না হয় ধরলামই মিছে কথা বলেছে টিনহা, বলল মুসা, কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হয়?

শেষ বিকেল। সকালে ওশন ওয়ার থেকে রকি বীচে ফিরেই লাইব্রেরিতে কাজে চলে যায় রবিন। মুসা যায় বাড়ির লন পরিষ্কার করতে, মাকে কথা দিয়েছিল। আজ সাফ করে দেবে। ইয়ার্ডে বোরিস আর রোভারকে সাহায্য করেছে কিশোর। চাজ সারতে সারতে বিকেল হয়ে গেছে তিনজনেরই। হেডকোয়ার্টারে জমায়েত হয়েছে এখন। এর আগে আর আলোচনার সুযোগ হয়নি।

তাছাড়া মিথ্যে কথা বলা বড়দের স্বভাব, বলেই গেল মুসা, কোন কারণ ছাড়াই মিছে কথা বলবে। গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করো, দশটা প্রশ্ন করে আগে তোমার মেজাজ বিগড়ে দেবে। তারপর যে জবাবটা দেবে সেটা হয় ঘোরানো-প্যাঁচাননা,

নয় স্রেফ মিছে কথা…

কথা শেষ করতে পারল না মুসা, টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলল কিশোর।

হালো, স্পীকারে শোনা গেল পুরুষের গলা। কিশোর পাশার সঙ্গে কথা বলতে চাই, প্লীজ।

বলছি।

আজ সকালে ওশন ওয়ারল্ডে একটা হারানো তিমির খোঁজ নিতে গিয়েছিলে, কথায় কেমন একটা অদ্ভুত টান, তাছাড়া কিছু কিছু শব্দ ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করে,

যেমন, ওয়ারল্ডকে বলছে ওয়া-রলড়।

হয়ত মিসিসিপির ওদিকের কোনখানের লোক, ভাবল রবিন, অ্যালবামার হতে পারে। ওই অঞ্চলের কারও সঙ্গে আগে কখনও পরিচয় হয়নি তার, তবে টেলিভিশনে দেখেছে, দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা ওরকম করেই টেনে টেনে কথা বলে, তবে এই লোকটা আরও এক কাটি বাড়া, শব্দও ভেঙে ফেলেছে।

হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, জবাব দিল কিশোর। কেন?

আমি আরও জেনেছি তোমরা একধরনের শখের গোয়ে-নদা…

হ্যাঁ, আমরা গোয়ে-নদাই। নানা রকম সমস্যা…

কিশোরকে বলতে দিল না লোকটা। তাহলে নিশ্চয় একটা কেস নিতে আগ্রহী হবে, আগ্রহীকে বলল আগ-রহী, তিমিটাকে খুঁজে বের করে সাগরে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারলে একশো ডলার পুরস্কার দেব।

একশো ডলার। ফিসফিস করে বলল রবিন, ব্যাটার কি লাভ?

কিশোর জবাব না দেয়ায় আবার বলল নোকটা, তাহলে কেসটা নিচ্ছ? কেসটা উচ্চারণ করল কেস-আস।

খুশি হয়ে নেব, হাত বাড়িয়ে একটা প্যাড আর পেনসিল টেনে নিল কিশোর। আপনার নাম আর ফোন নম্বর…

ফাইন, বাধা দিয়ে বলল লোকটা। তাহলে এখুনি কাজে নেমে পড়ো। দিন দুয়েকের মধ্যেই আবার খোজ নেব।

কিন্তু আপনার নাম… থেমে গেল কিশোর, লাইন কেটে দিয়েছে ওপাশ থেকে। এক মুহূর্ত হাতের রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে রইল সে, তারপর আস্তে করে নামিয়ে রাখল। কাজ দিল, পুরস্কার ঘোষণা করল, আনমনে বলল কিশোর, কিন্তু নিজের নাম বলল না। আজ সকালে ওশন ওয়ারল্টে গিয়েছি সেকথাও জানে… নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল সে।

কিশোর, মুসা বলল, কেসটা নিচ্ছ তে? একশো ডলার, কম কি?

মোটেই কম নয়। টাকার চেয়েও বড় এখন এই রহস্যময় কল, এর রহস্য ভেদ করতেই হবে। তার ওপর যোগ হয়েছে একটা হারানো তিমি। কিন্তু কথা হচ্ছে, তদন্ত শুরু করি কোনখান থেকে? কয়েক সেকেণ্ড নীরব রইল কিশোর, তারপর টেনে নিল টেলিফোন বুক। টিনহা.শ্যাটাগো এই একটাই সূত্র আছে আমাদের

হাতে।

দ্রুত ডিরেক্টরির পাতা উল্টে চলল কিশোর। প্রথমে নামটা বিদঘুটে মনে হয়েছে তার কাছে, কিন্তু একেবারে যে দুর্লভ নাম নয়, ফোন বুক ঘেঁটেই সেটা বোঝা গেল। এক শহরেই শ্যাটানোগা পাওয়া গেল আরও তিনজন জিমবা শ্যাটানোগা, শিয়াওঁ শ্যাটানোগা আর ম্যারিবু শ্যাটানোগা! কিন্তু টিনহ, শাটানোগার নাম নেই।

মিস্টার জিমবাকে দিয়েই শুরু করল কিশোর তিনটে রঙের পর জবাব দিল অপারেটর, জিমবা শ্যাটানোগার লাইন কেটে দিয়েছে টেলিফোন বিভাগ।

অনেকক্ষণ ধরে শিয়াওঁ শ্যাটানোগার ফোন কেউ ধরল না, তারপর মোলায়েম একটা গলা প্রায় ফিসফিসিয়ে জবাব দিল। জানাল ব্রাদার শিয়াওঁ মন্দিরে ধ্যানমগ্ন রয়েছেন। যদি তিনি এসে ফোন ধরেনও কিশোরের কথা শুধু শুনতেই পারবেন, জবাব দিতে পারবেন না, কারণ ছ-মাস ধরে কথা বন্ধ রেখেছেন তিনি, আরও অনেকদিন রাখবেন। শুধু ইশারায়ই নিজের প্রয়োজনের কথা জানান।

হেত্তোরি! লাইন কেটে দিয়ে তিক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আগে ভাবতাম পাগলের গোষ্ঠী খালি ভারত আর আমার দেশেই আছে, এখন দেখছি এখানে আরও বেশি। কথা বন্ধ রেখেছে না ছাই, হুঁহু, বলতে বলতেই তৃতীয় নম্বরটায় ডায়াল করল।

আগের দুজনের তো কোনভাবে জবাব পাওয়া গেছে, এটার কোন সাড়াই এল। কেউ ধরল না ফোন।

ম্যারিবু শ্যাটানোগার নামের নিচে লেখা রয়েছে ঃ চার্টার বোট ফিশিং। আরেকবার চেষ্টা করে দেখল কিশোর, কিন্তু এবারও সাড়া মিলল না।

চার্টার-বোট-ফিশিং-শ্যাটানোগার খবরই নেই, রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। হলো না। অন্য কোন উপায় বের করতে হবে।

টিনহাকে কোথায় পাওয়া যাবে, জানি আমরা, বলল রবিন। হপ্তায় ছ-দিন পাওয়া যাবে তাকে ওশন ওয়ারন্ডে।

আরও একটা ব্যাপার জানি, কিশোর যোগ করল, মানে চিনি। তার পিকআপ ট্রাক। চোখ আধবোজা করল সে, ভাবনা আর কথা একই সঙ্গে চলছে। বিকেল ছটায় বন্ধ হয় ওশন ওয়ার। তারপরেও নিশ্চয় অনেকক্ষণ থাকতে হয় টিনহাকে, কারণ সে ট্রেনার। দর্শক চলে যাওয়ার পরও তার কাজ থাকে। ঝট করে সোজা হলো সে। মুসা তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই। আজ হবে না, দেরি হয়ে গেছে। কাল যাবে।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কোথায়?

কাল বলব।

পরদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বোরিসকে পাকড়াও করল কিশোর, তাদেরকে ওশন ওয়ারন্ডে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে।

ইয়ার্ডের ছোট ট্রাকটা বের করল বোরিস, তাতে দুটো সাইকেল তোলা। হলো। তিন কিশোরের কাজেকর্মে আজকাল আর বিশেষ অবাক হয় না সে, তবু প্রশ্ন না করে পারল না, তোমরা মানুষ তিনজন, সাইকেল নিয়েছ দুটো। তৃতীয়জনকে কি দুই সাইকেলে ঝুলিয়ে নিয়ে ফিরবে?

মুসার সাইকেলের দরকার হবে না,বাোিকে আশ্বস্ত করুল কিশোর। বিনে পয়সায় গাড়িতে চড়বে সে।

হোকে (ও-কে), শ্রাগ করল বোরিস। আর কিছু না বলে ড্রাইভিং সীটে উঠে কল।

ওশন ওয়ারন্ডের পার্কিং লটে গাড়ি থামাল বোরিস। সাইকেল নিয়ে নেমে পড়ল তিন কিশোর।

জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল বোরি, আমাকে দরকার হলে ফোন কোরো ইয়ার্ডে। ট্রাক ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল সে।

টিনহার গাড়িটা খুঁজতে শুরু করল ওরা। বেশি খোঁজাখুজি করতে হলো না, দড়ির বেড়া দেয়া, স্টাফ লেখা সাইনবোর্ড লাগানো একটা জায়গায় দেখা গেল সাদা পিকআপটা। ঘুরে গাড়ির পেছনে চলে গেল কিশোর আর মুসা, গেটে পাহারায় রইল রবিন। টিনহাকে আসতে দেখলেকদের হুঁশিয়ার করে দেবে।

ট্রাকের পেছনটা খালি নয়। নানারকম জিনিসপত্র ফোম রবারের লম্বা লম্বা ফালি, এলোমেলো দড়ি, আর বেশ বড়সড় এক টুকরো ক্যানভাস, ছড়িয়ে পড়ে আছে।

মেঝেতে শুয়ে পড়ল মুসা। ক্যানভাস দিয়ে তাকে ঢেকে দিল কিশোর। রবারের ফানি এমনভাবে গরণে আর ওপরে রেখে দিল যাতে বোঝ না যায় কিছু। তাছাড়া আরেকটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে, গাড়ির পেছনে কেউ খুঁজে দেখতে আসবে বলেও মনে হয় না।

আমরা কেটে পড়ি,মুসাকে বলল কিশোর। ঘোরাঘুরি করতে দেখলে সন্দেহ করে কুৰে টিনহা। হেডকোয়ার্টারে অপেক্ষা করব তোমার জন্যে। ঠিক আছে?

ঠিক আছে,ক্যানভাসের তলা থেকে জবাব দিল ফুস। যত শীঘ্রি পারি ফোন করব।

কিশোরের নেমে যাওয়ার আওয়াজ শুনল মুসা। তারপর অনেকক্ষণ আর কোন শব্দ নেই, শুধু পার্কিং লটে মাঝে মাঝে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়া ছাড়া।

বেশ আরামেই আছে মুসা, সারাটা দিন পরিশ্রমও কম করেনি। ঘুম এসে গেল তার। হঠাৎ একটা শব্দে তন্দ্রা টুটে গেল। ক্যানভাসের ওপর পানি ছিটকে পড়েছে, কয়েকটা ফোটা চুইয়ে এসে তার মুখ ভিজিয়ে দিল। ঠোঁটেও লাগল পানি। কি ভেবে জিভ দিয়ে চাটল। নোনা পানি।

ট্রাকটা স্টার্ট নিল। গতি বাড়া পর্যন্ত অশেক্ষা করল মুসা, তারপর সাবধানে মুখের ওপর থেকে ক্যানভাস সরিয়ে উঁকি দিল। তার মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে রয়েছে বড় একটা প্ল্যাসটিক কনটেইনার। চার পায়ের ওপর রয়েছে জিনিসটা। মূসা রয়েছে তলায়। পানি ছলাৎছল করছে ভেতরে। জীবন্ত কিছু ঘষা মারছে কনটেইনারের গায়ে।

মাছ, অনুমান করল মুসা, মাছ জিয়াননা রয়েছে ভেতরে। আবার মুখের ওপরে ক্যানভাস টেনে দিল সে।

ছুটে চলেছে ট্রাক, ঝাকুনি প্রায় নেই। তারমানে সমতুল মসৃণ রাস্তা দিয়ে চলেছে। বোধহয় কোস্ট হাইওয়ে ধরেই। কয়েক মিনিট পর গতি কমল ট্রাকের। ওপর দিকে উঠতে শুরু করল পাহাড়ী পথ বেয়ে। কোথায় এল? সান্তা মনিকা? কোন দিকে কবার মোড় নিচ্ছে গাড়ি খেয়াল রাখার চেষ্টা করল সে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। গোলমাল হয়ে গেল। আবার সমতলে নেমে এল গাড়ি।

অন্ধকার নামার পর আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল গাড়ি। নেশ ঘোরানো পথ। সান্তা মনিকায় পাহাড়ী অঞ্চলেরই কোন জায়গা হবে, অনুমান করল মুসা।

অবশেষে থামল পিকআপ। টেইল গেট নামানোর শব্দ শোনা গেল। তারপর খালি পায়ের শব্দ। দম বন্ধ করে রইল মুসা।

পানির জোর ছলাৎছল, নিশ্চয় কনটেইনারটা তোলা হচ্ছে। চলে গেল পায়ের শব্দ।

মিনিট তিনেক অপেক্ষা করল মুসা, তারপর ওপর থেকে ক্যানভাস সরাল।

বেশ বড়সড় বিলাসবহুল একটা র‍্যঞ্চ হাউসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। পিকআপ। সদর দরজার সামনে একটা ল্যাম্প ঝুলছে। কংক্রিটের সিড়ি উঠে গেছে দরজা পর্যন্ত। সিড়ির গোড়ায় একটা মেইলবক্স। নামটা পড়তে পারছে মুসা : উলফ।

আরও এক মিনিট অপেক্ষা করল মুসা, তারপর খুব সাবধানে নামল ট্রাক থেকে। ঘুরে চলে এল গাড়ির সামনের দিকে, বনেটের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাড়িটার ওপর নজর রাখার ইচ্ছে।

কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এই এলাকায় ওরকম বাড়ি থাকতে পারে ভাবেনি সে। তবে অবাক হলো অন্য একটা কারণে। দরজার কাছে ওই একটি মাত্র আলো ছাড়া পুরো বাড়িটা অন্ধকার। কোন জানালায় আলো নেই। টিনহা ওই বাড়ির ভেতরে গিয়েছে কিংবা আছে বলে মনে হয় না ভাবসাব দেখে।

এখানে সারারাত এভাবে ঘাপটি মেরে থাকার কোন মানে নেই, ডাবল মুসা। দুটো কাজ করতে পারে সে এখন। গলির মাথায় গিয়ে রাস্তার নাম-নম্বর জেনে উলফের ঠিকানা জানিয়ে কোথাও থেকে ফোন করতে পারে কিশোরের কাছে। কিংবা খোজ করে দেখতে পারে, টিনহা কোথায় গেছে, কি অবস্থায় আছে, কি করছে প্ল্যাসটিক কনটেইনারের জ্যান্ত মাছ নিয়ে।

দুটোর মধ্যে প্রথমটাই মনঃপূত হলো মুসার। গলির মাথায় যাওয়ার জন্যে সবে পা বাড়িয়েছে, এই সময় মেয়েলী কণ্ঠে কথা শোনা গেল, কাকে জানি নাম ধরে ডাকছেঃ রোভার! রোভার!

ডাকের জবাব শোনা গেল না।

মুসা শিওর, ঘরের ভেতর থেকে কথা বলেনি মেয়েটা, বাইরে কোথাও রয়েছে। হয়তো পেছনের আঙিনায়।

বাড়িতে ঢোকার পথ খুঁজতে লাগল মুসা। চোখে পড়ল, বাঁ দিকে কংক্রিটের একটা সরু পথ ধীরে ধীরে উঠে গেছে গ্যারেজে। গ্যারেজের পাশে একটা কাঠের ঘোট গেট, তার ওপরে তারাজ্বলা কালো আকাশের পটভূমিকায় কয়েকটা পাম গাছের মাথা।

নিঃশব্দে গেটের কাছে চলে এল মুসা। সাধারণ একটা খিল দিয়ে গেটের পান্না আটকানো রয়েছে। ভেতরে ঢুকে আবার লাগিয়ে দিল পান্না।

গ্যারেজের পেছনে সিমেন্ট বাঁধানো একটা পাকা পথ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝুঁকে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল পা পা করে।

আবার ডাক শোনা গেল : রোভার! রোভার!

খুব কাছেই রয়েছে মহিলা। মূসার মনে হলো, মাত্র কয়েক গজ দূরে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। সামনে আর বাঁয়ে এক চিলতে করে ঘাসে ঢাকা জমির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে পামের সারি, রাস্তা থেকেই দেখেছে ওগুলো। ডানের কিছু দেখতে পারছে না। বাগান বা যা-ই থাকুক ওখানে দেখা যাচ্ছে না এখনও গ্যারেজের দেয়ালের জন্যে। এক সেকেণ্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল সে, তারপর এক ছুটে ঘাসে ঢাকা জমি পেরিয়ে চলে এল পামের সারির কাছে। লম্বা দম নিয়ে ঘুরে তাকাল।

চোখে পড়ল বিশাল এক সুইমিং পুল, মূল বাড়িটার প্রায় সমান লম্বা। পানির নিচে আলো, ঝিকমিক করছে টলটলে পানি।

রোভার। লক্ষ্মী ছেলে রোভার, বলল টিনহা।

সুইমিং পুলের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সে, পরনে সেই টু-পীস সাঁতারের পোশাক, অফিসে যেটা পরে ছিল সকালে। তার পাশে কংক্রিটের চত্বরের ওপর রাখা আছে প্ল্যাসটিকের কনটেইনারটা।

ঝুঁকে কনটেইনার থেকে একট মাছ তুলে নিল টিনহা, জ্যান্ত মাছ, ছটফট করছে, লেজ ধরে ওটাকে ছুঁড়ে মারল। বৈদ্যুতিক আলোয় ক্ষণিকের জন্যে রূপালী একটা ধনুক সৃষ্টি করে পুলের ওপর উড়ে গেল মাছটা।

সঙ্গে সঙ্গে পানি থেকে মাথা তুলল একটা ধূসর জীব। উঠছে, উঠছে, উঠছে, পানি থেকে বেরিয়ে এল পুরো সাত ফুট শরীর। একটা মুহুর্ত শূন্যেই স্থির হয়ে ঝুলে রইল যেন। মুখ হাঁ করে রেখেছে। শুন্যে থেকেই মোচড় দিয়ে শরীর বাকিয়ে ধরে ফেলল উড়ন্ত মাছটা, তারপর নিখুত ভাবে ডিগবাজি খেয়ে আবার পানিতে পড়ল মাছ মুখে নিয়ে।

রোভার লক্ষী ছেলে, হাসি মুখে প্রশংসা করল টিনহা। ডুবুরীর ফ্লিপার পরাই আছে তার পায়ে, ডাইডিং গগলসটা ফিতেয় ঝুলছে গলা থেকে, ওটা পরে নিল চোখে। পুলে নামল।

বেশ ভাল সাঁতারু মুসা নিজে, অনেক ভাল ভাল সাঁতারুকে দেখেছে, কিন্তু টিনহার মত কাউকে আর দেখেনি। সাঁতার কাটার জন্যেই যেন জন্ম হয়েছে তার, ডাঙা নয়, পানির জীব যেন সে, এমনি স্বচ্ছন্দ সাবলীল ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে। হাত-পা প্রায় নড়ছেই না, বাতাসে ডানা মেলে যে ভাবে ভেসে উড়ে চলে সোয়ালো পাখি টিনহার সাঁতার কাটার ভঙ্গি অনেকটা সেরকম।

চোখের পলকে চলে এল পুলের মাঝখানে ছোট তিমিটার কাছে। এমন ভাবভঙ্গি যেন অনেক পুরানো বন্ধুত্ব। নাক দিয়ে আস্তে করে টিনহার গায়ে এতো মারল তিমিটা। ওর গোল মাথাটা ডলে দিল টিনহা, ঠোঁটে টোকা দিয়ে আদর করল। এক সঙ্গে ডাইভ দিয়ে নেমে চলে গেল পুলের তলায়, হুঁশ করে ভেসে উঠল আবার। পাশাপাশি সাঁতার কাটল কিছুক্ষণ, তারপর তিমির পিঠে সওয়ার হলো টিনহা।

কোথায় রয়েছে ভুলেই গেছে মুসা দেখতে দেখতে। নিজের অজান্তেই একটা গাছের গোড়ায় ঘাসের ওপর বসে পড়েছে, থুতনিতে হাত ঠেকানো। এরকম দৃশ্য সিনেমায়ও দেখা যায় না, পুরোপুরি মগ্ন হয়ে গেছে সে।

নতুন খেলা শুরু করল টিনহা। তিমিটাকে নিয়ে চলে এল পুলের এক প্রান্তে, মূসা যেদিকে বসে আছে সেদিকে তিমির মাথায় আস্তে করে চাপড় দিয়ে হঠাৎ পানিতে ডিগবাজি খেয়ে শরীর ঘুরিয়ে শাঁ করে চলে গেল দূরে। তিমিটা অনুসরণ করল তাকে।

আবার তিমির মাথায় চাপড় দিল টিনহা, মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। আবার সরে গেল তিমির কাছ থেকে। এবার আর পিছু নিল না তিমি, যেখানে আছে সেখানেই রইল।

পুলের অন্য প্রান্তে গিয়ে কংক্রিটে বাঁধানো পাড়ের কিনারে উঠে পানিতে পা ঝুলিয়ে বসল টিনহা। অপেক্ষা করে আছে তিমি।

রোভার! রোভার! ডাকল টিনহা।

পানি থেকে মাথা তুলল তিমি। চোখ সতর্ক হয়ে উঠেছে, দেখতে পাচ্ছে মুসা। দুটতে শুরু করল তিমি। পানির মধ্যে দিয়ে শাঁ করে উড়ে গিয়ে পৌঁছল যেন টিনহার পায়ের কাছে।

লক্ষ্মী ছেলে, লক্ষ্মী রোভার, তিমির ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করল টিনহা। কাত হয়ে হাত বাড়িয়ে কনটেইনার থেকে একটা মাছ এনে গুজে দিল রোভারের খোলা মুখে।

লক্ষ্মী ছেলে, লক্ষ্মী রোভার, আবার তিমিটাকে আদর করল সে। তারপর পাশে ফেলে রাখা একটা বিযেন তুলে নিল।

জিনিসটা কি চিনতে পারছে না মুসা। পূলের নিচে আলো আছে, তাতে পুরোপুরি আলোকিত হয়েছে পানি। কিন্তু পুলের ওপরে চারধারে অন্ধকার।

নাম ধরে ডাকল তিমিটাকে টিনহা।

মাথা তুলেই রেখেছে, রোভার, আস্তে আস্তে উঁচু করতে শুরু করল শরীর। নেজের ওপর খাড়া হয়ে উঠল আশ্চর্য কায়দায় পানিতে ভর রেখে। ওটাকে জড়িয়ে ধরল টিনহা। না না, জড়িয়ে তো ধরেনি, দুহাত তিমির মাথার পেছনে নিয়ে গিয়ে কি যেন করছে।

ভাল করে দেখার জন্যে মাথা আরেকটু উঁচু করল মুসা। চিনে ফেলল জিনিসটা। ক্যানভাসের তৈরি একটা লাগাম পরাচ্ছে টিনহা। ঘাড় তো নেই তিমির চোখের পেছনে যেখানে ঘাড় থাকার কথা সেখানে লাগিয়ে দিচ্ছে কেট। শক্ত করে বকলেস আটকে দিল। ঠিক লাগাম বলা যায় না ওটাকে, কুকুরের গলায় যে রকম কলার আটকানো হয় তেমন ধরনের একটা কিছু কলারও ঠিক বলা চলে না।

হঠাৎ মাথা নুইয়ে ফেলল মূসা। উপড় হয়ে শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।

গেট খোলার শব্দ। বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে পায়ের আওয়াজ। এত কাছে এসে গেল, মুসার ভয় হলো তাকে না দেখে ফেলে।

পুলের দিকে চলে গেল পদশব্দ, থামল।

হাই টিনহা, পুরুষের গলা।

শুড ইভিনিং, মিস্টার উলফ।

মাথা তুলে দেখার সাহস হলো না মুসার, শুধু থুতনিটা ঘাসের ছোঁয়া মুক্ত করে তাকাল পলের দিকে।

টিনহার পাশে দাঁড়িয়েছে লোকটা। বেঁটেই বলা চলে, মেয়েটার চেয়ে ইঞ্চি। ছয়েক খাটো। অন্ধকারে রয়েছে মুখ। চেহারা বোঝার উপায় নেই। তবে একটা জিনিস দিনের আলোর মত স্পষ্ট। টাক। পুরো মাথা জুড়ে টাক, আবছা

অন্ধাকরেও চকচক করছে। হাতের চামড়া আর শরীরের বাধন দেখে অনুমান করল মুসা, লোকটার বয়েস তিরিশের বেশি হবে না, বয়েসের ভারে চুল উঠে গেছে তা নয়।

কেমন চলছে? জিজ্ঞেস করল লোকটা। কখন রেডি হবে? টেনে টেনে কথা বলে।

শুনুন, মিস্টার উলফ, লোকটার দিকে তাকাল টিনহা, শীতল কণ্ঠস্বর। রেগে যাচ্ছে বোঝাই যায়। শুধু বাবার জন্যে আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছি। আমাকে আমার মত কাজ করতে দিন। সময় হলে বলব। বেশি বাড়াবাড়ি যদি করেন, রোভার সাগরে ফিরে যাবে। আরেকটা তিমি এক আরেকজন ট্রেনার খুঁজে বের করতে হবে তখন আপনাকে। এক মুহুর্ত থেমে বলল, বুঝেছেন?

বুঝেছি, মিস শ্যাটআ-নোগা।

<

Super User