জিনা? কি হয়েছে, জিনা? ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

জবাবে শুধুই চিৎকার। মাথা খারাপ হয়ে গেছে যেন জিনার।

মরছে নাকি! আলো হাতে পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল ম্যাকআরখার, করিডরে গিয়ে ঢুকল।

পেছনে গেল ছেলেরা।

মস্ত এক কালো খাদের পাড়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে জিনা। আরেক পা এগোলেই যেত পড়ে গর্তের মধ্যে।

থামো! এই মেয়ে, শুনছ? চুপ! ধমক দিল ম্যাকআরথার। হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে জিনাকে সরিয়ে আনল গর্তের ধার থেকে। কি, হয়েছে কি?

থরথর করে কাঁপছে জিনা, হাত তুলে ইঙ্গিত করল গর্তের দিকে। ও-ওখানে…নিচে…

সাবধানে খাদের পাড়ে এসে দাঁড়াল চারজনে। ভেতরে আলো ফেলল ম্যাকআরখার, উঁকি দিল ছেলেরা। বেশি গভীর নয়, দশ-বারো ফুট। তবে একেবারে খাড়া দেয়াল।

খাদের তলায় কি যেন পড়ে আছে। প্রথমে কাপড়ের স্তুপ বলে মনে হলো। কিন্তু ঠিকমত আলো ফেলে ভাল করে তাকাতেই দেখা গেল, একটা হাত বেরিয়ে আছে। কাপড়ের ভেতরে রয়েছে দেহটা, দুমড়ে-মুচড়ে বিকৃত। চোখের জায়গায়। দুটো শূন্য কোটর, মাথার চুল পাটের রুক্ষ আঁশের মত লেপটে রয়েছে খুলির সঙ্গে।

মরা! চেঁচিয়ে উঠল আবার জিনা। মরা!…মরে গেছে।

আহ, থামোতো। আবার ধমক লাগাল ম্যাকআরথার।

ঢোক গিলল জিনা, চুপ করল।

বেরোও, আদেশ দিল ম্যাকআরথার। সব্বাই।

দু-পাশ থেকে জিনার দু-হাত ধরে টেনে নিয়ে এগোেল কিশোর আর রবিন। পেছনে টলমল পায়ে চলল মুসা। সবার পেছনে আলো হাতে রয়েছে। ম্যাকআরথার।

খোলা আকাশের নিচে উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল ওরা।

কুকুরের পরিচিত ডাক অপার্থিব লাগছে কিশোরের কানে। যেন এইমাত্র ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে। গুহার তলায় কাপড়ের স্তুপের ভেতরে কোচকানো চামড়া আর হাড্ডি সর্বস্ব হাত, শূন্য কোটর, লেপটানো চুল…শিউরে উঠল সে, কড়া রোদের মাঝেও শীত শীত লাগছে।

যাও, বাড়ি যাও, বলল ম্যাকআরথার। খবরদার, আর কখনও এদিকে আসবে না। যদি আর কোনদিন দেখি…

গটমট করে গিয়ে কেবিনে ঢুকল সে, দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা।

ধীর পায়ে এগোল ছেলেরা। খনিমুখের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখন একটা উজ্জা লাল শেভি সুবারব্যান ট্রাক, ম্যাকআরথারের। ওটার পাশ দিয়ে মাঠ পেরিয়ে এগোল। পিকআপের পাশ কাটিয়ে এল, চালানোর সাধ্য নেই আর এখন জিনার। হেঁটে চলল বাড়িতে।

র‍্যাঞ্চ হাউসে ফিরতে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল জিনা। রক্ত ফিরল মুখে। শেরিফকে খরব দিতে হবে। ম্যাকআরথারের কাজ। আগেই বলেছি, বাটা নাম্বার ওয়ান শয়তান।

তোমার দরকার নেই, বলল কিশোর, সেই এতক্ষণে খবর দিয়ে ফেলেছে। শেরিফকে। শেরিফের কাছে ওর কথা উল্টো-পাল্টা কিছু বলবে না, সাবধান।

কেন বলব না? তর্ক শুরু করল জিনা। ওর খনিতে মানুষ মরে পড়ে আছে…

শহরের দিক থেকে ছুটে আসছে ছোট্ট একটা ধুলোর মেঘ। কয়েক সেকেন্ড পর ওদের পাশ কাটিয়ে গেল মেঘটা, বাদামী রঙের একটা সিডান গাড়ি। দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ওশেরিফ। পলকের জন্যে ড্রাইভারকে দেখতে পেল ছেলেরা, বিশালদেহী লোক, মাথায় স্টেটসন হ্যাট! ম্যাকআরথারের কেবিনের সামনে গিয়ে থামল গাড়ি।

কি বলেছিলাম? জিনার দিকে চেয়ে হাসল কিশোর।

হাসিটা ফিরিয়ে দিল জিনা, কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। শেরিফকে কি বলে ম্যাকআরথার কে জানে।

তোমার চাচাকে কি বলবে, তাই ভাববা, পথের দিকে নির্দেশ করল কিশোর। স্টেশন ওয়াগনটা ফিরছে।

গেটের কাছে পৌঁছে গেছে ছেলেরা, স্টেশন ওয়াগনও এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ডাকলেন উইলসন, জিনা? শেরিফকে। দেখলাম। কিছু হয়েছে?

ম্যাকআরথারের খনিতে একটা লাশ পড়ে আছে, আরেক দিকে চেয়ে জবাব দিল জিনা।

লাশ? খনিতে?

মাথা ঝোঁকাল জিনা।

মাদ্রে দু দিও! বিড় বিড় করল ভিকি, বেরিয়ে আসছে গাড়ি থেকে। জিনা, তুমি জানলে কিভাবে?

অস্বস্তিকর নীরবতা। ভাইঝির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন উইলসন। জিনা, আবার ঢুকেছিলি খনিতে?

কোনমতে মুখ তুলে বলল জিনা, হ্যা…গতরাতে গুলির শব্দ শুনলাম তো…ভাবলাম…।

কোন কৈফিয়ত শুনতে চাই না, কড়া গলায় বললেন তিনি। যাও, বাড়ি যাও। খবরদার, আর বেরোবে না।

গাড়ি থেকে নেমে মাঠের ওপর দিয়ে ম্যাকআরবারের বাড়ির দিকে দৌড় দিলেন উইলসন। তার সঙ্গে যোগ দিলেন মিসেস ফিলটার, শেরিফের গাড়ি দেখেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।

র‍্যাঞ্চ হাউসের দোতলায় এক জানালা থেকে আরেক জানালায় গিয়ে উঁকি দিতে লাগল চারজনেই। বাইরে, ম্যাকআরথারের বাড়িতে কি হচ্ছে দেখার জন্যে উদগ্রীব। আরও কিছুক্ষণ পর একটা অ্যামবুলেন্স গিয়ে থামল খনিমুখের সামনে। ঘন্টাখানেক পর চলে গেল শহরের দিকে। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা গাড়ি এসেছে। তার একটা হাইওয়ে পেট্রল পুলিশের।

বেলা তিনটায় পিকআপটা নিয়ে ফিরে এলেন উইলসন।

চাচা, দেখেই বলে উঠল জিনা, ম্যাকআরথারকে অ্যারেস্ট করেছে?

তাকে কেন করবে? খনির ভেতর লোকটা অনেক আগে মরেছে। ময়না তদন্তের পর বোঝা যাবে কয় বছর আগে ঘাড় ভেঙেছিল। এতে ম্যাকআরথারের দোষ কি? খনির মুখ শিক দিয়ে বন্ধ করার আগেই মরেছে লোকটা।

পাঁচ বছর, উইলসনের সাড়া পেয়েই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে ভিকি। আহা, বেচারা। পাঁচ-পাঁচটি বছর ধরে মরে পড়ে আছে ওখানে, কেউ জানে না।

মাত্র পাঁচ? মুসা বলল। আমি তো ভেবেছি চল্লিশ বছর।

খনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই, জানাল ভিকি, তবে মুখ বন্ধ করা হয়নি, লোক যাতায়াত থামেনি। অ্যাকসিডেন্টের ভয়ে শেষে বছর পাচেক আগে, বসন্তকালেই বুঝি…হা, হ্যাঁ, বসন্তকালে শিক দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করে দেয়া হয়।

মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে কিশোর, আনমনে একটা কিছু ছুঁড়ছে আর লুফে নিচ্ছে।

কি, ওটা? জিজ্ঞেস করল জিনা।

খপ করে ধরল আবার কিশোর। খনিতে পেয়েছি। এটার জন্যেই আলো ধরতে বলেছিলাম তোমাকে। ডান হাতের তর্জনী জিভে ঠেকিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে পাথরের মত জিনিসটার গা ডলল। শুনেছি ওটা রুপার খনি ছিল। সোনাও ছিল নাকি?

না, শুনিনি তো? উইলসন বললেন।

পাথরটা আলোর দিকে ধরল কিশোর। উজ্জ্বল একটা দাগ। আয়রন পাইরাইট হতে পারে। ফুলস গোন্ড বলে একে। বাংলায় বলল, বোকার স্বর্ণ…না না, সোনালি ফাঁকি।

আয়রন পাইরাইট না কিসের পাইরাইট, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার,বলে উঠল জিনা। আমি জানতে চাই, আগে কেন লাশটার কথা পুলিশকে বলেনি ম্যাকআরখার? আমরা দেখে ফেলায় জানাতে বাধ্য হয়েছে।

ধৈর্য হারালেন উইলসন। ম্যাকআরথার জানত নাকি, লাশ আছে? গত হপ্তায় মাত্র শিকগুলো সরিয়েছে সে, খনির ভেতরে পুরোপুরি দেখার সময়টা পেল কই? পাঁচ বছর আগের একটা মড়া লুকানোর কোন দরকার আছে তার? দেখো জিনা, বেশি মাথায় উঠে গেছ।

বাইরে একটা গাড়ি এসে থামল। শব্দ শুনেই দরজা খুলে দিল ভিকি।

বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলেন শেরিফ। সরাসরি তাকালেন জিনার দিকে। জিনা, তুমি জানো, খনিটার নাম কেন ডেথ ট্রাপ রাখা হয়েছে?

মাথা ঝাঁকাল জিনা। ওখানে অ্যাকসিডেন্টুে লোক মারা যায়। যায় তো?

আবার মাথা ঝাঁকাল জিনা। যায়। জানি।

আবার যদি ওখানে যাও, ধরে নিয়ে গিয়ে সোজা হাজতে ভরবো। কোর্টে যেতে হবে তোমার চাচাকে, তোমাকে ছাড়াতে। ছেলেরা, তোমাদেরও হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।

একটা চেয়ার টেনে বসলেন শেরিফ।

লোকটা কে, জানা গেছে? জিজ্ঞেস করলেন উইলসন।

বোধহয়, শেরিফ বললেন। পকেটে মানি ব্যাগ আর একটা আইডেনটিটি কার্ড পেয়েছি, তাতে স্যান ফ্রানসিসকোর ঠিকানা। ওখানে ফোন করলাম। পুলিশ জানাল, বছর পাঁচেক আগে জানুয়ারি মাসে বাড হিলারি নামে একটা লোক নিখোঁজ হয়েছে, রেকর্ড আছে। লোকটার অনেকগুলো ছদ্মনাম, এই যেমন, বেরি হারবার্ট, বন হিরাম, বার হুম্যান। ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে স্যান কুয়েনটিন-এ জেল খেটেছে ছয় বছর। ছাড়া পাওয়ার পর পুলিশ স্টেশনে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছে মাত্র দুবার, তারপরই গায়েব। পুলিশের ওয়ানটেড লিস্টে আছে দীর্ঘ দিন ধরে। খনিতে পাওয়া লাশের সঙ্গে হিলারির চেহারার বর্ণনা মিলে যায়। বদ্ধ বাতাসে একই আবহাওয়ায় থেকে পচেনি দেহটা, মমি হয়ে গেছে। আরও শিওর হওয়ার জন্যে তার ডেন্টাল চার্ট চেক আপ করার নির্দেশ দিয়েছি।

বেচারা ম্যাকআরথার, ব্যঙ্গ প্রকাশ পেল জিনার কণ্ঠে, লাশটা যে আছে তার খনিতে, জানেই না।

জানেনা-ই তো। জানলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করত আমাকে, উঠে দাঁড়ালেন শেরিফ। তো, যা বলেছি মনে থাকে যেন, ইয়াং লেডি। খনির ধারে কাছে যাবে

শেরিফকে এগিয়ে দিতে বেরোলেন উইলসন।

শিক খোলার পর খনির ভেতরটা ঘুরে দেখেনি ম্যাকআরথার, অবাকই লাগে, বলল কিশোর। আমার খনি হলে আমি আগে ঘুরে দেখতাম।

বলছিই তো ব্যাটা আস্ত ইবলিস! জিনার সেই এক কথা।

পাঁচ বছর আগে, জানুয়ারি মাসে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, বাড হিলারি নামের এক ডাকাত, ছাড়া পেল জেল থেকে। এরপর নিয়মিত দুই বার দেখা করল সে স্যান ফ্রানসিসকো পুলিশ অফিসে, তারপর গায়েব। তখন ছিল বসন্তকাল, খনির মুখ বন্ধ করার সময়। পালিয়ে টুইন লেকসে চলে এসেছিল লোকটা, খনিতে পড়ে মরল। কিন্তু স্যান ফ্রানসিসকো থেকে পালানো আর খনিতে পড়ার আগে মাঝখানের সময়টা সে কোথায় ছিল? কি করেছিল? ভিকিখালা, বলতে পারো, টুইন লেকসেই কি ছিল সে।

মাথা নাড়ল ভিকি। টুইন লেকস খুব ছোট জায়গা, সবাই সবাইকে চেনে। নতুন কেউ এলে চোখে পড়েই।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঠিক পুলিশের নজর থেকে পালিয়ে এলে অন্য কারও. চোখে পড়তে চাইবে না। অথচ ইচ্ছে করেই যেন এখানে চোখে পড়তে এল সে।

পাঁচ বছর আগে টুইন লেকসে আসলে কি ঘটেছিল? কিশোরের কথার পিঠে বলল জিনা। একটা চোর ভেতরে থাকতেই বন্ধ করে দেয়া হলো খনির মুখ। এ ব্যাপারে কারও বিশেষ আগ্রহ ছিল না তো? হ্যারি ম্যাকআরথারের মত?

আমার মনে হয় না, টেবিলে শুপ করে রাখা সংবাদপত্রগুলো ঘটছে রবিন। তবু খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি আমরা। তাতে যদি তোমার দুশ্চিন্তা দূর হয়, ভাল।

কি ভাবে?

স্থানীয় খবরের কাগজ, একটা কাগজ তুলে দেখাল রবিন। দি ডেইলী টুইন লেকস। শহরের কোথায় কি ঘটছে না ঘটছে সব ছাপা হয়। এমন কি কার বাড়িতে কবে কজন মেহমান এল সে খবর পর্যন্ত। পুরানো কাগজ ঘাটলে বাড হিলারির ব্যাপারে কিছু বেরিয়েও যেতে পারে।

দারুণ আইডিয়া! আনন্দে হাত তালি দিয়ে জিনা বলল, চলো এখুনি যাই। সম্পাদক সাহেবকে আমি চিনি। আমি আসার খবর পেয়েই এসে দেখা করেছিলেন, কেন এসেছি, কদিন থাকব, নানা রকম প্রশ্ন। ছেপে দিয়েছেন পত্রিকায়। তোমরা যে এসেছ, সে খবরও নিশ্চয় পেয়েছেন। এখনও আসছেন না কেন তাই ভাবছি।

বাড়ি থেকে বেরোতে দেবেন তোমার চাচা? মুসার প্রশ্ন।

দেবে না মানে, একশো বার দেবে। খনি ছাড়া অন্য যে কোন জায়গায় যেতে দেবে।

<

Super User