লোকটাকে ধরার জন্যে ছুটলো দুজনে। কিন্তু দেখে ফেললো লোকটা। লাফ দিয়ে বাক্স থেকে নেমে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ওদের দিকে। তারপর ঘুরে দৌড় দিলো উল্টো দিকে।
পাথরটাকে এড়ানোর জন্যে ঝট করে মাথা সরিয়ে ফেললো, কিশোর আর রবিন। চিৎকার করে ডাকলো কিশোর, শুনুন! দাঁড়ান!
কিন্তু লোকটা কি আর শোনে। থামলো না। টর্চ জ্বেলে তার পিছু পিছু দৌড় দিলো দুই গোয়েন্দা। লোকটা বেঁটে, কালো চুল। দৌড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যায় এলাকাটা খুব ভালোমতো চেনে, কোনো রকম দ্বিধা নেই। পেছনের একটা পথ দিয়ে ছুটে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো কিশোর আর রবিন। একজায়গায় মাটিতে জুতোর ছাপ ছাড়া লোকটার আর কোনো চিহ্নই দেখতে পেলো না।
পুলিশকে জানানো দরকার, কিশোর বললো। আমি থাকি। পাহারা দিই। তুমি গিয়ে পুলিশকে ফোন করো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির হলো একটা পেট্রোল কার। লোকটা যেখানে ছিলো, সেই জায়গাটা পরীক্ষা করতে লাগলো। জানালার চৌকাঠে আঙুলের ছাপ ফেলে গেছে লোকটা। সেগুলো তোলার ব্যবস্থা করলো পুলিশের বিশেষজ্ঞ। মাটি থেকে জুতোর ছাপের মডেল তৈরি করলো। আর যে বাক্সের ওপর দাঁড়িয়েছিলো লোকটা, সেটাও তুলে নিলো গাড়িতে।
ছেলেদেরকে ধন্যবাদ দিলেন পেট্রোল কারের অফিসার-ইন-চার্জ। আবার কোনো চোরছ্যাঁচোড়কে চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে জানানোর অনুরোধ করে চলে গেলেন।
পুলিশ চলে গেলে আবার অ্যাজটেক যোদ্ধার সূত্র খুঁজতে শুরু করলো দুই গোয়েন্দা। টর্চের আলো ফেলে ঘুরে ঘুরে দেখলো। কিছুই চোখে পড়ছে না। তারপর হঠাৎ বলে উঠলো কিশোর, মনে হয় পেলাম!
দৌড়ে এলো রবিন। কিশোরের আলোটার পাশে আলো ফেললো। একটা বড় পাতের কান্ডে খোদাই করে আঁকা হয়েছে একজন ইনডিয়ান মানুষের প্রতিকৃতি, মাথা থেকে কাধের নিচ পর্যন্ত।
কি বোঝাতে চেয়েছে, কিশোর বললো। বুঝলাম না। তবে অ্যাজটেক যোদ্ধার ছবি হতে পারে।
গাছের পুরো কাণ্ডটাতেই চোখ বোলালো ওরা, আরও সূত্রের আশায়। আরেকটা ছবি কিংবা ফাপা জায়গা। নেই কিছু।
গাছের কাছে মাটিতে কিছু পুঁতে রাখেনি তো? রবিনের প্রশ্ন।
আবার খোঁজা শুরু হলো। গাছটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করলো দুজনে। মাটির দিকে চোখ। অনেকখানি জায়গা দেখলো। মাটি খোঁড়ার চিহ্ন চোখে পড়লো না। সমান মাটি। সব জায়গায় সবুজ ঘাস, একরকম হয়ে জন্মেছে। মাটির রঙেরও কোনো পরিবর্তন নেই।
খোঁড়া হলেও, কিশোর বললো। কিছু দিনের মধ্যে অন্তত হয়নি। অনেক আগে। মাটি না খুঁড়লে কিছু বোঝাও যাবে না আছে কিনা। আজ রাতে হবে না সেটা। তাছাড়া মিস্টার ফাউলারের অনুমতি নিতে হবে।
চলো, গিয়ে অনুমতি নিয়ে নিই।
আজকে তো আর হবে না। কাল সকালে দেখা যাক।
রাত তো বেশি হয়নি। এখন কোথায় যেতে চাও? বাড়িতে?
না, চলো, একবার মিস্টার সাইমনের ওখান থেকে ঘুরে যাই। তিনি কিছু করতে পারলেন কিনা জানা দরকার।
আরেকটা জরুরী কেসে ব্যস্ত মিস্টার সাইমন। অ্যাজটেক যোদ্ধা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই পাচ্ছেন না। দুই গোয়েন্দাকে দেখে খুশি হলেন। রেডফোর্ড এস্টেটে যা যা ঘটেছে তাকে জানালো কিশোর আর রবিন।
অন্ত্রের কথা শুনে সাইমন বললেন, ইনটারেসটিং! লুকানো থাকতেও পারে। নিককে ভিজ্ঞেস করবো। গাছের গোড়ায় লুকানো থাকলে অবাক হবো না।
ফাউলারকে ফোন করলেন তিনি। মাটি খুঁড়তে দিতে আপত্তি নেই উকিল সাহেবের। তাকেও বেশ আগ্রহী মনে হলো। জানিয়ে দিলেন, আগামী দিন সকাল নটায় রেডফোর্ড এস্টেটে যাবেন তিনি। ইচ্ছে করলে তখন গোয়েন্দারাও যেতে পারে।
অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করলেন সাইমন। জবাবে ফাউলার বললেন, বছরখানেক আগেই ওই শখ চলে গিয়েছিলো মিস্টার রেডফোর্ডের। তালিকাটা আমি দেখেছি। তাতে অ্যাজটেক যোদ্ধার নাম নেই।
পরদিন সকালে সময়মতো এসে রেডফোর্ড এস্টেটে হাজির হলো কিশোর, রবিন আর মিস্টার সাইমন। মুসা আসতে পারেনি। গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত। দুটো গাড়ি সাপ্লাই দেবে বলে দুজন খদ্দেরের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা নিয়েছে, ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে না পারলে ইজ্জত যাবে। সে-কারণে প্রচন্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আসতে পারেনি।
গ্যারেজ থেকে কোদাল আর বেলচা বের করে আনলেন ফাউলার। চারজনে মিলে মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন। গাছের চারপাশে বড় বড় গর্ত খোড়া হয়ে গেল। কিছুই পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে সেগুলো আবার মাটি দিয়ে ভরে দিতে লাগলো দুই গোয়েন্দা। হোস পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে, মাটি ডলে সমান করে আগের মতো করে ঘাসের চাপড়াগুলো আবার বসিয়ে দিতে লাগলো। ভীষণ পরিশ্রমের কাজ।
সাইমন বললেন, নিক, যদি সময় দিতে পারো, আমি একবার বাড়িটাতে ঢুকতে চাই। মিস্টার রেডফোর্ডের কাছে নিশ্চয় অনেক চিঠিপত্র আসতো। সেগুলো একবার দেখতে চাই, অ্যাজটেক যোদ্ধার ব্যাপারে কিছু পাওয়া যায় কিনা।
রাজি হলেন উকিল। তবে তেমন কিছু পাওয়া যাবে আশা করতে পারলেন না। রেডফোর্ডের কাগজপত্র নাকি সবই পড়া হয়ে গেছে তার। তবু সাইমন যখন দেখতে চাইছেন.‥তালা খুলে দিলেন তিনি।
কিশোর বললো, আপনারা কাগজ দেখুন। আমি আর রবিন বাকি স্লাইডগুলো দেখে ফেলি।
ভালো কথা বলেছো, উকিল বললেন। দেখ। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, পুলিশকে ফোন করেছিলাম সকালে। আঙুলের ছাপের কথা জিজ্ঞেস করলাম। ওদের রেকর্ডে নেই ওই ছাপ। তারমানে অতীতের কোনো অপরাধের ইতিহাস নেই লোকটার। পুলিশের যে রকম ধারণা ছিলো।
বারোজের কি খবর? জানতে চাইলো কিশোর। হুঁশ ফিরেছে?
না। তবে অবস্থা উন্নতির দিকে। ডাক্তারদের ধারণা তাড়াতাড়িই ফিরবে।
কাগজপত্র ঘাটায় মন দিলেন সাইমন। তার সঙ্গে রয়েছেন ফাউলার। কিশোর ও রবিন প্রোজেক্টর আর পর্দা সাজিয়ে বসলো। মেকসিকোতে তোলা ছবির আরেকটা বাক্স পাওয়া গেল। মেশিনে স্লাইড ঢুকিয়ে বোতাম টিপে চালু করে দিলো রবিন। কয়েকটা ছবি পেরোতেই চেঁচিয়ে উঠলো, আরেকটা সূত্র!
একটা মেকসিকান পিরামিডের সামনে তোলা হয়েছে ছবিটা। সেই রহস্যময় লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে অ্যাজটেক যোদ্ধার পোশাক।
স্টিল করে রাখো, কিশোর বললো। আমি মিস্টার সাইমন আর ফাউলারকে ডেকে আনি।
দৌড়ে এসে লাইব্রেরিতে ঢুকলো সে। গভীর মনোেযোগে চিঠি পড়ছেন সাইমন। পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন উকিল সাহেব। দুজনকে খবরটা জানালো কিশোর।
হুমম! ছবিটা দেখে মাথা দোলালেন খোঁড়া গোয়েন্দা (এখন আর খোঁড়া নন তিনি, পা ভালো হয়ে গেছে), ভালো সূত্র বের করেছে। হয়তো ওই লোকটাই মিস্টার রেডফোর্ডের অ্যাজটেক যোদ্ধা।
এবং সেই সম্পত্তির সত্যিকার মালিক, যোগ করলেন ফাউলার। যেটার কথা লিখে গেছেন তিনি।
লোকটা কে? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো কিশোর। পিন্টো আলভারো, না অন্য কেউ?
এসব ছবি একটা কথাই প্রমাণ করে, রবিন বললো। আমরা যাকে খুঁজছি, তার আসল ঠিকানা রয়েছে মেকসিকোতে।
হাসলেন সাইমন। এতো শিওর হয়ো না। লোকটা মেকসিকোতেই আছে, তা না-ও হতে পারে। অন্য কোনো দেশেও থাকতে পারে। মেকসিকান হলেই যে মেকাকোতে থাকতে হবে তার কোনো মানে নেই।
আরেকটা কথা বললেন তিনি, লোকটা যদি অ্যাজটেক যোদ্ধা হয়ও, কি জিনিস খুঁজে বের করে তাকে ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে, ছবি দেখে তা জানার কোনোই উপায় নেই।
একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, উকিল বললেন মাথা চুলকাতে চুলকাতে। লোকটার নাম কেন উইলে উল্লেখ করলেন না, মিস্টার রেডফোর্ড? দুটো রহস্য রেখে গেছেন তিনি। এক, অ্যাজটেক যোদ্ধাকে খুঁজে বের করা। দুই, যোদ্ধার সম্পত্তি খুঁজে বের করা।
রহস্য আরও একটা আছে, সাইমন বললেন। কেসের সমাধান না হওয়াতক কেন সম্পত্তির উত্তরাধিকারীদেরকে তাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত রাখতে চেয়েছেন?
এর একটাই জবাব হতে পারে, কিশোর বললো। কোনো বিশেষ কারণে ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে চেয়েছেন তিনি। আর সেই কারণটা হলো, অ্যাজটেক যোদ্ধা আর তার সম্পত্তি রক্ষা করা। উত্তরাধিকারীরা পাওনা দখল করে ফেললে কোনো ভাবে যোদ্ধা আর তার সম্পত্তির ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।
যুক্তি আছে তোমার কথায়, একমত হলেন উকিল সাহেব। কিন্তু সেই সম্পত্তিটা কি হতে পারে?
নিশ্চয় দামী কোনো জিনিস, রবিন অনুমান করলো। জিনিসটার নাম বললে হয়তো চোর-ডাকাতেরা ছুটে আসবে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে। সেই ভয়েই গোপন রেখেছেন।
হুঁ, মিস্টার সাইমনেরও তা-ই মনে হলো। আরও সাবধানে কাজ করতে হবে আমাদের। আরও গোপনে।
সূত্র খোঁজা চললো। স্লাইড দেখতে লাগলো দুই গোয়েন্দা। সাইমন আর ফাউলার আবার ফিরে গেছেন লাইব্রেরিতে। একের পর এক স্লাইড ঢোকাচ্ছে আর বের করছে রবিন। গভীর মনোযোগে পর্দার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আচমকা হাত চেপে ধরলো রবিনের। স্টিল করতে বললো। আরেকটা ছবি আগ্রহ জাগিয়েছে তার। বিশাল এক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে রহস্যময় সেই লোক।
বাপরে বাপ! বলে উঠলো রবিন। কত্তোবড় গাছ! কয়েক মিনিট পরে আরেকটা ছবি পাওয়া গেল।
আবার সেই লোক! প্রায় ফিসফিস করে বললো কিশোর, যেন জোরে বললে ছুটে পালিয়ে যাবে মানুষটা।
লাইব্রেরি থেকে ফিরে এলেন সাইমন আর ফাউলার। ওদেরকে ছবিদুটো দেখানো হলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে চোয়াল ডললেন গোয়েন্দা। এখন আমার মনে হচ্ছে, লোকটাকে মেকসিকোতেই পাওয়া যাবে।
তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর রবিন। কিন্তু তিনি ওদের দিকে তাকিয়ে নেই। পর্দার দিকে চেয়ে কিছু ভাবছেন। চোখ ফেরালেন হঠাৎ। শোনো, ছেলেদের বললেন তিনি। আমার এখন যাওয়ার উপায় নেই। একটা সিরিয়াস কেসের তদন্ত করছি। উইলে তোমাদেরকেও দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। যাবে নাকি মেকসিকোতে? আলভারোকে খুঁজতে?
হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়লো রবিনের। আমি এক্ষুণি যেতে রাজি।
তোমার গানের অফিসের চাকরি?
ছুটি নিয়েছি কয়েকদিনের। বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্যেই। তবে কোথায় যাবো, ঠিক করতে পারছিলাম না। পেয়ে গেলাম।
গুড। কিশোর, তুমি?
প্লেনের টিকেট কেটে শুধু হাতে দিন। তারপর আর আমার ছায়াও দেখতে পাবেন না এ-শহরে, হেসে বললো কিশোর।
সাইমনও হাসলেন। তা দিতে আপত্তি নেই। খরচ তো দেবে রেডফোর্ড এস্টেট। তবে তোমাদের বয়েসী, অর্থাৎ, টীনএজারদের মেকসিকোতে যাওয়ায় কিছু সরকারী অসুবিধে আছে। বয়স্ক কারো সঙ্গে ছাড়া এই বয়েসীদের ঢুকতে দেয়া হয় সাধারণত, খুব কড়াকড়ি। দুটো বিশেষ পাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি আমি।
সাইমনের কাঁধে হাত রাখলেন উকিল। ভালোই হবে তাহলে। ওরা গিয়ে ওখানে খুঁজুক, আমরা এখানে খুঁজবো। দেখি, কোন্ দল সেই রহস্যময় সম্পত্তি খুঁজে বের করতে পারে?
দেখা যাবে! কিশোরের কণ্ঠে চ্যালেঞ্জের সুর। সাইমনের দিকে তাকিয়ে বললো, পাস দুটো হলে চলবে না, স্যার, তিনটে।
ওহ্ হো, ভুলেই গিয়েছিলাম। মুসা বাদ পড়ে গেছে। ঠিক আছে, তিনটেরই ব্যবস্থা হবে।
থ্যাংক ইউ, স্যার।
যে স্লাইডগুলোতে রহস্যময় লোকটার ছবি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে গিয়ে প্রিন্ট করার অনুমতি চাইলো কিশোর। রাজি হলেন ফাউলার।
ইয়ার্ডে ফিরে এলো কিশোর আর রবিন। লাঞ্চের পর হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো। স্লাইডগুলো নিয়ে ডার্করুমে ঢুকলো রবিন। কিশোর ফোন করতে বসলো মুসাকে।
কে, কিশোর? চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। খুশি খুশি লাগছে তাকে। পেয়ে গেছি! সব পার্টস পেয়ে গেছি!
মেকসিকোতে বেড়াতে যাবে?
কি বললে!
শুনতে চাইলে পার্টসের ভাবনা বাদ দিয়ে এক্ষুণি চলে এসো। আমি আর রবিন আছি।
জাহান্নামে যাক গাড়ি! আমি আসছি!
মিনিট পনেরো পরেই শোনা গেল মুসার গাড়ির বিকট ভটভট। ইয়ার্ডে ঢুকলো। মিস ফায়ার করলো কয়েকবার, যেন পিস্তলের গুলিবর্ষণ করলো। থেমে গেল এঞ্জিন।
<