কিন্তু যেতে দিলেন না উইলসন, স্রেফ মানা করে দিলেন। উপরন্তু তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে গিয়ে লাগিয়ে দিলেন গাছ ছাঁটার কাজে, কড়া নির্দেশ দিয়ে রাখলেন, ডিনারের আগে কতখানি জায়গার গাছ ছাঁটতে হবে। বাড়িতে একা একা বসে আঙুল চোষা ছাড়া আর কিছু করার থাকল না জিনার।

পর দিন সকালে মেজাজ ভাল হয়ে গেল উইলসনের। জিনা যখন বলল তিন গোয়েন্দাকে শহর দেখাতে নিয়ে যেতে চায়, শুধু বললেন, সারাদিন কাটিয়ে এসো না।

না, কাটাব না, বলল জিনা। আর টুইন লেকসে আছেই বা কি, এত সময় দেখবে?

ধুলো-ঢাকা কাঁচা সড়ক ধরে হেঁটে চলল ওরা। পর পর কয়েকটা গাড়ি পাশ কাটাল ওদের, ম্যাকআরথারের বাড়ি যাচ্ছে। একটা গাড়ি থেমে গেল কাছে এসে। জানালা দিয়ে মুখ বের করল একজন, জিজ্ঞেস করল, ডেথ ট্র্যাপ মাইনে কি এদিক দিয়েই যেতে হয়?

হ্যাঁ, বলল জিনা।

থ্যাংকিউ, গাড়ি ছাড়তে গিয়ে কি মনে করে আবার থেমে গেল লোকটা। এই শোনো, তোমরাই কি লাশটা আবিষ্কার করেছ?

হয়েছে! আঁতকে উঠল রবিন। তাড়াতাড়ি জিনার হাত ধরে টান দিল, জিনা, এসো, জলদি। খবরের কাগজ।

এই শোনো, শোনো, গাড়ি থেকে ক্যামেরা হাতে নামছে লোকটা। এই, এক সেকেণ্ড, তোমাদের একটা ছবি

লাগবে না, হাত নেড়ে জবাব দিয়েই হাঁটার গতি বাড়াল মুনা।

প্রায় ছুটতে শুরু করল ওরা। আরেকটা গাড়ি পাশ কাটাল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাদের দেখছে আরোহীরা।

জানতাম এরকমই হবে, গতি কমাল না কিশোর। গতরাতে টেলিভিশনে খবরে দেখিয়েছে, লোকের কৌতূহল হবেই। সব পাগল। যেন আর কোন কাজ নেই দুনিয়ায়।

খবরদার, ছবি তুলতে দিয়ো না, জিনাকে হুঁশিয়ার করল মুসা। তোমার চাচা রেগে যাবেন।

শহরের প্রধান সড়কে বেশ ভিড়। পথের ধারে গাড়ির মেলা। কোর্ট হাউসের সামনে ঠেলাঠেলি করছে নারী-পুরুষ, ওদেরকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শেরিফ, ঘেমে নেয়ে উঠেছেন, মুখ-চোখ লাল। এক সঙ্গে কজনের প্রশ্নের জবাব দেবেন?

রিপোর্টারের দল, বলল রবিন। স্টোরি চায়।

ডেইলী টুইন লেকসের অফিসটা এককালে মুদী দোকান ছিল। ওটাকেই সামান্য পরিবর্তন করে প্রেস বসানো হয়েছে। পথের দিকে মুখ করা রয়েছে বিশাল কাচের জানালা, দোকান যে ছিল বোঝাই যায়। ভেতরে গোটা দুই পুরানো নড়বড়ে ডেস্ক। একটাতে বিভিন্ন অফিশিয়াল কাগজ আর পত্রিকা-ম্যাগাজিনের তুপ। আরেকটার সামনে বসে আছেন রোগাটে এক তালপাতার সিপাই, শরীরের যেখানে সেখানে দড়ির মত ফুলে আছে মোটা মোটা রগ। লালচে চুল, তীক্ষ্ণ চেহারা। মহাউত্তেজিত, টাইপ রাইটারের চাবিগুলোতে ঝড় তুলেছেন, একনাগাড়ে টিপে যাচ্ছেন।

আরে, জিনা! দেখেই বলে উঠলেন সম্পাদক। এসো, এসো। তোমার কথাই ভাবছি। লেখাটা শেষ করেই যেতাম। শেরিফের কাছে শুনলাম, তুমিই লাশটা খুঁজে পেয়েছ।

হাসল জিনা। আপনিই স্যার একমাত্র লোক, যিনি খুশি হলেন। ম্যাকআরথার তো পারলে ঘাড় মটকে দিত। শেরিফ বলল, জেলে ভরবে। আর আমার নিজের চাচা, পুরো চোদ্দ ঘন্টা আটকে রাখল বাড়িতে।

জানি জানি। সব ঠিক হয়ে যাবে, ভেব না। তবে এখন আর খনির কাছাকাছি যেও না। তা, ইন্টারভিউ দিতে আপত্তি আছে? তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন। তোমার বন্ধুরা না? লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এসেছে?

শুনে ফেলেছেন তাহলে। এ-হলো কিশোর পাশা, ও মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড, ওর বাবা লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের রিপোর্টার।

আহ্ পত্রিকা একখান! দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সম্পাদক।

ঠিকই বলেছেন, স্যার, পার্টিশনের ধার দিয়ে সরে যেতে লাগল রবিন, লক্ষ্য ওপাশের আধো অন্ধকার বড় ঘরটা। একটা ছোট রোটারি প্রেস আর লাইনোটাইপ মেশিন চোখে পড়েছে তার। ধুলোয় ভারি হয়ে আছে বাতাস, ছাপার কালির কড়া গন্ধ।

ঘুরে দেখতে চাও? জিজ্ঞেস করলেন সম্পাদক।

দেখালে খুব খুশি হব, স্যার, বলল রবিন। পত্রিকার কাজ খুব ভাল লাগে আমার। লাইনোটাইপটা কি আপনিই চালান?

কম্পোজ থেকে শুরু করে সবই আমি করি। তবে কাজ বিশেষ থাকে না। এ-হপ্তার কথা অবশ্য আলাদা। জিনা, বসো ওখানটায়। হ্যাঁ, এবার খুলে বলো তো সব। রবিন, তুমি গিয়ে দেখো। লাইট জ্বেলে নিও।

মুসা আর কিশোরও চলল রবিনের সঙ্গে। সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল কিশোর। সিলিঙে লাগানো উজ্জল ফুরোসেন্ট আলোয় ভরে গেল ঘর। এক ধারে দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে তাক, তাতে বড় বড় ড্রয়ার, প্রতিটি ড্রয়ারের হাতলের নিচে সাদা রঙে লেখা রয়েছে তারিখ, মাস, বছর।

পুরানো ইস্যুগুলো এদিকে, রবিন দেখাল।

পাঁচ বছর আগেরগুলো দরকার, কিশোর বলল।

কয়েকটা ড্রয়ার নামিয়ে নিল ওরা। খনির মুখ যখন বন্ধ করা হয়, তখনকার কপি আছে ওগুলোতে।

প্রত্যেকটা কপি দেখবে, বলল কিশোর। হেডলাইনগুলো পড়বে। আমাদের দরকারে লাগতে পারে এমন কোন কিছুই যেন চোখ এড়িয়ে না যায়।

পত্রিকার বোঝা নিয়ে মেঝেতেই পা ছড়িয়ে বসল ওরা। পাশের ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে জিনার কথা।

ঘেঁটে চলেছে ওরা পত্রিকা। বিরক্তিকর কাজ। মজার কিছুই নেই, অতি সাধারণ কভার, কার বাড়িতে আগুন লেগেছিল, শেরিফ কবে নতুন গাড়ি কিনলেন, কোন আত্মীয় কবে টুইন লেকসে কার বাড়িতে বেড়াতে এল, ইত্যাদি। বাড হিলারির নাম-গন্ধও নেই। তবে ২৯ এপ্রিলের পত্রিকার এক জায়গায় এসে থমকে গেল কিশোর, বোধহয় কিছু পেলাম।

কি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

পুরো এক মিনিট নীরবে পড়ল কিশোর। মুখ তুলে বলল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল পাঁচ বছরের একটা মেয়ে, তিন ঘণ্টা নিখোঁজ হয়ে ছিল। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে শেষে ডেথ ট্র্যাপ মাইনে পাওয়া গেছে তাকে। খনিতে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। আঁতকে উঠল লোকে, টনক নড়ল, মারাও যেতে পারত মেয়েটা। চাদা তুলতে শুরু করল তার বাবা-মা, খনির মুখ ভালমত বন্ধ করার জন্যে।

খুঁজল কিশোর। মে-র ছয় তারিখের পেপারটা কোথায়? দেখো তত তোমার ওখানে?

এই যে, বের করল রবিন। হ্যাঁ, পয়লা পাতায়ই আছে খনির খবর। টুইন লেকস মার্কেটের মালিক দোকানের সামনে পা গ্যালনের একটা ড্রাম রেখে দিয়েছিল, তার গায়ে লেখা ছিল? খনি বন্ধ করার জন্যে মুক্তহস্তে দান করুন। দুদিনেই লোহার গ্রিল কেনার টাকা উঠে গেল। লর্ডসবুর্গ থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা হলো গ্রিল। ঠিক হলো, মে-র চোদ্দ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করা হবে খনির মুখ!

তেরো তারিখের পত্রিকায় আরও বিস্তারিত লেখা রয়েছে, কি ভাবে বন্ধ করা হবে মুখটা। প্রচণ্ড উত্তেজনা গিয়েছে কদিন ছোট্ট শহরটায়। অনেক তোড়জোড় করে নির্দিষ্ট দিনে সিমেন্ট গেঁথে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রিল—এসব কথা লেখা আছে। বিশ তারিখের পত্রিকায়।

বাপরে বাপ, যেন আমেরিকার জন্মদিন গেছে, বলল মুসা।

সম্পাদক সাহেব কি বললেন শুনেছ তো, রবিন মনে করিয়ে দিল। কাজ তেমন নেই তার। হোট শহর, হাতে গোণা কয়েকজন লোক, ওই খনি বন্ধ করার ব্যাপারটাই একটা বিরাট ঘটনা।

টুইন লেকসবাসীরা মিছিল করে যাচ্ছে খনির দিকে, ছবিটার দিকে চেয়ে রইল। রবিন। হঠাৎ বলে উঠল, আরে, এই তো। চার পৃষ্ঠায়। খনির সীমানার মধ্যে সেদিন পরিত্যক্ত একটা গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল। একটা শেভ্রলে সেডান। পুলিশ পরে জেনেছে, লর্ডসবুর্গের সুপার মার্কেট থেকে তিন দিন আগে চুরি হয়েছিল ওটা। এই যে, শেরিফ থ্যাচারের মন্তব্যও কোট করা হয়েছে। তার ধারণা, টুইন লেকসের কোন তরুণের কাণ্ড। বিনে পয়সায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্যে গাড়ি চুরি করেছে। হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, এরপর যদি এ-ধরনের ঘটনা ঘটে, টুইন লেকসের সব উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে হাজতে ঢোকাবেন।

মুখ তুলল রবিন।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, গভীর ভাবনায় মগ্ন। বিড় বিড় করল, লর্ডসবুর্গ থেকে চুরি…পাওয়া গেল খনির কাছে। খনির ভেতরে তখন এক চোর, সে-ই চুরি করেছিল বললে অতিকল্পনা হয়ে যাবে? কোন কারণে খনির ভেতরে ঢুকেছিল…আর বেরোতে পারেনি।

তা না হয় হলো, কথাটা ধরল মুসা, কিন্তু তাতে আমাদের কি লাভ? আমরা তে যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে যাচ্ছি। ধরে নিলাম, স্যান ফ্রানসিসকো থেকে পালিয়ে লর্ডসবুর্গে এসেছিল হিলারি, সেখান থেকে গাড়ি চুরি করে নিয়ে এসেছে টুইন লেকসে। কিন্তু কেন? কিসের তাগিদে?

মুখ বাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল শুধু কিশোর।

পুরানো কাগজ ঘেঁটে চলল রবিন। এই রহস্যের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তো কিছুই আর চোখে পড়ছে না। হ্যারি ম্যাকআরথারের উল্লেখ নেই। জানা গেল, ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে টুইন লেকসে এসেছিল মিসেস রোজি ফিলটার। পরে দুটো সংখ্যায় বিস্তারিত জানানো হয়েছে, কোথায় কবে কতখানি জায়গা কিনেছে মহিলা। জায়গাগুলো ছিল খনির সম্পত্তি।

ভাবছি, স্যান ফ্রানসিসকো থেকে পালিয়ে এসে কতদিন লর্ডসবুর্গে ছিল হিলারি? আনমনে বলল কিশোর।

লাইনোটাইপ মেশিনের গায়ে হেলান দিল মুসা। কে জানে? পুলিশকে না জানিয়ে পালিয়ে এসে আইন অমান্য করেছে সে, ঠিক। তবে সেটা পাঁচ বছর আগে। এতদিনে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে নিশ্চয় পরিস্থিতি।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বিনা কারণেই এসেছিল এখানে। খনিতে ঢুকেছিল। এমন একটা খনি, যেটা কিনেছে হ্যারি ম্যাকআরথার। লাশটা যে ছিল খনিতে, কেন জানল না সে? দুজনের মাঝে, ঘটনাগুলোর মাঝে কি কোন যোগসূত্র রয়েছে? একজন জেলফেরত দাগী আসামী আর একজন রহস্যময় ধনীর মাঝে? একটাই কাজ এখন করার কাছে আমাদের।

কী? আগ্রহে সামনে ঝুঁকল মুসা।

সময়কে পিছিয়ে নিতে পারি আমরা।

হাঁ হয়ে গেল মুসা। কি আবল-তাবল বকছ? এই কিশোর?

অ্যাঁ? সংবিৎ ফিরল যেন কিশোরের। হ্যাঁ, সময়কে পিছিয়ে নিতে পারি। হিলারির অতীত উদঘাটনের চেষ্টা করতে পারি। লর্ডসবুর্গে থেকে থাকলে, নিশ্চয় রাতে ঘুমাতে হয়েছে তাকে। কোথায়? এত বছর পর জানার চেষ্টা করা কঠিন, হয়তো বৃথাই হবে, তবু চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। পুরানো খবরের কাগজ আর টেলিফোন ডিরেকটরি ঘেটে দেখতে পারি। হ্যাঁ, এই একটাই কাজ করার আছে। এখন আমাদের।

<

Super User