চোখে অনেক আশা নিয়ে কিশোর আর মুসার দিকে তাকালেন লারসেন। যেন বোঝার চেষ্টা করছেন, ওদেরকে যে সম্মানটা দেয়া হচ্ছে সেটা ওরা বুঝতে পারছে কিনা।
ঘড়ি দেখল মুসা। লাঞ্চটাইম তো হয়নি এখনও।
ডাক্তার বলেছেন, কিশোর বলল। কোন রকম রিচ ফুড না খেতে। ভাজাভুজি তো একেবারে বারণ। পেটের অবস্থা ভাল না আমার।
ওই ডাক্তার ব্যাটাদের কথা শুনো না! প্রায় গর্জে উঠলেন লারসেন। ওরা তো কত কথাই বলে। সব শুনলে না খেয়ে উপোষ করে মরতে হবে রোগীকে। এসো। এখনও গরম গরম রয়েছে ড্রিপিং চিকেন। এই সুযোগ হারালে পরে পস্তাবে… বুঝতে পারছ না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তোমাদেরকে। কোথায় পাঠানো হবে।
ঠিকই পারছি! নরকে! ভাবল মুসা।
তর্ক করে লাভ হবে না। সন্দেহ না জাগিয়ে লারসেনকে কোন কিছু বলেই নিরস্ত করা যাবে না এখন। কি আর করে? ধীরে ধীরে তার সঙ্গে এগোল দুজনে।
একটা ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ডন। দুই গোয়েন্দাকে ইশারা করল তার অফিসের দিকে যেতে। সে এগোল সেদিকে। লারসেন গেলেন না। ডনকে বললেন, ট্রেটা রেখেই যাতে চলে আসে। কাজ আছে।
ডনের অফিসে ঢুকল কিশোর আর মুসা। স্টেইনলেস স্টীল আর কাচের তৈরি সুদৃশ্য আধুনিক টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল ডন। স্যান্ডউইচের মত দেখতে চমক্কার খাবার। গরম। ধোয়া উড়ছে। দেখতে তো খুবই ভাল, কিশোর বলল।
পাগল হয়ে গেলে নাকি? মুসা বলল, ওগুলো বিষাক্ত! খাওয়া একদম উচিত হবে না। এক কাজ করি, পকেটে ভরে ফেলি।
নিজের প্যান্টের দিকে তাকাল কিশোর। আঁটো জিনস। পকেটে ঢোকানো যাবে না, আর জোরজার করে কোনমতে ঢোকালেও উঁচু হয়ে থাকবে। স্পষ্ট বোঝা যাবে। মাথা নাড়ল, হবে না।
তাহলে? ওয়েস্টবাস্কেটেও তো ফেলতে পারব না। দেখে ফেলবে।
উঁচু হয়ে থাকলেও পকেটেই ঢোকাতে হবে। আর কোন উপায় নেই। আমি পরেছি জগিং স্যুট, পকেটই নেই।
কাউচের নিচে ফেলে দিলে কেমন হয়?
তাতেও লাভ হবে না। যে হারে গন্ধ বেরোচ্ছে, ওরা গন্ধ পেয়ে যাবে। বের করে ফেলবে। পকেটেই রাখতে হবে। ঢোকাও। জলদি!
আর কোন উপায় না দেখে পকেটেই ঢোকাতে বাধ্য হলো কিশোর। আঠাল ঝোলের মত জিনিস পকেটের কাপড় ভেদ করে পা বেয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করল। আমি দরজায় চোখ রাখছি, মুসা বলল। তুমি খোঁজ। দেখো, কিছু বেরোয় কিনা।
খুঁজতে লাগল কিশোর। জুনের ব্রিফকেসটা। ডেস্কের পেছনে, নিচে, ড্রয়ারে, কোথাও পাওয়া গেল না। ফাইল কেবিনেটে তালা দেয়া। ওর ভেতরে দেখা গেল না।
ব্রিফকেস খোঁজা বাদ দিয়ে অন্য সূত্র মেলে কিনা দেখতে শুরু করল সে। ডনের ডেঙ্ক ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখল একটা পাতা নেই, ছয় দিন আগের তারিখের।
মুসা শুনে বলল, সেদিন শুক্রবার। জুন যে দিনের কথা মনে করতে পারছে, যে দিন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল কিশোর। যোগাযোগ আছে কিনা বের করা দরকার, এই সময় পায়ের শব্দ শুনতে পেল। এগিয়ে আসছে।
ঠোঁটে আঙুল রেখে কিশোরকে চুপ করতে ইশারা করল মুসা।
একটু পরেই ঘরে ঢুকল ডন। প্রথমেই তাকাল ট্রের দিকে। শূন্য। বেশ বেশ, খেয়েছ তাহলে? কেমন লাগল আমাদের ড্রিপিং চিকেন?
ওই জিনিস জীবনে খাইনি, সত্যি কথাটাই বলল কিশোর।
আমাদের জেনারেল শুনে খুব খুশি হবেন, লারসেনের কথা বলল ডন। একটা জরুরী কাজে চলে গেছেন। তোমাদেরকে বলতে বলেছেন। ড্রিপিং চিকেন কার আবিষ্কার? আপনার?
না, মাথা নাড়ল ডন। ডেস্কের ওপাশে গিয়ে বসল। এই একটা আইটেমের জন্যে বাইরে গিয়েছিলেন জেনারেল। যেতে অনেক মানা করেছিলাম, শুনলেন না। বলেছি, চেষ্টা করলে এখানেই বানাতে পারব আমরা। সোজা আমাকে বলে দিলেন, তিনি বস, যা করার তিনিই করবেন। গেলেন ফেলিক্স আরোলার কাছে, মিরাকল টেস্টের মালিক। অথচ আমরা দুজনে, চিকেন কিং আর কেমিক্যাল কিং মিলেই বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
তার মানে কি আছে এতে আপনি জানেন না? জিজ্ঞেস করল মুসা।
নিশ্চয় জানি। গবেষণা করাই তো আমার কাজ। পরীক্ষা করে বের করে ফেললাম কি কি মেশানো হয়েছে। সে কথা জানালাম জেনারেলকে। খুশি হয়ে আরেকটা মোরগ আমাকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন জেনারেল, পকেটে ঝোলানো দশ নম্বর রুপার মুরগীটা দেখাল ডন। তবে স্বীকার করতেই হবে, যা আছে সব ক্লাসিক জিনিস। তোমাদেরকে অবশ্যই বলব না। বিজনেস সিক্রেট।।
আমরা শুনতে চাইও না, কিশোর বলল। যা দেখলাম তাতেই খুশি আমরা। চিকেন লারসেনের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাই তো একটা সৌভাগ্য। কি বলো, মুসা? আট দিন আগেও তো আমরা চিনতাম না, তাই না?
শূন্য দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। দেখল, কিশোরের নজর ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে। ভুল করলে। আট নয়, ছয় দিন আগে, হাসল সহকারী গোয়েন্দা।
আট দিন, জোর দিয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
ভুল, ডনের ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ক্যালেন্ডার উল্টে যে পাতাটা নেই সেখানটায় এসে থামল। ছয়দিন। গত শুক্রবার। আমি শিওর… আরে, পাতাটা কোথায়?
নেই, এমন ভঙ্গিতে বলল ডন, যেন জানাই আছে নেই যে। মুদী দোকান থেকে আনা জিনিসের লিস্ট লিখে রাখি ক্যালেন্ডারে। মাঝে মাঝে পাতা ছিড়ে সাথে করে নিয়ে যাই।
ঠিক আছে, যা দেখার দেখলাম, কিশোর বলল। চলি। বাড়ি গিয়ে কাপড় বদলানো দরকার।
হাসি চাপতে গিয়ে কেশে ফেলল মুসা। নিশ্চয় কিশোরের কাপড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রস, আঠা লাগছে চামড়ায়, ভীষণ অস্বস্তিকর। রসের রঙ এখন বাইরে থেকে দেখা না গেলেই হয়। পকেটের উঁচু জায়গাটা চেপে ধরে রেখেছে কিশোর।
বেরিয়ে এল দুজনে। প্রথমেই ময়লা ফেলার যে ড্রামটা পেল তাতে ফেলে দিল ড্রিপিং চিকেন। তারপর বাড়ি রওনা হলো।
সেই বিকেলে ছয় বাক্স চীনা খাবার নিয়ে আসা হলো। চীনের দেয়ালের মতই যেন সাজিয়ে রাখা হলো কিশোরের ওয়ার্কশপে বাক্সগুলো। তিন গোয়েন্দাই হাজির। চিকেন লারসেনের অফিসে গিয়ে কি কি করে এসেছে রবিনকে বলছে মুসা, মাঝে মাঝে কথা জুগিয়ে দিচ্ছে কিশোর।
তারপর চলল খাবারে বিষ মেশানো নিয়ে আলোচনা।
ড্রিপিং চিকেনে বিষ মেশানোর উদ্দেশ্যটা মোটামুটি আঁচ করা যায়, রবিন বলল। তার পরেও চারটে প্রশ্ন থেকে যায়। কে মেশাল, কোথায় মেশাল, কখন মেশাল, কেন মেশাল? আরেকটা সম্ভাবনাও থেকেই যায়। হেনরি অগাসটাস এতে জড়িত এবং খারাপ কিছু করছে।
জুনের ব্রিফকেসটা পেলে হত, কিশোর বলল। কিছু না কিছু পাওয়া যেতই ওতে।
গত শুক্রবারে জুনকে কেউ দেখেছে বলেও বলল না, মুসা বলল। একজন বুড়ো লোক বাদে। তবে তার কথাও বিশ্বাস করা যায় না। কথাবার্তা কেমন অগোছাল। ভুল করে একদিনের কথা আরেকদিন বলে দিয়েছে কিনা তাই বা কে জানে।
এই খাবার এনেছ কেন? আচমকা প্রশ্ন করল রবিন। কেন, খেতে ইচ্ছে করে না বুঝি? প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়েই সারল মুসা। কোন রেস্টুরেন্ট থেকে? যেটা থেকে সব সময় আনি। ডেই ডং। তাহলে আর বসে আছি কেন? খেয়ে ফেলি।
একটা বাক্স টেনে নিয়ে খুলল। খুলে একটা প্যাকেট হাতে নিয়েই স্থির হয়ে গেল। কি ব্যাপার? কি হয়েছে? জানতে চাইল মুসা। ফরচুন কুকির বিজ্ঞাপন করেছে নাকি বড় বড় কথা বলে?
মোড়কের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। নীরবে বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে। হাতে লেখা একটা নোট। দেখার জন্যে কিশোরও বুকে এল। লেখা রয়েছেঃ
এইমাত্র যে খাবার খেলে, তাতে বিষ মেশানো থাকতে পারত। এবার নেই। পরের বার থাকতেও পারে। কাজেই সাবধান! অন্তত চিকেন কিঙের খাবার থেকে দূরে থাকবে!
<