিয়ে এদিকেই আসছে দুজন লোক।

মূসার কাছে চেহারার বর্ণনা শুনেছে, দেখেই উলফকে চিনতে পারল কিশোর। অন্য লোকটাকে চিনল তিনজনেই। সেই লম্বা লোকটা, যে নিজেকে টিনহার বাবা বলে পরিচয় দিয়েছিল।

আপনি এখানে আসবেন না বলেছিলেন, উলকে দেখে রেগে গেছে টিনহা। খবরদার আর আসবেন না। রোভারের ট্রেনিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসতে পারবেন না।

জবাব দিল না উলফ। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা কারা? কারা উচ্চারণ করল ও কা-আরা।

আমার বন্ধু, বলল টিনহা। স্কুবা ডাইভার। আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।

মাথা ঝাঁকাল উলফ, যদিও বোঝা গেল, এসব পছন্দ করছে না সে। কিন্তু টিনহা বলেছে তার বন্ধু, তাই আর প্রতিবাদ করতে পারল না।

উলফের পাশে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখছে টিনহা। বন্ধুটি কে?

আমার নাম বনেট, নিজেই পরিচয় দিল লম্বা লোকটা। নীল বনেট। উলফের পুরানো বন্ধু। আপনার বাবার বন্ধু মিস। হেসে বলল, মেকসিকো থেকে এসেছি।

অ। ওকে।

কিশোর বুঝতে পারছে, নামটা টিনহার অপরিচিত, আগে কখনও দেখেনি লোকটাকে। কিন্তু তার মেকসিকো থেকে এসেছি কথাটা বলার পেছনে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে!

তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে বনেটের হাসি বিস্তৃত হলো। তাহলে তোমরা স্কুবা ডাইভার। ওশন ওয়ারল্ডে মিস শ্যাটানোগার সঙ্গে কাজ করো?

মাঝে মাঝে, চট করে জবাব দিল টিনহা, স্থায়ী কিছু না। ও, সরি, পরিচয় করিয়ে দিই। কিশোর, মুসা, রবিন।

পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, আগে থেকেই যে চেনে এটা সামান্যতম প্রকাশ পেল না লোকটার দৃষ্টিতে, হাসিমুখে হাত মেলাল তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।

হয় স্মরণশক্তি সাংঘাতিক খারাপ, নয়তো দিনের বেলায়ও ঘুমের ঘোরে হাঁটে ব্যাটা, লোকের সঙ্গে কথা বলে, ডাবল কিশোর। কিন্তু এর কোনটাই বিশ্বাস করতে পারল না সে। আসলে লোকটা একটা মস্ত ধড়িবাজ, তাদের সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছে, এটা জানাতে চায় না টিনহাকে।

কেন? অবাক লাগছে কিশোরের। কি লুকাতে চায় নীল বনেট?

<

Super User