আরে আরও কয়েকটা কেক নাও না, রান্নাঘরে লম্বা টেবিলের কিনার থেকে বলে মৃত্যু খনি উঠল ডিকি। খুব ভাল জিনিস, জ্যাম মেশানো।
মাথা নাড়ল কিশোর, না আর পারব না। অনেক খেয়েছি।
ভুরু কোঁচকাল ভিকি। অনেক খেয়েছ মানে? দিয়েছিই তো এই কটা। এজন্যেই এমন পাকাটির মত শুকনো, হাড় জিরজিরে। ওই জিনাটাও হয়েছে এমন। আজকালকার ছেলেপুলে, খালি ওজন নিয়ে ভাবে। আরে বাপু, ছেলেমানুষ তোমরা, অমন চড়ুইর খাবার খেয়ে বাড়বে কি করে?
আমাদের দিকে নজর দিও না, খালা, অনুরোধ করল জিনা। ওই ওকে খাওয়াও, শান্তি পাবে,মুসাকে দেখিয়ে দিল সে।
খাওয়াবই তো। খায় বলেই তো এমন চমৎকার স্বাস্থ্য। তোমাদের মত শোলা নাকি, ফুঁ দিলেই পড়ে যাবে। এই মুসা, কেকের ট্রে-টা ঠেলে দিল ভিকি,,
চট করে শেষ করে ফেলো তো এগুলো। আরও এনে দিচ্ছি।
ও-কি, উঠে যাচ্ছিস কেন, জিনা? বললেন উইলসন। তুই বাপ একেবারেই বেয়াড়া হয়ে গেছিস, তোর মাকে জানাতে হবে। বলি, আমরা সবাই রয়েছি টেবিলে, তুই উঠে যাচ্ছিস, ভদ্রতার খাতিরেও না হয় বসে থাক।
না খেলে বসে থেকে কি করবে? জিনার পক্ষ নিল ভিকি। ছেলেপিলের ওসব ভদ্রতার দরকার নেই। যাও, মুখ ধুয়ে ফেলো।
প্লেটটা নিয়ে সিংকে চুবাল জিনা।
হয়েছে হয়েছে, পেছন থেকে বলল ডিকি, ওটা তোমার ধুতে হবে না। আমিই সব খোব। তুমি মুখ ধুয়ে ফেলো।
রবিনও উঠল, হাতে এটো প্লেট।
তুমি এটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? ডাক দিল ভিকি।
ধুয়ে ফেলি। কি হবে? বাড়িতে কি ধুই না?
যাও তো। খাওয়া শেষ, হাত ধুয়ে ভাগো। রান্নাঘরে ভিড় পছন্দ নয় আমার। কাউকেই কোন সাহায্য করতে দিল না ভিকি, প্রায় জোর করে তাড়াল রান্নাঘর থেকে।
লিভিং রুমে এসে বসল সবাই। টেলিভিশনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সোফায় বসেই ঘুমিয়ে পড়লেন উইলসন। ছেলেরাও হাই তুলতে শুরু করল।
সব বাচ্চা খোকা, ঝাঝাল কণ্ঠে বলল জিনা। বিকেল না হতেই ঘুম। নটাও তো বাজেনি।
ভোর পাঁচটায় উঠেছি, সে খেয়াল আছে? প্রতিবাদ করল রবিন।
আমিও তো উঠেছি। এসো, দাবা খেলি…
আমি বাদ, তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর। মাথার ভেতরে একটা ঘড়ি কানো আছে আমার। ওটা জানাচ্ছে : রাত সাড়ে দশটা, শুতে যাও। আমি চললাম।
আমিও কিশোরের পিছু নিয়ে সিঁড়ির দিকে রওনা হলো মুসা।
বড় করে আরেকবার হাই তুলে রবিনও আগের দুজনকে অনুসরণ করল।
ধ্যাত্তোর! রাগে সোফার হাতলে থাবা মারল জিনা। আলসের ধাড়ী সব।
এত কম খেয়েও এত এনার্জি পায় কোথায় জিনা? নিজেদের ঘর বাংরুমে কাপড় ছেড়ে বিছানায় উঠে বলল মুসা।
মাথার নিচে হাত দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর। আনমনে বলল, আমি শিওর না।
টেলিভিশনের শব্দ থেমে গেল। শোনা গেল উইলসনের ঘুমজড়িত কণ্ঠ। একটা দরজা বন্ধ হওয়ার পর শাওয়ারে পানি ছাড়ার শব্দ হলো। বন্ধ হলো আরেকটা দরজা।
জিনাও ঘরে গেছে, বলল কিশোর।
কাত হয়ে বালিশে মাথা রেখে বেডসাইড ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল সে। অন্ধকার হয়ে গেল ঘর, কিন্তু পুরোপুরি নয়। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না আসছে। ঠাণ্ডা, জালি কাটা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঠের মেঝেতে।
চোখ মুদল কিশোর। ঘুমিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। ভোতা একটা শব্দ শুনেছে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল প্রতিধ্বনির রেশ।
বিছানায় উঠে বসল সে। কান পেতে অপেক্ষায় রইল আবার শব্দ হয় কিনা শোনার জন্যে।
নিজের বাংকে গুঙিয়ে উঠল মুসা। ভিকি। আবার গুলি করেছে কুকুরটাকে।
না, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। গুলির শব্দই, কিন্তু ভিকি না। অনেক দূর থেকে এসেছে।
বিস্তৃত ক্রিস্টমাস ক্ষেতের দিকে তাকাল সে, চাদের আলোয় রহস্যময় মনে হচ্ছে গাছগুলোকে। ডানে মিসেস ফিলটারের বাড়ি আর পরিত্যক্ত বিশেষ স্থানগুলো। নাক বরাবর সোজা, ধীরে ধীরে উঠে যাওয়া উপত্যকার ম্যাকআরবারের সম্পত্তি। ছোট একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে খনিমুখের কাছে। কেবিনের কাছে একটা ছায়ার নড়াচড়া। শেকলে বাধা কুকুরটা মাথা তুলে হউউউ করে উঠল।
উইলসনের এলাকায় ঢোকার গেটের ওধারে ছোট বাড়িটার এক ঘরে আলো জ্বলল, আলো এসে পড়ল গেটের কাছে। ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল মিসেস ফিলটার, পরনে ড্রেসিং গাউন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকাল, বোধহয় ম্যাকআরবারের
কেবিনের দিকেই।
নিচে লিভিং রুমে কথাবার্তা শোনা গেল। উইলসন উঠে পড়েছেন, ভিকিও।
আমি না, ভিকির কণ্ঠ, আমি গুলি করিনি।
সিঁড়িতে খালি-পায়ের শব্দ হলো। দরজায় করাঘাত। শুনছ, মশাইরা? জিনা। শুনেছ কিছু?
ড্রেসিং গাউন পরে দরজা খুলে বেরোল তিন গোয়েন্দা।
একটা জানালার চৌকাঠে হাতের ভর রেখে বাইরে মাথা বের করে দিয়েছে। জিনা। ফিসফিস করে বলল, ম্যাকআরথার। আমি শিওর, ওদিক থেকেই শব্দটা এসেছে। দেখে যাও।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। কি? মৃত্যু খনি
রোজি ফিলটারের বাড়ির দিকে দেখাল জিনা। ঘুরে গিয়ে ঘরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন মহিলা। মিসেস ফিলটারও জেগে গেছেন, জিনা বলল। ম্যাকআরবারের কুত্তাটাও। ইস, রাফিয়ানকে নিয়ে আসা উচিত ছিল। বাবার জন্যেই পারলাম না। এমনিতে দেখতে পারে না, অথচ এখন বাড়ি পাহারায় রেখে দিব্যি কেমন নিশ্চিন্তে বিদেশ চলে গেছে। ওই কুত্তাটা কি রকম ঘাউ দাউ করছে শুনছ? আগে থেকে ওরকম চেচালে ওর ডাকেই ঘুম ভেঙে যেত আমাদের। অথচ কানের কাছে থেকেও ম্যাকআরখারের ঘুম ভাঙছে না। তুমি আমি হলে কি করতাম? আলো জ্বেলে বাইরে বেরিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতাম, কেন এমন করছে জানার চেষ্টা করতাম। অথচ ব্যাটা কিছুই করছে না। ও নিজেই তো গুলি করেছে, জানার চেষ্টা করবে কি?
জিনা? নিচ থেকে ডাকলেন উইলসন। তুই ওখানে কি করছিস?
দেখছি, জবাব দিয়ে বেয়ে সিঁড়ির মাথায় উঠে গেল জিনা। চাচা, দেখে যাও। ম্যাকআরথারই গুলি করেছে।
জিনা, কয়েক ধাপ উঠে এলেন উইলসন, নাহ, ম্যাকআর্যার রোগেই ধরল দেখি তোকে। মাথাটা খারাপ করে দিল। ও কিছু না, বুঝলি। কেউ খরগোশ মারছে। কিংবা কয়োট।
কে? প্রশ্ন করল জিনা। পুরো এলাকাটা দেখতে পাচ্ছি আমি। কাউকে দেখছি। কথােট হলে আমাদের মুরগীগুলো খেতে আসে না কেন?
কি করে আসবে? ওদিকেই আগে হানা দিয়েছিল, গুলি করে তরে ফেলেছে, বললেন উইলসন। যা, নিচে, শো গিয়ে। ওদেরকে ঘুমোতে দে।
ধ্যাত্তোর! বিরক্তি চাপতে পারল না জিনা। সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাবে, জানালার কাছ থেকে ডাকল কিশোর।
এগিয়ে গেল জিনা।
কেবিনের বাইরের খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসেছে ম্যাকআরথার। বগলতলায় চেপে ধরে রেখেছে শটগান। পাহাড়ের দিকে ফিরে কি দেখল সে, তারপর বন্দুক কাধে ঠেকিয়ে ফায়ার করল।
আরেকবার রাতের নীরবতা ভাঙল বন্দুকের গর্জন। আবার চেঁচিয়ে উঠল কুকুরটা। এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে ওটার মাথায় চাপড় দিল ম্যাকআরথার।
ঘেউ ঘেউ থামাল কুকুরটা, কেবিনে ঢুকে গেল তার মনিব। ঠিকই বলেছ, জিনা, মুসা বলল পাশ থেকে, ম্যাকআরথারই।
তোমার চাচা ঠিকই বলেছেন, বলল রবিন। কয়োটই। ওই যে তাড়াল ম্যাকআরথার।
নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল জিনা। নেমে গেল নিজের ঘরে।
ম্যাকআরবারের পেছনে ভালমত লেগেছে জিনা, বাংকে উঠে বলল রবিন। এখন যা-ই করুক লোকটা, জিনা তার অন্য অর্থ করবে। খালি বলবে কুমতলব আছে।
আমি যদি কখনও খনির মালিক হই, বিছানায় উঠতে উঠতে বলল কিশোর, আর জিনা যদি ভেতরে ঢুকে দেখতে চায়, সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দেব। ওর শত্রু হয়ে বিপদে পড়তে চাই না।
রসিকতায় হাসল তিনজনেই।
আবার ঘুমিয়ে পড়ল মুসা আর রবিন। কিশোরের চোখে ঘুম এল মা। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে ভাবছে আর কান পেতে শুনছে ক্রিস্টমাস পাতার মরমর।
হঠাৎ উঠে বসল সে। জোরে জোরে বলল, পয়লা গুলিটার সময় কোথায় ছিল ম্যাকআরধার?।
উঁম? ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরল মুসা।
আঁ…কী? রবিন জেগে গেছে।
বলছি পয়লা গুলিটা কোথা থেকে করেছে ম্যাকআরথার? আবার বলল কিশোর।
পয়লা গুলি? মুসার ঘুম ভেঙে গেছে। বাড়ির ভেতর থেকে।
বাড়ির ভেতর থেকে বেরোতে দেখেছ তাকে? প্রশ্ন করল কিশোর। দ্বিতীয় গুলিটা করার আগে কোথা থেকে বেরিয়েছে, দেখেছ?।
না তো। জিনা আর তার চাচার কথা শুনছিলাম তখন।
রবিন?
দেখেছি।
মাটি খুঁড়ে উদয় হয়নি নিশ্চয়, বলল কিশোর। মুসা দেখেনি-না হয় ধরলাম সে তাকায়নি। কিন্তু তুমিও দেখোনি, আমিও দেখিনি। তাছাড়া কোথা থেকে গুলি করলে ওরকম ভোতা শব্দ শোনা যাবে? খনির ভেতরে থেকে।
তাতে কি? বুঝতে পারছে না মুসা।
হয়তো কিছুই না, বলল কিশোর। তবে খনির ভেতর কয়োট ঢুকেছিল, এটাও বিশ্বাস করব না আমি। কয়োটের সাড়া পেলেই চেমোনো শুরু করত কুকুরটা। কিন্তু গুলির শব্দের আগে রা করেনি। এমনও তো হতে পারে, খনির ভেতরে গুলি ছুড়েছিল ম্যাকআরথার, তারপর বাইরে বেরিয়ে দেখল পড়শীরা জেগে উঠেছে। তা যদি হয়, আর সন্দেহমুক্ত হতে চায়, কি করবে তাহলে?
চুপ করে রইল অন্য দুজন।
বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে গুলি করবে না? নিজেকেই প্রশ্ন করছে কিশোর। বোঝাতে চাইবে না, কয়োট তাড়ানোর জন্যে গুলি করেছে?
জিনার মতই সন্দেহ রোগে ভুগতে শুরু করেছ তুমি, রবিন বলল।
হয়তো বা, অস্বীকার করল না কিশোর। তবে মিস্টার হ্যারি ম্যাকআরথারের আচার-আচরণও সন্দেহ করার মতই। মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে একটা কেস দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তিন গোয়েন্দার জন্যে।
<