মাথা নিচু করে নিচের চত্বরে পড়তে যাচ্ছে মুসা। মরিয়া হয়ে শূন্যেই শরীরটাকে বাঁকাল সে। বান মাছের মত শরীর মুচড়ে সরাসরি চত্বরে পড়া থেকে বাঁচল কোনমতে। ডাইভিং বোর্ড থেকে ঝাঁপ দিতে দিতেই এই কায়দাটা রপ্ত করেছে। সুইমিং পুলের দিকে সরে চলে এসেছে। নামছে তীব্র গতিতে। এই ডাইভ তাকে অলিম্পিকের স্বর্ণপদক এনে দেবে না, কিন্তু পদকের চেয়ে অনেক অনেক দামি জীবনটা তো বাঁচল।

ঝপাং করে পানিতে পড়ল মুসা। যতটা ডোবার ডুবে ভেসে উঠতে শুরু করল। ভুস করে মাথা তুলল পানির ওপরে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। কাঁপছে এখনও। অল্পের জন্যে বেঁচেছে। পুলের কিনার থেকে ডজনখানেক হাত এগিয়ে এল তাকে টেনে তোলার জন্যে। কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই রইল সে, শকটা হজম করে নেয়ার জন্যে।

আরেক গ্রহে নামল নাকি, ভাবছে মুসা। তার সামনের লোক-গুলোকে মনে হচ্ছে স্টার ওঅরস ছবির এক্সট্রাদের মত। রোবট, সবুজ মানুষ, মূল মাথা ছাড়াও আর দুটো বাড়তি মাথাওয়ালা মানুষ, আর বিচিত্র সব জীব। ওরাও আসলে মানুষ, এই সাজে সেজেছে।

মুসার মনে পড়ল কস্টিউম কনটেস্টের কথা। সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছে অনেকে। তাদের ঠিক মাঝখানেই পড়েছে সে। তীরে দাঁড়ানো অনেকের চোখেই বিরক্তি দেখতে পেল। কারণ আছে। আচমকা পানিতে পড়ে ওদেরকে ভিজিয়ে দিয়েছে সে।

তার পরেও কয়েকজন টেনেটুনে তুলল ওকে। ওদের মাঝে তার বন্ধু কিশোর আর রবিনও রয়েছে।

কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।

ভিড় সরানোর চেষ্টা করছে কিশোর।

দেখলাম ঢুকলে, রবিন বলছে, একটু পরেই দেখি দরজা দিয়ে উড়ে বেরোলে। ব্যাপারটা কি?

উড়তে সাহায্য করা হয়েছিল আমাকে। এমন জোরে ঘুসি মারল…

তোমার মত মানুষও সামলাতে পারল না, কথাটা শেষ করে দিল রবিন। কে মারল? হুফার? না লাল আলখেল্লা পরা লোকটা?

মাথা নাড়ল মুসা। আমার মনে হয় না ভূতটা হুফার। ওর ঘরে কোন কস্টিউম দেখলাম না। আমাকে যে মেরেছে তার গায়ে মোষের জোর। সারা গায়ে পেশী আর পেশী। মুখ দেখতে পারিনি। ফ্রগ মিউট্যান্টের মুখোশ পরা ছিল।

হুঁ, আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। দুজন জুটল এখন। একজন কমিক লিখে হিরো হয়ে গেছে, আরেকজন মুখোশ পরে ভিলেন সেজেছে, চুরি করে ঢুকেছে হুফারের ঘরে। মুখ তুলল। দুজনের মাঝে সম্পর্ক নেই তো?

ওই যে, এসে গেছে, নিচু গলায় বলল রবিন।

হোটেলের ব্লেজার পরা একজন লোক এগিয়ে এলেন। পকেটের মনোগ্রাম দেখে বোঝা গেল, তিনি হোটেলের ম্যানেজার। চেহারাটা রুক্ষ, মোটেও আন্তরিক নয়। পেছনে দৌড়ে আসছেন আরেকজন, লুই মরগান।

কি হয়েছিল? কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন ম্যানেজার।

আমি-ইয়ে…পড়ে…গিয়েছিলাম, আমতা আমতা করে জবাব দিল মুসা। প্লাস্টিকের একটা পুল চেয়ারে বসেছে।

পড়ে গিয়েছিলে? কি করে? কোত্থেকে? মুসার ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালেন ম্যানেজার।

আমি… মরিয়া হয়ে যেন চারপাশে তাকাল, মুসা। তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল কিশোর।

আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়া দরকার, ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল কিশোর। ব্যালকনিতে ওগুলো কি রেলিং লাগিয়েছেন? এত নিচু! পড়ল তো সেজন্যেই। ভাগ্যিস ডাইভ দেয়ার অভ্যেস আছে ওর। নইলে তো… কেঁপে ওঠার অভিনয় করল গোয়েন্দপ্রধান। দরজার দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে এসেছিল আমার বন্ধু। হঠাৎ দিল হাঁচি। তাল সামলাতে না পেরে উল্টে পড়ে গেল। আপনাদের রেলিংগুলো আরেকটু উচু হলে এই অবস্থা হত না। শুকনোয় পড়ে যদি মরত, পারতেন আর ফিরিয়ে দিতে?

কিশোরের এই ভাষণে থতমত খেয়ে গেছেন ম্যানেজার। সামলে নিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই হোটেলের গেস্ট?

এগিয়ে এলেন লুই মরগান। হ্যাঁ। রুম নম্বর তিনশো ষোলো। আমার সঙ্গে উঠেছে।

প্রতিবাদ করল না কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে মরগানের দিকে।

তাই! কনভেনশন চীফের দিকে ঘুরলেন ম্যানেজার। দিনটাই আজ খারাপ যাচ্ছে, কি বলেন মিস্টার মরগান? প্রথমে হলো ডাকাতি, তারপর এই কাণ্ড আশা করি আর কোন গোলমাল দেখতে হবে না আজ। বলে রওনা হয়ে গেলে।

গটমট করে হেঁটে যাচ্ছেন ম্যানেজার। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন মরগান, তদন্ত করতে গিয়েই নিশ্চয় এটা ঘটল?

হ্যাঁ, স্বীকার করল কিশোর। তদন্ত করতে গেলে অনেক সময় মাথার ঠিক থাকে না মুসার, উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে। বোধহয় পানিতে ঝাপ দেয়ার শখ হয়েছিল। যা-ই হোক, সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু ম্যানেজার যদি তিনশো যোলোতে আমাদের খোঁজ নিতে যান…?

তাহলে তোমাদের পেয়ে যাবেন। ঘরটা তোমাদেরকে দিতে চাই। পাশের ঘরটাই আমার, দুশো আট নম্বর। আমি বুঝতে পারছি, এই কেসের তদন্ত করতে হলে হোটেলের একটা ঘর তোমাদের লাগবেই। চাবি বের করে দিলেন মরগান। তোমার বন্ধুর কাপড় বদলানোও দরকার। তবে, ভিজে কাপড় গায়ে লেপটে সগিম্যান সেজে থাকার ইচ্ছে যদি হয়ে থাকে আমার আপত্তি নেই। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বিচারক মন্ডলীকে বলে দেব, এই কস্টিউম যেন শো করার ব্যবস্থা করা হয়।

এমন ভঙ্গিতে বললেন মরগান, সত্যি ভেবে বসল মুসা। তাড়াতাড়ি হাত তুলে নিষেধ করল, না না, ওকাজ করবেন না!

হাসলেন মরগান। এগিয়ে গেলেন বিচারকের মঞ্চের দিকে।

তিন গোয়েন্দা চলল ৩১৬ নম্বর কামরায়।

ঘরে দুটো ডাবল বেড আছে, একটা ড্রেসার আছে, আর আছে একটা তালা দেয়া দরজা, যেটা খুললে ৩১৪ নম্বরে ঢোকা যায়।

তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল মুসা। এখানে রবিন আর কিশোরের আপাতত কিছু করার নেই। আবার নিচে রওনা দিল দুজনে।

সম্মেলনে যাওয়ার টিকেট চেক করছে এখন অন্য একজন। গোলগাল মুখ, যেন একটা কুমড়ো। এলোমেলো চুল। লোকের টিকেট দেখে হাতের উল্টো পিঠে সীল মেরে দিচ্ছে। দরজা পাহারা দিতে বসেছে এখন সেই মেয়েটা, যার চুল দুই রঙে ডাই করা, যে তিন গোয়েন্দার হাতে সীল মেরেছিল। কিশোরের দিকে একবার চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। কিন্তু রবিনের দিকে তাকিয়েই রইল। হাসল। বলল, হাই, আমার নাম ডোরা।

রবিন তার মধুরতম একটা হাসি উপহার দিল মেয়েটাকে। ডোরা! চমৎকার নাম! আমার খুব পছন্দ। আচ্ছা, ভোরা, ওই স্মােক বম্ব ফাটার পর কালো আলখেল্লা পরা কোন মানুষকে কি এখান দিয়ে যেতে দেখেছ?

রবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। মাথা নাড়ল।

এডগার ডুফারের বর্ণনা দিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করল ডোরাকে, ওরকম কাউকে যেতে দেখেছে কি-না।

ভ্রূকুটি করল মেয়েটা। ওরকম মোটকা কত লোক এখানে কমিক কিনতে আসে জানো? হাজার হাজার। ওদের নশো নব্বই জনই যায় এখান দিয়ে। সব দেখতে এক রকম। কতজনের কথা মনে রাখব?

এই লোকটা মোটামুটি পরিচিত, রবিন বলল। কমিকের লেখা লেখে। দাড়ি আছে…

ডুফারের কথা বলছ না তো? তোমার বন্ধু তাহলে ওকথা বললেই পারত, নামটা বললেই বুঝতে পারতাম। হ্যাঁ, দেখেছি। এই তো মিনিট দুই আগে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে গেল।

রেস্টুেরেন্টে এসে লোকটাকে পেল গোয়েন্দারা।

ওদেরকে লাঞ্চের দাওয়াত দিল ডুফার। চলো, বাইরের টেবিলে গিয়ে বসি। তাহলে খেতে খেতে সম্মেলন দেখতে পারব।

সোনালি চুলওয়ালা মেয়েটাকে আরেকবার দেখার আশায় রাজি হয়ে গেল কিশোর।

সুইমিং পুলের কিনারে একটা টেবিলে এসে বসল ওরা। ছাতার নিচে। সম্মেলন চলছে। একজন করে প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করা হচ্ছে, আর সেই ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটছে সুইমিং পুলের কিনার দিয়ে, চারপাশে এক চক্কর, দর্শক আর বিচারক মন্ডলীকে দেখাচ্ছে তার পোশাক।

দুটো করে চীজবার্গারের অর্ডার দিল ভুফার। একটা করে তুলে নিল কিশোর আর রবিন।

কামড় বসাল কিশোর। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, কমিকের ব্যাপারে আমাদের কিছু তথ্য দরকার। আপনি কি বলতে পারবেন?

ভুরু কুঁচকে গেল ডুফারের। দাড়িও যেন উঠে এল সামান্য ওপরে। বলো, কি জানতে চাও?

ওরা কথা বলছে, এই সময় পুলের কিনারে এসে দাঁড়াল আরেকজন প্রতিযোগী। অদ্ভুত এক পোশাক পরেছে। যেন বিশাল একটা টোস্টারের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে শরীরটা। হাত, পা আর মুখ বেরিয়ে আছে শুধু।

কিশোরের প্রশ্নের জবাবে ডুফার বলল, আমি কমিক সংগ্রহ করি, তার কারণ, করতে আমার ভাল লাগে। পাতা উল্টাই ওগুলোর। কোন ছবি ভাল লেগে গেলে, সেগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গায় লিখি নিজের মত করে। লিখতে আমার ভাল লাগে। কমিক অনেকেই পছন্দ করে, তবে শুধু পড়তেই। আঁকাআঁকি কিংবা লেখার ঝোঁক নেই তাদের।

সবার নেই, রবিন বলল। একথা বলা যাবে না।

তা ঠিক। আমার আছে। হুফারেরও আছে। ও অবশ্য লিখতে পারে না, হাতের লেখা ভাল নয় তো। তবে তার ছবিগুলো দেখার মত, কি বলো?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চোখ অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে সেই মেয়েটার দিকে। সোনালি চুল।

বলে চলেছে ডুফার, হুফারের কাজগুলো একেকটা ক্ল্যাসিক। দশ বছর আগে, মাত্র আঠারো বছর বয়সেই দুর্দান্ত এক হিরো তৈরি করে বসেছিল সে। গল্প তৈরি করল, ছবি আঁকল, ছাপতে দিল এক কমিক ম্যাগাজিনে। সাংঘাতিক সাড়া জাগাল। রাতারাতি অংসখ্য ভক্ত জুটে গেল তার। কমিকের নায়কের নাম রেখেছিল সে, গ্রে ফ্যান্টম।

হাসল ডুফার। ফ্যানজাইন ম্যাগাজিনে ছাপার ব্যবস্থা হয়েছিল তার কমিক। রঙের ব্যাপারে একটা বাধা ছিল। চার রঙা ছাপার উপায় ছিল না, সাদা-কালোতে ছাপা হত ম্যাগাজিনটা। তৃতীয় আর একটামাত্র রঙে ছাপা যেত, তাহল ধূসর। আর তাই বাধ্য হয়ে নায়কের নাম দিতে হলো হুফারকে, গ্রে ফ্যান্টম বা ধূসর ভূত। ওই রঙেতেই ছাপল তার কমিক। যা-ই হোক, খুবই সাড়া জাগাল গ্রে ফ্যান্টম। হিরোয়িক কমিকস নামে একটা কোম্পানি কাজের অফার দিল হুফারকে, এবং তখন তার হিরোর নাম হয়ে গেল…

ক্রিমসন ফ্যান্টম! প্রায় চিৎকার করে বলল রবিন। টকটকে লাল ওই হিরোর গল্প আমি পড়েছি!

হুফারের এক সাংঘাতিক সৃষ্টি। শুধু যে কাহিনীই ভাল, তা-ই না, আঁকতেও পারে বটে লোকটা। আর সব কমিকের চেয়ে একেবারে আলাদা, গতানুগতিকার বেড়া ডিঙাল ক্রিমসন ফ্যান্টম। তারপরে রয়েছে একটা বিশেষ ব্যাপার…

মাথা ঝাঁকাল রবিন। ঠিকই বলেছেন। গোপন গোপন ভাব। একটা রহস্য। ক্রিমসন ফ্যান্টম যে আসলে কে, তা-ই জানে না লোকে। তার পরিচয় গোপন থাকে। ওভাবেই কাজ করে যায় সে। তিন-চার রূপ, একেক বার একেক রূপে উদয় হয়। কমিকের তিন-চারটে চরিত্রের যে কোন একটা হতে পারে সে, কোনটা আসল ফ্যান্টম, বোঝা মুশকিল। ওই ধাঁধার জবাব খুঁজতে খুঁজতে তো মাথাই খারাপ হয়ে যেত আমার।

এ যাবৎ হাতে গোনা যে কটা ভাল কমিক বেরিয়েছে, তার মধ্যে একটা ছিল ওই ক্রিমসন ফ্যান্টম, ভোঁতা গলায় বলল হুফার। অথচ ধ্বংস করে দেয়া হলো ওটাকে।

ধ্বংস? এতক্ষণে সতর্ক হলো কিশোর, কিভাবে?

নীল বোরাম নামে একজন লোকের সঙ্গে কাজ করত হুফার। লোকটা ছিল তার কমিকের এডিটর। বোরামকে বিশ্বাস করেছিল সে। কপিরাইটের ব্যাপারে কি জানি একটা ঘাপলা বাধিয়ে ক্রিমসন ফ্যান্টমের কপিরাইট নিজের নামে করিয়ে নিল বোরাম। টেবিলে চাপড় মারল ডুফার। মহা শয়তান। নিয়ে নেয়ার পর সিরিজটাকে আরও জনপ্রিয় করার জন্যে নানা রকম কায়দা করতে লাগল সে। একটা বিশেষ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করল। ক্রিমসন ফ্যান্টম আসলে কোন চরিত্রটা, বলতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে।

রবিন বলল, ওই প্রতিযোগিতার কথা জানি আমি।

তা তো জানবেই। অনেক ছেলেই জানে ক্রিমসন ফ্যান্টম প্রতিযোগিতার কথা। তারপর আরও দুটো নতুন ক্রিমসন ফ্যান্টম বই বের করল বোরাম। একটার নাম দিল সিক্রেটস অভ দি ক্রিমসন ফ্যান্টম, আরেকটা দ্য ব্যাটেলিং ক্রিমসন ফ্যান্টম। নতুন লেখক আর আর্টিস্ট নিয়োগ করল একাজে। ওরা খারাপ করেনি, তবে হুফারের তুলনায় একেবারেই সাধারণ।

রাগে ভুরু কোঁচকাল ডুফার। আসলে চরিত্রটার যা যা বিশেষত্ব ছিল, সব নষ্ট করল বোরাম, খুন করল চরিত্রটাকে। ক্রিমসন ফ্যান্টম এখনও আছে, ভালই বিক্রি হয়, তবে এটা একেবারেই অন্য কমিক। আসলটার ধারেকাছেও লাগে না। অবশ্য বিক্রি হয় প্রচুর। হিরোয়িক কমিকসকে তুলেছে ওটাই, বোরামকেও বড়লোক বানিয়েছে।

এডগার ডুফার কিছুই করতে পারল না? প্রশ্ন করল কিশোর। এই সময় ওদের টেবিলের পাশ দিয়ে গেল কস্টিউম পরা আরেকজন প্রতিযোগী। এই লোকটার পোশাক বিচিত্র। টমেটোর চারপাশে সাজিয়ে রাখা অনেকগুলা লেটুসপাতা যেন বিশাল আকার নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

চেষ্টা অনেকই করেছে, জানাল ডুফার। ঠেকানর চেষ্টা করেছে বোরামকে। পারেনি। আর পারবেই বা কি করে? চালাকি করে ততদিনে ক্রিমসন ফ্যান্টমের কপিরাইট নিজের নামে করে ফেলেছে বোরাম। ডুফার ভাবল, সে কাজ না করলেই কমিকটা বন্ধ হয়ে যাবে, আর কেউ আঁকতে পারবে না। তাই হিরোয়িক কমিকস থেকে বেরিয়ে চলে আসে সে। কিন্তু বোরাম ধুরন্ধর লোক। অন্য লোক দিয়ে কমিক আঁকাতে শুরু করল। কিছুই করতে না পেরে নিজের সৃষ্টির ওপরই ভীষণ রেগে গেল ডুফার। যেখানেই পায় নষ্ট করে ফেলে। তোমাদের সামনেই তো নষ্ট করল। দেখলেই ওরকম করে পোড়ায়।

তার মানে, কিশোর বলল, আপনি বলতে চাইছেন কোম্পানিটা ক্রিমসন ফ্যান্টমের ভক্তদেরকে ঠকাচ্ছে?

ঠকাচ্ছে আসলে অনেকেই, এক বোরাম নয়, হাত ওল্টাল ডুফার। ঘুরে তাকাল পাশের টেবিলে বসা কালো-চুল এক তরুণের দিকে। তাকে বলল, অ্যাই, পিটার, তোমার কাছে ওভারস্ট্রীটের কপি আছে?

বার্গার খাচ্ছিল লোকটা। হাতের খাবার প্লেটে নামিয়ে রেখে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে বের করে আনল একটা দোমড়ানো মোটা বই। এই নাও, বলে ছুড়ে দিল ডুফারের দিকে।

লুফে নিল ডুফার। টেবিলে বিছিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল। এই যে, পাওয়া গেছে। সেরিবাস। সাদা-কালো কমিক, প্রথম প্রকাশিত হয় উনিশশো সাতাত্তর সালে। আসল একেকটা কপি বিক্রি হবে এখন পাঁচশো ডলারে। এই যে, দেখ, নকলও রয়েছে। জালিয়াতি। যারা চেনে তারা ঠিকই বুঝতে পারবে এটা নকল। নকলগুলো বিক্রি হয় বিশ-তিরিশ ডলার দামে।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে গিয়ে বইটা ফেরত দিয়ে এল ডুফার। ছেলেদেরকে বলল, কমিক ভক্তদের ব্যাপারটা বুঝি না। অনেক সময় যারা ঠকায় তাদেরও লাভবান করে দেয়। জাল বলেই কিনে নেয় অনেকে অনেক দাম দিয়ে, সংগ্রহে রাখার জন্যে।

আবার ভ্রূকুটি করল ডুফার। ঠকিয়েও পয়সা কামায়। লোকে আসল ভেবে বেশি দাম দিয়ে কেনে। লাভটা যায় প্রকাশকের পকেটে। সেগুলো বিক্রি করারও মানুষ আছে। আসল বলে গছিয়ে দেয় ক্রেতাকে।

মুখ তুলল কিশোর, যেমন? কার মত বিক্রেতা?

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল ডুফার। লোকে তো প্রায়ই অভিযোগ করে জেমস ডিকসনের নামে। ওর কাছে কিছু কিনতে গেলে সাবধান। হাতে ঘড়ি থাকলে, হাত মেলানর পর ভালভাবে দেখে নেবে বদলে দিল কি-না। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল সে।

প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে। বিজেতার নাম ঘোষণা করার আগে বাঁশি বাজল। ঘোষণা করলেন বিচারক। প্রথম হয়েছে রোমশ পোশাক পরা একজন। ও সেজেছিল স্লোর্জ দ্য প্ল্যানেট ইটার।

পাশের টেবিলে বিরক্তি প্রকাশ করল পিটার। এটা একটা কাজ হলো? আমি তো ভেবেছিলাম ওই সোনালি চুল মেয়েটাই জিতবে!

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিশোরও একই কথা ভাবছে, তবে সেটা প্রকাশ করল না।

উঠে দাঁড়াল ডুফার। এবার যেতে হয়। রকের জাহাজ ভাঙার তোড়জোড় করছে মাকৰ্মান। দ্রুত গিয়ে খাবারের বিল দেয়ার জন্যে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল সে।

হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা। হেসে উঠল পিটার। বুঝলে না? রক অ্যাসটারয়েড ছবির কথা বলল ডুফার। সিনেমার খুব ভক্ত, সাইন্স ফিকশন। অনেক কিছুই মনে রাখে। ভাল ভাল ডায়লগ মুখস্থ করে রাখে, জায়গা মত ঝাড়ে। হাহ হা।

উঠে দাঁড়াল রবিন। বিড়বিড় করে বলল, কি সব মানুষ! সবাই-ই পাগল নাকি এখানকার!

বেরোনোর জন্যে রওনা হল দুই গোয়েন্দা। চোখের কোণ দিয়ে কিশোর দেখতে পেল সোনালি ঝিলিক।

ঘুরে তাকাল সে। রেস্টুরেন্টে ঢোকার মুখের কাছে একটা টেবিলে বসেছে সোনালি চুল মেয়েটা। সঙ্গে আরেকজন বয়স্ক মহিলা, বোধহয় মেয়েটার মা। তৃতীয় আরও একজন রয়েছেন, যাকে চিনতে পারল কিশোর। সেই টাকমাথা লোকটা, ম্যাড ডিকসনের কাছ থেকে যে ফ্যান ফানের কপিটা কিনতে চেয়েছিলেন।

দরজার দিকে এগোনোর সময় কথা কানে এল কিশোরের। টাকমাথা লোকটার সঙ্গে কথা বলার সময় মেয়ের কাঁধে আলত চাপড় দিল বয়স্ক মহিলা। বলল, ফটোকভারের জন্যে আমাদের মিরার মত মেয়ে আর পাবেন না, মিস্টার বোরাম। ও আপনার পারফেক্ট মডেল।

ও, এ-ই তাহলে নীল বোরাম, ভাবল কিশোর, আইজাক হুফারের প্রথম দিককার কাগজগুলোর ব্যাপারে এত আগ্রহী কেন লোকটা?

হঠাৎ রাগী একটা জোরাল কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকাল সে। প্রবেশ পথের একটু দূরে চোখমুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হুফার। চিকার করে বলল, হচ্ছেটা কি এখানে, মরগান! আমার ঘরে কে জানি ঢুকে সব তছনছ করে দিয়েছে!

<

Super User