একটা মুহূর্তের জন্যে প্যাডাল চাপা বন্ধ করছে না মুসা। কাজ তো করা উচিত! সে নিজে সব কিছু চেক করে। ব্রেক ফুইড ঠিক আছে কিনা নিয়মিত দেখে।

কিন্তু, কথাটা সত্যি, ব্রেক কাজ করছে না। কোনমতেই চাপ দিচ্ছে না চাকায়। গতিরোধ করার চেষ্টা করছে না। পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। ফলে গতি তো কমছেই না, আরও বাড়ছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চৌরাস্তায় গিয়ে পড়বে ভাগ্য ভাল হলে কোন গাড়ির গায়ে তো না লাগিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তবে লাগার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ লাল আলো জ্বলছে তার দিকটায়। অন্যদিকের গাড়িগুলো চলাচল করছে। ওগুলোর চালকদের জানার কোনই উপায় নেই যে মুসার গাড়ি ব্রেক ফেল করেছে।

মুসার মনে হচ্ছে তার গলার ভেতরে একটা আস্ত আপেল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বেরও করতে পারছে না, গলা দিয়ে নামাতেও পারছে না। ঘেমে ভিজে গেছে হাতের তালু।

কিন্তু মাথাটা এখনও ঠান্ডাই রেখেছে। ভেজা তালু দিয়ে চেপে ধরল গিয়ারশিফট নব। একটানে নামিয়ে নিয়ে এল ফোর্থ গিয়ার থেকে সেকেন্ড গিয়ারে। গতি কমানোর জন্যে। ইতিমধ্যে সামনের পোরশেটা মোড় নিল গতি না কমিয়েই। রাস্তায় ঘষা খেয়ে আর্তনাদ তুলল টায়ার। ঘুরে গেল গাড়িটা। দ্রুত সরে যেতে লাগল।

গতি কমছে শিরোকোর, তবে যথেষ্ট নয়। চৌরাস্তাটা আর মাত্র একশো গজ দূরে। হস হস করে বেরিয়ে যাচ্ছে ওপাশের গাড়িগুলো। এপাশের হলুদ সিগন্যাল এখনও জ্বলেনি।

জোরে হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করল একটা নীল হোন্ডা।

ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে মুসার হৃৎপিন্ড। গিয়ার আরও নিচে নামাল সে। তারপর চেপে ধরল হ্যান্ডব্রেক। একই সঙ্গে ডানে কাটল স্টিয়ারিং।

নিমেষে রাস্তা থেকে একটা শূন্য জায়গায় নেমে এল গাড়ি। কিছু বাড়িঘর উঠবে ওখানে, তারই প্রস্তুতি চলছে। মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। তাতে আরও কিছুটা গতি কমল গাড়ির। লম্বা ঘাসের ভেতরে পড়ে আছে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাব, সেগুলোতে ধাক্কা লেগে থেমে গেল শিরোকো।

প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগল। সীটবেল্ট বাঁধা না থাকলে উইওশীন্ডে গিয়ে বাড়ি লাগত মুসার মাথা।

মরতে মরতে বাঁচলাম! ভাবল সে। লম্বা দম নিতে লাগল নিজেকে শান্ত করার জন্যে। তারপর দরজা খুলে নেমে এল টর্চ হাতে। গাড়ির পাশে বসে পড়ে নিচে আলো ফেলে দেখতে লাগল ক্ষতিটা কোথায় হয়েছে। হুম, তাহলে এই ব্যাপার! ব্রেকের ফ্লুইড লাইন কাটা! ইগনিশন থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে। গোধূলি শেষ হয়ে অন্ধকার নামতে আরম্ভ করেছে তখন। স্যালভিজ ইয়ার্ডে ফিরে চলল সে।

দুই ক্যান সোডা ওয়াটার গেলার পর অনেকটা শান্ত হলো মুসার কাঁপুনি। হেডকোয়ার্টারের ট্রেইলারটা যে জঞ্জালের স্তুপের ভেতর লুকানো, তার বাইরে তিনটে পুরানো লোহার চেয়ারে বসেছে রবিন আর কিশোরের সঙ্গে।

যাক, কিশোর বলল। অবশেষে মিস্টার এক্সের দেখা মিলল।

ব্যাটা শয়তান, এখনও রাগ কমেনি মুসার। ব্রেকের লাইন ও-ই কেটে রেখেছিল। এমন ভান করছিল, যাতে আমি ওকে ফলো করি। কিংবা আমরা সবাই করি। এবং করলেই গিয়ে বাড়ি খাই পাহাড়ে।

তিন গোয়েন্দার নাম মুছে যেত তাহলে। কিংবা দুই গোয়েন্দা হয়ে যেত এতক্ষণে।

আমি ভাবছি, রবিন বলল। লোকটা কে? আমাদের পিছে লেগেছে কেন?

আর কি করেই বা জানল, যে আমরা তদন্ত করছি? যোগ করল কিশোর।

এটা আরেক রহস্য। পার্টিতে কিন্তু দেখিনি ওকে।

আর্মি জ্যাকেট পরা ওরকম কাউকে চেনে না জুন, মুসা বলল। তারমানে…

সে লারসেন পরিবারের কেউ নয়, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। কারও হয়ে কাজ করছে।

কার?

জবাব দিতে পারল না কেউ। তিনজনেই প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে ঘুমাল সে রাতে।

পরদিন সকালে ইয়ার্ডের গেটের বাইরে একটা অপরিচিত গাড়ি হর্ন দিতে লাগল, আর টেলিফোনটাও বেজে উঠল একই সঙ্গে। অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে কিশোর। ওসিলোস্কোপ দিয়ে ওর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছিল সে। ফোনের রিসিভার কানে ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। একটা রহস্যের সমাধান হলো। অপরিচিত হর্নটা মুসার গাড়ির। অচেনা, তার কারণ শিরোকোটা আনেনি মুসা। নিয়ে এসেছে আরেকটা, ওর মায়েরটা।

টেলিফোনটাও অবাক করল কিশোরকে।

কিশোর, আমি জুন লারসেন বলছি। আমার ব্রিফকেস!

ইঙ্গিত কিংবা সঙ্কেত খুব ভালই বোঝে কিশোর, কিন্তু জুনের কথা তাজ্জব করে দিল ওকে। তবে সে প্রশ্ন করার আগেই জুন বলল, এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠেছি আমি। তখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমার ব্রিফকেসটা, পাচ্ছি না, লম্বা দম নিল সে। এর আগে পর্যন্ত ওটার কথা ভুলেই ছিলাম। আজ ঘুম থেকে ওঠার পর মনে পড়েছে।

উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। তোমার স্মৃতি ফিরতে আরম্ভ করেছে।

মনে হয়, জুন বলল। যাই হোক, ব্রিফকেসটা পাচ্ছি না। কেন ওটা এত খুঁজছি তা-ও বুঝতে পারছি না। ভেতরে বোধহয় জরুরী কিছু ছিল।

আমি আর মুসা তোমার আব্বার অফিসে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম।

অফিসেও ফেলে রেখে আসতে পারি। খুঁজতে যেতে চাইছিলাম, কিন্তু কদিন যেতে বারণ করে দিয়েছে বাবা। বলেছে রেস্ট নিতে। আচ্ছা, একটা কথা, শুক্রবারে অ্যাক্সিডেন্টটা হওয়ার আগে আমি কোথায় ছিলাম, বের করতে পারবে?

ঠিক এই কাজটা করার কথাই ভাবছিলাম, মনে মনে বলল কিশোর। জুনকে বলল, দেখি, খোঁজখবর করব। কখন কোথায় যাও, লিখেটিখে রাখার অভ্যাস আছে, ক্যালেন্ডারে? থাকলে ভাল হত। একটা সূত্র পেতাম।

রাখি। নীল রঙের মরক্কো লেদারে মোড়া একটা সুন্দর ডায়েরীতে। ব্রিফকেসেই রাখি ওটা।

গাড়ির হর্ন বাজাতে আরম্ভ করল আবার মুসা, তালে তালে, একটা বিশেষ ছন্দ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

ঠিক আছে। ব্যাপারটা নিয়ে সব রকমে ভেবে নিই, কিশোর বলল জুনকে। রাতে ফোন করব।

আচ্ছা। আমারও কিছু মনে পড়লে জানাব তোমাকে, লাইন কেটে দিল জুন।

বাইরে বেরোল কিশোর। ততক্ষণে বনেট খুলে ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে পড়েছে মুসা। ইঞ্জিন সামান্যতম গোলমাল করলে সেটা দেখা এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার।

জুন ফোন করেছিল, কিশোর জানাল। ওর ব্রিফকেসটা নাকি পাচ্ছে না। জরুরী কিছু ছিল বলে মনে হচ্ছে ওর।

কিশোরের দিকে না তাকিয়েই মুসা বলল, আমি শিওর, মিস্টার এক্স ওটাই খুঁজছিল হাসপাতালে।

মুখ তুললে দেখতে পেত উত্তেজনায় চোয়াল স্কুলে পড়েছে কিশোর পাশার। একটা সাতিক কথা বলেছ তো! মনেই হয়নি আমার!

গাড়িতে উঠে বসল দুজনে। রওনা হলো চিকেন লারসেনের স্যান ফারনানদো ভ্যালির অফিসে। যাওয়ার পথে দেখতে পেল ঢালের নিচে তরাইয়ে তেমনি পড়ে আছে মুসার গাড়িটা।

একটা পেট্রল স্টেশনে থামল মুসা। মেরিচাচীর বোনপো নিকি পাঞ্চকে ফোন করার জন্যে। যাকে এক ভীষণ বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল তিন গোয়েন্দা। গাড়ির জাদুকর বলা যায় লোকটাকে। দিন কয়েক হলো আবার ফিরে এসেছে রকি বীচে। গাড়ি মেরামতের একটা গ্যারেজ করার কথা ভাবছে এখানে। উঠেছে ম্যালিবু বীচে এক বন্ধুর সঙ্গে একটা কটেজ ভাড়া করে। গরমকালটা কাটাবে এখানে, গাড়িটাড়ি মেরামত করবে, ব্যবসাটা জমে গেলে চিরস্থায়ীই হয়ে যাবে।

নিকিভাই? ফোনে বলল মুসা। মুসা। আমার গাড়িটা একটু দেখবেন?

কোনটা? শিরোকোটা?

হ্যাঁ। গাড়িটা পড়ে আছে। তুলে নিয়ে গিয়ে মেরামত করে নিন, কয়েক দিনের জন্যে চালাতে দেব। একটা গাড়ি আপনার দরকার বলেছিলেন না?

নিকির সঙ্গে আলোচনা করে গাড়ির একটা ব্যবস্থা করে আবার গাড়িতে ফিরে এল মুসা।

চিকেন লারসেন করপোরেশনের পার্কিং লটে এনে গাড়ি রাখল। ছয়তলা একটা আধুনিক বাড়িতে লারসেনের অফিস।

চিকেন করপোরেশনের পার্কিং লটে এনে গাড়ি ঢোকাল মুসা। জায়গাটা দেখে হাসি পেল দুজনেরই। এখানেও লারসেনের বিচিত্র রুচির নিদর্শন স্পষ্ট। আধুনিক ছতলা একটা বাড়ি আর এক চিলড্রেন পার্কের মিশ্রণ যেন। ভিজিটরস গেটে তালা দেয়া। ঢোকার আগে অনুমতি নিতে হয়। ইন্টারকমে কথা বলতে গেল মুসা। মুরগীর আকৃতিতে তৈরি ইন্টারকম দেখে হাসি পেল। কেন ঢুকবে, প্রশ্ন করা হলে খাবারের অর্ডার দিল সে। চিকেন লারসেন রেস্টুরেন্টে ঢোকার কথা বলল। ভাবল, আগে ভেতরে ঢুকি তো, তারপর দেখা যাবে কোথায় যাওয়া যায়।

ইলেক্ট্রনিক সিসটেমে হাঁ হয়ে খুলে গেল গেট। লাল-হলুদ রঙ করা বাড়িটার দিকে গাড়ি চালাল মুসা।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা কাজ করেন লারসেন। চওড়া হাসি দিয়ে স্বাগত জানালেন ওদের। পরনে লাল জগিং স্যুট। কিশোরকে দেখেই বললেন, একটা ধাধার জবাব দাও। বলো তো কোন্ সালে পেষানো মুরগীর মাংসে গাজর মেশাতে আরম্ভ করেছি?

উনিশশো সাতাশি সালে। ছোট ছোট টিনে ভরে সাপ্লাই দিতেন।

অ্যাই, কি বলেছিলাম। বলিনি, ছেলেটা পারবেই! কাছাকাছি যত লোক আছে সবাইকে শোনানোর জন্যে চেঁচিয়ে বললেন লারসেন। গলা তো নয়, মাইক। তুমি একটা পাগল, পুত্র, সন্দেহ নেই, তবে আমার মত পাগল। দাঁড়াও, আইডেনটিফিকেশন ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা দুজনে যে কোন সময় ঢুকতে পারবে। আমাদের এখানে সিকিউরিটি খুব কড়া, চাপড় মেরে কিশোর আর মুসার পিঠে স্টিকার লাগিয়ে দিলেন তিনি।

কিশোরের পিঠে কি লাগানো হয়েছে, দেখে মুসা তো থ। সন্দেহ হতে নিজের  পিঠেরটা দেখাল কিশোরকে। হো হো করে হেসে উঠল কিশোর। লেখা রয়েছেঃ মুরগীর ঠোকর। জিজ্ঞেস করল, আমার পিঠে কি? মুসা জানাল, মুরগীর খামচি। ওদের সঙ্গে সঙ্গে লারসেনও হাসতে লাগলেন।

হাসি থামলে বললেন, খেতে এসেছ বলে তো মনে হয় না। তা কি দেখতে এসেছ, বলো তো? মুরগী বেচে লাভ করা আমার প্রথম ডলারটা? ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছি। আমার অফিসে। আমার প্রথম স্ত্রীর ছবিটাও বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি। হাহ হাহ হা!

আসলে, কিশোর বলল। অফিসগুলো দেখারই লোভ। আপনারটা। আরও কিছু এবং বিশেষ করে জুনের নতুন অফিসটা।

আমি দেখতে চাই খাবার কি করে বানানো হয়, মুসা বলল। আর কি কি জিনিস দেয়া হয় মাংসের সঙ্গে।

ও, আমার পাগল বিজ্ঞানীগুলোকে দেখার শখ তোমার? হাসলেন লারসেন। বেশ। খাঁচা থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি ওদেরকে। তারপর, কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। একটা স্পেশাল খাবার দেব তোমাকে। চেখে দেখার জন্যে।

ভয় পেয়ে গেল কিশোর। তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমি খাবারের কিছু বুঝি! বুড়ো আঙুল দিয়ে মুসাকে দেখিয়ে বলল, ওকে দেবেন।

কিশোর আর মুসাকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললেন লারসেন। আমার নতুন জিনিসটা দেখলে বুঝবে। বিশ্বাসই করতে চাইবে না। আমি নিজেই পারিনি। অথচ আমারই আবিষ্কার।

এলিভেটরে করে উঠে এল তিনজনে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন লারসেন। মাঝে মাঝে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে থামছেন। এই সুযোগে যাকে পাচ্ছে তার সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করছে কিশোর, জুনের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে। একজন অ্যাকাউনটেন্ট জানাল, সে সেদিন ওকে দেখেছে। তবে ব্রিফকেসের ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। কয়েকজন জানাল, কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পার্কিং লটে জুনের মাসট্যাং গাড়িটা দেখেছিল। তবে জোরাল কোন সূত্র কেউই দিতে পারল না।

অবশেষে দুই গোয়েন্দাকে মাটির তলার ঘরে নিয়ে এলেন লারসেন। বন্ধ কাচের দরজার ওপাশে বিশাল গবেষণাগার। ঢোকার অনেকগুলো দরজা। যারা ঢুকছে তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্যে ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা রয়েছে। অপরিচিতজন কিংবা যাদের ঢোকার অনুমতি নেই তাদেরকে ঢুকতেই দেবে না। সাবধান বাণী লেখা রয়েছে দরজার কপালে।

একটা ইলেকট্রনিক বক্সে একটা প্লাষ্টিকের কার্ড ঢুকিয়ে দিলেন লারসেন। খুলে যেতে লাগল কাচের দরজা। মুসা আর কিশোরকে বললেন, আমি যা বলব, সঙ্গে সঙ্গে তাই বলবে। কোড। হ্যাঁ, বলো, মুরগীর বাচ্চার কথা কাউকে বলব না।

তোতাপাখির বুলি আওড়ানোর মত করে বলল দুজনেই।

হ্যাঁ, হয়েছে, তারপর গলা চড়িয়ে ডাকলেন লারসেন, গমগম করে উঠল তার কণ্ঠ, কেঁপে উঠল যেন গবেষণাগারের কাচের দেয়াল, ডন!

এগিয়ে এল একজন বেঁটে, মোটা, টাকমাথা লোক। চোখে গোল্ডরিম চশমা। গায়ে ল্যাবরেটরির সাদা পোশাক। পকেটে একসারি মুরগীর মডেল ঝোলানো, সামরিক বাহিনীর লোকে মেডেল যেভাবে ঝোলায় সে ভাবে। কাছে এসে অনেকটা মিলিটারির মতই স্যালুট করল।

পরিচয় করিয়ে দিলেন লারসেন, ডন বারোজ, বিশাল থাবা দিয়ে চাপড় মারলেন লোকটার পিঠে। বাঁকা হয়ে গেল লোকটা। কল্পনাই করতে পারবে না আমার এখানে আসার আগে কোথায় কাজ করত ডন।

নিশ্চয় ডিজনিল্যান্ডে, ভাবল মুসা। জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

পেনটাগন, জবাব দিলেন লারসেন। ওয়াশিংটনে ছিল ওর ল্যাবরেটরি, পেনটাগনের পাঁচ ব্লক দূরে। তাহলে পেনটাগনই ধরা যায়, যদিও ওখানে কাজ করেনি। কাছাকাছি ছিল তো। হাহ হাহ।

আসলে, পেন্টাগন রয়েছে ভারজিনিয়ার আরলিংটনে, পটোম্যাক নদীর ধারে। চুপ করে রইল কিশোর। ভুলটা ধরিয়ে দিল না।

কাঁচুমাচু হয়ে গেছে বেচারা ডন। ভয়ে ভয়ে রয়েছে আবার কখন পিঠে আন্তরিকতার চাপড় পড়ে। একে একে গোয়েন্দাদের নাম বলে গেলেন লারসেন। হাত মেলাল ডন। ঘেমে গেছে হাতের তালু। ঠান্ডা।

ডন একজন সুগন্ধ বিশারদ, লারসেন বললেন। আমার আর অ্যান্ড ডি-র হেড, ভুরু কোঁচকালেন তিনি। বুঝলে না? রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। খুব ভাল কাজ জানে। আমি যা জানি তা-ও শেখাব। ওস্তাদ বানিয়ে ছেড়ে দেব। চিকেন ডন বারোজ হয়ে যাবে তখন। হাহ হাহ হা! ডন, ধর, ছেলেরা ড্রিপিং চিকেন খেতে চায়? দিতে পারবে?

কিশোর আর মুসার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ দেখা দিল ডনের চোখে। ওরা সিভিলিয়ান, স্যার?

তাতে কোন অসুবিধে নেই, অভয় দিলেন লারসেন। কোন বছর সেই খাবারটা বানিয়েছিলাম, যেটার নাম দিয়েছিলাম উইং অন আ স্ট্রিং? একটুকরো সাবানের ওপর দড়ি পড়ে থাকতে দেখে যে খাবারটা তৈরির ভাবনা মাথায় এসেছিল আমার?

নাইনটিন এইটি ফাইভ, জবাব দিল ডন।

তারিখ?

মাথা নাড়ল ডন।

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর, বাইশে জুন, উনিশশো পঁচাশি।

দেখলে তো? হেসে বললেন লারসেন। কাকে নিয়ে এসেছি? ওকে আমি পালকপুত্র বানিয়েছি এ জন্যেই। জুনকেও বলে দিয়েছি। ছেলেটা একটা চলমান রেফারেন্স বুক। একেবারে কম্পিউটারের মেমোরি। ডনের দিকে তাকালেন, আর সন্দেহ নেই তো তোমার? যাও, ড্রিপিং চিকেন নিয়ে এসো।

যাচ্ছি, স্যার, এবার আর স্যালুট করল না ডন, তবে ভাব সাব দেখে মনে হলো করতে পারলেই খুশি হত। সেই সঙ্গে খটাস করে বুট ঠুকতে পারলে তো আরও। তবে ঘুরে যখন রওনা হলো, সাধারণ মানুষের মত হেঁটে মার্চ করে এগোল। ল্যাবরেটরির রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে চাবি বের করে তালা খুলল।

ড্রিপিং চিকেনটা কি জিনিস? জানতে চাইল মুসা।

বললে বুঝবে? আচ্ছা, বলি, লারসেন বুঝিয়ে দিলেন, মুরগীর মাংস থেকে পুরোপুরি হাড় আলাদা করে ফেলে, মেশিনে পিষে ফেলা হয়। বিস্কুটের গুঁড়ো মিশিয়ে ভেজে পুরো বাদামী করে ফেলে তার ওপর মাখিয়ে দেয়া হয় সোনালি রঙ করা মাখন। বুঝলে?

ছবি দেখতে পাচ্ছি, কিশোর জবাব দিল।

ছবি?

ও কিছু না।

আরও কিছু জিনিস মেশানো হয়, লারসেন বললেন। যেগুলো বললেও বুঝবে না। কাজেই, থাক।

আমার আর শোনারও দরকার নেই, জিভে পানি এসে গেছে মুসার।

আমার এই নতুন খাবারে বিশেষ একটা জিনিস মেশানো থাকবে, প্রতিটি বড়ার মধ্যে, লারসেন বললেন। লোকে মজা করে খাবে। তারপরই খাবে ধাক্কা। বুঝতেই পারবে না কিসে আঘাত করল ওদেরকে।

খাওয়া লাগল না, কথাটা শুনেই ধাক্কা খেলো দুই গোয়েন্দা। ভীষণ চমকে গেল। ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। পরস্পরের দিকে তাকাল। এক মুহূর্ত আগেও ড্রিপিং চিকেন খাওয়ার জন্যে লোভ ছিল দুজনের। এমনকি কিশোরও ভাবছিল, পেট এখন ভাল হয়ে গেছে, খানিকটা খাবার চেখে দেখবেই। লারসেনের কথা শোনার পর ইচ্ছেটা উবে গেছে। লোকে কেন ধাক্কা খাবে? কেন বুঝতে পারবে না… কিসে আঘাত করেছে ওদেরকে? আর খাওয়ার মধ্যে আঘাতের কথা আসে কেন? ড্রিপিং চিকেনে বিষ মেশানো হবে না তো?

খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। নতুন একটা খাবার আবিষ্কার করেছেন লারসেন। তার পরপরই ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখল জুন। কাকতালীয় হতে পারে…কিন্তু কিশোরের মনে হতে লাগল, এই খাবারটাই জুনের আতঙ্কের কারণ। কোথাও একটা যোগাযোগ আছে। কানের পর্দায় যেন ভাসতে লাগল কিশোরেরঃ মুরগীতে বিষ মেশাচ্ছে সে! লাখ লাখ লোক মারা যাবে!

রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল ডন, খুব সুন্দর হয়েছে! আর বেশ গরম!

এসো, দুই গোয়েন্দাকে বললেন লারসেন। আমার গিনিপিগ বানাতে চাই তোমাদেরকে। তোমরাই প্রথম চেখে দেখো, কেমন হলো ড্রিপিং চিকেন।

<

Super User